প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৯. গ্রাম-সমবায় : গণ-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ

১৯. গণ-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ : গ্রাম-সমবায়

ভারতীয় সমাজের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটো ছোটো গ্রাম-সমবায় (village-communities) এবং জাতিভেদ-প্রথা (caste-system)—এই দু’-এর উল্লেখ করতে হয়। আমরা বলতে চাইছি, উভয় বৈশিষ্ট্যকেই ট্রাইব্যাল সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ বলে বোঝবার চেষ্টা করা যেতে পারে।

বৃটিশ আমলের প্রথম যুগের সেটল্‌মেণ্ট ও রেভিনিউ বিভাগের দলিল-পত্রগুলি বিশ্লেষণ করে মার্ক্‌ উইল্‌ক্‌স্‌,(১৯৩) জর্জ ক্যামবেল(১৯৪) এবং হেনরি মেইন(১৯৫) সিদ্ধান্ত করেন, ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চলের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো জমিতে যৌথ স্বত্ব অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অভাব। তাছাড়া, ভারতবর্ষের মতো কৃষিপ্রধান দেশে আইনের বইগুলিতে জমির স্বত্বাধিকার-সংক্রান্ত আইন-কানুন চোখে পড়ে না(১৯৬)—এ-থেকেও অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, আমাদের দেশে জমির উপর ব্যক্তিবিশেষের স্বত্বাধিকার তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি। তাই হেগেল(১৯৭) এবং মার্কস(১৯৮) সিদ্ধান্ত করেছেন যে, আমাদের দেশের সাবেকী গ্রামগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব। জমির উপর যৌথ স্বত্ব বলে এই লক্ষণটি ট্রাইব্যাল সমাজেরই চিহ্ন। ইরোকোয়া-ট্রাইবের মানুষেরা বলে, জল আর বাতাসের মতোই জমি কেনা-বেচা করবার প্রশ্ন ওঠে না(১৯৯)।

বেডেন-পাওএল(২০০) যদিও মেইন প্রমুখের উক্ত সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে খণ্ডন করবার,–বা শুধরে নেবার—চেষ্টা করেছেন, তবুও এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ভারতবর্ষের অন্তত কয়েকটি বিস্তৃত অংশের বেলায় তাঁদের ওই সিদ্ধান্ত তথ্য-নির্ভর এবং অবশ্য-স্বীকার্য। এবং সাধারণ নিয়ম হিসেবে বেডেন-পাওএল(২০১) যখন দাবি করেন যে, ঐতিহাসিকভাবে জমিতে যৌথ স্বত্বের চেয়ে প্রাচীনতর ব্যবস্থা হলো ব্যক্তিগত স্বত্ব,–তখন তাঁর দাবিটি যে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন, সে-বিষয়ে কোনো রকম প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। অপর পক্ষে, মেইন প্রমুখের সিদ্ধান্তের পক্ষে অনেক জোরালো যুক্তি রয়েছে। মার্ক উইক্‌ল্‌স্‌(২০২) যে-রকম বলছেন, সপ্তদশ শতাব্দীতে যে-সব ইয়োরোপীয় পরিব্রাজকেরা আওরংজেব-এর দরবার পরিদর্শন করেছিলেন তাঁরা এক বাক্যেই স্বীকার করেছেন যে, ভারতবর্ষে তখনো জমিত উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ছিলো না। অবশ্যই, প্রাচীন গ্রীক বর্ণনাদাতাদের(২০৩) বক্তব্য কিছুটা অন্যরকম। কিন্তু মার্ক উইক্‌ল্‌স্‌(২০৪) দেখাচ্ছেন যে, এ-বিষয়ে তাঁদের মন্তব্য খুব বেশি মূল্যবান হতে পারে না। কেননা, তথ্য সঞ্চয়ের জন্যে প্রায়ই তাঁরা নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলেন একের পর এক তিন তিনজন দোভাষীর ব্যাখ্যার উপর, এবং এই তিনজনের মধ্যে একজনের কথাও গ্রীক বর্ণনাদাতারা বুঝতে পারতেন না। হয়তো সেই কারণেই, কীথ এবং ম্যাকডোন্যাল্ড(২০৫) আক্ষেপ করেছেন, এ-বিষয়ে গ্রীক বর্ণনাদাতাদের মধ্যে কারুর সঙ্গে কারুর মতের মিল নেই।

অবশ্যই, শিলালিপি প্রভৃতিতে ভূসম্পত্তি-দানের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এই নজির দেখিয়ে কেউ কেউ(২০৬) অনুমান করেছেন যে, তাহলে নিশ্চয়ই জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলো। কিন্তু এই জাতীয় দলিলগুলিতে ভূসম্পত্তি বলতে ইয়োরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক অর্থে ভূসম্পত্তি নাও বোঝাতে পারে—এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, দান বলতে এখানে গ্রামাঞ্চল থেকে রাজার প্রাপ্য রাজস্বটুকুকেই উল্লেখ করা হয়েছে(২০৭)। তাছাড়া, এই দলিলগুলি থেকেই দেখা যায় দানের আগে দাতার পক্ষে গ্রামবাসীদের সম্মিলিত সম্মতি নেবার দরকার পড়তো(২০৮)। গ্রামের জমির উপর গ্রামবাসীদের যদি যৌথ অধিকার না থাকে তাহলে এইভাবে তাদের কাছ থেকে যৌথ সম্মতি নেবার প্রয়োজন হবে কেন?

