2 of 4

৩.০১.৩ সেয়ানা চোর আলীচাঁদ-এর কিসসা

সেয়ানা চোর আলীচাঁদ-এর কিসসা

চারশো উনপঞ্চাশ রজনী। আবার সে যথারীতি গল্প শুরু করলো :

বাগদাদে আহমদের সময়ে আর একজন সেয়ানা চোর ছিলো। তার নাম আলীচাঁদ। তাকে কিছুতেই ধরা-ছোঁয়া যেত না। পাঁকাল মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে যেত। আলীচাঁদের আসল বাস কইরোয়। এবং এই নামটাও তার তার নিজের নাম নয়।

বাগদাদে আসার আগে সে কাইরোতেও এই চুরি ডাকাতিই করতো। কেন তাকে স্বদেশ ছেড়ে বাগদাদে পালিয়ে আসতে হয়েছিলো আগে সেই কাহিনী শুনুন।

একদিন আলীচাঁদ দুঃখিত এবং বিষণ্ণ মনে তার সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে বসেছিলো তাদের আস্তানায়। দলের সবাই কাঁচা খিস্তি খেউর-এ মত্ত ছিলো, কিন্তু সেদিন আলীচাঁদের কিছুই ভালো লাগছিলো না। সে এক কোণে বসে বসে অন্য কথা ভাবছিলো।

ওস্তাদ, একজন এগিয়ে এসে বললো, এইভাবে বসে না থেকে চলো কইরোর পথে বাজারে একটু ঘুরি। হয়তো ভালো মতো মালাকডি কিছু মিলেও যেতে পারে।

নিরাসক্তভাবে আলী বললো, তোরা থাক, আমি একাই চলি।

আলী রাস্তায় নামে। চলতে চলতে সে লালপথে চলে আসে। কাছেই একটা শরাবখানা-এইখানেই ওরা নেশাভাঙা করে। ভিতরে ঢুকতে যাবে সে, এমন সময় দেখা হলো এক ভিস্তিওলার সঙ্গে! লোকটার কাঁধে চামড়ার থলে ভর্তি জল, হাতে দু’খানা তামার পেয়ালা। লোকটা সারাদিন শহরের পথে পথে জল বিক্রি করে। সদাই তার মুখে নানা সুরের নানা ঢংএর গান শহরবাসীরা নিত্য শোনে। সেদিনও সে গান গাইছিলো মুখে আর বোল বাজাচ্ছিল পেয়ালায় পেয়ালা ঠিকে।

আলী এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পড়ে। বুড়োটা বেশ মজার গান ধরেছে আজ। হঠাৎ তার মেজাজখানা অনেকটা শেরিফ হয়ে ওঠে। ভিস্তিওলাকে ইশারায়, কাছে ডাকে।

লোকটা কাছে এসে একটা পেয়ালায় জল ঢালতে উদ্যত হয়, কী সাহেব দেব নাকি? আমার পানী শহরের সেরা। একবার যে খেয়েছে, সেও পস্তাবে আর যে না খেয়েছে, সেও পস্তাবে। বিলকুল চিড়িয়া কী আঁখো কা তারা সাফা। দেখুন খেয়ে প্ৰাণ জুড়িয়ে যাবে।

আলী ইশারায় বলে, দাও।

কিন্তু জলের পেয়ালাটা হাতে নিয়ে সে পান করে না। ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

ভিস্তিওলা অবাক হয়, ইয়া আল্লা ফেলে দিলেন, সাব?

–আর এক পেয়ালা দাও।

দ্বিতীয়বারও সে একই কায়দায় জলটুকু ফেলে দেয়।

এবার ভিস্তিওলা চটে যায়। যদি পিয়াসই না পেয়ে থাকে। তবে ঝুটমুট নিয়ে ফেলে দিচ্ছেন কেন, মালিক?

—এমনি, মজা লাগছে। দাও, আর এক পেয়ালা দাও।

ভিস্তিওলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পেয়ালা পূৰ্ণ করে আলীর হাতে দিতে দিতে বলে, এইভাবে পিয়াসের পানি নিয়ে যদি ছেলেখেলা করতে থাকেন তবে আমাকে ছাড়িয়ে দিন, আমি আমার কাজে চলে যাই।

এবার আলী জলটুকু গলায় ঢেলে দেয়। তারপর জেব থেকে একটা সোনার মোহর বের করে ভিস্তিওলার হাতে দিয়ে বলে, এবার হয়েছে তো?

আলী ভেবেছিলো সোনার দিনারটা হাতে পেয়ে লোকটা খুশিতে গদগদ হয়ে তাকে সেলাম ঠুকতে ঠকতে চলে যাবে। কিন্তু সে-সব কিছুই করলো না সে। দিনারটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে আলীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে বললো।

–খানদান দুসরা চিজ! পয়সা থাকলেই বা ছড়ালেই তা কিন্তু কব্জায় আনা যায় না।

ভিস্তিওলার এই রকম কথায় আলীর হাড়পিত্ত জ্বলে ওঠে। ঠাঁই ঠাঁই করে গোটকতক রদ্দা বসিয়ে দেয়। তার মাথায়।

—ওরে বুড়ো বোকা বেহুদা, তোর তিন পেয়ালা পানির দাম কতো? তিন পয়সাও হবে না! তার জায়গায় আমি তোমাকে নগদ একটা সোনার দিনার দিলাম, তার বদলে আমাকে এই রকম খারাপ কথা বলছে? তোমার টুটি আমি ছিঁড়ে ফেলবো, বদমাইশ, জানো আমি কে?

রাগে তার মাথায় খুন চেপে যায়। আলীর এক একটা ঘুষির ওজন নেহাৎ কম নয়। মারতে মারতে লোকটাকে সে ফোয়ারা-বাগিচার দেওয়ালের কাছে এনে ফেলে।

-খানকির বাচ্চা, তোকে আজ আমি খতম করে ফেলবো। জিন্দগীতে একটা সোনার দিনার চোখে দেখেছিস কখনও? তোর কতটুকু পানি আমি খেয়েছি বা নষ্ট করেছি? সব মিলে একটা পোয়াও হবে না। তার দাম কত?

বুড়ো ভিস্তিওলা বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার পানির দাম তিন দিরহামের বেশি হবে না।

—তবে? তবে কেন তুমি ঐ রকম খানদান তুলে কথা শোনালে আমাকে? আমার মতো এই রকম দিল-দরিয়ার মানুষ কোথাও দেখেছে কখনও?

বুড়ো বলে, আল্লাহ সাক্ষী, দেখেছি, এমন দরাজ দিলের মানুষ আমি দেখেছি যা তামাম দুনিয়া টুড়লে তার জুড়ি মিলবে না!

আলীচাঁদ জিজ্ঞেস করে, কে সে? কার কথা বলছো?

আলীচাঁদের হাতের মুঠিতে তখনও লোকটার চুলের গোছা ধরা। ভিস্তিওলা বললো, মেহেরবানী করে আমাকে যদি ছেড়ে দেন, কোথাও গিয়ে একটু বসেন। তবে শোনাতে পারি সে কাহিনী :

এই সময় রাত্রি শেষ হচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো পঞ্চাশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

আলী আর ভিস্তিওলা বাগিচার ভিতরে ঢুকে ফোয়ারার পাশে শান-বাঁধানে চবুতরায় সিঁড়ির ধাপে গিয়ে বসে। তারপর সেই বুড়ো তার কাহিনী বলতে শুরু করে।

শুনুন মালিক, আমার বাবা ছিলো এই শহরের সব ভিস্তিওলাদের সর্দার। শুধু যারা ধরাবাঁধাবাড়ি বাড়ি পানি দিয়ে বেড়াতো তারা নয়, আমার মতো পথে পথে যারা যেসব ভিস্তিওলা পানি ফিরি করে ফিরতো তাদের সকলেরই প্রধান ছিলো সে। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে আমি পেলাম পাঁচটি উট একটি খচ্চর, একখানা দোকান এবং একখানা মাকান। আমার মতো লোকের পক্ষে এই-ই অনেক। কিন্তু গরীবরা কিছুতেই তুষ্ট হতে পারে না। যদি কখনও কোনও কারণে তারা পুরোপুরি সস্তুষ্ট হতে পারে তখন আর তারা তা ভোগ করে যেতে পারে না। আনন্দের চোটেই অক্কা পায়।

আমি ভাবলাম, আমার এই বিষয় আশয়কে আরও অনেক বাড়াতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য যাহোক একটা কিছু করতে হবে।

আমাকে শহরের অনেক খানদানী মানুষ এবং সওদাগররা খুব বিশ্বাস করতো। মক্কায় হজ-এ যাবার দিন এসে গেলো। আমি আমার উটগুলো আর খচ্চরটা ভাড়া খাটানোর জন্যে হজে যাবো বলে ঠিক করলাম।

কিন্তু ঐ যে বললাম, গরীব মানুষ কখনও বেশি পয়সার মুখ দেখতে পায় না, আর যদি কখনও দেখেও ভোগ করতে পারে না। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।

সেবার আমার এমনই বরাত, আমি যখন মক্কার পথে যাবো ঠিক করলাম, তার আগেই তীর্থযাত্রীরা রওনা হয়ে গিয়েছিলো। পথে আমি এক পড়লাম। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ডাকাতের হাতে পড়ে মালপত্র সব খুইয়ে বসলাম। কিন্তু মহাজনরা শুনবে কেন, তাদের দেনা শোধ করতেই হবে। তাই আমার উটগুলো আর খচ্চরটাকে বিক্রি করে মোটামুটি জনাকয়েক পাওনাদারের দেন। চুকালাম। কিন্তু আরও অনেকে রয়ে গেলো। তখন ভাবলাম, এই অবস্থায় আমি যদি দেশে ফিরি, আমার মহাজনরা আমাকে রেহাই দেবে না। দেনা চুকিয়ে দিতে না পারলে তারা আমাকে ফাটকে দেবে। সুতরাং আমি সিরিয়ার এক তীর্থযাত্রী দলের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে দামাসকাসে চলে গেলাম। তারপর সেখান থেকে আলেপ্পো হয়ে বাগদাদে গিয়ে পৌঁছলাম।

বাগদাদের ভিস্তিওয়ালা সমিতির সভাপতির সঙ্গে দেখা করে তাকে আমার দুঃখের কাহিনী শোনালাম সব। আর শোনালাম, আমার চোস্ত আরবী উচ্চারণে কোরাণ পাঠ। মিয়া সাহেব আমার ওপর খুব সদয় হলো। তাঁর পয়সায় আমাকে একখানা চামড়ার ভিস্তি আর দু’খানা তামার পেয়ালা কিনে দিয়ে বললো, যাও, পথে পথে পানি বিক্রি করে খাওগে।

কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। সারা বাগদাদ শহরের দোরে দোরে পথে ঘুরেও আমি দু’খানা রুটির পয়সা রোজগার করতে পারলাম না।

একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, কাইরো আর বাগদাদের মানুষের মধ্যে অনেক ব্যাপারে আদপেই কোনও মিল নাই। বাগদাদের মানুষ পয়সা দিয়ে পানি কিনে খেতে অভ্যস্ত নয়। পিপাসার্ত কেউ যে-কোনও বাড়িতে বা দোকানে যদি পানি চায়, সাগ্রহে দেয় সকলে। তারা বলে, পানি মানুষের প্রাণ, তুল্য—এবং এ-বস্তুটি আল্লাহ তৈরি করে পাঠিয়েছেন মানুষের প্রাণ ধারণের জন্য। পয়সার বিনিময়ে যারা তা বিক্রি করে, তারা কাফের। এবং এই কারণে এ ব্যবসা যেমন কেউ করেও না, তেমনি বড় একটা দরকারও হয় না।

যাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘পানি খাবেন?’ সেই ’না’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। একজন আমাকে কিছুটা করুণা করেই উপদেশ দিয়ে গেলো, তুমি বড় বাজে ব্যবসায় সময় নষ্ট করছে। এ ধোন্দা ছেড়ে অন্য কিছু করার উপায় দেখ।

আর একজনকে বলতেই সে প্রায় ক্ষেপে গেল আমার ওপর, তুমি কি আমাকে খানা খাইয়েছে, যে পানি দিতে চাইছো? আগে খেতে দাও, তারপর তোমার পানি দিও।

আর একজনের মন্তব্য, আল্লাহর তৈরি পানি বিক্রি করে নাফা করছে? ঠিক আছে, এখানে সুবিধে হবে না, পথ দেখ।

এতো সত্ত্বেও আমি কিন্তু হাল ছাড়তে চাইলাম না। বাজারের দোকানে দোকানে  ফিরি করে বেড়াতে থাকলাম। কিন্তু লাখোপতি সওদাগর থেকে কুলি মজুর কেউই আমার খদের হতে এগিয়ে এলো না। কেউ দয়া দেখিয়েও বললো না, আচ্ছা, এসেছে। যখন, দাও এক পেয়ালা।

এইভাবে দুপুর গড়িয়ে গেলো। কিন্তু তখনও সামান্য দু’খানা রুটির পয়সা রোজগার হলো না। আমার। গরীবদের খিদে পায় বেশি। কিন্তু খিদের চাইতে লজ-সঙ্কোচ তাদের আরও বেশি। বড় লোকদের লজ্জা-শরম গরীবদের চাইতে কম। আমি আপনার ব্যবহারে খুব ক্ষুব্ধ হয়েছি। আপনার পয়সা আছে, আপনি বড় লোক। কিন্তু একটা কথা ইয়াদ রাখবেন, পানি পয়দা করেছেন খোদাতাল্লা। তার জিনিস, যা না পেলে আপনি জীবন ধারণ করতে পারেন না, এমনি ভাবে খেয়াল খুশিমতো নষ্ট করলেন কেন? আপনাকে হয়তো কড়াভাবেই কথাগুলো বললাম, কিছু মনে করবেন না। ঘরে গিয়ে এক এক চিন্তা করবেন। দেখবেন, আমি যা বললাম। তার অর্থ মালুম হবে।

যাই হোক, আমার কিসসা শুনুন : বাগদাদের পথে পথে পানি ফিরি করে সাকুল্যে কিছুই রোজগার হলো না। সারাদিন পেটে দানা-পানি পড়েনি। খিদের জ্বালায় ছটফট করতে থাকিলাম।

–ইয়া, আল্লাহ, এই কী তোমার বিচার? একটুকরো রুটিও কী আমার বরাতে লেখোনি? এর চাইতে আমার নিজের দেশে ফাটকে কয়েদ খাটাও তো ভালো ছিলো? এই বিদেশ বি-ভূই-এ অনাহারে মারা যাবো? এখানে কেউ পয়সা দিয়ে পানি কিনে খায় না।

রাস্তার ধারের একটা বাড়ির রোয়াকে বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কাহিনী রোমন্থন করতে করতে আপন খেয়ালে বিড়বিড় করে চলেছি, এমন সময় দেখলাম বাজারের লোকজনের মধ্যে হঠাৎ একটা চাঞ্চল্য জেগে উঠলো। নানা দিক থেকে ছেলে বুড়ো সবাই ছুটে আসতে লাগলো। রাস্তার মোড়ে। যেখানেই বেশি লোকের ভীড় অতি স্বাভাবিক কারণেই সেদিকে আমার নজর। তাই আমিও পানির ভিস্তিটা কাঁধে ঝুলিয়ে সেইদিকে ছুটে যাই। মানুষের ভীড় ঠেলে যখন রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ালাম, দেখি, এক বিরাট জমকালো মিছিল চলেছে। একই সাজের বাহারী পোশাক পরে রাস্তার দু’পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলেছে। সিপাইবাহিনী। সকলের হাতে ইয়া বড় বড় লাঠি। কোমরে ঝোলানো তলোয়ার। সিপাইদের সর্দারকে দেখলাম-পেল্লাই চেহারা। মুখের দিকে তাকালে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। রাস্তার ওপরে দু’পাশের দণ্ডায়মান মানুষ মাথা নুইয়ে তাকে সালাম জানাতে লাগলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করি, কীসের মিছিল? আর ইনিই বা কে?

লোকটা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো, একটা ছোট ছেলেও জানে, আর তুমি জান না? ওঃ, তুমি তো পরদেশী, তাই! তোমার কথার টান শুনেই বুঝেছি, তুমি মিশরের বাসিন্দা। তা শোনো, ঐ যে সিপাইদের সেনাপতি দেখছো, ওঁর নাম আহমদ। খলিফার একেবারে ডান হাত। সারা শহরের শান্তি বজায় রাখার ভার ওঁকে দিয়েছেন খলিফা। মাসে হাজার দিনার ইনাম পায়। ইঁহঁ বাবা, যে সে আদমী নন। খোদ খলিফার খাস পেয়ারের লোক। আহমদ সাহেবের মতো আর একজন সেনাপতি আছে খলিফার। তার নাম হাসান। তিনিও মাসে হাজার দিনার পান। আর এই সিপাইরা পায় প্রত্যেকে একশো দিনার। প্রাসাদ থেকে ওরা এখন শহর দেখতে বেরিয়েছেন। এরপরে খানা-পিনা করতে যাবেন।

আমি আর কাল-বিলম্ব না করে আমার স্বদেশী টানে জোরে হাঁকিতে থাকি। পানি চাই–পা-নি—

তামার পেয়ালা দু’টো ঠুকে ঠুকে ঠুনঠুন আওয়াজ তুলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। একটু আগে আপনি যেমন শুনছিলেন ঠিক তেমনি মিঠে আওয়াজ।

সেপাই সেনাপতি আমার গলার স্বর শুনে আমার পাশে এগিয়ে এলেন, তুমি তো মিশরের লোক, তাই না ভাইসোব? আমি তোমার কথার টান শুনেই বুঝতে পেরেছি। দাও, আমাকে এক পেয়ালা পানি দাও।

আমি পর পর তিনবার তাকে তিন পেয়ালা পানি ভরে দিলাম। কিন্তু ঠিক আপনারই মতো তিনিও দু-দুবার পেয়ালার পানি মাটিতে ফেলে দিলেন। খেলেন শেষ পেয়ালা। একেবারে এক ঢোকে-ঠিক আপনারই মতো করে। তারপর বললেন, আমার কইরো ভাইরা দীর্ঘজীবী হোন। আচ্ছা, তুমি কেন পানি বিক্রি করতে স্বদেশ ছেড়ে এই বাগদাদে এসেছে? এদেশের মানুষ এ ব্যবসাটাকে ভালো নজরে দেখে না। আর পয়সাও রোজগার হয় না। এতে।

আমি সংক্ষেপে আমার ধার-দেনার কাহিনীটুকু বললাম তাকে। সেনাপতি সাহেব দয়া-পরবশ হয়ে আমাকে পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা বকশিশ দিলেন। তারপর সিপাইদের উদ্দেশ্য করে বললেন, এই ভিত্তিওলা ভাইটি আমার দেশের লোক। দায়ে ঠেকে আজ সে বাগদাদে এসে এই কাজ করছে। তোমরা যে যা পারো, একে একটু খয়রাতি করো।

সেনাপতি সাহেবের অনুরোধ মানেই হুকুম। তাই প্রত্যেক সেপাই এক পেয়ালা করে পানি খেয়ে একটা করে দিনার হাতে তুলে দিলো আমার। এক দণ্ডের মধ্যে আমি শতাধিক দিনারের মালিক হয়ে গেলাম। সেনাপতি আহমদ বললেন, আমরা রোজই এই সময় এই পথ দিয়ে যাই। তুমি দিনকয়েক এখানে দাঁড়িয়ে থেকে। তা হলেই অনেক টাকার জোগাড় হয়ে যাবে। তারপর দেশে ফিরে গিয়ে তোমার দায় দেনা শোধ করে দিও।

এইভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই আমার থলেটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। গুণে দেখলাম হাজারেরও বেশি হয়ে গেছে। বুকে বল ফিরে পেলাম। যাক, এবার তাহলে দেশে ফিরতে পারবো। সব মানুষের কাছে তার নিজের দেশই সেরা। তার চাইতে মধুর আর কিছুই হতে পারে না। ভাবলাম, দেশে ফিরে সব আগে আমি দেনা পরিশোধ করবো।

ভিস্তি-সর্দারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশের পথে রওনা হলাম একদিন।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো একান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

একদল যাত্রী কাইরোর দিকে যাচ্ছিল, আমি তাদের দলে ভিড়ে গেলাম। হ্যাঁ ভালো কথা, বলতে ভুলে গেছি, সেনাপতি আহমদ সাহেব আমাকে একটা তাগড়াই খচ্চর আর একশোটা মোহর দিয়ে বলেছিলেন, শোনো ভাই, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোমাকে।

-বলুন মালিক কী কাজ, আলবৎ করে দেবো।

আহমদ বললেন, কাজটা খুব গোপনীয়। কেউ যেন টের না পায়। আচ্ছা তুমি কাইরোর কী অনেক মানুষকে চেনো?

-তা চিনি বইকি। শেরিফ আদমিদের সবাইকে চিনি আমি।

-ঠিক আছে, এই খৎখানা ধরো। কাইরোর চাঁদ আলীকে দিতে হবে। সে আমার পুরানো দোস্ত। খুঁজে বের করতে পারবে তাকে? চিঠিখানা দিয়ে শুধু তাকে বলবে, তোমাদের ওস্তাদ এখন বাগদাদে স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদের দক্ষিণ হস্ত হয়ে বহাল তবিয়তে আছে। সে যেন আর দেরি না করে বাগদাদ শহরে চলে আসে আমার কাছে।

কাপ্তান আহমদের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তাকে সালাম জানিয়ে আমি কাইরোর। যাত্রীদলের সঙ্গে সামিল হয়ে গেলাম।

 

পুরো পাঁচ দিনের পথ। বাগদাদ থেকে কাইরো। দেশে ফিরে এসে জনে জনে ডেকে তাদের পাওনা-গণ্ডা চুকিয়ে আমি ঋণমুক্ত হলাম। কাপ্তেন আহমদকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। একমাত্র তারই কল্যাণে আজ আমি দেশে ফিরে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলাম।

আবার আমার জাত-ব্যবসায় নেমে পড়লাম। কাধে পানিভর্তি ভিস্তি ঝুলিয়ে দুটো তামার পেয়ালায় ঠুনটুনি বাজিয়ে আবার পথে পথে পানি ফিরি করে বেড়াতে থাকলাম। দিবারাত্র সব সময় আমি আহমদ সাহেবের খৎখানা বয়ে বেড়াচ্ছি। চাঁদ আলীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে চিঠিখানা। কিন্তু তামাম বাগদাদ শহর ছুঁড়েও তার কোনও হদিস করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।

ভিস্তিওলা এই পর্যন্ত বলে থামলো। চাঁদ আলী আনন্দের আতিশয্যে ভিস্তিওলাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে এলোপাতাড়ি চুম্বন করতে থাকে, আল্লাহই তোমাকে মিলিয়ে দিয়েছে। আমি—আমিই সেই চাঁদ আলী। কই, দাও আমার ওস্তাদের চিঠিখানা।

ভিস্তিওলাও বিস্মিত হয়। এক মুহুর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চাদের মুখের দিকে। তারপর আনন্দে ভরে ওঠে ওর মুখ। বলে, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই দেব। দেবার জন্যেই তো এতোদিন ধরে সঙ্গে সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছি, মালিক, এই নিন।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে চাঁদ আলী বলে, তোমার সঙ্গে হয়তো খানিকটা খারাপ ব্যবহার করেছি। তার জন্যে কিছু মনে করো না, ভাই। আহমদ সাহেব আমাদের দলের ওস্তাদ ছিলেন। আমি তার পেয়ারের সাগরেদ।

চিঠির বয়ানঃ

প্রাণাধিক পুত্রসম চাঁদ আলীর প্রতি মহামান্য খলিফার সিপাই-প্রধান আহমদের আন্তরিক অভিনন্দন।

চাঁদ, আসমানের চাঁদ, আমার দিল-কা কলিজা, তোমার কাছে উড়ে যাবো, আমার প্রাণের কথা বলবো, সে ক্ষমতা আমার নাই। আল্লাহ আমাকে পাখীর মতো দু’খানা ডানা দেননি।

তুমি হয়তো শুনে খুশি হবে এখানে আমি চল্লিশটা কেতাদুরস্ত পাজি বদমাইশের কাপ্তান বনে বহালতবিয়তে দিন কাটাচ্ছি। আমার সাগরেদ সিপাইগুলো সবাই পুরোনো দাগী-আসামী। হাজারো রকমের চুরি ডাকাতি ছিনতাই-এ তারা চোস্ত ছিলো এক সময়। আজ সুলতানের অনুগ্রহে সবাই শাহী তমা পেয়েছে। খলিফা আমাকে শহর রক্ষার ভার দিয়েছেন। তিনি হাজার দিনার বেতন দেন আমাকে। এছাড়া উপরি রোজগার তো আছেই।

পেয়ারের চাঁদ, যদি তুমি গুছিয়ে নিতে চাও, আর কাল-বিলম্ব না করে পত্রপাঠ আমার কাছে চলে এসো। তোমার যা শয়তানী বুদ্ধি আমি দেখেছি, তাতে তুমি এখানে এলে, বাজী মাৎ করে দিতে পারবে। বাগদাদের পথেঘাটে পয়সা উড়ে বেড়াচ্ছে। তোমার মতো চৌকস্ নওজোয়ান আমার পাশে এসে দাঁড়ালে আমরা কামাল করে দিতে পারবো। তুমি আমার মনের মতো সাগরেদ। তোমাকে যে-সব ফন্দী-ফিকির প্যাচ-পয়জার আমি হাতে কলমে শিখিয়েছি তার দু চারটে নমুনা যদি এখানে একবার ছাড়ো, খলিফা তোমাকে মাথায় করে রাখবেন। আর তাছাড়া আমি তো আছিই, খলিফার কাছে তোমার গুণগান আমি গাইবো, যাতে তিনি তোমাকে একটা উঁচু পদে বহাল না করে পারবেন না।

আর দেরি করো না, খুব তড়িঘড়ি চলে এসো, বেটা। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে রইলাম। আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুন।

চাঁদ আলী চিঠিখানা পড়ে এক অনির্বচনীয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। হাতের ছড়িখানা ঠুকে ঠুকে সে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করে নাচন-কোদন শুরু করে দেয়। আজ তার কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। তার গায়ের ধাক্কায় রাস্তার ভিখিরিরা হুমড়ী খেয়ে পড়ে। চাঁদ শুধু নেচেই চলে। আর ঘন ঘন চিঠিখানায় ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খায়।

ভিস্তিওলা বলে, তা হলে এবার আমি চলি, মালিক।

চাঁদ ওর গলা জড়িয়ে ধরে। জেবে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো মোহর বের করে ভিস্তিওলার ঝুলিতে ভরে দেয়। তারপর ছুটতে ছুটতে চলে যায় তার মাটির তলার গুপ্ত ডেরায়।

—শোন, সাগরেদ দোস্তরা। আমি ঠিক করেছি, বাগদাদে চলে যাবো। সেখান থেকে আমার ওস্তাদ আহমদ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। এখন বল, তোমাদের কি মত?

চোরচোট্টাগুলো সমস্বরে প্রতিবাদ জানায়, সে কী করে হয়, ওস্তাদ? ভঁড়ারে রেস্ত বলতে কিচ্ছু নাই। এই অবস্থায় আমাদের এখানে ফেলে রেখে তুমি কেটে পড়বে?

চাঁদ বলে, কী করবো বললা, নিয়তি আমাকে ডাকছে। আমার পুরানো সাথী ওস্তাদের ডাকে সাড়া দিতেই হবে।

সাঙ্গপাঙ্গরা ক্ষোভ জানায়, এ অসহায় অবস্থায় আমাদের ফেলে তুমি বাগদাদে চলে যাবে, ওস্তাদ, একী তোমার ধর্মে সইবে?

চাঁদ বলে, না; একেবারে সহায়-সম্বলহীন করে তোমাদের ছেড়ে যাবো না। আমি বাগদাদে যাবার পথে দামাস্কাসে কাটাবো কয়েকটা দিন। সেখান থেকে কিছু মালকড়ি বাগিয়ে তোমাদের জন্যে পাঠিয়ে দেবো। তা দিয়ে তোমাদের যাতে বছরখানেক চলে যায়, তার ব্যবস্থা

আমি করে যাবো।

মুসাফিরের সাজ-পোশাকে সেজেগুজে তৈরি হলো চাঁদ। কোমরে দু’খানা ছুরি গুঁজে নিলো। মাথায় পরলো বিচিত্র ধরনের এক টুপী হাতে নিলো ইয়া বড় একখানা বাঁশের লাঠি। তারপর তেজি ঘোড়ার পিঠে চেপে সঙ্গী-সাথীদের কাঁদিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লো।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো বাহান্নতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

কাইয়েরা ছেড়ে দামাসকাসের পথে চলতে চলতে এক তীর্থযাত্রীদলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো চাঁদের। দলের কর্তা দামাসকাসের বণিকসভার শাহবার। বহুৎ খানদানি মানুষ। মক্কা থেকে হজ করে দেশে ফিরছিলো।

আলী নওজোয়ান, খুবসুরৎ তরুণ। এখনও তার দাড়ি গোঁফ গজায়নি। হাজী সাহেবের নজরে ধরে গেলোলা দেখা মাত্র। শাহবার সাহেব দলের লোকজনরাও চাঁদকে পেয়ে ভুলে গেলো। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সে সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো। অবশ্য তার একাধিক কারণও ছিলো। দামাসকাসের পথ বড় বিপদসঙ্কুল। মাঝে মাঝেই ডাকাতি রাহাজানি হয়। বিশেষ করে বাদাবী দস্যুদের আক্রমণে যাত্রীদল সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। ঐ রকম কয়েকটি ডাকাতদল আর বাদাবী দস্যুদের আক্রমণ থেকে চাঁদআলী তাদের রক্ষা করেছিলো। তার অসীম সাহস এবং সিংহ-বিক্রমের সামনে ডাকাতরা কাছে এগোতে পারেনি। এছাড়া মাঝে মাঝে জঙ্গলের জানোয়ার সিংহের আক্রমণ প্রতিহত করেছিলো সে। এই সব কারণে হাজী সাহেবের মাথার মণি হয়ে ওঠে চাঁদ আলী।

দামাসকাসে পৌঁছে সে নিজের দলের লোকজনদের প্রত্যেককে পাঁচটি করে দিনার ইনাম দিলো। আর চাঁদ আলীকে দিলো এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।

চাঁদ ভাবলো, এতো টাকা সঙ্গে নেবার কোনও প্রয়োজন নাই। সামান্য কিছু রাহাখরচ রেখে বাকী সবটাই সে পাঠিয়ে দিলো কাইরোয় তার সাগরেদদের আস্তানায়।

এইভাবে সে একদিন বাগদাদ শহরে এসে পৌঁছলো। এবার তার প্রথম কাজ তার শিক্ষাগুরু ওস্তাদ আহমদের বাড়ি খুঁজে বের করা। শহরে ঢুকেই সে যাকে সামনে পেলো তাকে জিজ্ঞেস করলো, আহমদের ঠিকানা। কিন্তু পরদেশী ভেবেই হোক, কিংবা অন্য কোনও আশঙ্কাতেই হোক, কেউ তার কথার জবাব দিলো না বড় একটা।

জনে-জনে জিজ্ঞেস করতে করতে এক সময় সে অল-নাজ চৌমাথায় এসে পড়লো। চাঁদ দেখলো একপাশে একটা ফাঁকা মাঠে কতকগুলো খুদে মস্তান গুলতানী করছে। তাদের দলের পাণ্ডাটি আরও খুদেকিন্তু বিচ্ছু। এর আসল পরিচয় ঠগের সেরা জাইনাবের বড় বোনের আটাশে ছেলে মহম্মদ।

আলী ভাবলো, বাচ্চারা অনেক বেশি খোঁজ-খবর রাখে। এদের দিয়েই কাজ হতে পারে। ওদের আরও কাছে এগিয়ে সে ডাকলো, এই শোননা।

আটাশে ছেলে মস্তান মহম্মদ ভারিকি চালে এগিয়ে এলো চাঁদের সামনে?

—কী, ডাকছো কেন? কাছেই একটা মণ্ডা-মিঠাই-এর দোকান ছিলো। বারকোষে সাজানো নানা হালওয়া মণ্ডা। চাঁদ সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে মহম্মদকে বলে, নেবে তোমরা? হালওয়া খাবে, চলো।

মহম্মদ বলে, তা দিলে, না করবো কেন?

–তবে চলো আমার সঙ্গে।

চাঁদ আলী দোকানে ঢুকে একখানা রেকাবীর পুরো হালওয়াটা কিনে মহম্মদের হাতে তুলে দেয় এবং দেবার সময় কায়দা করে একটা দিনারও গুঁজে দিতে যায়। কিন্তু মহম্মদ ধনুকের মতো বেঁকে দাঁড়ায়, এ কী? আপনি আমাকে ঘুষ দিতে চাইছেন? নিন ধরুন, আপনার পয়সা

আর হালওয়া। চাই না আমরা। ভেবেছেন পয়সা দিয়ে আমাদের কিনে নেবেন। আমরা অত কচি ছেলে নই—হুঁ হুঁ বাবা–

চাঁদ মহম্মদের এবম্বিধ অসভ্য আচরণে বিরক্ত বোধ করে। কিন্তু মনের রাগ মনে চেপে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, ও হো হো, পয়সা দেখে তোমাদের গোসা হয়ে গেলো। তাজ্জব কি বাত, তা আমি তোমাকে ঝুট-মুট পয়সা দিচ্ছি না। তার বদলে আমার একটু কাজ করে দিও।

গম্ভীর চালে সে প্রশ্ন করে, কী কাজটা শুনি?

আমাকে একটা বাড়ির নিশানা বলে দিতে হবে। আমি পরদেশী মানুষ। তোমাদের শহরে এসেছি—এইটুকু সাহায্য কি করবে না?

আটাশে ছেলে ঠোঁট উল্টে বলে, ওঃ এই কথা! তা কার বাড়ি যাবে?

-খুলিফার সিপাই-সর্দার কাপ্তান আহমদের বাড়ি।

—অঃ! আচ্ছা, আমার পিছনে পিছনে এসো।

মহম্মদ এমন একটা ভঙ্গী করলো, যা দেখে মনে হয়, আহমদের বাড়িটা যেন সে নেহাৎ করুণা করেই তাকেই দেখাবে। একটু এগিয়ে নিচে থেকে তুলে নিলো একটা মাটির ঢিল। ঠাই করে ছুঁড়ে মারলো একটা বাড়ির দরজায়।

—ঐ। ঐ হচ্ছে আহম্মকের-থুড়ি আহমদের আস্তানা। দরজায় ঢিল পড়ার আওয়াজে পাল্লা খুলে বেরিয়ে আসে আহমদ। চোখে মুখে ক্রোধ। কিন্তু তার আগে মহম্মদ তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। আহমদ এদিক ওদিক উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সামনে চাঁদ আলীকে ছাড়া আর কাউকেই নজরে পড়ে না।

—আরে চাঁদ আলী তুমি!

আহমদ ছুটে এসে আলীকে জড়িয়ে ধরে বুকে।

চাঁদ আলী বলে ওস্তাদ, তোমার বাড়ি খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান। যাকে জিজ্ঞেস করি, কেউই কোনও জবাব দেয় না। কেন বলো তো?

-ভয়ে। স্রেফ ভয়ে। আমি শহরের সেপাই সেনাপতি। আমার নাম শুনলে লোকের হৃদকম্প জাগে। তারা ভেবেছে, কী বলতে কী বলে ফেলবে, শেষে আমার রোষে পড়বে। তাই পাশ কাটিয়ে গেছে। তা চলো, বাড়ির ভিতরে চলো। দেখবে কি পেল্লাই আমার বাড়ি—যেন একখানা প্রাসাদ।

সত্যিই, আহমদের বাড়িখানা চমৎকার সাজানো গোছানো। বাহারী গালিচা পর্দা আর দামী মেহগনি কাঠের সব আসবাবপত্র। বাড়ির ভিতরে বড় ঘরখানায় আহমদের চল্লিশজন সিপাই থাকে। তাদের সকলের সঙ্গে চাদের আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয়।

—এ হচ্ছে আমার দেশোয়ালী সাগরেদ। এমন তুখোড় ধড়িবাজ মস্তান সারা কাইরোতে নাই।

তারপর আহমদ চাঁদকে তার শোবার ঘরে নিয়ে আসে।

—এই হচ্ছে সেই বাদশাহী সাজ-পোশাক। খলিফা যেদিন আমাকে এই শহরের সেপাই-সেনাপতির পদে বহাল করেছিলেন সেদিন তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এমন জমকালো সাজ তোমার মতো খুবসুরৎ নওজোয়ানকেই মানায়। তাই তোমার জন্যেই তুলে রেখেছি। আমি জানতাম, একদিন না একদিন তোমার সঙ্গে আমার ভেট হবেই। আমি খলিফার ডান হাত। আমার তাঁবে চল্লিশজন সেপাই-সান্ত্রী ওঠ বোস করে।

সেইদিন সন্ধ্যায় চাঁদ আলীর সম্মানে আহমেদ এক ভোজসভার আয়োজন করলো। সে উৎসবে আহমদের সিপাইরাও সামিল হলো। খুব হৈ-চৈ আনন্দ করে কাটলো চাঁদ আলীর।

পরদিন সকালে আহমদ সেজেগুজে খলিফার দরবারে যাওয়ার সময় আলীকে বলে গেলো, ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুবে না কোথাও। নতুন জায়গা-পথ-ঘাট বা ঘাঁৎ-ঘোঁৎ কিছুই জানা নাই তোমার। একা একা পথে বেরুলে নানারকম বিপদ আপদ ঘটতে পারে। সুতরাং কয়েকটা দিন এই ঘরে বসেই বিশ্রাম কর। তারপর আমি সব বিধি-ব্যবস্থা করবো। কিন্তু সাবধান, বলে গেলাম তার এদিক ওদিক করো না। চারদিকে আমার শত্রু। আর বাগদাদের বদমাইশ মানুষগুলো সব সময় ওৎ পেতে বসে আছে, আমাকে বেকায়দায় ফেলার জন্যে। তোমাকে দেখলেই তাদের মগজে বদ ফন্দী চেপে উঠবে। ওসব ঝামেলায় না গিয়ে চুপটি করে ঘরে বসে থাক ক’টা দিন। মনে রেখ, বাগদাদ শহরটা কাইরো নয়। এখানে খলিফার চর কাইরোর মাছির মতো ভনভন করছে সর্বত্র। আবার কাইরোয় যেমন যত্রতত্র হাঁস মুরগী মরাল চরে বেড়ায়, তেমনি ছুঁচো পাজি লোচ্চা বদমাইশ গিজগিজ করছে এই বাগদাদের পথে ঘাটে।

—কিন্তু ওস্তাদ, চাঁদ আলী ক্ষোভের সঙ্গে বলে, ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে মেয়েমানুষের মতো বোরখা পরে বসে থাকার জন্যে তো আমি বাগদাদে আসিনি!

আহমদ হাসলো, না তা কেন, তোমার যেখানে খুশি যাবে, বেড়াবে। কিন্তু আমি বলি কি, মাত্র দু’একটা দিন চুপচাপ থাকো। তারপর আমিই তোমাকে পথঘাট ডেরা-আস্তানা সব চিনিয়ে দেবো।

আহমদ আর দাঁড়ালো না। তার ধনুর্ধরদের নিয়ে দরবারে রওনা হয়ে গেলো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো তিপ্পান্নতম রজনীতে আবার সে শুরু করে?

পাক্কা তিন-তিনটে দিন চাঁদ আলী অনেক ধৈর্য ধরে আহমদের ঘরে বন্দী হয়ে কাটালো। কিন্তু চারদিনের দিন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে চাইলো। আহমদকে কাতরভাবে জানালো, ওস্তাদ আর তো পারি না। এবার আমাকে হুকুম দাও। আমি আমার চুরি বিদ্যার এমন সাংঘাতিক এক বাহাদুরী দেখাই খলিফা যাতে তাজ্জব বনে যান।

আহমদ আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ডান হাতখানা বাড়িয়ে বলে, ধৈর্য ধর বৎস, ধৈর্য ধর। সব জিনিসেরই একটা সময় আছে। অত তাড়াহুড়া করলে কী চলে? তোমার পুরো ব্যাপারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকো। দেখ, আমি কী করি। সময় সুযোগ মতো খলিফার কানে তোমার নাম আর কীর্তিকলাপ পৌঁছে দেব। এমনভাবে তাকে টোপ দেব, যাতে তিনি নিজে থেকেই বলেন, তাকে নিয়ে এস আমার কাছে। ব্যস, তারপর আর কিছুর দরকার হবে না। সোজা-দরবারে নোকরী হয়ে যাবে।

মুখের ওপর আর কিছু বলতে পারলো না চাঁদ আলী। কিন্তু মনে মনে খুব খুশি হতে পারলো না। আহমদ বেরিয়ে যেতেই বাইরে বেরুবার মতলব ভঁজতে লাগলো সে। ভাবলো, এইভাবে কয়েদ হয়ে আর এখানে পড়ে থাকবে না সে। তিলমাত্র অপেক্ষা না করে তৎক্ষণাৎ সে রাস্তায় নেমে পড়লো।

উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এপথে পথে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সে একটা কাফের সামনে এসে দাঁড়ায়। খিদেও পেয়েছিলো, ভিতরে ঢুকে ভালোম কয়েকটা পদ নিয়ে খেখো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো, রক্তরাঙা রেশমীর পোশাকে সেজে-গুজে এক দল আবলুস কালো নিগ্রো সেই পথ দিয়ে আসছে। তাদের কোমরে চামড়ার পেটিকা, মাথায় শিরস্ত্রাণ, হাতে ইস্পাতের ধারালো খাঁড়া। পাশাপাশি দু’জন, তাদের পিছনে আরও দু’জন এবং তাদের পিছনে কোনও হারেমের এক বৃদ্ধ জেনানা। তার পিছনে আরও চারজন নিগ্রো প্রহরী। বৃদ্ধার মাথায় মহামূল্যবান রত্নখচিত এক স্বর্ণমুকুট। মুকুটের ওপরে একটি রূপোর পায়রা বসানো।

এই বৃদ্ধাই ধূর্ত ডিলাইলাহ। সে এখন খলিফার, চিড়িয়াখানার হর্তাকর্তা। দরবারের কাজকর্ম সেরে চিড়িয়াখানায় ফিরে চলেছে।

চাঁদ আলী কাফের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ডিলাইলাহ চাঁদকে চেনে না। এ শহরে তাকে সে কখনও দেখেনি। চাঁদপনা মুখের দিকে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। নিগ্রোদের একজনকে ফিসফিস করে বলে, ছেলেটি কে, একবার খবর নিয়ে এসো তো দোকানীর কাছে।

নিগ্রোটা ফিরে এসে বলে, দোকানী কিছু বলতে পারলো না, মালকিন। ছেলেটি মনে হয়, পরদেশী।

ডিলাইলাহ ফিরে এসে জানাইবকে বলে, আজ বাজারের কাছে একটা ফুটফুটে সুন্দর ছেলেকে দেখলাম। কিন্তু নাম ধাম পরিচয় কিছুই পাত্তা করতে পারলাম না। ছেলেটি দেখতে ভারি চমৎকার। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কেবল চোট্টা আহমদের কথাই মনে পড়ছিলো। আমার যাদুমেজ আর বালি নিয়ে আয় তো। আমি মন্তর পড়ে দেখবোছেলেটা কে? কেন যেন ছেলেটিকে দেখা ইস্তক আমার মনে হচ্ছে, ওর হাবভাব বড় সুবিধের নয়। মনে হয় কোনও বদ মতলবে অন্য দেশ থেকে এসেছে সে বাগদাদে। অথবা কোনও খারাপ কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে এ শহরে। যাইহোক, গুণে পড়ে দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের শত্রুর অভাব নাই, হয়তো কেউ শয়তানী করার জন্যেই তাকে লাগাবে আমাদের পিছনে।

জাইনাব বালি আর যাদুমেজ এনে রাখলো মায়ের সামনে। ডিলাইলাহ টেবিলের ওপর বালিগুলো ছড়িয়ে বিছিয়ে কি সব আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বিড়বিড় করে কী সব মন্ত্রতন্ত্র আওড়াতে থাকলো। একটুক্ষণ পরে সে চিৎকার করে উঠলো, জাইনাব, বেটি, মিল গয়া!

জাইনাব কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকায়, কী মা? কী পেলে?

—ঐ সুঠাম সুন্দর ছেলেটির নাম চাঁদ আলী। কাইরো থেকে এসেছে। আহমদের সে পেয়ারের দোস্ত। সে-ই তাকে বাগদাদে ডেকে এনেছে আমাদের দুজনকে চিট করার জন্যে। তুই যে মদের সঙ্গে আফিং খাইয়ে ওদের কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে বেআব্রু বেইজ্জৎ করেছিলি তারই বদলা নেবার জন্যে আহমদ তাকে কাইরো থেকে ডেকে এনেছে। ছেলেটি কাইরোর সবচেয়ে সেরা ঠগ ধড়িবাজ ধূর্ত। দেখছি, খোদ আহমদের বাড়িতেই উঠেছে সে।

–আচ্ছা মা, জাইনাব বলে, তুচ্ছ একটা দুগ্ধপোষ্য বালক—এখনও যারা গোঁফদাড়ি গজায়নি, তাকে নিয়ে অত মাথা ঘামাচ্ছো কেন?

ডিলাইলাহ মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মতো উপদেশ দেয়, উঁ হুঁ হুঁ, দাড়িগোঁফ উঠুক আর নাই উঠুক, ছেলেটি কিন্তু ধারালো ইস্পাতের ফলা। কী ভাবে, কখন, কেমন করে বুকে গেঁথে বসবে কিছুই বলা যায় না। অন্ততঃ আমার গণনায় তাই বলছে, মা। আর তুমি তো জানো, আমার যাদু-বিচার কখনও মিথ্যা হয় না।

জাইনাব বলে, তা জানি মা। কিন্তু কী এমন তালেবর যে, আমাদের ধোঁকা দিয়ে সে পার পেয়ে যাবে? যাইহোক, তুমি কিছু ভেবো না, আমি এখুনি তার সঙ্গে ভেট করে আসছি।

আর এক মুহূর্ত দেরি না করে চোখে সুর্মা কাজল পরে, দামী-রেশমী সাজপোশাক এবং রত্নালঙ্কারে সুন্দর করে সেজেগুজে জাইনাব রাস্তায় বের হলো।

খুব ধীর পায়ে সে বাগদাদের বাজার পথে চলতে থাকে। পাছা দোলে না, কোমর বাঁকে না এমনি শান্ত, সংযত তার পদক্ষেপ। রোয়াকবাজ ছেলেরা সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকে। কেউ বা একটু মুচকি হাসি, তেরছা নজর হানে। কেউ বা শিস দেয়, সিটি বাজায়। আবার কেউ বা বুক চাপড়ে গেয়ে ওঠে :

ও আমার ময়না
আর তো প্রাণে সয় না…

জাইনাব কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করে না। চুড়ির টুনটুন আর মলের ঝুমুর ঝুমুর মিষ্টি আওয়াজ তুলে সহজ স্বাভাবিক ভাবে পথে চলে। সে আওয়াজে রকবাজ ছোকরাদের বুকে তুফান তোলে।

আরও একটু এগোতে চাঁদ আলীর দেখা পায় জাইনাব। মা-এর বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিল আছে ছেলেটির চেহারার। প্রায় নিখুঁত সুন্দর, চাদের মতো

ফুটফুটে, সুগঠিত সুঠাম দেহ! জাইনাবের আর বুঝতে বাকী থাকে না, এই সেই চাঁদ আলী।

চাঁদ আলী আসছিলো আর জাইনাব যাচ্ছিল। সামনা-সামনি হতেই জাইনাব আলীকে ইচ্ছে করেই কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে। যেন হঠাৎ লেগে গেছে, এই রকম ভাব দেখিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলে, কিছু মনে করবেন না, আমি অন্যমনস্ক ছিলাম।

কোমল তনুর স্পর্শে আলীর সারা দেহে তড়িৎ প্রবাহ খেলে যায়। মুগ্ধ নয়নে সে জাইনাবের ঢলঢলে যৌবনের যাদু নিরীক্ষণ করতে থাকে।

জাইনাব মিষ্টি করে হাসতে জানে। সে হাসির শাণিত ছুরিকা পলকে প্রবেশ করিয়ে দিতে না পারে যে-কোনও পুরুষের বুকে। আলীই আজ তার শিকার।

আলী আর বুঝি নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়, কপালে স্বেদবিন্দু জমতে থাকে। কোনও রকমে সে বলতে পারে, তুমি কী সুন্দর! কার সন্ধানে পথে বেরিয়েছ?

খিল-খিল করে হেসে ওঠে জাইনাব। সে হাসি শব্দে মুক, কিন্তু অভিব্যক্তিতে মুখর। বলে, ধর তোমার মতো কোনও এক সুন্দর সুপুরুষ নওজোয়ানের সন্ধানে–

আলির স্বর্ণচাঁপার মতো মুখমণ্ডল রাঙা হয়ে ওঠে।

-শাদী করোনি?

—করেছি; আমি এখানকার এক সওদাগরের মেয়ে। আমার স্বামীও সওদাগর। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মাঝে মাঝেই তাকে বিদেশ যেতে হয়। এখন আমার স্বামী বাইরে গেছে। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে। তাই আজ আমি প্রথম ঘরের বাইরে বেরিয়েছি–তোমার মতোই একজন নাগর খুঁজতে। মৌজ করে খানাপিনা করবো দুজনে। তারপর…

আলীর বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটতে থাকে। কান গরম হয়ে ওঠে। জাইনাব বলে, আমার চাকরকে নানারকম খানা পাকাতে বলে এসেছি। আজ আমার দেহমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তোমার মতো সুন্দর কারো সঙ্গে রাত কাটাবার জন্যে। এতোটা পথ এলাম, অনেক ছেলে-ছোকরাই আমার পিছনে লেগেছিলো, সত্যি কথা বলতে কি, তাদের কাউকেই আমার মনে ধরেনি। কিন্তু তোমাকে দেখামাত্রই আমি মোহিত হয়ে গেছি। এখন তুমি যদি মেহেরবানী করে আজ আমার ঘরে চলো, আমার সাথী হও, তাহলে রাতটা সুরা, সুধায় ভরে ওঠে। যাবে?

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো চুয়ান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে?

আলী বলে, তোমার মতো যোড়শী সুন্দরীর আমন্ত্রণ কী আমি উপেক্ষা করতে পারি। যাবো, নিশ্চয়ই যাবো। এতে আমার পরম সৌভাগ্য—

জাইনাবের পিছনে পিছনে অনুসরণ করে চলতে থাকে আলী। শহরের অনেক আঁকা-বাঁকা গলিপথ (সবই তার কাছে একেবারে অচেনা) অতিক্রম করতে করতে আলি ভাবে, এই শহরে সে সম্পূর্ণ নবাগত এক মুসাফির। এখানকার পথঘাট মানুষ জন কিছুই সে চেনে না। হঠাৎ এক সুন্দরীর আহ্বানে তার ঘরে যাওয়া কী ঠিক হবে। অন্যের শাদী করা বিবি সে। হয়তো সে এখন বাড়িতে নাই। কিন্তু ফিরতেই বা কতক্ষণ? আচম্বিতে মাঝ রাতে সে যদি এসে উপস্থিত হয়? যদি দেখে, তার বিবি অন্যের অঙ্কশায়িনী হয়ে পড়ে আছে! তখন অতি স্বাভাবিক কারণেই তার মাথায় খুন চেপে যেতে পারে এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম-অবধারিত মৃত্যু। উফ্, আলী আর ভাবতে পারে না-না না, এসব সে ভাবতে চায়ও না। মহাজনরা বলে গেছেন, ‘বিদেশে অচেনা নারীর সঙ্গে অবৈধ সঙ্গম পরিহার করবে!

-নাঃ, আর সে এগোবে না, আলী ভাবতে থাকে, এই রূপসী নারী তাকে কোন বিপদের গুহায় নিয়ে যেতে পারে, কে জানে?

আলী এতক্ষণ জাইনাবের সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব রেখে পথ চলছিলো। এবার সে পা চালিয়ে তার পাশে এসে বললো, শোনো সুন্দরী, আজকের মতো আমাকে ক্ষমা করো। তুমি বরং অন্য কাউকে সঙ্গী করে নিয়ে যাও আজ। খুব সুরৎ নওজোয়ানের অভাব হবে না এ শহরে। কিন্তু আমাকে আজকের মতো ছেড়ে দাও। এ শহরে আমি সদ্য এসেছি। অন্যের আশ্রয়ে অতিথি হয়ে উঠেছি। এ অবস্থায় তাকে না জানিয়ে সারারাত বাইরে কাটানো কোনও মতেই উচিত। কাজ হবে না। কথা দিচ্ছি, পরে একদিন তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করবো আমি।

জাইনাব আব্দারের সুরে নাছোড়বান্দা বায়না ধরে, নাঁ-আঁ–, সে কিছুতেই হবে না। তোমাকে যেতেই হবে। তোমাকে দেখার পর থেকে দিল আমার তড়পাচ্ছে। আজ আর আমি অন্য কাউকে নিয়ে রাত কাটাতে পারবো না। আমার সারা মন জুড়ে বসে গেছ তুমি। এখন না বললে হবে কেন?

এ আবদার উপেক্ষা করতে পারে না আলী। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবার জাইনাবের পিছনে পিছনে চলতে থাকে সে।

অনেক পথের গোলকধাঁধা পেরিয়ে এক সময় এক বিশাল ইমারতের ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। ফটকের দরজা তালাবন্ধ ছিলো। জাইনাব তার কামিজ কুর্তার মধ্যে হাতড়াতে থাকে। চাবিটা গেলো কোথায়? তাজ্জব ব্যাপার! তবে কী পথে পড়ে গেলো? আলীর দিকে তাকিয়ে একটু চড়া গলাতেই বললো সে, মনে হচ্ছে চাবিটা হারিয়েছে। তা হাঁ। করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তালাটা খোলার কিছু একটা ব্যবস্থা কর।

আলি বলে, চাবি ছাড়া তালা খুলবো কী করে?

-তবুও চেষ্টা তো করবে?

—গায়ের জোর দিয়ে হয়তো তালাটা ভেঙ্গে ফেলতে পারি। কিন্তু তা চাই না।

-বাঃ, চাই না বললেই হলো, তা বলে ঘরে ঢুকবো না?

স্বচ্ছ নাকাবের তলা থেকে জাইনাব এমন এক কটাক্ষ বাণ ছুঁড়লো, যার ফলে আলীর হৃদয়ের সব বন্ধ তালাগুলো সব পটপট করে খুলে পড়ে গেলো।

কলের পুতুলের মতো আলী তালাতে হাত রাখে। আর কী আশ্চর্য, তালাটা সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায়।

জাইনাব আলীকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। সারা ঘর দামী পারস্য গালিচায় মোড়া। দেওয়ালে

ঝুলানো নানারকমের অস্ত্রশস্ত্র। জাইনাব একটা আসনে বসে আলীকে পাশে বসতে বললো। সামনের টেবিলে সাজানো ছিলো নানারকম মুখোরোচক খানাপিনা। দু’জনে তৃপ্তি করে খেলো! তারপর জাইনাব মদের পেয়ালা পূর্ণ করে আলীকে দিলো এবং নিজেও নিলো। আলী লক্ষ্য করলো, জাইনাব সারাক্ষণ সহজ অথচ সংযতভাবে আলীর স্পর্শ, মর্দন এবং চুম্বন পরিহার করে চললো। যতবারই আলী তার অধরে চুমু এঁকে দিতে চায়, জাইনাব হাত চাপা দিয়ে ঢেকে ফেলে। ফলে, হাতের তালুতেই তার চুম্বন আবদ্ধ আহত হয়ে ফিরে আসে। জাইনাব বাধা দিয়ে বলে ধৈর্য ধর সাহেব, ধৈর্য ধর। এমন জমকালো আলোয় কী কামনা-বাসনার দরজা খোলে? বাতি নিভাতে দাও, অন্ধকার আচ্ছন্ন করুক। তারপর দেখে নিও, আমার খেলা। তখন দেখবো, কেমন তোমার পৌরুষ।

খানাপিনা শেষ করে ওরা দুজনে ঘরের বাইরে প্রাঙ্গণে কূয়ার পাশে আসে মুখ হাত ধুতে। একটা বালতিতে করে জল তুলতে থাকে জাইনাব। হঠাৎ সে কপাল চাপড়াতে থাকে।

–হায় হায়, একি সর্বনাশ হলো আমার?

দারুণ আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসে আলী।

-কী ব্যাপার, কী হলো?

—আর কী হলো—আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। পানির বালতি তুলতে গিয়ে আমার আঙ্গুল থেকে হীরের আংটিটি খুলে পড়ে গেছে। এখন কী হবে সোনা? গতকাল  বাইরে যাবার আগে আমার স্বামী পাঁচশো দিনার দিয়ে কিনে এনে দিয়েছিলো আমাকে। পরার সময়ই একটু ঢিলে-ঢালা হয়েছিলো। কিন্তু এইভাবে কুয়ার পানিতে পড়ে যেতে পারে, ভাবিনি। কুয়ায় অবশ্য বেশি পানি নাই। নেমে হাতড়ালেই পাওয়া যাবে। সমস্যা হলো, এই রাতে নামবে কে? লোকজন তো কাউকেই পাবো না! যাই হোক, সাজ-পোশাক খুলে ন্যাংটো হয়ে আমিই নামি, কী বলো? তুমি বাপু দেওয়ালের দিকে মুখ করে দু’হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখো। একদম এদিকে তাকাবে না। আমি ন্যাংটো হবে।

আলীর পৌরুষে আঘাত লাগে, আমি থাকতে তুমি নামবে কুয়ার নিচে, সে কি হয়? আমি নেমে গিয়ে খুঁজে নিয়ে আসছি তোমার আংটি। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।

জাইনাবকে আর কিছু বলা বা করার কোনও সুযোগ না দিয়ে পলকের মধ্যে সে সাজ-পোশাক খুলে ফেলে।

রশিটা ধরে তরতর করে নেমে যায় নিচে। জাইনাব লক্ষ্য করলো, আলী বালতিটার ভিতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একমুহূর্ত কী যেন ভাবলো আলী। পা ডুবিয়ে জলের শীতলতা অনুভব করলো বোধহয়। তারপর ঝুপ করে ঝাপিয়ে পড়ে জলের নিচে তলিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে জাইনাব বালতিটাকে ক্ষিপ্রহাতে টেনে উপরে উঠিয়ে এনে বললো, এবার তোরা বাবা, আহমদকে ডাক রে হাঁদা। সে এসে তোকে বাঁচাক। আমি চললাম।

জাইনাব আর দাঁড়ালো না সেখানে। আলীর সাজ-পোশাকগুলো বোরখার তলায় বগলদাবা করে নিমেষে হাওয়া হয়ে গেলো সে।

এই বিশাল ইমারতখানা খলিফার দরবারের এক সম্ভ্রান্ত আমিরের। জাইনাব আগেই খোঁজ নিয়েছিলো, বাড়ির ফটকে তালা দিয়ে সে কোথাও কোনও কাজে বেরিয়েছে।

একটু পরে আমির সাহেব তার চাকরকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসে দেখে সদর দরজা হাট করে খোলা। তালাটা ভাঙ্গা। আমির ভাবে ঘরে চোর ঢুকেছিলো। কিন্তু সারা ঘর-দোর পরীক্ষা করে বুঝতে পারে, যেখানে যা যা ছিলো সবই ঠিক-ঠাক আছে—একমাত্র টেবিলের খানাপিনা করে বুঝতে ছাড়া কিছুই খোয়া যায়নি! আমির অবাক হয়, এমন অদ্ভুত চোরের কথা তো কখনও সে শোনেনি!

মুখ হাত ধুয়ে কূয়ার কাছে আসে আমির। চাকরটা জল ভোলার জন্য বালতি নামায়। কিন্তু সামান্য এক বালতি জল সে আর কিছুতেই টেনে তুলতে পারে না। পেল্লায় ভারি মনে হয়। কুয়ার নিচের দিকে নজর করে। কালো কিম্ভুতকিমাকার একটা বস্তু বালতির ওপর বসে থাকতে দেখে সে আঁতকে ওঠে।

-হেই বাপ, ওটা কী?

আমির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী রে, কী হলো?

চাকরটার তখন কাঁপুনি ধরে গেছে, হুজুর, কুয়ার নিচে দৈত্য!

-দৈত্য?

আমিরও কেমন ভীতচকিত হয়ে ওঠে। চাকরটা বলে, ঐ দেখুন বালতিটার মধ্যে বসে আছে—কালো দৈত্যের মতো কী একটা জিনিস, ঠিক বুঝতে পারছি না। বুননাশুয়োরও হতে পারে?

—তোব তোবা, বলিস কী রে? যা শিগ্নির মৌলভী সাহেবদের ডেকে নিয়ে আয়। কোরাণশরীফ পাঠ করাতে হবে! তোবা তোবা

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো পঞ্চান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে?

চাকরটা ছুটে গিয়ে চারজন কোরাণ-পাঠককে ডেকে আনে। ওরা সকলে কূয়ার চারপাশে দাঁড়িয়ে কোরাণশরীফ পাঠ করতে থাকে। সেই সময় আমির আর চাকর মিলে টেনে তোলে বালতিটা। আর সঙ্গে সঙ্গে কাদা-পাঁকে লেপা চাঁদ আলী লাফিয়ে দাঁড়ায়।

—আল্লাহ হো আকবর–

এতক্ষণে আমির বুঝতে পারে, আসলে সে কোনও দৈত্য আফ্রিদি নয়। রক্ত-মাংসে গড়া মনুষ্য-সন্তানই বটে। এতক্ষণে ভয়ে জড়সড় হয়েছিলো, এবার সে গর্জে ওঠে, কী রে ব্যাটা, চুরি করতে ঢুকেছিলি?

আলী বলে, আল্লা কসম, আমি চোর না। গরীব বেচারা একজন জেলে। মাছ ধরতে গিয়েছিলাম টাইগ্রিস। সারাদিন খেটে-খুটে পরিশ্রান্ত হয়ে নদীর ধারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর আর কিছু জানি না। ঘুম ভাঙ্গলো দেখি, আমি জলের মধ্যে শুয়ে আছি। আমাকে আপনারা জানে বাঁচিয়েছেন, এজন্য বহুৎ সুক্রিয়া জানাচ্ছি। খোদা মেহেরবান, না হলে বে-ঘোরে পড়ে আজ জানে মারা যেতাম।

আমির ভাবলো, লোকটার কথা সত্যিও হতে পারে। হয়তো কোনও আফ্রিদি দৈত্য ওকে তুলে এনে ফেলে গেছে এই কুয়ার মধ্যে। চাকরটাকে বললো, যা তো, একটা পুরোনো পাতলুন নিয়ে এসে ওকে পরতে দে।

ব্যাপারটা অনুসন্ধানের জন্য আলীকে সে শহর-সেনাপতি আহমদের কাছে পাঠিয়ে দিলো।

আলীর জন্য সারাটা বিকাল-সন্ধ্যা আহমদ বাগদাদ শহর চষে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোনও হদিশ করতে পারেনি। এখন এই শোচনীয় অবস্থাতেও তাকে ফিরে পেয়ে আহমদের ধরে প্রাণ ফিরে আসে।

অবাক হয়ে সে প্রশ্ন করে, এ কী তোমার দশা হয়েছে আলী? কী করে হলো? কোথায় গিয়েছিলে? কার পাল্লায় পড়েছিলে?

আলী তার কাহিনী শোনালো। আহমদ মুখ টিপে হাসলো, হাসলো তার চল্লিশজন ধনুর্ধররাও। আহমদ ঠাট্টা করে বললো, তুমি না কাইরোর জাঁদরেল মস্তান! বাগদাদে এসে প্রথমেই কুপোকাৎ! কাপড়চোপড় কেড়ে নিয়ে বেমালুম ন্যাংটো করে ছেড়ে দিয়েছে!

হাসানও উপস্থিত ছিলো সেখানে। হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ গো, কাইরোর কামাল, বাগদাদের একটা মেয়ের প্যাঁচে তুমি ধরাশায়ী হয়ে পড়লে? জানো, ঐ মেয়েটি কে?

আলী বলে, জানি। সে এক সওদাগরের মেয়ে। তার স্বামীও সওদাগর।

—বিলকুল ঝুট! ওর বাবা ছিলো খলিফার চিড়িয়াখানার সর্দার। আর মা হচ্ছে বাগদাদের সেরা ধূর্ত মহিলা ডিলাইলাহ। এখন সে খলিফার চিড়িয়াখানার সরদারণী হয়েছে। ওর নাম জাইনাব! ঠগের সেরা ঠগ। এখনও সে কুমারী—একেবারে আনকোরা বুনো ওল। স্বামী-ফামীর তোয়াক্কা করে না সে। মা আর এই বেটি দু’জনে মিলে সারা বাগদাদ শহরের মানুষকে পুতুল নাচাচ্ছে। কেন, তুমি কি শোননি, আমাদের এই কাপ্তান আহমদ সাহেব আর এর চল্লিশজন সাগরেদকে সে একদিন ন্যাংটো করে এক শরাবখানার আস্তাবলে ফেলে রেখে দিয়েছিলো? যাই হোক, এখন তোমার কী ইচ্ছা, বলো?

আলী বললো, আমি ওকে শাদী করবো। আপনি আমাকে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করুন, হাসান সাহেব।

বহুৎ আচ্ছা। করতে পারি সাহায্য, কিন্তু একটা শর্তে। অন্য কারো কথায় চলতে পারবে না। আমি যা যা বলবো তাই শুনতে হবে। আমি যা যা করতে বলবো, করতে হবে।

আলী বললো, আজ থেকে আমি তোমার সাগরেদ হলাম, ওস্তাদ। বলুন আমাকে কী করতে হবে?

হাসান বলে তা হলে আর সময় নষ্ট করে কী হবে। এখন থেকে কাজে নেমে পড়া থাক। শোননা, সাজ-পোশাক খুলে একেবারে উদোম উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াও তুমি। কী? লজ্জা করবে?

—আরে দুর, শরম কা কেয়া বাত–

আলী নিমেষের মধ্যে কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়ালো হাসানের সামনে! একটা কালো কালির ডিবা এনে হাসান নিজে হাতে তার সর্বাঙ্গ কালিতে লেপে দিলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার চাপার বর্ণ দেহখানা আবলুস কালো এক নিগ্রোর মতো হয়ে গেলো।

হাসান আনন্দে নেচে ওঠে, বেড়ে লাগছে দেখতে! একেবারে হাবসী এক নিগ্রো নফর, কী বলো?

ঠোঁটে আর চোখের নিচে লাল সুর্মা লাগিয়ে দিলো হাসান। একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে গেলো। কেউ দেখে আর বুঝতে পারবে না, আসলে সে নিগ্রো কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই রঙ শুকিয়ে গেলো, হাসান একখানা কৌপীন-সদৃশ স্বল্পবাস কোমরে জড়িয়ে দিলো আলীর। বললো, ব্যস! এবারে মোল আনা নিগ্রো বনে গেলে তুমি। এখন তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। পাচক সেজে ডিলাইলাহর রসুইখানার খানসামার সঙ্গে ভাব জমাতে যেতে হবে। পারবে তো?

আলী বলে, সে আর এমন কঠিন কী কাজ? খুব পিরবো। আমার মতো চোস্ত নিগ্রো-ভাষা কম লোকেই জানে। এভোকাল তো ওদের চরিয়েই খেয়েছি।

হাসান বলে, তবে তো আর কথাই নাই। তুমি শুধু ডিলাইলাহর নিগ্রো পাচকটার সঙ্গে আলাপ সালাপ করে ভাব জমিয়ে ফেলবে। এই পাচকটাকে ডিলাইলাহ খুব বিশ্বাস করে। সে শুধু ডিলাইলাহ আর তার মেয়ে জাইনাবেরই খানা তৈরি করে না, চিড়িয়াখানার পাহারাদার চল্লিশজন সিপাই, আর শিকারী কুকুরগুলোর জন্যও খানা পাকায়। ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে বলবে, দোস্ত অনেকদিন আড়ি আর ভেড়ার বাচ্চার কাবাব খাইনি। খেতে বড় সাধ, কিন্তু একা একা জমে না। তোমার মতো একজন সমজদার ইয়ার পেলে আমি আসর বসাতে পারি। তখন সে বলবে মালকিনের কড়া হুকুম, রসুইখানা ছেড়ে বাইরে কোথাও যেন না যাই। তা তোমার যখন এতো ইচ্ছে, এসো না—আমার রসুইখানায়। খুব চমৎকার করে বানিয়ে দেবো ভেড়ার কাবাব। কত খাবে। এক পয়সা খরচা হবে না। সবই ডিলাইলাহর ওপরে চালিয়ে দেবো। ব্যস! আর দেখতে হবে না, তুমি সঙ্গে সঙ্গে তার নেমন্তন্ন মেনে নেবে। তা হলেই বাজী মাৎ হয়ে যাবে।

আলী বুঝতে পারে না, কিন্তু কী করে?

হাসান হাসে, বলছি। কায়দা করে তুমি কম খেয়ে পাচকটাকে আকণ্ঠ গেলাবে। লোকটার নেশা যত চড়তে শুরু করবে, দেখবে আপনা থেকেই সে গড়গড় করে অনেক গুপ্ত কথা বলতে শুরু করে দেবে। তখন তুমি কথার ছলে এক এক করে সব গোপন তথ্য সংগ্রহ করে নেবে তার কাছ থেকে। কী ধরনের খাবার-দাবার সে বানায় ডিলাইলাহ আর জাইনাবের জন্য, পাহারাদার সিপাই আর কুকুরগুলোর জন্যই বা কতটা কী খানাপিনার ব্যবস্থা আছে, রসুইখানায় ঢোকার পথ, কোথায় থাকে তার দরজার চাবী—এই সব খবরাখবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতে হবে তোমাকে। নেশার ঝেকে সে তোমাকে সব বলে দেবে। এরপর তুমি একটা আফিঙের ডেলা ফেলে দেবে তার তাড়ির মগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবে তার মুখ দিয়ে গাঁজলা, উঠছে। বুঝবে দাওয়াই-এ কাজ হয়েছে। তখন লোকটাকে উলঙ্গ করে ওর সাজ-পোশাক তুমি পরে নেবে। ওর সজীকাটার ছুরিখানা খুঁজে নেবে তোমার কোমরে। এরপর একটা খালি ঝুড়ি নিয়ে তুমি বেরিয়ে পড়বে বাজারে। উদ্দেশ্য কিছু গোস্ত আর সজী কেনা।

সওদা শেষে আবার ফিরে যাবে রসুইখানায়। ভাড়ার থেকে তেল, মাখন, মসলা, চাল, ডাল ইত্যাদি যা যা দরকার সব পরিমাণ মতো বের করে নেবে! কতটা কী দরকার হতে পারে সে তো তুমি আগেই জেনে নিয়েছ। সুতরাং কোনও অসুবিধে হওয়ার কতা নয়। তারপর যা যা খানা পাকান হয় রোজ, সেই সব খাবারগুলো বেশ যত্ন করে তৈরি করে ফেলবে তুমি। হ্যাঁ, খাবার গুলোর গন্ধ শুকেই জিভে জল আসে যেন। আর মনে রেখো, প্রতিটি খানায় এক ডেলা করে আফিং মিশিয়ে দেবে।

ডিলাইলাহ, তার কন্যা জাইনাব, চল্লিশজন অনুচর আর পোষা কুকুরগুলোর জন্য খাবার সাজিয়ে পাঠিয়ে দেবে। এর পরের খেলাটা জমবে ভালো। সবাই যখন খেয়ে-দেয় ঢলে পড়বে, তখন এক এক করে সক্কলের সাজ-পোশাক গহনাপত্র সব খুলে নিয়ে সোজা চলে আসবে আমার কাছে। কেমন? পারবে তো?

আলী বলে, খুব পারবো।

হাসান বলে, হা, জাইনাবকে সত্যিই যদি তুমি তোমার বিবি বানাতে চাও তবে হ্যাঁ, তোমাকে আরও একটা কাজ করতে হবে।

-কী কাজ, ওস্তাদ?

হাসান বলে, চিড়িয়াখানা থেকে খলিফার সবচেয়ে প্রিয় চল্লিশটা শেখানো পায়রাকে একটা খাঁচায় পুরে নিয়ে আসতে হবে।

রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে বসে থাকে।

 

চারশো ছাপ্পান্নতম রজনী। আবার সে কাহিনী শুরু করে?

ফৌজী কেতায় আলী ডান হাত কপালের কাছে এনে পায়ের সঙ্গে পা জোড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর ‘জো হুকুম, ওস্তাদ’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

বাজারের মধ্যে দেখা হয়ে যায় পাচক নিগ্রোটার সঙ্গে। আলী স্মিত হেসে তাকে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে।

—এই যে দোস্ত, কেমন আছ?

-এই—চলছে আর কি।

আলী বলে, খেটে খেটে মরে গেলাম, মাইরী। তা একদিন একটু মৌজ-মৌতাত করা যাক না? এক হাঁড়ি তাড়ি আর কচি ভেড়ার মাংসের কাবাব, কী জমবে না?

নিগ্রো পাচকটা জুলজুল করে তাকায়, তা মন্দ কী?

-তা হলে তোমার সময় মতো এসো একদিন আমার ডেরায়।

নিগ্রোটা বলে, সে পারবো না, ভাই। আমার মালকিন বড় কড়া। বাইরে কোথাও যাওয়ার নিয়ম নাই। তার চাইতে তুমিই বরং চলে এসো আমার রসুইখানায়। নিজের গাঁট থেকে খরচা করে কী লাভ? মালকিনের ওপর দিয়েই মজাটা লুটা যাবে।

আলী সানন্দে সম্মতি জানায়। তখুনি সে নিগ্রোটার সঙ্গে চলে আসে তার রসুইখানায়। হাসানের কথামতো খানাপিনা চলতে থাকে। চলতে থাকে নানা কথাবার্তা। ধীরে ধীরে নেশায় ঝুঁদ হতে থাকে পাচকটা। সেই সুযোগে তার পেট থেকে সব কথা টেনে বের করে নেয় আলী। কোথায় ভাড়ার ঘরের চাবি থাকে, ডিলাইলাহ কী খায়, চল্লিশজন সিপাই বা কতটা কী খায় এবং কুকুরগুলোর খাবার কী দেওয়া হয়—সব সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেবার পর ওর তাড়ির মগে এক ডেলা আফিং ফেলে নিমেষের মধ্যেই ওকে বেহুঁশ অজ্ঞান করে ফেলে।

ডিলাইলাহর আর তার কন্যার জন্য দুপুরের খানা পাঁচ পদের তৈরি হয়। রাতেও হয় পাঁচ রকমের। শুধু আজ তারা আরও দুটি বাড়তি পদের ফরমাশ করেছে। রোজ হয় ডাল, কড়াইশুটি ভাজি, একটা ঝোল, মৃদু জ্বালে সেদ্ধ মাংস এবং গুলাবী মণ্ডা। শুধু আজকের জন্য দুটি বিশেষ পদের হুকুম হয়েছে—মধু আর জাফরান দিয়ে তৈরি চালের বিরিয়ানী এবং পেস্তা বাদাম আখরোট দিয়ে তৈরি বেদানার হাওয়া।

চল্লিশজন সিপাই-পাহারাদারের নিয়মিত খাবার : সেদ্ধ বরবটী মাখন দিয়ে ভেজে দিতে হয়। সঙ্গে কুচানো-পিঁয়াজ আর এক মগ করে তাড়ি। আর কুকুরদের জন্য বরাদ্দ–কুকুর পিছু আধ পোয়া মাংস। তার সঙ্গে মা-মেয়ের উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়।

চকটা মোষের মতো নাক ডাকাতে শুরু করলো। আলী ওর গায়ের বেশ-বাস খুলে নিজে পরে নিলো। ভঁড়ারের চাবিটা খুঁজে বের করে নিলো। পাচকের সজীকাটা ছুরিখানা কোমরে গুঁজে একটা খালি ঝুড়ি মাথায় করে বাজার-হাট করতে বেরিয়ে পড়লো সে।

কেনা-কাটা শেষ করে রসুইখানায় ফিরে এসে খুব যত্ন করে খানা পাকালো আলী। এবং প্রতিটি খাবারে এক ডেলা আফিং মিশিয়ে দিলো। তারপর যথা সময়ে ঘরে ঘরে খানাপিনা সাজিয়ে রেখে এলো সে। কেউই কিছুমাত্র সন্দেহাকুল ভাবে তাকালো না তার দিকে।

আলী দেখলো, একমাত্র রসুইখানার বেড়ালটা ছাড়া সবাই অঘোরে ঘুমে ঢলে পড়েছে। প্রথমে সে বুড়ি ডিলাইলাহকে ন্যাংটো করলো। উফ কী কুৎসিত কদাকার তার দেহ। আলী পাশের ঘরে ঢোকে। জাইনাব অসাড় হয়ে পড়েছিলো। এক এক করে তার দেহের সব আবরণ ও আভরণ খুলে নেয় সে। মাখনের মতো নরম নিভাঁজ পেলব তার শরীর। কামনার আগুন

এ জ্বলে ওঠে তার বুকে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে রাখে। আজ বাদে কাল। যাকে সে ঘরের বিবি বানাবে বলে ঠিক করেছে, তার কুমারীত্ব হরণ করতে সে চায় না। শুধু ওর সারা দেহে হাত বুলিয়ে স্পর্শ-সুখ অনুভব করে। পায়ের তলায় বসে ওর সুন্দর পা দুখানা নিয়ে আদর করতে থাকে। এক সময় পায়ের তালুতে সুড়সুড়ি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের ঘোরেই প্রচণ্ড বেগে একটা লাথি ছোঁড়ে জাইনাব। আর লাগবি তো লাগ—একেবারে আলীর মুখেই গিয়ে লাগে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এবং হাসতে হাসতে সে সরে যায়।

এরপর আলী এক এক করে নিগ্রো সিপাইদের ন্যাংটো করে সাজ-পোশাক খুলে নেয়। তারপর ছাদের ওপরে ওঠে গিয়ে পায়রাগুলোকে একটা খাঁচার মধ্যে ভরে ফেলে। কাপড়-চোপড় গহনাগাটিগুলোকে একটা পোঁটলায় বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে, পায়রার খাঁচাটা হাতে ঝুলিয়ে পথে নেমে পড়ে। সদর দরজাটা হাট হয়ে খোলাই পড়ে থাকে। আলী সেদিকে ভ্রক্ষেপও করে না। সোজা চলে আসে সে আহমদ হাসানের কাছে।

—সাবাস বেটা, হাসান আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, বাজী মাত্ করে দিয়ে এসেছে। এই না হলে আমার সাগরেদ! জাইনাবের সঙ্গে তোমার শাদী আমি দেবোই দেবো।

সকালে সব আগে ঘুম ভাঙ্গে ডিলাইলাহর। তখনও মাথাটা ঝিম ঝিম করছিলো তার। বুঝতে পারে, তার শরীরে কোনও আবরণ নাই। ধড়মড় করে উঠে বসে সে বিছানায়। গত রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই তার খাবারের মধ্যে আফিঙ মিশিয়ে দিয়েছিলো কেউ। তাড়াতাড়ি সে অন্য একটা সাজ-পোশাক পরে সোজা ছাদের ওপরে উঠে আসে। যা আশঙ্কা করেছিলো, ঠিক তাই ঘটেছে। খলিফার খবরবাহী পোষা পায়রাগুলোর একটাও নাই। ঘরগুলো সব ফাকা। মাথায় হাত দিয়ে সে ছাদের ওপরেই বসে পড়ে, এখন কী হবে? খলিফা শুনলে তার গর্দান যাবে।

নেমে এসে সে কুকুরগুলোর আস্তাবলে যায়। সবগুলো চিৎপটাং হয়ে মরার মতো পড়ে আছে। বুড়ি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে নিগ্রো প্রহরীদের ডেরায় ঢোকে। সেখানেও সেই একই দৃশ্য। উলঙ্গ অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে সবাই। এরপর সে ছুটতে ছুটতে জাইনাবের ঘরে যায়। তার আদরের দুলালী—তার কী দশা করে গেছে, কে জানে।

জাইনাবের দেহেও কোনও বস্ত্রাবরণ নাই। কুসুমের মতো কোমল তনুলতা এলিয়ে পড়ে আছে শয্যায়। ডিলাইলাহর বুকে কেঁপে ওঠে। জাইনাব—তার কুমারী কন্যা। তবে কি তার কুমারীত্ব নষ্ট করে দিয়ে গেছে? ভয়ে ভয়ে সে আরও কাছে আসে ঘুমন্ত জাইনাবের। দেহের নিম্নাঙ্গ ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে। না, লোকটা সে-সব কিছু করেনি। কিন্তু কেন করে নি। এমন ঢলঢলে যৌবন তার মেয়ের। এমন রূপ ও এমন লাবণ্য সারা বাগদাদেই বা আছে কটা। সেই মেয়েকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তার সর্বনাশ করেনি—সে কে?

ডিলাইলাহ দেখতে পায়, একটুকরো কাগজ—জাইনাবের বুকের ওপর। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সে খুলে পড়ে?

আমি কাইরোর চাঁদ আলী! আমার মতো সাহসী যোদ্ধা বীরপুরুষ সারা কাইরোতে কেউ নাই। আমার মনে হয় বাগদাদেও। এ ছাড়াও লোকে আমাকে ভদ্র বিনয়ী উদার বলে জানে। তুমিও তা বুঝতে পারবে, যখন জানবে, আমার পুরো কজাতে পেয়েও তোমার কুমারীত্ব আমি নষ্ট করিনি।

চিঠিখানা পড়ে আলীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে তার হৃদয়। সত্যি তো, ছেলেটি বড় সুন্দর। এমন কটি ভঁসা মেয়েকে হাতের মুঠোয় পেয়ে কেউ কি কখনও ছেড়ে দেয়।

জাইনাব জেগে ওঠে। ডিলাইলাহ তাকে সব জানায়।

-তুই যা-ই মনে কর মা, এই ছেলেটার কথা যতই আমি ভাবছি, অবাক হয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, সে তোকে আস্ত রেখে গেছে। কিন্তু আমি তো তোকে নিজ হাতে পরীক্ষা করে দেখলাম। না, সে কিছু করেনি। এ জন্যে তোরও কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত, মা। সে তোর কত ইজ্জৎ করেছে, বল! আমার সব চুরি করে নিয়ে গেছে। খলিফার দরবারে আমার বিচার হবে, জানি। তা হোক, তা সত্ত্বেও তাকে আমি কিছুতেই একটা সাধারণ ঠগ-প্রবঞ্চক বলে মনে করতে পারছি না, জাইনাব। ওর কলিজাটা বড় সাচ্চা। তা না হলে এই লোভ কেউ সামলাতে পারে না।

মায়ে ঝিয়ে বসে বসে অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলো। ডিলাইলাহ বললো, আমি এখুনি যাবো আহমদের কাছে। একবার স্বচক্ষে দেখে আসবো তাকে।

 

দরজার কড়া নাড়তেই হাসান বলে, ঐ, ঐ বুড়ি ডিলাইলাহ এসেছে। আমি ওর খট খট আওয়াজেই চিনতে পেরেছি। যাও, দরজা খুলে দাও।

আলী গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ডিলাইলাহ এক মুখ হাসি ছড়িয়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। মেজের এক পাশে কাপড় বিছিয়ে হাসান আহমদ আর আলী বসে খানা করছিলো। রেকাবীতে সাজানো শশা রুটি আর পায়রার মাংস। হাসান এবং আহমদ দুজনেই এক সঙ্গে। স্বাগত জানায় বুড়িকে, আসুন, আসুন, মেহেরবানী করে বসুন। গরীবের ঘরে যখন পা দিয়েছেন, আমাদের সঙ্গে একটু পায়রার মাংস দিয়ে নাস্তা করে যান।

–পায়রার মাংস?

আঁৎকে ওঠে ডিলাইলাহ। তবে কী পায়রাগুলো–না, না, সে কথা সে ভাবতে পারে না। চিৎকার করে ওঠে সে, আপনাদের একটুও শরম হচ্ছে না? এই খবর-বওয়া পায়রাগুলো খলিফার প্রাণাধিক প্রিয়—কলিজার সমান। আর সেগুলো চুরি করে এনে আপনারা ফলার করছেন?

হাসান হাসতে হাসতে বলে, খলিফার পায়রা? কে, কে চুরি করেছে আপনার চিড়িয়াখানা থেকে?

-কেন, কিছুই জানেন না নাকি? এই কাইরোর মস্তান, আপনাদের চাঁদ আলীই চুরি করে এনেছে আমার হেপাজত থেকে।

চাঁদ আলী অবাক হওয়ার ভান করে বলে, সে কী? আমি ভেবেছিলাম এমনি সাধারণ পায়রা। কী করে জানবো ওগুলো খলিফার খবর চালাচালির পায়রা? হায় হায়, কী হবে? আমি তো মনের আনন্দে সবগুলোকে জবাই করে কড়াই-এ চাপিয়েছি…

ডিলাইলাহ রেকাবী থেকে একটা পায়রার ঠ্যাং ধরে ওপরে তুলে নাকের কাছে ধরে। কী যেন আঘ্রাণ করে। তারপর মুচকি হেসে আবার রেখে দেয়।

—ভালো তামাশা করতে জানতো, ছেলে? এ তো আমার সে পায়রা নয়! হাসান আহমদ আলী সকলেই অবাক হয়। -সে কি? নাকে শুকে কী করে বুঝলেন, ও-পায়রা সে-পায়রা না?

ডিলাইলাহ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, খলিফার সোহাগের পায়রাগুলোকে রোজ দামী আতর মাখানো হয়। সে-আতরের খুশবু সেদ্ধ করলে বা কাবাব করলেও নষ্ট হবার নয়। তার সুবাস থাকবেই। কিন্তু এ পায়রার মাংসে তেল মসলার গন্ধ ছাড়া অন্য কিছু নাই।

এবার সকলে হো হো করে হেসে ওঠে, বহুৎ আচ্ছা। চিন্তা করবেন না, আমরা অত আহাম্মক নই, খলিফার পেয়ারের পায়রাগুলোকে আদরেই রেখেছি।

ডিলাইলাহ বলে, আপনাদের যা খুশি করুন। খলিফার জিনিস নিয়ে তামাশা করবেন না। ওগুলো আমাকে ফিরিয়ে দিন।

হাসান বলে, দেবো, নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবো। খলিফার সম্পত্তি জোর করে আটকে রাখার এক্তিয়ার কারো নাই। কিন্তু একটা শর্তে–

-কী শর্ত?

—আলীর সঙ্গে আপনার কন্যা জাইনাবের শাদী দিতে হবে।

ডিলাইলাহ হাসে, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। তবে কি জানেন, মেয়ে লায়েক হয়েছে। তার নিজস্ব একটা মতামত আছে। সে যদি রাজি থাকে, আমি পা বাড়িয়েই আছি। কিন্তু আমার ইচ্ছাতেও তোত আমাদের বংশের কোনও শাদী-নিকা হতে পারে না। আমার মাথার ওপরে আছেন বড় ভাই, জুরেক—এই শহরেই শুঁটকী মাছের ব্যবসা করেন তিনি। তাঁর মত করাতে হবে আপনাদের। তবে আমি কথা দিচ্ছি, মেয়েকে এবং আমার বড় ভাইকে আমি আমার সাধ্যমত বোঝাবার চেষ্টা করবো।

হাসান ইশারা করতে চাঁদ আলী পায়রার খাঁচাটা এনে ডিলাইলাহর হাতে তুলে দেয়। ডিলাইলাহ আর দেরি করে না, দ্রুত পায়ে হেসে ফিরে আসে নিজের ডেরায়।

—জাইনাব মা, ডিলাইলাহ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, আলী তোকে শাদী করতে চায়। বড় সুন্দর ছেলে।

জাইনাব বলে, আমার কোনও অমত নাই মা। ওর মতো ভালো ছেলে হয় না। তা না হলে যে সুযোগ সে পেয়েছিলো তাতে আমার সর্বনাশ করে দিতে পারতো। কিন্তু তা সে করেনি।

ডিলাইলাহ বলে, তা তো হলো মা, কিন্তু তোর মামাকে রাজি করাবি কি করে? এই শাদীর কথা শুনলেই তো সে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দেবে।

এদিকে আলী হাসানকে জিজ্ঞেস করে, ওর মাতুল জুরেক লোকটি কেমন? তার দোকানই বা কোথায়?

হাসান বলে, লোক যেমনই হোক, তাকে রাজী করাতেই হবে। তা না হলে জাইনাবকে পাওয়ার কোনও আশা নাই। যদিও বৃদ্ধ জুরেক আজ শুঁটকী মাছের ব্যবসা করে, এক সময়ে এই মহাবিদ্যার ব্যবসায়ে তামাম ইরাকে নাম ডাক ছিলো তার। এক ডাকে চিনত সকলে। চুরি ডাকাতি রাহাজানি প্রতারণা প্রবঞ্চনায় তার জুড়ি ছিলো না কেউ। তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নিত্য-নতুন লোক ঠকানোর ফন্দী-ফিকির বের হতো। আজ বুড়ো হয়েছে সে, গায়েব তাগদ কমে এসেছে। এখন আর ঐ সব ঝামেলার কাজে যেতে চায় না। সেই কারণে—শুঁটকী মাছের কারবার করছে বাজারে বসে বসে। তা এখনও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা সঙ্গ ছাড়েনি বুড়োর। ঐ দোকানেই তাদের আড্ডা বসে। অনেক বদ কর্মের সলা-পরামর্শ চলে গোপনে গোপনে। এখনও এই বুড়ো হাড়ে সে অনেক ভেষ্কীই দেখাতে পারে। আমি আর আহমদ তো চোর গুণ্ডা ধাপ্পাবাজদের নাটের গুরু ছিলাম এককালে। আর তুমিও আমাদের যোগ্য সাগরেদ, সন্দেহ। নাই। কিন্তু আমাদের সবাইকে সে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে দিতে পারে এখনও। তার মতো শঠ শয়তান ধূর্ত ধড়িবাজ আমার জীবনে দুটি দেখিনি। সুতরাং সাবধান বৎস, খুব সাবধান। আমার মনে হয়, ও বুড়োর কাছে আর্জি পেশ করে কোনও ফয়দা উঠাতে পারবে ন তুমি। লাভের মধ্যে হবে—এই কচি বয়সে বেঘোরে প্রাণটা খোয়াবে। তোমার জায়গাতে যদি আমি হতাম আলী, তবে কসম খেয়ে বলছি, ঐ সুন্দরী জাইনাবের দিকে আমি হাত বাড়াতাম না। একেবারে গনগনে আগুন পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে হবে। তার চেয়ে বলি কি, জীবনে চলার পথে অনেক খুবসুরৎ মেয়ের দেখা পাবে। তাদের কাউকে না হয় বিবি করে ঘরে এনো। কিন্তু এ দুরাশা তুমি ত্যাগ কর আলী, আমার কথা শোনো।

আলী বলে, কিন্তু ওস্তাদ, আমি যে তার কাজল-কালো চোখ দুটো কিছুতেই ভুলতে পারছি। সদা-সর্বদা আমাকে হনন করছে। না না না, জাইনাবকে না পেলে আমি বাঁচবো না। ওকে আমার চাই-ই। কিসের অত ডর, আমি যাবো তার দোকানে। দেখি কি করে সে!

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো আটান্নতম রজনীতে আবার সে শুরু করে?

বাজারে গিয়ে জুরেকের সঙ্গে দেখা করলো আলী।

—আমি আপনার ভাগ্নী জাইনাবের পাণিপ্রার্থী! তাকে আমার খুব পছন্দ। আমার মনে হয় সেও গররাজী নয়। সুতরাং আমি চাই, আপনি আমাদের শুভ-মিলন ঘটিয়ে দিন।

বৃদ্ধ জুরেকের চোখে শয়তানের হাসি। আলীর আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলে, তা সাহেবের কী করা হয়?

—জী, বড় বিদ্যার ব্যবস্থায় করি। আপনি তো এ বিদ্যায় সবার সেরা ছিলেন এককালে, সে খবর আমি জানি। আপনার ভগ্নী এবং ভাগ্নী দু’জনেই বাগদাদের সেরা ঠগ। আমার কাজকামের নমুনা অবশ্য এখানে সামান্যই দেখাতে পেরেছি। তবে কাইরো—আমার স্বদেশে আমাকে সবাই এক ডাকে চেনে। রোজগারপাতিও আপনাদের দোয়াতে কিছু কম করি না।

—হুম, বৃদ্ধ গম্ভীর হয়ে যায়, তা তোমার কাজের খানিকটা নমুনা তো আমাকে দেখাতে হবে।

—হুকুম করুন, চাচা। কোনও কাজই আমি দুঃসাধ্য মনে করি না।

বৃদ্ধ বলে, শাদীর দেনমোহর দিতে হবে তো?

—নিশ্চয়ই দেবো। কি চান, বলুন?

বৃদ্ধ বললো, এই শহরে এক ইহুদী যাদুকর জহুরী আছে। তার নাম? আজারিয়াহ। তার একমাত্র কন্যার একটি সোনার সাজ-পোশাক, একটি সোনার মুকুট এবং একজোড়া সোনার জুতো আছে। আমার মতে জাইনাবকে শাদী করতে হলে তোমাকে এই জিনিসগুলো দিয়েই দেনমোহর দিতে হবে। কী, পারবে?

আলী বলে, এ আর এমন কঠিন কী কাজ, কেন পারবো না?

—একটু উঁচুদরের ঠগবাজের কাছে, আপাতভাবে মনে হবে, ব্যাপারটা খুবই সহজ। আসলে কিন্তু অতটা সহজ নয়। ঐ ইহুদীটা মায়ামন্ত্র জানে। সে একটা বিরাট প্রাসাদে বাস করে। আগাগোড়া প্রাসাদটা সোনা আর রূপোর ইট দিয়ে গড়া। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে তার ইমারত। কিন্তু আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত দিনের বেলায় কেউ খুঁজে পায়নি তার প্রাসাদ। জহুরী আজারিয়াহ যখন সকালবেলা বাজারে চলে আসে, তখন সে মন্ত্রবলে বাড়িটাকে অদৃশ্য করে রেখে আসে। ফলে, কোন চোর ডাকাতই তার প্রাসাদে ঢুকে কন্যার মহামূল্যবান আবরণ আভরণ চুরি-ডাকাতি করে নিয়ে যেতে পারে না। এখন তা হলে বোঝ, কাজটা কতখানি সহজ।

আলী বলে, সে আপনি কিছু ভাববেন না। আমার ফন্দী ফিকিরের কাছে আপনার যাদুকর নস্যি। এক চালে সব টেনে বের করে এনে দেবো আপনার কাছে।

বৃদ্ধ জুরেকের চোখে অবিশ্বাসের হাসি। কিন্তু মুখে বলে, সাবাস্ বেটা, এই না হলে কাইরোর কামাল!

আলী সোজা চলে আসে স্যাকরা-পট্টিতে—ইহুদী জহুরী আজারিয়াহর দোকানের সামনে। দূর থেকে দেখেই সে চিনতে পারে জহুরীকে। লোকটার চেহারা কদাকার। প্রথম দর্শনে আঁৎকে উঠতে হয়। সচরাচর এমন কুৎসিত মানুষ চোখে পড়ে না। মাথার চুল বকের পালকের মতো শাদা। খুদে খুদে চোখ দুটোর নিচের চামড়া জড়ো জড়ো হয়ে গেছে। আকৰ্ণ-বিস্তৃত মুখ। একটাও দাঁত নাই। নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে। নাকটা অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ, টিয়াপাখির মতো। গায়ের রঙ এককালে সোনার মতো ছিলো। কিন্তু জরাবার্ধক্যে কিছুটা ম্লান হলেও বেশ গৌরকান্তিই বলা যায়। শরীরটা হাড্ডিসার। মাংস নাই বললেই চলে। চোখের দৃষ্টি শকুনের মতো।

বুড়ো আজারিয়াহ তখন একটা নিক্তিতে সোনা ওজন করে থলেয় ভরছিলো। দরজার সামনে একটা খচ্চর দাঁড়িয়েছিলো। বুড়োটা সোনা ভর্তি থলেগুলো এক এক করে খচ্চরটার পিঠে চাপিয়ে দিলো। তারপর দোকানের দরজা বন্ধ করে খচ্চরটাকে মন্ত্র পড়ে অদৃশ্য করে তার পিছনে পিছনে চলতে থাকলো।

আলীও অনুসরণ করে চললো বুড়োটাকে। শহর ছাড়িয়ে মাঠ। মাঠের পথ ধরে বুড়োটা এগিয়ে চলে। পিছনে পিছনে আলীও। কিন্তু যতদূরই যায় কোনও জন-বসতির কিছুমাত্র দেখতে পায় না সে। চারদিকে শুধু ধূ-ধূ করা প্রান্তর। আলীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ভাবে, লোকটা কি তার চলা শেষ করবে না আজ? ঠিক সেই সময় যাদুকর জহুরী দাঁড়িয়ে পড়ে বিড় বিড়। করে মন্ত্র আওড়ায়। আর কী আশ্চর্য, তখুনি, সেই মাঠের মধ্যে বিশাল একখানা প্রাসাদ সাকার হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ জুরেক যা বলেছিলো, অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। আগাগোড়া প্রাসাদটা সোনা আর রূপোর ইটে গড়া। স্ফটিকের তৈরি অগণিত দরজা জানালা।

যাদুকর জহুরী খচ্চরটার পিঠে চেপে ক্ষণকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেলো। তারপর ওকে দেখা গেলো প্রাসাদের এক গবাক্ষে। তার হাতে একটা বড় বারকোষ। তাতে সাজানো একটি সোনার সাজ-পোশাক, একটি রত্নখচিত স্বর্ণমুকুট, আর একজোড়া সুবর্ণ পাদুকা। বুড়োটা বেশ গলা চড়িয়েই বলতে থাকে এই যে, শোননা কাইরোর পীর মস্তান, তুমি নাকি তামাম ইরাক, পারস্য এবং আরবের আতঙ্ক! তা এসো, দেখি কত হিম্মত তোমার, চুরি করে নিয়ে যাও তো আমার মেয়ের এই পোশাক আভরণ। যদি তুমি সত্যিই তেমন গুণধর হও, আমি জবান দিচ্ছি, আমার এই বিশাল বিষয় সম্পত্তির একমাত্র মালিক আমার মেয়েকে শাদী দেবো তোমার সঙ্গে।

আলী ভাবলো, জুরেকের প্রস্তাব বুড়োকে জানানো দরকার। শুধু শুধু চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে তো সে তার পিছু ধাওয়া করে আসেনি। সে কথা তাকে জানানো উচিত মনে করলো আলী। ইশারা ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইলো, সে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

বুড়োটা ইশারা করে ডাকলো, ওপরে এসো।

আলী চলে এলো দোতলায়, বুড়োর ঘরে।

জহুরী জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী?

—জী, চাঁদ আলী।

-কী বলতে চাও? কেন এসেছে আমার কাছে?

আলী বলে, আমি শহরের শুঁটকী মাছ ব্যবসায়ী জুরেকের ভাগ্নী জাইনাবকে শাদী করতে চাই। কিন্তু বুড়োটা আমার কাছে দেনমোহর হিসেবে দাবী করছে এক অদ্ভুত বস্তু।

-কী বস্তু?

—আপনার মেয়ের ব্যবহারের সোনার সাজ-পোশাক, সোনার মুকুট আর সোনার জুতো জোড়া সে চায়। শুধু এই কারণেই আমি আপনার পিছু ধাওয়া করে এসেছি। যেন তেন প্রকারে এই সামানগুলো আমাকে জোগাড় করতেই হবে।

বৃদ্ধ ভ্রূকুটি করে, জোগাড় করতেই হবে? তার মানে তুমি কী বলতে চাও, আমি দান-সক্র খুলে বসে আছি! যে যা চাইবে, তাই আমি দিয়ে দেবো তাকে?

আলী বলে, না, না তা আমি ভাবিনি। এমন অমূল্য ধন কেউ কাউকে প্রাণে ধরে বিলিয়ে দিতে পারে না। সে জন্য আমি তৈরি হয়ে এসেছি।

—তৈরি মানে? চুরি করবে?

চুরি না করতে পারলে ডাকাতিই করবো।

বুড়োটা ফোকলা মুখে বিকট করে হাসলো। তারপর যাদু টেবিলের দিকে এগিয়ে বললো, মরার যদি সাধ জাগে, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারো। আর যদি আমার কথা শোেননা, তাহলে বলি, এসব বদ ফিকির ছেড়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। তা না হলে, এর আগে যেসব মস্তানরা হাত বাড়াতে এসেছিলো, তাদের যা দশা হয়েছিলো, তোমারও তাই হবে। আমি যদি গুনে পাই দেখি, তোমার মউৎ আমারই হাতে লেখা আছে, তবে আর একটা মুহূর্ত দেরি করবো না। এখুনি তোমার গর্দান মুণ্ডু আলাদা করে দেবো।

বুড়োর এই বস্তাপচা তম্বি শুনে আলী ক্রোধে জ্বলে ওঠে। ক্ষিপ্র হাতে সে তলোয়ার খুলে যাদুকরের বুকে বসিয়ে দিতে উদ্যত হয়। দারুণ দীপ্ত রোষে গর্জে ওঠে, এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তোমার মেয়ের ঐ সামানগুলো যদি দিয়ে না দাও তবে শেষ করে দেবো তোমাকে।

বুড়ো দু পা পিছিয়ে গিয়ে দু’হাত জোড় করে এমন ভঙ্গী নিয়ে দাঁড়ায়, যেন মনে হয়, এক্ষুনি সে নতি স্বীকার করে আলীর ইচ্ছা পূরণ করবে। কিন্তু সে তার ছল মাত্র। পর মুহূর্তেই সে চিৎকার করে ওঠে, যে হাতে তুমি আমাকে সংহার করতে উদ্যত হয়েছে, সেই ডান হাত তোমার অবশ পাথর হয়ে যাক।

সঙ্গে সঙ্গে আলীর হাত থেকে তলোয়ারখানা খসে পড়ে। হাতখানা যেমন উদ্যত ছিলো তেমনি অনড় থেকে যায়। আলী তক্ষুনি বাঁ হাত দিয়ে কুড়িয়ে নেয় তলোয়ারখানা। কিন্তু বুড়ো আবার বলে ওঠে, তোমার বাঁ হাতখানাও ঐ রকম হোক।

তৎক্ষণাৎ তার বাঁ হাত থেকেও তলোয়ারখানা নিচে পরে যায়। হাতখানা যেমন ওঠানো ছিলো তেমনি ওঠানোই থাকে। আলী ক্রোধে ফেটে পড়ে। প্রচণ্ড জোরে সে তার পেটের ওপরে এক লাথি বসিয়ে দেয়। ছিটকে পড়ে যায় বুড়ো, কিন্তু পলকের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে বলে, তোমার ডান পাখনাও পাথর হয়ে যাক।

এরপর অসহায় আলী শুধুমাত্র বাঁ পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এই সময়ে শাহরাজাদ দেখলো ভোর হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো বাষট্টিতম রজনী।

আবার সে বলতে শুরু করে :

আলী তার অবশ অঙ্গগুলোকে সচল করার অনেক ব্যর্থ প্রয়াস করে। বুড়ো বলে, এবার? এবার কোথায় যাবে চাঁদ? এখনও কী আমার মেয়ের সামানপত্র হরণ করার সাধ জাগছে প্রাণে?

আলী বলে, এখন আমি নিরুপায়। কিন্তু তবু আশা কী করে ছাড়বো? তা হলে তো জাইনাবকে পাওয়ার আশাও ত্যাগ করতে হবে আমাকে। সে আমি। পারবো না। জাইনাব ছাড়া আমার জীবনের অন্য কোনও কামনা নাই। তাকে আমি চাই-ই। আর সেই কারণেই আপনার মেয়ের। জিনিসগুলোও আমাকে পেতে হবে।

বুড়ো শয়তানটার মুখে এক বদমাইশের হাসি ফুটে ওঠে, অতি উত্তম কথা। তা হলে তুমি তো আমার মেয়ের জিনিসগুলো না নিয়ে এখান থেকে যাবে না। কিন্তু বলি, নেবে কী করে। মাথায় করে মোট বয়ে নিয়ে যাবে? আহা-হা সে কী হয়। কাইরোর মালিক, কুলির কাজ করবে, সে কি হয়? তার চাইতে এসো, তোমাকে একটা গাধা বানিয়ে দিই। তখন দিব্যি পিঠে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে ওগুলো। লোকে দেখে কেউ আর ঠাট্টা-তামাশা করবে না।

এই বলে উঠে গিয়ে একটা ছোট্ট পাত্রে করে মন্ত্র-পড়া জল নিয়ে এসে নি আমার গায়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে বিড় বিড় কর কি সব আওড়ালো সে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা গর্দভের আকার ধারণ করলাম।

বুড়োর মুখে হাসি আর ধরে না, বলে এইতো দিব্যি সুন্দর চেহারা হয়েছে তোমার! কুলোর মতো কান, কি সুন্দর লেজ, আর মুখের সুরৎই বা কেমন চমৎকার হয়েছে। নিজের চেহারা তো নিজে দেখতে পাচ্ছো না, আহা যেন কোন্ সুলতান বাদশাহর পুত্র! রূপের জেল্লায় যেন ঘর ভরে গেলো।

আলীর অন্তর আক্রোশে খাক হতে থাকে। কিন্তু কী করবে, মুখের ভাষা নাই, কিছুই বলতে পারে না সে।

যাদুকর ওকে নিচে নামিয়ে এনে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে কাঠকয়লা দিয়ে তার চারপাশে এক বৃত্ত এঁকে দেয়। অর্থাৎ এই বৃত্তের বাইরে সে পালাতে পারবে না!

ঐ উন্মুক্ত আকাশের নিচে অনাহারে অনিদ্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারাটা রাত কেটে যায় তার। অনেক কসরৎ করেও ঐ দাগের বাইরে পা বাড়াতে পারলো না সে।

সকালে যথারীতি দোকানে যাবার জন্য তৈরি হয়ে বুড়ো আজারিয়াহ নিচে নেমে আলীর পিঠে চেপে বসে চাবুক মেরে বলে, চল, বাজারে চল। আজ তোকে বেচে দেবো। যাক্, আজকের মতো আমার বুড়ো খচ্চরটার তো একটু বিশ্রাম হলো। নে, জলদি চল।

আলী আর কী করবে, বুড়োটাকে পিঠে করে পথে নেমে পড়ে। এদিকে নিমেষের মধ্যে প্রাসাদটা হাওয়ায় মিশে অদৃশ্য হয়ে যায়।

দোকানের সামনে যে জায়গায় খচ্চরটাকে বেঁধে রাখতে জহুরী, আলীকেও সেই জায়গায় বেঁধে রাখলো। সারাদিন ধরে ঠাঠা করা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বলতে থাকলো সে। দানাপানি বলতে শুকনো কিছু ছোলা তাকে খেতে দিয়েছিলো বুড়োটা। কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে, সেই অবস্থায় ঐ শুকনো ছোলাই সে গব গব করে খেলো খানিকটা। যেমন করেই হোক, বেঁচে থাকতে হবে তাকে এবং জাইনাবের মাতুলের দাবী পুরণ করে জাইনাবকে পেতেই হবে।

বুড়োটা সারাদিন ধরে নিক্তিতে সোনা ওজন করে থলেয় ভরতে থাকে। আলীর মনে হয় শয়তানটাকে এক গুলো মেরে শেষ করে দেয়। কিন্তু নাগালের বাইরে বসে আছে সে। আলী মাঝে মাঝে বিকট চিৎকার করে ওঠে। আশে-পাশের দোকানদার পথচারীরা চকিত হয়ে তাকায়। আলী জলের চাড়িতে নাক ডুবিয়ে জল টেনে নিয়ে ফরফর করে জহুরীর গায়ে ছিটিয়ে দেয়।

আজারিয়াহ দাঁত কড়মড় করে বলে, দাঁড়াও, তোমাকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করছি।

একটু পরে তার দোকানে একটা ইহুদী ছেলে এসে বলে, জহুরী সাহেব, বড় বিপদে পড়ে এসেছি আপনার কাছে। ব্যবসায় আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। এখন বিবি-বাচ্চাদের মুখে দানাপানি দেবো কী করে, তাই ভাবছি। এই নিন, আমার বিবির বাজুবন্ধ, এ দু’টো রেখে আমাকে কিছু টাকা দিন, আমি একটা গাধা কিনে পানির ভিস্তি বইয়ে বাড়ি বাড়ি পানি বেচবো।

বুড়ো জহুরী বলে, তোমাকে এই গাধাটা আমি দিতে পারি, কিন্তু একটা শর্ত, এর পিঠে পেল্লায় বোঝা চাপাতে হবে। গাধাটা বড্ড বেয়াড়া, একেবারে খল, কিছুতেই নড়তে চায় না। ওকে বেধড়ক পিটে পিটে মোট বওয়াতে হবে। যদি রাজী থাক, আমি তোমাকে বিনি পয়সায় দিয়ে দিতে পারি।

ইহুদী ছেলেটা উৎসাহিত হয়ে বলে, সে আপনি কিছু ভাববেন না, জহুরী সাহেব। এমন পিটানী লাগাবো,ওর বাপ ঠাকুরদার নাম ভুলিয়ে দেবো আমি।

আলীকে সঙ্গে করে সে বাড়ি নিয়ে যায়। বিবিকে বলে, গাধাটাকে নিয়ে এলাম। কাল থেকে ওকে পানির ভিস্তি বহাবো। আমি কিছু সামানপত্র কিনতে বাজারে যাচ্ছি। তুমি একে কিছু দানাপানি খেতে দাও।

ইহুদীর বিবি কিছু ছোলা এনে আলীকে খেতে দিতে ওর সামনে এগিয়ে আসে। আলী প্রচণ্ড জোরে নাক ঝেড়ে মাথা দিয়ে একটা গুঁতো মেরে মাটিতে চিৎপাট করে ফেলে দেয় ওকে। তারপর বুকের নিচে চেপে ধরে তার গাধাড়ে লম্বা জিভটা দিয়ে বৌটার নরম গাল চাটতে থাকে। পড়ে যাওয়ার সময় বৌটার কাপড়-চোপড় অসংবৃত হয়ে গিয়েছিলো। গাধার কামোত্তেজনা দেখে সে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকে।  তার আর্তনাদে পড়শীরা ছুটে এসে গাধারূপী আলীকে ঘা-কতক লাগিয়ে সরিয়ে দেয়।

একটু পরে স্বামী ফিরে আসতেই রাগে ফেটে পড়ে বৌটা। তোমার মতো শয়তান বে-আক্কেলে মরদে আমার দরকার নাই। সারা বাগদাদে এই মেয়ে-খেকো গাধা ছাড়া আর গাধা খুঁজে পেলে না তুমি?

স্বামীটা কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। জিজ্ঞেস করে, কেন, কী হয়েছে, কী করেছে গাধাটা? লাথ-ফাৎ চালিয়েছে নাকি?

-আরে না, ওসব হলে তো কথা ছিলো না। আসলে গাধাটা ভীষণ কামুক। আমাকে দেখামাত্র এক গুঁতো মেরে মাটিতে ফেলে দিলো। আমি তো চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেছি। কাপড়-চোপড় সরে গেছে, এক রকম উদোম বললেই হয়। গাধাটা করলো কি জান, আমার বুকের সঙ্গে বুক ঠেকিয়ে ওর ওই খরখরে জিভ দিয়ে আমার এই গাল আর ঠোঁট চাটতে লাগলো। আমি প্রাণপণে ওটার চেষ্টা করছি। ভয়ে শিটকে গেছি তখন। পরণের বেশ-বাস ঠিক নাই, কাউকে ডাকতেও পারছি না। কিন্তু একটুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, গাধাটা আমাকে শেষ না করে ছাড়বে না। আমাকে সে ফেঁড়ে ফেলবেই। এবং তার বিক্রম ঠেকাবার বা সহ্য করার শক্তি আমার নাই। তাই শরমের মাথা খেয়ে নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে পাড়ার লোককে জড়ো করতে বাধ্য হলাম। সময় মতো ওরা এসে গাধাটার লালচ থেকে আমাকে না বাঁচালে এতক্ষণে আমি শেষ হয়ে যেতাম। আমাকে ফেঁড়ে ফেলে দিত সে। এখন তুমি এর বিহিত করা হয় গাধাটাকে তাড়াও, নয়তো আমি তোমাকে তালাক দেবো। আর এক দণ্ড দেরি করবো না আমি।

ইহুদী যুবক বললো, আমার দরকার নাই এমন গাধার। যার গাধা তাকে ফেরত দিয়ে আসছি।

আলীকে মারতে মারতে সে ইহুদী জহুরীর দোকানে নিয়ে এসে বলে, আপনার গাধা আপনি ফেরত নিন, সাহেব। এমন বেয়াড়া জানোয়ার দিয়ে আমার কাজ চলবে না।

তারপর সে জহুরীকে গাধার কাণ্ডকারখানা সব খুলে বলে চলে গেলো। জহুরী আলীকে বললো, কীহে, সুন্দরী মেয়েছেলে দেখে লোভ সামলাতে পারোনি? আচ্ছা চলো, আজ তোমাকে অন্য দাওয়াই দেবো।

দোকানের কাজ-কাম সমাধা করে গাধার পিঠে সামানপত্র চাপিয়ে প্রাসাদে ফিরে যায় জহুরী।

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো তেষট্টিতম রজনীতে আবার গল্প শুরু করে সে?

আলীকে প্রাসাদের একটা ঘরে এনে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিয়ে আবার তাকে আগের আকৃতিতে ফিরিয়ে আনে।

-এবার বলো, তোমার কিছু শিক্ষা দীক্ষা হলো? এখনও কী সেই গোঁ ধরেই বসে আছো?, মতটত কিছু পালটেছো?

আলী বলে, মত আমার একটাই! জান থাকতে তা পালটাবো না।

বুড়োটার চোখ জ্বলে ওঠে, হুঁ, ভাঙ্গবে, তবু মচকাবে না দেখছি।

আলী বুড়োটার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য তাক করতেই সে পলকের মধ্যে মন্ত্রবলে তাকে একটা ভাল্লুকে রূপান্তরিত করে ফেলে।

গলায় একটা লোহার শিকল বেঁধে সারারাত প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে দাঁড় করিয়ে রেখে, দেয় আলীকে। সকাল বেলায় টানতে টানতে তাকে দোকানে নিয়ে যায় বুড়ো। সারাদিন ধরে টা টা করা রোদের মধ্যে দোকানের সামনে একটা খুঁটিতে বেঁধে রাখে। কত লোক আসে যায়, কত বেচা কেনা দেখে সে। কিন্তু কাউকেই কোনও কথা বলতে পারে না। জানাতে পারে না তার মনের বাসনা। বুড়ো যাদুকর তাকে বোবা করে রেখেছে।

একটি লোক আলীকে দেখে বুড়ো জহুরীটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, আপনার এই ভক্ষুকটা বিক্রি করবেন? আমার বিবি খুব অসুস্থ। তাকে হেকিম দেখিয়েছি। তিনি বলেছেন, ভল্লুকের মাংস খাওয়াতে হবে আর ভল্লুকের চর্বি মাখাতে হবে তাকে। এই ভল্লুকটা পেলে আমার কাজ চলে যাবে।

যাদুকর বলে, আজই তুমি একে জবাই করতে চাও? তবে দিতে পারি।

লোকটা বললো, হ্যাঁ, আজই। আমার বিবির জন্যে সারা শহরে হন্যে হয়ে খুঁজছি। কিন্তু মনের মতো একটাও পেলাম না। আপনার ভল্লুকটা আমার খুব মনে ধরেছে।

জহুরী বললো, উত্তম কথা। নিয়ে যাও, আমি বিনি পয়সাতেই তোমাকে দিয়ে দিলাম।

আলীকে বাড়ি নিয়ে গেলোলোকটি। চাকরকে পাঠালো একটা কষাইকে আনার জন্য। কষাই এসে তার ছুরি শান দিতে দিতে বললো, ভল্লুকটা বেশ তাগড়াই, ভালো গোস্ত হবে।

মৃত্যুর মুখোমুখি হলে মানুষ তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শরীরে দ্বিগুণ শক্তি সঞ্চার করতে পারে। আলীও নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রচণ্ড বিক্রমে কষাইকে এক ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে চলে গেলো। একটানা ছুটতে ছুটতে অবশেষে সে যাদুকরের প্রাসাদে এসে হাজির হয়।

বুড়ো যাদুকর ভল্লুককে ফিরে আসতে দেখে বললো, ফিরে যখন এসেছো, আর একবার বাঁচার সুযোগ আমি তোমাকে দেবো। কিন্তু এখনও তুমি যদি একগুঁয়ে হয়েই বসে থাক, আমার কিছু করার নাই।

এই বলে সে আবার মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে আলীকে মানুষের চেহারায় ফিরিয়ে আনে। এবার সে তার কন্যা কামরকে ডাকে। যাদুকর-কন্যা আলীর অলৌকিক রূপ-লাবণ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন সুন্দর সুঠাম চেহারার নওজোয়ান সে জীবনে দেখেনি কখনও। আলীর সামনে এসে বলে, আচ্ছা সাহেব, সত্যি করে বলো তো, তুমি শুধু আমার সাজ-পোশাকই চাও—আমাকে চাও না?

আলী বলে, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছো, আমি তোমার সাজ-পোশাকই চাই—তা শুধু আমার জাইনাবের জন্য। ওগুলো না দিতে পারলে তাকে যে আমি শাদী করতে পারবো না।

ক্ষোভে অপমানে কামর-এর মুখ কালো হয়ে যায়। বুড়ো আজারিয়াহ হুঙ্কার ছাড়ে, দেখলি মা, দেখলি? কত দেমাক দেখলি? এততাতেও ওর এক রতি শিক্ষা হলো না।

এই বলে সে আবার আলীর গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে বলে, কুকুর হয়ে যা বলার সঙ্গে সঙ্গে আলী কুকুরের রূপ ধারণ করে। বুড়োটা ওর মুখে থুথু ছিটিয়ে এক গোত্তা মেরে রাস্তায় বের করে দেয়, যা, পথে পথে ঘোর।

আলী কুকুর হয়ে বাগদাদের এক প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত চরে বেড়ায়। কিন্তু অন্য কুকুরের তাড়া ছাড়া কোনও খাদ্যবস্তুই সে সংগ্রহ করতে পারে না। খিদের জ্বালায় পেট জ্বলতে থাকে। শেষে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে একটা দোকানের সামনে এসে ধুকতে ধুকতে এলিয়ে পড়ে। তার এই অবস্থা দেখে দোকানীর মনে করুণার উদ্রেক হয়। সে তাকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে আসে।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো চৌষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে?

সওদাগরের কন্যা কুকুররূপী আলীকে দেখা মাত্র নাকাব দিয়ে মুখ ঢেকে সামনে থেকে আড়ালে সরে গিয়ে বলে, আব্বাজান, এ তুমি কাকে ধরে নিয়ে এসেছে অন্দরমহলে?

সদাশয় বৃদ্ধ সওদাগর নিরীহ সরল মানুষ। কন্যার কথা কিছুই বুঝতে পারে না।

-তুই কার কথা বলছিস মা? আমার সঙ্গে তো অন্য কোনও পরপুরুষ আসেনি।

মেয়ে বলে, তুমি বুঝতে পারনি, আব্বাজান। যাকে তুমি কুকুর ভেবে অন্দরে এনেছো, আসলে যে এক নওজোয়ান পুরুষ। তার নাম চাঁদ আলী। কাইরোর বাসিন্দা। আজ নসীবের ফেরে পড়ে এই হাল হয়েছে। যাদুকর আজারিয়াহ তাকে কুকুর বানিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।

সওদাগরের বিশ্বাস হয় না। সে আলীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কী, যা বলছে আমার মেয়ে, সব ঠিক?

আলীর মুখে ভাষা নাই। কিন্তু বুঝতে পারে সবই। মাথা হেলিয়ে সে জানায়—সব সত্যি।

-—ইহা আল্লাহ, সওদাগর চিৎকার করে উঠে, এখন উপায়?

—উপায় আছে, আব্বাজান। আমি ওকে আবার মানুষের রূপে ফিরিয়ে আনতে পারি।

সওদাগর অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়, তুমি? তুমি ওকে

মানুষ বানিয়ে দিতে পারো? পারি, আব্বাজান। যদি সে আমাকে শাদী করবে কথা দেয়, এক্ষুনি আমি ওকে ওর আগের চেহারায় ফিরিয়ে দিতে পারি।

হায় আল্লাহ, ওসব হিসেব নিকেষের কথা পরে হবে মা, যদি পারো, আগে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করে মানুষের চেহারায় ফিরিয়ে আনা ওকে। তারপর শাদীর প্রস্তাব দেবো আমি। নিশ্চয়ই সে অকৃতজ্ঞ হবে না।

সওদাগর-কন্যা তখন একটি পাত্রে খানিকটা জল এনে আলীর গায়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে মন্তর আওড়ায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলী আবার তার আগের রূপ যৌবন

চেহারা সব ফিরে পায়।

সওদাগর অবাক হয়ে আলীকে দেখতে থাকে। এমন চাঁদের মতো সুন্দর ছেলেটাকে ঐ বুড়ো আজারিয়াহ একটা কুকুর বানিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলো?

সওদাগরের ক্রীতদাসী নিগ্রো মেয়েটা ছুটে আসে; এ তোমার কী রকম ব্যাপার, ছোট মালকিন? তোমার সঙ্গে আমার ওয়াদা কী ছিলো?

এই নিগ্রো ষােড়শী মেয়েটি সওদাগর-কন্যারই সমবয়সী। বাড়ির কেনা দাসী হলেও সখী-সহচরীও বটে। আগে সে যাদুকর আজারিয়াহর বাড়িতে কাজ করতো। সেই সময় কায়দা করে সে বুড়োর পাঁজিপুঁথি চুরি করে পড়ে পড়ে এই যাদুবিদ্যার কৌশল রপ্ত করেছিলো। সওদাগরের বাড়িতে আসার পর তার মেয়ের সঙ্গে বেশ ভাব জমে যায় তার। তার অধিত বিদ্যার সবটাই সে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয় তাকে। কিন্তু সে শেখানোয় একটা শর্ত ছিলো। ওরা দু’জনে কসম খেয়ে হলফ করেছিলো, জীবনে তারা কখনও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকবে না। এবং সেই কারণে দু’জনেই একজন পুরুষকে শাদী করবে। কিন্তু আজ সওদাগর-কন্যা আলীকে শাদী করার প্রস্তাব দেবার সময় নিগ্রো সহচরীর কথা উল্লেখ করেনি বলে সে আহত হয়ে ক্ষোভ জানায়।-এ তোমার কেমনতর বিচার ছোটা মালকিন, কথা ছিলো যাকে শাদী করবো, দু’জনে এক সঙ্গে করবো?

আলী পুরোপুরি মানুষের আকৃতি ফিরে পেয়ে বলে, আমি তোমাদের দু’জনকেই শাদী করবো। তোমাদের দয়াতেই আমি আমার আগের জীবন ফিরে পেলাম।

এমন সময় দরজা ঠেলে জহুরী যাদুকরের মেয়ে কামর প্রবেশ করে সেখানে। তার হাতে একখানা সোনার রেকাবী। তাতে সাজানো তার সোনার পোশাক, সোনার মুকুট এবং সোনার জুতো জোড়া। সে বলে, এই নাও, তোমার ভালোবাসা জাইনাবের দেন-মোহর দিয়ে যেতে এসেছি আমি। সত্যিই জাইনাবের সৌভাগ্য দেখে হিংসে হয়। তার জন্যে তুমি যে অমানুষিক লাঞ্ছনাকষ্ট সয়েছো, ভালোবাসার ইতিহাসে তার কোনও নজির নাই। জাইনাবকে পেয়ে তোমার জীবন মধুময় হোক, তাতেই আমি সুখী হবো।

চাঁদ আলী বলে, জাইনাব আমার জীবনের স্বপ্ন। তাকে আমি নিশ্চয়ই চাই। সেই সঙ্গে তোমাদেরও দূরে রাখতে পারবো না। তোমরা এই তিনজন আমার জীবনে আবার নতুন করে ফুল ফুটিয়ে দিলে। কামর, তোমার এই মহান ত্যাগের কাহিনীও সোনার জলে লেখা থাকবে। জানি, প্রথম দর্শনেই তুমি আমাকে মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছে। আমার কষ্টে তুমি যন্ত্রণা ভোগ করেছে। আমার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য আজ তুমি নিজে হাতে করে নিয়ে এসেছে তোমার সবচেয়ে প্রিয় মহামূল্যবান সাজ-পোশাক। সে পোশাক আমি আমার প্রিয়তমা জাইনাবকে পরাবো, সে তুমি ভালো করেই জানো। সব জেনে শুনেও, তুমি যে এইসব আমার হাতে তুলে দিতে এসেছো এর বদলে তোমাকে কী শূন্য হাতে ফেরাববা?

-আমি কোনও প্রত্যাশা নিয়ে আসিনি, আলী? শুধু তুমি সুখী হবে বলে আলী বলে, আজ তুমি যে সামান্য আশা-আকাঙ্ক্ষার অনেক ওপরে উঠে এসেছো, কামর। তাই আমি তোমাকে শাদী করবো। এরা দু’জন আমার প্রথম ও দ্বিতীয় এবং তুমি হবে আমার তৃতীয় বিবি।

—আর জাইনাব?

কামর জানতে চায়। আলী বলে, সে আমার চতুর্থ এবং শেষ বিবি। তারপরে আর আমার জীবনে কিছু নাই। তা হলে, আজকের মতো ছুটি দাও; আমি এই সাজ-পোশাক নিয়ে যাই জাইনাবের কাছে। তাকে দিয়ে আসি।

রাস্তায় বেরিয়ে আলী একটা বেঁটেখাটো মেঠাইওলার দেখা পায়। সে হালওয়া আর পেস্তার বরফি বিক্রি করে বেড়াচ্ছিল। আলী ভাবে, জাইনাবের কাছে কিছু মিষ্টি নিয়ে যাবে। মেঠাইওলাকে সে ডাকে, এই—শুনছো, এদিকে এসো, নামাও, দেখি কী মেঠাই আছে তোমার ডালায়।

লোকটা তাড়াতাড়ি কাছে এসে ডালা নামায়, আমার মেঠাই সারা বাগদাদের সেরা, সাহেব। একবার মুখ দিয়ে দেখুন না!

লোকটার হাত থেকে একটুকরো হালওয়া নিয়ে আলী মুখে পোরে। এগাল-গাল করতেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে। গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে যায়। মাথাটা ধরে সে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর মুহূর্তের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে।

এই বেঁটেখাটো মেঠাইওলাটি জাইনাবের বড় বোনের আটাশে ছেলে মহম্মদ। আলীকে ফাঁদে ফেলার জন্যই সে আফিং মেশানো মেঠাই নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো।

আলী পথের মাটিতে অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ার পর মহম্মদ সেই সোনার সাজ-পোশাকগুলো বগলদাবা করে চোঁ দৌড় দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু হাসান তার ধনুর্ধরদের নিয়ে সেই সময় ঐ পথ দিয়ে ফিরছিলো। ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে মহম্মদকে পাকড়াও করে ফেলে। চড়-চাপড় লাগাতেই সে কবুল করে, হ্যাঁ সামানগুলো চাঁদ আলীরই বটে। সে তাকে প্রতারণা করে আফিং মেশানো মণ্ডা খাইয়ে সেগুলো নিয়ে সটকে পড়ার ফিকিরে ছিলো।

অচৈতন্য আলীকে হাসান তার বাড়িতে নিয়ে আসে। আফিং-এর ঘোর কাটানোর দাওয়াই দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। আলী চোখ খুলেই চিৎকার করে ওঠে, আমার জাইনাবের সাজ-পোশাক কোথায়?

হাসান হাসে, আছে, আছে। তোমার এতো কষ্টের সংগ্রহ করা জিনিস আর একটু হলেই লোপাট হয়ে যাচ্ছিল। সময় মতো আমার নজরে আসতে রক্ষা পেয়েছে, এই নাও।

চাঁদ আলী তার নিদারুণ অভিজ্ঞতার হৃদয়বিদারক কাহিনী শোনালো হাসানকে। সব শুনে হাসান বলে, সাবাস, একেবারে কামাল করে দিয়েছে। কামরকে যখন শাদী করছে, তখন তো

তুমি বুড়ো আজারিয়াহর দোকান-পাট প্রাসাদ সব বিষয় সম্পত্তির সোল আনা মালিক হচ্ছো। তা হলে শাদীর উৎসবটা ঐ যাদুকরের প্রাসাদেই হবে, কী বলে?

আলী হাসে, তাতে আর বাধা কী? যাই হোক, এখন আমি জাইনাবের মামা সেই পাজি শয়তান জুরেকের কাছে এই সাজ-পোশাক নিয়ে যাবো। মনে হয়, এবার আর সে না’ করতে পারবে না। শাদীর পর জাইনাবের সেই বোনপোটাকে একটু ঢিট করে দিতে হবে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো পঁয়ষট্টিতম রজনীতে আবার সে শুরু করে?

হাসান জুরেককে খবর পাঠিয়েছিলো, আমরা আপনার বায়না মতো দেনমোহর সঙ্গে নিয়ে চিড়িয়াখানার বাসগৃহ ডিলাইলাহ এবং জাইনাবের কাছে যাচ্ছি। আপনি মেহেরবানী করে সেখানে আসুন।

আলীকে সঙ্গে নিয়ে হাসান সেই সাজ-পোশাকের রেকাবীখানা বয়ে নিয়ে চলে।

জাইনাব আর ডিলাইলাহ তখন পায়রাদের দানা খাওয়াচ্ছিল। জুরেক বসেছিলো এক পাশে। হাসান সাজ-পোশাকের ডালাখানা তার সামনে নামিয়ে বললো, দেখুন জনাব, আপনি যা যা চেয়েছিলেন, সব ঠিক ঠিক আছে কিনা, দেখে নিন। এবার তো আপনার অমত হবে না! এর পরেও যদি আপনি অন্য ছুতো তোলেন, তাহলে কিন্তু ইজ্জতের লড়াই বেধে যাবে আপনার সঙ্গে।

জুরেক হাসলো, আমি লোকটা একটু কড়া ধাঁচের, সবাই জানে। কিন্তু তা বলে কথার খেলাপ করবো কেন? খুব খুশি হয়েছি আমরা। আর কোনও কিছু দাবী দাওয়া নাই। জাইনাবও খুশি হয়ে শাদীতে মত দিচ্ছে।

পরদিন সকালে চাঁদ আলী জহুরী আজারিয়াহর প্রাসাদ অধিকার করে বসে। সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় কাজীকে ডাকা হয়। আহমদ তার চল্লিশজন অনুচরদের সাক্ষী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যায়। পর পর চারটি শাদী-নামা তৈরি করে কাজী। ডিলাইলাহর কন্যা জাইনাব, আজারিয়াহ-তনয়া কামর, সদাগর-নন্দিনী এবং তার নিগ্রো সহচরী এই চারজনের সঙ্গে আলীর শাদীপর্ব সমাধা হয়।

প্রথম রজনীতে বাসরশয্যায় এলো জাইনাব। আলী বুঝলো; সত্যিই সে এতোদিন অপাপবিদ্ধ কুমারীই ছিলো। তার পরদিন থেকে প্রতিদিন এক এক বিবির সঙ্গে সহবাস করে সে খুশি হলো। তার চার বিবির সকলেই খুব চমৎকার।

এরপর পুরো, এক মাস ধরে খানাপিনার মহোৎসব চলতে থাকে। অতিথি মেহেমান অভ্যাগতরা খানাপিনা, নাচগান বাজনা হৈ-হল্লা করে সারা প্রাসাদ মাতিয়ে রাখলো।

হাসান দরবার থেকে ফিরে এসে আলীকে বললো, চাঁদ একটা শুভ সংবাদ আছে। খলিফার চোখ পড়েছে তোমার ওপর। তিনি তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন তার কাছে।

আহমদ আর হাসানের সঙ্গে আলী দরবারে এসে খলিফাঁকে কুর্ণিশ জানিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে। খলিফা আলীর রূপ দেখে মুগ্ধ হন।

প্রহরীদের একজন রুমালে ডাকা একখানা রেকাবী হাতে করে সুলতানের সামনে এসে দাঁড়ায়। খলিফার ইশারাতে রুমালখানা তুলে নেয় সে। রেকাবীর ওপরে একটি কাটা মুণ্ডু। খলিফা হেসে আলীকে জিজ্ঞেস করে, দেখো তো, চিনতে পারো কিনা—কার মাথা?

—আলী বলে, খুব পারি, ধর্মাবতার। এ সেই শয়তান জহুরী যাদুকর আজারিয়াহর কাল্লা।

খলিফা বলেন, লোকটার অত্যাচারে বাগদাদের মানুষ অহর্নিশ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। এই তার সমুচিত পুরস্কার–

আলী বলে, ধর্মাবতার যোগ্য সাজাই বিধান করেছেন। আর কিছুকাল ওকে বাঁচিয়ে রাখলে তামাম শহরটাকেই সে জ্বালিয়ে দিত।

এরপর আলী তার অভিজ্ঞতার কাহিনী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলো খলিফার সামনে। খলিফা শুনে একদিকে যেমন বিস্মিত হলেন আর এক দিকে তেমনি মুগ্ধও হলেন আলীর দুঃসাহসিক অভিযান আর অসীম সাহস দেখে। তৎক্ষণাৎ তিনি আলীকে আহমদ হাসানের সম মর্যাদার পদে বহাল করলেন।

শাহাজাদ থামলো।

সুলতান শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা শাহরাজাদ এ কাহিনী কী সত্যি সত্যিই ঘটেছিলো? না, নেহাতই বানানো কিসসা।

শাহরাজাদ বলে, আমি যা বললাম, তার একবর্ণও বানানো নয়, জাঁহাপনা। সবই সত্যি ঘটনা। কিন্তু এরপর যে কাহিনীটা শোনাবো সেটা আরও চমক জাগানো, সত্যি ঘটনা। ধীবর যুদর অথবা আশ্চর্য যাদু-থলের কাহিনী শুনুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *