আনারকলি এবং বদর বাসিমের কিসসা
শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :
অনেক অনেক দিন আগে আজম মুলুকের খুরাসন শহরে শাহরিমান নামে এক বাদশাহ বাস করতেন। তার হারামে শতাধিক সুন্দরী বাঁদী রক্ষিতা ছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কারুরই গর্ভে কোনও সন্তানাদি হয়নি।
বিশাল সলনিয়ত, কে তার উত্তরাধিকারী হবে, তার অবর্তমানে কে বসবে মসনদে, এই নিয়ে তিনি সদাই চিন্তিত এবং বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকতেন। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য নানা শাস্ত্রের গুণী-জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্ব আলোচনায় দিন কাটাতেন।
এমনি এক দিনে, যখন তিনি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ধর্ম আলোচনায় ব্যাপৃত, সেই সময়ে দ্বার রক্ষী এসে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, জাঁহাপনা, বিদেশী এক সওদাগর এসেছেন সঙ্গে এক পরমাসুন্দরী বাঁদী নিয়ে। আপনার দর্শন-প্রার্থী তিনি।
সুলতান বললেন, নিয়ে এসো তাকে।
সওদাগরের সঙ্গে মেয়েটি এসে দাঁড়ালো। তার রূপের ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো দরবার মহল। পাতলা ফিনফিনে বোরখার আড়ালে তার দেহের প্রতিটি ভঁজ প্রতিটি খাঁজ। স্বচ্ছ পরিষ্কার প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। অমন অনিন্দ্য রূপ-যৌবন কোনও নারীর হতে পারে ভাবা যায় না। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিটোল নিখুঁত সুন্দর। সুলতান। বললেন, কত নেবে বণিক?
সওদাগর বিনয়ের অবতার বললো, জাঁহাপনা আমি একে প্রথম। পালকের কাছ থেকেই কিনেছি। এখনও অপাপবিদ্ধ-কুমারী। তিনি দাম নিয়েছিলেন তিন হাজার দিনার। এরপর নানা দেশের নানা হাটে বাজারে ঘুরেছি। তাতেও আমার হাজার তিনেক খরচ হয়েছে। এখন শাহেনশাহর সামনে হাজির করেছি। যদি জাঁহাপনার মনে ধরে তবেই আমি ধন্য হবো। ইনাম কিছু আশা করি না।
সওদাগরের ব্যবহারে প্রীত হলেন সুলতান। উজিরকে বললেন, ওকে ও দশ হাজার স্বর্ণমূদ্রা এবং এক প্রস্থ মূল্যাবান সাজপোশাক বকশিশ দিয়ে দাও।
সওদাগর দশ হাজার দিনার ও শৌখিন সাজ বগলদাবা করে সুলতানের ১ শতায়ু কামনা করতে করতে বিদায় হলো।
সুলতান খোজা সর্দারকে বললেন, যা একে হারেমে নিয়ে যা। দাসী বাঁদীদের বল, হামামে নিয়ে গিয়ে খুব ভালো করে ঘষে ৩ মেজে যেন গোসল করায়। অনেক দূর দেশ থেকে এসেছে। পথের ক্লান্তি জমে উঠেছে অঙ্গে। সব যেন সাফা করে দেয় তারা।
খোজা সর্দার মেয়েটিকে অন্দরমহলে নিয়ে চলে যায়। সারাদিন ধরে দরবারের কাজকর্ম সামাধা করে সুলতান নিজের কক্ষে আসেন। মেয়েটিকে গোসলাদি করিয়ে মূল্যবান নতুন সাজ-পোশাকে সাজিয়ে দাসী বাদীরা সুলতানের ঘরে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো।
ঘরে ঢুকে তিনি মেয়েটিকে কাছে ডাকেন, কই, এ দিকে এসোত সুন্দরী। নাকাব খোলো তত একবার, দেখে জীবন সার্থক করি।
কিন্তু কি আশ্চর্য, যাঁর এক ইশারাতে সারা সলনিয়ত থরথর কম্পমান, সেই অমিত বিক্রম এবং অতুল ঐশ্বর্যের অধিপতিকে সামনে দেখে সে একবার উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম কুর্নিশ জানালো না!
সুলতান শাহরিমান-এর মুখ কালো হয়ে গেলো। অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, বেয়াদপ! যারা মানুষ করেছে, দেখছি আদবকেতা কিছুই শেখায়নি!
—তোমার নাম কী? কিন্তু কোনও উত্তর দিলো না মেয়েটি। তবে কী বোবা বধির? সুলতান এবার ওর সামনে সরে আসেন। নিজের হাতে নাকাব সরিয়ে দেন। সে চোখের দৃষ্টিতে কোনো চাঞ্চল্য নাই। স্থির, ঠাণ্ডা। ভাবলেশ হীন। নিথর ও নিষ্পন্দ।
কে তুমি?
কোনও জবাব নাই! শান্ত নির্বিকার নির্বাক হয়ে বসে থাকে সে। সুলতান দু’হাতে টেনে নেয় ওকে। বুকের মধ্যে পেষণ করে জাগ্রত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। সাপের মতো ঠাণ্ডা। শরীর। কোনও উত্তাপ-উত্তেজনা নাই।
এবার তিনি ক্ষুব্ধ বিরক্ত বোধ করেন। কিন্তু মেয়েটির অপার রূপ-লাবণ্য তাঁকে আবার প্রসন্ন করে তোলে।
ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো সাতাশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?
সে দিনের মতো তিনি আর মেয়েটিকে কোনও প্রশ্ন করেন না।
পরদিন উৎসবের আয়োজন করা হয়। খানাপিনা গান-বাজনায় মেতে ওঠে প্রাসাদের মানুষজন। কিন্তু মেয়েটির কোনও বিকার নাই।
উৎসবের শেষে সবাই বিদায় নিলে সুলতান নিজের কক্ষে ফিরে আসেন। মেয়েটিকেও নিয়ে আসা হয় তার ঘরে।
সুলতান ওকে দু’হাতে তুলে শুইয়ে দেন পালঙ্ক শয্যায়। এক এক করে দেহের আবরণ খুলে ফেলতে থাকেন তিনি। পরপর সাতটা পোশাক খোলার পর একটি মাত্র পাতলা রেশমী শেমিজ অবশিষ্ট থাকে। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ান তিনি। তারপর সেটিও খুলে নেন। এমন নিভাজ নিখুঁত দেহবল্লরী তিনি কখনও প্রত্যক্ষ করেননি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে কামনার আগুন।
কিন্তু মেয়েটি অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। ওর দেহে কোনও চাঞ্চল্য জাগে না। সে রাতে সুলতান আকণ্ঠ পান করেন ওর দেহ সুধা। মনের সব ক্ষোভ রাগ উবে যায়। আনন্দে নেচে ওঠে হৃদয় মন।
এইভাবে রাতের পর রাত ওকে শয্যাসঙ্গিনী করে মেতে থাকেন তিনি। হারেমের অন্য সব মেয়েদের কথা একেবারে ভুলে থাকেন।
একটা বছর কেটে যায়। মেয়েটিকে দিয়ে সুলতানের কাম-বাসনা চরিতার্থ হয় কিন্তু ১. একটা কথাও তিনি আদায় করতে পারেন না তার কাছ থেকে। সুলতান বুঝতে পারেন না, কেন সে কথা বলে না। রাতের পর রাত কত আদর সোহাগ করে কতভাবে তাকে ভোলাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না।
-তুমি আমার দেহের ক্ষুধা তৃপ্ত করেছ, তোমাকে পেয়ে আমার সব দৈন্য ভুলে গেছি, শোনও চোখের মণি, একবার কথা বলো। আমি তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি কী বুঝতে পার না? বিশ্বাস কর না আমাকে? তোমার জন্য আমার সব বেগম বাদীদের বরবাদ করে দিয়েছি? তোমাকে পেয়ে আমি দরবারের কাজেও তেমন মন দিই না—প্রজাদের ওপর অবিচার করি। সে কী তুমি জান না? তোমার জন্য আমি। আমার সব কিছু ঐশ্বর্য বিসর্জন দিতে পারি—একথা কি বিশ্বাস। কর? কথা বলো সোনা, একটিবার কথা বলো। আর যদি তুমি। নাই বলতে পার কথা—যদি বোবাই হও তাতেও আমি ক্ষুব্ধ হবো না। তুমি ইশারাতেও বোঝাও তোমার মনের ভাষা। তোমার আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালো লাগা না লাগা বুঝতে দাও আমাকে। আল্লা তোমাকে আলোক-সামান্য রূপযৌবন দিয়েছেন। আর মুখে ভাষা দেননি সে কি বিশ্বাস করা যায়? তিনি কী এতোই নির্মম হতে পারেন?
সুলতানের এতো অনুরোধ উপরোধও সে নির্বাক হয়ে বসে থাকে। সুলতান বলেন, ঠিক আছে, কথা না হয় নাই বললে, তুমি আমাকে এক পুত্র উপহার দাও। আমার বয়স বাড়িয়ে বিকেল হতে চললো। এতো বড় সলনিয়ত। এই বিপুল। বৈভব—মসনদ, কে সব ভোগ করবে। তুমি আমাকে দয়া কর, একটি পুত্র সন্তান দাও। আর কদিন বাঁচবো জানি না। কিন্তু যদি এই সান্ত্বনা নিয়েও মরতে পারি, তোমার গর্ভে আমার সন্তান আছে, সে সুলতান হয়ে আমার মসনদে বসবে, আমার বংশ রক্ষা করবে, আমার বেহেস্ত লাভ হবে।
হঠাৎ মেয়েটি মাথা তুলে তাকাল। এতোদিন পরে ওর মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটেছে। বললো–
পাঁচশো উনত্রিশতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
-মহানুভব সুলতান, আপনার আর্জি আল্লা পূরণ করেছেন। আমার গর্ভে আপনার সন্তান। এসেছে। জানি না সে ছেলে কি মেয়ে—তিনিই একমাত্র বলতে পারেন। আমার প্রতিজ্ঞা ছিলো, যতদিন না আমি আপনার সন্তান ধারণ করি আপনার সঙ্গে বাক্যালাপ করবো না।
এতোদিন পরে ওর মুখে কথা ফুটছে দেখে সুলতানের আনন্দ আর ধরে না। সে যে কী আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ কার সম্ভব নয়। হৃদয়াবেগে তিনি কি করবেন কিছুই ঠিক করতে পারেন না। ওর কুসুমদল কোমল দেহলতাখানি বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর সোহাগ চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে থাকেন।
-এতোদিন আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন। তোমার মুখের ভাষা শুনতে পেয়েছি। আজ আমার কী আনন্দের দিন, তোমার গর্ভে আমার সন্তান। আমার ভবিষ্যৎ বংশধর, মসনদের উত্তরাধিকারী!
দরবারে গিয়ে সবাইকে জানালেন তিনি। এতোদিন পরে ঘর আলো করতে আসছে তার সন্তান। উজির আনন্দ কর, আনন্দ কর। যে যা চায় দাও। আমার আর কোনও দুঃখ নাই, আর কোন বাসনা নাই।
সুলতানের নির্দেশে অকাতরে দানধ্যান করা হতে লাগলো। দীন-দরিদ্ররা আহার্য বস্ত্র বকশিশ নিয়ে দোয়া মাঙতে মাঙতে চলে গেলো। সারা প্রাসাদ শহর সলতানিয়ত সুলতানের জয়গানে মুখর হয়ে উঠলো। প্রজারা আশ্বস্ত হলো—তাদের ভাবি সুলতান তবে আসছে।
দরবারের কাজ সেরে সুলতান আবার ফিরে আসে নিজের কক্ষে। প্রাণাধিকাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে।
–আচ্ছা নয়নতারা, বলো দেখি, কেন এতোদিন আমাকে এতো কষ্ট দিয়েছ? কেন কথা বললানি?
সে বলে, জাঁহাপনা আমি যখন এখানে আসি তখন আমার কী পরিচয়? আর অধিকারই বা কতটুকু। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে প্রাসাদে ঠাই দিলেন, তাতেই বা কী গেলো এলো? আমি তো জানতাম আপনার কাছে আমার কানাকড়িও দাম থাকবে না, যদি না আমি আপনাকে সন্তান উপহার দিতে পারি! শা ছিলো, আপনার শতাধিক বেগম-বাঁদী যা পারেনি—আমিই বা তা পিরবো, কী ভরসা! তাই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম। আমি জানতাম, যদি ব্যর্থকাম হই, যদি আপনার মনস্কামনা পূর্ণ করতে না পারি, তবে হারেমের অন্য বাঁদী বেগমদের যা বরাতে জুটেছে আমার ভাগ্যেও তাই মিলবে। এঁটো কলাপাতার মতো পরিত্যাগ করে প্রাসাদের এক কোণে রেখে দেবেন। হয়তো বৎসরান্তেও একবার খোঁজ নেবার ফুরসত হবে না আপনার। সেই দুঃখ সইবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম আমি। দু’দিনের আদর ভালোবাসা সোহাগ খেয়ে লালসা বেড়ে গেলে পরে আরও বেশি কষ্ট পাবো এই আশঙ্কাতেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম।
সুলতান অবাক হয়ে বললেন, শুধু এইমাত্র কারণ? কিন্তু না, আমার মনে হয় তোমার মনে অন্য কোনও ব্যথা-বেদনা আছে। আসল কারণ সেইটেই।
সে বলে, আমি আজ চার বৎসর মা ভাই আত্মীয় পরিজনদের ছেড়ে চলে এসেছি। তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হবে না। আমার জন্মভূমি থেকে সাত সমুদ্র পার হয়ে আজ আমি কত দূরে চলে এসেছি। জানি না, আমার মা ভাইরা কে কেমন আছে।
সুলতান বলেন, এইজন্যেই তোমার মন খারাপ করে? এইজন্যে এতোদিন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলোনি? তা সে তোমার মা ভাই যত দূরেই থাক, আমি কি তোমাকে তাদের কাছে পাঠাতে পারি না কয়েকদিনের জন্য?
সে বলে, আমার নাম গুলনার। আমাদের মাতৃভাষায় একথার অর্থ- বেদনার ফুল-আনারকলি। আমার জন্ম সাগরে। আমার বাবা ছিলেন সমুদ্রের শাহ। মা-এর নাম লোকাস্ত। এবং এক ভাই আছে, তার নাম সালির। ছোট্টবেলা থেকেই আমার প্রতিজ্ঞা ছিলো, সমুদ্রে আমি থাকবো না। জলের ওপরে মাটির দেশে যাবো—এই আমার একমাত্র স্বপ্ন। সেখানকার প্রথম চেনা পুরুষ হবে আমার ভালোবাসার সঙ্গী। সে আমাকে রক্ষা করবে। ভরণ-পোষণ করবে। তার বদলে আমি তাকে উজাড় করে দেব আমার দেহ-মন-প্রাণ ভালোবাসা-যাকে তোমাদের ভাষায় বলে মহব্বত।
একদিন রাতে মা ভাই যখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সেই সময় আমি চুপিসারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। উত্তাল জলরাশি ঠেলে শোঁ শোঁ করে উঠে আসলাম ওপরে। সাঁতার কেটে এসে পৌঁছলাম সমুদ্র উপকূলে। তখন গভীর রাত। মাথার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদ। আলোর ০৪অমৃত ঝরে পড়ছিলো। দক্ষিণা বাতাসে ঘুম এসে গেলো চোখে।
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক হত-কুৎসিত লোক। প্রায় দৈত্যের মতো। লোমশ হাতের থাবা বাড়িয়ে আমাকে তুলে নিলো সে কাঁধের ওপর। আমি অনেক হাত পা ছুঁড়লাম। দাপাদাপি করলাম। কিন্তু ওর কবল ছাড়া পেলাম না।
এক জঙ্গলের মধ্যে একটা কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে নামালো সে। জোর করে শুইয়ে দিলো চিৎ করে। তারপর পাশবিক ক্ষুধা মেটাবার জন্য জোর জবরদস্তি করতে থাকলো। কিন্তু আমি প্রাণপণে ওর মুখে এমন একটা ঘুষি মারলাম, লোটা আর্তনাদ করে ছিটকে পড়লো দুরে। সেই ফাঁকে আম উঠে দে দৌড়। সে আমার পিছু ধাওয়া করেছিলো, কিন্তু ধরতে পারেনি।
দৌড়ে আর কোথায় পালাবো, এক সওদাগরের খপ্পরে গিয়ে পড়লাম। সে আমাকে বাঁদী হাটে নিয়ে গিয়ে বেচে দিলো এই সওদাগরের কাছে। এবং তার কাছ থেকেই আপনি আমাকে কিনেছেন। লোকটা খুব সৎ এবং নিষ্ঠাবান ধার্মিক ছিলো। তা না হলে, আমার মতো একটি কচি ডাগর মেয়েকে নিয়ে সে পুরো তিনটি বছর এদেশে সেদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে একদিনের তরে গায়ে হাত ঠেকায়নি!
এই আমার জীবনের কাহিনী।
এখানে আসার পর প্রথম আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। সদাই মনে হতো, এই জানালা দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি সমুদ্রের জলে। ডুব দিয়ে চলে যাই আমার দেশে মা ভাই-এর কাছে, কিন্তু পারিনি। পরে যখন বুঝতে পারলাম আপনি মানুষটা নেহাত খারাপ নন তখন আর সে ঝোক ছিলো না। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা ছিলো, গোড়াতেই বেশি ঢলাঢলি করবো না। কারণ সুলতান বাদশাহদের খামখেয়ালীর অনেক কাহিনী আমার শোনা ছিলো। আজ তারা যাকে মাথার মণি করে রাখে কাল তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সেই কারণে আমি আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইনি। জানতাম, আমার গর্ভে সন্তান উৎপন্ন না হলে আপনার কাছে আমার প্রয়োজন ফুরোতে দেরি হবে না। এতোদিনে যখন বুঝতে পারলাম, আমি সন্তান-সম্ভবা তখন মনে ভরসা পেলাম তা হলে আপনি আর আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। এখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি, আপনার হারেমের ঐ শতাধিক বেগম বাঁদীদের কাউকে আপনি আর ভালোবাসবেন না। কিন্তু আমি বুঝি আর আমার মা ভাইকে দেখতে পাবো না। আমার শোকে কেঁদে কেঁদে তারা সারা হয়ে যাচ্ছে। এমন দেশ, সেখানে লোকজন পাঠিয়েও কোনও খবর দেবার উপায় নাই। আর তা ছাড়া আমি যদি নিজেও যাই, তারা আমার কথা আদৌ বিশ্বাস করবে না। আমি যে এখন আর সামান্যা কেউ নই—পারস্য এবং খুরাসনের শাহেন শাহর একমাত্র পেয়ারের বাঁদী, সে কথা তারা আজগুবি গল্প বলে উড়িয়ে দেবে।
এই সময়ে রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো ত্রিশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয় :
আনারকলির কাহিনী শুনে সুলতান শাহরিমান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওর মুখের দিকে।
-কী অদ্ভুত সুন্দর কাহিনী শোনালে, আমায়! কিন্তু যে কারণেই হোক তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও কখনও, আমি আর এক মূহূর্তও বাঁচবো না —নির্ঘাৎ মরে যাবো। তুমি বললে, তোমার জন্ম সমুদ্রের নীচে। তোমার বাবা ছিলো সমুদ্রের সুলতান। তোমার মা তোকস্ত আর তোমার ভাই সালিহ। ওরা এখনও সমুদ্রের তলাতেই বসবাস করে। সবই বড় অদ্ভুত। শোনাচ্ছে আমার কাছে। সত্যিই কোন মানুষ সমুদ্রের নিচে থাকতে পারে কিনা, আছে কিনা আমার কোনও ধারণা নাই। শুধু বুড়ো-বুড়িদের কাছে ছোটবেলায় কিছু গল্প কাহিনী শুনেছিলাম। কিন্তু সে তো সবই বানানো কিসা। সত্যিই যে কিছু তেমন সব নরনারী পানির নিচে থাকতে পারে বিশ্বাস করিনি। আজ তোমার মুখে শুনে আর অবিশ্বাস করতে পারছি না, আমি। উপরন্তু তোমাদের জাত ধর্ম আচার ব্যবহার সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানবার কৌতূহল হচ্ছে। আচ্ছা, একজন মানুষ ঐ পানির নিচে চলা-ফেরা করতে পারে কী করে? দম আটকে মরে যায় না? বড় অদ্ভুত ব্যাপার তো!
আনারকলি বলে, আমি যা জানি, সব আপনাকে বলবো, জাঁহপনা। সুলেমান ইবন দাউদের অশেষ করুণায় আমরা সমুদ্রের নিচে সুখে সচ্ছন্দে বসবাস করি। আপনারা যেমন এই মাটির পৃথিবীতে বাস করেন তেমনিভাবে। জলই আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বস্তু। আপনারা যেমন নাক দিয়ে হাওয়া টানেন ছাড়েন, আমরা তেমনি জল টানি আর ছাড়ি। জলই আমাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। জলে আমাদের দেহ নরম এবং সতেজ থাকে। আমাদের দেহের আচ্ছাদন জলে কখনও ভেজে না। এই যে আমার চোখের মণি দেখছেন, জলের তলায় সে জ্বলে। অনেক দূরে দিগন্তে চলে যেতে পারে এই চোখের দৃষ্টি। সমুদ্রের গভীর তলদেশে থেকেও আমরা স্বচ্ছ পরিস্কার দেখতে পাই চাঁদনি তারার রোশনাই। পৃথিবীর সব মুলুক এক সঙ্গে জুড়লে আমাদের জল মুলুকের চার ভাগের এক ভাগ হবে। কী বিরাট বিশাল, তা কল্পনা করা যায় না। আমাদের সমুদ্র সাতটি মুলুকে বিভক্ত। তার এক একটা প্রায় আধখানা পৃথিবী। লক্ষলক্ষ কোটি কোটি মানুষ, জন্তু জানোয়ার এবং মাছের বাস এই সব সমুদ্রে। এর নিচে বিশ্বের সব চাইতে মূল্যবান ধনরত্ন সঞ্চিত আছে। আমরা যে শহরে বাস করি সেখানকার ঘর বাড়ি দেখলে আপনি তাজ্জব বনে যাবেন। স্ফটিকের তৈরি নানারকম কারুকার্য করা সব বাড়িঘর। লাড়ুর মত বড় বড় মুক্ত, প্রবাল, চুনী, পান্না পদ্মরাগমণি, সোনা-চাদীর পাহাড় চারপাশে। কেউ হাত দিয়ে ছোঁয় না। ওসবে কার কী প্রয়োজন? কিন্তু, কিন্তু এখানে—তোমাদের এই মাটির দেশে সেই সব এক একটা জিনিষের কী দাম?
আমরা ইচ্ছামত সাঁতার কেটে যেখানে খুশি, যত দূরে খুশী চলে যেতে পারি। তাই গাধা ঘোড়া বা পাল্কী রথের কোনও প্রয়োজন হয় না। তোমাদের এখানে অবশ্য ঐগুলোই পথ চলার সেরা অবলম্বন। তবে ওসব আমাদের দেশেও আছে। আস্তাবলে রেখে দেয় লোকে। উৎসব অনুষ্ঠানের সময় কেউ হয়তো শখ শৌখিনতা করে এক-আধটুক চাপে। যাই হোক, একদিনে আপনাকে কত আর বলবো। আমি তো আপনার সারা জীবনের সঙ্গিনী, পরে আবার অনেক মজার মজার কথা শোনাবো।
তবে একটা কথা, আনার আবার বলে, আমাদের দেশের এবং আপনাদের দেশের প্রসূতি পরিচর্যার মধ্যে আসমান জমিন ফারাক আছে। আমাদের শরীরটা যেভাবে তৈরি আপনাদের এখানকার মেয়েদের শরীর ঠিক সেইভাবে তৈরি নয়। সেই কারণে এখানকার ধাইরা হদিশই করতে পারবে না আমাদের পেটে বাচ্চা কীভাবে থাকে, কখন সে প্রসব করবে, এবং নবজাতককে কীভাবে রাখলে, পরিচর্যা করলে সে সুস্থ থাকবে। এই সব ভেবে আমার বড় ভয় করছে জাঁহাপনা, আমার পেটে আপনার যে বাচ্চা আছে তার জন্মকালে ধাইদের দোষে তার না কোনও অনিষ্ট হয়। কারণ এখানকার ধাইরা তো এখানকার মতো করে আমাকে প্রসব করাবার চেষ্টা করবে। তাতে ফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি!
সুলতান আঁৎকে উঠলেন, বলো কী? সর্বনাশ হবে যে!
—তাই তো বলছি, জাঁহাপনা, আপনি আমার মা ভাইদের খবর পাঠান। তারা আমার কাছে থাকলে আর কোনও ভয় থাকবে না। আমার মা সব জানে। সে সব নিখুঁত বন্দোবস্ত করতে পারবে। আমাদের বাচ্চার নিরাপদের কথা ভেবেই তাদের খবর দেওয়া দরকার।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো একত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
সব শুনে সুলতান বললেন, কিন্তু তোমার মা ভাই-এর এখানে কী করে নিয়ে আসা যায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, আনার। আমার লোকজন তো পানির তলায় যেতে পারবে না।
আনারকলি বলে, তার দরকার নাই, জাঁহাপনা। আপনি যদি বলেন আমি তাদের এখানে এনে হাজির করে দিতে পারি।
—তুমি পার? কী করে?
-আপনি পাশের ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকুন, তা হলেই দেখতে পাবেন কী করে আমি তাদের নিয়ে আসি এখানে!
আনারকলি ওর বুকের মধ্যে থেকে দুটুকরো ছোট ছোট চন্দন কাঠের টুকরো বের করে। একটা সোনার পাত্রে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে গল গল করে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকে। আনার বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র আওড়ায়। আর তক্ষুনি, দেখা গেলো, সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। তারপর মুহূর্ত মধ্যে প্রবল ঝড় ঝঞা তুফান শুরু হয়ে যায়। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ আছাড় খেয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে। সেই তরঙ্গতুঙ্গে ভেসে ওঠে এক সুন্দর সুপুরষ যুবক। তার এক হাতে একটি ফুল। এবং তার ওপরেই ভাসে এক পলিত-কেশ বৃদ্ধা নারী। সুলতানের বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেই বৃদ্ধা আনারের মা লোকস্ত। আর ঐ যুবক তার ভাই সালিহ। এরপর আরও পাঁচটি সুদর্শনা মেয়ে ভেসে ওঠে জলের ওপর। এরা সকলে ভাসতে ভাসতে প্রাসাদ-সমীপের উপকূল দিয়ে এগিয়ে আসে। তারপর কূলে উঠে ওরা প্রাসাদের জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। এবং এক এক করে লাফিয়ে লাফিয়ে আনারের ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আনার-এর মা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, অমাদের ছেড়ে তুই এতোদিন কী করে ছিলি মা। আমরা ভাবলাম তুই আর বেঁচে নাই। কেঁদে। কেঁদে সারা হয়েছি এতোকাল।
—আমার দোষ স্বীকার করছি মা। না বলে কয়ে ঐ ভাবে ঘর ছেড়ে চলে আসা আমার উচিত হয়নি! কিন্তু নিয়তির লিখন কে খণ্ডাতে পারে, বলো। যাইহোক, দেরিতে হলেও আবার তো আমরা এক জায়গায় হতে পেরেছি। এ আনন্দই বা রাখবো কোথায়?
তারপর আনার তার বিচিত্র অভিযানের কাহিনী বর্ণনা করলো ঐ তাদের কাছে।
-এখন আমি বাদশাহ শাহরিমানের পেয়ারের বেগম। আমর। গর্ভে তার একমাত্র সন্তান। এই বিশাল সলতানিয়তের একমাত্র মালিক। { এই সন্তানের প্রসব যাতে নিরাপদে হয় সেই জন্যেই আমি তোমাকে স্মরণ করেছি, মা। তুমি ছাড়া আমাদের রীতি-নীতি এরা তো কেউ জানে না।
আনার-এর মা বলে, বাছা তোমাকে এই মাটির দেশে দেখে আমি তা আঁতকে উঠেছিলাম। না জানি কত দুঃখে কষ্টে তোমার দিন কাটছে। ভেবেছিলাম স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্যেই বুঝি আমাদের ডাকছে। কিন্তু এখন এই অবস্থা স্বচক্ষে দেখে বুঝতে পারছি, তুমি খুব সুখে আনন্দে আছে।
আনার বললো, আজ আমার মতো ভাগ্যবতী সুখী মেয়ে আর কে আছে, মা!
এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো বত্রিশতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :
পাশের ঘর থেকে সবই শুনছিলেন সুলতান। তার প্রিয়তমা আনার আজ মা ভাইকে ফিরে পেয়ে খুশির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে, তার মুখে হাসি ফুটেছে। সুলতান পুলকিত হয়।
আনারকলি দাসী বাঁদীদের ডেকে খানাপিনা সাজাতে বলে। নানারকম বাদশাহী খাবার-দাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে দেয় তারা। মা বলে, সে কি, আমরা এলাম যাঁর ঘরে তিনি কোথায়? তার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলো না, খাবো কি? যা মা, তাঁকে ডাক, আমরা তাকে দেখি আলাপ করি, তারপর খাবো।
আনারকলি একটু গলা চড়িয়ে সুলতানকে ডাকে, জাঁহাপনা, শুনতে পাচ্ছেন? আমার মা ভাই এসেছে। তারা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে।
সুলতান পাশের ঘর থেকে এসে আনারের মা ভাইকে শুভেচ্ছা স্বাগত জানালেন, আমি বড় খুশি হয়েছি আপনারা এসেছেন।
সালিহ বললো, আমার আদরের ভগ্নী আনার, মনে ভয় ছিলো সে বুঝি সুখে নাই, সুলতান বাদশাদের হিংস্র কামনার স্বীকার হয়ে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু আনারের মুখে সব শুনলাম, আপনি তাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। এ আমাদের পরম সৌভাগ্যের কথা। অবশ্য সবই নিয়তির খেলা। যার ভাগ্যে যা লিখেছেন তিনি, তাই তো হবে। তা না হলে, আমার বোন আনার সমুদ্রের কন্যা, অতল সমুদ্রের প্রত্যন্ত প্রদেশে আমাদের বাস। সেখান থেকে উঠে সে কী করে আপনার সন্তানের জননী হচ্ছে?
সুলতান বললেন, এ তুমি যথার্থই বলেছ, শালা সাহেব। নিয়তির লেখা কেউ এড়াতে পারে না। যাক, এবার খানাপিনা কর।
সেদিন থেকে ওরা সকলে প্রাসাদেই অবস্থান করতে থাকলো। যথাসময়ে আনারকলি তার মা লোকস্তের হাতে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলো। চাদের মতো সুন্দর ছেলে। যেমন রং, তেমনি চেহারা। সুলতানের যে কী আনন্দ, কী করে তা বলবো। সে ভাষা আমার নাই। সাত দিন পরে শুদ্ধাচার করে ছেলেকে সুলতানের কোলে তুলে দিলো আনারকলি। নবজাতকের নাম রাখলেন তিনি বদর বাসিম। অর্থাৎ চাঁদের হাসি।
এই সময় রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো তেত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?
সুলতানের হাত থেকে সালিহ,—আনারকলির ভাই, ছেলেকে হাতে নিয়ে আদর সোহাগ করতে থাকে। নানা ভাবে নাচাতে নাচাতে সে ঘরময় নেচে বেড়ায়। হঠাৎ সুলতানকে হতবাক করে দিয়ে সালিহ ছেলেকে হাতে ধরে জানালা দিয়ে লাফিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাপিয়ে পড়ে অতলে তলিয়ে যায়। সুলতান অসহায়ভাবে আর্তনাদ করে ওঠেন। তার সারা চোখে মুখে সে। কি আতঙ্ক, ভয়! একটু পরে নিদারুণ হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
আনারকলি হাসে। আপনি শান্ত হোন, জাহাপনা, ভয়ের কোনও কারণ নাই। ছেলের কোনো অনিষ্ট হবে না। বহাল তবিয়তে আবার তারা ফিরে আসবে।
কিন্তু সে কথায় সুলতান আশ্বস্ত হতে পারেন না। তার সারা চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে, এখন আমি কী করি, কী হবে, ওরে বাবা, এ কী হলো?
আনার সুলতানকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে, আপনি উতলা হবেন না জাঁহপানা, এটা তো মানেন, আমি তার মা, দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছি। আপনার চাইতে দরদ আমার অনেক বেশি। সেই মা হয়ে আমি বলছি, হতাশার কোনও কারণ নেই। আপনার সন্তান যেমনটি ছিলো তেমনি সুস্থ অবস্থায় আবার ফিরে আসবে। আপনি শান্ত হোন।
সুলতান বুঝলেন সবই। আনারকলি তার গর্ভধারিণী মা। সে যখন এতো নিশ্চিত, নিশ্চয়ই আশাঙ্কার কোনও কারণ থাকতে পারে না। তবু অশান্ত পিতার মন কিছুতে প্রবোধ
মানতে চায় না। অপলক চোখে তিনি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ভেসে ওঠে সালিহ। তার হাতে বদর বাসিম। সুলতান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
কি আশ্চর্য, সুলতান ছেলেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন, একেবারে মায়ের বুকের শিশুর মতো ঝকমক করছে এক ফোটা পানিও গায়ে লাগেনি।
সালিহ বলে, আমি ভেবেছিলাম আপনি ভীষণ ভয় পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভয়ের কিছু নাই। ওর শরীরের অর্ধেক রক্ত আমার ভগ্নী আনারের। সেই সূত্রে সে জলচরের সব যোগ্যতার হকদার। পরমপিতা সুলেমানের আশীর্বাদ নিয়ে সে জন্মেছে। জল তার সহায় হবে জীবনভোর, কোনও অনিষ্ট করবে না। আমি ওকে কাজল পরাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। জন্মের সাতদিন পরে আমাদের প্রত্যেক শিশুকে আমরা পরিয়ে দিই। এর ফলে সারাজীবন ধরে সে জলের মধ্যে সব কিছু স্বচ্ছ পরিষ্কার দেখতে পায়। জলের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে এর কখনও কিছু অসুবিধে হবে না। এমন কি জলে চলবে, জলে শোবে অথচ একবিন্দু জল লাগবে না গায়ে। এ হচ্ছে আমাদের জন্মগত ব্যাপার। সুলেমানের আশীর্বাদ।
সালিহ বদর বাসিমকে আনারকলির কোলে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ট্যাকে ঝোলানো থলেটা খুলে সুলতানের হাতে দেয়।
-ভাগ্নের মুখ দেখার নজরানা!
কার্পেটের ওপর থলেটা উপুড় করে ঢেলে দেন সুলতান। বিস্ময়ে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। পায়রার ডিমের মতো বড় বড় হীরে, এক বিঘৎ মাপের পান্না, মটরদানার মতো মুক্তো, অদ্ভুত লাল রঙের প্রবাল, এবং অজস্র মাপের মূল্যবান গ্রহরত্ন। সারা ঘরখানা আলোয় আলোয় ঝকমক করে উঠলো।
সুলতান ভেবে পান না, সালিহকে কী বলে ধন্যবাদ জানাবেন। আনারকলিকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমার ভাই-এর এই অভাবনীয় উপহার দেখে আমার তো আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে, আনার। এর এক একটা রত্ন আমার সারা মুলুকের সম্বৎসরের আয়ের সমান।
আনারকলি বলে, সে যাই হোক, আপনার যোগ্য উপহার আমরা দিতে পারি না, জাঁহাপনা। যা-ই দিই না কেন, আপনার ঋণ শোধ হবে না কোনও দিন। আমরা সবাই মিলে হাজার বছর ধরে আপনার বাঁদী গোলাম হয়ে থাকলেও আপনার দেনা শোধ দিতে পারবো না।
সালিহকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে সুলতান বললেন, এই খানে আমার প্রাসাদে তোমরা আরও চল্লিশ দিন থাকো—এই আমার ইচ্ছা, ভাই।
সুলতানের অনুরোধে আরও চল্লিশটা দিন কাটিয়ে দেশে ফিরে যাবার উদ্যোগ করলো ওরা। সুলতান বললেন, ক’টা দিন বড়ই আনন্দে কাটলো। সালিহ, তোমাকে কিছু দিতে চাই আমি, কী নেবে, বলো?
সালিহ বললো, যে আদর ও আতিথেয়তা পেলাম, তার তুলনা নাই। এর বেশি কী আর কামনা করতে পারে মানুষ। ধন দৌলতের তো কোনও মূল্য নাই আমাদের কাছে। আমরা চাই ভালোবাসা-প্রেম ও শুভেচ্ছা। এবং তা আপনার কাছ থেকে পর্যাপ্তই পেয়েছি আমরা। মন ভরে গেছে। এখন অনুমতি করুন, স্বদেশে ফিরে যাই। জল ছেড়ে আমরা অনেকদিন হাওয়ার মধ্যে আছি। স্বাস্থ্যের পক্ষে এটা শুভ নয়। বেশিদিন ডাঙায় থাকলে অসুখ বিসুখ করতে পারে। এখন আমরা বিদায় নিচ্ছি। পরে আবার আসবো।
ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
পাঁচশো চৌত্রিশতম রজনী?
আবার কাহিনী শুরু হলো :
সালিহ বলতে থাকে, ভাগ্নেকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মন বড়ই বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু উপায়ই বা কী? যাই হোক, মাঝে মাঝে এসে মামুকে দেখে যাবো।
সুলতান বলেন, না আর তোমাদের আটকে রাখবো না। এখন ফিরে যাও। কিন্তু যখনই সময়-সুযোগ হবে, চলে এস। তোমাদের মজার দেশটা দেখার বড় ইচ্ছে। কিন্তু পানি আমি ভীষণ ভয় করি।
আনারকলি বাচ্চা বদর বাসিম এবং সুলতানকে নিয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া দেখতে থাকলো।
এবার আমরা বদর বাসিমের কথায় আসি।
আনারকলি আয়াধাইদের বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কোলে ছেলেকে ছেড়ে না দিয়ে নিজের বুকের দুধই খাইয়ে লালন করতে থাকলো। এইভাবে চার বছর কাটে। দামাল শিশু দিনে দিনে সিংহ-শাবকের মতো বেড়ে ওঠে।
বাসিমের বয়স যখন পনের হলো, তার রূপের বাহার আরও ফেটে পড়তে লাগলো। পড়াশুনা, খেলাধুলা, নাওয়া-খাওয়া, ঘুমনো—সব তার ঘড়ির কাটায় চলে। কোনও অনিয়ম উচ্ছঙ্খলা নাই। দিনে দিনে বিকশিত হতে থাকে ওর যৌবনের গোলাপ-কুঁড়ি।
সুলতান বৃদ্ধ হয়েছেন। দেহ অথর্ব হয়ে পড়ছে। বুঝতে পারছেন, সময় সমাগত। আর বেশি দেরি নাই—এবার যেতে হবে। সুলতান ভেবে আনন্দ পান তার একমাত্র সন্তান বাসিম রূপে, গুণে, শৌর্যে ক্রমশঃ পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
একদিন উজির আমির অমাত্য আমলা ইয়ার বক্সী,পাত্র-মিত্র পারিষদ এবং সেনাপতিদের সমক্ষে বাসিমের মাথায় বাদশাহী শিরোপা মুকুট পরিয়ে দিলেন সুলতান। নিজে হাতে ধরে তার মসনদে বসিয়ে দিলেন পুত্রকে।
আজ থেকে তুমি এই সলতানিয়তের সুলতান। আমি চাই যে, এই পবিত্র মসনদের মর্যাদা তুমি জীবন দিয়েও রক্ষা করবে। এই ধর, ন্যায় দণ্ড, শিষ্টের পালন আর দুষ্টের দমন। এসবই বাদশাহর ধর্ম।
সুলতান বাসিমের কপালে চুম্বন এঁকে দিলেন। এইভাবে অভিষেক হলো তার।
বদর বাসিম তখতে বসে প্রথমে উজির আমিরদের নিয়ে সভা করলো।
–সবলের আক্রোশ থেকে দুর্বলকে এবং ধনীর শশাষণ থেকে গরীব-দুঃখীকে রক্ষা করাই আমার প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে।
নতুন সুলতানের মুখে এই সাম্যের বাণী শুনে বৃদ্ধ শাহরিমান ও উজির-আমির সকলেই মুগ্ধ বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।
এরপর শাহরিমান সুখে অবসর যাপন করতে থাকলেন। আর বাসিম বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রজাপালন করেতে লাগলো।
এক বৎসর পরে আল্লার নামগান করতে করতে একদিন শাহরিমান দেহ রাখলেন। ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
পাঁচশো পঁয়ত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
আনারকলি এবং বাসিম এক মাস ধরে শোক পালন করলো। শাহরিমানের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সালিহ এলো সমুদ্রতল থেকে। এই সতেরো বছরে আরও অনেক বার এসে সে দেখে গেছে তার বোন আর ভাগ্নেকে। বাসিমের কাছে অনেক দুঃখ প্রকাশ করলো সে।
-তার মরার সময় আমি কাছে থাকতে পারলাম না, বাবা। এ দুঃখ আমার যাবে না। যাক, বাবা-মা কারো চিরকাল বেঁচেথাকে না। শোক করো না মামু। ভালোভাবে শাসন কাজ চালাও। তোমার প্রজারা তোমার পুত্রসম। তাদের সুখ-সুবিধে দেখাই তোমার একমাত্র কাজ।
ভাই-বোনে বাসিমের শাদী নিয়ে আলোচনা হয়। সালিহ বলে, বাসিম, বড় হয়েছে—সতেরোয় পা দিলো, এবার তো ওর একটা শাদীর ব্যবস্থা করতে হয়, বোন।
আনারকলি বলে, আমিও তাই ভাবছিলাম, দাদা। ভালো মেয়ে কোথায় পাওয়া যায় দেখ। একমাত্র সলতে, সময় মতো শাদী দিয়ে বংশ রক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।
সালিহ বলে, আমার মতে, সমুদ্রের শাহজাদীদের কারো সঙ্গে ওর শাদী দেওয়া উচিত।
আনারকলি বলে আমারও তাই ইচ্ছে। ভেবে দেখতো কোন সুলতান বাদশাহর সুদর্শনা সুলক্ষণা সুন্দরী কন্যা আছে!
সালিহ এক এক করে নাম করতে থাকে। কিন্তু আনারকলির কাউকেই মনে ধরে না।
-না, এরা কেউই বাসিমের যোগ্য হবে না। ওর যা বাড়ন্ত গড়ন—যা রূপ, শিক্ষাদীক্ষা, তার উপযুক্ত এরা কেউ না।
সালিহ বলে, মনে পড়েছে, আনার। সুলতান সামানদালের এক পরমাসুন্দরী কন্যা আছে-তার নাম জানারা।
আনার বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারও মনে পড়ছে। আমি যখন চলে আসি তখনও ওর বয়স ছিলো বছরখানেক। ফুটফুটে সুন্দর চাঁদের মতো মেয়ে—একেবারে ডানাকাটা পরীর মতো।
এই মেয়েই আমার ছেলের যোগ্য হবে। তুমি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলো, দাদা।
দুই ভাইবোনে যখন এই সব কথাবার্তা হচ্ছিল বাসিম শুয়ে শুয়ে ঘুমের ভান করে সব শুনছিলো। জানারার রূপের বর্ণনা শুনে সে মনে মনে শিহরিত হয়ে ওঠে।
সালিহ বলে, কিন্তু বোন, কাজ অত সহজ হবে বলে তো মনে হয় না। জানরার বাবা বড় একরোখা গোঁয়ার। এর আগে অনেক সুলতান বাদশাহর প্রস্তাব সে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমন কি কয়েকজন শাহজাদাকে ঠেঙিয়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিয়েছে। আবার শুনেছি, কাউকে মারতে মারতে শহরের বাইরে বের করে দিয়েছে। জানি না, আমাদের প্রস্তাব সে কী ভাবে নেবে। এই কারণে আমার সন্দেহ হয়, ব্যাপারটা হয়তো শুভকর হবে না।
আনারকলি বলে হুঁ, কাজটা খুব হিসেব করে ও সাবধানে এগোতে হবে। ঝোপ বুঝে কোপ মারা ছাড়া আর পথ নাই। তাছাড়া করতে গেলে দয়ে মজতে হতে পারে! যাক, এ নিয়ে ভেবে চিন্তে পরে আবার আলোচনা করা যাবে।
এই সময়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাসিম জেগে ওঠে। ভাবখানা এতক্ষণ সে ঘুমিয়েছিলো। এই মাত্র জাগলো। বিছানা ছেড়ে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। কিন্তু অন্তরে দগ্ধ হতে থাকলো। জানারা তার বুকে ভালোবাসার আগুন জ্বালিয়েছে। এখন কিসে তার নির্বাপিত হবে?
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো সাঁইত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
বাসিম ভাবে, তার হৃদয়ের এই আকুলতা মা ও মামার কাছে গোপন রাখবে। সারা রাত ধরে নানা রঙের স্বপ্নের জাল বুনে চলে। চোখে আর কিছুতেই ঘুম আসে না।
ভোর না হতেই সে শয্যা ছেড়ে উঠে পড়ে। মামার ঘরে গিয়ে সালিহকে ডেকে তোলে, মামা, ওঠ, চলো তোমার সঙ্গে আজ সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাবো। সারারাত ঘুম হয়নি। মাথাটা ধরে আছে। খোলা হাওয়ায় বেড়ালে হয়তো একটু ভালো লাগবে।
সালিহ বলে, বেশ তো চলো, মামু। সকাল বেলায় সমুদ্রের হাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভালো।
সমুদ্রে উপকূলে এসে ওরা একটা উঁচু টিলার ওপরে বসে। সামনে শান্ত গভীর সমুদ্রের ঘন নীল জল। মাথার ওপরে নির্মেঘ আকাশ। এক সময় বাসিম বলে, মামা আপনাদের কথাবার্তার সবই আমি শুনেছি। সুলতান সামানদালের কন্যা জানারাকে দেখার জন্য মন আমার চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
সালিহ বুঝলো ভাগ্নের হৃদয়ে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। বললো, কিন্তু তাকে পাওয়া তো খুব সহজ কাজ হবে না, মামু।
কিন্তু মামা, যে ভাবেই হোক জানারাকে পেতেই হবে। তার কথা শোনার পর থেকে আমার বুকের মধ্যে তার অসন পাতা হয়ে গেছে। আমি তাকে না পেলে মরে যাবো। আপনাকে ব্যবস্থা একটা করে দিতেই হবে। তাকে ছাড়া অন্য কোনও নারীকে আমি হৃদয়ে স্থান দিতে পারবো না।
সালিহ বলে, তা হলে মামু, চলো তোমার মা-এরা কাছে যাই। তাকে বলি, সুলতান সামানদলের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য আমরা সমুদ্রের নিচে যেতে চাই। সে যদি যাবার অনুমতি দেয় তবে তোমাকে নিয়ে আমি সামানদলের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
বাসিম বাধা দিয়ে বলে, মাকে এসব বলে তার অনুমতি আদায় করতে যাওয়া বৃথা। আমি তার একমাত্র সন্তান। এক পলক চোখের আড়াল করতে চাইবে না, কিছুতেই আমাকে যেতে দিতে রাজি হবে না। তার চেয়ে আমি বলি কি তাকে না বলেই, চলো আমরা চলে যাই। হয়তো মা খানিকটা কষ্ট পাবে, কিন্তু আমি ফিরে এলেই আবার মুখে হাসি ফুটবে তার। আর তা ছাড়া মা-এর আশঙ্কা, সুলতান সামানদাল ভীষণ নিষ্ঠুর, সে আমাদের সঙ্গে হয়তো খারাপ ব্যাবহার করবে! মা বলবে, নিজের সুলতানিয়ত ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া আমার পক্ষে সঙ্গত হবে না। কারণ মসনদ অরক্ষিত থাকলে শত্রুর মনে লোভ জাগবে। আমি আমার মাকে ভালো করে জানি, সে এই সব অজুহাত দেখিয়ে আমার যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে। তার চেয়ে, মাকে। কিছু বলার দরকার নাই, চলো আমরা একবার সামানদালের সঙ্গে মোলাকাত করে আসি। দেখি তার কী মতামত।
সালিহ বললো, তোমার যখন এতোই ইচ্ছা, চলো যাই একবার ঘুরে আসি। এই বলে সে তার হাতের একটা আংটি খুলে বাসিমের হাতে দিয়ে বললো, এটা পরে নাও। রক্ষাকবচ, হাতে থাকলে জলের নিচে তোমার কেউ কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
এরপর টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সালিহ আল্লা হো আকবর বলে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিলো। মামার দেখাদেখি ভাগ্নেও ঠিক একইভাবে ঝাপিয়ে পড়লো জলে। নিমেষে তলিয়ে গেলো দু’জনে। একেবারে সমুদ্রের গভীর তলদেশে।
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো আটত্রিশতম রজনী। আবার সে শুরু করে :
সালিহর ইচ্ছা প্রথমে সে তার ভাগ্নেকে তাদের নিজের প্রাসাদে নিয়ে যায়। তার মা লোকস্ত নাতিকে দেখে পুলকিত হবেন।
সুতরাং সে বাসিমকে সঙ্গে নিয়ে মা-এর কাছে উপস্থিত হলো। লোকঔ বাসিমকে দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বুকে জড়িয়ে ধরে আদর সোহাগ করতে থাকে।
-তোমার মা কেমন আছে, ভাই? —ভালো আছে, দাদীমা। লোকস্ত বলে, আজ আমার বড়ই আনন্দের দিন। কতকাল পরে আবার তোমাকে দেখতে পেলাম। আনারকে আনতে পারলে না ভাই, তাকে একবার দেখতাম।
বাসিম বললো, মা আপনাকে শুভেচ্ছা আর সালাম জানিয়েছে দাদীমা।
আপনারা বুঝতে পারছেন, এখানে বাসিম মিথ্যে কথা বললো। আসার সময় সে তো তার মা-এর সঙ্গে দেখা করেই আসেনি।
সালিহ বললো, তোমার নাতি সামানদালের কন্যা জানারাকে শাদী করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। ওকে নিয়ে এসেছি সামানদালের সঙ্গে এই শাদীর ব্যাপার নিয়ে এক প্রস্তাব দেব বলে।
ছেলের কথা শুনে লোস্ত ভীষণ রেগে উঠলেন, তোর তো সবই জানা আছে বাবা। সামানদাল ভীষণ জেদী একরোখা এবং ভয়ঙ্কর লোক। কত সুলতান বাদশাহকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে, কত শাহজাদাদের মেরে হাড়-গোড় ভেঙ্গে দিয়েছে, সেকি তুই জানিস না? এসব জেনে শুনে ওর কাছে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসলে মাটির মানুষের কাছে। আমাদের মান ইজ্জত কী বাড়বে সালিহ।
—কিন্তু মা আমাদের ছেলেই বা কম কিসে? হতে পারে তার মেয়ে জানারা সুন্দরী, কিন্তু আমাদের বাসিম তারও অধিক সুন্দর সুপুরুষ। হতে পারে তারা বিত্তশালী কিন্তু আমাদের ছেলে তার চেয়েও ধনী সুলতান।
লোকস্ত দেখলো, ছেলেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। তার মা বললো, যেতে হয়ত তুই এক যা। আমি বাসিমকে সঙ্গে দেব না। কোনও কারণে সে যদি অপমান অবজ্ঞা করে সে আমি সইতে পারবো না।
সালিহ দুই বস্তা উপহার সামগ্রী চাকরদের মাথায় চাপিয়ে সামানদালের প্রাসাদের দিকে চললো।
এই সময়ে ভোর হতে থাকে। শাহরাজাদও গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো উনচল্লিশতম রজনী :
আবার গল্প শুরু করে সে।
সামানদালের প্রাসাদে এসে সে সুলতানের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে। এবং প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। সালিহ দরবারে প্রবেশ করে।
একখানা পান্নার সিংহাসনে বসেছিলো সামানদাল। সালিহ তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে উপহারের বস্তা দু’খানা তার সামনে রাখে। সুলতানও তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পাশে বসতে বলে।
-সু-স্বাগতম শাহজাদা সালিহ। কী খবর, এস, এস, এখানে বসো আমার পাশে। অনেকদিন পরে তোমাকে দেখে বড় আনন্দ হলো। আচ্ছা, বলল কেন এসেছ আজ, দেখি কিছু করতে পারি কিনা তোমার জন্য?
নিশ্চয়ই আপনি করতে পারবেন, জাঁহাপনা। আজ আমি যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। দুনিয়াতে একমাত্র আপনিই তা পূরণ করতে পারেন।
সামানদাল অধৈর্য হয়ে ওঠে, আহা, ভূমিকা রেখে চটপট বলেই ফেল, না।
সালিহ বলে, আপনার প্রাণাধিক কন্যার সঙ্গে আমার ভাগ্নে সুলতান বদর বাসিমের শাদীর প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আমি। পারস্য এবং খুরসানের পরলোকগত সুলতান শাহরিমানের একমাত্র সন্তান সে–বর্তমানে সুলতান।
সালিহর প্রস্তাব শুনে সামানদাল হো-হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লো।
আমি ভেবেছিলাম, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, কিন্তু এখন দেখছি, নাঃ, আমি ভুল করেছি। তা না হলে এই ধরনের অদ্ভুত আজগুবি একটা প্রস্তাব তুমি রাখতে পার আমার কাছে।
-কেন, প্রস্তাবটা আজব হলো কী করে। আমার ভাগ্নে বাসিম আপনার কন্যার অযোগ্য কোন দিক দিয়ে। রূপে? গুণে? ঐশ্বর্যে? আমি বলবো, আপনার কন্যার যা গুণ আছে। বাসিমের গুণ তার চেয়ে অনেক বেশি। আর ঐশ্বর্য তার এতো আছে— আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না।
সালিহর এই সব কথা শুনে সামানদাল ক্রোধে ফেটে পড়ে।
-কী, এতো বড় স্পর্ধা! আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে অপমান? এই কে—আছিস, কুত্তার বাচ্চাকে মেরে হাড় ভেঙ্গে দে তো।
একদল ষণ্ডামার্কা পেয়াদা তাকে পাকড়াও করার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু সালিহ আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় তাদের সকলকে পাশ কাটিয়ে প্রাসাদের বাইরে ছিটকে আসতে পারে।
বাইরে এসেই সে চমকে যায়। তার মা তোকস্ত সন্তানের বিপদ আশঙ্কায় এক হাজার অশ্বারোহী সেনা পাঠিয়েছে তাকে রক্ষা করার জন্য। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত তারা।
সেনাপতি জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে শাহাজাদা। আপনি এতো ভীত চকিত হয়ে ছুটে বেরিয়ে এলেন কেন?
সালিহ বলে, সামানদাল আমাকে কুৎসিততম গালমন্দ দিয়েছে। তার লোকজনদের লেলিয়ে দিয়েছে আমার ওপর। আমাকে তারা মারবে।
সেনাপতি তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলো, দরবারে ঢুকে সুলতানকে আক্রমণ কর।
তৎক্ষণাৎ সৈন্যরা লাফ দিয়ে নেমে অসি উন্মুক্ত করে রে রে করে ঢুকে পড়লো দরবার মহলে।
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো চল্লিশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :
সামানদাল দেখলো, এক উন্মুক্ত সৈন্যদল তার প্রাসাদ আক্রমণ করেছে। এক মুহূর্ত সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু তারপর চিৎকার করে উঠলো, আমার বীর যোদ্ধা সৈন্যরা, শত্রু হানা দিয়েছে, বীর বিক্রমে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়। কচুকাটা করে শুইয়ে দাও এদের। এই মুহূর্তে আমি দেখতে চাই, শয়তানদের মুণ্ডু গড়াগড়ি যাবে আমার পায়ের তলায়।
সামানাদালের সৈন্যরাও তেড়ে এলো। দুই দলে প্রচণ্ড যুদ্ধ হতে লাগলো। কিন্তু সালিহর সৈন্যবাহিনী অমিত বিক্রমশালী। এক পা পিছনে হটাতে পারলো না। তাদের অসির আঘাতে সামানদালের সৈন্যরা লুটিয়ে পড়তে থাকলো। এইভাবে অনেকক্ষণ লড়াই চলার পর দেখা গেলো, সামানদালের সব সৈন্য নিঃশেষ হয়ে গেছে। অগণিত মৃতদেহ লুটিয়ে পড়েছে সারা দরবার মহলে। রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে।
সামানদাল শঙ্কিত হলো। এবার বুঝি তার প্রাণ যায়। সিংহাসন ছেড়ে সে পালিয়ে অন্দরমহলে যেতে চায়। কিন্তু সালিহ লাফিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। তলোয়ার উঁচিয়ে ধরে বলে, খবরদার, এক পা নড়বে না। যদি পালাবার চেষ্টা কর শয়তান, এই যে দেখছো, শাণিত তলোয়ার, তোমার মুণ্ডু লুটিয়ে পড়বে এখুনি।
সামানদাল হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। সালিহর সৈন্যারা পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেলে তাকে।
সামানদাল সালিহর হাতে বন্দী থাকে। আমরা এখন তার কন্যা জানারার কথা বলি।
প্রাসাদের সৈন্যবাহিনী শত্রুর হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত,ভুলুণ্ঠিত হয়েছে এবং বাবা সামানদাল বন্দী, এই সংবাদ পাওয়া মাত্র জানারা তার এক নিত্য সহচরী বাঁদী সিরৎলিকে সঙ্গে করে খিড়কীর দরজা দিয়ে পালিয়ে অজানার পথে বেরিয়ে পড়লো।
পথঘাট কিছুই জানা নাই। প্রাণভয়ে দিশাহারা হয়ে কোথায় যে সে ছুটে চললো কিছুই বুঝতে পারে না। প্রাসাদের বাইরে সে কখনও আসেনি।
চলতে চলতে এক জনবসতি-শুন্য গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করে সে একটা ঝাকড়া গাছের ওপরে উঠে পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইলো।
কিন্তু নিয়তির এমনি খেলা যে লোকস্তের প্রাসাদ এই বনভূমির অতি সন্নিকটে।
দুইজন অশ্বারোহী সৈন্য ছুটতে ছুটতে এসে লোকাস্তকে সংবাদ দিলো। শাহজাদা সালিহকে সুলতান সামানদাল অপমান করেছিলো। তাকে প্রহার দেবারও হুকুম দিয়েছিলো সে। কিন্তু তা তারা পারেনি। ইতিমধ্যে আমরা, এক সহস্র সেনা সেখানে পৌঁছে যাই। এখন দুই দলে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলেছে। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না বেগমসাহেবা, এ যুদ্ধে জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
বদর বাসিম আতঙ্কিত হলো। সর্বনাশ! এখন উপায়? শুধু একমাত্র তারই কারণে এই যুদ্ধ। মামা যদি মারা যায়? তা হলে? তা হলে সে দাদীমা লোকস্তের চোখের বিষ হবে। সব দোষ তার ঘাড়েই চাপবে। বলবে, তোমার খেয়াল চরিতার্থ করতে গিয়েই আমার ছেলেটা প্রাণ হারালো! না না, না, আর ভাবতে পারে না বাসিম।
সকলের অলক্ষ্যে সে প্রাসাদ ছেড়ে বনের দিকে ছুটে চলে। কোথাও পালাতে হবে। আত্মগোপন করতে হবে। না হলে পুত্রহারা মায়ের রোষানলে পড়ে সে ছারখার হয়ে যেতে পারে।
নিয়তিই তাকে সেই ঝাকড়া গাছের নিচে এনে দাঁড় করালো। আপনারা জানেন, এই গাছের ডালে বসে আছে সামানদাল কন্যা জানারা। সেও প্রাণভয়ে এখানে এসে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো।
গাছের ডালে উঠে বসতে যাবে, হঠাৎ বাসিমের নজরে পড়ে এক পরমাসুন্দরী কন্যা একটা ডালের ওপরে বসে ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। এমন রুপবতী নারী কখনও দেখেনি।
—কে তুমি? কেনই-বা এখানে এই গাছে বসে আছ, সুন্দরী?
-আমি জানারা, আমার বাবা সুলতান সামানদাল। সালিহ তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আমাদের প্রাসাদ আক্রমণ করেছে। আমাদের সমস্ত সৈন্য-সামন্ত খতম হয়ে গেছে। আমার বাবা এখন শাহাজাদা সালিহর হাতে বন্দী। আমার তল্লাশে তার সৈন্যরা এতক্ষণে সারা প্রাসাদ তোলপাড় করছে। আমি অনেক আগেই প্রাসাদ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু তুমি কে?
—আমার নাম বদর বাসিম, সালিহর ভাগ্নে। পারস্য এবং খুরাসনের সুলতান। আমার বাবা ছিলেন সেখানকার সুলতান। আমার মা আনারকলি, বেগমসাহেবা লোকস্তের কন্যা। মামার মুখে তোমার রূপের অনেক কথা শুনেছি। আমারই ইচ্ছায় তিনি গিয়েছিলেন তোমার বাবার কাছে। শাদীর প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু তোমার বাবা শুনেছি আমার মামাকে প্রহার করতে উদ্যত হয়। আত্মরক্ষার জন্যই তিনি সৈন্য ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তোমার বাবা উদ্ধত, অবিনয়ী। তার নির্বুদ্ধিতার জন্যেই এই মর্মান্তিক কাণ্ড সংঘটিত হলো। মামার প্রস্তাবে সে যদি রাজি নাও হতো এমন কোনও অপরাধ ছিলো না। কিন্তু পেয়াদা সিপাই দিয়ে মারধোর করানো কি সহ্য করা সম্ভব!
জানারা বলে, আমার বাবা ভীষণ বদরাগী, একরোখা মানুষ। তা না হলে, তোমার মতো এমন সুন্দর সুপুরুষ পাত্রকে তার পছন্দ হয় না? তোমাকে জামাই করতে পারলে, যে-কোনও সুলতান বাদশাহ নিজেকে ধন্য মনে করবে। কিন্তু আমার বাবা নিজের ভালো, আমার ভালো কিছুই বুঝতে চাননি। তাঁর দম্ভেই তিনি মারা গেলেন। আপনার মামার হাতে আজ তিনি বন্দী। কে জানে, তিনি তাকে ক্ষমা করবেন কিনা। না করাই স্বাভাবিক। নিজেকে রক্ষা না করতে পারলে তো এতক্ষণে তার দেহ লুটিয়ে পড়তে আমার বাবার পায়ের নিচে। এখন তাঁর অনুকম্পার ওপরই সব নির্ভর করছে।
জানারা নিচে নেমে এলো। বাসিম তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে, তুমি আমার কল্পলোকের মানসী প্রিয়া। শয়নে স্বপ্নে, নিদ্রা জাগরণে শুধু তোমারই ধ্যান করেছি আমি। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচতে পারবো না—এই কারণেই সুদূর মাটির দেশ থেকে নেমে এসেছি এই গহিন সমুদ্রে। বলল, তুমি আমার হবে?
চুম্বনে চুম্বনে ভরে দেয় জানারার অধর কপোল, বুক। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে পিষ্ট করে ফেলতে চায় ওর ফুলের মতো কোমল তনুলতা। বাসিম অনুভব করতে পারে, জানারার সুডৌল স্তনযুগল মর্দনের আনন্দে যেন আর্তনাদ করে উঠছে।
বাসিম উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। ক্ষিপ্রহাতে সে জানারার কটিবন্ধ খোলার জন্য হাত বাড়ায়। কিন্তু পারে না। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা মেরে বাসিমকে ঠেলে ফেলে দেয় জানারা। মুখে থুথু ছিটিয়ে ফুঁসে ওঠে, অসভ্য জানোয়র, কামনার কীট, এই তোর ব্যবহার? এই তোর ভালোবাসা? নারী-মাংসের পাশবিক ক্ষুধা তোর শিরায় শিরায়। তুই আমাকে ভালোবাসিস? মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা? তোর অপকর্মের সাজা কেমন করে দিতে হয়, একবার দ্যাখ। শোনও মাটির দেশের জন্তু, আমার সঙ্গে যে ব্যবহার তুমি করলো তার দণ্ড হিসাবে তোমাকে আমি এই মুহূর্তে না-পাখি না-পশু এক অদ্ভুত ধরনের জীবে পরিণত করলাম।
কি আশ্চর্য, জানারার মুখের অভিশাপ শেষ হতে না হতে বদর বাসিম একটা বিরাটাকৃতির শাদা উটপাখির আকার ধারণ করলো।
জানারা তার সহচরী বাদীকে বললে, এই কামুক জানোয়ারটাকে আমি এমন একটা জীব বানালাম সে কোনও দলেই ঠাই পাবে না। পাখীরা বলবে, তুমি উড়তে পার না, ডানা থাকলে কী হবে, আমরা তোমাকে দলে নেব না। আর জানোয়াররা বলবে, তোমার তো দুখানা পা। তুমি আবার জানোয়ার হতে চাও কোন মুখে, দূর হও। সিরৎলি, এটাকে নিয়ে চলে যা ঐ মরুভূমির মধ্যে। বেঁধে রেখে আয়, না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে মরুক লোচ্চাটা। নারী-মাংস খুবলাতে আসার মজাটা একবার বুঝুক।
এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো বিয়াল্লিশতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
জানারা বললো, তুমি ভুল জায়গায় খাপ খুলতে গিয়েছিলে মিট্টির সুলতান। জানারা ভালোবাসার দাসী হতে পারে কিন্তু কারো পাশবিক কামনার শিকার হবে না! সিরৎলি যাও, নিয়ে যাও তাকে ঐ উত্তপ্ত বালুকারাশির মধ্যে, ওকে বেঁধে রেখে এস। গলা শুকিয়ে না খেয়ে মরুক, ওটা!
সিরলি বাসিমকে তাড়াতে তাড়াতে মরুভূমির দিকে নিয়ে চলে। বাসিম-এর চোখে জল আসে। চলতে চলতে কখনও সে দাঁড়িয়ে পড়লে সিরৎলির ডাণ্ডা এসে পড়ে ওর পিঠে। বেদনায় কঁকিয়ে ওঠে সে। আবার চলতে থাকে। কিন্তু হাজার হলেও সুলতানের দুলাল। দৌড় কঁপের অভ্যাস নাই কোনকালে, অমন তাড়া সহ্য করবে কি করে। আবার সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সিরৎলির দিকে করুণভাবে তাকায়।
সিরৎলির মায়া হয়। আহা কী সুন্দর শাহজাদা। না হয় একটু বাড়াবাড়িই করেছিলো, তাই বলে এই হাল করতে আছে। সে ভাবে, ঐ খাঁ খাঁ মুরভূমির মধ্যে বেঁধে রেখে এলে নির্ঘাৎ মারা যাবে। না, তা সে করতে পারবে না। একটা সোনার চাঁদ ছেলেকে এইভাবে হত্যা করার পাপের ভাগী সে হতে পারবে না। অন্য কোথাও, অন্য কোনও স্থানে রেখে দিয়ে যাবে। যেখানে অন্ততঃ প্রাণে মারা যাবে না। তারপর ওর যা বরাতে লেখা আছে তাই হবে। চাই কি শাহজাদী জানারার রাগ পড়ে গেলে তারও মনে অনুতাপ অনুশোচনা হতে পারে। তখন হয়তো সে-ই তাকে উল্টে চাপ দিয়ে দুষবে, আমি না হয় রাগের মাথায় তাকে মেরে ফেলতেই বলেছিলাম, তাই বলে তুমি ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হয়ে অমন সুন্দর এক শাহজাদাকে হত্যার মুখে রেখে এলে?
নবাব বাদশাহর বাড়িতে নোকরী করে করে তার তিন কাল গেছে। এদের খামখেয়ালীপনা দেখে দেখে নাড়ি-নক্ষত্র সব তার চেনা হয়ে গেছে। একই কথা মেজাজ মর্জি বুঝে চলতে পারলে ইনাম মেলে। আবার সেই কথারই দোষ ধরে, অন্য সময় হয়তো বা কারো গর্দান যায়।
সিরলি উটপাখী রূপী বাসিমকে তাড়িয়ে নিয়ে এক শ্যামল বন-প্রান্তরের দিকে চলে যায়। অদুরে এক স্বচ্ছ-সলিলা নদী প্রবাহিতা। গাছে গাছে পাকা পাকা ফল। সে ভাবলো, এইখানে শাহজাদাকে রেখে গেলে গাছের ফল আর নদীর জল খেয়ে সে অন্ততঃ জীবন ধারণ করতে পারবে।
সালিহ সামানদালকে বন্দী করে তারই প্রাসাদের এক কক্ষে কয়েদ করে রাখে। এবং মসনদে আরোহণ করে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করে দেয়। সারাটা প্রাসাদ তন্ন তন্ন। করে খুঁজেও সে শাহজাদী জানারার সন্ধান পায়।
সালিহ বুঝতে পারে বিপদের আশঙ্কা বুঝে পূর্বাহ্নেই সে কেটে পড়েছে। মা-এর কাছে ফিরে আসে সে। লোকস্ত ছেলেকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। কেঁদে আকুল হয়।
–এদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেছে, বাবা।
—কেন কী, আবার কী হয়েছে মা? সালিহ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। লোস্ত বলে, বাসিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অচেনা-অজানা বিদেশ-বিভূঁই-এ কোথায় গেলো সে, আর কেনই বা না বলে কয়ে চলে গেলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নফর চাকরদের খুঁজতে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা ফিরে এসে বললো, ধারে কাছে কোথাও সে নাই। বহু দূরে অন্য কোথাও গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে হয়তো বা।
সালিহ চারদিকে লোকজন পাঠালো। সারা শহর গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরে এলো তারা। না, কোথাও সন্ধান পাওয়া গেলো না বাসিমের। অবশেষে সে শ্বেত শহরে দূত পাঠালো আনারকলির কাছে। গভীর দুঃখ-বেদনা জানিয়ে এক পত্র লিখলো সে, বাসিম কোথায় উধাও হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তার সন্ধান করতে পারিনি।
দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে আনারকলি এসে উপস্থিত হলো। মা লোকস্ত ভাই সালিহ গভীর শশাকে মুহ্যমান। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে তাদের।
সালিহ চোখের জল ফেলতে ফেলতে সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলো।
—আমি এখন সামানদালের মসনদ অধিকার করে সুলতান হয়ে বসেছি। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও শাহাজাদী জানারাকেও পাওয়া যায় নি। প্রাসাদ কেন, সমগ্র দেশেও তাকে দেখে নি কেউ। বদর বাসিমের সন্ধানে এখনও আমার বিশাল বাহিনী দেশের সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আনারকলির চোখের সামনে আঁধার নেমে এলো। পুত্রহারা মা-এর গগনভেদী আর্তনাদে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠলো। প্রাসাদ ছাপিয়ে পড়লো বুক ভাঙ্গা কান্নার ঢেউ।
মা নোকস্ত কন্যাকে সান্ত্বনা দেয়, খোদা এতো নিষ্ঠুর হবেন না, মা। বাসিম আমার ফুলের মতো নিস্পাপ নির্মল। তার কোনও ক্ষতি হতে পারে না। তুই দেখিস, বাসিম আবার ফিরে আসবে।
আনারকলি বলে, মা আমি তো আর এখানে পড়ে থাকতে পারবো না। চার দিকে শত্রুর অভাব নাই। মসনদ অরক্ষিত আছে, আমি যাচ্ছি। বাসিমের খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে দূত পাঠাবে আমার কাছে।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো তেতাল্লিশতম রজনী?
আবার সে বলতে শুরু করে :
এবার চলুন আমরা সেই সবুজ বনানীর নদী উপকূলে যাই। সেখানে সিরৎলি বদর বাসিমকে কীভাবে রেখে গেছে—একবার দেখে আসি।
উটপাখি-রূপী বাসিম যখন দেখলো, দাসীটা তাকে নদীর ধারে ছেড়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো, কান্নায় ভেসে যেতে লাগলো তার দু’চোখ। পাখা আছে তবু উড়ে পালাবার ক্ষমতা নাই। বিশাল দেহটা নিয়ে দুপায়ে গুটি গুটি হেঁটে আর কতদূর যাওয়া যায়? এবং যাবেই বা
কোথায়। সবই অচেনা-অজানা। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা করে দেখে নিলো সে।
খিদের তেষ্টাও পেয়েছিলো বেশ। চারপাশে অনেক ছোট ছোট ঝকড়া গাছ। এবং সেই সব গাছের নাম না জানা হাজার হাজার পাকা ফল। বাসিম যতটা পারলো খেলো। তারপর নদীর ঘাটে গিয়ে প্রাণভরে জল পান করলো। তারপর খুঁজে পেতে একটা বিশাল প্রাচীন বটের কোটরে আশ্রয় নিলো। জায়গাটা সে মন্দ বের করেনি। বিশ্রাম করার পক্ষে উপযুক্ত।
রাত্রির অন্ধকার নেমে এলো। বাসিম বৃক্ষ-কোটরে ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল বেলায় ঘুম ভেঙ্গে যে চমকে ওঠে। এক শিকারী জালে আবদ্ধ করেছে তাকে।
শিকারীর মুখে বিজয়ের হাসি।
যাক, আজ একটা ভালো দাও পাওয়া গেছে। বাজারে নিয়ে গেলে চড়া দামে বিকাবে। শিকারী তার কাঁধে তুলে নিলো উটপাখী-রূপী বাসিমকে। স্বগতভাবে বলতে বলতে পথ চলে, এতোকাল এতো পাখি ধরেছি, কিন্তু এ রকম অদ্ভুত নতুন পাখি তো কখনও পাইনি। দামটা যাচাই করে দেখতে হবে। নিশ্চয়ই কোনও সাধারণ পাখি নয়। হয়তো অনেক দাম হবে। হাটে বাজারে কোনও সাধারণ লোকের কাছে বেচে দিলে দামও বেশি পাওয়া যাবে না, এবং এর মর্ম বোঝার চেষ্টা না করে কেটে ফেলবে হয়তো। তার চাইতে সুলতান বাদশাহের কাছে হাজির করলে মোটা বকশিশ মিলতে পারে।
হাঁটতে হাঁটতে সে এক সুলতানের প্রাসাদে পৌঁছালো। পাখিটার অদ্ভুত আকার এবং ঠোঁট চোখ পালক দেখে সুলতান মোটা ইনামের বিনিময়ে পাখিটা কিনে নিয়ে একটা সোনার খাঁচায় ভরে রাখলো। একটা পাত্রে করে খেতে দিলো কিছু ভুট্টা আর ডালের দানা। কিন্তু কিছুই স্পর্শ করলো না সে। সুলতান ভাবলো, এ পাখি এসব বুঝি খায় না। তারপর কিছু মাংস এবং ফল এনে দিলো। এবার কিন্তু পাখিটা সাগ্রহে খেতে থাকলো।
সুলতান আনন্দে নেচে ওঠে। খোজাকে ডেকে বলে, ওরে যা যা, শিগ্নির বেগমসাহেবাকে খবর দে, কী অদ্ভুত একটা পাখি কিনেছি আজ। পাখিটা ডালের দানা ছোঁয় না। অথচ মাংস ফল পেলে গবগ করে খায়।
খোজাটা ছুটে যায় হারেমে। একটু পরে বেগমসাহেবা আসে। কিন্তু পাখিটা দেখামাত্র সে নাকাব দিয়ে মুখ ঢেকে থামের আড়ালে দাঁড়ালো। সুলতান বুঝতে পারে না, কী ব্যাপার?
বেগমের পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হলো? এতো শরম কীসের? এখানে তো বাইরের কোনও পুরুষ নাই!
বেগম বলে, এই পাখিটা আসলে পাখি নয়। এক শাহজাদা। খুব সুন্দর দেখতে। ওর নাম বদর বাসিম। সুলতান শাহরিমানের পুত্র। ওর মা আনারকলি। শাহজাদী জানারার অভিশাপে ওর এই উটপাখির দশা হয়েছে।
সুলতান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, জানারা অভিশাপ দিলো কেন?
—তার কারণ, এই বদর বাসিমের মামা সালিহ জানারার বাবা সামানদালকে বন্দী করে মসনদ দখল করে নিয়েছে।
সুলতান চিৎকার করে ওঠে, আল্লাহ ঐ শাহাজাদী জানারাকে সমুচিত সাজা দেবেন। কী কী ঘটেছে, সব আমাকে খুলে বলো, বেগম।
সুলতান-বেগম অসাধারণ যাদু বিদ্যাধরী। আগাগোড়া সব কাহিনী খুলে বললো সে। সুলতান সব শুনে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে উঠপাখির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী, সব সত্যি।
পাখিটা ঠোঁট নেড়ে, পাখা ঝটপট করে জানালো সবই ঠিক। এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো চুয়াল্লিশতম রজনী?
আবার সে বলতে শুরু করে : সুলতান বলে, বেগমসাহেবা, তুমি ওকে শাপমুক্ত করে দাও। আবার সে মানুষ হয়ে উঠুক। বেগমের নির্দেশে খোজা এক পেয়ালা জল এনে দেয়। বিড় বিড় করে কী সব
মন্ত্র আওড়ে কয়েকবারে জলটুকু পাখিটার গায়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে আবার কী সব বলতে থাকে।
নিমেষের মধ্যে উটপাখিটা মানুষের আকার ধারণ করতে থাকে। একটু পরে সে এক সুন্দর সুপুরুষ শাহজাদার চেহারা ফিরে পায়। খাঁচার দরজা খুলে সে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
—আল্লাহ মেহেরবান। সুলতান বদর বাসিমকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার সব কাহিনী শুনতে চাই, বেটা।
বদর বাসিম তার জীবনের সব কাহিনী সবিস্তারে খুলে বললো তাকে। শোনার পর সুলতান বললো, এখন বলল, বাবা, তোমার জন্যে কী আমি করতে পারি। বদর বলে, সব আগে আমি আমার সলতানিয়তে ফিরে যেতে চাই। অনেক দিন দেশ ছাড়া। মসনদ খালি পড়ে আছে। চারদিকে শত্রুর অভাব নাই। না জানি এতোদিনে কী ঘটেছে। দারুণ উৎকণ্ঠায় মা দিন কাটাচ্ছেন। আমাকে না দেখা পর্যন্ত তার মুখে হাসি ফুটবে না।
সুলতান বললো, আমি তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
খুব সুন্দর দেখে একখানা ময়ূরপঙ্খী নৌকা বানিয়ে অনেক খাবার দাবার এবং সোনাদানা হীরে জহরতে বোঝাই করে বাসিমকে চাপিয়ে বিদায় দিলো সে।
বাসিমের বড় আশা ছিলো সে দেশে ফিরতে পারবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ভাগ্য যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানে না গিয়ে উপায় কী?
পাঁচ দিন চলার পর হঠাৎ সমুদ্রে তুফান উঠলো! ঝড়ের তোড়ে নৌকাখানা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেলো। মাঝি মাল্লারা কে কোথায় তলিয়ে গেলো কেউ জানে না। বাসিমের যখন সম্বিত ফিরে এলো, দেখলো, সে শুয়ে আছে এক পাহাড়ের পাদদেশে সমুদ্র উপকূলে! আশে-পাশে তাকিয়ে দেখলো, কোনও জনমানব নাই। একটু পরে দেখা গেলো গরু, গাধা, ঘোড়া, খচ্চর মোষের একটা দল এগিয়ে আসছে। বাসিমের ভয় হলো। ওরা যদি আক্রমণ করে, প্রাণে আর বাঁচবে না সে। ভয়ে আতঙ্কে সে ছুটতে থাকে। জানোয়ারগুলোও তাড়া করে নিয়ে চলে। এইভাবে দৌড়তে দৌড়তে এক সময় এক শহরের ভিতরে প্রবেশ করে। সামনেই
একটা দাওয়াখানা। উপায়ান্তর না দেখে সে ঐ ওষুধের দোকানেই ঢুকে পড়ে।
দোকানের মালিক এক পলিত-কেশ বৃদ্ধ। বাসিম তখন ভয়ে থর থর করে কাঁপছিলো। আর্তকণ্ঠে মিনতি জানালো সে, মেহেরবাণী করে বাঁচান আমাকে। এক দল জন্তুজানোয়ার তাড়া করেছে আমাকে। উফ্ কী সাংঘাতিক ব্যাপার। এতো জন্তুজানোয়ার এলো কোথা থেকে এ শহরে?
বৃদ্ধ বললো, তোমার কোনও ভয় নাই, বেটা। তুমি স্থির হয়ে বসো এখানে। তারপর চলো আমার বাসায়। খানাপিনা কর। তখন তোমাকে বলবো সব কাহিনী।
দোকানের পিছন দিকে বৃদ্ধের বাড়ি। বাসিমকে নিয়ে এসে সে শোবার ঘরে বসলো। নফর খানা সাজিয়ে দিয়ে গেলো। খেতে বসে বৃদ্ধ বাসিমকে বলতে থাকে, এই শহরের নাম যাদুপুরী। এখানকার শাসক এক যাদুকরী-বেগম সালমানখ। তার যাদুবিদ্যার কৌশল জগৎবিখ্যাত। আসলে সে এক দানবী! নারীমূর্তি ধরে আছে এখানে। দারুণ কামুক।
দুনিয়ার এমন কোনও বীর্যবান পুরুষ নাই, যে ওর কামক্ষুধা মেটাতে পারে। এই দ্বীপে যারা আসে তাদের মধ্য থেকে সুন্দর সুন্দর সেরা জোয়ানদের সে পাকড়াও করে আনে। যতক্ষণ তাদের ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ ধরে তাকে নিয়ে কামসম্ভোগ করে। তারপর নিবীর্য হয়ে পড়লে মন্ত্র পড়ে জানোয়ার বানিয়ে ফেলে। এবং নিজেও সেই জাতের মাদী জানোয়ারের রূপ ধরে পাল খেতে থাকে। এইভাবে জানোয়ারও যখন তাগদহীন হয়ে a পড়ে তখন আবার সে নারীমূর্তি ধারণ করে। কিন্তু এ জানোয়ারকে তবে মানুষের চেহারা ফিরিয়ে দেয় না। তুমি যাদের তাড়া খেয়ে আমার দোকানে ঢুকেছিলে সেই জানোয়ারগুলো আসলে কেউ জানোয়ার নয়। সকলেই পরদেশী মুসাফির! ঐ শয়তানীর খপ্পরে পড়ে আজ তাদের এই দশা। ওরা চেয়েছিলো, তুমি যাতে এই শহরে না ঢোকো। সেইজন্যে তাড়া করে সমুদ্রেই পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু তুমি বুঝতে পারনি। ভয় পেয়ে সাপের গর্তের মধ্যেই ঢুকে পড়েছ। তোমার রূপ অসাধারণ। যৌবন অটুট তাগড়াই আছে। এই শয়তানী যাদুকরীটা তোমাকে দেখলে তার জিভে পানি ঝরবে। কিন্তু সাবধান কোনভাবেই তার কজায় পড়ে না। একেবারে ছোবড়া করে ফেলে দেবে।
অবশ্য আমিও একজন যাদুকর। এমন বিদ্যা জানি, ওই আলমানখকে সাতঘাটের পানি খাইয়ে দিতে পারি। কিন্তু নিজের যাদুক্ষমতা আমি কাজে লাগাই না, আমি সাচ্চা মুসলমান, নিত্য কোরান পাঠ করি। আল্লাহর নির্দেশ আছে অসৎ কাজে যাতে এই সব যাদুবিদ্যার ব্যবহার না হয়। সুতরাং সে রকম অনাচার আমি কিছু করতে পারি না। তা না হলে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম ঐ যাদুকরীকে।
বৃদ্ধের কথা শেষ, হতে না হতে সুবেশা সুন্দরী প্রায় এক হাজার মেয়ের একটা বাহিনী এসে বাড়ির দরজার সামনে দুই সারিতে বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এবং তার মাঝখান দিয়ে একটা আরবী তেজি ঘোড়ায় চেপে এসে দাঁড়ালো সেই বেগম আলমানাখ তার পরণে চোখ ধাঁধানো জমকালো বাদশাহী সাজ-পোশাক।
বাড়ির ভিতর ঢুকে সে বৃদ্ধকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানালো।
সদর-পেরিয়ে ছোট একখানা বসার ঘর। তার পাশেই বৃদ্ধের শোবার ঘর। একখানা কুর্শিতে বসে পড়ে আলমানাখ আড়চোখে বাসিমকে নিরীক্ষণ করতে থাকে।
ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো ছেচল্লিতম রজনী?
আবার গল্প শুরু হয় :
একটু পরে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে, আবদ অল রহমান সাহেব, এই খুবসুরত ছেলেটি কে? বৃদ্ধ জবাব দেয়, আমার ভাইপো। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
—ভারি চমৎকার দেখতে আপনার ভাতিজা। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে যায়। যদি কিছু মনে না করেন, তবে একটা রাতের জন্যে ওকে আমি আমার প্রাসাদে নিয়ে যেতে চাই। আপনি বিশ্বাস করুন, কোনও রকম খারাপ কাজ করবো না। শুধু নয়ন ভরে দেখবো ওর মনোহর রূপ। এক সঙ্গে বসে গল্পসল্প করবো, খানাপিনা, গান বাজনা করবো। ব্যস, এর বেশি আর কিছু করবো না। আপনি নিশ্চিন্তে একটা রাতের জন্যে আমার হাতে ছেড়ে দিন। সত্যি বলছি, আর কোনও কিছু করবো না। ছেলেটিকে দেখেই বড় ভালো লেগেছে। ওকে একটু প্রাণভরে দেখবো, এই আর কি!
আবদ অল রহমান বলে, দেখুন, আপনার হাতে ছেড়ে দিতে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু আমার ভাইপোর ওপর কোনও যাদুবিদ্যা খাটাবার চেষ্টা করবেন না। তা হলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। কারণ আপনাকে তো চিনতে আমার বাকী নাই!
-আরে না, না, আমি আপনাকে যখন কথা দিয়ে যাচ্ছি, ওসব খারাপ কিছু করবো না। এই নিন, আপনার সেলামী রইলো। ওকে দিন, আমি যাই।
এক হাজার মোহরের একটা থলে বৃদ্ধের সামনে রেখে বাসিমকে ঘোড়ায় চাপিয়ে সে প্রাসাদে ফিরে এলো।
প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করে বাসিম স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এমন অসাধারণ কারুকর্ম কোথাও সে দেখেনি। দরজা জানলাগুলো সব সোনার তৈরি। ঘরে ঢুকেই সে বাসিমকে নিয়ে পালঙ্ক-শয্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু না, আসুরিক কোনও কায়দা নয়, বেশ সোহাগ করেই ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলতে থাকে বাসিমকে। বাসিমের সমস্ত সত্তা ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে থাকে আল-মানাখের সোহাগ শৃঙ্গারের যাদুতে। মেয়েটি কামকলায় ওস্তাদ। কী ভাবে মরুভূমিতেও ফুল ফোটাতে হয় সে কায়দা তার জানা।
বাসিম বৃদ্ধের কাছ থেকে পূর্বাহ্নেই সব জেনে নিয়ে ছিলো। সেই কারণে নিজেকে সে কঠিন করে বেঁধে রাখার প্রাণপণ কসরৎ যে করে নি তা নয়, কিন্তু মেয়েটির আশ্চং রতিরঙ্গ ভঙ্গী এবং রীরংসা জাগাবার ছলা-কলার কাছে কোথায় সে-সব খড়কুটোর মতো ভেসে গেলো।
আনন্দ যেমন সে লুটতে জানে, আনন্দ তেমনি সে দিতেও জানে। সে দেওয়ার কোনও কার্পণ্য নাই। দু’হাত ভরে উপুড় করে ঢেলে দেওয়া। দেহ প্রাণ মন ভরে গিয়ে উপচে উপচে পড়তে থাকলো।
বাসিম ভেবে পায় না, এতো আসন, এতো ব্যসন, বিহার সে শিখলো কোথায়? যে কোন হীন বীর্য পুরুষও এই রতিসঙ্গ লাভ করলে সিংহের মতো তড়পে উঠবে।
পরদিন বাসিম নিজেই নড়লো না। তারপর দিনও সে আল মানাখের দেহপাশেই আবদ্ধ রয়ে গেলো। মেয়েটি অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো। মুখ টিপে হেসে ঠোনা মেরে বলেছিলো, কী গো নাগর, এখনও তোমার আশ মিটলো না? আর কত মধু খাবে। এবার যাও তোমার বুড়ো চাচার দোকানে। তোমাকে না পেয়ে সে যে মূৰ্ছা যাবে।
—তা যাক, আমি তোমার কাছেই থাকবো-চিরকাল।
—চিরকাল? হা হা হা—চিরকাল? আহা, পুরুষদের কী আমার চিনতে বাকী আছে? একটা মেয়েতে কী তাদের চিরকাল চলে! দিনকয়েক পরেই আমাকে এঁটো কলাপাতার মতো ছুঁড়ে দিয়ে অন্য মেয়ের ওড়না পাজামা খুলতে ছুটবে। আমি তোমাদের চিনি না?
–বিশ্বাস করো, যে রসের স্বাদ তুমি আমাকে দিয়েছ, জীবনে এর আগে কেউ দেয় নি। আমার বিশ্বাস এ বিদ্যার এতো কলা অন্য কোনও মেয়ের জানাও নাই। তাই আমি তোমার কাছেই থাকবে চিরকাল। কোথাও যাবো না।
—দেখা যাক।
মেয়েটি মুচকি হেসে আবার সুরত রঙ্গে মেতে উঠলো।
এইভাবে চল্লিশটা দিন, চল্লিশটা রাত মধুর আনন্দে কেটে যায়। বাসিম ভাবে এবার সে একটু অভিনয় দেখাবে আল মানাখকে। সন্ধ্যাকালে যথারীতি মেয়েটি কাছে এসে আদর সোহাগ আরম্ভ করে। কিন্তু বাসিম অনীহা দেখিয়ে বলে, আজ শরীরটা ভালো নাই গো, আজকের রাতটা রেহাই দাও।
আল মানাখ ঠোঁটের কোণে হাসে, শরীরের আর কী দোষ, বলো। একনাগাড়ে কতদিন আর পারবে? ঠিক আছে, বিশ্বাস কর আর বিরক্ত করবো না তোমাকে।
বাসিম ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে।
রাত গভীর হলে মেয়েটি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের এক পাশ থেকে একটা পাত্রে খানিকটা বার্লি নিয়ে আসে। জল দিয়ে গুলে কাই করে তার মধ্যে আর একটা গুড়ো পদার্থ খানিকটা মিশিয়ে ঢেকে রাখে। তারপর আবার বাসিমের পাশে এসে শুয়ে পড়ে।
পরদিন খুব ভোরে উঠে বাসিম সোজা সেই বৃদ্ধের দোকানে আসে। সব ব্যাপার খুলে বলে তাকে। বৃদ্ধ বলে, শয়তানী আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? ওর মরার পাখা গজিয়েছে। তোমাকে আমি একখানা পিঠে দিচ্ছি। এ-খানা নিয়ে যাও। ওখানে গিয়ে দেখবে, শয়তানীটা নাস্তা সাজিয়ে বসে আছে। এবং সেই নাস্তা-খাবারের মধ্যে এই রকম একখানা পিঠে দেখতে পাবে। ওই পিঠেখানা কিছুতেই খাবে না। ওর মধ্যে ওষুধ মিশিয়ে রেখেছে সে। খেলেই কিন্তু তুমি একটা গাধা হয়ে যাবে। এই পিঠেখানা কৌশল করে ওকে খাওয়াতে পারবে তো? হলেই বাজিমাৎ হয়ে যাবে। তোমাকে গাধা বানাতে গিয়ে সে নিজেই গাধা হয়ে যাবে। তখন তুমি ওর পিঠে চেপে সোজা চলে আসবে আমার দোকানে। তারপর যা করার আমি করবো।
বাসিম প্রাসাদে ফিরে এসে দেখে সামনের ফুলবাগিচার মধ্যে একটা টেবিলে খানাপিনা সাজিয়ে বসে আছে আল মানাখ। বাসিমকে দেখে সে বলে, কী ব্যাপার, কোথায় গিয়েছিলে এতো সকালে?
বাসিম বলে, অনেক দিন চাচার সঙ্গে দেখাতে করতে পারি নি। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ভাবলাম, একবার দেখা করে আসি। তা চাচা পেট পুরে নাস্তা খাইয়ে দিয়েছেন। কী চমৎকার পিঠে বানাতে পারেন তিনি। আমি তো অনেকগুলো খেলাম। চাচা তোমার জন্যও একখানা দিলেন, খেয়ে দেখ।
বাসিম পিঠেখানা আল মানাখের হাতে তুলে দেয়। আল মানাখ বলে আমিও বানিয়েছি ; আমারটা একবার খেয়ে দেখ দেখি, তোমার চাচার চেয়ে খারাপ হয়েছে কিনা।
নাস্তার রেকাবী থেকে একখানা পিঠে তুলে দেয় সে বাসিমের হাতে। বাসিমের বুঝতে অসুবিধে হয় না ওর কারসাজী। পিঠেখানার একটুকরো ভেঙ্গে নিয়ে মুখে পোরার ছল করে কামিজের মধ্যে ফেলে দেয়! মিছি মিছি করে এগাল ওগাল করে চিবুতে থাকে। আল মানাখও একটুকরো ছিড়ে নিয়ে মুখে দেয়। এগাল ওগাল করে খেয়ে সে জলের গেলাস তুলে নিয়ে এক আঁজলা জল বাসিমের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলতে থাকে, ওরে হাঁদা, কি খেয়েছিস, জানিস না, এইবার তুই গাধা হয়ে যা।
কিন্তু বাসিমের আকৃতির কোনও পরিবর্তন হলো না। আল মানাখ শিউরে ওঠে। তবে—তবে কী আমার যাদুবিদ্যা মিথ্যা হয়ে গেলো?
—হ্যাঁরে, বিশ্বাসঘাতক শয়তানী, মিথ্যেই হয়ে গেছে তোর ভেল্কিবাজী। এইবার দেখ আমার যাদুবিদ্যার ক্ষমতা।
এই বলে সে এক আঁজলা জল ছিটিয়ে দিলো ওর গায়ে।
—আমাকে গাধা বানাতে গিয়েছিলি? এবার তুই নিজে গাধা হয়ে যা। সঙ্গে সঙ্গে যাদুকরী গাধা হয়ে গেলো। এবং বাসিমও ওর পিঠে চেপে সোজা চলে এলো বৃদ্ধের ওষুধের দোকানে।
আবদ অল রহমান গাধারূপী আল মানাখকে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়ে। এইবার বিশ্বাসঘাতিনী, তোকে আমি কি শিক্ষা দিই এইবার দেখ।
এই বলে সে আল মানাখের মুখের ওপর একটা লাথি মারে। বাসিমকে বলে, বাবা, তোমাকে আর আটকাবো না। তুমি দেশে ফিরে যাও। তোমার মা দারুণ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আমি আগে তোমার পৌঁছবার ব্যবস্থা করছি। তারপর ঐ সব হতভাগ্য পরদেশী মুসাফিরগুলোকে আবার মানুষের রূপে ফিরিয়ে আনবো।
বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তেই সামনে এসে দাঁড়ালো এক আফ্রিদি জিন। অল রহমান বললে, এই শাহজাদাকে নিয়ে শ্বেতশহরে তার প্রাসাদে পৌঁছে দাও।
জিন তার পিঠে তুলে নিলো বাসিমকে। তারপর ঊর্ধ্বাকাশে উঠে গেলো। তীরবেগে ছুটে চললো সে শ্বেতশহরের দিকে। একদিন এক রাত্রি ছুটে চলার পরে এসে পৌঁছয় শ্বেতশহরের প্রাসাদ-চূড়ায়। সেখানে সে বাসিমকে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই সময়ে ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো আটচল্লিশতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :
বাসিম সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আসে। দুঃখী মায়ের মুখে হাসি ফোটে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর সোহাগ করতে থাকে। দু’চোখে ভরে ওঠে অশ্রু।
বাসিম দেখলো লোকস্তু এবং সালিহও এসেছে তার মা-এর কাছে। তার বিচিত্র
অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনালো সকলকে। তারপর মা-এর দিকে তাকিয়ে বললো, মা, জানারাকে শাদী করার ইচ্ছা আমি ত্যাগ করতে পারি নি। তোমরা যে ভাবে পার তার ব্যবস্থা করো।
সালিহ বললো, সে আর এমন কী কঠিন কাজ মামু। জানারার বাবা সামানদাল আমার হাতে বন্দী হয়েছে। ওকে আমি তারই প্রাসাদের এক অন্ধকার কয়েদখানায় আটক করে রেখেছি। এখুনি নিয়ে আসছি এখানে।
তুড়ি বাজাতেই এক প্রহরী এসে দাঁড়ালো। সালিহ বললো, যাও পাতালপুরী থেকে সামানদালকে নিয়ে এসো এখানে।
প্রহরী বিদায় নিলো। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শৃঙ্খলিত সামানদালকে এনে দাঁড় করালো সে সালিহর সামনে।
সালিহ বললো, কী কেমন আছেন শাহেনশাহ!
-কেন আমাকে বিদ্রুপ করছো, সালিহ। তুমি আমার মসনদ অধিকার করে নিয়েছ, আমি তো এখন আর সুলতান নই, তোমার বন্দী মাত্র।
সালিহ বলে, আপনার সলতানিয়ত দখল করে ভোগ করার কোনও বাসনা নাই আমার। আপনার মসনদ আপনাকেই ফিরিয়ে দেবো। কিন্তু একটা শর্তে।
সামানদাল জানতে চায়, কী শর্ত?
—আপনার কন্যা জানারাকে শাদী করতে চায় আমার এই ভাগ্নে বাসিম। আপনি একে এর আগে স্বচক্ষে দেখেন নি। ভালো করে দেখুন তো, আপনার মেয়ের চাইতে কোনো অংশে এ খাটো কিনা?
সামানদাল বলে, চমৎকার ছেলে। এমন জামাই পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। আমি এখুনি রাজি। কিন্তু জানারাকে আনতে তো লোক পাঠাতে হবে। আমার প্রাসাদে সে নাই। তবে এটা ঠিক, ধারে কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
সালিহ প্রহরীকে ডেকে বললো, জলদি যাও। যে ভাবে পার, সুলতান সামানদালের কন্যা জানারাকে খুঁজে পেতে এনে হাজির করো এখানে।
প্রহরী চলে গেলো। এবং অল্পক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এলো জানারাকে সঙ্গে নিয়ে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সামানদাল। আদর সোহাগ করে বললো, মা-জননী, এঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই—ইনি হচ্ছেন বেগম লোকস্ত, এ হচ্ছে তার ছেলে সালিহ, আমাকে বন্দী করেছে ; আর এ তার ভগ্নী আনারকলি—এখানকার সুলতান বদর বাসিমের মা। এবং এই হচ্ছে সেই
বাধা দিয়ে জানারা বললো, জানি বাবা, ইনি হচ্ছেন মহামান্য সুলতান বদরু বাসিম। এঁর সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছে।
সামানদাল বললো, মা, আমি এদের জবান দিয়েছি—বাসিমের সঙ্গে তোমার শাদী দেবো। আমি জানি তুমি আমার ভীষণ অনুগত। আমার কথার খেলাপ হবে তেমন কাজ করবে না কখনও। বাসিম তোমার যোগ্যপাত্র হতে পারবে। রূপে গুণে শৌর্যে, বীর্যে ওর তুলনা নাই, আমার তো মনে হয় তোমরা দুজনে দুজনের যোগ্য।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পাঁচশো উনপঞ্চাশতম রজনীতে আবার সে কাহিনী বলতে শুরু করে :
জানারা সলজ্জভাবে মাথা নিচু করে। বিনয় কণ্ঠে বলে, আব্বাজান, আপনার কথা আমার কাছে হাদিশের বাণী। আপনি যখন ভালো বুঝেছেন, নিশ্চয়ই এ শাদী আমার পক্ষে শুভকর হবে। আমার কোনও দ্বিধা নাই। আপনি ব্যবস্থা করুন, আব্বাজান। আমি রাজি।
জানারার সম্মতি শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের সকলে আনন্দ ধ্বনি করে ওঠে। তড়িৎ প্রবাহের মতো পলকে ছড়িয়ে পড়ে এই শুভ সংবাদ।
সন্ধ্যাকালে কাজী এবং সাক্ষী-সাবুদ এলো। শাদীনামা তৈরি করলো তারা। দারুণ জাঁকজমকের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেলো জানারা-বাসিমের শাদী পর্ব।
Bhai, Golpo ta sompurno publish korieyen (Jodi yet na kore thaken)