তাহলে প্রাচীনদের স্মৃতি থেকে এ-কথা একেবারে মুছে যায়নি যে, এক আদিম অবিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরেই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব ঘটেছিলো। সেই আদিম সমাজে শাসক-শাসিতে প্রভেদ নেই; রাজা নেই, প্রজা নেই; লোভ নেই, অধর্ম নেই—মানুষের সঙ্গে মানুষের শুধু প্রীতির সম্পর্ক। আমাদের বক্তব্য হলো, এদেশে আদিম সমাজের রূপটি ঠিক কী রকম ছিলো এবং কী ভাবে সে-সমাজ ধ্বংস হয়ে আবির্ভাব হলো রাষ্ট্রশক্তির—এ-বিষয়ে মৌলিক গবেষণার অবকাশ রয়েছে, ভারততত্ত্বে যাঁরা সুপণ্ডিত তাঁদের দৃষ্টি এই সমস্যার দিকে আকৃষ্ট হওয়া প্রয়োজন। গণপতির পদানুসণ করে আমরা এই ইতিহাসের বহিঃরেখার আভাষ পেলাম এবং সাধারণভাবে কয়েকটি কথা মানতে বাধ্য হলাম। প্রথমত, আমাদের প্রাচীন পুঁথিপত্রে এই প্রাগ্-বিভক্ত প্রাচীন সমাজের উল্লেখ রয়েছে—গণ, ব্রাত, সংঘ, পূগ, শ্রেণী প্রভৃতি নানান নামে প্রাচীনেরা এই সমাজকে অভিহিত করতে চেয়েছেন। এই আদিম সাম্যসমাজে অবশ্যই ষোলো আনা গণতন্ত্রের আয়োজন; দুঃখের বিষয় আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এই গণতন্ত্রের লক্ষণ থেকে আদিম সমাজকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে সর্বত্রই এক সঙ্গে এই আদিম সমাজ ভেঙে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব ঘটেনি। আজো, ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে ওই জাতীয় আদিম সমাজ টিকে রয়েছে : সাঁওতাল বিদ্রোহের বর্ণনাদাতা ইংরেজ লেখক(১৬৩) সাঁওতালদের সম্বন্ধে বলছেন, they republicans and communists in politics—ওরা রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রবাদী ও সাম্যবাদী। উনবিংশ শতাব্দীতেই যদি ওই জাতীয় সমাজ দেশে টিকে থাকে (আজো আছে), তাহলে আজ থেকে প্রায় হাজার দুয়েক বছর আগেকার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রে নিশ্চয়ই ওই আদিম সমাজের—বা গণ-সমাজের পরিচয় বেশি হবার কথা। অতএব, অনুমান করা যায়, প্রাচীন ভারতের এখানে-ওখানে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হবার পর তারই আশে পাশে গণসমাজও থেকে গিয়েছিলো। গণপতির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমরা দেখতে পেলাম, রাষ্ট্রশক্তির মুখপাত্ররা এই গণসমাজকে খুব সুনজরে দেখেননি। এই কারণেই, প্রচীন আইনের পুঁথিতে গণপতি দেখা দিয়েছেন মূর্তিমান বিঘ্ন বা বিঘ্নরাজ হিসেবে।
অবশ্যই, গণপতির ইতিহাসে এর চেয়েও চিত্তাকর্ষক পর্যায় হলো ওই বিঘ্নরাজের পক্ষে সিদ্ধিদাতার পর্যবসিত হওয়া। এবং আমরা বলতে চাইছি, আধুনিক ঐতিহাসিকেরা যদিও গণপতির ইতিহাসের এই পর্যায়টির দিকে ভালো করে নজর দেননি তবুও এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, এই পর্যায়টির দিকে ভালো করে বিশ্লেষণ করলে পর ভারতীয় ইতিহাসের একটি বিখ্যাত রাষ্ট্রের আবির্ভাব কাহিনী উদ্ধার করা যাবে। অবশ্যই, ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে উক্ত বিশ্লেষণের যোগ্যতা নেই। কিন্তু দক্ষতর বিদ্বানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার আশায় আমি এখানে কয়েকটি কথার অবতারণা করতে চাই।
প্রথমত, ঐতিহাসিক বিবর্তনের কয়েকটি মূল নিয়ম আছে। এ-কথা না মানলে ইতিহাসকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেওয়া দুষ্কর(১৬৪)। কিন্তু এ-কথা মানতে হলে স্বীকার করতে হবে, অন্যান্য দেশের ইতিহাসের বেলায় যে-ভাবে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব ঘটেছে আমাদের দেশের ইতিহাসের বেলাতেও সেইভাবেই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হওয়াই স্বাভাবিক। তাই অন্যান্য কোনো দেশের বেলায় যদি কোনো সূত্র ধরে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব-কাহিনী নিয়ে সার্থক গবেষণা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের দেশের পুরোনো ইতিহাসের বেলাতেও একই সূত্রে অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্রের আবির্ভাব-কাহিনী উদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয় যদিও বিদেশের ক্ষেত্রে এ-বিষয়ে সত্যিই উচ্চাঙ্গের গবেষণা হয়েছে তবুও এখনো আমাদের ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনুরূপ পথে অগ্রসর হবার উৎসাহ দেখা দেয়নি।
অথচ, আমাদের প্রাচীন পুঁথিপত্রেই এমন ইঙ্গিত রয়েছে যেগুলিকে বিশ্লেষণ করলে অনুরূপ পথে অগ্রসর হবার সুযোগ পাওয়া যায়। প্রথমে এইরকমেরই কিছু ইঙ্গিতের উল্লেখ করবো এবং তারপর আলোচনা করবো বিঘ্নরাজ থেকে সিদ্ধিদাতায় পর্যবসিত হবার পেছনে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব-কাহিনী সংক্রান্ত কী তথ্য পাওয়া যায়।
ধরা যাক মৌর্য রাষ্ট্রের কথা। এ-রাষ্ট্রের উৎপত্তি কী করে হলো? সাধারণত আমরা এ-বিষয়ে মূরা-নাম্নী দাসী পুত্রের কাহিনী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি। অথচ, আধুনিক গবেষণার আলোয় ইতিহাসের একটি সাধারণ নিয়ম হিসেবে আমরা আজ এ-কথা মানতে বাধ্য যে, ট্রাইব্যাল-সমাজ ভেঙেই রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়। এই ট্রাইব্যাল-সমাজকে চেনবার একটি উপায় হলো জন্তু-জানোয়ারের নাম থেকে সমাজর নাম-করণ পদ্ধতি—অর্থাৎ, টোটেমবিশ্বাস মূলক নাম। এই দুটি কথা মনে রাখলে মৌর্য-রাষ্ট্রের আবির্ভাব-ইতিহাস হিসেবে মূরা নাম্নী দাসীর কাহিনী নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত হবে না। কেননা, অপরপক্ষে অন্যান্য তথ্য রয়েছে, এবং সেই তথ্যগুলির তাৎপর্য ইতিহাস-বিজ্ঞানের দিক থেকে মূল্যবান। প্রথমত, আধুনিক ঐতিহাসিকেরা জানেন যে, মৌর্য অশোক তাঁর রাজ্যে ময়ুর-বধ নিষিদ্ধ করেছিলেন(১৬৫)। এই ঘটনাটির তাৎপর্য ঠিক কী? এ-কি শুধুই অশোকের পক্ষে জীবে দয়ার পরিচয়? তা হতে পারতো, যদি রাজাজ্ঞায় নির্বিচারে সমস্ত রকম প্রাণীবধই নিষিদ্ধ হতো। কিন্তু নিষেধটা যেতেতু নির্দিষ্ট এক প্রাণী সম্বন্ধেই সেইহেতু অনুমান করবার সুযোগ থেকে যে এর পিছনে কোনোরকম টোটেম-বিশ্বাসের পরিচয় থাকতে পারে। কেননা, টোটেম বিশ্বাসের সঙ্গে টাবু-র বা নিষেধাজ্ঞার যোগাযোগ রয়েছে। এই টাবু প্রধাণত দু-রকম। এক, বিবাহ সংক্রান্ত; দুই, টোটেম-প্রাণীটির হত্যা ও আহার সংক্রান্ত : হরিণ-দলের মানুষ হরিণদলের কাউকে বিয়ে করতে পারবে না, হরিণ-দলের মানুষ হরিণ-হত্যা করতে পারবে না। হরিণ-দলের মানুষ অন্য যে-কোনো রকম প্রাণী হত্যা করতে ও ভক্ষণ করতে পারে, কেবল হরিণ হয়। তাই মৌর্য অশোকের রাজ্যে যদি নির্দিষ্টভাবে ময়ূর-বধ নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে এই নিষেধাজ্ঞাকে ময়ূর-বধ সংক্রান্ত টাবুর স্মারক মনে করবার অবকাশ থাকে না কী? তার মানে এই এই নয় যে, মৌর্য রাজবংশের উৎপত্তি ময়ূর-টোটেম-যুক্ত কোনো ট্রাইব্যাল-সমাজ থেকে হওয়াই সম্ভবপর? এবং ঠিই এই ইঙ্গিতটিই পাওয়া যায় জৈন-পুঁথিতে(১৬৬) :
চন্দ্রবচ্চন্দ্রগুপ্তহপি ব্যবর্দ্ধত দিনে দিনে।
ময়ূর পোষক কুলোৎপলিনী বনলাসকঃ।।
অর্থাৎ, গুপ্ত ছিদ্রযুক্ত তৃণমণ্ডপমধ্যে চন্দ্রসুধাপান করিয়া সন্তানপ্রসূত হয় বলিয়া তাহার নাম হইল চন্দ্রগুপ্ত। ইনি ময়ূরপোষক-কুলোৎপন্ন।
এইদিক থেকে ভেবে দেখলে মনে হয় ময়ূর-টোটেম-যুক্ত কোনো ট্রাইব্যাল-সমাজ থেকে মৌর্যবংশের উৎপত্তি অসম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এখনো সূত্রটিকে অনুসরণ করে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেননি।
সিদ্ধিদাতা গণেশের বেলাতেও এই জাতীয় সূত্র থেকে গিয়েছে এবং দক্ষ ঐতিহাসিকদের পক্ষে সেই সূত্র অনুসরণ করে সেকালের ভারতবর্ষের আর একটি বিখ্যাত রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব-কাহিনী উদ্ধার করা বোধ হয় অসম্ভব নয়। ওই সূত্রগুলি ঠিক কী? এই প্রশ্নের জবাব দেবার আগে প্রাচীন মিশরের রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব-কাহিনী নিয়ে মরেট ও ডেভি(১৬৭) যে-সার্থক গবেষণা করেছেন তার কিছুটা উল্লেখ করবো। কেননা, আমাদের ধারণায় উক্ত বিদ্বানেরা যে-ভাবে অগ্রসর হয়েছেন গুপ্ত-রাষ্ট্রের আবির্ভাব প্রসঙ্গেও সেই পথে অগ্রসর হবার অবকাশ আছে।
মিশরের ইতিহাসে যিনি প্রথম একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসলেন তাঁর নাম মেনেস। কিন্তু মেনেস-এর পক্ষে এই একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসবার যে-বর্ণনা পাওয়া যার তা ভারি অদ্ভুত ধরনের। বর্ণনাটি হলো : বাজপাখি গিলে খেলো বাকি সব জানোয়ার। মরেট ও ডেভির গবেষণা থেকে বোঝা যায়, এই বর্ণনাটি মেনেস-এর পক্ষে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসবার পক্ষে কেন সত্যিই এক নিখুঁত বর্ণনা। সূত্রটি হলো, মেনেস ছিলেন বাজপাখি-দলের প্রধান। বাজপাখি মানে তাই মেনেস-এর দলের টোটেম-চিহ্ন। কিন্তু এই দলের নেতার পক্ষে অনেক বড়ো এলাকা জুড়ে রাষ্ট্রশক্তির অধিনায়ক হতে হলে অবশ্য অন্যান্য দলগুলিকে পরাস্ত করা প্রয়োজন। মেনেস-এর দলের পরিচয় যে-রকম বাজপাখি তেমনি অন্যান্য দলের পরিচয়ও অন্যান্য জানোয়ার থেকেই। এখন, মরেট আর ডেভি দেখাচ্ছেন, মেনেস-এর পক্ষে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসবার ঠিক আগের যুগটিতে অঙ্কিত অনেক ছবি পাওয়া যাচ্ছে—এই ছবিগুলোর বিষয়বস্তু হলো, নানান জানোয়ারের মধ্যে লড়াই চলছে এবং সেই লড়াইতে জয় হয়ে চলছে বাজপাখির। নানারকম টোটেম-দলের মধ্যে যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে বাজপাখি-টোটেমযুক্ত দলটির জয় আর কী ভাবে এঁকে বোঝানো যায়? চিত্রে মেনেস্-এর বিজয়কাহিনী সংক্রান্ত অন্যান্য যে-সব তথ্য পাওয়া যায় তাও এই টোটেম-বিশ্বাসের দিক থেকেই বুঝতে পারা সম্ভব : ফাঁসিকাঠে-ঝোলানো শত্রুদের কথা আঁকা হয়েছে কয়েকটি জানোয়ারকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হিসেবেই, কিংবা, বিজিত মানুষদের যেখানে শিরঃ-ছেদ আঁকা হয়েছে সেখানে যদিও মানুষদের চেহারা মানুষ হিসেবেই আঁকা তবুও তারা যে-কোন দলের মানুষ তা বোঝাবার জন্যে ছিন্নমস্ত মরদেহগুলির উপরই জন্তু-জানোয়ারের ছবি আঁকতে চিত্রকরেরা ভুলে যাননি। তাই, বাজপাখি গিলে খেলো বাকি সব জানোয়ার,–এই বর্ণনার অর্থ হলো বাজপাখি দলের কাছে পরাজয় ঘটলো অন্যান্য দলের মানুষদের(১৬৮)।
এই প্রসঙ্গেই মনে রাখতে হবে, মরেট এবং ডেভি দেখাচ্ছেন, বিজয়ী মেনেস্-এর পক্ষে রাজা হবার কাহিনীই হলো বাজপাখি-টোটেমটির পক্ষে দেবতা হোরাস হয়ে যাওয়ার কাহিনীও। অর্থাৎ, রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব ও দেবতার জন্ম স্বতন্ত্র কাহিনী নয়। টোটেম-সমাজে উপাস্য-উপাসকে তফাত নেই, দলের প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে টোটেমটির একাত্মভাব। তাই, এ-সমাজে আধুনিক অর্থে দেবতার বা আধুনিক অর্থে ধর্মভাবের কোনো অবকাশ নেই—কেননা, উপাস্য-উপাসকে তফাত না থাকলে সে-অবকাশ সম্ভব নয়। যে-দলের টোটেম হলো সূর্যমুখী ফুল সে-ফলের সবাই বলবে, আমরা হলাম সূর্যমুখী ফুল; যে-দলের টোটেম হলো সাময় হরিণ সে-দলের সবাই বলবে, আমরা হলাম সাময় হরিণ। তাই, বাজপাখি যতোদিন একটি দলের টোটেম ততদিন পর্যন্ত ওই দলের সকলের মনেই বাজপাখির সঙ্গে একাত্ম-চেতনা : তাই সবাই বাজপাখি, বাজপাখি তখনো তাদের কাছে উপাস্য-দেবতার স্বাতন্ত্র্য পায়নি। কিন্তু সেই আদিম-সাম্যসমাজ ভেঙে যখন রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হলো তখন দলের ঐশ্বর্য এলো ব্যক্তিবিশেষের কবলে—মেনেস্-এর কবলে। তেমনি অধ্যাত্ম-শক্তিও কেন্দ্রীভূত হলো একজায়গায়—বাজপাখি আর বাজপাখি রইলো না, দেবতা হয়ে গেলো, সে-দেবতার নাম হোরাস্। অবশ্যই, রাজা মেনেস ও দেবতা হোরাস্–দু’-এর মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তাই ছবিতে দেখা যায়, রাজার ধ্বজায় আঁকা হয়েছে বাজপাখি হোরাসকে, দেখা যায় দেবতা হোরাস রাজার কাছে উপহার আনছে ক্রীতদাস। রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে অধ্যাত্মশক্তির আবির্ভাবের এই যোগাযোগটির কথা মূল্যবান(১৬৯)।
মিশর-ইতিহাসের এই বিচিত্র ঘটনাটি থেকে আমাদের দেশের প্রাচীন-যুগের ইতিহাস সংক্রান্ত কোনো তথ্য অনুমান করবার অবকাশ আছে কি? একটি টোটেম দেবতার পক্ষে দেবতায় পরিণত হওয়ার নিশ্চয়ই আকস্মিক ঘটনা নয়, এবং তারই পাশাপাশি যদি কোনো রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হতে দেখা যায় তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে, টোটেমটির পক্ষে এই দেবত্বপ্রাপ্তি এবং ওই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব সম্পর্কহীন ঘটনা নয়—যে-ট্রাইব্যাল সমাজ ভেঙে এই রাষ্ট্রের উদয় হলো দেবত্বপ্রাপ্তির পূর্বে টোটেমটিও সেই ট্রাইব্যাল সমাজেরই পরিচায়ক ছিলো। আমাদের এই অনুমান আরো জোরালো হবে যদি দেখা যায় নবোদিত রাষ্ট্রশক্তি নবজাত ওই দেবতাটির মহাত্ম্যপ্রচারে প্রচুর উৎসাহের পরিচয় দিচ্ছে।
এই রকমই কিছুকিছু তথ্যের পরিচয় পাওয়া যায় সিদ্ধিদাতার জন্মকথা-প্রসঙ্গে।
গণেশের নরদেহের উপরে ওই রকমের একটা গজানন কেন? এ-প্রশ্ন পুরাণকারেরাও তুলেছিলেন এবং আমরা দেখেছি তাঁদের সমাধানগুলির অসংলগ্নতা ও পরস্পর-বিরোধিতা থেকেই প্রমাণ হয় যে, এগুলি উত্তরকালের কৃত্রিম রচনা। এই জাতীয় কৃত্রিম সমাধানের পরিচয় আধুনিক পণ্ডিতমহলেও দুর্লভ নয়। কেননা, ওই গজানন থেকে গণেশের উৎস সম্বন্ধে একটিমাত্র তথ্যই অবধারিতভাবে প্রমাণ হয়—প্রমাণ হয় দেবতাটির আদিরূপটা, অর্থাৎ, প্রাগ-দেবত্বপ্রাপ্তির রূপটা, ছিলো হাতি-টোটেম। হাতি-টোটেমের কথায় বিস্মিত হবার কারণ নেই। আমাদের দেশের পুরানো পুঁথিতে এ-জাতীয় টোটেমের উল্লেখ পাওয়া যায়(১৭০) এবং আধুনিক যুগের সেন্সাস-রিপোর্টেও দেখা যায় এই হাতি-টোটেমের উল্লেখ রয়েছে। আজো মহীশূর অঞ্চলে একদল মানুষের নাম হলো আনে(১৭১)—আনে মানে হাতি।
কোনো এক হাতি-টোটেম থেকেই যে গণেশের জন্ম হয়েছে তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ হলো গণেশের ওই গজাননটি। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখা দরকার যে, এককালে গণপতি বা বিনায়ক শব্দের সঙ্গে শুধুমাত্র ওই হাতি-টোটেমটিরই সম্পর্ক ছিলো না। তার বদলে, সন্দেহ হয়, এই গণপতি শব্দটি ছিলো প্রাণীজগতের রকমারি বাসিন্দার সঙ্গে সংযুক্ত একটি সাধারণ নামের মতো। আগেই বলেছি, যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখের রচনা থেকে বোঝা যায়, বিনায়ক এক ছিলেন না, বহু ছিলেন। তাই অনুমান করতে হবে, এই বহু বিনায়কের মধ্যে গজাননধারী একটি নির্দিষ্ট বিনায়কই উত্তরকালে এক এবং অদ্বিতীয় বিনায়ক হয়ে দাঁড়ালেন—তিনিই আমাদের সিদ্ধিদাতা গনেশ। এবং ওই অন্যান্য বিনায়কদের চেহারা কী রকম ছিলো তা অনুমান করবার মতো অন্তত একরকম তথ্যের উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। তন্ত্রসাহিত্যে গণেশের পঞ্চাশটি নামের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে কয়েকটি চিত্তাকর্ষক নাম হলো, বৃষভধ্বজ, বৃষকেতন, দ্বিজিহ্ব। এই নামগুলি থেকেই অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে, এককালে ওই বহু বিনায়কের বহুপ্রকার রূপ ছিলো,–কোনোটা সাপের মতো, কোনোটা বা ষাঁড়ের মতো।
এই জাতীয় বহু টোটেম-রূপী বিনায়কদের মধ্যে গজাননধারী নির্দিষ্ট একটি বিনায়ক সিদ্ধিদাতা দেবতা হয়ে উঠলেন এবং তারই গৌরব-প্রচারে মুখর হয়ে উঠলো শাসক-শ্রেণীর সাহিত্য ও ভাস্কর্য! অথচ, তার আগের যুগের শাসক-শ্রেণীর সাহিত্যই বিনায়ক-বিদ্বেষে বিষাক্ত হয়েছিলো, বিনায়ককে চেনবার চেষ্টা ছিলো বিঘ্নরাজ বলেই।
বিঘ্নরাজ থেকে সিদ্ধিদাতা। ঘৃণিত, আতঙ্কসঞ্চারী টোটেম-রূপী বহু বিনায়কদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিনায়কের এই দেবত্বপ্রাপ্তির সঙ্গে কি ভারতীয় ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাবের সম্পর্ক আছে? আছে। তার নাম গুপ্তরাষ্ট্র। সম্পর্কটা কী রকম? আনন্দকুমার কুমারস্বামী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে গণেশমূর্তির আবির্ভাব আকস্মিকভাবেই বহুল—অর্থাৎ কিনা, গুপ্তযুগ থেকেই দেখা গেলো হঠাৎ বহুলভাবে গণেশ-মূর্তির আবির্ভাব ঘটতে শুরু করছে। পুরাণগুলিও যে, অমনভাবে সিদ্ধিদাতার মাহাত্ম্যে মেতে উঠলো তাও ওই যুগটা বরাবর হওয়া অসম্ভব নয় : স্কন্ধপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,–অর্থাৎ, যে-দুটি পুরাণে বিশেষ করে গণেশ মাহাত্ম্যের প্রচার হয়েছে,–গুপ্তযুগ বরাবরই রচিত কি না এ-বিষয়ে বিদ্বানেরা নিশ্চয়ই চিন্তা করতে পারেন; কিন্তু স্যর গোপাল ভাণ্ডারকর(১৭২) ইতিপূর্বেই অনুমান করেছেন যে, গুপ্তযুগে সমস্ত পুরাণগুলিকেই অন্তত ঢেলে সাজানো হয়েছিলো।
মহামহোপাধ্যায় পি. ভি. কানেও (১৭৩) মানছেন, গুপ্তযুগ থেকেই গনেশ মাহাত্ম্যর প্রচার শুরু হয়েছে।
তাই রকমারি টোটেম-রূপী বহু বিনায়কের মধ্যে গজরূপী নির্দিষ্ট বিনায়কটির পক্ষে দেবত্বপ্রাপ্তির সঙ্গে সেকালের ভারতবর্ষে একটি রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব-কাহিনীরও সম্পর্ক রয়েছে। মরেট ও ডেভির মিশর-ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষণা থেকে আমরা যদি শিক্ষালাভ করতে প্রস্তুত থাকি তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষে সন্দেহ করা অন্যায় হবে না যে, সিদ্ধিদাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হয়তো গুপ্ত-রাষ্ট্রের আবির্ভাব-কাহিনীর উপর আলোকপাত করবার আশা আছে। কেননা, গুপ্ত-রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঠিক কীভাবে হয়েছিলো ভারতীয় ইতিহাসে তা আজো অনেকাংশে অমীমাংশিত প্রশ্ন। বিদ্বানেরা ভেবে দেখতে পারেন, হাত-টোটেমযুক্ত কোনো ট্রাইব্যাল সংগঠন ভেঙে এই রাষ্ট্রের আবির্ভাব সম্ভব কি না। আলবারুণী(১৭৪) নাকি গুপ্তবংশের উৎপত্তি প্রসঙ্গে এক অরণ্যবাসী দুর্দান্ত দস্যুদের কথাই উল্লেখ করেছেন। তার মানে, তা কোনো এক ট্রাইব্যাল সংগঠন হওয়া অসম্ভব নয়। সেই ট্রাইবের সঙ্গে হাতি-টোটেমের কোনো সম্পর্ক ছিলো কি না এই প্রশ্ন অনুসন্ধানযোগ্য।
অবশ্যই, এখানে সে-অনুসন্ধান চালাবার যোগ্যতা আমাদের নেই, সুযোগও নেই। কিন্তু গণপতির বিচিত্র ইতিহাসের তৃতীয় পর্যায়টির ব্যাখ্যায় আলোচনার অন্তত একটি বহিঃরেখা দাঁড় করাবার প্রয়োজন ছিলো। এই তৃতীয় পর্যায়টি হলো, বিঘ্নেশ্বর থেকে সিদ্ধিদাতায় পরিণত হবার কাহিনী। আমরা দেখলাম, অন্তত কালনির্ণয়ের দিক থেকে এই কাহিনীর সঙ্গে ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক নতুন রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাবের সম্বন্ধ আছে।
সংক্ষেপে, গণেশের ইতিহাসে মোটের উপর তিনটি পর্যায় দেখা যায়। ভারতীয় সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে এই তিনটি পর্যায়ের সম্পর্ক রয়েছে।
এক : পৃথিবীর সব-মানুষের মতোই বৈদিক আর্য এবং অনার্য উভয় প্রকার মানুষই এককালে প্রাগ-বিভক্ত ট্রাইব্যাল সমাজে জীবন-যাপন করেছে। এই ট্রাইব্যাল সমাজেরই নাম হলো গণ। ফলে, বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতর পর্যায়গুলিতে গণ বা গণপতি নিন্দিত নয়।
দুই : ভারতবর্ষের মানুষদের উন্নতি হয়েছে অসমান তালে। তাই, রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হবার পরও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার পাশাপাশিই থেকে গিয়েছে গণসমাজ। এই অবস্থায়, রাষ্ট্রশক্তির মুখপাত্রেরা গণসমাজকে কী রকম ঘৃণার চোখে দেখেছেন তার নজির মহাভারতে পাওয়া যায় এবং তাঁরা তাই গণপতিকেও কী রকম বিষনজরে দেখেছেন তার নজির পাওয়া যাওয়া মানবগৃহ্যসূত্র, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি প্রভৃতিতে।
তিন : একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পাশাপাশি বহু বিনায়কের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিনায়ককে বিঘ্নরাজের বদলে সিদ্ধিদাতা দেবতার সম্মান পেতে দেখা যায়। এই তৃতীয় পর্যায়টির ব্যাখ্যা পাবার আশায় আমরা সন্দেহ করলাম, যে-ট্রাইব্যাল সমাজ ভেঙে উক্ত রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে সেই ট্রাইব্যাল-সমাজের সঙ্গে উক্ত বিনায়কটির যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা তা অনুসন্ধানযোগ্য।
অবশ্যই, ওই তৃতীয় পর্যায়টির ব্যাখ্যা হিসেবে আমাদের এই সন্দেহের পক্ষে খুব জোরালো কোনো প্রমাণ এখানে দেওয়া গেলো না। প্রাচীন মিশর-ইতিহাসের একটি পরিস্থিতি সংক্রান্ত গবেষণা আমাদের সাধারণভাবে এই সন্দেহের দিকে আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু এই তৃতীয় পর্যায়টি সংক্রান্ত উক্ত সন্দেহের উপর আমাদের মূল যুক্তির ঐকান্তিক নির্ভরতাও নেই। কেননা, আমাদের উদ্দেশ্য হলো লোকায়তিক ধ্যানধারণের উৎস-অম্বেষণ। এবং আমাদের মূল যুক্তি হলো, প্রাগ-বিভক্ত আদিম সমাজের মধ্যেই এই ধ্যানধারণাগুলির উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই গণপতির ইতিহাসের বিশেষ করে প্রথম পর্যায়টির কথাই আমাদের যুক্তির পক্ষে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
—————
১৬৩. cf. W. W. Hunter IGI 4:177 “ the whole village feasts, hunts and worship together…So strong is the bond of race, that expulsion from the tribe was the only Santhal punishmenst.”
১৬৪. দুঃখের বিষয়, আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই এ-ভাবে ইতিহাসকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট নন।
১৬৫. এই তথ্য সংশোধন-সাপেক্ষ। শুদ্ধিপত্র দ্রষ্টব্য।
১৬৬. বিশ্বকোষ ১৫:৪৬৯।
১৬৭. A. Moret & G. Davy FTE 115ff.
১৬৮. Ibid. 128ff.
১৬৯. Ibid. 133.
১৭০. ক্ষিতিমোহন সেন : জাতিভেদ ১০০ : “মাতঙ্গ অর্থ হস্তী। মহাভারত ও পুরাণের বহু স্থলেই মতঙ্গ চণ্ডালদের কথা পাই”।
১৭১. E. Thurstton & Rangacari CTSI- Ane.
১৭২. T. W. Rhys Davids BI 23.
১৭৩. P. V. Kane HD 4:215, 725.
১৭৪. বিশ্বকোষ ৫:৪২৮।