প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩৪. তান্ত্রিক ধ্যানধারণার অন্যান্য কয়েকটি দিক : খপুষ্প ও পঞ্চমকার

তান্ত্রিক ধ্যানধারণার অন্যান্য কয়েকটি দিক : খপুষ্প ও পঞ্চমকার

আমাদের যুক্তি অনুসারে, আদিম পর্যায়ের কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করেই তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার আদিতাৎপর্য অনুমান করা সম্ভব হতে পারে।। আমাদের এই যুক্তিটির পক্ষে এখানে আরো কিছু কিছু নজির দেখাবার চেষ্টা করা যাক।

আদিম পর্যায়ের কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে ঋতুরজের জাদুবিশ্বাসগত তাৎপর্য প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে অধ্যাপক জর্জ টমসনের মন্তব্য মুদীর্থভাবে উদ্ধৃত করেছি (পৃ. ৩৩৬–৩৯)। অর্ধ-অসহায় অবস্থার ওই মানুষের প্রজননরহস্যকে যেটুকু বুঝতে পেরেছিলো সেই বোধ অনুসারে মানবীর ঋতুরজই এর মূল উপকরণ। এবং এই পর্যায়ের মানুষ জাদুবিশ্বাসের দিক থেকে যেহেতু মানবীয় ফলপ্রসূতার অন্থকরণের সাহায্যে বা সংস্পর্শের সাহায্যে, প্রকৃতির ফল-প্রসূতাকেও আয়ত্তে আনবার কল্পনা করেছে সেইহেতু তাদের ধারণায় ঋতুরঙ্গ—বা সিন্দুর প্রভৃতি ঋতুরজের নকলগুলির,—গুরুত্ব অত্যন্ত অসামান্য।

তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার মধ্যে যদি ওই প্রাকৃত পর্যায়ের কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের স্বাক্ষর টিকে থাকে তাহলে তান্ত্রিক সাধনাতেও ঋতুরজের গুরুত্ব থাকাই স্বাভাবিক। এবং তা আছেও। তন্ত্র অনুসারে ঋতুরজের গুরুত্ব যে কতোখানি তা নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি(৫৬১) থেকেই অনুমান করা যাবে :

ক্রমসংকেত খপুপ, স্বয়ম্ভুকুমম, কুণ্ডোম্ভব, গোলোদ্ভব, বজ্ৰপুপ, উল্লাস, প্রৌঢ়, ইত্যাদি—তন্ত্রে ঐ সকল তাত্রিক শব্দের অর্থ নির্ণীত হইয়াছে। আবার অনেক সাংকেতিক শব্দের অর্থ অভিষিক্ত গুরুর নিকট ভিন্ন আর কোনো প্রকারে জানা যায় না।

স্বয়ম্ভুকুমুম—প্রথম ঋতুমতীর রজঃ। যথা—
হরসম্পর্কহীনায়াঃ লতায়াঃ কামমন্দিরে।
জাতং কুসুমমাদেী যন্মহাদেব্যৈ নিবেদয়েৎ॥
স্বয়ম্ভুকুমমং দেবি রক্তচন্দনসংজ্ঞিতম্।
তথা ত্রিশূলপুপঞ্চ বজ্রপুষ্পং বরাননে॥
অমুকুলং লোহিতাক্ষচন্দনং হরবল্লভং। (মূণ্ডমালাতন্ত্র ২ প)

হর, অর্থাৎ পুরুষের সংশ্রব ব্যতিরেকে লতা অর্থাৎ স্ত্রীলোকের যোনি হইতে যে কুসুম অর্থাৎ রজঃ হয়, তাহাকেই স্বয়ম্ভুকুসুম বা রক্তচন্দন বলা যায়। ইহার অভাবে ত্রিশূলপুষ্প ও বজ্ৰপুষ্প (চণ্ডালীর রজঃ) মহাদেবীকে নিবেদন করিবে। ইহার অনুকল্প শিবপ্রিয় লোহিতাক্ষ চন্দন।

কুণ্ডলোম্ভব—অথবা সধবা স্ত্রীলোকের রজঃ। যথা—
জীবদ্ভর্তৃকনারীণাং পঙ্কমঞ্চেব কারয়েৎ ।
তস্যা ভগস্য যদ্দ্র ব্যং তৎকুণ্ডোদ্ভবমুচ্যত ।৷ (সময়াচারতন্ত্র ২য় প)

গোলোম্ভব, অর্থাৎ বিধবা স্ত্রীলোকের রজঃ। যথা—
মৃতভর্তৃকনারীণাং পঙ্কমঞ্চেব কারয়েৎ।
তস্যা ভগস্য যদ্‌দ্ৰব্যং তদ্গেলোদ্ভবমুচ্যতে।।
ইত্যাদি ইত্যাদি।

তান্ত্রিক ধ্যানধারণা অনুসারে মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সম্পর্কটি ওই তান্ত্রিক পরিভাষা থেকেও অনুমান করা যেতে পারে। তান্ত্রিক পরিভাষায়, নারী জননাঙ্গের নাম লতা : নারী জননাঙ্গ থেকেই সন্তানের আবির্ভাব হয়, প্রকৃতিতেও লতায় ফল ফলে। কিন্তু সন্তানজন্মের আগে ঋতুরজঃ, ফলের আগে ফুল। তন্ত্রেও তাই ঋতুরজঃকে কুসুম, পুষ্প ইত্যাদি পরিভাষা দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে।

বলাই বাহুল্য, কুসুম বা পুষ্পের মতো কাব্যিক নাম সত্ত্বেও তন্ত্রের ওই কথাবার্তাগুলি আমাদের আধুনিক রুচিকে অত্যন্ত কঠোরভাবে পীড়িত করে। তার কারণ কি সত্যই এই যে, আমরা আজকের দিনে ঋতুরজের বৈজ্ঞানিক তাৎপর্যকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিনতে শিখেছি এবং অতএব তন্ত্রের ওই কল্পনা আমাদের কাছে কুসংস্কার মাত্র? এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, আমাদের আধুনিক জ্ঞানের কাছে তন্ত্রের ওই কল্পনা অন্ধ কুসংস্কারের আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে খপুষ্পাদি প্রসঙ্গে আমাদের রুচি যে এইভাবে পীড়িত হয় তার প্রকৃত কারণ আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়—তার বদলে আমাদের মনের একটি নতুন কুসংস্কার। আমরা লালিত হয়েছি পুরুষ-প্রধান সমাজে, আমাদের রুচি ও সংস্কারের উপর তাই পুরুষ-প্রধান সমাজের অনিবার্য স্বাক্ষর। ফলে, আমাদের পক্ষে ঋতুরজকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে মানবদেহজাত অন্যান্য রক্তের সমতুল্য বলে গ্রহণ করতে পারা সম্ভব নয়। মাতৃপ্রধান সমাজে এই রক্তের প্রতি যে-কুসংস্কার ছিলো পিতৃপ্রধান সমাজে তারই বিপরীত কুসংস্কার আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করতে চায়; মাতৃপ্রধান পরিবেশে মাতৃত্বের মূল উপাদান হিসেবে মানুষ যাকে পবিত্রতম মনে করেছে পিতৃপ্রধান পরিবেশে তাই এক রকম ঘৃণিত, অপবিত্র ও অশুচিসূচক বস্তু। এও নিশ্চয়ই বস্তুনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিক চিন্তার পরিচয় নয়, এক রকমের কুসংস্কারই। তবে, তান্ত্রিক কুসংস্কারের ঠিক উল্টো।

এখানে ভারতীয় ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, অসমান উন্নতির ফলে আমাদের দেশের স্থান-বিশেষে সমাজ-বিকাশের ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়টি এখনো বিলুপ্ত হয়নি। দৃষ্টান্ত হিসেবে আসাম অঞ্চলের (বিশেষত খাসি আর গারোদের) কথা উল্লেখ করা যায়; সে-অঞ্চলে মেয়েরা নাকি জাদু জানে, পুরুষদের ভেড়া করে রাখে। আবার সে-অঞ্চলেরই প্রধান তীর্থ কামরূপ-কামাখ্যা হলো যোনিপীঠ। অম্বুবাচীর দিন দেবী রজঃস্বল হন—ওই দিনটিই এ-অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। শুধু তাই নয়। এই স্তরের মানবচেতনায় জাদুবিশ্বাসের দাবি অনুসারে মানবীর (এবং অতএব দেবীর) দেহভাণ্ডের উপমা দিয়েই ব্ৰহ্মাণ্ডকে বোঝবার চেষ্টা; তাই কল্পনা করা হয় এই দিনটিতে পৃথিবীও রজঃস্বলা হন : সামনে ফসলের সময় এসেছে, ফসলের জন্ম দিতে হলে মানবীর অনুকরণে পৃথিবীকেও রজঃস্বল হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত ও খর্ব হয়ে থাকবার দরুন এই অর্থনৈতিক বিকাশের উপর প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক খিলানটির গায়েও দীর্ঘস্থায়ী কারুকার্যের মতো ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের চিন্তা-চেতনার বহু স্মারক অত্যন্ত প্রকটভাবে টিকে থেকেছে। অবশ্যই, এইভাবে টিকে থাকতে গিয়ে সেগুলির একজাতীয় রূপান্তর ঘটতে বাধ্য : এককালে যে-চেতনা ছিলো জীবন-সংগ্রামের উপায়, সে-চেতনা জীবন-সংগ্রামের বাস্তব পটভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে জীবন-সংগ্রামের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থহীন ও বীভৎস ধর্মমোহের রূপ গ্রহণ করেছে। ধর্মমোহের প্রকৃতিই ওই রকম, তার মধ্যে অতীতকে খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম তাৎপর্যপূর্ণ অতীত হিসেবে নয়, বিপরীতে পর্যবসিত অতীত হিসেবে। অতীতের যে-জাদু-অনুষ্ঠান ছিলো জীবন-সংগ্রামের উপায়, ধর্মমোহ হিসেবে তাই হয়ে দাঁড়ায় জীবন-সংগ্রামের অন্তরায়। কাল্পনিক হলেও আদিম জাদুবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত মানুষের ধ্যানধারণাগুলি কীভাবে তাকে জীবন-সংগ্রামের ব্যাপারে মানসিক উদ্দীপনা যুগিয়েছে তার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করেছি; ধর্মমোহের অঙ্গ হিসেবে আজকের দিনে এই আদিম বিশ্বাসের স্মারকই কী রকম অর্থহীন বীভৎসতায় পরিণত হয়েছে তার কিছু নমুনা দেখা যাক।

ত্রিবাঙ্কুরের মন্দিরে একটি প্রধান অনুষ্ঠানের নাম ত্রিপ্লুখারত্তু(৫৬২)। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে দেবী বছরে আট-দশবার রজঃস্বলা হন, সেই উপলক্ষ্যেই উক্ত অনুষ্ঠান। দেবীর অঙ্গবন্ত্র তখন নাকি রক্তের দাগে লাল হয়ে যায়, এই বস্ত্রের একটু টুকরো পাবার জন্যে জনসাধারণের মধ্যে কাড়াকড়ি পড়ে যায়। অন্যত্র(৫৬৩) দেবী পাৰ্বতীর অনুরূপ অবস্থা কল্পনা করে একই রকমের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায়। এই বিশ্বাসই আধুনিক সমাজে কতো চূড়ান্ত কামবিকারে পরিণত হতে পারে তার একটি নমুনা হলো বাংলাদেশের গৌরীগরণ : “…এই অনুষ্ঠানের রক্তে নিষিক্ত ন্যাকড়া ‘সিদ্ধবস্ত্র’ রূপে সমাজে চলে—রোগ-বিনাশ, শক্র-নিপাত, মামলা-জয়, পরীক্ষা-পাস ইত্যাদি ব্যাপারে বিশেষ ফলপ্ৰদ বিশ্বাসে অনেকে তা সংগ্রহ করে রাখেন, মাদুলীতে ধারণও করেন। কিন্তু জিনিসটা কী তা হয়তো অনেকেই জানেন না।” (৫৬৪)

 

তন্ত্রের পঞ্চমকার সম্বন্ধে একই কথা। কুলার্ণব-তন্ত্র(৫৬৫) বলছে :

মদ্যং মাংসঞ্চ মৎস্যঞ্চ মুদ্রামৈথুনমেবচ।
মকারপঞ্চকং দেবি দেবতাপ্রতিকারকম্।।

—মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পাঁচটি বস্তুর নামের আদিতে ম’ অক্ষরটি থাকায় ইহাদের সংক্ষিপ্ত নাম মকার …

মকারপঞ্চকং দেবি দেবানামপি দুর্লভং।
মদ্যৈর্মাংসৈস্তথা মৎস্যৈর্মুদ্রাভির্মৈখুনৈরপি।।
স্ত্রীভিঃ সার্দ্ধং মহাসাধুরর্চ্চয়েৎ জগদম্বিকা।
অন্যথা চ মহানিন্দা গীয়তে খণ্ডিতৈঃ সুরৈ॥

পঞ্চমকার তন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। পঞ্চমকার ব্যতীত তান্ত্রিকের কোনো কার্যেই অধিকার নাই। পঞ্চমকার দেবতাদিগেরও দুর্লভ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চমকার দ্বারা জগদম্বিকাকে পূজা করিতে হয়।

কিংবা(৫৬৬),

পঞ্চমেন বিনা দেবি চণ্ডিমন্ত্ৰং কথং জপেৎ।
—পঞ্চমকার ব্যতীত চণ্ডিমন্ত্র কেমন করিয়া জপ হইতে পারে?

ইত্যাদি ইত্যাদি। বস্তুত এ-সব কথা এমন কিছু নতুন কথা নয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরই পরিচয় আছে তিনি জানেন যে, পঞ্চমকার ছাড়া তন্ত্র সাধনা হয় না। এবং আজকের দিনে আমাদের উন্নততর ও মার্জিত রুচির কাছে এই পঞ্চমকার যে কী উৎকট বীভৎসতার রূপ গ্রহণ করেছে তাও আধুনিক বিদ্বানদের অনেকের রচনাতেই স্বীকৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করে পঞ্চমকারের বীভৎসতাকে ঢাকবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যাখ্যাগুলি যে নেহাতই কৃত্রিম তার একটা প্রমাণ হলো এ-জাতীয় ব্যাখ্যায় সাধারণত চূড়ান্ত মন্তব্য হিসেবে বলা হয়, পঞ্চমকারের তাৎপর্য অতি গৃঢ়, সাধারণের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কিনা, ওই আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আধুনিক বিদ্বানদের কাছে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার নগ্নতা-নিবারণের উপায়মাত্র :

যাহারা শাস্ত্রের মর্মার্থ বুঝিতে পারেন না, তাহারাই পঞ্চমকারের নামে নানা দোষারোপ করেন।…গুরূপদেশ ব্যতীত এই সকল বিষয়ে কোনো আলোচনা চলিতে পারে না। অসি ধারার উপর দিয়া চলা, বাঘের সহিত গলাগলি করা এবং বিষধর সাপ লইয়া খেলা করা অপেক্ষাও কুলসাধন কঠিন ব্যাপার। কৌল সাধকগণ এই আচারকেও বেদবাহ্য বলিয়া স্বীকার করেন না। একমাত্র জিতেন্দ্রিয় পুরুষই এই সকল আচারে অধিকারী। অসংযত ব্যক্তির পক্ষে পঞ্চতত্বের সাধনা বিশেষ দুঃখের এবং পতনের কারণ হইয়া থাকে।(৫৬৭)

ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের মন্তব্য হলো, এইভাবে আধুনিক রুচি ও আধুনিক নীতিবোধ দিয়ে পঞ্চমকারের নগ্নতা-নিবারণ করবার বা পঞ্চমকারকে সমর্থন করবার চেষ্টাটা সম্পূর্ণ নিরর্থক। কেননা, আমাদের আধুনিক জীবনের পটভূমিতে এই পঞ্চমকার নিশ্চয়ই অর্থহীন বীভৎসতা মাত্র। কিন্তু সেই সঙ্গেই আমাদের যুক্তি হলে, এই বীভৎসতাই পঞ্চমকারের আদি-তাৎপর্য হতে পারে না। কেননা তাহলে, পঞ্চমকার-প্রাণ এই তান্ত্রিক সাধনা এতো বড়ো একটা দেশকে এতো শতাব্দী ধরে এমন গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারতো না।

তাহলে সমস্যা ওঠে : সেই আদি-তাৎপর্যের অনুসন্ধান কেমন করে সম্ভবপর হবে? আমাদের পদ্ধতি অনুসারে, তার জন্যে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে আজো যে-সব মানবদল পিছিয়ে-পড়া দশায় আটকে রয়েছে তাদের বিশ্বাস আর অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

পঞ্চমকারের মধ্যে আমরা বিশেষ করে মদ্য ও মৈথুন—এই দুটির আলোচনা তুলবো। কেননা, এই দুটি নিয়েই সন্দেহ জাগে সবচেয়ে বেশি। আধুনিক বিদ্বান(৫৬৮) – যেমন বলছেন :

বৈধ মাংস, মাছ এবং মুদ্রা সম্বন্ধে কোনো কথা উঠে না, কিন্তু মদ্য ও মৈথুন এই দুটিই সাধনার অঙ্গরূপে কীভাবে গৃহীত হইতে পারে—এই সন্দেহ জাগে।

অথচ তন্ত্র(৫৬৯) বলছে, মদ্যপান বিনা সাধনা সম্ভব নয় :

বিনা মদ্যং মহেশানি ন সিদ্ধন্তি কদাচন।
তস্মাদাদৌ প্রযত্নেন পীত্বা তাং পায়য়েদ্বুধঃ।।
কিন্তু ইহাতে মদ্য বিনা কখনই সিদ্ধি হইতে পারে না। সেই জন্য পুর্বে যত্নপূর্বক স্বয়ং মদ্যপান করিয়া এবং তাহাকে পান করাইয়া জপ করিবে।

প্রশ্ন হলো, মানব-উন্নতির কোন স্তরের চেতনা আজো আমাদের দেশে এইভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাসনা হিসেবে টিকে রয়েছে?

পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে মদ্যপানের দৃষ্টান্ত যথেষ্টই দেখতে পাওয়া যায়। এই মদ্যপান যে আধুনিক অর্থে এবং আধুনিক উদ্দেশ্যে মদ্যপান নয় তার প্রমাণ হলো, প্রাচীন সমাজে মদ্যপানের অনুষ্ঠান-গত গুরুত্ব রয়েছে। আমরা এখানে বিশেষ করে দুটি অনুষ্ঠানের উল্লেখ করবো। কেননা এই দুটি অনুষ্ঠান থেকেই প্রাচীন মানুষদের মদ্য সংক্রান্ত ধ্যানধারণার তাৎপর্য অনুমান করবার সুযোগ হতে পারে।

একটি অনুষ্ঠান মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হবার কামনায়। আর একটি অনুষ্ঠান নবজাতককে লাভ করবার কামনায়। তাই এই দুটি অনুষ্ঠানকে পরীক্ষা করলে অনুমান করা যেতে পারে যে, আদিম মামুষের চেতনায় মদ্যও রক্তের মতোই জীবন ও জন্মের একটি মূল উপাদান বা অন্তত প্রধান সহায়ক। তাই নবজন্মের কামনা—তা সে মানবীয়ই হোক আর প্রাকৃতিকই হোক— যেহেতু তান্ত্রিক সাধনার আদি তাৎপর্য, সেইহেতু মদ্যপান বিনা তান্ত্রিক সাধনাকে প্রাচীনের অসম্ভব মনে করেছিলেন।

প্রথমত, প্রাচীন সমাজের এই দু’রকম অনুষ্ঠানকে পরীক্ষা করা যাক। মৃত্যুকে অতিক্রম করবার কামনায় মন্ত্রের ব্যবহার আধুনিক গবেষকদের কাছে অপরিচিত নয় :

The Irish wake is a familiar example of the practice of drinking to celebrate death. In West Africa the Tshi people drink heavily during the fast which follows a death, and the mourners are generally intoxicated. The same is the case among the Yorubas. But it is chiefly after the funeral that drinking is the rule of the feast.
At funerals among the Woolwa Indians there is much drinking of mishla. A long line of cotton is stretched, like a telegraph wire, from the house of the dead, where the drinking takes place, to the burial ground where the body has been deposited. ‘I have seen the white thread following the course of the river for many miles, crossing and recrossing the stream several times’. As soon as a Bangala man dies, the family gets in a large supply of sugar-cane wine. Dancing and drinking are carried on for three or four days and nights, or until the wine is finished. The Guiana Indians drink and dance at the funeral feast.
Among the Tshinyai of the Zambesi the native beer, pombe, plays a considerable part in post-funeral rites. For the ceremony of Bona, a large quantity is prepared. Holes are bored above the grave and pombe is poured in. In one hole, in front of the house where the grave is, the mourners wash their hands with pombe. As the procession retires, a widow of the deceased (she is called musimo, the spirit) her head covered with calico, constantly calls out for pombe, which she drinks beneath the covering. At the house of the head widow, a large hole is dug and well-cemented. This is filled with pombe, and every one lies down and drinks it without help of spoon or vessel. A feast follows consisting of pombe and meat(৫৭০).
মৃত্যু-উৎসবে মদ্যপান-ব্যবহারের একটি স্বপরিচিত দৃষ্টান্ত হলো আইরিসদের শব-সংকার। দক্ষিণ আফ্রিকায় টুশিরা কারুর মৃত্যু ঘটলে পর উপবাস দেয়, সেই উপবাসের সময় তারা অত্যন্ত বেশি মদ্যপান করে, শোকার্তরা সাধারণত মাতাল হয়ে যায়। ইয়োরুবাদের মধ্যেও একই ব্যাপার চোখে পড়ে। কিন্তু সাধারণত নিয়ম হলো, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর জ্ঞাতিভোজনের সময় মদ্যপান করা হবে।
উলওয়াদের মধ্যে দেখা যায়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় প্রচুর মদ্যপান করবার প্রথা আছে। সেই মদ্যের নাম মিশলা। মৃতের বাড়িতে মদ্যপান করা হয়, সেখান থেকে কবরখানা পর্যন্ত টেলিগ্রাফের তারের মতো সুতো টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ‘মাইলের পর মাইল ধরে নদীর কিনারা দিয়ে এবং নদীকে বারবার ডিঙিয়ে এই সুতো খাটানো হতে আমি দেখেছি’। বগলদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের লোকের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর পরিমাণ আখের মদ সংগ্রহ করে; তারপর তিনচার দিন ধরে, কিংবা যতোক্ষণ না মদটা শেষ হচ্ছে, সারা রাত তাদের নাচ এবং মদ্যপান চলে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিমন্ত্রণে গিআনারা মদ্যপান করে এবং নাচে।
জাম্বেলির তিসিন্নাইদের পচাই মদের নাম পম্‌বি; অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের অনুষ্ঠানে এই মদের ব্যবহার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘বোনা’ অনুষ্ঠানের জন্যে বিস্তর মদ তৈরি করা হয় এবং কবরের গর্ত খুঁড়ে পম্‌বি ঢালা হয়। বাড়ির সামনে কবরখানার উপরের একটি ওইরকম গর্তের গায়ে শোকতপ্তরা পম্‌বি দিয়ে হাত ধোয়। মিছিলটির ফিরতি পথে মৃতের এক বিধবা পত্নীকে সাদা কাপড়ের ঘোমটা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়; ঘোমটার মধ্যে থেকে সে একটানা পম্‌বি চাইতে থাকে এবং প্রভূত পরিমাণে তা পান করে। প্রধান বিধবার বাড়িতে একটা বড় গর্ত করা হয় এবং সেটা ভালো করে লেপন করে তার মধ্যে পম্‌বি ঢেলে ভরতি করা হয়। সকলে গুয়ে পড়ে সেই গর্তের ভিতর থেকে চামচ বা মগের সাহায্য ছাড়াই পম্‌বি পান করতে থাকে। তারপর মাংস ও পম্‌বির ভোজ হয়।

আমাদের দেশে তথাকথিত নিচুশ্রেণীর মানুষদের মধ্যেও এই জাতীয় প্রথা দুর্লভ নয়। যেমন, মেথর ধোপা প্রভৃতির মধ্যে দেখা যায়, আত্মীয়বিয়োগ ঘটলে তারা তাড়ি বা ওই জাতীয় কোনো মদ প্রচুর পরিমাণে পান করে থাকে। সমাজের সদর মহলের মানুষ নয় বলেই এদের আচারঅনুষ্ঠানের মধ্যে সমাজ-বিকাশের পিছনকার পর্যায়ের অনেক কিছুই আজো অমনভাবে টিকে রয়েছে, তাই সেগুলিকে বিশ্লেষণ করলে পর আমাদের পূর্বপুরুষদের নানারকম দুর্বোধ্য বিশ্বাসের উপর আলোকপাত হতে পারে। ধোপা মেথরদের অনুষ্ঠান বিশ্লেষণ করে বৈদিক দেবতাদের বিশ্বাসকে বোঝাবার চেষ্টা অনেকের আত্মমর্যাদায় আটকাবে। কিন্তু সমাজ-বিকাশের যে পর্যায়ের ধ্যানধারণা মেথর প্রভৃতিদের মধ্যে আজো এইভাবে টিকে রয়েছে বৈদিক মানুষেরাও এককালে সেই পর্যায়ে জীবন যাপন করেছিলেন; তাই বৈদিক সাহিত্যে সেই পর্যায়ের বিশ্বাস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে কেন?

ঋগ্বেদে(৫৭১) দেবতারা গাইছেন :

অমাম সোমম্‌ অমৃতা অভূম
—আমরা সোম পান করে অমৃতত্ব লাভ করেছি।

বৈদিকে ঋষিদের কাছে, মদ্য বলতে ওই সোমই। তাঁদের বিশ্বাস অনুসারে এই মদ্যের সাহায্যেই মৃত্যুকে উর্ত্তীর্ণ হয়ে অমৃতত্ত্ব লাভ করা যায়।

প্রাচীন পর্যায়ে আটকে-থাকা মানুষদের মধ্যেও তাই। তাই, মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মদ্যের ব্যবহার, কবরের গায়ে গর্ত খুড়ে মৃতের উপর মদ্য ঢালবার আয়োজন, মদ্যপানরত আত্মীয়দের সঙ্গে সুতো বেঁধে কবরখানাকে সংযুক্ত করবার ব্যবস্থা—ইত্যাদি, ইত্যাদি। আজো আমাদের দেশে সাবেকি পদ্ধতিতে প্রস্তুত মদের নাম দেওয়া হয় মৃতসঞ্জীবনী।

প্রাচীন মানুষদের কল্পনায় মদ্য যদি মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হবার,—মৃত্যুর স্পর্শ কাটিয়ে জীবনকে ফিরে পাবার,—এক রকম উপকরণ হয়, তাহলে বুঝতে হবে প্রাচীন মানুষদের কাছে মদ্যের তাৎপর্যটা অন্য রকমের ছিলো : মদ্যের বাস্তব গুণাগুণ বোঝবার মতো জ্ঞানের সঙ্গতি তাদের ছিলো না, থাকবার কথা নয়। মদ্যপানের দৈহিক ফলাফল সংক্রান্ত তাদের যেটুকু অভিজ্ঞতা সেটুকু হলো, সাময়িকভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা এমন কি শক্তি-সামর্থের বৃদ্ধি— অনেক সময় যেন মানুষটার প্রকৃতি বদলে গিয়ে নতুন মানুষে পরিণত হচ্ছে।

অতএব এই মদ্য নবজীবনের আধার, তরল জীবন–রক্তের মতো।

আর জীবন বলেই মদ্যের সাহায্যে মৃত্যুর স্পর্শকে উত্তীর্ণ হবার অতো রকম আয়োজন।

যদি তাই হয়, তাহলে মদ্যের ব্যবহার শুধুমাত্র মৃত্যু প্রসঙ্গেই হবার কথা নয়। জাদু-বিশ্বাস অনুসারে প্রাচীন মানুষের পক্ষে নবজাতককে পাবার— সন্তান-উৎপাদনের—সহায়ক হিসেবেও মদ্যের সংস্পর্শ মূল্যবান হবার কথা।

সাঁওতালদের সৃষ্টি-উপাখ্যানে(৫৭২) এই বিশ্বাসেরই ইংগিত পাওয়া যায়। আদি-নর এবং আদি-নারী গড়বার পর মরণ-বুরু দেখলে তাদের মধ্যে সন্তান-উৎপাদনের কোনো তাগিদ নেই। অতএব মরণ-বুরু তাদের মদ তৈরি করতে শেখালো—এই মদ পান করবার পরই তাদের মধ্যে প্রজননের উৎসাহ প্রথম দেখা দিলো, তারই ফলে সম্ভব হলো মনুষ্যজাতির আবির্ভাব।

প্রাচীন পর্যায়ে আটকে-থাকা মানুষদের মধ্যে দেখা যায়, যৌন-মিলনমূলক উৎসবের প্রধানতম অঙ্গ হলো মদ্যপান। আমরা আগেই দেখেছি, এবং পঞ্চমকারের মৈথুন-প্রসঙ্গে সে-কথার পুনরুল্লেখ করবো যে, এ-উৎসবের যৌন-মিলনকে আধুনিক সমাজের গণিকালয়ের আলোয় চিনতে গেলে খুবই ভূল হবে। কেননা সে-উৎসবের পিছনে মূল কথাটা হলো প্রকৃতিকে ফলপ্রস্থ করবার কামনা। তেমনি, ওই উৎসবের মদ্য-ব্যবহারকেও আধুনিক সমাজের সুঁড়িখানার আলোয় চিনতে গেলে ভুল করা হবে; কেননা, তার পিছনে মূল কথা হলো, ওই তরল প্রাণশক্তি ব্যবহারের সাহায্যেই প্রকৃতিতে নবজন্মের আয়োজন করা।

নবজন্মের কামনায় এই তরল জীবনীশক্তির ব্যবহার আজো মানবসমাজে কীভাবে টিকে রয়েছে তার কিছু কিছু নমুনা পাওয়া যায় দেশবিদেশের বিবাহ-অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করলে : বহু ক্ষেত্রেই বিবাহ-অনুষ্ঠানের একটি প্রধান অঙ্গ হলো মদ।

At Tipperah weddings the bride recives a glass of liquor from her mother. She takes this to the bridegroom, sits on his knee, and, after drinking some of the liquor, gives the rest to him. …Among the Nakri Kunbis of Thana, liquor is given to the pair when the wedding ceremony is completed. The girl relatives of the Khyoungtha bride bar the entrance to the village against the bridegroom with a bamboo. Across this he has to drink with them a loving cup of fraternity before he is allowed to enter. At weddings in Morocco the priest hands to the pair a cup of wine which he has blessed. … Among the Larkas, a cup of beer is given to each of the two parties; they mix the beer and then drink it. This completes the marriage. In the Moluccas, Japan, Bengal, Brazil, Russia, Scandinavia and many other districts of Europe, the bridal pair drinks, as the marriage ceremony or part of it, wine or beer from one vessel. At Beni-Israil weddings the bridegroom pours wine into the bride’s mouth. In Korea and China the pair drink wine from two cupo which are tied together by a red thread. In Christian countries the rite is separated from the ceremonial proper, but is carried out independently when the pair receive together the wine of the Communion, which is to be partaken of immediately or soon after the marriage itself. Among the Gonds, the respective fathers of the bridal pair drink together(৫৭৩).
অর্থাৎ, (সারমর্ম), ত্রিপুরায় বিয়ের অনুষ্ঠান হিসাবে কনের মা কনেকে একপাত্র মদ দেয়; কনে সেই পাত্র নিয়ে বরের কাছে যায়, তার কোলে বসে পাত্র থেকে নিজে কিছুটা খায় আর তারপর বাকিটুকু বরকে খেতে দেয়। থানা অঞ্চলে নকরি কুনবিদের মধ্যে প্রথা হলো, বিবাহ-অনুষ্ঠানের শেষে বরবধূকে মদ্যপান করতে দেওয়া হবে। খিয়ুঙটায় কন্যাপক্ষের মেয়েরা বরের সামনে বাঁশ দিয়ে গ্রামে চোকবার পথ বন্ধ করে রাখে; বাঁশের উপাশে দাঁড়িয়ে এদের সঙ্গে মদ্যপান করবার পর তবেই তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়। মোরোক্কোর বিবাহানুষ্ঠানে পুরোহিত একটি মদের পাত্রে আশীৰ্বাদ বর্ষণ করে বরবধূকে পান করতে দেয়। সারকাদের মধ্যে প্রথা হলো, বর ও বধূ উভয়কেই এক পাত্র করে মদ দেওয়া হয়; তারা পাত্রের মদ একসঙ্গে মিশিয়ে পান করে; এরই পর বিবাহানুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি। মলুক্কাস, জাপান, বাংলা, ব্রেজিল, রাশিয়া, স্কাণ্ডিনেভিয়া এবং ইয়োরোপের নানা অঞ্চলে বিবাহ-অনুষ্ঠান বা তার অঙ্গ হিসেবে বরবধূকে একই পাত্র থেকে মদ পান করতে হয়। বেনি-ইসরাইল-এর বিয়েতে বর কনের মুখে মদ ঢেলে দেয়। কোরিয়া আর জাপানে প্রথা হলো, লাল সুতো দিয়ে বাঁধা দুটি পাত্র থেকে বর ও বধূকে মদ্যপান করতে হবে। খৃস্টান দেশে যদিও মূল বিবাহ-অনুষ্ঠান থেকে, এই ব্যবস্থাটুকু বিচ্ছিন্ন হয়েছে তবুও স্বতন্ত্রভাবে তা পালন করবার ব্যবস্থা দেখা যায়—বিবাহের অব্যবহিত পরে বর ও বধূকে মদ্যপান করতে হয়। গোণ্ডদের মধ্যে প্রথা হলো, দুই বেয়াই একসঙ্গে বসে মদ্যপান করবে।

প্রাচীন সমাজে প্রজননের আয়োজনেই বিবাহ।

তাহলে, প্রাচীন মানুষদের ধারণায় মদ্যের ব্যবহার শুধুমাত্র মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হবার আশায় নয়, নবজন্মের সাফল্য-কামনাতেও।

যদি দেখা যায়, এইভাবে একই বস্তু মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হবার আশায় এবং প্রজননের সাফল্য-কামনায়—উভয় উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে, তাহলে সে-বস্তুটির তাৎপর্য কী হতে পারে? প্রাণ, জন্ম, নবজীবন। যে-জীবন চলে গিয়েছে তাকে ফিরে পাবার চেষ্টা। আর যে-জীবন কামনা করা হচ্ছে তাকে সুনিশ্চিতভাবে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা। মদ্য সম্বন্ধে এই মনোভাবটির মূলে মানবদেহের উপর মদ্যের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার প্রভাব সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাটা নিশ্চয়ই ছিলো : মদ্যপানের ফলে যে সাময়িক উৎসাহ-উদ্দীপনাদি পাওয়া যায় তা সম্যকভাবে বিচার করা আদিম মানুষদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি; ফলে ব্যক্তিত্বের ওই সাময়িক পরিবর্তনকে তারা মানবদেহে স্বতন্ত্র প্রাণশক্তির পক্ষে ভর করবার লক্ষণ বলেই ভুল করতে পারে। এই প্রাণশক্তি পানীয়ের মধ্যে দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে, আদিম বিশ্বাস অনুসারে ওই পানীয়ই প্রাণশক্তি।

খৃস্টানদের ধর্মপুঁথিতে মদ্যকে যীশুর রক্ত বলে যে-কল্পনা করা হয়েছে তাও এই আদিম বিশ্বাসেরই পরিণাম। প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসের নানান দৃষ্টান্তে দেখা যায়, দশায়-পাওয়া, দিব্যোন্মাদন, ঠাকুর-দেবতার ভর হওয়া প্রভৃতি নানান নামে যে-অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয় তার সঙ্গে মদ্যপানজনিত অবস্থার সাদৃশ্য রয়েছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে(৫৭৪) ধর্মানুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত পুরোহিত মদ্যপান করতে বাধ্য। তার কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান থেকে এই জাতীয় ধর্মবিশ্বাসের জন্ম; এবং সেই জাদুঅনুষ্ঠানের মূল কথা হলো, জীবনীশক্তির স্পর্শে বা জীবনীশক্তির একটা নকলের সাহায্যে প্রকৃতির জননশক্তিকেও আয়ত্তে আনবার আয়োজন।

অতএব, আমাদের মূল যুক্তি যদি ঠিক হয়,–যদি ওই কৃষিভিত্তিক জাদু-অনুষ্ঠান থেকেই তান্ত্রিকাদি সাধনার জন্ম হয়,—তাহলে নিশ্চয়ই মদ্যপান বিনা সে-সাধনার সম্ভাবনা থাকে না। তন্ত্র বলছে : বিনা মদ্যং মহেশানি ন সিদ্ধন্তি কদাচন।

 

পঞ্চমকারের মধ্যে অন্যতম মকার বলতে মৈথুন। এই ‘ম’-কারটি যে তান্ত্রিক সাধনার প্রধানতম অঙ্গ তা প্রমাণ করবার জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। শুধু তাই নয়, তন্ত্রে যেহেতু মানবীয় ব্যাপারের উপমান হিসেবেই বিশ্বরহস্য উদঘাটন করবার চেষ্টা সেইহেতু তন্ত্রের বিশ্বরূপকল্পনাতেও(৫৭৫) এই মৈথুন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

অথচ আধুনিক রুচিবোধ এবং নীতিবোধের দিক থেকে তন্ত্রকে বিচার করতে গিয়ে আধুনিক বিদ্বানেরা এই ‘ম’-কারটি নিয়েই সবচেয়ে বিব্রত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই বিষয়টির উল্লেখ করেই তন্ত্রকে অতি জঘন্য ও বিকৃত মনোভাবের পরিচায়ক বলে নিন্দা করে থাকেন। অপরের তন্ত্রকে সমর্থন করতে গিয়ে এই বিষয়টিকে হয় গোপন করতে চান বা কৃত্রিম ব্যাখ্যার সাহায্যে একে সমর্থন করতে চেষ্টা করেন।

প্রথমে এই রকম কয়েকটি উক্তি উদ্ধৃত করা যাক। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(৫৭৬) বলছেন :

অন্যকথা খুলিয়া বলিতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিতে হয়,—হয়তো পিনাল কোডের ধারায়ও পড়িতে হয়। তবে একটা কিছু না বলিলে নয়—তাই কয়েকটি নমুনা দিতেছি—
দ্বাদশাব্দিকাং কন্যাং চণ্ডালস্য মহাত্মন: ।
সেবয়েং সাধকে নিত্যং বিজনেষু বিশেষতঃ।।
মোট কথা এই যে,
দুষ্করৈৰ্নিয়মৈস্তীব্রৈঃ সেব্যমানে ন সিদ্ধতি।
সৰ্বকামোপভোগৈশ্চ সেবয়ংশ্চাণ্ড সিদ্ধতি।।
অর্থাৎ দুষ্কর কঠোর নিয়ম করিয়া সেবা করিলে কিছুতেই সিদ্ধিলাভ হয় না। সর্বপ্রকার কামোপভোগ করিয়া যদি সেবা করে—তাহা হইলে নিশ্চয় শীঘ্র সিদ্ধিলাভ হইবে।…
একজন ইউরোপীয় লেখক বলিয়াছেন—ভারতবর্ষের অধঃপতনের কারণ খুঁজিতে গেলে এই সকল জঘন্য বই ঘাঁটিতে হইবে। ভবিষ্যতে কোন হতভাগ্য পণ্ডিতের অদৃষ্টে যে সে দুর্ভোগ আছে তাহা বলিতে পারি না।  কিন্তু সে দুৰ্যোগ না ভুগিলেও এত বড় ধর্মটা–কেন যে অধঃপাতে গেল, তাহা তো বুঝা যায় না। তাই কাহাকেও না কাহাকেও একদিন সে দুর্ভোগ ভুগিতে হইবে। কিন্তু যে ভুগিবে সে সত্য সত্যই ভারতের একটা মহা উপকার সাধন করিয়া যাইবে। সে অন্তত বলিবে—“বাপু! এ পথে আর আসিও না—এ পথে আসিলে অধঃপতন অবধারিত”।

মহামহোপাধ্যায়ের মতে এই তন্ত্র হলো বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতে-যাওয়ার পরিণাম। তাঁর ওই মত কতোখানি স্বীকারযোগ্য সে-আলোচনা পরে তোলা যাবে। আপাতত আমাদের প্রশ্ন হলো, তান্ত্রিক ধর্মের আধুনিক সংস্করণটি যতো বীভৎসই হোক না কেন—এই বীভৎসতাই তন্ত্রের আদিতাৎপর্য হতে পারে না। কেননা, শুধু বীভৎসতা, শুধু বিকৃতি এতে বড় একটা জাতকে, এতো শতাব্দী ধরে সত্যই এমনভাবে প্রভাবিত করে রাখতে পারে না। তাই প্রশ্ন ওঠে, সেই আদি-তাৎপর্য কী ছিলো? কেমনভাবে কোন পদ্ধতিতে, আমাদের পক্ষে তা অন্বেষণ করা সম্ভবপর? উত্তরটা মহামহোপাধ্যায়ের আশঙ্কা থেকেই অনুমান করা যেতে পারে : ‘খুলিয়া বলিতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিতে হয়। বস্তুত আমাদের যুক্তিও ঠিক তাই-ই। তন্ত্রের আদি রহস্য বুঝতে হলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করে পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়ে থাকা অসভ্য মানুষদের আচার-অনুষ্ঠান ও বাস্তব বিশ্বাসকেই পরীক্ষা করতে হবে। তাতে নিশ্চয়ই তন্ত্রকে সমর্থন করবার যুক্তি পাওয়া যাবে না; কিন্তু তন্ত্রকে বুঝতে পারবার—ব্যাখ্যা করবার,—একটা উপায় হতে পারে। এবং তার সাহায্যে ‘ভারতবর্ষের অধঃপতনের কারণ’ বোঝা না গেলেও অনুন্নতির বা বাধাপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষণকে চিনতে পারা সম্ভব হবে।

শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তন্ত্রকে সমর্থন করতে চান। আর সেই কারণে আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত পদ্ধতিই তিনি অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছেন—অর্থাৎ কিনা, পিছিয়ে-পড়া মানুষদের দিকে তাকাবার বদলে উন্নততর জাতিদের দোহাই দিয়ে তন্ত্রের মহিমা প্রচার করবার চেষ্টা করছেন(৫৭৭):

নরনারীর সঙ্গমটাকে জঘন্য ব্যাপার বলিয়া পরিচিত করিলেই, তাহার পর হইতে দুর্বল পুত্রকষ্ঠ উৎপন্ন হইবে, যথাশাস্ত্র বংশরক্ষা দুষ্কর হইবে। জর্মন মনীষিগণ এইটুকু বুঝিতে পারিয়াই গত কুড়ি বৎসর কাল জর্মনির চিকিৎসকগণ মৈথুনের সায়ান্স-সন্মত পদ্ধতি প্রকাশ্যভাবেই ব্যাখ্যা করিতেছেন।
…জর্মনির বিদ্বজ্জন সমাজে জীবসৃষ্টির পদ্ধতির ব্যাখ্যা লজ্জাজনক নহে। আমাদের দেশে যখন তন্ত্রধর্ম প্রবল ছিল, তখন মৈথুনটা গোপ্য, নিন্দনীয় ও জঘন্য ব্যাপার বলিয়া পরিচিত ছিল না। খৃষ্টানী বুদ্ধিতে এখন তন্ত্রের পঞ্চমকারের নিন্দা করিলে চলিবে কেন?

কোন উদ্দেশ্যে জর্মনিতে আধুনিক যুগে প্রজনন-তত্বের উপর অমন গুরুত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো এবং তার বাস্তব ফলাফলই বা কী হয়েছিলো—এ-আলোচনা অবশ্যই স্বতন্ত্র। আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে যে-কথাটুকু প্রাসঙ্গিক তা হলো, এইভাবে হাল-জর্মনির দোহাই দিয়ে তন্ত্রের মৈথুনকে সমর্থন করবার চেষ্টা অত্যন্ত প্রকটভাবেই কৃত্রিম। তার কারণ, তন্ত্র অতি প্রাচীন ব্যাপার— আমাদের দেশে এ-যুগে তার প্রভাব যতো গভীরই হয়ে থাকুক না কেন, সমাজ-বিকাশের এক অতি প্রাকৃত পর্যায়েই তার উৎস। বস্তুত, আমাদের আধুনিক সমাজ-বাস্তবের মধ্যে থেকে সেই প্রাকৃত সমাজ-বাস্তবের চিহ্ন অসমাপ্তভাবে বিলুপ্ত হয়েছে মাত্র; তাই তান্ত্রিক ধ্যানধারণা আজো আমাদের দেশে এতো ব্যাপক, এতো বিপুল প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। অতএব, সেই সুপ্রাচীন সমাজ-বাস্তবের দিক থেকেই তন্ত্রের তাৎপর্য অনুসন্ধান করতে হবে—তার বদলে আধুনিক ইউরোপীয় সমাজের নজির দেখিয়ে তন্ত্রের সমর্থন খোঁজবার চেষ্টাটা এ-যুগের বিদ্বানের পক্ষে তন্ত্রের প্রতি ভ্রান্ত অনুরাগের পরিচায়ক।

অতএব, আমরা আমাদের পদ্ধতি অনুসারে পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করে তন্ত্রের এই প্রধানতম মকারটির আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করবো।

আমরা ইতিপূর্বেই এ-বিষয়ে কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি, কৃষি-আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃতির উর্বরা-শক্তির সঙ্গে মানবীর উর্বরা-শক্তির নিবিড় সাদৃশ্য ও এমন কি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ কল্পনা করা হয়েছে। ফলে, এই স্তরের চেতনায় প্রজনন ও ধনউৎপাদন—সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং ফসল ফলানো—দুটি সম্পর্কহীন ক্রিয়া নয়। অর্থাৎ, ওই অর্ধঅসহায় অবস্থায় মানুষেরা সন্তান লাভ সংক্রান্ত নানারকম ক্রিয়াকলাপের সাহায্যেই শস্য উদ্গমের আর শস্য-বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে, কিংবা, অপরপক্ষে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার নকল তুলে নিজেদের প্রজনন-প্রচেষ্টাকেও সফল করতে চেয়েছে।

এ-বিষয়ে রবার্ট ব্রিফন্ট সুবিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করবার বদলে জমিতে চাষ দিয়ে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হবার পর থেকে খাদ্য-উৎপাদন সংক্রান্ত জাদু-অনুষ্ঠানের মূল কামনা হলো পৃথিবীর উর্বরা-শক্তির বৃদ্ধি এবং সে-অনুষ্ঠানের মূল অঙ্গ হলো মৈথুন।

The belief that the sexual act assists the promotion of an abundant harvest of the earth’s fruits, and is indeed indispensable to secure it, is universal in the lower phases of culture.(৫৭৮)
সংস্কৃতির নিম্নতর পর্যায়ে সর্বত্রই এই বিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায় যে, মৈথুনের সাহায্যেই পৃথিবীতে বহুল পরিমাণে ফসল ফলানো যাবে, এমন কি পৃথিবীতে ফসল ফলানোর ব্যাপারে মানুষের মৈথুন অনিবাৰ্যভাবে প্রয়োজন।

মধ্য-আমেরিকার আদিবাসীরা(৫৭৯) বীজ বপনের রাতে এবং বীজ বপনের ঠিক মুহূর্তটিতে ক্ষেতের উপর মৈথুন করবার উদ্দেশ্যেই কয়েকজনকে বিশেষভাবে নিয়োগ করে। মুসকোয়াকি নামের রেড্‌-ইণ্ডিয়ানদের(৫৮০) মধ্যে প্রথা হলো, বীজবপন উপলক্ষ্যে জনৈক যুবককে নির্বাচন করা হবে এবং তাকে একটি সঙ্গিনী দেওয়া হবে—সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যুবকটি ক্ষেতে যাবে। পেরুভিয়ানরা(৫৮১) ফসল পাকবার আগে পর্যন্ত কঠিন আত্মসংযম করে থাকে; তারপর ফসলের দিন ঘনিয়ে এলে স্ত্রী-পুরুষেরা একত্র সমবেত হয়, সকলেই দেহাভরণ খুলে ফেলে একটি দৌড়-প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়—এই প্রতিযোগিতায় যে-পুরুষ যে-নারীকে ধরতে পারবে তারই সঙ্গে মিলিত হবে। জাভা-দ্বীপে কিষাণ-কিষাণীরা ধান ক্ষেতের মধ্যে মিলিত হয়—তাদের ধারণায় এই হলো শস্যকে প্রচুর করবার কৌশল।

রবার্ট ব্রিফল্ট(৫৮৩) ও দেখাচ্ছেন, ফসল পাবার কামনায় এইভাবে প্রকাশ্যে মৈথুনে প্রবৃত্ত হবার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া নানান অঞ্চলেই চোখে পড়ে; তিনি চিলি, নিউমেস্কিকো, মেস্কিকো, নিকারাগুয়া প্রভৃতির উল্লেখ করছেন।

হাণ্টার-এর(৫৮৪) বর্ণনা অনুসারে রাজমহল-পৰ্বত অঞ্চলের আদিবাসীদের যেটা সবচেয়ে বড়ো পরব তা স্পষ্টই কৃষিকেন্দ্রিক; এ-উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ হলো স্ত্রীপুরুষের মধ্যে অবাধ মিলন। বস্তুত, পরবের সময়ে ওরা তরুণ-তরুণীর মিলনকে অনিবাৰ্যভাবেই প্রয়োজনীয় মনে করে।

জয়পুর অঞ্চলে পাঞ্চাদের(৫৮৫) মধ্যে নববর্ষ উপলক্ষ্যে (ফসলের সময় থেকেই বর্ষারম্ভ; এবং আগেই প্রকাশ আমাদেরও আগে অগ্রহায়ণ থেকে বর্ষারম্ভ হতো) একমাস ধরে অবাধ যৌন-মিলনের উৎসব চলে।

এই উৎসবই চোখে পড়ে নিলগিরি পাহাড়ের কোটারদের(৫৮৬) মধ্যে। বলাই বাহুল্য, এ-জাতীয় উৎসব শুধু উৎসব নয়-গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানও। :

বাটলারের(৫৮৭) বর্ণনা অনুসারে আসামের ট্রাইবদের মধ্যে বসন্তোৎসবের সময়ে মেয়েরা পরিপূর্ণ যৌন-স্বাধীনতা পায় এবং উৎসবকালীন আচরণ নিয়ে পরে তাদের কোনো রকম সমালোচনা শুনতে হয় না, দুর্নাম কুড়োতে হয় না।

হড্‌সনের(৫৮৮) বর্ণনা অনুসারে দেখা যায়, মণিপুরের নাগা ট্রাইবদের মধ্যে একই উৎসব বা অনুষ্ঠান বর্তমান রয়েছে।

এ্যাণ্ডারসন(৫৮৯) তার বর্মা-অভিযান-এ উত্তর-বর্মার একটি উৎসবের বর্ণনা দিচ্ছেন; অন্যান্য জায়গায় প্রচলিত অবাধ মিলনোৎসবের সঙ্গে উত্তর-বর্মার এই উৎসবটির সাদৃশ্য অস্পষ্ট নয়।

কেবল এখানেও মনে রাখা দরকার, ইউরোপীয় পরিদর্শকদের চোখে যে-ঘটনা শুধুমাত্র উৎসব বলে মনে হয়েছে তা আধুনিক অর্থে উৎসব নয়। কেননা, আধুনিক অর্থে উৎসব বলতে প্রধানতই আমোদ-প্রমোদের ব্যাপার মনে হয়। অথচ, ওই প্রাচীন পর্যায়ের মানুষদের কাছে এর গুরুত্ব অসামান্য,— এমন কি এতে যোগ দেওয়ার পিছনে একটা কঠিন কর্তব্যপরায়ণতার চাপও আছে। তাই, একে উৎসব না বলে অনুষ্ঠান বলাই সঙ্গত-হয়তো ধর্মানুষ্ঠানই বলা যেতো, কিন্তু আমরা দেখাতে চাই যে, সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়ে এই জাতীয় অনুষ্ঠানের বিকাশ সে-পর্যায় প্রাক্‌-অধ্যাত্মবাদী ও প্রাক্-ধর্মানুষ্ঠানিক। তাই একে জাদুবিশ্বাসগত অনুষ্ঠান বলাই শ্রেয়—ধর্মের আগে জাদুবিশ্বাস এবং ধর্মের সঙ্গে জাদুবিশ্বাসের গুণগত বৈষম্য।

আসল কথা হলো, আমাদের পক্ষে পিছিয়ে-পড়া মানুষদের ওই উৎসব বা অনুষ্ঠানের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারা খুব কঠিন। শুধু তাই নয় এর তাৎপর্যকে ভুল বোঝবার সম্ভাবনাই প্রচুর। কেননা, শুধুই যে আমরা জামাদের আধুনিক রুচিবোধ আর নীতিবোধের দিক থেকে এ-জাতীয় অনুষ্ঠানকে কদৰ্য নীতিপরায়ণতা বলে মনে করতে পারি তাই নয়, প্রাকৃতিক নিয়ম সংক্রাস্ত জ্ঞানের দিক থেকেও আমরা এতো বেশি এগিয়ে গিয়েছি যে, প্রাচীন মানুষদের ওই বিশ্বাসটিকে আমরা স্বভাবতই অবিশ্বাস্য রকমের কাল্পনিক বলে মনে করতে বাধ্য।

আসলে, প্রাচীন মানুষদেরও একটা কর্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান আছে। এবং যেহেতু অন্ন লাভের উপরই ওদের পুরো দলের জীবনমরণ নির্ভর করছে সেইহেতু ওদের ধারণায়, অল্পকে বহু করবার জন্য অনিবাৰ্যভাবে প্রয়োজনীয় এই অনুষ্ঠানটিকে, তারা গুরুত্বপূর্ণকর্তব্য বলেই মনে করে। স্যর জেমস ফ্রেসার(৫৯০) যেমন বলছেন, মধ্য-আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে বীজবপন-উপলক্ষ্যে এই মৈথুন-অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যেরই অন্তর্গত—in default of which it was not lawful to sow the seeds, এ-অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে বীজবপনের কাজটাই বেআইনী।

অর্থাৎ, এক-কথায়, প্রাচীন মানুষদের এই যে ভিন্ন-রুচি ও ভিন্ন-নীতি তার পিছনেও অত্যন্ত বাস্তব ও মূর্ত কারণ ছিলো। সেটা হলো, বাঁচবার ভাগিদ, কিংবা বাঁচবার পক্ষে সবচেয়ে প্রাথমিক যে প্রয়োজন—অন্ন—তারই তাগিদ। কেবল, এই মূর্ত তাগিদটিকে মেটাবার জন্যে তারা যে-অনুষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে চাইছে সেটা তাদের পার্থিব দারিদ্র্যের অনুরূপ জ্ঞানের দারিত্র্যেরই পরিণাম : তাদের ধারণায় উৎপাদনের একটা নকল তুলতে পারলেই প্রকৃতির উৎপাদন-বৃত্তিও আয়ত্তে আনা যাবে। সেটা ভুল, সেটা নিশ্চয়ই কল্পনামাত্র। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, প্রাচীন সমাজের পটভূমিতে এবং প্রাচীন মানুষদের চেতনা অনুসারে অনুষ্ঠিত এই মৈথুন নিছক নীতিবোধের অভাব নির্ণায়ক। আসলে, তাদের কাছে এইটে হলো নীতিবোধেরই বিকাশ—কেবল তাদের এই নীতিবোধ তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিরই অনুরূপ। অন্যান্য সমাজের মতো প্রাচীন সমাজের নীতিবোধও নিরালম্ব নয়—অর্থনৈতিক জীবনের উপর, ধনউৎপাদন-পদ্ধতির উপর তা নির্ভরশীল।

 

আমাদের যুক্তি হলো, তন্ত্রের ওই প্রধানতম মকারটি যে এতো বড়ো একটা দেশকে এতোদিন ধরে এমন গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে, তার কারণ এর পিছনে একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস ছিলো। সে-ইতিহাসের আভাস পাওয়া যায় পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের পরীক্ষা করলে। মানবউন্নতির একটা বিশেষ স্তরে মৈথুন বলতে শুধুমাত্র রতিবাসনার চরিতার্থতা নয়, তার বদলে একরকম অনুষ্ঠান বিশেষ—এবং এ-অনুষ্ঠান সবচেয়ে মৌলিক অর্থনৈতিক চেষ্টারই অঙ্গ। আমাদের দেশের ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে এর স্মারক অমন প্রকটভাবে টিকে রয়েছে তার কারণ অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে আমাদের দেশের সমাজ-বাস্তব থেকে ওই প্রাচীন পর্যায়ের স্মারক মাত্র অসম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়েছে।

অবশ্যই, তন্ত্রে আজ আমরা অনুষ্ঠানটিকে যে-রূপে দেখতে পাই তার মধ্যে ওই প্রাচীন পর্যায়ের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য-সাধনের পরিচয় নেই; তন্ত্রে মৈথুন ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গ, উৎপাদন-পদ্ধতির অঙ্গ নয়। বস্তুত, ওই আদি-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হবার ফলে আদিম প্রক্রিয়াটির পক্ষে ধর্মানুষ্ঠানে পরিণত হওয়াটা একটি স্বাভাবিক বা জাগতিক নিয়মেরই ফল। কেননা, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুষ্ঠান হলো সেইসব আচার-বিচারেরই আধার, যেগুলি এককালে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করবার জোরেই—জীবনোপায়ের সহায়ক ছিলো বলেই— মানুষের চেতনায় এবং মানবসমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে পেরেছিলো। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ এখানে বৈদিক যজ্ঞের উল্লেখ করা যায় : আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুসারে যজ্ঞ এককালে দেবতাগণের কাছে অন্ন-লাভের উপায়মাত্র ছিলো এবং তা ছিলো বলেই বৈদিক মানুষদের জীবনে যজ্ঞের স্থান অমন অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরকালে, ওই অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যজ্ঞ পরিণত হলো নিছক ধর্মানুষ্ঠানে।

এবং এইভাবে অতীত পর্যায়ের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত কোনো অনুষ্ঠান ধর্মানুষ্ঠানমাত্রে পরিণত হবার ফলে তার আদি-তাৎপর্য বিপরীতে পর্যবসিত হওয়া শুধু স্বাভাবিক নয়, অনিবার্যও : যা ছিলো জীবনের সহায় তাই হয়ে দাঁড়ায় জীবনের পরিপন্থী। ফলে, তন্ত্রের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মতোই ওই প্রধান মকারটিও আজকের দিনে আমাদের কাছে শুধুই অর্থহীন ও বীভৎস কামবিকার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আজকের দিনে অনুষ্ঠানটিকে আমরা যে-ভাবে দেখছি সেই রূপটির মধ্যেই তার আদি ও অকৃত্রিম তাৎপর্যের পরিচয় পাওয়া সম্ভবপর।

প্রশ্ন উঠবে, পৃথিবীর সবদেশের মানুষের পক্ষেই বন্যদশার নিচু স্তর থেকে সভ্যতার দিকে এগোবার পথটি যদি একই রকম হয় এবং এই মৈথুন-অনুষ্ঠান যদি ওই পথের কোনো এক স্তরের পরিচায়কই হয়, তাহলে শুধুমাত্র আমাদের দেশের ধর্মাচরণের মধ্যেই তার স্মারক কেন? উত্তরে বলবো, যদিও বাধাপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে বিশেষ করে আমাদের দেশে প্রাচীন জাদুঅনুষ্ঠানের এই দিকটি ধর্মানুষ্ঠানে পর্যবসিত হবার পরও অস্বাভাবিকভাবে পল্পবিত হয়েছে, তবুও তা শুধুমাত্র আমাদের দেশের ধর্মবিকাশের বৈশিষ্ট্য নয়। বস্তুত, প্রাচীন পর্যায়ের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় যেখানেই পাওয়া যায় সেখানেই এই প্রাচীন অনুষ্ঠানটিকেও দেখতে পাওয়া অসম্ভব নয়।

প্রাচীন গ্রীসে ডায়োনিসাসকে কেন্দ্র করে যে ধর্মবিশ্বাস, অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন(৫৯১) সুদীর্ঘভাবে তার বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, কৃষিকেন্ত্রিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই তার উৎপত্তি এবং এই ডায়োনিসাস্-ধর্মের মধ্যে মদ্য, প্রকাশ্য মৈথুন প্রভৃতি তান্ত্রিক মকারগুলির পরিচয় সত্যিই অস্পষ্ট নয়।

আরো কতো প্রাচীন অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে এই মকারটির পরিচয় পাওয়া যায় তার নমুনা হিসেবে এখানে আমরা রবার্ট ব্রিফন্ট-এর(৫৯২) রচনা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করতে পারি :

The sacred festivals of Jurupai among the Uaupes and other tribes of the Amazon region are scenes of unrestricted sexual license in which old and young join without restraint. Among the Choroti every ritual dance is followed by public promiscuity, and similar rites are observed among the Bororo. Among the Patagonians the chief religious festival, or Kamaruko, concludes with a general sexual orgy. Among the tribes of the plains of North America and of the lower Mississippi valley the harvest festivals were attended with general license, and the old men and women exhorted the younger ones to indulge without restraint……
…Among the Dayaks of British North Borneo, at the festival called Bunut by which the fertility of the soil and a plentiful harvest of paddy are secured, general license takes place lasting exactly a quarter of an hour, after which perfect order and beseemingness are restored. During that time a naked man wanders in and out among the men and women, and each woman touches him as he passes. In the Malay Peninsula, during the rice-harvest the men of the Jakun tribes exchange wives.

মালয় পেনিনসুলার জাকুনদের ওই অনুষ্ঠানটি আমাদের বৈষ্ণব পরকীয়াতত্ত্বের উপর কোনো রকম আলোকপাত করে কি না এবং বাংলাদেশের বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের সঙ্গে তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কী—এ-সব প্রশ্নের অবতারণা করতে গেলে আপাতত আমাদের আলোচনা অত্যন্ত বেশি বিক্ষিপ্ত হবার সম্ভাবনা। তার বদলে বর্তমানে আমরা প্রকট তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলিকেই বোঝবার চেষ্টা করবো। তন্ত্রের পুঁথিপত্রে আমরা সাধারণত যে-ভাবে এই মকারটির পরিচয় পাই তার মধ্যে অবশ্য দলগতভাবে যৌন-মিলনের কথাটা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আনন্দগিরি গাণপত্যদের যে-সম্প্রদায়টিকে উৎকট বামাচারী বলে বর্ণনা করছেন তার ক্ষেত্রে দেখা যায়, “সর্বে বর্ণাঃ সমানজাতয়ঃ দাম্পত্যব্যবস্থা নাস্তি। যেন কেনাপি পুরুষেণ স্বস্বহেরম্বতাং বিভাব্য যাং কাঞ্চিৎস্ত্রিয়ং তচ্ছক্তিং বিচিন্ত্য সুরতেন সম্ভোগঃ কার্য।” ইত্যাদি, ইত্যাদি। শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন-এর(৫৯৩) গ্রন্থে সহজিয়াদের কিশোরী-ভজক সম্প্রদায়ের যে-বর্ণনা পাওয়া যায় তার সঙ্গে ও আনন্দগিরির এই উক্তি মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।

তাহলে তন্ত্রের পঞ্চমকারের মধ্যে মদ্য ও মৈথুন বলে প্রধানতম দুটি মকারকে উর্বরতার কামনামূলক জাদুবিশ্বাসের দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে তন্ত্রের অন্যান্য মকারগুলির উপরও ওই আদিম বিশ্বাসই আলোকপাত করতে পারবে। এই যুক্তির উপর নির্ভর করেই আমরা তন্ত্র সাধনায় মৎস্যের তাৎপর্য অনুসন্ধান করেছি। মুখের বিষয় শ্রীযুক্ত এস্ কে, দিক্ষীত(৫৯৪) ইতিপূর্বেই মৎস্যের তাৎপর্য নিয়ে সুদীর্ঘ গবেষণা করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, বহু দৃষ্টান্তেই প্রাচীন মাতৃপ্রধান ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মৎস্যের যোগাযোগ রয়েছে এবং এই মৎস্য অবধারিতভাবেই উর্বরতা-বৃদ্ধির প্রতীক। এখানে আমাদের যুক্তির পক্ষে তীর সিদ্ধান্তটুকু(৫৯৫) উদ্ধৃত করাই পর্যাপ্ত হবে;

In India, too, fish is looked upon with reverence…all varieties are emblems of fertility, and therefore used in marriage rites. The significance of fish in the religious rites pertaining to marriages of the Aos, the Chongis, the Lohars of the U. P., as well as of the Bengalis may, therefore, be now apparent… That is why fish is taboo to a Bengali widow, and is to be held in her hand by a Bengali bride in performing marriage rites….Mina (Fish) forms one of the panchamakaras (five m-s) of the vama-margin Saktas, a section of the Indian devotees of the Mother-Goddess, who have kept up faithfully most of the barbaric traditions conected with her worship in all their pristine purity.
অর্থাৎ, সারমর্ম, ভারতবর্ষেও মাছ উর্বরতা-বৃদ্ধির কামনাতেই প্রযুক্ত হয়। এই কারণেই নানান বিবাহ-অনুষ্ঠানে মৎস্যের ব্যবহার দেখা যায়, বাংলায় বিধবাদের পক্ষে মৎস্য নিষিদ্ধ এবং বামমার্গাবলম্বী শাক্তদের পঞ্চমকারের মধ্যে একটি মকার ওই মাছই।

তাহলে, তন্ত্রের পঞ্চমকারের মধ্যে এই মকারটির উৎসেও উর্বরতার কামনামূলক সেই আদিম জাদুবিশ্বাসেরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।

 

———————
৫৬১. বিশ্বকোষ ৭:৫২২ ।
৫৬২. R. Briffault op. cit. 2:435-6.
৫৬৩. Ibid.
৫৬৪. নন্দগোপাল সেনগুপ্ত বর্ণিত গৌরীগরণ প্রথার বিবরণ : আবুল হাসানৎ যৌনবিজ্ঞান ১:২৪০।
৫৬৫. বিশ্বকোষ ৭:৫৩১।
৫৬৬. ঐ ৭:৫৩২।
৫৬৭. সুখময় ভট্টাচার্য : তন্ত্রপরিচয় ৫৬-৭।
৫৬৮. ঐ ৫৬।
৫৬৯. বিশ্বকোষ ৭:৫২৬ ।
৫৭০. ERE 5:79.
৫৭১. ঋগ্বেদ ৪.৪৮.৩।
৫৭২. JAS (s) xix—1953, No. 1.
৫৭৩. ERE 5:80.
৫৭৪. Ibid-5:79.
৫৭৫. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২৫৪-৩০৭ ।
৫৭৬. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৮৩।
৫৭৭. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:৩২১।
৫৭৮. R. Briffault op. cit. 3:196.
৫৭৯. Ibid.
৫৮০. Ibid.
৫৮১. Ibid.
৫৮২. Ibid. 3:197.
৫৮৩. Ibid. 3:196-7.
৫৮৪. Ibid 3:198.
৫৮৫. Ibid.
৫৮৬. Ibid.
৫৮৭. Ibid.
৫৮৮. Ibid. 3:199.
৫৮৯. Ibid.
৫৯০. J. Frazer GB 136.
৫৯১. G. Thomson AA 130ff.
৫৯২. R. Briffault op. cit. 3:197.
৫৯৩. D. Sen CHA 375ff.
৫৯৪. S. K. Dikshit MG 30-6.
৫৯৫. Ibid 32-3.