2 of 4

২.১৮ অদ্ভুত বটুয়ার কাহিনী

শাহরাজাদ বলে : —এবারে এক অদ্ভুত বটুয়ার কাহিনী বলবো।

কোন এক রাতে খলিফা হারুন অল রসিদের চোখে ঘুম আসছিলো না। ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি পায়চারী করে কাঁটাচ্ছিলেন তিনি! এক সময় উজির জাফরকে ডেকে পাঠালেন।

জাফর ছুটে আসতে খলিফা বললেন, আজ রাতে বোধহয় আর চোখে ঘুম আসবে না, জাফর। তাই তোমাকে ডেকে পাঠালাম। বাকীটা রাত যাতে ভালোভাবে কাটে তার ব্যবস্থা কর।

জাফর বলে, ধর্মাবতার আলী নামে আমার এক দোস্ত আছে—সে পারসী শেখ। এক সময় অনেক মজাদার কাহিনী সে আমাকে শুনিয়েছিলো।

হারুন অল রসিদ বললেন ডাকো তাকে এক্ষুণি। আমি শুনবো তার কিসসা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সুলতান সমীপে হাজির করা হলো। জাফর তাকে পাশে বসিয়ে বললো, শোনো আলী, খলিফার চোখে আজ ঘুম আসছে না। রাতটা যাতে ভালোভাবে কাটে সে জন্য তোমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তোমার গল্পের জাদুতে সারাটা রাত। খলিফাকে ভুলিয়ে রাখতে হবে।

খলিফা বললেন, শুনলাম; তোমার গল্পের এমন গুণ শুনতে শুনতে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসে। তাই কী? তা হলে এমন একটা গল্প ফান্দো, যা শুনতে শুনতে আমি ঘুমে গলে যেতে পারি।

আলী সবিনয়ে মাথা নুইয়ে বলে, জো হাকুম জাঁহাপনা। এবারে আজ্ঞা করুন কী ধরনের কাহিনী আপনি শুনতে ইচ্ছা করেন। বানানো কিসসা-না, আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা?

সুলতান বললেন, তুমি নিজে যে ঘটনার সঙ্গে জডিত-সেইরকম একটা শোনাও।

আলী বলতে শুরু করে : একদিন আমি দোকান খুলে বসে আছি, এক সময় একটা কালো নিগ্রো এলো আমার দোকানে! দোকানে সাজানো নানারকম জিনিসপত্র দেখতে থাকলো। এটা ওটা নিয়ে দরদরি করতে লাগলো। তারপর, আমি লক্ষ্য করলাম এক সময় টুক করে একটা বটুয়া তুলে নিলো সে। ও ভাবলো, আমার নজরে আসেনি। তারপর অতি সহজভাবে দোকান থেকে বেরিয়ে হন হন করে চলতে থাকলো। এমন একটা ভাব, যেন কিছুই হয়নি। আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। ছুটে গিয়ে তার কামিজের খুঁট চেপে ধরলাম, এ্যাই—আমার বটুয়া দাও।

লোকটা রাগে ফুসে উঠলো, এটা আমার বটুয়া। এর মধ্যে আমার সামানপত্ব আছে। আমি ঐ ডাহা মিথুকটার কথা শুনে চিৎকার করে উঠলাম। পথচারীদের ডেকে জড়ো করলাম। শোনাও মুসলমান ভাইসব, এই বিধর্মী লোকটা আমার দোকান থেকে এই বটুয়াটা চুরি করে পালাচ্ছে।

আমার চোঁচামেচিতে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেলো। সমব্যবসায়ীরা পরামর্শ দিলো, আর দেরি করো না। লোকটাকে এখুনি কাজীর কাছে নিয়ে যাও।

তাদের সাহায্যে নিগ্রোটাকে টানতে টানতে আমি কাজীর কাছে নিয়ে গেলাম। কাজীর প্রথম প্রশ্ন : কে বাঁদী, কে আসামী?

আমি বলতে যাবো, তার আগেই নিগ্রোটা কাজীকে সালাম ঠুকে বলতে লাগলো, আল্লাহর দোয়ায় আপনি ন্যায়বান ধর্মাবতার। আপনার কাছে আমার নিবেদন, এই বঁটুয়া আমার সম্পত্তি। এর মধ্যে যা কিছু আছে তাও আমার জিনিস। আমার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো এটা। আজ ওর দোকান থেকে উদ্ধার করেছি আমি।

কাজী প্রশ্ন করে : কবে হারিয়েছিলো?

গতকাল। এর চিন্তায় কাল সারাটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, ধর্মাবতার।

কাজী বললো, ঠিক আছে। বটুয়াটা আমার সামনে রোখ। এর মধ্যে কী কী জিনিসপত্র আছে তার একটা ফৰ্দ বানাও।

নিগ্রোটা বলতে থাকলো : এর মধ্যে আমার দু’খানা স্ফটিকের কাজলকৌটো আছে। এ ছাড়া দুখান রূপের কাজল পরানো কাঁটা, একখানা রুমাল, দুটো বাহারী হাতল লাগানো সরবতের গেলাস, দুটো চিরাগবাতি, দু’খানা বড় চামচ, দু’খানা কুর্শির গদি। খেলার মেজে পাতার জন্য দু’খানা গালিচা, দুটো জলের বোতল, দু’খানা মুখ ধোবার গামলা, একখানা রেকবী, একটা রসুইপত্র, একটা মাটির পানি রাখার কুজো, একখানা রসুইখানার সিক, একখানা বড় কুরুশ কাঁটা, দু’খানা মদের থলে, একটা অন্তঃসত্ত্বা বেড়াল, দুটো মাদীকুত্তা, একটা চালের হাঁডি, দুটো গাধা, দুই প্রস্ত মেয়েদের শেবার ঘরের সামানপত্র, একখানা শণপাটের পোশাক, দুটো মেয়েদের ঢিলেঢালা কামিজ, একটা গরু, দুটো বাছুর, দুটো দ্রুতগামী আরবী উট, দুটো ভেড়া, একটা বড় উট, দুটো বাচ্চা, উট, একটা মোষ, দুটো ষাঁড়, একটা সিংহী, দুটো সিংহ, একটা মাদী ভালুক, দুটো খেঁকশিয়াল, একখানা গদীআটা আরামকেদারা, দু’খানা বিছানা, একখানা বিরাট

প্রাসাদ–তার মধ্যে দু’খানা ইয়া বড় বড় মজলিশি দরবার কক্ষ, দু’খানা সবুজ তাঁবু, দু’খানা চাঁদোয়া,

দুই দরজাওয়ালা একটা রসুইখানা এবং এক দল কুর্দ নিগ্রো। এ সবই আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

এইগুলো আছে ঐ বটুয়ায়-আমি হলফ করে বলছি, হুজুর, বন্টুয়াটা আমার।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো ছিয়াত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

কাজী আমার দিকে ফিরে বললো, এখন তোমার কী বক্তব্য আছে, বলে। আমি আর কী বলবো, নিগ্রোটার সেই আজগুবী কথাবার্তা শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম। যাই হোক, একটুক্ষণের মধ্যে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আমি কাজীকে বললাম আল্লাহ আপনার আরও খ্যাতি, মান বাড়বেন হুজুর। আমার ঝোলাটায় একটা সভামঞ্চের ভাঙ্গচুর আছে। আর আছে একটা গোটা ইমারাৎ কিন্তু কোনও রসুইখানা নাই। আছে একটা পোল্লাই বড় কুকুরশালা, একটা ছেলেদের মাদ্রাসা। একদল আমুদে দাবাড়ে, একটা ডাকাতের আস্তানা, একদল ফৌজ আর তাদের সেনাপতি, গোটা বসরাহ আর বাগদাদ শহর, আন্দের পুত্র আমির সাদাদের প্রাচীন প্রাসাদ, একটা কামারশালা, একখানা মাছ ধরা জাল, একখানা মেষপালকের লাঠি, পাঁচটি খুবসুরৎ ছোকরা, বারোটি কুমারী কন্যা এবং মরুযাত্রীদের এক হাজার সর্দার। এই সবই আছে ঐ ঝোলায়। আমি দাবি করছি—এই আমার প্রমাণ, ঝোলাটা আমার।

আমার জবাব শোনামাত্র নিগ্রোটা কান্নায় ফেটে পড়লো। কুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বলতে লাগলো, ধর্মাবতার আমার বটুয়াটা সকলের কাছে সুপরিচিত। যাকে জিজ্ঞেস করবেন। সেই বলবে বটুয়াটা আমার সম্পত্তি। আমি আপনার কাছে আগে যে ফর্দ পেশ করেছি তা ছাড়াও আরও কতকগুলো জিনিস ওই বঁটুয়ায় আছে। সেগুলো শুনুন : দুটা বাজেয়াপ্ত শহর, দশটা গম্বুজ, দুটো রসায়ন কারখানা, চারজন দাবাড়ে, একটা মাদী ঘোড়া, দুটো ঘোড়ার বাচ্চা, একটা পাল দেওয়া ঘোড়া,

দালাল, এক অন্ধ, দুজন জ্যোতিষী, একজন খোঁড়া মানুষ, দুজন অসাড়লোক, একজন জাহাজের কাপ্তেন, এক জাহাজ ভর্তি নাবিক, এক পাদরী, একজন পাঠান ধর্মযাজক, একজন সমাজপতি, দুজন সাধু এবং একজন কাজী। এছাড়া আরও আছে দুজন সাক্ষী। তারাই বলবে বটুয়াটা আমার। এর পর কাজী আবার আমার দিকে ফিরে বললো, এর জবাবে তোমার যদি কিছু বলার থাকে বলতে পার।

আলী বলতে থাকে : তখন আমার মাথা গরম হয়ে গেছে, জাঁহাপনা। কিন্তু নিজেকে সহজ এবং সংযত করে কাজীকে বললাম আল্লাহ আমাদের কাজীকে আরও উদার, নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধি দিন। আমি এর আগে যে সব সামানপত্রের কথা আপনাকে বলেছি তা ছাড়াও আরও কতকগুলো জিনিস আমার ঐ ঝোলাটায় আছে, ধর্মাবতার। সেগুলো বলছি : মাথা ধরার দাওয়াই, একটা সেনাবাহিনীর সাজ-পোশাক, বর্ম এবং অস্ত্রাগার, এক হাজার লড়াকু ভেড়া, একটা হরিণ চরানোর খোয়াড়, মেয়ে পাগল একদল মানুষ, কেতাদুরস্ত কতকগুলো ছোকরা, ফুল ফলের গাছে ভরা বাগিচা, দ্রাক্ষাকুঞ্জ, আপেল, ডুমুর জলের বোতল, পেয়ালা, সদ্য শাদী হওয়া যুগল দম্পতী, বারোটা পুর্তিগন্ধময় বাতকর্ম, অনেকগুলো কাপুরুষ, একটা শস্যশ্যামল মাঠ ভর্তি মানুষ, নিশান এবং পতাকা, হামাম নিসৃত সুগন্ধী হাওয়া, কুড়িজন গায়িকা, চারজন গ্ৰীক রমনী, পঞ্চাশজন তুরস্ক

আস্তাবল, একটি মসজিদ, অনেক হামাম, একশো সওদাগর, একটা হাতুড়ী, একটা পেরেক, একটা বাঁশীবাদক নিগ্রো, এক হাজার দিনার, নানা জিনিসপত্রে ঠাসা কুড়িটা প্যাটরা, কুড়িজন ঈষত নাচনেওয়ালী, পঞ্চশটা ভাড়ার ঘর, গোটা কুফা শহরটা, এছাড়া গাজা, দামিয়েটা এবং

শাবন শহর, সুলেমানের খুসরাম আমুশিরবান প্রাসাদ কক্ষ এবং ইসপাহানের মাঝখানের পুরো ভূখণ্ড। এছাড়া, আল্লাহ কাজীকে দীর্ঘায়ু করুন, একখানা শবাধার শব্বাচ্ছাদন এবং কাজী সাহেব যদি আমার অধিকার স্বীকার না করেন। সেই জন্যে দাড়ি কামানোর একখানা ক্ষুরও আছে ঐ ঝোলায়। আবারও বলছি, ঝোলাটা আমার ঝোলা।

এই সব কথা শোনার পর কাজী আমাদের দুজনের দিকে তাকালো। তারপর বলতে থাকলো, খোদা হাফেজ, হয় তোমরা দুজনেই পাজী বদমাইস আইনকে নিয়ে রঙ্গ তামাশা করতে এসেছ না। হলে এই বঁটুয়াটা কোনও অলৌকিক বস্তু।

এর পর কাজী বন্টুয়াটার মুখ খুলে ফেললো। তার মধ্যে কমলা রঙের একটা বডি আর কতকগুলো জলপাই এর আঁটি ছিলো মাত্র।

কাজী ব্যাচারা ভাবচ্যাক খেয়ে গেছে। আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তাকে বললাম, না। না, এ ঝোলা আমার না, এ নিশ্চয়ই ঐ নিগ্রোটার। ওকেই দিয়ে দিন।

এই বলে আমি সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। এই কাহিনী শুনে খলিফা হারুন অল রসিদ হেসে গড়িয়ে পড়লেন। খুশি হয়ে আলীকে নানা ইনাম উপহার দিয়ে বিদায় করলেন।

এরপর খলিফা শোয়ামাত্র নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে থাকলেন। শাহরাজাদ বলে, কিন্তু জাঁহাপনা, আপনি ভাববেন না, এর চেয়ে মজাদার কিসসা আপনাকে আর শোনাবো না। হারুন অল রসিদের আর একটা কাহিনী শুনুন।

শাহরিয়ার বললে, আমি তো শোনার জন্যেই ঘুম কামাই করে বসে আছি। শাহরাজাদ। এবার শুনুন হারুন অল রসিদের মহব্বতের কাহিনী :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *