2 of 4

২.২৯ বখরা

একদিন রাতে খলিফার চোখে আর কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। উজির জাফরকে ডেকে খলিফা তার অনিদ্রার দুঃখ জানাচ্ছিলেন এমন সময় দেহরক্ষী মসরুর উচ্চৈঃস্বরে হোসে উঠলো। তার উচ্চকিত হাসির শব্দে খলিফা বিরক্ত হয়ে ভ্ৰী কুঁচকে মসরুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এতে হাসির কী হলো? তোমার কী মাথার কিছু বিকৃতি ঘটেছে? তা না হলে এইরকম বেয়াদপের মতো হেসে ওঠার মানে কী?

হারুন অল রসিদের এই ধমকে মসরুর লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে।

—আমার গোস্তাকি মাফ করবেন, জাঁহাপনা। আমি আপনার কোনও কথা শুনে হাসি নি। আপনাকে অবজ্ঞা করার স্পর্ধা আমার কী করে হতে পারে? আমি-হাসলাম একটা হাসির কথা মনে পড়ে গেলো বলে।

-কী কথা?

গতকাল টাইগ্ৰীসের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে একদল লোক ইবন অল কবিবী। নামে ভাড়কে ঘিরে তার কিসসা শুনতে শুনতে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলো। আমিও শুনেছিলাম। তার রসের গল্প। সেই কথা মনে হতে হাসি আর চাপতে পারলাম না, জাঁহাপনা। খলিফা বললেন, তাই নাকি! তা হলে তো শুনতে হয় তার রসাল কিসসা। বেশ, তলব করে নিয়ে এসো তাকে। দেখা যাক, তার হাসি মাস্করার গল্প শুনে মেজাজটা হাল্কা হয়। কিনা। তা হলে হয়তো ঘুমও আসতে পারে।

তক্ষুণি মসরুর ছুটে গেলো। সেই ভাঁড় ইবন কবিবীর সন্ধানে। খুঁজে পেতে তাকে ধরে নিয়ে এলো খলিফার প্রাসাদে। খলিফার সামনে হাজির করার আগে মসরুর তাকে কড়ার করতে বললো, দেখ ভাঁড় আমার জন্যেই তুমি আজ খলিফার সামনে দাঁড়াতে পারছে। তা শোনো, তোমার কিসসা শুনে খলিফা খুশি হয়ে যা বকশিস করবেন তার তিনভাগ আমাকে দেবে আর এক ভাগ নেবে তুমি।

লোকটা চোখ কপালে তুললো, তুমিই তিন ভাগ নিয়ে নেবে? আমার একটা কথা রোখ। যা পাবো তার দু ভাগ তোমাকে দেব, আমি নেব এক ভাগ। মসরুর আরও কিছু দর কষাকষি করতে চেয়েছিলো, কিন্তু দেরি হয়ে যাবার আশঙ্কায় সে বললো, ঠিক আছে, চালো। ভাড়টাকে দেখে খলিফা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি নাকি খুব লোক হাসাতে পার? তা আমাকে দু-একটা শোনাও দেখি তোমার চুটকী। কিন্তু একটা কথা, তোমার চুটকী শুনে যদি আমার মজা না লাগে, হাসি না পায় তবে চাবুকের ঘা খেতে হবে, মনে থাকে যেন?

খলিফার সামনে এমনিতেই দাঁড়াতে তার হাত-পা কাঁপিছিলো, এখন এই চাবুকের ভয়ে হাসি তামাশা বেমালুম সব তার মগজ থেকে উবে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও একটা চুটকী সে মনে করতে পারলো না। যতই সে ভাবতে চেষ্টা করে ততই সব গুলিয়ে যেতে থাকে। ঘামে সারা শরীর নেয়ে যায়। হাত-পা সিটিকে ধরে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না-তো তো করতে থাকে।

খলিফা ধমক দেয়, থামো, আর ন্যাকামী করতে হবে না। এই কে আছিস, একশো ঘা চাবুক লাগাও। যদি বা চাবুকের চোটে বাছাধনের মগজ খোলসা হয়।

সঙ্গে সঙ্গে ঘাতক এসে লোকটাকে মাটিতে ফেলে চাবুকের ঘা বসাতে থাকে। ভাড়াটা মুখ বুজে। নীরবে সহ্য করে এই সাজা প্রতিটি চাবুকের ঘা গুণতে থাকে সে। এক-দুই-তিন …এইভাবে তিরিশ ঘা পর্যন্ত সে একটিও শব্দ উচ্চারণ করে না। কিন্তু তার পরেই সে তড়াক করে উঠে বসে, এর পরের চাবুকগুলো মসরুরকে মারার হুকুম দিন জাঁহাপনা।

খলিফা অবাক হন, কেন? মসরুরকে কেন?

ভাঁড় বলে, এখানে আসার আগে মসরুর আমাকে কড়ার করিয়ে নিয়েছে, আপনার কাছ থেকে যা পাবো তার দুভাগ সেই নেবে, আমি পাবো একভাগ মাত্র।

খলিফা গর্জে উঠলেন, কোথায় মসরুর, ধরে নিয়ে এসো তাকে। লোগাও চাবুক। প্রহরীরা বেঁধে নিয়ে এসে হাজির করে মসরুরকে। সপাং সপাং করে চাবুকের ঘা পড়তে থাকে তার পিঠে। কয়েক ঘা মাত্র মারা হয়েছে হঠাৎ খোজা-সর্দার হা হাঁ করে ওঠে, থামো থামো। আর ওকে নয়। বাকীটা আমার পিঠে মারো।

এই সব কাণ্ড দেখে খলিফা হেসে গড়িয়ে পড়েন। হাসতে হাসতে তার দেহ মনের সব গ্লানি সাফ হয়ে যায়। ঝরঝরে তাজা মানুষ হয়ে ওঠেন। তিনি। জাফরকে বলেন, ওদের তিনজনকে হাজার দিনার করে বকশিস দিয়ে দাও।

তখনও রাত বেশ কিছু বাকী। শাহরাজাদ আরও একটা ছোট গল্প বলতে শুরু করে-এক মাদ্রাসার মৌলভীর কিসসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *