প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

ভূমিকা : লোকায়ত, মাধবাচার্য ও আধুনিক গবেষণা

ভূমিকা : লোকায়ত, মাধবাচার্য ও আধুনিক গবেষণা 

[পুরোটা প্রুফরীড করা হয়নি]

গোড়ায় ভেবেছিলাম, লোকায়তর-অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদ বা materialism-এর-একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনার চেষ্টা করবো। কিন্তু এ- দায়িত্ব যে কতো কঠিন সে-বিষয়ে তখন সত্যিই ধারণা ছিলো না। 

অবশ্যই জানা ছিলো, লোকায়ত সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত বিরল এবং এগুলি একান্তই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত। লোকায়ত-প্রসঙ্গে অনিশ্চয়তার মহাসমুদ্রে একমাত্র যে- কথা জোর করে বলা যায় তা হলো, লোকায়তিকদের নিজস্ব কোনো রচনাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কালে এ-জাতীয় কোনো রচনা একান্তই ছিলো কিনা-সে-বিষয়েও বিদ্বানেরা একমত নন। রিস-ডেভিডস এ-সম্ভাবনাকে সন্দেহ করেন, যদিও গার্বে, তুচি এবং দাসগুপ্ত তার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য উপস্থিত করেছেন। সে-সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যদিই বা স্বীকার করতে হয় যে, এককালে এ- জাতীয় গ্রন্থ সত্যিই ছিলো। তবুও কিন্তু মানতেই হবে যে তা বিলুপ্ত হয়েছে।— হয়তো বিপক্ষেরা সেগুলি স্বেচ্ছায় ধ্বংস করেছিলো। এ-অবস্থায় রিস ডেভিডস যখন দাবি করেন লোকায়তিকদের নিজস্ব কোন রচনা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পক্ষে বড়ো জোর একটা অস্থায়ী প্রকল্পের উপর নির্ভর করা সম্ভব,–তখন তার উক্তি না-মেনে উপায় নেই। 

রিস-ডেভিডস এ-কথা লিখেছিলেন ১৮৯৯ সালে। তারপর আজ পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, ও-জাতীয় কোনো গ্রন্থ আবিষ্কৃত হবার আর কোনো সম্ভাবনাও নেই। অবশ্যই ১৯২১ সালে এফ, ডাবলিউ, টমাস বৃহস্পতি-সূত্র বলে একটি গ্রন্থ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও তর্জমা করে প্রকাশ করেন। ঐতিহ্য অনুসারে বৃহস্পতিই লোকায়ত-মতের প্রবর্তক; তাই এ গ্রন্থ বিদ্বান মহলে লোকায়ত-সংক্রান্ত পুরোনো কৌতুহলকে নতুন করে নাড়া দিয়েছিলো। কিন্তু গ্রন্থটির আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে স্পষ্টই বোঝা গেল, এর চরিত্র মোটেই অকৃত্রিম লোকায়তিক নয়। বরং লোকায়ত-বিরোধিতাইও এর প্রধান প্রতিপাদ্য। অধ্যাপক তুচির ভাষায়, গ্রন্থটি স্পষ্টই ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব প্রণোদিত it bears a clear Brahmanical character। কিন্তু সঙ্গেই তিনি দাবি করলেন, তবুও এই গ্রন্থে লোকায়ত-প্রসঙ্গে এমন কিছু কিছু উদ্ধৃতি পাওয়া যায় যেগুলি সম্ভবত কোনো প্রাচীন কিন্তু বিলুপ্ত গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিলো এবং সেই বিলুপ্ত গ্রন্থটির চরিত্র ছিলো স্পষ্টই লোকায়তিক— a peculiar lohayata character. 

কিন্তু আসল সমস্যা তো এই নিয়েই; লোকায়তিক চরিত্র বলতে আমরা ঠিক কী বুঝবো এবং কোথা থেকেই বা তার নির্দেশ পাবো? 

এ-বিষয়ে আমাদের একমাত্র সম্বল বলতে বিরোধী সম্প্রদায়গুলির লোকায়ত-খণ্ডন। অর্থাৎ, বিরুদ্ধ সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা লোকায়তর খণ্ডন-প্রসঙ্গে যা বলেছেন তার থেকেই লোকায়ত মতকে পুনর্গঠন করবার চেষ্টা ছাড়া আমাদের আর গতান্তর নেই। অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে তাই আক্ষেপ করে বলছেন, এ-সম্প্রদায়ের এমনই দুর্ভাগ্য যে একমাত্র বিপক্ষের রচনা থেকেই আমাদের পক্ষে একে বোঝবার চেষ্টা করা সম্ভব। 

স্বভাবতই, বিপক্ষের প্রধান উৎসাহ লোকায়ত-খণ্ডন; লোকায়ত-বৰ্ণন নয়। ফলে এই সূত্রে লোকায়ত-সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা যে অবিকৃত এবং নৈর্ব্যক্তিক হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দার্শনিকের বিভিন্ন সমস্যা-প্রসঙ্গে · লোকায়ত-খণ্ডনের আয়োজন করেছেন; ফলে তাদের রচনায় লোকায়ত-সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়। তাও নেহাতই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত-লোকায়তার কোনো সামগ্রিক বা ধারাবাহিক পরিচয় নয়। একমাত্র মাধবাচার্যের সর্বদর্শনসংগ্রহ, শঙ্করাচার্য রচিত বলে খ্যাত সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ এবং হরিভদ্রসুরীর ষড়দর্শনসমুচ্চয়-প্রধানতই প্রথম গ্রন্থটি-এই উক্তির আপাত ব্যতিক্রম। কিন্তু মাধবাচার্যের লোকায়ত বর্ণনা কতোখানি নির্ভরযোগ্য সে-আলোচনা আমরা একটু পরেই তুলবো। 

বলাই বাহুল্য, লোকায়ত-সংক্রান্ত এ-জাতীয় কথা ভারতীয় দর্শনের ছাত্রমাত্রের কাছে সুবিদিত। অতএব, যখন কাজ শুরু করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিলো সমস্যাটা প্রধানতই হবে তথ্যের অপ্রাচুর্য নিয়ে। অর্থাৎ, বিপক্ষের রচনায় পাওয়া ওই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত তথ্যগুলি থেকেই লোকায়তর সামগ্রিক রূপটি পুনর্গঠন করবার প্রয়াস করতে হবে। সে-কাজও নিশ্চয়ই যথেষ্ট দুরূহ। কিন্তু কিছুটা অগ্রসর হয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে হলো, আসল সমস্যাট আরো অনেক কঠিন। কেননা ওই তথ্যগুলি শুধু খণ্ড ও বিক্ষিপ্তই নয়; তাছাড়াও অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য; এমনকি অন্তত আপাত দৃষ্টিতে অনেকাংশেই অসংলগ্ন ও পরস্পর- বিরোধী সিন্ধান্তে উপনীত যে হয়েছেন, তার একটি প্রধান কারণ আলোচ্য তথ্যের এই আপাত-অসংলগ্নতাই। অর্থাৎ, গবেষক-বিশেষ যে-নির্বাচিত তথ্যের উপর ঐকান্তিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন তার সঙ্গে অপর গবেষক নির্বাচিত তথ্যান্তরের অন্তত আপাত-দৃষ্টিতে সঙ্গতি নেই; ফলে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যেও যেন আকাশ-পাতাল তফাত। 

তফাত যে বাস্তবিকই কতোখানি তার কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে। 

অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ এবং মূয়ার উভয়েই লোকায়তকে প্রাচীন ভারতের চিন্তা রাজ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান; কিন্তু এই সংযোগটির কথা দু’জনে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবেই কল্পনা করেছেন। রাধাকৃষ্ণণের মতে মহাকাব্যের যুগে,-অর্থাৎ, ৬০৭-২০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে—ভারত শ্রুতি-শাসনের কঠোরতা ভেঙে চিন্তার মুক্তি ঘোষিত হয়েছলো এবং তারই পরিণাম হলো ওই চূড়ান্ত নাস্তিক দার্শনিক সম্প্রদায়টি। অপরপক্ষে, মুয়ার মনে করেন অতি সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতের ধ্যানরাজ্যে চিন্তার স্বাধীনতা স্বীকৃত ছিলো; উত্তরকালে লোকায়তিক ও বৌদ্ধদের নাস্তিক্য-বাহুল্যের ফলেই আস্তিকেরা শঙ্কিত বোধ করেন এবং কঠোর শ্রুতি-শাসন প্রবর্তন করেন। অতএব, রাধাকৃষ্ণণের মতে যে-লোকায়ত শ্রুতি-শাসন ভেঙে পড়বার পরিণাম, মূয়ার-এর মতে সেই লোকায়তই হলো শ্রুতি-শাসন প্রবর্তিত হবার কারণ। 

কিন্তু অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের সিদ্ধান্ত অনুসারে লোকায়তর মূলে ছিলো একরকম সৎকার-পদ্ধতিগত বিশ্বাস—চিন্তাজগতের মুক্তি বা স্বাধীনতা- সংক্রান্ত কোনো ব্যপারাই নয়। এবং এই সৎকার-পদ্ধতিটি আদিতে ভারতীয়ও ছিলো না-তার বদলে প্রাচীন সুমেরীয়ায় তা প্রচলিত ছিলো। কালক্রমে ওই সৎকার-পদ্ধতি-গত বিশ্বাসটি ভারতে এসে পড়ে এবং ভারতের জমিতে তার কিছু পরিবর্তনও ঘটে। 

অধ্যাপক তুচির সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসের চিন্তা-স্বাধীনতা কিংবা সুমেরীয় ইতিহাসের সৎকার-পদ্ধতি-কোনো কিছুরই সম্পর্ক নেই। তিনি অনুমান করছেন, লোকায়ত বলতে প্রাচীন ভারতের রাজোপদেশক পুরোহিতদের প্রজ্ঞা বোঝাতো। তখনো ধর্ম এবং অর্থের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়নি। কিন্তু কালক্রমে সে-বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে; তখন অর্থ যেন ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তারই পরিমাণ হিসাবে দেখা দেয় নিরীশ্বর ও ভোগসর্বস্ব লোকায়ত দৰ্শন। 

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অনুমান করছেন, লোকায়তার সঙ্গে কামসাধনার -অতএব বামাচারী কাপালিকাদি সম্প্রদায়ের-একটা গভীর সম্পর্ক বা এমনকি ঐক্যও স্বীকারযোগ্য। অতএব তার সিদ্ধান্ত অনুসারে লোকায়ত আজো ভারতভূমি থেকে বিলুপ্ত হয়নি-দেহবাদী ও কামসাধক সম্প্রদায় সহজিয়া বৈষ্ণব প্রভৃতি নামান্তরের আড়ালে আজো তা আমাদের দেশে বর্তমান রয়েছে। 

অবশ্যই রিস্ ডেভিডস্ অনেকদিন আগেই যে-সিদ্ধান্ত করেছিলেন তা স্বীকার করতে পারলে আজকের দিনে আমাদের পক্ষে লোকায়ত নিয়ে এতো রকম মতবাদের আবর্তে পড়ে বিভ্রান্ত বোধ করবার সম্ভাবনা থাকতো না। কেননা তাঁর মতে লোকায়ত বলে ভারতবর্ষে কোনো কালেই কোনো রকম দার্শনিক মতবাদ ছিলো না। স্বভাবতই, আমরা যদি রিস ডেভিডসকে অনুসরণ করে লোকায়তার সমস্যাটিকেই অস্বীকার করতে পারতাম তাহলে তার সমাধান নিয়েও কোনো হাঙ্গামা থাকতো না। 

.

বলাই বাহুল্য, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, ভারত-তত্ত্ববিদ হিসেবে তারা সকলেই এতোখানি শ্রদ্ধেয় যে, কারুর কথাই আমরা অসংকোচে অগ্রাহ করতে পারি না। অপরপক্ষে, সকলের সিদ্ধান্তই সমানে স্বীকার করবার সুযোগ আমাদের নেই; কেননা এই সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে সঙ্গতি খুঁজে পাওয়াও সাধ্যাতীত। অতএব এক্ষেত্রে সুযোগ্য বিদ্বানদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে সন্দিহান হবার অপ্রিয় দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অপরপক্ষে, এ- বিষয়েও সন্দেহ নেই যে, ভারততত্ত্ববিদ-হিসেবে ধারা অমন শ্রদ্ধেয় তারা কেউই বিনা-তথ্যে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছুবার চেষ্টা করেননি এবং আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো। এই সিদ্ধান্তগুলি যতো পরস্পর বিরোধীই হোক না কেন, কোনোটিকেই একেবারে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কেবল, বিভিন্ন বিদ্বান যে- সব বিভিন্ন তথ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সেগুলির মধ্যে আপাত-দৃষ্টিতে সঙ্গতি নেই। ফলে সঙ্গতি নেই তাদের সিদ্ধান্তগুলির মধ্যেও। 

প্রাচীন লোকায়ত প্রসঙ্গে আধুনিক বিদ্বানদের সিদ্ধান্তগুলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আর একটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বিষয়টি হলো, পরস্পরের সিদ্ধান্তের মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ যতোই থাকুক না কেন, আধুনিক বিদ্বানের মোটের উপর একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ, একই পদ্ধতি অনুসরণ করা সত্ত্বেও বিভিন্ন তথ্যের উপর বিভিন্নভাবে গুরুত্ব আরোপ করবার ফলেই তাদের সিদ্ধান্তগুলি পরস্পর-বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বভাবতই মনে হয়েছিলো এমন হওয়া অসম্ভব নাও হতে পারে যে, আমরা যদি কোনো নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে হয়তো আলোচ্য তথ্যের আপাত-অসংলগ্নতাও আমাদের সামনে থেকে দূর হতো। কেননা, বিশিষ্ট বিদ্বানেরা এই যে-সব বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন সেগুলিকে সন্দেহ করবার কোনো কারণ নেই; অতএব সেগুলির মধ্যে বাস্তব অসংলগ্নতা থাকাও স্বাভাবিক নয়। আমাদের মনে হয়েছিলো, অধ্যাপক জর্জ টমসনের সাম্প্রতিক গ্রন্থাবলীতে এই জাতীয় নূতন পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়-দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আমরা বিস্তারিতভাবে এই পদ্ধতিটির আলোচনা করেছি। কিন্তু তার উল্লেখ করবার আগে লোকায়তর পুনর্গঠনে সাবেক পদ্ধতিটি কেন গ্রহণযোগ্য মনে হয় না, যে-কথা ব্যাখা করা দরকার। 

আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে সাধারণভাবে স্বীকৃত ওই পদ্ধতিটি ঠিক কী? মাধবাচার্য তাঁর সর্বদর্শন-সংগ্রহে চার্বাক বা লোকায়ত নাম দিয়ে একটি দার্শনিক মতের বর্ণনা দিয়েছেন। আধুনিক বিদ্বানেরা তারই উপর প্রধান গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। লোকায়ত-প্রসঙ্গে অধ্যাপক গার্বে যেমন বলছেন, এ- বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের প্রধানতম উৎস হলো সর্বদর্শন-সংগ্রহের প্রথম পরিচ্ছেদ। এইভাবে মাধবের রচনা থেকে লোকায়তার মূল ধারণাটি সংগ্রহ করে আধুনিক বিদ্বানেরা তারই আলোয় অন্যান্য-সূত্রেপাওয়া অন্যান্য তথ্যের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন। লোকায়তাঁর পুনর্গঠন-প্রসঙ্গে তাদের পদ্ধতি বলতে এইটিই। অবশ্যই রিস-ডেভিডস ও সচেতনভাবে এ-পদ্ধতি বর্জন করতে চেয়েছেন। কেননা তার ধারণায়, সর্বদর্শন-সংগ্রহের লোকায়ত-বর্ণন স্পষ্টই মাধবের কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু শুনতে যতোই আপাত-বিরোধী মনে হোক না কেন, আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো যে, মাধবের বিরুদ্ধে রিস-ডেভিডস-এর এই আপত্তির অন্তরালে মাধবের উপরই ঐকান্তিক নির্ভরতার পরিচয় প্ৰচ্ছন্ন আছে। 

মাধবের বর্ণনা থেকে শুরু করবার অবশ্যই দুটি সুবিধা আছে। 

প্রথমত, মাধব যে-ভাবে লোকায়তার বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে অস্পষ্টতা বা অনিশ্চয়তা নেই। তার বর্ণনাটি সামগ্রিক ও পুর্ণাঙ্গ: লোকায়তিকের ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ ছাড়া জ্ঞানের আর কোনো উৎস স্বীকার করে না, ফলে তারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জড়াজগৎটি ছাড়া আর কিছুর সত্তাও মানে না, অতএব তাদের কাছে ইন্দ্ৰিয়াভোগ্য সুখ ছাড়া আর কোনো রকম পুরুষার্থের অর্থও থাকতে পারে না। অতএব, মাধবের লোকায়ত বর্ণন তাঁর মনগড়া হোক আর নাই হোক—এর মধ্যে একটা সামগ্রিক সঙ্গতি আছে। সেখান থেকে শুরু করতে পারলে অনেকাংশেই সুনিশ্চিত বোধ করা সম্ভব। 

দ্বিতীয়ত, আধুনিক বিদ্বানদের কাছে বস্তুবাদের এই বর্ণনা একটা সুপরিচিত ও অভ্যন্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। কেননা সাধারণভাবে আধুনিক বিদ্বানদের মনে বস্তুবাদ সংক্রান্ত যে-ধারণা-এবং বিশেষত বন্তবাদের বিরুদ্ধে যে- বিদ্বেষ—মাধবের বর্ণনাটি তার সঙ্গে সহজেই খাপ খায়। মাধবের বর্ণনা অনুসারে লোকায়তিকের অত্যন্ত স্থূল ইন্দ্রিয়সুখ ছাড়া আর কোননো উচ্চতর আদর্শ স্বীকার করে না এবং আধুনিক বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করেন। 

এই বিদ্বেষের দুটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো। 

লোককায়তর ব্যাখ্যায় জনৈক আধুনিক বিদ্বান বলছেন, — A man who wanted to convert-let us say ‘pervert’-a woman to his materialistic ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ লেখকদের কাছে বস্তুবাদ একটা বিকার- মাত্র perversion। এবং এ-মন্তব্য যেন এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে, নেহাত আনুষঙ্গিকভাবে তার উল্লেখ করাই যথেষ্ট-কথাটা প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে কোনো রকম যুক্তিতর্কের প্রশ্ন ওঠে না। 

বস্তুবাদের প্রতি মোটের উপর একই মনোভাব পোষণ করেন বলেই অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ লোকায়তর পুনর্গঠনে শুধু যে প্রবোধচন্দ্রোদয় বলে রূপক নাটকটির উপর অত্যন্ত মৌলিকভাবে নির্ভর করেছেন তাই নয়, তাছাড়াও সহজ- স্বাভাবিকভাবেই বলছেন যে, উক্ত নাটকেরই একটি চরিত্রের উক্তি থেকে লোকায়ত-মতের সংক্ষিপ্তসার সংগ্রহ করা যায়। লেখক নিশ্চয়ই জানেন, এ-প্রস্তাব অনেকাংশেই এ্যারিস্টোফেনিসের নাটক থেকে সক্রেটিসের মত ও চরিত্রের কথা উদ্ধার করবার মতো। কেননা, এরিস্টোফেনিস যেমন সক্রেটিসকে নিয়ে শুধুই ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে চেয়েছেন অনেকটা সেইভাবেই কৃষ্ণমিশ্রও তাঁর ওই নাটকটিতে বেদান্তমতের প্রতিষ্ঠা-প্রচেষ্টায় বৌদ্ধ, জৈন, লোকায়ত, কাপালিক প্রভৃতি বেদান্তবিরোধী মতগুলি নিয়ে শুধুমাত্র ব্যঙ্গবিদ্রুপই করবার চেষ্টা করেছেন। প্রবোধচন্দ্রোদয় থেকে বৌদ্ধ বা জৈন মতের সারমর্ম উদ্ধার করবার প্রস্তাব কোনো আধুনিক বিদ্বান নিশ্চয়ই করবেন না; আধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ তো ননই। কিন্তু লোকায়তার বেলায় অন্য রকম। এই মতের সারমর্ম এবং এই মত নিয়ে প্রহসন-দুয়ের মধ্যে প্রভেদ করবার প্রয়োজন হয় না। কেননা, লেখকের রুচি ও বিচার অনুসারে মতটাই প্রহসনের মতো। এবং আধুনিক বিদ্বানদের প্রায় সকলেরই এই মনোভাব। কারণেই মাধবের লোকায়ত-বর্ণন। তাদের কাছে একটা পরিচিত পরিবেশ সৃষ্টি করে। 

কিন্তু এই দুটি আপাত-সুবিধা সত্ত্বেও আমরা মাধবের বর্ণনায় আস্থা স্থাপন করতে দ্বিধা বোধ করেছি। তার কারণ শুধু এই নয় যে, আধুনিক বিদ্বানদের পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তগুলি অনেকাংশেই এ-আস্থার পরিণাম। তাছাড়াও তাঁর রচনার আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য এবং তাঁর রচনা-বহির্ভূত অন্যান্য তথ্যও সুস্পষ্টভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে যায়। সেগুলর আলোচনা তোলবার আগে দেখা যাক, আধুনিক বিদ্বানদের সিদ্ধান্তগুলির পরস্পরবিরোধিতার জন্য মাধবের উপর নির্ভরতা কীভাবে বা কতোখানি দায়ী। 

.

অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ বলছেন, মহাকাব্যের যুগে–অর্থাৎ তার হিসেবে খৃষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ২০০-র মধ্যে—ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় নানা রকম তোলপাড় শুরু হয়েছিলো এবং তারই পরিমাণ হিসেবে চিন্তাক্ষেত্রে লোকায়ত-মতের আবির্ভাব হয়। এই যুগটিতে অনেক শতাব্দীর পুরোনো বিশ্বাস ভেঙে পড়ছিলো, টলে উঠছিলো শ্রুতির শাসন। ফলে রকমারি দার্শনিক মত ও নিষ্ফল কল্পনার আবির্ভাব হয়। একদিকে দেখা যায় লোকায়তিকেরা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষের উপরই আশ্রয় গ্রহণ করবার চেষ্টা করছে। অপরদিকে বৌদ্ধর উচ্চাঙ্গের মনস্তত্বমূলক ও নীতিশাস্ত্রগত শিক্ষা প্রচার করছে। এই পরিস্থিতিটিকে মনে রাখলে বুঝতে পারা যাবে, লোকায়তিকদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিলো পুরোনো কালের আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং জাদুবিশ্বাসের প্রভাব বর্জন করে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা ঘোষণা করবার ভূমিকা। অতীতের যে-বোঝা তখনো মানুষকে নিষ্পেষিত করে রেখেছিলো তা থেকে মুক্তি পাবার আশায় চার্বাক-দর্শন যেন একরকম উন্মত্ত ব্যবহার; তবু কূপমণ্ডুকতা দূর করে এ-দর্শন মানবাত্মার মহান সৃজনী সম্ভাবনাকে মুক্তি দিয়েছিলো। অর্থাৎ অন্ধ উন্মক্ত বিক্ষোভের মতো হলেও উত্তরকালের মহান দার্শনিক প্রচেষ্টার জন্যই লোকায়ত মতের একটা প্রয়োজন ছিলো, যদিও সে প্রয়োজন নেহাতই নেতিবাচক। 

এই সিদ্ধান্তটির প্রধান গুণ অবশ্যই সারল্য এবং সে-সারল্যের প্রধান কারণ হলো মাধবের উপর ঐকান্তিক নির্ভরতা—লেখককে যেন প্রতিজ্ঞা করতে 

হয়েছে লোকায়ত- সংক্রান্ত যে-সব তথ্য মাধবের বর্ণনার সঙ্গে খাপ খায় না সেগুলিকে অবজ্ঞা করতেই হবে। অতএব লোকায়ত-প্রসঙ্গে অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ সর্বদর্শনসংগ্রহ ছাড়া কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধ চন্দ্রোদয় এবং শঙ্করাচার্য-বিরচিত বলে খ্যাত (যদিও এগলিং-এর মতে এ খ্যাতি ভিত্তিহীন) সর্বসিদ্ধান্তসারসংগ্রহ বলে গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছেন; সর্বদর্শনসংগ্রহের মতোই এ-দুটিও অর্বাচীন রচনা, এ-দুটিও বেদান্তমত প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যেই রচিত এবং এ-দুটিও লোকায়তকে নেহাতই নেতিমূলকভাবে বর্ণনা করেছে-লোকায়ত অনুমান মানে না, ঈশ্বর আত্মা পরকাল পরলোক মানে না, ধর্ম ও মোক্ষ বলে পুরুষার্থ মানে না। লোকায়তার শুধু এই নিছক নেতিমূলক বর্ণনাকে গ্রাহ্যের মধ্যে এনেছেন বলেই, এবং বৌদ্ধ জৈন ও এমনকি রামায়ণ মহাভারত উপনিষদাদি গ্রন্থের সাক্ষ্যকেও প্রায় সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন বলেই লোকায়তার ব্যাখ্যায় অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণের কাছে একমাত্র প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দাঁড়ালো: প্রাচীন ভারতে এ-রকম চুড়ান্ত নেতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব কী করে সম্ভব হয়েছিলো এবং ঐতিহাসিকভাবে তার সার্থকতাই বা কতোটুকু? সামাজিক বিপর্যয়ের ফলে পুরোনো কালের বিশ্বাস ভেঙে পড়ছিলো—এমন কোনো যুগের প্রকল্প তার প্রথম প্রশ্নটির উত্তর যোগাতে পেরেছে। এবং এরই উপর নির্ভর করে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, লোকায়ত-মত যতোই নেতিবাচক হোক না কেন প্রাচীনকালে তা আমাদের দেশের ধ্যানরাজ্যে মুক্তি ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলো। 

শ্রীযুক্ত জে. মূয়ার প্রধানতই মাধবের নেতিমূলক বর্ণনাটির উপর নির্ভর করেছেন বলেই তাঁর কাছেও লোকায়ত প্রাচীন ভারতের ধ্যানরাজ্যে মুক্তি ও স্বাধীনতার পরিচায়ক। কিন্তু তাঁর মতে এ-মুক্তি শ্রুতি-শাসন ভেঙে পড়বার পরিণাম নয়, বরং শ্রুতি-শাসন কঠোর ও সংহত হবার কারণ। অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে তার সিদ্ধান্তের এই প্রভেদটির কারণ কী? আসলে, মাধবের বর্ণনা ছাড়াও তিনি লোকায়ত-সংক্রান্ত আরো কিছু প্রাচীনতর তথ্যকে স্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু এই বাড়তি তথ্যের সঙ্গে মাধবের বর্ণনার অন্তত আপাত-দৃষ্টিতে অত্যন্ত প্রকট বৈষম্য চোখে পড়ে। অথচ শ্রীযুক্ত মূয়ারের মনে মাধবের প্রতি নিষ্ঠাই সবচেয়ে মৌলিক। ফলে তিনি এমন একটি প্রকল্পে উপনীত হবার চেষ্টা করছেন যার যাহায্যে ওই আপাত বৈষম্যটুকুর ব্যাখ্যা করা যায়।

বাড়তি তথ্য হিসেবে তিনি দেখছেন, অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ-দেশে নাস্তিক–অতএব লোকায়তিক—চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এমনকি রামায়ণেও দেখা যায় ব্রাহ্মণ জাবালি রামচন্দ্রকে যে-উপদেশ দিচ্ছেন তা নাস্তিকতায় ভয়ঙ্কর। অমন ভয়ানক নাস্তিক্যমূলক বলেই এ-উপদেশকে শ্রীযুক্ত মূয়ার লোকায়তিক বলে সনাক্ত করছেন-অবশ্য এই সনাক্তিকরণের পিছনে তাঁর মনে শুধুই যে মাধবের প্রভাব আছে তাই নয়,বিষ্ণুপুরাণ-বর্ণিত মায়ামোহপ্রচারিত লোকায়ত-মতের সঙ্গে জাবালির উপদেশটির নিকট সাদৃশ্যও তিনি লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু মাধবের বর্ণনার সঙ্গে রামায়ণের এই তথ্যটি অসঙ্গতি কোথায়? রামায়ণের বর্ণনা অনুসারে চাবালি ছিলেন ব্রাহ্মণ। অতএব শ্রীযুক্ত মূয়ার মনে করছেন, রামায়ণের এই অংশ যদি প্রক্ষিপ্ত না হয় (এবং তাঁর মনে অংশটি সত্যই প্রক্ষিপ্ত নয়) তাহলে মানতে হবে যে, রামায়ণ রচিত হবার যুগেও একজনের পক্ষে ব্রাহ্মণ হয়ে থাকা সত্ত্বেও লোকায়ত-মত পোষণ করায় বাধা ছিলো না। কিন্তু তা কী করে সম্ভব হতে পারে? মূয়ার মনে করছেন, একমাত্র এই সর্তে ঘটনাটি সম্ভব হতে পারে যে, তখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণের পক্ষে শুধু কয়েকটি আনুষ্ঠানিক দিক বজায় রাখাই যথেষ্ট, কিন্তু তার সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট মতবাদ মানা-না-মানার বাধ্যবাধকতা ছিলো না—অর্থাৎ তখনো চিন্তার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বর্তমান ছিলো। অতএব, অতি সুদূর অতীত থেকেই ভারতবর্ষে চিন্তার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়ে আসছে, রামায়ণ রচনার যুগেও চিন্তার উপর হস্তক্ষেপ করা হতো না। চিন্তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে অনেক পরে। আসলে, বৌদ্ধ লোকায়তিক প্রভৃতি নাস্তিকদের আক্রমণ অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠার পর থেকেই আস্তিক্য বা বেদপন্থীরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন এবং অত্যন্ত কঠোর শ্রুতি-শাসন প্রবর্তন করতে চাইলেন। অতএব মাধবের লোকায়ত বর্ণনের সঙ্গে লোকায়ত সংক্রান্ত কিছু বাড়তি তথ্যের সঙ্গতি খুঁজতে গিয়ে শ্রীযুক্ত মূয়ার অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণের ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন; লোকায়ত- মত চিন্তা রাজ্যে শ্রুতি-শাসন প্রবর্তনের কারণ, শ্রুতি-শাসন ভেঙে পড়বার পরিণাম নয়। 

এবং একই কারণে-অর্থাৎ, মাধবের বর্ণনার সঙ্গে কিছু বাড়তি তথ্যের সঙ্গতিরক্ষার চেষ্টায়-অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তও লোকায়ত-সংক্রান্ত তার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যদিও বাড়তি তথ্য হিসেবে তিনি বিশেষ করে যেটির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা অনেকাংশে অভিনব বলেই অধ্যাপক দাসগুপ্তের সিদ্ধান্তটিও অভিনব হয়ে দাঁড়ালো। তিনি কোন তথ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করছেন? ছন্দোগ্য-উপনিষদের ইন্দ্ৰ-বিরোচন সংবাদ; অসুরদের প্রতিনিধি বিরোচন মনে করেছিলেন দেহই আত্মা, এই কারণেই অসুরের মৃতব্যক্তির দেহ সুশোভিত করে এবং খাদ্যাদির সম্ভার সহকারে তার কবর দেয়। অধ্যাপক দাসগুপ্তের ধারণায় অম্বর বলতে প্রাচীন সুমেরীয়দের বুঝতে হবে এবং উক্ত সৎকার-পদ্ধতি তাদেরই বৈশিষ্ট্য। এই সৎকার-পদ্ধতির অন্তর্নিহিত দেহাত্মবাদই কালক্রমে আমাদের দেশে এসে লোকায়ত-মতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু লোকায়ত-সংক্রান্ত তথ্যের মধ্যে অধ্যাপক দাসগুপ্তের কাছেও মাধবের বর্ণনাই প্রধানতম অবলম্বন বলেই তিনি এখানে একটিমাত্র সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন; ছান্দোগ্য বর্ণিত ওই অসুরমত কীভাবে কালক্রমে মাধব-বর্ণিত লোকায়ত-মতে পরিণত হলো? ঐতিহাসিক বিবর্তন মূলক একটি প্রকল্পের সাহায্যে তিনি এ সমস্যার সমাধান করতে চাইলেন। আমরা গ্রন্থমধ্যে অধ্যাপক দাসগুপ্তের এই সিদ্ধান্তটি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি এবং লোকায়তর সঙ্গে অসুরমতের সাদৃশ্যমূলক ইংগিতটির তাৎপর্য্য কী হতে পারে তারও আলোচনা তুলেছি। 

অধ্যাপক তুচি সিদ্ধান্ত করছেন, শুরুতে লোকায়ত ছিলো রাজোপদেশক পুরোহিত শ্রেণীরই প্রজ্ঞা-তখনো পুরুষার্থ হিসেবে ধর্ম ও অর্থের মধ্যে বিরোধ ফুটে উঠেনি। অর্থ বলতে তিনি এখানে রাজার দণ্ডনীতি ইত্যাদি বুঝতে চেয়েছেন এবং তাঁর ধারনায় এ-জাতীয় রাজনৈতিক কুটবুদ্ধির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক খুব বেশিদিন টিকতে পারে না। রাজনীতিকদের মধ্যে কেউ কেউ ক্রমশই ধর্ম- শাসনের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াতে লাগলেন এবং দাবি করলেন পার্থিব ব্যাপারে ঈশ্বর ও পুরোহিতদের হস্তক্ষেপ স্বীকার করা হবে না। এ-অবস্থায় সাধারণত যা ঘটে এক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। শুধুই যে ধর্মের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলো তাই নয়, অর্থ যেন ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। এবং এই ভাবেই কালক্রমে লোকায়তায় আদিরূপটি পরিবর্তিত হয়ে মাধব-বর্ণিত ওই সুখবাদী নিরীশ্বর ও জড়বাদী দর্শনে পরিণত হলো। 

অবশ্যই অধ্যাপক তুচি ধর্ম ও অর্থের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধের এই কাহিনীটির পক্ষে বিশেষ কোনো তথ্য, যুক্তি বা প্রমাণ উপস্থিত করেননি; উপস্থিত করা একান্তই সম্ভব কিনা তাও হয়তো সন্দেহের কথা। অতএব প্রশ্ন ওঠে, তিনি কেন এ-জাতীয় একটি কাহিনী রচনা করতে বাধ্য হলেন? তার রচনা বিশ্লেষণ করলে এর কারণ দেখতে পাওয়া যায়। মাধবের চেয়েও অনেক পুরনো সুত্রে তিনি লোকায়তা-সংক্রান্ত এমন কিছু কিছু তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন যার সঙ্গে মাধবের এই বর্ণনাটি খাপ খায়না-পাদটীকায় এ-জাতীয় তথ্যের নমুনা দেওয়া গেলো। এই গরমিল থেকে অধ্যাপক তুচি অবশ্যই মাধবের বর্ণনাটিকে সন্দেহ করতে পারতেন; কিন্তু অন্যান্য আধুনিক বিদ্বানদের মতোই তাঁর কাছেও এ- বর্ণনাই চূড়ান্ত মূল্যবান। ফলে তার পক্ষেও এমন কোনো প্রকল্পের আশ্রয় গ্রহণ করা প্রয়োজন হলো যার সাহায্যে প্রাচীনতর সুত্রে পাওয়া লোকায়তর আদিরূপটিই কীভাবে কালক্রমে মাধব-বণিত লোকায়তে পরিণত হয়েছিলো সে-প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হয়। 

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও মাধবের বর্ণনাটি থেকেই শুরু করেছেন। ‘লোকায়ত’ নামে তার ক্ষুদ্র কিন্তু অমূল্য পুস্তিকার প্রারম্ভেই তিনি বলছেন, সর্বদর্শন সংগ্রহ বলে গ্রন্থটি অনেকদিন আগেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো এবং আমি অচিরেই চার্বাক-দর্শন সংক্রান্ত পন্থাংশটুকু মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। স্বভাবতই, মহামহোপাধ্যায় তাঁর পুস্তিকাটির প্রথমাংশে সর্বদর্শন- সংগ্রহের ভিত্তিতেই লোকায়তর ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তাঁর পুস্তিকাটির প্রথমাংশে সর্বদর্শন-সংগ্রহের ভিত্তিতেই লোকায়তর ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তাঁর মতো বিদ্বানের পক্ষে লোয়তর পুনর্গঠন প্রসঙ্গে স্বা থাকা সম্ভব হয়নি। তাই অনুষ্ঠান্য সূত্রে লোকায়ত-সংক্রান্ত আর কী তথ্য পাওয়া যায় তিনি সে প্রশ্ন তুলেছেন। এবং এ জাতীয় তথ্যের অন্বেষণে অগ্রসর হয়ে তিনি অত্যন্ত বিষ্ময়কর কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেমন, বৃহস্পতি সূত্রে হয়েছে অর্থ-সাধন ব্যাপারে লোকায়তই একমাত্র শাস্ত্র এবং সেই সঙ্গে- মহামহোপাধ্যায়ের বর্ণনায়, প্রায় একনিঃশ্বাসে-বলা হয়েছে যে, কামসাধন ব্যাপারে কাপালিকই একমাত্র শাস্ত্র। স্বভাবতই মহামহোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে, এইভাবে একনিঃশ্বাসে লোকায়ত ও কাপালিক-অর্থসাধন ও কামসাধন-দ্বয়ের উল্লেখ করবার পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইংগিত থাকাই সম্ভবপর। এবং সে-ইংগিতটিরর তাৎপর্য আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জৈন লেখক গুণরত্বের রচনায়। গুণরায় বলছেন, লোকায়তিকের মদ্যপান করে, মাংস ভক্ষণ করে তারা মৈথুনাসক্ত। শুধু তাই নয়, তারা গায়ে ভষ্ম মাখে, তারা যোগী। এবং প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে অবাধ মৈথুনে প্রবৃত্ত হবার উদ্দেশ্যে তারা একত্রে মিলিত হয়। এ-বর্ণনা স্বভাবতই মহামহোপাধ্যায়কে বামাচারী তান্ত্রিক সম্প্রদায়গুলির কথা মনে করিয়েছে এবং তিনি জানেন যে, এ-জাতীয় তান্ত্রিক সম্প্রদায় আমাদের দেশ থেকে আজো বিলুপ্ত হয়নি। অতএব তিনি সিদ্ধান্ত করছেন সহজিয়া বৈষ্ণব ইত্যাদি নামান্তরের আড়ালে লোকায়ত সম্প্রদায় আজো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে। সেই সঙ্গেই কিন্তু তিনি বলেছেন, সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলি অধঃপতিত মহাধান-বৌদ্ধধর্মেরই স্মারকমাত্র। এবং বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের কারণটাও হলো প্রাকৃতজনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত- লোকেষু আয়ত—হয়ে পড়া। এইভাবে স্থূল লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় বৌদ্ধধর্মের মহান আদর্শগুলি নষ্ট হলো এবং ক্রমশই তা বীভৎস কামবিকারে পরিণত হয়ে পড়লো। সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলি সংক্রান্ত মহামহোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত আমরা গ্রন্থমধ্যে আলোচনা করেছি। 

যদি তাই হয়, তাহলে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে, মাধব বর্ণিত লোকায়তর সঙ্গে এ-সবের সম্পর্ক কী, সাদৃশ্য কোথায়? এবং যদি কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে তাঁর উক্ত সিদ্ধান্তের দিক থেকে মাধবের লোকায়ত বৰ্ষনাকে সন্দেহ করবার প্রয়োজন হবে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, মাধবের প্রতি তার নিষ্ঠা কতোখানি গভীর। অতএব, মাধবের বর্ণনা সন্দেহ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে তিনি এ-প্রশ্নটিই তুললেন না। তার দরুন কিন্তু তার পুস্তিকার প্রথমাংশের সঙ্গে শেষাংশের কোনো সঙ্গতি রইলো না: তিনি যেন তথ্যের খাতিরে সিদ্ধান্তের অসঙ্গতিকেই স্বীকার করে নিলেন। 

প্রধানত তাঁর এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাটির উপর নির্ভর করেই ডাক্তার দিক্সণারঞ্জন শাস্ত্রী ভারতীয় বস্তুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন এবং মহামহোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তের অসঙ্গতিকেও সাধ্যমতো সঙ্গত করে নেবার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তা করা যায়? কী করে মাধবের বর্ণনার সঙ্গে কামাচারী তান্ত্রিক সম্প্রদায়গুলির কথা খাপ খাওয়ানো সম্ভব হতে পারে? ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রীর যুক্তিটি মোটের উপর এই; মাধব বলেছেন লোকায়তিকেরা ইন্দ্রিয়ভোগ ছাড়া আর কোন আদর্শ মানতো না, অতএব এই ভোগবাদের প্রভাবেই দেশে নীতিগহিত অবাধ মৈথুনের উৎসাহ দেখা দিলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এ-জাতীয় বামাচারী ধ্যানধারণার প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কতো ব্যাপক ও গভীর তার একটি প্রমাণ উড়িষ্যা প্রভৃতির মন্দির ভাষ্কার্য। ভারতীয় সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্যকে যদি শুধুমাত্র মৈথুনাসক্তিরই পরিচায়ক মনে করতে হয় এবং এই মৈথুনাসক্তিকে যদি ভোগসর্বস্ব লোকায়ত-মতের প্রভাব-পরিণাম বলেই গ্রহণ করা হয় তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করবার প্রয়োজন পড়ে যে, পুরো দেশটাই যেন লোকায়ত-মতের প্লাবনে ভেসে গিয়েছিলো। ভক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী এই রকমই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, লোকায়ত ছিল সুখবাদ, আনন্দ-উচ্ছল; তারই প্রভাবে ভারতীয় ইতিহাসের এই যুগে মন্দির আর রাজদরবার, শিল্প আর সাহিত্য ইন্দ্রিয় চরিতার্থতার উৎসাহে ভরপুর হয়েছিলো, সারা দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছিলো কামসর্বস্বতার প্লাবন-ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত, রাজা থেকে ভিখিরি পর্যন্ত সকলেই মদনোৎসবে মেতে উঠতো, সে উৎসবের মূল কথা হলো মদন বা কামের উপাসনা। আমরা গ্রন্থমধ্যে ডক্টর শাস্ত্রীর এই সিদ্ধান্তটি বিচার করবার চেষ্টা করেছি। 

যদিও ঠিক কবে, কোন যুগে, সমগ্র ভারত এ-ভাবে লোকায়ত-মতের প্রভাবে প্লাবিত হয়েছিলো লেখক সে-কথা আমাদের বলেননি, তবুও নিশ্চয়ই রাজা থেকে ভিখিরি পর্যন্ত সকলের পক্ষে একটি মতবাদ নিয়ে এমনভাবে মেতে ওঠবার কাহিনী অত্যন্ত রোমাঞ্চকর মনে হতে বাধ্য। তাই এর পর লোকায়ত সংক্রান্ত রিস ডেভিডস এর সিদ্ধান্তটি শুনতে অত্যন্ত নৈরাশ্যজনকই মনে হবে। কেননা তিনি বলছেন, কোনোকালেই এ-দেশে লোকায়ত-দর্শন বলে কোনো কিছুই ছিলো না। সমগ্র বৌদ্ধশাস্ত্রে লোকায়ত-সংক্রান্ত মতো তথ্য পাওয়া যায় সেগুলি বিশ্লেষণ করে তিনি মন্তব্য করেছেন। 

Throughout the whole story we have no evidence of any one who called himself a Lokayatika….And of the real existence of a school of thought, or of a system of philosophy that called itself by that name, there is no trace. 

অবশ্যই, নিজেকে লোকায়তিক বলছেন এমন কারুর কথা কোথাও পাওয়া যাক আর নাই যাক অপরকে লোকায়তিক বলে সনাক্ত করবার দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই বিরল নয়। এসব ক্ষেত্রে লোকায়ত বলতে কী বোঝা দরকার? রিস ডেভিডস বলছেন, folklore বা nature-lore.

After the early use of the word in some such sense as Nature-lore or folk-lore, there is a tone of unreality over all the statements we have…In the middle period, the riddles and quibbles of the nature-lorists were despised. In the last period the name Lokayata, Lokayatika became hobby horses, pegs on which certain writers can hang the views that they impute to their adversaries, and give them, in doing so, an odious name. 

প্রশ্ন হলো, রিস-ডেভিডস কেন এ-জাতীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন? অন্যান্য বিদ্বানদের মতো তার বেলাতেও কি এ-কথা খাটে যে, মাধবের উপর নির্ভরতাই এর প্রধান কারণ? আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, তা হতে পারে না। কেননা আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই মাধবের এ-বর্ণনাকে সরাসরি কাল্পনিক বলতে চেয়েছেন: 

His very able description has all the appearance of being drawn from his own imagination. 

তবুও, শুনতে যতোই আপাত-অসম্ভব মনে হোক না কেন, মাধব সম্বন্ধে এই তীব্র মন্তব্য সত্ত্বেও মাধবের উপর প্রচ্ছন্ন নির্ভরতার দারুনই তিনি শেষ পর্যন্ত লোকায়তকে এভাবে অলীক মনে করেছেন। যেন মাধবের যাথার্থ্যের 

উপরই লোকায়ত সত্তা নির্ভর করছে— তাঁর বর্ণনা যদি কাল্পনিক হয় তাহলে লোকায়তই কাল্পনিক হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, মাধবের এই বর্ণনাটিই লোকায়ত প্রসঙ্গে আমাদের একমাত্র সম্বল এবং এ-সম্বলটি কাল্পনিক বলেই সামগ্রিকভাবে লোকায়তকে কাল্পনিক মনে করা প্রয়োজন। 

রিস-ডেভিডস-এর যুক্তিটি ভালো করে বিশ্লেষণ করলে এ-কথা বুঝতে পারা যাবে। তিনি লক্ষ্য করছেন, বৌদ্ধ-গ্রন্থাবলী অনুসারে যে-ক’টি বিষয়ে পারদর্শিতা বিদ্বান ব্রাহ্মণের পক্ষে অপরিহার্য বলে বিবেচিত, তার মধ্যে একটি হলো ওই লোকায়ত । 

…the description of the good Brahmana, as put in the Buddhist Suttas, into the mouth of the Brahmanas themselves, mentions lokayata as one branch of his learning. The whole paragraph is complementary. And though the exact connotation of one or two of the other terms is doubtful, they are all descriptive of just those things which a Brahmana would have been rightly proud to be a master of. 

বলাই বাহুল্য, উত্তরকালে ব্রাহ্মণ-শ্রেণী বলতে আমাদের যে সাধারণ ধারণা তার সঙ্গে এ জাতীয় তথ্য খাপ খায় না। তাই এ জাতীয় তথ্যকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হলে বৌদ্ধশাস্ত্র-বর্ণিত ব্রাহ্মণ বলতে আমাদের চলতি ধারণাটির সংশোধন প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তাছাড়া আরো একটি সম্ভাবনাও রয়েছে। আমাদের মনে সাধারণত লোকায়ত বলতে যে-ধারণা আছে হয়তো সেটিও সংশোধন-সাপেক্ষ—এবং এই ধারণাটি মূলতই মাধবের কাছ থেকে পাওয়া। 

প্রসঙ্গান্তরে ব্যক্ত রিস-ডেভিডস-এর মন্তব্য থেকে অনুমান করা যায় যে, ব্রাহ্মণ সংক্রান্ত চলতি ধারণাটিকে সংশোধন করতে তিনি হয়তো আমাদের উৎসাহিতই করবেন। বৌদ্ধ-ভারতে জাতিভেদ ব্যবস্থার পরিস্থিতি এবং বৌদ্ধশাস্ত্রে ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ সংক্রান্ত তাঁর সিদ্ধান্তগুলি মনে রাখলে বৌদ্ধভারতে ব্রাহ্মণের পক্ষে বেদবিরোধী অর্থে নাস্তিক হওয়ার সম্ভাবনা খুব খাপছাড়া মনে না হতেও পারে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হলো, প্রধানতই মাধবের কাছ থেকে পাওয়া লোকায়ত-সংক্রান্ত আমাদের চলতি ধারণাটি সংশোধন করবার কথা। রিস্ ডেবিডস এর যুক্তিটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি এই বর্ণনাটিকে কাল্পনিক মনে করলে সামগ্রিকভাবে লোকায়তকেও অলীক মনে করা প্রয়োজন- – যেন লোকায়াতের পুনর্গঠনে মাধব ছাড়া আমরা সম্পূর্ণ নিরুপায়, মাধবকে মানতে পারা-না-পারার উপরই লোকায়তকেও মানতে পারা-না-পারা নির্ভর করছে। কিন্তু এইভাবে লোকায়তকে অলীক মনে করলেও প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত লোকায়ত শব্দটির একটা ব্যাখ্যা চাই। লেখক বলছেন, লোকায়ত বলতে প্রথমে বোঝাতো nature-lore বা folklore, কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্ব বা দার্শনিক মত নয়। ক্রমশ ফোকলোর নিন্দিত হয় এবং শেষপর্যন্ত লোকায়ত শব্দটিই শুধু একটা গালিগালাজের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। ফোকলোর মানে কী, তার মধ্যে কোনো আদিম পর্যায়ের বিশ্বাস ও তত্ত্বের পরিচয় আছে কিনা এবং কী ভাবে ও কেন আমাদের দেশের বর্তমানে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আমাদের দার্শনিক সাহিত্যের সাক্ষ্য অনুসারেই রিস ডেভিডস-এর এই মন্তব্য গ্রহণ করায় বাধা আছে। প্রথমত, আমরা আগেই দেখেছি যে, লোকায়তিকদের নিজস্ব রচনা বিলুপ্ত হলেও আমরা এ-কথা মানতে বাধ্য যে, কোনো এককালে এ জাতীয় রচনা যে সত্যিই ছির সে কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, সে-রচনা বিলুপ্ত হলেও লোকায়ত-খণ্ডনের নিদর্শন দুর্লভ নয় এবং এগুলি একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক তত্ত্বের—প্রধানতই দেহাত্মবাদের—খণ্ডন। শঙ্করাযার্যের রচনাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবং এ-কথা মনে করবার কোনো কারণ নেই যে, শঙ্করাচার্য যে-মতটি খণ্ডন করছেন তার আসল নাম লোকায়ত নয় এবং তার আসল নামটি উহ্য রেখে কেবল একটা সুবিধাজনক গালাগালি হিসেবেই তিনি আখ্যা দিয়েছেন। এ-জাতীয় কথা স্পষ্টই কষ্টকল্পিত হবে। কিন্তু রিস-ডেভিড্স-এর সিদ্ধান্ত স্বীকার করতে হলে এ-জাতীয় কথা কল্পনা না করেও উপায় নেই ।

.

আধুনিক বিদ্বানদের কয়েকটি সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা গেলো এবং দেখা গেলো সিদ্ধান্তগুলি আপাত-দৃষ্টিতে যতোই পরস্পর-বিরোধী ও অসংলগ্ন হোক না কেন, মোটামুটি একই পদ্ধতির পরিণাম : আধুনিক বিধানেরা লোকায়তর পুনর্গঠনে মাধবের বর্ণনাকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং তার সঙ্গে অন্যান্যসূত্রে পাওয়া লোকায়ত-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন–কেননা ওই বিভিন্ন তথ্য সত্যিই বিচিত্র, এমনকি আপাত দৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী ও অসংলগ্ন । মাধবের বর্ণনাটির প্রভাব মুক্ত হয়ে লোকায়তর পুনর্গঠনে এ-জাতীয় আপাত-অসংলগ্ন তথ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো সত্যিই যায় কিনা—সে-প্রশ্ন তোলবার আগে আমরা মাধবের বর্ণনাটিকে খুঁটিয়ে বিচার করবার চেষ্টা করবো।

.

ছুটি প্রধান কারণে মাধবের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সংশয় জাগতে পারে।

প্রথমত, মাধব ছিলেন খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর লেখক; অপরপক্ষে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র৩৮ এবং ব্রহ্মজালসূত্র প্রভৃতি প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে লোকায়তর উল্লেখ থেকেই অনুমান করা অসংগত নয় যে, মাধবের প্রায় ছ’হাজার বছর আগেও এদেশে লোকায়ত-মত সুপ্রচলিত ছিলো। অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে। এমনকি এ-কথা মনে করছেন যে, ঋগ্বেদেও যত্নবাদী চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ‘প্রাক্-বৌদ্ধ যুগেও যে বিশুদ্ধ বস্তুবাদের প্রচারক এ-দেশে ছিলেন সে-বিষয়ে স্বস্পষ্ট ইংগিত আছে’। একথা মনে করবার নিশ্চয়ই কোনো কারণ নেই যে, এই সুদীর্ঘ যুগের মধ্যে লোকায়ত মতের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অতএব, মাধবের সময়ে এবং বিশেষত ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে লোকায়ত – যজ্ঞের যে পরিণতি ঘটেছিলো মাধব বড়ো জোর তারই বর্ণনা করেছেন এবং এই রূপটিই লোকায়তর আদি-অঞ্চত্রিম রূপ মাও হতে পারে ।

দ্বিতীয়ত মাধবের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কথাও অগ্রাহ করা যায় না। ভ্রাতা সায়নাচার্যের মতোই তিনিও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও মন্ত্রী ছিলেন ; শুধু তাই নয়, এমন কথাও সন্দেহ করা হয় যে, এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য শঙ্কর মঠ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ তিনিই সংগ্রহ করেছিলেন। অতএব রাজনৈতিক ব্যাপারে তিনি গভীয়ভাবে লিপ্ত ছিলেন এবং তাঁর দার্শনিক উৎসাহটুকুও এ-রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়াই স্বাভাবিক। অপরপক্ষে, নামেই প্রকাশ যে, লোকায়ত হলো জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত ধ্যানধারণা। রাজনীতিতে যিনি অভিজাতশ্রেণীর এমন সমর্থক, তাঁর পক্ষে জনসাধারণের ধ্যানধারণাকে অবিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করবার মতো সহানুভূতি থাকা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক নয় ।

উত্তরে মাধবের পক্ষ থেকে বলা যায় এই ছুটি প্রাথমিক আপত্তির মধ্যে একটিরও গুরুত্ব বেশি নয়। আছি-লোকায়ত ও মাধবের মধ্যে সময়ের ব্যবধান অনেকখানি হতে পারে 3 কিন্তু ভারতীয় দর্শমের একটি বৈশিষ্ট্যই হলো অনেক যুগ ধরে তা মূলতই অপরিবর্তিত থাকে। আদি-লোকায়ত্তর মধ্যে যে চিন্তা বীজাকারে ছিলো মাধবের সময়ে তা হয়তো পত্রে-পুষ্পে বিকশিত হয়েছে এবং হয়তো অনেকাংশেই সংহত ও হুশৃঙ্খল হয়েছে; কিন্তু তার মানেই এই নয় যে, দুয়ের মধ্যে কোনো রকম গুণগত পার্থক্য অনুমান করবার সুযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মাধব ব্যক্তিগতভাবে লোকায়তর প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিহীন ছিলেন। কিন্তু আপত্তিটা শুধু মাধবের বেলাতেই বা কেন ? আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, বিপক্ষের রচনা ছাড়া লোকায়ত সংক্রান্ত কোনো তথ্যই সংগ্রহ করবার উপায় নেই। এবং বিপক্ষের মধ্যে অন্যের। হয়তো মাধবের মতো অমন প্রকটভাবে রাজনীতিতে উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের ধর্মগত ও সম্প্রদায়গত উৎসাহও কম তীব্র নয়— ফলে লোকায়ত – প্রসঙ্গে অন্য কারুর উক্তি যে মাধবের চেয়ে বেশি নৈর্ব্যক্তিক হবে এমন সম্ভাবনা সত্যিই সংকীর্ণ।

কিন্তু এই দুটি প্রাথমিক আপত্তির বিরুদ্ধে মাধবকে সমর্থন করা সম্ভব হলেও আমরা তাঁর লোকায়ত-বর্ণনকে সন্দেহ করতে বাধ্য হয়েছি। কেননা তাঁর রচনার আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য এবং বিশেষত তাঁর রচনা-বহির্ভূত আনুষঙ্গিক তথ্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে যায় ।
আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য হিসেবে আমরা প্রধানত দুটি বিষয়ের আলোচনা করবো। এক : মাধবের রচনাভঙ্গি। দুই : অনুমান-প্রসঙ্গে লোকায়ত-মত ।

মাবাধবের রচনাভঙ্গি। অধ্যাপক ই.বি. কাওয়েল লিখছেন, বিপক্ষের মতবাদ আলোচনা করবার সময় মাধব এক অদ্ভুত পরিহাস-রসের পরিচয় দেন–তিনি যেন বিপক্ষের স্থান নিজেই গ্রহণ করেন এবং এমন একটা ভঙ্গিতে তর্ক করেন যে, আসলে যে-মতবাদের সঙ্গে তার সত্যিই কোনো সম্পর্ক নেই সাময়িকভাবে তিনি যেন সেই মতবাদটিই গ্রহণ করেছেন! 

অধ্যাপক কাওয়েল এর এ মন্তব্য অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এর থেকে বোঝা যায়, সৃজনী চিন্তার প্রতিভায় মাধব অসামান্য ছিলেন; কিন্তু এর থেকেই অনুমান করা প্রয়োজন যে, মাধবের বর্ণনা থেকে তাঁর বিপক্ষ-মতকে বোঝাবার চেষ্টা বিপজ্জনক। যেমন, প্লেটোর তুলনায় জেনোফেন অনেক কম প্রতিভাশালী ছিলেন বলেই সক্রেটিসের মত নৈর্ব্যক্তিকভাবে বোঝাবার জন্য জেনোফেনের বর্ণনার উপর নির্ভর করা তুলনামূলক নিরাপদ— অনেকটা সেই রকম। যদিও অন্যান্য দিক থেকে দুটি পরিস্থিতিতে বহু প্রভেদ আছে। 

মাধবের ওই প্রতিভাই তার রচনার নৈর্ব্যক্তিকতার অন্তরায়। লোকায়তিকেরা ঠিক কী ভাবে তর্ক করেন, ঠিক কী তত্ত্ব প্রতিপন্ন করতে চান–শুধুমাত্র তারই একটা সহজ পরিচয় দিয়ে সন্তুষ্ট থাকা মাধবের মতো প্রতিভাশালীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার বদলে তিনি যেন এ-কথা বলতেই অনেক বেশি ব্যস্ত যে, তিনি নিজে যদি লোকায়তিক হতেন তাহলে ঠিক কী ভাবে তর্ক করতেন, কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা করতেন। এককথায়, নিজস্ব সৃজনী চিন্তার বন্যায় তিনি যেন ভেস যান; ফলে রোকায়তর বাস্তব বর্ণনাটুকুর মধ্যে আবদ্ধ থাকা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। 

এর ফলে নানা রকম অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক । মাধব নিজে ছিলেন বৈদান্তিক; এবং লোকায়তিকের তর্কপদ্ধতি আর যাই হোক বৈদান্তিকের মতো হতে পারে না। কেননা, বেদান্ত মতে শ্রুতিই চূড়ান্ত প্রমাণ, অতএব শ্রুত্যনুগৃহীত তর্কের মূল্য থাকতে পারে, কিন্তু শুধু-তর্ক অপ্রতিষ্ঠ। এই কারণে বৈদান্তিকেরা আত্মপক্ষ সমর্থনে নানা রকম যুক্তিতর্ক দিলেও শেষ পর্যন্ত শ্রুতিবাক্য উদ্ধৃত করেই নিজেদের বক্তব্যকে চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন। বলাই বাহুল্য, এ-পদ্ধতি লোকায়ত-স্বীকৃত হতে পারে না; কেননা মাধবের রচনা ছাড়াও অন্যান্য সূত্রে অন্তত এটুকু বাঝো যায় যে, লোকায়তকেরা শ্রুতি-বিরোধী ছিলেন। অতএব, লোকায়তকেরা যে আত্মপক্ষ সমর্থনে শ্রুতি উদ্ধৃত করবেন এমন সম্ভাবনা নিশ্চয়ই প্রবাদ-বচনের ‘ভূতের মুখে রাম নামের’ চেয়েও সুদূরপরাহত। অথচ নিজের তর্কপদ্ধতি নিয়ে মাধব এমনই বিভোর যে, লোকায়তকদের মুখে শ্রুতিবাক্য বসিয়ে দিতেও তার দ্বিধা হয়নি: “তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি। তেভ্য এব দেহাকার পরিণতেভ্যঃ কিণ্বাদিভ্যো মদশক্তিবচ্চৈতন্যমুপজায়তে। তেষু বিনষ্টেষু সৎযুস্বয়ং বিনশ্যতি। তদাহুঃ- ‘বিজ্ঞানঘন এবৈতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুত্থায় তান্যেবাসু বিনশ্যতি ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তি’।। বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২, ৪, ১২ ॥ বলাই বাহুল্য, বৃহদারণ্যকের এই উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য যাই হোক না কেন, লোকায়তিকেরা যে তারই সাহায্যে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করবেন—একথা কল্পনাতীত। অথচ, মাধব অতি অনায়াসেই তা লোকায়তিকদের উপরেও আরোপ করেছেন! এবং মাধবের রচনাভঙ্গি যদি একই রকম হয় তাহলে তাঁর বর্ননার উপর নির্ভর করে লোকায়তর অকৃত্রিম পরিচয় পাবার সম্ভাবনা সত্যিই কতোটুকু? 

মাধবের রচনার আর একটি আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য বিচার করা যাক। আমরা সাধারণত ধরে নিই যে, লোকায়তিকের অনুমানকে অসিদ্ধ মনে করেন এবং অতএব প্রমাণ হিসেবে অনুমান-নির্ভর শ্রুতি প্রভৃতিরও মূল্য অস্বীকার করে তারা শুধু ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন। আমাদের এই চলতি ধারণাটি প্রধানতই মাধবের কাছ থেকে পাওয়া এবং লোকায়তিকেরা যে কীভাবে অনুমানকে অপ্রতিষ্ঠ বলে প্রতিপন্ন করতে চান এ-বিষয়ে মাধব একটি সুচিন্তিত যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। বলাই বাহুল্য, এ-রকম চুড়ান্ত অর্থে অনুমানের মূল্য অস্বীকার করলে তর্কপদ্ধতিরই কোনো রকম নির্ভরযোগ্যতা থাকে না। ফলে, লোকায়তিকদের জবাব দেওয়াও অনেক সহজ হয়; তোমরাই বলো অনুমানের কোনো মূল্য নেই অথচ তোমরাই আবার তর্ক করে সে-কথা প্রমাণ করতে চাও। কিংবা, নৈয়ায়িক উদয়ন যেমন বলছেন, লোকায়তিকদের এ-দাবি মানলে এমনকি ব্যবহারিক জীবনও অসম্ভব হয়ে পড়ে, কেননা ঠিক বর্তমান মুহূর্তে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যেটুকু জানা যাচ্ছে তা ছাড়া আর কিছুর সত্তাই মানা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, লোকায়তিকদের নিয়ে এ-ভাবে যুক্তিতর্কের মূল্য সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করানোর ব্যাপারে মাধব সত্যিই কতোখানি বস্তুনিষ্ঠ? অর্থাৎ সত্যিই কি লোকায়তিকেরা এমন চুড়ান্ত অর্থে অনুমানের মূল্য অস্বীকার করেছেন যে, তাঁদের দাবি অনুসারে যুক্তি মাত্রই নিষ্ফল হয়ে দাঁড়ায়? না, এখানেও মাধব তাঁর নিজস্ব ধারণাই লোকায়তিকদের উপর আরোপ করবার আয়োজন করছেন? 

পঞ্চদশ শতাব্দীর বৌদ্ধ টীকাকার রোকায়তকে ‘বিতণ্ডা-বাদ-সথ্‌থ’ বলে বর্ণনা করেছেন। সথ্‌থ মানে শাস্ত্র। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত প্রশ্ন তুলেছেন, একই সঙ্গে লোকায়ত কীভাবে বিতণ্ডা এবং বাদ উভয় শাস্ত্র হতে পারে? কেননা, নৈয়ায়িকদের ব্যাখ্যা অনুসারে ‘বিতণ্ডা’ হলো কোনো নির্দিষ্ট মত প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা না করে শুধুই নেতিমূলক কুটতর্ক; এবং ‘বাদ’ হলো একটি নির্দিষ্ট মত স্থাপনের উদ্দেশ্যেই সুস্থ তর্ক। উত্তরে অধ্যাপক দাসগুপ্ত বলছেন, বৌদ্ধর ‘বিতণ্ডা’ এবং ‘বাদ’ দুয়ের মধ্যে এ-জাতীয় প্রভেদ করতেন না। তাই যদিও নৈয়ায়িক অৰ্থে লোকায়ত শুধু বিতণ্ডাই ছিলো তবুও বৌদ্ধরা তাকে ‘বাদ’ বলতেও দ্বিধা করেননি। অবশ্যই এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, বৌদ্ধরা লোকায়তকে এই রকমই বৃথা-তর্কে ব্যাপৃত বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু সে-বর্ণনা যে অনেকাংশেই কাল্পনিক এ-কথা সন্দেহ করবার ও কারণ আছে। কেননা বৌদ্ধর লোকায়তিকদের উপর এমন কিছুকিছু তর্ক আরোপ করেছেন যা স্পষ্টতই আজগুবি এবং অসম্ভব। যেমন: কাক সাদা, কেননা তার হাড় সাদা; বক লাল কেননা তার রক্ত লাল। বলাই বাহুল্য, লোকায়তিকেরা যদি এ-জাতীয় আজগুবি তর্কে ব্যাপৃত থাকতেন তাহলে তাঁদের কথা খণ্ডন করবার জন্য বিপক্ষের এমন মাথা ব্যাথা থাকতো না। তাছাড়া অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে এ-কথাও অনুমান করবার সুযোগ আছে যে, লোকায়তিকের শুধুমাত্র নিষ্ফল কুটতর্ক করতেন না। শুক্রনীতিসার অনুসারে নাস্তিক-শাস্ত্র তর্কবিদ্যায় পারদর্শী। মনুস্মৃতির টীকাকার মেধাতিথি চার্বাকদের তর্কবিদ্যার উল্লেখ করেছেন এবং স্বয়ং মনু হেতুশাস্ত্র এবং হৈতুকাঃ শব্দ ব্যবহার করছেন এবং অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই বলছেন যে, এখানে লোকায়তিকদেরই উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, কেননা নৈয়ায়িক এবং মীমাংসকদেরও যদিও হৈতুকাঃ বা তার্কী বলে উল্লেখ করবার দৃষ্টান্ত আছে। তবুও এগুলি আস্তিক সম্প্রদায়; অপরপক্ষে মনু-উল্লিখিত হৈতুকরা নাস্তিক ছিলেন। ভাগবতপুরাণেও নাস্তিক এবং পাষণ্ডীদের সঙ্গেই হৈতুকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

অবশ্যই মনু এই হৈতুকদের বিরুদ্ধে কঠিন বিধান দিয়েছেন। কিন্তু তার থেকে শুধু এটুকুই প্রমাণ হয় যে, লোকায়িতকরা বেদ বিরোধী তর্ক করতেন; অর্থাৎ এ কথা প্রমাণ হয় না যে, তারা নিষ্ফল বিতণ্ডায় ব্যাপৃত থাকতেন। অপরপক্ষে কৌটিল্য সাংখ্য ও যোগের সঙ্গেই আম্বীক্ষিকী হিসেবেই লোকায়তর উল্লেখ করেছেন এবং লোকায়ত সেখানে নিন্দিত নয়। তাছাড়া, দীঘনিকায় (৩, ১, ৩) এবং অঙ্গুত্তর ( ১, ১৬৩) বলে প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে লোকায়তর উল্লেখ পাওয়া যায়, হয়তো এখানেও লোকায়ত-শাস্ত্র বলতে তর্কশাস্ত্রই বোঝানো হয়েছে। 

এ-জাতীয় তথ্য থেকে অন্তত এটুকু কথা অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে,তর্কের—তথা অনুমানের—প্রতি লোকায়তিকদের দৃষ্টিভঙ্গিটা মূলতই নেতিবাচক ছিলো না। অথচ, মাধবের লোকায়ত-বর্ণনের তাৎপর্য তাই-ই। ফলে এদিক থেকেও মাধবের বর্ণনাটিকে সন্দেহ করবার অবকাশ আছে। শুধু তাই নয়; লোকায়তিকের ঠিক কী বলেন এবং কী ভাবে তা প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেন তার নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনা দেবার চেয়েও মাধবের বড়ো উৎসাহ হলো, তিনি নিজে লোকায়তিক হলে কী বলতেন এবং কী ভাবে সে-কথা প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করতেন। সেইহেতু অনুমানের-তথা তর্কের-প্রামাণ্য-প্রসঙ্গে লোকায়তিকদের উপর তিনি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করছেন যা সত্যি বলতে প্রচ্ছন্ন ভাবে তাঁর নিজেরই—অর্থাৎ বৈদান্তিকেরই—দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করেছেন যা সত্যি বলতে প্রচ্ছন্ন-ভাবে তাঁর নিজের বৈদান্তিকেরই—দৃষ্টিভঙ্গি। কেননা ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে একমাত্র বেদান্ত-সম্প্রদায়ই তর্কের প্রমাণ্যের প্রতি এ-রকম চুড়ান্ত নেতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। বেদান্ত সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা উত্তরকালে অনুমান-প্রসঙ্গে যে-মন্তব্যই করুন না কেন, আমাদের পক্ষে বাদরায়ণের রচনার উপর নির্ভর করেই বোন্তের মূল কথা বোঝা দরকার এবং বাদরায়ণ বলছেন তর্ক অপ্রতিষ্ঠ। কেননা প্রমাণ হিসেবে একমাত্র শ্রুতিরই মূল্য আছে। যদি সামগ্রিকভাবে তর্কই অপ্রতিস্ঠ হয় তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান-পদ্ধতির কোনো প্রতিষ্ঠা স্বীকার করা যায় না। অতএব, অনুমানও অপ্রতিষ্ঠ। এবং এটি মাধবের মত, যদিও তিনি তা লোকায়তিকদের উপরই আরোপ করেছেন। অপরপক্ষে, কৌটিল্য প্রভৃতির সাক্ষ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, তর্কের প্রতি লোকায়তিকদের দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই এমন নেতিবাচক ছিলো না; বরং তাঁরাই হয়তো ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে তর্ক-বিদ্যার প্রবর্তক ছিলেন। কেননা এর চেয়ে কোনো পুরোনো সূত্রে আত্মীক্ষিকী হিসেবে আর কোনো দার্শনিকদের উল্লেখ পাওয়া যায় না। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, তর্কের প্রমাণ্যের প্রতি এ-রকম মূলতই নেতিবাচক দৃষ্টিভদি না থাকলেও লোকায়তিকেরা হয়তো শুধুমাত্র নেতিবাচক উদ্দেশ্যই- ন্যায়শাস্ত্রের সংজ্ঞা অনুসারে শুধুমাত্র বিতণ্ডা হিসেবেই তর্কের ব্যবহার করতেন। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী—যেমন বলেছেন, they have a few doctrines to defend but a lot to assail, ইত্যাদি। এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ নেই যে, লোকায়তিকদের সম্বন্ধে আমরা প্রধানত এই রকমই একটা ধারণা পেয়েছি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, লোকায়ত সংক্রান্ত তথ্যের উৎস বলতে বিপক্ষের রচনাই এবং বিপক্ষেরা স্বভাবতই লোকায়তিকদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই লোকায়তিকদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন; অর্থাৎ, লোকায়তিকের তাদের দাবিগুলি যে-ভাবে খণ্ডন করতে চান তারই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। ফলে, লোকায়ত-সংক্রান্ত আমাদের তথ্যটুকুই প্রধানত নেতিবাচক-লোকায়তিকের কী কী মানেন না তারই পরিচয়। অতএব, আমাদের মনেও এমন একটা ধারণা জন্মানো অস্বাভাবিক নয় যে, লোকায়তিকের বিশেষ কিছুই মানেন না, তার বদলে সব কিছুই যেন শুধু অস্বীকার করতে চান। কিন্তু লোকায়ত-সংক্রান্ত আমাদের ধারণার এই অসম্পূর্ণতাকে লোকায়তর বৈশিষ্ট্য মনে করা ঠিক হবে না। 

সুখের বিষয় অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত তর্ক ও অনুমানের প্রতি লোকায়তিকদের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত একটি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছেন: তথ্যটির বিশেষ গুরুত্ব এই যে, এখানে তর্ক ও অনুমানের প্রতি লোকায়তিক দৃষ্টিভঙ্গিটি জনৈক লোকায়তিকের নামের সঙ্গেই সংযুক্ত। তার নাম পুরন্দর এবং অধ্যাপক তুচি ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত উভয়েই স্বীকার করছেন যে, পুরন্দর স্বয়ং লোকায়তিক ছিলেন। অধ্যাপক দাসগুপ্ত বলেছেন, পুরন্দর 

Admits the usefulness of inference in determining the nature of all worldy things where perceptual experience is available; but inference cannot be employed for establishing any dogma regarding the transcendental world, or life after death or the laws of Karma, which cannot be available to ordinary perceptual experience. The main reason for upholding such a distinction between the validity of experience in our practical life of ordinary experience, and in ascertaining transcending truths beyond experience lies in this, that an inductive generalization is made by observing a large number of cases of agreement in presence, together with agreement in absence, and no case of agreement in presence can be observed in the transcendent sphere; for even if such spheres existed they could not be perceived by the senses. Thus, since in the supposed supra-sensuous transcendent world no case of a hetu agreeing with the presence of its sadhya can be observed, no inductive generalization or law of concomitance can be made, relating to this sphere. 

ঠিক কী কী তথ্যের নির্ভরে অধ্যাপক দাসগুপ্ত এই মতকেই পুরন্দরের মত বলে ব্যাখ্যা করছেন তা অবশ্যই চিত্তাকর্ষক: এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক দাসগুপ্তের ব্যাখ্যা পাদটীকাও দ্রষ্টব্য।

আপাতত আমাদের মন্তব্য হলো, এই যদি পুরন্দরের মত হয় এবং পুরন্দর যদি স্বয়ং লোকায়তিক হন, তাহলে মানতে হবে অনুমান- প্রসঙ্গে মাধব লোকায়তিকদের উপর যে-মত আরোপ করছেন তা বহুলাংশেই মাধবের কল্পনা প্রসূত। 

.

পুরন্দর-প্রসঙ্গ মাধবের রচনা-বহির্ভূত সাক্ষ্যের আলোচনায় আমাদের উপনীত করলো। এবার সেদিক থেকে দেখা যাক মাধবের লোকায়ত-বর্ণনাকে কতোখানি বস্তুনিষ্ঠ মনে করবার সুযোগ আছে। 

অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে বলছেন, এ কথা মনে করাই স্বাভাবিক যে, বিপক্ষের রচনা থেকে লোকায়ত সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য আমরা পাচ্ছি লোকায়ত আদিতে তার চেয়ে অনেক গভীর তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো এবং লোকায়তর দার্শনিক পরিণতিও অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ হয়েছিলো। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে-কথা মনে করাই স্বাভাবিক কেন? অধ্যাপক বেলভেলকায় ও রানাডের রচনা থেকে প্রশ্নটির উত্তয় পাওয়া যায়। লোকায়ত- প্রসঙ্গে তারা বলছেন, 

Its great seductive charm and extensive vogue cannot be readily explained on the usual assumptions regarding the purely negative and destructive character of its tenets. 

প্রধানত মাধবের প্রভাবেই যে আমরা লোকায়তকে এ-রকম চুড়ান্ত নেতিমূলক বলে মনে করে থাকি সে কথা অত্যন্ত স্পট বলেই বোধ হয় লেখকদ্বয় আর তার ব্যাখ্যা করেননি। আমাদের যুক্তি হবে, লেখকদ্বয় যাকে লোকায়তর seductive charm and extensive yogae বলে বর্ণনা করছেন। তাই মাধবের লোকায়ত-বর্ণনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালো সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। 

আমাদের দেশে লোকায়তর প্রভাব যে বিশাল ও গভীর ছিলো—সে বিষয়ে নানা প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রথমত, লোকায়ত নামটির বুৎপত্তিগত অর্থ: সাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত, এই অর্থেই নাম লোকায়ত। মনে মাখা প্রয়োজন যে, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অধ্যাপক কাওয়েল এই অর্থেই লোকায়ত নামটিকে প্রগণ করেছেন। মাধব নিজেও জানতেন যে, লোকেষু আয়ত অর্থেই এর নাম লোকায়ত । কিন্তু নামটির এ-তাৎপর্যকে তিনি হেয়ত্ব সূচক অর্থেই ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন; সাধারন লোক অর্থ ও কাম ছাড়া আর কিছু বোঝে না বলেই পরলোক অস্বীকার করে চার্বাক মতের অনুগমন করে-এই কারণেই চার্বাক-মতের নাম লোকায়ত। গুণরত্ব এবং শঙ্করাচার্যের রচনাতেও জনসাধারণের মধ্যে লোকায়ত-মতের ব্যাপক ও বিশাল প্রভাবকে এই রকমেরই অবজ্ঞাসূচক অর্থে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা দেখা যায়। গুণরত্ন বলছেন, সাধারণ লোক নির্বিচার বলেই এ-মত গ্রহণ করে থাকে। শঙ্করাচার্য বলছেন, এ-মত প্রাকৃত-জনের পক্ষেই স্বাভাবিক। 

কিন্তু এ-ধরনের অবজ্ঞাসূচক অর্থ যে নেহাতই অলীক সে-বিষয়ে অনেক প্রমাণ দেওয়া যায় । 

মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদী বলছেন: “পূর্বে পিতা একজন পণ্ডিত ব্রাহ্মণকে আপনার ভবনে বাস করাইয়াছিলেন, আমিও তৎকালে তাঁহাদের নিকট ইহা শ্রবণ করিয়াছিলাম। হে মহারাজ! আমি যখন ঐ সমস্ত বিষয় শুনিবার মানসে কোনো কার্যোদ্দেশে পিতার ক্রোড়ে গিয়া বসিতাম, তখন সেই ব্রাহ্মণ আমাকে সান্ত্বনা করিয়া এই সকল নীতি করিতেন”। 

বলাই বাহুল্য, ভারতীয় ঐতিহ্যকে অত্যন্ত মৌলিকভাবে অস্বীকার না করলে, মানতে হবে বৃহস্পতিপ্রোক্ত নীতি এবং লোকায়ত-মত স্বতন্ত্র নয়। তাছাড়া, রিস্ ডেভিডস যেমন দেখাচ্ছেন, মহাভারতে (১,২৮৮৯ = হরিবংশ, ১৪০৬৮) দেখা যায় at the end of a list of the accomplishments of learned Brahmanas, they are said to be masters of the Lokayata। অতএব, লোকায়ত বলতে যাই বোঝাক না কেন, তাকে প্রাকৃত-জনের নির্বিচার ভোগপ্রিয়তার পরিণাম মনে করবার কারণ নেই। 

দ্রৌপদী ছিলেন পাঞ্চালী-পঞ্চাল-কন্যা। বৌদ্ধ-ভারতের মানচিত্রে আমরা কুরু ও পঞ্চালদের পরিচয় পাই। অধ্যাপক গার্বে প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানেরা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, ভারতের এই উত্তরপূর্ব এলাকাটিতে—অর্থাৎ যাকে আমরা সাধারণত বৌদ্ধ ভারত বলে উল্লেখ করি, সেখানে—বৈদিক প্রভাব অনেক পরে প্রবেশলাভ করেছে ও সংহত হয়েছে। ফলে প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্রে—অর্থাৎ, যে যুগে এবং ভারতের ওই অঞ্চলে—ব্রাহ্মণ বলতে যাই বোঝাক না কেন, তার সঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্র-বর্ণিত ব্রাহ্মণের হুবহু সাদৃশ্য আশা করা সঙ্গত নয়। এ-বিষয়ে অধ্যাপক রিচার্ড ফিক ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উদাহরণ-স্বরূপ তিনি দেখাচ্ছেন, মনুর মতে ব্রাহ্মণের পক্ষে কৃষিকাজ গর্হিত; অথচ জাতকের গল্পে ব্রাহ্মণ প্রধানতই কৃষিকর্মে ব্যাপৃত। 

অবশ্যই বৌদ্ধ ভারতে ব্রাহ্মণ শব্দের তাৎপর্য ঠিক কী ছিল, সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। কিন্তু মাধবাচার্য্যের লোকায়ত-বর্ণনের বিরুদ্ধে যুক্তি শুধু এই নয় যে, বৌদ্ধ ভারতে যাদের ব্রাহ্মণ বলা হতো তাঁরা লোকায়তর চর্চা করতেন; আরো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুসারে এই ব্রাহ্মণেরা যারা লোকায়তার চর্চা করতেন—তারা বিদ্বান বলেও পরিগণিত ছিলেন। অর্থাৎ, লোকায়তর জ্ঞান বিদ্বান ব্রাহ্মণদের পক্ষে অপরিহার্য বলে পরিগণিত হতো। এ-বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বেই রিস-ডেভিডস-এর মন্তব্য উদ্ধৃত করেছি। পাঞ্চালী দ্রৌপদীও বলছেন, লোকায়ত-বিদ্যা শেখাবার জন্য তাঁর পিতা জনৈক বিদ্বান আচার্যকে নিয়োগ করেছিলেন। যদি তাই হয় তাহলে লোকায়তকে প্রাকৃত জনের স্বভাব স্থূল অর্থ কামপ্রবণতার পরিচায়ক মনে করা যায় না। 

শুধু ব্রাহ্মণই বা কেন। রিস-ডেভিডস বলছেন, মিলিন্দির এক জায়গায় উপাখ্যানের নায়কের উপর লোকায়ত জ্ঞান আরোপ করা হয়েছে। তাছড়া হর্ষচরিত্র-এর এক জায়গায় জ্ঞানী ও তপস্বীদের একটি দীর্ঘ তালিকার মধ্যে বৌদ্ধ, শ্বেতাম্বর জৈন, কপিল-শিষ্য, কণাদ-শিষ্য প্রমুখের সঙ্গেই লোকায়তিকেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং এ-জাতীয় উল্লেখের উপর নির্ভর করেও আমরা অনুমান করতে পারি, লোকায়ত-মতের বিশাল ও গভীর প্রভাবের— seductive charm and extensive vogue-এর—প্রকৃত ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, শঙ্কর ও মাধবের মতো বৈদান্তিক-প্রদত্ত ব্যাখ্যাটি স্বীকারযোগ্য না-হওয়াই সম্ভব। 

বিশেষত বৈদিক প্রভাব বহির্ভুত অঞ্চলে লোকায়তর এই seductive charm and extensive vogue-এর সঙ্গে বেদপন্থীদেরে পক্ষ থেকে লোকায়তর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানের তুলনা করলে হয়তো এমন কথা সন্দেহ করবার অবকাশ থাকে যে, ওই ব্রাহ্মণ্যআদর্শের সঙ্গে লোকায়তর সংঘাত যেন অনেকাংশেই দুটি বিরুদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাতের ইংগিত দেয়। 

 মহাভারতের শান্তি পর্বের একটি উপাখ্যান থেকে আলোচনা শুরু করা যাক।

“পাণ্ডবগণের পুরপ্রবেশকালে সহস্র সহস্র পুরবাসী প্রজা দর্শনাকাঙ্খী হইয়া তথায় আগমন করিতে লাগিল।…ঐ সময় সহস্ৰ সহস্ৰ ব্রাহ্মণ প্রীতি-প্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণপূর্বক অবস্থান করিতেছিলেন। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করিয়াই নির্ভীকচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্বিত বাক্যে যুধিষ্টিরকে সম্বোধন পুর্বক কহিল, ‘মহারাজ! এই ব্রাহ্মণগণ আপনাকে জ্ঞাতিঘাতী ও অতি কুৎসিত রাজা বলিয়া ধিক্কার প্রদান করিতেছেন। ফলতঃ এইরূপ জ্ঞাতিসংহার ও গুরুজনদিগের বিনাশ সাধন করিয়া আপনার কী লাভ হইল? এক্ষণে আপনার মৃত্যুই শ্রেয়।”… তখন তত্রত্য অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ চার্যাকের সেই বাক্য শ্রবণে সাতিশয় ক্রুদ্ধ, ব্যথিত ও লজ্জিত হইয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। রাজা যুধিষ্টির ব্রাহ্মণগণকে তদাবস্থা দেখিয়া…কহিলেন,..আমি অচিরাৎ প্রাণত্যাগ করিব, আপনারা আর আমাকে ধিক্কার প্রদান করিবেন না। 

তখন সেই ব্রাহ্মণগণ রাজা যুধিষ্টিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ধর্মরাজ! আমরা আপনাকে ধিক্কার প্রদান করি নাই, আপনার মঙ্গল হউক। তপোনুষ্ঠানসম্পন্ন বেদবেত্তা দ্বিজাতিগণ যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলিয়া জানচক্ষুদ্বারা চার্যাককে বিশেষ জ্ঞাত হইয়া পুনরায় ধর্মরাজকে কহিলেন, মহারাজ! যে ব্যক্তি আপনার প্রতি কুটুক্তি করিল, ঐ দুরাত্মা দুর্যোধনের পরম বন্ধু চার্বাক নামে রাক্ষস… 

অনন্তর সেই ব্রাহ্মণগণ চার্যাকের প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ভৎসনা করত হঙ্কার শব্দ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন চার্যাক সেই মহাত্মাদিগের ক্রোধাগ্নিতে দগ্ধপ্রায় হইয়া আপনি দগ্ধ পাদপের ন্যায় অচিরাৎ ভুতলে নিপাতিত হইল। মহারাজ যুধিষ্ঠির তদর্শনে ব্রাহ্মণগণকে যথোচিত সন্মান করিতে লাগিলেন। 

চার্বাক বর্ধের এই উপাখ্যান একাধিক দিক খেকে চিত্তাকর্ষক।

এখানে চার্বাক বা লোকায়তর যে নীতিকথার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গে অবশ্যই মাধব-বর্ণিত ঋণং-কৃস্ব—ঘৃতং-পিবেৎ জাতীয় স্কুল ভোগলিঙ্গার লেশমাত্র সম্পর্ক নেই। তার বদলে এখানে শুধু জ্ঞাতিহত্যার বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ ও নির্ভীক একটা প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে। এদিক থেকে লোকায়িক নীতিবোধের সঙ্গে প্রাচীন জ্ঞাতিভিত্তিক* সমাজের মূলমন্ত্রের সাদৃশ্য দেখা যায়। সে-সমাজে জাতিহত্যাই চূড়ান্ত মহাপাতক। অবশ্যই, বেদবেত্তা দ্বিজাতিগণ ওই জাতিভিত্তিক সমাজের মূল-নীতি অবদলিত করে, সে নীতি সমর্থককে দগ্ধ করে মহারাজ যধিষ্ঠিরের মহিমা কীর্তন করেছেন। হয়তো কুরুক্ষেত্রের কাহিনীর অন্তরালে ওই জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপর রাজশক্তির আবির্ভাব-কাহিনীর আভাস আছে এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় স্বয়ং শ্রীভগবানের মুখে এই সবপরিস্থিতির নতুন নীতিবোধাদির মহিমা কীর্তিত হতে শোনা যায়। শ্রীভগবান অর্জুনকে বলছেন, হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম। উত্তরকালে যারা বৈদিক ঐতিহ্যের বাহক বলে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন সেই বেদবেত্তা দ্বিজাতিগণের মূলমন্ত্র যদি এই হয় এবং এই মূলমন্ত্রের উপর নির্ভর করে তারা যদি জ্ঞাতিহত্যারও একটা নৈতিক সমর্থন উদ্ভাবন করতে পেরে থাকেন, তাহলে মাধবাচার্য লোকায়তিকদের উপর যে-স্থূল ভোগবাদ আরোপ করছেন তা আসলে চার্বাক-বধকারী ওই ব্রাহ্মণদের উপরই কতোখানি প্রযোজ্য সে-কথা ভেবে দেখবার অবকাশ থাকে নাকি? কিন্তু আপাতত জাতিভিত্তিক সমাজের সঙ্গে লোকায়ত-মতের সম্পর্কের ইংগিতটির দিকেই আমরা দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে চাই। কেননা, আমরা গ্রন্থমধ্যে (চতুর্থ পরিচ্ছেদে) দেখাবার চেষ্টা করেছি, মানবোন্নতির এই জাতিভিত্তিক যা প্রাক-ভিত্তক্ত পর্যায়ে মানবচেতনাও সাধারনভাবে প্রাক- অধ্যাত্মবাদী—যদিও এই প্রাক-অধ্যাত্মবাদী চেতনার বিকাশ বিচিত্র হতে পারে এবং জাদুবিশ্বাসের জটিলতায় তা আমাদের কাছে অনেকাংশেই দুর্বোধ্য ও অর্থহীন মনে হতে পারে। আমরা আরো দেখাবার চেষ্টা করেছি, দেশের রাষ্ট্রাকাশে সাম্রাজ্যের উত্থান পতন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জীবন থেকে ওই প্রাক-বিভক্ত সমাজের স্মারক অসম্পূর্ণভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে। অতএব ওই প্রাক-অধ্যাত্মবাদী পর্যায়ের চেতনাই সাধারণ মানুষের মধ্যে seductive charm and extensive vogue প্রসারিত করেছে। অর্থাৎ ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যেন দুটি স্পষ্ট ধারা স্বতন্ত্রভাবে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। একদিকে অধ্যাত্মবাদের মহিমা-মুখর শ্রেণীবিভক্ত সমাজের শাসক-শ্রেণীর সংস্কৃতি। অপরদিকে প্রাক-অধ্যাত্মবাদের- এবং, অতএব প্রাক-বিভক্ত পর্যায়ের-স্মারক-বহুল গণ-সংস্কৃতি। দ্বিতীয়টিই লোকেষু আয়ত এবং সেই অর্থে লোকায়ত । 

[* প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, বৌদ্ধ যুগেও ভারতের উত্তরপুব অঞ্চলটিতে—যে অঞ্চলে তখনো তথাকথিত ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব আপেক্ষিকভাবে অপ্রতিষ্ঠিত এবং লোকায়তও নিন্দিত নয়—জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজ বহুলাংশেই অক্ষুণ্ণ ছিল।]

এদিক থেকে লোকায়ত-প্রসাদে রিস-ডেভিডস্-এর সিদ্ধান্তটিকে নতুনভাবে বোঝবার অবকাশ থাকতে পারে। কেননা, লোকায়তকে সংকীর্ণ অর্থে একটি নির্দিষ্ট দার্শনিকমত হিসেবে সনাক্ত করা সত্যিই সম্ভব কিনা তা সন্দেহের কথা। রিস ডেভিডস বলছেন লোকায়ত বলতে folk-lore বোঝাতে কালক্রমে এই ফোক্‌-লোর নিন্দিত হয়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত লোকায়ত নামটিই গালিগালাজের সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু ফোক-লোর কেন নিন্দিত হলো সে-প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি। অপরপক্ষে, গণ-সংস্কৃতির নামান্তর হিসেবে বোঝবার চেষ্টা করলে এ-প্রশ্নের ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে, কেননা, ওই তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যনীতির প্রচারকদের পক্ষ থেকে লোকায়তকে অবদমন করবার জন্য অত্যন্ত ব্যপক ও বিচিত্র আয়োজন হয়েছিলো; আইনকারেরা লোকায়তর বিরুদ্ধে কঠিন বিধান দিয়েছিলেন, পুরাণকারেরা লোকায়তর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সঞ্চারের উদ্দেশ্যে অতিকথা রচনা করেছিলেন, নাট্যকারের রচনা করেছিলেন ব্যঙ্গবিদ্রুপ। সংকীর্ণ অর্থে একটি নির্দিষ্ট মতবাদের খণ্ডন হিসেবে বিশেষত দেশের আইনকার ও পুরাণকারীদের এতো রকম প্রচেষ্টা অসামঞ্জস্যমূলকই মনে হয় না কি? 

কিছুকিছু নমুনা দেখা যায়। লোকায়তর বিরুদ্ধে মনুর বিধান প্রসঙ্গে শ্রীযুক্ত জে. মুয়ার বলছেন, 

Such heretics appear to have been numerous when the Institutes were compiled, as the faithful are warned ( IV: 61 ) against living in a village ‘overrun with heretics’; ‘a kingdom in which sudras predominate, overrun with nihilists and destitute of Brahmins’ is said (VIII: 22 ) to be doomed to destruction; a king who is a nihilist is threatened with perdition (VIII. 309) and it is enjoined (IX: 225 ) that heretics shall be banished. Allusion is said to be made in V, 89, 90 and VIII, 363 to female anchorites of a heretical religion.

একই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত বলছেন, Manu says that the Brahmin who, through a greater Confidence in the science of logic (hetu-sastra) disregards the authority of the Vedas and the smriti, are but nastikas who Should be driven out by good men…Again in Manu IV. 30, it is said that one should not even speak with the heretics (pasandino) transgressors of caste disciplines (vikramasthan), hypocrites (vaidal-vratika), double-dealers and sophists (haituka). 

শ্রীযুক্ত মূয়ার এবং অধ্যাপক দাসগুপ্ত উভয়ের মতেই, মনুর এই বিধানগুলি লোকায়তিকদের প্রতিই প্রযুক্ত। অতএব প্রশ্ন উঠতে পারে: প্রাচীনকালের আইনকর্তারা যদি সত্যিই এতোভাবে লোকায়িতকদের দমন করবার আয়োজন করে থাকেন, তাহলে কি এগুলিকে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট মতবাদের খণ্ডন-প্রচেষ্টা বলে গ্রহণ না করে, তথাকথিত শ্রীমণ্য-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতাদের পক্ষে লোকসংস্কৃতিকে অবদলিত করবার এবং তার উপর ওই ব্যাহ্মণ্য-সংস্কৃতির মহিমাকে প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টা বলেই সন্দেহ করবার অবকাশ থাকে না? 

লোকায়তর বিরুদ্ধে পুরাণকারদের প্রচার প্রচেষ্টাও এই সন্দেহকেই দৃঢ়তর করতে চায় । 

বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, অসুরদের মোহগ্রন্ত করবার উদ্দেশ্যেই মায়ামোহ তাদের মধ্যে এই মারাত্মক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। এরই মোহে পড়ে অসুরের বৈদিক জ্ঞানকে উপহাস করতে শিখলেন; অতএব তাদের দারুণ অধঃপতন ঘটলো। সেই অবকাশে দেবতাদের শক্তি সঞ্চয় করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন এবং সহজেই অসুরদের পরাজিত করলেন। 

মৈত্রী উপনিষদেও মোটের উপর একই পৌরাণিক উপাখ্যানের সন্ধান পাওয়া যায়। উপনিষদের এই উপাখ্যানটি অনুসারে দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরগুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে ইন্দ্রের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই অসুরদের মধ্যে এই মারাত্মক ও অবিদ্যা-মূলক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন-সেই অবিদ্যার প্রভাবেই অসুরের অধর্মকে ধর্ম এবং ধর্মকে অধর্ম মনে করতে শুরু করেন। 

পৌরাণিক কাহিনী অবশ্যই ইতিহাস নয়। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনীর অন্তরালে ঐতিহাসিক তথ্যের ইংগিত পাওয়াও অসম্ভব নয়। লোকায়ত-প্রসঙ্গে আমরা যে-পৌরাণিক কাহিনীর সন্ধান পাই সেগুলির মূল ইংগিত হলো, লোকায়ত-মত সআসলে অসুরদেরই মত- অসুর মত। 

এই দিক থেকে লোকায়ত প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের সিদ্ধান্তটিকে নতুনভাবে বোঝবার অবকাশ থাকতে পারে। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি—এবং গ্রন্থমধ্যে এ-বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবারও চেষ্টা করেছি —যে প্রধানতই ছান্দোগ্য-উপনিষদের ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদের উপর নির্ভর করে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তও লোকায়ত-মতকে অসুরমত বলেই সনাক্ত করবার চেষ্টা করেছেন। অধ্যাপক দাসগুপ্ত মনে করেন, অসুর বলতে এখানে প্রাচীন সুমেরীয়দেরই উল্লেখ করা হয়েছে। এ-বিষয়ে অবশ্যই অন্যান্য ভারততত্ত্ববিদেরা তার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু অসুর বলতে যাদেরই বোঝাক না কেন, তাদের সংস্কৃতি যে-বেদবিরোধী ছিলো এবং অতএব বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের অন্তত পরবর্তীকালে যে তাদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখবার চেষ্টা করেছিলেন—এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীভগবান বলছেন, 

দ্বৌ ভুতসর্গোঁ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবে বিস্তরাশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু। ১৬.৬৷৷ 
প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিন্দুরাসুরাঃ। 
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে। ১৬,৭। 

এর সঙ্গে বিষ্ণুপুরাণ, মৈত্রী উপনিষদ প্রভৃতিতে ব্যক্ত অসুর মতের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের তুলনা করা যায়। 

সুখের বিষয় উপনিষদ এবং গীতায় এই ঘৃণা-বিদ্বেষের পরিচয় ছাড়াও অসুরমত সংক্রান্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট তথ্যেরও আভাস পাওয়া সম্ভব; লোকায়াতের পুনর্গঠন-প্রচেষ্টায় সেগুলি আমাদের সহায়ক হতে পারে। 

আমরা এ-জাতীয় দুটি তত্বের উল্লেখ করবো। এক: আত্মতত্ত্ব। দুই: সৃষ্টিতত্ত্ব। এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, উভয় তত্ত্বের দিক থেকেই এই অসুরামতের-তথা লোকায়ত মতের সঙ্গে তন্ত্রের আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। অতএব, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লোকায়তর সঙ্গে তান্ত্রিকাদি সম্প্রদায়গুলির যে-অভিন্নতা প্রতিপাদন করবার চেষ্টা করেছেন তার তাৎপর্য লঘুমূল্য নয়। 

প্রথমত আত্মতত্ত্বের কথাটা ধরা যাক। 

মৈত্রী উপনিষদের ( ৭, ১০ ) উপাখ্যান অনুসারে দেব ও অসুর উভয়েই আত্মকাম হয়ে (আত্মজ্ঞানের উদ্দেশ্যে) ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন । ব্রহ্মাকে নমস্কার করে তাঁরা বললেন, ভগবন, আমরা আত্মকাম হয়েছি, আমাদের (আত্মতত্ত্ব) বলুন। ব্রহ্মা অনেকক্ষণ চিন্তা করে স্থির করলেন, এই অসুরেরা ভ্রান্ত আত্মতত্ত্বেরই যোগ্য। তাই তিনি তাদের সম্পূর্ণ ভ্রান্ত উপদেশ দিলেন। অতএব এই অম্বরেরা মিথ্যাকেই সত্য বলে জেনে জীবনযাপন করে-ইন্দ্রজালের প্রভাবে যে-রকম অনৃতই সত্য বলে প্রতীয়মান হয় সেই রকম। 

অসুরদের আত্ম-তত্ত্ব ব্রহ্মার কাছ থেকেই শেখা। কিনা এ-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও মৈত্রী উপনিষদের উপাখ্যান থেকে একটি কথা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যায়: এখানে উপনিষদের ঋষি অসুরমতের মধ্যে বিশেষ করে আত্মতত্ত্বটিকেই ভ্রান্ত ও হেয় প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্যই অসুরদের আত্মতত্ত্ব বলতে ঠিক কী বোঝাতে সে-কথা মৈত্রী উপনিষদে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি-কেননা, ব্রহ্মা অসুরদের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট মতবাদ প্রচার করেছিলেন সে-প্রশ্নের উত্তর মৈত্রী উপনিষদে পাওয়া যায় না। 

কিন্তু ছান্দোগ্য উপনিষদে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। আমরা গ্রন্থমধ্যে ছান্দোগ্যর ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদটি উদ্ধৃত করেছি। এখানে শুধুমাত্র এটুকু উল্লেখ করলেই হবে যে, ছন্দোগ্যর উপাখ্যান অনুসারে অসুরদের এই আত্মতত্ত্ব বলতে দেহাত্মবাদ বা দেহতত্ত্বই বোঝাতো-বস্তুত এইদিক থেকেই অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়তর সঙ্গে অসুরমতের অভিন্নতা অনুমান করেছেন। 

মাধবাচার্যের বর্ণনা অনুসারেও এই দেহতত্ত্বই লোকায়তিকদের একটি প্রধান প্রতিপাদ্য। কিন্তু নানা কারণে আমরা মাধবের এই বর্ণনাটির উপর আস্থা স্থাপন করতে দ্বিধাবোধ করেছি। তবু এই দেহাত্মবাদই যে লোকায়তিকদের প্রধানতম প্রতিপাদ্য ছিলো সে-বিষয়ে মাধবাচার্যের রচনার চেয়েও অনেক পুরোনো প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব। আমরা দুটি প্রমাণের উল্লেখ করবো। এক, শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য দুই, প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্ৰ । 

ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য তিনবার লোকায়তিকদের সনাক্ত করতে চেয়েছেন। তিনবারই তিনি লোকায়ত-মত হিসেবে দেহাত্মবাদকেই সনাক্ত করতে চেয়েছেন। যথা: “দেহমাত্রং চৈতন্যবিশিষ্টামন্নেতি প্রাক্কতা জনা লোকায়তিকাশ্চ প্রতিপন্নাঃ ( ১, ১, ২ )”; “লোকায়তিকানামপি চেতন এব দেহোংচেতনানাং রথাদীনাং প্রবর্তকো দৃষ্ট…(২, ২, ২)”; “অত্রৈকে দেহমাত্রাত্মদর্শিনো লোকায়তিকা দেহব্যাতিরিক্তস্যাত্মনোংভাবং মন্যমানাঃ সমন্তব্যন্তেষু বাহ্যেষু পৃথিব্যাদিষদৃষ্টমপি চৈতন্যং শরীরাকারপরিণতেষু ভূতে স্যাদিতি স্যাদিতি সম্ভাবয়ন্তন্তেভ্যচৈতন্যং মদশক্তিববিজ্ঞানং চৈতন্যবিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষ ইতি চাহঃ (৩, ৩, ৫৩)” । অতএব, 

শঙ্করাচার্যের এই উক্তিগুলি থেকে অনুমিত হয় যে, তার সময় পর্যন্ত এই দেহাত্মবাদই লোকায়তমতের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়েছিলো। করছেন, 

লোকায়ত-মতের এই ব্যাখ্যার উল্লেখ করেই রিস-ডেভিডস মন্তব্য করেছেন,

A very similar, if not indeed the very same view is also controverted in the Brahmajala Sutta and is constantly referred to throughout the Pitakas under the stock phrase tam jivam tam sariram (for instance in Mahali and eJaliya Suttas.) 

রিস ডেভিডস-এর তর্জমা অনুসারে ব্রহ্মজাল সুত্ত প্রভৃতি প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লিখিত এই দেহাত্মবাদের বর্ণনা হলো, 

In the first place, brethren, some recluse or Brahman puts forth the following opinion, the following view: “Since, Sir, this soul has form, is built up of the four elements, and is the offspring of father and mother, it is cut off, destroyed, on the dissolution of the body; and does not continue after death; and then, Sir, the soul is completely annihilated…. 

যদি প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্রে বারবার এই দেহাত্মবাদেরই উল্লেখ পাওয়া যায় তাহলে অন্তত এটুকু অনুমিত হতে বাধ্য যে, বৌদ্ধ-ভারতে এ-জাতীয় একটি মতবাদ নিশ্চয়ই প্রচলিত ছিলো। এ বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই—এবং স্বয়ং রিস্ ডেভিডস্-ই সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন-যে ওই প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্রেই ‘লোকায়ত’ এবং ‘লোকায়তিক’ শব্দের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু রিস-ডেভিডস বলছেন, বৌদ্ধ শাস্ত্রের কোথাও উপরোক্ত দেহাত্মবাদই যে লোকায়তিকদের মতবাদ এ-কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। অর্থাৎ, দেহাত্মবাদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে এবং লোকায়ত নামেরও উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে-কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে না। আর তা যাচ্ছে না বলেই রিস-ডেভিডস দাবি করছেন, দু’য়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক অনুমিত হতে পারে না। ফলে, রিস-ডেভিডস-এর যুক্তি অনুসারে, শঙ্করাচার্য যখন লোকায়ত- মত হিসেবে এই দেহাত্মবাদেরই উল্লেখ করতে চান তখন তার উক্তি ভ্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক; 

Samkara, in setting forth his theory of the soul, controverts a curious opinion which he ascribes to Lokayatikas, possibly wrongly, as the very same opinion was controverted ages before in the Pitakas, and not there called Lokayata, though the word was used in Pitaka times. 

কিন্তু আমরা রিস্ ডেভিডস্-এর এ যুক্তি স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করেছি। পিটকে এই দেহাত্মবাদের খণ্ডনই আছে, পিটকে ওই লোকায়ত নামও আছে; কিন্তু লোকায়ত বলতে যে দেহাত্মবাদই বোঝাতো তা স্পষ্টভাবে বলা নেই । এ-কথা নিশ্চয়ই স্বীকার যোগ্য; কিন্তু এর থেকেই রিস ডেভিডস এর সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হয় না। যদি পিটক-সাহিত্যে ওই দেহাত্মবাদেরই নামান্তর পাওয়া যেতো, কিংবা, লোকায়ত নামের সঙ্গে তত্ত্বান্তরের সম্পর্ক নির্দিষ্ট হতো —তাহলে তার সিদ্ধান্তটি সমর্থনযোগ্য হতে পারতো। সে-জাতীয় কোনো ইংগিত বৌদ্ধ শাস্ত্রে নেই। এক্ষেত্রে রিস-ডেভিডস-এর সিদ্ধান্তটি মানতে হলে কল্পনা করা 

প্রয়োজন যে, বৌদ্ধ ভারতে এই দেহাত্মবাদের প্রভাব প্রভূত হলেও তার কোনো স্বতন্ত্র নাম ছিলো না, কিংবা অন্তত বৌদ্ধ-শাস্ত্র প্রণেতারা সে-নামটি উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করেননি। আরো কল্পনা করা প্রয়োজন যে, বৌদ্ধভারতে লোকায়ত বলতে অন্য কোনো তত্ত্ব বোঝাতে; কিন্তু বৌদ্ধ-শাস্ত্র প্রণেতারা শুধুমাত্র লোকায়ত নামটি ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট হতেন-লোকায়ত বলতে যে-তত্ত্ব বোঝাতো তার উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু উভয় সম্ভাবনাই কষ্টকল্পিত হতে বাধ্য। 

অপরপক্ষে, এই প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্যের সাক্ষ্যকেও এতোখানি লঘু মনে করবার সঙ্গত কারণ নেই। কেননা, রিস-ডেভিডস-এর মন্তব্য মানতে হলে স্বীকার করা প্রয়োজন যে, শঙ্করাচার্য যে-মতটির নাম দিচ্ছেন লোকায়ত সেটির নাম আসলে লোকায়তই নয়, অন্য কিছু; কিংবা হয়তো তার নিজস্ব কোনো নাময় ছিল না। যদি তাই হয় তাহলে তা সত্ত্বেও শঙ্করাচার্য কেন এতে লোকায়ত আখ্যা দিলেন, সে প্রশ্নের একটা সঙ্গত ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। ব্যাখ্যা হিসেবে রিস- ডেভিডস হয়তো বলবেন, ইতিমধ্যে লোকায়ত শব্দটিই গালিগালাজের সামিল হয়ে দাড়িয়েছিলো। কিন্তু সে-বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া, গালিগালাজ হিসেবে ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে অন্যান্য শব্দের প্রচলন বিরল নয়। 

বরং রিস-ডেভিডস নিজেই এই যে-সব তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তার থেকেই এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া স্বাভাবিক যে, লোকায়ত বলতে প্রধানতই এই দেহাত্মবাদ বোঝাতে : বৌদ্ধশাস্ত্রে এ- দেহাত্মবাদের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়, লোকায়ত নামের উল্লেখও বৌদ্ধ শাস্ত্রে বিরল নয়; এবং দুয়ের মধ্যে স্পষ্ট সম্পর্কের যে-উল্লেখ বৌদ্ধ শাস্ত্রে পাওয়া যাচ্ছে না, তা শঙ্করাচার্যের রচনায় পাওয়া যায় বলেই আমরা অনুমান করতে পারি যে, এ-বিষয়ে শঙ্করাচার্যের উক্তিগুলি বৌদ্ধ তথ্যের পরিপূরক হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। 

অতএব, এইভাবে লোকায়তার পুনর্গঠনে আমরা একটি সুনিশ্চিত মন্তব্যে উপনীত হতে পারি; লোকায়তিকদের একটি প্রধানতম তত্ত্ব বলতে দেহাত্মবাদই বুঝতে হবে। বিষ্ণুপুরাণ, মৈত্রী উপনিষদ প্রভৃতির সাক্ষ্য অনুসারে অনুমান হয় যে, প্রাচীনেরা এই লোকায়তকেই অসুরমত বলে বর্ণনা বা নিন্দা করেছিলেন। এবং অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত যেমন দেখাচ্ছেন, ছান্দোগ্য উপনিষদের ইন্দ্র- বিরোচন উপাখ্যান অনুসারেও অসুরমত বলতে এই দেহাত্মবাদই। 

কিন্তু, আমরা একটু আগেই দেখাবার চেষ্টা করেছি, লোকায়তর সঙ্গে তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতির সংঘর্ষ অনেকাংশেই দুটি বিরুদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে সংঘর্ষের আভাস দেয়। এবং লোকায়ত নামের বুৎপত্তিগত অর্থও হলো, সাধারণ লোকের মধ্যে পরিব্যাপ্ত। অধ্যাপক বেলবেলকার এবং রানাডে লোকায়তর extensive vogue and seducative charm -এর উল্লেখ করছেন। অতএব প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় ইতিহাসে বৈদিক ঐতিহা-বিরুদ্ধ এমন কোনো সাংস্কৃতিক ধারার পরিচয় কি আমরা পাই যা শুধু সুপ্রাচীনই নয়, তা একাধারে দেহাত্মবাদী এবং লোকেষু আয়ত, দুই-ই। 

ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুটি স্বতন্ত্র ধারা প্রবাহিত হতে দেখা যায়- বৈদিক ও তান্ত্রিক। দ্বিতীয়টি প্রসঙ্গে আধুনিক বিদ্বান বলছেন, 

In the popular knowledge and belief they have practically superseded the Vedas over a large part of India… 

এইদিক থেকে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণাকেই লোকেষু আয়ত আখ্যা দেওয়া যায়। কিনা তা ভেবে দেখবার অবকাশ থাকতে পারে। বিশেষত, বাংলা দেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ-রকমই একটা সন্দেহ দৃঢ় হতে চায়; “সে-সব খাঁটি বাংলার জিনিস যদি খুঁজিয়া বাহির করিতে চাও, তবে বাঙালীর বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া ধর্ম 

এবং বাংলার তন্ত্র ও তান্ত্রিক ধর্ম বুঝিবার এবং জানিবার চেষ্টা কর এবং, “ব্রাহ্মণ্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বাঙলায় অনেক জাল জুয়াচুরি চলিয়াছিল, ঘটক ঠাকুরেরা অনেক সত্যের গোপন করিয়াছিলেন, স্মার্ত নাটারে ও নদীয়ার ব্রাহ্মণ রাজাদের প্রভাবে ও চেষ্টায় আরও অনেক গোলমাল ও গোলযোগ স্মৃতিশাস্ত্রের রূপার তবকে ঢাকা পড়িয়াছে। শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় আরো দেখাচ্ছেন, যদিও উত্তরকালে ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠার প্রচারকেরা তন্ত্রের সঙ্গে নানান আপোষ করেছিলেন এবং যদিও কালক্রমে বৌদ্ধ ও হিন্দু মনীষা তন্ত্রের উপর “একটা নূতন ধর্মের প্রাসাদ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন,” তবুও তন্ত্র অতি প্রাচীন-বৌদ্ধ ধর্মের চেয়েও প্রাচীন এবং আদিতে তা ব্রাহ্মণ্য বিরোধী তথাকথিত ইতর জাতিদের মধ্যেই প্রচলিত ছিলো। 

ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে তন্ত্রকেই কেন বৈদিক ঐতিহ্যের বিরোধী লোকায়তিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক মনে করা অসঙ্গত নয়, এ-বিষয়ে গ্রন্থমধ্যে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। অতএব এখানে প্রশ্ন হলো, লোকায়তিক সংস্কৃতি বলতে যদি এই তন্ত্রকেই বুঝিয়ে থাকে তাহলে তার সঙ্গে আলোচ্য দেহাত্মবাদের সম্পর্ক কী? শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা থেকেই আমরা এ-প্রশ্নের উত্তর উদ্ধৃত করতে পারি; “যাহা আছে দেহভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে-“ব্রহ্মাণ্ডে যে গুণাঃ সস্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবরে’। ইহাই সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত।…তন্ত্র বলিতেছেন যে, যখন ব্রহ্মাও ও দেহভাণ্ড একই পদ্ধতি অনুসারে, একই রকমের উপাদান সাহায্যে নির্মিত, উভয়ের মধ্যে একইভাবে নানা শক্তির খেলা হইতেছে, তখন দেহগত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে ব্রহ্মাণ্ডের শক্তি তোমার অনুকুল, সহায়ক হইবে।—”এ দেশের সিদ্ধগণ বলেন যে, মনুষ্যদেহের মতন পুর্ণাবয়ব যন্ত্র আর নাই; এমন যন্ত্র আর কেহ গড়িতে পারে না, এমন যন্ত্র নির্মাণ করাও মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নহে। অতএব এই যন্ত্রস্থ সকল গুপ্ত এবং সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে, অন্য কোনো স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে তোমার বাসনা পুর্ণ হইতে পারে।” তাই তন্ত্রসাধনার নাম কায়সাধনা, তন্ত্রতত্বের নাম দেহতত্ত্ব। এবং এই দেহতত্বের কথাই যদি in the popular knowledge and belief… have practically superseded the Vedas over a large part of India, তাহলে বিপক্ষ দার্শনিকদের পক্ষে এই মতটিকেই রোকায়ত আখ্যা দেওয়া স্বভাবিক হয় না কি? 

কিন্তু মহাভারতের চার্বাক-বধ বৃত্তন্তটি অবলম্বন করে আমরা দেখেছি এই লোকায়ত-মতের সঙ্গে প্রাকবিভক্ত জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজের ধ্যানধারণার একটা সম্পর্কও অনুমান করা অসম্ভব নয়। এবং গ্রন্থমধ্যে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়ে আমরা ওই প্রাক-বিভক্ত সমাজের আলোচনাতেই গিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছি। 

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় অসুর মত সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বের আভাস পাওয়া যায়; লোকায়তর পুনর্গঠনে সেটিও আমাদের পক্ষে সহায়ক হতে পারে। এই তত্ত্ব হলো অসুরদের সৃষ্টি-তত্ত্ব। 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীভগবান অসুর মত হিসেবে যে মতটির উল্লেখ করেছেন শ্রীধরস্বামী বলছেন সেটি আর কিছুই নয় লোকায়ত-মত মাত্র। অন্যান্য সূত্রেও অসুর-মতের সঙ্গে লোকায়তর সম্পর্কের ইংগিত পাওয়া যায়; তাই শ্রীধর স্বামীর এই মন্তব্যকে অবজ্ঞা করবার কোনো কারণ নেই। 

এই অসুর মত—তথা লোকায়ত মতের—ব্যাখ্যায় শ্রীভগবান বলছেন 

অসত্যমপ্ৰতিষ্ঠং তে জগদাহুরানীশ্বরম। 
অপরস্পরসম্ভূতং কিমান্যৎ কামহৈতুকম। ১৬,৮ ৷৷ 

প্রথম পঙক্তিটির ব্যাখ্যা নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে; সম্ভবত এর তাৎপর্য হলো ঈশ্বর-সৃষ্ট বা ঈশ্বর প্রতিষ্ঠিত অর্থে জগৎ সত্য নয়, কেনানা ঈশ্বর নেই। কিন্তু দ্বিতীয় পঙক্তিটির অর্থ অস্পষ্ট নয় এবং আমাদের বর্তমান আলোচনায় এই দ্বিতীয় পঙক্তিটিই বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। এর অর্থ হলো, জগৎ স্ত্রী-পুরুষের মিলনাজাত এবং কামোদ্ভূত। অসুরদের-তথা লোকায়তিকদের-সৃষ্টিতত্ত্ব বলতে যদি এই বোঝায় তাহলে লোকায়তমতকে সনাক্ত করা আমাদের পক্ষে সুকঠিন হবার কথা নয়। কেননা, তন্ত্রসাহিত্যে আমরা ঠিক এই সৃষ্টিতত্ত্বেরই পরিচয় পাই: “যে পদ্ধতিক্রমে নরনারীর সংযোগে নূতন জীবের সৃষ্টি হয়, সেই পদ্ধতিক্রমে পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগে বিশ্বসংসারের উদ্ভব হইয়াছে।—মহাকাশে যাহা স্পন্দন, নরনারীর মধ্যে তাহা কাম ও মদনের লীলা।—কাম ও মদন জন্য যেমন নূতন জীবের নাম ও রূপের বিকাশ হয়, তেমনিই পুরুষপ্রকৃতির মধ্যে কাম ও মদনের স্পন্দন জন্য বিশ্বব্যাপী নাম ও রূপের বিকাশ হইয়াছে।—তন্ত্রবিশেষে বিশ্বসৃষ্টির জন্য শিবশক্তির এবং জীবসৃষ্টির জন্য নরনারীর মিলনের একতা পদে পদে খুলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া দেওয়া আছে। 

তাহলে, সৃষ্টিতত্ত্বের দিক থেকেও শ্রীভগবান উক্ত অসুরমতকে—তথা লোকায়ত-মতকে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার সঙ্গে অভিন্ন মনে করবার অবকাশ আছে। আমরা গ্রন্থমদ্যে এ বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যের উল্লেখ করেছি। অবশ্যই এ-জাতীয় তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য বলতে গুণরত্নের লোকায়তবর্ণন। এবং মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রধানত তার উপর নির্ভর করেই লোকায়তর সঙ্গে কাপালিক, সহজিয়া প্রভৃতি তান্ত্রিক ধ্যানধারণার সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন। 

অবশ্যই লোকায়তকে এইভাবে ব্যাপক অর্থে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণা বলে সনাক্ত করবার চেষ্টায় নানা বাধা আছে। প্রধান বাধা হলো, লোকায়ত-সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত ধারণা এবং তন্ত্র সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত ধারণা-দুয়ের মধ্যে সঙ্গতি নেই। কিন্তু লোকায়ত-সংক্রান্ত আমাদের প্রচলিত ধারণাটি প্রধানতই মাধবের কাছ থেকে পাওয়া; এবং আমরা দেখেছি মাধবের উপর ঐকান্তিক নির্ভরতায় বাধা আছে। অপরপক্ষে, গ্রন্থমধ্যে আমরা তন্ত্রতত্ত্বের আলোচনায় অগ্রসর হয়ে দেখেছি যে, তন্ত্র-সংক্রান্ত আমাদের প্রচলিত ধারণাটিও বহুলাংশেই সংশোধন-সাপেক্ষ। কেননা, তন্ত্রের-আদি অকৃত্রিম রূপটির উপর উত্তরকালে নানা প্রকার বৌদ্ধ ও হিন্দু ধ্যানধারণা অধ্যস্ত হয়েছে এবং তারই ফলে আমরা অনেক সময় এই অধ্যস্ত ধ্যানধারণাগুলিকেই তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বলে ভুল করে থাকি। তন্ত্রের উপর উত্তরকালে অধ্যস্ত ওই ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব মুক্ত হয়ে আমরা যদি তন্ত্রের আদিরূপটির অনুসন্ধান করি তাহলে হয়তো আমরা অধ্যাত্মবাদের পরিবর্তে পরিচয় পাবো বস্তুবাদেরই—সে বস্তুবাদ যতো অস্ফূট ও যতো প্রাকৃতই হোক না কেন, যতোই স্থূল হোক না কেন তার বাস্তব জ্ঞানের দৈন্য। অতএব, মাধবের প্রভাব মুক্ত হয়ে লোকায়তকে এবং এই অধ্যস্ত ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব মুক্ত হয়ে তন্ত্রের আদি অকৃত্রিম রূপকে আমরা যদি চেনবার চেষ্টা করি তাহলে হয়তো দুয়ের মধ্যে অসঙ্গতি অমন প্রকট মনে হবে না । 

কিন্তু, প্রশ্ন উঠবে, তন্ত্র-সংক্রান্ত আমাদের উত্তরকালের ধ্যানধারণাকে যেভাবেই সংশোধন করা যাক না কেন, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে, তন্ত্র প্রধানতই একটি সাধনপদ্ধতি; তার তত্ত্বের দিকটুকু এই সাধনপদ্ধতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধে সংযুক্ত। অর্থাৎ, তন্ত্রের এই আনুষ্ঠানিক দিকটিই প্রধান। এবং যদি তাই হয় তাহলে লোকায়াতের সঙ্গে তার সাদৃশ্য বা সঙ্গতি কোথায়? 

উত্তরে বলা যায়, লোকায়ত নামেরও হয়তো এককালে কিছু আনুষ্ঠানিক তাৎপর্য ছিলো। এ-বিষয়ে প্রাচীন রচনার কিছুকিছু ইংগিত উল্লেখ করা যায়। 

প্রাভাকর মীমাংসকদের সমালোচনা করে কুমারিল ভট্ট বলছেন, “প্রায়েণৈব হি মীমাংসা লোকে লোকায়ন্তিকৃত। তম আস্তিকপথে কতুম অয়ম যত্নঃ কৃতো ময়া” (বার্তিক: ১.০)। অর্থাৎ, লোকে মীমাংসাকে প্রায় লোকায়তারই সামিল করে তুলেছিলো, আমি তাকে আস্তিক-পথে নিয়ে আসতে যত্নবান হয়েছি। প্রশ্ন হলো, কুমারিল এখানে লোকায়ত-শব্দকে ঠিক কোন অর্থে ব্যবহার করছেন? আধুনিক বিদ্বানেরা বলেন, প্রাভাকর মীমাংসকেরা নিরীশ্বর-বাদী ছিলেন এবং সেই অর্থেই কুমারিল তাঁদের প্রায়লোকায়তিক বলে বর্ণনা করছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক দিকের উপর একান্ত গুরুত্ব আরোপ করবার উৎসাহ ছাড়া পুর্বমীমাংসার কথা ভাবা যায় না-প্রাভাকর এবং ভাট্ট উভয় সম্প্রদায়ের বেলাতেই এই কথা। অতএব, এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, কুমারিল এখানে লোকায়ত শব্দের সাহায্যে শুধুমাত্র নিরীশ্বরবাদই বোঝাতে চাইছেন না, ঈশ্বর-বিহীন অনুষ্ঠান-পরায়ণতার কথাই উল্লেখ করছেন। 

ঈশ্বর-বিশ্বাসহীন হলেও অসুরেরা-তথা লোকায়তিকেরা-যে কোনো-না- কোনো প্রকার অনুষ্ঠান-পরায়ণই ছিলো এ-বিষয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সাক্ষ্যও অগ্রাহ করা যায় না। অসুর প্রসঙ্গেই শ্রীভগবান বলছেন, 

যজস্তে নামষজৈন্তে দম্ভেনাবিধিপূর্বকম। ১৬,১৭৷৷ 

অর্থাৎ সংক্ষেপে, দাম্ভিক অসুরেরা নামেই যজ্ঞ করে থাকে। বলাই বাহুল্য, বেদ-বাহ্য বলেই ঈশ্বর-বিহীন অসুরদের যজ্ঞকে বেদপন্থীদের পক্ষ থেকে নামেমাত্র যজ্ঞ বলে নিন্দ করা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের আলোচনায় বর্তমানে যে-কথা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক তা হলো শ্রীধর স্বামীর নির্দেশ অনুসরণ করে আমরা যদি গীতার শ্রীভগবান-বর্ণিত অসুরমতকে লোকায়ত-মত বলেই এবং অতএব ওই অসুরদের, লোকায়তিক বলেই-সনাক্ত করতে সন্মত হই তাহলে আমাদের পক্ষে একথাও স্বীকার করা প্রয়োজন যে, বেদবাহ এবং ঈশ্বরবিহীন হলেও লোকায়তর সঙ্গে কোনো-না-কোনো রকম যজ্ঞ কর্মের সম্পর্ক ছিলো। অসুরদের যজ্ঞ-প্রসঙ্গে আমরা ঋগ্বেদের একটি চিত্তাকর্ষক সক্ষ্যেরাও উল্লেখ 

করেছি। ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে; তুমি মায়াসমূহের দ্বারা, যাহারা নিজেদের মুখে স্বধা (অন্নহবি: ) প্রদান করিত, সেই মায়াবীদিগকে পরাজিত করিয়াছিলে। ভায্যে সায়নাচার্য কৌষীতকী ও বাজসনেয়ীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। কৌষীতকী বলেন, অসুরের অগ্নিকে পরাভূত করিয়া নিজেদেরই হোম করিত। বাজসনেয়ী বলেন, দেবতা ও অসুরগণ পরস্পর স্পর্ধাযুক্ত হইল, তাহার পর অসুরের অভিমান ভরে ঠিক করিল, “আমরা কাহাকেও হোম করিব না?; অতএব নিজেদের মুখে হবিপ্রদান করিয়া তাহারা ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল এবং অবমাননা করিল। প্রশ্ন হলো, এখানেও কি অসুর বলতে লোকায়তিকদের-অর্থাৎ, ব্যাপক অর্থে তান্ত্রিকদেরই-বুঝতে হবে? সে-প্রশ্নের সহজ উত্তর দেওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। কিন্তু তন্ত্রসাধনার পঞ্চমকারের মধ্যে চারটি মকারমন্ত, মাংস, মীন, মুদ্রা-নিজেদের মুখেই হবিপ্রদানের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে, আপাতদৃষ্টিতে এ- হবি যতোই নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য মনে হোক না কেন। 

.

দুই 

এইভাবে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সিদ্ধান্ত অবলম্বন করে এবং আরো কিছুকিছু প্রাচীন তথ্যের ইংগিত অনুসরণ করে আমরা লোকায়ত বলতে প্রধানতই তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণাকে বোঝবার চেষ্টা করেছি। 

কিন্তু আধুনিক রুচি-বিচারে তন্ত্র অনেকাংশেই বীভৎস বিকৃতি বলেই প্রতীয়মান হয়। অপরপক্ষে, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই তন্ত্রেরই প্রভাব সুবিশাল ও সুগভীর। অতএব প্রশ্ন ওঠে, ওই বীভৎস বিকৃতিই যদি তন্ত্রের আদি- অকৃত্রিম তাৎপর্য হয় তাহলে তা এতো বড়ো একটা দেশকে এতো শতাব্দী ধরে এমন গবীরভাবে কী করে প্রভাবিত করলো? অবশ্যই আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকে তন্ত্রের উপর জটিল অধ্যাত্মতত্ত্ব আরোপ করে যেন তন্ত্রের নগ্নতা-নিবারণ করতে চেয়েছেন; কিন্তু এ-জাতীয় ব্যাখ্যা আমাদের কাছে কৃত্রিম মনে হয়েছে বলেই আমরা তা গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করেছি। 

তার বদলে আমরা সন্দেহ করতে বাধ্য হয়েছি, আধুনিক বিচারের মানদণ্ড যা অমন বীভৎস বিকৃতি বলেই প্রতীয়মান হয় তারই আদি-তাৎপর্য অন্য কিছু হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, সে-আদি-তাৎপর্ধের সন্ধান করা যাবে কী করে, 

কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে? আমাদের মনে হয়েছে, অধ্যাপক জর্জ টমসনের সাম্প্রতিক রচনায় এই বাঞ্ছিত পদ্ধতিটির পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা তার পদ্ধতিই গ্রহণ করবার চেষ্টা করেছি। 

কিন্তু সে-পদ্ধতি অবলম্বনের চেষ্টায় আমাদের আলোচনা অনিবার্যভাবেই নানান দিকে বিক্ষিপ্ত হয়েছে। কেননা, আমরা এমন কয়েকটি প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়েছি লোকায়তর আলোচনায়-তথা ভারতীয় দর্শনের আলোচনায়-সাধারণত যা তোলা হয় না। ফলে আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনাটিকেই অনেকাংশে সংশোধন করবার প্রয়োজন হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনা-প্রচেষ্টার পরিবর্তে আমাদের আলোচনা প্রধানত কয়েকটি অনভ্যস্ত সমস্যার সূত্র ধরেই অগ্রসর হতে চেয়েছে। এখানে এ-জাতীয় সমস্যার কিছুকিছু পরিচয় দেবো। 

প্রথমত অবশ্যই, যে-গৃহ সম্প্রদায়গুলিকে সাধারণত ব্যাপক অর্থে তান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া হয় সেগুলির উৎস এবং আদি-তাৎপর্য সংক্রান্ত সমস্যা। তন্ত্রের উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়ে আমরা মানবসমাজের আদিম পর্যায়ের বিশ্বাস ও ধ্যানধারণার আলোচনায় গিয়ে পড়েছি এবং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, কৃষি-আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে মানবমনের যে প্রাকৃত বিশ্বাস এবং সাধনপদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায় তা থেকেই তন্ত্রের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব। 

দ্বিতীয়ত প্রশ্ন ওঠে, তন্ত্র যদি আদিম সমাজেরই স্মারক হয় তাহলে ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এতোদিন ধরে—এমনকি অত্যন্ত সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত—তার প্রভাব এমনভাবে অক্ষুন্ন থাকে কী করে? অতএব আমরা ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছি এবং এই বৈশিষ্ট্য বলতে প্রধানত দুটি বিষয়ের আলোচনা উত্থাপন করেছি। 

এক: অসমান উন্নতির নিয়ম বা Law of uneven development । অর্থাৎ সমগ্র ভারত জুড়ে সব মানুষেরই উন্নতি একইভাবে এবং সমান তালে ঘটেনি। তাই এমনকি আজকের দিনেও আমাদের দেশের এলাক-বিশেষে প্রাচীন ট্রাইব্যাল সমাজের পরিচয় অক্ষুধা আছে-ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার-এর লেখক 

একেই fragments of a prehistoric wold’ remnant to our own day of the Stone Age আখ্যা দিয়েছিলেন। 

India thus forms a great museum of races, in which we can study man from his lowest to his highest stages of culture. The specimens are not fossils or dry bones, but living communities… 

সাম্প্রতিক ভারত সংক্রান্ত এ-মন্তব্য প্রাচীন-ভারত প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আরো প্রযোজ্য হবে। অতএব, এ-অনুমানে বাধা নেই যে, বহুদিন থেকেই আমাদের দেশে উন্নত ও সভ্য সমাজের পাশাপাশিই প্রাকৃত প্রাচীন সমাজ সহাবস্থান করেছে। অতএব, বিশেষত পুরাকালে এই সহাবস্থানের ফলে প্রাচীন সমাজের প্রাকৃত বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান যে সভ্য সমাজের সংস্কৃতির মধ্যেও সংক্রমিত হবে। এতে বিস্ময়ের অবকাশ নেই। 

বস্তুত, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকেই দেখাবার চেষ্টা করেছেন, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভারতীয় আদিবাসীদের ধ্যানধারণা এবং আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব। আধূিনিক বিদ্বানেরা সাধারনত এই আদিবাসীদের অনার্য বা আর্য-পূর্ব বা আর্যেত্বের বা দ্রাবিড়—বা ওই ধরনের কোনো নাম দিয়ে থাকেন। অতএব,তাদের পরিভাষায় ভারতীয় সংস্কৃতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আর্যেতার জাতিদের অবস্থান। 

কিন্তু ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেছি বলেই আমাদের কাছে এ-বিষয়ে আরো কিছু সমস্যা উপস্থিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমাত্রেরই বাস্তব ভিত্তি থাকতে বাধ্য। অতএব, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যদি ট্রাইব্যাল সংস্কৃতির প্রভাব অমন গভীর হয় তাহলে অনুমান করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় – সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেও ওই ট্রাইব্যাল-সমাজের বৈশিষ্ট্য অনেকাংশেই অক্ষুন্ন থেকেছে। ফলে, ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য-প্রসঙ্গে আমরা আরো একটি বিষয়ের আলোচনার অবতারণা করেছি। 

দুই: বাধাপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক বিকাশ ও ট্রাইব্যাল সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ । ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ট্রাইব্যাল-পর্যায়ের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের প্রভাব যে এতো ব্যাপক ও গভীর তার ব্যাথ্যায় শুধুমাত্র এটুকু আলোচনাই যথেষ্ট নয় যে, এ-দেশে সভ্য ও প্রাচীন বা ট্রাইব্যাল সমাজ পাশাপাশি অবস্থান করেছে; তাছাড়াও অনুমিত হয় যে, রাষ্ট্রশাসনভুক্ত সভ্য এলাকাতেও বাস্তব ট্রাইব্যাল-সমাজের স্মারক অনেকাংশেই অক্ষুন্ন থেকেছে! কীভাবে তা সম্ভব হতে পারে? কৌটিল্যের সংঘবৃত্ত এবং প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্র থেকে আমরা এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে পারি। এগুলির সাক্ষ্য অনুসারে অনুমিত হয় যে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই রাষ্ট্রশক্তির অধিনায়কদের একটি মূল নীতি ছিলো আশপাশের ট্রাইব্যালেসমাজগুলিকে আক্রমণ করে তাদের রাষ্ট্রশাসনভুক্ত করা। অতএব, অর্থনৈতিক উন্নতির স্বাভাবিক পরিণাম হিসেবে এই ট্রাইব্যাল-সমাজের মানুষের রাষ্ট্রশাসিত সভ্য- সমাজের আওতায় এসে পড়েনি; তার বদলে বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়ে-অতএব কৃত্রিমভাবেই তারা সভ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। ফলে তাদের জীবন থেকে মাত্র অসমাপ্তভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে ট্রাইব্যাল সমাজের বৈশিষ্ট্য। আমরা গ্রন্থ মধ্যে দীর্ঘভাবে ট্রাইব্যাল-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ সংক্রান্ত প্রকল্পটির আলোচনা করেছি এবং তার সাহায্যেই আমরা বোঝবার চেষ্টা করেছি যে, তন্ত্রের উৎসে প্রাচীন পর্যায়ের প্রাকৃত বিশ্বাস এবং ধ্যানধারণার পরিচয় থাকলেও তা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে এতো দীর্ঘ দিন ধরে ও এমন গভরিভাবে কী করে প্রভাবিত করেছে। 

তৃতীয়ত, তন্ত্রের আলোচনায় অগ্রসর হয়ে আমাদের পক্ষে সাংখ্য-দর্শনের উৎস ও আদিরূপ সংক্রান্ত সমস্যাও উত্থাপন করতে হয়েছে। কেননা, তন্ত্রের মতোই সাংখ্যা-মতেও প্রকৃতিই প্রধান, জগৎকারণ। এবং তন্ত্রের মতোই সাংখ্য- মতেও এই প্রকৃতি বহুলাংশে নারীরূপে কল্পিত: “বাচ্যবস্তুটিকে স্ত্রীরূপেই সাংখ্য কল্পনা করিয়াছে। প্রকৃতি পুরুষকে মোহিত করে-যেমন নারী পুরুষকে বশ করে; 

প্রকৃতির ক্রিয়াও নারীর লাস্য ও হাস্য এবং হাব ও ভাবের অনুরূপ কল্পিত হইয়াছে”। অপরপক্ষে অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে দেখাচ্ছেন, কালক্রমে সাংখ্যের পুরুষ বলতে যাই বোঝাক না কেন আদিতে তা পুরুষ-মানুষবোধক‍ই ছিলো। যদি তাই হয় তাহলে সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং তন্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে কোনো বড়ো প্রভেদ নেই। সাংখ্যকারিকার ভাষ্যে গৌড়পাদ বলছেন, যথা স্ত্রী- পুরুষসংযোগাৎ সুতোৎপত্তিস্তথা প্রধানপুরুষসংযোগাৎ সর্গন্যেৎপত্তি। স্বভাবতই সাংখ্যের এই সৃষ্টিতত্ত্ব শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রভিগবান বর্ণিত অসুর মতের—অতএব শ্রীধরস্বামীর ব্যাখ্যা অনুসারে লোকায়ত-মতেরও-কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বস্তুত, সাংখ্যের সঙ্গে লোকায়তার পার্থক্য যে নেহাতই সামান্য, এ বিষয়ে জৈন রেখকেরা ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন; অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত দেখাচ্ছেন, শীলাঙ্ক-রচিত। সুত্রকৃতাঙ্গসূত্রের ভাষ্যে সাংখ্য ও লোকায়তার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি। অতএব, তন্ত্র তথা লোকায়ত-প্ৰসঙ্গেই আমরা সাংখ্যদর্শনের উৎস ও আদিরূপ সংক্রান্ত বহু মতবাদসমাকীর্ণ সমস্যার মধ্যেও প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছি এবং যতো আংশিকভাবেই হোক না কেন, একটি সমাধানেরও সন্ধান করেছি। 

চতুর্থত, তন্ত্র ও সাংখ্যের উৎস-সংক্রান্ত সমস্যা যতোই জটিল হোক না কেন, তারই সমাধান-প্রচেষ্টায় আমরা জটিলতর একটি সমস্যার মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছি প্রাচীন ভারতে মাতৃপ্রধান সমাজ এবং সাম্প্রতিক যুগেও তার স্মারকের সমস্যা। তন্ত্র ও সাংখ্য নারীপ্রধান ধ্যানধারণা বলেই তার মধ্যে মাতৃপ্রধান বা নারীপ্রধান-কিংবা, শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন-এর মতে এদেশে যাকে ক্ষেত্রপ্রধান বলা হতো সেই-সমাজ-বাস্তবের প্রতিবিম্ব অনুমেয়। অতএব এই মাতৃপ্রধান সমাজবাস্তবের পটভূমি ছাড়া তন্ত্র ও সাংখ্যকে সম্যকভাবে বিচার করা যায় না। 

বস্তুত, আমরা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছি যে, লোকায়ত-তথা তন্ত্র ও সাংখ্য সংক্রান্ত অনেক ধারণা যে আজো আমাদের কাছে অস্পষ্ট হয়ে আছে তার প্রধানতম কারণ হলো ভারতে মাতৃপ্রধান সমাজ এবং মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণা বিষয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা এখনো অসম্পূর্ণ। অবশ্যই, শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দকে অনুসরণ করে স্যর জন মার্সাল মোহেনজোদারোর ধর্মপ্রসঙ্গে এ-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাছাড়া, ডক্টর এরেনফেলস তাঁর ‘মাদার রাইট ইন ইন্ডিয়া’ এবং শ্রীযুক্ত দীক্ষিত তাঁর ‘মাদার-গডেস’ গ্রন্থে ভারতে মাতৃপ্রধান সমাজ এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার প্রতিবিম্ব সংক্রান্ত বহু মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু মাতৃপ্রাধান্য-প্রসঙ্গে মর্গান, এঙ্গেলস এবং বিশেষ করে ব্রিফন্ট-এর গবেষণা বিদ্বানমহলে আজো অনাদৃত বলেই এতো অজস্র তথ্যের ব্যাখ্যাও অস্পষ্ট ও অসন্তোষজনক হয়ে থেকেছে। 

পঞ্চমত, প্রাক-অধ্যাত্মবাদী-এবং সেই অর্থে প্রাকৃত পর্যায়ের বস্তুবাদী চিন্তাচেতনার সমস্যাও। কেননা, তন্ত্র ও সাংখ্য শুধুমাত্র নারী প্রাধান্যের পরিচায়ক নয়, প্রাক-অধ্যাত্মবাদী চেতনারও পরিচায়ক। জগৎকারণ ওই প্রধান শুধুই female principle নয়, material principles অবশ্যই উত্তরকালে তন্ত্রের উপর বিবিধ অধ্যাত্মতত্ত্ব আরোপিত হয়েছে; তবুও তন্ত্রের মূল তত্ত্ব বলতে দেহতত্ত্ব: যাহা আছে দেহভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি, মানবদেহকেই এইভাবে উপমা হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে বোঝবার চেষ্টা করা হয়েছে বলেই তন্ত্রের আদি-অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে অধ্যাত্মবাদের অবকাশ নেই। অপরপক্ষে সাংখ্যকেও উত্তরকালে আস্তিক-এমনকি সেশ্বর-করে নেবার আয়োজন হয়েছে। কিন্তু বাদরায়ণের সাংখ্য-খণ্ডন প্রভৃতি সাংখ্যের প্রাচীনতর পরিচয়গুলিকে পরীক্ষা করলে স্পষ্টই বোঝা যায় সাংখ্য- মতের আদিরূপটির মধ্যে অধ্যাত্মতত্বের স্থান থাকা সম্ভব নয়। 

অতএব, আদিতে তন্ত্র এবং সাংখ্য উভয়ই প্রাক-অধ্যাত্মবাদী চিন্তাচেতনার– অচেতনকারণবাদের–পরিচায়ক। লোকায়তিক ধ্যানধারণার এই বৈশিষ্ট্যটিকে আমরা কিছুটা পরোক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ করে বোঝার চেষ্টা করেছি। প্রশ্ন তুলেছি, অধ্যাত্মবাদ ও চেতনকারণবাদের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে। আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি, মানবসমাজে শ্রেণীবিভাগ ফুটে উঠবার ফলেই মানব-চেতনায় আধ্যাত্মবাদের বা চেতনকারণবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। অতএব, প্রাক-বিভক্ত সমাজের স্বাক্ষর বহন করছে বলেই লোকায়তিক ধ্যানধারণা প্রাক-অধ্যাত্মবাদী হয়ে থেকেছে। 

.

তিন

বলাই বাহুল্য, উপরোক্ত সমস্যাগুলি অত্যন্ত জটিল এবং আমাদের পক্ষে কোনোটিরই পুর্ণাঙ্গ সমাধান দেওয়া সম্ভব হয়নি। বস্তুত, পূর্ণাঙ্গ সমাধান দেবার চেষ্টা আমাদের উদ্দেশ্যও ছিলো না। কেননা আমাদের ধারণায় প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি সংক্রান্ত গবেষণা আজো অনেকাংশে অসম্পূর্ণ। অতএব বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্যান্য বিষয়ের মতোই লোকায়তসংক্রান্ত সমস্তাগুলির পূর্ণাঙ্গ সমাধান-সন্ধান কিছুটা অকাল-প্রচেষ্টা বলে প্রতীয়মান হতে বাধ্য। তার বদলে আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, এ-বিষয়ে প্রচলিত সিদ্ধান্তগুলির বিচার এবং প্রকৃত সমস্যাবলীর স্বরূপ-নির্ণয়। বর্তমান গ্রন্থে আমরা প্রধানত এই চেষ্টাই করেছি। 

তবুও আমরা এমনকি এ-কথাও দাবি করতে পারি না যে, লোকায়ত সংক্রান্ত সমস্ত প্রাসঙ্গিক সমস্যাই আমাদের পক্ষে উত্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও আমরা যে-সমস্যাগুলি উত্থাপন করতে পারিনি তার মধ্যে প্রধান হলো পালি পুথি বর্ণিত ছ’জন নাস্তিকদের নিয়ে সমস্যা। এদের নাম: পুরণ কিস্সপ, মক্ষলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কচ্চায়ন, সঞ্জয় বেলথিপুত্ত, নিগন্থ নাতপুত্ত। সাধারণত এঁদের,-বিশেষ করে এদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে- লোকায়তিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। অতএব ভূমিকায় আমরা এদের মতামতের সামান্য পরিচয় দেবার চেষ্টা করবো এবং আমাদের পক্ষে কেন এদের সমস্যা সম্যকভাবে উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি তাও ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করবো। 

এঁদের কার মতবাদ যে ঠিক কী রকম ছিলো সে-কথা সঠিকভাবে সনাক্ত করা অবশ্যই অত্যন্ত কঠিন। কেননা বিভিন্ন গ্রন্থে এদের উপর বিভিন্ন মতামত আরোপিত হতে দেখা যায়। এ-বিষয়ে অধ্যাপক ব্যাসাম একটি চিত্তাকর্ষক ছক তৈরি করেছেন। কিন্তু তা স্বত্তেও তিনি নিজেই স্বীকার করছেন যে, দীর্ঘ-নিকায়র সামান্যফলসুত্তে এঁদের যে-পরিচয় পাওয়া যায় খুব সম্ভব সেইটিই সবচেয়ে মৌলিক । 

সামান্যফলসুত্তের আখ্যায়িকাটি মোটের উপর এই; 

বুদ্ধ তখন ১২৫০ জন ভিক্ষু নিয়ে মগধের রাজধানী রাজগহতে অবস্থান করছেন। সে-সময়ে রাজা অজাতিসত্ত্ব, আধ্যাত্মিক উপদেশের প্রয়োজন বোধ করলেন। প্রশ্ন হলো, কার কাছে এ-উপদেশ পাওয়া সম্ভব? রাজার ছ’জন মন্ত্রী একে একে ওই ছ’জন জ্ঞানীর নাম উল্লেখ করলেন এবং প্রত্যেককেই সুবিখ্যাত, গণাচারিয়ো, তিথকারো, সাধুসন্নতো, চিরপধ্বজিতো প্রভৃতি বিশেষণে বিভূষিত করলেন। কিন্তু এদের নাম শুনে রাজা কোনো উৎসাহ দেখালেন না। অবশেষে রাজকুমারদের চিকিৎসক জীবক বুদ্ধের নাম প্রস্তাব করলেন। রাজা তাতে সন্মত হলেন এবং বুদ্ধের কাছেই গমন করলেন। 

যে-প্রশ্ন রাজার চিত্তকে চঞ্চল করেছিলো তা এই: বৈষয়িক ক্রিয়াকর্মের ফলাফল তো স্পষ্টই দেখা যায়; কিন্তু সন্ন্যাসের কোনো সুফল কি প্রদর্শন করা সম্ভব? রাজা বুদ্ধকে বললেন, ইতিপুর্বে শ্রমণ ও ব্রাহ্মণের কাছে তিনি এ-প্রশ্ন করেছেন; কিন্তু কোনো সুফল পাননি। বুদ্ধ রাজাকে অনুরোধ করলেন, উপরোক্ত ছ’জন নাস্তিক এ-প্রশ্নের কী কী উত্তর দিয়েছেন তা খুলে বলতে। উত্তরে রাজা যা বললেন প্রধানত তারই উপর নির্ভর করে আমরা পুরাণ-কসসপ প্রমুখের মতামত বোঝবার চেষ্টা করে থাকি। 

উত্তরগুলি বিচার করে আধুনিক বিদ্বানেরা সিদ্ধান্ত করছেন যে, এর মধ্যে নিগন্থ নাতপুত্তর মতটি বর্ধমান মহাবীরের মতের সঙ্গে অভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক; অতএব তাকে লোকায়তিক না বলে জৈন বলাই বাঞ্ছনীয়। সঞ্জয়ের উত্তর অত্যন্ত দুর্বোধ্য: অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ুয়া, তাকে গ্রীক দার্শনিক ফিরোর শিষ্যদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই অর্থে সঞ্জয় চূড়ান্ত সন্দেহবাদী-কোনোরকম জ্ঞানের সম্ভাবনাই তিনি স্বীকার করেন না। কিন্তু লোকায়ত বলতে এ-রকম চুড়ান্ত অবিশ্বাসবাদ বোঝবার কোনো কারণ নেই । 

অজিত কেশকম্বলীর মতবাদ যে ঠিক কী সে-বিষয়েও অন্তত কিছুটা অস্পষ্টতা আছে। সামান্যফল সুত্তের বর্ণনা অনুসারে অজিতের মত হলো, 

দান যজ্ঞ হোম এবং সুকৃত ও দুষ্কৃত কর্ম সমূহের কোনো ফলবিপাক নাই। ইহলোকও নাই, পরলোকও নাই। মাতা নাই, পিতা নাই, উপপত্তিক কোনো সত্তাও নাই। ইহলোকে সন্মগ-গতো (সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন?) কোনো শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ নাই,—যাহারা সম্যক গমন করেন, যাঁহারা স্বয়ং অভিন্ন সাক্ষ্য দ্বারা ইহলোক এবং পরলোকগুলিকে অনুধাবন করিতে পারেন এবং নিজেদের জ্ঞান অপরের কাছে বিতরণ করিতেও পারেন।
চারি মহাভূত-বিশিষ্ট পুরুষ যখন মারা যায় তখন তার কায়ার পৃথিবী পৃথিবীতে প্রবেশ করে, কায়ার জল জলে প্রবেশ করে, কায়ার তেজ তেজে প্রবেশ করে, কায়ার বায়ু বায়ুতে প্রবেশ করে এবং ইন্দ্রিয়গুলি শূন্যে বিলীন হয়। চারজন শববাহী—এবং শবাধার হলো পঞ্চম—তাহার মৃতদেহকে লইয়া যার এবং সৎকারস্থান পৌছানো পর্যন্ত মানুষেওরা তাহার গৌরব কীর্তন করে। তাহার আস্থিগুলি কপোতের ন্যায় হইয়া যায় (পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়) এবং তাহার আগহুতিগুলি ভর্ম্মে পরিণত হয়। ভিক্ষা অথবা দান-যাহারা এইরূপ তুচ্ছ মিথ্যা প্রলাপ বকে তাহাদিগকে আস্তিক্যবাদী বলা হয়। মৃত্যুর পর মুর্থ ও পণ্ডিতের মধ্যে প্রভেদ ছিন্ন হয় এবং মরণের পর আর কিছুই থাকে না। 

অজিতের এই মতটিও অনেকাংশে দুর্বোধ্য। সেই কারণেই এর নানারকম ব্যাখ্যা হয়েছে। যেমন, বুদ্ধঘোষ বলছেন, অজিত পরলোক মানতেন, কিন্তু মানুষের পক্ষে পরলোক-প্রাপ্তির সম্ভাবনা মানতেন না। এ-ব্যাখ্যা ঠিক হলে অজিতকে লোকায়তিক বলতে বাধা হবে; কিন্তু এ-ব্যাখ্যা ঠিক কিনা সে-বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি না। অবশ্যই, এ-জাতীয় ব্যাখ্যার জটিলতায় প্রবেশ না করেও সামান্যফলসুত্তের অপেক্ষাকৃত সুস্পষ্ট নির্দেশগুলির উপর নির্ভর করে প্রশ্ন তোলা যায়, অজিতকে লোকায়তিক বলে সনাক্ত করা কতখানি যুক্তিসম্মত হবে? তাঁর মতে দান, যজ্ঞ, হোম সুকৃত—সমস্তই নিরর্থক মানুষ চতুর্ভূত-বিশিষ্ট দেহ ছাড়া কিছুই নয়-মৃত্যুর পর এই চতুর্ভূত প্রকৃতিতেই প্রত্যাবর্তন করে, কিছুই বাকি থাকে না। এ-জাতীয় বক্তব্যের সঙ্গে অন্তত মাধববর্ণিত লোকায়ত মতের সাদৃশ্য আছে; কেননা মাধবের বর্ণনা অনুসারে লোকায়তিকেরা যাগযজ্ঞকে সম্পূর্ণ নিম্ফল মনে করেন এবং বলেন, ভস্মীভূতান্ত দেহস্য পুনরাগমনং, কুতঃ? কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, মাধবের ওই লোকায়ত-বৰ্ণনা সংশয়াতীত বলে গ্রহণ করাও নিরাপদ নয়। তাছাড়া, সামান্যফলসুত্ত-বর্ণিত অজিতের মতের সঙ্গে মাধব- বর্ণিত লোকায়ত-মতের সাদৃশ্য আংশিকমাত্র, অজিতের অন্যান্য মন্তব্যের সঙ্গে মাধব-বর্ণিত লোকায়তের মিল নেই। অজিতের মতে ইহলোকও নেই, পরলোকও নেই। মাতা নেই, পিতা নেই এবং তজ্জাত-নয় এমন কোনো সত্তাও নেই। শ্রমণ নেই, ব্রাহ্মণ নেই; জ্ঞান নেই, জ্ঞানের উপদেশ নেই। দেহাতিরিক্ত সত্তা বলেও কোনো-কিছু নেই; শ্মশানগমনেই সবকিছুর চুড়ান্ত পরিণতি। 

এজাতীয় মতবাদের লোকায়তিক না বলে বরং চূড়ান্ত অর্থে সন্দেহবাদ বা scepticism আখ্যা দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত। বস্তুত, রিস-ডেভিডসও অজিতের মতকে লেকায়তিক না বলে the view of a typical sophist হিসেবেই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। 

সামান্যফলস্বত্ত বর্ণিত নাস্তিকদের মধ্যে বাকি থাকে আরো তিনজনের কথা: পুরাণ কসপ, মক্ষলি গোসাল এবং পকুধ কাচ্চায়ন। এরা তিনজনেই মোটামুটি একই মতবাদ পোষণ করতেন এমন কথা অনুমান করবার অবকাশ আছে। 

In certain other passage of the Pali canon the distribution of doctrines among the six teachers is significantly altered, in a way which strongly suggests that the credos ascribed in the Samanna-phala Sutta to Makkhali, Purana and Pakudha were aspects of a single body of teaching 

এখন, জৈন পুঁথিপত্র থেকে এই তিনজনের মধ্যে মক্ষলি গোসাল-এর মতবাদ এবং সাধন-পদ্ধতি সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তার কারণ, মক্ষলি গোসাল দীর্ঘদিন ধরে মহাবীরেরই অনুগামী ছিলেন।যদিও নানান বিবাদ- বিসংবাদের পর শেষপর্যন্ত মহাবীরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়েছিলো। এই কারণে জৈন লেখকের মক্ষলিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন এবং এমনকি অনেকাংশে উপহাসের পাত্র হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই কারণেই জৈন পুঁথিতে—বিশেষত ভগবতীসূত্রে —মক্ষলির জীবনী এবং মতামত সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যগুলি অবশ্যই অলৌকিক কাহিনীর আবর্জনায় অনেকাংশেই অস্পষ্ট; তবুও এগুলির মধ্যে থেকে অন্তত কিছু পরিমাণ বাস্তব ঐতিহাসিক সত্য উদ্ধার করা অসম্ভব নয়। অধ্যাপক ব্যাসাম্ প্রধানত এইজাতীয় তথ্যের উপর নির্ভর করেই মক্ষলি-প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়টির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, ষষ্ঠ খৃষ্টপূর্বাব্দে ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়ের মতোই মক্ষলি একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার নাম আজীবিক সম্প্রদায়। মৌর্য যুগেই এ-সম্প্রদায়ের চূড়ান্ত সাফল্য ঘটেছিলো। তারপর সম্প্রদায়টি ভেঙে যায়। কিন্তু অনেক পরে দক্ষিণ ভারতে চোল-রাজাদের আমলে এই আজীবিক সম্প্রদায়েরই পুনর্বিকাশ ঘটে; তারই ফলে তামিল ভাষায় লেখা আজীবিকদের গ্রন্থ পাওয়া যায়। 

আজীবিক নামটির অর্থ অনেকাংশেই অনিশ্চিত; আধুনিক বিদ্বানেরা তার নানারকম ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। আজীবিকদের সাধনপদ্ধতিও অনেকাংশে দুর্বোধ্য; কেননা তার মধ্যে নগ্নতা, নাচ, গান—এমনকি হয়তো কামাচারেরও স্থান ছিলো। কিন্তু আজীবিকদের দার্শনিক মতবাদ অনেকাংশেই স্পষ্ট। তার নাম নিয়তিবাদ। অধ্যাপক ব্যাসাম এই নিয়তিবাদের নিম্নোক্ত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন: 

The fundamental principle of Ajivika philosophy was Fate, usually called Niyati. Buddhist and Jaina sources agree that Gosala was a rigid determinist, who exalted Niyati to the status of the motive factor of the universe and the sole agent of all phenomenal change. This is quite clear in our locus classicus, the Samanna – phala Sutta…

Fatalism proper finds no place in orthodox Hinduism, Buddhism, or Jainism… The Indian doctrine of karma, as it is usually interpreted, provides a rigid framework within which the individual is able to move freely and to act on his own decision… 

This doctrine Gosala opposed. For him, belief in free will was a vulgar error. The strong, the forceful, and the courageous, like the weakling, the idler, and the coward, were all completely subject to the one principle which determined all things…

The path of transmigration was rigidly laid out and every soul was fated to run the same course through a period of 8,400,000 mahakalpas. This figure is corroborated by independent testimony, and is a measure of the gigantic and weary universe of the Ajivika cosmologists. 

আজীবিকদের দার্শনিক তত্ত্ব বলতে যদি প্রধানত এই হয় তাহলে তাদের লোকায়তিক আখ্যা দেওয়া কতোখানি সঙ্গত হবে? 

অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামান্যফলা-সুত্তে আমরা যে-ছ’জন নাস্তিকের উল্লেখ পাই তাদের কাউকেই নিঃসংশয়ে লোকায়তিক আখ্যা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। 

কিন্তু আমরা গ্রন্থমধ্যে এদের কথা আলোচনা যে উত্থাপন করতে পারিনি। তার কারণ সম্পূর্ণ অতন্ত্র। আসলে এদের কথা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আদিরূপের সঙ্গে—এবং বৌদ্ধভারতের পরিস্থিতির সঙ্গে-এমনভাবে জড়িত যে, তার আলোচনা বাদ দিয়ে এঁদের কারুর কথাই সম্যকভাবে আলোচনা করবার উপায় নেই। কিন্তু 

নানা কারণে আমাদের পক্ষে এই গ্রন্থে বৌদ্ধ ও জৈন-ধর্মের উৎস সংক্রান্ত সমস্যা তোলা সম্ভব হয়নি। তার মধ্যে প্রধান কারণ অবশ্যই গ্রন্থের কলেবর। লোকায়ত- প্রসঙ্গে অন্যান্য সমস্যাগুলির আলোচনা তুলতে গিয়েই এ-কলেবর রীতিমতো বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রাসঙ্গিক হলেও আমরা বৌদ্ধ-ভারতের দার্শনিক পরিস্থিতির কথা তুলতে সমর্থ হয়নি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *