মার্কসবাদ ও দৃষ্টিদান
এতোক্ষণে আমরা অধ্যাপক জর্জ টমসনের পদ্ধতির মোটামুটি পরিচয় পেলাম।
অধ্যাপক জর্জ টমসন মার্ক্স্বাদী। অধ্যাপক-জীবনের প্রথমার্ধে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ হবার গৌরব পেলেও তিনি কেমনভাবে অধ্যাপক-জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে গ্রীক সাহিত্য বোধবার প্রকৃত পথ খুঁজে পেলেন সে-অভিজ্ঞতার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
এই পথই হলো মার্কসবাদের পথ। গ্রীক সাহিত্য বিচারে তিনি যে-পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন সে-পদ্ধতি হলো প্রাচীন দলিলগুলির উপর মার্কসীয় মূলসূত্রের প্রয়োগ। অবশ্যই, অধ্যাপক জর্জ টমসন আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ হেনরি লুইস মর্গানের গবেষণার উপরও নির্ভরশীল। এবং মর্গানকে নিশ্চয়ই কার্ল মার্কস-এর অনুগামী বলা চলে না, কেননা, সমসাময়িক হলেও মার্কস-এর রচনাবলীর সঙ্গে মর্গানের পরিচয় ছিলো না(১২৮)। তবুও মর্গান তাঁর নিজের পথে অগ্রসর হয়েও, এবং তাঁর নিজের গবেষণার সংকীর্ণ ক্ষেত্রটিতে স্বতন্ত্রভাবে, যে-সব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তার সঙ্গে মার্কস-এর সিদ্ধান্তের বিরোধ তো নেই-ই, এমনকি আশ্চর্য মিল থেকে গিয়েছে! তাই এঙ্গেল্স্(১২৯) বলছেন :
Morgan rediscovered in America, in his own way, the materialist conception of history that had been discovered by Marx forty years ago, and in his comparison of barbarism and civilization was led by this conception to the same conclusions, in the main points, as Marx had arrived at.
অর্থাৎ, চল্লিশ বছর আগে মার্ক্স্ ইতিহাসের যে-বস্তুবাদী ব্যাখ্যা আবিষ্কার করেন, মর্গানও তাঁর নিজের পথে আমেরিকায় তার পুনরাবিষ্কার করেছিলেন। এবং বর্বরতার সঙ্গে সভ্যতার তুলনা করবার সময় এই ধারণার সাহায্যে তিনি যে-সব সিদ্ধান্তে উপনীত হন সেগুলি মূলত মার্ক্স্-এর সিদ্ধান্তও।
অবশ্যই, মার্কসবাদেরই একটি মূল কথা হলো, চরম সত্য বা শেষ সত্য বলে কিছুই বৈজ্ঞানিকভাবে সম্ভবপর নয়,(১৩০) কেননা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা দিনের পর দিন নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করে সত্যকে সম্বৃদ্ধ করে তোলে। ফলে, অধ্যাপক জর্জ টমসনের পক্ষে মর্গানের মূল সিদ্ধান্তগুলিকে গ্রহণ করাও যে-রকম তাঁর মার্ক্স্বাদেরই পরিচয় তেমনিই মর্গানের কোনো কোনো সিদ্ধান্তকে পরবর্তী যুগের গবেষণা-লব্ধ তথ্য সমৃদ্ধ ও সংশোধিত(১৩১) করবার চেষ্টাতেও মার্কসবাদ-বিরোধের কোনো পরিচয় নেই।
তাই, অধ্যাপক জর্জ টমসনের পদ্ধতি বলতে প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলির উপর মার্কসবাএর প্রয়োগ ছাড়া আর কিছুই বোঝা উচিত নয়। এইভাবে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যের উপর মার্কসবাদের মূল সিদ্ধান্তগুলির প্রয়োগ করে অধ্যাপক জর্জ টমসন মার্কসীয় বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধতর করেছেন। কেননা, মূর্ত প্রয়োগের সাহায্যেই মার্কসীয় মূল সিদ্ধান্তগুলির সমৃদ্ধি সম্ভবপর। মার্কসবাদ অনুসারে প্রয়োগ-নিরপেক্ষ জ্ঞান অর্থহীন ও অবান্তর।
অধ্যাপক টমসনের গবেষণা থেকে প্রেরণা পেয়ে আমরাও যে ভারতীয় দর্শনের একটি সমস্যার আলোচনা করবার চেষ্টা করেছি তার কারণ আমাদের ধারণাতেও মার্কসবাদের সাহায্য ছাড়া প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলির সাক্ষ্য সম্যকভাবে বুঝতে পারবার আর কোনো উপায় নেই। কেননা, পুরোনো পুঁথির তাৎপর্য স্পষ্ট হলেও অনেক সময় তা আমাদের চোখে পড়ে না। তার কারণ, আমাদেরই এক রকম অন্ধতা। একমাত্র মার্কসবাদের সাহায্যেই সে-অন্ধতা দূর করা সম্ভব।
এই কথাটা একটু ব্যাখ্যা করে বলা দরকার।
প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলি প্রায়ই আমাদের কাছে দুর্বোধ্য বলে প্রতীয়মান হয়। সে-দুর্বোধ্যতার নানা কারণ আছে। তার মধ্যে ভাষাগত কারণ নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভাষাগত কারণ ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে, কেননা, প্রাচীন-পুঁথিগুলি শুধুই যে প্রাচীন ভাষায় লেখা তাই নয়, এগুলির অন্তর্গত ধ্যানধারণাও প্রাচীন। এবং এইজাতীয় প্রাচীন ধারণার সঙ্গে আমাদের আধুনিক ধারণার অনেক সময় মৌলিক তফাত। ফলে, ভাষাগত সমস্যার সমাধান হবার পরও, ওই প্রাচীনকালের ধারণাকে সামনে পেয়ে আধুনিক বিদ্বানের পক্ষে তার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করবার সমস্যাটা বাকি থেকে যেতে পারে। এই কারণেই, প্রাচীন পুঁথি বোঝবার ব্যাপারে ভাষাতত্ত্বগত-ব্যুৎপত্তিই পর্যাপ্ত নয়।
এই রকমেরই একটা যুক্তি দেখিয়ে সেকালে অধিকার-ভেদের(১৩২) কথা বলা হতো। আর আমাদের বলবার কথাটিও শুরু ঠিক এইখান থেকেই। এবং ওই কথাটি পাড়বার আশাতেই আমরা ছান্দোগ্য-উপনিষদের একটি আপাত-অর্থহীন অংশের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি। সে-অংশের ভাষা অপেক্ষাকৃত সরল। কিন্তু শব্দার্থ পাবার পরও অংশটি অনেকাংশে দুর্বোধ্য বা অবোধ্য থেকে যায়।
কেননা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাচীনদের এই রচনাটি বোঝবার কোনো উপায় নেই। বুঝতে হলে প্রাচীনদের দৃষ্টিভঙ্গিটা গ্রহণ করবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা আধুনিক যুগে জন্মগ্রহণ করেছি, আধুনিক ধ্যানধারণায় লালিত হয়েছি—তার প্রভাব মুক্ত হয়ে প্রাচীনদের দৃষ্টিকোণটা গ্রহণ করবো কেমনে করে?
এই সমস্যারও সমাধান আছে। সমাধানটা বোঝবার জন্যে প্রধানত দুটি কথা মনে রাখা দরকার।
এক : মানুষের ধ্যানধারণা আকাশ থেকে জন্মায় না; সেগুলির উৎসে রয়েছে মানুষের বাস্তব সমাজ-জীবন। তাই প্রাচীনদের দৃষ্টিকোণটা বোঝবার ব্যাপার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশ পাওয়া যাবে প্রাচীন সমাজ-জীবন সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থেকেই।
দুই : কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাচীনকালের ঐ সমাজ-জীবন সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে কেমন করে? বহু শতাব্দী আগেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছেন। তাই, তাঁরা ঠিক কী ভাবে বাঁচতেন তা তো আর আমাদের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে জানা সম্ভবপর নয়। এ-বিষয়ে বড়ো জোর কিছুকিছু পরোক্ষজ্ঞান পাওয়া যায়। বহু শতাব্দীর সঞ্চিত ধুলো সরিয়ে তাঁদের কীর্তির কিছুকিছু চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেতে পারে এবং এই চিহ্নগুলি থেকে তাঁদের জীবনযাপন সম্বন্ধে কিছু কথা অনুমান করতে পারা অসম্ভব নয়। তাছাড়া, প্রাচীনেরা যে-সব সাহিত্যাদি রচনা করে গিয়েছেন সেগুলি থেকেও তাঁদের সমাজ-জীবনের কিছুটা চিত্র খুঁজে পাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভবপর।
কিন্তু প্রত্নতত্ত্বমূলক উপাদানই হোক আর সাহিত্যিক উপাদানই হোক—শেষ পর্যন্ত তা পরোক্ষ। তাই, প্রত্যক্ষভাবে প্রাচীন সমাজকে চেনবার যদি কোনো পথ থাকতো তাহলে এই পরোক্ষ উপাদানগুলিকে তারই আলোয় আরো স্পষ্টভাবে, আরো নির্ভুল ও নিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করবার উপায় পাওয়া যেতো।
এবং ঠিক এইখানেই হেনরি লুইস মর্গানের গবেষণা সত্যিই যুগান্তকারী। মর্গানের আবিষ্কারের একটা কথা হলো, আমাদের পক্ষে আজো ওই প্রাচীন সমাজকে স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া সম্ভব। অনেক শতাব্দী আগেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঠিক কী ভাবে জীবন-যাপন করতেন তা আজকের দিনেও আমাদের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে জানবার একটা উপায় রয়েছে। আর, মর্গানের এই দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সাহায্যেই প্রত্নতত্ত্বমূলক বা সাহিত্যমূলক ওই পরোক্ষ দলিলগুলিকে আরো নির্ভরযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করবার অবকাশ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তাই, মর্গানের মূল দাবিটিকে ভালো করে বোঝা দরকার।
সারা পৃথিবীর বুক জুড়ে সমস্ত মানুষের উন্নতিই সমান তালে হয়নি। কোথাও বা মানুষ এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূরে, কোথাও বা মানুষ পড়ে রয়েছে অনেকখানি পিছনে। এবং মর্গান দাবি করলেন, ওই পিছিয়ে-পড়া মানুষদের বাস্তব অবস্থাকে পরীক্ষা করলে এগিয়ে-যাওয়া মানুষদের অতীত ইতিহাসটিকেও দেখতে পাওয়া যাবে। তার কারণ, মানুষের পক্ষে এগিয়ে চলবার পথে একের পর এক যে-সব পর্যায় সেগুলির মধ্যে স্বাভাবিক ও অনিবার্য পারস্পর্য রয়েছে। মর্গানের ভাষায়, natural as well as necessary sequence of progress(১৩৩)। যেন একের পর এক কয়েকটি নির্দিষ্ট ও অনিবার্য ধাপ বেয়ে এগোবার চেষ্টা—যেখানেই মানুষ এগিয়েছে সেখানেই এই ধাপগুলি ভেঙে এগোতে হয়েছে, যেখানে এগোতে পারে নি সেখানে ওই ধাপগুলির কোনো-না-কোনো একটি ধাপে আটকে রয়েছে আর সেই জন্যেই যারা এগোতে পারে নি তাদের দিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায় যারা এগিয়ে গিয়েছে তারা ঠিক কোন কোন ধাপ ভেঙে এগিয়েছে।
এই ধাপগুলি ঠিক কী কী? কোন পথে এগিয়ে, ঠিক কোন কোন পর্যায় পার হয়ে, মানুষ শেষ পর্যন্ত সভ্যতার স্তরে উঠে এলো? মর্গানের পরিভাষা অনুসারে সভ্যতার স্তরে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত মানুষের অবস্থাকে মোটের উপর দুটি অংশে ভাগ করা যায় : বন্য-দশা (savagery) ও বর্বর-দশা (barbarism)। এই দুটি দশারই আবার স্তরবিভাগ রয়েছে : নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ। অর্থাৎ মানুষ শুরু করেছে নিম্ন-বন্য-দশা থেকে, তারপর এগিয়ে এসেছে মধ্য-বন্য-দশায়, তারপর উচ্চ-বন্য-দশায়। তারপর মানুষ বন্য-দশা ছেড়ে বর্বর-দশায় উঠে এসেছে : প্রথমে নিম্ন-বর্বর-দশা, তারপর মধ্য-বর্বর-দশা, তারপর উচ্চ-বর্বর-দশা। আর, তারপর মানুষ বর্বর-দশা ছেড়ে সভ্যতার আওতায় এসে পৌঁছেছে।
এই সব বিভিন্ন পর্যায়ের পরিচয় কী কী রকম সে-আলোচনায় পরে ফিরতে হবে। আপাতত মর্গানের মূল যুক্তিটির অনুসরণ করা যাক। মর্গান বলছেন, আজকের পৃথিবীতে এমন কোনো মানবদলের পরিচয় অবশ্যই পাওয়া যায় না যারা একেবারে নিম্ন-বন্য-দশায় পড়ে রয়েছে। কিন্তু মধ্য-বন্য-দশায় নানা দলকে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
আবিষ্কৃত হবার সময় পলিনেশিয়া আর অস্ট্রেলিয়ার উপজাতিরা ছিলো মধ্য-বন্য-দশায়।
আমেরিকার ‘হাডসন-বে টেরিটরি’ ও ‘কলম্বিয়া উপত্যকা’র নানান উপজাতিরা ছিলো উচ্চ-বন্য-দশায়।
মিসিসিপি নদীর পূব-কিনারায় রেড-ইণ্ডিয়ানরা ছিলো নিম্ন-বর্বর-দশায়।
নিউ মেক্সিকো, মেক্সিকো, মধ্য-আমেরিকা ও পেরুর নানা উপজাতিদের দেখা গেলো মধ্য-বর্বর-দশায়(১৩৪)।
এরপর উচ্চ-বর্বর-দশার কথা। মর্গান বলছেন, সে-দশার পরিচয় পাওয়া যায় হোমারের যুগের গ্রীকদের মধ্যে, রোম স্থাপিত হবে মুখোমুখি সময়কার লাতিন জাতিগুলির মধ্যে এবং সিজারের সময়কার জার্মানদের মধ্যে। এই উচ্চ-বর্বর-দশার আওতা পেরিয়েই সভ্যতার শুরু। অতএব মর্গান সিদ্ধান্ত করছেন :
Commencing, then, with Australians and Polynesians following with the American Indian tribes, and concluding with the Roman and Grecian, who afford the highest exemplifications respectively of the six great stages of human progress, the sum of their united experiences may be supposed fairly to represent that of the human family from the Middle Status of savagery to the end of ancient civilization. Consequently, the Aryan nations will find the type of the condition of their remote ancestors, when in the Lower Status of barbarism, in that of the partially village Indians of America; and when in the Middle Status, in that of the Village Indians with which their own experience in the Upper Status directly connects. So essentially identical are the arts, institutions and mode of life in the same status, upon all the continents, that the archaic form of the principal domestic institutions of the Greeks and Romans must even now be sought in the corresponding institutions of the American aborigines,……
In studying the condition of tribes and nations in these several ethnical periods we dealing, substantially, with the ancient history and condition of our own remote ancestors.(১৩৫)
অর্থাৎ, মানুষের অগ্রগতির ছ’টি প্রধান স্তরের প্রকৃষ্টতম নিদর্শন পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয় ও পলিনেশিয়দের থেকে শুরু করে আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ানদের অনুসরণ করে রোমান ও গ্রীকদের কথায় শেষ করলে; এদের মিলিত অভিজ্ঞতাকে মধ্য-বন্য-দশা থেকে শুরু করে প্রাচীন সভ্যতার শেষ পর্যন্ত মানবগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার পরিচায়ক বলা যায়। অতএব আর্যজাতিগুলি তাদের সুদূর পূর্বপুরুষদের বন্য-দশার অবস্থাটা দেখতে পাবে আমেরিকার আংশিকভাবে গ্রামবাসী রেড-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে; মধ্য-বর্বর-দশার অবস্থাটা দেখতে পাবে গ্রামবাসী রেড-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে—এদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর্যজাতিগুলির উচ্চ-বর্বর-দশার অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। সমপর্যায়ের মানুষদের মধ্যে শিল্প, সমাজ-সংগঠন ও জীবন-যাপন পদ্ধতি সমস্ত মহাদেশের বেলাতেই এমন মৌলিকভাবে অভিন্ন যে, গ্রীক ও রোমানদের গার্হস্থ্য-ব্যবস্থার আদিম রূপটিকে এখনো খুঁজতে হবে আমেরিকার আদিবাসীদের অনুরূপ ব্যবস্থার মধ্যে…
নৃতত্ত্বমূলক এই বিভিন্ন পর্যায়গুলিতে যে-সব বিভিন্ন জাতি-উপজাতি রয়েছে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা নিজেদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন ইতিহাস এবং অবস্থার কথাও পর্যালোচনা করবো।
তাই, আদিবাসী-সংগ্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য আহরণের কাজে নিজের প্রায় পুরো জীবনটিকে উৎসর্গ করে হেনরি লুইস মর্গান প্রাচীন সাহিত্যের তোরণদ্বার খোলবার চাবিকাঠি আমাদের হাতে দিয়ে গিয়েছেন।
মর্গানের এই মূল সিদ্ধান্তগুলি মরে রেখে প্রাচীন যুগের ইতিহাস-রচনা সংক্রান্ত সাধারণ সমস্যার আলোচনায় ফিরে আসা যাক।
পিছিয়ে-পড়া মানুষদের দিকে এইভাবে চেয়ে দেখলে যদি সত্যিই এগিয়ে-যাওয়া মানুষদের অতীত ইতিহাসটাকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারা সম্ভবপর হয় তাহলে প্রাচীন ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রত্নতত্ত্বমূলক ও সাহিত্যমূলক পরোক্ষ উপাদানগুলিকে এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের আলোয় যাচাই করে নিলে নিশ্চয়ই আমাদের সিদ্ধান্ত অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হবে।
অধ্যাপক জর্জ টমসন(১৩৬) তাই বলছেন, পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব—বিজ্ঞানের এই দুটি শাখার মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। নৃতত্ত্বের সাহায্য পুরাতত্ত্বের আবিষ্কারকে কী ভাবে বুঝতে পারা সহজসাধ্য হয় তিনি তার একটি নমুনা দিচ্ছেন। পুরাতত্ত্ববিদেরা মাটি খুঁড়ে প্রাচীন ড্যানিউব-সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটি তথ্য আবিষ্কার করলেন : দেখা গেলো সে-সংস্কৃতির মানুষেরা অনেকখানি এলাকা জুড়ে একের পর এক বাসস্থান গড়ে তুলেছিলো, কিন্তু কোনো বাসস্থানেই তারা বেশিদিন ধরে একটানা বাস করে নি। ঘটনাটির ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে আফ্রিকার নানা জায়গায় আজো যে-সব আদিবাসীরা রয়েছে তাদের কাছ থেকে। তারা আবাদী জমির পাশে বাসস্থান গড়ে এবং যতোদিন পর্যন্ত না জমির উর্বরতা একেবারে উজোড় হয়ে যায় ততোদিন তারা সেইখানেই চাষবাস করে। তারপর তারা সেই বাসস্থান পরিত্যাগ করে চলে যায়; অন্যত্র নতুন বাসস্থান গড়ে তোলে।
অবশ্যই, গর্ডন চাইল্ড(১৩৭) প্রমুখ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, পুরাতত্ত্বের সঙ্গে এইভাবে নৃতত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়া প্রাচীন মানুষদের সমাজ-জীবন ও ধ্যানধারণার কথা অনুমান করবার চেষ্টা সঙ্গত নয়। সমস্যাটা কী, এবং এঁদের আপত্তিটা ঠিক কেন প্রথমে তাই দেখা যাক। ধরুন, পুরাতত্ত্বের গাঁইতি এক জায়গায় দশ হাজার বহচর আগেকার কোনো একদল মানুষ সম্বন্ধে এমন চিহ্ন আবিষ্কার করলো যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় তাদের জীবন-যাপন নির্ভর করতো শিকারের উপর। এদিক, নৃতত্ত্ববিদ সংবাদ দিলেন শিকারজীবী মানুষের দল আজো পৃথিবীর এখানে-ওখানে টিকে রয়েছে এবং তাদের সমাজ-সংগঠন ও ধ্যানধারণা সংক্রান্ত তথ্য প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে কি এ-কথা দাবি করা সঙ্গত হবে যে, ওই দশ হাজার বছর আগেকার মানুষদের সমাজ-জীবন ও ধ্যানধারণা আজকের এই মানুষদের অনুরূপই ছিলো? গর্ডন চাইল্ড বলেছিলেন, এ-জাতীয় অনুমান সঙ্গত নয়। কেননা, আজকের ওই শিকারজীবীরা যদিও উৎপাদন-পদ্ধতির দিক থেকে অতোখানি পেছিয়ে পড়ে রয়েছে তবুও তাই বলে এ-কথা নিশ্চয়ই প্রমাণ হয় না যে, তাদের মানসিক বিকাশও ওই দশ হাজার বছর আগেকার মানুষদের মনোবিকাশের পর্যায়েই একেবারে নিশ্চল হয়ে গিয়েছে।
উত্তরে অধ্যাপক জর্জ টমসন(১৩৮) বলেছেন, তা নিশ্চয়ই হয়ে যায়নি। যে-সব মানুষেরা আজো উৎপাদন-পদ্ধতির দিক থেকে ওই রকমের পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে আটকে রয়েছে তাদের মানসিক পরিবর্তনও নিশ্চয়ই ঘটে চলেছে। কিন্তু এ-পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই ঘটেছে এবং সে-গণ্ডি নির্ভর করছে ঐ উৎপাদন-পদ্ধতির উপরই।
……the social institutions of these modern tribes have not remained stationary. They have continued to develop, but only the directions determined by the prevailing mode of production. This is the key to the problem. If, for example, we examine the Australian forms of tokenism, exogamy and initiation the Australian forms of totemism, exogamy, and initiation, and compare them with similar institutions elsewhere, we find that they are extraordinarily elaborate, pointing to a long period of development. But these are all institutions characteristic of a simple hunting economy. In other words, just as the economic development of these tribes is stunted, so their culture is ingrown. And consequently, while we cannot expert to find such institutions in Paleolithic Europe in the same form, we are likely to find them there in some form.
অর্থাৎ, এই সব আধুনিক উপজাতিগুলির সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেমে থাকে নি। সেগুলির বিকাশ ঘটে চলেছে, কিন্তু তা একান্তভাবেই প্রচলিত উৎপাদন-পদ্ধতিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত অভিমুখেই। এই হলো সমস্যাটিকে বোঝবার মূল কথা। যেমন ধরুন, আমরা যদি টোটেম-বিশ্বাস, বহির্বিবাহ ও দীক্ষার অস্ট্রেলিয়ায় প্রচলিত রূপগুলিকে বিশ্লেষণ করি এবং তার সঙ্গে অন্যত্র প্রচলিত অনুরূপ অনুষ্ঠানের তুলনা করি তাহলে দেখবো অস্ট্রেলিয়ার অনুষ্ঠানগুলি অসাধারণ রকমের ফাঁপানো-ফোলানো—তার থেকেই দীর্ঘ যুগ ধরে বিকাশের নির্দেশ পাওয়া যায়। অর্থাৎ কিনা, এই উপজাতিগুলির অর্থনৈতিক উন্নতি যে-রকম খর্ব সেই রকমই তাদের সংস্কৃতির বিকাশও অন্তর্মুখি। তাই, পুরোনো-পাথর যুগের ইয়োরোপে যদিও আমরা এই অনুষ্ঠানগুলিকে এই রূপেই আশা করতে পারি না তবুও সেগুলিকে কোনো-একরূপে খুঁজে পাবার আশা করতে পারি।
তাই, অধ্যাপক জর্জ টমসনের কাছে প্রাচীন ইতিহাস রচনার কাজে আদিবাসী সংক্রান্ত আধুনিক গবেষণা,—বিশেষ করে মর্গানের গবেষণা—এতো মূল্যবান হয়েছে। লোকায়ত-দর্শনের আলোচনায় আমাদের প্রধান সমস্যা অবশ্যই পুরাতত্ত্বমূলক আবিষ্কারকে নৃতত্ত্বে আলোয় বোঝবার সমস্যা নয়, তার বদলে প্রাচীন সাহিত্যের কিছুকিছু আপাত-দুর্বোধ্য নিদর্শনের তাৎপর্য নির্ণয় করবার সমস্যা। তবু, এই নিদর্শনগুলিও যেহেতু বহু পুরোনো যুগের স্মারক সেইহেতুই অধ্যাপক জর্জ টমসনের পদ্ধতি আমাদের প্রচেষ্টার পক্ষেও অমূল্য। অবশ্যই, আজকের দিনে পণ্ডিতমহলে নৃতত্ত্ব নিয়ে উৎসাএর অভাব নেই। কিন্তু বিদগ্ধ মহলের একজন দিকপাল হয়েও অধ্যাপক জর্জ টমসনের পক্ষে এইভাবে প্রাচীন ইতিহাসের ক্ষেত্রে নৃতত্ত্বের প্রয়োগে বৈশিষ্ট্য আছে। বৈশিষ্ট্যটি হলো, তাঁর বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, যার একটি পরিচয় হলো মর্গানের গবেষণাকে গ্রহণ করা। কেননা, সোভিএট ইউনিয়ন ও নয়া-গণতান্ত্রিক দেশগুলির বাইরে মার্কস-এর আবিষ্কারের মতোই মর্গানের আবিষ্কারও নিষিদ্ধ করা হয়ে রয়েছে(১৩৯)। মর্গানের বিরুদ্ধে এই প্রতিবন্ধের পরিচয় শুধু আজকের দিনেই নয়, তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পরেই তাঁর আবিষ্কারগুলি চেপে যাবার চেষ্টা করা হয়েছে(১৪০)। অধ্যাপক জর্জ টমসন দেখাচ্ছেন সমস্যাবিশেষের আলোচনায় মর্গানের আবিষ্কার অগ্রাহ্য করাই দরুনই রিভারস্, মেনিলাউস্কি প্রমুখের রচনায় নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান কী ভাবে প্রায় অজ্ঞানের কোঠায় পৌঁছেছে(১৪১)।
মর্গানের বিরুদ্ধে এই প্রতিবন্ধের কারণ ভালো করে বিশ্লেষণ করা দরকার। কোনো একজন বৈজ্ঞানিক আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রায় পুরো জীবনটা কাটিয়ে যদি তাদের সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। তাহলে আধুনিক বিদগ্ধ-সমাজ তাঁর প্রতি বিরূপ হবে কেন?
অবশ্যই, আদিবাসী-সংক্রান্ত তাঁর ওই গবেষণা শুধুমাত্র অসভ্য মানুষ সম্বন্ধেই আমাদের জ্ঞান দেয়নি, আমাদের নিজেদের অতীতটাকেও আমাদের চিনতে শিখিয়েছে। এবং আসল হ্যাঙ্গামাটা ঠিক এইখানেই : অতীতের উপর থেকে পর্দা সরালে শুধুমাত্র অতীতটুকুও চোখে পড়ে না—পাওয়া যায় এক ভবিষ্যতের নির্দেশও(১৪২)। কী ভাবে তাই দেখা যাক।
মর্গান আবিষ্কার করলেন, আধুনিক দাম্পত্য-সম্পর্ক, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা—মানবজাতির পক্ষে এগুলির কোনোটাই অপরিহার্য নয়। কেননা, প্রত্যেক জাতির জীবনেই এমন একটা যুগ গিয়েছে যখন তাদের মধ্যে এ-সব কিছুরই পরিচয় ছিলো না। বস্তুত, আজকের দিনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রভাব যতো প্রচণ্ডই মনে হোক না কেন, পৃথিবীর বুকে মানবজাতির পুরো জীবনটার তুলনায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের যুগটা চোখের পলকের মতো। তার প্রমাণ, মধ্য-বন্য-দশা থেকে শুরু করে মধ্য-বর্বর-দশা পর্যন্ত সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে যে-সব মানবদল এখনো টিকে রয়েছে তাদের জীবনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানবজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হতে পারে না। অতীতে যদি তার প্রভাব ছাড়াও জীবনধারণ সম্ভবপর হয়ে থাকে তাহলে ভবিষ্যতেও মানুষের পক্ষে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রভাব-মুক্ত হওয়া অসম্ভব কথা নয়। আর, ঠিক এই কথাটিই হলো মর্গানের গবেষণার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তিনি দেখলেন, বর্তমান যুগে এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বগ্রাসী প্রভাবে মানুষের জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন প্রাচীন পর্যায় আলোচনা করে তাঁর মনে এ-বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিলো যে মানুষ এগিয়ে চলবে—মানুষ চিরকাল এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলার ক্ষমতাই তাকে পশুর রাজ্য থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে এতো আশ্চর্য সভ্যতার আওতায়। তাই, ব্যক্তিগত সম্পত্তি আজ তার জীবনে যতো বাধাই সৃষ্টি করুক না কেন, সে-বাধা অলঙ্ঘনীয় নয়। অগ্রগতি অতীতের নিয়ম হয়েছে, অগ্রগতিই ভবিষ্যতের নিয়ম হবে। তাই মর্গান মানুষের সামনে যে-উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পেলেন সেখানে ব্যক্তিগত-সম্পত্তির গ্লানি নেই—সবাই সমান, সবাই স্বাধীন, মানুষে-মানুষে সত্যিই ভাই-ভাই ভাব। আর মর্গান চিনতেও পারলেন : এ-যেন সেই প্রাচীন সমাজেরই পুনরাবর্তন—কিন্তু ওই প্রাচীন পর্যায়ে নয়, উন্নত ও সমৃদ্ধ এক নতুন পর্যায়ে। ভবিষ্যতের ওই ছবিটি মর্গানের কাছে দিবাস্বপ্ন নয়, অতীত-অনুসন্ধানের অনিবার্য অনুসিদ্ধান্ত।
কিন্তু আজকের যুগে দিনের চিন্তা আর রাত্রির স্বপ্ন সবকিছুর উপরই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অমোঘ প্রভাব। এই আবহাওয়াতেই লালিত হয়েছে আধুনিক বিদ্বান-ব্যক্তিরাও। অতি বড়ো বিদ্বানের দৃষ্টিও তাই ভবিষ্যতের ওই ছবিটির দিকে যেতে চায় না। ফলে, অতীত সম্বন্ধেও এক আশ্চর্য অন্ধভাব!
প্রাচীন রচনাবলীর তাৎপর্য-নির্ণয় করা নিয়েই আমাদের সমস্যা। কিন্তু আমরা যতোদিন পর্যন্ত ওই অন্ধভাবের বশবর্তী হয়ে থাকবো ততোদিন পর্যন্ত এ-তাৎপর্য উদ্ধার করবার সম্ভাবনা থাকবে না। কেননা, অস্পষ্ট এক অতীতে রচিত বলেই এগুলির মধ্যে প্রাচীন-সমাজের বহু স্মৃতি থেকে গিয়েছে। সেগুলি বুঝতে হলে প্রাচীন সমাজকেও স্পষ্টভাবে চিনতে হবে। প্রাচীন সমাজকে যদি চিনতে হয় তাহলে পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সনাতন মনে করা চলবে না।
আমরা যে-অর্থে অন্ধভাবের কথা বলছি তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে কার্ল মার্কস-এর একটি চিঠি উদ্ধৃত করলে। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন মাউরের নামে জার্মান ঐতিহাসিক ও আইনবিদের গবেষণা-প্রসঙ্গে। এ-গবেষণার আলোয় দেখা গেলো জার্মান দেশে জমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিয়েছে অনেক পরের যুগে, এবং এমনকি আধুনিক যুগেও নানা জায়গায় প্রাচীন যৌথ-সম্পত্তির চিহ্ন টিকে থেকেছে। তাহলে, ব্যক্তিগত-সম্পত্তির বিরুদ্ধে অতি-আধুনিক সমাজতান্ত্রিক আয়োজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তির চিহ্নহীন অতি প্রাচীন ব্যবস্থার সাদৃশ্য রয়েছে; অতি প্রাচীনের মধ্যেই আবিষ্কার করা যাচ্ছে অতি-আধুনিককে এবং এই আবিষ্কারের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টার যোগাযোগ রয়েছে। মার্কস(১৪৩) বলছেন :
Owing to a certain judicial blindness, even the best minds fail to see, on principle, what lies in front of their noses. Later, when the time has come, we are surprised that there are traces everywhere of what we failed to see. The first reaction to the French Revolution and the Enlightenment bound up with it was naturally to regard everything as mediaeval, romantic, and even people like Grimm are not free from this. The second reaction to it is to look beyond the Middle Ages into the primitive age of every people — and this corresponds to the socialist tendency, though these learned men have no idea that they are connected with it. And they are then surprised to find what is newest in what is oldest, and even egalitarians to a degree which would have made Proudhon shudder.
অর্থাৎ, এক রকম আইনগত অন্ধতার দরুন এমনকি শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমানেরাও যা একেবারে নাকের গোড়ায় রয়েছে তা দেখতেই পান না। পরে, যখন সময় উপস্থিত হয়ে তখন, যে-সব চিহ্ন আমরা আগে দেখতে পাইনি সর্বত্র সেগুলিকে দেখে অবাক হয়ে যাই। ফরাসী বিপ্লব সম্বন্ধে এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত নবজাগরণের যুগের সম্বন্ধে, প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো মধ্যযুগীয় সবকিছুকেই সুন্দর মনে করায়; এবং গ্রীম্-এর মতো ব্যক্তিরাও এর প্রভাবমুক্ত নন। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হলো, মধ্যযুগ পেরিয়ে…প্রত্যেক জাতিরই আদিম যুগটির দিকে চেয়ে দেখা, এবং এ-চেষ্টা সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টারই অনুরূপ, যদিও এই দু’-এর মধ্যে যে কোনো সম্পর্ক আছে সে-সম্বন্ধে ওই সব বিদ্বান-ব্যক্তিদের কোনো ধারণাই নেই। তাঁরা তাই যা কিনা সবচেয়ে পুরোনো তারই মধ্যে যা হলো সবচেয়ে নতুন তাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে যান—এমনকি সাম্যবাদীদেরও এই দশা, ব্যাপারটা এতোই চরম যে প্রুধঁ-র মতো ব্যক্তিরও তা দেখে হৃৎকম্প হবে।
উদ্ধৃত অংশের বিশেষ করে তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
প্রথম, মার্কস একরকম আইনগত অন্ধতার কথা বলছেন : শ্রেণীসমাজের আবহাওয়ায় ব্যক্তিগত সম্পত্তিকেই মানুষ পরমপুরুষার্থ মনে করতে শিখেছে, তাই যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অভাব তা একেবারে নাকের গোড়ায় থাকলেও সাধারণত আমাদের চোখে পড়তে চায় না।
দ্বিতীয়ত, মার্কস বলছেন, প্রত্যেক জাতির আদিম যুগটির দিকে চেয়ে দেখা সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টারই অনুরূপ। তার কারণ, সমাজতন্ত্র এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রভাব থেকে মুক্ত হবার পথনির্দেশ দিচ্ছে এবং প্রত্যেক জাতিরই আদিম অবস্থার দিকে চেয়ে দেখলে দেখা যায় তখনো মানুষের সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সূচনা হয়নি।
আর, ঠিক এই কারণেই মার্কস বলছেন, যা-কিনা সবচেয়ে পুরোনো তারই মধ্যে, যা-হলো সবচেয়ে নতুন তাকে আবিষ্কার করতে পারা। মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে আধুনিক বলতে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা বা সাম্যবাদের আয়োজন। আদিম মানবসমাজও একরমের সাম্যসমাজ। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখতে হবে, মর্গানের সামনেও অতীতের উপর থেকে পর্দা সরে যাবার দরুনই এক ভবিষ্যতের চিত্র উন্মোচিত হয়েছিলো এবং সে-ভবিষ্যতের বর্ণনায় মর্গান বলেছিলেন : ‘সেই প্রাচীন সমাজের সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতাই আবার ফিরে আসবে উন্নততর এক পর্যায়ে’।
আমাদের বর্তমান আলোচনায় বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক হলো আধুনিক যুগের ব্যক্তিগত-সম্পত্তির প্রভাব-লালিত অন্ধতা প্রাচীন রচনাবলীর তাৎপর্য নির্ণয়ে কী রকম বাধা সৃষ্টি করে সে-সম্বন্ধে সচেতন হবার প্রয়োজনীয়তা তারই উদাহরণ হিসেবে মার্কস(১৪৪) বলছেন :
To show how much we are all implicated in this judicial blindness :…philologists of the force of a Grimm mistranslated the simplest Latin sentences…
E.g., the well-known passage in Tacitus: “arva per annos mutant et superest ager,” which means, “they exchange the fields, arva (by lot, hence also sortes [lot] in all the later law codes of the barbarians) and the common land remains over” (ager as public land contrasted with arva)–is translated by Grimm, etc. “they cultivate fresh fields every year and still there is always (uncultivated) land over!”
আমরা সবাই কী ভাবে এই আইনগত অন্ধতার বশ তাই দেখা যাক।…গ্রীম্-এর মতো অতো বড়ো ভাষাতত্ত্ববিদও সবচেয়ে সরল লাতিন বাক্যের ভ্রান্ত তর্জমা করেছেন। উদাহরণ : “arva per annos mutant et superest ager“—ট্যাসিটাসের এই বিখ্যাত অংশটির মানে হলো, “তারা লটারি করে জমি বদল করে এবং সাধারণের জমি বাকি থাকে”; গ্রীম্ প্রভৃতি এর তর্জমা করছেন, “তারা প্রতি বছর নতুন জমি চাষ করে এবং তবুও অনাবাদী জমি বাকি পড়ে থাকে”। (সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)।
প্রাচীন সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তার সাহায্য না নিয়ে প্রাচীন সাহিত্যের অর্থনির্ণয় করবার চেষ্টায় অতিবড়ো বিদ্বানেরাও কী রকম কাল্পনিক কথা বলতে পারেন তার একটি দৃষ্টান্ত ভারতীয় সাহিত্য থেকে এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। মহাভারতে বাহীকদের বর্ণনায়(১৪৫) ঘৃণাভরে বলা হয়েছে :
তস্মাত্তেষাং ভাগহরা ভাগিনেয়া ন সুনবঃ
অর্থাৎ এই নিমিত্তই তাহাদের পুত্রেরা ধনাধিকারী না হইয়া ভাগিনেয়গণই ধনাধিকারী হইয়া থাকে।
প্রাচীন সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্য অনুসারে এই উত্তরাধিকার ব্যবস্থা মাতৃ-প্রধান সমাজের স্বাভাবিক স্মারক বলে বুঝতে অসুবিধে হয় না। মহাভারতে বাহীকদের বর্ণনায় এই মাতৃপ্রধান্যের ইঙ্গিতও অস্পষ্ট নয়(১৪৬) এবং আজো ভারতের স্থানবিশেষে(১৪৭),—যেখানে মাতৃপ্রাধান সমাজের চিহ্ন আছে সেখানে,—এই জাতীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থাই দেখতে পাওয়া যায়। অথচ, মহাভারতের এই সরল তথ্যটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নীলকণ্ঠের মতো বিদ্বান-ব্যক্তিও কী রকম মনগড়া কথা বলছেন :
যদি অপি পুত্রী পুত্রঃ চ দ্বৌ অপি জারজৌ তথাপি পিতৃত্বে ইব মাতৃত্বে বিসংবাদীভাবাৎ দৌহিত্রঃ এব রিঞ্চ্ অহারী ভবতি ন পুত্রঃ ইতি ভাবঃ। যতঃ তে ভগিনীষু এব অপত্যানি জনয়ন্তি স্বাদারেষু অতঃ তেষাং ভাগিনেয়াঃ ভাগহরাঃ ইতি……
অর্থাৎ, যদিও পুত্রী ও পুত্র দুজনেই জারজ তথাপি পিতৃত্বের ন্যায় মাতৃত্বে বিসংবাদঅভাব হেতুম দৌহিত্রই ধনাধিকারী হয়, পুত্র নহে। যেহেতু তাহারা ভগিনীতেই অপত্য উৎপাদন করে, নিজেদের পত্নীতে নহে—সেই হেতু তাহাদিগের ভাগিনেয়গণই উত্তরাধিকারী হয়।
মার্কস যে-অন্ধতার কথা উল্লেখ করছেন এখানে তারই অনুরূপ অন্ধতার পরিচয়। এখানে এই অন্ধতা দূর করবার জন্যেই গ্রীকতত্ত্বের অতো বড় পণ্ডিত হয়েও অধ্যাপক জর্জ টমসন গ্রীক সাহিত্য বোঝবার তাগিদেই মার্কসবাদী হয়েছিলেন।
————–
১২৮. F. Engels OFPPS ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
১২৯. Ibid 7.
১৩০. F. Engels LF, AD ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।
১৩১. G. Thomson AA 421; SAGS 43; FP 43-4, ইত্যাদি।
১৩২. বেদান্তসার প্রভৃতি দ্রষ্টব্য।
১৩৩. H. L. Morgan AS 3.
১৩৪. Ibid 10-1, 56.
১৩৫. Ibid 17-8.
১৩৬. G. Thomson SAGS 34.
১৩৭. G. Childe MMH 51.
১৩৮. G. Thomson op. cit. 35.
১৩৯. Ibid 86.
১৪০. F. Engels OFFPPS 30.
১৪১. G. Thomson op. cit. 85-6.
১৪২. Ibid 57 : “To tell the whole story from beginning to end would not only reveal the present as a continuation of the past—it would lift the veil on the future. There’s the rub.”
১৪৩. K. Marx & F. Engels C 209.
১৪৪. Ibid.
১৪৫. কর্ণপর্ব ৩৪:১১৯।
১৪৬. তৃতীয় পরিচ্ছেদের “রাষ্টশক্তির আবির্ভাব” অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১৪৭. G. Thomson SAGS 155 : আমেরিকার ইরোকোয়া এবং ভারতের খাসিদের মধ্যে এই ব্যবস্থা প্রচলিত। অন্যান্য ভারতীয় দৃষ্টান্তের জন্য O. R. Ehrenfels-এর MI দ্রষ্টব্য।