অতিকথার বিড়ম্বনা
বিঘ্নরাজকে সিদ্ধিদাতা সাজাতে হলে তাঁর একটা জমকালো জন্মকথার দরকার পড়ে। এ-চাহিদা মেটাতে গিয়ে পুরাণকারেরা রীতিমতো হিমশিম খেয়ে গিয়েছেন। তাই, আলফ্রেড ফুসে(৭৫) বলছেন, এবং ঠিকই বলছেন, গণেশের জন্মবৃত্তান্তগুলির মধ্যে অসঙ্গতি এবং বিশেষ করে অসংলগ্ন থেকেই প্রমাণ হয় এগুলি উত্তরযুগের নতুন পরিস্থিতির চাহিদা মেটাবার জন্যেই উদ্ভাবিত হয়েছে—যাঁরা উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁরা সামান্য ব্যক্তি ছিলেন না।
উপাখ্যানগুলির মধ্যে অসঙ্গতি এবং অসংলগ্ন যে কতোদূর তা কেনেডির(৭৬) ‘হিন্দু মাইথোলজি’ বা গোপীনাথ রাও-এর(৭৭) ‘হিন্দু আইকনোগ্রাফি’ দেখলেই বুঝতে পারা যাবে,—এঁরা উভয়েই বিভিন্ন পুরাণ থেকে এ-জাতীয় বহু উপাখ্যান সংকলিত করেছেন। আমাদের যুক্তির পক্ষে মাত্র কয়েকটি নমুনা উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট হবে।
কোনো পুরাণে(৭৮) লেখা আছে, একা শিব থেকেই গণেশের জন্ম। কোনো পুরাণে(৭৯) আবার লেখা আছে, একা পার্বতী থেকেই গণেশের জন্ম। অথচ এমন নয় যে, স্ত্রী-পুরুষে মিলন বাদ দিয়ে প্রজনন-সম্ভাবনাকে পুরাণকারেরা সত্যিই স্বাভাবিক মনে করতেন। তাই, এ-জাতীয় কাহিনী থেকেই প্রমাণ হয় যে, আভিজাতিক দেবলোকে গণেশের আবির্ভাব আর যাই হোক সহজ যা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
ওই অস্বাভাবিক ঘটনাটিকে স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন করবার একটা মস্ত অন্তরায় ছিলো গণেশের গজাননটি। তাই, গণেশের মাথা নিয়ে পুরাণকারদের মাথাব্যাথাও খুব কম নয়। এ-নিয়েও অনেক রকম অসংলগ্ন ও এলোমেলো কাহিনী পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণের গণেশখণ্ডে(৮০) লেখা আছে জন্মাবার পর শনির দৃষ্টিতে গণেশের মাথা উড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু একটি হাতির মাথা কেটে এনে নবজাতকের কাঁধের উপর এঁটে দেন। আবার স্কন্দপুরাণের গণেশখণ্ডে(৮১) লেখা আছে, সিন্দুর বলে এক দৈত্য পার্বতীর গর্ভে অষ্টম মাসের সময় প্রবেশ করে গণেশের মাথাটি কেটে দেয় এবং শিরহীন অবস্থায় জন্মার পর নারদের অনুরোধে গণেশ গজাসুরের মাথাটি কেটে নিজের স্কন্ধে যোজনা করেন—তার মানে, গণেশের গজাননটি তাঁর নিজস্ব নয়, গজাসুরের কাছ থেকে ধার করা। কিন্তু এ-বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্য পৌরাণিক কাহিনী(৮২) হলো, শিব ও পার্বতী একবার হাতির রূপে মৈথুন করেছিলেন—তাই ওই রকম গজানন সন্তানের জন্ম হয়।
কিন্তু এতোভাবে গণেশের জন্মকাহিনী রচনা করেও পুরাণকারেরা যেন কিছুতেই ভুলতে পারেন না যে, তাঁর জন্মের সঙ্গে একটা নোংরা কিছুর সম্পর্ক রয়েছে। তাই, তাঁকে পার্বতী-তনয় বলে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও এ-কথাও বলতে যেন দ্বিধা হচ্ছে যে, পার্বতীর গর্ভে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জন্ম হয়েছিলো। পুরাণকারেরা বারবার(৮৩) বলছেন, নিজের গায়ের নোংরা নিয়ে খেলা করতে করতে পার্বতী একটি কিম্ভুত-কিমাকার শিশুমূর্তি গড়ে তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত তারই মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে গণেশকে সৃষ্টি করেন।
আর একটি পুরাণ(৮৪) যেন আরো এক-পা এগিয়ে যেতে চায় এবং ওই আভিজাতিক দেবলোকে গণেশের আসল আবির্ভাব-কাহিনীকে প্রকাশ করে দেবার উপক্রম। এই কাহিনী অনুসারে পার্বতী বুঝি একবার স্নানের সময় গায়ে-মাখা তেলের সঙ্গে নিজের শরীরের নোংরা মেশান এবং মালিনী বলে গঙ্গাতীরবর্তী এক গজাননা রাক্ষসীকে এই উপাদেয় বস্তুটি খাওয়ান। তারই ফলে মালিনীর গর্ভে গণেশের জন্ম হয়। তারপর পার্বতী তাঁকে গ্রহণ করেন। এই উপাখ্যানটি চিত্তাকর্ষক। কেননা, এখানে স্পষ্টই বলে দেওয়া হচ্ছে যে, গণেশের জন্মটা আসলে দেবতাদের ঘরে নয়। দেবলোকে তাঁর স্থান পোষ্য-সন্তান হিসেবেই। কেবল এই উপাখ্যানে বলে দেওয়া হয়নি যে, পোষ্য-গ্রহণের আগে সংস্কার করবার দরকার হয়েছিলো—সেই সংস্কারের ফলেই রাক্ষসকুলজাত বিঘ্নরাজ দেবলোক-লালিত সিদ্ধিদাতায় পর্যবসিত হন।
গণেশ-সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনীগুলির মধ্যে আর এক রকম কাহিনীতে(৮৫) ওই বিঘ্ন-বিপর্যয়ের স্মৃতিটা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি, যদিও সে-স্মৃতি টিকে রয়েছে উল্টো হয়ে। কাহিনীটা হলো, ইন্দ্র প্রভৃতি আভিজাতিক দেবতারা একবার খুবই বিপদে পড়েছিলেন। তার কারণ, নারী ও শূদ্ররা দলে দলে সোমনাথ পাহাড়ে শিবের কাছে যাত্রা করেছিলো। এই নিকৃষ্টদের মিছিল দেখে দেবতারা বিশেষ শঙ্কিত হন। তাঁরা শিবের কাছে গিয়ে বললেন—প্রভু, ওদের এই মিছিল বন্ধ করবার জন্যে যা হোক একটা ব্যবস্থা করুন। শিব তাতে রাজি হলেন না। তাই, ইন্দ্রাদি দেবতারা গিয়ে পড়লেন পার্বতীর কাছে। পার্বতী নাকি এই মানবেতরদের মিছিলে বিঘ্ন সৃষ্টি করবার জন্যেই বিঘ্নেশ্বরকে সৃষ্টি করলেন।
পৌরাণিক সাহিত্যে এই কাহিনী বা এই জাতীয় কাহিনী একাধিকবার পাওয়া গেলেও এর মধ্যে বাস্তবের প্রতিবিম্ব যে উল্টো হয়ে পড়েছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। গণেশ-সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য থেকেই তা বুঝতে পারা যায়। আমরা আগেই দেখেছি, মনুর মতে গণেশ হলেন শূদ্রদের দেবতা। পরে, উচ্ছিষ্টগণপতির আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখতে পাবো, গাণপত্য সম্প্রদায়ের একটু মূল কথা হলো নারীজাতির সাম্য ও স্বাধীনতা। তাই এই গণেশই যে স্ত্রী-শূদ্রের বিরুদ্ধে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা সরাসরি স্বীকার করতে দ্বিধা হয়। ফলে, উক্ত পৌরাণিক কাহিনীর তাৎপর্য বুঝতে হলে মনে রাখা দরকার, শাসক-শ্রেণীর চেতনায় বাস্তবের প্রতিবিম্ব উল্টো হয়ে পড়ে(৮৬)। অর্থাৎ, এককালে বিঘ্ন সৃষ্টিই হলো গণেশের কাজ—কিন্তু সে-বিঘ্ন স্ত্রী-শূদ্রের বিরুদ্ধে নয়। যাজ্ঞবল্ক্যের বিনায়ক-বর্ণনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বুঝা যায় বিঘ্নটা আসলে কাদের বিরুদ্ধে।
এই প্রসঙ্গেই মনে রাখা দরকার, গণেশের বহু নামের মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক নাম হলো, দ্বিদেহক(৮৭)। অর্থাৎ, গণেশের দুটি স্বতন্ত্র দেহ। আর সত্যিই তাই। গণেশের সত্যিই দুটি দেহ—দুটি স্বতন্ত্র জন্ম, দুটি স্বতন্ত্র সত্তা। এক, বিঘ্নরাজ। দুই, সিদ্ধিদাতা। বিঘ্নরাজটা আগেকার। সিদ্ধিদাতাটা পরের যুগের।
———————-
৭৫. Introduction to A. Getty G xxi.
৭৬. Kennedy HM 353f.
৭৭. T. G. N. Rao EHI Vol. I Part I.
৭৮. বরাহপুরাণ। cf. H. Mitra in VQ-May 1935, 105.
৭৯. শিবপুরাণ, মৎসপুরাণ ও স্কন্দপুরাণ। cf. H. Mitra op. cit. cf. A. Getty G 5.
৮০. ERE 2:808.
৮১. বিশ্বকোষ ৫:২০২।
৮২. H. Mitra op. cit. 105. cf. A. Getty G 7; T. G. N. Rao EHI Vol. I. Part I.
৮৩. মৎস্যপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ইত্যাদি।
৮৪. ERE 2:808.
৮৫. A. Getty G 5.
৮৬. F. Engels AD 470-2.
৮৭. A. Getty G xxiv.