2 of 4

৩.০৫ পীতাম্বর যুবকের কাহিনী

পীতাম্বর যুবকের কাহিনী

একদিন রাত্রে খলিফা হারুন অল রসিদ তার উজির জাফর, উজির অল ফজল, আবু ইশাক, কবি আবু নবাস এবং দেহরক্ষী মাসরুর হাবিলদার আহমদকে সঙ্গে নিয়ে সওদাগরের ছদ্মবেশে প্রাসাদ ছেড়ে পথে বের হলেন। খলিফা অনিদ্রা রোগে ভুগছেন। সারাদিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েও রাতে তার ঘুম আসে না। উজির জাফরের পরামর্শেই তিনি টাইগ্রিসের দিকে চললেন, জাফর বলেছিলো, মনের প্রশান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নৌকাবিহার বড় চমৎকার।

টাইগ্রীসের উপকূলে এসে ওঁরা একখানা নৌকা ভাড়া করে চেপে বসেন। রাত্রিকালে টাইগ্রিসের শোভা বড়ই মনোহর। মাথার ওপর চাঁদ ঝুলছিলো, মৃদুমন্দ সমীরণ বইছিলো। দূরে মাঝিরা দেহাতী গান ধরেছিলো। নৌকা চলতে থাকে।

এক সময় নদী-তীরবর্তী এক প্রাসাদোপম ইমারতের কাছে এসে পড়েন ওঁরা। খলিফা কান পেতে শোনেন, ঐ বাড়িটার ভেতর থেকে এক সুমধুর সঙ্গীত ভেসে আসছে। জাফরকে। উদ্দেশ্য করে বললেন, শুনতে পাচ্ছ?

জাফর বলে, বড় মিঠে গলা, জাঁহাপনা। এমন গান কখনও শুনিনি!

খলিফা বলে নৌকা ভেড়াও। দেখতে হবে কে গাইছে। এমন ভাল গান দূর থেকে শুনে কী আশ মেটে। যে ভাবেই হোক অন্দরে ঢুকতে হবে।

রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

.

পাঁচশো ষোলতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?

—জাফর, খলিফা বলেন, আমরা পরদেশী মুসাফির—এই বলে গৃহস্বামীর আতিথ্য নিতে হবে। বাড়ির ভিতরে না ঢুকতে পারলে এমন মধুর সঙ্গীত ভালো করে উপভোগ করা যাবে না।

নৌকা থামলে ওরা সকলে নেমে বাড়িটার দরজার সামনে দাঁড়ালেন। কড়া নাড়তেই এক খোজা প্রহরী এসে দরজা খুলে দিলো।

-কাকে চান, জনাব?

জাফর বলে, আমরা পরদেশী মুসাফির। আজকের রাতের মতো মাথা গোজার একটু আস্তানা চাই।

—আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি খবর দিচ্ছি।

খোজাটা অদৃশ্য হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গৃহস্বামী এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে।

—আসুন আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক, জনাব। আমার কী পরম সৌভাগ্য, আমার বাড়িতে পায়ের ধুলে দিতে এসেছেন আপনারা। এ ঘর-দোর আপনাদের নিজেদের মনে করে ভিতরে আসুন জনাব।

এক প্রশস্ত কক্ষ। সেখানে নিয়ে গিয়ে গৃহস্বামী যুক্তকরে বললো, মেহেরবানী করে আসন নিন।

ঘরখানা অতি মুল্যাবান আসবাবপত্রে সাজানো গোছানো। দেওয়াল ও ছাদে শিল্পীর তুলিতে আঁকা নানা ছাঁদের সুন্দর সুন্দর কারুকার্য। ঘরের ঠিক মাঝখানে স্ফটিকের চৌবাচ্চার মধ্যে বসানো একটা জলের ফোয়ারা। বিরাম-বিহীন ধারা বর্ষণ করে চলেছে। এবং তারই ফলে সারা ঘরটায় সুখদায়ক শীতলতা ছড়িয়ে পড়েছে।

গৃহস্বামী সবিনয়ে বললো, আপনাদের কে কী মর্যাদার মানুষ আমি জানি না। তাই, সকলকেই আমি সমান সম্মান দেখাচ্ছি। ঘরে অনেক প্রকারের আসন কুর্শি কেদারা আছে। আপনারা যে যেখানে বসতে ইচ্ছা করেন বসুন।

এরপর সে ঘরের অপর প্রান্তে চোখ রাখলো। সেখানে একশোটি সোনার কুর্শিতে একশোটি সুন্দরী তরুণী আসীন ছিলো। হাতের ইশারা করতেই ওরা এক এক করে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। এবং দ্বিতীয় সঙ্কেত করতে নফররা কারুকার্য করা একখানা কাপড় বিছিয়ে দিলো পাশের মেজ-এ। তারপর এক এক করে সুগন্ধী খানাপিনা এনে সাজিয়ে দিলো।

গৃহস্বামীর অনুরোধে ওরা সকলে বসে আহার করলো। মুখ-হাত ধোয়া শেষ হলে এবার গৃহস্বামী বললো, আপনারা আজ রাতে আমার ঘরে মহামান্য অতিথি। অনুগ্রহ করে বলুন, কী ভাবে আপনাদের তুষ্ট করতে পারি। আপনাদের যা অভিরুচি ফরমাইশ করুন; আমি পূরণ করার কৌশিস করবো।

জাফর বলে, আমরা যখন নদীর ঘাটে নৌকা ভেড়ালাম তখন এক সুন্দর সঙ্গীতের রেশ আমাদের কানে ভেসে আসছিলো। এবং আপনার এই ইমারত থেকেই আসছিলো বুঝতে

পারলাম। যদি কোনও অসুবিধা না থাকে তবে ঐ গান আমাদের একবার শোনান, জনাব।

গৃহস্বামী বললেন, অনেক ধন্যবাদ। এখুনি শোনাচ্ছি আপনাদের।

পাশের একটি নফরকে বললো তোমার মালকিনকে গিয়ে বলো, মেহেমানরা তার গান শুনতে চাইছেন।

ঘরের শেষ প্রান্তে দামী পর্দা টাঙানো ছিলো। তার ওপার থেকে গৃহস্বামীর বিবি উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম জানালো। একটু পরে সে গাইতে শুরু করলো। কী সে অপূর্ব গান। যেমন কথা তেমনি তার সুরেলা কণ্ঠ। সারা ঘরময় কান্নার বেদনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

খালিফা মুগ্ধ হয়ে আবু ইশাককে বলেন, ইয়া আল্লাহ, এমন গান আমি কখনও শুনিনি, ইশাক।

তারপর গৃহস্বামীর দিকে লক্ষ্য করে বললেন, মনে হয় গায়িকা তার প্রিয়তমের বিরহে একেবারে মুহ্যমান হয়ে গেছেন। গানের ভাষা ও সুরে তারই করুণ বেদনা ঝরে ঝড়ছে।

গৃহস্বামী বললেন, জী না সাহেব, আপনার এ অনুমান ঠিক না, তবে আপনজন—তার মা এবং বাবার বিয়োগের ব্যথা তাকে মথিত করে ফেলেছে। যখনই তাদের কথা মনে পড়ে সে এই ধরনের করুণ সুরের গান গায়।

খালিফা এই প্রথম গৃহস্বামীর দিকে ভালো করে তাকালেন। বয়সে সে যুবক। সুন্দর চেহারা। কিন্তু সারা মুখে এক বিষাদের ছাপ। যেন মনে হয়, দেহের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ। পীতাভ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সারা মুখ। যুবককে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমরা বিদেশী, আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারের কোনও কথা জানতে চাওয়া বোধহয় সঙ্গত হবে না, তবু বলছি, যদি আপত্তি না থাকে তবে বলুন, মুখের যে এই পীতাভ ফ্যাকাশে রং একি আপনার জন্মগত, না অন্য কোনও কারণে হয়েছে।

যুবক বললো, না, বলতে কোনও বাধা নেই। সে এক বড় বিচিত্র কাহিনী। আপনাদের যদি শোনার ধৈর্য থাকে, আমি শোনাতে পারি।

—আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে আছি। আপনি বলুন। এই সময় রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো সতেরোতম রজনী।

আবার গল্প শুরু করে সে?

