০৫. হীরার বাদশাহী

ইরাক এবং তার আশেপাশের এলাকায় কোরোশ কাবির অথবা সায়রাম যুল কারনাইনের (খৃষ্টপূর্ব ৫৭৫ থেকে ৫২৯ সাল পর্যন্ত) সময় থেকেই পারস্যদের রাজত্ব চলে আসছিলো। ফরাশীদের মোকাবেলা করার মতো শক্তি কারো ছিলো না। খৃষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে সিকান্দার মাকদুনি প্রথম পরাজিত করে পারস্য শক্তি নস্যাৎ করেন। এর ফলে পারস্য সাম্রাজ্য খন্ড খন্ড হয়ে যায়। এ বিশৃঙ্খল অব্স্থা ২৩০ সাল পর্যন্ত অব্যহত থাকে। এ সময়ে কাহতানি গোত্রসমূহ দেশত্যাগ করে। ইরাকের এক বিস্তীর্ণ সীমান্ত থেকে যেসব আদনীনী দেশত্যাগ করে গিয়েছিলো, তারা এ কারিলায় ফিরে এসে প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে ফোরাত নদীর উপকূল ভাগের একাংশে বসতি স্থাপন করে।
এদিকে ২২৬ সালে আর্দেশির সাসানি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর ধীরে ধীরে পারস্য শক্তি পুনরায় সংহত হতে শুরু করে। আর্দেশির পারস্যদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং তার দেশের সীমান্তে বসবাসকারী আরবদের প্রতিহত করেন। এর ফলে কোযায়া গোত্র সিরিয়ায় পথে রওয়ানা হয়। পক্ষান্তরে হীরা এবং আনবারের আবর অধিবাসীরা বশ্যতা স্বীকারে সম্মতি জ্ঞাপন করে।
আর্দিশিরের শাসনামলে হীরা, বাদিয়াতুল ইরাক এবং উপদ্বীপবাসীর ওপর রবিয়ী গোত্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। মোদারী গোত্রসমূহের ওপর সরাসরি শাসনাকার্য পরিচলা করা এবং সীমান্তে তাদেরকে লুটতরাজ থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। বরং ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে এমন কোন আবর নেতাকে শাসক হিসাবে নিযুক্ত করাই হবে বুদ্ধিমত্তার কাজ। এর ফলে একটা লাভ এই হবে যে, প্রয়োজনের সময়রোমকদের বিরুদ্ধে এসব আরবের সাহায্য নেয়া যাবে এবং সিরিয়ার রোমকপন্থী আরব শাসকদের মোকাবেলায় ইরাকের এসব আরব শাসনকর্তাকে দাঁড় করানো যাবে। হীরার বাদশাহদের অধীনে পারস্য সৈন্যদের একটি ইউনিট আবিসিনিয়ায় থাকতো। এদের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে আবর বিদ্রোহীদের দমন করা হতো।
২৬৮ সালে জাযিমা মৃত্যু বরণ এবং আমর ইবনে আদী ইবনে নসর লাখামী হাদরামি তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন লাখাম গোত্রের প্রথম শাসকর্তা। শাবুল কোবাজ ইবনে ফিরোজের যুগ পর্যন্ত একাধারে হীরার ওপর লাখমিদের শাসন চলতে থাকে। কোবাজের সমসময়িককালে মোজদকের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন সংস্কারবাদের প্রবক্তা। কোবাজ এবং তার বহু সংখ্যক অনুসারী বাদশাহ মোনযার ইবনে মাউসসামাকে বার্তা পাঠালেন যে, তুমিও এ ধর্ম গ্রহণ করো। মোনযার ছিলো বড়ই দূরদৃষ্টি মানুষ, তিনি অস্বীকার করে বসলেন। ফলে কোবাজ তাকে বরখাস্ত করে তার স্থলে মোজদাকি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা হারেস ইবনে আমর ইবনে হাযার ফিন্দীর হাতে হীরার শাসনভার ন্যস্ত করেন।
কোবাজের পরে পারস্যের শাসনক্ষমতা কেসরা নওশেরও’য়ার হাতে আসে। তিনি এ ধর্মকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। তিনি মোজদাক এবং তার বহু সংখ্যক সমর্থককে হত্যা করেন। মোনযারকে পুনরায় হীরার শাসনভার ন্যস্ত করেন এবং হারেস ইবনে আমরকে ডেকে পাঠান। কিন্তু হারেস বনু কেনাযের এলাকায় পালিয়ে গেলে তিনি সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।
মোনযার ইবনে মোউসসামার পরে নো’মান ইবনে মোনযারের কাল পর্যন্ত হীরার শাসনক্ষমতা তার বংশধরদের মধ্যে আবির্তিত হয়। এরপর যায়েদ আদী এবাদী কিসরার কাছর নো’মান ইবনে মো্নযারের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে। কেসরা নওশেরওয়া এতে ক্ষেপে যান এবং নো’মানকে ডেকে পাঠান। নো’মান প্রথমই হাযির না হয়ে চুপিসারে বনু শায়বানের সর্দার হানি ইবনে মাসুদের কাছে যান এবং পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ সবকিছু তার কাছে রেখে কেসরার দরবারে হাযির হন। কিসরা তাকে বন্দী করেন এবং ঐ অব্স্থায়ই তার মৃত্যৃ হয়।
এদিকে কেসরা নো’মানকে বন্দী করার পর তার স্থলে ইয়াস ইবনে কোবয়সা তাঈকে হীরার শাসকর্তা নিয়োগ করেন এবং হানি ইবনে মাসুদের নো’মানের জামানত চাওয়ার জন্যে ইয়াসকে নির্দেশ দেন। আত্নমর্যাদাসম্পন্ন হানি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইয়াস কেসারার সৈন্যদের নিয়ে এবং মুরযবানদের দল নিয়ে রওয়ানা হন। জিকার ময়দানে তুমুল যুদ্ধে বনু শায়বান জয়লাভ করে এবং ফরাসীরা লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়। এই প্রথম আরবরা অনারবদের ওপর জয়লাভ করেন। এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের কিছুকাল পরে ঘটেছিলো। হীরায় ইরাস এর শাসন পরিচলনার অষ্টম মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন। ইয়াস এর পরে কেসরা একজন ফরাসী গর্বণর নিয়োগ করেন। কিন্ত ৬৩২ সালে লাখেমিরদের ক্ষমতা পুনর্বহাল হয় এবং মোনযের ইবনে মারুর নামে এক ব্যক্তি শাসন ক্ষমতা দখল করেন। শাসনকার্য পরিচলনার আট মাস পরেই হযরত খালেদ (রা) ইসলামী শক্তির পতাকা নিয়ে হীরায় প্রবেশ করেন।