প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৯. অথ কুকুরস-সম্বন্ধী সামগান

অথ কুকুরস-সম্বন্ধী সামগান

ছান্দোগ্য-উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের একাদশ খণ্ডে একটি অদ্ভুত, ও আপাতঃ- অর্থহীন, বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের ধারণায় এর অর্থনির্ণয় করা সম্ভব, কিন্তু তার জন্যে নতুন প্রদ্ধতির প্রয়োজন। সে-পদ্ধতির পরিচয় হিসেবে উপনিষদের এই অংশটুকুর উপর পদ্ধতিটির প্রয়োগ করবার চেষ্টা করা যাক। ছান্দ্যোগ্য লেখা আছে :

অতএব এখন কুকুর সম্বন্ধীয় সামগান (উদগীথ)। তখন বক দালত্য, ওরফে অতৃপ্ত (গ্লাব) মৈত্রেয়, স্বাধ্যায়ে (=বেদজ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে) বেরিয়েছিলেন।।১।১২।১।।
তাঁর কাছে শ্বেতবর্ণ কুকুর আবির্ভূত হলেন। অন্য কুকুরেরা তাঁর (=সেই শ্বেতবর্ণ কুকুরের) কাছে গিয়ে বললো, “ভগবান, আমাদের অন্নের জন্য গান করুন। আমরা ভোজন করতে চাই।।১।১২।২।।
সেই সাদা কুকুর অন্য কুকুরদের বললেন, “ভোর বেলায় এইখানে আমার কাছে সমাগত হয়ো।” বক দালভ্য, ওরফে অতৃপ্ত মৈত্রেয়, অপেক্ষা করে রইলেন।।১।১২।৩।।
বহিষ্পবমানের সাহায্যে স্তোষ্যমান অবস্থায় যেমন পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে সর্পিল গতিতে নড়াচড়া করা হয় (সর্পন্তি), তারা (=সেই কুকুরেরা) তেমনি গতিতে ঘুরলো (আসসৃপু)। তারপর তারা (=সেই কুকুরেরা) একত্রিত হলে ও হিং (হিংকার) করলো।।১।১২।৪।।
(তারা গান করতে লাগলো) “ওম, আমরা ভোজন করি। ওম্‌ আমরা পান করি। ওম্‌ দেবতা বরুণ, প্রজাপতি, সবিতা এইখানে অন্ন আহরণ করিতেছিলেন। হে অন্নপতি, এইখানে অন্ন আহরণ করো। ওম্‌।” ইতি।।১।১২।৫।।

শব্দার্থের দিক থেকে কয়েকটা কথা গোড়ায় বলে নেওয়া দরকার।

সামগানের পাঁচ ভাগে বা পাঁচ স্তরে ভাগ করা হয় : হিংকার, প্রস্তাব, উদগীথ, প্রতিহার ও নিধন। অধ্যাপক আর. ই. হিউমের(৪১) তর্জমা অনুসারে : হিংকার=preliminary vocalizing, প্রস্তাব=introductory praise, উদগীথ=loud chant, প্রতিহার=response, নিধন=conclusion।

বহিষ্পবমান স্তোত্র। প্রথমত, স্তোত্র : “যাহা গান করা যায় তাহার নাম স্তোত্র।”(৪২) দ্বিতীয়ত, বহিষ্পবমান : যজ্ঞবিশেষে ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের একাদশ সূক্তটি গান করবার সময়, পাঁচজন ঋত্বিক (অধ্বষ্যু, প্রস্তোতা, প্রতিহর্তা, উদগাতা ও ব্রহ্মা) ও তারপরে যজমান হাত ধরাধরি করে চত্তাল অভিমুখে প্রসর্পণ করেন, সকলে উপবেশন করলে পর হোতা তাঁদের অনুমন্তন করেন।

স্বাধ্যায়। এ-কথার চলতি মানে হলো প্রাথমিক বেদজ্ঞান। সু+আ=অধ্যায়ম্‌। কিন্তু অন্য ভাবেও এই শব্দ নিষ্পন্ন হতে পারে : স্ব+অধ্যায়ম্‌, অর্থাৎ, নিজে নিজে অধ্যয়ন।

বক দালভ্য, ওরফে, গ্লাব মৈত্রেয়। বক মানে বক, যদিও কিনা মানুষের নাম যে কি করে বক হতে পারে এ-নিয়ে আধুনিক পণ্ডিতেরা কিছুটা মুস্কিলে পড়েছেন। তাই, তর্জমা করবার সময় মক্ষমুলার(৪৩) করছেন Vaka, “বাক”। অধ্যাপক হিউম(৪৪) করছেন Baka। কিন্তু যাঁরা উপনিষদ লিখেছিলেন তাঁরা Vakaও লেখেন নি, Bakaও লেখেন নি; শুধু “বক”ই লিখেছেন। দালভ্য : এ-নামটার শব্দার্থ যাই হোক না কেন, মহৎ পাণ্ডিত্যের সঙ্গে এর যোগাযোগ আছে। কেননা, ছান্দোগ্য-উপনিষদেই(৪৫) একটু আগে লেখা হয়েছে : মাত্র তিনজন উদগীথ-বিদ্যায় কুশল ছিলেন—শালাবত্য শিলক, দালভ্য চৈকিতায়ন এবং প্রবাহন জৈবলি। অবশ্যই, দালব্য বক এবং দালব্য চৈকিতায়ন—দু’-এর মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিলো কিনা সে-কথা উপনিষদে লেখা নেই। কিন্তু, তাহলেও, বক দালভ্যও খুব কম পণ্ডিত ছিলেন না। ছান্দোগ্য-উপনিষদের অন্যত্র সে-কথা লেখা আছে(৪৬)। গ্লাব মানে অতৃপ্ত—এই মানেটাই মনে রাখা ভালো। অতৃপ্ত বলেই তিনি স্বাধ্যায়ে বেরিয়েছিলেন।

 

এইবার শব্দার্থের কথা ছেড়ে পুরো বর্ণনাটুকুর তাৎপর্য সন্ধান করা যাক। মনে রাখবেন, এটি হলো ছান্দোগ্য-উপনিষদের প্রথম অধ্যাএর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খণ্ড এবং উপনিষদে এই পরমাশ্চর্য দৃশ্যটির কথা যেমনি খাপছাড়া ভাবে অবতারণা করা হলো তেমনি খাপছাড়া ভাবেই তা শেষ হয়ে গেলো।

কুকুরদের কথা হঠাৎ উঠলো, হঠাৎ শেষ হলো—সারা উপনিষদটিতে তাদের আর কোথাও খুঁজে পাবেন না! ব্যাপারটা কী? উপনিষদের আধুনিক টীকাকারেরা বলছেন, পুরো ব্যাপারটাই হলো প্রকাণ্ড পরিহাস। কাদের সম্বন্ধে পরিহাস? যজ্ঞের পুরোহিতদের সম্বন্ধে। পরিহাস কেন? কেননা, এঁরা ধর্মের নামে পানাহারে প্রমত্ত হয়ে উঠেছিলেন। বস্তুত, আধুনিক পণ্ডিতদের কাছে একটি প্রিয় মতবাদ হলো, বৈদিক যুগের পর দেশে যখন ব্রাহ্মণ-পুরোহিতেরা ক্রিয়াকাণ্ড নিয়ে প্রচণ্ড মাতামাতি করছেন তখনই উপনিষদের ঋষিরা তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তোলেন(৪৭)। তাঁরা যজ্ঞীয় ক্রিয়াকর্মের নিন্দা করে ব্রহ্মজ্ঞানকেই পরম পুরুষার্থ বলে ঘোষণা করতে চাইলেন। ফলে, যজ্ঞীয় ক্রিয়াকর্মকে বিদ্রুপ করাই তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক।

আধুনিক কালে পণ্ডিত মহলে এই মতবাদটির জনপ্রিয়তা যতোই হোক না কেন, উপনিষদকে এই ভাবে বুঝতে যাওয়া সত্যিই চলে কিনা সে-বিষয়ে অজস্র প্রশ্ন ওঠে(৪৮)। আপাতত আমাদের পক্ষে সে-সব প্রশ্নের আলোচনায় প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তার বদলে উপনিষদের আলোচ্য অংশটিকেই খুঁচিয়ে বিচার করবার চেষ্টা করা যাক।

আধুনিক পণ্ডিতদের মতবাদের নমুনা হিসেবে এই অংশ উপলক্ষেই স্যর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ কী লিখেছেন দেখুন :

There are occasions when the sacrificial and priestly religion strikes them as superficial, and then they give vent to all their irony. They describe a procession of dogs to march like a procession of priests each holding the tail of the other in front and saying, “Om! Let us eat. Om, let us drink…”(৪৯) etc.
অর্থাৎ, তাঁদের কাছে মাঝে মাঝে যজ্ঞমূলক ব্রাহ্মণ্যধর্ম নেহাৎ বাহ্য ব্যাপার বলে মনে হয়েছে এবং তখন তাঁরা তাঁদের সবটুকু বিদ্রুপ উজোড় করে দিয়েছেন। পুরোহিতদের মিছিলকে তাঁরা একদল কুকুরের মিছিলের মতো বর্ণনা করেছেন,–ওই কুকুরদের প্রত্যেকেই সামনের কুকুরের লেজ কামড়ে ধরেছে আর বলছে : “ওম্‌ আমরা ভোজন করি। ওম্‌ আমরা পান করি”। ইত্যাদি

স্যর সর্বপল্লি ছাড়াও আধুনিক যুগের প্রায় সমস্ত পণ্ডিতই(৫০) একবাক্যে বলছেন : ছান্দোগ্যের এ-অংশ পুরোহিত-শ্রেণীর ক্রিয়াকাণ্ড নিয়ে বিদ্রুপ না হয়ে যায় না!

কিন্তু প্রশ্ন হলো, উপনিষদের মানে করবার সময় উপনিষদে যা লেখা আছে শুধুমাত্র তার উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে হবে, না, অজস্র আধুনিক কল্পনাকে উপনিষদের উপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে? ওঁরা বলছেন, বিদ্রুপ। কিন্তু বিদ্রুপের ছিটে-ফোঁটাও কি আপনি উপনিষদে যা লেখা আছে তার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন? উদ্ধৃত অংশটিকে ভালো করে পরীক্ষা করুন; দেখবেন, বিদ্রুপ তো দূরের কথা লেখকের কাছে পুরো অংশটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক। মনে রাখবেন, দালভ্য একজন প্রকাণ্ড পণ্ডিত লোক এবং তিনি অতৃপ্ত হয়ে জ্ঞানান্বেষণে বেরিয়েছিলেন। আর তাঁকে বেদজ্ঞান দেবার প্রসঙ্গেই পুরো দৃশ্যটির অবতারণা করা হয়েছে।

বিদ্রুপ তো আর বললেই হলো না।

ওঁরা বলবেন, তা কেন? বিদ্রুপ না হলে যারা বহিষ্পবমান স্তোত্রের মতো করে গান গাইছে তাদের কুকুর বলে বর্ণনা করা হবে কী করে? উপনিষদে লেখা আছে : কুকুর। সে-বিষয়ে তো আর সন্দেহ নেই! আর, আমি-আপনি যদি কাউকে কুকুর বলি তাহলে নিশ্চয়ই খুব খাতির দেখাবার উদ্দেশ্যে বলি না!

————–
৪১. R. E. Hume TPU 191
৪২. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) ১৩৮।
৪৩. SBE. 1:21.
৪৪. R. E. Hume op. cit. 188.
৪৫. ছান্দোগ্য উপনিষদ : ১.৮.১।
৪৬. ঐ : ১.২.১৩।
৪৭. S. Radhakrishnan IP 1:149.