গণেশের কথা কেন?
কিন্তু দেবতা তো এ-দেশে এক-আধটি নন। তাঁদের মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে অনুসরণ করা যাবে?
আগেই বলেছি, আমরা বিশেষ করে গণপতির পদানুসরণ করবো। কেননা, তাঁকে অনুসরণ করবার অনেক রকম সুবিধে আছে।
প্রথমত, এ-নির্বাচন আমাদের ঐতিহ্য-বিচ্যুত করবে না। দেশের ঐতিহ্য অনুসারে যে-কোনো পূজোর বেলাতি গণেশ পুজো পান সর্বপ্রথম। এই ঐতিহ্য অনুসারে গণেশ হলেন সিদ্ধিদাতা। সংকল্প যতো দুরহই হোক না কেন, তাঁকে অনুসরণ করলে সিদ্ধিলাভ সুনিশ্চিত হয়।
কিন্তু ঐতিহ্যের কথা ছাড়াও অন্য যুক্তি রয়েছে। আপনি যদি চণ্ডী বা মনসা বা ওই রকম আর কোনো দেবদেবীকে অনুসরণ করতে চান তাহলে শুরুতেই আপনার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে—কিন্তু বিঘ্ন-বিনাশক গণেশের বেলায় সে-বিঘ্নের ভয় নেই। কী রকম বিঘ্ন? মনসা প্রভৃতির বেলায় আধুনিক পণ্ডিতেরা বলবেন, এঁরা ছিলেন স্থানীয় অনার্যদের উপাস্য দেবদেবী। তাই, আগন্তুক আর্যদের মনে, কিংবা আভিজাতিক আর্য-ঐতিহ্যের বাহকদের পক্ষে, এঁদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধ থাকাই স্বাভাবিক। চাঁদসওদাগরের উপাখ্যানে তারই স্বাক্ষর রয়েছে(৮)। কিন্তু এ-প্রতিবন্ধ শুধুমাত্র ধর্মবোধপ্রসূত, আর্যদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অনার্যদের ধর্মবিশ্বাসের সংঘাত-কাহিনী। সে-কাহিনী থেকে ধর্মবিশ্বাসের সংঘাত অনুমান করা যেতে পারে, তার চেয়ে বেশি কিছুই নয়। গণপতির বেলায় কিন্তু এতো সহজ একটা সমাধান দেখিয়ে আমাদের প্রচেষ্টাকে নিরস্ত করা যাবে না। কেননা, গণপতি হলেন না আর্য না অনার্য, কিংবা, আর্য আর অনার্য দুই-ই। বাজসনেয়ী সংহিতায়(৯) তাঁর গান শোনা যায় : গণানাং ত্বাং গণপতি হবামহে! এমনকি, বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশে—ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে—তাঁর উল্লেখ আছে(১০)। আবার ভিলদের গ্রামেও তাঁকে দেখা যায়—চাষের আগে আবাদী জমির উপর একটি শিলাখণ্ডকে তারা গণেশ বলেই সম্বোধন করছে(১১)। গণেশ যে স্থানীয় অনার্যদের বিশ্বাস থেকে ঋগ্বেদ সংহিতায় বা বাজসনেয়ী সংহিতায় প্রবেশলাভ করেছিলেন, এমন কথা যদিও ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়(১২) প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন তবুও তাঁর যুক্তির জোর খুবই ক্ষীণ মনে হয়। অপরপক্ষে গণেশ যে সংহিতা সাহিত্য থেকে বেরিয়ে কোলভিলদের মন জয় করেছিলেন এ-ধরনের কথা প্রমাণ করা আরো দুঃসাধ্য হবে। তাই, অন্যান্য দেবদেবীর বেলায় আধুনিক পণ্ডিতেরা যে অতিসরল সমাধান দিতে পারবেন গণেশের বেলায় তা সম্ভব হবে না।
গণেশকে অনুসরণ করবার তৃতীয় সুবিধে হলো, আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে ইতিপূর্বে অনেকেই তাঁর ইতিহাস রচনা করবার চেষ্টা করেছেন। এ-বিষয়ে শ্রীযুক্ত হরিদাস মিত্র(১৩) ও শ্রীমতি অ্যালিস গেটীর(১৪) গবেষণা বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য। পূর্বসুরীদের এই জাতীয় গবেষণা আমাদের প্রচেষ্টাকে অপেক্ষকৃত সহজসাধ্য করতে পারে।
সুবিধের কথা ছাড়াও আমাদের পক্ষে গণেশের ইতিহাস অন্বেষণ করাই বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক। তারও নানান কারণ আছে। প্রথমত, আমাদের উদ্দেশ্য হলো লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস অনুসন্ধান করা এবং আমরা আগেই দেখেছি লোকায়তের সঙ্গে বামাচারের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। এবং ওই তেত্রিশকোটির মধ্যে গণেশই বোধ হয় একমাত্র দেবতা যাঁর সঙ্গে লোকায়ত ও বামাচার দু’-এর স্পষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। দেশের ঐতিহ্য অনুসারে লোকায়ত-দর্শনের আদি-গুরু হলেন বৃহস্পতি এবং ঋগ্বেদের মন্ত্র অনুসারে বৃহস্পতি ও গণপতিতে তফাত নেই(১৫)। অপরপক্ষে, এই গণেশই আবার তান্ত্রিক সাহিত্যের হেরম্ব—হেরম্ব ছাড়াও তন্ত্রে গণেশের আরো অনেক রকম নাম আছে। তাছাড়াও, শক্তি-গণপতির মূর্তি এবং আনন্দগিরির শঙ্কর বিজয়ে গাণপত্যসম্প্রদায়ের বর্ণনা গণেশকে একেবারে অভ্রান্তভাবেই বামাচারের সঙ্গে সংযুক্ত বলে প্রমাণ করে(১৬)। দ্বিতীয়ত, সমাজ-ইতিহাসের কথা বাদ দিয়ে দর্শনের ইতিহাস আলোচনা অসম্ভব। গণপতিকে অনুসরণ করেই প্রাচীনকালের সমাজ-ইতিহাসের দিকে অগ্রসর হওয়া সুবিধাজনক। কেননা, গণপতির কাহিনী আর গণের কাহিনী আলাদা নয়। এখানেও পূর্বসূরীদের প্রচেষ্টা আমাদের পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক হবে। কেননা, আধুনিক যুগের দু’জন বিখ্যাত ঐতিহাসিক,—অধ্যাপক কে. পি. জয়সওয়াল(১৭) ও অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার(১৮),—এই গণের কথাই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা একটি পরেই দেখবো, মার্কস যাকে বলেছেন ‘আইনগত অন্ধতা’ তারই দরুন এঁরা গণ সম্বন্ধে বহু তথ্য সংগ্রহ করেও শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান-বিচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু এঁদের সিদ্ধান্ত স্বীকারযোগ্য না হলেও এঁরা যে-সব তথ্য সঞ্চয় করেছেন তা মহামূল্যবান।
——————–
৮. A. Mitra CWB 1951—TCWB 7.
৯. বাজসনেয়ী সংহিতা ২৩.১৯।
১০. ঋগ্বেদ ২.২৩.১।
১১. W. Crooke RFNI 250.
১২. ক্ষিতিমোহন সেন : জাতিভেদ ৬৪।
১৩. H. Mitra in VQ 1931-32, 1935.
১৪. A. Getty G.
১৫. ঋগ্বেদ ২.২৩.১। cf. R. G. Bhandarkar VS 149.
১৬. এই গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদের “আয়ুধজীবীগণ ও বার্তাশস্ত্রোপজীবীগণ” অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১৭. K. P. Jayaswal HP.
১৮. R. C. Majumder CLAI.