গণেশ মানে কী?
এই সব নানান কারণে আমরা তেত্রিশকোটির মধ্যে বিশেষ করে গণপতিরই শরনাপন্ন হতে চেয়েছি।
কিন্তু গণেশ না হয়ে শিবও হতে পারতো, কৃষ্ণও হতে পারতো; হতে পারতো বুদ্ধ, হতে পারতো কপিল; এমনকি হতে পারতো স্বয়ং বৃহস্পতি—যাঁর নামের সঙ্গে লোকায়ত-দর্শনের যোগাযোগটা কিছুতেই ভোলা চলে না। কিন্তু এখানে খুবই আশ্চর্য ব্যাপার আছে—যেন, উপনিষদের ভাষায়, একবিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞানম্। এক গণেশের ইতিহাসকে খুঁজে পেলেই শিব, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, কপিল, বৃহস্পতি—অনেকেরই জন্মাদিরহস্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়া, ভারতীয় ঐতিহ্যের এমনই জটিলতা যে, গণেশের সঙ্গে শিবের আর কৃষ্ণের, কপিলের আর বুদ্ধের একাত্মভাব একাধিকবার ঘোষিত হয়েছে। বৃহস্পতির কথা তো আগেই বলেছি। ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয় বলছেন, “এখন আমরা গণদেবতা বলিতে শুধু গণেশকেই বুঝি। কিন্তু মহাদেবও গণেরই দেবতা। গণদেবতা অর্থাৎ সাধারণ লোকপূজ্য দেবতা(?)। মহাদেবেরই এক নাম গণেশ (বনপর্ব, ৩৯, ৭৯), তিনিই গণানাং পতিঃ (দ্রোণপর্ব, ২০১, ৪৮), তিনিই গণাধ্যক্ষ গণাধিপ (সৌপ্তিকপর্ব, ৭, ৮; শান্তিপর্ব, ২৮৪, ৭৬)। বিষ্ণুও গণদেবতা। তাই তাঁর নাম গণেশ্বর, লোকবন্ধু, লোকনাথ, ইত্যাদি (অনুশাসনপর্ব, ১৪৯, বিষ্ণু সহস্রনাম)। মহাদেবের প্রায় নামই বিষ্ণু সহস্রনামে দেখা যায়। যথা, ঈশান, স্থাণু, মহাদেব, রুদ্র, বৃষাকৃতি, লোকাধ্যক্ষ ইত্যাদি।(১৯) মনিয়ার উইলিয়ামসও(২০) বলছেন, মহাভারতের স্থানবিশেষে শিবের নাম গণাধিপতি বা গণেশ। বুদ্ধ আর কপিলের সঙ্গেও অন্তত এই রকমই নামের মাধ্যমেই গণেশের সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, গণেশের একটি নাম হলো বিনায়ক। এবং বিণায়ক বলতে বুদ্ধকেও বোঝায়, কপিলকেও বোঝায়।
তাই, গণপতির ইতিহাস একা গণপতিই ইতিহাস নয়। কিংবা, ঘুরিয়ে বললে হয়তো একথাও বলা যায় যে, এক গণপতিই নানা রূপে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের নানা জায়গা জুড়ে রয়েছেন।
ভারতীয় ঐতিহ্যের এতো সব জটিলতা সত্ত্বেও কিন্তু এতোটুকুও জটিলতা নেই গণেশের নামটা নিয়ে। অতুলচন্দ্র গুপ্ত(২১) মহাশয় যেমন বলছেন, “সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা বলে যে দেবতাটি হিন্দুর পূজা-পার্বণে সর্বাগ্রে পূজা পান, তাঁর গণেশ নামেই পরিচয় যে, তিনি ‘গণ’ অর্থাৎ জনসঙ্ঘের দেবতা। এ থেকে যেন কেউ অনুমান না করেন যে, প্রাচীন হিন্দুসমাজের যাঁরা মাথা তাঁরা জনসঙ্ঘের উপর অশেষ ভক্তি ও প্রীতিমান ছিলেন। যেমন তার সব সমাজের মাথা, তেমনি তাঁরাও সঙ্ঘবদ্ধ জনশক্তিকে ভক্তি করতেন না, ভয় করতেন!…গণশক্তির প্রতি প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার কর্তাদের মনোভাব কি ছিল। তা গণেশের নরশরীরের উপর জানোয়ারের মাথার কল্পনাতেই প্রকাশ।”
অতুলচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের ‘গণেশ’ বলে ওই ছোট্ট প্রবন্ধটি আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান মনে হয়েছে। তার প্রধান কারণ এই যে, তিনিই অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আমাদের স্মরন করিয়ে দিলেন, গণেশের প্রতি শাসক-সমাজের একালের মনোভাবটার সঙ্গে সেকালের মনোভাবের মিল নেই। আমরা একটু পরেই দেখবো, এই সূত্রটি আমাদের পক্ষে কতোখানি মূল্যবান।
কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, অতুলবাবুর প্রতিটি মন্তব্যই স্বীকারযোগ্য। প্রথমত, ‘গণ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ কী, এ-বিষয়ে দিকপাল ভারততত্ত্ববিদেরা বহু আলোচনা করেছেন—তাঁদের আলোচনা উপেক্ষা করে গণেশের ইতিহাস আলোচনা করা যায় না। দ্বিতীয়ত, গণেশের ওই গজাননটির কাহিনী সত্যিই অতো সহজ নয়। বিশেষ করে এই কারণে নয় যে, গণেশের চিরকালই এ-রকম হাতির মাথা ছিলো কিনা সন্দেহের কথা। বৈদিক সাহিত্যে গণপতির উল্লেখ আছে, কিন্তু তাঁর গজাননের উল্লেখ নেই(২২)। তান্ত্রিক সাহিত্যে গণেশের বহু চিত্তাকর্ষক নামের মধ্যে কয়েকটি নাম হলো : বৃষভধ্বজ, দ্বিজিহ্ব, বৃষকেতন ইত্যাদি(২৩)। এই জাতীয় নাম হাতির বদলে সাপ আর ষাঁড়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। খোদাইকরের ছেনি যদি গণেশকে দ্বিজিহ্বের রূপ দিতো তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর মূর্তিতে গজমূণ্ডের চিহ্ন থাকত না। বস্তুত, নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া কোনো কোনো গণেশমূর্তির(২৪) সঙ্গে হাতির মাথার সত্যিই কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি, নির্দিষ্ট কোনো রূপহীন শিলাখণ্ডকে আজো ভারতবর্ষের নানা জায়গায় গণেশ আখ্যা দেওয়া হয়(২৫)। আনন্দকুমার কুমারস্বামী(২৬) মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গজাননবিশিষ্ট গণেশের এই মূর্তিটি ভারতবর্ষ বহুলভাবে প্রচলিত হতে শুরু করেছে শুধু গুপ্তযুগ থেকেই। এই সব নানা কারণে আমাদের সন্দেহ হয় গণেশের ওই হাতির মাথার মধ্যে অনেক রকম খবর লুকোনো আছে তার তাই এ-বিষয়ে কোনো একটা মতবাদকে তাড়াতাড়ি মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা হয়।
তৃতীয়ত, অতুলচন্দ্র গুপ্ত মহাশয় বলছেন, গণেশ নামেই পরিচয় যে, তিনি গণ অর্থাৎ জনসঙ্ঘের দেবতা। কিন্তু এখান দেবতা কথাটিতে উত্তরযুগের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ঠিক কতোটুকু বর্তমা তাও ভেবে দেখা দরকার। বাজসনেয়ী সংহিতায় যিনি গণপতি তাঁর মধ্যে আধুনিক অর্থে দেবভাব একান্তই আছে কিনা তা ভেবে দেখবার কথা। মনিয়ার উইলিয়ামস-এর(২৭) মতে সেখানে গণপতি বলতে একদল মানুষের বা কোনো এক গোষ্ঠীর নেতামাত্রই বুঝিয়েছে। এবং, তাঁর ধারণায় ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে গণপতি বা ব্রহ্মণস্পতি নামের তাৎপর্যও আলাদা নয়। বরাহমিহিরও(২৮) গণনায়ক শব্দটিকে ঠিক এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন। মনে রাখা দরকার, গণেশেরই অপর নাম হলো গণনায়ক এবং নায়ক মানে নেতা। গণেশের দেবত্বের অভাব আরো স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে অন্য একটি নামের মধ্যে। উইলসন(২৯) বলছেন, গণেশের একটি নাম শুধু গণ। তান্ত্রিক সাহিত্যেও(৩০) এ-কথার নজির রয়েছে। এবং গণ বলতে যাই বোঝাক না কেন, দেবতা বোঝাবার কোনো কারণ নেই। তার মানে, এমনটা হওয়া নিশ্চয়ই অসম্ভব নয় যে, শুরুর যুগে গণেশ আধুনিক অর্থে দেবতা ছিলেন না।
আপত্তি তুলে হয়তো বলা হবে, নামে কিছুই আসে যায় না। গণেশ হলেন সিদ্ধিদাতা দেবতা—তা তাঁকে গণপতিই বলা হোক বা গণনায়কই বলা হোক বা শুধু গণ-ই বলা হোক। আমাদের ধারণায় অবশ্য নামে নিশ্চয়ই আস-যায়। কিন্তু আপাতত সে-তর্ক না তুললেও চলতে পারে। কেননা, শুধুমাত্র ওই বিচিত্র নামগুলিই গণেশের ইতিহাসে বড়ো কথা নয়। আগেই বলেছি, গণেশ না হয়ে কৃষ্ণ হতে পারতো, কপিল হতে পারতো, বুদ্ধ হতে পারতো, বৃহস্পতি হতে পারতো। এঁদের নামের সঙ্গে অন্তত আপাত-দৃষ্টিতে গণের কোনো সম্পর্ক নেই। তার মানে, গণেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্য দিকটিকে তাঁর ওই নামগুলির মধ্যেই খোঁজ করবার প্রয়োজন নেই।
তাহলে, সেই আশ্চর্য দিকটি ঠিক কী? সে-এক অপরূপ পরিবর্তন।
একটা বিশেষ যুগে দেখা যায় সমাজের সদরমহলে গণেশের প্রতি মনোভাবটা একেবারে পাল্টে যাচ্ছে। আর, শুধু এই মনোভাবের পরিবর্তনই নয়, গণেশের নিজস্ব তাৎপর্যও। এই ওলট-পালটের কাহিনী ভারতের আদিপর্বের ধ্যানধারণার ইতিহাসের উপর আলোকপাত করে। এবং ধ্যানধারণা বলতে যেহেতু অনিবার্যভাবেই মানুষের ধ্যানধারণা সেই হেতু দেবতাদের সূত্র ধরে অগ্রসর হয়েই মানুষের ইতিহাসও অনুমান করবার অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। এবং, শুধুমাত্র গণেশের ক্ষেত্রেই যদি এই জাতীয় ওলট-পালট চোখে পড়তো তাহলে না হয় তা অগ্রাহ্য করবার অবকাশ থাকতো—এই একই ঘটনা ঘুরেদিরে নানান বার নানান ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। তাই, এ-ঘটনা হলো চলতি কথায় যাকে বলা হয় টিপিক্যাল। দর্শনের ক্ষেত্রে কপিল, বুদ্ধ বা বৃহস্পতির বেলাতেও কী ভাবে একই অদলবদল ঘটেছে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবার অবকাশ হয়তো হবে না। তবু গণেশের ইতিহাস থেকেই তাঁদের ইতিহাসও অনুমান করা অসম্ভব নয়।
গণেশের ইতিহাসে ওই অপরূপ অদল-বদলটি ঠিক কী রকম?
সমাজের সদরমহল এককালে গণেশকে রক্তকলুষ বিঘ্নস্রষ্টা বলেই চিনতে চেয়েছিলো। অথচ, এই গণেশই শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলো সর্বসিদ্ধির দেবতা! এ-পরিবর্তন সত্যিই বড়ো অপরূপ!
—————
১৯. ক্ষিতিমোহন সেন : জাতিভেদ ৬৪।
২০. M. Monier-Williams SED 343.
২১. অতুলচন্দ্র গুপ্ত : শিক্ষা ও সভ্যতা ১৪৪।
২২. ঋগ্বেদ ২.২৩.১।।১০.১১২.৯।।cf. P. V. Kane HD 2:213.
২৩. বিশ্বকোষ ৫:২০৫।
২৪. A. Getty G Plates দ্রষ্টব্য।
২৫. বিশ্বকোষ ৫:২০৫। cf. P. B Kane HD 2:716 cf. A. Getty G 22.
২৬. A. Coomarswamy in BBMFA 26 (1928):30.
২৭. M. Monier-Williams op. cit.—‘Gana’.
২৮. Ibid.
২৯. Ibid.
৩০. বিশ্বকোষ ৫:২০২।