2 of 4

২.৩৯ কালো ঘোড়ার আশ্চর্য যাদু কাহিনী

আবলুস কাঠের এক যাদু-ঘোড়ার কাহিনী শুনুন এবার :

সেকালের পারস্য দেশে এক প্রবল পরাক্রান্ত শাহেনশাহ ছিলেন। তার নাম সাবুর। তাঁর তুল্য অতুল ঐশ্বর্য সে সময় আর কোনও সুলতান বাদশাহরই ছিলো না। শুধু ধনে নয়, জ্ঞানে গুণে গরিমাতেও কেউ তাঁর সমকক্ষ ছিলো না। ও-রকম উদার মহৎ দানশীল মহামতি শাহেনশাহ বড় একটা দেখা যায় না। তাঁর কাছে হাত পেতে কেউ কখনও বিমুখ হতো না। নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দান, আর্তের সেবা তার জীবনের অন্যতম প্রধান ব্রত ছিলো। গরীব, নিরস্ত্র অসহায়ের তিনি একমাত্র সম্বল। তার প্রাসাদের দ্বার সদাই উন্মুক্ত থাকতো তাদের জন্য। কিন্তু উদ্ধত অবিনয়ী, বিদ্রোহীকে তিনি তখনই কান্ত করতেন না। সেখানে তিনি কঠোর, নিৰ্মম, নিষ্ঠুর।

বাদশাহ সাবুরের তিন কন্যা। সকলেই পরম রূপ-লাবণ্যবতী। বেহেস্তের ডানাকাটা পরী বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। যেন রাতের আসমানে একই সঙ্গে তিনটি পূর্ণ চাঁদের হাট। অথবা বলা যায়, গুলবাগিচায় একই বৃন্তে প্রস্ফুটিত তিনটি গুলাব। সবুরের একটি পুত্র-সন্তানও ছিলো—কামার আল আকামর-অর্থাৎ চাঁদের মেলায় সব থেকে সেরা এক চাঁদ।

ফি বছর বাদশাহ সাবুর দু’বার খুব জাঁকজমক করে উৎসবানুষ্ঠান করতেন। বসন্তকালে যে উৎসবটি করা হতো তার নাম নওরোজ। আর শরৎ কালের নাম মীরগান।

উৎসব-কালে প্রাসাদের সমস্ত ফটক উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো। দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে জমায়েৎ হতো প্রাসাদে। বাদশাহের হুকুমে দু’হাতে দান ধ্যান করা হতো। পেট ভরে ফলার খাওয়ানো হতো। বাদশাহ খুশি হয়ে কোনও কোনও কয়েদীদের মেয়াদ কমিয়ে দিতেন। কেউ বা একেবারেই খালাস পেত। দরবার এবং দপ্তরের কর্মচারীদের পদোন্নতি হতো। বিশেষ বিশেষ যোগ্যতার জন্য বিভিন্ন শাহীখেতাব বিলি করা হতো। সেনাবাহিনীর মধ্যেও নানা ইনাম পুরস্কার বিতরণ করতেন। তিনি। শাহেনশাহকে অভিনন্দন জানাবার জন্য সারা মুলুক থেকে হাজারো জ্ঞানী গুণী, ধনী নির্ধন আসতো তার কাছে। যারা সওদাগর আমির ওমরাহ জাতের—তারা বাদশাহকে মূল্যবান ধনরত্ন চাকর নফর দাসী-বাদী, খোজা এবং নানারকম বাহারী বস্তু নজরানা দিয়ে যেত।

বসন্ত সময়ে নওরোজ উৎসবে বাদশাহ এক বিদ্যোৎসভার আয়োজন করতেন। বিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ বুৎপত্তি ছিল বাদশাহর।

এইরকম এক বসন্ত-উৎসবের দিনে নানা মুলুক থেকে তিনজন বিখ্যাত বিশারদ এসেছিলো তার কাছে। এবং এদের সকলেই অলৌকিক গুপ্তবিদ্যা এবং নানা কলা-কৌশলের অধিকারী।

তারা তিনজন তিনদেশের মানুষ। তাদের ভাষা আলাদা। একজনের হিন্দি, একজনের রুমি এবং অন্যজনের ভাষা পারসী।

প্রথমে হিন্দী-ভাষী পণ্ডিত কুর্ণিশ জানিয়ে বাদশাহকে বললো, আমি আমার দেশ এবং সম্রাটের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, জাঁহাপনা। আপনার আদর-আপ্যায়নে আমি আহ্বাদিত হয়েছি। আপনাকে একটি আশ্চর্য বস্তু উপহার দিতে চাই, শাহেনশাহ।

এই বলে সে বাদশাহ সাবুরের সামনে একটি অভিনব বস্তু স্থাপন করলো। একটি সোনার তৈরি মনুষ্যমূর্তি। বহু দুষ্প্রাপ্য মহামূল্যবান হীরক-খচিত তার সর্বাঙ্গ। হাতে একটা সুবর্ণ-শিঙা!

বাদশাহ প্রশ্ন করলেন, মূর্তিটা কীসের জন্য এনেছেন, পণ্ডিতজী? পণ্ডিতপ্রবর জবাব দিলো, এই মূর্তি এক অলৌকিক দৈব গুণের অধিকারী, জাঁহাপনা। একে যদি আপনি আপনার শহর-প্রান্তের সদর ফটকের মাথায় স্থাপন করেন, তবে এ এক দক্ষ অতন্দ্রা প্রহরী হয়ে দিবারাত্র আপনার শহর পাহারা দিতে থাকবে। বাইরের কোন শত্রুর ক্ষমতা নাই, যে আপনার শহর আক্রমণ করতে পারবে। দূর প্রান্তরে শত্রুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের এই শিঙীয় সে মুখ লাগবে। আর তৎক্ষণাৎ গভীর আর্তনাদ করে সমস্ত শহরবাসী, সৈন্য সামন্ত-সকলকে হুশিয়ার করে দেবে। এই শিঙার এমনই গুণ, এর সিংহনিনাদে শত্রুর কলিজা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। প্রাণভয়ে সেনাবাহিনী ছত্রাকার হয়ে প্রালিয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু এর আওয়াজের এমনই যাদু, কেউই পালাতেও পারে না। দেহ অসাড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ভয়ে, আতঙ্কেই তারা অক্কা পায়।

বাদশাহ সাবুর আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, ইয়া আল্লাহ, তাজ্জব কি বাৎ। আপনি যা বললেন, তা যদি সত্যি হয়, পণ্ডিতজী, আপনার কোনও বাসনাই অপূর্ণ রাখবো না আমি।

এরপর রুমি-পণ্ডিত উঠে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ জানালো। শাহেনশাহ মহানুভব, আমি এই রূপোর গামলায় চব্বিশটা সুবৰ্ণ-ময়ুরী পরিবৃত একটি সুবৰ্ণ ময়ুর উপহার দিতে এনেছি আপনাকে।

সাবুর জিজ্ঞেস করেন, এ দিয়ে কী হবে?

রুমি পণ্ডিত বলে, সারাদিন রাতে এই ময়ুরটা একঘণ্টা অন্তর অন্তর এই ময়ুরীগুলোর সঙ্গে কাম-সংসর্গে মিলিত হবে। দিন-রাতে চব্বিশ ঘণ্টায় চব্বিশটির সঙ্গে সে রতি-রঙ্গ করবে। প্রতিবার রাগমোচনের সময় প্রচণ্ড শব্দে সে পাখা ঝাপটাবে। এবং তা থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘডির সময়-সংকেত বোঝা যাবে। এইভাবে দিনে দিনে যখন মাস ফুরিয়ে যাবে তখন ময়ুরটা মুখ ব্যাদন করবে একবার। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে নিৰ্গত হয়ে আসবে প্রতিপদের একখানা চাঁদ।

বাদশাহ অবাক হয়ে শুনছিলেন এতক্ষণ, এবার বললেন, আপনার কথা যদি সত্যিই ঠিক হয়, পণ্ডিতপ্রবর, তবে আপনারও কোন বাসনা অপূর্ণ রাখবো না আমি।

এবার উঠে দাঁড়ায় পারস্য-পণ্ডিত। বাদশাহকে যথারীতি কুর্ণিশ ও সৌজন্য দেখিয়ে সে বলতে থাকে, জাঁহাপনা আমি আপনার জন্যে এনেছি। একটি সামান্য ঘোড়া। তাও আবার জ্যান্তি নয়। কাঠের তৈরি একটা খেলনা বলতে পারেন।

এই বলে পারস্য-পণ্ডিত বাদশাহের সম্মুখে কৃষ্ণবৰ্ণ আবলুস কাঠের একটি ঘোড়া দাঁড় করিয়ে দিলো।

—দুষ্প্রাপ্য আবলুস কাঠের তৈরি এই কালো ঘোড়াটি এক অলৌকিক দৈবশক্তি-সম্পন্ন।

বাদশাহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন, অতি মূল্যবাদন মণিমুক্তা হীরেজহরতে খচিত জীনলাগামে সুসজ্জিত ঘোড়াটা দেখতে বড়ই বাহারী, চমৎকার! দেখতে দেখতে ভুলে যেতে হয়, জানোয়ারটা প্রাণহীন একটা কাঠের পুতুল মাত্র।

পারস্য-পণ্ডিত বলতে থাকে, এমনি আশ্চর্য ব্যাপার, ঘোড়াটার ওপর চেপে বসলে সোওয়ারকে নিয়ে সে ওপরে শূন্যে উঠে যায়। তারপর তার ইচ্ছা মতো বায়ুবেগে উড়ে চলে। একটা জ্যান্ত ঘোড়ার এক বছরের পথ একলহমায় অতিক্রম করে যেতে পারে সে।

একদিনে একই সময়ে রকম তিনটি পরমাশ্চর্য বস্তুর সন্ধান পেয়ে বাদশাহ সাবুর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। কিছুক্ষণ তাঁর মুখে কথা সরে না। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।

–এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে সত্যি সত্যিই ঘটতে পারে। আমি এখন ভাবতেই পারছি না। যাই হোক, যা আপনি বললেন তা যদি সত্যিই ঘটাতে পারেন, যা চাইবেন তাই আপনাকে দেব আমি।

তিনদিন ধরে এই তিনটি অলৌকিক বস্তুর প্রত্যক্ষ পরীক্ষা নিলেন তিনি। সোনার মূর্তি শিঙে ফুকলো। সোনার ময়ুর প্রতি ঘণ্টায় ময়ূরী সহবাস করে সময় নির্দেশ করলো। এবং সব শেষে পারস্য-পণ্ডিত তার আবলুস কাঠের ঘোড়ায় চেপে শো-শোঁ করে শূন্যে উঠে গিয়ে বিদ্যুৎগতিতে এক বিশাল বৃত্ত পথপ্রদক্ষিণ করে আবার যথা নির্দিষ্ট স্থানে এসে অবতরণ করলো।

এই সময় রাতের আঁধার সরে যেতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো ষোলতম রজনী সমাগত আবার সে বলতে থাকে :

তিন পণ্ডিতের এই অলৌকিক বিদ্যা দেখে বাদশাহ সাবুর একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আনন্দ শিহরণে তার সর্বাঙ্গ কাপতে থাকে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। তিনি। মাটিতে গড়িয়ে পড়েন।

কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সংযত করে নিয়ে পণ্ডিতপ্রবরাদের জিজ্ঞেস করেন তিনি, আপনাদের অপার দৈব ক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ! এখন বলুন, আপনারা কী চান? আমি আপনাদের সব বাসনা পুরণ করবো।

তিনজনে সমবেতভাবে জানালো, বাদশাহ আমাদের ওপর সস্তুষ্ট হয়েছেন জেনে বড় আহ্লাদ হচ্ছে। আমাদের মনোবাঞ্ছা পূৰ্ণ করতে চান তিনি। আমরা তিনজনেই এক বস্তুর প্রার্থী। বাদশাহ তিন কন্যার পিতা। আমরা তিনজনে তার এই কন্যাদের পাণি-প্রার্থনা করছি। আমরা তার জামাতা হতে চাই।

আপনাদের শাদী দিয়ে দিচ্ছি। এবং এক্ষুণি। শুভ কাজে দেরি করতে নাই।

তখুনি কাজীকে ডাকা হ’লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাক্ষীসাবুদ সঙ্গে নিয়ে হাজির হলো সে। সঙ্গে সঙ্গেই শাদীনামা বানানো হলো।

পর্দার ওপাশে বসেছিলো তিনকন্যা। আর এপাশে বাদশাহ কাজী এবং তিন পণ্ডিত! পর্দার আড়ালে বসে মেয়েরা তাদের স্ব স্ব হবু স্বামীকে নিরীক্ষণ করতে থাকলো।

সবচেয়ে ছোট কন্যার বরাতে জুটেছে লোলচর্ম পঙ্কিত কেশ এক বৃদ্ধ। বয়সের গাছপাথর নাই তার। কম করে হলে একশ বছর হবে। মাথাটা বলতে গেলে একরকম ন্যাড়াই। পিছনের ঘেরে দু-চার গাছি সাদা রোঁয়া এখনও লেগে লেগে আছে। ভু দুটো একেবারে চাছা মোছা। ইয়া বড় বড় গাধার মতো তার কান। কিন্তু এই বুড়ো হাড়েও শখ মরেনি, দাঁড়ি গোঁফ কুচকুচে কালো রঙে রঙ করে এক অদ্ভুত সঙ সেজেছে। একেবারে বেমানান বিশ্ৰী লাগছে। তার ঘোলাটে চোখে ছানির পর্দা, নাকটা থ্যাবড়া, কপাল বলিরেখায় কণ্টকিত। জরায় বার্ধক্যে মুখের চামড়া কুঁচকে এক অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে। বুনো শুয়োরের মতো দাতালো দাঁত। নিচের ঠোঁটটা অস্বাভাবিক ভাবে ঝুলে পড়েছে। মনে হয়, ঠিক যেন উটের অণ্ডকোষ! এক কথায় বলতে গেলে এই বৃদ্ধ পণ্ডিত এক মূর্তিমান আতঙ্ক বিশেষ। হত। কুৎসিত বীভৎস-দর্শন একটা দানবের হতশ্ৰী তার সর্বাঙ্গে।

কিন্তু অন্যদিকে ছোট কন্যার রূপলাবণ্যের কোনও তুলনা হয় না। তার মতো পরমাসুন্দরী সারা আরব দুনিয়ায় একশো বছরের মধ্যে কেউ জন্মায়নি। শুধু কি দেখতেই সে নিখুঁত সুন্দরী; তার মতো কোমল স্বভাবের কন্যাই বা কটা মেলে। হরিণীর মতো চঞ্চল সে, ঝরণার মতো উচ্ছল। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে সন্ধ্যাসমীরণ তার পায়ে মাথা কুটে। আসমানের চাঁদ সালাম জানায়। তরুশাখা আন্দোলিত করে আলিঙ্গন জানাতে চায়। বাগিচার ফুল বলে; ধন্য আমরা শাহজাদী, তোমার স্পর্শ পেয়ে আমাদের ফুটে ওঠা সার্থক হয়।

ছোট কন্যা যখন তার হবু বরকে প্রত্যক্ষ করলো, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না কিছুতেই। ছুটে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো।

বোনের এই অবস্থা দেখে তার ভাই কামার আল আকমর সস্নেহে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বোন, কেঁদেছিস কেন?

-কী হয়েছে, কী হতে চলেছে, কিছুই কী জান না, বড় ভাই?

কামার আল বলে, না বোন, কিছুই জানি না আমি। একটা দিন শিকারের সন্ধানে প্রাসাদের বাইরে ছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই এমন কী ব্যাপার ঘটতে পারে? তোর চোখে পানি? এতো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না, বোন? কিছুই বুঝতে পারছি না। আর দেরি না করে চটপট সব খুলে বলো, দেখি!

—সবই বলবো, বড় ভাই। তোমার কাছে লুকোবার আমার কী আছে? কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো, এত বড় অন্যায় আমি কিছুতেই মেনে নেবো না। তোমার বাবা, নিশ্চিতভাবেই ক্ৰোধে ফেটে পড়বেন আমার এই ব্যবহারে। কিন্তু দাদা, এভাবে আমার এই জীবন-যৌবন ব্যর্থ হতে দিতে পারি না আমি। তোমার বাবার খামখেয়ালের পুতুল নই আমি। তিনি আমার জিন্দগীটা বরবাদ করে দেবেন, আর আমি তা মুখ বুজে সহ্য করবো—সে কিছুতেই হয় না-হতে পারে না। তোমার বাবার খপ্পর থেকে পালিয়ে যাবো—যাবোই। কেউ জানবে না, আমি এই ঐশ্বৰ্য-সুখের প্রাসাদপুরী থেকে চুপিসারে পালিয়ে যাবো। এবং এও জেনে রাখো, দাদা, একেবারে শূন্য হাতে বেরিয়ে যাবো আমি। প্রাসাদের কোনও ধনদৌলত সঙ্গে নেব না। কামার অল অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে, কিন্তু কী, ব্যাপার কী? কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না, বোন! খুলে বল আগে শুনি। হঠাৎ এতো উত্তেজিত হয়ে পড়লে কেন?

ছোট বোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকে, তুমি আমার একমাত্র ভাই, তোমার কাছে কিছুই গোপন করবো না, দাদা। বাবা আমাকে একশো বছরের এক বুড়ো পণ্ডিতের সঙ্গে শাদী দেবেন। তিনি নাকি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন তিনি, এ আমি কিছুতেই সহ্য করবো না।

কামার অল অবাক হয়, কিন্তু হঠাৎ ঐ বুড়ো পণ্ডিতকে কথাই বা দিতে গেলেন কেন শাহেনশাহ?

—সেই পারস্য পণ্ডিত বাবাকে যাদু করেছে। একটা কাঠের ঘোড়া এনে বাবাকে সে বললো, এর পিঠে চেপে বসলে সোয়ারকে নিয়ে সে আসমানে উঠে গিয়ে সহস্ব যোজন পথ নিমেষে অতিক্রম করে যেতে পারবে।

পণ্ডিতের কথা শুনে বাবা বলেছিলেন, যদি সত্যিই তা হয়, তবে যা সে চাইবে তাই তিনি দেবেন। তাকে। কি আশ্চৰ্য্য, পণ্ডিতের কী ভেল্কিবাজী, ঘোড়াটা সত্যি সত্যিই তাকে নিয়ে মহাশূন্যে উঠে বিশাল বিস্তুত বৃত্তপথে কয়েকবার পাক দিয়ে আবার এসে নেমে পড়লো!

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাই।’

পণ্ডিত আমাকে শাদী করতে চাইলো। বাবা, সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন। তোমাকে কি বলবো বড় ভাই, লোকটা কি কুৎসিত কদাকার, একটা বুড়ো-হাবড়া। তুমি নিজে চোখে একবার তাকে দেখে এসো, তা হলেই সব বুঝতে পারবে।

কামার আল সান্ত্বনা দেয়, অধৈর্য হয়ে না, বোন। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখনি বাবার সঙ্গে দেখা করছি।

ভাই-এর কথা শুনে ছোট বোন কিছুটা আশ্বস্ত হয়। কামার আল বাবার কাছে গিয়ে বলে আব্বাজান, এসব কী শুনছি? আপনি নাকি একটা যাদুকরের ভেন্ধীতে ভুলে ছোটকে তার সঙ্গে শাদী দেবেন, কথা দিয়েছেন? এমন কী অলৌকিক বস্তু সে আপনাকে উপহার দিয়েছে, যার জন্যে আপনি আমার বোনের জীবনটা বরবাদ করে দিতে উদ্যত হয়েছেন? এ আপনার ভীষণ অন্যায়, বাবা। এ ব্যাপার কিছুতেই ঘটতে দেওয়া যেতে পারে না।

পারস্য-পণ্ডিত পাশেই ছিলো। কামার অলের সব কথাই সে শুনতে পেল। প্রচণ্ড ক্ৰোধে সে ফেটে পড়তে চাইলো।

বাদশাহ সাবুর বললেন, কামার অল, তুমি তো সেই অলৌকিক ঘোড়ার দৈব ক্ষমতা দেখনি। একবার যদি নিজের চোখে দেখ, তা হলে বুঝতে পারবে, কী মহামূল্যবান বস্তু তিনি আমাকে উপহার দিয়েছেন। তার বদলে আমার কাছে সামান্যই চেয়েছেন তিনি।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো সতেরতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

বাদশাহ সাবুর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে আসেন। ক্রীতদাসদের হুকুম করেন, ঘোড়াটা বাইরে বের করে নিয়ে আসতে।

কালো কাঠের ঘোড়াটাকে দেখে শাহজাদা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এমন সুন্দর গড়ন সে খুব কমই দেখেছে। কামার অল দুর্ধর্ষ ঘোড়সোয়ার, পলকে সে ঘোড়াটার পিঠে লাফিয়ে উঠে বসে। লাগামে বঁটাকনি দেয়। কিন্তু কাঠের ঘোড়াটা নড়ে না। খেলনার মতোই দাঁড়িয়ে থাকে। বাদশাহ পণ্ডিতকে বলে, কী ব্যাপার, নড়ে না কেন? নিশ্চল পুতুলের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো কেন? আমার ছেলের মনের দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে দিন, পণ্ডিতপ্রবর। তা না হলে যে তার কাছে মিথ্যোবাদী হয়ে যাবো আমি।

পারস্য পণ্ডিত কামার অলের কথায় রুষ্ট হয়ে ছিলো। তার কারণ বাদশাহ কন্যার সঙ্গে তার শাদীতে সে বাধ সোধেছে। গভীর কণ্ঠে সে কামার অলকে বললো, জীনের ডান পাশে একটা সোনার বোতাম দেখছেন? ওটাই আসল চাবি কাঠি। টিপে ধরুন, দেখবেন ঘোড়া ওপরে উঠতে শুরু করেছে…

কামার অল তৎক্ষণাৎ সেই সোনার বোতামে মোচড় দিতেই শো শো শব্দ করে মহাশূন্যে উঠে যায় ঘোড়াটা। আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখে সকলে, ঘোড়ার আকার ক্রমশই ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর এক বিন্দুর মতো হয়ে পলকের মধ্যে দৃষ্টিপথের ওপরে চলে গেলো।

কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলো। বাদশাহ উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কামার অল ফিরে আসে না। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে সে পণ্ডিতের দিকে তাকায়, এখন কী উপায় পণ্ডিতপ্রবর, কী করে তাকে নামিয়ে আনা যায়?

পণ্ডিত বলে, জাঁহাপনা, আমার করার কিছুই নাই। আপনার পুত্রকে আর ফিরে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছি না আমি। একমাত্র শেষ বিচারের দিনেই তার সঙ্গে দেখা হতে পারবে।

বাদশাহ আর্তনাদ করে ওঠেন, সে কি?

পণ্ডিত বলে, জীনের বা পাশে আর একটা সোনার বোতাম আছে। সেটা টিপে নিচে নেমে আসা যায়। কিন্তু আপনার পুত্র আমার সব কথা শোনার আগেই সে ডান পাশের বোতাম টিপে ওপরে উঠে গেলো। আমি কী করবো বলুন জাঁহাপনা? আমার কী গোস্তাকি?

বাদশাহ ক্ৰোধে জ্বলে উঠলেন। নিগ্রো নফরদের ডেকে হুকুম দিলেন এই পারসী বদমাইশটাকে বেদম প্রহার করে অন্ধকার কারাগারে কয়েদ করে রেখে দাও।

তারপর পুত্রশোকে বাদশাহ বুক চাপড়াতে লাগলেন। বাদশাহী সাজপোশাক ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে থাকলেন। মাথার মুকুট খুলে ফেললেন। দাঁড়ি গোঁফ ছিঁড়তে লাগালেন। প্রাসাদে প্রবেশ করে সমস্ত দরজা জানালা রুদ্ধ করে দিলেন। মেজেয় পড়ে হাত পা ছুঁড়ে গোঙতে লাগলেন। বেগম সাহেবাও তার পুত্রশোকে কেঁদে কেঁদে সারা হতে থাকলেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিন কন্যা, উজির, আমির, আমলা দাস দাসী নফর চাকর বাঁদী সকলেই। সারা শহরে উঠলো কান্নার, গগন-বিদারী আর্তনাদ। এমন যে আনন্দ উৎসবের হাট, পলকে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেলো। সারা প্রাসাদে সারা শহরে নেমে এলো হতাশা, শোক দুঃখ তাপের এক কালো ছায়া।

শাহাজাদাকে পিঠে নিয়ে ঘোড়াটা ঊর্ধ্বলোকে একটানা উঠে যেতে থাকে। কোনও দিকেই তার গতি ফেরানো যায় না। এইভাবে উঠতে উঠতে সে এক সময় সূর্যের কাছাকাছি এসে পড়ে। কামার অল বুঝতে পারে, মৃত্যু অবধারিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যের দাবিদাহে সে দগ্ধ হয়ে যাবে। সেই ভয়াবহ অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি এসে পড়েছে সে। এই তো মউৎ এড়াবার কোনও পথ নাই। কামার অল ভাবে, পণ্ডিত তার উপর উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পেরেছে। তার বাড়াভাতে ছাই দিতে গিয়েছিলাম আমি। তারই উচিত পুরস্কার সে আমাকে দিয়েছে। লোকটা মহা শয়তান। আমারই উচিত হয়নি, তার এই যাদুযান্ত্রে চেপে বসা। কিন্তু সে-সব কথা এমন ভেবে কী লাভ? কী করে এখন নিজেকে বাঁচানো যায়? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এ সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও উপায় নাই।

হঠাৎ কামার অল-এর মাথায় এক প্রশ্ন জাগে? আচ্ছা, ওপরে ওঠার জন্য যেমন এই বোতাম নিচে নামার জন্যও তো তেমনি কিছু একটা থাকবে? তা না হলে ঐ পণ্ডিতই বা নেমেছিলো কী করে?

আতি-পাতি করে এপাশ ও পাশ হাতড়াতে থাকে। সে। হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় জীনের বাঁ পাশে এক জায়গায় আর একটা ছোট্ট বোতাম তার হাতে ঠেকে। খুবই ছোট্ট—একটা আলপিনের মাথার টুপির মতো প্ৰায়। আল্লাহর নাম নিয়ে সেই বোতামটায়। সে চাপ দেয়। আর কী আশ্চর্য, তৎক্ষণাৎ ঘোড়ার উর্ধ্বগতি রুদ্ধ হয়ে আসে। ঘোড়াটা এক পলকের জন্য, সেই নিঃসীম মহাশূন্যে অনড় অচল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর আবার শো-শোঁ করে নিচের দিকে নামতে থাকে। যেমন তীরবেগে উঠেছিলো, তেমনি তীরবেগেই নামতে থাকলো। এইভাবে নামতে নামতে সে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবীর পরিধির মধ্যে এসে পড়ে। তারপর যতই মাটির নিকটবতী হতে থাকে গতি ক্বমশঃ হ্রাস পায়। এবং মাটির তলদেশ স্পর্শ করার সময় এক চুল ঝাকানিও লাগে না তার।

কামার আল জামান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায়। তারই অপার মহিমায় আজ তার জীবন রক্ষা পেলো। এতক্ষণে সে ঘোড়ার কলকন্তুজার হদিশ পেয়ে গেছে। কী ভাবে উপরে নিচে ওঠা নামা করা যায় তা তার জানা হয়ে গিয়েছিলো। এবারে সে সামনে পিছনে চালাবার চাবিকাঠির সন্ধান পেয়ে গেলো। নিচে নেমে আসার একটু পরেই সে আবার উঠে গেলো। আর একটা চাবি টিপে সামনের দিকে এবং অন্য আর একটা চাবি টিপে পিছনের দিকে ইচ্ছা মতো চালনা করে সব ব্যাপারটা রপ্ত করে ফেললো।

এইভাবে সে বহু নদী সমুদ্র গিরিপর্বত অতিক্রম করে নানা সুন্দর সুন্দর দেশ পরিভ্রমণ করতে থাকলো।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো আঠারোতম রজনী। আবার সে বলতে থাকে :

চলতে চলতে এক সময় সে এক সুন্দর সাজানো গোছানো শহরের ওপর এসে পড়ে। বড় মনোরম সেই শহরের শোভা। কামার অল ভাবলো, এইখানে সে নামবে। শহরটির মাথার ওপরে বারিকয়েক চক্কর দিলো সে। তারপর একটা পছন্দসই জায়গা দেখে আস্তে আস্তে নামতে থাকে।

সূর্য তখন পাটে বসেছে। দিনের আলো নিভে আসছে। প্রায় গোধূলি লগ্ন। শহরটার শোভা দেখে মন প্ৰাণ জুড়িয়ে যায় কামার অলের। মনে মনে ভাবে, সেদিনের রাতটা সে সেই শহরেই কাটাবে। কাল সকালে সে ফিরে যাবে নিজের মুলুকে, নিজের শহরে। বাবা, মা, বোনদের সে শোনাবে তার বিচিত্র অভিযানের অদ্ভুত এই কাহিনী।

মাটির কাছাকাছি আসতে সে দেখলো, একটা প্রাসাদের ঠিক ওপরে এসে গেছে তার ঘোড়া। যদি আর কোনও ভাবে না চালায় তবে সে ঐ বিশাল ইমারতের ছাদে গিয়ে নামবে।

প্রাসাদটা শহরের ঠিক মাঝখানে। তার চুড়ায় চল্লিশজন সশস্ত্র নিগ্রো প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। তাদের সকলের হাতেই উন্মুক্ত তরোয়াল, কাঁধে তীর ধনুক, বর্শা।

শাহজাদা কামার অল আকমর ছাদের এক প্রান্তে এসে নামলো। তখন সবে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। শাহজাদা ছাদের ওপরে ঘোড়ার পিঠে চুপচাপ বসে রইলো অনেকক্ষণ। রাত্রি আরও গম্ভীর হলো। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন সে ঘোড়ায় পিঠ থেকে ছাদের ওপরে নেমে পড়লো।

সারাটা দিন কিছু পেটে পড়েনি। ক্ষিদেয় পেট চো চো করছে। কিন্তু কীই বা উপায়? পিপাসাতেও গলা শুকিয়ে কাঠ। পানিই বা কোথায় পাবে সে?

অবশেষে মরিয়া হয়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। নামতে নামতে একেবারে নিচে প্ৰাসাদ প্রাঙ্গণে নেমে আসে। কিন্তু কী আশ্চর্য এত বড় প্রাসাদে কোনও জন-মানবের অস্তিত্ব বুঝতে পারে না সে। মনে হয়, একেবারে পরিত্যক্ত পুরী।

এদিক ওদিক বেশ ভালো করে খুঁজে পেতে দেখে সে। কিন্তু না; কোথাও কেউ নাই। কামার অল ভাবে, আবার সে ছাদেই ফিরে যাবে। আজকের রাতটা কোনরকেমে ছাদেই শুয়ে সে কাটাবে। তারপর সকাল হতে না হতে নিজের শহরে ফিরে যাবে।

এই ভেবে সিঁড়ির দিকে আবার ফিরে আসতে থাকে সে, হঠাৎ একটা ক্ষীণ আলোর রোশনাই এসে লাগলো তার চোখে। লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো, প্রাসাদের একবারে অন্তরপ্রদেশ থেকে আসছে সেই আলোর রশ্মি।

আলোর নিশানা ধরে পায়ে পায়ে সে এগিয়ে আসতে থাকে প্রাসাদের অন্দরমহলে। একেবারে হারেমের দরজার সামনে। সেখানে একটা খাটিয়ায় শুয়েছিলো একটা নিগ্রো খোজা। প্রচণ্ড নাসিকা গর্জন তুলে সে ঘুমোচ্ছে। তার মাথার কাছে রাখা একটা চিরাগ। এই বাতির আলোর নিশানা ধরেই আসতে পেরেছে সে।

দরজাটাকে আড়াআডি করে এমন ভাবে তার বিশাল লাশটা পড়ে আছে কার বাপের সাধি, ডিঙিয়ে কেউ ঘরের ভিতরে ঢুকতে পারে। পাশে একখানা খাড়ার মতো প্রকাণ্ড তলোয়ার-একেবারে খোলা। এবং মাথার ওপরে থামের আংটায় ঝুলানো একটা সিকেয় তার কিছু খাবার।

দৈত্যের মতো বিশাল বাপু ঐ নিগ্রোটাকে দেখে কামার অলের বুক কাঁপতে থাকে। ওরে বাস, একেবারে সাক্ষাৎ দোজকের দূত। হায় আল্লাহ, এ কোথায় নিয়ে এলে আমাকে? তোমার দোয়াতে একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। কিন্তু এবার বোধহয় বেঘোরেই প্ৰাণটা হারাতে হবে। কিন্তু খিদেয়। আমার পেট জ্বলছে, চোখের সামনে এইসব দাবার দেখে চুপ করেই বা থাকি কি করে। নসীবে যা থাকে হবে, খাবারের সিকেটা খুলে নিয়ে যেতেই হবে আমাকে।

অতি সন্তৰ্পণে সে সিকেটা খুলে নিয়ে আবার পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে। নানা রকম মুখরোচক খাবার-দাবারে ঠাসা ছিলো সিকেটা। চলতে চলতেই সে একটু একটু করে মুখে পুরতে থাকে। কী সুন্দর স্বাদ! প্রাসাদ প্রাঙ্গণের একপাশে একটা ফোয়ারা দেখতে পেয়ে সে-দিকে এগিয়ে যায়। খাবারগুলো সব খেয়েদেয়ে ফোয়ারার কাছে এসে প্রাণভরে পানি খায়। তারপর আবার ফিরে আসে খোঁজটার পাশে। খুব সাবধানে যথাস্থানে টাঙিয়ে রাখে। সিকেটা, এবং আলতোভাবে তলোয়ারখানা তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে আবার বেরিয়ে আসে। খোজাটা তখনও দৈত্যের মতো পড়ে পড়ে নাক ডাকতে থাকে।

শাহরাজাদ দেখলো রাত শেষ হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশে ঊনিশতম রজনী:

শাহরাজাদ বলতে থাকে :

চলতে চলতে সে এক সময় আর একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজার সামনে একটা মখমলের পর্দা ঝুলছিলো। পর্দটা তুলে ভিতরে ঢুকতে দেখলো, একটা প্রশস্ত শয্যাকক্ষ। মাঝখানে একটা শশাঙ্ক শুভ্ব নয়নাভিরাম হাতীর দাঁতের পালঙ্ক। হীরে চুনী পান্না মুক্তো বসানো। চারটি ডাগর-ডাসা মেয়ে মেজেয় শুয়ে ঘুমে অচেতন। কামার অল পায়ে পায়ে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য—শয্যাশায়িনীকে দেখা।

নব-যৌবন-উদ্ভিন্না অসামান্যা রূপলাবণ্যবতী এক কণক কন্যা আলুলায়িত কেশে সারা মুখ আবৃত, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সকাল বেলা সূর্য ওঠার কালে পূর্ব দিগন্ত যে অবর্ণনীয় রূপচ্ছোটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই আলোকসামান্য রূপের জেল্লা তার সর্বাঙ্গে।

কামার আল আকামর-এর সারা দেহে শিহরণ খেলে যায়। এমন সুন্দর মেয়ে সে এই প্রথম দেখলো। ধীরে মুখটা নামিয়ে এনে সে মেয়েটির গালে আলতোভাবে একটি চুম্বন একে দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। চোখ মেলে তাকায়। হরিণীর মতো কাজল-কালো টানাটানা চোখে এক নিদারুণ বিস্ময় ফুটে ওঠে।

—কে তুমি? কেন এসেছ, কতক্ষণ এসেছ, কেমন করে ঢুকেছ এখানে?

এক সঙ্গে এক রাশ প্রশ্ন। কোনটার জবাব দেবে কামার আল?—আমি তোমার বান্দা।

–কে তোমাকে নিয়ে এলো এখানে?

কামার অল বলে, খোদা, আমার নসীব, আমার সৌভাগ্য।

তরুণীর নাম সামস অল নাহার। খুব সহজভাবেই সে প্রশ্ন করে, তুমি কী হিন্দুস্থানের কোনও বাদশাহজাদা? গতকাল সে আমার বাবার কাছে এসে আমাকে শাদী করার প্রস্তাব করেছিলো। কিন্তু আমার বাবা তাকে জামাতা করতে রাজী হন নি?

কামার অল জানতে চায়, কেন?

–সে নাকি দেখতে ভীষণ বিশ্ৰী ছিলো, তাই। কিন্তু তোমাকে দেখে কুশ্ৰী বলবে কে? তোমার মন-ভোলানো রূপের বাহারে আমি তো প্রথম দর্শনেই মোহিত হয়ে গেছি।

সামস অল নাহারের মুখে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে কামার অলের মন খুশিতে ভরে যায়। মুগ্ধ হয়ে অপলকভাবে দেখতে থাকে। ওকে। সামস অল দুহাত বাড়িয়ে কামার অলকে কাছে টেনে নেয়। তারপর দুজনে দুজনের বাহু বন্ধনে বাধা পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। দেহ দিয়ে দেহের সুধা পান করার এক অপোর আনন্দে অধীর হয়ে ওঠে। ওরা।

তারপর রাত্ৰি গভীরতর হতে থাকে। কামনার আগুনও জ্বলে ওঠে ওদের দেহে। নানারকম আদর সোহাগ চুম্বনে মেতে ওঠে। ওরা। হঠাৎ একসময় মেজেয় শোয়া একটি দাসীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। অবাক চোখে তাকায় সে। তাদের শাহজাদীর শয্যায় অচেনা অজানা এক নওজোয়ানকে দেখে আঁৎকে ওঠে, আপনার পাশে কে, শাহজাদী?

সামস অল বলে, আমি জানি না। ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এ। প্রথমে মনে হয়েছিলো, কাল বাবা যে শাহজাদাকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন, বুঝি সে। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, না, তা নয়।

দাসীটা বলে, না না, সে হতে যাবে কেন? সে তো হত-কুৎসিত কদাকার ছিলো দেখতে। আমি নিজে চোখে তাকে দেখেছি। আর এর তো চাঁদের মতো সুরৎ। মনে হয় কোনও এক বাদশাহর ছেলে। কাল যে আপনাকে শাদী করার জন্য এসেছিলো। সে আপনার নফর। চাকর বান্দা হওয়ার যোগ্য নয়।

এরপর দাসীটা খোজাঁটার কাছে গিয়ে জাগালো তাকে।

—খুব তো নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। এদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেলো! এবার তোমার গর্দান যাবে।

খোঁজটা ধড়মড় করে উঠে বসে, এ্যাঁ! কী হয়েছে?

কী হয়েছে? কী হয়নি, তাই বলে! তুমি আছো হারেমের পাহারায়। অথচ নাক ডাকিয়ে সারারাত ঘুমাও! তোমার নাকের ডগা দিয়ে শাহজাদীর ঘরে ঢুকেছে এক শাহজাদা, সে খবর রাখা কী?

খোজাটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ তোলে? আঁ, কী বললে? শাহজাদীর ঘরে ঢুকেছে পরী-পুরুষ?

তড়াক করে সে লাফিয়ে দাঁড়ায়। তলোয়ারখানা হাতে নিতে যায়। কিন্তু একি! কোথায় গেলো তার তলোয়ার? খালি খাপখানা দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে? এবার সে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। থর থর করে কাঁপতে থাকে সারা শরীর। দিশাহারা হয়ে ছুটে আসে। শাহজাদীর ঘরে। কামার অল তখনও শাহজাদীর বাহুপাশে আবদ্ধ মধুর আলাপ রত।

এই প্রেমালাপনের দৃশ্য দেখে নিগ্রোটার মুখ হাঁ হয়ে যায়। কথা বেরোয় না কয়েক মুহূর্ত। তারপর ভয়ে জবুথবু হয়ে জিজ্ঞেস করে, মালিক, আপনি কী কোন জীন বা আফ্রিদি? না,

নিগ্রোটার কথায় রোষে। ফেটে পড়ে কামার আল। —এত বড় স্পর্ধা তোর, তামাম পারস্য মুলুকের শাহেনশাহ আমার বাবা সাবুর। তাঁর একমাত্র পুত্র আমি। আর আমাকে বলিস কিনা—জিন, না, আফ্রিদি?

এই বলে সে সিংহবিক্রমে লাফিয়ে ওঠে শয্যা ছেড়ে। তলোয়ারখানা বাগিয়ে ধরে বলে, আমি তোর সুলতানের জামাতা। তার এই কন্যার সঙ্গে আজ রাতে আমার শাদী হয়েছে। তাই তার শোবার ঘরে তাকে নিয়ে আমি মধুযামিনী কাঁটাচ্ছি। এত বড় সাহস তোর, ঘরে

খোজা নিগ্রোটা এবার খানিকটা ধাতস্থ হয়।–মালিক, আপনি যদি সত্যি শাহজাদা হন তা হলে একশোবার বলবো, আমাদের শাহজাদীর যোগ্য বর হয়েছে। আপনার মতো এমন খুবসুরৎ শাহজাদা আমি আর দেখিনি কখনও। খুব ভালো হয়েছে—চমৎকার মানানসই হয়েছে। এরপর খোজাটা ঘর ছেড়ে চলে গেলো। চলে গেলো একেবারে সোজা সুলতানের শোবার ঘরে। মাথার চুল ছিড়ে, কপাল বুক চাপড়াতে থাকলো, সর্বনাশ হয়ে গেছে, জাঁহাপনা।

সুলতান তো অবাক, আরে, কী হয়েছে বলবি তো? শুধু শুধু হা-হুতাশ করে মাথার চুল ছিড়লে আর কপাল বুক চাপড়ালে বুঝবো কী করে? খুলে বল আগে। কী এমন বিপদ ঘটলো? যা বলার খুব চটপট সংক্ষেপে বল, একদম কোনও ভণিতা করবি না। তোর ঐ বিকট চিৎকার। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। নে, যা বলার তাড়াতাড়ি বল। শাহজাদা দেখলো, প্রভাত সমাগত। গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশে কুড়িতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

নিগ্রোটা বিকট আওয়াজ করে আর্তনাদ তোলে, জাঁহাপনা, আর এক মুহূর্ত দেরি করবেন। না। শিগ্‌গির চলুন, দেখবেন, আপনার কন্যার শোবার ঘরে এক আফ্রিদি জিন এসেছে। শুয়ে আছে শাহজাদীর সঙ্গে। এক শাহজাদার রূপ ধরে এসেছে সে।

সুলতান তখন ক্ৰোধে জ্বলে উঠলেন। মনে হলো, তখুনি বুঝি বা তিনি নিগ্রোটার গর্দান নামিয়ে দেন।

—তোর এত বড় সম্পন্ধা, আমার মেয়ের ঘরের দরজায় নজর রাখিস না। তোর চোখের সামনে দিয়ে অন্য লোক তার ঘরে কী করে ঢোকে? সারাদিন রাতের জন্য পাহারা করে রাখা হয়েছে তোকে। পাহারা না দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাস নাকি, বাঁদর?

সুলতান আর বেশি বাক্য বায় না করে প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে গেলো শাহজাদী সামস অল নাহারের ঘরের দরজায়। দাসীগুলো ভয়ে বিবর্ণা, থর থর করে কাঁপছিলো।

-শাহজাদীরা কী হয়েছে?

সুলতান কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করেন।

দাসীদের মধ্যে একজন কাঁপতে কাঁপতে বললো, আমরা কিছুই জানি না, জাঁহাপনা। ঘুমিয়েছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতে দেখি, শাহজাদীর শয্যায় চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর এক শাহজাদা। খুব ঘনিষ্ট হয়ে দু’জনে গল্প করছিলেন। দেখে মনে হলো, কত কালের যেন চেনা জানা। সত্যি কথা বলতে কী, জাঁহাপনা, এমন রূপবান পুরুষ আমরা জীবনে কখনও দেখিনি। তবে সন্দেহ হয়, সত্যিই সে শাহজাদা, না, আফ্রিদি। যেই হোন। তিনি, তাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

সুলতানের রাগ কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসে। খুব আস্তে আস্তে পর্দা উঠিয়ে তিনি দেখতে থাকেন, এক অপূর্ব সুন্দর যুবক তাঁর কন্যার বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন। তার মুখখানা বিলকুল চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর।

সুলতান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, এমন সময় ঘুমের ঘোরেই শাহজাদী ছেলেটিকে আদর করতে থাকে। মুখখানা আরও কাছে টেনে এনে ছেলেটির একটা গালে অধর রাখে। এবার আর স্থির থাকতে পারেন না। সুলতান। কোমর থেকে তলোয়ার খুলে বাগিয়ে ধরে ভিতরে ঢোকেন। তিনি। পিতৃত্বের সহজাত ঈর্ষা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে দুজনেরই তন্দ্ৰা কেটে যায়। কামার আল জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবা?

সামস অল ঘাড় নেড়ে জানায়, হ্যাঁ।

কামার অল তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে তলোয়ারখানা উচিয়ে ধরে গর্জে ওঠে। সুলতান মুহূর্তেই বুঝে নেয়, যুবকের সিংহবিক্রম প্রতিরোধ করার তাকত তার নাই। সঙ্গে সঙ্গে দুই কদম তিনি পিছিয়ে গেলেন। তলোয়ারখানা নামিয়ে নিলেন। মুখে মধুর সম্ভাষণ টেনে বললেন, বেটা, তুমি মানুষ না জিন-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

—ইয়া আল্লাহ, আপনি শাহজাদীর পিতা হতে পারেন। কিন্তু আপনার এই কথায় আমি আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না। আপনার কন্যাকে আমি প্ৰাণাধিক ভালোবেসে ফেলেছি। না হলে, আপনাকে এই মুহূর্তে আমি খতম করে ফেলতাম। শুধু রেহাই পেলেন। শাহজাদীর বাবা বলে আপনার এতবড় সাহস, আমি পারস্য অধিপতির পুত্র, আমাকে কিনা বলেন, জিন, না, দৈত্য? যদি আমরা ইচ্ছা করি, তবে এক লহমায় আপনাকে তখত থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি। আপনার এই প্রাচীর-প্রাকার সুরক্ষা, আর আপনার মোন ইজ্জৎ সব মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারি, সে কথা জানেন?

সুলতান এবার নিশ্চিত হন। না, এ কোনও জিন আফ্রিদি নয়। সাচ্চা এক সুলতান বাদশাহরই ছেলে। মনে মনে শ্রদ্ধা এবং ভয়-দুই জেগে ওঠে।

—যদি তুমি সত্যিই কোনও শাহজাদা হও, তবে আমার বিনা আমন্ত্রণে আমার প্রাসাদের হারেমে এসে ঢোকার দুঃসাহস কী করে হয় তোমার? তুমি এক বাদশাহর সন্তান হয়ে অন্য এক সুলতানের কন্যার ইজ্জতই বা নষ্ট কর কী করে? তুমি আমার মাথা হোঁট করে দিয়েছ। কিন্তু তুমি কী জান, আমার এই কন্যার জন্য আমি কত সুলতান বাদশাহ এবং তাদের পুত্রদের প্রাণ সংহার করেছি। তারা আমার কন্যাকে জোর জবর-দস্তি করে কেড়ে নিয়ে যেতে এসেছিলো। এবং তারই ফলে এই সব কাণ্ড আমাকে করতে হয়েছে। আজ তুমি আমার মেয়ের ঘরে চোরের মতে ঢুকেচ্ছ। তাকে গোপন শাদী করে তার ইজ্জত নিয়েছ। …কিন্তু ভেবে দেখ, এখন আমি যদি আমার লোকজনদের হুকুম দিই, তোমার গর্দান থাকবে?

কামার অল বলে, তা হলে এও জেনে রাখুন। সুলতান, আপনার ঘাড়েও মাথা থাকবে না। আপনার মগজে যদি বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু থাকে তাহলে ঐ ধরনের খামখেয়ালীর কাজ করতে সাহস পাবেন না। আপনি। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো আমার চেয়ে ভালো পাত্র আপনি কোথাও জোগাড় করতে পারবেন? আমার মতো বীর্যবান এবং সম্ভ্রান্ত শাহজাদা কী ভুরি ভুরি মিলবে আপনার কন্যার জন্য?

—সে কথা ঠিক। পাত্র হিসাবে তোমার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কাজীকে ডেকে বিধান সম্মত ভাবে শাদী না হলে গোপন-শাদী আমি মানি না।

কামার আল বলে, আপনার কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু সেই কারণে এখন আপনি যদি আপনার সেপাই পেয়াদাকে ডাকেন তাহলে কী আপনার আখেরে ভালো হবে? একবার যদি সেই ভুল করেন, হাতের তীর ছিলা ছেড়ে চলে যায়, তবে হাজার চেষ্টা করেও আর নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না। আপনার তখন্ত, সালতানিয়ৎ, সম্মান সবই ধূলোয় মিশে যাবে, সুতরাং রাগ রোষে মাথা গরম করে কিছু করবেন না। খুব ঠাণ্ডা মগজে বেশ ভালো করে ভেবে দেখুন। পরে আমাকে কোনও দোষ দিতে পারবেন না। আমি আপনাকে যথেষ্ট সুপরামর্শই দিচ্ছি। এবং আপনার মঙ্গলের জন্যই।

রাত্রির অন্ধকার সরে যেতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো একুশতম রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে শুরু করে :

কামার আল বলতে থাকে, দুটো পথ আপনার সামনে খোলা আছে। হয় আপনি এখনি আমার সঙ্গে এক অসি-যুদ্ধে আসুন, আমি আপনাকে এক ঘায়ে কুপোকাৎ করে সিংহাসন অধিকার করবো, না হয়। আজ সারা রাত আপনার কন্যার সঙ্গে আমাকে সহবাস করতে দিন। কাল সকালে আপনার তামাম সলতানিয়তের যত সৈন্যসামন্ত আছে, সব ডেকে আনুন, আমি লড়বো তাদের সঙ্গে। ভালো কথা, সংখ্যায় তারা কত হবে?

সুলতান বলে চল্লিশ হাজার। এর মধ্যে আমার নফর চাকর ক্রীতদাস বা তাদের অনুচরদের ধরিনি। তারাও নেহাত নগণ্য নয়!

কামার আল বলে, অতি উত্তম, কাল ভোরে তাদের সকলকে ডাকুন। আমাকে দেখিয়ে তাদের বলুন, ‘এই মানুষটি আমার কন্যার পাণি-প্রার্থী। কিন্তু আমি তাকে বলেছি, আমার সমগ্র সৈন্য-বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে তাদের হারাতে হবে। তবেই পাবে তাকে, তার আগে নয়।’ তারা যদি রাজি হয়, আমার সঙ্গে লড়াই করার স্পর্ধা নিয়ে এগিয়ে আসে, এবং সম্মুখ সমরে আমাকে যদি নিহত করতে পারে। তবে আপনার মান ইজৎ সবই রক্ষা পাবে। আর যদি না পারে—? যদি তারা পরাজিত হয়ে পালায়, তবে? তখন কিন্তু মাথা নুইয়ে আমাকে আপনার জামাতা করেই নিতে হবে, সুলতান।

সুলতান মনে মনে মতলব ভাঁজে। যুবকের এই প্রস্তাবই মেনে নিতে হবে। তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে নামা বুদ্ধিমানের কাজ না। বয়সের ভারে সে এখন ক্লান্ত, ’যৌবনের শক্তি এবং সিংহবিক্রমে যখন ভাটা পড়েছে, এ অবস্থায় এই রকম এক নওজোয়ান যোদ্ধার সঙ্গে এক এক লড়াই-এ নামা উচিত হবে না। কিন্তু আমার গোটা সৈন্য-বাহিনীর সঙ্গে সে লড়বে? লোকটা কী পাগল? যাক নিজের নিবুদ্ধিতাতেই সে খতম হবে, কোনও চিন্তা নাই। সুলতান নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবে, কাল সকালেই বাছাধনের গর্দান গড়াগড়ি যাবে আমার প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে। জাত মান কুল সবই রক্ষা পাবে। সুতরাং এই পথই অনুসরণ করা শ্রেয়ঃ মনে করলেন তিনি।

-ঠিক আছে, আজ রাতটা তুমি যে ভাবে কাটাতে চাও কাঁটাও, আমি কোনও বাধা দেব না। কিন্তু কাল সকালে তোমার মউৎ কেউ রুখতে পারবে না।

সুলতান সদৰ্পে সেখান থেকে নিজের কক্ষে চলে গেলেন। খোজাকে বললেন এখুনি উজিরকে খবর দে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই উৎকণ্ঠিত উজির হাজির হলে, সুলতান তাকে সব ঘটনা খুলে বলে বললেন, আর তিল মাত্র দেরি করবে না, এখুনি যাও, সেনাবাহিনীকে তৈরি হতে বলে। সকালেই তারা যেন আমার প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে হাজির থাকে। আমি ঐ উদ্ধত শাহাজাদাকে সমুচিত সাজা দিতে চাই।

উজির আশ্বাস দিয়ে বলে, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্ৰা যান, জাঁহাপনা। যা করার সব আমি করছি। লোকটার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ, না হলে গোটা ফৌজের সঙ্গে লড়াই করার কথা বলে। আপনার সৈন্যবাহিনীতে এমন সব জাঁদরেল যোদ্ধা আছে, তাদের একজনের সঙ্গেই সে লড়তে পারবে না, তা আবার গোটা বাহিনী! ছোঃ!

সুলতান গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু তা বলে, তুমি শুধু সেনাপতিদেরই ডেকো না। আমি চাই আমার পুরো সেনাবাহিনীই হাজির থাকবে আমার প্রাসাদের সামনে।

উজির আর কথা বাড়ায় না, আপনি যখন বলছেন, তাই হবে, জাঁহাপনা। উজির সোজা চলে যায় ফৌজ দপ্তরে। সেখানে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ব্যবস্থা সব পাকা করে রাখে।

সুলতান শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকেন, ছেলেটি ভারি সুন্দর। যেমন তার রূপ, তেমনি তার বীরের মতো সুঠাম দেহ। আর কী সুন্দর কথা বলার কায়দা। এমন খানদানী ব্যবহার রক্তে না থাকলে রপ্ত করে হয় না। আহা, এমন সুন্দর চাঁদের মতো ছেলেটা যদি তার জামাই হতো, কী-ভালোই না হতো! কিন্তু সবই নসীবের লেখা, তাকে আজ হাতের মুঠোয় পেয়েও চিরদিনের মতো হারাতে হচ্ছে। কাল সকালেই আমার ফৌজদের তলোয়ারের ঘায়ে লুটিয়ে পড়বে তার গর্দান! উফ, ভাবতেও কষ্ট লাগে। কিন্তু উপায়ই বা কী? তার মতো গোয়ার ছেলের এ ছাড়া আর কী পাওনা থাকতে পারে? সে যদি আমার কাছে ক্ষমা চাইতো। না না, তাই বা কী করে সম্ভব? ক্ষমা করাই সে শিখেছে, ক্ষমা চাওয়ার কথা সে ভাববে কী করে? সে তো বাদশাহজাদা!

তবু আর একবার তার কাছে যাওয়া যাক। যদি সে মাথা নোয়ায়। তা হলে সব কূলই বজায় থাকে। মেয়েটাও সুখী হতে পারে, সে নিজেও জামাতা-গর্বে গর্বিত হতে পারে। আর সবার ওপরে সন্ত্রম ইজৎ, জাত মান কুল সব রক্ষা হয়। কিন্তু তা কী হবে?

সুলতান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। কিন্তু না, আবার সেখানে যেতে পা চলে না। যদি সে ভাবে, আমি সন্ধির ছুতোয় তার কাছে গিয়েছি? না না না, আমি তাকে তেমন কিছু ভাববার সুযোগ দেব না। যাব না।

ভোর না হতেই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। রণসাজে সজ্জিত হাজার হাজার সৈন্য-সামন্ত এসে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে থাকে।

শাহাজাদা কামার অলকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান দরবার কক্ষে প্রবেশ করে তখতে আরোহণ করেন। বান্দাদের হুকুম করেন, এই শাহজাদার জন্য আমার আস্তাবলের সবচেয়ে সেরা তাজা ঘোড়াটা নিয়ে এসে জমকালো যুদ্ধ সাজে সাজিয়ে দে।

সুলতানের এই হুকুম শুনে কামার অল বলো, আমার জন্যে কোন যুদ্ধের ঘোড়া দরকার হবে না।

সুলতান অবাক হয়ে তাকান, তবে কী তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবে নাকি?

–না, আমার নিজেরই ঘোড়া আছে। আপনার ঘোড়ার কোনও দরকার নাই।

সুলতান আরও অবাক হন, তোমার ঘোড়া? কোথায় তোমার ঘোড়া?

কামার আল বলে, হ্যাঁ, আমার ঘোড়া! যাতে চেপে আমি এসেছি আপনার প্রাসাদে। আমি সেই ঘোড়ায় চেপেই লড়াই করবো।

— কোথায় তোমার ঘোড়া? কোথায় রেখে এসেছ?

—কামার আল ছাদের ওপরের দিকে তর্জনী তুলে বলে, প্রাসাদের ছাদে আছে সে।

সারা দরবার কক্ষ ক্ষণ-কালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। কারো মুখে কোনও কথা সরে না। ছেলেটা বলে কী? সত্যিই ওর মাথার গোলমাল আছে। সুলতান ভাবে, শেষ পর্যন্ত একটা উন্মাদকে হত্যা করে কী সে মহাপাতক হতে যাচ্ছে?

সুলতান বললেন, এসো আমার সঙ্গে এসো। তোমার জন্যে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে আঁঠুক্তি কারা এসে হাজির হয়েছে, দেখবে, এসো।

কামার অলকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান দরবার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। হাজার হাজার বর্মশিরস্ত্ৰাণ পরা অসি-বর্শা হাতে সৈন্যসামন্ত জড়ো হয়েছে প্রাসাদের সামনে পোলো-খেলার মাঠে। পুরাভাগে সেনা-বাহিনীর প্রবীণরা ঘোড়ার পিঠে চেপে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। সুলতান বললেন, এই আমার সমগ্র সেনা-বল। এদের সঙ্গে একা তুমি লড়বে বলে বড়াই করেছ। সে যাক, এখন তৈরি হয়ে নাও। আমার সৈন্যরা প্রস্তুত।

তারপর তিনি তার সেনাপতিদের ডেকে বললেন, এই যুবক এসেছে আমার কন্যাকে শাদী করবে বলে। জামাতা হবার পক্ষে উপযুক্ত পোত্র, সন্দেহ নাই। যেমন এর রূপ-যৌবন তেমন তার সাহস বিক্রম। কিন্তু এ আমার কাছে মাথা নোয়াতে রাজি নয়। বলে, এমনি না দিলে, জোর করে নিয়ে যাবে আমার মেয়েকে। এর ধারণা, আমার এই বিশাল সৈন্য-বাহিনীকে একই জব্দ করতে পারবে। আমি একে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি, আমার সৈন্যবল অসীম। কিন্তু সেকথা কানেই তুলতে চায় না। এই বীরপুরুষ। যাক, এবার তোমরাই তৈরি হও। এখনই শক্তি পরীক্ষা হয়ে যাবে। একটা কথা, তোমরা সংখ্যায় অনেক, আর এ একা। তোমাদের একমাত্র কাজ হবে, একে প্রতিহত করা—নিহত করা নয়!

তারপর সুলতান কামার অল-এর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, বেটা, বুকে সাহস সঞ্চয় কর, লড়াইএ তুমি জয়ী হলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো।

কামার অল বলে, কিন্তু সুলতান, একি আপনার আচরণ! আমি মাটিতে দাঁড়িয়ে, আর আপনার সেনাপতিরা ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করবে? একি মহারথী প্রথা?

সুলতান বলে, কিন্তু বেটা, আমার কী দোষ, আমি তো তোমাকে আমার আস্তাবলের সবচেয়ে সেরা লড়াকু ঘোড়াই দিতে চেয়েছিলাম? তুমিই তো নিলে না! এখনও বলছি, আমার অশ্বশালায় চলো, যেটা তোমার পছন্দ, তুমি নিজেই বেছে নাও, আমি খুব খুশি হবো।

কামার আল বলে, আপনার কোনও ঘোড়া আমার প্রয়োজন নাই। আমার নিজের ঘোড়াতে চেপেই আমি লড়াই করতে চাই।

–কিন্তু কোথায় সে ঘোড়া?

কামার আল আবার প্রাসাদের ছাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ঐ ছাদের এক পাশে রাখা আছে।

–ছাদের ওপরে রাখা আছে? তোমার ঘোড়া?

হয়, লোকটা বলে কী?

কামার আল বলে, হ্যাঁ, আমার ঘোড়া। কাল সন্ধ্যায় আমি ঐ ঘোড়ায় চেপেই এই প্রাসাদে এসেছি।

সুলতান সেনাপতিদের বলেন, যাও তো, দেখে এসো। ছাদের ওপরে ঘোড়া কী করে যেতে পারে! তাজ্জব কি বাত!

সুলতানের নির্দেশে সেনাপতিরা প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়।

একি, সত্যিই তো একটা তাগড়াই ঘোড়া ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে? কুচকুচে কালো, গা বেয়ে যেন তেল ঝরে পড়ছে এমন চমৎকার ঘোড়া তারা আগে কখনও দেখেনি। সেনাপতিরা আরও নিকটে যায়। কিন্তু একি, এতো একটা কাঠের ঘোড়া-খেলনা মাত্র! সবাই সমস্বরে হো হো করে হেসে ওঠে।

—যুবকটি নিশ্চয়ই এক বদ্ধ উন্মাদ। আহা, হয়তো কোনও সুলতান বাদশাহরই সন্তান। মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। প্রধান সেনাপতি বলে, সবাই মিলে ধরাধরি করে ঘোড়াটাকে সুলতানের সামনে নিয়ে চলো। তামাশাটা তিনি বুঝতে পারবেন।

সেনাপতিরা ঘোড়াটাকে কাঁধে করে নিচে নামিয়ে আনে। সুলতানের সামনে রেখে বলে, সব বুজরুকী, জাঁহাপনা। এটা একটা কাঠের খেলনা ঘোড়া।

রাত্রির অন্ধকার কেটে যায়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো বাইশতম রজনী :

সে শুরু করে :

প্রধান সেনাপতি বলে, আমার মনে হচ্ছে, জাঁহাপনা ইনি কোনও সম্ভ্রান্ত সুলতান বাদশাহর সন্তান। কিন্তু কোনও কারণে এর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। তা না হলে এ ধরনের অদ্ভুত প্রস্তাব কেউ রাখতে পারে না। আমার সেনাবাহিনীর বিক্রম আমি জানি। তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়বে এই বাদশাহাজাদা–তাও এই কাঠের পুতুল নিয়ে? হা হা—

সুলতান থামিয়ে দিয়ে বলেন, থামো, আত্ম গর্বে ফুলে উঠে না। শক্রকে কখনও খাটো করে ভাবতে নাই।

তারপর কামার অলকে উদ্দেশ করে বললেন, এই তোমার ঘোড়া? একটা কাঠের খেলনা? এই দিয়ে তুমি লড়বে আমার এই বিপুল বাহিনীর সঙ্গে?

—কামার আল খুব সহজ শান্তভাবে জবাব দেয়, হ্যাঁ। এই আমার আজব ঘোড়া। এরই ভেন্ধী দেখে আপনি ভিরমি খাবেন। একটু সবুর করুন, এখনই প্রমান পেয়ে যাবেন।

এই বলে সে ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে যায়। তার গলায় হাত রাখে। শুনুন সুলতান, এই কাঠের ঘোড়ায় চেপে আমি আপনার সেনাবাহিনীকে–ডাইনে বাঁয়ে ঘায়েল করতে থাকবো।

সুলতান হাসতে হাসতে বলে, একশোবার। সব বীরপুরুষই তাই করে। শত্রুকে শায়েস্তা করাই বীরের ধর্ম। সেখানে কেউ কাউকে রেহাই দেবার কথা ভাবে না। তুমিও কাউকে রেহাই দেবে না, মনে রেখ, তারাও তোমাকে রেয়াত করবে না।

এরপর কামার অল এক লাফে ঘোড়াটার পিঠে উঠে বসে। হাজার হাজার সৈন্য-সামন্ত, শত সহস্র প্রাসাদ-পুরবাসী নরনারী–সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঘোড়সওয়ার কামার অল-এর দিকে। সবাই সংশয়ে দোদুল্যমান। একটা কাঠের ঘোড়া সজীব হয়ে লড়াই করবেএমন তাজ্জব কথা কী-শুনেছ। কেউ? সেই অভাবনীয় অলৌকিক দৃশ্য আজ তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। দারুণ কৌতূহলের চাপা গুঞ্জনে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণ গমগম করতে থাকে।

তাকে প্রতিরোধ করার জন্য অশ্বারোহীরা আরও সামনে এসে সারিবদ্ধ-ভাবে তলোয়ার বাগিয়ে দাঁড়ায়। একজন নির্দেশ দেয়, যখনই সে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে: আর তিল মাত্র অপেক্ষা করবে না তোমরা। ঝোপ বুঝে কোপ মেরে একেবারে সাবাড়ি করে দেবে।

কিন্তু অন্য একজন বলে, ইয়া আল্লাহ, এমন চাঁদের মতো ছেলে, একে আমরা হত্যা করবো কি করে? এমন সুন্দর ফুলের মতো নরম শরীরে খাড়ার ঘা বসাবো কি করে? সারা আরব দুনিয়া টুডিলে এমন সুঠামদেহী সুন্দর সুপুরুষ কটা পাওয়া যাবে?

আর একজনের মন্তব্য : আমরা যত সহজে ওকে কাবু করতে পারবো ভাবছি, ব্যাপারটা, আমার মনে হয়, তত সহজ নয়। আমরা ভাবছি, সে পাগল, কিন্তু তার আদব-কায়দা, কথাবার্তায় তো আদৌ মনে হয় না? মাথার কোনও গোলমাল আছে? আর তা যদি না থাকে, তবে সে কি এতই মুখ, আমাদের এই বিশাল সৈন্য-বাহিনীর সঙ্গে লড়ার পায়তারা করবে? হারাতে ওকে হবেই, কিন্তু খুব সহজে আমরা জিততে পারবো তাও ভাবা উচিত না। যাই হোক, প্ৰাণপন লড়ে আমাদের মান ইজৎ বাঁচাতেই হবে।

জিনের ওপর ঠিক হযে বসে, রেকবীতে পা ঢুকিয়ে, লাগাম হাতে ধরে কামার অল আকমর। তারপর ডানদিকের বোতামটায় আঙ্গুল রাখে। অল্প একটু চাপ দিতেই, সকলকে স্তব্ধ বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে ঘোড়াটা ঈষৎ কেঁপে উঠে। শো শোঁ করে উধ্বাকাশে উঠে যেতে থাকে। সুলতান, উজির আমির এবং তাবৎ সৈন্যবাহিনীর সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁ করে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। সকলেরই বাহ্যজ্ঞান তখন লোপ পেয়ে গিয়েছিলো।

স্বল্পক্ষণের মধ্যে সুলতান সম্বিত ফিরে পান। চিৎকার করে ওঠেন। তিনি, পালিয়ে গেলো, পাকড়াও! জলদি–

সেনাধ্যক্ষ শান্ত কণ্ঠে বলে, কিন্তু জাঁহাপনা, ডানাওলা পাখীকে কি তাড়া করে ধরা যায়? সে তো আমাদের তীর বর্শার পাল্লা ছাড়িয়ে অনেক-অনেক ওপরে উঠে গেছে। তাকে পাকড়াও কী ভাবে করা সম্ভব।

সমগ্র সৈন্য-বাহিনী আকাশের দিকে চোখ রেখে দেখতে থাকলো, ঘোড়াটা উঠতে উঠতে এক সময় তীরবেগে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলো।

উজির বললো, এ কোনও সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। নিশ্চয়ই কোনও জিন আফ্রিদি অথবা কোনও যাদুকর। যাক, চলে গেছে, বাঁচা গেছে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন।

দুর্বোধ্য এক বিস্ময় নিয়ে সুলতান প্রাসাদের অন্দরে যান। সামস অল নাহারকে সমস্ত ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে বলে বোঝাবার চেষ্টা করেন, আসলে সে কোনও মনুষ্যসন্তান নয়, মা। হয় কোনও জিন আফ্রিদি, নয় কোনও যাদুকর।

কিন্তু শাহাজাদী সে কথা বিশ্বাস করে না। অঝোের নয়নেকাঁদতে  থাকে। কপাল বুক চাপড়াতে চাপড়াতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সুলতান তাকে আদর করে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকেন;।

–আল্লাহকে শত সহস্র ধন্যবাদ জানাও, মা। তিনি আমাদের এই অলৌকিক দৈব-দুর্বিপাক থেকে উদ্ধার করেছেন। কে জানে, তার খেয়াল হলে এক লহমাতে সে আমার গোটা সৈন্যবাহিনীই খতম করে দিতে পারতো। কিনা! লোকটা একটা আস্ত শয়তান, ঠগ, মিথ্যেবাদী, জোচ্চোর, শূয়ার!

কিন্তু এতেও শাহজাদী শান্ত হও না। আরও আকুল হয়ে কাঁদতে  থাকে।

—খোদা মেহেরবান, সে আর যদি ফিরে না আসে, এই আমি বলে রাখলাম, আব্ববাজান, নাওয়া-খাওয়া কিছুই আমি করবো না। যতদিন না সে এসে আমাকে গ্রহণ করে, আমি না খেয়ে শুকিয়ে মরবো।

সুলতান ভাবলেন, বৃথাই তাকে সান্ত্বনা দেওয়া। কোনই ফল হবে না। সারা দুনিয়া তার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। বিড়বিড় করে কী সব আবোল তাবোল। আওড়াতে থাকলেন।

এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো তেইশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

উল্কার গতিতে ঘোড়াটাকে উপরে মহাশূন্যে তুলে এনে কামার আল সামনের দিকে ছুটে চললো। এই দিকে তার স্বদেশ। চলতে চলতে সে ভাবে, প্রিয়া রইলো তার পিতার প্রাসাদে বন্দী হয়ে। তাকে সে একদিন উদ্ধার করে নিয়ে যাবেই। তা সে যে ভাবেই হোক। প্ৰিয়তমার বাবার সালতানিয়তের নাম সে জেনেছে। ইয়ামান। আর শহরটার নাম সানা।

বলতে গেলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বায়ু বেগে ছুটতে ছুটতে, ঘোড়াটা তার নিজের শহর-সীমায় এসে পড়ে। বিরাট একটা চক্কর দিয়ে সে নিচে নেমে পড়ে। একেবারে তার নিজের প্রাসাদের ছাদের ওপর। ঘোড়াটাকে সেইখানেই দাঁড় করিয়ে তরতর করে সে নিচে নেমে যায়-সিডি বেয়ে।

সারা প্রাসাদে তখন কবরের নিস্তব্ধতা। কামার আল বুঝতে পারে না, কেন এই নীরব নিঃঝুম আবহাওয়া! এ-ঘর ও-ঘর সে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কোথাও কোনও টু শব্দটি নাই। মনে হয় এক নিদারুণ শোকের ছায়া ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। কামার অল ভাবে, নিশ্চয়ই কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। হয়তো কেউ মারা গিয়েছে। আর ভাবতে পারে না সে। হন হন করে সে তার বাবার একান্ত ব্যক্তিগত কামরায় ঢুকে পড়ে। বাবাকে জীবিত দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়। সেই একই ঘরে তার মা এবং তিন বোনও শোকে দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিলো। কামার দেখলো, তার মায়ের চোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু নিৰ্গত হয়ে চলেছে। বাবা সন্দিগ্ধ চোখে মুখ তুলে তাকালেন। নিজের চোখকে নিজেই তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না-এই কী তার কামার অল? কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব! তিনি হয়তো জেগে জেগেই খোয়াব দেখছেন।

–আব্বাজান, আমি কামার অল, আমি ফিরে এসেছি।–হঠাৎ কামার আল-এর আবেগ উচ্ছসিত কণ্ঠস্বরে সারা প্রাসাদ গম গম কর ওঠে। সুলতান সবিস্ময়ে উঠে বসে চোখ রাগড়াতে থাকেন। তাইতো এতো কোনও স্বপ্ন নয়। এ যে তার বুকের কলিজা-কামার আল। বাদশাহ সাবুর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না-পুত্রের বুকে কাঁপিয়ে পড়েন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন তিনি। অনেক-অনেক্ষণ ধরে।

মা এবং বোনরা আকুল হয়ে উঠে এসে কামার অলকে জড়িয়ে ধরে, হাউ মাউ করে।কাঁদতে  থাকে। ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন মা। কপালে চিবুকে চুমায় চুমায় ভরে দিতে থাকেন।

অনেকক্ষণ পরে যখন তারা খানিকটা ধাতস্থ হলো, কামার অল তার অদ্ভুত লোম-হৰ্ষক এবং রোমাঞ্চকর অভিযানের কাহিনী বলতে লাগলো তাদের কাছে। সে কাহিনী আবার এখানে পুনঃ উল্লেখ করা নিম্প্রয়োজন।

বাদশাহ সাবুর ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন। সারা দেশে চাঁড়া পিটে জারি করা হলো, সুলতানের প্রাসাদে সাত দিন ব্যাপী খানাপিনা গান-বাজনা নৃত্যের উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। বাদশাহজাদা কামার আল আকর্মর সশরীরে সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছে—এ উৎসব তারই জন্য। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা আপামর সকল মানুষের সাদর নিমন্ত্রণ রইলো প্রাসাদের এই উৎসবে।

সারা শহর, প্রাসাদ, জলপথ সুন্দর করে সাজানো হতে লাগলো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হলো তোরণ-মঞ্জিল। দোকানপাট উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো আলোর মালায়।

প্রাসাদকে সাজানো হলো এক মনোহারী সাজে। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেলো দেওয়াল কার্নিশ। হাজারো বাতির ঝাড় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো সদর ফটকের সামনে। লোকে লোকারণ্য। মহা ধূমধামে দান ধ্যান খানা পিনা নাচ গান হৈ-হল্লা চলতে থাকলো সাত দিন ব্যাপী। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে নানা মর্যাদার খেতাব বিলি করলেন সুলতান। কয়েদীদের মেয়াদ কমিয়ে দেওয়া হলো। যাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুখে ছিলো তাদের অনেককে খালাস করে দেওয়া হলো।

বাদশাহ সাবুর শাহজাদা কামার-অল-আকমরকে সঙ্গে নিয়ে শহরের প্রতিটি বাড়ির দরজায় দরজায় ঘুরে এলেন। সবাইকে জানিয়ে এলেন তার হারানো মণি কামার আল আবার বহাল তবিয়াতে ফিরে এসেছে!

প্রজারা স্বচক্ষে আবার দেখতে পেলো তাদের ভাবী বাদশাহকে। আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠলো শহরের আকাশ বাতাস।

তারপর একদিন আনন্দ উৎসব শেষ হয়ে যায়। কামার অল বাবাকে জিজ্ঞেস করে, যে-পারসী-পণ্ডিত আপনাকে এই ঘোড়াটা দিয়েছিলো, সে কোথায় গেলো, আব্বাজান?

পণ্ডিতের কথা উঠতেই বাদশাহ ক্ষেপে ওঠেন, ওর নাম মুখে এনে না, লোকটা একটা সাক্ষাৎ শয়তান, যাদুকর। ওরই জন্যে আমি এত দুঃখ শোক ভোগ করলাম। ওকে আমি প্রহার করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেছি! জানি না, বেঁচুে আছে কি নাই। আল্লাহ ওকে ক্ষতম করুন। তোমার সঙ্গে আমার এই ছাড়াছাড়ির একমাত্র কারণ সে। তার ধোঁকাবাজীতে না ভুললে, আমাকে এত দুঃখ আর তাপ সইতে হতো না। আমি তাকে ক্ষমা করতে পারবো না কখনও।

কামার অল বলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো আমি ফিরেই এসেছি আব্বাজান! তাছাড়া দোষটা যে পুরোপুরি তারই, তাই বা কী করে বলা যায়? আমারও তো উচিত ছিলো, ঘোড়াটা চালাবার সব কায়দা কৌশল তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া। তখন সে-ধৈর্য তো আমার ছিলো না। ঘোড়াতে চেপেই, তার কথা শেষ না হতেই, আমি বোতাম টিপে ধরেছিলাম। দোষ বলতে গেলে পুরোটাই আমার বাবা। আপনি ওকে জানে মারবেন না, ছেড়ে দিন, এই আমার আর্জি।

কামার অল-এর ইচ্ছায় না করতে পারলেন না বাদশাহ। পারসী-পণ্ডিতকে কারাগার থেকে মুক্ত করে প্রচুর অর্থ ও এক নতুন সাজপোশাক উপহার দিয়ে বললেন, এবার তুমি দেশে ফিরে যেতে পার।

কিন্তু ছোট কন্যার সঙ্গে শাদীর কথাটা বেমালুম চেপে গেলেন তিনি। পণ্ডিতও সে ব্যাপারে। আর কোনও কথা তুললো না। বাদশাহ ভেবে রেখেছিলেন, পণ্ডিত যদি তার ছোট কন্যাকে শাদী করতে চানও তৎক্ষণাৎ তিনি ‘না’ বলে দেবেন, তাতে জ্বান যদি নষ্ট হয়, হবে। কিন্তু তাই বলে একটা যাদুকর শয়তান শঠের হাতে মেয়েকে তুলে দেবেন না তিনি। পণ্ডিত জেনে শুনে তার পুত্রকে ঘোড়ায় চাপতে দিয়েছিলো—মেরে ফেলার জন্য। না হলে, গোড়াতেই সে বলতে পারতো। সব কিছু না শিখে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপাই চলবে না। কিন্তু তা সে করেনি। যেহেতু কামার অল তার ছোট বোনের সঙ্গে পণ্ডিতের শাদীতে বাধ সেধেছিলো সেই কারণে, প্রতিশোধ নেবার জন্যে, সে তাকে মরণের ফদে ফেলে দিয়েছিলো। আল্লাহ মেহেরবান, তাই কামার অল ফিরে আসতে পেরেছে। অন্য কেউ হলে জ্বলন্ত সূর্যের গোলার মধ্যে ঢুকে পড়ে নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। এমন শয়তানের হাতে কেউ মেয়ে দেয়!

বাদশাহ সাবুর ঘোড়াটার কি বিধি ব্যবস্থা করবেন, কিছুই ঠিক করতে পারেন না। তাই তিনি কামার অলকে ডেকে পাঠালেন।

—বল তো বাবা, ঐ অপয়া কালো-ঘোড়াটাকে নিয়ে কী করা যায়? আমার মনে হয়, আমন সর্বনেশে জিনিস ঘরে না রাখাই ভালো। ভেঙ্গে গুড়ো করে দিই, কী বলো?

কামার অল বলে, কেন আব্ববাজান, এখন তো আমি ওর সব কায়দা কৌশল্যই রপ্ত করে। নিয়েছি। তখন কিছু জানা ছিলো না বলে আমনটা হতে পেরেছিলো। কিন্তু এখন তো আর সে ভয় নাই।

বাদশাহ সাবুর কিন্তু পুত্রের কথায় সায় দিতে পারে না।

–না বেটা, আমার মনে হয় এখনও ওর অর্ধেক কলাকৌশল তোমার জানা হয় নি। তার চেয়ে বলি কি, ওটার পিঠে তুমি আর চেপো না। ও আমার আতঙ্ক, আমার দুশমন। ওতে চড়া মোটেই নিরাপদ নয়, বাবা।

কামার অল তখন সানার সুলতান প্রাসাদে শাহজাদীর সঙ্গে এক রাতের সহবাস, সুলতানের ক্ৰোধ, এবং তার হাত থেকে, এই কালো-ঘোড়ার দৌলতে, অব্যাহতি পাওয়া-সব খুলে বললো।

বাদশাহ সাবুর। তবু বুঝতে চান না, সবই নিয়তির খেলা, বাবা। মৌৎ যেভাবে লেখা থাকে, কেউ খণ্ডন করতে পারে না। তাঁ। তোমার মৃত্যু সানার সুলতানের হাতে ছিলো না বলেই সে তোমাকে হত্যা করতে পারে নি। অথবা এরপর অন্য কোনও সময় তারই হাতে তোমার মৃত্যু নির্ধারিত হয়ে আছে! তখন তুমি যে খানেই থাকো, ঘটনাচক্ৰে তার সন্মুখে তোমাকে যেতেই হবে। এবং সে তোমাকে নিহত করবেই। সুতরাং তুমি যা বলছে, সে কোনও কথা নয়। যাই হোক, আমি চাই না, ঐ ঘোড়াটায় তুমি আবার কখনও চড়ো।

দিন যায়। কিন্তু সামস অল নাহারকে কিছুতেই ভুলতে পারে না কামার আল আকমর। প্রতিটি পল স্মৃতি কুরে কুরে খায় তার বুকের পাঁজর। কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না—সেই একটা রাতের মধুর মিলন-স্মৃতি। এক হলেও, সহস্র রজনীর স্বাদ সে কামার অলকে দিয়েছে। তার হ্রদয়াকে উন্মুক্ত করে খুলে ধরেছিলো সামস অল নাহার। সেই রাতের আধো আলো আধো অন্ধকারে সব সে দেখেছে, সব সে চেখেছে। সামস নিজেকে সঁপে দিয়েছে তার হাতে। এখন সে তার। সুতরাং এইভাবে, তাকে ছেড়ে দূরে দূরে থাকা তো তার পক্ষে সম্ভব না। যে ভাবেই হোক, যেমন করেই হোক, তাকে ওখান থেকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেখানে সে যাবে কেমন করে। তার বাবা বাদশাহ সাবুরের নির্দেশ সে যেন আর ঐ কালো ঘোড়ায় না চাপে। সে ঘোড়ায় না। চেপে সে কী করে যাবে তার প্রাসাদে? তাকে চুরি করে আনা ছাড়া অন্য কোনও পথ নাই। কারণ তার বাবা সানার সুলতান এবং সারা শহরবাসী। তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তাকে একবার কোজায় পেলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেবে।

একদিন বাদশাহ সাবুর এক গান বাজনার মাইফেলের আয়োজন করেছিলেন। শহরের নামকরা বাঈজীরা এসেছিলো মুজরো করতে। মাইফেলের আসরে বসে সেদিন সন্ধ্যায় একখানা বিরহ-সঙ্গীত শুনে কামার আল-এর হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠে সামস অল নাহার-এর বিরহে আরও বেশি কাতর হয়ে পড়ে সে। শত চেষ্টা করেও মনকে প্রবোধ দিতে পারে না। তাই বাবার নির্দেশ অমান্য করেই সে আবার কালো ঘোড়ায় চেপে বসে। ডান দিকের বোতাম টিপে ধরতেই ঊর্ধ্বাকাশে উঠে চলে যায় এক নিমেষে। তারপর উড়তে উড়তে এক সময় সে চলে আসে সানায়। সেই প্রসাদের ছাদে গিয়ে নামে। রাত তখন গভীর। সবাও ঘুমে অচেতন! কামার অল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে। তারপর পায়ে পায়ে চলে আসে নিগ্রো খোঁজটার পাশে। সেই একই দৃশ্য। দৈত্যের মতো বিশাল লাসখানা এলিয়ে দিয়ে সে বিকট আওয়াজ তুলে নাসিকা গর্জন করছে। মাথার কাছে সিকেয় ঝোলানো খাবার-দাবার এবং দেয়ালে দাঁড় করানো একখানা তরোয়াল।

কামার এবার আর সিকেটাও খুলে নিলো না, নিলো না তারোয়াল খানাও। পা টিপে টিপে সে পেরিয়ে গেলো দ্বিতীয় দরজার সামনে। যথারীতি সেই মখমলের পর্দা ঝুলছিলো। কামার অল পর্দা  সরিয়ে ভিতরে ঢোকে। শয্যার চারপাশে বসে দাসী মেয়েগুলো সামস অল নাহারকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, দুঃখ করবেন না। শাহজাদী, আমাদের বিশ্বাস তিনি আবার আসবেনই। যে ভালোবাসার স্বাদ তিনি পেয়েছেন, তা কখনই ভুলতে পারবেন না। আপনি কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছেন। এ ভাবে না খেয়ে না ঘুমিয়ে যদি কাটাতে থাকেন। কদিন বাঁচবেন? কিন্তু বঁচতে যে আপনাকে হবেই, মালকিন? আপনার ভালোবাসার জন্যই আপনাকে ভালোভাবে বাঁচিতে হবে। আর বাঁচতে গেলে খেতে হবে, ঘুমাতেও হবে। নিন, উঠুন, কিছু একটু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমরা বলছি, তিনি বেশিদিন আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো চব্বিশতম রজনী। আবার সে কাহিনী শুরু করে :

এদিকে সকালে বাদশাহ সাবুর খবর পান, কামার অল প্রাসাদে নাই। তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাদশাহ স্বয়ং সারা প্রাসাদ তন্নতন্ন করে খুঁজলেন!। কিন্তু না, কোথায়ও তাকে পাওয়া গেলো না। হঠাৎ তার খেয়াল হলো কালো ঘোড়ার কথা। ছাদের ওপরে উঠে এসে দেখলেন, ঘোড়া নাই। কামার আল তার কথা অমান্য করে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে। রাগে তিনি কাঁপতে লাগলেন। আশঙ্কায় বুক দুরু দুরু করতে থাকলো। আবার যদি তার কোনও বিপদ ঘটে? নিশ্চয়ই সে সানার প্রাসাদে গেছে। শাহজাদীর সঙ্গে মুলাকাত করতে। কিন্তু সে-মেয়ের বাবা, সেখানকার সুলতান নাকি একরোখা মানুষ। যদি তার কোপে পড়ে সে প্রাণ হারায়-। না না, সে কথা ভাবতে চান না। তিনি। ভাবতে পারেন না। তিনি—

সাবুর মনে মনে ঠিক করলেন, এবার কামার অল ফিরে এলে ঐ ঘোড়াটাকে আগে তিনি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করবেন, তার পরে অন্য কথা। তার মনের সব শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে ঐ ঘোড়াটা।

পর্দা উঠিয়ে কামার আল কান পেতে শুনতে থাকে দাসী মেয়েদের সন্তুনার কথাগুলো। কিন্তু সে সাত্ত্বনায় সামস অল নাহার একতটুকু শান্ত হতে পারে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদতে থাকে; না না, তোরা আমাকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছিস, সে আর ফিরে আসবে না। আমার বাবা তাকে পছন্দ করে না। সে জানো-এখানে এলে আর তাকে আস্তা রাখবে না। আমার বাবা।

কামার অল পায়ে পায়ে পালঙ্কের পাশে দাঁড়ায়। কেউ তাকে লক্ষ্য করতে পারে না। সবাই তখন সামস অল নাহারকে নিয়ে ব্যস্ত।

শাহজাদীর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেছে, কামার আল মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো, এই তো আমি এসেছি পিয়ারী। তুমি কি ভেবেছিলে, তোমার বাবার ভয়ে আমি আসবো না? কিন্তু আসল মহব্বাৎ কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। মৃত্যুভয়ে সে ভীত হয় না। জন্মালে একদিন মরতেই হবে। এতো সবাই জানে। তাই বলে কেউ কি সমরক্ষেত্রে যুদ্ধ করে না?

এও আমার ভালোবাসার জন্যে যুদ্ধ মনে কর, সামস। তোমাকে একবার দেখতে পাবো, তার জন্যে যদি আমাকে মরতেই হয়, হাসিমুখে বরণ করে নেবো, সে মরণ আমার মহব্বৎকে আরও মহৎ করবে, জান।

বাঁদীরা সব পলকে সরে যায়। সামস অল নাহার মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কামার অল-এর মুখের দিকে। ভাবতে পারে না সে-এ দৃশ্য আবার সে দেখবে। কামার আল—তার প্রিয়তম আবার এসে দাঁড়াবে তার পালঙ্কের অতি পাশে, তা সে ভাববেই বা কি করে? তার বাবা কামার অলের ওপর খড়গ হস্ত হয়ে আছে। একবার সে তার কিন্তুজা থেকে পালিয়ে গেছে, কিন্তু আর একবার যদি সে ফিরে পায়। তবে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে। একথা কামার আলও খুব ভালো করেই জানে। তাই, সে যে আবার ফিরে আসতে পারে, ভাববে কি করে!

তবুও তো সে এসেছে। অনেক বিপদ খাড়া মাথায় করে সে তো এসে দাঁড়িয়েছে? সামস আর ভাবতে পারে না; দু’হাত বাড়িয়ে কামার অলকে টেনে নেয় বুকে। কেঁদে কেঁদে বুকের ব্যথা হাল্কা করে। কামার অলও চোখের জল রাখতে পারে না।–

—জন সামস, তোমার জন্য সারা দিন-রাত কী ভাবে কেটেছে আমার। মুখে খানা রুচেনি, শুয়ে ঘুম আসেনি একদিনও। তুমি কেমন ছিলে?

সামস অল নাহার চুমায় চুমায় ভরে দেয় কামার অল-এর অধর গাল বুক।

—কেমন ছিলাম, কেমন থাকতে পারি বুঝতে পারছো না মণি, তোমার বিরহে আমার কী চেহারা হয়েছে একবার চেয়ে দেখ। আর কদিন যদি তোমাকে না দেখতে পেতাম, তাহলে তুমি ফিরে এসে আর আমাকে দেখতে পেতে না, সোনা। তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে চাই না। জীবনে যদি ভালোবাসা এলো আর সে ভালোবাসাকে যদি ধরেই না রাখতে পারলাম, তবে কাজ কী বলে এই ব্যর্থ জীবনে? তাই ঠিক করেছিলাম তুমি যদি আর ফিরে না আস জহর খেয়ে খতম করে দেব এ ছার জীবন।

কামার অল, সামস-এর মুখে হাত চাপা দেয়, ওকথা মুখে আনতে নাই সামস। আমি যেখানেই থাকি আর যত দূরেই থাকি, তুমি নিশ্চিত জেনো, আমি তোমারই আছি-তোমারই থাকবো। আমাদের এই নিখাদ ভালোবাসায় কোনও দিন চিড় খাবে না।

এক অব্যক্ত আনন্দের শিহরণ খেলে যায় সামস অল নাহারের সারা শরীরে। আরো নিবিড় করে কামার অলকে জড়িয়ে ধরে সে।

কামার আল বলে, সামস, বড় খিদে পেয়েছে, অনেকদিন খাওয়া-দাওয়া নাই। খিদেও ছিলো না, কিন্তু এখন পেট চুই চুই করছে। মেয়েদের বলো, কিছু খানাপিনা আনুক। আমরা দু’জনে একসঙ্গে খাবো, কেমন?

সামস অল হাসে, বেশ তো!

তখনই নানারকম খানাপিনায় মেজ সাজিয়ে দেয় মেয়েকে। কামার অল নিজে হাতে সামসকে খাইয়ে দিতে থাকে। সামস আল-ও কামার –আলকে। অনেক দিন বাদে আবার তারা প্রাণভরে খানাপিনা করে।

হাসি আনন্দ আদর সোহাগে রাতের প্রহর কাটাতে থাকে। খুশিতে উপচে ওঠে দু’জনের হৃদয়। একসময় কামার আল বুঝতে পারে, রাত্রি প্রায় শেষ হতে চলেছে এবার বিদায়ের পালা। পুষ্ট ভারাক্রান্ত মনে সে সামসকে বলে, ভোরের আগেই আমাকে পালাতে হবে। না হলে খোঁজটা জেগে গেলে মুসকিল হবে। তবে কথা দিয়ে যাচ্ছি, সোনা, প্রতি সপ্তাহে একবার এসে তোমাকে দেখে যাবো।

–না না, সে হবে না নয়নমণি, আর আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। একটি দিনও না-একটি মুহূর্তও না।

সামস অল নাহারের এই আকুলতায় সব গোলমাল হয়ে যায় কামার অল-এর। বলে, কিন্তু এখানে আমার থাকা কি নিরাপদ হবে সামস। তোমার বাবার রোষ তো তুমি জান।

সামস অল বলে, জানি, খুব ভালো করেই জানি এখানে তুমি আমার কাছে রয়ে গেলে, কাল সকালেই তোমাকে চিরকালের মতো হারাবো আমি। সে-কথা আমি বলবো না, কামার আল। কিন্তু তোমাকে ছেড়েও আমি থাকতে পারবো না। আমি তোমার সঙ্গেই যাবো। তা সে যদি আমাকে জাহান্নামেও নিয়ে যাও, আমার কোনও আপত্তি নাই। তোমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমি কোন কষ্টই কষ্ট বলে মনে করি না। সোনা, আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চল। তোমার বাবা পারস্যের শাহেনশাহ, তার মান-ইজৎ আমি খোয়াতে চাই না। তিনি যদি আমাকে ঘরে নিতে নারাজ হন। কোনও দুঃখ করবো না। তুমি আমাকে অন্য কোথাও রাখবে। তা সে যত কষ্টকর জায়গাই হোক, সুলতান-দুহিতা প্রথম প্রথম হয়তো একটু আমার অসুবিধা হবে, দেখে নিও, হাসিমুখে আমি সব সয়ে নেবো। তোমার মহব্বতের কাছে আমার সে কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যাবে।

কামার আল আনন্দে প্রায় লাফিয়ে ওঠে, তুমি যাবে সামস? আমার সঙ্গে যাবে তুমি? এই বিত্ত-বৈভব, এই অঢেল সুখ-সাচ্ছন্দ্য, তোমার বাবা, তোমার সালতানিয়াৎ সব ছেড়ে যেতে পারবে আমার সঙ্গে? আমি সত্যিই কোনও কথা দিতে পারি না। সামস আঁল। আমার বাবা তামাম পারস্যের শাহেন শাহ, একথা ঠিক। কিন্তু আমার তো নিজস্ব কোনও সম্পদ নাই, তিনি যদি আমাকে গ্রহণ না করেন। তবে আমি অতি সাধারণ এক বিত্তহীন কামার আল। সে ক্ষেত্রে তুমি বাদশাহজাদী, আদরের দুলালী, হয়তো সত্যিই অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে।

সামস অল নাহার কামার অলকে থামিয়ে দিয়ে বলে, সে সব কথা আমিই তোমাকে বললাম, সোনা। ভালোবাসার জন্য আমি সব হাসিমুখে কেমন করে সইতে পারি, একবার, না হয় পরীক্ষা করে দেখ।

কামার আল বলে, ভোর হতে চললো; তাহলে আর দেরি নয় সামস, তৈরি হয়ে নাও, এখনই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। না হলে খোঁজটা জেগে গেলে, বিপদ হবে।

শাহজাদী শয্যা ছেড়ে উঠে পড়ে। সিন্দুকের তালা খুলে বের করে কিছু সাজ-পোশাক, রত্নাভরণ এবং মহামূল্যবান বিলাস-বস্তু। একটা থলেয় ভরে বলে, চলো, আর কিছু নেবার नाङ्ग्रे।

দাসী-মেয়েরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কোনও বাধা দিতে পারে না-সোরগোল তুলে সাড়া জাগাতেও পারে না।

সামস অলকে হাতে ধরে কামার আল। ছাদের ওপর ওঠে আসে। ঘোড়াটার জিনের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয় থলেটা। তারপর দু’হাতে তুলে শাহজাদীর হাল্কা দেহখানা ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে তার পিছনে। সামসের পাতলা শরীরটা কামার অল-এর বিশাল বিস্তুত বক্ষপটের মধ্যে হারিয়ে যায়।

ডানদিকের বোতামটা টিপে ধরতেই শোঁ শোঁ করে ওপরে উঠতে থাকে কালো ঘোড়া। উল্কার বেগে। কামার অল সামসের কানের কাছে মুখ রেখে বলে, খুব ভয় করছে!

সামসের কণ্ঠে শিশুর সারল্য, —ভয় করবে কেন? আমি তোমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে আছি। তামাম দুনিয়ায় এর চাইতে নিৰ্ভয় জায়গা তো আমার আর নাই, সোনা।

কামার অল-এর বুক ভরে যায়। ভালোবাসার কথা এত ভালো করে বলতে পারে সামস—

একটুক্ষণের মধ্যেই তারা পারস্যের প্রাসা-শিখরে এসে নেমে পড়ে।

কামার অল-এর ঘোড়া আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাসী মেয়েরা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে : ওরে বাবারে, কী সর্বনাশ হলো রে, কই গো, কে কোথায় আছ, ছুটে এসো, শাহজাদীকে চুরি করে পালিয়ে গেলো সেই লোকটা–

ধড়মড় করে উঠেই তলোয়ারখানা বাগিয়ে ধরে খোজাঁটা। হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে, ছুটে আসে। ছুটে আসে সুলতানও, আলু থালু বেশবাস, খালি পা, ঘুমে চোখ জড়ানো।

-কী? হয়েছেটা কী? এত চোঁচামেচি চিৎকার কেন এই রাতে?

মেয়েরা তখনও ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলো। একজন বললো, সেই মানুষটা আবার এসেছিলো, শাহজাদীকে চুরি করে নিয়ে উড়ে পালিয়ে গেলো।

সুলতান হুঙ্কার ছাড়ে, তোরা কোথায় ছিলি?

—জী হুজুর, আমরা ঘুমে অচৈতন্য হয়েছিলাম—

আর এই বাঁদর খোজাটা—

নিগ্রোটার হাতে তখন ইয়া বড় তরোয়ালখানা ঠক ঠক করে কাঁপছিলো।

সুলতান ক্ষণকাল আর অপেক্ষা করলেন না সেখানে। ছুটতে ছুটতে ছাদের ওপরে উঠে এলেন। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়াটা ততক্ষণে মেঘের কাছাকাছি। সুলতান চিৎকার করে বলতে রথাকেন, শোন শাহজাদা কামার অল, আমার একটা মিনতি শোনো, দোহাই বাবা, আমার একমাত্র নয়নের মণি বুকের কলিজাকে এইভাবে ছিনিয়ে নিয়ে যেও না। ফিরিয়ে দিয়ে যাও, ফিরিয়ে দিয়ে যাও। নেমে এসো, আমি কথা দিচ্ছি, তোমার সঙ্গে শাদী দিয়ে দেব। ফিরিয়ে দাও তাকে।

কিন্তু সুলতানের সে আকুল আবেদনে সাড়া দিলো না কামার আল। কী করেই বা দেবে? তখন তারা মানুষের কণ্ঠস্বরের নাগাল ছাড়িয়ে আরো অনেক ওপরে উঠে গেছে।

সুলতান ভাবেন, কামার অল তার কথায় সাড়া দেবেন না। তারপর তিনি আরও জোরে চিৎকার তোলেন, সামস আল-ফিরে আয় মা, তোমার বুড়ো মায়ের মুখ চেয়েও একটিবারের জন্য ফিরে আয়, বাছা। আজ বাদে কাল সে দেহ রাখবে, একবার তাকে দেখে যা। আমি কথা দিচ্ছি মা, তোরা যা চাইবি তাই হবে। শুধু একটি বারের জন্য ফিরে আয়।

কিন্তু ফিরে এলো না কেউ। শুধু নিজেরই প্রতিধ্বনি বার বার ফিরে ফিরে এসে বিদ্রুপ করতে থাকলো।

রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো পঁচিশতম রজনী। আবার সে বলতে থাকে :

কামার অল বলে, এই আমাদের প্রাসাদ। কিন্তু তোমাকে এখন কোথায় নিয়ে যাই, সেই কথাই ভাবছি। সোজা যদি বাবার সামনে হাজির করি তোমাকে আর তিনি যদি রুষ্ট হয়ে তোমাকে কোনও কটুকথা বলেন, সে তো আমি সইতে পারবো না সোনা। সুতরাং ভাবছি, এখনই প্রাসাদে না ঢুকে তার চেয়ে বরং চলো বাগিচামহলে গিয়ে উঠি। তোমার কী মত?

আমার আবার আলাদা মত কী হবে? তোমার মতেই আমার মত। তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে। তবে একটা কথা, তোমাকে ছাড়া আমি একটা রাতও থাকতে পারবো না।

কামার অল হেসে সামস-এর পাপড়ি নরম গালে আস্তে একটা ঠোনা মারে।

—আমিই কী ভাবছো, তোমাকে ছেড়ে একটা রাত কাটাতে পারি? চলো আমরা এই প্রাসাদে ঢুকবো না। বাগিচা বাড়িতেই যাই।

আবার সে ঘোড়াটাকে খানিকটা ওপরে ওঠায়। তারপর অদূরে অবস্থিত সুরম্য বাগিচা-মহলের সামনে গিয়ে নেমে পড়ে। বড় মনোরম জায়গা। যে দিকে তাকায় সামস, শুধু ফুলে ফুলে ভরা। কত সহস্র রকম জানা অজানা ফুলের গাছ। বাগিচার মাঝখানে একটি স্বফটিকের ফোয়ারা। তার চার পাশে স্বচ্ছ নীল জলে কেলি করে মাছেরা। সামস অল নাহারের দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। কামার আল বলে, এখানে দু-একটা দিন তুমি থাকো—আমিও থাকবো। তারপর সুযোগ মতো বাবাকে বলবো তোমার কথা। আমি তার একমাত্র পুত্র সন্তান। তার মনে বড় আশা, আমার শাদী হবে খুব জাঁকজমক করে। দেশ-বিদেশ থেকে আসবে হাজার হাজার অতিথি অভ্যাগতরা। তাদের সামনে শাদী হবে তার পুত্র-পারস্যের ভাবী শাহেন শহর। আমি এখন যাচ্ছি, বাবার সঙ্গে দেখা করতে হবে। কাল রাতে তাকে না বলে চলে গেছি, না জানি কত দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে আছেন তিনি। ঘোড়াটা এখানে রইলো। একটু নজর বেখো, কেমন?

সামস অল নাহার বলে, ঠিক আছে, বাবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

ছেলেকে দেখে বাদশাহ সাবুরের ধড়ে প্ৰাণ আসে। সারাটা রাত বিনিদ্র রজনী কেটেছে র্তার। নানা অশুভ চিন্তায় দেহ, মন অসাড় হয়ে গিয়েছিলো, কামার অলকে দেখে তিনি খুশিতে উপচে পড়েন। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আনন্দেকাঁদতে কাঁদতে  বলেন, এইভাবে বুড়ো বাপের মনে কষ্ট দিতে আছে, বেটা?

কামার আল বলে, আপনার জন্যে একটা মজার জিনিস আনতে গিয়েছিলাম, আব্ববাজান!

–কী জিনিস বাবা?

—আপনিই বলুন, আব্বাজান, কী হতে পারে?

বাদশাহ সাবুর হদিশ করতে পারেন না কিছু। অধৈৰ্য হয়ে প্রশ্ন করেন, খোদা হাফেজ, আমি তো কিছুই ঠাওর করতে পারছি না। বাবা। কী ব্যাপার, কী এমন বস্তু আনতে গিয়েছিলে আমার জন্যে?

-সানার সুলতান-কন্যাকে সঙ্গে এনেছি, আব্বাজান। সে আপনার ছেলের বেগম হবে। তার মতো খুব সুরৎ মেয়ে তামাম আরব পারস্যে মিলবে না। আর একটা। যেমন রূপ তেমনি তার আদব কায়দা!

বাদশাহ চিৎকার করে ওঠেন, কোথায় সে?

–আমি তাকে বাগিচামহলে রেখে এসেছি, আব্ববাজান। তাকে আপনি জাঁকজমক করে ঘরে আনবেন। সেইজন্যে সরাসরি আপনার কাছে হাজির করিনি।

বাদশাহ সাবুর ছেলের বুদ্ধির তারিফ করেন, ভালো করেছ। সে আমার ছেলের বেগম হবে। লোকলস্কর সঙ্গে নিয়ে, শাদী-কেতায় তাকে সাজিয়ে গুজিয়ে হাজার হাজার মানুষের মিছিল করে প্রাসাদে আনতে হবে তো। তাকে নিয়ে তুমি যদি জীবনে সুখী হও তার চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে আমার? তোমার মুখে হাসি দেখলে আমার সব চিন্তা ভাবনা মুছে যায়।

তক্ষুনি তিনি উজিরকে নির্দেশ দিলেন, উজির আর দেরি নয়, মিছিলের আয়োজন কর, প্রাসাদ শহর পথঘাট সাজাতে বলে। আমার ছেলের বেগম বরণ করে আনতে হবে।

বাদশাহ নিজ হাতে রত্ন-সিন্দুক খুললেন। এই সিন্দুকেই রাখা আছে পারস্যের সেরা সম্ভার। যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত করে গেছে। এতাবৎ কালের বাদশাহ। সাবুর বেছে বেছে বের করলেন সবচেয়ে দামী দামী জড়োয়ার সব গহনাপত্র। সবই হীরা মণি মুক্তাখচিত অমূল্য রত্নালঙ্কার। বংশানুক্রমে এই প্রাসাদের বেগমরা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে এসেছে এই রত্ন আভরণ—।

অলঙ্কারগুলো ছেলের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আমাদের খানদানের অলঙ্কার। অধিকার সূত্রে এসব এখন তারই প্রাপ্য। তুমি তাকে নিজে হাতে সাজিয়ে নিয়ে আসবে প্রাসাদে।

উজির আয়োজন করেছিলো শোভাযাত্রার। বিশাল বিরাট। প্রায় গোটা শহরের মানুষই বুঝি বা সেই মিছিলে সামিল হয়েছে। ধীরে মন্থর-গতিতে চলেছে শোভাযাত্রা। কামার অল-এর আর সহ্য হচ্ছিল না। এই বিলম্ব। তার প্রাণ আকুলি বিকুলি করছে সামস-এর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে।

কামার অল মিছিলের সঙ্গ পরিহার করে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য একটা সরু পথ দিয়ে সরে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পৌঁছে যায় বাগিচা মহলে–সামস অল নাহারের বিশ্রামকক্ষে। কিন্তু একি! সামস অল কোথায়— ঘরে তো নাই সে! ফিরে তাকিয়ে দেখে, ঘোড়াটাকে যেখানে রেখে গিয়েছিলো সে, সেখানে ঘোড়াটাও নাই! তবে? আর ভাবতে পারে না কামার অল? মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে।

অনেকক্ষণ কেটে যায়। সম্বিৎ ফিরে আসে। কিন্তু তখনও সে বুঝতে পারে না ব্যাপারটা, সামসের পক্ষে ঘোড়া চেপে অন্য কোথাও চলে যাওয়া কী সম্ভব? না না, সে কী করে হতে পারে। কলের ঘোড়া চালাবার কায়দা কসরৎ না জানলে চালাবে কী করে? এবং-এ পর্যন্ত সামস অল কখনও জানতেও চায়নি, কী ভাবে চালাতে হয়। অন্য কোনও মানুষের পক্ষেও তাই। চালাবার কৌশল একমাত্র সেই পারস্য-পণ্ডিত ছাড়া তো কারোই জানা নাই। তবে কী সে-ই?

রাতের অন্ধকার হাল্কা হয়ে আসে। প্রভাত সমাগত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো ছাব্বিশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

বাগিচার মালির কাছে ছুটে যায় কামার অল।

—বাগিচায় অন্য কোনও লোককে ঢুকতে দেখেছে? কোন ঝুট বলবে না, তা হলে তোমায় গর্দান যাবে—

ভয়ে থর থর করে কাঁদতে থাকে লোকটা। আল্লাহ কসম, অন্য কাউকেই দেখিনি। শুধু সেই পারসী-পণ্ডিত একবার ঢুকেছিলেন। দু-একটা ফুল তুলেছিলেন নজর করেছি। কিন্তু সে এখনও বাইরে যায়নি। ভিতরেই কোথাও আছে।

এবার আর বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না কামার আল-এর। আর কেউ নয়, সেই শয়তানটাই তার প্রিয়তমাকে উধাও করে নিয়ে পালিয়েছে। দুঃখে বিষাদে সারা দেহ, মন ছেয়ে যায়। এখন সে কী করবে, কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। দিশাহারা হয়ে মিছিলের দিকে ছুটে চলে। বাদশাহ সাবুরের সঙ্গে দেখা করে বলে, আব্বাজান, সর্বনাশ হয়েছে! সেই শয়তান পণ্ডিতটা সামস অল নাহারকে নিয়ে পালিয়েছে। মিছিল ফিরিয়ে নিয়ে আপনি প্রাসাদে চলে যান। আমি চললাম, যতদিন না। তাকে খুঁজে পাই, আমি ফিরবো না।

বাদশাহ আতঙ্কিত হয়ে আর্তনাদ করে ওঠে।

—আমার কথা শোন বাবা, প্রাসাদে ফিরে চল। তোমাকে আমি এক ছেড়ে দিতে পারবো না। ফিরে চল, তারপর আমি একটা ব্যবস্থা করছি।

-সে হয় না, বাবা, আমি এর শেষ দেখে নিতে চাই। কত বড় শঠ শয়তান সে, আমি একবার দেখবো।

বাদশাহ বলেন, কিন্তু বাবা, ও যে যাদুকর। তার ভেল্কিবাজীর কাছে তোমার দেহাবল তুচ্ছ। সে তোমাকে মন্ত্রবলে নিমেষে হত্যা করে ফেলবে। তার চেয়ে তুমি প্রাসাদে চল। আমি তোমার জন্য তামাম আরব বাদশাহদের সুন্দরী কন্যা জোগাড় করে আনবো। তার মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ হয় তার সঙ্গে শাদী দিয়ে দেব।

কামার আল রুদ্ধকণ্ঠে বলে, এ আপনি কী বলছেন, আব্বাজান! সামস ছাড়া আমি অন্য নারীর চিন্তাও করতে পারবো না। আপনি আমাকে বাধা দেবেন না বাবা, কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আল্লাহ যখন আমাকে রক্ষা করেছেন আমি আর কাউকেই ডরাই না।

বাদশাহকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে ঘোড়ার পিঠে চাবুক বসায়! তীরবেগে ছুটে বেরিয়ে যায় কামার আল। হাপুস-নয়নে কাঁদতেকাঁদতে  ফিরে আসেন বাদশাহ সাকুর।

নিমেষের মধ্যে শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। সারা শহরে। প্রাসাদে বিরাজ করতে থাকে কবরের নিস্তব্ধতা।

একেই বলে নিয়তি। সেই পারসী যাদুকর সেইদিন ঘটনাক্রমে বাগিচায় ঢুকেছিলো কিছু ফুল সংগ্রহ করতে। কিন্তু বাগানে ঢুকেই সে বুঝতে পারলো কাছে-পিঠেই এমন কেউ আছে—যার গায়ের অতি মূল্যবান আতরের খুশবু সারা বাগানে ভুর ভুর করছে। পায়ে পায়ে সে বাগিচামহলের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। জানিলা দিয়ে ঘরের পালঙ্ক-শয্যা পরিষ্কার চোখে পড়ে। যাদুকর দেখলো, এক পরমাসুন্দরী রমণী শয্যায় গা এলিয়ে পড়ে আছে। চোখ দুটো বোজা। হয় বা ঘুমিয়ে গেছে, হয়ত নয়; এমনিই চোখ বন্ধ করা অন্তস্থ হয়ে আছে। ওপাশে নজর পড়তেই দেখলো, তার সেই যাদু ঘোড়া-দরজার একপাশে দাঁড় করানো। এবার বুঝতে কষ্ট হলো না, ঘোড়াটা কামার অলই রেখে গেছে। এখানে। এবং এই আলোক-সামান্যাও তারই এক সংগ্বহ।

বুড়ে যাদুকরের চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। মাথায় এক বন্দবুদ্ধি খেলে যায়। ঘোড়াটার পাশে গিয়ে সে ভালো করে দেখে নেয়। যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক আছে কিনা। তারপর আস্তে আস্তে এসে সামস অল-এর ঘরে ঢুকে আভুমি নত হয়ে সশব্দে লম্বা একটা কুর্ণিশ জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

সামস-এর তন্দ্ৰাভাব কেটে যায়। চোখ মেলে। দরজার দিকে এক পলক তাকিয়েই আঁৎকে উঠে আবার সে বন্ধ করে নেয় চোখ দুটো।

—কে তুমি?

-আমি শাহজাদা কামার আল আকামার-এর বান্দা, বেগমসাহেবা? তার একটা খবর বয়ে এনেছি আপনার কাছে!

-কী খবর?

সামস-অল ঐ কুৎসিত কদাকার বুড়োটার দিকে তাকাতে পারে না।

–যাদুকর বিগলিত কণ্ঠে বলে, শাহজাদা আপনাকে বলে পাঠিয়েছেন, এই শহরেই অন্য একটা বিলাসমহলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।

এখানে আপনার কষ্ট হতে পারে। সেইজন্যে তিনি আরও সুন্দর আরও ভালো একটি বিলাসবহুল প্রাসাদ সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিকঠাক করছেন। সেখানে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন তিনি, মেহেরবানী করে আমার সঙ্গে চলুন আপনি।

সামস অল নাহার বিরক্ত বোধ করে, তা তিনি নিজে না এসে তোমাকে পাঠালেন কেন?

—সে কি! আপনি জানেন না? তার মা-এর অবস্থা খুব খারাপ। তাঁকে ছেড়ে এখন তিনি ওঠেন কি করে? তাই আমাকে পাঠালেন। আমি আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেবো।

সামস অল বলেই ফেলে…তা আর কোনও লোক পেলেন না। তিনি? তোমার মতো একটা ভয়ঙ্কর জীবকে পাঠিয়েছেন? উফ, তোমার কী বিশ্ৰী চেহারা। দেখলে গা গুলিয়ে যায়!

যাদুকর আরও বিনয়াবনত হয়ে বলে, জী—সেই কারণেই তো আমাকে পাঠিয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকালে কোনও মেয়ের চরিত্র নষ্ট হবে না—সে কথা জেনেই তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। তা না হলে প্রাসাদে কী চাকর নফরের অভাব ছিলো? কিন্তু অন্য কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। তিনি। উনি জানেন, আমার দিকে লোভের নজর দিয়ে তাকবে না কোনও মেয়ে। আর আমি একশো বছরের একটা বুড়োহাবড়া-সে-সব বালাই তো আমার দেহমান থেকে বিদায় হয়েছে অনেককাল। তা আর বিলম্ব করবেন না, বেগমসাহেবা। দেরি দেখলে শাহজাদা আবার চিন্তিত হতে পারেন।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো সাতাশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

যাদুকরের এই সব মধুঢ়ালা কথাবার্তায় সামস অল নিঃসন্দেহ হতে পারে।

—ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। কিন্তু যাবো কিসে? কী এনেছো?

যাদুকর বলে, যে ঘোড়ায় চেপে আপনি এসেছেন, সেই ঘোড়াতেই নিয়ে যাবো।

সামস অল না না করে ওঠে, ওরে বাবা, ও ঘোড়ায় আমি এক চাপতে পারবো না।

যাদুকর হাসে। মনে মনে ভাবে, এবার যাবে কোথায়, বাছাধন। এখন তুমি আমার কোজায়। যেখানে তোমাকে নিয়ে যাবো, সেখানেই যেতে হবে। দাঁড়াও একবার তোমাকে জিনের ওপরে চাপাই আগে, তারপর দেখবে আমার খেল—

-সেজন্যে আপনি কিছু ভয় করবেন না, বেগমসাহেবা, আমি আপনার সঙ্গে চাপবো। তা না চাপলে, এ তো আর জ্যান্ত ঘোড়া নয়, আপনি চালাবেন কী করে?

যাদুকর সামস অলকে জিনের ওপর চাপিয়ে নিজে তার পিছনে বসলো। তারপর ডানদিকের বোতামটা টিপে ধরে বললো, কোন ভয় নাই, বেগমসাহেবা, একটুও নড়াচড়া করবেন না। আমি আপনাকে ধরে থাকছি। এক লহমাতেই পৌঁছে যাবো।

শো শোঁ করে আকাশের ওপরে প্রায় মেঘের কাছাকাছি উঠে যায় যাদুকর। তারপর আর একটা বোতাম টিপে সে তীরবেগে সামনের দিকে ছুটে চলে। সামস অল দেখে, নিচে শহরের প্রাসাদ ইমারত ছাড়িয়ে ঘোড়াটা ছুটে চলেছে মরুপ্রান্তরের উপর দিয়ে। তারপর এক সময় বিশাল বিস্তৃত মরুভূমিও পার হয়ে যায় ঘোড়াটা। গাছপালা, শ্যামল শস্যক্ষেত্ব, নদী, জনবসতি আসে। নিমেষেই তারা পিছনে পড়ে থাকে। তখন ঘোড়াটা উল্কার বেগে ছুটে চলেছে।

সামস অল নাহার বুঝতে পারে না। এ সে কোথায় চলেছে? লোকটা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ভয়ার্ত কণ্ঠে সে প্রায় চিৎকার করে ওঠে, একি? এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? আমাকে তো শোনালে, শহরের কাছেই যেতে হবে। কিন্তু কত নদী, মরুভূমি ছাড়িয়ে এলাম, এখনও কী দেরি আছে?

-এই তো এসে পড়েছি। কিন্তু এসে পড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। সামনে ছুটেই চলতে থাকলো। এবার সামস্, অল বুঝতে পারে যে সে, শয়তানের খপ্পরে পড়েছে। ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসে ওঠে সে। এ কেমন চালাকী! তুমি না শাহজাদার বিশ্বাসী চাকর? এই তোমার ব্যবহার?

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে যাদুকর, হো হো হো করে। আমি চাকর? তোমার নাগরের চাকর? আহা, কী এমন সুখের কথা?

নিমেষে মুখে ফুটে তার ভয়ঙ্কর এক হিংস্রতা।

—শোনো, সুন্দরী, তুমি যেই হও, এখন থেকে আমার পেয়ারের বাঁদী হয়ে থাকবে। এই আমার শেষ কথা।

একটা নদীর পাড়ে একটা বাগানের পাশে এসে ঘোড়াটা নেমে দাঁড়ায়। যাদুকর বলে, উফ বড় তেষ্টা পেয়েছে। চলো, একটু পানি খাবো।

সামস অল নাহার ঘোড়া থেকে নেমে এসে ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়ে।

—এত বড় শয়তান তুমি, ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে তোমার আস্তানায় নিয়ে যেতে চাইছো? সে কিছুতেই হবে না।

—আহা-হা, অত চটছো কেন সুন্দরী। তোমাকে আমি তোমার নাগর কামার অল-এর চাইতে আরও বেশি সুখে রাখবো। জানো, আমি কে? তামাম আরব পারস্য দুনিয়ার মানুষ আমার যাদুর কথা জানে। আমি মন্ত্রবলে অসাধ্য-সাধন করতে পারি। আমার প্রাসাদে চলো, দেখবে। বাদশাহ সাবুর সে-প্রাসাদ জিন্দগীতে বানাতে পারবে না। আমি মন্ত্রবলে তৈরি করেছি এক নতুন বেহেস্ত। তুমি হবে তার মালকিন। কত-শত সহস্ব বাঁদী তোমার সেবা যত্ন করবে। যে সুধা পান করলে মানুষ অমর হয়। সেই সুধা আছে আমার কাছে। তোমাকে দেব, তুমি খেয়ে চির-যৌবনা হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। বলে তোমার নাগর কামার অল পারবে এসব দিতে? পারবে কী করে, বলো? এ বস্তু তো কডি দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় না। যাদুবলে সংগ্বহ করেছি আমি। আমার বয়স কত জান? একশো বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু দেখ, আমার শরীরে কী তাকত। হাজার পালোয়ানকে এক লহমায় কুপোকাৎ করে দিতে পারি। ভাবছো, আমি বুড়ো হয়েছি, তোমার যৌবন-কাম ব্যর্থ হয়ে যাবে? তবে জেনে রাখা সুন্দরী, আমি দেখতে কুরূপ হতে পারি, বয়েস আমার একশোরও বেশি হতে পারে, কিন্তু এখুনও আমি তোমার মতো শত সুন্দরীকে সমানভাবে তুষ্ট রাখতে পারি। সুতরাং মন থেকে ওই সব ভালোবাসার প্যানপ্যােনানি মুছে ফেলো। মেয়েরা চায় বিলাস-ব্যাসন, আর চায় রতি-রঙ্গের জাঁদরেল যন্তর। ও দুটো আমার কাছ থেকে যা পাবে, কামার অল এর কাছ থেকে তা কখনই পাবে না। কামার অল একটা লম্পট, চোর। আজ যে মেয়েকে নিয়ে নাচে, কাল তাকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দেয়। এই যে কলের ঘোড়াটা দেখছো, এটার মালিক কে জানো? আমি। সে আমার জিনিস চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো তোমাকে ভুলিয়ে ভাগিয়ে আনতে।

সামস অল নাহার চিৎকার করে ওঠে, থামো! তোমার অনেক বুজরুকি আমি শুনেছি, আর শুনতে চাই না। এখন জানে বঁচতে চাও তো কেটে পড়। না হলে কপালে তোমার দুঃখ আছে।

যাদুকর হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ে, আমার কপালে দুঃখ জিনিসটা লিখতে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, সুন্দরী। আমি সুখের সাগরে ভেসে বেড়াই। তোমাকেও অবশ্য সঙ্গী করে নেব, ভয় নাই।

এমন সময় দুজন জাঁদরেল সেনাপতি গোছের লোক পিছন দিক থেকে অতর্কিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো যাদুকরের ওপর।

—এ্যাই, ওঠ, চলো, শাহেনশাহর কাছে যেতে হবে।

পারস্যের সীমানা ছাড়িয়ে রুমমুলুকে এসে ঘোড়াটাকে নিচে নামিয়েছিলো যাদুকর। উদ্দেশ্য ছিলো খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে পানি পান করে আবার আকাশে উড়বে। রুম ছাড়িয়ে, আরও সুদূরে, অন্য কোনও দূরদেশে পাড়ি জমাবে। কিন্তু তা আর হলো না।

কাছেই রুমের শাহেনশাহর শহর। বাদশাহ প্রতিদিন বিকালে মুক্ত বায়ু সেবন করতে আসেন এই নদীর ধারে। সে-দিনও যথারীতি উজির আমির সেনাপতি নবাব বান্দা সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। হঠাৎ তার কানে ভেসে এল নারী-কণ্ঠের আর্তনাদ। ভালো করে নজর করতে, বুঝতে পারলেন অনেকটা দূরে একখণ্ড সবুজ ঘাসের ওপর বসে আছে একটি পরমাসুন্দরী মেয়ে, আর তার পাশে এক বুড়ো। তরুণীর আর্তকণ্ঠ শুনে তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই লোকটা কোনও দুবৃত্ত, বদমাইশ। অসহায় অবলাকে জোর করে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সেনাপতিদের বললেন, ঐ লোকটাকে ধরে নিয়ে এসো। বুড়ো যাদুকর ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেছে। হঠাৎ এখানে কেউ এসে পড়তে পারে, মনে হয়নি।

-এ্যাঁ, আমাকে কেন পাকড়াও করছেন? কী করেছি আমি।

সেনাপতিরা বলে, সে কৈফিয়ৎ শাহেনশাহর কাছেই দেবে, চলো।

কিন্তু তবু যাদুকর নড়তে চায় না। সেনাপতিদ্বয় তার দুই গালে বিরাশিসিক্কার দু’খানা ঘুষি লাগাতেই বাছাধন কঁকিয়ে ওঠে, যাচ্ছি-যাচ্ছি।

বাদশাহ দেখে অবাক হয়, লোকটা কী ভয়ঙ্কর কুৎসিত কদাকার। এমন হত-কুৎসিত মানুষ তিনি জীবনে দেখেননি কখনও। আর এ-রকম অলোক সামান্যা সুন্দরী যুবতীও তিনি কমই দেখেছেন। বাদশাহ সামস অলকে জিজ্ঞেস করে, তোমার বাপ-মা কী নিষ্ঠুর পাষণ্ড। তোমার মতো এক অপূর্ব রূপসী মেল্লয়কে এই কবরের মড়া একটা বুড়োর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে?

পারসী যাদুকর বলে, জাঁহাপনা, ও আমার চাচার মেয়ে, আমি ওকে শাদী করেছি।

—মিথ্যো কথা, সামস অল নাহার ফুসে ওঠে। একদম ডাহা মিথ্যে কথা, জাঁহাপনা। লোকটা মহা শয়তান, বদমাইশ যাদুকর। আমাকে ভাওতা দিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেও আমি ওকে চিনতাম না। জীবনে কখনও দেখিনি। পারস্যেব শাহজাদা আমার স্বামী। সেখান থেকে ও আমাকে ধাপ্পা দিয়ে বের করে নিয়ে এসেছে।

বাদশাহ বললেন, আমি সবই বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে এখনই দাওয়াই দিচ্ছি।

বাদশাহর হুকুমে সেনাপতিরা বেদম প্রহার করতে থাকলো যাদুকরকে। তাদের এক একটা ঘুষিতে তার হাড় পাঁজর গুড়ো গুড়ো হয়ে যেতে লাগলো। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকে সে। কিন্তু মুখে দোষ স্বীকার করে না।

বাদশাহ বললেন, আচ্ছা এখন ওকে কারাগারে কয়েদ করে রেখে দাও। পরে আবার দেখা যাবে।

সামস অল নাহার এবং সেই আজব কাঠের ঘোড়াটাকে সঙ্গে নিয়ে বাদশাহ প্রাসাদে ফিরে এলেন। বাদশাহ ভেবে অবাক হন এই কাঠের ঘোড়ায় করে তারা এলো কী করে। অদ্ভুত ব্যাপার তো, মাথার মধ্যে শুধু এই একটা চিন্তাই ঘোরাফেরা করতে থাকে।

 

এবারে বাদশাহজাদা কামার আল আকমরের কথা শুনুন। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে মরুপ্রান্তর, নদী নালা পাহাড় বন্দর। কত সবুজ ফসলের মাঠ অতিক্রম করে, কত গ্রাম গঞ্জ পিছনে ফেলে বিরাম-বিহীনভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে থাকে সে।

রাত্রির অন্ধকার হাল্কা হতে থাকে। প্রভাত সমাগত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো আটাশতম রাত্রি :

আবার সে বলতে থাকে :

এইভাবে দিনের পর দিন কেটে যায়। দিনে দিনে মাস অতিক্রান্ত হয়। অনেক শহর গ্রাম পার হয়ে যায় সে। পথের মাঝে যাকে দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করে, সেই আজব ঘোড়া, সেই বুড়ো যাদুকর আর এক সুন্দরী কন্যার কথা। কিন্তু কেউই তার জিজ্ঞাসার কোনও জবাব দিতে পারে না। সবাই একই কথা বলে, না তেমন কোনও ঘোড়া বা নর-নারীকে দেখেনি তারা—শোনেও নি কারো মুখে তেমন কিছু।

এইভাবে চলতে চলতে একদিন সে সানা-শহরে এসে পড়ে। কামার অল ভেবেছিলো, যদি সামস অল এখানে ফিরে এসে থাকে। কিন্তু সানা-বাসীরা বললো, শাহজাদীর শোকে বাদশা-বেগম শয্যাশায়ী হয়ে আছে। না, তিনি ফিরে আসেন নি। ফিরলে সারা সালতানিয়ৎ আবার আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়বে না?

হতাশ মনে কামার অল আবার অন্য পথে চলতে থাকে। এইভাবে চলতে চলতে কপালক্রমে একদিন সে রুম মুলুকে এসে হাজির হয়। জনে জনে জিজ্ঞাসা করতে থাকে সে। যদি কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারে, সেই আশায়। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারে না। কেউ দেখাতে পারে না। আশার আলো।

একদিন, তখন সন্ধ্যা হয় হয়, কামার অল একটা সরাইখানায় এসে থামে। রাতটা সেখানেই সে কাটাবে।–সেইরকম ইচ্ছা। সরাইখানার সামনের ঘরে এক দল সওদাগর গোল হয়ে বসে খানাপিনা আর গল্প-গুজব করছিলো। কামার অল তাদের কাছাকাছি একটা আসনে বসে পড়লো।

সওদাগরদের একজন বলতে থাকে, এক আজব কাহিনী শুনে এলাম। কামার আল কান খাড়া করে শোনে।

সওদাগররা সবাই উৎসকুক হয়ে তাকায়, কী এমন আজব কাহিনী ভাই সাহেব?–আমি রুমের শহরে সওদা বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরছি। সেখানকার লোকের মুখে মুখে ফিরছে। শুধু একটাই কথা।

-কী কথা?

বাদশাহ নাকি একদিন নদীর ধারে এক জঙ্গলে শিকারে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটা কদাকার বুড়োর সঙ্গে একটা অসাধারণ সুন্দরী রূপসী মেয়েকে ধরে এনেছেন।

সওদাগররা চুপসে গেলো, তারা ভেবেছিলো এমন কথা শোনাবে যে যাতে একেবারে তাক লেগে যায়। সবাই সমস্বরে বললে, এ আর এমন কী ঘটনা।

এমন কাণ্ড আজকাল আকছার হচ্ছে। কত মেয়ে কত মানুষের সঙ্গে ভোগে যাচ্ছে-তা নিয়ে আবার গল্প কী-?

সওদাগরটি বলে, আহা রসো, আসল কথা তো এখনো বলিনি।

আবার সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকায়। সওদাগরটি বলে, ঐ বুড়োটা আর সুন্দরী মেয়েটা নাকি একটা আজব কাঠের ঘোড়ায় চেপে আসমান দিয়ে উড়ে এসে নেমেছিলো। ঘোড়াটা আর মেয়েটিকে বাদশাহ প্রাসাদে রেখে দিয়েছেন। আর বুড়োটাকে রেখেছেন। কয়েদখানায়।

সওদাগরটি অনেক ফুলিয়ে ফাপিয়ে রসিয়ে রসিয়ে নানা রকম রঙিন বর্ণনা সহকারে কাহিনীটা বলতে থাকে। তার বিস্তারিত বিবরণ এ কাহিনীর উদ্দেশ্য নয়।

কামার আল-এর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না। এতদিন ধরে সে যার সন্ধান করে বেড়াচ্ছে আজ তার হদিস পেয়ে মন চনমান করে ওঠে। গায়ে পড়ে সে সওদাগরটিকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা জনাব, কোন শহরের কথা বললেন?

—এখান থেকে কতদূর। কোন পথে যাওয়া যায়?

সওদাগর তখন তাকে রুমে যাওয়ার সোজা পথের নিশানা বাতলে দিলো।

আর তিলমাত্র অপেক্ষা না করে সে রাতেই সে বেরিয়ে তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে-চলতে এক-সময় রুম শহরের প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছয়। ফটকের পাহারাদার বিদেশী কামার অলকে দেখে বলে, এখানকার নিয়ম অন্য দেশের কোনও মানুষ এ-শহরে ঢুকতে চাইলে আগে তাকে বাদশাহর দরবারে যেতে হবে। বাদশাহ যদি অনুমতি দেন তবেই সে শহরে ঢুকতে পারে।

কামার আল বলে, বেশ তো আমাকে নিয়ে চলো, তোমাদের বাদশাহর দরবারে।

কিন্তু রাত। তখন অনেক। পাহারাদার বলে, এত রাতে তো বাদশাহর সঙ্গে দেখা হবে না। আজ আপনাকে এখানেই কয়েদখানায় রাত কাটাতে হব।

কিন্তু ফটকের কোতোয়াল কামার অল-এর অদ্ভুত সুন্দর চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। ভাবে, আহা এমন খুবসুরৎ নওজোয়ান-একে সে কয়েদখানায় ঢোকাবে?

কোতোয়াল কামার অলকে তার নিজের ঘরে বসায়। একসঙ্গেই খানাপিনা করে। এক সময় সে জিজ্ঞেস করে, তা সাহেব, কোথা থেকে আসছেন?

–আমি পারস্য থেকে আসছি।

কোতোয়াল হেসে ওঠে, কিছু মনে করবেন না, পারসীদের সম্বন্ধে ধারণা আমাদের খুব খারাপ। শুনেছি তাদের মধ্যে ভালো লোক খুবই কমই আছে। ঠগ, জোচ্চোর, বদমাইশ, শয়তানদের সংখ্যাই নাকি বেশি। এই তো কিছুদিন আগে একটা বুড়ো পারসী এসেছে আমার এই কয়েদখানায়। অনেক পারসীকে দেখেছি, আলাপও করেছি। অনেকের সঙ্গে। নানারকম মিথ্যা আজগুবি কিসসা তারা শোনায়। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে এই বদখদ বুড়ো কয়েদীটো। লোকটা চোখে মুখে মিথ্যে কথা বলে। এমন ঠগ শয়তান আমি জীবনে দেখিনি কখনও।

কামার অল উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী রকম? কী ধরনের মিথ্যে কথা সে বলেছে। –লোকটা হামবড়াই। তার ধারণা সে একটা পীর পয়গম্বর। তার মতো ধন্বন্তরী হেকিম নাকি সারা দুনিয়ায় নাই। আমাদের বাদশাহ একদিন শিকারে বেরিয়ে এক জঙ্গলের পাশে এই বুড়োটাকে দেখতে পান। লোকটা এক অপরূপ সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে পালাচ্ছিল। ওদের সঙ্গে একটা কাঠের ঘোড়া পাওয়া গেছে। এই কালো কাঠের ঘোড়াটা এক তাজ্জব জিনিস। কাঠের ঘোড়টায় কল বসানো আছে। সেই কল টিপলে নাকি সে আকাশে উঠে ছুটিতে থাকে। প্রাসাদেই রাখা আছে ঘোড়াটা।

কামাল জানতে চায়, আর সেই মেয়েটা?

—শুনছি, তাকে তো বাদশাহ শাদী করবেন। তার মতো সুন্দরী নাকি তামাম আরব পারস্যে দুটি নাই। বাদশাহ তার রূপের মোহে মাতাল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু মেয়েটার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সাব-সময় বিড়বিড় করে আপন মনেই কী সব বলতে থাকে। খায় না, নায় না। কারো সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলে না। বাদশাহ তাকে সারিয়ে তোলার জন্য দু’হাতে অকাতরে পয়সা খরচ করেছেন। দেশ-বিদেশ থেকে নামজাদা হেকিম বিদ্যিরা আসছেন। কিন্তু কেউই কিছু করতে পারছেন না। বুড়োটা সারা দিন-রাত তড়পায়, আমাকে নিয়ে চল বাদশাহর কাছে। এক লহমায় আমি তার সব রোগ সারিয়ে দেব। কিন্তু ঐ উন্মাদের কথা কে শুনবে? লোকটা রাতেও ঘুমায় না। সারারাত ধরে চেঁচামেচি চিৎকার করেই চলেছে। আমাদের এক পলক স্বস্তিতে থাকতে দেয় না ব্যাটা।

কামার অল ভাবে, যাক একটা হদিশ পাওয়া গেলো। তখন সে কী ভাবে এগুবে তারই মতলব করতে লাগলো। রাত যখন আরও গম্ভীর হয়ে এলো তখন কোতোয়াল বললো, এবার সাহেব, আপনাকে কয়েদখানার ভিতরে ঢুকতে হবে যে।

কামার আল বলে, আমি তো প্রস্তুত। চলুন, কোথায় নিয়ে যাবেন।

ভিতরে ঢুকেই সে একটা গোঙনী শুনতে পেলো। সেই বুড়ো যাদুকরটা নিজের মনেই বিড়-বিড় করে বকে চলেছে।

—হায় হায় একি সর্বনাশ করলাম আমি। কেন মরতে ঐ নদীর পাশে নামতে গেলাম! আমন সুন্দর কচি ডাগর ছুডিটা রসিয়ে-রাসিয়ে উপভোগ করবো। আশা করেছিলাম—কিন্তু শয়তান বাদশাহটা তা হতে দিলো না। আমার বাড়াভাতে ছাই দিয়ে দিলো! একটুখানি চালের ভুলের জন্য আমার এই সর্বনাশ হয়ে গেলো। উঃ!

কামার অল আকমর কাছে সরে এসে চোস্ত পারসী ভাষায় বুড়োকে জিজ্ঞেস করে, অমন চোখের জল ফেলে কান্নাকাটি করছে কেন, কী হয়েছে? তোমার কী ধারণা, দুনিয়াতে একই তুমি দুঃখী হতভাগ্য!

কামার আল-এর এই সহৃদয় সহানুভূতি পেয়ে বুড়োটা নড়েচড়ে বসে। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে কামার অলের মুখখানা দেখতে পায় না। হয়তো বা দেখতে চায়ও না। গলাটা খাটো করে কামার অল-এর কানের কাছে সরে এসে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বলতে থাকে। কী ভাবে সে মেয়েটিকে ধাপ্পা দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল, এবং কী ভাবেই বা বাদশাহর হাতে ধরা পড়ে প্রচণ্ড প্রহার খেয়েছিলো এবং তার বিস্তারিত কাহিনী শোনালো তাকে। কানে কানে ফিস ফিস করে বললো বটে কিন্তু কয়েদখানার কোনও কয়েদীরই একাহিনী শুনতে আর বাকী নাই। যখনই কোনও নতুন কয়েদী আসে, বুড়ো ছলে ছুতোয় তার কাছে যাবেই এবং তার এই মহান কীর্তি-কলাপের কিসসা তাকে শোনাবেই।

বুড়োর কাহিনী শুনতে শুনতে রাত কাবার হয়ে যায়।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো ঊনত্রিশতম রজনী :

আবার গল্প শুরু হয় :

পরদিন সকালে কয়েকখানায় কোতোয়াল কামার অলকে বের করে বাদশাহর দরবারে নিয়ে গিয়ে হাজির করে। যথাবিহিত কুর্নিশ করে বলে, এই নওজোয়ান কাল রাতে এই শহরে এসে পৌঁছয়। তাই কাল আপনার দরবারে হাজির করতে পারিনি, জাঁহাপনা; সারারাত ওকে কয়েদখানায় রেখেছিলাম। আজ সকালে হুজুরের সামনে পেশ করছি।

বাদশাহ প্রশ্ন করলেন, কী তোমার নাম? কোথা থেকে আসছো? তোমার ব্যবসাই বা কীসের। আমার শহরে কেন ঢুকতে চাও?

কামার অল বলে আমার নাম হরজা-শুদ্ধ পারসী শব্দ। পারস্য আমার দেশ। জাত-ব্যবসা হেকেমী। আমি দেশে-বিদেশে মানুষের রোগ সারিয়ে বেড়াই। এই আমার কাজ। যে-সব দুরারোগ্য ব্যাধি-বিশেষ করে মানসিক ব্যাধি অন্য কোনও হেকিম বদ্যি সারাতে পারে না তখনই আমার ডাক পড়ে। লোকে বলে আমি নাকি ধন্বন্তরী। আমার হাতে রুগী সারেনি—এমন একটাও হয়নি। আমার নিজের গুণ-কীর্তন আমি আদৌ পছন্দ করি না। জাঁহাপনা। দেশ-বিদেশের সুলতান বাদশাহরা সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে যে-সব তি মোহর ফলক উপহার দিয়েছেন সেগুলোর মালা কুরে গলায় ঝোলাবার সাধ্য আমার নাই। তার ওজনের ভারে আমি চলতেই পারবো না। আর তাছাড়া ওসব ভড়ং আমার পছন্দও নয়। আমাকে দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ চেনে। খাতির করে। ওসব গলায় পরে সং সেজে কী হবে? আমি কোনও মন্তর-তন্তর পড়ে রোগ সারাই না। স্রেফ দাওয়াই দিয়েই সারিয়ে তুলি। অনেকে আছে ঝাড়ফুক করে, রোগীর বুকে পিঠে মুখে কিল চড় থাপ্পড় ঘুষি চালায়, চুল কান ধরে টানা হেঁচড়া করে। কিন্তু আমার ওই ফেরেব-বাজীর ব্যবসা নয়। রোগী দেখবো। রোগ ধরবো। দাওয়াই দেব। সেরে যাবে। ব্যস, আমার ইনাম নিয়ে আমি ঘরে ফিরে যাবো। আর যদি না। সারাতে পারি, একটি পয়সা নেব। না। নাকে খত দিয়ে বিদেয় হবো। বান্দর এই পরিচয়, জাঁহাপনা

বাদশাহ বাহবা দিলেন, বহুত বডিয়া বাত। চমৎকার। তুমি যথা-সময়েই এসে পড়েছে। আমার কাছে। ঠিক এই রকম একজনকেই আমি খুঁজছিলাম, হেকিম।

এরপর বাদশাহ তার বেড়াতে যাওয়ার কাহিনী দিয়ে শুরু করে বৃদ্ধকে কয়েদ করা পর্যন্ত আদ্যোপান্ত সমস্ত কাহিনী সবিস্তারে বললো কামার অলকে। তারপর মেয়েটির মাথার গোলমাল শুরু হলে, কোন হাকিমকে দিয়ে কবে কবে দেখিয়েছিলেন তারও লম্বা ফিরিস্তি।

—এখন তুমি যদি সত্যিই তাকে সারিয়ে তুলতে পোর, তোমার কোনও ইচ্ছাই আমি অপূর্ণ রাখবো না হেকিম। যা চাইবে তাই পাবে। আমার কী মনে হয় জানি, মেয়েটির রূপে পাগল হয়ে কোনও একটা জিন বা আফ্রিদি তার কাধে ভর করে আছে।

কামার আল বলে, আল্লাহর অপার করুণা বর্ষিত হোক; এখন আমাকে রোগের লক্ষণ-গুলো ঠিক ঠিক বলুন তো, জাঁহাপনা। কী কী উপসর্গ তার দেখেছেন? এবং কবে থেকে এরকমটা হচ্ছে।

—হচ্ছে সেই প্রথম দিন থেকেই। যেদিন তাকে আর সেই যাদুকর বুড়োটাকে এবং সেই আবলুস কাঠের ঘোড়াটাকে নিয়ে এলাম সেইদিন থেকেই সে অসুখে পড়ে।

কামার আল জিজ্ঞেস করে, সেই বুড়োটা এখন কোথায়?

—তাকে আমি এখনও কয়েদখানাতেই রেখে দিয়েছি।

—আর সেই ঘোড়াটা?

–ওটা আছে আমার খাজাঞ্চীখানায়। অমন মহামূল্য সম্পত্তি তো আর বাইরে রাখা যায় না।

—তাতো বটেই।

মনে মনে ঠিক করলো, সবকিছু করার আগে আর একবার ঘোড়াটাকে স্বচক্ষে দেখে নিতে হবে। বলা যায় না, বুড়ো শয়তানটা কোনও কারসাজী করে রেখেছে। কিনা। যদি দেখি; ঘোড়াটা ঠিক আছে, তা হলে আমার বাজী মাৎ করতে বেগ পেতে হবে না। কিন্তু ঘোড়াটা যদি কোনক্রমে বিকল হয়ে থাকে, তা হলে সামসকে উদ্ধার করার অন্য উপায় বের করতে হবে। বাদশাহর দিকে ফিরে কামার আল বলে, আগে আমি ঐ ঘোড়াটাকে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। হয়তো রোগের আসল কারণ ওর মধ্যেই নিহিত আছে।

বাদশাহ বললেন, বেশ তো, এ আর এমন কি কথা, এখুনি দেখিয়ে দিচ্ছি।

কামার অলকে সঙ্গে নিয়ে বাদশাহ খাজাঞ্চীখানায় চলে আসেন। কামার অল এক এক করে সব বোতাম যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে দেখে নেয়। না, ঠিক আছে। কামার আল খুশিতে নেচে ওঠে।

—আমার মনে হচ্ছে এই ঘোড়া থেকেই তার রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। যাক, এবার আমি রুগীকে দেখবো! আমার বিশ্বাস, রোগ আমি ধরতে পেরেছি। দাওয়াই আমি নিজে হাতেই বানাবো। কিন্তু তার জন্যে রুগীর সঙ্গে এই ঘোড়াটাকে দরকার হতে পারে জাঁহাপনা।

বাদশাহ কামার অলকে নিয়ে সামস অল নাহারের শয্যাকক্ষে আসেন। সামস অল, কামার অলকে লক্ষ্য করে, তাদের দেখামাত্র তার পরণের সাজ-পোশাক ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকলো। কখনও বা হা হা হি হি করে হাসতে লাগল, আলুথালু চুল, অসংবৃত বেশবাস। কখনও সে হাততালি দেয়, গান গায়। আবার কখনও বা কপাল বুক চাপড়াতে থাকে।

কামার আল বুঝলো, এ-সবই তার চালাকী। কী করে সুলতানকে সেখান থেকে সরানো যায় তারই কায়দা খুঁজতে থাকে সে।

কামার আল সামসের কাছে এগিয়ে যায়। খুব ধীরে ধীরে বলে, দিন দুনিয়ার মালিক যিনি তারই দোয়ায় আপনার সব রোগ সেরে যাবে।

কামার অল-এর কথা শেষ হতেই সামস তার মুখের দিকে ফিরে তাকায়। বুকের মধ্যে এক অসহ্য আনন্দের জোয়ার ঠেলে উঠতে চায়, কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারে না। হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে মেজেয় লুটিয়ে পড়ে যায়।

বাদশাহ ভাবলেন, হেকিম বন্দ্যিদের সম্বন্ধে একটা আতঙ্ক হয়ে গেছে তার। কোনও মানুষকেই সে বরদাস্ত করতে পারে না, বিশেষ করে হেকিমদের একেবারে না। কামার আল সামস অলকে ওঠাবার চেষ্টা করে। কনের কাছে ফিসফিস করে বলে, সামস অল নাহার, আমার চোখের মণি, সোনা, ওঠে, এইভাবে জীবনটাকে বরবাদ করে দিও না। আমার দিকে চোখ মেলে তাকাও; দেখ, আমি এসেছি। আর তোমার ভাবনা কী। এতদিন কষ্ট করে আছ, আর দু একটা দিন কষ্ট করে কাটাও, আমি তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবোই, সোনা। এখন খুব সাবধানে—সতর্কভাবে চলতে হবে। আমাদের। কেউ যেন ঘৃণাক্ষয়েও কোন রকম সন্দেহ না করে। অনেক ধৈর্য ধরে মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ হাসিল করতে হবে। চালে একটু ভুল হলেই সব মাটি হয়ে যাবে। তা হলে আমি আর জান নিয়ে ফিরতে পারবো না। যদি আমরা এই নারী-মাংসলোভী অত্যাচারী বাদশাহর মনে একবার গভীর আস্থা এনে দিতে পারি, তা হলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে উঠবে। এজন্যে তোমার সাহায্য সবচেয়ে বেশি দরকার। বাদশাহ পাশের ঘরেই বসে আছেন, আমি তাকে গিয়ে বলছি তোমাকে জিনে ধরেছে। সেই কারণেই তোমার মধ্যে একটা উন্মাদের ভাব দেখা গেছে। এবং এও তাকে আমি আশ্বাস দেবো, আমার চিকিৎসায় থাকলে ও নির্ঘাৎ সেরে যাবে। তুমিও-এরপর যখন বাদশাহর সঙ্গে কথা বলবে, অপেক্ষাকৃত একটু শান্তভাবে, সাধারণ সুস্থ মানুষের মতো বলবে। এর ফলে বাদশাহ ভাববেন আমার চিকিৎসাতে অনেকটা ফল হয়েছে।

সামস অল নাহার মৃদু হেসে বলে, ঠিক আছে, দেখো কেমন পাকা অভিনয় করি। এতদিন যে পাগলী সেজে ছিলাম, কেউ কি এক বিন্দু সন্দেহ করতে পেরেছে?

শাহজাদা কামার অল পাশের ঘরে এসে বাদশাহকে বলে, জাঁহাপনা আমি একেবারে নিঃসন্দেহ, ওকে জিনে ধরেছে। আল্লাহ অনেক মেহেরবান, যথাসময়ে আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন তিনি। আর যদি কটা দিন দেরি হতো, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেত সে। তবে আমি যখন এসে পড়েছি, আর কোনও ভয় নাই। আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারেন, শাহজাদীকে আমি নির্মূল করে সারিয়ে দেবো। আমি একটা দাওয়াই তাকে দিয়ে এলাম। ফল হাতে হাতেই বুঝবেন। যান, ও-ঘরে যান, নিজের চোখেই দেখে আসুন, ওর সঙ্গে কথা বলুন, তা হলেই বুঝতে পারবেন, কতটা উপকার হয়েছে।

বাদশাহ অবাক হয়, বলো কী হেকিম? তোমার ওষুধের এত গুণ?

–আপনার যদি ইচ্ছা হয়, আপনার মনের ইচ্ছা তার কাছে খুলে ধরুন। দেখবেন সে কী জবাব দেয়।

আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বাদশাহ পাশের ঘরে ঢোকেন। বাদশাহকে দেখা মাত্র সামস আল নাহার যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানায়।

—বাদীকে যে এই অসময়ে স্মরণ করেছেন, এ জন্য আমি ধন্য হলাম, জাঁহাপনা। রাত্রির অন্ধকার কাটে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো তিরিশতম রজনী :

আবার গল্প শুরু হয় :

হঠাৎ তার এই অসাধারণ পরিবর্তন দেখে বাদশাহর আনন্দ আর ধরে না। দাসী বাঁদী খোজাদের ডেকে তিনি হুকুম করেন, শিগ্‌গির-ওকে হামামে নিয়ে গিয়ে ভালো করে ঘষে মেজে গোসল করাও। খুব জমকালো সাজপোশাকে সাজাও। আমার প্রাসাদের খানদানী রত্নাভারণে মুড়ে দাও ওর সর্বাঙ্গ।

দাসী বাঁদী এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ায়। সামসও তাদের কথার যথারীতি জবাব দেয়। ওরা ওকে হামামে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে সুন্দর করে পরীর সাজে সাজায়। সত্যিই রুপের তুলনা মেলা ভার। বেহেস্তের ডানাকাটা পরীই বটে!

শাহজাদা কামার আলোর প্রতি বাদশাহ অপরিসীম। প্রসন্ন হয়ে ওঠেন।

—তোমাকে কী বলে সম্বোধন করবো বুঝতে পারছি না হেকিম। তুমি সামান্য এক চিকিৎসক নও, তোমার ভিতরে যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে তা কেবলমাত্র পীর পয়গম্বরদেরই থাকতে পারে। তুমি এক বিরাট দার্শনিক-একথা বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। অনেকদিন পরে আজ আমার এবং তার মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছে সে তো শুধু তোমারই কল্যাণে। আল্লাহ তোমাকে চিরায়ু করে রাখুন। দুনিয়ার অনেক মানুষের দুঃখ মোচন করতে পারবে তুমি।

শাহজাদীকে সঙ্গে নিয়ে আপনি আজই কোনও স্বাস্থ্যকর মনোরম পরিবেশে চলুন। সেখানেই আমি চিকিৎসার শেষ পর্ব শুরু করবো। ঐ কাঠের ঘোড়াটাকে সঙ্গে নিতে হবে। ওটা আসলে কিন্তু কাঠের ঘোড়া নয়, রোগের আসল উৎপত্তিই ওখানে। ওই হচ্ছে জীনের বাহন। এ অবস্থায় এখানে এই প্রাসাদে থেকে ঐ জীনকে একে বারে তাড়ানো শক্ত হবে। আপাততঃ সে হয়তো শাহজাদীকে ছেড়ে প্রাসাদের কোনও কক্ষে লুকিয়ে থাকবে। তারপর আমি ফিরে এলেই আবার এসে ভর করবে তার ওপর। সেই কারণে আমার পরামর্শ, ঘোড়াটাকেও সঙ্গে নিতে হবে। ফাঁকা জায়গায় তাকে আমি কাজায় আনতে পারবো। হয়তো কিছু সময় লাগবে, কিন্তু আমি যখন তাকে পুরোপুরি হাতের মুঠোয় আনতে পারবো। তখনই তাকে জালার মধ্যে পুরে দরিয়ার জলে ফেলে দেবো।

 

রুম অধিপতি সেইদিনই রওনা হয়ে গেলেন। অনেক লোকলিস্কর দাসদাসী সঙ্গে নিলেন। কামার অল-এর কথামতো কাঠের ঘোড়াটাও বয়ে নিয়ে চললো বাহকরা।

এক পাহাড়ের পাদদেশে মনোরম পরিবেশে তাঁবু ফেলা হলো। কামার অল বাদশাহকে বললো, কাল সকালে আমি শাহজাদীকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চাপবো। জীনের সঙ্গে তখনই হবে আমার বোঝাপড়া। সে আমাকে খতম করার কায়দা করবে। কিন্তু আমাকে ঘায়েল করার সাধ্য জীনের হবে না। প্রথমে খুব দাপাদাপি করবে, কিন্তু আমি তাকে এমন ভাবে আকড়ে ধরবো, কিছুতেই পালাতে পারবে না। একটা কথা, জাঁহাপনা, আপনি বা আপনার সৈন্যসামন্ত, লোকজন কেউ যেন ওই জীনের নজরবন্দীর আওতায় যাবেন না। তা হলে সে হয়তো তখন শাহজাদীকে ছেড়ে আপনার অথবা অন্য কাউকে ভর করতে পারে। আমি যখন ওকে পুরোপুরি ভাবে কাজায় আনতে পারবো, তখন আপনাকে কাছে ডাকবো। তার আগে—আপনারা অনেকটা দূরে দূরে থাকবেন।

বাদশাহ বললো, কতটা দূরে কোথায় আমরা থাকবো, তুমি বলে দেবে। তার এক পা এদিক ওদিক যাবো না কেউ।

পরদিন সকালে তাঁবু থেকে ক্রোশখানেক দূরে কাঠের ঘোড়াটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। কামার অল একটা জায়গা দেখিয়ে বাদশাহকে বললো, আপনি এইখানে অপেক্ষা করুন, জাঁহাপনা। আপনার সৈন্যসামন্ত লোকজনদের বলুন, তারা যেন এখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে না যায়। আমি শাহজাদীকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়াটার কাছে যাচ্ছি। শাহজাদীকে দেখে জীনটা হয়তো খানিকটা বেগড়বাই করতে পারে। হয়তো সে ছুটে এসে আপনার সেনাদেরও ঘায়েল করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। আমি ওকে সামলে 0न्म<!

বাদশাহর বুক দুরু দুরু করতে থাকে। যদি জীনটা হেকিমকে হারিয়ে দিয়ে ওকে মেরে ফেলে! তা হলে তো সে আর শাহজাদীকে ছেড়ে যাবে না।! আবার এও ভাবে, হেকিমের যা হিন্মৎ—তার সঙ্গে জীনটা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারবে না। নিৰ্ঘাৎ সে ঐ জীনটার জান খতম করতে পারবে।

অনেক দূরে একটা ফাঁকা প্ৰান্তরে ঘোড়াটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কামার আল আর শাহজাদী হাঁটতে হাঁটতে একসময় তার কাছে এসে দাঁড়ালো। কামার অল দেখে নিলো, সেখান থেকে বাদশাহ আর তার সৈন্যবাহিনীকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নজর করলে তবে বোঝা যায় অনেক দূরে একদল মানুষ নিশাচল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কামার অল প্রথমে সামস আলকে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে দিলো, তারপর নিজে লাফিয়ে উঠে তার সামনে বসলো।

—সামস অল, আমার বগলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার কঁধ দু’খানা বেশ শক্ত করে আকড়ে ধরে থাকে। আমি এক্ষুনি বোতাম টিপবো।

সামস বলে, ঠিক আছে, তুমি চালাও।

তৎক্ষণাৎ ঘোড়াটা একবার নড়ে চড়ে ওঠে। তারপর শো শো করে আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে।

বাদশাহ দূর থেকে আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছিল, ঘোড়াটা শূন্যে উঠে যাচ্ছে। তখনও তার মনে অণুমাত্র সন্দেহ জাগেনি। হেকিমের ওপর অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থা তার। তিনি ভাবলেন, জীন হয়তো তাকে ঘায়েল করার কসরৎ করছে। কিন্তু সে তো পারবে না, এখুনি হেকিম তাকে শায়েস্তা করে ফেলবে।

ঘোড়াটা ততক্ষণে মহাশূন্যে সুদুর নীলিমায় বিলীন হয়ে গেছে। আর কিছুই দেখা যায় না। তখনও বাদশাহ ভাবলেন, হেকিম নিশ্চয়ই এখনই তাকে আবার মাটিতে এনে ফেলবে।

প্রধান সেনাপতি বললো, কিন্তু ফেরার তো কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, জাঁহাপনা!

বাদশাহ দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেন, সবুর কর সেনাপতি, এবার সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি হচ্ছে। এখুনি বাছাধন জীনের কী দশা হয়, দেখতে পাবে। ওখানে যে পোল্লাই একটা তামার জালা দেখছো, ঐ জালায় তাকে ভরা হবে।

কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর এবং দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো, তখনও ঘোড়াটা ফিরে এলো না দেখে বাদশাহ চিন্তিত হলেন।

—তাইতো, ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না!

সেনাপতি বললো, আমার কিন্তু গোড়া থেকেই কেমন সন্দেহ হয়েছিলো জাঁহাপনা। কিন্তু আপনার মুখের সামনে সাহস করে বলতে পারিনি তখন। এই হেকিম লোকটা আসলে একটা ঠগ। ও আপনাকে ধোঁকা দিয়ে শাহজাদীকে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।

বাদশাহ আৎিকে উঠলেন, এ্যা, বলো কী? এখন কী করা যায়।

সেনাপতি বলে, এখন হা-হুতাশ ছাড়া করার আর কিছুই নাই, জাঁহাপনা। পাখী পালিয়েছে।

বাদশাহ ক্ৰোধে কাঁপতে লাগলেন। তাঁর মনে হলো, এ সবই সেই কদাকার বুড়োটার কারসাজী। গর্জে উঠলেন তিনি, ওই শয়তানটাকে পাকড়াও করে নিয়ে এসো আমার সামনে।

তখুনি বাদশাহ প্রাসাদে ফিরে গেলেন। বুড়ো যাদুকরকে হাজির করা হলো সেখানে। বাদশাহ হুঙ্কার ছাড়লেন, এ্যাই ব্যাটা বাঁদর, বল, কেন তুই আমার কাছে গোপন করে রেখেছিস-ঘোড়াটা আসলে একটা জীন? হায় হায়, হেকিমটা শাহজাদীকে সারিয়ে তুললো, কিন্তু তা আর আমার কপালে জুটলো না। না-জানি ওদের কী হলো? আমার অতগুলো মহা মূল্যবান রত্নালঙ্কার পরিয়েছিলাম শাহজাদীকে—সবই খোয়া গেলো। শুধু তোর জন্য? আমি তোর গর্দান নেব, শয়তান। সেই তোর উপযুক্ত সাজা।

বাদশাহর হুকুমে তখুনি ঘাতকের খাড়ার ঘায়ে পারসী যাদুকরের ধড় মুণ্ডু আলাদা হয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

 

এবার কামার আল আর সামস অল-এর কথা শুনুন : বোতাম টিপতেই নিমেষে ঘোড়াটা আকাশের ওপরে উঠে গেলো! কামার আল আর একটা বোতাম টিপে তীরবেগে চলে এলো পারস্যে তার নিজের শহরের উপরে। তারপর নেমে পড়লো তার প্রাসাদের ছাদে।

পুত্রকে আবার ফিরে পেয়ে বাদশাহ সব শোক তাপ ভুলে গেলেন। আবার প্রাসাদ ভরে উঠলো হাসি আর গানে। সানার শাহজাদী সামস অল নাহারকে সাদরে তিনি বরণ করে নিলেন। খানা-পিনা দান-ধানের মহোৎসব আরম্ভ হয়ে গেলো।

ভবিষ্যতে আর যাতে মনের শান্তি ব্যাহত না হতে পারে সেজন্য বাদশাহ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হুকুম দিয়ে সেই আবলুস কাঠের কালো ঘোড়াটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। তার কলকন্তুজা যন্ত্রপাতি সব দরিয়ায় জলে ফেলে দেওয়া হলো। প্রভাত আগত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো বত্রিশতম রজনীতে আবার সে শুরু করলো :

কামার আল সানার সুলতানকে একখানা খৎ লিখে পাঠালো। চিঠিতে তার দুঃসাহসিক অভিযানের সব কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলো সে। আরও লিখলো শাহজাদী সামস আল নাহারকে সে শাদী করে তার বেগম করেছে। তিনি যেন কোনও দুশ্চিন্তা না করেন। চিঠির সঙ্গে নানা মূল্যবান উপহার উপটৌকন সঙ্গে দিয়ে দূত পাঠালো সে সানায়।

সানার সুলতান কন্যার খবর পেয়ে আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। কামার আল-এর পাঠানো উপহার সামগ্ৰী গ্রহণ করে জামাতাকেও অনুরূপ উপহার পাঠিয়ে দিলেন তিনি।

কামার অল-এর মনে আশঙ্কা ছিলো, হয়তো সামস অলের বাবা তাকে ক্ষমার চোখে দেখবেন না। হয়তো তিনি তার উপহার প্রত্যাখ্যান করে ফেরৎ পাঠাবেন। কিন্তু দূত যখন ফিরে বললো, তিনি খুব খুশি হয়েছেন তখন কামার অল এবং সামস-এর মন আনন্দে নেচে উঠলো।

সেই থেকে যতদিন সানার সুলতান জীবিত ছিলেন ফি বছর নানা নতুন নতুন উপহার উপটৌকন পাঠিয়েছিলো কামার আল। তার বাবা বাদশাহ একদিন দেহ রাখলেন। কামার অল সারা পারস্য মুলুকের শাহেনশাহ হলো। সানার নতুন সুলতানের সঙ্গে ছোট বোনের শাদী দিয়ে দিয়েছিলেন কামার আল আকমর।

কামার অল-এর আসনকালে প্রজারা সুখে স্বচ্ছেন্দে দিন কাটিয়েছিলো। তার ন্যায় বিচার এবং সুশাসন প্রজাদের মনোরঞ্জন করতে পেরেছিলো। বাদশাহ কামার অলকে তারা প্ৰাণাধিক ভালোবেসেছিলো। এইভাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিপুল গৌরবে স্বদেশ রক্ষা এবং প্রজোপালন করে সময় কালে সে দেহ রক্ষা করেছিলো। তার প্রাণাধিক প্রিয় বেগম সামস আল নাহারেরও ইন্তেকাল হলে, তার মরদেহও কামার আল আকমরের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়েছিলো।

শাহেন শাহ কামার আল আকমরের গুণগাথা আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। মহৎ মানুষের কখনই বিনাশ হয় না। মরেও সে মানুষের অন্তরে অমর হয়ে থাকে।

বললো, দারুণ কিসসা শোনালে শাহরাজাদ! কালো কাঠের অদ্ভুত ঐ ঘোড়াটাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। জানতে ইচ্ছে করে, কীভাবে তৈরি করা হয়েছিলো তাকে। আজকের দিনে কী এমন কোনও কারিগর নাই, যে তৈরি করে দিতে পারে ঐ রকম একটা উড়ন্ত-যান।

শাহরাজাদ বলে, ঘোড়াটা যদি না ভেঙ্গে দিতেন বাদশাহ সাবুর তা হলে আমার মনে হয়, আজকের মানুষ ওটা দেখে আরও অনেক উড়ন্ত ঘোড়া তৈরি করতে পারতো। কিন্তু তার আর ऊाश्वो नाट्ने।

হতাশ কণ্ঠে শাহরিয়ার বলে, ঘোড়াটা যখন বাদশাহ সাবুর ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন, বড় আঘাত পেয়েছিলাম মনে। সেই থেকে বড় খারাপ লাগছে।

শাহরাজাদ বলে, আপনার খোস-মেজাজ যাতে আবার ফিরে আসে তার জন্যে এবারে একটা অন্য ধরনের মজার কিসসা শুনুন, জাঁহাপনা। এ কাহিনী শুনতে শুনতে এমনি নেশায় মশগুল হয়ে যাবেন আপনি যে, মনে আর কোনও আক্ষেপ হতাশা থাকবে না।

ডিলাইলাহ নামে এক ধূর্ত বুড়ি আর জাইনাব নামে এক মেয়েছেলের ঠগের কাহিনী। শাহরিয়ার বলে, বলো বলো, শুনি। এই সব কিসা শুনতে আমার দারুণ মজা লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *