প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১০. গণ মানে কী—কালীপ্রসাদ জয়সওয়াল ও রমেশচন্দ্র মজুমদার

গণ মানে কী—কালীপ্রসাদ জয়সওয়াল ও রমেশচন্দ্র মজুমদার

গণ মানে কী? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া সত্যিই তেমন দুরূহ হওয়া উচিত নয়। কেননা, প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র রেখে যাবার ব্যাপারে প্রাচীনেরা মোটেই কৃপণ ছিলেন না। তবু এ-কথাও ঠিক যে, শুধুমাত্র ওই দলিলগুলির শব্দার্থের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে গণকে বোঝবার চেষ্টা একপেশে, অতএব ভুলও হতে পারে। তার কারণটা খুব জটিল নয়। দলিলগুলির উপর চোখ বোলালেই বুঝতে পারা যায় গণ ছিলো সেকালের কোনো একরকম সমাজ-সংগঠন। তাই, গণকে বুঝতে হলে সংস্কারমুক্ত সমাজবিজ্ঞানের সাহায্যও প্রয়োজন।

এই সংস্কারমুক্তির কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, শুধু যে সেকালের রচনাই সেকালের সামাজিক-পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য তাই নয়, সেকালের রচনা সম্বন্ধে একালের মনোভাবটির একালের সামাজিক-পরিস্থিতির প্রভাব নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। কারণ, সেকাল নিয়ে গবেষণা করলেও একালের ঐতিহাসিক হাজার হোক একালেরই মানুষ। এবং, একালের মানুষ হিসেবে তাঁর মনে একালের প্রয়োজন নানারকম সংস্কার সৃষ্টি করতে বাধ্য। তাই, আধুনিক ঐতিহাসিকের লেখনী পুরোনো দলিলপত্রের ব্যাখ্যা দেবার সময় সেগুলিকে আধুনিক যুগের আশা-আকাঙ্খার রঞ্জিত করবার প্রলোভনে পড়তে পারে। এ-ক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক হবার একমাত্র পথ হলো, আধুনিক যুগের আশা-আকাঙ্খাগুলিকে সচেতনভাবে সমালোচনা করবার প্রবেষ্টা(৯৮)।

কথাটা বিশেষ করে কেন উঠলো তাই বলি। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা গণ নিয়ে গবেষণা বড়ো কম করেননি। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক কাশীপ্রসাদ জয়সয়ালের “হিন্দু পলিটি” এবং অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের “কর্পোরেট লাইফ ইন এন্সেণ্ট ইণ্ডিয়া”,–বিশেষ করে প্রথম বইটির নাম—উল্লেখ না করলেই নয়। এই বই দুটিতে তাঁরা প্রাচীনদের কাছ থেকে পাওয়া গণ-সংক্রান্ত বহু তথ্য একত্রিত করেছেন—বস্তুত, তাঁদের ওই পরিশ্রমই আমাদের পক্ষে গণ নিয়ে আলোচনার পথ সুগম করেছে। তবুও তাঁরা যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেয়েছেন তা আমাদের কাছে স্বীকারযোগ্য মনে হয়নি। তার কারণ, তাঁদের ঐতিহাসিক দক্ষতার অভাব নয়, তাঁদের মনের উপর আধুনিক যুগের এক নির্দিষ্ট আশা-আকাঙ্খার প্রভাব। কেননা, তাঁদের গবেষণার পিছনে স্পষ্ট প্রেরণা হলো একটি নির্দিষ্ট যুগের একটি নির্দিষ্ট রাজনীতির। এই রাজনীতির সাময়িকতা ও সংকীর্ণতা তাঁদের সিদ্ধান্তকেও সাময়িক মূল্য দিয়েছে ও সংকীর্ন করেছে।

কথাটা এমনি শুনলে হয়তো সন্দেহজনক মনে হবে। অথচ, তথ্যের দিক থেকে তাঁদের গবেষণার পিছনে তাঁদের সময়কার রাজনীতির দাবিটা সত্যিই অস্পষ্ট নয়।

প্রথমত, জয়সওয়াল আর মজুমদারের আগেও অনেক বড়ো বড়ো বিদ্বান প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে অনেক বড়ো বড়ো বই রচনা করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই বইগুলিতে গণ-এর তাৎপর্য-বিচারের চেষ্টা নেই বললেই চলে। জয়সওয়াল ও মজুমদারের রচনাই সর্বপ্রথম বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করলো, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে সম্যকভাবে বুঝতে হলে গণ-এর তাৎপর্য বিচার করবার প্রয়োজন আছে। এ-ঘটনা উল্লেখযোগ্য। কারণ, আগেই বলেছি, প্রাচীন পুঁথিপত্রে গণ-সংক্রান্ত যে-মালমশলা মজুত আছে তার পরিমাণ বড়ো কম নয়। তাই, আগেকার স্বনামধন্য ঐতিহাসিকদের পক্ষে সেগুলিকে উপেক্ষা করাও তুচ্ছ ঘটনা নয়। গণ-এর প্রতি তাঁদের নজর না পড়বার কারণ হলো তাঁদের পক্ষে গণকে বোঝবার তাদিগই ছিলো না। অথচ, গণ-এর প্রতি আলোচ্য ঐতিহাসিক দু’জনের দৃষ্টি পড়লো, কেননা, দৃষ্টি পড়বার স্পষ্ট তাগিদ ছিলো। তাগিদটি ঠিক কী রকম তা বোঝবার জন্যে আমাদের জাতীয়-সংগ্রামের ইতিহাসের একটি পর্যায়ের কথা মনে রাখতে হবে।

বই দুইটি রচনাকাল কী? অধ্যাপক জয়সওরালের বই প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৪-এ। কিন্তু লেখা কয়েক বছর আগেকার। প্রকাশিত হতে দেরি হবার অপ্রীতিকর কারণ লেখক ভূমিকায় ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাপক মজুমদারের বইটির রচনাকালও আনুমানিক একই রকম, ১৯১৯-এর কিছু আগে হবে।

এই সময়টা বরাবর ভারবর্ষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অবস্থাটা ভেবে দেখা যাক। জাতীয় কংগ্রেসের কণ্ঠে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯১৯-এর প্রস্তাবে(৯৯) ঘোষণা করা হলো, স্বায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে দেশে সাধারণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র চাই। অবশ্যই, এ-দাবির প্রতিষেধক হিসেবে ইংরেজ শাসকেরা পাইক-পেয়াদা থেকে অর্ডিন্যান্স-গোয়েন্দা পর্যন্ত কোনো অনুষ্ঠানেরই ত্রুটি করেননি।

কিন্তু তাছাড়াও দেশের জনমতকে ধোঁকা দেবার জন্যে দরকার ছিলো ইতিহাসের দোহাই। ও-তরফের পণ্ডিতেরা তাই আমাদের বারবার বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন যে, ভারতবর্ষে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথাই ওঠে না,—ভারতবর্ষের ঐতিহ্যে তার কোনো নজির নেই। বিদেশী শাসকদের মুখপাত্রেরা তাই প্রমাণ করছিলেন, সাধারণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিটা আমাদের পক্ষে নেহাতই বিজাতীয় উৎসাহের পরিচায়ক।

ফলে, জাতীয় আন্দোলনের তরফ থেকেও ঐতিহাসিক গবেষণা যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠবে তাতে বিস্ময়ের অবকাশ নেই। তাগিদ পড়লো দেশের অতীত খুঁড়ে পাল্টা নজির খুঁজে বের করবার। আর, এই কারণেই ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো উপেক্ষিত ও অবহেলিত গণগুলির দিকে। পাল্টা নজির হিসেবে ওই গণ-এর সাক্ষ্য সত্যিই দুর্মূল্য। কেননা, গণ বলতে আসলে যাই বোঝাক না কেন, এ-বিষয়ে এতোটুকুও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তা একরকমের সমাজসংগঠন এবং তার মধ্যে সাধারণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসনের আয়োজন সত্যিই ষোলো আনা।

বই-এর ভূমিকায়(১০০) অধ্যাপক জয়সওয়াল সানন্দে ঘোষণা করলেন, স্যর শঙ্কর নায়ার ভারতসরকারের কাছে গঠনতান্ত্রিক সংশোধনের প্রথম সুপারিশে (৫ই মার্চ, ১৯১৭) বইটির পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আর, বইটির রচনা-সময়েই লেখক যে গণতান্ত্রিক সংশোধন-বিষয়ে কতোখানি হুশিয়ার ছিলেন তা বইটির সূচীপত্রের উপর একবার চোখ বোলালেই বুঝতে পারা যায়। তাঁর ভারত-আবিষ্কার থেকে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রমূলক কোনো রকম খুঁটিনাটির হিসেবই বাদ পড়েনি : লোকসভার আসন, কোরাম, হুইপ, ভোট, অনুপস্থিতের ভোট, ব্যালট ভোট, সংখ্যা-গরিষ্ঠ সংক্রান্ত নীতি, প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি, ভোটের অধিকার, রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, নাগরিকের অধিকার,—এক কথায়, জাতীয় কংগ্রেস তখন যে-গঠনতন্ত্র চেয়েছে তার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি পর্যন্ত।

অধ্যাপক মজুমদারের বই-এর মূলেও এই রাজনৈতিক প্রেরণা স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। বইটি সম্বন্ধে স্বদেশী পত্রিকাগুলির প্রতিক্রিয়া থেকেই তা অনুমান করা যায়। অধ্যাপক মজুমদারের বইটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই মডার্ন রিভিউ(১০১) উচ্ছ্বাস করে বললো : ইতিহাসকে অস্বীকার করে যাঁরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, স্বায়ত্বশাসনে শুধুমাত্র পাশ্চাত্য জাতিদেরই একচেটিয়া অধিকার তাঁদের যুক্তিকে এ-বই একবারে নস্যাৎ করে দেবে। অমৃতবাজার পত্রিকা(১০২) সগর্বে ঘোষণা করলো : ফিরিঙ্গি ভায়ারা তো বারবার তর্ক তুলে বলেন যে, গণতান্ত্রিক পরীক্ষা ভারতবর্ষে চলবে না—এই বই তাঁদের একেবারে মুখের মতো জবাব হয়েছে।

ঐতিহাসিক আবিষ্কারের পিছনে সমসাময়িক রাজনীতির প্রেরণাটা এতোটুকুও অস্পষ্ট নয়।

আমাদের যুক্তি হলো, সেকাল সম্বন্ধে গবেষণায় প্রবৃত্ত হলেও একালের ঐতিহাসিক যেহেতু অনিবার্যভাবেই একালের আশা-আকাঙ্খার দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য সেই হেতু নৈর্ব্যক্তিক হবার একমাত্র পথ একালের ওই ধ্যানধারণাগুলিকে সচেতনভাবে সমালোচনা করবার প্রচেষ্টা। তাই, গণ-সংক্রান্ত আধুনিক ঐতিহাসিকদের গবেষণাকে গ্রহণ করবার আগে তাঁদের ওই রাজনৈতিক প্রেরণার সমালোচনা করা প্রয়োজন।

আমরা আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় জেনেছি, ওই রাজনীতির আসন অবদানই বা কোথায় আর সংকীর্ণতাই বা ঠিক কী। গণতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দাবিতে নিশ্চয়ই অগ্রগতির স্বাক্ষর ছিলো। অপরপক্ষে, জনসাধারণের মধ্যে সাম্যজীবনের চাহিদাকে উপেক্ষা করাই এ-রাজনীতির প্রকৃত সংকীর্ণতা। উক্ত রাজনীতির প্রেরণায় যে ঐতিহাসিক গবেষণা তার বেলাতেই একই কথা। ইংরেজ ও ফিরিঙ্গি যুক্তির বিরুদ্ধে দেশের ইতিহাস থেকে গনতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসনের ঐতিহ্যকে তুলে ধরবার চেষ্টা এঁদের গবেষণার প্রকৃত গৌরব। কিন্তু অন্যান্য সমস্ত দেশের মানুষের মতোই ভারতবর্ষের মানুষও যে এককালে আদিম সাম্য সমাজে বাস করেছে সে-বিষয়ে চেতনার অভাব এঁদের গবেষণার প্রকৃত সংকীর্ণতা। বস্তুত, আমরা বহু প্রমাণের সাহায্যে একটু পরেই দেখতে পাবো, গণ শব্দের আদি তাৎপর্য অভ্রান্তভাবেই ওই আদিম সাম্যসমাজ। অথচ, দেশের ঐতিহ্য সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নজির খোঁজবার প্রেরণায় উভয় ঐতিহাসিকই গণকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এঁদের প্রধান যুক্তি হলো, গণকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে মানতেই হবে, কেননা, গণ-এর মধ্যে গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ আয়োজন রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র গণতন্ত্রের লক্ষণ থেকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রমাণ হয় না। মর্গানের(১০৩) গবেষণার সাহায্য গ্রহণ করলে এঁরা অনায়াসেই দেখতে পেতেন, প্রাগ-বিভক্ত প্রাচীন সমাজে গণতন্ত্রের ষোলো আনা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রশক্তির পরিচয় নেই। ওই একান্ত গণতান্ত্রিক সাম্যসমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হয়েছে।

গণ বলতে প্রাচীনেরা সত্যিই যদি এ-হেন প্রাগ-বিভক্ত আদিম সাম্য সমাজ বুঝে থাকেন তাহলে জাতীয় কংগ্রেসের একটি নির্দিষ্ট দাবির মধ্যে ঐতিহাসিক গবেষণার প্রেরণাকে আবদ্ধ রেখে এই গণ-সমাজের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অধ্যাপক জয়সওয়াল ও অধ্যাপক মজুমদারের সিদ্ধান্ত তাই অনিবার্যভাবেই বিজ্ঞান-ভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত হয়েছে। গণ-এর অর্থবিচার এবং প্রাচীন সমাজে গণতন্ত্রের আয়োজন নিয়ে আলোচনা সুদীর্ঘ হবে। এখানে শুধু নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায় একটি নির্দিষ্ট রাজনীতির প্রেরণার ফলে অতো বড়ো বড়ো ঐতিহাসিকেরাও কী রকম কাল্পনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

মহাভারতের সভাপর্বে(১০৪) নকুলের দিগ্বিজয়-বর্ণনার এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, যুদ্ধে পৌরব ও পর্বতবাসী দস্যুদের পরাস্ত করবার পর উৎসব-সংকেত নামের সাতটি গণ তিনি জয় করলেন।

পৌরবং যুধি নির্জিত্য দস্যুন্‌ পর্বতবাসিনঃ।
গণানুৎসবসংকেতানজয়ৎ সপ্ত পাণ্ডবঃ।।

তাহলে এখানে সেকালের সাতটি গণ-এর কথা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলির সমবেত নাম হলো উৎসব-সংকেত। প্রশ্ন হলো, উৎসব-সংকেত মানে কী? টীকাকার নীলকণ্ঠ বলছেন:

উৎসবসংকেতানাং স্ত্রী-পুরুষয়োঃ পরস্পরপ্রীতিরেব রত্যর্থং সংকেতঃ। ন তু দাম্পত্যব্যবস্থা। পশুনামিব যত্রান্তীত্যর্থঃ।
অর্থাৎ, এই উৎসব-সংকেতের বেলায় স্ত্রী-পুরুষদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রীতিই হলো রতিসম্পর্কের সংকেত। এদের মধ্যে দাম্পত্যব্যবস্থা নেই। তাই, এদের যৌন-জীবন পশুদের মতোই নির্বিচার।

মনিয়ার উইলিয়ামস-এর অভিধান অনুসারে সংকেত কথার শব্দার্থ হলো এনগেজমেণ্ট। উৎসব শব্দটিকে আমরা আজকাল যে-অর্থে বুঝি এখানেও যদি সেই অর্থে গ্রহণ করবার অবকাশ থাকে তাহলে আধুনিক নৃতত্ত্ব-বিজ্ঞানের সঙ্গেও সামঞ্জস্য থাকে। কেননা, প্রাগ-বিভক্ত উপজাতি-সমাজে ‘উৎসবে’র সঙ্গেই ‘রত্যর্থং সংকেতঃ’ দেখা যায়। কিন্তু আপাতত সে-আলোচনা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেলো। তাহলেও এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, নীলকণ্ঠ দাম্পত্য-জীবন বলতে স্ত্রী-পুরুষের যে-সম্পর্ককে সমাজ সঙ্গত বলে মনে করতেন এই গণগুলির মধ্যে তার অভাব ছিলো। অবশ্যই, নীলকণ্ঠ যদি তাঁর সমসাময়িক নীতিবোধের তাড়নায় “পশুনামিব যত্রাস্তীত্যররথঃ” বলে গালাগাল না দিয়ে ওই প্রাগ-দাম্পত্য সম্পর্কের স্পষ্টতর বিবরণ দিতেন তাহলে এই গণগুলি প্রাগ-বিভক্ত সমাজের ঠিক কোন পর্যায়ে ছিলো তা মর্গানের গবেষণার আলোয় অনুমান হয়তো করা যেতো। কেননা, মর্গান দেখিয়েছেন, প্রাচীন প্রাগ-বিভক্ত সমাজে শুধুই যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রশক্তির অভাব তাই নয়, উত্তরকালের দাম্পত্য-ব্যবস্থারও অভাব আছে এবং অবশ্যই ওই প্রাগ-বিভক্ত সমাজেরও ইতিহাস আছে এবং সে-ইতিহাসের পর্যায়ভেদের সঙ্গে নরনারীর সম্পর্কেও প্রভেদ দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখানে অতো খুঁটিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছবার অবকাশ না থাকলেও এটুকু নিশ্চয়ই বলা চলে যে, উত্তরকালের সংজ্ঞা অনুসারে যা দাম্পত্য-ব্যবস্থা (অর্থাৎ, এক-বিবাহ বা মনোগ্যামী)  নীলকণ্ঠের বর্ণনা অনুসারে উৎসব-সংকেতের মধ্যে যেহেতু তার অভাব সেই হেতু এই গণগুলিকে প্রাগ-বিভক্ত সমাজের কোনো এক পর্যায় বলে না মেনে উপায় নেই।

কিন্তু অধ্যাপক জয়সওয়ালের পক্ষে এই মূল্যবান সূত্রটি অনুসরণ করবার কথাই ওঠে না। তার কারণ তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো প্রাচীন ভারতে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আবিষ্কার করা। তাই, তিনি বিনা দ্বিধায় লিখলেন(১০৫) :

The Utasaba-Sanketas were republicans, probably founded by two men Utasava and Sanketa. We may, however, point out that ‘sanketa’ is a technical term denoting an act or resolution passed by a republic and it is just possible that ‘sanketa’ here originally denoted a state founded by resolution of the Utasavas.
অর্থাৎ, উৎসব সংকেতগুলি প্রজাতান্ত্রিক ছিলো, খুব সম্ভব উৎসব ও সংকেত নামের দুই ব্যক্তি সেগুলির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কিন্তু এখানে বলে রাখা যায় যে, সংকেত একটি পারিভাষিক শব্দ, তার অর্থ হলো প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গৃহীত প্রস্তাব। এবং এও নিশ্চয়ই সম্ভব যে, সংকেত বলতে এখানে এমন এক রাষ্ট্র বোঝানো হয়েছে যা উৎসবদের গ্রহণ করা প্রস্তাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো।

অতো বড়ো একজন ঐতিহাসিকের রচনায় এ-রকম আবোল-তাবোল কথা পড়লে দুঃখিত হতে হয়। অথচ, সমসাময়িক কোনো আশা-আকাঙ্খাকে ঐতিহাসিক গবেষণার একমাত্র প্রেরণা বলে গ্রহণ করলে শেষ পর্যন্ত এ-ভাবে বিজ্ঞান ভ্রষ্ট ন হয়েই বা উপায় কী।

——————————–
৯৯.  R. P. Dutt IT 314.
১০০. K. P. Jayaswal HP 1:vi.
১০১. Modern Review : 1919, March.
১০২. Amrita Bazar Patrika : 1919, 20th E.
১০৩. H. L. Morgan AS 47-154.
১০৪. সভাপর্ব ২৭.১৬।
১০৫. K. P. Jayaswal HP 1:156.