প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০২. লোকায়ত-প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

লোকায়ত-প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

লোকায়তিকদের নিয়ে কী এমন সমস্যা উঠছে যে সমাধানের খোঁজে এইভাবে কালাপানি পার হতে হবে?

আমাদের যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ভারততত্ত্ববিদের রচনা থেকেই আলোচনা শুরু করা যাক।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘লোকায়ত’ নামে ইংরেজীতে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৫-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রবন্ধটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে লোকায়তিকদের সম্বন্ধে এমন কয়েকটি উক্তি সংগ্রহ করেন যার সঙ্গে লোকায়ত-দর্শন সংক্রান্ত আমাদের সাধারণ ধারণার সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। এ-জাতীয় তথ্য তাই ভারতীয় দর্শনের ছাত্রের কাছে সমস্যা সৃষ্টি না করে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো সে-সমস্যাকে তুচ্ছ মনে হবে; কিন্তু ভেবে দেখলে দেখা যায়, তা নয়।

সমস্যা যে ওঠে এ-বিষয়ে তিনি নিজেও সচেতন। বস্তুত, সে-সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা তিনি নিজেই করেছেন। তাছাড়া, তাঁর ওই ছোট্ট পুস্তিকাটির ভিত্তিতেই শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী ‘ভারতীয় বস্তুবাদ, ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদ ও ভোগবাদ’(৭) নামের ইংরেজী বইতে লোকায়তিকদের সম্বন্ধে কিছু কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটুখানি এদিক-ওদিক তাকালেই,—অর্থাৎ কিনা, ভারতবর্ষের অন্যান্য কিছুকিছু প্রাচীন পুঁথিপত্রের সাক্ষ্য গ্রহণ করলেই,—বোঝা যায় এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত জিজ্ঞাসু মনকে সত্যিই সন্তুষ্ট করতে পারে না। সমাধান হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার বদলে এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত কিছু কিছু নতুন সমস্যারই সৃষ্টি করে।

মহামহোপাধ্যায় লোকায়তিকদের সম্বন্ধে কী রকম তথ্য সংগ্রহ করেছেন? তার থেকে কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়? সে-সমস্যার সমাধান হিসাবে তিনি, বা তাঁকে অনুসরণ করে শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী, যা বলেছেন তা কেন সন্তোষজনক মনে হয় না?

তথ্যগুলির বর্ণনা থেকেই শুরু করা যাক।

প্রথমত, বার্হস্পত্যসূত্রম্‌-এর(৮) সাক্ষ্য। স্বয়ং বৃহস্পতির নামের সংগে জড়িত এই পুঁথিটির সঙ্গে আধুনিক পণ্ডিতমহলের পরিচয় খুব বেশি দিনকার নয়। সম্প্রতি কালে ডক্টর এফ. ডব্লিউ. টমাস এটি সংগ্রহ করেন এবং তাঁরই লেখা দীর্ঘ ভূমিকা ও ইংরেজী তর্জমা সম্বলিত হয়ে ১৯২১-এ পাঞ্জাব থেকে এটি প্রথম ছাপানো হয়। ভূমিকায় ডক্টর টমাস আলোচনা করেছেন, পুঁথিটিকে যে-অবস্থায় আমরা পাচ্ছি তার কোনো কোনো অংশ যেমনই প্রাচীন আবার কোনো কোনো অংশ তেমনি অর্বাচীন। ডক্টর টমাসের মতে, প্রাচীনতম অংশগুলিতে লোকায়ত-দর্শনের আদি ও অকৃত্রিম রূপটি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু মহামহোপাধ্যায় বলছেন, পুঁথিটির যে-অংশগুলিকে ডক্টর অর্বাচীন মনে করেন তার সাক্ষ্যও কম মূল্যবান নয়।

এখানে পুঁথিটির স্তর-বিচার করবার চেষ্টা করলে আলোচনা অনেকখানি বিক্ষিপ্ত হবার সম্ভাবনা। তাই, সে-আলোচনা মূলতবী রেখে দেখা যাক, পুঁথিটির ঠিক কোন সাক্ষ্যের দিকে মহামহোপাধ্যায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান।

এই পুঁথির দ্বিতীয় অধ্যায়ে পরের পর দুটি সূত্রে,—তাই মহামহোপাধ্যায়ের ভাষায়, যেন এক-নিশ্বাসে,—লোকায়তিক এবং কপালিকদের সম্বন্ধে দুটি কথা বলা হয়েছে :

সর্বথা লোকায়তিকমেব শাস্ত্রমর্থসাধনকালে।।২।।৫
কাপালিকমেব কাম সাধনে।।২।।৬
–অর্থাৎ, অর্থসাধনকালে সর্বত্র লোকায়তিকই হলো শাস্ত্র, কামসাধনে সর্বত্র কাপালিকই শাস্ত্র।

মহামহোমাধ্যায় বলছেন, এই ভাবে এক-নিশ্বাসে দুটি কথা বলা থেকেই বোঝা যায় কথা দুটি আলাদা নয়। অর্থাৎ, লোকায়তিক ও কাপালিক আলাদা নয়। তাঁর এই উক্তির পক্ষে অবশ্যই আরো একটি যুক্তি দেখানো যায়। তাঁর এই উক্তির পক্ষে অবশ্যই স্বীকার করেন যে কামসাধনার শাস্ত্র বলতে একমাত্র কাপালিকই, তাহলে তাঁর পক্ষে লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের কোনো বড়ো রকমের তফাত স্বীকার করা সম্ভব হবে না। কেননা, মাধবাচার্য প্রমূখ সমস্ত লেখকদের মতেই, লোকায়তিকেরা পুরুষার্থ বলতে স্বীকার করেন শুধু অর্থ এবং কাম(৯)। আর, যদি তাই হয় তাহলে কাপালিক বা কামসাধনশাস্ত্র লোকায়তের সঙ্গে অভিন্ন হবারই কথা।

কিন্তু লোকায়তের সঙ্গে কাপালিকদের অভিন্নতা প্রমাণ করবার জন্যে বৃহস্পতি-সূত্রের সাক্ষ্যই একমাত্র নয়। শাস্ত্রী মহাশয় আরো একটি সাক্ষ্যের কথা তুলছেন এবং এই দ্বিতীয় সাক্ষ্যের সনতারিখ সম্বন্ধেও স্পষ্ট মত ব্যক্ত করছেন।

হরিভদ্র ছিলেন অনুমানিক খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর জৈন লেখক। তাঁর লেখা ষড়দর্শনসমুচ্চয়-এর উল্লেখ প্রথম পরিচ্ছেদে করা হয়েছে। এ-বইতে তিনি লোকায়তমতের ব্যাখায় করেছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই তাঁর টীকাকার গুণরত্ন লোকায়তিকদের সম্বন্ধে অনেক কিছু বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন। অবশ্যই, মহামহোমাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে গুণরত্নের কথাগুলি বিস্তৃত বিবরণ বা বিশ্লেষণ দেন নি। সে-আলোচনায় আমরা পরে ফিরবো। আপাতত, গুণরত্নের মন্তব্যের ঠিক যতোটুকু মহামহোমাধ্যায় নিজে উল্লেখ করেছেন ততোটুকুর উপরই দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা যাক।

মহামহোমাধ্যায় বলছেন, যদিও বৃহস্পতির রচনায় লোকায়তিক ও কাপালিকদের কথা স্বতন্ত্র ভাবে উল্লেখিত হয়েছে তবুও গুণরত্নের মতে এ-দু’-এর মধ্যে কোনোই তফাত নেই(১০)। মহামহোপাধ্যায়ের হিসেবে গুণরত্ন ছিলেন খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর লেখক। এবং মহামহোপাধ্যায় বলছেন, তাঁর লেখা পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় যে তাঁর সময়েও লোকায়তিক সম্প্রদায় দেশ থেকে বিলুপ্ত হয় নি। কথাটি বিশেষ করে উল্লেখ করলাম এই কারণে যে মহামহোপাধ্যায়ের নিজের লেখা সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, তাঁর ধারণায় তাঁর নিজের যুগেও অন্তত বাংলা দেশে নামান্তরের আড়ালে লোকায়তিকের দল সত্যিই টিকে রয়েছে। এই চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের আলোচনায় আমরা একটু পরেই ফিরবো। আপাতত, কাপালিকদের কথাটা ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। কেননা, গুণরত্ন লোকায়তিকদের সঙ্গে এদের অভিন্নতা উল্লেখ করেই ক্ষান্ত নন, লোকায়তিকদের এমন বর্ণনা দিচ্ছেন যা ওই কাপালিকদের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় : লোকায়তিকেরা নাকি গায়ে ভস্ম মাখে, মদ খায়, মাংস খায়, তারা মৈথুনাশক্ত ও যোগী(১১)।

সর্বশেষ বিশেষণটি সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। লোকায়তিকদের সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু সাধারণ ধারণা তার সঙ্গে আর যাই হোক যোগী শব্দটা কিছুতেই খাপ খায় না। অথচ পুঁথিতে লেখা রয়েছে,—কথাটাকে তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও চলবে না! তাহলে পুঁথিতে যা লেখা রয়েছে তাকে গুরুত্ব দিতে হলে শুধু লোকায়ত নয়, ‘যোগী’ সম্বন্ধেও আমাদের সাধারণ ধারণাকে শুধরে নেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু শুধরে যে নেবো তা তো দলিল-দস্তাবেজের উপর নির্ভর করেই। অবশ্যই, দলিলের অভাব নেই। আমরা যতোই অগ্রসর হবো ততোই দেখতে পাবো ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে বহুদিন ধরে প্রচলিত আমাদের সাধারণ ধারণার সঙ্গে খাপ-খায় না এমনতরো দলিল রয়েছে রাশি রাশি। কিন্তু শুধু দলিল থাকলেই হয় না। দলিলগুলির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করার জন্যে একটা কোনো অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিরও প্রয়োজন। আমি বলতে চাই, সে-পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে অধ্যাপক জর্জ টম্‌সনের গ্রন্থাবলী থেকে। উক্ত পদ্ধতির সাহায্যে লোকায়ত ও যোগী উভয় শব্দকেই কী রকম নতুন আলোয় দেখা সম্বব তার আলোচনা পরে তুলবো। আপাতত, শুধু এইটুকুই দেখাতে চাইছি যে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আমাদের সাধারণ যে সব ধারণা তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা কোনো কাজের কথা নয়। কেননা, তাহলে ভারতীয় দর্শনের পুঁথিপত্রগুলিতেই যা লেখা আছে তাও অস্বীকার করা দরকার।

————————
৭. D. R. Shastri SMIMSH
৮. H. P. Shastri op. cit. 5.
৯. এই গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের চতুর্থ পাদটীকা দ্রষ্টব্য।
১০. H. P. Shastri op. cit. 6.
১১. এই গ্রন্থের ৪৩৫-৬ পৃষ্ঠ দ্রষ্টব্য [“লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-প্রসঙ্গে : অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত]