2 of 4

৩.০২ ধীবর যুদর অথবা আশ্চর্য যাদু-থলের কাহিনী

ধীবর যুদর অথবা আশ্চর্য যাদু-থলের কাহিনী

উমর নামে এক সওদাগর ছিলো। তার তিন পুত্র। বড়টির নাম সালিম, মেজোটি সলিম আর ছোটছেলের নাম যুদর। সওদাগর তিন ছেলেকেই সমান আদর-যত্নে লালন-পালন করে বড় করলো। কিন্তু বড় দুই ভাই ঘোটর প্রতি দুর্ব্যবহার করতো নিয়ত। সওদাগর বুঝলেন, তার মৃত্যুর পরও ছোটছেলের প্রতি অসদাচরণ করবে তারা। তাই সে কাজী এবং পরিবারের সকলকে ডেকে তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করে বললো, ভাই-এ ভাই-এ সদ্ভাব নাই। সুতরাং আমার মৃত্যুর পর ছোটকে পথে বসাবে বড় দুই ভাই। সেই কারণে আজই আমি আমার বিষয় সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে দিতে চাই।

উমরের নির্দেশে তার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি সমান চার-ভাগে ভাগ করে দিলেন কাজী। এক

এক ভাগ পেলো এক এক পুত্র। বাকী একভাগ নিজের দখলে রাখলো সওদাগর। – বললো, আমার মনে হয়, এবার আর কোন ঝগড়া বিবাদ বাধবে না। আমার মৃত্যুর পর আমার ভাগের সম্পত্তির মালিক হবে আমার বিধবা বিবি। শেষ বয়সে যাতে ছেলেদের হাত-তোলা হয়ে না থাকতে হয় তাকে, সেই কারণেই এই ব্যবস্থা করে গেলাম।

আত্মীয়-পরিজন সকলেই সাধুবাদ জানিয়ে বললো, খুব পাকা কাজ করে গেলো সওদাগর। এতে সকলেই সুখে শান্তিতে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। সওদাগরের মৃত্যুর পর নানা ছলছুতো করে বড় দুই ভাই যুদরের বিষয়-সম্পত্তি বে-দখল করে নিলো।

যুদর পাড়া-প্রতিবেশিদের স্মরণাপন্ন হলো। তারা এসে মিটমাট করার অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। সালিশের কোনও কথাই বড় দু’ভাই গ্রাহ্য করলো না। তারা বললো, ঘোটর জন্যই আমাদের এই দুর্দশা। এতো বড় সম্পত্তি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। দোকানপাট বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন আমরা খাবো কী? সুতরাং ঐ সম্পত্তিরও ভাগ চাই আমরা।

প্রতিবেশিরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো, দেখ, এসব ফালতু যুক্তি আইনের ধোপ টিকবে না। তোমার বাবা বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। কানুনমাফিক তিনি কাজী এবং সাক্ষী-সাবুদ ডেকে সম্পত্তি ন্যায্যমতো ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন। আদালতে সেই দলিলই গ্রাহ্য হবে। এখন তোমরা বড় হয়েছে, বাপের বাক্য যদি অমান্য করতে চাও, আমাদের কিছু বলার নাই। তবে এটাও ঠিক, আমাদের পাঁচজনের কথা অগ্রাহ্য করে কোট-কাছারী করলে, ফয়দা হবে না কারো।

এতেও বড় দুই ভাই-এর বোধোদয় হলো না। বাধ্য হয়েই যুদরকে আদালতে যেতে হলো। বিষয়-সম্পত্তির মামলা বড় জটিল ব্যাপার। অতি সহজে এর নিষ্পত্তি হতে পারে না। আর মামলা একবার রুজু করলে পিছনে হটাও সম্ভব না। আদালতে দাঁড়ানো মানেই উকিল মোক্তারকে জেবে পয়সা গুঁজে দেওয়া। এইভাবে কলসীর জল গড়াতে গড়াতে একদিন তা শেষ হতে বাধ্য। এছাড়া মামলা-মোকদ্দমার নেশা মদের নেশার চেয়েও মারাত্মক। মামলায় জেতার জেল মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেয়।

উমর-সন্তানদেরও তাই হলো। মামলার খরচ জোগাতে জোগাতে এক এক করে সব বিষয়-সম্পত্তিই নিঃশেষ হয়ে গেলো সকলের। শেষ পর্যন্ত কেউই আর টিকে থাকতে পারলো না। মামলাটা খারিজ হয়ে গেলো।

এই সময়ে ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো ছেষট্টিতম রজনীতে আবার সে শুরু করে?

তিন ভাই-এর এমন দুর্দশা-দিনান্তে একখানা রুটি আর একটুকরো পেঁয়াজ জোগাড় করতে পারে না তারা। বড় দুই ভাই এবার মা-এর বিষয়টুকু কেড়ে-কুড়ে নিয়ে উধাও হলো। মা বেচারী কাঁদতে কাঁদতে ছোটছেলে যুদরের কাছে এসে সাহায্য চায়। বড় দুই ছেলের নামে বার বার অভিসম্পাত দিতে থাকে।

যুদর বলে, অমন করে ওদের শাপ-শাপান্ত করো না, মা। হাজার হলেও ওরা তো তোমার পেটের সন্তান। উপরে আল্লাহ আছেন, তিনিই বিচার বিহিত করবেন। ও নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। তোমার এই ছোটছেলে যুদর তো এখনও জিন্দা আছে মা। আমি যদি এক বেলা খেতে পাই, তুমিও পাবে! আর-খঞ্জ অথর্ব তো নই। গায়ে তাগদ আছে, জোয়ান মরদ ছেলে, দুনিয়ার হাজারো মানুষ খেটে খাচ্ছে, আর আমি পারবো না? তবে এও ঠিক, মায়ের সম্পত্তি ছেনতাই করে ওরা পেট ভরাবে, তাও আমি সইবো না। লাঠালাঠি আমি পছন্দ করি না, কিন্তু তা বলে, অন্যায়, অধর্মও আমি বরদাস্ত করবো না। যা হয় হবে, আজই আমি আবার মামলা ঠুকে দেবো ওদের নামে।

মা বাধা দিয়ে বললো, অমন কথাটি মুখে আনিসনি, বাবা। একবার মামলা করে তো দেখলি, কী হলো। নিজেরা পথের ভিখিরি হয়ে উকিল মোক্তারদের পেট মোটা করালি। যা গেছে তা যাক, আর কখনও আদালতের ত্রি-সীমানা মাড়াস না—এই আমার উপদেশ বাবা। ওতে আখেরে কারো লাভ হয় না। ওপরে তিনি আছেন, শেষ-বিচারের দিন কেউ কিছু গোপন করতে পারবে না। কড়ায়-গণ্ডায় সব হিসেব নিকেষ নেবেন তিনি। তিনিই বিচার করবেন—সাজা দেবেন।

যুদর একখানা মাছধরা জাল কিনে আনলো। নীল নদের জলে মাছ ধরে বাজারে বেচতে লাগলো। প্রতিদিন সে বুলক পুলের ওপরে দাঁড়িয়ে নদীর জলে জাল ফেলে। কোনও দিন, নসীবে থাকলে, মোটামুটি কিছু মেলে, আবার কোনও দিন হয়তো বা শুধু চুনো পুঁটি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যুদর-এর মনে কোনও ক্ষোভ নাই। একদিন সে শহরের এক বিত্তবান পরিবারের সন্তান ছিলো, সে কথা ভেবে আজ সে বৃথা অনুতাপ করে না। কী ছিলো, কী রাখতে পারলে কী হতে পারতো, সেই-সব অলীক চিন্তায় সে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চায় না। অবস্থা এবং সময়ের ফেরে আজ সে যেখানে দাঁড়িয়েছে তাকেই সে হাসিমুখে আলিঙ্গন করে নিয়েছে।

প্রত্যেক দিনই হয়তো সমান রোজগার হয় না—তবে কেনও দিন দশ, কোনও দিন কুড়ি, আবার কোনও দিন ত্রিশ-চল্লিশটা তামার পয়সা সে ঘরে আনতে পারে। দুধে-ভাতে না হলেও, মোটামুটি খেয়ে পরে তাদের দু’জনের দিন চলে যায়।

মা-এর সর্বস্ব অপহরণ করেও তার দু-ভাই বেশি দিন রাখতে পারে না। কিছুদিনের মধ্যে সব উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আবার তারা দীন-ভিখারি হয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকে।

মায়ের প্রাণ মোমের পাথরে গড়া। স্নেহের উত্তাপে গলেগলে সারা হতে কতক্ষণ! অভুক্ত উপবাসী, রিক্ত-বস্ত্র, নগ্নপ্রায় সন্তানকে দেখে কোন্ মা-ই বা পাষাণ হয়ে থাকতে পারে? যুদরের অলক্ষ্যে সে খিড়কীর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্য পাটে বসে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। অশরীরী প্রেতাত্মার মতো সালিম সলিম দুই ভাই মাটির সরা হাতে করে এসে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আঁচলে চোখের জল মুছে মা কিছু রুটি আর মচ্ছী ঢেলে দিয়ে বলে, যা যা, এখানে আর দাঁড়াস নে, পালা। ছোট এসে দেখলে আমাকে বকাবকি করবে।

এইভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় দুই ভাই চুপিসারে খিড়কির দরজায় এসে মায়ের দেওয়া রুটি-তরকারী নিয়ে চলে যায়। একদিন কিন্তু যুদর দেখে ফেলে। সাধারণত: এই সময় সে বাড়ি ফেরে না। কিন্তু সেদিন কী একটা কারণে সে বাড়ি ফিরে এসে দেখে তার মা দুই ভাই কে খেতে দিচ্ছে। ছোট ছেলে দেখে ফেলেছে জানতে পেরে মা ভয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে থাকে। যুদর কিন্তু হাসিমুখে মা আর ভাইদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

-কী ব্যাপার বড় ভাই, তোমরা এই অন্ধকারে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? এসো, ভেতরে এসো। কতকাল তোমাদের দেখিনি। এইভাবে ছোট ভাইকে ভুলে থাকতে আছে? আমি অনেক খোঁজ করেছি তোমাদের। কিন্তু কোনও হদিস করতে পারিনি। কেমন আছ, কোথায় থাক কিছুই জানি না।

সালিম সলিম বলে, কী করে আর তোমার সামনে এসে দাঁড়াই, বলো? যে অন্যায় করেছি আমরা, তা কী অত সহজেই তুমি ভুলতে পারো? কী বলবো ভাই, সবই শয়তানের কারসাজি। তা না হলে, তোমার মতো ভাই-এর সঙ্গে আমরা ঝগড়া-বিবাদ করি? আজ আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি—কী দুর্ব্যবহারই না করেছি তোমার সঙ্গে। এখন এতো বড় দুনিয়াতে তুমি আর মা ছাড়া আমাদের আপনজন বলতে কেউ নাই, যুদর।

মা বলে, একমাত্র খোদা-তালার ওপর ভরসা রাখ, বাবা। তিনিই সব বিপদ কাটিয়ে দেবেন। আবার সুদিন ফিরে আসবে।

যুদর বললো, পথে পথে কোথায় ঘুরবে, আমার কাছেই থাক তোমরা। আমাদের যদি কিছু জোটে, তোমাদেরও জুটবে।

এইভাবে সেদিন সন্ধ্যায় ভাই-এ ভাই-এ আবার মিলন ঘটলো।

পরদিন সকালে উঠে তিন ভাই একসঙ্গে বসে নাস্তা-পানি করলো। তারপর যুদর জাল কাঁধে করে নীলের দিকে রওনা হলো আর সালিম সলিম বেড়াতে বেরুলো। দুপুরবেলায় ফিরে এসে তারা দু’জনে মা-এর সঙ্গে বসে আহারাদি সেরে আবার বেরিয়ে গেলো। সন্ধ্যায় ফিরে এলো যুদর। সারাদিন মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সজী মাংস সওদা করে ঘরে এলো সে।

এইভাবে একটা মাস কেটে যায়। যুদর সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে পয়সা রোজগার করে নিয়ে আসে। আর দুই ভাই খায় দায়, আর গুলতানি করে ঘুরে বেড়ায়।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো সাতষট্টিতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

একদিন নদীতে জাল ফেলে ফেলে সারাদিনে একটি পুঁটি মাছও তুলতে পারলো না। পরদিনও সেই একই ব্যাপার ঘটলো। এই কারণে তার পরদিন সে জায়গা বদল করে নদীর অন্যত্র জাল ফেলতে লাগলো। কিন্তু এমনই বরাত সারাদিন ধরে চেষ্টা করেও একটা ছোটখাটো মাছও সে তুলতে পারলো না। পরদিন সে আবার স্থান পরিবর্তন করে। কিন্তু নসীব যখন সাধ দেয় না তখন কিছুতেই কিছু হয় না। এক এক করে অনেকগুলো জায়গায় জাল ফেলেও সে কিছু সংগ্রহ করতে পারলো না।

তবেকী পানিতে আর মাছ নাই? যুদর শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তা হলে কী উপায় হবে? ঘরে যা জমানো ছিলো সব শেষ হয়ে গেছে। আজ কিছু না নিয়ে যেতে পারলে উপোস দিতে হবে! সে নিজে না হয় দু-একটা দিন না খেয়ে কাটাতে পারবে। যুদর ভাবে, কিন্তু তার মাতার দুই ভাই? তাদের অভুক্ত রাখবে কী করে?

চলতে চলতে এক সময় সে রুটির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রতিদিন সে ফেরার পথে এই দোকান থেকে রুটি কিনে বাড়ি ফেরে। কিন্তু আজ তার কাছে একটা পয়সা নাই। কী করে কিনবে রুটি!

যুদর দোকানের এক পুরানো খদ্দের। প্রত্যেক দিন সে জাল কাঁধে করে সোজা দোকানে ঢুকে রুটি কেনে। কিন্তু আজ, দোকানী ভাবে, সে ঐ ভাবে সতৃষ্ণ-নয়নে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে কেন?

—যুদর ভাই, কী হলো? আজ বাইরে দাঁড়িয়ে যে? রুটি নেবে না?

যুদর কোন জবাব দিতে পারে না। দোকানী বলে, বুঝেছি, আজ জালে কিছু ধরা পড়েনি, এই তো? তা, এতো সঙ্কোচ কেন, ভাই। এসো, ভেতরে এসো, যা দরকার নিয়ে যাও। কাল মাছ উঠলে দাম দিয়ে যেও।

যুদর বলে, আমাকে দশ পয়সার রুটি দিন। কাল জালে মাছ উঠলে দাম দেবো।

– আরে, তার জন্য অত ভাবছো, কেন? কাল না হয়, পরশু দেবে। না হয় আরও দুদিন পরে দেবে। মাছ তো একদিন উঠবেই।

দোকানী ওকে রুটি এনে দেয়। যুদর কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।—আপনি বরং আমার এই জালখানা বাঁধা রাখুন–

–পাগল ছেলের কথা শোনো, জালখানা এখানে রেখে দিলে তুমি মাছ ধরবে কী দিয়ে? যাও, বাড়ি যাও, খেয়ে দেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাও গে। কাল সকালে তো আবার বেরুতে হবে।

যুদর স্বস্তি পায়। সে রাতটাও কোনোরকমে কেটে যায়। কিন্তু পরদিনও সে। একটা মাছ তুলতে পারে না। সেদিনও রুটিওলা ওকে ধারে রুটি দেয়। বলে, যুদর ভাই আমার, কোনও শরম করো না। যা দরকার আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও। জানি, মানুষের সব দিন সমান যায় না। তা বলে মুষড়ে পড়লে তো চলবে না। বরং মনে আরও সাহস সঞ্চয় করতে হবে। খারাপ সময়ের মোকাবিলা করাই আদর্শ কর্ম।

যুদর বলে, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবেন। দেখি, কাল আবার জায়গা বদল করে জাল ফেলবো।

কিন্তু তার পরদিনও যুদর কোনও মাছ ধরতে পারে না। সেদিনও সে রুটিওলার কাছ থেকে কিছু রুটি এবং দশটা নগদ পয়সা ধার করে নিয়ে যায়। ভাবে, পরদিন নিশ্চয়ই সে মোটা মাছ পাবে। তা হলে প্রথমে সে দোকানীর ধার মিটিয়ে দেবে। মানুষটা বড় ভালো। তার সহৃদয়তা কখনও সে ভুলতে পারবে না! কিন্তু হায় রে পোড়া কপাল, সারাদিন চষে বেড়িয়েও সে দশ পয়সার মাছ ধরতে পারলো না। সে দিন সে আর দোকানের সামনে না দাঁড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে। দোকানী ছুটে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়।

-এই তোমার ব্যবহার? পয়সা দেওয়ার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছো?

যুদর কী বলবে, ভেবে পায় না।

—উ হুঁ, একটিও কথা নয় যুদর, এই ধর, রুটি নাও। আর এই নাও দশটা পয়সা। শুধু রুটি তো খাওয়া যাবে না: কিছু সজী কিনে নিয়ে যাও। খেয়ে দেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাও গো শরীরটাকে তো ঠিক রাখতে হবে। তার পর কালকের ব্যাপার কাল দেখা যাবে। আমার যতটা সাধ্য আছে আমি তোমাকে দিয়ে যাবো। তোমার যখন সুবিধে হবে আমাকে ফেরত দিও। কোনও লজ্জা করো না, বুঝলে?

পরদিনও সে শুন্য হাতে ফিরে এসে দোকানীর কাছ থেকে রুটি আর পয়সা কর্জ করে বাড়ি আসে। এইভাবে আরও সাতটা দিন সে দেনা করেই কাটায়। রোজইজাল নিয়ে নদীতে যায়, কিন্তু একটা খলসে দাও জালে ওঠে না। ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিড়তে থাকে সে। এভাবে কতদিন চালাবে সে? না না না-মাছ তাকে ধরতেই হবে। এই নীল নদ তাকে আর কিছু দেবে না। সে একেবারে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তা নিক, তা বলে সে তো আর হাল ছেড়ে বসে থাকতে পারে না। নীল যদি নির্দয়ভাবে তাকে ফেরায়ও তবে সে অন্য কোথাও বা অন্য কোনওখানে গিয়ে জাল ফেলবে, মাছ তাকে তুলতেই হবে।

পরদিন সকালে সে জাল নিয়ে কারুণ হ্রদে যায়। এই হ্রদটা কাইরো থেকে বেশি দূরে নয়। সবে জলে জাল ফেলতে যাবে, এখন সময় সে দেখতে পেলো, এক মুর একটি সুসজ্জিত খচ্চরে চেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। নিজেও সেজেছে মূল্যবান সাজ-পোশাকে। মুর তাকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়, কী গো উমরের পো যুদর, কেমন আছ?

—এই—কেটে যাচ্ছে, হাজী সাহেব?

হাজী সাহেব আরও কাছে এসে বলে, তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম উমরের’ পো। তোমার সঙ্গে আমার একটা দরকার আছে, বাবা! যুদর বলে, কী দরকার বলুন, চাচা। আমি তো আপনারই বান্দা। আমাকে দিয়ে যদি আপনার কোনও কাজ হয়, এখুনি করে দেবো।

হাজী সাহেব প্রথমে কোরাণ শরীফের কয়েকটা বয়েৎ আবৃত্তি করলো। তারপর জীনের হাওদায় ঝুলানো একটা থলে থেকে একগাছি রেশমী সুতা বের করে বললো, শোনও উমরের পো যুদর, এই রেশমী রশিটা দিয়ে তুমি আমার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধো। তারপর ঐ সাগরের পানিতে আমাকে ফেলে দাও। যদি প্রথমে আমার হাত ভেসে ওঠে, আমাকে। তুমি জাল ফেলে ওপরে তুলে আনবে। আর যদি দেখ, আমার পা দু’খানা জলের ওপরে ভেসে উঠেছে বুঝবে, আমি মারা গেছি। তখন তুমি আমার এই থলেটা আর খচ্চরটা নিয়ে বাজারে যাবে। সেখানে ইহুদী সামাইয়াহর কাছে খচ্চরটাকে একশো দিনারে বেচে দেবে। খুব গোপন রাখবে এসব কথা। কাউকে বলবে না কিন্তু।

এই সময় ভোর হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো আটষট্টিতম রজনী।

আবার সে গল্প শুরু করে।

মুরের সেই কথামতো যুদর সুতোটা দিয়ে তাকে পিছমোড়া দিয়ে হাত দু’খানাকে শক্ত করে বাঁধে। তারপর কাঁধে তুলে হ্রদের জলে ফেলে দেয় তাকে।

কিছুক্ষণ পরে দুখানা পা ভেসে ওঠে জলের ওপর। যুদর বুঝলো হাজী সাহেবের ইন্তেকাল হয়ে গেছে। যুদর আর অপেক্ষা না করে খচ্চরের পিঠে চেপে বসে।

বাজারে ঢুকে সেই ইহুদী সামাইয়াহকে খুঁজে বের করে সে। লোকটা জুলজুল করে খচ্চরটার দিকে তাকায়।

—হুম, তা হলে খতমই হয়ে গেলোলোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ইহুদী সহওদাগর যুদরকে খচ্চরের মূল্য বাবদ একশো দিনার দিয়ে বললো, ব্যাপারটা গোপন রেখ, কাউকে বলো না যেন।

যুদর সব আগে রুটিওলার কাছে ছুটে আসে। একটা গোটা দিনার তার হাতে দিয়ে বলে, এই নিন আপনার ধারটা কেটে নিন। আর যা থাকে আমাকে রুটি দিন।

দোকানী হিসেবপত্র করে বললো, আরও দুদিন রুটি দিলে তবে দিনারটা পুরো হবে।

এরপর যুদর কসাই ও সজীওলার কাছে গিয়ে তাদের দেনা পরিশোধ করে মাংস আর কাচা তরকারী সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই যুদরের কানে এলো তার দুই ভাই খাবারের জন্যে মাকে নানারকম কটু কথা শোনাচ্ছে। ছোট ভাই-এর হাতে খাবার-দাবার দেখে তারা প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিলো রুটির ঠোঙাটা।

পরদিন আবার জাল কাঁধে করে যুদর কারুণ হ্রদে যায়। জলে জাল ফেলতে যাবে, এমন সময় আর এক মুর একটা খচ্চরে চেপে তার সামনে এসে হাজির হয়।

—হ্যাঁ গো, উমরের পো যুদর, গতকাল কী এই সময় এখানে আমার মতো আর একজন মুর এসেছিলো? জান কিছু তুমি?

যুদর ভাবলো, লোকটা তার কাছ থেকে ধোঁকা দিয়ে কথা বের করে নিতে চায়। কিন্তু মুর সাহেব তাকে বারণ করে গেছে—কাউকে কিছু বলবে না।

—জী না, কই কেউ আসেনি তো

–কেন মিথ্যে বলছো, উমরের পো যুদর। আমি জানি, সে কাল এখানে এসেছিলো। সে তো আমার বড় ভাই। তার কথা মতো তুমি তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে এই দরিয়ায় ফেলে দিলে। তারপর পা দু’টো ভেসে উঠলে তার কথামতো খচ্চরটাকে বাজারের ইহুদী সওদাগর সামাইয়াহর কাছে একশো দিনারে বেচে দিয়ে চলে গেছ তুমি। আমার কাছে লুকাচ্ছো কেন? আমি সবই জানি।

—তা এতোই যদি জানেন, আমাকে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?

মুরটা বলে, না, মানে—আমি তোমার কাছ থেকে এই কাজটুকুই চাই। আমার বড় ভাই-এর মতো আমাকেও বেঁধে তুমি পানিতে ফেলে দাও। যদি আমার পা ভেসে ওঠে,, আমার খচ্চরটা নিয়ে গিয়ে ইহুদীটার কাছে একশো দিনারে বেচে তুমি বকশিশ নিও।

যুদর মুর-এর হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বেঁধে হ্রদের জলে ফেলে দিয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকলো। একটুক্ষণের মধ্যেই দু’খানা পা উঠলো জলের ওপর।

–ইয়া আল্লাহ, লোকটা খতম হয়ে গেলো। বা, বেশ মজা তো? নিত্যি যদি এমনি একটা মক্কেল জোটে মন্দ হয় না।

ইহুদী সওদাগরটা আবার যুদরকে খচ্চরে চেপে আসতে দেখে আফসোস করে ওঠে, আর একটাও গেলো! লোভ যে মানুষকে কোথায় টেনে নিয়ে যায়—

কথা আর শেষ করে না, ঝকঝকে একশোটা স্বর্ণমুদ্রা গুণে যুদরের হাতে দেয় সে।

যুদর পুরো টাকাটা এনে মা-এর হাতে তুলে দেয়। মা বুঝতে পারে না, এতো সোনা তার ধীবর ছেলে পেলো কোথায়? ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞেস করে, হারে খোকা, এসব পেলি কোথায়? আমার ডর লাগছে, বাবা।

যুদর বলে, ভয়ের কোনও ব্যাপার নাই, মা। তোমার ছেলে যুদর কাউকে ঠকিয়ে একটা পয়সা ঘরে আনবে না।

এরপর সব ব্যাপারটা খুলে বললো সে মা-এর কাছে। মা শঙ্কিত হয়ে বলে, কী জানি, আমার বুক কাঁপছে, বাবা। কাল থেকে আর ঐ কারুণ সায়রে তোমার যাওয়ার দরকার নাই। এই মুর জাতটাকে আমার বড় ভয়।

—কিন্তু মা, যুদর বলে, ওদের কথামতোই আমি ওদের জলে ফেলে দিয়েছি। আমার দোষটা কোথায়? এমন একটা লাভের কারবার কেউ সাধ করে বন্ধ করে? ফি দিনে যেখানে নগদ একশোটা সোনার মোহর রোজগার হচ্ছে, সেই কাজ তুমি আমাকে বন্ধ করতে বলছো, মা? যাই-ই বল, আমি কিন্তু রোজই কারুণ সায়রে যাবো। এমন আশা কেউ ছাড়তে পারে?

পরদিন যথাসময়ে কারুণের তীরে গিয়ে বসে। সেদিনও আর এক মুর এসে হাজির হয়। দারুণ জমকালো তার সাজ-পোশাক, বাহারী জীন লাগামে সাজিয়েছে খচ্চরটাকে। যুদর অবাক হয়ে দেখলো, জীনের দুপাশে দু’টো কাচের কলসী ঝুলছে। লোকটা কাছে এসে সেই একই ভাবে শুভেচ্ছা জানায়।

-হ্যাঁ গো উমরের পো যুদর, কেমন আছো?

-এই, কেটে যাচ্ছে, আর কী।

যুদর অবাক হয়, এই লোকগুলো সকলেই তার নাম ধাম জানলে কী করে।

এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো ঊনসত্তরতম রজনী।

আবার সে বলতে থাকে।

–এর আগে আর কোনও মুর এসেছিলো এখানে? আগন্তুক প্রশ্ন করে।

যুদর বলে, দু’জন।

-কোথায় গেলো তারা?

যুদর বলে, আমি তাদের বেঁধে এই সায়রের জলে ফেলে দিয়েছি। তারা দুজনেই অক্কা পেয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আপনিও এক পথের পথিক। তাহলে আর দেরি কেন, আসুন।

বৃদ্ধ মুর হাসে, অবোধ বেচারা, তুমি কি জানো না, প্রত্যেক মানুষেরই ভাগ্যলিপি আগে থেকে লেখা থাকে তার কপালে?

এই বলে সে খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে একগাছি রেশমী সূতো তুলে দেয় যুদরের হাতে। বলে, চটপট কাজ হাসিল কর, আমার আর তর সইছে না।

যুদর বলে, আপনি কিছু ভাববেন না, হাত আমার রপ্ত হয়ে গেছে। এক্ষুণি আপনাকে আচ্ছা করে কষে বেঁধে ডুবিয়ে দিচ্ছি—যাতে আর আপনি জিন্দা ভেসে উঠতে না পারেন।

মুর বলে, সাবাস, এই না হলে তুমি উমরের সন্তান যুদর।

যুদর ওকে খুব মজবুত করে বেঁধে সায়রের জলে ফেলে দেয়। অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, কখন পা দু’খানা ভেসে উঠবে। কিন্তু কি আশ্চর্য, পা-এর বদলে ভেসে উঠলো দু’খানা হাত। লোকটা খাবি খেতে খেতে চিৎকার করতে থাকলো, জলদি জাল ফেলে আমাকে টেনে তোলো। না হলে আমি সাঁতার জানি না, মরে যাবো।

যুদর ক্ষিপ্রহাতে জালখানা বৃত্তাকারে ছড়িয়ে তার মাথার ওপরে ফেললো। কিছুক্ষণের মধ্যে টেনে তুললো তাকে সাগরের তীরে এবং অবাক হয়ে সে দেখলো, লোকটার দু’হাতে দু’টো প্রবাল বর্ণের রঙিন মাছ। বৃদ্ধ মাছ দু’টো শক্ত মুঠিতে ধরে উঠে দাঁড়ালো। খচ্চরের জিনে ঝোলানো সেই কাঁচের কলসী দু’টোতে মাছ দুটো পুরে যুদরকে সে জড়িয়ে ধরে এন্তার চুমু খেয়ে আদর করতে থাকলো।

—আজ তোমার জন্যেই আমি জানে বেঁচেছি। তুমি সাহায্য না করলে এ মাছ আমি কিছুতেই ধরতে পারতাম না, যুদর।

যুদর বললো, সত্যিই যদি আমি আপনার কোনও কাজে লেগেছি মনে করেন তবে মেহেরবানী করে এই হেঁয়ালীটা আমাকে একটু খুলে বলুন। সে-ই আমার ইনাম পাওয়া হবে।

বৃদ্ধ বলতে থাকে : তোমার ধারণা ঠিকই। গত দুদিন যে দু’জন এই সায়রে প্রাণ হারিয়েছে, ওরা দু’জনই আমার বড় ভাই। প্রথম জনের নাম আবদ অল সামাদ। আর ঐ বাজারের যে ইহুদী সওদাগর সেজে তোমার কাছ থেকে একশো দিনার দিয়ে খচ্চরটা কিনেছে—ও আমার চতুর্থ ভাই, সাচ্চা মুসলমান। ওর আসল নাম আবদ্ অল রহিম। আমাদের বাবা, আবদ অল ওয়াদুদ, একজন ক্ষমতাবান যাদুকর ছিলেন। নানা শাস্ত্রে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিলো তার। তিনিই আমাদের চার ভাইকে যাদুবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। এছাড়াও আমরা তার কাছ থেকে অনেক মন্তরতন্তর এবং গুপ্তধন আবিষ্কারের সূত্র পাঠ করতে শিখেছিলাম। এই সব অলৌকিক বিদ্যা এমনভাবেই আমরা রপ্ত করতে পেরেছিলাম যে, জিন মারিদ এবং আফ্রিদিরাও আমাদের ইশারায় উঠ বোস করে।

পরিণত বয়সে বাবা একদিন দেহ রাখলেন। তিনি যে বিশাল বিষয় সম্পত্তি এবং অমূল্য ধনরত্ন রেখে গিয়েছিলেন তা এক কথায় অপরিমেয়। আমরা বলতে পারবো না—টাকার অঙ্কে তা কত হতে পারে। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, বাবার একখানা হাতে লেখা কিতাব ছিলো। সেই ভীষণ ভারি কিতাবকানা একদিকে আর অন্যদিকে সমান ওজনের হীরে চাপালে সেই হীরের যা দাম হবে তাতে ঐ কিতাবের দামের হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র হতে পারে। তবেই বোঝ, ব্যাপারখানা কী।

এ হেন সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কলহ-কাজিয়া বাধাই স্বাভাবিক। আমরা চার ভাই তার রেখে যাওয়া ধন-রত্নাদি, আপোষে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করে নিতে পারলাম। কিন্তু মুশকিল হলো বাবার মহামূল্য কিতাবগুলোর স্বত্ব নিয়ে। কে কোন্‌খানা নেবে, সেই নিয়ে ঝগড়া বিবাদ বাধলো। আগেই বলেছি, বাবার সবচেয়ে মূল্যবান কিতাবখানা—‘এ’ নিয়ে বিবাদ চরমে উঠলো। কেউ ছাড়তে চায় না কারো অধিকার।

এমন সময় একদিন আমাদের বাড়ীতে এলেন এক সদাশয় বৃদ্ধ। এঁর কাছ থেকে বাবা সবকিছু শিক্ষা লাভ করেছিলেন। সেই পীরসদৃশ বৃদ্ধের নাম অল-কাহিন অল-অবতান। তিনি সেই মহামূল্য কিতাব ‘এ’ হাতে নিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য করে বাণী দিলেন : বৎস, তোমরা। আমার প্রাণাধিক পুত্রসম শিষ্যের আদরের দুলাল। বিশেষ কারো প্রতি পক্ষপাত দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি ফরমান দিচ্ছি—যে অল শমরদলের গুপ্তধন আবিষ্কার করে তার সেই অলৌকিক গোলক, কাজললতা, তলোয়ার এবং সেই মোহর আঁকা আংটিটা নিয়ে আসতে পারবে সে-ই এই কিতাবের মালিক হওয়ার যোগ্য হতে পারবে। এই সব জিনিসগুলোর অলৌকিক যাদু ক্ষমতা আছে। সেই আংটিটা রক্ষা করছে আর এক জিন। তার নাম বজ্ৰদানব। এই আংটি যদি কেউ ধারণ করতে পারে তবে সে সলতানিয়তের সুলতান হয়েও দণ্ডমুণ্ডে বিধাতার ক্ষমতা অর্জন করবে। সুলতানের সব ক্ষমতাই সে করায়ত্ত করতে পারবে। তার হুকুম তামাম দুনিয়া তামিল করবে। আর ঐ তলোয়ার যার হাতে থাকে সে আর কাকে ডরায়? এক বিশাল সৈন্যবাহিনীকে ঐ একখানা তলোয়ারে সে কেটে কুচি কুচি করে দিতে পারবে। আর ঐ গোলকটা থাকবে যার দখলে সে ঘরে বসে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসতে পারবে এক মুহূর্তে। যে দেশের যে জায়গা দেখার ইচ্ছা হবে গোলকের সেই বিন্দুতে আঙ্গুল রাখার সঙ্গে সঙ্গে গোলকটা বনবন করে ঘুরতে থাকবে এবং তখুনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই দেশের গ্রামগঞ্জ পথঘাট নদী-নালা পশুপক্ষী মানুষ জন, সব। যদি এই গোলকাধিপতি পৃথিবীর কোন দেশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে বুঝতে পারেন, কোথাও ঘোর অন্যায় অবিচার এবং পাপে পূর্ণ হয়ে গেছে তখন তিনি সূর্যের রশ্মি আকর্ষণ করে সেই দেশকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারেন। আর ঐ কাজললতার কাজল যদি কেউ চোখে লাগান তবে পৃথিবীর তাবৎ লুকানো গুপ্ত ধনাগার তার সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠবে। এই কিতাব ‘এ’ যদি পেতে চাও তোমরা, তবে এই পরম আশ্চর্য ঐশ্বর্য ভাণ্ডার আবিষ্কার করে এই জিনিসগুলো বের করে আনতে হবে। এখন দেখ চেষ্টা করে—কে আনতে পারো।

তখন আমরা চার ভাই-ই সমস্বরে বললাম, আমরা আপনার শর্তে রাজি আছি, পীর সাহেব। কিন্তু আমরা তো কেউই শমরদলের সেই অতুল ঐশ্বর্য ভাণ্ডার সম্বন্ধে কিছুই জানি না।

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো সত্তরতম রজনী। আবার কাহিনী শুরু হয়?

তখন সেই জ্ঞান-বৃদ্ধ পীর কাহিনী বললেন :

সুলতান লাল শাহর দুই পুত্রের অধিকারে আছে এই শমরদল। তাদের দু’জনকে পরাজিত করতে পারলে সেই ঐশ্বর্য ভাণ্ডার অধিকার করা সম্ভব নয়। তোমাদের পিতা অনেক চেষ্টা করেছিলো সুলতানের পুত্র দুটিকে কজায় আনার। শঙ্কিত হয়ে কিন্তু পূর্বাহ্নেই সংবাদ পেয়ে ও আত্মরক্ষার জন্য তারা কারুণ সায়রে ঝাঁপ দিয়ে প্রবাল মাছের রূপ ধরে আত্মগোপন করে রইলো। তোমার পিতা আর ঝামেলার মধ্যে যেতে চাইলো না। তখন আমি গুণে পড়ে দেখলাম, এই অবস্থায় শমরদলের ঐশ্বর্য ভাণ্ডার তখন আর আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না তার পক্ষে। বেশ কিছুকাল পরে কাইরোর যুদর নামে এক যুবকের সাহায্যেই শুধু এই সম্পদ উদ্ধার হতে পারবে। এই যুদর সওদাগর উমরের পুত্র। জাত-ব্যবসা তার মাছ ধরা নয়, কিন্তু ঘটনাচক্রে তাকে এই ব্যবসায়ই গ্রহণ করতে হবে এবং নিরুপায় হয়ে একদিন তাকে আসতেও হবে এই কারুণের উপকূলে। কবে সে আসবে তার প্রতীক্ষায় দিন গুণতে হবে। তার আগমনেই শুধু ঐ সায়রের মধ্যে নিক্ষেপ করাতে হবে নিজের দেহটাকে। পানির তলায় যাওয়া মাত্র তার বন্ধন মুক্ত হবে। সে তখন সন্ধান করে বেড়াবে শুধুমাত্র দুটি প্রবাল মাছ—সেই সুলতানের দুই পুত্রকে। যদি তার বরাত ভালো হয়, যদি সে ধরতে পারে তাদের, তবেই তার হাত দু’খানা ভেসে উঠবে উপরে। তখন ঐ উমর-সন্তান যুদর জাল ফেলে তাকে কুলে তুলে আনবে। আর যে তা পারবে না, অর্থাৎ সেই প্রবাল মাছ দু’টো ধরতে পারবে না, তার আর বাঁচবার কোন আশা থাকবে না। কারুণের পাণিতে তার সলিল সমাধি ঘটবে। মরার পর তার পা দু’খানা ভেসে উঠবে শুধু।

আমরা বড় তিনজন বললাম, ঠিক আছে মরতেও আমরা রাজি আছি। আমরা যাবো সেই কারুণ সায়রে। দেখবো, সেই প্রবাল মৎস্যরূপী শাহজাহাদের পারি কিনা ধরতে? যায় যাবে প্রাণ, যাক। মরতে তো একদিন হবেই।

কিন্তু আমাদের ছোটভাই, আবদ অল রহিম এই দুঃসাহসিক অভিযানে যেতে রাজি হলো এবং শুধু এই কারণেই আমরা তাকে ইহুদী সওদাগর বলে ক্ষ্যাপাতে লাগলাম। সেই থেকে লোকে জানে, সে ইহুদী সওদাগর। কিন্তু আসলে তার মতো সাচ্চা মুসলমান পাওয়া ভার।

আমাদের ওয়াদা ছিলো, যদি কেউ কারুণের পানিতে প্রাণ হারায় তবে তার খচ্চর আর থলেটা যুদর নিয়ে যাবে ছোট ভাই-এর কাছে। সে তাকে প্রতিবারে একশো দিনার ইনাম দিয়ে খচ্চর আর থলেটা কিনে নেবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবে, তার কোন্ কোন্ ভাই-এর ইন্তেকাল হলো।

তুমি তো জানো যুদর, এর আগে আমার দুই ভাই-এর বরাতে কী জুটেছে। এই মাছ দু’টো ধরতে গিয়ে তারা জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছে এখানে। একমাত্র আমিই আজ তোমার সহায়তায় এই শাহজাদাদের কজাগত করতে পেরেছি। আমিও এদের সঙ্গে লড়াই-এ প্রায় কাবু হয়ে পড়েছিলাম। নেহাত বরাত ভালো, তাই ওদের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলতে পেরেছি। এই দুই শাহজাদা অনন্ত শক্তির অধিকারী দুই আফ্রিদি দৈত্য। আজ তাদের আমি এই কাচের কলসীতে পুরে ফেলেছি। আজ এদের ধরার ফলে সেই শমরদলের ঐশ্বর্য ভাণ্ডার আবিষ্কারের প্রথম পর্বটি আমার সমাধা হলো মাত্র। সেই পীর কাহিনের ঠিকুজীর নির্দেশ অনুসারে তোমার উপস্থিতি একান্তভাবে দরকার। তুমি কী আমার সঙ্গে সেই ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের লক্ষ্যস্থান মারঘ্ৰিবে যেতে পারবে? ফেজ এবং মিকনাস থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। সঙ্গে থাকলে আমি সহজেই সেই পথ খুঁজে পাবো। এর জন্য যা চাও আমি তোমাকে দেবো এবং সারা জীবন আমি তোমার দোস্ত হয়ে থাকবো। অভিযান শেষ হলে আবার তুমি তোমার ঘরে আপনজনের কাছে ফিরে যেতে পারবে।

যুদর বললো, শুনুন সাহেব, আমি প্রথমে আমার মা এবং ভাইদের কাছে বলবো সব। তারা যদি অমত না করে, আপনার সঙ্গে যেতে আমার কোনও আপত্তি নাই। কিন্তু তাদের কথা অমান্য করে আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া, আমি সংসারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ, আমি তাদের ফেলে চলে গেলে খাবে কী তারা?

মুর বললো, এ তোমার কুড়েমির কথা। টাকা পয়সাই যদি সমস্যা হয়, তা আমি এক হাজার দিনার দিচ্ছি তোমাকে। যাও, দিয়ে এসে তাদের। আমাদের ফিরতে মাস চারেক সময় লাগবে। এক হাজার দিনারে চার মাস চালাতে পারবে না তারা?

মূর-এর প্রস্তাব শুনে যুদর হাঁ হয়ে যায়। লোকটা বলে কী? এক হাজার দিনার দেবে সে? বলে, তা হলে টাকাটা দিন, আমি আমার মা-এর হাতে দিয়ে চার মাসের ছুটি নিয়ে চলে আসি। টাকা পেলে তারা কেউ আমাকে আটকাবে না।

মুর তাকে এক সহস্র মুদ্রা দিলো।

যুদর দিনারের থলেটা মা-এর হাতে তুলে দিয়ে বললো, মা, এতে এক হাজার দিনার আছে। সংসার খরচের টাকা। আমি মারঘ্ৰিবের এক অধিবাসীর সঙ্গে চার মাসের জন্য এক অভিযানে বেরুচ্ছি। এই খরচাপাতি রইলো, কোনও চিন্তা ভাবনা করো না। আমি আবার। যথাসময়ে ফিরে আসবো।

মা কেঁদে আকুল হলো, সে কি কথা বাবা। এমন দূরদেশে গেলে কেউ ফিরে আসতে পারে?

-কোনও ভয় নেই মা। যার সঙ্গে যাচ্ছি, সব পথঘাট তার ভালো করে চেনা। কিছু ভেবো না, তোমার ছেলে আবার তোমার কোলে ফিরে আসবে।

মা বললো, যা ভালো বুঝিস বাবা, কর। আমি আর কী বলবো? তবে বিদেশ বিভূই, একটু দেখে শুনে থাকিস। আল্লাহ মেহেরবান, তোর ভালো করবেন তিনি।

যুদর ফিরে আসতে মুর জিজ্ঞেস করে, কী, মায়ের মত পেলে?

—পেয়েছি। মা আমাকে দোয়া করেছে, আমাদের কোনও বিপদ হবে না। আর কালবিলম্ব না করে মুর খচ্চরে চেপে তার পিছনে বসিয়ে নিলো যুদরকে। তারপর সেই খাড়া দুপুর থেকে শুরু করে সূর্য পাটে বসা অবধি আকাশ পথে উড়ে চলতে থাকলো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো একাত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

বায়ুবেগে চলতে চলতে যুদর ক্ষুধার্ত বোধ করে। কিন্তু ভেবে আতঙ্কিত হয়, তাদের সঙ্গে খাদ্যবস্তু বলতে কিছুই নাই। মুরকে বলে, আমার মনে হয় সঙ্গে খাবার দাবার আনতে আপনি ভুলে গেছেন, জনাব!

মুর বলে, কেন, খুব খিদে পেয়েছে বুঝি?

-তা পেয়েছে।

-কী খাবে বলো?

–কী আর বলবো, থলেয় তো দেখছি খানাপিনা কিছুই নাই!

–আরে, কী খাবে তাই বলো না? খিদে যখন পেয়েছে, খেতে তো হবে!

–যা হোক কিছু একটা হলেই হতো—

তবু বলল না, রসনা কী চাইছে?

যুদর বলে, একটু রুটি আর পানি হলেই চলে।

বৃদ্ধ মুর হাসে, সে তো নেহাতই সাদা-মাঠা-শুধু পেট ভরাবার জন্যে দরকার হয়। ও সব নয়, তোমার সব চাইতে কী খেতে ভালো লাগে, তাই বলো।

যুদর বললো, খিদেয় পেট চুই ছুঁই করছে, এখন যা পাওয়া যাবে তাই অমৃত মনে হবে।

বৃদ্ধ বললো, তন্দুরী মুরগী চলবে?

যুদর চোখ বড় বড় করে, চলবে মানে? তার চাইতে আর কী ভালো হতে পারে?

—কেন, মধুর বিরিয়ানী সঙ্গে হলে ভালো হয় না?

—চমৎকার হয়।

-আর যদি পাখীর মগজ এবং বিলাতী বেগুনের টক-ঝাল পাও?

–তোফা!

-তুমি কী ধনেপাতা আর শালুক উঁটা দিয়ে সূর্যমুখী ফুলের শুখা চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসো?

-খুব!

-ভেড়ার মগজের ঝল?

—জিভে পানি আসছে, জনাব।

-বার্লির পকোড়া? আঙ্গুরপাতা ভাজা? পিঠে-পুলি ইত্যাদি নানা রকম মেঠাই মণ্ডা?

-হেই বাপ! এতোসব খাবার এক সঙ্গে?

বৃদ্ধ বলে, হ্যাঁ এক সঙ্গেই দেবো। আরও কিছু চাও?

যুদর ভাবে, লোকটা বদ্ধ পাগল! তা না হলে এই পরবাসে এসে এইসব খানাপিনার কথা তোলে কেউ? না আছে হাঁড়ি-পাতিল, না আছে রসুই-এর সাজসরঞ্জাম, অথচ আহার্য বস্তুর ফিরিস্তি শোনাচ্ছে হাজারো কিসিমের। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনও এইসব আজগুবি কথাবার্তা বলতে পারে? যুদর বলে, এই খিদের সময় আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন, সাহেব? আপনার খানাপিনার ফর্দ শুনে আমার জিভে জল এসে গেছে। যা বললেন, তার একটা খাবারও কী আপনি এখানে যোগাড় করতে পারবেন?

বৃদ্ধ বলে, আমি তো তাই চাইছিলাম, যুদর। ভালো ভালো খানাপিনার ছবি চোখের সামনে ভেসে না উঠলে ক্ষুধার উদ্রেক হবে কেন? তা এখন মনে হচ্ছে খিদেটা বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে, কেমন? আচ্ছা এই ধর, থলেটা। হাত ঢুকিয়ে এক এক করে বের করো সব থালাগুলো। যা যা খেতে চেয়েছিলে, দেখবে, এক একখানা থালায় ভর্তি করে সাজানো আছে সব। খাবারগুলো আগে বের করো। তারপর রসিয়ে রসিয়ে খাওয়া যাবে ‘খন।

বিস্ময়ে বিমূঢ় যুদর থলে থেকে খাবারের থালাগুলো এক এক করে বের করে। সব হাতে-গরম! খুসবুতে মদির হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।

—নাও, শুরু করো। যুদর চিৎকার দিয়ে ওঠে, এ সব কী, জনাব? আমার মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে না জানিয়ে এগুলো আগে থেকেই বানিয়ে এনেছিলেন?

বৃদ্ধ বলে, না গো উমরের পো যুদর, না। আসলে এই থলেটাই অলৌকিক যাদুমন্ত্রপুত। এ সবই তার কল্যাণে। এই যে খানাপিনা যা বের করেছ, এক আফ্রিদি আমার হুকুম তামিল করে এনে দিয়েছে। এ তো সামান্য, তুমি যদি দুনিয়ার নানান দেশের হাজারো জাতের খানাপিনার ফরমাইশ করতে, তাও নিমেষে এনে দিত সে। এখনি যদি বলো হাজার রকমের সিরিয়ার, হাজার রকমের মিশরের, হাজার রকমের হিন্দুস্তানের এবং হাজার রকমের চীনা খাবার তুমি খেতে চাও, এক পলকে সব সে এনে হাজির করে দেবে এখানে।

দুজনে মিলে বেশ তৃপ্তি করে, পেট পুরে আহার করলো। কিন্তু অত সব খাবার দু’জনে নিঃশেষ করবে কী করে? যতটা পারলো খেলো, বাকীটা ফেলে দিয়ে সোনার থালাগুলে থলেটার মধ্যে ভরে রাখলো বৃদ্ধ। তারপর থলেটার আর একদিক থেকে একটা জল ভর্তি সোনার বদনা বের করে আকণ্ঠ পান করলো। তারপর হাত মুখ ধুয়ে বদনাটাকে থলেয় ভরে আবার তারা খচ্চরটার পিঠে চেপে বসে, আকাশ-পথে বায়ুবেগে ছুটে চলতে থাকলো।

বৃদ্ধ এক সময় জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা—বলতে পার যুদর, কাইরো থেকে আমরা কত দূরে এসে পড়েছি?

যুদর বলে, খোদা জানেন, আমি বলতে পারবো না।

—এই দু ঘণ্টায়, বৃদ্ধ মুর বলে, আমরা প্রায় এক মাসের পথ পার হয়ে এসেছি। একমাত্র আফ্রিদি জিন ছাড়া এই বেগে আর কেউই চলতে পারে না। এইভাবে পুরো একটা দিন আমরা চলতে থাকলে এক বছরের যাত্রাপথ অতিক্রম করবো।

দিনের পর দিন ওরা আকাশ-পথে উড়ে চলতে থাকে। মাঝে মাঝে খানাপিনার জন্য বিরতি দিতে হয়। যুদরের রসনা মতো নানা উপাচারের আহার্য পাওয়া যেতে থাকে সেই আশ্চর্য থলেয়। এইভাবে পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি চলার পর মারঘ্ৰিবে এসে পৌঁছয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেজ আর মিকনাস শহরে অবতরণ করে ওরা।

শহরের পথে চলতে চলতে যুদর বুঝতে পারে, বৃদ্ধ মুরকে সেখানকার অনেকেই চেনে। জনে জনে কাছে এসে মুরকে কুশল অভিনন্দন জানাতে থাকে। অবশেষে এক সময়ে ওরা এক বিশাল প্রাসাদের সামনে এসে থামে। দরজায় কড়া নাড়তে খুলে যায়। হরিণ-নয়না পরমাসুন্দরী এক তরুণী হাসিভরা মুখে এসে দরজা ধরে দাঁড়ায়। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে বলে, কী আমার সৌভাগ্য, আসুন, ভিতরে আসুন।

-রহমা মা, বৃদ্ধ সস্নেহে বলে, বড় ঘরখানা খুলে দাও, আমাদের জন্যে।

রহমা তাড়াতাড়ি মাঝের বড় ঘরখানা খোলার জন্য ছুটে যায়। তার ভারি নিতম্বের উথাল-পাথাল যুদরের বুকে চাঞ্চল্য জাগায়। ভাবে, এ মেয়ে তো যে সে মেয়ে নয়, নিশ্চয়ই কোনও শাহজাদী-টাহজাদী হবে।

থলেটা নামিয়ে নিয়ে বৃদ্ধ খচ্চরটাকে বললো, এখন তুমি যাও। আবার যখন ডাকবো, এসো।

সঙ্গে সঙ্গে ধরণী দ্বিধা হয়ে গেলো এবং খচ্চরটা মাটির নিচে চলে যেতে আবার জোড়া লেগে গেলো মাটির ফাটল। যুদর হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

—এ কী তাজ্জব কাণ্ড!

বৃদ্ধ বলে অবাক হওয়ার কিছু নাই, যুদর। তোমাকে তো আগেই বলেছি সে আসলে কোনও খচ্চর নয়—জিনিয়াহ দানবী।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো বাহাত্তর রজনী। আবার সে বলতে থাকে:

বৃদ্ধের সঙ্গে যুদর এসে বসে একটা প্রকাণ্ড কামরায়। সারা ঘরটা মূল্যবান জিনিসপত্রে সাজানো গোছানো। চোখ ঝলসে যায়।

মেয়েটি ঘরে ঢুকে মূদরের হাতে একটা মোড়ক তুলে দেয়। বলে, এতে সাজ-পোশাক আছে। আপনার ঐ পোশাক ছেড়ে এটা পরে নিন।

যুদর অবাক হয়ে যায়। অন্তত পক্ষে হাজার দিনার দাম হবে সেই সাজ-পোশাকের। যুদর যখন পরে দাঁড়ালো, মনে হতে লাগলো, না জানি কোন্ দেশের সে বাদশাজাদা।

ইতিমধ্যে বৃদ্ধ মুর অলৌকিক থলে থেকে এক এক করে অনেক রকম খাবারের থালা বের করে টেবিলে সাজিয়েছে।

-আর দেরি নয় যুদর, এসো, খাবে এসো। অবশ্য জানি না এসব খানা তোমার মুখে রুচবে কিনা। আমার নিজের ইচ্ছেমতো এগুলো আনিয়েছি। তোমার যদি ভালো না লাগে বলল, আবার ফরমাইশ মতো আনিয়ে দিচ্ছি।

যুদর বলে, এ আপনি কী বলছেন, জনাব। আমার মুখে সব খানাই ভালো লাগে। আপনার পছন্দ আমারও পছন্দ। চিরকালই আমি পেটুক মানুষ। খাবার দেখলেই লোভ হয়। ভালমন্দ বাছ-বিচার করতে জানি না। সব খাবারই আমার দারুণ ভালো লাগে। যা পাই পরিতৃপ্তি করে খাই।

কুড়িটা দিন বৃদ্ধের আদর আপ্যায়নে কাটালো যুদর। প্রতিদিন এ-বেলা ওবেলা সে নতুন নতুন পোশাক বদলায়। আর খানাপিনা—তার তো তুলনাই নাই। যা প্রাণ চায়, তাই সে খায়।

শুধু একবার মুখ ফুটে উচ্চারণ করলেই হলো।

একুশ দিনের দিন সকালে বৃদ্ধ এলো তার কাছে। তখন যুদর অলস নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলো। সে ডাকে, এই যে উমরের পো, যুদর, ওঠ, ওঠ। চল এবার আমাদের কাজে নামতে হবে। আজই শমরদলের ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের পথ খুঁজে পাওয়ার উপযুক্ত দিন।

দু’জনে প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে শহরের সীমানা প্রাচীরের পিছনে এসে দাঁড়ালো। যুদর দেখলো, দুটি খচ্চর এবং দু’জন নিগ্রো ক্রীতদাস এসে হাজির হলো সেখানে। দু’জনে খচ্চর দু’টোয় চেপে বসতে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে থাকলো জানোয়ার দুটো। আর পিছনে পিছনে আসতে থাকলে সেই নিগ্রো-নফররা।

ঠিক দুপুরে এসে পৌঁছলো একটা নদীর উপকূলে। খচ্চর থেকে নামলো ওরা। বৃদ্ধ ইশারা করতে নিগ্রো দুটো জানোয়ার দু’টোকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবং একটু পরেই আবার ফিরে এলো তাবু খাটানোর সাজসরঞ্জাম কাঁধে নিয়ে। চটপট একটা সুন্দর তাবু খাটিয়ে ফেললো। তাঁবুর ভিতরে গালিচা বিছিয়ে আসন পেতে দিলো। আর এক পাশে বসিয়ে দিলো সেই কাচের কলসী দু’টো। প্রবাল বর্ণের মাছ দু’টো তার মধ্যে খেলা করে বেড়াচ্ছিল। এরপর নিগ্রো দুটো অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে গেলো।

খানাপিনা শেষ হলে বৃদ্ধ মূর কাচের কলসী দু’টোকে একটা ছোট টুলের উপরে স্থাপন করে অস্ফুট মন্ত্র আওড়াতে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলসীর মাছ দু’টো ছটফট করে কঁকিয়ে উঠলো, আমরা এখানে আছি, যাদু-সম্রাট। দোহাই আপনার,আমাদের হত্যা করবেন না। আমরা আপনার দাসানুদাস-ক্ষমাপ্রার্থী।

কিন্তু বৃদ্ধ মন্ত্রপাঠ থামালো না। একটুক্ষণের মধ্যেই খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেলো কলসী দুটো। আর সঙ্গে সঙ্গে মাছ দু’টো দুই শাহজাদার রূপ ধরে যুক্ত করে দাঁড়িয়ে পড়লো তার সামনে।

—আপনি সর্বশক্তিমান যাদুকর, আমাদের প্রাণে মারবেন না, এই ভিক্ষা চাইছি আপনার কাছে।

বৃদ্ধ গর্জে উঠলো, চোপরাও, একটা কথা বলবে না। আমি তোমাদের টুটি টিপে মেরে ফেলে দেবো। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেবো একেবারে। হুম—বাঁচতে পারো, রেহাই দিতে পারি, যদি শমরদলের পথ বাৎলে দাও। তা না হলে, ঐ যা বললাম- একেবারে গলা টিপে মেরে ফেলে দেবো। জ্বলন্ত অঙ্গারে ফেলে ভস্ম করে দেবো।

শাহজাদা-দ্বয় ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

—আপনি নির্দয় হবেন না; প্রভু। আমরা আপনার সব কথাই শুনবো। আপনি যা জানতে চান, বলে দেবে। কিন্তু যাদুসম্রাট, আপনাকে পথ বলে দিলেও তো আপনি শমরদলের শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। একমাত্র যুদর নামে এক জেলেই সেখানে যেতে পারবে। তা-ও যে-কোন যুদর হলে হবে না। কাইরোর সওদাগর উমরের পুত্র যুদর হওয়া চাই। তাকে নিয়ে না আসলে তো আপনি ঐ অলৌকিক ঐশ্বর্যের সন্ধান পাবেন না।

বৃদ্ধ বলে, আমি তা জানি। আর জানি বলেই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তোমাদের সামনের দিকে তাকাও। দেখ, উমরের পুত্র যুদর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

শাহজাদা-দ্বয় যুদরকে দেখে প্রসন্ন মুখে বললো, তা হলে তো আপনি প্রায় বাজিমাৎ করেই ফেলেছেন! এবার আমাদের ওপর সদয় হোন, যাদুসম্রাট। আমাদের মুক্তি দিন।

বৃদ্ধ তাদের বললো, ঠিক আছে, যেতে পারো। দুই ভাই তখন নদীর জলে তলিয়ে গেলো।

একটি ধূপদানীর ভিতরে দুটি রক্তরাগমণি রেখে তার উপর কিছু কাঠকয়লা চাপিয়ে দিলো বৃদ্ধ। তারপর জোরে জোরে ফু দিতে থাকলো। একটুক্ষণের মধ্যেই কয়লাগুলো গনগনে আগুন হয়ে উঠলো। খানিকটা ধুনোর গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে যেতে লাগলো ওপরের দিকে। বৃদ্ধ বললো, যুদর শোনো। ধূপের ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে। এবার আমি সাধনায় বসবো। তার আগে তোমাকে যা বলার বলে নিতে চাই। কারণ আমার মন্ত্রসাধন সময়ে কোনও কথাবার্তা বলা চলবে না। কোনও কারণে যদি আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তাই, তোমাকে কী কী করতে হবে, সেই কথাগুলো আগেই শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি। মন দিয়ে শোনো, কাজের সময় এক চুল এদিক ওদিক করা চলবে না। তাতে প্রান-সংশয় ঘটে যেতে পারে।

যুদর বলে, আমি প্রস্তুত জনাব।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদও গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো তিয়াত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

বৃদ্ধ বলতে থাকে : আমি যখন এই ধূপের ধোঁয়ায় মন্ত্রপাঠ করতে থাকবো তখন, ঐ নদীর পানি আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসতে থাকবে। এই ভাবে, দেখবে, কিছুক্ষণের মধ্যে সারা নদীটা শুকিয়ে ধূ-ধূ করে চর হয়ে যাবে। তুমি তখন এই ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে নিচে নেমে যাবে। নেমেই দেখতে পাবে, নদীর পাড়ের নিচে এক বিশাল সিংহ দরজা। ও রকম দরজা একমাত্র সুলতান বাদশাহদের প্রাসাদ ফটকেই দেখা যায়। সে যাক, ঐ বদ্ধ দরজার পাল্লায় দেখবে ইয়া বড় বড় দুখানা সোনার বলয়ের মতো কড়া। তুমি তার একটা ধরে একবার নাড়বে। আওয়াজ উঠবে, কিন্তু কেউ খুলবে না। একটু পরে আর একবার নাড়া দেবে কড়াটায়। সেবারও কেউ সাড়া দেবে না! এরপর আরও একবার নাড়া দেবে কড়াটা। এইবার দরজাটা খুলে যাবে। ভয় পেয়ো না, তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে এক জল্লাদের মতো প্রহরী। হাতে ধরা খোলা তলোয়ার। হুঙ্কার ছেড়ে বলবে, কে তুমি? তুমি তখন নির্ভয়ে বলবে, আমি উমরের পুত্র যুদর। সে বিকটভাবে মুখ ব্যাদন করে বলবে, তুমি যদি যথার্থই যুদর হও তবে গর্দান বাড়িয়ে দাও আমার সামনে। আমি তোমার ধড় মুণ্ড আলাদা করে ফেলবো। যুদর, খুব সাবধান, প্রহরীর হুঙ্কারে একটুও ভয় করো না বা পালাবার কোনও চেষ্টা করো না, অথবা তাকে আক্রমণ করারও কোন প্যাচ কষতে যেও না। যেমনটি সে বলবে, তেমনি ভাবে সুবোেধ বালকের মতো গর্দানটা বাড়িয়ে দেবে তার তলোয়ারের সামনে। লোকটা তোমার ঘাড় তাক করে কোপ বসাতে যাবে, ঠিকই। কিন্তু তার আগে সে নিজেই ধরাশায়ী হয়ে পড়ে যাবে তোমার পায়ের তলায়। তারপর দেখবে, সে অক্কা পেয়েছে। তোমার কোন চোট লাগেনি। কিন্তু তুমি যদি তাকে বাধা দিতে চেষ্টা করো, সে তোমাকে নির্ঘাৎ কোতল করে ফেলবে।

এইভাবে প্রথম দরজার ফাঁড়া কাটাবার পর তুমি এগিয়ে যাবে দ্বিতীয় দরজার দিকে। সে দরজাও দেখবে, বন্ধ। যথারীতি কড়া নাড়লে দরজা খুলে দাঁড়াবে এক ঘোড়সওয়ার সেনাপতি। তার হাতে থাকবে একখানা বর্শা। সে তোমাকে জিজ্ঞেস করবে, কে তুমি? তুমি বলবে, আমি কাইরোর সওদাগর উমরের পুত্র যুদর।’ সে বলবে, ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকো, এই বর্শা তোমার বুকে বসাবো আমি। তুমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সেখানে। এক চুল নড়বে না। লোকটা বর্শাখানা ছুঁড়ে তোমার কলিজা বিদ্ধ করতে উদ্যত হবে। কিন্তু পারবে না। তার আগে নিজেই সে পড়ে যাবে ঘোড়া থেকে, একেবারে তোমার পায়ের তলায়। তারপর দেখবে, সেও বেঁচে নাই। এরপর তুমি তৃতীয় দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়বে। দরজা খুলেই রুখে দাঁড়াবে তীরন্দাজ। হাতে তার উদ্যত তীর ধনুক। কোনও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করেই সে তোমাকে তাক করে তীর ছুঁড়বে। কিন্তু পারবে না। নিজেই পড়ে যাবে তোমার পায়ের তলায়। দেখবে, তারও ইন্তেকাল হয়ে গেছে। একটা কথা মনে রাখবে, কোন কিছুতেই ভয় পাবে না। পালাবার চেষ্টা করবে না বা বাধা দিতে যাবে না। তা যদি কর, তুমিই মরবে।

এরপর চতুর্থ দরজার কাছে গেলেই দেখবে, এক ভয়ঙ্কর সিংহ গর্জন করছে। মনে হবে, তখুনি বুঝি তোমার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু না, সে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসবে তোমার সামনে। তুমি কিন্তু যেমনটি দাঁড়িয়েছিলে তেমনি দাঁড়িয়ে থাকবে। তোমার সামনে এসে সিংহটা প্রকাণ্ড হাঁ বাড়িয়ে তোমার মাথাটা মুখের মধ্যে পুরে ফেলতে চাইবে। তখন তুমি বুকে সাহস বেঁধে সিংহটার হাঁ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে তোমার ডান হাতখানা। দেখবে সে স্তব্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে যাবে তোমার পায়ের কাছে। তোমার গায়ে আঁচড়টি বসাতে পারবে না সে।

পঞ্চম দরজাটি খুলে দেবে দৈত্যের মতো আবলুস কালো এক নিগ্রো। ভাটার মতো জ্বলতে থাকবে তার গোলাকৃতি চোখ দুটো। দাঁত-মুখ খিচিয়ে সে তোমাকে প্রশ্ন করবে, কে তুমি? তুমি ওর ঐ হম্বি-তম্বিতে একটুও ভয় পেয়ো না। শান্তভাবে বলবে, আমি ধীবর যুদর। আমার বাবা কাইরোর সওদাগর ছিলেন, তার নাম উমর। তখন নিগ্রোটা বলবে, তুমি যদি সত্যিই সেই যুদর হও তবে যাও ঐ ষষ্ঠ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াও।

এই ষষ্ঠ দরজায় এসে বোধহয় তুমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। একমাত্র খোদাতালার নাম জপ করতে থাকবে। দরজাটা আরও অনেক বড়। পাল্লা খুলে যেতেই দেখবে, দুটি ড্রাগন বিকট হাঁ করে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে। ঐ ভয়াল-ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে স্বভাবতঃই সংজ্ঞা হারাবার কথা। কিন্তু আল্লাহর দোয়াতে তোমার সে-রকম কিছু হবে না। ওরা দুটিতে দু-পাশ থেকে তোমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকবে। যেই তারা থাবা বাড়াবে তোমার দিকে; তুমি বুকে সাহস এনে দু’হাতে দুটির দু’খানা পা চেপে ধরবে। অবছো শাল বট উপড়ে ফেলার শক্তি যাদের থাবায়, তাদের হাত ধরে কী ফায়দা হবে? হবে হবে, ওতেই কাজ হবে। কাজ তো এই মন্ত্রে হবে, তুমি তো উপলক্ষ্য মাত্র। যাই হোক, তোমার হাতের ছোঁয়া পাওয়ামাত্র তারা গগনবিদারী আর্তনাদ করে তোমার পায়ের কাছে ভেঙ্গে পড়বে। আর উঠবে না। তুমি দেখবে, তোমার দেহে কোনও আঘাত লাগেনি।

এরপর আরও একটি দরজার গণ্ডী তোমাকে পেরুতে হবে। এটি সপ্তম এবং শেষ দরজা। এই বন্ধ দরজার সামনে এসে কড়া নাড়ালেই বেরিয়ে আসবে এক হাস্যময়ী মাতৃমূর্তি। পর্কিত কেশ, বয়সের ভারে ন্যুজ হয়েছে দেহ। সে তোমাকে ছলনায় ভোলাবার বহুবিধ চেষ্টা করবে, সে কি রে বেটা, আমকে চিনতে পারছিস না? আমি যে তোর গর্ভধারিণী মা? আয় বাবা, আমার কাছে আয়। আমি যে চোখে ভালো দেখতে পাই না রে, আয় আমার কাছে আয়, কত কাল পরে এলি, একবার নয়ন ভরে দেখি! তুমি কিন্তু তার কথায় ভুলে কাছে যেও না। তা হলে তোমার এ জন্মের সাধ সে ঘুচিয়ে দেবে। নিজেকে শক্ত করে কঠিন কণ্ঠে বলবে, দাঁড়াও, আর এক পা এদিকে এগোবে না। শোনো, তোমার সাজ-পোশাক খুলে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়াও আমার সামনে। ডাইনিটা তখন তোমাকে বলবে, সে কী বাবা, আমি তোমার মা, আমাকে উলঙ্গ হতে বলছো তুমি? আমি তোমাকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরেছি, বুকের দুধ খাইয়ে লালন করেছি। তারই কী এই পুরস্কার, বাবা? তুমি আমাকে বিবস্ত্রা হতে বলছো? ধরিত্রী যে রসাতলে যাবে–

–-তা যাক, তুমি ন্যাংটো হবে কি না আমি জানতে চাই। এই মূহূর্তে এক্ষুণি যদি না তোমার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলল আমি তোমাকে সংহার করবো।

এই বলে পাশের দেওয়ালে ঝুলানো অসংখ্য তলোয়ারের একখানা খুলে হাতে নেবে তুমি। তখনও সে তোমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করার চেষ্টা করবে, করুণা চাইবে। কিন্তু তুমি টলবে না। তলোয়ারখানা বাগিয়ে ধরে তাকে ভয় দেখাতে থাকলে একটা একটা করে সে জামা-কাপড় খুলতে থাকবে। কিন্তু সবটা খুলবে না। আবার সে তোমার দয়া ভিক্ষা করবে। কিন্তু তুমি সে দিকে ভ্রূক্ষেপ করবে না। কেটে টুকরো টুকরো করার হুমকী দেখাবে। এর পর সে নিরুপায় হয়ে এক এক করে শেষ পোশাকটিও পরিত্যাগ করবে। কিন্তু আশ্চর্য হবে, সেই ডাইনীটার দেহের কোনও অস্তিত্ব দেখতে পাবে না তুমি। পলকে সে অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে যাবে।

আর কোনও বাধা নাই। এবার তোমার সামনে ঐশ্বর্যের সমুদ্র। কত কী নেবে তুমি? কত কী নিতে পারো তুমি? এতো ঐশ্বর্য কখনও দেখিনি কেহ। তাল তাল সোনা, তাল তাল রুপা। হীরে জহরতের স্থূপ চারপাশে। তুমি কিন্তু কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ করবে না। সোজা চলে যাবে ভিতরের ঘরে। সে ঘরে এক সোনার মসনদে শুয়ে আছেন যাদুসম্রাট অল শমরদল। ঘুমে আচ্ছন্ন, তার মাথায় এক রত্নমুকুট। মুকুটের শীর্ষে একটি মাণিক জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। সেই আলোতে আলোময় হয়ে আছে সারা ঘর। লোকে বলে, সাত সম্রাটের ধন এক মাণিক। সেই মাণিক আছে অল শমরদলের মাথার মুকুটে। এতো বিরাট মাণিক্য আর দুটি নাই দুনিয়ায়। আসলে এই মাণিকটিই আশ্চর্য গোলক। শমরদলের কোমরে আছে সেই তলোয়ার,আর এক হাতের আঙ্গুলে পরা আছে আংটিটা এবং গলায় তক্তি করে ঝোলানো আছে সেই কাজললতাখানা।

এই চারটি পরমাশ্চর্য সম্পদ তোমাকে সংগ্রহ করে আনতে হবে সেখান থেকে। আমি যা বললাম, আশা করি মন দিয়ে শুনেছো। দেখো, কোথাও যেন চালে ভুল করো না। একটু

এদিক-ওদিক হলে কিন্তু তোমাকে চিরকালের মতো হারাবো আমি।

বৃদ্ধ মূর বললো,-হয়তো তোমার কোথায়ও বুঝতে ভুল চুক হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং মন দিয়ে শুনে নাও, আরও একবার বলছি তোমার কাছে।

বৃদ্ধ তোতা-পাখীর মতো করে শিখিয়ে পড়িলে দিলো যুদরকে।

এই সময় ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো চুয়ারত্তম রজনী।

আবার সে গল্প শুরু করে।

যুদর বলে, সবাই বুঝলাম। কিন্তু আপনি যা বললেন, সেই সব ভয়ঙ্কর ব্যাপার সহ্য করা কী মানুষের পক্ষে সম্ভব?

বৃদ্ধ বলে, আমি তো বলছি, তোমার কোনও ভয় নাই। যা যা বললাম, ঠিক ঠিক মতো করতে পারলে, তোমার একগাছি চুলও কেউ ছিড়তে পারবে না। দ্বাররক্ষী হয়ে যারা তোমার সামনে দাঁড়াবে, আসলে তো তারা সকলেই ভূতপ্রেত-অপছায়া মাত্র। সে তো আমি এখান থেকে মন্ত্রবলেই শায়েস্তা করবো। মোট কথা, তোমার ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। বরং তাদের সামনে অত্যন্ত সহজ সাধারণ ভাবে দাঁড়াবে।

যুদর বলে, ঠিক আছে, একমাত্র আল্লাহই ভরসা।

ধূপদানীতে আবার নতুন করে ধূপের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিলো মূর। গলগল করে ধোঁয়া উঠতে লাগলো ওপরে। বৃদ্ধ মন্ত্র-সাধনায় বসলো। যুদর লক্ষ্য করে নদীর জল ধীরে ধীরে কমছে। শেষে এক সময় একেবারেই শুকিয়ে চড়া পড়ে গেলো। বৃদ্ধের নির্দেশ মতো সে নদীর নিচে নেমে দেখতে পেলো সেই বিশাল সিংহ-দরজা। বার বার তিনবার কড়া নাড়ার পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, কে তুমি?

-আমি কাইরোর সওদাগর উমরের পুত্র যুদর।

সশব্দে দরজাটা খুলে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে এক জাঁদরেল প্রহরী। হাতে তার শাণিত তলোয়ার। বললো, তুমি যদি সত্যিই যুদর হও, তোমার গর্দান পেতে দাও আমার তলোয়ারের নিচে। আমি তোমার মুণ্ডচ্ছেদ করবো।

যুদর বৃদ্ধের কথা স্মরণ করে গর্দান বাড়িয়ে দিলো তার সামনে। কিন্তু কোপ সে বসাতে পারলো না। নিজেই লুটিয়ে পড়লো যুদর পায়ের তলায়।

এরপর দ্বিতীয় দরজা। সেখানেও যথারীতি মূরের নির্দেশমতে, ঘোড়সওয়ারকে ধরাশায়ী করে।

এইভাবে এক এক করে ছয়টি দরজার সংকট কাটিয়ে সে সপ্তম এবং শেষ দরজার সামনে গিয়ে সেই ডাইনী বুড়ির মুখোমুখী হয়। যুদর ভাবে বুড়িটা অবিকল দেখতে তার মা-এর মতো। তার চেহারা, চলা বলা সব— সব তার মতো। কিন্তু সে জানে, এ মায়া। আসলে ওটা একটা ডাইনীর প্রেতছায়া। কোনও সশরীরী মানুষই না সে। গর্জে উঠলো যুদর,এই শোনো এক পা নড়বে না। তোমার সাজ-পোশাক সব খুলে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াও।

-সে কি বাবা, ছেলে হয়ে মাকে এই কথা বলে কেউ? আমি দশ মাস গর্ভে ধরেছি, বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছি। লেখাপড়া শিখিয়েছি—এই কী তার পুরস্কার,বাবা!

ও-সব কোনও কথা শুনতে চাই না। সব কাপড় চোপড় খুলবে কী বলো? না হলে, এই যে দেখছো তলোয়ার, একেবারে দু’খানা করে ফেলুবো।

ডাইনীটা বলে, খুলছি বাবা, খুলছি। মাকে যদি বেইজ্জত করতেই চাও, করো।

খানিকটা অঙ্গস খোলর পর আবার সে চুপ করে দাঁড়ায়। যুদর আবার হুঙ্কার তোলে, কী হলো, কথা কানে ঢুকছে না? তা হলে বাঁচার সাধ নাই, মনে হচ্ছে!

– না বাবা, না। অমন করে ভয় দেখিও না। এক্ষুনি খুলছি।

আবার দু-একখানা খুলে ফেলে দেয়। আবার দাঁড়িয়ে পড়ে।

-না, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না দেখছি, খোলো বলছি। নইলে এক ঘায়ে দেবো শেষ করে।

যুদর তলোয়ারখানা সাঁই করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে বুড়িটার নাকের ডগার ওপর দিয়ে। ভয়ে শিউরে ওঠে সে। ও বাবা গো, মরে যাবো গো? অমন করে নাকের ডগায় তলোয়ার নাচিয়ো না, বাবা। আমি খুলছি। এখুনি সব খুলে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়াচ্ছি তোমার সামনে। ছেলে হয়ে যদি মায়ের বস্ত্রহরণ করতে চাও, করো। ছিঃ ছিঃ কি ঘেন্নার কথা, দুনিয়াটা রসাতলে গেলো–

প্রায় সবই সে খুলে ফেলেছে। মাত্র শেষ অন্তর্বাসটি রয়ে গেছে। বুড়িটা করুণ মিনতি করে বলে, দোহাই বাপ, মাকে এইভাবে বে-ইজ্জৎ করো না। এর চাইতে আমার যে গলায় দড়ি দেওয়া ভালো ছিলো।

যুদরের সব তালগোল পাকিয়ে যায়। ভুলে যায় সে মুরের সতর্কবাণী। কেবল তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি মাত্র অশ্রুসজল মুখ—তার মায়ের মুখ। সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, থাক, আর দরকার নাই।

সঙ্গে সঙ্গে ডাইনীর অট্টহাসিতে সারা কক্ষ ফেটে পড়ে, এই–কে আছিস, বেহদ্দটাকে বেধড়ক পিটিয়ে এখান থেকে বের করে দে।

ডাইনীর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো, চারদিক থেকে অজস্র ধারায় কিল চড় লাথি বর্ষণ হতে লাগলো যুদরের ওপর। কে যে তাকে মারছে কিছুই বুঝতে পারে না। কারণ সকলেই অদৃশ্য-লোক থেকে হাত পা চালাচ্ছিল। মারের চোটে যুদরের হাড় মাস আলাদা হবার দাখিল হলো প্রায়। কোনও রকমে সে পিছু হটতে হটতে এক সময়ে প্রথম দরজা পার হয়ে নদীর চরে এসে দাঁড়াতে পারে।

বৃদ্ধ মূর মন্ত্রবলেই বুঝতে পেরেছিলো, সব ভণ্ডুল হয়ে গেছে। নদীর নিচে ছুটে এসে সে যুদরকে ওপরে নিয়ে যায়।

যুদর বলে, পারলাম না, জনাব। মায়ের বেদনার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই আর বলতে পারলাম না, খুলে ফেল তোমার ঐ শেষ অন্তর্বাসটুকু। আমি জানি, আমি ভুল করেছি। আমি জানি, সে আমার মা নয়—ডাইনী। তবু—তবু আমি পারলাম না। কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেলো। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় আমার মায়ের সেই রোদনভরা অশ্রুসজল মুখখানাই বার বার দেখতে থাকলাম। আমাকে মাফ করে দিন, জনাব। আমি আপনার সব ভেস্তে দিয়েছি।

বৃদ্ধ সান্ত্বনা দেয় যুদরকে। আমি বুঝেছি, কোথায় তুমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলে। সে যাক, যা হবার তা হয়েছে। ও-নিয়ে এখন আর ভেবে কিছু লাভ নাই। আবার একটা গোটা সাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক এক বছর পর এইদিনে, এই তিথি-নক্ষত্রে আবার আমরা এখানে আসবো। সেদিন পর্যন্ত তোমার দেশে ফেরা হবে না। আমার কাছেই থাকবে তুমি। চলো, আজ আর এখানে ফালতু বসে থেকে কাজ নাই। ঘরে ফেরা যাক।

সেই মুহূর্তে আবার সেই নিগ্রো নফর দুটো হাজির হলো সেখানে। বৃদ্ধের ইশারায় ওরা তবুটা গুটিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবং কিছুক্ষণ পরে খচ্চর বসলো।নিগ্রো দুটো পিছন পিছন চলতে থাকলো।

ফেজ শহরের সেই প্রাসাদতুল্য ইমারতে নানা সুখ-বিলাসের মধ্য দিয়ে গোটা একটা বছর কাটিয়ে দিলো যুদর।

আবার ফিরে এলো সেই তিথি-নক্ষত্র ফিরে এলো সেইদিন। মুর বললো, আজ আমাদের যেতে হবে।

সেই শহর-প্রাচীরের পাশে আসতেই নিগ্রো নফর দুটো খচ্চর সঙ্গে করে এলো। যুদর আর বৃদ্ধ খচ্চরে চেপে নদীর কিনারে এসে দাঁড়ায়। নিগ্রোরা খচ্চর দুটো নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার ফিরে আসে তারা তাঁবুর সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে। তাবু খাটানো হয়। মুর ধূপদানীতে ধুনো ছড়িয়ে দিতে দিতে যুদরকে বলে, সব ঠিক ঠিক মনে আছে তো? এবার আর ঐ রকম ভুল করবে না আশা করি।

যুদর বলে, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।

রাত্রি শেষ হয়। শাহারাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো পঁচাত্তরতম রজনীতে আবার গল্প শুরু করে সে।

তবু বৃদ্ধ বলে, ভুলেও কখন মনে করবে না, ঐ ডাইনী বুড়িটা তোমার গর্ভধারিণী মা। সবই তার ছলনা মাত্র। মোটকথা, তার ছলা-কলাতে তুমি কোনও মতেই ভুলবে না। প্রথমবার তুমি প্রাণে বেঁচে এসেছে। কিন্তু এবার যদি সেই ভুল করো, সশরীরে আর ফিরে আসতে পারবে না, আমার কাছে। তবে, তোমার প্রেতাত্মার সঙ্গে আমার মোলাকাত হতে পারবে।

যুদর বলে, এতো কাণ্ডের পর আবার যদি আমি ভুল করি তবে তো আমাকে জ্যান্ত পুড়য়ে মারা দরকার।

ধুপদানীতে ধূনো দিতে গলগল করে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকে। বৃদ্ধ মন্ত্রপাঠ করে চলে। নদীর জল শুকিয়ে শুকিয়ে এক সময় ধূ ধূ চর জেগে ওঠে। যুদর নিচে নেমে যায়। সেই রুদ্ধ দ্বারে কড়া নাড়ে। বার বার—তিন বার। ভিতর থেকে প্রশ্ন আসে, কে?

-আমি উমর সন্তান যুদর। দরজা খুলে যায়। শাণিত তরোয়াল বাগিয়ে প্রহরী হুকুম করে, গর্দান বাড়াও।

যুদর নিঃশঙ্ক চিত্তে মাথা পেতে দেয়। লুটিয়ে পড়ে প্রহরী। এইভাবে এক এক করে ছয়টি দরজা অতিক্রম করে সপ্তম এবং শেষ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই ছলনাময়ী পেতনী মায়ের রূপ ধরে যুদরের সামনে এসে দাঁড়ায়। যুদর কিন্তু নির্মম নিষ্করুণ কণ্ঠে বলে, তোমার সব সাজ-পোশাক খুলে আমার সামনে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াও।

ডাইনীটা নানা বাহানা করে তাকে ভোলাবার চেষ্টা করে। মা-ছেলের সম্পর্ক টেনে এনে যুদরকে বিভ্রান্ত করতে চায়। কিন্তু গত বছরের সে-কথা যুদর ভোলেনি। সেই হাড়-চুর করা কিল চড় ঘুসি লাথির ব্যথা এখনও সে কল্পনায় অনুভব করতে পারে। ডাইনীটা সাজ-পোশাক খুলতে খুলতে শেষ অন্তর্বাস-এ এসে থেমে যায়। সুদর খিস্তি খেউড় করে হুঙ্কার ছাড়ে, এই হারামজাদী, খোল শীগগির। নইলে, এই দ্যাখ তলোয়ার, একেবারে সোজা ঢুকিয়ে দেবো

ডাইনী শেষ বাসটুকু ছেড়ে ফেলে। কিন্তু কি আশ্চর্য, যুদর আর ডাইনিটাকে দেখতে পায় না। পলকে সে উবে গেছে।

ব্যস, আর কোনও বাধা নাই। যুদর এবার বড় কামরায় ঢুকে পড়ে। এই প্রকাণ্ড ঘরখানা সোনার ইটে ঠাসা। কিন্তু সেদিকে দৃকপাত করে না যুদর। খানিকটা এগোতে আর একটা ঘরের দরজা। পর্দা ঝুলছিলো। যুদর ঢুকে পড়ে। ঘরের এক পাশে একটি সোনার সিংহাসন। সেই সিংহাসনে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে যাদুসম্রাট অল-শমরদল। তার মাথায় নানা রত্নখচিত এক সুবর্ণমুকুট। মুকুটের শীর্ষে সেই আশ্চর্য গোলক। আসলে সেটা একটা মাণিক। শমরদলের ডান হাতের আঙ্গুলে পরা ছিলো একটি মোহারাঙ্কিত অঙ্গুরীয়। সিংহাসনের মাথার কাছে রাখা আছে একখানা তলোয়ার। আর শমরদলের কণ্ঠে ঝোলানো ছিলো একখানা তক্তি। আসলে এই তক্তিখানাই কাজললতা।

যুদর প্রথমে তলোয়ারখানা কোমরে বাঁধলো। তারপর শমরদলের আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে দিয়ে নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখলো। এবং সব শেষে সে মুকুট থেকে তুলে নিলো সেই আশ্চর্য গোলকটি।

তখন চারদিক থেকে জয়ধ্বনি হতে লাগলো, সাবাস যুদর, তুমিই কামাল করে দিলে!

নানারকম বিজয়-বাদ্য বাজতে লাগলো চারদিকে। যুদর ধীর পায়ে চলতে চলতে এক সময় নদীর চরে উঠে দাঁড়ালো। বৃদ্ধ মুর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। যুদরকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে, তা হলে পেরেছো, সত্যিই আসতে পেরেছে যুদর?

সেই অমূল্য রত্ন-সম্পদগুলো দু’হাতে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে সে, আমার এতোকালের স্বপ্ন আজ সফল হলো। দু ফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে তার দু’গাল বেয়ে।

-চলো চলো, আর এখানে দেরি করে কী লাভ? চলো এবার প্রাসাদে যাই।

আবার সেই নিগ্রোরা আসে। তাবুর পাট গোটানো হয়। দু’টো খচ্চর আসে। তার পিঠে চেপে যুদর আর বৃদ্ধ মুর প্রাসাদে ফিরে আসে।

সে রাত্রে তারা দু’জনে মিলে প্রাণভরে খানাপিনা করে। এতোকালের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে বৃদ্ধ মুর আবদ অল সামাদ। এ আনন্দ সে রাখবে কোথায়। যুদরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমার জন্যেই আমার এতোকালের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। বলো বাবা, যুদর, কী চাও তুমি। আজ তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই। তুমি যা চাইবে, তাই দেবো। দিতে পারবো। কারণ আজ আমি ত্রিভুবন বিজয়ের ক্ষমতা ধরি। বল, কী চাও?

যুদর বলে, আপনার ঐ মজার থলেটার ওপর আমার ভারি লোভ। যদি মেহেরবানী করে ওটা আমাকে দেন—

বৃদ্ধ হাসে, বোকা ছেলে, সামান্য এই থলেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাও?

সামান্য কেন বলছেন, জনাব? এমন কল্পতরুর মতো থলে—যা খেতে চাইবো তাই পাবো। এর চাইতে আর বেশি কি প্রয়োজন থাকতে পারে? পেট পুরে জিভের সাধ মিটিয়ে খানা-পিনা খেতে পেলে আমার আর কিছু চাই না।

‘মুর বলে, কিন্তু খেতে পাওয়াই তো সব নয়, যুদর। খাওয়া ছাড়াও মানুষের আরও অনেক কিছুর দরকার হয়। তোমাকে এই যাদু-থলের সঙ্গে আরও একটা থলে দিচ্ছি। এটা অবশ্য অলৌকিক না। তবে মণিমুক্তা হীরে-জহরত ভরা। সারা জীবন ধরে দু’হাতে খরচাপাতি করেও ফুরাতে পারবে না। তুমি এক কাজ করো। কাইরোতে ফিরে গিয়ে একটা দোকান নিয়ে বসো৷দেখবে শহরের সেরা সওদাগর হতে পারবে। তাছাড়া এই খাবারের যাদু থলে তো রইলোই। যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে ব্যাগটা হাতে ধরে শুধু মনে মনে বলবে, শোনো থলের নফর, এখন আমি এই খানাপিনা চাই। তাহলেই সঙ্গে সঙ্গে থলের মধ্যে এসে যাবে সেইসব খাবার ভর্তি থালাগুলো। একটা কথা, খানাপিনা শেষ হয়ে গেলে সোনার থালাগুলো আবার থলের মধ্যে পুরে দিতে হবে। থলের নফর জিনিয়াহকে যদি তুমি একদিনে হাজার রকমের দুষ্প্রাপ্য খানাপিনারও ফরমাশ করো, সঙ্গে সঙ্গে সে এনে হাজির করবে সব।

আবদ অল-সামাদ শূন্যের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ডাকতেই সেই নিগ্রো দুটোর একটা এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে নিয়ে এলো একটা খচ্চর। বৃদ্ধ মুর যুদরকে খচ্চরে চাপিয়ে দিলো। সঙ্গে দিলো সেই হীরে জহরৎ আর যাদু-থলে দুটো। বললো, তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে এই নিগ্রো। এই খচ্চরটা এক জিনিয়াহ। যেমন ভাবে আমরা এসেছিলাম তেমনি বায়ুবেগে উড়ে যাবে সে। কাইরোতে একেবারে তোমার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে। তুমি নেমেই দেখতে পাবে এই নিগ্রোকে। এর হাতে আবার এই খচ্চরটাকে ফেরত পাঠাবে আমার কাছে। যাও, আল্লাহর কাছে দোহা মাঙছি, তিনি যেন সারা জীবন তোমাকে সুখে রাখুন। কতকাল পরে দেশে ফিরছো, তোমার মা পথ চেয়ে বসে আছেন। তোমাকে পেয়ে আবার হাসি গানে ভরে উঠবে তার

সংসার। পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি উড়ে চলার পর যুদর কাইরোয় ফিরে আসে। মনে তার কত, আনন্দ, কতদিন পরে মাকে দেখতে পাবে সে?

বাড়ির দরজায় ঢুকেত গিয়েই চমকে ওঠে। একী ব্যাপার? তার মায়ের পরণে শতছিন্ন একখানি মাত্র বস্ত্র। কোনও রকমে সে লজ্জা নিবারণ করতে পেরেছে মাত্র। অনাহারে অনিদ্রায় তার চেহারার জৌলুস ধুয়ে মুছে গেছে। কেঁদে কেঁদে চোখের কালে কত কালি পড়েছে।

-মা, মাগো, একি তোমার চেহারা হয়েছে, মা? যেন মনে হচ্ছে—কতকাল তুমি অনাহারে আছো?

-খুব মিথ্যে নয়, বাবা। রোজদিন তো পেটে দানাপানি পড়ে না। দয়া করে যেদিন লোকে দেয়, সেদিন খাই। অন্যদিন উপোস।

—উপোস! সে কি! আমি যে অনেক টাকা তোমার কাছে রেখে গিয়েছিলাম, মা। একশো একশো করে দুবারে দুশো, তারপর এক হাজার—এই বারোশো দিনার তোমার কাছে সংসার খরচের জন্যে দিয়ে গিয়েছিলাম। রেখে ঢেকে খেলে এ টাকায় মাত্র এক বছর কেন মা, বহুকাল চলার কথা?

মা বললো তোর সব কথাই ঠিক, বাবা। অত পয়সা থাকতে আজ আমাকে সানকী হাতে করে দোরে দোরে ফিরতে হবে কেন? কিন্তু নসীবে লেখা থাকলে খাবে কে? তুই চলে যাওয়ার পরই তোর ভাই দুটো আমার কাছ থেকে টাকা পয়সাগুলো কেড়ে নিয়ে পথে বের করে দিলো। তারপর কী করলো জানি না দুদিনেই সব উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আবার এসে আমার ঘাড়ে চাপলো! সারাদিন আমি ভিক্ষে করে যা পাই, মায়ের প্রাণ, ওদের না দিয়ে তো মুখে দিতে পারি না।

যুদর বলে, তোমার সব দুঃখের আজ থেকে ইতি হয়ে গেলো মা। দেখ তোমার জন্যে কী নিয়ে এসেছি। কত ধন-দৌলত, কত খানাপিনা। আচ্ছা মা তোমার তো আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি? এখন কী খেতে চাও, বলো তো?

—গরীবের আবার বাছ-বিচার কী, বাবা। যা পাবো তাই খাবো।

–উঁ হুঁ, গরীব কী বলছো, আমি এখন বিরাট বড়লোক। বলো তুমি কী খেতে চাও। এক্ষুণি খাওয়াবো তোমাকে।

মা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকায়।

—তা তুই কী খেতে দিতে পারবি, বাবা? এতোকাল পরে এলি, দু’খানা থলে হাতে করে। তার আবার একটা খালি। অন্যটায় তোকই খানাপিনা কিছু দেখছি না।

—আছে আছে। তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। এখন বল, কী খেতে চাও?

-কী আবার চাইবো। তুই বাপু বাজে খরচ করিস নে। বাজার থেকে রুটি আর একটু পনির নিয়ে আয়। সবাই মিলে খাবো।

যুদর বলে, তুমি কী যে বলো মা, শুকনো রুটি আর পনিরই খাবে শুধু। কেন, মধুর বিরিয়ানী, মাংসের কোপ্তা, ভেড়ার কাবাব, মোরগ মসাল্লাম, পেস্তার বরফি, আফগানী হালওয়া, মধু—এসব তোমার পছন্দ নয়?

ছেলের মুখে এই সব দুষ্প্রাপ্য খানাপিনার ফিরিস্তি শুনে মা ভাবে, হয় ছেলে তার সঙ্গে তামাশা করছে, নয়তো মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আতঙ্কিত হয়ে সে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, যুদর এসব কী পাগলের মতো প্রলাপ বকছিস বাবা? তুই খোয়াব দেখছিস, না পাগল হয়ে পড়লি? এতো সব বাদশাহী খানাপিনার ফর্দ দিচ্ছিস। বলি, তাদের একটাও কী আমরা চোখে দেখেছি কখনও?

-দেখনি! কিন্তু আজ থেকে দেখবে এবং এখনি দেখবে। এই মুহূর্তে যেসব খানার নাম করলাম, তার সব তোমার সামনে হাজির করছি, মা। তোমার ছেলে কী তোমার সঙ্গে হাসি মজাক করতে পারে? ঐ খালি থলেটা আমাকে একবার দাও তো মা ছেলের হাতে যাদু থলেটা তুলে দিলে যুদর থলিটার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে এক এক করে থালা ভর্তি সব খাবারগুলো বের করে মেজেতে কাপড়ের ওপর রাখে। সুগন্ধে ভরে ওঠে ঘর। মা হাঁ হয়ে দেখতে থাকে।

—হ্যাঁ বাবা, দেখে তো মনে হয়েছিলো, থলেটা খালি! তা এতো সব খাবার দাবার ছিলো ওর মধ্যে।

যুদর বলে, ছিলো না। কিন্তু এখনই এলো। দেখছো না, ধোঁয়া উঠছে। বাস ছাড়ছে। সদ্য রান্না করা। হাত দিয়ে দেখ, কী গরম?

মা বেচারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।

-বলিস কী বাবা, এ যে ভূতুড়ে কাণ্ড। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু কী ব্যাপার বলতো, বাবা?

যুদর বলে, এই আশ্চর্য যাদু-থলেটা আমাকে সেই বৃদ্ধ মুর দিয়েছে মা। এর অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা। খানাপিনা বলতে যা বোঝায়—সব পাওয়া যাবে এই থলেয়। শুধু নামটা মনে করে থলেয় হাত ঢোকাতে হবে। ব্যস, আর কোনও ঝামেলা নাই। পলকের মধ্যে তোমার হাতে এসে যাবে গরমাগরম সেই সব খাবার ভর্তি থালা। তা সে হাজার কিসিমেরই হোক না কেন। সব এসে হাজির হবে এক পলকে। তবে একটা কথা, খানাপিনা শেষ হয়ে গেলে এই সোনার থালাগুলো আবার ভেতরে পুরে দিতে হবে। সুতরাং বুঝতে পারছো মা, সারা জীবনে আমদের আর খানাপিনার জন্যে কোনও চিন্তাভাবনা করতে হবে না।

মা জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ বাবা ক’জন মানুষের খানাপিনা পাওয়া যাবে?

—কত জনের দরকার মা? তোমার ছেলেদের শাদী দাও। হাজারো মেহেমানকে নেমন্তন্ন করো। দেখো, কোনও অসুবিধা হবে না। তাদের সবাইকে পেট পুরে খাইয়ে দেব আমি। তোমার যাকে খুশি ডেকে যত খুশি খাওয়াতে পারো,। কিন্তু একটা কথা, এই আজব থলের কথাটা কারো কাছে ফাস করো না। মুর সাহেব বার বার বারণ করে দিয়েছেন। এর গোপন রহস্য কাউকে জানাবে না কোনও দিন।

—তুই কী পাগল হয়েছিস বাবা, এসব কথা কাউকে বলতে আছে?

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো সাতাত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

এমন সময় সলিম সালিম দুই ভাইয়ে সদর দরজায় পা দিয়েই হাঁফ ছাড়তে ছাড়তে ঘরে আসে।

—মা বড় খিদে পেয়ে গেছে, শিগগির খেতে দাও—

কিন্তু মুখের কথা আর শেষ হয় না। নানারকম সুগন্ধী খাবারের থালায় সারা ঘর ভর্তি দেখে ওরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দরজায় মুখেই দাঁড়িয়ে পড়ে। খাবারের থালাগুলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে জুল জুল করে তাকিয়ে থাকে। জীভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে বলে, হেই বাপ, এসব কী? অঃ, ছোট এনেছে বুঝি!

তিন ভাই আর মা মিলে রসনার তৃপ্তি করে খেলো সে রাতে। তার পরদিনও ঐ রকম বাহারী বাদশাহী খানাপিনায় সাজানো হলো কাপড়। সকলে বেশ তৃপ্তি করে খেলো। তারপর দিনও একই ব্যাপার। সলিম সালিম অবাক হয়ে। রোজ রোজ এমন দামী দামী খানাপিনা খাওয়াচ্ছে তার

– ভাই যুদর। নিশ্চয়ই সে বিদেশ থেকে অনেক মাল-কড়ি নিয়ে এসেছে।

কয়েক দিন বিশ্রাম নেবার পর যুদর বাজারে যায়। এবার একটা দোকান-পাটের সন্ধান করতে হবে। বৃদ্ধ মুরের উপদেশ সে স্মরণ করে। সঙ্গে যা হীরে জহরৎ আছে তার অল্প কিছু দিয়েই একটা লাগসই দোকান সে কিনতে পারবে। ভালো করে সাজিয়ে গুজিয়ে বসতে পারলে অচিরেই শহরের সেরা সওদাগর হতে পারবে সে।

যুদর-এর অনুপস্থিতির সুযোগে সলিম সালিম মাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা মা, যখন আমরা যা খেতে চাই, তুমি ও-ঘরে ঢুকেই তা নিয়ে আস কী করে? এতো সব খাবার বানাও কখন?

—ও মা, বানাতে যাবো কেন?

—তবে? কেন জানিস না, যুদর দু’টো থলে এনেছে বিদেশ থেকে। তার একটা হীরে জহরতে ভর্তি। আর একটা খালি। কিন্তু খালি হলে কী হবে। থলেটা যাদুমন্ত্র করা। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে যে খাবারই চাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে এসে যাবে। তা না হলে এতো হরেক রকমের গরম গরম খানাপিনা খাচ্ছিস কী করে?

সলিম সালিম গোপনে যুক্তি করে! সলিম বলে, একটা ফন্দী বের করতে হবে। সালিম জিজ্ঞেস করে, কী রকম ফন্দী?

-মায়ের কাছ থেকে ঐ থলে লোপাট করতে হবে?

—কিন্তু যুদর জানতে পারলে–?

—জানতে যাতে না পারে তারই ব্যবস্থা করতে হবে।

—কী ব্যবস্থা?

-সুয়েজ বন্দরের কাপ্তান আমার চেনা। চলো, তার কাছে যাই। যুদরকে যদি সুয়েজে নিয়ে গিয়ে কাপ্তানের কাছে বিক্রি করে দিই, সে লুফে নেবে। ওরা জাহাজের দাঁড় টানবার লোক খুঁজছে। কিন্তু সমুদ্রের নোকরীতে কেহ যেতে চায় না।

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহারাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো আটাত্তরতম রজনী। আবার সে বলতে শুরু করে :

সালিম বলে, কিন্তু কী করে যুদরকে সেখানে নিয়ে যাবে?

সলিম বলে, আমরা নিয়ে যাবো কেন? কাপ্তানকে আমাদের বাড়িতে রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন করবো। বলবো, ‘আপনি দু’জন পালোয়ান খালাসীকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। তারপর কী করে কী করতে হয় তুমি দেখে নিও।

দুই ভাই সুয়েজে এসে কাপ্তানের সঙ্গে দেখা করে। সালিম বলে, আমরা একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।

কাপ্তান বলে, বেশ, বলল।

সলিম বলে, এ আমার ভাই। আরও একটি অপগণ্ড ভাই আছে আমাদের। বাবা মারা যাওয়ার সময় সকলকে সমান ভাগ করে দিয়ে গিয়েছিলেন তার বিশাল সম্পত্তি। কিন্তু আমাদের ঐ ছোট ভাইটি তার অংশের সবকিছু দু’দিনেই উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আমাদের ঘাড়ে ভর করেছে। প্রথম সে আমাদের নামে নানা রকম মিথ্যা কথা রটাতে থাকলো। পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে কঁদুনি গাইতে লাগলো, আমরা নাকি তাকে ফাঁকি দিয়েছি। তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছি। কিছু খারাপ পড়শী তাকে বদবুদ্ধি দিলো। তাদের কথায় নেচে আমাদের দুই ভাইয়ের নামে সে মামলা দায়ের করলো। অনেক দিন ধরে চললো সে মামলা। কাজী ব্যাটা ঘুষ খেয়ে আমাদের যথা সর্বস্ব জরিমানা করলো। এতেও কিন্তু আমার ভাইটি ক্ষান্ত হলো না। পরপর আর দুটি মামলা রুজু করলো আমাদের নামে। সে মামলা দুটি অবশ্য ধোপে টেকেনি। কিন্তু তার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমরা। আমাদের ঘাড়েই খাবে এবং আমাদের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র আঁটবে—এখন এই তার একমাত্র কাজ। এরকম কাল সাপ নিয়ে কতদিন বাস করা যায়, বলুন। তাই আমরা আপনার দ্বারস্থ হয়েছি আজ। একমাত্র আপনিই আমাদের বাঁচাতে পারেন।

কাপ্তান বলে, কিন্তু আমি তোমাদের বাঁচাতে পারবো কী করে?

সালিম বলে, যুদরকে আমরা আপনার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। আপনি ওকে এনে জাহাজে দাঁড়টানার কাজে লাগান।

কাপ্তান বললো, তা মন্দ বলনি। এ রকম দুষ্ট গরুকে দাঁড়ে বসিয়ে দিলে শায়েস্তা হবে। কিন্তু ওকে নিয়ে আসবে কী করে?

সে ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। আজ রাত আপনি দু’জন তাগড়াই খালাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসুন। সেখানে আপনার জন্যে খানাপিনার বন্দোবস্ত করবো আমরা। আপনি আমাদের মহামান্য মেহেমান হয়ে আজকের রাতটা আমাদের বাড়িতেই কাটাবেন। তারপর রাত গভীর হলে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, ওকে বেঁধে আপনার লোকরা নিয়ে চলে আসবে।

কাপ্তান বললো, কিন্তু তাকে কাঁধে তুলতে গেলেই তো ঘুম ভেঙ্গে যাবে তার। তখন তো চেঁচামেচি চিৎকার করবে!

-না তো করবে না। আমি সে ব্যবস্থা করেছি। তার খাবারের সঙ্গে কিছু ঘুমের দাওয়াই মিশিয়ে দেবো। তা হলে সে আর জাগবে না।

কাপ্তান হাসলো, বাঃ, বেড়ে বুদ্ধি তো তোমার। ঠিক আছে, খানাপিনা ঠিক রেখ। আজ রাতেই যাবো। আচ্ছা-কি দাম নেবে বলো? চল্লিশ দিনার?

সলিম বললো, খুবই কম হলো। তবু আপনার কথাই মেনে নিলাম। কারণ, আমরাও তো আপদ বিদায় করে নিষ্কৃতি পাবো। তা হলে ঐ কথাই রইলো। আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা আপনার জন্যে বড় মসজিদের পাশে অপেক্ষা করবো।

কাপ্তান বললো, ঠিক আছে।

দুই ভাই তখন বাড়িতে ফিরে এসে দুপুর বেলায় খেতে বসে নানা খোস গল্প করতে থাকে। এক সময় সলিম বলে, যুদর, আজ তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই একটা কাণ্ড করে এসেছি।

যুদর অবাক হয়ে তাকায়, কী ব্যাপার?

-না না, ভয় পাওয়ার মতো কিছু না। আমার এক পেয়ারের দোস্ত প্রায়ই আমাদের দু’জনকে তার বাড়িতে ডেকে ভুরি ভোজ করায়। বেশ বড় লোক সে। পয়সা আছে—দেদার খরচা করে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে খানাপিনা করে। কিন্তু আমরা তার বদলা দিতে পারি না। তা এখন যখন তোমার দৌলতে আমাদের অভাব বলতে কিছু নাই, তাই ভাবলাম বন্ধুটিকে ডেকে ভালো মন্দ কিছু খাওয়াই। সেই ভেবে আজ সকালে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমরা। ইচ্ছে ছিলো ওকে একাই আসতে বলবো আজ রাতে। আমাদের সঙ্গে খাবে। কিন্তু ঐ সময় ওর ঘরে ওর দুই ভাই বসেছিলো। বাধ্য হয়ে ওদেরও বলতে হলো। ভাবছি কাজটা বোধহয় ভালো করি নি। আগে অন্তত তোমার মতামত নেওয়া উচিত ছিলো। নানা কাজের মানুষ তুমি, হয়তো না। আজ রাতে তেমার সময় সুবিধে নাও থাকতে পারে।

যুদর বলে, তাতে কী হয়েছে। আমি থাকি না থাকি তাতে কী তোমাদের মেহেমানদের খানা-পিনার কিছু অসুবিধে হবে? মাকে বললেই সে সব ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। যা যা খাওয়াতে চাও, সব গরম গরম পাবে। আর তা ছাড়া আমি তো থাকবেই।

সন্ধ্যা বেলায় দুই ভাই বড় মসজিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু পরে কাপ্তান তার দুই সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হলো।

নানা উপাচারে খানাপিনা শেষ হলো। আশ্চর্য যাদু-থলের কল্যাণে প্রায় চল্লিশ রকম বাদশাহী খাবার-দাবার এনে দিলো ওদের মা। সলিম কায়দা করে যুদরের অলক্ষ্যে তার খাবারের মধ্যে এক ডেলা আফিং মিশিয়ে দিলো।

খাওয়া শেষ হতে না হতেই যুদর ঘুমে টলে পড়ে। রাত গভীরতর হলে দুই ভাই যুদরকে একটা কালো কাপড়ের থলেয় ভরে কাপ্তানের চাকরদের কাঁধে তুলে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমন্ত যুদরকে নীদর ঘাটে বাঁধা ছোট একটা নৌকায় নিয়ে গিয়ে ফেলে। তারপর সোজা সুয়েজে চলে যায়।

কাপ্তানের ডেরায় যুদর মুলত বন্দী হয়ে থাকে। তার পায়ে বেড়ি পড়িয়ে জাহাজের দাঁর টানার কাজে লাগানো হয়। এইভাবে কপালের ফেরে বহু ধনসম্পত্তির মালিক হয়েও যুদর আজ এক নগণ্য ক্রীতদাস হয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হলো।

রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো ঊনআশিতম রজনী। আবার গল্প শুরু হয় :

সকাল বেলায় সলিম এবং সালিম ঘুম থেকে উঠে ওদের মায়ের কাছে গিয়ে বললো, মা যুদর কী জেগেছে?

মা বলে, না বাবা আমি কোনও সাড়া পাইনি। বোধ হয় এখনও ঘুমিয়েই আছে। যা ডাক। আমি নাস্তা পানি দিচ্ছি। এক সঙ্গে বসে খা তোরা।

দুই ভাই পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে বলে, কই মা, ঘরে তো যুদর নাই।

মা বলেন, কিন্তু আমি অনেক ভোরেই জেগে গেছি। কই, তার ওঠার তো কোনও আওয়াজ পাইনি। এতো ভোরে সে গেলো কোথায়?

সলিম বলে, আমার মনে হয়, সে ঐ কাপ্তানের সঙ্গে বন্দরে চলে গেছে। ওর কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম, সাগর অভিযানের খুব সখ। হয়তো জাহাজে চেপে সাগর পাড়ি দেবে। সাগরপারের কোন দ্বীপে নাকি অঢেল ধনরত্ন আছে। হয়তো সেই রত্ন-ভাণ্ডারের সন্ধান করতে বেরিয়ে গেছে সে।

মা বললো, হতেও পারে। আমাকে বললে আমি রাজি হবো না, এই আশঙ্কাতেই কিছু না বলে চলে গেছে।

সলিম বলে, সে জন্য কোনও চিন্তা ভাবনা করো না, মা। যুদর ধনদৌলতের বরাত নিয়ে জন্মেছে। তুমি দেখে নিয়ে, আবার সে অনেক পয়সা কড়ি নিয়ে দেশে ফিরবে।

কিন্তু মায়ের প্রাণ কিছুতেই প্রবোধ মানে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।

সলিম চিৎকার করে ওঠে, শোনো মা, যুদর-এর জন্য তোমার দরদ খুব বেশি। কিন্তু আমরাও তোমার পেটের সন্তান। আমাদের জন্যে তো তোমার চোখে এক ফোটা পানি ঝরতে দেখিনি কোনও দিন? তুমি মা হয়ে আমাদের সঙ্গে সৎ মায়ের মতো ব্যবহার করো। আমাদের সুখ-দুঃ খের কথা একবারও ভাবো না। কিন্তু কেন? শুধু সে-ই কী তোমার সন্তান? আমরা নই?

মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, নিশ্চয়ই, তোমরাও আমার পেটের সন্তান। কিন্তু আজ আমার ভাবতে কষ্ট হয়, তোমাদের মতো অপদার্থ শঠ শয়তান কুলাঙ্গার ছেলেদের আমি কী করে জঠরে ধরেছিলাম। তোমাদের বাপজান মারা যাওয়ার পর থেকে একটা দিনের তরে আমাকে শান্তিতে কাটাতে দাওনি। বাপের রেখে যাওয়া বিষয়-আশয় দুদিনে ফুঁকে দিয়ে তোমার ছোট ভাই আর আমার ভাগের বিষয়টুকুও আত্মসাৎ হয় করেছ। একটা দিন রোজগার-পাতির ধান্দায় বেরুলে না। হয় আমার না হয় তোমার ভাই-এর ঘাড়ে চেপে রইলে। আমি বুড়ো হয়েছি, আমি তোমাদের গর্ভধারিণী মা, তোমাদের কী উচিত না—আমার ভরণপোষণ করা? সে চুলোয় যাক, নিজেদের খাওয়া-পরা জোগাড় করার যোগ্যতাও

তো তোমাদের নাই। বড় ভাই হয়ে এইভাবে ছোট ভাই-এর ঘাড়ে বসে বসে খেতে তোমাদের শরম লাগে না? এরপর সলিম সালিম বুড়ো মাকে বেদম প্রহার করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যুদরের থলে দুটো ঘরের বাইরে নিয়ে আসে।

-এ সবই আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। আমাদের ফাঁকি দিয়ে তুমি ছোট ছেলের জন্যে লুকিয়ে রেখেছিলে।

মা বলে, আল্লা কসম, যুদর বিদেশ থেকে রোজগার করে এনেছে। ও জিনিসে তোরা হাত দিসনি।

-তুমি চুপ কর। ছোট ছেলের হয়ে আর তোমাকে দালালি করতে হবে না। এসব আমাদের বাবার বিষয়। হকের জিনিস। আমরা ছাড়বো না!

মা কাতরভাবে কাকুতি মিনতি করতে থাকে, না না, শোন, ওই থলে দু’টো যুদরকে দিয়েছে এক বৃদ্ধ মুর। তোদের বাবা এসব কিছু রেখে যায়নি

—মিথ্যে কথা। তুমি একটা ডাহা মিথ্যুক। এগুলো আমরা দু’ভাই ভাগ করে নেবো। মায়ের কোনও কথায় ওরা কর্ণপাত করে না। নিজেরা ভাগ-বাঁটোয়ারায় মশগুল হয়ে পড়ে।

ধন-রত্নাদি ভাগ করতে বিশেষ অসুবিধে হয় না। কিন্তু গোলমাল বাধলো আসল বস্তুটি নিয়ে। দু’জনেই দাবী করে বলে ঐ অলৌকিক যাদু-থলেটা। সালিম বলে, আমিই সব ফন্দী ফিকির বের করেছি যুদরকে সরাবার। সুতরাং থলেটা আমারই প্রাপ্য।

কিন্তু সলিম বলে, সে কি করে হয়? আমার সাহায্য ছাড়া তোমার প্যাচ-পয়জার কাজে লাগাতে পারতে? ওটা আমার চাই-ই চাই।

সালিম চিৎকার করে পাড়া মাথায় তোলে।

ছাড়বে না মানে? ছাড়তে হবে তোমাকে। তা না হলে তোমার সব শয়তানীর কেচ্ছা আমি ফাঁস করে দেবো সকলের কাছে।

-কী, কী ফাঁস করে দিবি শুনি? ভেবেছিস, বলে দিয়ে শুধু আমাকেই ফঁসাতে পারবি? তোকে ধোয়া তুলসী পাতা বলে ছেড়ে দেবে লোকে? মরি তো তোকে সঙ্গে নিয়ে মরবো।

সালিম হুঙ্কার ছাড়ে, সে-ভি আচ্ছা। ফাঁসী যেতে রাজি আছি। কিন্তু তোর গুণের কীর্তি আমি বলবো’সবাইক।

সালিম, বলে, সে তুই যাকে খুশি, যা ইচ্ছে বলতে পারিস। এই থলে আমি ছাড়বো না। সালিম একটা ডাণ্ডা তুলে নিয়ে রুখে আসে, ছাড়বি না মানে; তোর বাপ’ ছাড়বে সলিম বেগতিক দেখলো। সালিম তার মাথায় হয়তো বসিয়ে দেবে। মা গো’ ‘বাবা গো’ বলে চিৎকার করতে করতে দু’টো থলেই বগলদাবা করে সে ছুটতে থাকে।

সালিমের মাথাতে তখন খুন চেপে গেছে। সে-ও পিছনে পিছনে তাড়া করে চলে। দুই ভাই-এর কেলেঙ্কারী কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য পটাপট বাড়ির দরজা জানালা খুলে মেয়েরা নাকাব সরিয়ে মজা অনুভব করতে থাকে। রাস্তায় লোক জমায়েৎ হয়ে যায়। এমন সময় সুলতানের দরবারে যাচ্ছিল কোতোয়াল। ব্যাপারটা তার নজরে পড়ায় সিপাইদের হুকুম করে, পাকড়াও করে নিয়ে এসো ওদের।

দরবারে হাজির করা হয় দুই ভাইকে। সুলতান সামস অল দুলহা দেখলো, একটা থলে বোঝাই হীরে জহরৎ। সে ভেবে অবাক হয়, এতো অমূল্য ধন-রত্ন এরা কোথায় পেলো? তার কোষাগারেও তো এ সম্পদ নাই!

—কোথেকে চুরি করেছিস? —ধর্মাবতার, এ সব চুরির জিনিস নয়।

সুলতান গর্জে ওঠে, সাফ সাফ সত্যি কথা বল, কোথায় এবং কার ঘরে কে সিঁদ কেটেছিস।

—বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, এসব আমার ছোট ভাই যুদর…

-চোপ রও, সুলতান হুঙ্কার ছাড়ে। আবার ছোট ভাই-এর ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। কোতোয়াল, এদের দু’টিকে অন্ধকার ফাটকে কয়েদ করে রেখে দাও। যতদিন না সত্যি কথা কবুল করে ততদিন ওরা ঐ আঁধিরা ঘরেই বন্দী থাকবে।

উজিরকে বললো সে, এদের মাকে দিন-গুজরান-এর মতো একটা মাসোহারা পাঠিয়ে দিও।

 

এবার যুদরের কাহিনী শুনুন।

সুয়েজ বন্দরের কাপ্তান যুদরকে খাটিয়ে খাটিয়ে ফর্দা-ফাঁই করে দিতে লাগলো। যুদর আর কী করবে। অদৃষ্টের ফের—অস্বীকার করবে কী করে সে? যতদিন কপালে দুর্ভোগ লেখা আছে, ভোগ করতেই হবে।

এইভাবে সাগরে পাড়ি দিতে দিতে এক পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে যুদরদের জাহাজখানা খান খান হয়ে যায়। সঙ্গী সাথীরা কে কোথায় তলিয়ে গেলো, কে তার হদিশ রাখে। যুদর কোনও রকমে পাহাড়ের শিলাখণ্ড আঁকড়ে ধরে প্রাণ রক্ষা পরতে পারে। অনেক কষ্টে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে সে তীরের সমতলভূমিতে পা রাখে। অচেনা অজানা দুর্গম মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে অবশেষে এক আরব তীর্থযাত্রীদের তাবুতে এসে উপস্থিত হয়। যাত্রীদলের প্রধান জিদ্দার এক সম্ভ্রান্ত সওদাগর। যুদরের জাহাজ ডুবির নিদারুণ কাহিনী শুনে করুণা-পরবশ হয়ে তাকে একটা নোকরী দিতে রাজী হয় সে।

-তুমি কি আমাদের সঙ্গে জিদ্দায় যেতে রাজি আছ? তাহলে তোমাকে কাজে বহাল করতে পারি।

যুদর সম্মতি জানায়। সওদাগর যুদরকে সাজ-পোশাক দেয়। বলে, আমরা মক্কায় হজে যাচ্ছি। তুমি আমাদের ফাই-ফরমাস খাটবে। হজ শেষ করে আমরা জিদ্দায় ফিরে যাবো। তোমাকেও নিয়ে যাবো সঙ্গে করে।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো আশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

একদিন তারা মক্কায় এলো। যুদর নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। কাবাহ প্রদক্ষিণ করার জন্য পুণ্যার্থীরা মিছিল করে অগ্রসর হতে থাকে। যুদরও ওদের সামিল হয়। এইভাবে কাবাহ-কে সাতবার প্রদক্ষিণ করার সময় হঠাৎ সেই বৃদ্ধ যাদুকর মুরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার!

—আরে যুদর না? এই বয়সে তুমি এখানে? হজে এসেছো?

চোখের জল ফেলতে ফেলতে যুদর তার দুঃখের কাহিনী বলে বৃদ্ধকে।

বৃদ্ধ আবাদ অল সামাদ তাকে তার নিজের ডেরায় নিয়ে যায়। মূল্যবান সাজ-পোষাক পরায়। ভালোভাবে খানাপিনা খাওয়ায়।

তোমার দুঃখের দিন ফুরিয়ে এসেছে, যুদর। আমি গুনে পড়ে দেখলাম, এবার তোমার সুখের দিন আসছে। সে সুখের তুলনা নাই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আর কেউ তোমার পথে বাধা হতে পারবে না।

যুদর জিজ্ঞেস করে, আমার ভাইরা কেমন আছে, জনাব?

বৃদ্ধ বলে, তোমার ভাই-অন্ত প্রাণ। কিন্তু সেই শয়তান ভাইদের জন্যেই আজ তোমার এই হাল। তারা তোমার থলে দুটো নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলো। সেই সময় সুলতানের দরবারে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সুলতান থলে দুটো কেড়ে নিয়ে ওদের অন্ধকার ফাটকে কয়েদ করে রেখেছে।

আর আমার মা?

—তাকে সুলতান অনুগ্রহ করে সামান্য কিছু মাসোহারা দিচ্ছে। সে যাক, ও-নিয়ে এখন চিন্তা করো না। মক্কায় এসেছে, তীর্থ ধর্ম কর। যত দিন না ধর্ম-কর্মের পাঠ শেষ হয় ততদিন তুমি আমার সঙ্গেই থাক। তারপর আমি আমার দেশে ফিরে যাবো। তোমাকেও পাঠিয়ে দেব কাইরোয়।

যুদর বলে, আমাকে একবার আমার মনিবের সঙ্গে দেখা করে আসতে দিন, জনাব। তিনিই এই বিপদের দিনে আমাকে প্রথম আশ্রয় দিয়েছেন। তার অনুমতি নিয়ে আপনার সঙ্গে আপনার বাড়িতে এসেছি। এখন যদি নোকরী ছেড়ে দিয়ে আমি দেশে ফিরতে চাই, তবু তো তার অনুমতি দরকার।

-আলবাত দরকার। তুমি এক্ষুণি যাও তোমার মনিবের কাছে। তাঁকে গিয়ে বলল, তোমার আপনজনের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেছে এখানে। সে তোমাকে স্বদেশে পৌঁছে দেবে।

যুদর জিদ্দার সওদাগরকে গিয়ে বলে, আপনার উপকার আমি ভুলবো না। কিন্তু আমি দেশে ফিরে যাবার একটা উপায় করতে পেরেছি। আপনি যদি মেহেরবানি করে আমাকে খালাস করে দেন

-এতো বহুৎ আনন্দের কথা, বেটা। নিজের দেশে ফিরতে পারবে, তার চাইতে ভালো আর কী হতে পারে! আমি খুশি মনে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি চলে যাও। এই নাও কুড়িটা দিনার। তোমার মজুরীর পাওনা। এটা নিয়ে দায়মুক্ত করে যাও।

যুদর দিনারগুলো হাত পেতে নিয়ে বলে, আপনার সব পাওনা-গণ্ডা আমি বুঝে পেলাম। আর কোনও দাবি দাওয়া রইলো না আমার।

মুর-এর বাসগৃহের পথে আসার সময় এক অতি দিন দীন-দরিদ্র ভিখারীর হাতে ঐ কুড়িটা দিনার দান করে দিলো যুদর।

এরপর তীর্থমেলার দিনগুলো আনন্দের মধ্যে কাটিয়ে অবশেষে একদিন ঘরে ফেরার দিন সমাগত হলো। বৃদ্ধ মুর তার হাতের সেই মন্ত্রসিদ্ধ যাদু আংটিটি যুদরের আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে বললো, আজ থেকে এটার মালিক তুমি। এই অলৌকিক আংটির দৌলতে তুমি ইচ্ছা করলে বিশ্ব বিজয় করতে পারো। এই মোহরটায় হাত রেখে ঘষামাত্র এক জিন এসে দাঁড়াবে তোমার সামনে। তার নাম বজ্ৰদানব, সে তোমাকে সেলাম করে বলবে, বান্দা হাজির, মালিক। হুকুম করুন কী করতে হবে? তখন তুমি যদি তাকে হুকুম কর, এখনই—এই মুহূর্তে তুমি এক নতুন শহর গড়ে তোলো। দেখবে পলকে সে তৈরি করে দিয়েছে এক মনোহর শহর-সভ্যতা। কিংবা যদি বলল, আমি চাই অমুক সুলতানের সলতানিয়ৎ ধ্বংস করে দাও। মুহুর্তে সে ধূলায় মিশিয়ে দেবে সেই সলতানিয়ৎ। শত্রুকে পরাভূত করার এমন অস্ত্র আর দুটি হয় না।

যুদর বৃদ্ধ মুরকে অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিয়ে আংটির মোহরে হাতের তালু ঘষে। সঙ্গে সঙ্গে বজ্ৰদান এসে সেলাম করে দাঁড়ায়, বান্দা হাজির মালিক, কুম করুন,কী করতে হবে।

যুদর বলে, আমাকে আমার স্বদেশ কাইরোয় নিয়ে চলো।

বজ্ৰদানব মাথা নুইয়ে বলে, আজই আপনাকে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি, মালিক।

এই বলে সে যুদরকে তার পিঠে তুলে নিয়ে উল্কার বেগে আকাশ পথে ছুটে চলে কাইরোর দিকে। দুপুর বেলায় যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এবং মাঝ রাত্রে যুদরকে সে তার বাড়ির ছাদে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ছেলেকে আবার ফিরে পেয়ে মা-এর সে কি আকুল কান্না। কীভাবে বড় ছেলেরা তাকে প্রহার করে বেঁধে রেখে তার থলে দুটো লোপাট করে পালাচ্ছিল, এবং সুলতানের রোষে পড়ে আজ কয়েদখানায় কী দারুণ দুর্দশা ভোগ করতে হচ্ছে তাদের—সব বিস্তারিত ভাবে খুলে বললো যুদরকে।

মা ছেলেকে বুকে চেপে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে। যুদর বলে, চোখের পানি মুছে ফেলো, মা। এইবার দেখ আমার কেরামতি।

হাতের আংটি ঘষতেই বজ্ৰদানব এসে সেলাম ঠুকে দাঁড়ালো, বান্দা হাজির মালিক, হুকুম করুন।

বজ্ৰদানব, আমার দুই ভাইকে কয়েদ করে রেখেছে এখানকার সুলতান। এক্ষুণি তাদের এখানে নিয়ে এসো।

—জো হুকুম, মালিক। পলকের মধ্যে সে সলিম-সালিমকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো যুদরের সামনে।

দুই ভাই কারাগারের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর দিন গুনছিলো। হঠাৎ বজ্ৰদানব তাদের পিঠে তুলে নিয়ে পাতাল প্রদেশ দিয়ে বেরিয়ে যেতেই তারা ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কিন্তু শেষে যুদর এবং মাকে দেখতে পেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়।

যুদর বলে, তোমরা এতোদিন মাকে ছেড়ে কোথায় ছিলে ভাই? এভাবে বুড়ো মাকে কষ্ট দিতে হয়?

ভয়ে দুঃখে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায় ওরা। অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। এমন যে তাদের ভাই-তার সঙ্গে তারা কি দুর্ব্যাবহারই না করেছে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো একাশিতম রজনী। আবার সে বলতে শুরু করে :

দু-ভাই অনুতপ্ত হয়ে কাঁদতে থাকে। যুদর সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কেঁদো না ভাই, শয়তান তোমাদের ওপর ভর করেছিলো। তা না হলে জাহাজের কাপ্তানের কাছে আমাকে বেচে দেওয়ার দুর্মতি হবে কেন তোমাদের? যাই হোক, যা হবার তা হয়েছে, কেঁদো না। আমি মহামতি জোসেফের কাহিনী স্মরণ করে আমার নিজের দুঃখ কষ্ট কিছু হালকা করতে পেরেছি। জোসেফকেও একদিন তার ভাইরা অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো। তোমরা আমার প্রতি যে দুর্ব্যবহার করেছ তার অনেক বেশী খারাপ আচরণ তারা করেছিলো জোসেফের সঙ্গে। তারা তাকে এক ঊষর মরুভূমির মধ্যে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। আল্লাহর কাছে দোয়া মাঙো। তিনিই তোমাদের সব গোস্তাকি মাফ করে দেবেন। আজ থেকে তোমরা আমার শুধু সহোদর ভাই নও, পরম প্রিয় বন্ধুও হলে। তোমাদের কোনও ভয় নাই। আমার কাছে নির্ভয়ে থাকো। এই দেখো, আমার হাতে এক অলৌকিক যাদু আংটি আছে। এরই জোরে আজ সুলতানের কারাগার থেকে তোমাদের উদ্ধার করে এনেছি। এর অলৌকিক ক্ষমতায় তামাম দুনিয়া আমার হাতের মুঠোয় আনতে পারি। সুতরাং অন্য কাউকে পরোয়া করার দরকার নাই। কেউ কোনও ক্ষতি করতে পারবে না আমাদের।

দুই ভাই আকুল হয়ে যুদরকে জড়িয়ে ধরে বলে, যা করেছি, তা করেছি। সব অপরাধ ক্ষমা করো ভাই। এরপর যদি কখনও আবার সে-রকম কোনও ব্যবহার করি তুমি আমাদের কঠোর শাস্তি দিও।

যুদর বলে, ওসব কথা থাক, এখন বলো তো ঐ সুলতান তোমাদের কী ধরনের সাজা দিয়েছে।

সুলতান থলে দু’টো কেড়ে নিয়ে কী অমানুষিক প্রহার করে কীভাবে তাদের এক দোজখানায় কয়েদ করে রেখে দিয়েছিলো তার মর্মন্তুদ কাহিনী যুদরকে শোনালো তারা।

যুদর হাতের আংটি ঘষতেই বজ্ৰদানব এসে দাঁড়ালো।

—সুলতানের কোষাগার থেকে আমার থলে দু’টো উদ্ধার করে নিয়ে এসো। আর সেই সঙ্গে কোষাগারের সব ধনরত্নও সাফ করে নিয়ে আসবে।

—জো হুকুম, মালিক। বজ্ৰদানব অদৃশ্য হয়ে গেলো এবং মুহূর্তের মধ্যে যুদরের থলে দুটো নিয়ে এসে বললো, এই নিন মালিক।

শুধু মাত্র যাদু-থলেটা নিজের কাছে রেখে হীরে জহরতের থলেটা এবং সুলতানের কোষাগারের সোনা-দানা টাকা-পয়সা সব মায়ের হেপাজতে রেখে দিলো যুদর। তারপর বজ্ৰদানবকে বললো, আজ রাতের মধ্যে আমার জন্য একখানা, বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে দাও। প্রাসাদের বাইরেটা সোনা দিয়ে বাঁধানো থাকবে। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে বেহেস্ত। সারা দুনিয়ার সেরা হওয়া চাই।

বজ্ৰদানব বললো, আজ রাতেই আমি বানিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালে আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাবেন মালিক, কেমন হলো। এমন প্রাসাদ বানিয়ে দেবো তামাম দুনিয়ায় তার জুড়ি খুঁজে পাবেন না।

–আচ্ছা, এখন তুমি যেতে পারো।

বজ্ৰদানব অদৃশ্য হয়ে গেলো। যুদর তার দুই ভাই এবং মাকে নিয়ে নানা রকম সুগন্ধী মুখরোচক খানাপিনা খেয়ে শুয়ে পড়লো।

সকাল বেলায় বজ্ৰদানব এসে বললো, আপনার প্রাসাদ তৈরি, মালিক। আপনি চলুন দেখবেন।

যুদর দুই ভাই এবং মাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদে পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। এমন আনিন্দ্যসুন্দর শিল্প-সৌন্দর্য কোন বাসগৃহের হতে পারে, সে কল্পনাও করেনি। অথচ এই চমৎকার প্রাসাদটির জন্য তার এক পয়সাও খরচ হয়নি।

মা জিজ্ঞেস করলো, বাবা, এখন থেকে তুই এখানেই থাকবি?

যুদর বলে, শুধু আমি কেন, তোমরা সকলেই বাস করবে এখানে।

বজ্ৰদানবকে ডেকে সে বললো, চল্লিশজন সুন্দর সুঠামদেহী বান্দা, আর চল্লিশটি নিগ্রো আর সুন্দরী বাঁদী চাই, চল্লিশটি খোজাও আমার লাগবে।

সঙ্গে সঙ্গে বজ্ৰদানব অদৃহ্য হয়ে গেলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলো ঐ সব দাস-দাসীদের সঙ্গে নিয়ে। এক এক করে প্রত্যেকটিকে পরীক্ষা করে দেখলো যুদর। সবগুলোই বড় চমৎকার।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো বিরাশিতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

যুদর বললো, এই দাসী ও বাঁদীদের জন্য সুন্দর সুন্দর সাজপোশাক এনে দাও এবং আমার দুই ভাই, মা ও আমার জন্য নিয়ে এস এর চেয়ে জমকালো বাদশাহী সাজপোশাক।

বজ্ৰদানব মুহূর্তের মধ্যেই এনে হাজির করলো যথা-নির্দেশিত পোশাক-আশাক। যুদর শাহেনশাহর সাজে সেজেগুজে সোনার মসনদে গিয়ে বসলো।

সকাল বেলায় সুলতানের খাজাঞ্চি কিছু অর্থ বের করবার জন্য কোষাগার খুলতেই ভয়ে শিউরে ওঠে, একী সর্বনাশ কাণ্ড! সুলতানের ধনাগারে একটা কানাকড়িও নাই?

সুলতান সমীপে ছুটে গিয়ে সে কঁপতে কাঁপতে জানালো, ধর্মাবতার, আজ রাতে ধনাগারের সব সম্পদ চুরি হয়ে গেছে।

সুলতান গর্জে ওঠে, পাজি শয়তান, তোমাকে কোষাগারের ভার দিয়েছি, এই কথা শোনার জন্য? এত কড়া পাহারা, চুরি কী করে সম্ভব?

খাজাঞ্চী বলে, আমি এইসব ভূতুরে কাণ্ডের কিছুই বুঝতে পারছি না, হুজুর। খাজাঞ্চিখানার দরজা যেমন বন্ধ করেছিলাম তেমনি বন্ধ ছিলো। আমি ভালো করে দেখেছি, কোনও সিঁদ-ফিদ কাটেনি কেউ। কিন্তু আশ্চর্য, ঘরে একটা ফুটোও নাই।

—আমি তোমার গর্দান নেব। এসব, তাহলে, তোমার নিজেরই কাজ। যুদরের ঐ দুই থলে? সে দুটোও গেছে?

খাজাঞ্চী মাথা নত করে বলে, হ্যাঁ জাঁহাপনা। সেগুলোও নাই। সুলতান ক্রোধে আরক্ত হয়ে বলে, চল, আমি নিজের চোখে দেখবো।

ধনাগারে প্রবেশ করে তিনি নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করে দেখলেন সব। না, বাইরের কোনও লোক ভিতরে ঢোকেনি, ঢোকা সম্ভবও না। তবে? তবে কী করে সব উধাও হয়ে গেলো রাতারাতি? কার ঘাড়ে দুটো মাথা, এতোবড় দুঃসাহসের কর্ম করবে? ভেবে কোনও কূল-কিনারা করতে পারে না সে।

দরবারের উজির, দেওয়ান, আমির আমাত্য সকলেই স্তব্ধ বিস্ময়ে শিউরে ওঠে। একী সর্বনাশ? সারা দরবার-মহলে কবরের নীরবতা নেমে আসে। কারো মুখে কোনও কথা নাই-চোখে কেবল আতঙ্ক, আর অনন্ত জিজ্ঞাসা।

এই সময় কারাগার-রক্ষী এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ায়, জাঁহাপনা আমি সারারাত অতন্দ্র প্রহরায় ছিলাম। কারাগারের লৌহকপাট অটুট অক্ষুন্নই আছে। কিন্তু সলিম সালিমকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি সব দরজা জানালা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, কোথাও একটা ফুটোও নাই। অথচ ওরা পালিয়েছে।

সুলতান হুঙ্কার ছাড়ে, অপদার্থ! আমি সব্বাইকে আজ শূলে চড়াবো।

কারাগার-রক্ষী বললো, জাঁহাপনা অভয় দেন তো একটা কথা বলি!

—ভণিতা ছাড়ো, যা বলার তাড়াতাড়ি বলল। রক্ষী বলে, আমি দরবারে আসার সময় দেখলাম, বড় ময়দানের ফঁকা মাঠের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা প্রাসাদ–

ঐ নিদারূণ দুঃখের মধ্যেও সকলের মুখে অবিশ্বাসের মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।

সুলতান বলে, সারারাত ধরে গাঁজা-ভাঙ্গ টেনেছ, দেখছি–

-না জাঁহাপনা। অবিশ্বাসের কথাই বটে, একটা রাতের মধ্যে অত বড় পেল্লাই প্রাসাদ কেউ বানাতে পারে এ কথা তো নিজের চোখে না দেখলে মানা যায় না। তাই বান্দার আর্জি, ধর্মাবতার, আপনি নিজে একবার দেখে আসুন। তারপর আমার কথা মিথ্যে হলে যা খুশি সাজা দেবেন।

সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। উজিরকে উদ্দেশ্য করে সুলতান বলে, যাও তো, একবার সরজমিনে দেখে এসোব্যাপারখানা কী!

কিছুক্ষণ পরে উজির এসে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আঁহাপনা। এমন অলৌকিক প্রাসাদ কোনও সুলতান বাদশাহর পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। শুনলাম এক উমরের পুত্র যুদর বানিয়েছে এই হৰ্মমালা। কত লক্ষ কোটি মুদ্রা ব্যয় করলে এবং কত শতসহস্র মিস্ত্রি মজুর কত বছর ধরে কাজ করলে এই সুরম্য ইমারত বানানো সম্ভব তা হিসেব করা যায় না। কিন্তু জাঁহাপনা, শুনে অবাক হবেন, এই সবই সংঘটিত হয়েছে মাত্র একটি রাতের মধ্যে। গতকাল বিকেলেও আমি ঐ ময়দানের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছি। কোথাও কিছু ছিলো না, হঠাৎ এখন দেখলাম, প্রায় সারা ময়দান জুড়ে দাঁড়ায়ে এক বিশাল প্রাসাদ! একি ভুতুড়ে কাণ্ড, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, জাঁহাপনা।

সুলতান চিন্তিত মুখে বললো, একই রাতে তিন তিনটি বিস্ময়কর কাণ্ড! খাজাঞ্জীখানা সাফ, কারাগারের কয়েদী হাওয়া আর ফাঁকা মাঠে এই ইমারত—এ সবগুলো কী বিচ্ছিন্ন ব্যাপার উজির?

উজির বললো, আমিও সেই কথাই ভাবছি। এইসব আজগুবি কাণ্ডকারখানার মধ্যে নিশ্চয়ই এক যোগসূত্র আছে। শুনেছি, উমরের পুত্র বিদেশ সফর করে গতকাল ফিরে এসেছে। আমার মনে হয় এসবই তার কারসাজী।

সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়ে,কী এতো বড় দুঃসাহস। উজির, তুমি এক্ষুণি চল্লিশজনের এক সিপাইবাহিনী পাঠাও। ধরে নিয়ে আসুক ওকে। আমি সদর রাস্তায় ফঁসীতে ঝুলাবো শয়তানকে।

সুলতানের আদেশে শহরের কোতোয়াল তার বিশাল সিপাইবাহিনী নিয়ে দরবারে এসে হাজির হলো।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়। শাহরজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো তিরাশিতম রজনী।

আবার সে বলতে শুরু করে :

উত্তেজিত সুলতানকে উজির শান্ত হওয়ার পরামর্শ দেয়। মহামান্য ধর্মাবতার, আপনি রাগ প্রশমিত করে ভালোভাবে ব্যাপারটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। যে মানুষ এক রাতে এতো বড় ইমারত বানাতে পারে, সে নিশ্চয়ই তুচ্ছ সাধারণ শক্তির অধিকারী নয়। তার প্রতি আপনি কঠোর আচরণ প্রদর্শন করবেন না। আমার মনে হয়, তাতে কোনও সুরাহা হবে না।

-তুমি কী বলতে চাও, উজির?

উজির বলে, আপনি এখন ক্রুদ্ধ উত্তেজিত। প্রথমে নিজেকে শান্ত করুন। তারপর আপনা থেকেই সব বুঝতে পারবেন। যুদর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে। কী সে ক্ষমতা, প্রথমে সেটা জানা দরকার।

সুলতান বলে, ওসব ভেল্কিবাজি দেখিয়ে আমার কাছে কোনও সুবিধে হবে না উজির। এক্ষুণি তাকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে ওর সব ফেরেব-বাজী খতম করে দেব।

উজির দেখলো, সুলতান ক্রোধে দিশাহারা, এখন কোনও ভালো পরামর্শ তার কানে ঢুকবে। তাই সে তাকে একটু অন্যভাবে মোচড় দেওয়ার মতলব আঁটলো।

—জাঁহাপনা, আমার একটা কথা শুনবেন?

—বলো। তোমার কথা শুনে শুনেই তো আজ আমার এই হাল। তবুও বলো দেখি, শুনি।

-শত্রুর শক্তির পরিমাণ না জেনে তাকে নিধন করার চেষ্টা করতে নাই। তাতে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। এ হচ্ছে সমর-নীতি। একথা আপনি মানেন তো?

-আলবাত। কিন্তু আমার নগণ্য এক প্রজা কী আমার সমকক্ষ শত্রু হতে পারে?

উজির বলে, আপাত-ভাবে যা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে তাকে আর নগণ্য প্রজামাত্র বলা বোধহয় সঙ্গত হবে না জাঁহাপনা। নিশ্চয়ই সে কোনও অপার্থিব ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে। কী সে ক্ষমতা—সেইটেই আপনাকে যাচাই করে দেখতে হবে। সেই কারণে আমার ইচ্ছা, আপনি তাকে সম্মানীয় অতিথির মর্যাদা দেবেন, এক ছলনায় আপনার প্রাসাদে আমন্ত্রণ করে পাঠান। সে আসুক। তাকে পর্যবেক্ষণ করুন। তারপর যদি বোঝা যায়, সে আপনার তবে থাকতে চাইবে না, আর কোনও দ্বিধা না করে সেই ভোজসভাতেই তাকে সাবাড় করে দেবেন। শত্রুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের কজায় আনতে হয় প্রথমে। তা না হলে তাকে জব্দ করবেন কী করে?

উজিরের কথাগুলো সুলতানের মনে ধরে, হুঁ, মগজে তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি এখনও কিছু আছে দেখছি। তা মন্দ বলনি। ঠিক আছে, তুমি আমার বিচক্ষণ আমির উথমানকে দৌত্য করতে পাঠাও তার কাছে। আজ রাতে আমার প্রাসাদে এক খানাপিনার আয়োজন করো, সেই ভোজসভায় আমি মোলাকাত করবো যুদরের সঙ্গে। কিন্তু উজির, আমির উথমানকে একা পাঠাবে না। সঙ্গে অন্ততঃ পঞ্চাশজন সিপাই-সান্ত্রী দেবে। দরকার হলে, ও আমার অমন্ত্রণ উপেক্ষা করলে, সে যাতে ওকে বলপ্রয়োগ করে ধরে আনতে পারে, সেজন্য তার সঙ্গে যথেষ্ট সশস্ত্র প্রহরী থাকা দরকার। যে ভাবেই হোক, যুদরকে ধরে আনতেই হবে।

সুলতানের এই আমিরটি সব সময় নিজেকে একজন বিচক্ষণ-বুদ্ধিমান মানুষ বলে জাহির করতো। আসলে সে একটা গবেট। মাথা মোটা লোক।

যুদরের প্রাসাদে এসে সে দেখে, প্রধান ফটকের সামনে বসে আছে এক বিকটাকৃতির প্রহরী। উথমান তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের মালিককে একবার ডাকে। তার সঙ্গে আমার দরকার আছে।

কিন্তু প্রহরী কোনও সাড়া দেয় না। এবার সে চিৎকার করে ওঠে, কী, কথা কানে যাচ্ছে? তোমাদের মালিক কোথায়?

—তিনি প্রাসাদের ভিতরে আছেন।

প্রহরী নির্বিকারভাবে বসে থাকে। উথমান সুলতানের আমির, তাকে গ্রাহ্য করছে না প্রহরীটা। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, তোমাকে না বলছি, তোমার মালিককে ডাকো, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই?

প্রহরী সে কথায় কর্ণপাত করলো না। মুখ ফিরিয়েই বসে রইলো। উথমান এবার আর প্রহরীর বেয়াদপি সহ্য করতে পারে না। হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে সে তেড়ে যায়।

—এতো বড় স্পর্ধা তোর, আমার কথা কানেই তুলছিস না?

এই প্রহরী স্বয়ং বজ্ৰদানব। সাধারণ এক খোজা সেজে সে সদর পাহারা দিচ্ছিল। উথমানের হম্বিতম্বি দেখে সে এবার উঠে দাঁড়ায়। হাতের ডাণ্ডাটা উঁচিয়ে ধরে আমিরের প্রহারোদ্যত লাঠিটাকে প্রতিহত করে। এর পর উথমান মরিয়া হয়ে ঝাপিয়ে পড়লে বজ্ৰদানব তাকে ডাণ্ডা দিয়ে প্রহার করে মাটিতে শুইয়ে দেয়।

এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আমিরের পঞ্চাশজন সিপাই তলোয়ার বের করে তেড়ে আসে। বজ্ৰদানব গর্জে ওঠে, তবে রে, তলোয়ার খুলেছ? দাঁড়াও মজাটা টের পাইয়ে দিচ্ছি।

পলকের মধ্যে প্রলয়-কাণ্ড ঘটে গেলো। বজ্ৰদানব যাদু-বলে সিপাইদের ও ধরাশায়ী করে দিলো। পটাপট পঞ্চাশখানা তলোয়ার এসে পঞ্চাশজনের পেটের মধ্যে গেঁথে গেলো। বিষম আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো সকলে। রক্তের নদী বয়ে যেতে লাগলো সেখানে।

এই সংবাদ যখন সুলতানের কাছে পৌঁছলো, নিদারুর ক্রোধে ফেটে পড়লো সে। উজিরকে হুকুম করলো, এক্ষুণি একশো সিপাই পাঠাও! সুলতানের নির্দেশে তৎক্ষণাৎ একশো সিপাই-এর এক সশস্ত্রবাহিনী পাঠানো হলো। কিন্তু বজ্ৰদানবের দাপটে তারাও নিমেষে ধরাশায়ী হয়ে পড়লো।

সুলতানের হুকুমে আরও দুশো সিপাই গেলো। কিন্তু বজ্ৰদানবের কাছে এসব নেহাতই তুচ্ছ ব্যাপার। এক লহমাতে সে দুশশা সিপাইকেই নিধন করে ফেলে।

এরপর সুলতান ক্ষেপে উঠলো। উজিরকে বললো, পাঁচশো সেনা নিয়ে তুমি আক্রমণ কর ঐ প্রাসাদ। ধূলায় গুড়িয়ে দিয়ে আসবে।

উজির বললো, আপনার আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু জাঁহাপনা আমার কোনও সিপাই-সেনার দরকার নাই। আমি একাই খালি হাতে যাবো তার কাছে।

সুলতান অবাক হয়, একা খালি হাতে যাবে তুমি। কী সাহসে?

উজির বলে, অস্ত্র-সজ্জায় যেখানে কাজ হয় না। সেখানে এছাড়া আর কী উপায়, জাঁহাপনা?

উজির একদরবেশের সাজ-পোশাক করে রিক্তহস্তে এসে উপস্থিত হলো যুদরের প্রাসাদে। খোজাপ্রহরী-বেশী বজ্ৰদানবের সামনে গিয়ে বিনয়াবনত হয়ে বললো, সালাম জনাব।

বজ্ৰদানব উত্তর করে, বলুন নরবর।

নরবর? উজির অবাক হয়ে তাকায় বজ্ৰদানবের দিকে। উজিরকে সে নরবর’ সম্বােধন করলো কেন; তবে প্রহরীর ছদ্মবেশে সে কোন দ্বৈত্যদানব? মানুষ নয়? ভয়ে আতঙ্কে সে শিউরে উঠলো। তার হাত পা ঠক-ঠক করে কাঁপতে থাকলো।

-আমাদের মলিক-যুদর সাহেব কি ভিতরে আছেন?

বজ্ৰদানব বলে, জী হ্যাঁ। প্রাসাদেই আছেন।

উজির বলে, মেহেরবানী করে আমাকে একবার ভিতরে নিয়ে চলুন। আমি তার সঙ্গে একবার মোলাকাত করতে চাই। আমাদের সুলতান সামস অল দুলাহ আজ রাতে তার সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করেছেন। সুলতানের হয়ে আমি ওঁকে নেমন্তন্ন জানাতে এসেছি। যদি উনি অনুগ্রহ করে আজকের সন্ধ্যাটা আমাদের সুলতানের সঙ্গে কাটান, তিনি ধন্য হবেন।

বজ্ৰদানব বললো, আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি মালিককে খবর দিচ্ছি। এই সময় রাত্রি অতিক্রান্ত হয়ে যায়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো চুরাশিতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

উজিরকে বাইরে বসিয়ে রেখে বজ্ৰদানব প্রাসাদের অন্দরে প্রবেশ করে যুদরকে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, মালিক, সুলতান প্রথমে এক উদ্ধত আমিরকে পাঠিয়েছিলো। আমি তাকে প্রহার করেছি। এতে তার পঞ্চাশ জন সিপাই আমাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে আমি তাদের খতম করি। এর পর সুলতান একশো সিপাই-এর একটা বাহিনী পাঠিয়েছিলো আমাকে তথা আপনাকে শায়েস্তা করতে। কিন্তু তাদেরও আমি কোতল করে ফেলি। তারপর সে দুশো সেনার এক বাহিনী পাঠায়। তারাও আমার হাতে নিধন হয়! এর পর এখন সুলতানের উজির এসেছে। তার সঙ্গে কোনও-সৈন্য-সামন্ত নাই। একাই এসেছে সে। সুলতান আপনার সঙ্গে ভেট করতে চায়। আজ রাতে আপনার সম্মানে সে এক ভোজসভার আয়োজন করেছে। সুলতানের তরফ থেকে তারই আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে এই উজির। এখন আপনি যা বলবেন, আমি সেই মতো করবো।

যুদর মণিমাণিক্য-খচিত এক স্বর্ণ-সিংহাসনে আসীন ছিলো। তার পায়ের তলায় ছিলো এক দুষ্প্রাপ্য গালিচা। মাথার ওপর হাজারো মোমের ঝাড়বাতি। বাদীরা চামর দোলাচ্ছিল। একটি ফুটন্ত গোলাপের বাস আঘ্রাণ করতে করতে সে বললো, উজিরকে নিয়ে এসো।

বাদশাহী কেতায় কুর্নিশ জানিয়ে এসে দাঁড়ালো উজির।

—মহামান্য মালিক, আপনার দোস্ত আমাদের সুলতান আজ রাত তার প্রাসাদে আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনি যদি মেহেরবানী করে যান, তিনি কৃতার্থ হবেন।

যুদর বলে, তিনি যখন আমার দোস্ত, তাহলে তো আর কোনও কথাই নাই। আপনি গিয়ে তাকে আবার শুভেচ্ছা জানান। বলুন, আমার দরজা সুলতানের জন্য সর্বদা খোলা আছে। আজ রাতের ভোজ-সভার আয়োজন আমিই করবো আমার এই প্রাসাদে। তিনি যদি আসেন, ধন্য হবো আমি।

আংটিটা ঘষতেই বজ্ৰদানব এসে দাঁড়ায়। যুদর বলে, উজির সাহেবকে বাদশাহী সাজ-পোষাক উপহার দাও।

পলকের মধ্যে বজ্ৰদানব এক জমকালো সাজ-পোষাক এনে উজিরের হাতে তুলে দেয়। যুদর বলে, আপনি পরুন। সুলতানের কাছে গিয়ে এখানে যা দেখে গেলেন, তাঁকে বলবেন।

উজির সেই মহামূল্যবান সাজ-পোশাক পরে যুদরের সামনে দাঁড়ায়। এমন পোশাক সে এই প্রথম চোখে দেখলো।

প্রাসাদে ফিরে এসে সুলতানকে উজির বলে, জাঁহাপনা, যুদর আপনাকেই নিমন্ত্রণ করেছে। আজ রাতে সে আপনাকে ভোজসভায় আপ্যায়ন করবে।

সুলতান বলে, ঠিক আছে, আমার এক সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে আজ যাবো তার ভোজসভায়।

 

বজ্ৰদানব যুদরকে সংবাদ দিলো, মালিক, সুলতান তার লোক-লস্কর, সিপাই সেনাপতি সঙ্গে করে আজ আপনার ভোজসভায় আসছে!

যুদর বলে, ঠিক আছে। তুমিও তোমার লোকজনকে এনে আমার প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাও। দেখেই যাতে সুলতানের হৃদকম্প ধরে যায়—সেইভাবে জাঁদরেল পালোয়ানদের নিয়ে এসে ভরে ফেলল।

সুলতান ফটকে প্রবেশ করতেই দেখতে পায়, দুইদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শ’ যোদ্ধা। একই বেশে, একই অস্ত্রে সুসজ্জিত সকলে! ভয়ে বুক শুকিয়ে যায় তার।

যুদর সিংহাসনে বসে তন্ময় হয়ে কী যেন চিন্তা করছিলো। সুলতান তাকে সালাম জানালো। কিন্তু তখনও সে একমনে কী যেন ভাবছেই। সুলতানের উপস্থিতি সে গ্রাহ্যই করলো না। একবার তাকে বসতেও বললো না সে। সুলতান ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো—অনেকক্ষণ। দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকালো সে। এই অবস্থায় কী করা উচিত। কীই বা করতে পারে সে কিছুই বোধগম্য হলো না।

অবশেষে, অনেকক্ষণ পরে যুদর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্নবাণ ছুঁড়লো।

—দুটি নির্দোষ যুবকের ওপর নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে হাজতের অন্ধকার-কক্ষে রুদ্ধ করে রেখে কী আপনি খুব বীরপুরুষের কাজ করেছিলেন? অন্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিজের ধনাগার ভরানোই বুঝি আপনার একমাত্র পেশা?

সুলতান করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, না জেনে যা অপরাধ করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত, মালিক। আপনি নিজগুণে ক্ষমা করে নিন। আমার অহঙ্কার এবং লোভই আমাকে এই খারাপ কাজ করেছিলো। আপনি মহানুভব, আমি ক্ষমাপ্রার্থী এক অপরাধী। তা দুনিয়াতে অপরাধ আছে বলেই তো ক্ষমার এতো কদর।

এইভাবে নানা সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে যুদরকে সে খুশি করার চেষ্টা করে। যুদর বলে, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আসুন, আমার পাশে বসুন।

এরপর যুদর তার দুই ভাইকে ডেকে বলে, এবার খানাপিনার ব্যবস্থা কর। এখানকার সুলতান আজ আমাদের অতিথি। এঁকে প্রসন্ন করাই এখন একমাত্র কাজ। দেখো, ব্যবস্থার যেন কোনও ত্রুটি না হয়। ভালো ভালো খাবার দাবার-এর আয়োজন কর। যেন কোনও নিন্দা না হয়।

দুই ভাই নিজ হাতে কাপড় বিছিয়ে দিলো। যাদু-থলের দৌলতে নানা রকম দুষ্প্রাপ্য খানাপিনায় সুলতানকে পরিতৃপ্ত করলো যুদর। সুলতান খুশি হয়ে প্রাসাদে ফিরে গেলো!

সেদিন ফিরে গেলো, কিন্তু পরদিন আবার এলো। তারপর দিনও। প্রতিদিনই যুদর সুলতানকে নতুন নতুন কায়দায় আদর অভ্যর্থনা জানাতে থাকলো! এক খানা সে দুদিন খেতে দেয় না তাকে। এক সাজ-পোশাক দ্বিতীয় দিন পরে না কেউ। প্রতিদিনই সুলতান যুদরের প্রাসাদে প্রবেশ করে দেখে, সারা প্রাসাদটা আগাগোড়া নতুন সাজে সাজানো হয়েছে। গতকালের সাজ-সরঞ্জাম, গালিচা পর্দা আসবাব আবরণ আজ দেখা যায় না। আজকের গুলো আবার অদৃশ্য হয়ে যায় আগামীকাল। যুদরের সহৃদয় প্রীতি ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে পারে না সুলতান। প্রতিদিন সে নিয়ম করে আসতে থাকে তার প্রাসাদে।

একদিন কথা প্রসঙ্গে সুলতান উজিরকে বললো, যুদর যেভাবে দোস্তি করছে; শঙ্কা হয়, কোন দিন না সে আমাকে হত্যা করে আমার মসনদ অধিকার করে বসে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো পঁচাশিতম রজনী। আবার সে বলতে শুরু করে :

উজির বলে, আপনার আশঙ্কা অমূলক জাহাপনা। কারণ যুদর এমন সম্পদের মালিক যার কাছে আপনার এই সলতানিয়ৎ নিতান্তই নগণ্য। আপনার মসনদের ওপর তার কোনও লোভ হতে পারে না। তার মতো বিত্ত ও ক্ষমতাবান মানুষ তামাম দুনিয়ায় কেউ নাই। সে আপনার সম্পদে কোনও লোভ দেখাবে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও আপনার মনে যদি ঐ আশঙ্কাই বাসা বেঁধে থাকে, তা হলে বলবো, আপনি তাকে অন্য ফাঁদে বেঁধে ফেলুন।

—কী রকম?

উজির বলে, আপনার একমাত্র কন্যা আসিয়াহ আপনার মসনদের ভাবী উত্তরাধিকারিণী। যুদরকে আপনি জামাতা করে নিন। আসিয়াহর সঙ্গে শাদী হলে সে আপনার প্রাণাধিক পুত্রসম আপনজন হবে। সুতরাং মনেও আর কোনও ডর থাকবে না।

সুলতান নতুন আলোর রোশনাই দেখতে পায়, বলে, কিন্তু কী ভাবে প্রস্তাবটা উত্থাপন করা যায়?

উজির বললো, আজ রাতে আপনিই যুদরকে আপনার প্রাসাদে আমন্ত্রণ করুন এবং সেই ভোজ-সভাতে আসিয়াহকে উপস্থিত রাখুন। তারপর, আসিয়াহ মা-এর যা রূপ-যৌবন, আপনাকে আর মুখ ফুটে কোনও প্রস্তাব দিতে হবে না। সব আপসে সমাধা হয়ে যাবে, দেখবেন। আপনার কন্যা আপনার এবং যুদরের বিশাল বৈভবের একমাত্র মালিক হতে পারবে।

সেইদিন রাতেই যুদরকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনলো সুলতান। ভোজ-সভায় আসিয়াহকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় যুদর। উজিরকে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটি তো অসাধারণ সুন্দরী, উজির সাহেব। কার মেয়ে?

উজির বলে, আপনার দোস্ত-সুলতানের মেয়ে।

যুদর বলে, আমি ওকে শাদী করতে চাই। আপনি সুলতানকে আমার হয়ে প্রস্তাব করুন। তিনি যা দেনমোহর চান, আমি দেব।

উজির সুলতানকে বললো, জাঁহাপনা, আপনার কন্যা আসিয়াহকে শাদী করতে চাইছেন যুদর সাহেব। আপনি যা দেনমোহর চান, তিনি দেবেন।

সুলতান বললো, এতো আমার পরম সৌভাগ্য। আর দেনমোহর? ও নিয়ে আমার কোন দাবি-দাওয়া নাই। আমি জানি, যুদর সাহেব স্বেচ্ছায় যা দেবেন, আমার আকাঙ্ক্ষার চাইতে তা অনেক বেশি। তিনি যে মেহেরবানী করে আমার কন্যাকে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, তাতেই আমি ধন্য।

সেইদিনই কাজীকে ডাকা হলো। বিরাট জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে যুদর-এর সঙ্গে আসিয়াহর শাদী সমাধা হয়ে গেলো।

এর পর বহুদিন ধরে যুদর আসিয়াহকে নিয়ে সুখ-সম্ভোগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছিলো। অবশেষে একদিন সুলতান দেহ রাখলো। উজির আমির প্রজাবৃন্দরা যুদরকে সুলতান হতে অনুরোধ জানালো। যুদর প্রথমে রাজি হয়নি। পরে অবশ্য সকলের অনুরোধ এড়াতে না পেরে মসনদে বসলো।

সুলতান হয়েই প্রথমে সে মৃত সুলতান সামস অল দুলাহর সমাধির ওপর বিরাট একটা মসজিদ বানালো। এই কবর এবং মসজিদটি বুনদাকানিয়াহ অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছিলো। পরে এই অঞ্চলটি জুনারিয়াহ নামে পরিচিত হয়।

যুদর তার দুই ভাই সলিম ও সালিমকে দুই উজির পদে বহাল করেছিলো।

এইভাবে পুরো একটা বছর কেটে গেলো। কিন্তু তার বেশি নয়।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো ছিয়াশিতম রজনীতে আবার গল্প বলতে শুরু করে :

একদিন সালিমকে সলিম বলে, এইভাবে ছোট ভাই-এর গোলামী আর কতকাল করবে?

সালিম বলে, কিন্তু যুদরের হাতে যতক্ষণ ঐ আংটি আছে—ওকে তো কিছুতেই কাবু করা যাবে না। তুমিই একটা ফন্দি-ফিকির বের করতে পারো। কারণ আমার চাইতে বদবুদ্ধি তোমার

অনেক বেশি।

সলিম বললো, শোনো, আগেই বলে নিচ্ছি। আমি যুদরকে হত্যা করে ওর হাতের আংটি আর ওই যাদু-থলে কজাগত করবো। কিন্তু একটা কথা, আমি হবো সুলতান, আর তুমি হবে আমার প্রধান উজির? কী রাজী? অবশ্য ঐ আংটি আর যাদু-থলে, তোমার যখন প্রয়োজন হবে, ব্যবহার করতে পারবে। তুমি।

সালিম বললো, আমি রাজি।

সেইদিন রাতেই সলিম খাবারের মধ্যে জহর মিশিয়ে দিয়ে যুদরবে হত্যা করে সেই আংটি আর যাদু-থলেটা হাতিয়ে নিলো।

আংটিটা ঘষতেই বজ্ৰদানব এসে দাঁড়ালোসলিমের সামনে।

–বান্দা হাজির হুজুর, হুকুম করুন, কী করতে হবে।

—আমার ভাই সালিমকে হত্যা কর। এক্ষুনি।

বজ্ৰদানব হুকুমের বান্দা। শমরদলের ঐ আংটি যার হাতে থাকবে তার আদেশ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বাধ্য। তা সে-কাজ ভালোই হোক বা খারাপই হোক। তৎক্ষণাৎ সে সালিমকে গলা টিপে হত্যা করলো।

তারপর সলিম বজ্ৰদানবকে বললো, যুদর আর সালিমের শবদেহ দুটি প্রধান সেনাপতির হাতে দিয়ে বলল, এদের দু’জনেরই ইন্তেকাল হয়েছে। যথাবিহিত সামরিক মর্যাদায় এদের সমাধিস্থ করতে হবে।

সেই সময় প্রধান সেনাপতি তার দলবল নিয়ে এক ভোজ-সভায় আমোদ-আহ্লাদ করছিলো। আফ্রিদি দানব যুদর আর সালিমের নিপ্রাণ দেহ দুটি এনে তার সামনে রাখতেই সে হায় হায় করে উঠলো। মুহূর্তে খানা-পিনা নাচ-গান হৈ-হল্লা সব স্তব্ধ হয়ে গেলো। সেনা অধ্যক্ষ ক্রোধে ফেটে পড়লো, কে, কে এই নৃশংস কাজ করলো?

আমি, হঠাৎ নাটকীয়ভাবে সলিম প্রবেশ করলো সেখানে, আমি হত্যা করেছি, আমার এই দুই ভাইকে। পথের কাঁটা সরিয়েছি। এখন কানুন মতো আমিই মসনদের একমাত্র দাবিদার এবং মালিক। আমাকে তোমরা যদি নির্বিবাদে সুলতান বলে মেনে নাও তা হলে কোনই গোল থাকে না। আর তা যদি না কর, তবে আমাকেও আমার পথ দেখতে হবে। এই যে দেখছো যুদরের হাতের আংটি—এটা এখন আমার হাতে! সুতরাং বুঝতেই পারছো, পৃথিবী পদানত করার ক্ষমতাও আমার মুঠির মধ্যে।

প্রধান সেনাপতি বুঝলো, কোনও উপায় নাই। প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ মানেই মৃত্যু। বললো, আমরা আপনাকে সুলতান বলে মেনে নিচ্ছি, জাঁহাপনা।

সলিম বললো, আজ রাতেই আম যুদরের বিধবা পত্নী আসিয়াহকে শাদী করবো। তার আয়োজন কর।

আমিররা বললো, একশোবার, আপনি তাকে শাদী করতে পারেন। কিন্তু বিধিমতো আপনাকে চার মাস দশ দিন অপেক্ষা করতে হয়।

—গুলি মারো, তোমাদের বিধি-প্রথায়। আমি আজই শাদী করবো তাকে।

সেই রাতেই আসিয়াহকে শাদী করলো সলিম। রাত্রি গভীর হতে না হতে সে আসিয়াহর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শাদীর প্রথম রাতে সে তার এতোকালের প্রলুব্ধ কাম চরিতার্থ করবে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো সাতাশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

বিধবা আসিয়াহ নতুন শাদীর সাজ পরে সলিমকে স্বাগত জানায়। দরজা বন্ধ করেই সলিম আসিয়াহকে অলিঙ্গন তথা চুম্বন করতে উদ্যত হয়। আসিয়াহ বলে, আহা, অত তাড়া কিসের! আমি তো সারা জীবনের মতো তোমার বাদী হয়ে গেলাম। আর আজকের রাতটাও অনেক বাকী। এসে, বসো, আমি তোমায় শরাব ঢেলে দিচ্ছি, খাও, মৌজ কর। তা না হলে জমবে কেন?

সলিম ভাবে, তাইতো। আসিয়াহ ঠিকই বলেছে। তাড়াহুড়ার কী আছে। সে তো এখন থেকে চিরজীবনের মতো তার হারেমের বেগম।

পালঙ্কের এক পাশে গিয়ে বসে সে। পেয়ালায় পূর্ণ করা ছিলো শরাব। আসিয়াহ অপূর্ব লাস্যময়ী ভঙ্গীতে পেয়ালাটা এগিয়ে দেয় সলিমের সামনে। এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলে সলিম।

ব্যস! মুহূর্তে মধ্যেই ঢলে পড়ে তার দেহ। সোনার বর্ণ মুখখানা জহরে নীল হয়ে যায়।

আসিয়াহ দরজা খুলে খোজাকে বলে, আমির সেনাপতিদের, ডাকো।

তাদের সকলের সামনে আসিয়াহ সেই আংটিটা হাতুড়ির ঘায়ে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে এবং থলেটাকে কেটে। টুকরো টুকরো করে বলে, যত পাপ যত অশান্তির মূলে ছিলো এরা। আমি সব শেষ করে দিলাম। এবার আপনারা মসনদের নতুন সুলতানের সন্ধান করুন…

শাহরাজাদ থামলো! কারো মুখে কোন কথা নাই। একটু পরে শাহরাজাদ বললো, এই হলো যুদর, তার ভাই, সেই থলে আর আংটির কাহিনী। এর পর আপনাকে অন্য কাহিনী শোনাবো, জাঁহাপনা।

দুনিয়াজাদ আনন্দে জড়িয়ে ধরে দিদিকে, কী চমৎকার কাহিনী দিদি আর কী মিষ্টি করেই তুমি বলতে পার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *