লোকায়ত বলতে বোঝায় সাধারণ লোকের দর্শন, জনসাধারণের দর্শন। লোকেষু আয়তো লোকয়তঃ। অর্থাৎ কিনা, সাধারণ লোকের মধ্যে পরিব্যাপ্ত বলেই এ-দর্শনের ওই রকম নাম। মাধবাচার্যের লেখা সর্বদর্শনসংগ্রহ বলে সংস্কৃত পুঁথির ইংরেজী তর্জমা করবার সময় অধ্যাপক কাওয়েল(১) লোকায়ত শব্দটিকে এই এই রকমই একটা ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গ্রহণ করবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সে-চেষ্টার পিছনে প্রাচীনদের সম্মতিরও অভাব নেই। দিব্যবিধান(২) নামের বৌদ্ধ পুঁথির স্থানবিশেষে লোকায়ত শব্দের সোজাসুজি এই অর্থই ধরা হয়েছে। জৈন লেখক বুদ্ধিজনের ষড় দর্শনসমুচ্চরের উপর টীকা রচনা করবার সময় গুণরত্ন(৩) বলছেন, যারা সাধারণ লোকের মতো নির্বিচার আচরণ করে তাদেরই বলে লোকায়ত। কিন্তু শুধুমাত্র নাস্তিকদের নজিরই নয়; লোকায়ত বলতে যে জনগণেরই দার্শনিক চেতনা বুঝতে হবে এ-কথা অগ্রণী আস্তিকরাও বারবার স্বীকার করেছেন। স্বয়ং মাধবাচার্য(৪) বলেছেন, এই সম্প্রদায়ের পক্ষে লোকায়ত নামটি বেশ মানানসই হয়েছে, কেননা সাধারণ লোক নীতিকামশাস্ত্র নিয়ে বিভোর হয়ে অর্থ ও কামকেই পরম পুরুষার্থ মনে করে আর তাই আমল দেয় না পরলোকের কথাকে,—ফলে তাদের চার্বাক-মতানুসারী মনে করাই ঠিক। মাধবাচার্যের ঢের আগে শঙ্করাচার্যও(৫) লোকায়তিক ও প্রাকৃতজন—এই দুটি শব্দকে একসঙ্গে আর একনিশ্বাসে উল্লেখ করে ইঙ্গিত দিয়েছেন দু’-এর মধ্যে সম্পর্ক কতো ঘনিষ্ঠ!
কিন্তু ওই লোকায়ত নামেরই আরো মানে হয়। লোকায়ত হলো ইহকাল-সংক্রান্ত দর্শন : যারা পরকাল মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে না, মোক্ষ মানে না, তাদেরই বলে লোকায়তিক। তারা মনে করে জল-মাটি-আগুন-হাওয়া দিয়ে গড়া এই মূর্ত পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য, আত্মা বলতে দেহ ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। কথায় বলি বটে আমার দেহ, যেন আমি আর দেহ দুটো আলাদা কিছু। কিন্তু এ হলো নেহাতই কথার কথা। যেমন কিনা বলা হয় রাহুর মাথা। আসলে রাহু তো আর সত্যিই মাথাটুকু ছাড়া কিছুই নয়।
তাহলে এই মানে অনুসারে লোকায়ত হলো দেহাত্মবাদ, বস্তুবাদ। ইংরেজী পরিভাষায় যাকে বলে মেটিরিয়ালিস্ম্।
অধ্যাপক তুচি(৬) দেখাবার চেষ্টা করেছেন, ব্যুৎপত্তির দিক থেকেও লোকায়ত শব্দ এই রকমই একটা অর্থের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অবশ্য বৃদ্ধসম্মতি হিসাবে এ-কথার পক্ষে তিনি যে-নজিরটি দিচ্ছেন তা কিছুটা জটিল : বুদ্ধঘোষ(৭) বুঝি আয়াত শব্দটাকে আয়তন অর্থে ব্যবহার করেছেন—আয়তন বলতে বোঝায় ভিত্তি। তাই যে-মতবাদের ভিত্তি হলো এই ইহলোক,—মাটির পৃথিবী,—তাকেই বলে লোকায়ত।
বলাই বাহুল্য, অধ্যাপক তুচির পক্ষে এই অর্থটি প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টা যতোখানিই কষ্টকল্পিত হোক না কেন, লোকায়ত নামটিকে আমরা সাধারণত বস্তুবাদ-সূচক অর্থেই গ্রহণ করে থাকি। লোকায়ত বলতে বস্তুবাদই বোঝায়। আর তা বোঝবার জন্যে খুব একটা ঘোরালো প্রমাণের সত্যিই দরকার নেই। কেননা, হরিভদ্র(৮) ষড়দর্শনসমুচ্চয়ে লোকায়তমত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, লোক বলতে শুধু সেইটুকুই যা কি না ইন্দ্রিয়গোচর : এতাবানেবলোকেহয়ং বারানিন্দ্রিয়গোচরঃ। টীকাকার মণিভদ্র(৯) কথাটাকে আরো পরিষ্কার করে বলছেন, লোক মানে নিছক পদার্থসার্থ বা পদার্থসমূহ।
তার মানে, প্রত্যক্ষে যেটুক ধরা পড়ে লোকায়তিকরা শুধুমাত্র সেইটুকুকেই সত্যি বলে স্বীকার করেন। তারই নাম লোক। লোকই একমাত্র সত্য।
——————————–
১. E. B. Cowell SDS 2n. cf. S. N. Dasgupta. HIP 3:515 cf. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৩৭
২. S. N. Dasgupta op. cit. 3:514.
৩. গুণরত্ন : তর্কন্যায়দীপিকা ৩০০—“লোকা নির্বিচারাঃ সামান্যা লোকাস্তদ্বদাচরন্তিম্মেতি লোকায়তা লোকায়তিকা ইত্যপি”।
৪. মাধবাচার্য : সর্বদর্শনসংগ্রহ ১।
৫. শঙ্করাচার্য : ব্রহ্মসূত্রভাষ্য : ১.১.১ : “দেহমাত্রং চৈতন্যবিশিষ্টমাত্মোতি প্রাকৃতজনা লোকায়তিকাশ্চ প্রতিপন্নাঃ”।
৬. S. N. Dasgupta op. cit. 3:514-5.
৭. Ibid 3:515n.
৮. হরিভদ্র : ষড়্দর্শনসমুচ্চয় ৮১ শ্লোক।
৯. St. Petersburg Dictionary-তেও লোকায়ত শব্দের অর্থ করা হয়েছে materialism. cf. রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় : বঙ্গদর্শন—শ্রাবণ ১২৮১, “ইহলোক ঐ দর্শনের সর্বস্ব, তজ্জন্যই উহার ঐরূপ নামকরণ হয়”।