উপসংহার (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পদ্ধতি প্রসঙ্গে)
আধুনিক যুগের বিদ্বানেরা ভারতবর্ষের প্রাচীন রচনাবলী সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করেছেন। সে-গবেষণাকে ছোটো করবার প্রশ্ন নিশ্চয়ই ওঠে না; কেননা, তার উপর নির্ভর করতে না পারলে আমাদের পক্ষে আজ হয়তো ওই পুঁথিপত্রগুলির দিকে অগ্রসর হওয়াই অনেকাংশে অসম্ভব হতো। কিন্তু তবুও শুধুমাত্র এই গবেষণা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাও সম্ভব নয়। কেননা, এই রচনাগুলিতে প্রাচীন-সমাজের সে-সব স্মারক পড়ে রয়েছে আধুনিক বিদ্বানেরা সেগুলির প্রকৃত ব্যাখ্যা খোঁজ করেন নি। তার কারণ কি এই যে, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ওই সব ঝুলজমা ধুলোঢাকা গহ্বরগুলিতে এমন কঙ্কাল লুকানো রয়েছে যার কাহিনী শুনতে আধুনিক সমাজ সাহস পায় না? এই কঙ্কালগুলি রবীন্দ্রনাথের কঙ্কাল গল্পের অশরীরী নায়িকাটির মতো সত্যিই বড় অপরূপ কাহিনী আমাদের শোনাতে চায়। এরা বলতে চায়, উত্তরযুগের ভারতীয় সমাজে হিংসা ও বিদ্বেষের তাণ্ডব যতো প্রচণ্ড হয়েই উঠুক না কেন এককালে এই সমাজেই সবাই স্বাধীন ছিলো, সবাই সমান ছিলো, মানুষে-মানুষে ছিলো ভাই-ভাই সম্পর্ক। তখনো মানুষ মানুষকে শোষণ করতে শেখেনি, তাই শেখেনি অধ্যাত্মবাদের প্রবঞ্চনা, শেখেনি ভাববাদের আলেয়া দেখিয়ে মানুষকে ভুল পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
এ-কাহিনী প্রকাশ করতে আধুনিক সমাজ এতো ভয় পায় কেন? কেননা, সে-কাহিনী শুনে আজকের মানুষ আবার সমানে-সমান সম্পর্ককে ফিরে পেতে চাইবে। তার মানে অবশ্যই সে-সমাজের দৈন্যকে ফিরে পাবার কথা নয়—ধনসম্পদের দৈন্যও নয়, চিন্তাচেতনার দৈন্যও নয়—তার বদলে, প্রাচুর্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নতুন সাম্য-সমাজ, আর তারই অনুরূপ ধ্যানধারণা হিসেবে বৈজ্ঞানিক তথ্যের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ লোকায়ত-দর্শনও। অতীতকে আবিষ্কার করবার সঙ্গে শুধুই অতীতকে চেনবার সম্পর্ক নয়—সচেতনভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবার যোগাযোগও আছে।