আইয়ামে জাহেলিয়াতে লোকদের চিন্তা, বিশ্বাস কাজ সম্পর্কে মোটামুটি আলোকপাত করা হলো। এসব কিছুর পাশাপাশি দ্বীনে ইবরাহীমীও তারা আংশিকভাবে পালন করতো। অর্থাৎ ইবরাহীমী দ্বীন তারা পুরাপরি ত্যাগ করেননি। তারা কাবা তওয়াফ করতো, কাবাঘরের সম্মান করতো, হজ্জ এবং ওমরাহ পালন করতো, আরাফাত এবং মোযদালেফায় অবস্থান করতো এবং হাদীর পশু কোরবাণী করতো। তবে দ্বীনে ইবরাহীমীতে তারা বেশ কিছু বেদায়া’তও যুক্ত করেছিলো। নিচে তার কিছু উদাহরণ উল্লেখ্য করা যাচ্ছে।
কোরায়শদের একটি বেদয়া’ত ছিলো এই যে, তারা বলতো, আমরা হযরত ইবরাহীম (আ) এর সন্তান। কাবার পাসবান বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, কাবাঘরের তত্ত্বাবধায়ক এবং মক্কার বাসিন্দা, আমাদের সমমর্যাদার কেউ নেই। আমাদের সমতূল্য অধিকার কারো নেই। এ কারণে তারা নিজেদের নামকরণ করতো হুসম। অর্থাৎ বাহাদুর এবং গরমজোশ। তারা বলতো, আমাদের অতি অসাধারণ মর্যাদা রয়েছে। কাজেই কাবাঘরের সীমানায় বাইরে যাওয়া আমাদের শোভনীয় নয়। হজ্জের সময়ে তারা আরাফাতে যেতো না এবং নিয়ম অনুযায়ী সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করতো না। বরং তারা মোযদালেফায় অবস্থান করে সেখান থেকেই প্রত্যাবর্তন করতো। আল্লাহ তায়ালা এই বেদয়া’তকে সংশোধন করে বলেন, অতপর অন্যান্য লোক যেখা থেকে প্রত্যাবর্তনও করে তোমরাও সেই স্থান থেকে প্রত্যাবর্তন করবে।
পৌত্তালিকদের একটি বেদয়া’ত ছিলো এই যে, তারা বলতো, হুমস অর্থাৎ কোরায়শদের জন্যে এহরাম বাঁধা অবস্থায় পনির এবং ঘি তৈরী করা বৈধ নয়। পশমওয়ালা ঘরে অর্থাৎ কম্বলের তাঁবুতে প্রবেশ হওয়াও বৈধ নয়। এটাও বৈধ নয় যে, ছায়া পেতে হলে চামড়ার তাঁবু ছাড়া অন্য কোথাও ছায়া লাভ করবে।
তাদের একটি বেদয়া’ত এটাও ছিলো যে, তারা বলতো, মক্কার বাইরে থেকে যারা হ্জ্জ বা ওমরাহ করতে আসবে, তাদের নিয়ে আসা খাদ্য পানীয় খাওয়া বৈধ নয়।
একটি বেদয়াত এই ছিলো যে, তারা মক্কার বাইরের অধিবাসীদের আদেশ দিয়ে রেখেছিলো যে, তারা হরমে আসার পর প্রথম যে তওয়াফ করবে, সেই তওয়াফ হুমস অর্থাৎ কোরায়শদের কাছ থেকে নেয়া কাপড়ে করতে হবে । যদি কাপড় না পেতো, তবে পুরুষেরা উলঙ্গ হয়ে তওয়াফ করতো এবং মহিলারা সব পোশাক খুলে ফেলে একটি ছোট খোলা জামা পরিধান তওয়াফ করতো। তওয়াফের সময় তারা এ কবিতা আবৃত্তি করতো।
লজ্জাস্থানের কিছুটা বা সবটুকু খুলে যাবে আজ
যেটুকু যাবে দেখা ভাবব না অবৈধ কাজ।
এ অশ্লীল আচরণ বন্ধ করতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, হে বনি আদম, প্রত্যেক নামাযের সময় সুন্দর পরিচ্ছিদ পরিধান করবে।
যদি মক্কা বাইরে থেকে আসা কোন পুরুষ বা নারী মক্কার বাইরে থেকে নিয়ে আসা পোশাকে তওয়াফে করতো, তবে তওয়াফ করতো, তবে তওয়াফ শেষে সেই পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো। সে পোশাক নিজেও ব্যবহার করতো না এবং অন্য কোন ব্যবহার করতো না।
কোরায়শদের একটি বেদয়াত এই ছিলো যে, তারা এহরাম বাঁধা অবস্থায় ঘরের দরোজা দিয়ে প্রবেশ করতো না বরং ঘরের পেছনের দিকে একটা ছিদ্র করে নিতো, সেই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করতো এবং বাইরে বের হতো।
এ ধরণের অদ্ভট কাজকে তারা পূণ্যের কাজ মনে করতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এরূপ করতে নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, পেছন দিক দিয়ে তোমাদের গৃহ প্রবেশ করাতে পূণ্য নাই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ যদি তাকওয়া অবলম্বন করে। সুতরাং তোমরা দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো। তোমরা আল্লাহক ভয় করো যাতে, তোমরা সফলকাম হতে পারো।
এই ছিলো পৌত্তলিকদের ধর্মীয় জীবনের রূপরেখা।
এছাড়া জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন এলাকায় ইহুদী, খৃষ্টান, মাজুসিয়ত বা অগ্নিপূজক এবং সাবেয়ী মতবাদের ব্যাপক প্রচলন ছিলো। নীচে এদের সম্পর্কে কিছু্আলোকপাত করা যাচ্ছেঃ
জাযিরাতুল আরবে ইহুদীদের ছিল দু’টি যুগ। প্রথম যুগ ছিল সে সময় যখন বাবেল ও আশুর সরকার ফিলিস্তিন জয় করেছিলো। এ সময়ে ইহুদীরা স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সেই সরকারের কঠোর নির্যাতন নিষ্পষণ এবং ইহুদী জনবসতির ধ্বংস সাধনের ফলে বহু সংখ্যক ইহুদী হেজায ছেড়ে ফিলিস্তানের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলো।
দ্বিতীয় যুগ ছিলো সেই সময় যখন ৭০ ঈসায়ী সালে টাইটাস রূমীয় নেতৃত্বে রোমকরা ফিলিস্তিন অধিকার করে। সেই সময় রোমকদের ইহুদী নির্যাতন এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বহু ইহুদী গোত্র হেজাযে পালিয়ে আসে। এরা ইরানের খয়বর ও তায়মাসে বসতি গড়ে তোলে এবং দুর্গ নিমাণ করে। এসব দেশ ত্যাগী ইহুদীর সাথে মেলামেশার ফলে আরব অধিবাসীদের মধ্যে ইহুদী ধর্ম-চিন্তার প্রসার ঘটে। এর ফলে ইসলামের আর্বিভাবের সময় যেসব ইহুদী গোত্র বিখ্যাত ছিলো, সেগুলো হচ্ছে খযবর, নাযির, মোস্তালেক, কোরায়যা, কায়নুকা সামহুদী। অফা ওয়া অফা গ্রন্থের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ্য করেছেন যে, এসময় ইহুদী গোত্রের সংখ্যা ছিলো বিশ-এর বেশি।
ইয়েমেনেও ইহুদীরা ছিলো শক্তিশালী। তাবান আসাদ আবু কারাব নামে এক ব্যক্তির মাধমে ইয়েমেনে ইহুদী মতবাদ প্রসার লাভ করে। যুদ্ধ যুদ্ধ করতে করতে সে ইয়াসরেব পৌঁছে।
ইয়াসরেব যাওয়ার পর সে ইহুদী মতবাদের দীক্ষা নেয় এবং বনু কোরায়যার দু’জন ইহুদী ধর্ম বিশেজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমেনে পৌঁছে। এদের মাধ্যমে ইয়েমেনে ইহুদী মতবাদ প্রচার প্রসার লাভ করে। আবু কারাবের পর তার পুত্র ইউসুফ জুনুয়াস ইয়েমেনে শাসন ক্ষমতা অধিকার করে। ইহুদী মতবাদের জোশে এই ব্যক্তি নাযরানের খৃষ্টানদের ওপর হামলা চালায় এবং জোর করে তাদেরকে ইহুদী ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে তারা অস্বীকৃতি জানায়। ক্রুদ্ধ জুনুয়াস বিরাট গর্ত খনন করিয়ে সে গর্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় বিশ থেকে চব্বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ৫২৩ ঈসায়ী সালের অক্টোবর মাসে এ ঘটনা ঘটে। পবিত্র কোরআনের সূরা বুরুজে এ ঘটনার উল্লেখ্য রয়েছে।
আরব দেশসমূহে ঈসায়ী বা খৃষ্টধর্ম আবিসিনীয় এবং রোমক বিজয়ীদের মাধ্যমে প্রচালিত হয়েছিলো। ইতিপূর্বই উল্লেখ্য করা হয়েছে যে, ইয়েমেনের ওপর আবিসিনীয়রা প্রথমবার ৩৪০ সালে আধিপত্য বিস্তার করে। ৩৭৮ সাল পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় ছিলো। এ সময়ে ইয়েমনে খৃষ্টান মিশনারী কাজ করতে থাকে। সেই সময়ে ফেমিউন নামে একজন বিশিষ্ট সাধক নাযরান পৌঁছেন এবং স্থানীয় লোকদর মধ্যে ঈসায়ী বা খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করেন। নাযরানের অধিবাসীরা খৃষ্টান ধর্মের সত্যতার প্রমাণ পাওয়ার পর খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে।
জুনুয়াসের হ্ত্যাকান্ডের ক্ষতচিহ্ন তখনো মুছে যায়নি। এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে হাবশীরা পুনরায় ইয়েমেন অধিকার করে এবং আবরাহা ক্ষমতা দখল করে। এই ব্যক্তি বিপুল উৎসাহের সাথে খৃষ্টান ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেয়। উৎসাহের আতিশয্যে এই ব্যক্তি ইয়েমেনে একটি মন্দির তৈরী করে। সে চাচ্ছিলো যে, ধর্মপ্রাণ মানুষেরা মক্কার কাবাঘরে গিয়ে তার তৈরী মন্দিরে যাবে। এ দুরাচার এ উদ্দ্যেশ্য মক্কায় কাবাঘর ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ঘৃণ্য দুঃসাহস দেখানোর ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন শাস্তি দিলেন যে, সে ঘটনা পূর্ববর্তী এবং সকলের জন্যে শিক্ষনীয় হয়ে রইল।
অন্যদিকে রোমকরা অধিকৃত এলাকার প্রতিবেশী হওয়ার আলে গাসসান, বনু তাগলাব, বনু তাঈ প্রভৃতি আরব গোত্রের মধ্যে খৃস্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করে। হীরার কয়েকজন আরব শাসকও খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত হন।
মাজুসী ধর্ম বা অগ্নিপূজকদের অধিকাংশ বসবাস করতো পারস্যে পতিবেশী আরব দেশসমূহে। যেমন ইরাক, বাহরাইন ও আরব উপসাগরের উপকূলীয় এলাকা। এছাড়া ইয়েমেনে পারস্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর বিচ্ছি্ন্নভাবে বহু লোক মাজুসী ধর্ম গ্রহণ করেছিলো।
সাবী বা সাবেয়ী ধর্ম। ইরাক এবং অন্যান্য স্থানে প্রাচীন নির্দশনসমূহ খনন করে উদ্ধার করার সময় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সাবী ছিলো কালদানি জাতির ধর্ম। এরা ছিলো হযরত ইব্রাহীম (আ) এর বংশধর। প্রাচীনকালে সিরিয়া এবং ইয়েমেনের বহু অধিবাসী এ ধর্মের অনুসারী ছিলো। কিন্তু ইহুদী এবং খৃষ্টান ধর্মের জয় জয়কার শুরু হলে এ ধর্মের বিলুপ্তি ঘটে।
তবুও মাজুসিদের সাথে মিশ্রিতভাবে বা তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে ইরাক এবং আরব উপসাগারীয় এলাকায় ও ধর্মের কিছু অনুসারী অবশিষ্ট ছিলো।