ভারতের কি কোন ইতিহাস নেই?
হেগেলের মূল কথা হলো, মানুষের ইতিহাসকে শুধুমাত্র মানুষের কীর্তিকাহিনী মনে করা ভুল। কেননা, এই পরিদৃশ্যমান জগতের পিছনে আছেন এক চিন্ময় পরমাত্মা। এখানের ধূলিকণা থেকে শুরু করে ধ্যানধারণার জটিলটা পর্যন্ত সর্বত্রই তাঁর বিকাশ।
তাই, ইতিহাস বলতে মরলোকের মানুষ যেটুকু দেখেছে সেটুকুই সব নয়। আসলে সবই তাঁর লীলা। আর কী অপরূপ এই লীলা : যুগের পর যুগ ধরে একের পর এক পর্যায় পার হয়ে, ভগবান তাঁর মহিমার বিকাশ করে চলেছেন! এক এক যুগের এক এক দেশের কথা তাই এই লীলাপ্রসঙ্গেই যেন এক একটি পরিচ্ছেদ।
আমাদের দেশে, ভারতবর্ষে, লীলাময়ের কী রকম মহিমা?
হেগেল(১) বলছেন, এ-যেন তাঁর স্বপ্ন-দশা। স্বপ্নমহিমা। তার মধ্যে লাবণ্য যে নেই তা নয় : যা-কিছু কঠিন, যা-কিছু এলোমেলো, এবড়ো-খেবড়ো, দ্বন্দ্বকণ্টকিত, তা সবই এখানে শান্ত, সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছে। তবুও, কী সাংঘাতিক অলীক এই স্বপ্ন—এমনকি মনগড়া বা কাল্পনিক কথার মতোও নয়। যদি তাই হতো তাহলেও জীবাত্মা এ-কল্পনা থেকে ও-কল্পনায় সহজে যাতায়াত করতে পারতো। তার মানে, একটা কল্পনাকে যতো সহজে জড়িয়ে ধরতো ততো সহজেই আবার তাকে ছেড়ে আসতে পারতো। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে লীলাময়ের যে-স্বপ্ন-দশা সেখানে জীবাত্মা যে-কোনো একটি খণ্ড ও সংকীর্ণ বস্তুর কাছেই একেবারে চরম আত্মসমর্পণ করে বসে—যেন বিধাতার পায়ে, ভগবানের কাছে, একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়া! এখানে তার সবকিছুই যেন এক একটি মূর্তিমান ভগবান : সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, গঙ্গা, সিন্ধু, জানোয়ার, সবকিছুই। ঈশ্বর-সৃষ্টির এই নেশায় জীবাত্মার স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অপরপক্ষে আবার সংকীর্ণ ও খণ্ড বস্তুরাজ্যের স্তরে নামিয়ে এনে মলিন করা হয় ঈশ্বরের মর্যাদা।
আর, হেগেল বলছেন, ঠিক এই কারণে ইতিহাস বলতে সত্যিই যা বোঝায় এ-দেশে তার সন্ধান করা চলে না(২)। কেননা, ব্যক্তিচেতনা যেখানে ধ্বংস হয়েছে, বস্তু-চেতনা যেখানে অনাবিল নয় সেখানে ইতিহাসের আশা করা নিষ্ফল। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হলো একদিকে চরম আত্মনাশ এবং অপরদিকে খণ্ডবস্তুর স্বরূপ ভুলে সবকিছুকেই ঈশ্বর করে তোলা। একদিকে জীবাত্মার বিলোপ, অপরদিকে পরমাত্মার অমর্যাদা। এ-শুধু স্বপ্ন-দশায় সম্ভব—একে ইতিহাস বলে না।
অতএব, হেগেল আরো বলে চলেছেন, ইয়োরোপের কাছে ভারতবর্ষ অনিবার্যভাবেই মাথা নোয়াতে বাধ্য ছিলো, কেননা, ইয়োরোপের শুধু যে ইতিহাস আছে তাই নয়, সে-ইতিহাসে পরমাত্মার অনেক উন্নত পর্যায়ের বিকাশ। হেগেল ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিলেন, চীনও একদিন না একদিন এইভাবেই ইয়োরোপের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। বস্তুত, এসিয়ার সমস্ত দেশেরই এই হলো অনিবার্য ভবিষ্যৎ(৩)।
কিন্তু ভারতবর্ষ—তথা এসিয়া—যে একদিন ইয়োরোপের দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তিও পাবে হেগেলের ভবিষ্যৎ-বাণীর মধ্যে এ-কথার স্থান নেই। কী করে থাকবে? যার অতীতটা অস্বীকার করা গেলেও তার ভবিষ্যৎটা স্বীকার করবার অস্বস্তি থেকে মুক্তিও পাওয়া যায়। তাই ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামে ভারতবর্ষের অতীত নিয়ে প্রশ্নটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা, অতীতের কথার সঙ্গে ভবিষ্যতের কথা সম্পর্কহীন নয়—অতীতের উপর থেকে যবনিকা উঠলে পর ভবিষ্যতেরও নির্দেশ পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষের সত্যিই কি কোনো অতীত ছিলো? যদি থাকে, তাহলে সে-অতীতকে আবিষ্কার করে ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের কোন ধরনের নির্দেশ পাওয়া সম্ভব হবে?
——————–
১. G. W. F. Hegel PH 147.
২. Ibid 148.
৩. Ibid 149.