—তাহলে শুনুন মালিক, আমার মাতৃভূমি উমান মুলুকে এক সময়ে আমার বাবা উমান শহরের নামজাদা সওদাগর ছিলেন। জাহাজের ব্যবসা ছিলো তার। নানা দেশের বন্দরে বন্দরে ভাড়া খেটে ঘুরে বেড়াতে সেগুলো। ত্রিশোনা জাহাজ। এর বাৎসরিক আয় ছিলো প্রায় তিরিশ হাজার দিনার।

বাবা খুব শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। সে-কারণে আমাকেও তিনি যথেষ্টই পড়া শুনা শিখিয়েছিলেন। জীবনের শেষ সময়ে বাবা আমাকে কিছু মুল্যবান উপদেশ দিয়ে যান। আমি শ্রদ্ধাভরে সেগুলো শুনেছিলাম সেদিন। এরপর আল্লাহ তাকে কোলে টেনে নিলেন।

বাবার মৃত্যুর পর আমি ইয়ার দোস্ত পরিবৃত হয়ে (তখন আমার অনেক টাকা কড়ি সুতরাং তাঁবেদারদের অভাব ছিলো না। একদিন বসে আছি এমন সময় অসময়ের ফলভর্তি একটা ঝুড়ি নিয়ে এসে হাজির হলো জাহাজের এক কাপ্তান। ফলগলো সত্যিই খুব সুন্দর এবং দুষ্প্রাপ্যও বটে। আমি ওকে একশো দিনার বকশিশ দিলাম। ইয়ার বন্ধুদের মধ্যে ফলগুলো বিলিয়ে দিতে দিতে কাপ্তানকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে এনেছ এই অকালের ফলগুলো। এখন তো আমাদের দেশে এসব পাওয়া যায় না।

কাপ্তান বলে, আমি সদ্য বসরাহ এবং বাগদাদ থেকে ফিরছি। ওখানকার বাজার থেকে সংগ্রহ করেছি। সাধারণ মানুষ এ ফল খেতে পারে না। সুলতান বাদশাহদের জন্য বিক্রি হয়।

আমার বন্ধু-বান্ধবরা বসরাহ আর বাগদাদের গুণগানে মুখর হয়ে উঠলো। সেখানকার মানুষ, তাদের আচার ব্যবহার, সভ্যতা ভদ্রতা নাকি অপরূপ। এক একজন এক-একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এমন সব সুন্দর সুন্দর কাহিনী শোনাতে থাকলো যে আমি বড়ই চমৎকৃত হলাম। আমার মনে দেশ ভ্রমণের বাসনা জেগে উঠলো। বিশেষ করে বসরাহ এবং বাগদাদ আমাকে দেখতেই হবে।

আমি আমার বিষয়-সম্পত্তি প্রায় জলের দরেই বেচে দিলাম। যত দাসী বাঁদী ছিলো তাও বেচলাম। একখানা মাত্র জাহাজ রেখে বাকীগুলো বেচে হাজার হাজার দিনার হাতে পেলাম। বেচলাম না শুধু আমার হীরে জহরত এবং সোনাদানাগুলো। তারপর দিনক্ষণ দেখে আমার সেই একমাত্র জাহাজখানায় চেপে বাগদাদের পথে রওনা হয়ে পড়লাম।

আল্লাহ সহায় ছিলেন। পথে কোনও বিপদ হলো না। কয়েকদিন পরে নিরাপদে এসে পৌঁছলাম বসরাহর বন্দরে। সেখান থেকে একখানা ছোট নৌকা করে চলে এলাম বাগদাদে।

আমার বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম বাগদাদের কার অঞ্চলে বিত্তশালীরা বাস করে। সেখানে একখানা বিরাট বাড়ি ভাড়া করে নিলাম। আমার বাড়িটা ছিলো ঠিক জাফরান পথের ওপর।

সেদিন জুম্মাবার ছিলো। আমি সদ্য শহরে এসেছি। শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখছি। বেড়াতে বেড়াতে এক সময় আমি টাইগ্রিসের উপকূলে এসে পড়লাম। সেখানে দেখি, একখানা বিরাট বাড়ির বাইরের বারান্দায় অনেকগুলো ছোট ছোট ছেলে এক পলিত-কেশ বৃদ্ধকে ঘিরে বসে আছে। আরও কাছে যেতে বুঝলাম তিনি কিস্সা শোনাচ্ছেন ছেলেদের। পরে জেনেছিলাম এই বৃদ্ধের নাম তাহির ইবন অল আলা। ছোটদের বন্ধু নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ছোট ছোট ছেলেদের তিনি খুব পেয়ার করেন। মজার মজার কাহিনী শোনান। নানারকম ফলমুল, মেঠাই-মণ্ডা খেতে দেন।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো আঠারোতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বৃদ্ধের কথাবার্তা শুনতে থাকলাম! বড় মজার মানুষ। তার

– গল্প বলার কায়দা ভারি অদ্ভুত। শুনতে শুনতে সব কিছু ভুলে যেতে হয়। ভে সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমার বাগদাদে আসা সার্থক হয়েছে।

বারান্দার ওপরে উঠে গিয়ে বৃদ্ধকে সালাম জানাতে তিনি আমাকে বসতে বললেন, সবিনয়ে বললাম, জনাব আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। আজ রাতটা যদি আপনার এখানেই কাটাই—

তিনি খুশি হয়ে বললেন, এতে আমার পরম সৌভাগ্যের কথা। বেশ তো থাকুন। খানাপিনা করুন। আমার এখানে অনেক রকম সুন্দর সুন্দর বাঁদী আছে। দশ বিশ পঞ্চাশ এমন কি একশো দিনারের মেয়েও আছে। আপনার যাকে পছন্দ সঙ্গী করে নিতে পারেন।

আমি বললাম, আমাকে একটা দশ দিনারের বাঁদী দিন। এই নিন একমাসের টাকা আগাম তিনশো দিনার।

বৃদ্ধের হাতে দিনারগুলো তুলে দিতে তিনি নিক্তি দিয়ে ওজন করে একটি ছেলেকে বললেন, সাহেবকে হামামে নিয়ে যাও। খুব ভালো করে গোসল করাও।

ঘষে মেজে গোসল করে আসার পর বৃদ্ধ আমাকে সঙ্গে করে একটা ঘরে নিয়ে গেলো। সেখানে একটি মেয়ে বসেছিলো। বৃদ্ধ তাদের সামনে আমাকে দেখিয়ে বললো, এই তোমার নতুন মেহেমান রেখে গেলাম।

তিনি চলে গেলেন। ভালো করে দেখলাম, মেয়েটি অপরূপ সুন্দরী। ওর লাবণ্য-লাস্য আমকে মুগ্ধ করলো।

সে আমাকে বসতে বললো। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। একটা মেজেয় সাজানো ছিলো নানারকম সুন্দর সুন্দর খানাপিনা।

দু’জনে মিলে আহারপর্ব সমাধা করলাম। তারপর সে আমাকে শরাবের পেয়ালা পূর্ণ করে দিলো। সেই রাতে সুরা এবং নারী-সুধা পান করলাম আকণ্ঠ।। মেয়েটি কায়দা-কানুন জানে, আমাকে অমৃতের সায়রে ভাসিয়ে রাখলো সারাটা রাত।

শুধু সেই একটা রাত্রিই নয় পর পর তিরিশটা রাত্রির সহচরী, শয্যা-সঙ্গিনী হয়ে আমাকে অনেক আনন্দ উজাড় করে দিলো সে। সুখের সময়গুলো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। একটা মাস কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। মনে হলো শুধুমাত্র একটা রাতই অতিবাহিত করেছি আমি।

ঠিক তিরিশটা রাত্রি কাটার পর একটি চাকর এসে আমাকে হামামে নিয়ে গেলো। গোসলাদি করার পর সে নিয়ে এলো আমাকে সেই বৃদ্ধের কাছে।

আমি বললাম, মালিক বড় আনন্দ পেয়েছি একটা মাস। এবার আপনি আমাকে কুড়ি দিনারের একটা মেয়ে দিন।

বৃদ্ধ হাত বাড়ালেন। আমি এক মাসের ভাড়া ছ’শ দিনার তার হাতে তুলে দিলাম। যথারীতি নিক্তিতে ওজন করলেন তিনি।

তিনি অন্য একটা ছেলেকে বললেন, যাও সাহেবকে নিয়ে যাও।

অন্য একটা ঘরে এসে দাঁড়ালাম। ঘরের মাঝখানে দুগ্ধ-ফেননিভ পালঙ্ক-শয্যা। তার চারপাশে চারটি দাসী দণ্ডায়মান। আমাকে বসতে বলে তারা পাশের ঘরে চলে গেলো। একটু পরে দেখলাম, এক খ্রীস্টান সুন্দরী এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। আগের মেয়েটির চেয়ে অনেক সুন্দর দেখতে। সাজ-পোশাকের বাহারও অনেক বেশি তার। সে আমার একখানা হাত ধরে পালঙ্কে বসালো।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো উনিশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?

সে আমাকে সোহাগ জানিয়ে বললো, সাহেবের এমন সুন্দর রূপ, তা এই ভাড়া করা মেয়ের দরকার হলো কেন? তোমাকে দেখে যে-কোনও মেয়েরই তো জিভে জল আসার কথা! যাই হোক, খানাপিনা তৈরি, চলো খেয়ে নিই আগে।

দুজনে তৃপ্তি করে খেলাম। খাবারের শেষে সুরা-সাধনা চলতে থাকলো। রাত বাড়ে। নেশাও বাড়তে থাকে। রক্ত নেচে ওঠে। আমরা শুয়ে শুয়ে অমৃতলোকে পাড়ি জমাই।

ভালো লাগে। বড় ভালো লাগে। অবশ্য এজন্য মেয়েটিই দায়ী। কী করে ভালো লাগাতে হয় সে বিদ্যা তার বেশ ভালো রকমই জানা আছে।

সারাটা মাস কেটে গেলো। আমি অনেক পেলাম। কিন্তু মনে হতে লাগলো, আরও চাই, আরও। আমার ক্ষুধার বুঝি শেষ নাই।

যথারীতি আবার চাকরটা এসে আমাকে হামামে নিয়ে গেলো, হামাম থেকে আবার সেই বৃদ্ধের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

আমি বললাম, অনেক আনন্দ পেয়েছি। আমার ইচ্ছা, বাকী জীবনটা আমি আপনার আনন্দ-গৃহেই কাটিয়ে দিই।

বৃদ্ধ বললেন উত্তম কথা। আজ রাতে আমাদের এই বাড়িতে এক সুন্দর উৎসব অনুষ্ঠান হবে। আপনি আমাদের মহামান্য অতিথি। আপনাকে এই উৎসবে যোগ দিতে অনুরোধ করছি। সন্ধ্যাবেলায় আপনি এসে সোজা-ছাদের ওপরে চলে যাবেন। সেখানেই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।

সেদিন ছাদের ওপরটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছিলো। ছাদের মাঝখানটায় একখানা মখমলের পর্দা খাটিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত করা হয়েছে। পর্দার ওপারে, দেখলাম এক তরুণ আর এক তরুণী গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে শায়িত।

পাতলা পর্দার বাধা থাকলেও মেয়েটির অসাধারণ রূপ-লাবণ্য আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো না। এমন আলোক-সামান্যা রূপবতী নারী আমি জীবনে দেখিনি কখনও। বুকের মধ্যে কামনার আগুন দাউ দাউ করে উঠলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। গত একটা মাস যে মেয়েটির সঙ্গে কাটিয়েছিলাম তার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ছাদের ওপরে যাকে দেখে এলাম, সে কে?

মেয়েটি মুচকী হেসে বলে, কেন, খুব বুঝি মনে ধরেছে? তা তো ধরবেই। তার মতো খুবসুরত মেয়ে তো তামাম আরবে নাই। সে-ই আমাদের মধ্যমণি। তার রূপের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কত সুলতান ও বাদশাহর ছেলে। তুমিও কী হাত বাড়াবে নাকি?

আমি বলি, ক্ষতি কী?

-না বিশেষ আর কী ক্ষতি। মাত্র পাঁচশো দিনার—এক রাতের ভাড়া।

মেয়েটি মুখ টিপে হাসে, ভালো করেই টোপ গিলেছ দেখছি। যাক কাল সন্ধ্যায় মালকড়ি নিয়ে এসো। সে তোমার বাদী হবে বৈকি।

পরদিন শাহজাদাদের জমকালো সাজ-পোশাকে সেজেগুজে এসে দাঁড়ালাম বৃদ্ধের সামনে। দিনারের একটা থলে বাড়িয়ে দিলাম তার হাতে।

-পনের হাজার আছে। এক মাসের ভাড়া।

বৃদ্ধ ওজন করে দেখে নিলো। তারপর একটি ছোকরাকে বললো, সাহেবকে নিয়ে যা। ছেলেটি আমাকে একখানা প্রশস্ত কামরায় নিয়ে এসে বললো, আপনি এখানে বসুন।

ছেলেটি বেরিয়ে যেতে পাশের ঘর থেকে দু’জন বাঁদী এসে আমাকে বললো, মেহেরবানী করে আমাদের সঙ্গে আসুন।

পাশের ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। এমন মূল্যবান গালিচা পর্দা, আসবাবপত্র আমি জীবনে কখনও দেখিনি। আর কী সুন্দর করে সব সাজানো গোছানো! দেওয়ালে দেওয়ালে নামী শিল্পীর আঁকা নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী। জীবন সার্থক হয়ে গেলো আমার।

ঘরের এক পাশে সোনার পালঙ্কে শুয়েছিলো সে। তার মাথা এবং পায়ের কাছে বাঁদীরা চামর দোলাচ্ছিল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি তাকে, তার রূপ-যৌবন,

লাস্যকে।

—আসুন আসুন, মালিক। আপনার পথ চেয়েই বসে আছি আমি।

যেন কেউ সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে উঠলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম, মেয়েটি দুহাত বাড়িয়ে আমাকে আহ্বান করছে।

—আসুন, বাঁদী আপনার সেবার জন্য প্রস্তুত মালিক। এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো কুড়িতম রজনী। আবার সে বলতে থাকে।

তার রূপের বর্ণনা দেব, সে ভাষা আমার নাই। তবে এইটুকু শুনে রাখুন, বেহেস্তের ডানাকাটা হুরী পরী সে। রূপবতী সুন্দরী নারী আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু এ মেয়ের সঙ্গে তাদের তুলনা চলে না। কবিরা হয়তো তাকে নিয়ে অনেক কাব্যগাথা রচনা করতে পারতেন, কিন্তু আমি এক সাধারণ মানুষ, সে ভাষা কোথায় পাবো। তবু বলবো, দুনিয়ার সেরা শিল্পীরও সাধ্য নাই তার মতো সুন্দরীর ছবি আঁকতে পারে।

সেই রাতে আমাকে সে অনেক সুমধুর গান শোনালো। সে গানের মিঠে সুর আজও আমার কানে বাজে। হৃদয়ের রক্তে, রন্ধ্রে অনুরণন তোলে।

শরাবের নেশায় পাগল হলাম, কিম্বা তার রূপের নেশায়, ঠিক বলতে পারবো না। তবে সে নেশার ঘোর আমার সারাটা মাস আর কাটলো না।

মাসান্তে আমার ডাক পড়লো। বৃদ্ধের সামনে নিয়ে গেলো নফর। আমি বললাম, আমার সব কিছু পাওয়া হয় নি, শেখসাহেব। আমি আরও কিছুকাল কাটাতে চাই তাকে নিয়ে।

বৃদ্ধ হেসে বললেন, এ তো বড় শুভ সংবাদ। তা টাকাটা আগাম যে চাই মালিক।

আমি লজ্জিত হয়ে বলি, একশো বার। এক্ষুণি আমি বাসায় গিয়ে নিয়ে এসে দিচ্ছি আপনাকে।

আরও পনের হাজার দিনার এনে দিলাম বৃদ্ধের হাতে। একটা মাস পরে আবার নফর এসে দাঁড়ায়। আমি তখন আরও বেশি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

আবার বৃদ্ধকে এনে দিলাম পনের হাজার দিনার। আর এক মাসের ভাড়া।

এইভাবে মাসের পর মাস চলে গেলো। সেই সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে গেলো আমার সমস্ত সঞ্চিত ধন। উমান থেকে যা কিছু এনেছিলাম সব শেষ হয়ে গেলো একদিন।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো একুশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

আমি কপর্দক শূন্য হয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকি। আমাকে কাঁদতে দেখে মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, মালিক, তোমার চোখে পানি কেন? কী হয়েছে?

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। দু হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠি, আমার আর কিছু নাই, সোনা। সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি পথের ভিখারি। পয়সা নাই সে জন্য আমার এক বিন্দু দুঃখ নাই মণি। শুধু এই ভেবে সারা হচ্ছি, তোমার সঙ্গ ছেড়ে আমাকে সরে যেতে হবে। তোমাকে না দেখে, আমি বাঁচবো কী করে?

মেয়েটি বলে, এর আগে একটা খদ্দেরেরও পয়সা ফুরিয়ে গিয়েছিলো। আমাকে নিয়ে সে অনেকদিন কাটাবার পর তারও বাড়িঘর বিষয়-সম্পত্তি সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার বাবা বড় ভালো মানুষ। তিনি বিনি পয়সায় আরও তিনটে দিন কাটাতে দিয়েছিলেন আমার সঙ্গে। তোমাকেও তিনি নিশ্চয় সেই কথাই বলবেন। কিন্তু প্রিয়তম, তুমি যেমন আমাকে ছেড়ে বাঁচতে পারবে না, আমিও তেমনি তোমার অদর্শন সইতে পারবো না। যেভাবেই হোক আমি একটা ফিকির বের করবো। যাতে তুমি আমি একসঙ্গেই সারাজীবন কাটাতে পারি তার একটা ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। যাক, ও নিয়ে তুমি কোনও দুর্ভাবনা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দরকার হলে আমার নিজের ভবিষ্যৎ আমিই নির্ধারণ করবো। বাবার কিছু বলার নাই, আমি বড় হয়েছি এখন। আমার স্বাধীন ভাবে চলা-ফেরার অধিকার আছে। তাতে কেউ বাধা দিতে পারে না। আমি তোমাকে পাঁচশো দিনার দিচ্ছি। এটা নিয়ে গিয়ে তুমি বাবাকে দিয়ে বললো, এখন থেকে রোজকার পয়সা বোজ দেবে। তাতেও তিনি না করবেন না। আজ তুমি যে টাকাটা বাবার হাতে দিয়ে আসবে সেই টাকাটা তিনি আমাকে দেবেন। আগামীকাল আবার সেই টাকাটা নিয়ে গিয়ে বাবাকে দিও। এইভাবে চলতে থাকলে বাবা বুঝতে পারবেন না। তোমারও আর থাকার কোনও অসুবিধা ঘটবে না।

মেয়েটির এই আশ্চর্য ফন্দীতে একটা বছর ওকে নিয়ে দিব্যি আনন্দে কাটালাম। কিন্তু নসীবে সুখ চিরকাল থাকে না কারো। মেয়েটি একদিন রাগের মাথায় তার দাসীকে একটা থাপ্পড় মেরে বসলো। আর সেই হলো আমার কাল। জব্দ করার জন্য সে বৃদ্ধের কাছে গিয়ে আসল কথা সব ফাঁস করে দিলো।

মেয়ের বাবা তো ক্ষেপে আগুন। তিনি শুধু মারতেই বাকী রাখলেন। ঠগ জোচ্চোর প্রতারক নানারকম বিশেষণে ভূষিত করলেন আমাকে।

-আপনার মতো এই রকম জালিয়াত ঠগ আমি কম দেখো। আমার নিয়ম আছে পয়সা ফুরিয়ে গেলে তিনটি দিন আমি তাকে বিনি পয়সায় থাকতে দিই।

কিন্তু আপনি আমাকে ধোঁকা দিয়ে মেয়ের সঙ্গে সাট করে গোটা একটা বছর কাটিয়েছেন। আর নয়, এবার মানে মানে কেটে পড়ুন। আমার এখানে কোনও জায়গা হবে না। শুধু এখানে কেন, এই বাগদাদ ছেড়ে চলে যেতে হবে আপনাকে, এবং আজই। নইলে আপনার লাস টাইগ্রিসে ভাসবে কাল।

বৃদ্ধ আমার দিকে দশটা চাঁদীর দিরহাম ছুঁড়ে দিলো। এই নিন রাহাখরচ। আধঘণ্টার মধ্যে বাগদাদের সীমানা ছেড়ে চলে যান।

উমানের সওদাগর-সম্রাটের পুত্র আমি। একদিন কয়েক লক্ষ দিনারের মালিক ছিলাম। আর আজ পথের ভিখারী। কী খাব কোথায় যাব কিছুই জানি না।

হাঁটতে হাঁটতে একদিন বসরাহ এসে পৌঁছলাম। খিদেয় পেট জ্বলছিলো। অথচ ট্যাঁকে কানা-কড়ি নাই। চেয়ে-চিন্তে কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা, সেই আশায় বাজারের দিকে চলেছি, হঠাৎ চমকে উঠলাম। পিছন থেকে কে যেন আমার কাঁধে হাত রেখেছে। ফিরে দেখি আমার দেশ উমানের এক সওদাগর। বাবার দোকানের কর্মচারী ছিলো এক সময়। এখন নিজেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ পয়সা করেছে।

—আরে, মালিক আপনি এখানে?

—আর মালিক। কে যে কখন বাদশাহ আর কে যে কখন ফকির হয় কে বলতে পারে।

আমার এই ধরনের দার্শনিক কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারলো না সে। বললো, কেন, কী হয়েছে?

আমি তখন আমার সব আনন্দ-দুঃখের কাহিনী খুলে বললাম তাকে।

—আমার যা ছিলো সবই তুলে দিয়েছি ওই বুড়োর হাতে। সে যে কী পরিমাণ অর্থ নিশ্চয়ই তুমি আন্দাজ করতে পার। ত্রিশোনা জাহাজ বিক্রির টাকা। তাছাড়াও আমার বাড়ি-ঘর জমি-জমা দোকান-পাট বেচেও পেয়েছিলাম অনেক। এর সঙ্গে ছিলো বাবার শখের সম্পত্তি-হীরে জহরত সোনা-দানা। সেও প্রচুর। সব মিলে কয়েক লক্ষ দিনার। এর একটা পয়সাও আমি অন্য দিকে খরচ করিনি। সবই দিয়েছি ঐ বুড়োকে। তার বিনিময়ে সে আমাকে তার মেয়ের সঙ্গে কাটাতে দিয়েছ কিছুকাল। আজ যখন আমি নিঃশেষ, রিক্ত, তখন সে আমাকে বের করে দিয়েছে। একটা পয়সা নাই যে রুটি সবজী সংগ্রহ করি।

বলতে বলতে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিলো। সে বললো, দুঃখ করে কোনও ফল হবে না মালিক। নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। না ঠেকলে মানুষ শেখে না। তবে অনেক সময় এই শিক্ষালাভের জন্য এতো মূল্য দিতে হয় যে আর টিকে থাকাই দায় হয়। যাক, সামনে চলতে হবে। নতুন করে বাঁচার ধান্দা করতে হবে। যতদিন না সময় সুযোগ হয় আপনি আমার গদিতেই থাকুন। বসরাহর বন্দরে আমি ভূষি-মালের কারবার করি। সারাদিনের কেনা বেচার হিসেবপত্র রাখবেন। তার বদলে খানাপিনা এবং নগদেও কিছু ধরে দেব। আপনি আমার মালিকের সন্তান। অবস্থার ফেরে পড়েছেন। তাই বলে মনে করবেন না আপাকে কর্মচারী করে রাখতে চাই। আপনি আমার দোকানটা দেখা-শুনা করবেন। তার সম্মান দক্ষিণা হিসাবে সামান্য কিছু দেবো আমি।

মনে সাহস এবং আশা ফিরে পেলাম। যাক, দুনিয়াতে সব মানুষই তবে অকৃতজ্ঞ নয়। এখনও কিছু হৃদয়বান পরোপকারী লোক আছে।

বসরাহর বন্দর বাজারে বছরখানেক কাটে। ইতিমধ্যে শ’খানেক দিনার জমিয়ে ফেলেছি। ভাবলাম, আর এইভাবে বসে বসে সময় নষ্ট করবো না। এই একশো দির সম্বল করেই ব্যবসা শুরু করবো।

একদিন বাগদাদের জাহাজে চেপে বসলাম।

জাহাজের পাটাতনে বসে দুর দিগন্ত বিস্তৃত অশান্ত জলরাশির দিকে তপলকভাবে তাকিয়ে থাকি। জাহাজ চলেছে, যাত্রীর কোলাহল, খালাসীদের ব্যস্ততা সারেঙের হাঁক–কিছুই কানে প্রবেশ করে না। আমি শুধু একা একা বসে অতীতের পাতা ওলটাই। স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাই।

হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি পাটাতনের এক পাশে কয়েকজন সওদাগর ঘিরে ধরেছে আর এক সওদাগরকে। সে একটা পোঁটলা খুলে মেলে ধরেছে তাদের সামনে। মুহূর্তে আমার চোখ ঝলসে গেলো। একসঙ্গে এতো চুনী-পান্না মুক্তো প্রবাল, নাগরাজ মণি প্রভৃতি মূল্যবান রত্ন কখনও দেখিনি।

ওদের কথাবার্তা এবং কলকোলাহল থেকে বুঝলাম, সওদাগর সাহেব। নানা দেশে ঘুরে স্বদেশে ফিরছেন। অনেক হীরে জহরত বিক্রী করেছেন। শেষে এইটুকু আর বেচা হয় নি। তাই সবাইকে বলছেন, যার দরকার। এগুলো নিয়ে নিন, খুব সস্তা দরে দিয়ে দেবো।

কিন্তু মওকা বুঝে সওদাগররা তেমন বড় একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তারা দাঁও খুঁজছিলো। নিশ্চয়ই সে নামবার আগে প্রায় মাটির দরে দিয়ে যাবে।

হয়তো দিতও তাই। কারণ অনেকদিন ঘর ছাড়া। আজ প্রথম পরবাস থেকে নিজের শহরে পা রাখবে সে। ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেও অনেক। লাভের অঙ্কটা নেহাত মন্দ আসে নি। এখন এই সামান্য কটা মাল নিয়ে আর ঝুলে থাকার ইচ্ছে নয় তার। জাহাজ থেকে নামার আগে হাত সাফ করতে চায় সে।

হঠাৎ আমার দিকে নজর পড়লো সওদাগর সাহেবের। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে পরিচয় হাতড়াতে লাগলাম।

-আপনি এখানে?

আমি তখনও তাকে ঠিক চিনতে পারছি না বুঝে তিনি বললেন, আপনার বাবা উমানের সওদাগরদের বাদশাহ ছিলেন, মালিক। আমি আপনার বাবার কাছে অনেক হীরে জহরত বিক্রী করে এসেছি। বহুত খানদানী বড়া আদমী ছিলেন আপনার বাবা। শুনলাম, তিনি গত হয়েছেন। তা আপনি এখন কোথায় ব্যবসা করেন, মালিক? আমি বললাম, ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু করি না।

করবারই বা কী দরকার। বাবা যা রেখে গেছেন তা সাতপুরুযে বসে খেলেও ফুরোবে। এগুলো দেখলেন হুজুর? পছন্দ হয়?

আমি বলি, পছন্দ হলেই বা কী করবো, বলুন। এই দুনিয়াতে আমি এখন মাত্র একশো দিনারের মালিক। তার বেশি এক আধলাও আমার নেই।

সওদাগর অবাক হন। বলেন, সে কি কর্তা? অতবড় বিশাল সম্পত্তি, নষ্ট হলো কিসে?

আমি বললাম, সে অনেক দুঃখ লজ্জার কাহিনী। এতো লোকের সামনে বলি কী করে। আর বলেই বা কী হবে। যা গেছে তা গেছে। ফিরে আসবে না কোনও দিন এবং ও নিয়ে দুঃ খও করি না। এখন আমি মাত্র একশোটা দিনার সম্বল করে অনির্দিষ্ট পথে চলেছি। যদি বরাতে কিছু থাকে হবে। না হলে—না হলে আর ভাবি না, যা হয় হবে।

সওদাগর আমার কথায় অভিভূত হয়ে বললেন, এক কালে আপনার বাবার পয়সা বহু লোকে খেয়েছে। আমিও যে তার ভাগ পাইনি তা নয়। যখনই গেছি তার কাছে—শূন্য হাতে কিরিনি। শৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি। ভালো হীরে জহরত মূল্যবান রত্ন কিছু নিয়ে গেলে লুফে নিতেন। দরদাম একদম পছন্দ করতেন না। মুখ ফুটে চাইতে পারলেই হতো। সেই দামই মঞ্জুর করতেন তিনি। তাই বলছিলাম, এক সময়ে আপনাদের অনেক খেয়েছি আজ না হয় আপনার এই অসময়ে তার কিছু ফেরতই দিলাম। আপনি এগুলো নিন মালিক! যদি বরাতে থাকে, যদি তেমন তেমন মক্কেলের দেখা পান এতেই আপনার অনেক হবে।

আমি বললাম, কিন্তু আমি দাম না দিয়ে নেব না। এবং ও-সব জিনিসের দাম আমার কাছে নাই।

সওদাগর নাছোড়বান্দা। বললেন, ঠিক আছে আপনি ঐ একশো দিনারই দিন আমাকে। ঐ দামেই আপনাকে বেচবো আমি।

তবু আমার মনে হতে লাগলো তিনি আমাকে যেন কৃপা করতে চাইছেন। আমি রাজি হবো কি হবো না ভাবছি। তিনি পুঁটলিটা বেঁধে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নিন ধরুন। ভাববেন না, আপনাকে আমি দান করে দিলুম। বাজারে দরদাম করে বেচলে হাজারখানেক লাভ করতে পারবেন। সে আর এমন কী। একশো দিনারে মাল কিনে হাজার দিনার কী নাফা হতে পারে না!

আমার দ্বন্দ্ব ঘুচে গেলো। তাই তো, ব্যবসাতে এরকম মওকা কখনও আসে বইকি। এবং সে সময়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকে নাকি কেউ?

সওদাগরের হাতে আমার পুঁজিটা তুলে দিয়ে রত্নের পুটলিটা নিয়ে নিলাম। এই সময়ে ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো তেইশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

সেই থেকে আমার ভাগ্যের বিবর্তন শুরু হলো। বাগানে এসে আমির অমাত্যদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে অনেক গুলো মাল বিক্রি করতে পারলাম। হাতে কিছু পয়সা হলো। তখন একটা দোকান ভাড়া করে কেনা-বেচার ব্যবসা শুরু করে দিলাম। দিনের শেষে লাভও থাকলো কিছু কিছু।

আমার রত্নগুলোর মধ্যে অদ্ভুত ধরনের একটা বস্তু ছিলো। সমুদ্রের কোনও ঝিনুক-টিনুক জাতীয় কিছু একটা হবে। দেখতে লাল টুকটুকে। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় দুটো চোখ এবং ফড়িং -এর মতো দু’খানা ঠ্যাং আছে তার। যাইহোক, বাজারের অনেককেই দেখালাম। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারলো না। এবং দামও দিতে চাইলো না কিছু। ভেবেছিলাম এক দুই দিনারও যদি পাওয়া যায় বেচে দেব। কিন্তু পনেরো দিরহামের বেশি দাম দিতে চাইলো না কেউ। আমি আর ও নিয়ে সময় নষ্ট করলাম না। দোকানের একটা তাকে ফেলে রাখলাম। থাক, যদি কখনও কারো দরকারে লাগে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে।

একদিন দোকান খুলে আছি, এক পরদেশী এসে ঢুকলো। আমি তাকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, বসুন, মালিক। কী চান বলুন? কী দেব?

আগন্তুক তাক-এ রাখা সেই অদ্ভুত বস্তুটার দিকে তাকিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, ইয়া আল্লাহ, এতোদিনে পেলাম।

অনেক দিনের অনাদরে অযত্নে পড়ে থাকার জন্য ওটার ওপর ধুলো বালি জমে গিয়েছিলো। লোকটি হাতে তুলে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে থাকলো। আমি ঈষৎ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এই সাত সকালে কোথায় ভাবলাম একটা মক্কেল এলো, তা না, যত সব ঝুট ঝামেলা–

লোকটা বললো, কত নেবেন এটা।

আমি বললাম, কত দিতে পারেন?

—কুড়ি দিনার।

একেবারে কুড়ি দিনার। আমি ভাবলাম লোকটা রসিকতা করতে, ঢুকেছে। রাগ হলো, কিন্তু আমি দোকান খুলে বসেছি। খদ্দেরের সঙ্গে রাগারাগি করা কেতা বিরুদ্ধ। মনের রাগ মনে চেপে নির্লিপ্ত ঠাণ্ডাগলায় বললাম, আপনি আসতে পারেন।

সে কিন্তু অন্যরকম ভাবলো, দামের অঙ্কটা শুনে হয়তো গোসা হয়েছে আমার। তাই আমাকে তোয়াজ করে বললো, আহা রাগ করছেন কেন? আমি খদ্দের, আমার যা ইচ্ছে দাম বলতে পারি। আপনার পোয় দেবেন, না হলে দেবেন না। এর মধ্যে রাগারাগির কী থাকতে পারে। ঠিক আছে পঞ্চাশ নিন। এবার নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম। লোকটার তামাশা করার ঢং দেখে রী রী করে জ্বলে উঠলো আমার শরীর। কিন্তু কথা উঠলে রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলবো, তার চাইতে গুম মেরে বসে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম। এক-খানা হিসেবের খাতা টেনে নিয়ে সেই দিকে মনোনিবেশ করতে চাইলাম। ভাবলাম এইভাবে ওকে দোকান থেকে বিদায় করবো। কিন্তু তা হলো না! দুম করে সে বললো, একহাজার দিনার, দেবেন?

এবার আমি ওর মুখের দিকে কটমট করে তাকালাম। ইচ্ছে হলো একটা ঘুষি মেরে ওর মুখের আদলটা বিগড়ে দিই। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার খাতার দিকে মনোসংযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। লোকটা একটু বেহুদা!

—আহা, আমার কথাটা একটু শুনুন। কী চান বলুন, দুহাজার, তিন হাজার, চার হাজার?

আর একটাও কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না আমার। সে এক তরফা বকেই চললো, দশ পনেরো–বিশ হাজার?

একটা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, কী ব্যাপার? আপনার মতলব কী? বিক্রি করতে চান, না চান না। সাফ সাফ বলে দিন।

তার চেঁচামেচিতে ততক্ষণে রাস্তার অনেক পথচারী দোকানে উঠে এসে ভিড় জমিয়েছে।

—কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

লোকটা বলে দেখুন, আমি এই জিনিসটা কিনতে চাই। তা নিজে থেকেও উনি দাম বলবেন। আমি দর দিচ্ছি তাও হ্যাঁ না কোনও জবাব দেবেন না।

একজন বললো, সে কি গো দোকানী, খদ্দেরের সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করে নাকি!

আমি দারুণ অস্বস্তিতে পড়লাম। একটা তুচ্ছ কারণে এতো লোক জমায়েত হয়ে গেছে। লোকটা তো মহাশয়তান। আমি বেশ রাগত স্বরেই বললাম। কী ব্যাপার, আপনি সত্যিই কিনতে চান, না মস্করা করছেন?

লোকটাও ঠিক তেমনি ভাবে জবাব দেয়, আপনি সত্যিই বিক্রী করতে চান, না, মস্করা করছেন?

নিশ্চয়ই বিক্রী করতে চাই।

-তাহলে আমার শেষ কথা শুনুন, আমি এর জন্য ত্রিশ হাজার দিনার দিতে পারি। যদি মনে করে লেনদেন শেষ করে দিতে পারেন।

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। চিৎকার করে উপস্থিত লোকদের সাক্ষী মানলাম, আপনারা শুনছেন, শুনছেন তো সব? আমি কিন্তু এক্ষুণি মেনে নেব ওঁর কথা! তখন পিছটান দিলে শুনবো না।

—আমিও শুনবো না। একবার যদি মেনে নেন আমার দাম। দিতে হবে ঐ দামে।

—আলবাৎ দেব। ফেলুন কড়ি।

—ত্রিশ হাজার?

-হ্যাঁ, ত্রিশ হাজারই দেব।

তখন লোকটি উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ করে বললো, আপনারা সাক্ষী। উনি আমাকে এই জিনিসটা ত্রিশ হাজার দিনারে বিক্রী করছেন। আমি এক্ষুণি দাম মিটিয়ে দিচ্ছি।

এ বলে সে একটা বস্তা এনে আমার সামনে রাখলো।

লেনদেন চুকে গেলো। সেই অদ্ভুত বস্তুটা জেবে ভরলো সে। আমি ত্রিশ হাজার দিনার বাক্সে তুললাম। লোকজন বিদায় নিলো। দোকানের ভিড় পরিষ্কার হয়ে গেলো। কিন্তু লোকটি গেলো না। আমার পাশে এসে বসলো। তারপর করুণা প্রদর্শন করে বললো, আপনার জন্য দুঃখ হচ্ছে। রাগের মাথায় এমন একটা অমূল্য জিনিস এই নামমাত্র দামে বেচে দিলেন? বুঝতে পারছি, আপনি একেবারে অজ্ঞ। জহুরীর ব্যবসাই কেঁদেছেন! কিন্তু আসল জহরত চিনতে পারেন না।

-মানে?

-মানে আর কিছুই নাই। হাতের মুঠোয় সাতরাজার ধন এসেছিলো। কিন্তু চিনতে পারলেন না? ছাইএর দামে বেচে দিলেন?

—ছাই-এর দামে?

-হ্যাঁ, ছাই-এর দামে। এর দাম মাত্র ত্রিশ হাজার নয়। ত্রিশ লক্ষেও এ বস্তু সংগ্রহ করা যায় না।

সেই মুহূর্তে আমার মাথাটা ঘুরে গেলো। কী ভাবে আমি প্রতারিত হয়েছি ভাবতে গিয়ে অজ্ঞান অচৈন্য হয়ে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম আমার সারা মুখের রক্ত দেহে নেমে গিয়ে পাণ্ডুর বর্ণ হয়ে গেছে। সেই থেকে আমার এই অবস্থা। অনেক চিকিৎসাপত্র করেও মুখের স্বাভাবিক অবস্থা আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি।

যাইহোক অনেক্ষণ পর ধাতস্ত হয়ে লোকটিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা বলুন তো, বস্তুটা কী। কী কাজেই বা লাগে? কেনই বা এর এতো দাম?

সে বললো, ভারত-সম্রাটের এক পরমাসুন্দরী কন্যা আছে। সারা দুনিয়ায় তার রূপের খ্যাতি। লোকে বলে, তার সমতুল্য রূপবতী নাকি আর দুটি নাই। কিন্তু সেই কন্যা এক দুরারোগ্য মাথার যন্ত্রণায় ভুগছে। নানা দেশের অনেক হেকিম বদ্যি তার চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু সুফল হয়নি।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চব্বিশতম রজনী।

আবার কাহিনী শুরু হয়।

ভারত-সম্রাটের আমি এক পারিষদ। একদিন তাকে বললাম, আপনার কন্যার এই দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে পারেন এমন ধন্বত্বরী মহাপুরুষের আমি সন্ধান পেয়েছি, সম্রাট।

-কে সে?

ব্যবিলনে বাস করেন এক সিদ্ধপুরুষ। তার নাম সাদ আলী। তিনি নাকি কঠিন অসুখ সারিয়ে দিতে পারেন। তবে সে অনেক খরচের ব্যাপার।

আমার কথা শুনে সম্রাট হাসলেন। কন্যা আমার প্রাণ-প্রতিমা। তার নিরাময়ের বিনিময়ে সাম্রাজ্যও দিয়ে দিতে পারি। যাও তুমি তার কাছে। যত অর্থ প্রয়োজন নিয়ে যাও। কন্যা সুস্থ হয়ে উঠবে, তার চেয়ে বড় কিছু নাই আমার কাছে।

আমি ব্যাবিলনে গিয়ে পীর সাদ আলীর সঙ্গে দেখা করলাম। সম্রাট নন্দিনীর অসুখের বিস্তারিত বিবরণ শোনালাম তাকে। তিনি বললেন, সাত মাস ধরে আমি বিচার বিবেচনা করবো। তারপর দেব বিধান।

সাতমাস ধরে তিনি গুনে পড়ে দেখলেন। তারপর বললেন, সমুদ্রে এক দুষ্প্রাপ্য শঙ্খ এই রোগের একমাত্র রক্ষাকচ। একটা ছোট লাল টুকটুকে বস্তু আমাকে দেখালেন! তার দুটি চোখ। ফড়িং-এর মতো দু’খানা ঠ্যাং। অনেকটা সমুদ্রের ফেনার মতো অদ্ভুত বস্তু। তিনি বললেন, সারা দুনিয়ায় কয়েকটিমাত্র আছে। পয়সা কড়ি দিয়ে এর দাম মেটানো যায় না। যাইহোক, তুমি আমাকে এক কোটি দিনার দিও।

দাম শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। যাইহোক, সম্রাটের হুকুম যত টাকা লাগে দেব, যদি মেয়ের রোগ সারে।

সাদ আলী সেই শাঁখটাকে আমার হাতে দিয়ে বললেন, মেয়ে গলায় হারের মতো ঝুলিয়ে রাখবে। দেখবে আর কোনও রোগ নাই। কিন্তু সাবধান গলা থেকে খুলবে না।

তা হলে আবার আক্রমণ করবে।

কী আশ্চর্য, একটা কবচ করে হারের মতো পরার দিন থেকে ১ সম্রাট-কন্যার সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গেলো। যে মেয়েকে শিকল দিয়ে বেঁধে। রাখতে হতো, সেই মেয়ে আবার হাসি গানে মুখর হয়ে উঠলো। সম্রাট নিশ্চিন্ত হলেন। প্রজারাও খুশি হলো।

কিন্তু সে-সুখ আর বেশিদিন সইলো না সম্রাটের। রাজকন্যা একদিন? সখী-সহচরীদের সঙ্গে নিয়ে কলহাস্যে মুখর হয়ে নৌকা-বিহারে বেরুলেন! সে-ই তার কাল হলো। আনন্দের হুটোপুটিতে কখন যে গলা থেকে রক্ষাকবচের হারটা নদীর জলে পড়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। কিন্তু একটু পরেই মাথাটা যখন, টনটন করে উঠলো তখন গলার দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠলেন তিনি। সেই থেকে রাজকন্যা আবার নিদারুণ মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। সম্রাট আমাকে ব্যাবিলনে পাঠালেন, আর একটা রক্ষকবচ কেনার জন্য। কিন্তু ব্যাবিলনে এসে শুনলাম, সাদ আলী দেহ রেখেছেন। চোখে অন্ধকার দেখলাম। সম্রাট বললেন, দিকে দিকে লোক পাঠাও। পৃথিবীর যে প্রান্তে পাওয়া যায় সংগ্রহ করে নিয়ে এস সেই রক্তবর্ণ রক্ষাকবচ। যত অর্থ প্রয়োজন হয়, দেব আমি।

আমরা দশজন অমাত্য পৃথিবীর দশ দিকে অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছিলমা। আজ আপনার দোকানে এসে, একমাত্র তার ইচ্ছায়ই, সেই হারা-নিধি অমূল্য-বস্তুর সন্ধান পেলাম। তার পরের ঘটনা তো আপনার জানা।

আমাকে আফশোশের হুতাশনে দগ্ধ করে রেখে সে বিদায় নিলো। ব্যবসা-বাণিজ্যে আর মন বসলো না। দোকানপাট বেচে দিয়ে আমি আবার গেলাম আমার প্রিয়ার সন্ধানে।

টাইগ্রিসের উপকূলের সেই প্রাসাদোপম ইমারত। কিন্তু একি তার জরাজীর্ণ দশা! চুনবালি খসে খসে পড়ছে। জানলার শার্সির কাচ ভাঙ্গা। কার্নিশে আগাছারা আড্ডা জমিয়েছে। কতকাল ঝাড়ু পড়েনি। ধুলোবালিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে সারা বাড়িটা।

দরজার একটি চাকরকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম। কী ব্যাপার এমন দশা হলো কী করে?

ছেলেটি বললো, সেই রমরমা আর নাই। সব শেষ হয়ে গেছে।

আমি জিজ্ঞেস করি, সেই বৃদ্ধ? তার মেয়েরা?

—উমানের এক সওদাগর-পুত্র—আবু অল হাসান তার নাম। তার সঙ্গে আমাদের মালিকের মেয়ের পেয়ার হয়েছিলো। কিন্তু বাড়ির মালিক মেয়ের বাবা জানতে পেরে তাকে তাড়িয়ে দেন। এতে অধর্ম সইবে কেন, হাসান সাহেব তার সব সম্পত্তি বেচে দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা এনেছিলেন। আমাদের মালিক সেগুলো হাতিয়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। সেই থেকে বৃদ্ধের বরাত খারাপ হয়ে গেলো। সে সময় সারা বাড়িটায় কত মেয়ে ছিল। কত খদ্দের আসতো। সারা বাড়িটা গমগম করতো দিনরাত। কিন্তু হাসান সাহেব যাওয়ার পর মালিক-কন্যা শয্যা নিলেন। কাজ কাম একেবারে বন্ধ করে দিলেন। সারা দিন-রাত ঘরের দরজা বন্ধ করে শুধু কাঁদেন—আর কাঁদেন। না আছে খাওয়া না আছে নাওয়া। দিনকে দিন। অমন ননীর শরীর শুকিয়ে যেতে লাগলো। বৃদ্ধ বাবা মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন মা, মনে কোনও দুঃখ রেখ না। এখানে কোনও মানুষই চিরদিন থাকবে বলে আসে না। ওরা আসে মরশুমী ফুলের মধু আহরণ করতে। ভালবাসতে আসে না কেউ। কিন্তু বৃদ্ধের এই সান্ত্বনায় কোনও কাজ হলো না। দরজা তিনি খুললেন না।

তিনিই ছিলের সারা বাড়ির শতেক মেয়ের সেরা—মধ্যমণি। তার মতো সুন্দরী তামাম বাগদাদে ছিলো না কেউ। আজও নাই। কত বড় বড় আমির সওদাগর আসতো। কিন্তু তারা যখন শুনলো মালিকের মেয়ে আর কোনও খদ্দের ঘরে ঢোকাবে না তখন ভিড় কমতে থাকলো। সারা বাগদাদে এই বাড়িটা সেরা ফুর্তির জায়গা বলে দেশ-বিদেশের লোকে জানতো। দুনিয়ার নানা দেশ থেকে কত ধনী সওদাগর আসতো এখানে। কিন্তু নাম একবার খারাপ হয়ে গেলে ব্যবসা রাখা দায় হয়।

মেয়ের অবস্থা দেখে মালিক তাহির সাহেব চিন্তিত হলেন। দেশ বিদেশে লোক পাঠালেন হাসান সাহেবের সন্ধানে। কিন্তু কি করে তার সন্ধান পাওয়া যাবে? দীন দরিদ্র অবস্থায় তিনি হয়তো অখ্যাত অজ্ঞাত কোন জায়গায় পড়ে আছেন।

শেষে, বৃদ্ধ তাহির সাহেব ব্যবসা-পাতি গুটিয়ে নিলেন। বাড়ি ভর্তি মেয়ে ছিলো। সবাইকে তিনি ছেড়ে দিলেন। সারা বাড়িটা খাঁ খাঁ করতে লাগলো। একদিন মাইফেল মজলিশে সরগরম থাকতো যে বাড়ি, আজ সেটা পড়ো ভূতুড়ে হয়ে পড়ে আছে। একটা মানুষ আসে না আজ।

আমি জিজ্ঞেস করি, মালিক তাহির সাহেব গেলেন কোথায়?

—তিনি আর এ বাড়িতে থাকেন না। দেহ জরাজীর্ণ হয়েছে। মেয়ের দুঃখে তিনি নেতিয়ে পড়েছেন। এখন শহরের ভিতরে তার এক আত্মীয়ের কাছে আছেন।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো পঁচিশতম রজনী।

আবার সে গল্প শুরু করে :

আমি বললাম, যাও তোমার মালিককে খবর দাও। বল, হাসান সাহেব ফিরে এসেছেন। তিনি তার বাড়িতে অপেক্ষা করছেন।

আমার কথা শুনে ছেলেটি একবার আমার আপাদমস্তক ভালো করে নিরীক্ষণ করে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো, আপনি সাহেব? দাঁড়ান, আমি আসছি।

প্রায় ছুটতে ছুটতে সে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবং অল্পক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো শেখ তাহিরকে সঙ্গে নিয়ে।

বৃদ্ধের দেহের সেই জৌলুস আর নাই। চোখের কোলে কালি পড়েছে। গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। মনে হলো, এই দু’বছরে বয়স যেন বিশ বছর বেড়ে গেছে তার।

আমাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়কে কাঁদতে থাকলেন তিনি।

-কোথায় ছিলে বাবা? তোমার জন্যে মেয়েটা আমার কেঁদে কেঁদে সারা হয়ে গেছে। তোমার টাকা পয়সা-যা আমার কাছে গচ্ছিত আছে সব ফেরত নিয়ে আমাকে ঋণ মুক্ত কর।

এই বলে একটা মোহর ভর্তি বস্তা এনে আমার সামনে রাখলেন তিনি।

—এতে এক লক্ষ দিনার আছে। এ সবই তোমার টাকা। নিয়ে আমাকে ভার মুক্ত কর। আজ দুটো বছর মেয়েটা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তুমি ওকেবাঁচাও বাবা, এই আমার একমাত্র ভিক্ষে তোমার কাছে।

আপনারা বিশ্বাস করুন জনাব, আমাকে দেখা মাত্র আমার প্রেয়সী আনন্দে মুছা গেলো। দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা। সে অশ্রু আনন্দের।

সেই রাতেই তাহির সাহেব কাজী এবং সাক্ষী সাবুদ ডেকে এনে আমাদের শাদী দিয়ে দিলেন। সেই থেকে তাহির সাহেবের প্রাণাধিক কন্যা আমার আদরের বিবি হলো। আমার এতো দিনের বাসনা পূর্ণ হলো। তাকে নিয়ে পরমানন্দে ঘর করছি আমি। আজ আমার মনে আর কোনও খেদ নাই। ওর ভালোবাসায় ভরে আছি কানায় কানায়! দশটা বছর কেটে গেছে। আমরা ভালোবাসার ফলে পেয়েছি একটি পুত্র সন্তান। চাঁদের মতো ফুটফুটে, ওর মায়ের মতোই খুবসুরত। একটু অপেক্ষা করুন, তাকে আপনাদের সামনে হাজির করছি।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ছাব্বিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

এই বলে সেই পাণ্ডুবর্ণ যুবক অন্দরে চলে গেলো। একটু পরে বছর দশেকের একটি সুন্দর ছেলেকে সঙ্গে করে এনে বললো, এই হচ্ছে আমাদের একমাত্র সন্তান। মেহমানদের আদাব জানাও বেটা।

খালিফা দেখলেন ছেলেটি সত্যিই অপূর্ব সুন্দর। যেমন চেহারা তেমনি আদব-কায়দা। মন ভরে গেলো।

এরপর ওঁরা বিদায় নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন।

পরদিন সকালে খালিফা বললেন, জাফর, একবার আবু অল হাসানকে হাজির কর। এবং সারা বছর ধরে বাগদাদ বসরাহ এবং খুরাসন থেকে যত ভেট নজরানা পেয়েছি সেগুলো সব এই দরবার-কক্ষে আমার সামনে নিয়ে এসে রাখ।

জাফরের ইশারায় মাসরুর সেই উপহার উপটৌকন সামগ্রী এনে দরবার-কক্ষের মাঝখানে স্তুপাকার করে রাখালা। হীরে চুনী পান্না প্রবাল ও মুক্তের সে কি এলাহী ব্যাপার! চোখ ঝলসে যায় আর কী! একখানা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হলো জহরতগুলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাসরুর সঙ্গে করে নিয়ে এলো সেই পাণ্ডুবর্ণ যুবক আবু অল হাসানকে। যথাবিহিত কুর্নিশ কেতা জানিয়ে অল হাসান অােবদনে দাঁড়িয়ে থাকে। খলিফা স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন। গতকাল রাতে তোমার হাবেলীতে যে ক’জন মুসাফির সওদাগর মেহমান হয়েছিলো, জান তারা কে?

-না জাঁহাপনা। তারা আমার মহামান্য অতিথি। তাঁদের সৎকার করাই আমার ধর্ম। কুলশীল জানার তো কোনও অধিকার নাই আমার।

—চমৎকার। ইশারা করতে মাসরুর চাঁদরের ঢাকাটা খুলে দিলো। খলিফা বললেন, চেয়ে দেখ তো যুবক। এখানে যে সব ধনরত্ন পালা দেওয়া আছে তার মোটমূল্য তোমার সেই দৈবরত্নের সমান হবে কিনা? কোন রত্নের কথা বলছি বুঝতে পারছো? যেটা তুমি না বুঝে মাত্র ত্রিশ হাজার দিনারে বেচে দিয়েছিলে?

আবু অল হাসান বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে খলিফার দিকে তাকিয়ে–

—আ-প-নি?

-হ্যাঁ, আমিই। কাল রাতে আমি—আব্বাস বংশের পঞ্চম ধারক খলিফা হারুন অল-রসিদ, আমার উজির জাফর এবং সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তোমার আতিথ্য নিয়েছিলাম। তোমার সেবায় বড় প্রীত হয়েছি। তোমার মহব্বতের বিরহ বেদনা মধুর কাহিনী শুনে মুগ্ধ হয়েছি। এবং দুঃখ অনুভব করেছি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য। যে অমূল্য রত্ন তোমার হাতে এসেছিলো, তোমার অজ্ঞতার দোষে, তার উচিত মূল্য তুমি লাভ করতে পারনি। এতে আমিও বিশেষ দুঃখ বোধ করেছি। এই যে ধন রত্ন দেখছে এখানে, এ সবই তোমার জন্য। একটা ভুলের জন্য, অজ্ঞতার জন্য যে ক্ষতি তোমার হয়েছে, আমি তো পুরণ করতে চাই। দেখ তো এগুলোর দাম তোমার সেই দৈবরত্নের দামের সমান হবে কিনা!

অল হাসান বলে, অনেক বেশিই হবে, জাঁহাপনা।

—তা হোক। এসব তোমার। আমি দিলাম, নিয়ে যাও।

আবু অল হাসান ভাবতে পারে না, কী কথা সে শুনলো। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ কেউ কাউকে দান করতে পারে। হোন না তিনি সুলতান বাদশাহ! দৌলতের মায়া কার নাই। সারা শরীরের মধ্যে কী এক অভূতপূর্ব শিহরণ খেলে যেতে থাকে। অল হাসান মাথা চেপে সেই দরবার-কক্ষেই বসে পড়ে। তারপর আর কোনও চৈতন্য থাকে না।

অনেকক্ষণ পর যখন সম্বিত ফিরে এলো তখন খালিফা জাফর এবং আমির অমাত্যরা অবাক হয়ে দেখলেন; যুবকের মুখের পাণ্ডুবর্ণ আর নাই। গালে রক্তের গোলাপী আভা ফুটে উঠেছে। কল্পনাতীত প্রাপ্তির আনন্দে তার দেহের তন্ত্রীতে আবার বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেছে। এবং তারই ফলে মুখের ধমনীতে আবার রক্ত-প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মাসরুর একখানা আর্শী এনে ধরলো হাসানের সামনে। অনেক দিন পরে নিজের চেহারার পূর্ব রূপ ফিরে পেয়ে আনন্দে নেচে ওঠে তার মন। এ-সবই আল্লাহর বরপুত্র খলিফার অপার মহিমা।

খলিফা চিৎকার করে ওঠেন, সবই সেই দয়াময়ের দোয়ায় হলো হাসান। আমার কোনও কেরামতি নাই। যাক, এবার এগুলো সঙ্গে নিয়ে ঘরে যাও। সুখে সচ্ছন্দে দিন কাটাও গে।

—জাঁহাপনা, এই হচ্ছে সেই পীত যুবক হাসানের কাহিনীর। এর পরে শোনাবো আপনাকে আনারকলি এবং বদর বাসিমের কিসসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *