নওজোয়ান নূর এবং এক লড়াকু মেয়ের কিসসা
শাহরাজাদ বললো, এর পর আপনাকে নওজোয়ান নূর এবং এক লড়াকু মেয়ের কিসসা শোনাই?
কোন এক সময়ে মিশরে এক সম্ভ্রান্ত সওদাগর বাস করতো। সে সময়ে তার মতো বিত্তবান আর কেউই ছিলো না। এই সওদাগররের নাম শের।
প্রথম যৌবনে সে নানা দেশ ঘুরেছিলো। নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সমুদ্র অভিযান করেছিলো।কত বিপদ-সঙ্কুল মুহূর্ত জীবনে এসেছে, কত ঝড় বয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু
সে-সবই অতীত স্মৃতি মাত্র আজ।
এখন বয়সের ভার নুজ হয়েছে দেহ। চুল দাড়ি সব হাঁসের পালকের মত শুভ্র হয়ে গেছে। যৌবনের উদ্দামতা আজ শান্ত স্থির। সেদিন যে স্বাস্থ্য যৌবন উদ্দীপনা ছিলো আজ তার কিছুই নাই।
কিন্তু একটা জিনিস আছে। অর্থ! অতুল বৈভবের সে মালিক আজ। সে দিন প্রথম যৌবনে, এই অর্থের কণামাত্র তার আয়ত্তে ছিলো না।
সারাটা যৌবন অর্থের অন্বেষণেই কেটে গেছে। ভোগের ফুরসত মেলেনি। কিন্তু আজ অফুরন্ত অবকাশ। এবং অকল্পনীয় ঐশ্বর্যের সে মালিক। কিন্তু হায়! যৌবন, যে কখন চুপিসারে বিদায় নিয়েছে। ভোগের বাসনাটুকু শুধু জেগে আছে মনে, সাধ কিছু নাই।
এই অগণিত দাস দাসী বাঁদী খোজা নফর এবং অপরিমিত ধন-দৌলত সবই ব্যর্থ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহর অপার করুণা-একটি মাত্র পুত্র সন্তান তিনি তাকে দিয়েছেন।
ছেলেটির বয়স এখন সবে চৌদ্দ। দেখতে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর। শের সন্তানের দিকে। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। সারা জীবনের অতৃপ্ত বাসনার সমস্ত জ্বালা নিমেষে জল হয়ে যায়।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো বাহাত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
একদিন বাবার দোকানে বসেছিলো নুর। এমন সময় তার কয়েকজন ইয়ার দোস্ত এসে বললো, চলো, এক মজার জায়গায় বেড়িয়ে নিয়ে আসি তোমাকে।
নূর বলে, কোথায়?
—আরে, চলই না ইয়ার। না গেলে বুঝবে কী করে?
নূর তবু জানতে চায়, জানতো ভাই, বাবাকে না বলে কোথাও যেতে পারি না। কোথায় যাবো, কত দেরি হবে, সব বললে তবে মত পাওয়া যাবে।
ছেলেদের মধ্যে সবগুলোইনূর-এর চেয়ে বয়সে বড়। এবং বেশ বোঝা যায়, চৌকস সেয়ানা হয়ে উঠেছে সকলেই। ওদের একজন বললো, আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে জান তো? সেই বাগানবাড়িতে আজ একটা মাইফেল বসবে সন্ধ্যেবেলা। তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
—মাইফেল? সে আবার কী?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নূর। সবে সে কিছুদিন হলো বাড়ির বাইরে বেরুবার ছাড়পত্র পেয়েছে। তাও দোকান পর্যন্ত, মাত্র দু এক ঘন্টার জন্য। সুতরাং বাইরের জগতের বহু বিচিত্র রসের সন্ধান সে কী করে রাখবে?
একজন বলে হৈ হৈ। মাইফেল জান না? তাহলে আর জীবনে জানলে কী? চলো চল কী জিনিস, তা মুখে বলে তো বোঝানো যাবে না? নিজের চোখে দেখতে হবে। দেখে মজা লুটতে হবে! তবে মোদ্দা কথা জেনে রাখ, একটা গান-বাজনার আসর বসবে। খানাপিনা হবে—এই আর কি?
নূর উৎসাহিত হয়। এই কৈশোর যৌবনের সন্ধিক্ষণে সব তরুণেরাই সহজাত কৌতূহল অদম্য হয়ে ওঠে। নূর বললো, তোমরা দাঁড়াও, আমি আব্বাজানের মত করিয়ে আসি।
ওরা যখন দল বেঁধে সেই বাগানবাড়ির ফটকে এসে দাঁড়ালো তখন সূর্য পাটে বসি বসি করছে। আমরা যাকে বলি গোধুলি লগ্ন বা কনেদেখা আলো।
বাগানের মালী এক সদাশয় বৃদ্ধ মানুষ। ওদের সকলকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো ভেতরে। সবুজ ঘাসের শয্যায় এলিয়ে আয়াস করে বসলো সকলে। বড় মনোরম পরিবেশ। যে দিকে চোখ যায়—শুধু সবুজের মেলা। গাছে গাছে ফুল ফল পাখী।
মালী এসে বলে, বাতি জ্বালানো হয়েছে মালিক, আপনারা রঙমহলে গিয়ে বসুন। ওরা সকলে পাশের হাবেলীতে প্রবেশ করে।
একখানা প্রশস্ত কক্ষ। দামী পর্দা গালিচায় মোড়া ঘরের দেয়ালে টাঙানো নামজাদা শিল্পীর রতিবিলাসের নানাবিধ আসন প্রক্রিয়ার রক্ত-নাচানো যৌনচিত্রাবলী। নূর এসব কখনও চোখে দেখেনি।
একটু ক্ষণের মধ্যেই নফররা খানা সাজাতে থাকলো। হাঁস, মুরগী, পায়রা প্রভৃতি পাখি জাতীয় মাংসের ঝোল, মসাল্লাম, ভেড়া, দুমবা খাসীর মাংসের কাবাব কোর্মা কোপ্তা। তন্দুরী রুটি, বিরিয়ানী এবং নানাবিধ মেঠাই মিেণ্ডা ও ফল।
খুব পরিতৃপ্তি করে আহার পর্ব শেষ করে ওরা। এর পর শরাবের পাত্রপেয়ালা এনে বসিয়ে দেয় নফররা।
নুর অবাক হয়! শরাব।
একজন হাসতে হাসতে বলে, হা শরাব–মৌজ করে পান করার বস্তু। নূর বলে, না, ওসব আমি খাবো না।
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে, আরে অত ভয় পাচ্ছো কেন, জহর নয়-অমৃত। একবার চুমুক দিয়েই দেখ। খাঁটি আঙ্গুরের রস।
—আঙ্গুরের রস? তবে যে বলছে, সরাব?
-ও সব মন্দ লোকে বলে। এর প্রতিটি ফেঁটা আঙ্গুরের রস থেকে তৈরি। নাও, খেলেই বুঝতে পারবে। খারাপ লাগে খেও না।
সবাই এক সঙ্গে মদের পেয়ালা মুখে তুলে ধরে। নূর তখনও সংশয়াচ্ছন্ন। তুলবে কী তুলবে ভাবছে। এমন সময় একজন হাতে করে তুলে ওর অধরে ধরে।
নূর একটা চুমুক দেয়। স্বাদটা নেহাত মন্দ নয়। এরপর সে নিজে হাতেই ধরে পেয়ালাটা। ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো চুয়াত্তরতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :
ধীরে ধীরে নেশাটা জমে ওঠে। সারা দেহের মধ্যে রক্তস্রোত দ্রুততর হয়। এ অনুভূতি নূরের জীবনে এই প্রথম। মাথার মধ্যে কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে। বুকের স্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে। এই অপরূপ সুখানুভূতিতে সবকিছুই সুন্দর হয়ে ওঠে তার চোখের সামনে। দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর দিকে এতক্ষণ সে সহজভাবে তাকাতে পারছিলো না। এবার কিন্তু আর কোন লজ্জা-সঙ্কোচ হয় না—সোজাসুজি দৃষ্টি মেলে সব ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গিলতে থাকে নূর। এবং দেখতে বেশ ভালোও লাগে। এতক্ষণ যা দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল, সুরার ইন্দ্রজালে সবই স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
বন্ধুরা বলে, কী হে দোস্ত, কবি হয়ে উঠলে নাকি?
এক ইয়ারের তীৰ্ষক বাক্যবাণে সম্বিত ফিরে পায় নূর।
-না মানে, ছবিগুলো দেখছিলাম—খুব সুন্দর।
বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠে।
একজন বলে, ওসব ছবি-টবি দেখে কী হবে, চাঁদ? দুধের সাধ কী ঘোলে মেটে। দাঁড়াও, আসল ক্ষীর তোমাকে খাওয়াচ্ছি।
নূর এ কথার অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। দেখাদেখি বোকার মতো ওদের হাসির তরঙ্গে গা ঢেলে দেয়।
এর পর আর কোনও বাধা থাকে না। পেয়ালার পর পেয়ালা নিঃশেষ হয়ে যায়। নূরের তখন মদে চুর চুর অবস্থা। চোখ ঢুল ঢুলু। গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে।
সবাই মিলে নূরকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়, এই নূর, এখনি ঢলে পড়লে চলবে কেন, দোস্ত। আসল চিজই তো আস্বাদ করলে না? চোখ মেল—তাকাও?
নূর চোখ না খুলেই বিজড়িত কণ্ঠে বলে, এর চেয়েও আর কি চিজ থাকতে পারে, ইয়ার?
—পারে পারে। একবার চোখ মেলে দেখ না?
নূর কোনও রকমে মাথা তুলে চোখ তুলে তাকায়। আর সঙ্গে সঙ্গে তড়িতাহতের মতো চমকে ওঠে। এক ভাবে তাকিয়ে থাকে। পলক পড়ে না।
একটি পরমাসুন্দরী নব-যৌবন উদ্ভিগ্না যুবতী নারী! স্বর্ণচাপার মতো গায়ের রঙ। কাজল কালো টানা টানা চোখ। গুলাবের পাপড়ির মতো গাল। আর অধর? সে তো এক চিত্ত-চঞ্চলকারী অপরূপ মায়াময় যাদু।
নূর অবাক হয়ে দেখতে থাকে। এত সূন্দর মেয়ে সে তো আগে কখনও দেখেনি। এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো ছিয়াত্তরতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
মেয়েটির মুখে এক দুর্বোধ্য মধুর হাসি। নূরের গা ঘেঁষে সে বসে পড়ে। ঐ নেশার ঘোরেও সহজাত সম্রম বোধ তখনও তার একেবারে বিনষ্ট হয়নি। ফারাক রেখে একটু সরে যেতে চায় সে। মেয়েটি ডান বাহু দিয়ে ওর গলাটা বেষ্টন করে কাছে টেনে ধরে, উঁহু, দেব না সরতে। কেন আমি কী বাঘিনী? খেয়ে ফেলবো।
নূর অনুভব করে, ওর বাঁ হাতের বাহুতে মেয়েটির নিটোল স্তনের নিষ্পেষন হয়ে চলেছে। সম্পূর্ণ এক অজানা শিহরণে শিহরিত হয়ে ওঠে সে। সরে যেতে গিয়েও আর সরে যেতে পারে না। পরন্তু মেয়েটিরই বুকের কাছে খানিকটা সরে আসে সে।
এর পর এক সময় নূর দেখলো ঘরে অন্য সবইয়ার বন্ধুরা আর কেউ নাই। কোন ফাঁকে কখন
না যে তারা সটকে পড়েছে নূর বুঝতে পারেনি।
চোখে মুখে এক ভয় ভাব ফুটে উঠে। মেয়েটি খিলখিল করে হাসে।
—কী ভয় করছে বুঝি, খোকা?
-না না ভয় করবে কেন? কিন্তু মানে—ওরা সব গেলো কোথায়?
-ওমা, তুমি কী অসভ্য গো, অতগুলো ইয়ার দোস্তের সামনে তুমি আমাকে বে-আব্রু করবে? তোমার শরম করবে না?
নূর এ কথার অর্থ বুঝতে পারলো না সেই মুহূর্তে। কিন্তু বুঝলো একটু পরেই। মেয়েটি এক এক করে তার অঙ্গবাস খুলে খুলে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে।
এইভাবে সে একসময় শুধুমাত্র একটি ফিনফিনে গোলাপী সেমিজ পরে দাঁড়ায়। এক মূহুর্ত। তীর্যক দৃষ্টি হেনে তাকায় নূরের চোখে চোখ রেখে, কী কেমন লাগছে?
মুখে ওর মধুর হাসি। নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে। তারপর ঝুপ করে বসে পড়ে নূরের কোলের ওপর। এক হাতে গলাটা জড়িয়ে ধরে মুখ বাড়িয়ে দেয় নূর-এর অধরের নিচে।
-কই, দাও?
নূর দুঃসাহসী হতে পারে না। মেয়েটিই কামড়ে ধরে নূরের টসটসে পাকা আঙ্গুরের মতো অধর।
সেই প্রথম বুঝতে পারে নূর, রক্তের স্বাদ নোতা। বাঘ নাকি এই দূরন্ত স্বাদের নেশাতেই মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
মেয়েটি বলে, তুমি কী হাঁদা গো, শেমিজটাও কী ও আমি খুলবো নাকি।
নূর এই প্রথম শিখছে। এ ধমক শুনতে যেন আরও মধুর লাগে।
বাড়ি ফিরে আসতে বেশ রাত হয়ে গেলো। নূরের মা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো চোখে মুখে দারুণ উৎকণ্ঠা। নূর এই প্রথম রাত করে বাড়ি ফিরলো। মা বললো, কী রে নূর, তোর এত দেরি হলো কেন, বাবা।
নূর কোনও কথা বলতে পারে না। নেশায় সে তখন টলছে। মা চমকে ওঠে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, একি, তুই মদ খেয়েছিস?
নূর তবু কোনও কথা বলে না। মা-এর কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কোনও রকমে টাল সামলাতে সামলাতে ঘরে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো সাতাত্তরতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হলো?
মা ভেবে আকুল হয়। নূরের বাবা যদি জানতে পারে, কেলেঙ্কারী কাণ্ড হবে। হলোও তাই।
অনেক রাতে নূরের বাবা ছেলের ঘরে আসে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে, নূর মদ্যপান করে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে জ্বলে ওঠে।
আমার বাড়িতে এত অনাচার। ঘুমন্ত নূরের চুলের মুঠি ধরে সে তুলে ধরে, এ্যাঁই-ওঠ, বেতমিজ। তোর এত বড় স্পর্ধা, আমার বাড়িতে মদ খেয়ে ঢুকেছিস।
নূরকে বেধড়ক প্রহার করতে থাকে সে। কিন্তু একতরফা মার খাওয়ার ছেলে সে নয়। তার ওপর মদের নেশায় চুর হয়েছিলো। বাবাকেও সেদু ঘা বসিয়ে দেয়। বৃদ্ধ বাবা জোয়ান ছেলের গোত্তা সহ্য করতে পারবে কেন? ঘুষি খেয়ে সে ছিটকে পড়ে যায়। নূর বাঘের মতো, হিংস্র হয়ে ওঠে। একখানা ডাণ্ডা তুলে সে বাবার দিকে ধেয়ে আসে। প্রাণভয়ে শের ছুটে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তিন কসম খেয়ে বলে, তোর মতো ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ঢের ভালো। আমি তোকে ত্যজ্যপুত্র করলাম। যে হাতে আমাকে মারলি সেই হাত কেটে নিয়ে তোকে যদি কাল সকালে বাড়ি থেকে না তাড়াই, আমি এক বাপের পুত্র নই।
মা হা-হা করে ছুটে আসে, এ তুমি কী কথা বললে নূরের বাপ। না না, ও কথা তুমি ফিরিয়ে নাও।
শের সিংহের মতো গর্জে ওঠে, আমার এক কথা, কাল ওকে আমি তাড়াবোই।
মা ভাবলেন, কাল সকালে একটা অঘটন ঘটবে। খুব ভোরে সেনূরকে ডেকে তোলে। বলে, তোর আর এ বাড়িতে থাকা হবে না, বাবা। তোর বাবা ক্ষেপে উঠেছে। এই নে, আমার কাছে এগারো শো দিনার ছিলো—তোকে দিলাম। এটা নিয়ে তুই আলেকজান্দ্রিয়াতে চলে যা। পয়সা ফুরিয়ে গেলে আমার কাছে লোক পাঠাবি। আবার দেব। যা বাবা, আর দেরি করিসনে। হয়তো এখুনি তোর বাবা জেগে উঠবে।
নূর আর দেরি করলো না। মায়ের দেওয়া দিনারগুলো কোমরে বেঁধে সে নীল-এর ঘাটে গিয়ে নৌকায় চেপে বসলো।
আলেকজান্দ্রিয়া দুনিয়ার সেরা শহর। নতুন জায়গায় এসে নূর-এর মন ভরে যায়। যে দিকে তাকায় ঝকঝকে তকতকে—সুন্দর সাজানো গোছানো—একেবারে ছবির মতো।
শহরটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। এক সময় সে বাঁদীবাজারে এসে হাজির হয়। দালালরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে জটলা করছে। বণিক সওদাগরেরা এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। একটু পরেই নীলামের ডাক শুরু হবে।
নূর লক্ষ্য করে, একটা খচ্চরে চেপে এক বৃদ্ধ এবং তার পিছনে এক পঞ্চদশী তরুণী এগিয়ে আসছে হাটের দিকে। মেয়েটির স্বচ্ছ বোরখার তলায় তার দেহের রূপ-লাবণ্য পরিষ্কার নজরে পড়ে। নূর-এর মনে হলো সেই বাগান বাড়ির মেয়েটির চেয়েও এ মেয়েটি আরও সুন্দরী—লাস্যময়ী।
বৃদ্ধকে দেখে দালালরা ছুটে আসে। বণিকরা উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটা উঁচু বেদির ওপর মেয়েটিকে দাঁড় করানো হয়। একজন দালাল তার পাশে দাঁড়িয়ে নীলাম শুরু করে।
-ইয়ে আসলি হীরা—বিকনে কে লিয়ে আয়া।
একজন দাম বললো, নয়শো দিনার।
আর একজন দর দেয়, নয়শো পঁচিশ।
কিন্তু বণিকসভার শাহবানদার বলে, আমার দাম সাড়ে ন’শো রইলো।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই চুপ করে যায়। বণিক সভার বৃদ্ধ সভাপতি যখন হাত বাড়িয়েছে তখন আর ওদিকে হাত বাড়াতে কেউ সাহস করে না। দালাল হাঁকে সাড়ে ন’শো–খালি সাড়ে ন’শো দিনার, পানিকা দাম। আউর কোই শেরিফ আদমী হ্যাঁয়।
কিন্তু শাহবানদারের সঙ্গে লড়বে, কার হিম্মৎ আছে?
দালাল নীলাম শেষ করতে উদ্যত হয়, সাড়ে ন’শো এক, সাড়ে ন’শো দুই। কিন্তু সকলে নিরুত্তর। এক দালাল প্রথানুযায়ী বাদীকে জিজ্ঞেস করে এই শাহবানদারের ঘরে যেতে তুমি রাজি আছ মেয়ে?
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলে, ঐ বুড়োর এত শখ কেন? ও তো আজ বাদে কাল কবরে যাবে। আমাকে নিয়ে গিয়ে কী করবে সে। ওর দাড়িতে কী মেহেন্দি মাখিয়ে দেবার জন্যে আমাকে
এ নিয়ে যেতে চায়? না, আমি রাজি নই।
দালাল বলে, ডাক বাতিল। আবার ডাক শুরু হবে। কে আছেন এগিয়ে আসুন।
অন্য একজন বুড়ো উঠে দাঁড়ায়। লোকটার চোখ কোটরে বসে গেছে, নাকটা সারস পাখীর ঠোঁটের মতো। মুখে একটাও দাঁত নাই। সারা শরীরে এক ছটাক মাংস নাই-হাড্ডিসার।
দালাল বলে, দেখ, এর ঘরে যেতে চাও?
মেয়েটি বলে, ঐ শকুনটা কী আমার মাংস ছিড়ে ছিড়ে খাবে? তারও তো উপায় নাই। দাঁত কই ওর? একটাও তো দেখছি না। বুড়োগুলোর শখ কেন? না, আমি যাবো না ওর ঘরে।
তারপর আর একজন উঠে দাঁড়ালো। লোকটা অপেক্ষাকৃত শক্ত সমর্থ কিন্তু দোষের মধ্যে ওর আজানুলম্বিত দাড়ি।
মেয়েটি বলে, বাঃ দাড়িটা বেশ মজার। একেবারে ছাগলের ল্যাজের মতো। মালিক বৃদ্ধকে বলে, না সাহেব আমার দ্বারা হলো নাএ হাটে হবে না। আপনি অন্য হাটে চেষ্টা করুন। আপনার বাঁদীর অনেক রকম ফিরিস্তি।
বৃদ্ধ হতাশ হয়ে মেয়েটিকে নিয়ে খচ্চরে চাপতে যায়। নূর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে ওকে। সত্যিই সুন্দরী সে। এমন সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে ঐ বুড়ো হাবড়াগুলো কী করতে চেয়েছিলো?
মেয়েটি বৃদ্ধের পিছনে পিছনে যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়ে নূরকে দেখে। তারপর বৃদ্ধকে বলে, আমার মনে হয় ঐ ছেলেটি আমাকে অপছন্দ করবে না।
বৃদ্ধ বলে, তা হলে সে ডাকলো না কেন? খোলা বাজারের নীলাম ডাকতে তো বাধা ছিলো না?
মেয়েটি বলে জানি না, তবে আমার মনে হচ্ছে, আমাকে দেখে ওর পছন্দ হয়েছে।
—কিন্তু সেধে তো তার কাছে যাওয়া যায় না। তাহলে দর পাওয়া যাবে না।
মেয়েটি বলে, ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি।
পায়ে পায়ে সে এগিয়ে আসে নূরের কাছে।
-কী? আমাকে তোমার পছন্দ হয়?
নূর বলে, পছন্দ নয় মানে? তোমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমি দেখিনি কোথাও।
—তবে নীলাম ডাকলে না কেন? তুমি ডাকলে আমি রাজি হয়ে যেতাম।
নূর বলে, আমি পরদেশী মিশরে আমার বাড়ি। তুমি যদি আমাদের শহরে নীলামে উঠতে, বাড়ি ঘর বাঁধা দিয়েও তোমাকে আমি কিনে নিয়ে যেতাম। কিন্তু এই বিদেশে তোমাকে আমি রাখবো কোথায়? খাওয়াবোই বা কী? আমার কাছে সাকুল্যে হাজারখানেক দিনার আছে।
মেয়েটি বলে, ঠিক আছে, ঐ হাজার দিনারই তুমি দর দাও। আমি তোমার হয়ে যাচ্ছি।
নূর কোমর থেকে হাজার দিনারের তোড়াটা খুলে পারসীটার হাতে তুলে দেয়।
কাজী আর সাক্ষীরা চুক্তিপত্র লিখে সই করে দেয়। মেয়েটি বলে এক হাজার দিনারের বদলে এই নওজোয়ানের কাছে স্বেচ্ছায় আমি যেতে রাজি হলাম।
উপস্থিত জনতা সাধু সাধু করে ওঠে, আল্লাহ ওদের দুজনকে দুজনের জন্য পয়দা করেছিলেন। খুব চমৎকার হলো।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো ঊনআশিতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :
মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে শহরের একটা বড়ো সরাইখানায় এসে ওঠে নূর। একখানা ঘর। ভাড়া করে। বলে, কী করবো, আমার কাছে পয়সা কড়ি নাই। তোমাকে একটু কষ্ট করেই থাকতে হবে। যদি আমার স্বদেশ কাইরো হতো, তবে তোমাকে প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে তুলতাম। কিন্তু আমি পরদেশ তাই জাঁকজমক কিছুই করা গেলো না।
মেয়েটি বলে, সে জন্যে তুমি অত মন খারাপ করছো কেন? আমার হাতের এই আংটিটা নিয়ে যাও। বাজারে বিক্রি করে কিছু ভালো খাবারদাবার আর একটু সরাব নিয়ে এস। আজ রাতটা আমরা ভালো করে খানাপিনা মৌজ মৌতাত করে কাটাবো। নাই বা হলো তোমার প্রাসাদ, এই সরাইখানাই আমাদের আজ মধুযামিনীর বাসর হয়ে উঠবে।
নূর আংটিটা নিয়ে বাজারে যায়। মোরগ মোসাল্লাম কাবাব কালিয়া কোর্মা বিরিয়ানী হালওয়া প্রভৃতি কিছু মুখরোচক খাবার এবং দামি খানিকটা মদ কিনে আনে। আর কেনে কিছু ফল ফুল এবং সুগন্ধী আতর গোলাপজল।
মেয়েটি ঘরটাকে পরিপাটি করে সাজিয়ে টেবিলে কাপড় বিছিয়ে বসেছিলো। খুব তৃপ্তি করে ওরা খেলো। তারপর একটা পেয়ালায় সরাব নিয়ে দুজনে চুমুক দিতে থাকলো।
আয়োজন অতি সামান্য, কিন্তু তাতে কোনও দুঃখ নাই। দুজনেই খুশির মেজাজে টৈটম্বুর হয়ে উঠতে পারলো।
সে রাতে মেয়েটি আর নূর অনেক আদর সোহাগ চুম্বনে দুজনে দু’জনকে ভরে দিলো।
সারারাত ধরে নানা আসনে ওরা ভালোবাসা করলো।
নূর এক সময় বললো, তোমার নামটা কিন্তু এখনও জানি না, বিবিজান। কোথায় তোমার দেশ, কেনই বা এই হাটে বিকাতে
এলে, বলবে না? ‘ মেয়েটি হাসে, বলবো, নিশ্চয়ই বলবো। আমার নাম মিরিয়াম।কনস্টাইটাইনের এক বিক্রমশালী সম্রাট আমার জন্মদাতা পিতা। ছোট থেকেই তিনি আমাকে পড়াশুনা, নাচ গান, সেলাইবোনা, শিল্পকর্ম প্রভৃতি নানা বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছেন। নিজের প্রশংসা নিজের মুখে শোভা পায় না, তবু বলছি, আমার মতো সূচের সুক্ষ্ম কারুকাজ খুব কম মেয়েই জানে। পাতলা রেশমীর কাপড়ে আমি বাহারী নক্সা তুলতে পারি। খুব দামী গালিচা পর্দা বানাতে পারি। সোনালী রূপোলী জরির কাজে আমার জুড়ি নাই। এ সবই আত্ম-প্রশংসা, কিন্তু বিশ্বাস করো, একটুও বাড়িয়ে বলছি না।
বাবা আমাকে অসূর্যস্পশ্যা করে অন্তঃপুরেই আটক রেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও আমার রূপের খ্যাতি নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। অনেক সম্রাট বাদশাহর ছেলেরা আমাকে শাদী করার জন্য বাবার কাছে প্রস্তাব রেখেছিলো। কিন্তু বাবা আমাকে কাছ ছাড়া করতে চায় না, তাই সবাইকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার আরও অনেক ভাই ছিলো, কিন্তু কন্যা বলতে আমি বাবার একমাত্র আদরের দুলালী। আমার ভাইদের চেয়েও আমাকেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন।
একসময় আমার কঠিন অসুখ করে। বাবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালেন, আমি যদি সেরে উঠি, তিনি আমাকে আমাদের সবচেয়ে বড় গীৰ্জামঠে তীর্থ করতে নিয়ে যাবেন।
বাবার এই আকুল আবেদন বুঝি ঈশ্বর শুনেছিলেন। তিনি আমাকে সুস্থ করে তুললেন। মানত রক্ষার জন্য বাবা আমার ধাইমাকে সঙ্গে দিয়ে সাগর পারের সেই গীর্জামঠে তীর্থ করতে
পাঠালেন। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, মুসলমান জলদস্যুরা আমাদের জাহাজে হানা দিয়ে নির্মমভাবে খুন জখম লুটতরাজ করলো। ওদের ঐ গগনভেদী গর্জনে এবং উদ্যত অসির তর্জনে আমি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ি। তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম আমি এক ডাকাত দলের হাতে বন্দী। আমার মতো আরও অনেক সুন্দরী মেয়েকে ওরা এক খোঁয়াড়ে পুরে রেখেছিলো। পরে শুনলাম, বাঁদী-হাটে আমাদের বিক্রি করা হবে। এর কয়েকদিন পরে ওরা আমাদের মিশরের বাজারে এনে বেচে দিয়ে গেলো।ঐ বাজার থেকে এই বুড়ো পারসী বণিকটি আমাকে সওদা করে এনেছিলো। মুসলমান ভকাতগুলো কিন্তু আমাদের কারুরই অঙ্গ স্পর্শ করেনি। শুনেছিলাম এটা ওদের পবিত্র ব্যবসা বলে মনে করে। জীবিকার বেশাতি নিয়ে ওরা ব্যভিচার করে না কখনও। আর ঐ পারসী বুড়োটা ধ্বজভঙ্গের রুগী। ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্যে কুলায়নি। এই পারসী লোকটির কিছুদিন আগে, বিমার হয়েছিলো। আমি আমার সাধ্যমতো সেবা যত্ন করে ওকে সারিয়ে তুলি। তারই কৃতজ্ঞতায় সে আমাকে বলেছিলো, তোমার জন্যে আমি সেরে উঠলাম।খুব খুশি হয়েছি। বলো তুমি কী চাও?
আমি বললাম, চাই না কিছুই। আপনি আমাকে আমার পছন্দমতো খদ্দেরের কাছে বেচে দেবেন—এই একমাত্র ইচ্ছা। আমি কোনও বুড়ো হাবড়ার ঘরে যেতে চাই না।
পারসী বললো, বেশ, তাই হবে। সেইজন্যেই দেখেছো, আমি যখন বাঁদী হাটে তিন বুড়োকে নাকচ করলাম, পারসী কিন্তু একটুও গোসা করেনি।
নূর বললো, হ্যাঁ, তা আমি নজর করেছি।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশোতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?
পরদিন থেকে মিরিয়ামের ইসলামের পাঠ গ্রহণ শুরু হয়। মিরিয়াম বলে আমি খ্রষ্টান-পরিবারে জন্মেছি। কিন্তু এখন আমি তোমার সহধর্মিণী। তোমার কর্মই আমার কর্ম, তোমার ধর্মই আমার ধর্ম। কিন্তু আমি তো ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই জানি না নূর, তুমি আমাকে সব শেখাও।
নূর বলে, ইসলাম খুব সহজ ধর্ম। কোনও ঘোর পঁাচ কিছুনাই। আজ হোক, কাল হোক, সারা দুনিয়ার মানুষ এর মহত্ত্ব একদিন উপলব্ধি করতে পারবেই। আজ যারা অন্ধকারে নিমজ্জিত আছে, ভবিষ্যতে ইসলামের আনুগত্যে এসে তারা আলোর মুখ দেখতে পাবে—এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। যদি তুমি ম্লেচ্ছ খ্রীস্টান ধর্মের অক্টোপাশ থেকে মুক্তি পেতে চাও, আমি তোমাকে সর্বান্তঃ করণে সাহায্য করবো। তবে তার আগে তোমাকে মেনে নিতে হবে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই। এবং মহম্মদই একমাত্র পয়গম্বর। শুধু এই বিশ্বাস যদি মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পার তাহলেই তুমি সাচ্চা মুসলমান হতে পারবে।
তৎক্ষণাৎ সম্রাট-কন্যা মিরিয়াম দুহাত জোড় করে উচ্চারণ করলো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও ঈশ্বর আমি মানি না—বিশ্বাস করি না। আল্লাহই একমাত্র সর্বশক্তিমান। মহম্মদ তার পয়গম্বর।
নূর আনন্দে জড়িয়ে ধরে মিরিয়ামকে, মিরিয়াম, এই মুহূর্ত থেকে তুমি মুসলমান হয়ে গেলে।
এর পর ওরা গোসলাদি সেরে খানাপিনা করলো।নূর যতই বেশি করে দেখছে মিশছে, ততই সে অবাক হচ্ছে মিরিয়ামের আচার আচরণ জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দীক্ষা রুচি প্রকৃতি দেখে।
সেদিন ছিলো জুম্মাবার। নূর বললো চলো, আজ আমরা মসজিদে গিয়ে নামাজ করবো।
মিরিয়াম খুশিতে নেচে ওঠে। এই প্রথম সে মসজিদ দেখবে।
এদিকে কনস্টানটাইন সম্রাট খবর পেলেন তার প্রাণাধিক কন্যাকে মুসলমানরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দিকে দিকে তিনি অশ্বারোহী সৈন্যদল পাঠালেন।
-যেখান থেকে পার, যেমন করে পার আমার মিরিয়ামকে উদ্ধার করে আনা চাই-ই। কিন্তু যারা সন্ধানে গেলো একদিন তারা শূন্য হাতেই ফিরে এলো সম্রাটের কাছে।
-নাঃ, কোথাও সন্ধান পাওয়া গেলো না, মহামান্য সম্রাট।
সম্রাটের গুপ্তচর বাহিনীর বড়কর্তা বললো, আমি গোপনে গোপনে তলাশ করার ব্যবস্থা করছি। লোক-জানাজানি হয়ে গেলে শয়তানরা তাকে লুকিয়ে রাখবে।
চৌকস সেয়ানা অথচ খুব ছোট্ট বেঁটে খাটো একটি বৃদ্ধা তার বুদ্ধি এবং কৌশলের জন্য গুপ্তচর বাহিনীর প্রধানের খুব প্রিয়পাত্রী ছিলো। বড়সাহেব তাকেই নির্বাচন করলো মিরিয়ামকে খুঁজে বের করার কাজে।ঠিক করা হলো এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির গুপ্তচরটাকে মুসলমান মুলুকে পাঠানো হবে।
সম্রাট তাকে বললেন, যদি তুমি কৃতকার্য হয়ে ফিরে আসতে পার, মেয়ে, তবে আমি তোমাকে সোনা দিয়ে মুড়ে দেব। কিন্তু যদি না পার, তবে তোমাকে সাপের ইঁদারায় ফেলে দেওয়া হবে, মনে থাকে যেন।
বুড়ি মাথা নুইয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বলে, তাই হবে মহামান্য সম্রাট, আপনার কন্যা রাজকুমারী মিরিয়ামকে যদি আমি ফিরিয়ে আনতে না পারি, তাতে যে সাজা আমাকে দেবেন, মাথা পেতে নেব।
বুড়িটা এক চোখে ফেটি বাঁধলো, পায়ে কাপড় জড়ালো। তারপর জনাকয়েক সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নানা দেশের নানা শহর বন্দর ঘুরতে ঘুরতে একদিন আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে হাজির হলো।
আলেকজান্দ্রিয়ার পমপি মিনার বিশ্ববিখ্যাত। একদিকে এটা যেমন মুসলমানদের তীর্থস্থান, আর একদিকে এক মনোহর পরিবেশ এবং মিনার সৌধের অপরূপ কারুকলা দেশ-বিদেশের মুসাফিরদের কাছে এক উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ।
মিরিয়াম বিকাল বেলায় প্রায় প্রতিদিন পবিত্র পমপি মিনারের পাদদেশে এসে মুক্ত বায়ু সেবন করে। সেদিনও সে একা একাই বসে প্রকৃতির মনোরম শোভা প্রত্যক্ষ করে পুলকিত হচ্ছিলো, এমন সময় সেই গুপ্তচর বুড়ি ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে মিরিয়ামের দেখা পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো।
বুড়িটা কাছে এগিয়ে গিয়ে রাজকুমারীকে অভিবাদন জানিয়ে তার হাতে চুম্বন করে।
হঠাৎ এক অপরিচিত নারী খ্রীষ্ট-কেতায় তাকে অভিবাদন এবং চুম্বন করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মিরিয়াম।
—কে তুমি ম্লেচ্ছ, শয়তান, কুত্তার বাচ্চা। জান না, এ আমাদের পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে তোমাকে কে ঢুকতে দিয়েছে? বেরিয়ে যাও বলছি।
বুড়িটা কিন্তু রাগ করে না। আরও বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে, আপনি আমার ওপর ক্রুদ্ধ হবেন না রাজকুমারী! আপনার পিতা আপনার অদর্শনে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। আপনার মাতা কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী। এ অবস্থায় আপনি যদি আপনার পিতার কাছে ফিরে না যান, হয়তো ঈশ্বর জানেন, কী ঘটবে।
মিরিয়াম ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, যা ঘটে ঘটুক, আমি যাবো না। এখন এই আমার দেশ, এই আমার স্বজন-ভূমি। আমি ইসলামে দীক্ষা নিয়েছি। এখন আমার একমাত্র বিশ্বাস ইসলামই সত্য, আর সব মিথ্যা। আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করি না আমরা। তুমি ফিরে যাও। সম্রাটকে গিয়ে বলল, আমি খুব সুখে আছি। এবং ইসলামে দীক্ষা নিয়েছি। খ্রীষ্ট সাম্রাজ্যে আর ফিরে যাবো না।
—কিন্তু ফিরে যে আপনাকে যেতেই হবে, রাজকুমারী। খালি হাতে ফিরে যেতে পারবো না আমি। ওয়াদা আছে, আপনাকে নিয়ে তবে দেশে ফিরতে পারবো। তা না হলে আমাকে সাপের ছোবলে মরতে হবে। কিন্তু একবার যখন আপনার সন্ধান পেয়েছি—কেন আর প্রাণটা খোয়াবো। আপনাকে না নিয়ে আমি ফিরবো না। এখনও মিনতি করছি, আমার কথা শুনুন, দেশে ফিরে চলুন।
মিরিয়াম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, ওরে কুত্তার বাচ্চা, আমার সামনে থেকে যাবি কিনা বল, না হলে এখুনি চিৎকার করে তোক জড়ো করবো। কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো।
মিরিয়াম চিৎকার করতে যাবে, এমন সময় বুড়ির ইশারায় তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা এসে তাকে ঘিরে ধরে। খবরদার, একটুও শব্দ করবে না। তা হলে এই যে দেখছো ঝকঝকে ছুরি, একেবারে আমূল বসিয়ে দেব বুকে।
হঠাৎ এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলো না মিরিয়াম। হতচকিত হয়ে পড়ে সে। সেই ফাঁকে সাঙ্গ-পাঙ্গরা মিরিয়ামের মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে হন হন গতিতে বন্দরের দিকে ছুটে চলে।
জাহাজ প্রস্তুত ছিলো। মিরিয়ামকে তোলামাত্র নোঙর তুলে ছেড়ে দিলো কাপ্তান। জাহাজ ভেসে চললো কনসতানতাইন-এর দিকে।
নূর সরাইখানায় মিরিয়ামের ফেরার পথ চেয়ে বসেছিলো। প্রতিদিন বিকেলে সে বেড়াতে যায় পমপি মিনারে। এবং ফিরে আসে সন্ধ্যার আগেই। কিন্ত আজ এত দেরি হচ্ছে কেন? অন্ধকার নেমে এলে তো পমপিতে কাউকে থাকতে দেয় না? তবে?
মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে সে সরাইখানা ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে। একে ওকে জিজ্ঞেস করে। একজন বলে,জনাকয়েক লোক একটি সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে জাহাজঘাটের দিকে গেছে কিছুক্ষণ আগে।
অজানা আশঙ্কায় নূর-এর বুক কেঁপে ওঠে। ছুটতে ছুটতে বন্দরে আসে। খবর পায় এটা খ্রীষ্টান জাহাজ এইমাত্র ছেড়ে চলে গেলো। কতকগুলো লোক একটা মেয়েছেলেকে জোর-জবরদস্তি করে জাহাজে তুলেই ছেড়ে দিয়েছে। কেন, কী হয়েছে?
নূর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, বিধর্মী ম্লেচ্ছরা আমার বিবিকে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।
—ওই মেয়েটি তোমার বিবি?
—জী হ্যাঁ। জাহাজটা কোথায় যাবে বলেছে কিছু?
-না। তবে জাহাজের নিশান পতাকা দেখে তো আমার চিনতে কোনও অসুবিধে হয় না—ওটা কনসনতাইনের জাহাজ।
—সর্বনাশ। ওরা তবে নির্ঘাৎ আমার বিবিকে নিয়েই পালিয়েছে।
কান্নায় ভেঙে পড়ে নূর। লোকটি বলে, আহা কেঁদ না, বাছা! আমি তোমার বিবিকে উদ্ধার করে দেব। ঐ দেখছো, দাঁড়িয়ে আছে আমার জাহাজ—ওই জাহাজের কাপ্তান আমি। আমার সঙ্গে একশোজন সাচ্চা মুসলমান কর্মচারী আছে। ইসলাম বিপন্ন, সুতরাং আর তো মুখ বুজে সহ্য করা যায় না। চলো, আমার জাহাজে ওঠ। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি ধাওয়া করবো ওদের। ব্যটারা পালাবে কোথায়? ধরবোই।
কাপ্তান তার একলোজন দাঁড়ি-মাল্লাদের বললো, খুব জোরসে চালাবে। সামনের ঐ কুত্তার বাচ্চাদের ধরতেই হবে।
নুরকে নিয়ে সে জাহাজ ছেড়ে দিলো। কিন্তু দিনের পর দিন তাড়া করে চলার পরও কনসনতাইন-সম্রাটের জাহাজখানা আর কিছুতেই ধরতে পারে না। নূর হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। কাপ্তান ওকে ভরসা দেয়, ঘাবড়াবার কিছুনাই। সমুদ্রে না পারি ডাঙ্গাতেও ধরবো। আমরা একসোজন আছি। সাচ্চা মুসলমানের সন্তান। আমাদের হাত থেকে নিস্তার পাবে না কাফেররা।
একান্ন দিন পরে জাহাজ ভিড়লো কনসনতাইনের বন্দরে। কিন্তু তীরে নামার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের সৈন্যবাহিনী ঘিরে ফেললো ওদের। নূরসহ বন্দী হলো সবাই।
সম্রাট ওদের কারাগারে নিক্ষেপ করলেন।
এই ঘটনার আগের দিন মিরিয়ামকে এনে সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছে সেই ‘গুপ্তচর।
মেয়েকে ফিরে পেয়ে সম্রাটের সে কি আনন্দ! সারা প্রাসাদ, সারা শহর আলোর মালায় সাজানো য়েছিলো। শহরের পথে পথে বসানো হয়েছিলো বিজয়তোরণ। আজ দেশবাসীর মহা আনন্দের দিন। অনেক দিন পরে সম্রাট প্রাণ খুলে হেসেছেন। তাই প্রজারাও বিশেষ পুলকিত।
মহারাণী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মা, তোকে ঐ যবনরা কিছু করেনি তো।
মায়ের কথায় মিরিয়াম হাসে, তুমি কী যেন বল মা। মুসলমানরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো কী শুধু মুখ দেখার জন্য? তুমি কী জান না, ইসলামে কোনও পরিণত-বয়স্কা নারী কুমারী থাকে না। মাসিক-ধর্ম শুরু হওয়ার পর মুসলমান মেয়েরা কুমারী থাকলে পাপ হয়। সুতরাং আমি ইসলামে দীক্ষা নেবার পর কী করে কুমারী থাকতে পারি, বলো?
মা কেঁদে আকুল হয়, ও কী কথা বলছিস খুকী, আমরা তো খ্রীষ্টান।
-তোমরা তো নিশ্চয়ই খ্রীষ্টান মা। যতদিন তোমাদের কাছে ছিলাম, আমি খ্রীষ্টানই ছিলাম। কিন্তু এখন আমি মুসলমান।
মহারাণী শিউরে ওঠেন, চুপ কর মা, ওকথা বলতে নাই। কেউ শুনতে পেলে কেলেঙ্কারী হবে।
কিন্তু মা গোপন করতে চাইলেও এত বড় সত্যি কথাটা গোপন রইলো না। সারা শহরে, দেশের প্রজাদের কানে কানে রটে গেলো। সম্রাট-নন্দিনীকে মুসলমানরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে তার সর্বনাশ করে দিয়েছে। যবনরা রাজকুমারীকে জোর করে মুসলমান-ধর্মের কলমা পড়িয়ে সহবাস সঙ্গম করেছে।
কথাটা সম্রাটও শুনলেন। মন্ত্রী যুক্তি দিলো, আপনি বড় গীর্জার পাদরীমাতার সঙ্গে পরামর্শ করুন, ধর্মাবতার। তিনি আপনাকে নিশ্চয়ই বিধান বলে দিতে পারেন।
পাদরী-মাতা সব শুনে বললেন, হুঁ, বিধর্মীরা রাজকুমারীর সতীত্ব অপহরণ করেছে। ঠিক আছে, আমি ওকে পুনরায় খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষা দেব। তবে একটি কাজ করতে হবে।
সম্রাট করজোড়ে বললেন, আজ্ঞা করুন মাতা।
-দীক্ষার পূর্বে কন্য মিরিয়ামকে একশোটি মুসলমানের রক্তে স্নান করিয়ে ওর সব অতীত পাপ ধুয়ে ফেলতে হবে।
সম্রাট বললো, সদ্য শতাধিক যবন বন্দী হয়েছে আমার সেনাবাহিনীর হাতে। তারা আমার কারাগারেই আছে। আপনি আজ্ঞা করলে আজই আমি শত-যবনের রক্ত সংগ্রহ করতে পারি।
পাদরী-মাতার ইচ্ছায় এবং সম্রাটের আদেশে নূর-সহ জাহাজের একশো খালাসী কর্মচারীদের হাজির করা হলো। সম্রাটের পাশে বসেছিলেন বৃদ্ধা পাদরী-মাতা। ঘাতক সকল বন্দীদের সারি বন্দী করে দাঁড় করালো। হাতে শাণিত তলোয়ার। সম্রাটের সামনে একটা
হাড়িকাঠ। তার নিচে পাতা ছিলো একটা বিরাট গামলা। তিনি হুকুম দেওয়া মাত্র এক এক জনকে ধরে এনে হাড়িকাঠে ঢুকিয়ে সাবাড় করতে থাকলো। এইভাবে গামলাটা রক্তে পূর্ণ হতে থাকে। এক এক করে একশোটা নরবলি সংঘটিত হওয়ার পর একশো একতম কয়েদী নূরকে দাঁড় করানো হয় হাড়ি কাঠের সামনে।
পাদরীমাতা সম্রাটকে বললো, সম্রাট, একশোটি যবনের রক্ত ধরা হয়ে গেছে। রাজকুমারীর শুদ্ধি-স্নানের জন্য এই রক্তই যথেষ্ট। আর প্রয়োজন নাই। এই যুবকটিকে আমি আমার গীর্জার প্রহরী হিসাবে নিযুক্ত করতে চাই।
সম্রাট বললেন, তাই তো, আমি অতটা খেয়াল করিনি। ঠিক আছে, আপনার যদি অভিরুচি হয় তবে নিয়ে যান ওকে। আমার কোনও আপত্তি নাই।
রাজকুমারীকে নতুন করে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করার পর পাদরী-মাতা প্রিয়দর্শন নূরকে সঙ্গে নিয়ে গীর্জায় ফিরে আসে।
নুর বুঝতে পারে না। কেনই বা তাকে হাড়িকাঠে হত্যা করা হলো না, কেনই বা তাকে মুসলমান জেনেও গীর্জায় নিয়ে আসা হলো।
পাদরী-মাতা বললো, শোনো যুবক, তোমার রূপ-যৌবন এবং ভাগ্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।
নূর বলে, আমার রূপ আছে—অনেকেই বলে। যৌবন যে আছে তা আমিও অনুভব করতে পারি। কিন্তু ভাগ্য? আমি যে ভাগ্যবান—সে কথা আমার অতি বড় আপনজনও বলবে না। কিন্তু আপনি আপনাকে ভাগ্যবান দেখলেন কী ভাবে? সত্যিই যদি আমার সৌভাগ্য হবে, তবে কী আজ আমার চোখের মণি, বুকের কলিজাকে হারাতে হয়? এবং তারই সন্ধানে এসে সম্রাটের রোষানলে পড়ে অন্ধকার কারায় পচে পচে মরতে হয়?
পাদরী মাতা বলে, জানি না কে তোমার চোখের মণি, বুকের কলিজা এবং কী করেই বা তাকে হারিয়েছ, তাও আমার অজানা। কিন্তু তুমি যে সম্রাটের কারাগারে একশো একতম মুসলমান বন্দী হতে পেরেছ সেই জন্যেই বলছি, তুমি পরম ভাগ্যবান। তা না হলে এতক্ষণে তোমার কাটা মুণ্ডু গড়াগড়ি যেত।
নূর বুঝতে পারে না। বলে, কারণ?
—কারণ, সম্রাট-নন্দিনীকে মুসলমানরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো। তাকে এখন উদ্ধার করে আনা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানেরা তার ধর্ম এবং সতীত্ব দুইই কেড়ে নিয়েছিলো। তাই আবার নতুন করে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দেবার জন্য আমি তাকে শত যবনের রক্তে স্নান করিয়ে পবিত্র হতে বিধান দিয়েছিলাম। সেই জন্যেই আজ একশোটি মুসলমানকে কেটে তাদের রক্ত সংগ্রহ করা হলো। আমি আশ্চর্য হলাম। তুমি ঐ একসোজনের একজন হলে না। তাই আমার মনে হলো, তুমি পরম ভাগ্যবান। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। এখন বলতে বেটা, তুমি কে! আর কেনই বা সম্রাটের কয়েদখানায় তুমি বন্দী হয়েছো? তোমাকে দেখে তো মনে হয় না, কোনও অপরাধ তুমি করতে পার?
নূর বলে, আপনি মহামান্য মাতা, আমার সব দুঃখের কাহিনী বলতে কোনও বাধা নেই। সম্রাট-নন্দিনী মিরিয়ামকে তার স্বইচ্ছায় আমি শাদী করেছি। সে ইসলামে দীক্ষা নিয়েছে। কিন্তু সেজন্য তার ওপর কোনও বল প্রয়োগ করা হয়নি, বিশ্বাস করুন। সে নিজে থেকেই মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। সম্রাটের গুপ্তচর আমার বিবিকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে এখানে, তাকে উদ্ধার করতেই আমি এখানে এসে সম্রাটের সেনার হাতে বন্দী হয়েছি। সে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে চাই না। তাই আজ যদি ঘাতকের ঘায়ে মারা যেতাম, সেই বুঝি আমার ভালো হতো।
নুরের গাল বেয়ে দুটো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
পাদরী-মাতা বিচলিত হয়ে পড়েন।
-আমি বুঝতে পারি, তোমার কী মর্মবেদনা। ভালোবাসা কোনও জাতি ধর্ম মানে না। মিরিয়াম যে তোমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো, সে কথাও আমি বিশ্বাস করি। যাই হোক, আজ রাতে মিরিয়াম গীর্জায় বাতি জ্বালাতে আসবে। সে-সময় তার সঙ্গে আমি তোমার দেখা করিয়ে দেব। দেখ, যদি এখনও সে তোমার প্রতি আসক্ত থাকে তবে আমি আর তাকে জোর করে এখানে আটকে রাখার পক্ষপাতী নই। নদীকে সহজ ভাবেই তার স্রোতে বয়ে যেতে দিতে হয়।
পাদরী-মাতা বলে, শোনো তোমাকে আমি এখানে এনেছি গীর্জার প্রহরী করবো বলে। কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য তা নয়। আমি তোমাকে পাদরীর বেশবাস এনে দিচ্ছি। তুমি এই মুসলমানী পোশাক ছেড়ে ফেলে ওগুলো পরে নাও। তাতে তোমার সুবিধে হবে।
সন্ধ্যাবেলায় মিরিয়াম আসে। গীর্জার বেদীতে মোমবাতি জ্বালিয়ে চলে যেতে পা বাড়ায়। পথরোধ করে দাঁড়ায় নূর। সামান্য এক পাদরীর দুঃসাহস দেখে অবাক হয় মিরিয়াম। ক্রোধান্বিত হয়ে সে পাদরীর মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু কেমন বিচলিত হয়ে পড়ে। অনেক কটু কথা বলবে ভেবেছিলো, কিন্তু সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যায়। কিছুই বলতে পারে না। শুধু বলে পথ ছাড়ুন।
নূর হাসে। মিরিয়াম অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, এই হাসি তো তার চেনা। তা কী করে হয়? পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয় সে। নুর হাত বাড়ায়, পথ যখন রুখে দাঁড়িয়েছি, যেতে যদি হয়ই দলে যাও—পাশ কাটিয়ে যেও না মিরিয়াম?
—সে কি নুর, তুমি–?
মুহূর্তে বিশ্ব-সংসার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। তারপর আর কিছুই মনে থাকে না। যখন সম্বিত ফিরে পায়, দেখে, নূরের কাধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে।
পাদরী-মাতা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব প্রত্যক্ষ করছিলো। এবার কাছে এসে বললো, আমি সব বুঝতে পারলাম, নূর। তুমি এক বর্ণও বাড়িয়ে বলনি। এ অবস্থায় মিরিয়ামকে যদি জোর করে খ্রষ্টান বানিয়ে আটকে রাখা হয়, যীশু আমাদের ক্ষমা করবেন না। তাই ঠিক করেছি, আমি তোমাদের সাহায্য করবো। মিরিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে তুমি আজই রাতে এদেশে থেকে পালিয়ে যাও। না হলে হয়তো সবই হারাতে হবে।
মিরিয়াম বলে, কিন্তু সম্রাটের এই কড়া পাহারা ভেদ করে নুর আমাকে নিয়ে পালাবে কি করে?
পাদরী মাতা বলে, আমি সে ব্যবস্থা করে দেব। আমার এক ভক্ত অনুচর সম্রাটের নৌবাহিনীর একজন,কাপ্তান। আমি তাকে বলে রাখছি, কাল খুব ভোরে তোমরা বন্দরে যাবে। কাপ্তান তার জাহাজে তোমাদের তুলে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে দেবে। কিন্তু খেয়াল রেখো, সে নিজে থেকেই তোমাদের নাম ধরে ডাকবে।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো তিনতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
পাদরী-মাতাকে অভিবাদন জানিয়ে মিরিয়াম প্রাসাদে চলে যায়। নূর রয়ে যায় গীর্জাতেই। পাদরী-মাতা তাকে পাথেয় হিসাবে কিছু খাবারদাবার এবং প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা এনে দেয়। বলে, এগুলো সঙ্গে রাখ, অনেক দিনের পথ। প্রয়োজন হবে। এই ঘরেই তুমি শোবে। খুব ভোরে তোমাকে আমি ডেকে ফটকের বাইরে বের করে দেব।
গীর্জার সদর ফটক থেকে জাহাজঘাট খুবই কাছে। পাদরী-মাতা নুরকে ফটক পার করে দেয়। নূর বন্দরে এসে দেখে, একখানা ছোট্ট জাহাজ ছাড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের পাটাতনে দশজন খালাসী এবং কাপ্তান। মনে হয় নূরেরই প্রতীক্ষা করছিলো তারা। কাছে যেতেই কাপ্তান জিজ্ঞেস করে তোমার নাম?
-আমার নাম নূর।
—উঠে এসো।
খালাসীদের হুকুম দিলো কাপ্তান, নোঙর তোলা।
খালাসীরা অনেকেই বিস্ময়াহত। এ জাহাজে স্বয়ং মন্ত্রীর যাবার কথা ছিলো। কিন্তু এতে এক পাদরী দেখছি।
কাপ্তান গর্জে ওঠে, জাহাজের কাপ্তান তোমরা, না? আমি?
একজন সামনে এসে প্রতিবাদ জানাতে যায়, কিন্তু আপনিই বলেছিলেন, জাহাজ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হও, এখুনি মন্ত্রীমশাই আসছেন। তিনি মিশরের উদ্দেশে রওনা হবেন। আমাদের রাজকুমারীকে যেসব মুসলমান দস্যুরা অপহরণ করেছিল—তাদের মোকাবিলা করতে যাবেন তিনি।
কাপ্তান তরবারি উন্মুক্ত করে বলে, জাহাজের শৃঙ্খলাভঙ্গ করার অপরাধে এই তোমার সাজা।
এবং সঙ্গে সঙ্গেই খালাসীটার মুণ্ডু পাটাতনে লুটিয়ে পড়ে। এতে বাকী নয়জন ক্রুদ্ধ হয়ে কাপ্তানকে ঘায়েল করার জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু কাপ্তানের তরবারি এক এক কোপে এক এক জন পাটাতনশায়ী হয়ে পড়ে।
এর পর সে নিজেই নোঙর তুলে জাহাজ ছেড়ে দেয়। হাওয়ার গতি ছিলো পালের অনুকূলে। ক্ষুদে জাহাজখানা তরতর করে বয়ে চলতে থাকে আলেকজান্দ্রিয়া অভিমুখে।
নূর তখন থর থর করে কাপছিলো। একসঙ্গে এতগুলো খালাসীকে কেটে ফেলেও কিন্তু কাপ্তান সাহেবের মুখে কোনও উত্তেজনা অস্থিরতা নাই। ব্যাপারটা যেন কিছুই না—এই রকম ভাবখানা।
নূর ভয়ে ভয়ে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না। কী জানি লোটার কী মতলব! হয়তো মাঝ দরিয়ায় ছুঁড়েই ফেলে দেবে তাকে। কিংবা ঐ তলোয়ারের এক ঘায়ে-না না, সে কথা ভাবতে পারে না নূর, ভাবতে চায় না।
তবে সে একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছে, কাপ্তানের কোনও সৎ উদ্দেশ্য নাই। তা না হলে, সে রাজকুমারী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই জাহাজখানা ছেড়ে দিলো কেন? সম্রাটের গুপ্তচর নয় তো? মিরিয়ামের সঙ্গে যখন তার যে গোপন পরামর্শ হয়—জাহাজঘাটায় যাবে খুব ভোরে, ওখানে জাহাজ প্রস্তুত থাকবে—সে কথা কী সম্রাটের কানে পৌঁছে দিয়েছিলো কেউ? হতে পারে। হয়তো ঐ বুড়ি পাদরী-মাতারই এই কারসাজী।
-এই যে পাদরী সাহেব, অমন মনমরা হয়ে বসে বসে কী ভাবছে ওখানে? এদিকে আমার কাছে এস। একটু গল্প সল্প করি।
কাপ্তানের গলায় যেন কেমন ব্যঙ্গের সুর। নূর ঢোক গিলে বলে, না, মানে এমনিই পানির শোভা দেখছি।
—সে তো এখানে বসেও দেখতে পারবে পাদরী সাহেব। এস, এখানে এস।
নূর আর না করতে পারে না। কে জানে হয়তো এখুনি হুট করে রেগে উঠে গলাটা কুচ করে নামিয়ে দেবে।
নূর ওর কাছে গিয়ে বসে। কাপ্তান বলে, আমরা কোথায় যাচ্ছি জানো?
-না। তবে যাওয়ার কথা ছিলো আলেকজান্দ্রিয়া। এখন আপনার মর্জি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যেতে হবে।
-কেন, তোমার মনে কোনও সন্দেহ হচ্ছে নাকি?
-না, মানে—রাজকুমারী মিরিয়ামের আসার কথা ছিলো। সে কথা কি আপনি জানতেন না?
—কেন জানবো না? তার হুকুমেই তো তোমাকে নিয়ে চলেছি।
নূর বলে, কিন্তু তার আসা পর্যন্ত তো অপেক্ষা করলেন না? এ জাহাজে আমার সঙ্গে তারও তো যাওয়ার কথা ছিলো।
কাপ্তান চোখ পাকিয়ে ওঠে, কথা ছিলো? রাজন্যাকে চুরি করে পালাবে ভেবেছিলে? জান, তুমি কোথায়, আর কার সাম্রাজ্যে দাঁড়িয়ে এইসব ষড়যন্ত্র এঁটেছিলে? সম্রাটের লাজুক কন্যাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবার মতলব করেছিলে?
—মোটেও না। আমি কাউকে ভাগাবার জন্য কোনও ফন্দী ফিকির করিনি। রাজকুমারী মিরিয়াম আমার শাদী করা বিবি। সম্রাটই ছল করে আমার বিবিকে চুরি করে এনেছে। আমি তাকে উদ্ধার করতে এসেছিলাম।
কাপ্তান বলে, কিন্তু রাজকুমারী তো তার ভুল বুঝতে পেরে আবার খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে।
—মিথ্যে কথা। জোর করে তাকে খ্রীষ্টান করা হয়েছে। আমি জানি, ওতে কেউ খ্রীষ্টান হয়। কারণ পয়গম্বর যীশু বলেছেন, কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে খ্রীষ্টান করা পাপ।
কাপ্তান বলে, তা হলে এখন কী করবে? রাজকুমারী তো ধোঁকা দিয়ে তোমাকে আলেকজান্দ্রিয়ায় পাঠিয়ে দিচ্ছে।
নূর বললো, আমি মিরিয়াম ছাড়া জীবন ধারণ করবো না। আপনার পায়ে পড়ি, কাপ্তান সাহেব, আলেকজান্দ্রিয়ায় আমি একা ফিরে যাবো না। আপনি আমাকে কনসতানতাইনের বন্দরেই ফিরিয়ে নিয়ে চলুন। সেখানে আমি সম্রাটের বন্দী হয়েই প্রাণ হারাতে চাই। তবু মিরিয়াম-বিহীন জীবন আমি রাখবো না।
কাপ্তান হাসে, সামান্য একটা ম্লেচ্ছ নারীর জন্য তুমি প্রাণ দেবে?তুমি না সাচ্চা মুসলমানের সন্তান?
নূর প্রতিবাদ করে, মিরিয়াম সামান্যা নারী নয়। এবং সে বিধর্মীও নয় কাপ্তান সাহেব। সে আমার সহধর্মিণী। দোহাই আপনার, জাহাজ ফেরান। আমাকে কনসনতাইনে ফিরিয়ে নিয়ে চলুন। না হলে, এই দরিয়ার পানিতেই আমি ঝাপিয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দেব।
উত্তেজনায় অধীর হয়ে ওঠে নূর। সে আর ধরে রাখতে পারে না নিজেকে। সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেবার জন্য ঝুঁকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কাপ্তান ওকে ধরে ফেলে। জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে।
কিন্তু একি!নূর বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ মেলে কাপ্তানের মুখের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে। কাপ্তান খিল খিল করে হেসে ওঠে। কী আশ্চর্য, হঠাৎ কাপ্তানের গলার আওয়াজ মধুর হয়ে গানের মতো বেজে ওঠে।
—মিরিয়াম তুমি?
কাপ্তান নকল দাড়ি গোঁফ টেনে খুলে ফেলে দেয়। মাথার পাগড়ী নামিয়ে রাখে।
সেই মিরিয়াম-তার চোখের মণি বুকের কলিজা। খিল খিল করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সে। নূরের গালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলে, খুব যাতনা দিয়েছি, না, সোনা?
নূর-এর মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে, তামাশারও একটা সীমা থাকা দরকার, মিরিয়াম। তুমি কী জান না, আমার মনের অবস্থা কী। আমি যদি এই দরিয়াতেই ঝাপিয়ে পড়ে আত্মঘাতী হতাম
—আমি হতে দিলে তো? এবারে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে নূরের অধরে ধীর্ঘ চুম্বন করে মিরিয়াম।
নূর জিজ্ঞেস করে, কিন্তু পাদরী-মাতা তো আমাকে বলেছিলেন, তার এক শিষ্য কাপ্তান একখানা ছোট জাহাজ নিয়ে বন্দরে অপেক্ষা করবে? তুমি কী করে এলে এই বেশে।
মিরিয়াম বলে, এ সবই পাদরী-মাতার দৌলতেই সম্ভব হয়েছে, নূর। তাকে আমার শতকোটি সালাম। তিনি সাহায্য না করলে আমার বাবার শ্যেন দৃষ্টি কঁকি দিয়ে এভাবে পালানো একেবারেই সম্ভব ছিলো না।
বাবাকে বলে তিনিই আমাকে গত রাতে গীর্জায় নিয়ে এসেছিলেন। প্রভু যীশুর কাছে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য সারা রাত ধরে আমাকে দীপ জ্বালাতে এবং উপাসনা করতে হবে—এই রকম বলে তিনি আমাকে প্রাসাদ থেকে নিয়ে এসেছিলেন।
মিরিয়াম বলতে থাকে : এই জাহাজের আসল কাপ্তান সত্যিই পাদরী-মাতার একান্ত অনুরক্ত শিষ্য। এখন সে ঐ গীর্জারই একটা ঘরে আত্মগোপন করে আছে। আমাকে তার সাজ-পোশাক পরিয়ে দিয়েছিলেন মাতা। এবং এই যে গোঁফ দাড়ি দেখছে—এও তিনি লাগিয়ে দিয়েছিলেন আমার মুখে। এমন নিখুঁতভাবে ছদ্মবেশে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যে, খালাসীরা দেখে নকল কাপ্তান বলে চিনতে পারেনি কেউ। তুমি ভাবছো, এমন অসি-বিদ্যা এবং জাহাজ চালাবার কৌশল আমি শিখলাম কোথায়? আমাদের রাজবংশের নিয়ম, প্রত্যেক সম্রাট-সন্তান—তা সে পুত্ৰই হোক, বা কন্যাই হোক, প্রত্যেককে যুদ্ধ বিদ্যায় বিশারদ হতে হবে। আমাদের সমুদ্র সন্নিহিত সাম্রাজ্য; সেই কারণে নৌবিদ্যাতেও দক্ষ হতে হয়। এজন্য খুব ছোট থেকে আমার ভাইদের সঙ্গে আমিও যুদ্ধবিদ্যা শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভাগ্যে বাধ্য হয়েছিলাম তা না হলে আজ কী করে তোমাকে ফিরে পেতাম বলো?
নুর মিরিয়ামের বুকে মাথা গুঁজে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
সাতশো পাঁচতম রজনী–
আবার সে বলতে শুরু করে :
মিরিয়াম বললো, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অপার করুণায় আমরা আবার মিলিত হতে পেরেছি। নূর। আর কেউ আমাদের ছাড়াছাড়ি করতে পারবে না।
সমুদ্র যাত্রা দীর্ঘ একান্ন দিনের পথ। একটি ছোট্ট জাহাজের পাটাতনে গা এলিয়ে শুয়ে বসে মধুর ভাবে দিবস-রজনী অতিক্রান্ত হতে থাকে। ওপরে উন্মুক্ত নীল আকাশ, আর নিচে নীল জলধি। তার ওপর দিয়ে হাওয়ার টানে ভেসে চলেছে ছোট জাহাজখানা। নূর আর মিরিয়াম ছাড়া সে দুনিয়ায় তৃতীয় কোনও প্রাণী নাই। দিনের বেলায় বিবস্ত্র হয়ে দুজনে জাহাজের পাটাতনে পাশাপাশি শুয়ে রৌদ্র-স্নাত হয়। আর রাত্রি বেলায় শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় দুজনে দুজনের বুকের ওমে উত্তাপ আহরণ করে।
নাচ গান আদর সোহাগ চুম্বন এবং সহবাসে প্রতিটি মুহূর্ত মধুরতর হতে থাকে।
এইভাবে একদিন ওরা আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে এসে জাহাজ ভেড়াতে পারে। নুর বলে, তুমি যে তীরে নামবে, কিন্তু বোরখা কোথায়?
মিরিয়াম বলে, তাই তো, বোরখা না পরে নামবোই বা কী করে? নূর বললো, ঠিক আছে, এখন তোমাকে নামতে হবে না। তুমি জাহাজেই অপেক্ষা কর। আমি বাজার থেকে তোমার জন্যে বোরখা আর নাগরা চটি কিনে নিয়ে আসি।
মিরিয়াম বলে, কিন্তু বেশি দেরি করো না, সোনা। আমার একা একা থাকতে মন চায় না।
নূর আদর করে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে দিয়ে মিরিয়ামের গালে, আর ভয় কী! আমি যাবো আর আসবো। তুমি একটুখানি একা একা থাক।
নুর নেমে বাজারের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
এদিকে কনসনতাইন সম্রাটের প্রাসাদে হৈ চৈ ওঠে। গতকাল রাতে মিরিয়াম গীর্জায় উপাসানা করতে গেছে, সকালেই তার ফেরার কথা, কিন্তু সকাল গড়িয়ে যায়, এখনও মিরিয়াম ফিরে আসেনি।
গীর্জায় লোক পাঠালেন সম্রাট। কিন্তু পাদরী-মাতা বললো, সে তো অনেক সকালে-খুব ভোরেই ফিরে গেছে।
সম্রাট চিন্তিত হয়ে চারিদিকে চর পাঠালেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া গেলো? রাজকুমারী নুরকে নিয়ে একখানা জাহাজে উঠে পালিয়েছে।
সম্রাট তার সেনাপতিদের ডেকে বললেন, যাও, এক্ষুনি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ধাওয়া কর ওদের। জীবিত অথবা মৃত মিরিয়ামকে আমি ফেরত চাই।
তৎক্ষণাৎ রণতরী ছুটে চললো সমুদ্রের বুক চিরে। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে আসার আগে পর্যন্ত কোনও জাহাজের সন্ধান করতে পারলো না।
সম্রাটের রণতরীর কাপ্তান আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে ঢুকতেই দেখতে পেলো, তাদেরই ছোট একখানা জাহাজ বন্দরে নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে।
পলকের মধ্যে ওরা মিরিয়ামকে জাহাজে তুলে নিয়ে আবার কনসতানতাইনের অভিমুখে যাত্রা করলো।
সম্রাট ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে মিরিয়ামকে বললেন, এর শাস্তি কী জান? কেন পালিয়েছিলে? ভেবেছিলে, পালিয়ে তুমি আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে? তোমার মতো নষ্ট-চরিত্রা ব্যভিচারিণীর স্থান নাই আমার প্রাসাদে। মৃত্যুই তোমার সাজা। এবং সেই শাস্তিই আমি তোমাকে দেব।
মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজই একে প্রকাশ্য রাজপথে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিন। আর আমাদের প্রজাদের জানিয়ে দিন, সম্রাটের আদেশে তার প্রাণাধিক কন্যার ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। যারা স্বচক্ষে দেখতে চায়, দেখে যাক।
সম্রাটের এই মন্ত্রী অশীতিপর বিরূপ দর্শন এক বৃদ্ধ। তার গায়ের চামড়া লাল, চোখ কোটরে বসে গেছে, মাথা ভরা টাক। একটাও দাঁত নাই। নাকটা ব্যাঙের মতো। প্রথম দর্শনে যে কেউ শিউরে উঠবে।
এই মন্ত্রীমহোদয় বললো, মহামান্য সম্রাট, আমার একটি নিবেদন আছে।
-বলুন। সম্রাট মন্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। মন্ত্রী বললো, রাজকুমারীকে আপনি কঁসি দেবেন না। বরং তার চেয়েও কঠিন সাজা দিন ওকে।
—মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে বড় সাজা আর কী হতে পারে, মন্ত্রিবর?
হতে পারে। আপনি ওকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিন। আমার মতো এক কদাকার কুসতি লোলচর্ম বৃদ্ধকে স্বামী হিসাবে বরণ করে নিতে হবে—এই যন্ত্রণা মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়াবহ। ফাঁসির দড়িতে লটকে দিলে ওর এক পলকের জন্য কষ্ট হবে মাত্র। তারপর সব শেষ। কিন্তু এতে সে তিল তিল করে দগ্ধ হয়ে মরবে। আমার মনে হয় রাজকুমারী সম্রাটের আনুগত্য উপেক্ষা এবং খ্রীষ্টধর্মের অমর্যাদা করে যে পাপের ভাগী হয়েছে, এই হবে তার যোগ্যতম দণ্ড।
সম্রাট বললেন, উত্তম। তাই হোক, আপনি ওকে বিয়ে করুন। আপনি একজন প্রকৃত নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টান। এই ভ্রষ্টা ব্যভিচারিণীকে নিয়ে আপনি কী করবেন?তা ছাড়া ওকে চোখে চোখে আগলে রাখা কী আপনার পক্ষে সম্ভব হবে? যে মেয়ে একবার বাঁধন ছিড়েছে, তাকে শিকলে বেঁধে রাখলেও আটকে রাখা যায় না।
মন্ত্রিবর বলে, সেজন্য আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, মহামান্য সম্রাট। আমার স্ত্রীকে কী করে বশে রাখতে হয়, সে ওষুধ আমার জানা আছে।
সম্রাট বলেন, কিন্তু কাজটা খুব সহজসাধ্য হবে না, মন্ত্রীমশাই। যাই হোক, আপনার কথায় আমি আজ ওকে ফাঁসিতে ঝুলালাম না। বিশ্বাস করে আপনার হেপাজতে দিচ্ছি। কিন্তু যে কারণেই হোক, বা যেভাবেই হোক, ছলচাতুরী করে সে যদি আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যায়, তবে এর সমুচিত শাস্তি আপনাকে মাথা পেতে নিতে হবে। তখন আপনি মন্ত্রী বলে আমি আপনাকে রেয়াত করবো না। এই শর্তে যদি রাজী থাকেন, তবেই ওকে বিয়ে করতে পারেন। নচেৎ বিরত হোন।
বৃদ্ধ মন্ত্রী বলে, আমি মহামান্য সম্রাটের সতর্কবাণী উপলব্ধি করতে পেরেছি। আপনি আশঙ্কা করবেন না। আমি এমন কিছু অপরাধ করবো না যাতে প্রাণটা খোয়া যায় আমার।
সারা প্রাসাদে ও শহরে মহা ধূম পড়ে গেলো। রাজকুমারীর বিয়ে হবে। খানাপিনা দান-ধ্যান-এর জন্য প্রাসাদ দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। দেশ-বিদেশ থেকে গণ্যমান্য রাজা মহারাজা নানারকম উপহার উপটৌকন পাঠাতে লাগলো।
এবং এক শুভক্ষণ দেখে গীর্জার পাদরী-মাতা বিয়ের শপথ বাক্য পাঠ করালো বৃদ্ধ উজিরকে।
এদিকে নুর বোরখা আর এক জোড়া চটি কিনে নিয়ে বন্দরে এসে দেখে মিরিয়াম নাই। কপাল বুক চাপড়াতে থাকলো সে। তার কান্নায় ছুটে এলো আশেপাশের লোকজন। সকলেই নূরের দুঃখে সমবেদনা জানাতে থাকলো। কেউ বলে, বিবিকে এইভাবে একা ফেলে কেউ বাজারে যায়! কী দরকার ছিলো বাপু, ছেড়ে যাবার?
নূর বলে, উপায় ছিলো না। জাহাজে আমরা দুজনে ছিলাম। বোরখার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এখন এই বন্দরে বোরখা ছাড়া মেয়েছেলে নামে কী করে?
নুর যে সরাইখানায় থাকে সেই সরাইখানারই এক বৃদ্ধ শেখ নূরের কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো, চোখের জল ফেলে আর কী করবে, বেটা। বিধর্মীদের কাণ্ডই ঐ রকম। যা হবার তা তো হয়ে গেছে, চল এখন সরাইখানায় ফিরে যাই।
রোরুদ্যমান নূরকে প্রায় জোর করেই সে সরাইখানায় নিয়ে আসে। ওকে পাশে বসিয়ে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে, দেখ বাবা, নারী শুধুমাত্র পুরুষের ভোগের বস্তু। ভালোবাসাই বলো, আর প্রেম মহব্বতই বলল, ওগুলো মেয়েদের কাছে কিছু নয়। ওরা রূপ-যৌবনের যাদুকরী-দেহ এবং কাম সর্বস্ব। সুতরাং শোক করো না। আজ তোমার মনে হচ্ছে, কনসতানতাইন সম্রাটের কন্যা ছাড়া তুমি প্রাণে বাঁচবে না। কিন্তু দু’দিন সবুর কর, দেখবে সব সয়ে গেছে। তখন দেখবে, এই ফুল লতা পাতা পাখী—সব আবার ভালো লাগছে। তখন দেখবে, তুমি আবার কথায় মুখর হয়েছ, হাসছ গাইছ। তখন দেখবে, অন্য আর এক রূপসী নারী তোমার মন কেড়ে নিচ্ছে। এই-ই হয়—এই-ই নিয়ম। সুতরাং শোক করো না। শান্ত হও।
নূর কিন্তু সে কথায় আদৌ সান্ত্বনা পায় না। বলে, না চাচা, আমি আমার বিবি মিরিয়ামকে ছাড়া এ জীবন রাখবো না। ওকে আমি চাই-ই।
শেখ বলে, কিন্তু কনসতানতাইনের বিক্রম এবং ইসলাম-বিদ্বেষ কী তোমার জানা নেই বাবা! ঐ ম্লেচ্ছবিধর্মী খ্রীষ্টান সম্রাটের সারা মুলুকে একটাও তুমি মুসলমান খুঁজে পাবে?না, নাই—সারা দেশে একটা মুসলমান সে রাখেনি। অথচ ছিলো—হাজার হাজার ইসলামে বিশ্বাসী মুসলমানের বাস ছিলো তার সাম্রাজ্যে। সম্রাট তাদের সবাইকে স্বধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীষ্টান হতে হুকুম করেছিলো। কিন্তু একটা মুসলমান তার হুমকীতে মাথা নত করেনি। এবং এই কারণে—ঐ বিধর্মী ম্লেচ্ছটা আমাদের প্রতিটি ভাইবোনদের শূলে চাপিয়ে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, কারণে অকারণে কতবার সে ইসলাম রাষ্ট্রগুলোর ওপর সৈন্যদল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এবং লুঠতরাজ হত্যা করে আবার সরে পড়েছে।
নূর বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু এবার তো আমরা মুসলমানরাই তার কন্যাকে অপহরণ করে বাঁদী-হাটে বেচে দিয়েছিলাম, চাচা।
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলেন, তা-হতে পারে। এবং সে যে খুব একটা অপরাধ, তাও আমি মনে করি না বাবা। খোঁজ নিয়ে দেখ, যারা সম্রাট-নন্দিনীকে অপহরণ করে বাঁদী-বাজারে বেচে দিয়েছিলো, তাদের কী সর্বনাশ করে গেছে সম্রাটের সেনারা? নিশ্চয়ই কোনো সাংঘাতিক ক্ষতি অনিষ্ট তাদের হয়েছে। না হলে শুধু শুধু তারা রাজকুমারীকে হরণ করতো না। খোঁজ নিলে হয়তো শুনবে, সম্রাটের নৃশংস অত্যাচারে তাদের বিবি বাচ্চারা নিহত হয়েছে—অথবা সৈন্যরা মজা দেখার জন্য গভীর রাতে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে।
বৃদ্ধের এই রক্ত-নাচানো বক্তৃতা শুনতে হাজারো লোক জড়ো হয় সেখানে।
শেখ আবার বলতে থাকে? যা বলেছিলাম, তুমি সামান্য এক মুসলমান সন্তান। সম্রাটের সৈন্যবল অসীম। এবং তার হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতারও তুলনা নাই। সে ক্ষেত্রে তোমার বিবিকে কীভাবে তুমি উদ্ধার করে আনবে, বাবা। একবার তো একশো জনকে সঙ্গে নিয়ে গেলে। সবাইকে হাড়িকাঠে ফেলে সে কোতল করলো।
সঙ্গে সঙ্গে আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়ে আওয়াজ ওঠে, আল্লাহ হো আকবর। আমরা ওতে ভয় খাই না। ইসলাম যেখানে বিপন্ন আমরা জানকে তুচ্ছ জ্ঞান করি। চলো, নওজোয়ান, আমরা তোমার সঙ্গে যাবো।
প্রায় শ’খানেক মুসলমান রাজি হয়ে গেলো। তখনই একখানা জাহাজ ঠিক করে নূরকে সঙ্গে নিয়ে চেপে বসলো তারা।
একটানা একান্ন দিন পরে জাহাজ এসে ভিড়লো কনসনতাইনের বন্দরে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই নূর-রা সকলেই বন্দী হলো সম্রাটের সেনাবাহিনীর হাতে।
প্রাসাদের সামনে সবাইকে সারবন্দী করে দাঁড় করানো হলো। সম্রাট হুকুম দিলেন, শূলে চড়াও।
এক এক করে সবাইকে শূলে গেঁথে হত্যা করা হলো। সব শেষে আনা হলো নূরকে। সম্রাট দেখে বিস্মিত হলেন, একি! এই যুবককে সেবার তো আমি পাদরী মাতার অনুরোধে রেহাই দিয়ে গীর্জার প্রহরী করে পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে পালিয়ে আবার আমার জালে ধরা পড়েছে। যীশুর কী অপার মহিমা! ঠিক আছে, এবার একে দু’দুবার শুলে গেঁথে বধ করতে হবে।
এই সময় সেই বৃদ্ধ উজির বললো, মহামান্য সম্রাট আমার প্রাসাদের দ্বাররক্ষীর জন্য তিনজন যবনকে নিযুক্ত করবো বলে আমি পণ করেছি। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে তিনটি যবনকে আমার হাতে দিন।
সম্রাট বললেন, আপনার প্রতিজ্ঞা আমি কী করে জানবো, মন্ত্রীমশাই। আগে যদি বলতেন তিন কেন, তিরিশটা দিতে পারতাম। কিন্তু এখন তো সব খতম হয়ে গেছে। বাকী রয়েছেমাত্র এই একটি, তা যদি চান, এটিকে নিয়ে যেতে পারেন।
নূরকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রী তার নিজের প্রাসাদে আসে। তার ধারণা তিনটি যবনের রক্ত দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধুয়ে দিলে আর কোন অশুভ শক্তি ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। যাই হোক, তিনটিকে যখন একসঙ্গে সংগ্রহ করা গেলো না, তখন বাকী দুটির জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। আবার নিশ্চয়ই মুসলমানরা সম্রাট-সেনার হাতে বন্দী হবে। তখন আর দুটি চেয়ে নিয়ে একসঙ্গে তিনটিকে বলি দিতে হবে। ততদিন এইটিকে জিইয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু কোথায় রাখা যায় এই ম্লেচ্ছ অপবিত্র জীবটিকে। প্রাসাদের কোনো কক্ষে রাখলে সে কক্ষ অপবিত্র হবে!
ভেবে ভেবে সে স্থির করলো, ঘোড়ার আস্তাবলে ওকে হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে ফেলে রাখবে।
সম্রাটের একটি আস্তাবলে দুটি জগৎ বিখ্যাত আরবী ঘোড়া ছিলো। একটির নাম সাবিক, আর একটির নাম লাহিক। সাবিকের গায়ের রঙ পায়রার মতো সাদা, আর লাহিক ঘোরতর কৃষ্ণ বর্ণের। তাবৎ মুসলমান এবং খ্রীষ্টান মুলুকে এই সাবিক-লাহিকের দারুণ প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছিলো। সে সময়ে ওদের সমকক্ষ দুরন্ত দুর্বার এবং নানা যুদ্ধ-কৌশলে ওস্তাদ ঘোড়া আর একটিও ছিলো না কোনও দেশে।
নুরকে সঙ্গে নিয়ে আস্তাবলে আসে উজির। বলে, আপাততঃ এইখানেই তোমাকে থাকতে হবে। যতদিন না তোমার মতো আর দুই বিধর্মী যবনকে সংগ্রহ করতে পারি, ততদিন এই আস্তাবল তোমার বেহেস্ত। এখানে বসে ঈশ্বরের উপাসনা কর। তারপর যথাসময়ে তিনজনকে এক সঙ্গে বলি দিয়ে তোমাদের পাপ মুক্ত করবো।
উজির ভেবেছিলো, আতঙ্কে আঁৎকে উঠবে সে। কিন্তু একি। ছেলেটা মিটিমিটি হাসছে।
অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করে, কী, আমার কথার মানে বুঝতে পারনি? তোমাদের কোতল করা হবে—যথাসময়ে!
—জী হ্যাঁ, তা খুব বুঝেছি।
-তবে হাসছো কেন?
নূর বলে আপনার আস্তাবলের হেকিম বেচারী কিছুই জানে না। না হলে, এই রকম সেরা জাতি ঘোড়াটার চোখে পিচুটি পড়েছে, দেখছেন সে সারাতে পারছেনা? চোখটা তো কানা হয়ে যাবে।
উজির শিউরে ওঠে, বলো কী? কানা হয়ে যাবে? তামাম দুনিয়ায় এ ঘোড়ার জুড়ি নাই, জান?
—জানবো না কেন, সেইজন্যেই তো বলছি, ভালো করে চিকিৎসা করান, তা না হলে পস্তাবেন। এমন অমূল্য জানোয়ার পয়সা ছড়ালেও তো জোগাড় করতে পারবেন না।
উজির বলে হেকিমটাকে তো আমি রোজই ধমকাচ্ছি। কিন্তু সে বলে, কালই সেরে যাবে। কিন্তু, তুমি ঠিকই বলেছ, আসলে ও রোগই ধরতে পারেনি। ওর কোনও দাওয়াই-ই কাজে লাগছে না।
এ রোগের দাওয়াই সবাই জানে না। আমি সারিয়ে দিতে পারি আপনার ঘোড়ার অসুখ।কিন্তু তার বদলে আপনি আমাকে কী দেবেন?
উজির আশান্বিত হয়ে প্রশ্ন করে, পার তুমি সারাতে? তুমি কী হেকিম?
তারপর বলে, যদি সারাতে পার, সম্রাটের সমস্ত আস্তাবলের বড়কর্তা করে দেব তোমাকে। আর দেব যেখানে খুশি চলা-ফেরার অবাধ স্বাধীনতা।
—আমি রাজি। আপনি এক কাজ করুন মন্ত্রীমশাই। আমাকে খানিকটা রসুন, চুন, মোম এবং বাছুরের যকৃত এনে দিন। আমি ওষুধ বানিয়ে লাগিয়ে দিচ্ছি, কালই সেরে যাবে অসুখ। তার আগে আমার হাতে পায়ের কড়াগুলো খুলে মুক্ত করে দিন।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
সাতশো সাততম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?
পরদিন সকালে উজির এসে বললো, কই চোখের বাঁধনটা খোল, দেখি তোমার ওষুধে কী কাজ হয়েছে?
নুর খুলে দেখালো। ঘোড়াটার চোখ হরিণের মত ভঁসা এবং স্বচ্ছ হয়ে গেছে। পিচুটির লেশ মাত্র নাই।
মন্ত্রী তারিফ করে নূরের পিঠ চাপড়ায়, বাঃ বহুত, ধন্বন্তরী হেকিম তো তুমি। শিখলে
কোথায়?
আসলে নূর হেকিমীর কিছুই জানে না। ওদের বাড়িতে একটা ঘোড়ার একবার এই অসুখ হয়েছিলো। তখন পাড়ায় এক হাতুড়ে এই ওষুধটা বানিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলো এবং একদিনেই সেরে গিয়েছিলো ঘোড়াটার চোখ। ওষুধটা কী ভাবে, কী কী দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিলো সে, নুরের পরিষ্কার মনে ছিলো সব। এছাড়া অন্য কোনও কেরামতি তার নাই। নূর বললো, জী, আমি তো এই বিদ্যাই শিখেছি।
উজির খুব খুশি হয়। বলে, আজ থেকে সব আস্তাবলের কর্তা নিযুক্ত করা হলো তোমাকে। তোমার হুকুমে সব সহিসরা ওঠা বসা করবে। যখন খুশি, যে-কোনও জানোয়ারকে পরীক্ষা করতে পারবে, দাওয়াই দিতে পারবে। কোনও জানেনায়ারকে বাইরে নিয়ে যেতে হলে তোমার ছাড়পত্র লাগবে। এ ছাড়া যে-কোনও জানোয়ার নিয়ে তুমি যত্র তত্র অবাধভাবে চলাফেরা করতে পারবে।
মিরিয়াম উজিরের ঘরে বন্দীদশায় দিন কাটায়। দিন রাত সে চোখের জল ফেলতে থাকে। বুড়ো উজিরটা নানাভাবে ওর মনোরঞ্জন করতে অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু মিরিয়াম তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
এই সময় এক দরদী সহচরী মিরিয়ামকে জানালো, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে একখানা জাহাজে করে শ’ খানেক মুসলমান এসে নেমেছিলো বন্দরে। সম্রাট তাদের একজনকে বাদে সবাইকে শূলে দিয়েছে।
মিরিয়াম শিউরে ওঠে, বলিস কী?
বাঁদীটা বলে, হা মালকিন, নূর নামে এক খুবসুরত নওজোয়ান শুধু রেহাই পেয়েছে। মিরিয়াম মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে, তুই ঠিক জানিস?
-হ্যাঁ মালকিন, সেই নূর সাহেব তো এখন সম্রাটের আস্তাবলের বড় সাহেব হয়েছেন?
-তুই তাকে দেখেছিস?
–দেখবো না কেন? কী সুন্দর দেখতে মালকিন—যেন রাজপুত্তুর।
মিরিয়াম বলে, আমার একটা কাজ করতে পারবি?
-কেন পারবো না?
—তাকে একবার এই জানলার ধারে বাগানে নিয়ে আসতে পারবি?
বাঁদীটা বলে, এ আর এমন শক্ত কী? আমি এখুনি খবর দিচ্ছি তাকে। মিরিয়াম ওর হাত চেপে ধরে, কিন্তু সাবধান, কেউ যেন টের না পায়? মেয়েটি বলে, বুঝতে পেরেছি মালকিন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কেউ জানতে পারবে না।
পরদিন সকালে মিরিয়াম জানলার ধারে বসে বাগানের দিকে তাকিয়েছিলো। এই সময় নূর এসে এ-গাছ ও-গাছ থেকে দু একটা ফুল তোলার অছিলায় জানলার দিকে তাকায়।
মিরিয়াম-এর সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। তাড়াতাড়ি সে কাগজ কলম নিয়ে একটা চিরকুট লেখে :
সোনা, তোমার আশাতেই দিন গুণছি। আজ সন্ধ্যায় শহরের শেষ প্রান্তের সুলতান ফটকের সামনে দু’টো ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করো। বাঁদী হাজির হবে—মিরিয়াম।
একখানা রেশমী রুমালের খুঁটে বেঁধে বাগিচার ভেতরে ছুঁড়ে দেয় মিরিয়াম। নুর পায়ে পায়ে এগিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে রুমালখানা তুলে নিয়ে চলে যায়। একটু পরে আবার ফিরে এসে ইশারা করে জানিয়ে যায়—ঠিক আছে।
বিকেল বেলায় সহিসদের ডেকে বলে সাবিক আর লাহিকের পিঠে জিন লাগাম চাপিয়ে বাইরে বের কর।
অনেক দিন বাদে সাবিক লাহিককে বাইরে বের করে জিন লাগাম পরানো হচ্ছে দেখে উজির নুরকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, কী তোমার জানোয়াররা কেমন আছে? আজ যে বড় সাজগোেজ দেখছি। কোথাও যাওয়া হবে নাকি।
নুর বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে, অনেক দিন এরা বাইরে বেরোয় না। এভাবে একটানা আস্তাবলে বন্দী করে রাখলে পায়ে বাত ধরে যাবে। তাই ঠিক করেছি আজ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় ওদের একটু দৌড় ঝাপ করাবো। তাতে শরীর ঠিক থাকবে।
উজির বলে, বাঃ চমৎকার, তাই তো দিনের পর দিন ওদের একভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলে জরা চেপে বসবে। আমাদের আগের হেকিমটার মাথায় গোবর পোকা ছিলো। ব্যাটাচ্ছেলে সারাদিন শুধু ভোস ভেঁস করে ঘুমুতে। এতগুলো জানোনায়ার কেউ মরলো কি বাঁচলো—খোঁজই রাখতো না সে।
উজির চলে গেলো। নূর ঘোড়ার পিঠে চাপলো না। ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে চললো সুলতান-ফটকের দিকে।
সন্ধ্যা হতে না হতে উজির এসে মিরিয়ামের পাশে বসে। অনেক মিঠে মিঠে বাত শোনায়। আদর সোহাগ করতে যায়। অন্যদিন মিরিয়াম কোনও পাত্তা দেয় না। কিন্তু সেদিন সে নিজে থেকেই বুড়োটার গা ঘেঁষে বসে। নাকিসুরে অনেক আব্দারের কথা বলে। বুড়ো বিগলিত হয়ে যায়।
মিরিয়াম বলে, আজ দুপুরে ভালো করে খানা খেতে পারিনি।বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। খেতে দিতে বলো না গো?
উজির বলে, খিদে পেয়েছে, তা এতক্ষণ বলনি কেন? এ্যাঁই—কে আছিস—খানা সাজিয়ে দে।
অন্যদিন উজির তাকে অনেক সাধ্য-সাধনা করেও খাওয়াতে পারে না, কিন্তু আজ সে খাবার টেবিলে নিজেই প্রধান ভূমিকা নেয়।
-আহা, ঐ পায়রার দো-পিঁয়াজিটা তুমি একদম খেলে না। ওটা এই বয়সে একটু বেশি করে খাওয়া দরকার। ওতে বীর্য বাড়ে নাও, আর একটা টুকরো খেয়ে নাও। গায়ে তাগদ বাড়াতে হবে
না?
একটুকরো পায়রার মাংস দু’আঙ্গুলে ধরে আলতো করে বুড়োর মুখে গুঁজে দেয় মিরিয়াম।
মিরিয়াম যে তাকে আপন করে নিতে পেরেছে এই ভেবে উজির আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে।
তা হলে কাল থেকে পায়রার মাংস বেশি করে দিতে বলবো, কী বলো? ওটা খেলে শরীর খুব গরম হয় না?
মিরিয়াম বলে, হ্যাঁ, কিন্তু আস্তে আস্তে সইয়ে নিতে হবে তো? এক দিনেই এক বাটি খেলে হজম করতে পারবে না।
—তা যা বলেছো। ধীরে ধীরে যৌবনকে ফেরাতে হবে। তা—তুমি যখন আমার হৃদয়ের রাণী হয়ে এসেছ—তোমার ছোঁয়াতেই যৌবন আমার ফিরে আসবে।
-থাক। অত আর মন ভুলিয়ে কথা বলতে হবে না। এমনিতেই আমি তোমার বাদী হয়ে থাকবে চিরকাল। নাও, এই বাচ্চা মুরগীর এই সুরুয়াটা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলতো! এটাও তোমাকে নিয়ম করে ওষুধের মতো খেতে হবে, বুঝলে? মেয়েমানুষের মান রাখতে গেলে এই সুরুয়াই কিন্তু আসল দাওয়াই। দু’বেলা দু’টি যদি খাও, দেহে মনে ফুর্তি জাগবে। শরীর চনমন করে উঠবে।
এই সব বক্তৃতার ফাঁকে কায়দা করে এক ডেলা মরোক্কার অ ফিঙ মিশিয়ে দিলো সে মুরগীর ঝোলে। বাটিটা বুড়োর মুখে তুলে ধরে বলে, নাও এক চুমুকে খেয়ে ফেললো। আজ প্রথম তোমার সঙ্গে আমার লড়াই হবে। দেখবো তোমার বুড়ো হাড়ে কেমন ভেল্কি দেখাতে পার?
বুড়ো দারুণভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে, আমি আর পারছি না মিরিয়াম। আজ সাতদিন আমাদের শাদী হয়েছে, এই সাতদিনের মধ্যে একটা দিনের তরে আমার আদর সোহাগ পাওনি
তুমি।
মিরিয়াম বলে, আহা, কী যে বলো, পুরোনো ঘা-টা শুকাতে সময় লাগবে না? আজ তো আমি পুরো সেরে উঠেছি। দেখো, আজ কত আদর সোহাগ খাবো তোমার। আচ্ছা এখন চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলতে সুরুয়াটা। তারপর তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বো। শাদী আমাদের যেদিনই হোক, আজই তো হবে প্রথম বাসর রাত্রি-কী বলে?
উজির ঝোলটা চুমুক দিয়ে খেয়ে শুধু বলতে পারে, তা যা বলেছে— ব্যস, এর পরই সে ঢলে পড়ে গালিচায়।
আগে থেকেই সব গুছিয়ে গাছিয়ে ঠিকঠাক করে রেখেছিলো মিরিয়াম। দুটো থলেয় ভরে নিয়েছিলো উজিরের সঞ্চিত সব মূল্যবান ধনরত্নগুলো। থলে দু’টো আর একখানা শাণিত তলোয়ার বেঁধে নিলো সে কোমরে। তারপর একখানা মোটা কাপড়ের কালো বোরখা দিয়ে ঢেকে নিলো সারা শরীর। জানরার চৌকাঠে রশি বেঁধে নিচে ঝুলে পড়লো মিরিয়াম। তারপর অতি সহজ স্বাভাবিক অথচ দ্রুতগতিতে হেঁটে চললো সুলতানী ফটকের দিকে।
নূর ঘোড়া দু’টো সঙ্গে নিয়ে মিরিয়ামেরই প্রতীক্ষা করছিলো। মিরিয়াম এসে লাফিয়ে উঠে বসে লাহিকের পিঠে।বলে, জলদি ওঠ সাবিকের পিঠে। জোর কদমে আমার পিছনে পিছনে ছুটে এস। আমি ছুটলাম।
তীরবেগে দুই ঘোড়া ছুটে চলে গ্রাম গঞ্জ মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে সারারাত ধরে। সকাল বেলা ওরা প্রায় হাজার যোজন পথ পার হয়ে শস্য-শ্যামল প্রান্ত সীমায় এক স্রোতস্বিনী নদীর কিনারে এসে থামে।
মিরিয়াম আর নূর নেমে পড়ে। ঘোড়া দু’টো মাঠে চরতে ছেড়ে দেয়। নিজেরা নদীতে নেমে হাত মুখ ধুয়ে রুজু করে নামাজ সারে। গাছের ফল পেড়ে আনে নুর। দুজনে তৃপ্তি করে খায়। তারপর নদীর জল পান করে নদীর ধারে ঘাসের শয্যায় গা এলিয়ে দেয়।
বাব্বা, সারাটা রাত কী দূরন্ত বেগে ছুটেছি।
নূর জিজ্ঞেস করে, আমরা কতদূর এসেছি মিরিয়াম?
—অনেক দূর। আমার বাবার সাম্রাজ্যের একেবারে শেষপ্রান্তে বলতে পার। এখন আর ওরা আমাদের পাত্তা করতে পারবে না। সারারাত ঘুমটুম তো হয়নি। এস, একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার চলবো।
অনেক ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে। দুজনেই অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে। দুপুরও বিকেল হতে চায়। কিন্তু ওদের আর ঘুম ভাঙ্গে না।
হঠাৎ হাজার হাজার অশ্বক্ষুর ধ্বনিতে চমকে ওঠে বসে মিরিয়াম।নূরকে নাড়া দিয়ে জগিয়ে তোলে, এই-শিগ্নির উঠে বস।
–ও কীসের শব্দ, মিরিয়াম? চারদিক এমন ধূলোর ঝড়ের মতো আঁধার হচ্ছে। মিরিয়াম গম্ভীর হয়ে বলে, হুঁ, হাজার দশেক হবে?
দশ হাজার? তা হলে কী হবে, মিরিয়াম?
-তুমি পিছনে সরে থাক। আমি একাই লড়বো। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা কোনও পাপ করিনি নুর। হার হবে না।
নুর শঙ্কিত হয়ে বলে, তা বলে তুমি ঐ বিশাল সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে একা কী করে লড়বে, মিরিয়াম।
–ধৈর্য ধর নুর। দেখ আমি কী করি।
সকালে যখন যথাসময়ে উজির দরবারে এলো না, সম্রাট খোঁজ করতে পাঠালেন তার প্রাসাদে। অবিলম্বে দূত এসে জানালো, উজির অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। রাজকুমারী ঘরে নাই।
সম্রাট ক্ষিপ্ত সিংহের মতো ছুটে এলেন উজিরের প্রাসাদে। উজিরটা তখন গালিচার ওপরে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলো। সম্রাট গর্জে উঠলেন, এই কুত্তার বাচ্চা, মিরিয়াম কোথায়?
উজিরের একখানা হাত ধরে প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকানি দিলেন তিনি, কিন্তু কোনও সাড়া নাই। জানলার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, কয়েকটা গরাদ ভাঙ্গা। একখানা দড়ি নেমে গেছে নিচে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই দড়ি বেয়েই সে নেমে গেছে। আস্তাবলের সহিসরা এসে খবর দিলো; কাল সন্ধ্যায় নূর সাহেব সাবিক আর লাহিককে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে বেরিয়েছিলো, কিন্তু আর ফিরে আসেনি।
এবার তিনি নিশ্চিত হলেন, ঐ ছোকরাটার সঙ্গেই সে পালিয়েছে। সম্রাটের মাথায় খুন চেপে গেলো, তরবারীর এক কোপে উজিরের ধড় মুণ্ডু আলাদা করে দিলেন তিনি।
তারপর সেনাপতিদের তিনজনকে ডেকে এনে হুকুম করলেন। আর এক তিল দেরি নয়, তোমাদের তিনজনের পুরোবাহিনী নিয়ে সুলতান-ফটক দিয়ে বেরিয়ে পড়। বায়ুবেগে ছুটে চলতে হবে। যেভাবেই হোক, মিরিয়ামকে জ্যান্ত অথবা মৃত অবস্থায় আমার চাই-ই।
তৎক্ষণাৎ তিন সেনাপতির নয় হাজার অশ্বারোহীর তিনটি বিশাল সৈন্যবাহিনী আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে নগর প্রান্তর ধূলি ও ধূম্রজালে আচ্ছন্ন করে উল্কার বেগে ছুটে চললো। সম্রাট স্বয়ং প্রধান সেনাপতি হয়ে তাদের পুরোভাগে ছুটতে থাকলেন।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো নয়তম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
লাফিয়ে ওঠে লাহিকের পিঠে চেপে বসে মিরিয়াম। নূরকে বলে, সাবিকে চেপে তুমি অনেকটা পিছনে সরে থাকো। আমি সম্মুখ সমরে লড়বো।
এই বলে সম্রাটের বিশাল সৈন্যবাহিনীর দিকে ঘোড়া ছুটালো।
দূর থেকে সম্রাটের দেখতে ভুল হলো না, উদ্যত তরবারি হাতে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে মিরিয়াম। সম্রাট ভাবলেন, মেয়েটা কী বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। তা না হলে আত্মসমর্পণ না করে একি তার স্পর্ধা! নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। সম্রাট তার সেনাপতিদের হুকুম দিলেন, সৈন্যবাহিনীর গতি স্তব্ধ কর। আমি একাই যাবো তার সামনে।
কন্যার মুখোমুখি এসে তিনি গর্জে ওঠেন, তোমার কী মাথার বিকৃতি ঘটেছে মিরিয়াম। খ্রীষ্টান সম্রাটের এই বিশাল বাহিনীর সামনে তুমি তরবারি উঁচিয়ে ছুটে আসছো? এখন তোমার সামনে একটাই পথ খোলা আছে তা আমার কাছে করুণা ভিক্ষা করা। না হলে মৃত্যু তোমার অবধারিত। কেউ রোধ করতে পারবে না।
মিরিয়াম বলে, আমি পিছনের দিকে তাকাতে জানি না, বাবা। যা ঘটে সামনাসামনিই ঘটুক। আল্লাহ আমাদের সহায় আছেন। এবং এও ঠিক, আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই। এবং মহম্মদ তাঁর পয়গম্বর। যদিও আমাকে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তবুও আমি আমার ধর্ম এবং ভালোবাসা থেকে বিচ্যুত হতে পারি না।
এই বলে সে ঘোড়ার লাগামে ঝাকি দিয়ে আরও কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায়। হাতের তলোয়ার রৌদ্রকিরণে ঝকমক করে ওঠে।
লাহিকের পাছায় আদর করে দুটি চাপড় মারে মিরিয়াম। এবং তৎক্ষণাৎ লাহিক চিহিহি আওয়াজ তুলে তীরবেগে ছুটে যায় সেনাবাহিনীর এক প্রান্তে। বাই বাই করে কয়েকবার ঘুরে আসে মিরিয়ামের তরবারী। এবং প্রায় জনা কুড়ি অশ্বারোহী লুটিয়ে পড়ে যায় নিচে। এবং সঙ্গে সঙ্গে লাহিক কয়েক কদম পিছিয়ে আবার ছুটে যায় ডানদিকের অশ্ববাহিনীর সামনে। মিরিয়ামের একটা মারও কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না। ঝুপ ঝুপ করে সব খসে পড়ে যেতে থাকে।
সম্রাট আকাশ ফাটিয়ে ডাকলেন বারটাউট।
বারটাউট সম্রাটের সেনাপতিদের প্রধান। তার অসীম শৌর্য-বীর্যের নানা কাহিনী দেশ বিদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তার অমিত বিক্রমে ও দুর্জয় দুঃসাহস সর্বজনবিদিত।
বারটাউট একটি সুন্দর তেজি ঘোড়ায় চেপেছে আজ। তার সারা চোখে দীপ্ত বিজয়ের হাসি। সম্রাটের সামনের এসে সে অভিবাদন জানায়।—মহামান্য সম্রাট, বারটাউট হাজির, হুকুম করুন
অধীশ্বর।
সম্রাট বললেন, বারটাউট, আজ এক ক্ষিপ্ত নারীর সঙ্গে তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে। তোমার মতো দুর্জয় বীর সেনাপতির পক্ষে হয়তো এটা অসম্মানজনক। কিন্তু ইতিমধ্যেই সেই উন্মাদিনী আমার শতাধিক সৈন্য ধরাশায়ী করে ফেলেছে। এবং এও তো ঠিক, আমার প্রতিটি সৈন্য দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা এক একজন শত সৈন্যের প্রাণ সংহার করেছে। কিন্তু আজ একি হলো! ঐ একটি তরুণীর তরবারির সামনে তারা কেউ এক পলকও টিকে থাকতে পারলো না?
তাই আমি শঙ্কিত হয়ে উঠেছি, বারটাউট। এইভাবে যদি আমার বুকের বল সৈন্যরা অসহায় পতঙ্গের মতো মৃত্যুবরণ করতে থাকে, তবে কি উপায় হবে? আমার মনে হয়, এখনি তাকে হত্যা করে আশঙ্কা নির্মূল করা দরকার। সামান্য একটা বিদ্রোহিনীকে দমন করার জন্য তোমাকে ডাকতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে। কিন্তু এখন সমূহ বিপদকাল। এ সময় ওসব চিন্তার সময় নাই।
বারটাউট অভিবাদন জানিয়ে বললো, যথা আজ্ঞা সম্রাট। তারপর সে হুঙ্কার ছেড়ে এমনভাবে ঝাপিয়ে পড়লো মিরিয়ামের ওপর, মনে হলো আমাদের সকল বিশ্বাস, সকল অহঙ্কার বুঝি সে নিমেষে ধূলিসাৎ করে দেবে। তার সেই বিকট আওয়াজে গগনমণ্ডল বিদারিত হয়ে যেতে থাকলো।
তারপর শুরু হলো প্রচণ্ড অসিযুদ্ধ। একদিকে মিরিয়াম, অপর দিকে বারটাউট। যেন দুই সিংহে সিংহে লড়াই।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলতে থাকলে সে যুদ্ধ। ক্ষণে ক্ষণে তরবারির আঘাতে আঘাতে আগুনের ফুলকি ছুটে বেরুতে লাগলো। কিন্তু কেউই কাউকে পরাস্ত করতে পারে না।
অবশেষে একসময় বারটাউটের হাতের ধমনী শিথিল হয়ে আসে, বুঝতে পারে ডানহাতে সে আর অসি ধরে রাখতে পারবে না। তাই হাত বদল করে বাঁ হাতে নিয়ে। নেয় অসিখানা। আর ডানহাত দিয়ে প্রচণ্ড বেগে নিক্ষেপ। করে একখানা বর্শা। কিন্তু মিরিয়াম আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় তরবারির আঘাতেই সে বর্শা মাটিতে ফেলে দেয়। বারটাউড চমকে ওঠে, সর্বনাশ তার বর্শার অব্যর্থ নিশানা। এবং বিদ্যুতের গতিবেগ রোধ করবার সাধ্য তো কোনও যোদ্ধারই নাই। কিন্তু একি হলো! আহত সিংহের মতো গর্জে উঠে আর একখানা বর্শা টেনে নেয় সে। এইবার তোমার মৌৎ কে রক্ষা করবে? কিন্তু সে বর্শাও পাশে ফেলে দেয় মিরিয়াম। এইবার আরও একখানা। কিন্তু মিরিয়ামের বেগ পেতে হয় না। অনায়াসে তার চারখানা বর্শা মাটিতে ফেলে দিতে পারে সে।
বারটাউট উন্মত্ত হয়ে ওঠে। লজ্জায় তার চোখ মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। সামান্য এক নারীর সঙ্গে সে বুঝতে পারছে না? ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা! আবার সে অসিখানা ডানহাতে ফিরিয়ে নেয়। এবং শত সিংহের বিক্রমে গর্জে ওঠে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই তরবারিই ছুঁড়ে দেয় মিরিয়ামের দিকে। বাই-বাই করে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে আসে তা মিরিয়ামের বুকের কাছে। সে অসিরগতি যদি রোধ করতে না পারতো তবে এক পলকে মিরিয়ামের দেহ শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। কিন্তু আল্লাহর অপার করুণায় সে গতিও রুদ্ধ হলো।মিরিয়ামের এক আঘাতে খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে গেলো বারটাউটের সেই বিজয়ী তরবারি।
এরপর মিরিয়াম ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে বারটাউটের চুলের মুঠি ধরে শূন্যে তুলে প্রচণ্ড শক্তিতে আছাড় মেরে নিচে ফেলে দিয়ে বললো, এই তুমি বিশ্ববন্দিত যোদ্ধা—বীর? তরবারির মর্যাদা জান না? থু।
রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো দশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুর করে?
বারটাউট মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে একবার মিরিয়ামকে দেখে নেয়। ভাবে, এইবার বুঝি তার ওপর সে ঝাপিয়ে পড়ে বুকে গেঁথে দেব। অসিখানা। কিন্তু মিরিয়াম হাসে, ভয় নাই তুমি নিরস্ত, তোমাকে আঘাত করবো না। কিন্তু একটা কথা পালাবার চেষ্টা করো না। তার পরিণাম ভালো হবে না। শুনেছিলাম, তুমি নাকি দুনিয়ার সেরা যোদ্ধা। কিন্তু এই কী মহারথী প্রথা? বর্শার বদলাই একমাত্র বর্শা হতে পারে। আর যুদ্ধক্ষেত্রে অসি ছুঁড়ে আঘাত করে কে? সে কী মহারথী, না মরকট?
বারটাউটের মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। তাই সে দিশাহারা হয়ে প্রাণ ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাবার চেষ্টা করে। মিরিয়ামের চোখে আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে, কাপুরুষ—গিদধঢ়। এই তোমার যোগ্য পুরস্কার।
ঘোড়াকে এক কদমও সে আগে বাড়ায় না। যেখানে দাঁড়িয়েছিলো, সেইখানে দাঁড়িয়ে হাতের অসিখানা প্রচণ্ড শক্তিতে ছুঁড়ে মারে। লক্ষ্য অর্থ। তরবারিখানা চক্রের মতো ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে বারটাউটের মুণ্ডুটা নামিয়ে দেয় মাটিতে।
চারদিকে ছিটিয়ে পড়েছিলো অগণিত তরবারি। তারই একখানা তুলে নিয়ে মিরিয়াম এবার ছুটে যায় খাস বাহিনীর দিকে।
সম্রাট দেখলেন, তাঁর প্রধান সেনাপতির বুকের পাঁজর বারটাউট ধরাশায়ী হয়েছে। এবার তিনি দ্বিতীয় সেনাপতি বারতাসকে আহ্বান করলেন। বারতাস বারটাউটের ছোট ভাই, এরও শৌৰ্য্যখ্যাতি অসীম। বীর যোদ্ধা হিসাবে তারও সমকক্ষ খুব বেশি কেউ নাই।
বারতাস এসে অভিবাদন জানাতে সম্রাট বললেন, তোমার দাদা তো প্রাণ হারালো, দেখছি আমার দারুণ দুঃসময়। ঐ নারীকে পরাস্ত না করতে পারলে তো মান থাকে না বারতাস। তুমি পারবে?
বারতাস বলে, পারা না পারা সে সম্মুখে সমরে ফয়সলা হবে, সম্রাট। কিন্তু তা বলে বারতাস কখনও লড়তে ভয় পায় না। আমি প্রস্তুত।
-তা হলে যাও। ঝাপিয়ে পড়। তোমার দাদার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ কর। বারতাস তলোয়ার বাগিয়ে রে রে করে ছুটে আসে মিরিয়ামের দিকে। কিন্তু মিরিয়াম অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। বারতাসের প্রথম আঘাত-এর লক্ষ্য ছিলো মিরিয়ামের শির। কিন্তু সে আশা তার ব্যর্থ হয়। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় পলকের মধ্যে সে আঘাত প্রতিহত করে মিরিয়াম। এর পর অসিতে অসিতে যুদ্ধ শুরু হয়। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুত চমকে চমকে ওঠে। আশ্চর্য, মিরিয়াম যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখানে অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে তরবারির যাদু দেখতে থাকে। বারতাস তাকে কাবু করার জন্য তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধ করে চলে। মাঝে মাঝে সিংহনিনাদ করে ওঠে সে এইবার—এইবার তোর ইন্তেকাল এসে গেছে। ওরে বিধর্মী যবন, তোর আল্লাহর নাম জপ কর।
মিরিয়াম কোনও জবাব দেয় না। নির্বিকার চিত্তে তরবারির খেলায় মেতে ওঠে সে। বারতাস বুঝতে পারে, এ মেয়ে তো সাধারণ মেয়ে নয়। না হলে, তার অসির তাণ্ডবের সামনে এতক্ষণ টিকে থাকার সাধ্য কী করে হয় তার?
বারতাসের আরও কয়েকটা মোক্ষম মার যখন তাচ্ছিল্যভাবে প্রতিহত করে মিরিয়াম, তখন সম্রাটের সেনাবাহিনীর বীরা যোদ্ধারা উদগ্রীব হয়ে আরও কয়েক কদম এগিয়ে আসে। কে এই বীরাঙ্গনা, দেখার খুব কৌতূহল হয় তাদের। বুঝতে আর দেরি হয় না। শুধু বারতাস যথেষ্ট নয়। তাকে রুখতে গেলে গোটা সেনাবাহিনীর শক্তিই কাজে লাগাতে হবে।
বারতাস এবার বর্শা ছুঁড়ে মারে। তীক্ষ্ণ-তীর সমতার গতি। সে বেগও লক্ষ্য কাটাবার দক্ষতা একমাত্র মিরিয়ামেরই ছিলো! ওরা তো কখনও কেউ জানতো না, এই বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে ত্রিভুবন বিজয়ের আশীর্বাদ লাভ করেছে সে তার গুরুর কাছ থেকে। আশৈশব আকৈশোরের একনিষ্ঠ সাধনার ফলে যে সিদ্ধিলাভ সে করেছিলো, আজ যুদ্ধক্ষেত্রে তারই মূর্ত প্রকাশ প্রত্যক্ষ করছে এরা সকলে।
বারতাস আর একখানা বর্শা নিক্ষেপ করে মিরিয়ামের বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করে। এখানা সে বাঁ হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলে। এবং সেই হাত দিয়েই তৎক্ষণাৎ ছুঁড়ে মারে বারতাসের নাভিস্থল লক্ষ্য করে। অব্যর্থ আঘাত। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিশাল এক দানবের মতো বিকট চিৎকার তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বারতাস। যেন একটা মিনারের শীর্ষদেশ ধ্বসে পড়লো ঊর্ধ্বাকাশ থেকে।
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো এগারতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
মিরিয়াম এবার লাহিককে ছুটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। দৃপ্তকণ্ঠে গর্জে ওঠে, কোথায় খ্রীস্টানের বীরপুরুষরা, এদিকে সামনে এগিয়ে এস, তোমাদের সুরতগুলো দেখি। কোথায় আমার বুড়ো-হাবড়া সাধের স্বামী-পিছনে লুকিয়ে রইলে কেন? একবার সামনে এসে দাঁড়াও। তোমরা কী সবাই সামান্য এক দূর্বল নারীর ভয়ে ভীত হয়ে পুচ্ছ গুটিয়ে পলায়নোদ্যোগ করছো? ছিঃ, ছিঃ, মরি, একি লজ্জা!
সম্রাট হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। তৃতীয় সেনাপতি তরুণ যোদ্ধা ফাসিয়ানকে আহ্বান করলেন তিনি।
-ফাসিয়ান, তুমিই শেষ ভরসা, তবে এও জানি, তোমার তরবারি দোর্দণ্ড। সবাই প্রাণভয়ে পালাবার পথ খুঁজে পায় না। আমি আশা করবো, তোমার এই প্রদীপ্ত যৌবনের বিদ্যুৎ ঝলকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারবে ঐ উদ্ধত নারীর দুঃসাহস আর দম্ভ। যাও সিংহের বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড় তার ওপর। আমি তার ছিন্নমুণ্ড দেখতে চাই তোমার তরবারির ডগায়।
ফাসিয়ান যথারীতি অভিবাদন করে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে মিরিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার সারা চোখে মুখে প্রতিহিংসার আগুন ধকধক করছে। কিন্তু মিরিয়ামের অসির স্পষ্ট মার ঠেকাতে না পেরে লাগাম টেনে কয়েক কদম সে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে সে মূহূর্তমাত্র। ফাসিয়ান ছুটে এসে প্রচণ্ড এক আঘাত হানে মিরিয়ামের শির লক্ষ্য করে। ফাসিয়ানের সতীর্থরা ভাবে, এইবার বুঝি সব খতম হয়ে গেলো। ফাসিয়ানের এ প্যাচ কাটিয়ে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা হবে না রাজকন্যার। কিন্তু ওদের ধারণা ভ্রান্ত। মিরিয়াম এমন তাক করে ফাসিয়ানের তরবারিতে আঘাত করলে যে ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে। এবার ফাসিয়ান ভয়ার্ত কণ্ঠে পিছনে যোদ্ধাদের ডাকে, তোমরা কে আছ, ছুটে এসে রক্ষা কর, হত্যা কর এই নারীকে। প্রাণভয়ে সে পালাবার চেষ্টা করতেই মিরিয়ামের তরবারি আমূল বিদ্ধ হয়ে যায় তার পিঠের ভিতরে। আর্তনাদ করে সে ছিটকে পড়ে যায়।
সিংহের আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে মৃগদল যেমন প্রাণপণে ছুটে পালায় তাদের তিন মহারথীর এই বিস্ময়কর পতনে সমগ্র সৈন্যবাহিনী সেইভাবে ভীত চকিত হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়নে তৎপর হয়ে ওঠে। সম্রাটের কোনও আবেদন, নিবেদন, আদেশ-নির্দেশ হুঙ্কার আর গ্রাহ্য করে না তারা। পলায়মান সমগ্র সৈন্যদলের মধ্যে পলকে ছড়িয়ে যায়, ওরে বাবা, পালাও। এ মেয়ে, মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই স্বর্গে দনুজদলনী কোন এক দেবী মূর্তি। সৈন্যদলের বিভাগীয় সহ-সেনাপতিরা দেশদ্রোহীতার ভয় দেখায়। স্থির হও, কেউ এক পা পিছু হটবে না। আমরা লড়বো। শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও লড়বো। কিন্তু পিছু হটবো না। কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করলে রাজদ্রোহের দণ্ড পেতে হবে তাকে, সুতরাং সাবধান।
কিন্তু কেউ পরোয়া করে না জাঁদরেলদের এই সতর্কবাণী। যে যেদিকে পারে ছত্রখান হয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করে। এর যা অবশ্যম্ভাবী ফল ঘটা সম্ভব, তা-ই ঘটতে থাকে। জাঁদরেলদের। সঙ্গে সাধারণ সৈনিকদের সম্মুখ সমর শুরু হয়ে যায়। নিজেরাই কাটাকাটি করে এক এক করে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
মিরিয়াম এই সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করলো। তরবারির এক এক কোপে এক একজন জাঁদরেলকে ভূপাতিত করতে থাকলো সে। কেউ-ই তার সামনে পলকের বেশি সময় টিকে থাকতে পারলো না। বিদ্রোহীরা, সৈন্যরা অনেকেই নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বা অশ্ব ছুটিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলো। কিন্তু যারা মিরিয়ামকে প্রতিহত করার সাধ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো। তারা আর কেউ জীবিত রইলো না।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই যুদ্ধে ইতি হয়ে গেলো। বিশাল প্রান্তরের বুকে নেমে এলো গভীর নিস্তব্ধতা আর রাত্রির কালো যবনিকা।
এইবার সে নদীর কিনারে ছুটে এসে নূরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন এঁকে দেয়।
-শুধু তোমার ভালোবাসার জোরে আর আল্লাহর দোয়ায় আমি এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি, সোনা। আমার গুরুর আশীর্বাদ আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। তিনি আজ কোথায় জানি না, যেখানেই থাকুন, হাজার সেলাম জানাই তার চরণে।
সে রাতে সেই নদী তীরের তৃণশয্যায় সুখ-সহবাস করলো দুজনে। এবং পরদিন সকালে ওঠে দামাসকাসের পথে রওনা হয়ে গেলো।
এদিকে পরাজিত সম্রাট ক্রোধানলে জ্বলতে জ্বলতে সিংহের থাবা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া নেকড়ের মতো গা ঢাকা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে পড়েন। প্রাসাদে ফিরে এসে অমাত্য পরিষদ এবং গীর্জার পাদরী-পিতা-মাতাদের ডেকে এক সভা করলেন। আমার কুলের কলঙ্কিনী কন্যা মিরিয়াম আমার তিন প্রধান স্তম্ভ বারটাউট, বারতাস এবং ফাসিয়ানকে হত্যা করেছে। এ বড়ই শোকের বিষয়।
সভায় সকলে ক্ষণকালের জন্য দাঁড়িয়ে মৌন হয়ে লোকান্তরিত সেনাপতিদের আত্মার শান্তি কামনা করে। তারপর সম্রাট আবার বলতে থাকেন। এরা তিনজন ছিলো আমার বুকের এক একখানা অস্থি। আজ আমি আর আপনাদের সেই প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাট নই। সৈন্যবল আমার সীমিত হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও আমি কিছুতেই অনুধাবন করতে পারছি না, এ অলৌকিক কাণ্ড কী করে সংঘটিত করতে পারলো।
জাঁদরেল একজন দাঁড়িয়ে বললো, মহামান্য সম্রাট যদি অনুমতি করেন, আমি একটা কথা বলবো।
-বলো, বলো? রাজকুমারী মিরিয়াম ধর্মচ্যুত হয়ে সে অসুর শক্তির উপাসনা করে শয়তানের বর লাভ করেছে। সেই কারণেই আমরা তার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারিনি।
গীর্জার পাদরীও সে কথায় সায় দিয়ে বলে, হুম্! তাই সত্য বলে মনে হয় আমাদের। কোনও অশুভ শক্তির সহায়তা ছাড়া এই দুঃসাহস কারো হতে পারে না। বিধর্মী ম্লেচ্ছ মুসলমানরা অনেক তুকতাক গুণগান জানে শুনেছি। এবং তার ফলে এমন সব যাদু বা ভেল্কি তারা দেখাতে পারে যা সাধারণ বিচার-বুদ্ধির বাইরে। কিন্তু এ সবই ধ্বংসাত্মক। কোনও শুভ কাজে, সে-সব যাদুবিদ্যা কোনও সুফল দেয় না, বা পৃথিবীর মঙ্গলে আসে না।
আমরা খ্রীষ্টান। যীশু আমাদের সহায় আছেন। সুতরাং কোনও অশুভ শক্তিই আমাদের ধ্বংস করতে পারবে না। আপনি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন সম্রাট। সময়ের সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকুন, দেখবেন জয় আপনার সুনিশ্চিত।
সম্রাট, মহামান্য প্রধান পাদরী-পিতার এই বাণী শিরোধার্য করে বলেন, কিন্তু পরম পিতা, আপনার বাক্য কী করে ফলবতী হতে পারে, আমি বুঝতে পারছি না। কারণ এই যুদ্ধে আপনাকে এই মাত্র জানালাম আমার সৈন্যবল সীমিত হয়ে গেছে। আমি যে তিন বীর-যোদ্ধাকে আজ হারিয়েছি, কোনও মূল্যের বিনিময়েই তাদের সমকক্ষ অন্য কোনও যোদ্ধা আমার পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় মুসলমান রাজ্য আক্রমণ করে তাদের এখানে বন্দী করে আনতে পিরবো, সে আশাও দুরাশা।
পাদরী-পিতা বললো না। সে পথ নয়। যেখানে দেহবল কাজে আসে না, সেখানে প্রয়োজন বুদ্ধির কৌশল। ছলে বলে কৌশলে কাজ হাসিল করতে হবে আপনাকে।
-কী ছল, কি বলো, কী কৌশল পিতা?
—আপনি খলিফা হারুন অল রসিদের কাছে দূত পাঠান। শুনেছি, লোকটা নাকি ভণ্ড-তপস্বী। তবে যাই হোক, বাইরের ভড়ংটা যোল আনা বজায় রেখে চলে সে। মুখে অন্ততঃ অনেক বড় বড় ভালো ভালো বুলি আওড়ায়—প্রজাদের ধোঁকা ধাপ্পা দিয়ে দিব্যি অনাচার ব্যভিচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই খলিফাটাকে টোপ দিতে হবে।
সম্রাট বলেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না পিতা। টোপ মানে? সে আরবের শাহেনশাহ, কোন ধন-দৌলতের লোভ দেখিয়ে তো তাকে ভোলানো যাবে না।
পাদরী সাহেব বলে, না ওসব নয়। ওসব তো আনুষঙ্গিক। উপহারের অছিলা করে কিছু পাঠাতেই হবে। কিন্তু আসল টোপ অন্য। আপনি ওকে একখানা চিঠিতে লিখে পাঠান, আপনার কন্যা উদ্ধত অবিনয়ী অবাধ্য হয়ে প্রাসাদ থেকে পালিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, সে এখন মিশরে এক যুবকের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত আছে। খলিফা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি যেন তাকে কনসনতাইনে পাঠিয়ে সখ্য-বন্ধন সুদৃঢ় করেন।
সম্রাট বাধা দিয়ে বলেন, কিন্তু খলিফা হারুন অল রসিদ কেন মাথা ঘামাতে যাবেন। তার সঙ্গে তো আমার আগের কোনও দোস্তি নাই।
পাদরী-পিতা বলে, আসল টোপটার কথাই বলছি। এর পর লিখে দিন, তিনি যদি আপনার এই উপকারটুকু করেন, তবে আপনি আপনার এই খ্রীষ্টান সাম্রাজ্যে মুসলমানদের সুবিধার জন্য একটি সুবিশাল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে দেবেন। এবং সে মসজিদটি তারই পরিকল্পনা মতো তারই নির্দিষ্ট স্থানে নির্মিত হবে।
সভাস্থ সকলে সাধু সাধু করে ওঠে। এ একেবারে মোক্ষম অস্ত্র। বিধর্মী খলিফা এক ঢিলেই কুপোকাত হয়ে যাবে। আর আমরাও বাজীমাত করে ফেলবো।
সম্রাট তখনই সে সভাস্থলে বসেই খলিফাঁকে এক পত্র লিখলেন।
মহামান্য ধর্মাবতার, সমগ্র আরব দুনিয়ার একচ্ছত্রাধিপতি আব্বাসের পঞ্চম পুরুষ খলিফা হারুন অল রসিদ।
অত্র পত্রে আমার বিনীত নিবেদন এই যে, আপনার সঙ্গে সখা-বন্ধন আরও নিবিড় আরও ঘনিষ্ঠ করতে আগ্রহী আমি। যদিও আপনি ইসলামের ধারক, তবু আপনার মহিমা ও সৎ গুণে আমি বিশেষ বিমুগ্ধ।
আমার কন্যা মিরিয়াম, আমার ভাগ্যদোষে, আজ অবাধ্য অবিনয়ী উদ্ধত এবং ব্যভিচারণী। প্রাসাদ থেকে পালিয়ে গেছে সে। খবর পেয়েছি, এখন সে মিশরের এক সওদাগর-পুত্রের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত আছে। আপনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান, আপনার সাম্রাজ্যে খ্রীষ্টান কন্যার এই কদাচার কখনও বরদাস্ত করবেন না, এই আমি আশা করি। পবিত্র মুসলমান ভূমি তার পদস্পর্শে কলুষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই আমার একান্ত অনুরোধ, আমাকে সহৃদয় বন্ধু বলে গ্রহণ করে আমার ঐ কলঙ্কিনী কন্যাকে এই উজিরের হাতে প্রত্যর্পণ করে আপনার নিগুঢ় বন্ধুত্বের বন্ধনে চিরকালের মতো আবদ্ধ করে রাখবেন আমাকে।
আপনার সঙ্গে আমার এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতির ব্যবহার চিরস্মরণীয় করে রাখতে চাই আমার এবং আমার প্রজাসাধারণের অন্তরে। প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ আপনার পরিকল্পনা ও ইচ্ছা অনুযায়ী আমি আমার সাম্রাজ্যে মুসলমান প্রজাসাধারণের হিতার্থে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করে দেব। এর ফলে ইসলাম-ধর্মীরা তাদের ঈশ্বরের উপাসনার এবং স্বজাতি মিলনের এক পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্র পেতে পারবেন। আপনার সম্মতি পেলেই আমার কারিগররা এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করে মসজিদের নক্সা ইত্যাদির কাজ পাকা করে আনতে পারে।
পরিশেষে লিখি, আমার কন্যাকে উদ্ধার করে যদি আপনি সরাসরি এখানে পাঠিয়ে দেন, তবে আরও ভালো হয়। সেক্ষেত্রে আপনি আপনার লোকজনের হাতে আমার উপহার উপঢৌকনের যৎসামান্য উপচারও পাঠাতে পারবো। আপনার হারেমের জন্য আমি দশটি গ্রীক-সুন্দরী বাঁদী সংগ্রহ করে রেখেছি। এ ছাড়া দাস দাসী নফর চাকরও অনেক থাকবে তাদের সঙ্গে। এই পরমা সুন্দরী বাঁদীদের দেহাভরণ অঙ্গ সাজ-সজ্জার জমকালো পোশাকাদির মূল্যও কিঞ্চিদধি দশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা হতে পারবে। অবশ্য মূল্য দিয়ে উপহারের মান বিচার করা সম্ভব নয়। আপনি যদি আমাকে এক দিনার মূল্যের কোন ভালোবাসার উপহার নিদর্শন পাঠান—তা হবে আমার মুকুট-মণির সমতুল্য।
আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করি। নিবেদন ইতি–
আপনাদের একান্ত বশংবদ
সিজার
কনসতানতাইনের সম্রাট
লেখা শেষ করে চিঠিখানা পড়ে শোনালেন সম্রাট। পাদরী-পিতা বললেন, দারুণ হয়েছে। ঐ মাথা-মোটা মুসলমান সুলতানটা এ টোপ গপ করে গিলবে, দেখে নেবেন। আপনার কন্যাকে যখন ওর লোকজনরা নিয়ে এসে নামবে-এই বন্দরে সঙ্গে সঙ্গে ঐ যবনদের শূলে চাপিয়ে খতম করে দেবেন। কারণ শত্রুর শেষ রাখতে নেই। ওরা হচ্ছে সর্বনাশার ঝাড়। আধমরা করে ফেলে রেখে দিলেও ওরা আবার বেঁচে উঠে সর্বনাশ করবে। ওদের প্রাণ বড় শক্ত। লোহার ডাণ্ডায় পিটলেও ব্যাটারা মরে না। একমাত্র শাস্তি ওদের শূলে গেঁথে মারা।
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
সাতশো বারতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
চিঠিখানা মোহর করে নতুন উজিরের হাতে দিয়ে সম্রাট বললেন, তুমি আমার দূত হয়ে বাগদাদে খলিফা হারুন অল রসিদের দরবারে যাবে। ভালো করে শোনো, তিনবার কুর্নিশ করবে তাকে। কুর্নিশ কী করে করতে হয় জান? যদি না জেনে থাক—মুসলমানী আদব কায়দা যারা জানে তাদের কারো কাছ থেকে জেনে নিও। মোট কথা সম্মান জানানোর ভড়ংটা যেন ঠিক থাকে। তারপর আমার চিঠিখানা তুলে দেবে তার হাতে। বলবে, আপনি যদি অনুমতি করেন; ধর্মাবতার—তবে কিছুদিন আমি এখানেই অবস্থান করি। রাজকুমারীকে যদি আমার সঙ্গেই দিয়ে দেন তবে আমিই তাকে নিয়ে যেতে পারি। খলিফা যদি বলে, থাকুন, আমি তার সন্ধান করে দেখছি—তবে ঐখানেই তুমি থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে একজন দূতকে পাঠিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়ে দেবে। আর যদি বলে, না, তার প্রয়োজন নাই, খোঁজখবর করে তাকে আমিই পাঠাবো আমার নোকজন দিয়ে, তা হলে আর অপেক্ষা করবে না সেখানে। সটান চলে আসবে।
সম্রাটের মন্ত্রী এসে হাজির হলো বাগদাদে খলিফার দরবারে। যথাবিহিত কুর্নিশাদি করে সে বললো, আমি এসেছি কনসনতাইন সম্রাটের দূত হয়ে। মহামান্য ধর্মাবতারকে আমাদের সম্রাট একখানি পত্র প্রেরণ করেছেন।
উজির জাফর চিঠিখানা পড়ে শোনালো হারু অল রসিদকে। খলিফা বললেন, ঠিক আছে, আপনি আমার প্রাসাদে অবস্থান করুন। আমি আমার সারা মুলুকের সর্বত্র চর পাঠাচ্ছি। সম্রাট-নন্দিনীকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখান থেকেই এনে এখানে হাজির করা হবে।
উজিরমশাই বিশেষ পুলকিত হয়ে ওঠে। –শাহেনশাহর অসীম করুণা।
খলিফা জাফরকে বললেন, জাফর মেহমানের আদর-যত্নে যেন কোনও ত্রুটি না হয়, দেখো। আর আজই সমস্ত শহর গঞ্জে চর পাঠাও। কনসনতাইন সম্রাট-কন্যা মিরিয়ামকে যেখানে যে
অবস্থায় পাওয়া যাবে আমার কাছে হাজির করতে নির্দেশ দেবে।
উজির জাফর জো হুকুম জাঁহাপনা, বলে মন্ত্রীবরকে নিয়ে অতিথিশালার দিকে পা বাড়ালো।
এদিকে মিরিয়াম তার ভালোবাসার পাত্র নূরকে নিয়ে দামাস্কাসের মনোরম পরিবেশে হেসে খেলে বেরিয়ে মজাসে দিন কাটাচ্ছিলো। হঠাৎ একদিন সুলতানের পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে গেলো তাদের। কোতোয়াল জিজ্ঞেস করে তোমার নাম ধাম কী?
নূর এবং মিরিয়াম গোড়া থেকে তাদের নাম ভাড়ায়নি। তার প্রয়োজনও বোধ করেনি। কারণ এখন তো তারা খ্রীষ্টান অধিকার থেকে মুসলমান সুলতান খলিফা হারুন অল রসিদের মুলুকে এসে বসবাস করছে।
নূর বললো, আমার নাম নূর আর আমার বিবির নাম মিরিয়াম।
—মিরিয়াম? মানে কনসতানতাইন-সম্রাটের কন্যা?
—জী হ্যাঁ। ঠিক আছে। খলিফা হারুন অল রসিদের হুকুমে তোমরা এখন তাঁর বন্দী। আজ তোমাদের বাগদাদে পাঠানো হবে।
অজানা আশঙ্কায় দুলে ওঠেনূর।—এ আবার নতুন কী ফ্যাসাদ হলো? আবার কী কয়েদ হতে হবে? ইয়া আল্লাহ, এই কী তোমার বিচার! ধরণীর এক কোণে আপন মনে আমরা দুজনে সুন্দরভাবে জীবন কাটাবোতাও তুমি হতে দিলে না?
মিরিয়াম ওকে সান্ত্বনা দেয়, দুঃখের দিনে বিচলিত হতে নাই, নুর! আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। তিনিই ঠিক পথে নিয়ে যাবেন আমাদের।
যথাসময়ে খলিফার দরবারে হাজির করা হলো ওদের।মিরিয়াম ও নুর দুজনে আভূমি আনত হয়ে খলিফাঁকে কুর্নিশ করে অবনত মস্তকে দাঁড়ায়।
দামাসকাসের সুবাদারের প্রধান সচিব বলে, ধর্মাবতার এই সেই মিরিয়াম, যাকে গ্রেপ্তার করার পরোয়ানা আপনি পাঠিয়েছিলেন সুবাদার সাহেবের কাছে। আর এ হচ্ছে নুর-কাইবোর। এক সম্ভ্রান্ত সওদাগরপুত্র। এরই সঙ্গে মিরিয়াম বসবাস করছিলো ওখানে।
খলিফা দৃষ্টিপাত করলেন। মেয়েটি অপরূপ সুন্দরী। মুখের দিকে তাকিয়ে কিন্তু বিধর্মী ম্লেচ্ছ খ্রষ্টান বলে মনেই হয় না।
-তা হলে তুমিই সেই মিরিয়াম-কনসতানতাইন সম্রাট-নন্দিনী?
খলিফার কণ্ঠস্বরে কিছুটা বুঝি বিদ্রুপের সুর। মিরিয়াম মাথাটা আরও খানিকটা অবনত করে বলে, ধর্মাবতারের বাঁদী হাজির জাঁহাপনা। আপনি আমাদের পয়গম্বর মহম্মদের চাচা আব্বাসের পঞ্চম পুরুষ-ইসলামের রক্ষাকর্তা। আমরা আপনার একান্ত অনুগত ভৃত্য।
এই স্তুতিবাক্যে খলিফা মুগ্ধ হলেন। এবার তিনি নূরের দিকে দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞেস করেন, আর তুমি বুঝি নুর—মিশরের সেই সওদাগরপুত্র?
নূর মাথা নুইয়ে বলে, আপনার বান্দার নাম নূর ধর্মাবতার এবং আমার বাবা কাইরোর এক সওদাগর।
হঠাৎ খলিফা গর্জে ওঠে বেতমিজ বেশরম, তুমি মুসলমানের সন্তান হয়ে এক ম্লেচ্ছ বিধর্মী খ্রীষ্টান কন্যার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছ? তুমি জান ইসলামের বিধানে এর কী সাজা?
নূর আরও বিনীত হয়ে বলে, জানি ধর্মাবতার। কিন্তু আমি বা আমরা ইসলামের কোনও বিধান লঙ্ঘন করিনি। আপনি যদি আমাকে বলার সুযোগ দেন আমি আমাদের আগাগোড়া
কাহিনী কোনও রকম বিকৃত না করে আপনার সামনে উপস্থাপন করতে পারি।
—বেশ বলো। খলিফা আদেশ করলেন। তখন নুর তাদের সমস্ত কাহিনী আদ্যোপান্ত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করে শোনালো। এখানে আর পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নাই!
সব শুনে খলিফা মিরিয়ামকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমার বাবা একজন দূতকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। তিনি আমাকে একখানা চিঠিও দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, আমি যদি তোমাকে ফেরত পাঠাই তবে তার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি তার দেশে মুসলমানদের নামাজের জন্য একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করে দেবেন। এবং সে মসজিদের পরিকল্পনার ভার আমাকে নিতে হবে। এখন এ বিষয়ে তোমার কী বক্তব্য?
এই কথা শোনামাত্র মিরিয়াম ফণিনীর মতো মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলতে থাকলো, ধর্মাবতার আপনি আল্লাহর বরপুত্র ইসলামের ধারক। পয়গম্বরের বাণীর যাতে কোনও অসম্মান অপমান বা অমর্যাদা না ঘটে সেই পবিত্র কর্তব্য আপনার ওপরে ন্যস্ত আছে। আমি এখন সাচ্চা মুসলমানী। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করি না। মহম্মদ আমাদের পয়গম্বর। এখন আপনি বলুন, কোন নীতিতে আপনি আমাকে বিধর্মী নাস্তিকের হাতে তুলে দিয়ে আমার ধর্ম ইজ্জত মান সব নষ্ট করতে অভিলাষী। যারা মনে করে তাদের মানব সূত যীশুও আমাদের আল্লাহর সমতুল্য, এবং যারা মূর্তিপূজা এবং ক্রুশকে ভক্তি করে, সেই ম্লেচ্ছ নাস্তিক বিধর্মী খ্রীষ্টানদের হাতে আমাকে তুলে দেবার অপরাধে আপনাকে আমি আল্লাহর দরবারে অভিযুক্ত করবো? এখানে তার বিচার হবার হয়তো কোনও সুযোগ নাই, কিন্তু আপনি জানবেন আপনার বিচার হবে শেষ বিচারের দিন তার দরবারে।
মিরিয়ামের এই দৃপ্তবাণী শুনে খলিফা বিচলিত হয়ে ওঠেন, দু চোখ জলে ভরে যায়।
কে তুমি কন্যা, তুমি আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিলে? তুমি যথার্থই বলেছ, কোনও সাচ্চা মুসলমানকে আমি বিধর্মী নাস্তিকের হাতে তুলে দিতে পারি না। আমি আল্লাহর তল্পিবাহক দাসানুদাস-ইসলামের রক্ষক। আমাকে এই মহা-পাতকের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন কন্যা। তোমার এই সৎ-সাহস এবং স্পষ্টবাদীতার জন্য আমি তোমাকে তোমার অভিরুচি মতো ইনাম দিতে চাই। তাতে যদি তুমি আমার সমগ্র মুলুকের অর্ধেকও চেয়ে বসো, সানন্দে দেব তোমাকে।
সুলতান বললো, মনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব জড়তা কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও। ভাবো, তারপর বলো, আর একটা কথা আমাকে বলতো মিরিয়াম, তুমি রাজার দুলালী। তোমার বংশমর্যাদা, আভিজাত্য অহঙ্কার এবং আত্মমর্যাদাবোধ সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটা ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে, কোনও এক সময়ে ঝোঁকের মাথায় ভালো লাগলেও লাগতে পারে, নূরের মতো এক অতি সাধারণ সওদাগর-তনয়কে জীবনসঙ্গী করে কী সুখী হতে পারবে?
মিরিয়াম বলে, আমার খেয়াল ও ঝোকের কথা বাদ দিন, ধর্মাবতার। আমি যদি তাকে আর নাও চাই সে কী আমাকে ছাড়বে? আর ছাড়বেই বা কেন? সে তো আমাকে উচিত মূল্য দিয়ে বাঁদী-বাজার থেকে সওদা করে। নিয়েছে। এখন আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাই তো শেষ কথা নয়। আর তা ছাড়া, আপনাকে একান্তে বলি, আমি নূরকে প্রাণাধিক ভালোবাসি। সে আমার জন্যে কী ভাবে দু’দুবার নিজের জীবন তুচ্ছ করতে পেরেছিলো—সে দিকটা একবার ভাবুন? আজ আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে এই যে কথা বলছি, এবং আমার ধর্মবিশ্বাসে অটল থাকতে পেরেছি—সে তো শুধু এই নূরেরই কল্যাণে। না হলে এতদিনে আমাকে কনসতানতাইন সম্রাটের সেই ঘাটের মড়া বুড়ো উজিরটার অঙ্কশায়িনী হয়ে স্বধর্ম ভ্রষ্ট হতে হতো।
খলিফা প্রীত হলেন। আর এক মুহূর্তও তিনি অপেক্ষা করতে চাইলেন না। বললেন, কাজী সাক্ষীদের ডাকো, এখনি এই দরবারকক্ষেই আমি এদের শাদী দিয়ে দেব। শুভ কাজে বিলম্ব করতে নাই।
এরপর সম্রাটের মন্ত্রী-দূতকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, সব তো নিজের কানেই শুনলেন। এই অবস্থায় আমি তো আপনার প্রভুর কাছে ফেরত পাঠাতে পারছি না তাকে। রাজকুমারী এখন মনে-প্রাণে মুসলমান। ইসলাম তার একমাত্র ধর্ম। আমি তো কোনও মুসলমানকে বিধর্মীর হাতে তুলে দিতে পারি না। ইসলামে তা মহাপাপের কাজ। আমি আল্লাহর তল্পিবাহক-ইসলামের রক্ষক হয়ে আমি নিজেই কী করে এই অনাচার করতে পারি। আপনি যা শুনলেন এখানে, সম্রাটের কাছে গিয়ে সব খুলে বলুন। হাত পা আমার বাঁধা, কিছুই করার নাই এ ব্যাপারে। আর আমি যদি আজ মহাপাতক হয়ে মিরিয়ামকে আপনার সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দিই তবে ইহজগতে আমিই হয়তো খলিফা বলে কোনও সাজা পাবো না, কিন্তু সেই শেষ বিচারের দিন, সে দিন? সে দিন তো খলিফা হারুন অল রসিদ আর ওরা নূর মিরিয়াম বলে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। সে দিন আমাকে কে রক্ষা করবে? আপনি বরং তার কাছে গিয়ে আমার অক্ষমতার কথা জানান।
এই সময় সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো চৌদ্দতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।
সম্রাটের দূত যখন পরিষ্কার বুঝতে পারলো, মিরিয়ামকে তিনি ফেরত পাঠাবেন না, তখন অস্বাভাবিক অভব্য ক্রোধে ফেটে পড়লো সে। সে সম্রাটের সামান্য এক মন্ত্রী, আর তার সামনে তামাম আরব দুনিয়ার অধিপতি আব্বাসের পঞ্চম পুরুষ ইসলামের রক্ষক ধর্মাবতার খলিফা। হারুন অল রসিদ মসনদে আসীন, সে কথা সে বেমালুম ভুলে গেলো।
-যীশুর নামে শপথ করে বলছি, হাজার বার সে ইসলামে দীক্ষা নিতে পারে, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না, কিন্তু তাকে তার বাবার কাছে ফিরে যেতেই হবে। তাতে যদি আপনি বাধা দেন, তবে ইউফ্রিট থেকে ইয়ামান পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত আপনার যে রাজ্যপাট, আমাদের সেনাবাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপে আপনাকে তা খোয়াতে হবে।
খলিফা গর্জে ওঠেন, কী এতবড় স্পর্ধা! এই কুত্তার বাচ্চা খ্রীষ্টানটা আমাকে শাসাচ্ছে? এখুনি ওর মুণ্ডুটা কেটে আমার প্রাসাদ-ফটকের সামনে ঝুলিয়ে দাও। আর ওর দেহটা ক্রুশে গেঁথে নর্দমায় ফেলে দিয়ে এস। ঘোষণা করে দিও, খলিফার হুকুমে দূতকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে।
সারা সভাস্থল ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। সেই নীরবতা ভঙ্গ করে মিরিয়াম কথা বলে, মহামান্য ধর্মাবতারের পবিত্র তরবারি এই কুত্তার রক্তে কলুষিত করবেন না জাঁহাপনা। আমি নিজের হাতে ওর সমুচিত সাজা দিচ্ছি। এই বলে মিরিয়াম ছুটে এসে মন্ত্রীটার কোমর থেকে তারই অসি খুলে নিয়ে প্রচণ্ড এক কোপে তার মুণ্ডটা কেটে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আর ওর ধড়টা পা দিয়ে লাথি মারতে মারতে দরবারের বাইরে ফেলে দিয়ে এলো।
এই তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হয়ে খলিফা তার নিজের মুকুট পরিয়ে দিলেন মিরিয়ামের মাথায়। এবং নূরকে ভূষিত করলেন এক মহামূল্যবান বাদশাহী সাজ-পোশাকে।
এক বিশাল উট-বাহিনীর পিঠে নানা অমূল্য উপহার উপঢৌকন সামগ্রী বোঝাই করে মিরিয়াম ও নূরকে তাদের স্বদেশ কাইরোয় পাঠিয়ে দিলেন খলিফা।
এইভাবে নূর মিরিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে অনেক দিন বাদে আবার ফিরে এলো তার বাবার কাছে। বহুদিন পুত্রের অদর্শনে বাবা সব রাগ রোষ ভুলে গিয়েছিলো। আবার সে ছেলে এবং তার বৌকে ফিরে পেয়ে আপন করে বুকে টেনে নিলো।
নূরের প্রত্যাবর্তন ও শাদী উপলক্ষে কাইরোর সম্ভ্রান্ত বণিক ও আত্মীয় ইয়ার বন্ধুদের ভোজ-সভায় আমন্ত্রণ জানালো ওর বাবা। নূরের বিবি মিরিয়ামকে দেখে পঞ্চমুখে প্রশংসা করে গেলো সবাই।
এরপর দীর্ঘকাল তারা একত্রে সুখে স্বচ্ছন্দে হেসে গেয়ে নেচে এবং আদর সোহাগ সহবাস করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছিলো।
গল্প শেষ হলো। শাহরিয়ার বললো, তোমার এই লড়াকু মেয়ের কিসসাটা খুব মজার লেগেছে, শাহরাজাদ। যাই হোক, আমার মনে হয়, তোমার গল্পের থলি প্রায় খালি হয়ে এসেছে, কী বলো? এবার তো তাহলে আমার সেই প্রতিজ্ঞা তোমার মুণ্ডচ্ছেদ—পালন করতে হয়–?
শাহরাজাদ ভাবে, আর বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা বোধ হয় সঙ্গত নয়। মৃদু কণ্ঠে বললো, এই দুঃসাহসিক লড়াই-এর কাহিনীর পর আরও চমৎকার দু একটা কাহিনী আপনাকে শোনাবো, জাঁহাপনা।
শাহরিয়ার বলে, তাই নাকি, আরও গল্প আছে তোমার ঝুলিতে? আচ্ছা, কি কিসসা শোনাবে বলো?