কোনো কোনো ইংরেজ পণ্ডিত প্রমাণ করতে চেয়েছেন, সাবেককালের ভারতবর্ষে জমির উপর কৃষকদের মালিকানা যে ছিলো না তা আসল কারণ হচ্ছে জমির প্রকৃত মালিক বলতে ছিলো রাজা বা সামন্ততান্ত্রিক প্রভুর দল। যেমন, ভিন্সেণ্ট স্মিথ(২০৯) লিখছেন, ভারতবর্ষের নেটিভ আইন অনুসারে চাষ-জমিকে বরাবরই রাজসম্পত্তি বলে দেখা হয়েছে। ইংরেজ-শাসনের তরফ থেকে ইতিহাসের নামে এ-রকম একটা মিথ্যে কথা প্রচার করবার প্রয়োজন ছিল; কেননা, ইংরেজ-শাসনের খুঁটি হিসেবে ওরাই এ-দেশে জমির মালিক নাম দিয়ে জমিদার-শ্রেণী হিসেবে যে নতুন এক-শ্রেণীর মানুষ সৃষ্টি করেছিলো এই জাতীয় ভুয়ো ইতিহাস তার কলঙ্ক কিছুটা পরিমাণে ঢাকা দিতে পারতো(২১০)। অধ্যাপক জয়সওয়াল(২১১) তাই স্মিথ সাহেবকে বিদ্রূপ করে বলছেন, এবং ঠিকই বলছেন, ‘ভারতবর্ষের সত্যিকারের প্রামাণ্য আইনকর্তা-প্রবর্তিত নেটিভ আইন বলতে ঠিক এর বিপরীত। এ-রকম আইন অন্য কোনো দেশের নেটিভ আইন হতে পারে, কিন্তু ভারতবর্ষের নেটিভ আইন নিশ্চয়ই নয়’।

জৈমিনী, নীলকণ্ঠ, মাধব,কাত্যায়ন। মিত্রমিশ্র প্রভৃতির রচনা থেকে বিস্তৃত উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করে অধ্যাপক জয়সওয়াল দেখাচ্ছেন(২১২) সাবেককালের ভারতবর্ষে জমির মালিক বলতে রাজা বা সামন্ত প্রভু হতেই পারে না। তিনি আরো বলছেন, জাতকের গল্পগুলি থেকে যে-ঐতিহাসিক তথ্য উদ্ধার করা যায় তাও ভিন্সেণ্ট স্মিথের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীত(২১৩)। কিন্তু ভারতবর্ষে জমির উপর রাজার মালিকানা ছিলো না—এ-কথা তথ্যবলে প্রমাণ করলেও অধ্যাপক জয়সওয়াল দেখাতে চাইছেন, জমির উপর কৃষকদের ব্যক্তিগত মালিকানা ছিলো(২০১৪)। তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের দুর্বলতা ঠিক এইখানেই এবং এ-দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যখন তিনি ভিন্সেণ্ট স্মিথের বিরুদ্ধে তর্ক করে বলেন, এ-হেন জনপ্রিয় একটি পাঠ্যপুস্তকে এ-বিষয়ে অমন ভ্রান্ত একটা সংস্কারগ্রস্ত মতবাদ প্রচারিত হওয়াটা খুবই ক্ষোবের ব্যাপার,–বিশেষ করে ক্ষোভের ব্যাপার এই কারণে যে, লেখক এ-বিষয়ে অত্যন্ত যোগ্য আলোচনাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেই নিজের মতবাদ পেশ করতে চাইছেন(২১৫)। বিশেষ যোগ্য আলোচনা বলতে অধ্যাপক জয়সওয়াল একটি বই-এরই উল্লেখ করছেন—১৮৬৯-এ প্রকাশিত মার্কস উইল্‌ক্‌স্‌-এর লেখা মাইসোর-ইতিহাস(২১৬)। আমরা ইতিপূর্বেই উক্ত গ্রন্থের উল্লেখ করেছি এবং বলেছি, প্রধানত এই গ্রন্থের ভিত্তিতেই হেগেল, মার্ক্‌স্‌ প্রমুখ মনীষীরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সাবেককালের ভারতবর্ষের জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা দেখা দেয়নি—জমি ছিলো গ্রামবাসীদের যৌথ সম্পত্তি। তাই অধ্যাপক জয়সওয়াল যদি সত্যিই মনে করেন, ভিন্সেণ্ট স্মিথের পক্ষে এই গ্রন্থটিকে অগ্রাহ্য করে জমির উপর রাজত্ব-স্বত্ব প্রমাণ করবার চেষ্টাটা খুবই গর্হিত কাজ হয়েছে, তাহলে অধ্যাপক জয়সওয়ালের নিজের পক্ষে উক্ত গ্রন্থকেই অগ্রাহ্য করে জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার কথা প্রচার করা কী করে সঙ্গত হতে পারে?

অবশ্যই, এ-কথার কোনো সন্দেহ নেই যে, সাবেকী ভারতবর্ষে জমির মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যা আজো অনেকাংশেই অমীমাংসিত। এ-বিষয়ে মৌলিক গবেষণার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া, ভারতবর্ষ সত্যিই এতোটুকু জায়গা নয়—প্রায় ইয়োরোপের মতো বড়ো একটি মহাদেশ-বিশেষ। তাই এদেশে ভূমিব্যবস্থা যে সর্বত্র একই রকমের ছিলো তাও মনে করা ঠিক হবে না। তবুও পূর্বগামীদের গবেষণার উপর নির্ভর করে অন্তত এটুকু অনুমান করা বোধ হয় অসঙ্গত নয় যে, ভারতবর্ষের কয়েকটি বিস্তৃত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যই ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিমূলক গ্রামসমবায় এবং এই সব গ্রামে জমি ছিলো গ্রামবাসীদের যৌথ সম্পত্তি। বেডেন্‌-পাওএল্‌ যদি সত্যিই প্রমাণ করে থাকেন যে, অন্যান্য অঞ্চলে জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা দেখা দিয়েছিলো তাহলেও নিশ্চয়ই এ-কথা প্রমাণিত হয় না যে, উইল্‌ক্‌স্‌, মেইন্‌ প্রমুখেরা অন্যান্য অঞ্চল সম্বন্ধে যে-বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন তা খণ্ডিত হয়ে যায়(২১৭)।

জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলিতে যৌথ-জীবনের কথা আমরা এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাইছি আমাদের মূল প্রকল্পটির পক্ষে নজির দেখাবার আশায়। প্রকল্পটি হলো, এদেশে ট্রাইব্যাল-সমাজের বিলোপ পরিপূর্ণ হয়নি—জমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অভাব ও গ্রামগুলিতে যৌথ-জীবনের স্বাক্ষর ওই ট্রাইব্যাল-সমাজেরই ভগ্নাবশেষ। কিনতি সেই সঙ্গেই আমরা বলতে চাইছি, রাষ্ট্রশক্তি যদি বাইরের থেকে ট্রাইব্যাল-সমাজকে আক্রমণ করে, সে-সমাজ ভেঙে এবং সেই সমাজেরই মানুষগুলিকে নিয়ে ছোটো ছোটো গ্রাম-নিবেশ করে থাকে তাহলে এই গ্রাম-গুলিতে যে-রক্ম ট্রাইব্যাল-সমাজের বহু চিহ্ন টিকে থাকবার কথা সেইরকমই ট্রাইব্যাল-সমাজের মূল সঞ্জীবনী-শক্তি থেকে উৎপাটিত হয়ে বিরুদ্ধ-পরিবেশে গ্রথিত হবার ফলে এই চিহ্নগুলির আদি-তাৎপর্য তার বিপরীতে পর্যবসিত হতে বাধ্য। ট্রাইব্যাল-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে যে-যৌথজীবন ছিলো বাঁচবার সহায়, রাষ্ট্রশাসন ও রাষ্ট্রশোষণের অন্তর্ভূক্ত ওই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির বৈশিষ্ট্য হবার পর সেই যৌথ-জীবনের ধ্বংসাবশেষই মানুষের জীবনের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।

এই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলি সম্বন্ধে হেগেল(২১৮) লিখছেন :

The whole income belonging to every village is, as already stated, divided into two parts, of which one belongs to the Rajah, the other to the cultivators; but proportionate shares are also received by the Provost of the place, the Judge, the Water-Surveyor, the Brahmin who superintends religious worship, the Astrologer (who is also a Brahmin, and announces the days of good and ill omen), the Smith, the Carpenter, the Potter, the Washerman, the Barber, the Physician, the Dancing girls, the Musician, the Poet. This arrangement is fixed and immutable, and subject to no one’s will. All political revolutions, therefore, are mater of indifference to the common Hindoo, for his lot is unchanged.

অর্থাৎ, প্রতিটি গ্রাম থেকে যা উপায় হতো তার পুরোটাই দ’ভাগে ভাগ করা হতো; তার মধ্যে একটা ভাগ রাজার, আর একটা ভাগ কৃষকদের। কিন্তু নিম্নোক্তরাও আনুপাতিকভাবে নিজেদের অংশ পেতো : স্থানীয় শান্তিরক্ষক, বিচারক, জল-পরিদর্শক, পুরোহিত, গণৎকার, কামার, ছুতোর, কুমোর, ধোপা, নাপিত, বৈদ্য, নর্তকী, গায়ক, কবি। এই ব্যবস্থা ছিলো একেবারে বাঁধাধরা ও অনড়-অচল এবং তা কারুরই ইচ্ছার উপর নির্ভর করতো না। অতএব সাধারণ হিন্দুর কাছে সবরকম রাজনৈতিক বিপ্লবই ছিলো উপেক্ষার ব্যাপার; কেননা, তার অবস্থায় কোনো পরিবর্তনই হবার নয়।

মার্ক্‌স্‌ও সাবেকী(২০১৯) ভারতবর্ষের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির বৈশিষ্ট্য-বর্ণনায় যৌথজীবনের উপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন এবং স্বভাবতই ভাববাদী-দার্শনিক হেগেলের তুলনায় বস্তুবাদী-দার্শনিক মার্ক্‌স্‌-এর বর্ণনা অনেক স্পষ্ট ও বস্তুনির্ভর :

Those small and extremely ancient Indian communities, some of which have continued down to this day, are based on possession in common of the land, on the blending of agriculture and handicrafts, and on an unalterable division of labour, which serves, whenever a new community is started, as a plan and scheme ready cut and dried. Occupying areas of from 100 up to several thousand acres, each forms a compact whole producing all it requires. The chief part of the products is destined for direct use by the community itself, and does not take the form of a commodity. Hence, production here is independent of that division of labour brought about, in Indian society as a whole, by means of the exchange of commodities. It is the surplus alone that becomes a commodity, and a portion of even that, not until it has reached the hands of the State, into whose hands from time immemorial a certain quantity of these products has found its way in the shape of rent in kind. The constitution of these communities varies in different parts of India. In those of the simplest form, the land is tilled in common, and the produce divided among the members. At the same time, spinning and weaving are carried on in each family as subsidiary industries. Side by side with the masses thus occupied with one and the same work, we find the ‘chief inhabitant’, who is judge, police, and tax-gatherer in one; the book-keeper who keeps the accounts of the tillage and registers everything relating thereto; another official, who prosecute criminals, protects strangers travelling through and escorts them to the next village; the boundary man, who guards the boundaries against neighboring communities; the water-overseer, who distributes the water from common tanks for irrigation; the Brahmins, who conduct the religious services; the school master, who on the sand teaches the children reading and writing; the calendar Brahmin or astrologer, who makes known lucky or unlucky days for seed time and harvest, and for every other kind of agricultural work; a smith and a carpenter, who make and repair all the agricultural implements; the potter who makes all the pottery of the village; the barber, the washer man, who washes clothes, the silversmith here and there the poet, who in some communities replaces the silversmith, in others the school master. This dozen of individuals is maintained at the expense of the whole community. If the population increases, a new community is founded, on the pattern of the old one, on unoccupied land. The whole mechanism discloses a manufactures is impossible, since the smith and the carpenter, etc., find and unchanging market, and at the most there occur, according to the sizes of the villages, two or three of each, instead of one. The law that regulates the division of labour in the community acts with the irresistible authority of a law of Nature, at the same time that each individual artificer, the smith, the carpenter, and so on, conducts in his workshop all the operations of his handicraft in the traditional way, but independently, and without recognising any authority over him. The simplicity of the organisation for production in these self-sufficing communities that constantly reproduce themselves in the same form, and when accidentally destroyed, spring up again on the spot and with the same name–this simplicity supplies the key to the secret of the unchangeableness of Asiatic societies, an unchangeableness in such striking contrast with the constant dissolution and refounding of Asiatic States, and the never-ceasing changes of dynasty. The structure of the economic elements of society remains untouched by the storm-clouds of the political sky.

অর্থাৎ, এই সব ছোটো ছোটো ও অত্যান্ত প্রাচীন ভারতীয় গ্রাম-সমবায়,–যার মধ্যে কিছু কিছু এখনো টিকে রয়েছে,–এগুলির ভিত্তিতে ছিলো জমিতে যৌথ স্বত্ব, কৃষির সঙ্গে কারিগরির মিশ্রণ এবং অপরিবর্তনীয় শ্রমবিভাগ, যা কিনা যখনই একটা নতুন যৌথ-সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে তখনই তার সামনে তৈরী আর বাঁধাধরা পরিকল্পনা হিসেবে থেকে গিয়েছে। ১০০ থেকে কয়েক হাজার একর জমি জুড়ে (নানা আকারের এই যৌথ-সম্প্রদায়গুলি), এক একটি নিটোল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ (সমবায় হিসেবে) নিজের যাবতীয় প্রয়োজন উৎপাদন করেছে। উৎপাদিত সামগ্রীর প্রধান অংশ পুরো সম্প্রদায় দ্বারা সরাসরি ব্যবহৃত হবার জন্যে তৈরী হয়, এগুলি পণ্যের রূপ পায় না। তাই সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজে পণ্যবিনিময়ের দরুন যে শ্রমবিভাগ আছে এই যৌথ-সমবায়গুলির আভ্যন্তরীন উৎপাদন তার প্রভাব-মুক্ত। শুধুমাত্র বাড়তিটুকুই পণ্য হয়, এবং তারও একটি অংশমাত্র রাষ্ট্রের কবলভুক্ত হবার পরই পণ্য হতে পারে—এক অস্পষ্ট অতীত থেকে রাজস্ব হিসেবে এই উৎপাদিত বস্তুগুলিরই একটা অংশ রাষ্ট্রের কবলভুক্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে এই যৌথ-সমবায়গুলির সংগঠন বিভিন্ন রকমের। যেখানে সবচেয়ে সরল সংগঠনের পরিচয় সেখানে জমি যৌথভাবে চাষ করা হয় এবং উৎপন্ন-বস্তু সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয়। সেই সঙ্গেই, প্রতিটি পরিবারে সহকারী শিল্প হিসেবে সুতোকাটা এবং কাপড়-বোনার কাজ চলে। এইভাবে একই কাজে নিযুক্ত জনসাধারণের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই মোড়ল—সে একাধারে বিচারক, পুলিশ এবং রাজস্ব আদায়কারী; খাজাঞ্চী—সে কৃষি সংক্রান্ত সবকিছুর হিসেব রাখে; আর একজন কমর্চারী—সে অপরাধীদের শাস্তি দেয়, আগন্তুক পথিকদের নিরাপদে পরের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে; সীমানাদার—সে আশপাশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রাখবার জন্যে নিজেদের সম্প্রদায়টির সীমানা পরিদর্শন করে; জলপরিদর্শক—সে কৃষির জন্যে বারোয়ারী পুকুর থেকে জল সরবরাহের তদারক করে; ব্রাহ্মণ—সে ধর্মকর্ম পরিচালনা করে; পাঠশালার পণ্ডিত—সে বালির উপরে ছেলেদের লেখাপড়া শেখায়; পুঁজিদার-ব্রাহ্মণ বা গণৎকার—সে বীজ বোনবার, ফসল কাটবার ও অন্যান্য সব-রকম কৃষিকর্মের পক্ষে শুভাশুভ সময়ের নির্দেশ দেয়; একজন কামার ও একজন ছুতোর—তারা চাষবাসের সমস্ত যন্ত্রপাতি তৈরী ও মেরামত করে; কুমোর—সে গ্রামের জন্য সমস্ত হাঁড়িকুঁড়ি বানায়; নাপিত; ধোপা—সে কাপড় ধুয়ে দেয়; স্যাকরা; কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবি—কোথাও বা সে স্যাকরার দবদলে আবার কোথাও বা পাঠশালার পণ্ডিতের বদলে থাকে। এই জনা বারো মানুষ পুরো যৌথ-সমবায়টির খরচে প্রতিপালিত হয়। জনসংখ্যা বেড়ে গেলে খালি জমিতে পুরোনো পরিকল্পনা অনুসারে নতুন একটি যৌথ-সমবায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো ব্যবস্থার মধ্যেই একরকম শ্রমবিভাগ দেখা যায়, কিন্তু এখানে কারখানা-শিল্পের (manufacture) মতো শ্রমবিভাগ অসম্ভব; কেননা, (এখানে—যৌথ-সমবায়গুলিতে) কামার বা ছুতোরের বাজার অপরিবর্তনীয় থেকেছে, বড়ো জোর কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রামগুলির আয়তনের উপর নির্ভর করে একের বদলে দুই বা তিনজন করে এ-রকম কামার বা ছুতোর থাকে। যৌথ-সমবায়ের মধ্যে যে-নিয়ম অনুসারে শ্রমবিভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় তা প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অমোঘ; অপরপক্ষে কামার বা ছুতোর ধরনের প্রতিটি কারিগরই নিজের কারখানায় চিরাচরিত পদ্ধতিতে উক্ত কাজের পক্ষে প্রয়োজনীয় পুরো ক্রিয়াটি একাই করে যায়, তাদের মাতাহ্র উপর এ-ব্যাপারে হুকুম দেবার কেউই নেই। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ যৌথ-সমবায়গুলি—যেগুলি থেকে একই রূপে নতুন যৌথ-সমবায়ের জন্ম হয় এবং যেগুলি দৈবাৎ বিনষ্ট হলে একই জায়গায় এবং একই নাম নিয়ে যেগুলি আবার গজিয়ে ওঠে—এগুলির মধ্যের উৎপাদন-সংগঠনের সারল্যই এসিয়াটিক সমাজের অপরিবর্তনীয়তাকে বোঝবার ব্যাপারে মূলসূত্র; এসিয়ায় রাষ্ট্রের ক্রমাগত উত্থান-পতনের এবং এসিয়াটিক সাম্রাজ্যের ক্রমাগত ধ্বংস ও পত্তনের পাশাপাশি গ্রামগুলির ওই অপরিবর্তনীয়তা অত্যন্ত প্রকট ভাবেই চোখে পড়ে। রাজনৈতিক আকাশের ঝোড়ো মেঘ সত্ত্বেও সমাজের মূল অর্থনৈতিক উপাদানগুলির কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে।

মার্ক্‌স্‌-বর্ণিত এই কৃষিমূলক গ্রামসমবায়গুলি সমাজ-ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে ঠিক কোন পর্যায়ে পড়ে তা নিয়ে গবেষণা করবার প্রয়োজন আছে। কেউ কেউ মনে করেন(২২০), এখানে মার্ক্‌স্‌ ট্রাইব্যাল-পর্যায়ের গ্রামগুলিরই বর্ণনা দিচ্ছেন। এবং সে-কথা মনে করবার কারণও আছে। কেননা, এই বর্ণনার কিছু আগে মার্ক্‌স্‌ বলছেন(২২১):

Co-operation, such as we find it at the dawn of human development, among races who live by the chase, or, say, in the agriculture of Indian communities, is based, on the one hand, on ownership in common of the means of production, and on the other hand, on the fact, that in those cases, each individual has no more torn himself off from the navel-string of his tribe or community, than each bee has freed itself from connection with the hive.

অর্থাৎ, মানব-উন্নতির শুরুর দিকে শিকারজীবী জাতিগুলির মধ্যে, বা, ধরা যাক, ভারতীয় গ্রামসমবায়গুলির কৃষিকর্মের ক্ষেত্রে, যে-সমবায় দেখা যায় তার ভিত্তিতে একদিকে হলো উৎপাদনের উপায়গুলির উপর যৌথ স্বত্ব এবং অপরদিকে হলো, এ-সমস্ত ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি ব্যক্তিই পুরো ট্রাইবের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্কে সংযুক্ত, যেমন কিনা প্রত্যেকটি মৌমাছিই মৌচাকের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।

মার্কস-এর এই উক্তিটি থেকেই বুঝতে পারা যায় তাঁর মতে ভারতীয় গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের চিহ্ন কতো স্পষ্ট। কিন্তু তাই বলে, এগুলিকে শুধুমাত্র বা পুরোপুরি ট্রাইব্যাল মনে করলেও ভুল করা হবে। কেননা, মার্কস ও এঙ্গেলস ট্রাইব্যাল সমাজে যে সরল, সহজ জীবনীশক্তির পরিচয় দেখছেন এই গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে তার একান্ত অভাব। আমরা বলতে চাইছি, ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপের পরিণাম হিসেবেই যেহেতু এই গ্রাম-সমবায়গুলি গড়ে উঠেছিলো সেইহেতু একদিকে যেমন এই গ্রাম-সমবায়ের মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের স্পষ্ট ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে অপরদিকে আবার দেখা যায় সেই ধ্বংসাবশেষগুলির ভিতর ট্রাইব্যাল-সমাজের প্রকৃত সঞ্জীবনীশক্তি মরে গিয়েছে—চিহ্নগুলির মূল তাৎপর্য পরিণত হয়েছে তার বিপরীতে। এই তফাতটা বোঝবার জন্যে প্রথমে দেখা যাক, মার্কস-এঙ্গেলস-এর মতে ট্রাইব্যাল সমাজের সহজ, সরল প্রাণশক্তির পরিচয়টা কী রকম; তারপর দেখা যাবে তাঁদেরই মতে ভারতীয় গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে সেই প্রাণশক্তির পরিচয় আছে কি না।
ট্রাইব্যাল-সমাজ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস(২২২) বলছেন:

And this gentile constitution is wonderful in all its childlike simplicity! Everything runs smoothly without soldiers, gendarmes or police; without nobles, kings, governors, prefects or judges; without prisons; without trials……There can be no poor and needy—the communistic household and the gens know their obligations toward the aged, the sick, and those disabled in war. All are free and equal–including women. …… And the kind of men and women that are produced by such a society is indicated by the admiration felt by all white men who came into contact with the uncorrupted Indians (আমেরিকার আদিবাসী), admiration of the personal dignity, straightforwardness, strength of character and bravery of these barbarians.
We have witnessed quite recently examples of this bravery in Africa. The Zulus a few years ago and the Nubians a few months ago—both of them tribes in which gentile institutions have not yet died out—did what no European army can do. ……This is what mankind and human society were, before class divisions arose. And if we compare their condition with that of the overwhelming majority of civilized people today, we will find an enormous gulf between the present-day proletarian and small peasant and the ancient free member of a gens.
This is one side of the picture. Let us not forget, however, that this organization was doomed to extinction. ……The power of these primordial communities had to be broken, and it was broken. But it was broken by influences which from the outset appear to us degradation, a fall from the simple moral grandeur of the ancient gentle society. The lowest interest—base greed, brutal, sensuality, sordid avarice, selfish plunder of common possessions—usher in the new, civilized society, class society; the most outrageous menas—theft, rape, deceit and treachery—undermine and topple the old, classless gentle society. And, the new society, during all the 2,500 years of its existence, has never been anything but the development of the small minority at the expense of the exploited and oppressed great majority; and it is so today more than ever before.

অর্থাৎ, শিশুসুলভ সারল্যময় এই জ্ঞাতিভিত্তিক সংগঠন সত্যিই অপরূপ। সিপাই নেই, পাইক নেই, পুলিশ নেই, সামন্ত নেই, রাজা নেই, রাজ্যপাল নেই, উজির নেই, কাজি নেই, কারাগার নেই, বিচারালয় নেই, সব কিছু ঘটে চলে সহজ সরলভাবে।…এখানে গরিব বা অভাবগ্রস্থ বলে কেউই থাকতে পারে না—বৃদ্ধ, অসুস্থ এবং যুদ্ধের দরুন যারা অক্ষম তাঁদের প্রতি কী কর্তব্য তা সাম্যবাদী পরিবার ও ‘গেন্‌’-এর জানা আছে। সকলেই স্বাধীন আর সমান—মেয়েরা পর্যন্ত।…নির্দোষ রেড-ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে যে-সব সাদা মানুষ সংস্পর্শে এসেছে তারা সকলেই এদের প্রশংসা করেছে—এই অসভ্য মানুষদের আত্মমর্যাদা, কুটিলতার অভাব, চরিত্রবল ও সাহস সম্বন্ধে প্রশংসা এবং এর থেকে বোঝা যায় ওই জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজ কোন ধরনের নরনারী তৈরী করেছে।
সম্প্রতি আমরা আফ্রিকায় এই বীরত্ব দেখতে পেয়েছি। বছর কয়েক আগে লুলু কাফিরেরা এবং মাস দুয়েক আগে নুবিয়ানরা—উভয় উপজাতির মধ্যেই জ্ঞাতিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এখনো টিকে আছে—যা করেছে, তা কোনো ইয়োরোপীয় সেনাবাহিনী করতে পারে না।…শ্রেণী-বিভাগ ফুটে ওঠবার আগে পর্যন্ত মানবজাতি ও মানবসমাজ এই রকমই ছিলো! এবং তাদের সঙ্গে আজকের সভ্য মানুষদের সবচেয়ে বিরাট অংশটির যদি তুলনা করা যায় তাহলে চোখে পড়ে, আধুনিক শ্রমিক ও কৃষকদের সঙ্গে সেই পুরানো ‘গেনস্‌’-এর স্বাধীন মানুষদের আকাশ-পাতাল তফাত।
এই হলো ছবিটির একপিঠ। কিন্তু ভুললে চলবে না যে এই সংগঠন ধ্বংস পেতে বাধ্য ছিলো।…এই আদিম যৌথ সম্প্রদায়গুলির শক্তি ভেঙে যাওয়া দরকার ছিলো, এবং তা ভেঙে গেলো। কিন্তু এমন প্রভাবের দরুন তা ভাঙলো যা শুরু থেকেই আমাদের কাছে অধঃপতন বলে প্রতীয়মান হয়—প্রাচীন জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজের সরল নৈতিক ঐশ্বর্য থেকে পতন। ঘৃণিত লোভ, পশুসুলভ ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, পঙ্কিল মাৎসর্য, স্বার্থপরভাবে যৌথ সম্পদকে লুঠ করা,–এই সব নীচ উৎসাহ ফুটে উঠলো, নতুন সভ্য সমাজে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে। চুরি, ধর্ষণ, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা—এই সব ঘৃণিত পদ্ধতিতে প্রচীন শ্রেণীহীন জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজকে দাবিয়ে দেওয়া ও ভাঙা হলো। এবং ওই নতুন সমাজটি—গত আড়াই হাজার বছর ধরে তার অবস্থিতির মধ্যে—সংখ্যাগরিষ্ঠদের শুষে সংখ্যাকনিষ্ঠদের উন্নতি ছাড়া আর কিছুই নয়—এবং আজকের দিনে তার এই রূপটি আগেকার যে-কোনো সমস্যের চেয়ে প্রকট।

মহাবস্তু অবদান প্রভৃতি আমাদের দেশের প্রাচীন পুঁথিতেও এ-স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায় যে প্রীতির সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত এক প্রাচীন-সমাজের ধ্বংস্তুপের উপরই শ্রেণীবিভক্ত সভ্য-সমাজ গড়ে উঠেছে। এই সভ্য সমাজের শাসক সম্প্রদায়ের কাছে এঙ্গেলস-বর্ণিত চুরি, ধর্ষণ, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতিই যে আদর্শ কূটনীতি বলে স্বীকৃত হয়েছিলো তার প্রমাণও আমরা কৌটিল্যের রচনা থেকেই পেয়েছি। এবং ওই “সহজ সরল নৈতিক ঐশ্বর্যপূর্ণ” মানুষদের ট্রাইব্যাল সমাজ একেবারে সাম্প্রতিক যুগেও আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। সে-মানুষদের বীরত্বের পরিচয় আমাদের অত্যন্ত সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসেও বারবার পাওয়া গিয়েছে। এদের প্রসঙ্গেই জনৈক বিখ্যাত ইংরেজ আমলা(২২৩) লিখছেন:

The very officers who have had to act most sharply against them speak most strongly, and often not without a noble regret and self-reproach, in their favour. ‘It was not war’, Major Vincent Jervis writes of the operations against the Santals in 1855. ‘They did not understand yielding ; as long as their national drums beat, the whole party would stand, and allow themselves to be shot down. They were the most truthful set of men I ever met’.
যে-অফিসারেরা এদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নির্মম ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরাই আবার এদের পক্ষে সবচেয়ে জোর দিয়ে কথা বলেছেন,–এই উক্তিগুলিতে প্রায়ই এদের প্রতি শ্রদ্ধা ও নিজেদের বিরুদ্ধে তিরস্কারের ভাব থেকেছে। ১৮৫৫-এ সাঁওতালদের বিরুদ্ধে অভিযান বর্ণনায় মেজর ভিনসেণ্ট জার্ভিস বলছেন, ‘একে যুদ্ধ বলে না। সম্পর্পণ বলতে কী বোঝায় ওরা তা জানে না। যতোক্ষণ ওদের জাতীয় ঢাক বেজে চলবে ততোক্ষণ পুরো দলটা সোজা হয়ে থাকবে এবং গুলি খেয়ে মরতে রাজি হবে। আমি জীবনে এ-রকম সত্যনিষ্ঠ মানুষ আর কখনো দেখিনি।’

ট্রাইব্যাল-সমাজের ওই প্রাণশক্তির দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে এঙ্গেলস(২২৪) বলছেন, তারই স্পর্শ পেয়ে রোমান-যুগের পাঁক থেকে মুমূর্ষু ইয়োরোপীয় সভ্যতা পুনরুজ্জীবন লাভ করেছিলো :

What was the mysterioys charm with which the Germans infused new vitality into dying Europe?…It was not their specific national qualities that rejuvenated Europe, however, but simply—their barbarism, their gentile constitution. Their personal efficiency and bravery, their love of liberty, and their democratic instinct which regarded all public affairs as its own affairs, in short all those properties which the Romans had lost and which were alone capable of forming new states and raising new nationalities out of the muck of the Roman world—what were they but characteristic marks of the barbarians in the upper stage, fruits of the gentile constitution?……All that was vital and life-bringing in what the Germans infused into the Roman world was barbarism.

বর্তমানে আমাদের কাছে প্রশ্ন হলো, মার্কস ওই যে ভারতীয় গ্রাম-সমবায়ের বর্ণনা দিয়েছেন তা কি এই জাতীয় ট্রাইব্যাল-সমাজেরই বর্ণনা? আমরা একটু আগেই দেখেছি, এই গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের চিহ্ন টিকে থেকেছে। কিন্তু তবুও এগুলিকে প্রকৃত ট্রাইব্যাল-সমাজের ওই প্রাণশক্তির একান্ত অভাব এই স্বয়ং-সম্পূর্ণ গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে। মার্কস(২২৫) বলছেন:

…We must not forget that these idyllic village communites, inoffensive though they might appear, had always been the solid foundation of Oriental despotism, that they restrained the human mind within the smallest possible compass, making it the unresisting tool of superstition, enslaving it beneath traditional rules, depriving it of all grandeur and historical energies…
We must not forget that this stagnatory, undignified and vegetative life, that this passive sort of existence evoked on the other part, in contradistinction, wild, aimless, unbounded forces of destruction and rendered murder itself a religious rite in Hindostan. We must not forget that these little communities were contaminated by distinctions of caste and by slavery, that they subjugated man to external circumstances instead of elevating man the sovereign of circumstances, that they transformed a self-developing social state into never changing natural destiny, and thus brought about a brutalizing worship of nature, exhibiting its degradation in the fact that man, the sovereign of nature, fell down on his knees in adoration of Hanuman, the monkey, and Sabbala, the cow.

ভোলা চলবে না, ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামগুলিকে যদিও দেখতে নিরীহ মনে হয় তবুও এগুলিই চিরকাল প্রাচ্য স্বৈরাচারের মজবুত বনিয়াদ ছিলো, এগুলিই মানব-মনকে সংকীর্ণতম গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে করে তুলেছিলো কুসংস্কারের অবাধ হাতিয়ার, সাবেকী নিয়মের ক্রীতদাস, সব রকম গৌরব ও ঐতিহাসিক শক্তি থেকে বঞ্চিত।
ভোলা চলবে না, এই থিতানো, মর্যাদাহীন, নিষ্কর্মা জীবন, এই নিষ্ক্রিয় সত্তা, অপর পক্ষে বিপরীত লক্ষণ হিসেবে জাগিয়ে তুলেছিলো ধ্বংসের উম্মত্ত, অন্ধ ও অসীম শক্তিকে—হিন্দুস্থানে এমন কি খুন করাকেও ধর্মকর্ম করে তুলেছিলো।
ভোলা চলবে না, এই ছোটো ছোটো সমবায়গুলি জাতিভেদ ও দাসপ্রথা দ্বারা কলুষিত ছিলো, মানুষকে পারিপার্শ্বিকের উর্ধ্বে তোলবার বদলে পারিপার্শ্বিকেরই ক্রীতদাস করে রেখেছিলো, স্বয়ং বিকাশমান সামাজিক অবস্থাকে প্রাকৃতিক নিয়তির সামিল করে তুলেছিলো আর এইভাবে পাশবিক প্রকৃতিপূজার জন্ম দিয়েছিলো—অধঃপতন যে কতোখানি তা এই ঘটনা থেকেই বুঝতে পারা যায় যে মানুষ, যে হলো কিনা প্রকৃতিরাজ্যের রাজা, সেই হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা শুরু করলো হনুমান বলে বাঁদরের সামনে বা সব্বলা বলে গরুর সামনে।

মার্কস যেগুলিকে ভিলেজ-কমিউনিটি বা গ্রাম-সমবায় বলছেন সেগুলির মধ্যে তাঁর ধারণায় যদি মানুষের এ-জাতীয় মানসিক অধঃপতন ঘটে থাকে, যদি সেগুলি জাতিভেদ ও দাসপ্রথায় কলুষিত হয়ে থাকে, তাহলে সেগুলিকে প্রকৃত ট্রাইব্যাল-সংগঠনের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা ভুল হবে। অথচ, আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি, এই গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের চিহ্ন যে নেই তাও ঠিক নয়। তাই আমরা বলতে চাইছি, ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য ওই গ্রাম-সমবায়গুলিকে ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করবে সুযোগ রয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষগুলির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের আদি তাৎপর্য অবশ্যই বিপরীতে পর্যবসিত হয়েছিলো : ট্রাইব্যাল-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিলো জীবনের সহায় এই গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে তাই হয়ে দাঁড়ালো জীবনের অন্তরায়।

===========
১৯৩. M. Wilks HSSI.
১৯৪. G. Campbell MI.
১৯৫. H.S. Maine VCEW.
১৯৬. Ibid 51.
১৯৭. G.W.F. Hegel PH 161.
১৯৮. “গণ-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ : গ্রাম-সমবায়” অধ্যায়ে হেগেলের উদ্ধৃতি দ্রষ্টব্য।
১৯৯. J.E.Lipps in GA (Ed. Boas) 516.
২০০. B.H. Baden-Powell IVC 4,5.
২০১. Ibid.
২০২. M. Wilks HSSI 114.
২০৩. Ibid 111.
২০৪. Ibid 112-13.
২০৫. A.B. Keith & A.A. Macdonell VI 2:214-5.
২০৬. IA-1910, 199-204 cf K.P. Jayaswal HP. 2:180.
২০৭. cf. Nilkantha, quoted by K.P. Jayaswal HP. 2:177.: “The King’s right is limited to the collection of tax therefrom. Therefore what is technically called at present as ‘gift of land’ etc. (by the king) does not mean giving away of land but a mere creation of allowance.”
২০৮.
২০৯. K.P. Jayasawal HP 2:181.
২১০. R.P Dutt IT 215ff.
২১১. K.P. Jayasawal op. cit. 2:181
২১২. Ibid 2:174ff.
২১৩. Ibid 2:180.
২১৪. Ibid 2:345.
২১৫. Ibid 2:181.
২১৬. Ibid.
২১৭. B.H. Baden-Powel IVC 5.
২১৮. G.W.F. Hegel PH 161.
২১৯. K. Marx C 357-8.
২২০. SAGS 151 থেকে অনুমান হয় অধ্যাপক জর্জ টমসনেরও খানিকটা যেন এই রকমেরই মত।
২২১. K. Marx C 334.
২২২. F. Engels OFPPS 160.
২২৩. W. W. Hunter IGI 4:192.
২২৪. F. Engels op. cit. 254-6.
২২৫. K. Marx BRI.