কোরাইশ নেতাদের উল্লেখিত উভয় আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের আক্রোশ বেড়ে গেল। অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়লো। সে সময় কোরাইশ নেতাদের ঘৃন্য ষড়যন্ত্রের মধ্যে আরো নতুন মাত্রা যোগ হলো। তারা রাসুলে কারিম (সাঃ) কে হত্যা করার প্রস্তাব করলো। কিন্তু সেই সময়ে দুই বিশিষ্ট কোরাইশ নেতা হযরত হামযা (রাঃ) এবং হযরত উমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণ ইসলামের শক্তি বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। রাসুলে কারিম (সাঃ)কে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে বরং এই দুই বীর কেশরী আল্লাহর রসুলের কাছে আত্মসমর্পন করে ইসলামেরই শক্তি বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহর রসুলের প্রতি পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতনের দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।
একিদন আবু লাহাবের পুত্র ওতাইবা রাসুলে কারিম (সাঃ)’র কাছে এসে বললো ‘ওয়াননাজমে উযা হাওয়া এবং ছুমামা দানা ফাতাদাল্লার ‘ সাথে আমি কুফর করছি। সূরা নাজমের এ দুটি আয়াতের অর্থ হচ্ছে, ‘শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্তমিত হয়। অতপর, সে তার নিকটবর্তী হলো অতি নিকটবর্তী। এরপর ওতাইবা আল্লাহর রসুলের উপর অত্যাচার শুরু করলো। তাঁর জামা ছিড়ে দিল এবং পবিত্র চেহারা লক্ষ্য করে থুথু নিক্ষেপ করলো। কিন্ত থুথু তা২র চেহারায় পরেনি। সে সময় রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বদ-দোআ দিলেন, তিনি বলেছিনে , হে আল্লাহ এর উপর তোমার কুকুর সমূহ এর মধ্য তেকে একটি কুকুর লেলিয়ে দাও। রসুলুল্লাহ (সাঃ),র বদ-দোআ কবুল হয়েছিল। ওতবা একবার কোরাইশ বংশের কয়েকজন লোকের সাথে এক সফরে সিরিয়া যাচ্ছিলো। যারকা নামক জায়গায় তারা একদা রাত্রি যাপনের জন্য তাবু স্থাপন করলো। সে সময় একটি বাঘকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। ওতাইবা বাঘ দেখে বললো, হায়রে, আমার ধ্বংস অনিবার্য খোদার কসম, এই বাঘ আমাকে খাবে। মোহাম্মদ (সা) আমার উপর বদ-দোআ করেছেন। দেখো আমি সিরিয়ায় রয়েছি,অথচ তিনি মক্কায় বসে আমকে মেরে ফেলছেন। সতর্কতা হিসাবে সফরসঙ্গীরা তখন ওতাইবাকে নিজেদের মাঝখানে রেখে শযন করলো। রাত্রিকালে বাঘ এলো, সবাইকে ডিঙ্গিয়ে ওতাইবার কাছে গেলো এবং তার ঘাড় মটকালো।
ওকবা ইবনে আবু মুইত ছিলো একজন প্রখ্যাত পৌত্তলিক। একবার এ দুর্বৃত্ত নামাজে সেজদা দেয়ার সময় রসুলুল্লাহ (সাঃ),র ঘাড় এত জোড়ে পেঁচিয়ে ধরলো, মনে হচ্ছিলো যেন, তার চোখ বেড়িয়ে যাবে।
ইবনে ইসহাকে একটি দীর্ঘ বর্ণনায় কোরাইশদের চক্রান্ত সম্পর্কে জানা যায়। তারা রসুলুল্লাহ (সাঃ)কে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য ক্রমাগত চক্রান্ত করছিলো। উক্ত বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, একবার আবু জাহেল বলেছিলো, হে কোরাইশ আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, মোহাম্মদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা এবং আমাদের উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না। আমাদের পিতা-পিতামহকে অবিরাম গালমন্দ দিয়েই চলেছে। এ কারণে আমি আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছি যে, আমি একটি ভারী পাথর নিয়ে বসে থাকবো, মোহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে, তখন সেই পাথর দিয়ে তার মাথা চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দিবো। এরপর যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত। ইচ্ছে হলে আপনারা আমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবেন অথবা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। এরপর বনু আবদে মন্নাফ আমার সাথে যেরুপ ইচ্ছে ব্যবহার করবে,এতে আমার কোন পরোয়া নেই। কোরাইশরা এ প্রস্তাব শোনার পর বললো, কোন অবস্থায়ই তোমাকে আমরা বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবোনা। তুমি যা করতে চাও, করতে পারো।
সকালে আবু জাহেল একটি ভারী পাথর নিয়ে রসুলুল্লাহ (সাঃ),র অপেক্ষায় বসে থাকলো। কোরাইশরা একে একে সমবেত হয়ে আবু জাহেলের কর্মতৎপরতা দেখতে উৎকন্ঠিত হয়ে রইলো। রসুলুল্লাহ (সাঃ) যথারীতি হাজির হয়ে নামাজ আদায় করতে শুরু করলেন। তিনি যখন সেজদায় গেলেন তখন আবু জাহেল পাথর নিয়ে অগ্রসর হইলো। কিন্ত পরক্ষনেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে এলো, এবং তার হাত পাথরের সাথে যেন আটকেই রইলো। কোরাইশদের কয়েকজন লোক তার কাছে এসে বললো, আবুল হাকাম তোমার কি হয়েছে ? সে বললো, আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম, সেটা করতে যাচ্ছিলাম কিন্ত কাছাকাছি পৌঁছুতেই দেখতে পেলাম, মোহাম্মদ আর আমার মাঝখানে একটা উট এসে দাড়িয়েছে। খোদার কমস আমি কখনো অতবড়, অতো লম্বা ঘাড় এ দাঁত বিশিষ্ঠ উট দেখিনি। উটটি আমার উপর হামলা করেত চাচ্ছিলো।
ইবনে ইসহাক বলেন, আমাকে জানানো হয়েছে যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, উটের ছদ্মবেশে তিনি ছিলেন জিব্রাঈল (আ)। আবু জাহেল যদি আসতো তবে তাকে পাকড়াও করা হতো।
এরপর আবু জাহেল রসুলুল্লাহ (সাঃ),র সাথে এমন ব্যবহার করেছিলো যে, সেটা দেখে হযরত হামযা ইসলাম গ্রহণ করেন। সে সম্পর্কে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।
কোরাইশের অন্যান্য দুর্বৃত্তরাও রসুলুল্লাহ (সাঃ) রসুলুল্লাহ (সাঃ)কে দুনিয়া থতেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবেন আমর ইবনুল আস (রা) ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, একবার পৌত্তলিকরা কা’বার সামনে বসেছিলো। আমিও সেখানে ছিলাম। তারা আল্লাহর রসুলের প্রসঙ্গ উথ্থাপন করে বললো, এই লোকটি সম্পর্কে আমরা যেরুপ ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছি তার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে তার ব্যাপারে আমরা অতুলনীয় ধৈর্য্য ধারন করেছি। এ আলোচনা চলার সময় রসুলুল্লাহ (সাঃ) উপস্থিত হলেন। তিনি প্রথমে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন এরপর কা’বা ঘর তওয়াফ করার সময়ে পৌত্তলিকদের পাশ দিয়ে গেলেন। তারা খারাপ কথা বলে তাঁকে অপমান করলো, আল্লাহর রসুলে চেহারায় সে অপমানের ছাপ ফুটে উঠলো। তওয়াফের মধ্যে পুনরায় তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে তারা পুনরায় একইভাবে অপমানজনক কথা বললো। সে অপমানের প্রভাব আমি তাঁর চেহারায় লক্ষ্য করলাম। তৃতীয়বারও একই ঘটনা ঘটলো। এবার আল্লাহর রসুলে ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। তিনি থমকে দাড়িয়ে বললেন, কোরাইশের লোকেরা শুন, সেই আল্লাহর শপথ, তাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আমি তোমাদের কাছে কোরবানীর পশু নিয়ে এসেছি।
রসুলুল্লাহ (সাঃ),র কথায় কোরাইশরা দারুনভাবে প্রভাবিত হলো।তারা সবাই নীরব হয়ে গেল। কঠোর প্রাণের লোকেরাও তাঁর প্রতি নরম ভাষা ব্যবহার করতে লাগলো। তারা বলেছিলো, আবুল কাশেম আপনি ফিরে যান। আল্লাহর শপথ আপনিতো কখনো নির্বোধ ছিলেন না। পরদিও কোরাইশরা একইভাবে সমবেত হয়ে রসুলুল্লাহ (সাঃ)’র প্রসঙ্ঘ আলোচনা করছিলো। এমন সময় তিনি এলেন, তিনি কাছে আসতেই একযোগে তাঁর উপর সবাই ঝাপিয়ে পরলো। একজন তাঁর চাদর গলায় জড়িয়ে শ্বাষরোধ করতে চাচ্ছিলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, তোমরা এমন একজন মানুষকে হত্যা করছো, যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আমার আল্লাহ? দুর্বত্তরা এরপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বলেন, কোরাইশদের অত্যাচারের ঘটনাসমূহের মধ্যে আমার দেখা এ ঘটনাটি ছিলো সবচেয়ে মারাত্মক।
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, পৌত্তলিকরা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-র সাথে সবচেয়ে বর্বরোচিত যে ব্যবহার করছিলো তার বিবরণ আমাকে বলুন। তিনি রসুলুল্লাহ (সাঃ) কাবার হাতীমে নামায আদায় করছিলেন। এমন সময় ওকবা ইবেন আবু মুঈত এসে হাযির হলো। সে এসেই নিজের চাদর আল্লাহর রসূলের গলায় পেঁচিয়ে তার শ্বাসরুদ্ধ করতে চাইলো। এমন সময় হযরত আবু বকর (রা) এলেন এবং ওকবার দুই কাঁধ ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন,তোমরা এমন একজন মানুষকে হত্যা করতে চাও যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ?
হযরত আসমা (রা) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) এ চিৎকার শুনতে পেলেন যে, তোমাদের সঙ্গীকে বাঁচাও। এ চিৎকার শোনা মাত্র তিনি আমাদের কাছ থেকে দৌড়ে গেলেন। তাঁর মাথায় চারটি বেণী ছিলো। তিনি একথা বলতে বলতে ছুটে গেলেন যে, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করতে চাও, যিনি বলেন, আমার প্রভু আল্লাহ? পৌত্তলিকরা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে ছেড়ে হযরত আবু বকরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তিনি বাড়ী ফিরে আসার পর আমরা তাঁর মাথার চুলের যেখানেই হাত দিচ্ছিলাম,চুল আমাদের হাতে উঠে আসছিলো।