2 of 4

৩.০৪ দুই আবদাল্লার উপকথা

দুই আবদাল্লার উপকথা

শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :

কোনও এক সময়ে আবদাল্লা নামে এক জেলে বাস করতো। নটি সন্তানের জনক সে। কিন্তু অত্যন্ত গরীব। দিন আনে দিন খায়—এই রকম দশা। রোজ সকালে সে জাল কাঁধে করে সমুদ্রের পাড়ে যায়। সারাদিন জাল ফেলে। যেদিন বরাতে থাকে মোটামুটি মাছ ওঠে। আর যেদিন নসীব সাধ দেয় না—সেদিন হরিমটর।

লোকটা খানিকটা বেপরোয়া। যেদিন চুনোপুঁটি ধরে, সেদিন সে কোন রকমে পেট ভরানোর মতো রুটি সবজী নিয়ে ঘরে ফেরে। কিন্তু যেদিন রাঘব বোয়াল রুই কাতলা তুলতে পারে সেদিন আর তাকে পায় কে? ভালো ভালো দামী দামী খানাপিনা সাজ-পোশাক কিনে নিয়ে যায়। সব পয়সা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নাই। বিবি হয়তো কখনও বলতে গেছে, ঘরে বাল বাচ্চা আছে একটু রেখে-ঢেকে খরচ কর। মানুষের সবদিন তো সমান যায় না।

আবদাল্লা সে-সব কথায় কর্ণপাতই করে না, কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। তা বলে আজ কষ্ট করে থাকবো কেন? আর তাছাড়া, জীবন দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।

এইভাবে দিন কাটে।

একদিন সকালে আবদাল্লা-বিবি দশম পুত্রের জন্ম দান করলো। আপনারা জেনে রাখুন, আল্লাহর অশেষ করুণায় এর আগের নটিও পুত্রসন্তান।

ঘরে একটা দানাও ছিলো না সেদিন। তবুও আবদাল্লা-গৃহিণী হাস্যমুখে বললো, হাগা, নবজাতকের মুখে তো একটু দুধ-মধু দিতে হবে। যাও; জাল নিয়ে বেরোও! আজ দেখো, তোমাকে দু’হাতে ভরে দেবেন তিনি।

আবদাল্লা বলে, আগের নটার বেলাতেও তো সেই আশাই ছিলো, বিবিজান। কিন্তু সবাই হা-ঘরে বরাত নিয়ে জন্মেছে। যাক, যাই দেখি সমুদ্রের ধারে। যদি কিছু জোটে। জান বিবিজান, আমি সব সময়ই আশাবাদী। তবে আশা আমার পূরণ হয় না এই যা-ফারাক—

আবদাল্লা আর দেরি করে না। জালখানা কাঁধে তুলে হন হন করে হেঁটে চলে। এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ছয়তম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে?

নবজাতকের নাম করে জাল ফেলে আবদাল্লা।

—আল্লাহ তুমি তাকে পাঠিয়েছে। তার জীবন যেন আমার মতো দুঃখের না হয়। তাকে দুধে ভাতে রেখ, এই দোয়া মাঙ্গি।

তারপর ধীরে ধীরে জালখানা টেনে তোলে। কিন্তু হায় রে কপাল, একগাদা মাটি,শামুক আর ঝিনুকের খোলা ছাড়া কিছুই ওঠে না।

আবদাল্লা দুঃখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে।

—হায় খোদা, এই কী তোমার বিচার হলো। যাকে পাঠালে তার আহারের কোনও ব্যবস্থা করলে না? কিন্তু এতো হতে পারে না—কখনই হতে পারে না। তাকে কী অনাহারে রাখার জন্য পাঠিয়েছ তুমি?

জালখানা কাঁধে তুলে সে সমুদ্র-সৈকতের অন্য প্রান্তে চলে যায়। আর একবার জাল ফেলে জলে। এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে জালখানা গুটিয়ে তুলতে থাকে। অবশেষে সে ওপরে তুলে দেখলো, একটা গাধা জল খেয়ে পেট ভঁই করে মরে আছে। আবদাল্লার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। কোন রকমে ছাড়িয়ে গাধাটাকে ফেলে দিয়ে জালখানা গুটিয়ে সে অন্য দিকে ছোটে। সমুদ্রপাড়ের আর এক দিকে। মনে মনে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে। একমাত্র আল্লার করুণা ছাড়া কিছুতেই কিছু হয় না। এতো মন্দভাগ্য তার হলো কী করে? এ নির্ঘাৎ তার অপয়া বিবির দোষে। তা না হলে আজকের মতো এমন খারাপ দিন তার আর কখনও আসেনি। এইভাবে যদি প্রতিবারেই মাছের বদলে আবর্জনা উঠতে থাকে তবে এ কারবার বন্ধ করে অন্য ধান্দা দেখতে হবে তাকে। অনেক দিন ধরে সে তার বিবিকে বলছিলো, মাছ ধরার কাজে কোনও নাফা নাই, অন্য কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু বজ্জাত মাগীটার জন্যেই সে এই বে-ফয়দার কাজটা ছাড়তে পারছে না। তার সেই এক কথা, কাজ কোনওটাই খারাপ নয়। আল্লার ওপর ভরসা রেখে চলো, দেখো একদিন না একদিন তিনি মুখ তুলে চাইবেন। কিন্তু এই কী মুখ তুলে চাওয়ার নমুনা?

হতাশায় ক্ষুব্ধ হয়ে সে অনেকক্ষণ সমুদ্র পাড়ে বসে রইলো। আর জাল ফেলেই বা কী হবে। হয়তো আবার কোনও নিষিদ্ধ জন্তু জানোয়ারের গলিত দেহ উঠে আসবে। বেলা পড়ে আসে। আবদাল্লা আর একবার জাল ফেলে জলে। মনে মনে ভাবে এই শেষ। যদি কিছু না ওঠে আর সে এমুখো হবে না কোনও দিন।

—আল্লাহ তোমার প্রাণে যদি এক বিন্দুও মায়া-মমতা থাকে তবে আমার সদ্যজাত সন্তানের মুখে একটু দুধ মধুর ব্যবস্থা করে দাও। আমি না হয় পাতক, অনেক দোষ করেছি, কিন্তু সে তো নিস্পাপ শিশু। তার কী অপরাধ? সে কেন অভুক্ত থাকবে? তাকে তুমি খেতে দাও—বাঁচাও। আমার বিশ্বাস, সে যখন বড় হবে তোমার নাম গান করবে। আহা শিশুটার কচি মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে এসেছি আমি। সে বড় ভালো ছেলে হবে। সাচ্চা মুসলমান হবে। শুধু তার মুখ চেয়ে অন্তত একটা মাছও আমার জালে দাও, খোদা। সে অন্তত বাঁচুক। আমার রুটিওলার কাছে অনেক ধার জমে গেছে। একটা ছোটখাটো মাছও যেন তাকে দিতে পারি আজ। তার কাছ থেকে রুটি নেব। কিছু নগদ পয়সাও ধার নেব। আহা, আহা, লোকটা বড় ভালো। সেধে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয় আমার সংসারের হাল। মুখ ফুটে বলতে না পারলেও সে সব বুঝতে পারে। রুটি তো দেয়ই, উপরন্তু কিছু নগদ পয়সাও খুঁজে দেয় হাতে। এমন মানুষ আজকের দিনে কটা মেলে!

এই সব বলার পর আস্তে আস্তে জালখানা সে টেনে তুলতে থাকে। এবার যেন আরো বেশি ভারি মনে হয়। মনে শঙ্কা জাগে, আবার হয়তো কোনও বাজে মাল জালে জড়িয়েছে। অবশেষে অনেক কষ্টে টেনে তুলতে পারে সে।

আবদাল্লা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, জালের ভিতরে জড়িয়ে আছে একটা মানুষ। তাঁ মানুষই তো। তার হাত পা, নাক মুখ চোখ সবই মনুষ্যাকৃতির। শুধু তার নিম্নাঙ্গটি মাছের মতো! মনে হয়, একটা লম্বা লেজ।

আবদাল্লার বুঝতে কষ্ট হয় না, সেই আজব বস্তুটি আসলে কোন জিন বা আফ্রিদি। হয়তো বহুকাল তামার জালায় বন্দী হয়ে ছিলো। হয়তো সে মহামতি সুলেমান দাউসের কোনও বিদ্রোহী নফর। অপরাধের সাজা দিয়ে এই দরিয়ায় কয়েদ করে রেখেছিলেন তিনি। তারপর কোনও ক্রমে সে সেই জালার মোহর ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

আতঙ্কিত আবদাল্লা সমুদ্রকূল ধরে ছুটে পালাতে থাকে।

-ওরে বাবা রে গেলাম রে, ও বাবা আফ্রিদি, ও বাবা সুলেমানের নফর, আমাকে মেরো না। দয়া কর।

—অরো এদিকে শোনো, ফিরে তাকাও, ও ধীবর ভায়া শোনো, এদিকে এস, তোমার কোনও ভয় নাই। আমি জিন আফ্রিদি বা বাঘ ভালুক—কিছুই না। তোমারই মতো এক মানুষ।

মৎস্যরূপী মানুষটা আবদাল্লাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু আবদাল্লা তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। মৎস্য-মানুষ আবার বলতে থাকে, আমি যদি সত্যিই কোন জিন অফ্রিদি হতাম, তুমি কী আমাকে এই সামান্য জালে আটকে রাখতে পারতে। এতক্ষণে তোমার ঘাড় মটকে ধরতাম না? কোনও ভয় নাই। কাছে এস। এলে তোমার লাভই হবে-এসো।

আবদাল্লা থমকে দাঁড়াল। ভাবে, তাতে ঠিকই। আসলে যদি সে কোনও দৈত্যদানবই হবে, ঐ তুচ্ছ জালের ঘেরোয় সে আবদ্ধ থাকে? এতক্ষণে এসে তার ঘাড় মটকে দিত না?

পায়ে পায়ে আবার সে ফিরে আসে জালের কাছে।

—সত্যিই তুমি কোনও জিন দৈত্য নও?

কোন রকমে আবদাল্লা এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে। রাত্রির অন্ধকার কেটে যেতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো সাততম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

জালের মানুষ বলে, তোমাকে তো বললাম, না, আমি কোনও দৈত্য-দানব নই। দেখছো না, অমি তোমারই মতো এক মানুষ। তোমারও যেমন হাত আছে মুখ আছে বুক আছে পেট আছে আমারও দ্যাখো সবই আছে, শুধু ফারাক—তোমার দুখানা পা আছে, আর আমার আছে এই ল্যাজ! তুমি ডাঙ্গায় চলো দুটো পা দিয়ে, আর আমি জলে চলি এই ল্যাজ নাড়িয়ে। আমি কোনও অভিশপ্ত প্রাণী নই। আমাকে কেউ জলে ফেলেও দেয়নি। আমরা জলের মানুষ। জলেই আমদের ঘর ও বাড়ি। শুধু আমি নই গো, আমার মতো হাজার হাজার জলপুত্র, জলকন্যা আছে এই দরিয়ার নিচে। তোমরা যেমন হাজার হাজার নরনারী বাস কর গ্রামে গঞ্জে শহরে, তেমনি আমরাও বসবাস করি জলের তলায়। আর তাছাড়া, আমার কথা-বার্তা শুনেও কী তুমি বুঝতে পারছে না, আমিও তোমার মতো রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ?

আবদাল্লা আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে, হা বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে তুমি কোনও জিন অফ্রিদি নও।

-তা হলে আর দেরি কেন, এবার জাল থেকে আমাকে বাইরে বের কর? তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। আজ থেকে তুমি আমার দোস্ত হলে। সেই রকম আমিও হলাম তোমার দোস্ত।

আবদাল্লা জাল থেকে ওকে বাইরে বের করে দেয়। জলপুত্র বেরিয়ে এসে আবদাল্লাকে সেলাম জানায়। খোদা মেহেরবান, তুমিও যেমন ইসলামে বিশ্বাসী আমিও তেমনি সাচ্চা মুসলমান। আজ থেকে আমরা দুজনে দোস্ত হয়ে গেলাম। আমার যতটা সাধ্য আমি তোমার উপকার করবো। আর তোমার যতটা ক্ষমতা তুমি আমার জন্য করবে—কী, রাজি?

আবদাল্লা বলে, বেশ তো। আমাকে কী কী করতে হবে, বলো।

জল পুত্র বলে, তুমি রোজ আমার জন্যে নিয়ে আসবে তোমাদের মাটির ফলমূল—আঙ্গুর, ডুমুর, তরমুজ, ক্ষীরা, শশা, আনার, বেদানা, জলপাই, কলা, খেজুর ইত্যাদি। আর তার বিনিময়ে আমি দেব তোমাকে পানির তলার ফল-ফলারী। যেমন—হীরে মুক্তো, চুনীপান্না, চন্দ্রকান্ত মণি ইত্যাদি গ্রহ-রত্নাদি। তুমি যে-ঝুড়ি করে আমার জন্যে ফলমুল আনবে, সেই ঝুড়ি

ভরেই আমি তোমাকে হীরে মুক্তো দেবো। কী? রাজী তো?

আবদাল্লা শুনে তো থ। বলে কী সে? আনন্দে নেচে ওঠে তার মন। বলে, রাজি মনে? একশোবার রাজি। আমি পা বাড়িয়েই রইলাম।

জলপুত্র বলে, তা হলে এস আমরা আল্লাহর নামে হলফ করি। কেউ আমরা কখনও আমাদের এই শর্তের খেলাপ করবো না।

দু’জনে মিলে উচ্চ কণ্ঠে কোরানশরীফের প্রথম পরিচ্ছেদ আবৃত্তি করে মৌখিক চুক্তির শর্তাবলী স্বীকার করে নেয়। আবদাল্লা জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী?

-আবদাল্লা, তোমার?

-আমারও নাম আবদাল্লা। উল্লাসে ফেটে পড়ে দরিয়া আবদাল্লা, বাঃ চমৎকার। তাহলে আজ থেকে হবে মিট্টি আবদাল্লা, আর আমাকে ডাকবে দরিয়া আবদাল্লা বলে, কেমন?

-তাই হবে।

দরিয়া আবদাল্লা বলে আল্লাহর কুদরতে আমাদের শুধু নামেই মিল নাই, অন্তরের দিক থেকেও আমরা এক। তুমি আমার ভাই, আমি তোমার ভাই। তুমি আমার দোস্ত, আমি তোমার দোস্ত। এস, হাতে হাত মেলাও।

অতি অল্প সময়ে দু’জনের মধ্যে গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। দরিয়া আবদাল্লা বলে, এখানে এক পলক দাঁড়াও, আমি যাবো আর আসবো। তোমার জন্যে এক ঝুড়ি হীরে চুনী পান্না নিয়ে আসি। কাল ঐ ঝুড়ি করেই আমার জন্যে ফলমুল নিয়ে আসবে।

এই বলে দরিয়া আবদাল্লা সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে তলিয়ে গেলো। মিট্রি আবদাল্লা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো পুতুলের মতো।

কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। তারপর আবার সে উঠে এলো জল থেকে। মাথায় একটা ঝুড়ি। মিট্রি আবদাল্লা বিস্ফারিত বিস্ময়ে দেখলো, সত্যিই—ঝুড়িটা হীরে চুনী পান্না মুক্তোয় ভরা। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে তার। দরিয়া আবদাল্লা বলে, নাও ধর, মাথায় তুলে ঘরে যাও। কাল যখন আসবে মনে থাকে যেন, ঝুড়িভর্তি ফল আনবে।

মিট্টি আবদাল্লা বলে, সে আর বলতে

হন হন করে পা চালিয়ে সে বাড়ির পথ ধরে। পথেই রুটিওয়ালার দোকান। মিট্রি আবদাল্লা ভাবে, লোকটার দেনা কোনও দিনই শোধ করতে পারি না। আজ শোধ। করে দেবো।

রুটিওলার দোকানের সামনে এসে আবদাল্লা বলে হ্যাঁ গো, দোকানী, আমার হিসেবটা একটু দেখ তো।

রুটিওলা বলে, অত হিসেব নিকেশের কী? আছে। যা এনেছ, দিয়ে যাও। রুটি যা দরকার, নিয়ে যাও। তুমি কী হাতে কিছু পেলে শোধ করে দেবে না?

-সত্যিই আজ হাতে হয়েছে, শেখ। তোমার কেন, সব দায়-দেনা আমি শোধ, করে দিতে পিরবো। অসময়ে তুমি আমার যা উপকার করেছ, দোস্ত, পয়সা কড়ি দিয়ে সে ঋণ পরিশোধও করা যায় না। সে চেষ্টাও আমি করবো না। তবে আজ যখন আল্লাহ দু’হাত ভরে দিয়েছে—তোমাকে খানিকটা তার ভাগ না দিলে আমি নিজেই শান্তি পাবো না। এই নাও

এই বলে আবদাল্লা এক মুঠি হীরে জহরৎ তুলে দেয় দোকানীর হাতে। মহামূল্য রত্নরাজি দেখে শেখ সাহেবের চোখ কপালে ওঠে।

—ইয়া আল্লাহ একী ব্যাপার? তুমি তো কামাল করেছ, দোস্ত?

দোকানী এক ঝুড়ি পাউরুটি নিজের মাথায় তুলে বলে, চলো চলো, আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার ছেলেটা দেখছি খুব পয়মন্ত। মনে হচ্ছে সুলতান বাদশাহর বরাত নিয়ে জন্মেছে।

আবদাল্লা বিবিকে সব ঘটনা আদ্যোপান্ত খুলে বললো।

—এই নাও হীরে জহরতগুলো সাবধানে তুলে রাখ। আর একটা কথা, কাউকে কিছু বলবে। বুঝলে?

আবদাল্লা-গৃহিণী খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে, পাগল নাকি। এসব কথা বলতে আছে কাউকে? আমি তো কাউকেই বলবো না। তুমি যেন আবার বলে বেড়িও না বাজারে।

আবদাল্লা বলে না না বিবিজান, একমাত্র আমার ঐ রুটিওলা দোস্ত ছাড়া কাউকেই বলিনি। বলবোও না।

পরদিন সকালে আবদাল্লা সমুদ্র উপকূলে যায়। নানারকম সুন্দর সুন্দর মিষ্টি ফলের ঝুড়ি মাথায় করে হাজির হয় সেখানে। বালির ওপর ঝুড়িটা নামিয়ে হাতে তুড়ি বাজিয়ে ডাকে, ও ভাই দরিয়া আবদাল্লা, কই, উঠে এসো, দেখ, কী মজার সব ফল এনেছি তোমার জন্য।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব আসে, এই তো আমি এলাম বলে।

একটু পরেই দরিয়া আবদাল্লা ওপরে উঠে আসে। উভয়ে সালাম-শুভেচ্ছা বিনিময় করার পর মিট্টি আবদাল্লা ফলের ঝুড়িটা দেখিয়ে বলে, তোমার জন্যে এনেছি। দেখ তো, পছন্দ হয় কিনা।

দরিয়া আবদাল্লা উল্লসিত হয়ে ওঠে, ইয়া আল্লাহ, কী তোফা–

এরপর সে তাকে সমুদ্র উপকূলে অপেক্ষা করতে বলে ঝুড়িটা নিয়ে জলের তলায় তলিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ওপরে উঠে আসে। এবার ঝুড়িটাতে ফল নাই, তবে মণি মুক্তোয় ঠাসা ছিলো।

এর পর যথারীতি বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে দু’জনেই দু’জনের ঘরের পথ ধরে। আবদাল্লা আবার রুটিওলা বন্ধুর দোকানে এসে থামে। তার মাথায় সেই জহরতের ঝুড়ি। এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদও গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো নয়তম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

—ও দোকানী ভাই, একবার এদিকে এসো, দেখ কে এসেছে? রুটিওলা ছুটে আসে। বলো, তোমাকে আর কষ্ট করে রুটি বইতে হবে না দোস্ত। আজ আমি বাদাম পেস্তা আকরোট কিসমিস চিনি মধু দিয়ে চল্লিশখানা পিঠে বানিয়ে তোমার বাড়িতে দিয়ে এসেছি। খেয়ে বলবে—কেমন হয়েছিলো।

আবদাল্লা ঝুড়ি থেকে তিনখানা বড় বড় জহরত বের করে বলে, এটা রাখ।

রুটিওলার মুখে কথা সরে না। বোবার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আবদাল্লার মুখের দিকে। আবদাল্লা বলে, অবাক হয়ে দেখছ কী? খুশি হয়ে তোমাকে দিলাম, নাও। আমি আর দেরি করবো না বাজারে যেতে হবে জহুরীর কাছে!

বাজারের সবচেয়ে সেরা জহুরীর দোকানে এসে আবদাল্লা দোকানীকে কয়েকটা হীরে চুনী পান্না দেখায়।

—এগুলোর কী দাম হতে পারে দেখুন তো, জনাব?

বৃদ্ধ জহুরী সন্দিগ্ধ চোখে আবদাল্লার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে দেখে।

-কতগুলো আছে?

আবদাল্লা বলে এগুলো তো নমুনা দেখাবার জন্যে এনেছি। বাড়িতে পুরো দুই ঝুড়ি আছে।

-কোথায় তোমার বাড়ি?

-খোদা মেহেরবান, বাড়িঘর বলতে যা বোঝায় তা আমার নাই, জনাব। ঐ মাছের বাজারের পাশে একটা বস্তির ঘরে বাস করি আমরা।

আবদাল্লার এই কথা শুনে জহুরী তার কর্মচারীদের বলে,-লোকটাকে পাকড়াও কর। চুরির মাল পাওয়া গেছে ওর কাছে। বেগম সাহেবার যে সব জড়োয়া গহনাপত্র চুরি গিয়েছিলো সেইগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে এর কাছে। লোকটা চোর।

জহুরীর লোকজন আবদাল্লাকে পাকড়াও করে আষ্টেপিষ্টে বাঁধে। একজন বলে, এই লোকটাই তো গত মাসে হাসান সাহেবের দোকানে ডাকাতি করে পালিয়েছিলো।

আর একজন বলে, তাই বলি, ইদানিং এতো বাড়িতে চুরি হচ্ছে কী করে?

সকলেই এক একটা রোমাঞ্চকর চুরি ডাকাতির গল্প ফেঁদে বসে। আবদাল্লা একটাও কথা বলে না। চুপচাপ সব শোনে।

দোকানের কর্মচারীরা মারতে মারতে আবদাল্লাকে নিয়ে যায় সুলতানের কাছে। জহুরী নানা রং চড়িয়ে নালিশ করে।

—লোকটা মহাচোর। বেগম সাহেবার গহনাপত্র সব এ-ই চুরি করেছে, জাঁহাপনা। খবর পেয়ে বাজারের অন্যান্য জহুরীরাও ছুটে আসে সুলতানের দরবারে। তাদের মুখেও একই কথা।

এই লোকটাই যত চুরি ডাকাতির নাটের গুরু। বেগম সাহেবার যে হারটা হারিয়ে গিয়েছিলো, এই হীরে জহরতগুলো তা থেকেই খুলে এনেছে ব্যাটা।

জহরতগুলো খোজার হাতে দিয়ে সুলতান বললেন, বেগম সাহেবার কাছে নিয়ে যা। তাকে দেখা তো—এগুলো তার কিনা!

বেগম সাহেবা হীরে জহরতগুলো হাতে নিয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে : বাঃ চমৎকার তো? কোথায় পেলি?

খোজাটা বলে, জাঁহাপনা জানতে চাইছেন, আপনার যে গলার হারটা চুরি গেছে, দেখুন তো জহরতগুলো তার কিনা।

বেগম সাহেবা বলে, না না, সে তো আমি খুঁজে পেয়েছি। আমার বাক্সের তলায় পড়ে গিয়েছিলো। আর তা ছাড়া, এতো দামী জিনিস কোথায় পাবো? এ বস্তু তো তামাম দুনিয়া খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তুই সুলতানকে গিয়ে বলল,আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি যেন আমার মেয়ের জন্য এগুলো কিনে নেন। আমি তাকে একটা সাতনরী হার গড়িয়ে দেব।

খোজা গিয়ে সুলতানকে বললো, জাঁহাপনা, জহরতগুলো খুব পছন্দ হয়েছে বেগম

– সাহেবার। কিন্তু এগুলোর একটাও তার নয়। তার যে হারটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো মনে করেছিলেন, আসলে তা চুরি যায়নি। ঘরেই ছিলো।

খোজার কথা শুনে সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়লেন, জহুরীদের তিরস্কার করে বললেন, তোমাদের কোনও কাণ্ডজ্ঞান নাই। একটা নিরীহ গোবেচারা মানুষ-তাকে চোর ডাকাত বলে ধরে এনেছ আমার কাছে? আল্লাহ তোমাদের এই গোস্তাকি মাফ করবেন কখনও?

জহুরীটা তখনও সুলতানকে বোঝাতে চায়, আপনি ভেবে দেখুন জাঁহাপনা, লোকটা সামান্য একটা জেলে। সে এই

মহামূল্যবান জহরত পেলো কোথায়? তাও আবার একটা দুটো ক নয়, বলে কিনা ওর বাড়িতে আরও দুই ঝুড়ি আছে। একটা হাঘরে লোকের পক্ষে এইসব মহামূল্য সম্পদ সভাবে রোজগার করা কী সম্ভব হুজুর?

সুলতান আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, কেন সম্ভব নয়। আল্লাহ কখন কাকে কী ভাবে দেন কেউ বলতে পারে? সত্যিকার সৎ মানুষই তার কৃপায় একদিনে রাতারাতি অতুল ঐশ্বর্যের মালিক হতে পারে। তোমরা লোভী, ঈর্ষাকাতর শকুনী। তাই অন্যের ঐশ্বর্যে কাতর হয়ে তার সর্বনাশ চিন্তা করছ। কিন্তু আমার সলতানিয়তে ধনী নির্ধন সব প্ৰজাই আমার চোখে সমান। তুমি শাহবানদার বলে ভেব না তোমাকে আমি বিশেষ কোনও সুনজরে দেখবো, আর এই গরীব বেচারা—যেহেতু সে তোমাদের মতো অসৎ গলাকাটা ব্যবসা করে পরস্ব অপহরণ করতে পারে না সেই কারণে তার ওপর নির্দয় হবো।

তোমরা আজ বিত্তবান—তাই সমাজের মাথায় পা রেখে যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। এই অসহায় লোকটাকে আজ মারধোর করতে করতে এখানে নিয়ে এসেছ। কিন্তু কেন? কী তার অপরাধ? সে কিছু বিত্তের মালিক হয়েছে বলে? এতো তোমাদের ঈর্ষা! তোমরা কেউই চাও na, আর কেউ তোমাদের সমকক্ষ হোক। তাই বুঝি আজ একে চোর ডাকাতের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার দরবারে এনে হাজির করেছিলে। ভেবেছিলে, তোমরা শহরের সম্রান্ত কেতাদুরস্ত সওদাগর। তোমাদের কথা আমি অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়ে এই নিরপরাধ লোকটিকে ফাসীকাঠে ঝুলাবো। বাঃ, চমৎকার তোমাদের ফন্দী! কিন্তু একবারও কী ভেবেছিলে শাহবানদার, আমাকে ধোঁকা দিতে পারলেও আখেরে আল্লাহর কাছে ফাঁকিবাজী টিকবে না? শেষ বিচারের দিন সব কড়ায়গায় তিনি বিচার করে দেবেন। তখন? তখন তোমারাই বা পালাবে কোথায়; আর আমিই বা আমার ভুলের, অজ্ঞতার কী জবাবদিহি করতে পারবো?

এই সময় প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো দশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে?

এইবার সুলতান আবদাল্লাকে উদ্দেশ করে বলে, তুমি গরীব বেচারা, আল্লাহ তোমার ওপর সদয় হয়ে কিছু দিয়েছেন, বুঝতে পারছি। আমি তোমাকে ভরসা দিচ্ছি, তোমার কোও ভয় নাই। এবার নির্ভয়ে বলো তো এই মহামূল্য হীরে জহরত তুমি পেলে কেমন করে? এগুলো দেখে আমি বুঝতে পারছি, এ সব জিনিস কোন সুলতান বাদশাহদের কোষাগারেও দুর্লভ।

আবদাল্লা বলে, জাঁহাপনা, এই ধরনের হীরে জহরতের দু’টো ভর্তি ঝুড়ি আছে আমার বাসায়। আমার এক দোস্ত, নাম দরিয়া আবদাল্লা—সে আমাকে দিয়েছে এগুলো।

এরপর আবদাল্লা সমুদ্র উপকূলের সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনালো সুলতানকে এবং বললো, আমি তার সঙ্গে কোরাণশরীফ হলফ করে এক শর্ত করেছি—প্রতিদিন সকালে আমি তাকে এক ঝুড়ি ফল দেব, আর তার বিনিময়ে সে দেবে আমাকে এক ঝুড়ি এই সব হীরে জহরত।

সুলতান শুনে প্রীত হয়ে বললেন, তুমি আল্লাহর নিষ্ঠাবান ভক্ত। তারই পুরস্কার তুমি পাচ্ছ। কিন্তু একটা কথা, ধন সংগ্রহ করা আর সেই ধন রক্ষা করতে পারা এক কথা নয়। তোমার ধনরত্ন রক্ষা করার সব ভার আমি নিলাম।

যতদিন তুমি বাঁচবে আমি তার যথাযোগ্য পাহারার ব্যবস্থা করবো। এমনি কি তোমার মৃত্যুর পরও নিরাপদ থাকবে তোমার সম্পদ। তবে তোমার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীরা কী করবে আমি বলতে পারি না এবং সে নিয়ে আমি কোনও বাধাও দিতে পারবো না তাদের। তবে তুমি যদি চাও আমার কন্যার সঙ্গে তোমার শাদী দিতে পারি। সবে সে বিয়ের বয়সে পা দিয়েছে। এবং আমার কন্যাকে যদি তুমি শাদী কর তবে আমার মৃত্যুর পর তুমিই আমার মসনদে বসবে। সুলতান হবে। এখন তোমাকে আমি আমার উজির করে রাখবো, কথা দিচ্ছি।

আবদাল্লা সম্মতি জানায়। সুলতান তার নফরদের ডেকে বলে, আবদাল্লাকে হামামে নিয়ে যাও।

চাকররা ওকে হামামে নিয়ে গিয়ে ভালো করে সাবান ও খোসা দিয়ে ঘষে মেজে সাফ করে গোসল করায়। তারপর মহা মূল্যবান সাজ-পোশাকে সাজিয়ে সুলতানের সামনে হাজির করে।

সুলতান বলেন, এখন থেকে তুমি আমার উজির হলে। কী কী তোমার দপ্তর থাকবে, আমি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।

আবদাল্লা বলে, আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য।

সুলতান বললেন, আমি তোমার বাড়িতে দামী দামী নফর পেয়াদা পাহারা পাঠিয়েছি। তারা তোমার বিবি সন্তান এবং হীরে জহরতগুলো এখানে নিয়ে আসবে, আমার প্রাসাদেই থাকবে তারা।

সেইদিনই সুলতান তার কন্যার সঙ্গে আবদাল্লার শাদী দিয়ে দেন। উৎসবের সমারোহে প্রাসাদ ও প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে। সারা শহরের পথঘাট বাজার আলোর মালায় ঝলমল করতে থাকে। আজ প্রাসাদের দ্বার সকলের জন্য অবারিত উন্মুক্ত। খানাপিনা নাচ-গান হাসি-হল্লায় মেতে ওঠে, আমির, ইতর সকলে। সুলতানের সেনাবাহিনীও নতুন সাজ-পোশাক পরে উৎসবে যোগ দিতে আসে।

আবদাল্লার জীবনে সেদিন এক পরম লগ্ন এলো। শাহাজাদী তার বেগম হয়ে অঙ্কশায়িনী হলো। এমন সৌভাগ্য কজনে কল্পনা করতে পারে?

প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সেদিনও অতি প্রত্যুষে সুলতান শয্যা ছেড়ে উঠেছেন। জানলার ধারে বসে আল্লাহর নাম গান করছেন। এমন সময় নজরে পড়লো, তার জামাতা উজির আবদাল্লা একটি ফলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সদর পেরিয়ে চলে যাচ্ছে? সুলতান ডাকলেন, কী ব্যাপার জামাই বাবা, এ সব কী, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো এগারোতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

—আমার দোস্ত দরিয়া আবদাল্লার জন্যে ফল নিয়ে যাচ্ছি। সুলতান বলেন, কিন্তু তা বলে এতো ভোরে? এ সময় তো প্রাসাদ থেকে কেউ বাইরে বেরোয় না! আর তাছাড়া, তুমি আমার জামাতা, সামান্য একটা কুলির মতো মাথায় মোট বয়ে নিয়ে যাবে, তাই বা কী করে হয়?

আবদাল্লা বলে, আপনি যথার্থই বলেছেন, জাঁহাপনা। কিন্তু আমার কথাটা একবার ভাবুন। আমার কথার খেলাপ হোক, আমার দোস্তের কাছে আমি মিথ্যেবাদী হই—এটাও তত আপনার কাম্য নয়, জাঁহাপনা। আজ এই যে আমার বিত্ত, এই যে আমার খ্যাতি সম্মান, এই সবেরই তো মূলে সে। তাকে কী করে ভুলবো বলুন?

সুলতান বললেন, ঠিক, ঠিক বলেছ। যাও বাবা, তাড়াতাড়ি যাও তার কাছে। ওয়াদা আগে পূরণ করতে হবে। জীবনে জবানের দাম না দিতে পারলে আর কিছুই থাকে না।

আবদাল্লা ফলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে। কোনও কোনও পথচারী তাকে চিনতে পেরে অন্যজনকে বলে, ঐ দ্যাখ সুলতানের জামাই চলেছে সমুদ্রের উপকুলে।

অনেকেই সে-কথা বিশ্বাস করে না। ভাবে এমন গাঁজাখোরী কথা-বার্তা কেউ শুনেছে কখনও। বাদশাহর জামাই মোট বয়ে বেড়াবে কোন দুঃখে?

কেউ বা ভাবে, নোকটা ফলওলা। তাকে ডাকে, ফলওলা, তোমার আনার কত করে দেবে?

আবদাল্লা রাগ করে না। বরং আরও বিনীত হয়ে বলে, জী, এ ফল বিক্রীর না। আমার দোস্তের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।

এইভাবে সে একসময় সমুদ্র-সৈকতে এসে হাজির হয়। তার ডাকে সাড়া দিয়ে দরিয়া আবদাল্লা উঠে আসে। যথাবিহিত কুশল বিনিময়ের পর ফলের ঝুড়িটা নিয়ে জলের তলায় তলিয়ে যায় সে। ফিরে আসে আবার, নানা বর্ণের অমূল্য রত্নাভরণ ভরে নিয়ে। ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে আবদাল্লা আবার ফিরে আসতে থাকে। পথে সেই রুটিওলার দোকান। সেখানে সে দাঁড়ায়। দোকানটা সেদিন বন্ধ দেখে পাশের দোকানীকে জিজ্ঞেস করে, হাঁ গো, বলতে পারো, এই রুটিওলা দোকান খোলেনি কেন?

কিন্তু কোনও সঠিক উত্তর দিতে পারে না সে। তখন আবদাল্লা জানলা বেয়ে উঠে ওপরের ঘুলঘুলি দিয়ে দোকানের ভিতরটা দেখে নেবার চেষ্টা করে। দোকানী গুটিসুটি মেরে বিছানায় পড়ে আছে। আবদাল্লা ডাকে, দোস্ত-দোস্ত শুনছো?

দোকানী ধড়মড় করে উঠে বসে। সারা চোখে মুখে তার আতঙ্ক।

—সে কী? এখনও তুমি জিন্দা আছে? আমি তো শুনেছিলাম তোমার ফাসী হয়ে গেছে। হাটে বাজারের মানুষ সেইরকম আলোচনা করছিলো।

আবদাল্লা বলে, সব বলছি। আগে দরজাটা খোলো। কোনও ভয় নাই। আমি মরিনি এবং তোমারও কোন ক্ষতি করতে পারবে না কেউ?

রুটিওলা দরজা খুলে দেয়। আবদাল্লা সব বৃত্তান্ত খুলে বলে তাকে। বাজারের জহুরীগুলো তাকে শেষ করারই প্যাচ কষেছিলো। কিন্তু সুলতান ধর্মাত্মা। তিনি সব বুঝে তাদেরই তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমার ওপর সদয় হয়ে সুলতান তার কন্যার সঙ্গে আমার শাদী দিয়ে আমাকে জামাতা তথা উজির করেছেন। এখন আমি প্রাসাদের এক হারেমে মা এবং বেগমকে নিয়ে বসবাস করার অধিকার পেয়েছি।

আবদাল্লা এক নিশ্বাসে বলে গেলো কথাগুলো। একটু থামলো। তারপর আবার বলতে থাকলো, দোস্ত, আমার আশার অতিরিক্ত আমি পেয়ে গেছি। এতো দৌলতে আমার কি বা প্রয়োজন। তাই আজ তোমাকে এই ঝুড়ির সব হীরে জহরতগুলো দিয়ে যেতে এসেছি। তুমি নিয়ে আমাকে ধন্য কর।

রুটিওলা বেচারার মুখে কথা যোগায় না। হতবাক হয়ে সে আবদাল্লার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আবদাল্লা শূন্য ঝুড়ি নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসে। সুলতান হেসে বলেন, আজ দেখছি তোমার দরিয়া দোস্ত তোমার সঙ্গে ধোঁকাবাজী করলো!

আবদাল্লা বলে, না জাঁহাপনা, সেও তার ওয়াদা পূরণ করেছে। বরঞ্চ গতকালের চেয়ে আরও বাহারী মাল সে দিয়েছে।

-তবে তোমার ঝুড়ি খালি কেন?

—আজকের সবটাই আমার এক রুটিওলা দোস্তকে দান করে এলাম। লোকটি বড় ভাল। আমার অসময়ের বন্ধু। যখন অভাবের তাড়নায় খেতে পেতাম না, লোকের কাছে ধার চেয়ে মুখ-ঝামটা খেতাম, সেই সময় আমার এই বন্ধু দিনের পর দিন রুটি এবং নগদ পয়সা ধার দিয়ে আমার বাল-বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলো। সেই অসময়ের উপকার আমি ভুলবো কি করে? শুধু পয়সা-কড়ি বা ধন-দৌলত দিয়ে সে ঋণ শোধ করা যায় না। তাই আজ আমি যৎসামান্য তার হাতে দিয়ে এলাম। সে আমার অসময়ের বন্ধু। আজ আমার সুখের দিনে তাকে ভুলবো কি করে?

সুলতান বললেন, তোমার কথা শুনে খুবই প্রীত হলাম বাবা। তা ঐ রুটিওলার নাম কী।

তার নাম তন্দুরী আবদাল্লা।

সুলতান হাসলেন, বাঃ চমৎকার যোগাযোগ তো! তোমার নাম মিট্টি আবদাল্লা, তোমার এক দোস্তের নাম দরিয়া আবদাল্লা, আর এক দোস্তের নাম তন্দুরী আবদাল্লা এবং আমার নাম তো জানো, সুলতান আবদাল্লা। সকলেই আমরা আল্লার পেয়ারের নোকর। সকলেই আমরা সমান তার চোখে। ধর্মে বিশ্বাসে সততায় আমরা সকলেই এক। তোমার এই তন্দুরী আবদাল্লা বন্ধুর সঙ্গে আমার আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। তোমার মতো তাকেও আমি এক উজির বানাতে চাই।

মিট্টি আবদাল্লা তার বন্ধু রুটিওলা আবদাল্লাকে ডেকে আনে সুলতানের কাছে। সুলতান তার সঙ্গে কথা বলে খুব খুশি হন। বলেন, আজ থেকে তোমাকে আমার বাঁ-পাশের উজির করে নিলাম। আমার জামাতা থাকবে আমার ডান পাশে।

আবদাল্লা আজ সুলতান জামাতা-উজির। অতুল ঐশ্বর্যের মালিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিনের জন্য ভুল হয় না। দরিয়া দোস্ত-এর সঙ্গে দেখা করতে যায় যে প্রতিদিন সকালে, নিজের মাথায় বয়ে নিয়ে যায় নানারকম মরশুমী ফলমুল এবং প্রতিদিনই সে ফিরে আসে ঝুড়ি ভর্তি হীরে জহরত নিয়ে। এইভাবে বরোমাসে একটা দিনও সে বিরতি দেয় না। বছরের একটা সময়ে কোনও তাজা ফল পাওয়া যায় না। তখনও সে শুকনো ফল যা মিলতো তাই বয়ে নিয়ে যেত তার বন্ধুর জন্য। এইভাবে পুরো একটা বছর কেটে গেলো।

একদিন প্রত্যুষে যথারীতি সমুদ্র-সৈকতে বসে দুই বন্ধু আলাপ সালাপ করছিলো। এই সময় প্রভাত সমাগত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে রইলো।

 

পাঁচশো বারোতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

মিট্টি আবদাল্লা জিজ্ঞেস করছিলো, আচ্ছা দোস্ত, তোমাদের দেশটা কেমন? খুব সুন্দর?

দরিয়া আবদাল্লা বলে, তুমি যদি দেখতে চাও আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি, যাবে? যদি যাও দেখবে, আমাদের দেশের মানুষজন ভালো। সবাই তোমাকে কত আদর যত্ন করবে।

মিট্টি আবদাল্লা বলে, কিন্তু দোস্ত, তোমরা পানিতে জন্মেছ, পানির নিচেই মানুষ হয়েছ। সেই কারণে জলের মধ্যে অবাধ গতিতে চলা-ফেরা করতে পারো। কিন্তু তা বলে আমরা তো মাটির মানুষ—আমরা পারবো কেন? যাই হোক, তুমি আমাকে পানির দেশে নিয়ে যেতে পারবে? আমার কোনও অসুবিধে হবে না?

দরিয়া আবদাল্লা বলে, তা হবে। ডাঙ্গায়ও আমার বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। হাঁসফাস করি। গায়ের চামড়ায় হাওয়া লেগে শুকিয়ে যায়। টান ধরে। মনে হয় সারা শরীরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় এই বুঝি হাওয়ার দাপটে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।

মিট্টি আবদাল্লা হেসে বলে, আমাদেরও ঠিক ওই রকম হয়। পানির মধ্যে হাওয়া কম। অথচ আমরা দমভরে অনেক বেশি হাওয়া টানি আর ছাড়ি। ডাঙাতে আমাদের জন্ম। এবং এখানকার আবহাওয়া আমাদের ধাত সওয়া হয়ে গেছে। পানির নিচে একটুক্ষণ থাকলেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। দেহে অনাবশ্যক পানি ঢুকে কাহিল করে তোলে! এবং জোর করে পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের প্রাণসংশয় ঘটতে পারে।

দরিয়া আবদাল্লা বলে, তুমি যদি রাজি থাক আমি তোমার সারা গায়ে এমন একটা মালিশ মাখিয়ে দেব, যার ফলে, আর কোনও অসুবিধাই হবে না। চাই কি, বাকী জীবনটাও যদি পানির তলায় আমাদের সঙ্গে কাটাও, কোনও ক্ষতি হবে না তোমার। যেমন খুশি চলা-ফেরা করতে পারবে। খাওয়া, ঘুমানো, বেড়ানো-যা প্রাণ চায় করতে পারবে।

তা যদি হয়, তা হলে তোমার সঙ্গে পানির তলায় যেতে আমার বাধা কী? ঠিক আছে, নিয়ে এস সেই মালিশ। দেখি একবার চেষ্টা করে।

ফলের ঝুড়িটা তুলে নিয়ে জলপুত্ৰ সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে তলিয়ে যায়। এবং কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই আবার ওপরে উঠে আসে। হাতে একটা পাত্র। তার মধ্যে গাওয়া ঘি-এর মতো খানিকটা তৈলাক্ত পদার্থ! হলদে রং। চমৎকার গন্ধ।

মিট্টি আবদাল্লা একটুখানি আঙ্গুলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী দিয়ে তৈরি জিনিসটা?

দরিয়া আবদাল্লা বলে, এটা দানদান মাছের তেল। দানদান হলো সমুদ্রের সব মাছের সেরা! এক একটা মাছ বিরাট আকারের হয়। মাছের বাদশাহ বলতে পার। হাতির মতো আকৃতি প্রকৃতি।

—সর্বনাশ! এতো বড় মাছটা কী খেয়ে বেঁচে থাকে?

ছোটোখাটো মাছই তার খাদ্য। তুমি তো জান, সবলের ভক্ষ্য দুর্বল। মিট্টি আবদাল্লা বলে, হাঁ, তা জানি। কিন্তু একটা কথা, তুমি যেখানে থাক সেখানে কী অনেক দানদান মাছ ঘোরাফেরা করে? তা হলে দোস্ত আমি তোমার সঙ্গে যাবো না।

দরিয়া আবদাল্লা হেসে বলে, ভয় নাই বন্ধু, ভয় নাই। দানদানরা ভয়ঙ্কর মারাত্মক ঠিক, কিন্তু ওরা মানুষের গন্ধ পেলে ত্রিসীমানায় থাকে না। তার কারণ মানুষের রক্তমাংসে যে জহর আছে তা তাদের পেটে গেলে নির্ঘাৎ মৃত্যু।

মিট্টি আবদাল্লা বলে, আমাকে মুখে পোরার পরে তো বুঝবে আমার রক্ত-মাংসে ওর মরণ বিষ আছে। আমাকে যদি সে গিলেই ফেরে তারপরে সে দানদান বেঁচে থাকলো কী মারা গেলো, আমার কী যায় আসে। আমি তো তার আগেই খতম হয়ে যাবো।

দরিয়া আবদাল্লা অভয় দিয়ে বলে, না না, ওসব ভয় করার কেনও ব্যাপার নাই। দূর থেকে ওরা মানুষের গায়ের গন্ধ পাওয়া মাত্র সেখান থেকে হাওয়া হয়ে যায়। সুতরাং তুমি নির্ভয়ে আমার আমার সঙ্গে যেতে পার।

মিট্টি আবদাল্লা খানিকটা ভরসা পায়। বলে, একমাত্র খোদা আর তোমার ওপর নির্ভর করে আমি তোমাদের দেশে যাবো।

এই বলে সে তার সাজপোশাক খুলে একটা বালির গর্তের মধ্যে পুরে মাটি চাপা দিলো। উদ্দেশ্য কোনও মানুষের নজরে পড়বে না।

জলের তলা থেকে উঠে এসে আবার এই সাজপোশাক পরে সে প্রাসাদে ফিরবে।

—তা হলে চলল, দোস্ত, আমি তৈরি।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো তেরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

দানদান মাছের তেল ওর সারা গায়ে মাখিয়ে দেয় দরিয়া। তারপর মিট্টি আবদাল্লাকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে তলিয়ে যায়। নামতে নামতে ওরা এক সময় একেবারে তলদেশে এসে হাজির হয়। এইবার দরিয়া মিট্টির চোখের পট্টি খুলে দেয়।

—চোখ মেলে দেখ, দোস্ত, আমাদের দেশে পৌঁছে গেছি আমরা।

মিট্টি আবদাল্লা দেখলো, তার শরীরে কোন আঘাত লাগেনি অথবা কোনও জড়তাও অনুভব করছে না সে। ওপরে বিশাল জলরাশির চাপ। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বা ছাড়তে কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছে না তার। বরং বলতে গেলে, নিজেকে অনেক হাল্কা বোধ হচ্ছে।

আমরা যেমন মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালে দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ দেখি তেমনি সমুদ্রের নিচে দাঁড়িয়ে ওপরের বিস্তৃত জলরাশিকে এক সমুদ্র দিক-চক্রবাল বলে মনে হতে থাকে। চারপাশে অসংখ্য লতাপাতা গাছপালার অপূর্ব সমারোহ। অদূরে একটি ছোেট পর্বতমালা চোখে পড়ে। পাহাড়ের কোথাও কোথাও সুন্দর সবুজ উপত্যকার মনোরম শোভা দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। আবদাল্লা দেখলো, একপাশে একটা বিস্তীর্ণ রক্তমুখী প্রবাল বন। তার মাঝে মাঝে সাদা এবং গোলাপী প্রবালও দেখা যাচ্ছিল। প্রবালের গাছগুলোর বহু বিস্তৃত ডালপালা নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দিকে একটা হীরের পাহাড়। পাহাড়ের তলায় একটা গুহা। গুহার মুখ পদ্মরাগমণির একখানা বড় চাই দিয়ে ঢাকা। সেই পাহাড়ের মাথায় হাজার হাজার নানা বর্ণের ঝিনুক। আলোর রশ্মি পড়ে সেই ঝিনুকগুলো ঝলমল করছিলো।

মাথার ওপর দিয়ে আবদাল্লা ওপরে তাকিয়ে দেখে, নানা রঙের মাছ চলা-ফেরা করে বেড়াচ্ছে। তাদের কেউ ফুলের মতো, কেউ ফলের মতো, আবার কেউ বা পাখীর আকারের। আবার অনেকগুলো মাছ দেখতে নানা ধরনের জন্তু-জানোয়ারের মথো। যেমন গরু, মোষ, হরিণ, খরগোস, কুকুর। আবার কেউ বা দেখতে অবিকল মনুষ্যাকৃতির।

আবদাল্লা চলতে চলতে হীরে জহরতের পাহাড়ে উঠে আসে। মণি-মুক্তার দ্যুতিতে চোখ ঝলসে যায় আর কি! কোথাও বা চুনী কোথাও হীরে কোথাও পান্না, আবার কোথাও বা মুক্তোর পাহাড়।

মিট্টি আবদাল্লা তখনও তার দোস্ত দরিয়ার হাত ধরে চলছিলো। চলতে চলতে সে অবাক হয়ে দেখলো, একটা পান্নার পাহাড়কে কেটে ছোট ছোট গুহার মতো ডেরা বানানো হয়েছে।

আর সেই প্রতিটি গুহার মুখে এক একটি পরমাসুন্দরী যোড়শী কন্যা দাঁড়িয়ে আছে।

দরিয়াকে সে জিজ্ঞেস করে, এই মেয়েগুলো কারা? দেখে মনে হচ্ছে, এরা একা। শাদী নিকা এখনও হয় নি।

—তুমি ঠিক ধরেছ। ওরা সবাই কুমারী—সমুদ্র কন্যা। আর ঐ যে পান্না পাহাড়ের গুহাগুলো দেখছো—ওই ওদের থাকবার ঘর। যতদিন না কোনও পুরুষ এসে পছন্দ করে তাদের নিয়ে যায় ততদিন ওখানেই ওরা বাস করবে। সেই রকম একজন পুরুষের প্রতীক্ষাতেই ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকে—যতদিন না তেমন কেউ আসে।

এই শহরের অন্যদিকে আছে জন-বসতি। সেখানে মানুষ স্ত্রী-পুত্র কন্যা নিয়ে ঘর সংসার করে। কিন্তু মেয়েরা যখনই শাদী-যোগ্যা হয় তখনই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই পর্বতগুহায়। এই সময়টা এদের পতি সাধানার কাল। আত্মীয় পরিজন ছেড়ে এসে কায়-মনো-ঝক্যে শুধু মনের মানুষের চিন্তা করে এখানে।

দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে সামনে এগিয়ে চলে। মিট্টি আবদাল্লা দেখতে পায় অনেক লোজন নারী-পুরুষ বালবাচ্চা এবং তাদের ঘরবাড়ি। কিন্তু দোকান পাট বা হাট-বাজার কিছুই নজরে পড়ে না। মিট্টি আবদাল্লা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা দোস্ত, তোমরা সওদাপাতি কর কোথায়? কই, কোনও দোকান পাট তো দেখছি না।

দরিয়া বলে, না নেই। ও সবের দরকার হয় না আমাদের। প্রয়োজনের তুলনায় জিনিসপত্র এখানে অনেক বেশি। তাই বেচা-কেনার কোনও দরকার হয় না। যা যা দরকার হাত বাড়ালেই পায় মাঙনায়। সুতরাং হাট-বাজারে কী হবে? ঐ যে দেখছো, ছোট ছোট অসংখ্যা মাছ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, এগুলোই আমাদের আহার্য। খিদে পেলেই ধরে ধরে খাই। আর মনের আনন্দে গান গাই। অভাব অভিযোগ বলতে কিছু নাই এখানে।

আবদাল্লা বললো, তোমরা, কেউই সাজ-পোশাক পর না? সবাই এরকম উদোম উলঙ্গ হয়ে থাক কেন? শরম লাগে না?

-শরম? সে আবার কী বস্তু? আর সাজ-পোশাক আমাদের কাছে বাহুল্য মনে হয়। আল্লা আমাদের যাকে যে ভাবে গড়েছেন তা কাপড়-চোপড় জড়িয়ে ঢেকে রাখতে যাব কেন? ওসব আমরা পছন্দ করি না। তাই এখানে সাজ-পোশাক বলতে কী বোঝায় তা জানে না কেউ।

আবদাল্লা জানতে চায়, আচ্ছা তোমাদের শাদীর ব্যাপারটা কী তাবে হয়?

—এখানে নানা জাতের মানুষের বাস। খ্রীস্টান, ইহুদী, পারসী, মুসলমান সব জাতের লোকই থাকে এই শহরে। বিধর্মীরা শাদী নিকার ধার ধারে না। কোনও একটা মেয়েকে কোনও একটা ছেলের মনে ধরলেই তারা একসঙ্গে সহবাস করতে থাকে। এই ভাবে কিছুকাল কাটার পর ছেলে বা মেয়ে কারো যদি অনিচ্ছা জন্মে, তবে আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন ছেলেটি খুঁজে বেড়ায় অন্য একটি মেয়ে। সেই রকম মেয়েটিও অন্য এক পুরুষের সন্ধান করতে থাকে। তবে এ সবই বিধর্মীদের ব্যাভিচার। সাচ্চা মুসলমানরা কিন্তু পবিত্র কোরাণের নির্দেশ মতোই শাদী নিকা করে।

দরিয়া আবদাল্লা বলে, আর একটু জোরে চলো দোস্ত, আমাদের নিজেদের মুলুকের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। দেখবে সে কী বাহারী জমকালো শহর। চোখ জুড়িয়ে যাবে। মন ভরে যাবে। আর দেখবেই বা কত! দু’চার দিন বা দু’চার বছর ঘুরে দেখে তো তার কিছুই দেখা সম্ভব না। এক হাজার বছর ধরে যদি দেখ তবে দেশটার দেখার মতো সুন্দর সুন্দর জিনিসের শতাংশের এক অংশ দেখা সম্ভব হতে পারে। এবং তা থেকে এর সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা করাও সম্ভব না।

মিট্টি আবদাল্লা বললে, বড্ড খিদে পেয়েছে দোস্ত। কিন্তু আমি তো তোমাদের মতো ঐ কাচা মাছ খেতে পারবো না।

দরিয়া আবদাল্লা অবাক হয়, সে কি? তবে তোমরা খাও কী করে?

—অলিভ তেলে ভেজে নিই। অথবা লঙ্কা পেয়াজ রসুন ইত্যাদি মসলা দিয়ে ঝোল-ঝাল বানাই। অবশ্য অলিভ তেল ছাড়া বিনের তেলেও রান্না করি আমরা।

দরিয়া আবদাল্লা হো হো করে হেসে ওঠে, তবেই বোঝ, এই সমুদ্রের তলায় আমরা অলিভ বা বিনের তেল পাবো কোথায়? আর এই জলের ভিতর আগুনই বা জ্বালাবো কী করে?

-তা বটে। যাইহোক, চলো, তোমাদের শহরের ভিতরে নিয়ে চলো।

ভোর হয়ে আসছিলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চৌদ্দতম রজনী আবার গল্প শুরু হয় :

দরিয়া আবদাল্লা এবার মিট্টিকে সঙ্গে নিয়ে এক নতুন দেশে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে একটা পাহাড়ের তলায় ছোট বড় অনেক গুহা। এই সব গুহাতে বাস করে এরা। যার যে রকম সংসার সেই ভাবে বেছে নিয়েছে গুহার আকার। কারো সংসার ছোট। সে থাকে ছোট্ট গুহায়। কারো আবার আল্লার দোয়ায় অনেক বালবাচ্চা। সে বেছে নিয়েছে বড় সড় গোছের একটা। দরিয়া এই রকম একটা গুহার সামনে এসে থামে।

-এই হোল আমার আস্তানা। এখানেই আমি থাকি। এস, ভেতরে এসে।

দুই বন্ধু গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ পরে। দরিয়া ডাকে, কই গো, মা জননী, একবার এদিকে দেখবে এস, কে এসেছে।

দরিয়ার বড় কন্যা এগিয়ে আসে। গুলাবী প্রবালের মতো গায়ের রং। এলায়িত সেনালী চুল। সুডোল স্তনভার। সুন্দর পেটখানা। পাতলা ছিপছিপে শরীরের গড়ন। আর বিশাল কাজল কালো ওর চোখ দুটি। কিন্তু হায়, এমন সুঠাম সুন্দর সুতনুকার ভারী নিতম্ব নাই। নাই দু’খানা পা। তার বদলে এক দীর্ঘায়ত লেজ শোভা পাচ্ছে তার নিম্নাঙ্গে।

পরদেশী মেহেমানকে দেখে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ ধরে মিট্টি আবদাল্লাকে আপাদমস্তক গভীর কৌতূহলের সঙ্গে নিরীক্ষণ করতে থাকে। তারপর এক সময় হি-হি করে হেসে ওঠে, আব্বাজান এর লেজ নাই কেন? এ কেমন জীব?

দরিয়া বলে, ইনি আমার দোস্ত, মা। জলের ওপরে মাটির দেশে থাকেন। আমি যে রোজ তোমার জন্য ঝুড়িভর্তি ফল নিয়ে আসি, সে-সব ফলমূল ইনিই আমাকে দেন। খুব সাচ্চা আদমী। অমন ভয় করছ কেন? কাছে এস, এঁর সঙ্গে কথা বলো। ইনি যে আমাদের মাননীয় মেহেমান, মা।

মেয়েটি কাছে আসে। মিষ্টি গলায় বলে, বসুন। আমাদের দেশে এসে আপনার কেমন লাগছে?

আবদাল্লা জবাব দিতে যাচ্ছিল এমন সময় সেখানে এলো দরিয়ার বিবি। কোলে কাঁধে দুটি বাচ্চা। ওদের হাতে দুটো মাছ। কামড়ে কামড়ে খাচ্ছিল। আবদাল্লার মনে হলো, আমাদের দেশের বাচ্চারা ঠিক এই ভাবে শশা পেয়ারা খায়।

মিট্টি আবদাল্লাকে দেখে হাঁ হয়ে যান দরিয়ার বিবি। বাচ্চা দুটোকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

-খোদা হাফেজ, তাজ্জব কাণ্ড! এ যে দেখি ল্যাজ নাই গো। ল্যাজ ছাড়া কী করে চলা ফেরা করেন ইনি? কী কাণ্ড

বৌটা আবদাল্লার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সব চেয়ে রোমাঞ্চকর মনে হয় ওর কাছে আবদাল্লার নিম্নাঙ্গ। এমন সুন্দর জিনিস সত্যিই হয় না আল্লাহর কী অপরূপ সৃষ্টি প্রথমে কেমন ভয় ভয় লাগে, কিন্তু একটু পরে জড়তা কেটে যায়। বৌটা হাতের আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করে আবদাল্লার সারা শরীর, মাঝে মাঝে সে ফিক ফিক করে হেসে ওঠে, সবই সুন্দর, চমৎকার। কিন্তু ল্যাজ নাই—এ কেমন ব্যাপার?

এই পা উরু পাছা জঙ্ঘা ও কটিওলা লেজবিহীন জীবটিকে দেখে দেখে বিস্ময় আর কাটে না তার। মিট্টি আবদাল্লার কিন্তু এই সব আদৌ ভালো লাগে না। একটু রাগত স্বরেই সে অনুযোগ করে, দোস্ত, তোমার বিবি-বাচ্চাদের উপহাস কুড়াতেই কি এসেছি এখানে? আমকে দেখে ওরা অত হাসাহাসি করছে কেন?

-ক্ষমা কর ভাই, সত্যিই আমি লজ্জিত। ওদের ঐ সব পাগলামীতে কান দিও না তুমি। আসলে মেয়ে-মানুষ আর বাচ্চাদের জ্ঞান-বুদ্ধি একটু তরল হয়।

এই বলে ছোট দু’টোকে ধমক দেয় দরিয়া, এ্যাঁই, কী হচ্ছে, চুপ কর।

সঙ্গে সঙ্গে সকলের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ভীত চকিত চোখে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। দরিয়া আবার বলে, ওদের আচরণে আহত হয়ে না ভাই। জন্মাবধি ওরা লেজ ছাড়া কোনও মানুষ চোখে দেখেনি। সুতরাং তোমার এই পা কোমর পাছা ওদের কাছে আজব বস্তু বলেই তা মনে হবে। তোমরা চিড়িয়াখানায় গেলে যে কৌতূহল নিয়ে নানা জাতের বহুবিচিত্র জন্তুজানোয়ার দেখো, তোমাকে দেখেও ওদের চোখে সেই বিস্ময় ফুটে উঠেছে। ওরা অবোধ অবলা শিশু। এতে যে তোমার মনে কোনও আঘাত অভিমান হতে পারে সে দিকটা চিন্তা করার মতো বুদ্ধি ওদের নাই। সেই ভেবেই ওদের ক্ষমা এবং অবজ্ঞা কর।

ওরা যখন এইসব কথাবার্তা বলছিলো সেই সময় ইয়া লম্বা তাগড়াই দশটি সমুদ্রমানব এসে দাঁড়ালো সেখানে।

—শোনো আবদাল্লা, সুলতান শুনেছেন, তুমি এক ল্যাজহীন মাটির মানুষকে এনে ঢুকিয়েছ তোমার ঘরে! কথাটা কী সত্যি?

মিথ্যে হবে কেন? বিলকুল সত্যি। এবং এই দেখ সে লোক। আমার দোস্ত-আমার মেহেমান। আমাদের দেশ দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম। এখুনি আবার সমুদ্রকুলে তুলে দিতে যাচ্ছি।

-না; তা তুমি পারো না। সুলতানের হুকুম, এই পরদেশীকে তার সামনে হাজির করতে হবে। সুলতান পরীক্ষা করে দেখবেন, আসলে এর শরীরের গঠন-প্রকৃতি কেমন। এবং কী বস্তুতে গড়া। সুলতান খবর পেয়েছেন, এর সামনেটা এক রকম এবং পিছনটাও নাকি আর এক রকম? শরীরে নাকি এমন সব কল-কজা বসানো আছে; যা কোনও মানুষের হয় না। তিনি একে দেখার জন্যে দারুণ কৌতূহল নিয়ে বসে আছেন। এক্ষুণি যেতে হবে।

দরিয়া দোস্তের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে দু’হাত জোড় করে বলে, আমাকে ক্ষমা কর ভাই। আমাদের মহামান্য সুলতানের আদেশ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নাই। তিনি যখন তোমাকে দেখতে চেয়েছেন, নিয়ে যেতেই হবে তার সামনে।

মিট্টি আবদাল্লা বলে, আমার কেমন ভয় ভয় করছে, দোস্ত। হাজার হলেও সুলতান তো। খেয়ালী মানুষ, যদি মেজাজ মর্জি ভালো থাকে, কথা নাই। কিন্তু যদি প্রথম দর্শনেই তার খারাপ লাগে তবে আমার গর্দান থাকবে তো?

দরিয়া বলে, তোমার কোন ভয় নাই, ভাই। আমি তো তোমার সঙ্গে থাকবো। যদি কোনও বিপদ ঘটে, আমি বাঁচাবো তোমাকে।

আবদাল্লা বলে, সবই খোদা ভরসা। তিনি যদি রাখেন তবেই বাঁচবো। ঠিক আছে, চলো তার দরবারে।

আবদাল্লাকে দেখা মাত্র উৎসুক আর আনন্দে হেসে গড়িয়ে পড়ে সুলতান। হাসির হুল্লোড়ে সিংহাসনটা জলের তলায় তলিয়ে যায় বার বার।

–ইয়া আল্লাহ, এ যে দেখছি, ল্যাজ হীন মানুষ! কী হে, কী ব্যাপার? তোমার ল্যাজ নাই। কেন? চলাফেরা কর কী করে?

আবদাল্লা বলে, আমি জানি না। পা দিয়েই আমরা চলি। আমাদের দেশের কোন মানুষেরই লেজ নাই। সকলেরই আমার মতো পা আছে।

সুলতান জিজ্ঞেস করে, তোমাদের পিছনের ওই ভারী বস্তুটি কী?

আবদাল্লা বলে, কেউ বলে পাছা, কেউ বলে নিতম্ব।

–কী কাজে দরকার হয়?

-বাঃ, পাছা না থাকলে বসবো কী করে? অবশ্য এই পাছা মেয়েদের অঙ্গ শশাভাও বটে। ভারী নিতম্বগুওলা মেয়েদের কদর বেশি।

—আর তোমাদের ঐ সামনের বস্তুটি কী? কী কাজেই বা লাগে?

আবদাল্লা সলজ্জ কণ্ঠে বলে, এটা পুরুসাঙ্গ-লিঙ্গ। মানুষের জীবনের এ বস্তু একাধিক কাজে দরকার হয়। কিন্তু মহামান্য সুলতানের সামনে সে-সব কথা আমি বলতে সঙ্কোচ বোধ করছি। তবে এইটুকু জেনে রাখুন জাঁহাপনা, মানব-সভ্যতার মূলসূত্র এই লিঙ্গ। এর দ্বারা আমরা বংশ বৃদ্ধি করে টিকে আছি।

আবদাল্লার কথা শুনে সুলতান এবং দরবার-শুদ্ধ সকলে হো হো করে হেসে ওঠে।

আবদাল্লা হতচকিত মূক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদও গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো পনেরোতম রজনী আবার সে বলতে শুরু করে।

সুলতান প্রীত হয়ে মিট্টি আবদাল্লাকে বলে, শোনো ল্যাজহীন, তোমার পাছাটা দেখে আমি বড় খুশি হয়েছি। তোমাকে আমি পুরস্কার দিতে চাই। বলো, কী তোমার বাসনা—কী নিতে চাও?

আবদাল্লা বলে, জাঁহাপনা, দুটি বস্তু আমার কাম্য। প্রথমত, আমি ফিরে যেতে চাই আমার দেশে এবং যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে চাই কিছু জহরত।

দরিয়া আবদাল্লা বলে, জাঁহাপনা, আমার বন্ধুটি এখানে আসার পর থেকে কিছুই আহার করে নি! -আমাদের প্রিয় খাদ্য কঁচা মাছ ওরা খেতে পারে না। সেই কারণে ওকে এখুনি সমুদ্রের ওপরে ফিরিয়ে দিয়ে আসা দরকার।

সুলতান বললো, ঠিক আছে। যতটা চায় হীরে জহরত দিয়ে ওকে ওপরে রেখে এসো।

সুলতানের লোকজন নানা বর্ণের বহুবিচিত্র অমূল্য মণিমাণিক্য এনে হাজির করলো তখুনি।

সুলতান বলে, যত পার, নিয়ে যাও। কিন্তু নেবে কিসে?

দরিয়া আবদাল্লা সেই ফলের ঝুড়িটা নিয়ে এসে এক ঝুড়ি বোঝাই করে নিলো সেই হীরে চুনি পান্না মুক্তো, মণি ইত্যাদি। তারপরে মিট্টিকে সঙ্গে করে সোঁ সোঁ করে অনন্ত জলরাশি ভেদ করে ওপরে উঠে এলো।

সমুদ্রসৈকতে তুলে দিয়ে দরিয়া আবদাল্লা বললো, তা হলে এবার আমি চলি ভাই।

বালির ওপরে বসে রইলো আবদাল্লা। একটানা অনেক পথ সাঁতার কেটে ওঠার পর হাঁফ ধরে গেছে তার। বেশ কিছুক্ষণ পৃথিবীর মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলো। তারপর জহরতের ঝুড়িটা মাথায় তুলে শহরের পথে হেঁটে চললো।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, এবং দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো দেখে সুলতান চিন্তিত হলেন। হয়তো জামাতার কোনও বিপদ ঘটে থাকতে পারে। তন্দুরী উজিরকে বললেন তিনি, এতো দেরি তো তার কোনও দিন হয় না, উজির। আমার লোকজন সঙ্গে নিয়ে তুমি সমুদ্রের ধারটা দেখে এস তো।

—জো হুকুম, জাঁহাপনা।

জনা কয়েক নফর চাকর সঙ্গে নিয়ে তন্দুরী আবদাল্লা সমুদ্রের দিকে যাচ্ছিল। পথের মধ্যে দেখা হয়ে গেলো মিট্টি আবদাল্লার সঙ্গে।

—কী ব্যাপার দোস্ত! আজ এতো দেরি? আমরা তো ভাবনায় মরি।

জহরতের ঝুড়ি একটা নফরের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে মিট্টি বলে, আর বলো কেন, আমার দোস্ত আজ নিয়ে গিয়েছিলো তার ঘরবাড়ি শহর মুলুক দেখাতে।

-সে কী পানির তলায়? গেলে কেমন করে? দম বন্ধ হয়ে গেলো না? আবদাল্লা বলে, না। সব বলবো, চলো আগে প্রাসাদে যাই। প্রাসাদে পৌঁছে সুলতান এবং অন্যান্যদের সামনে তার সমুদ্র তলদেশের সেই বিচিত্র অভিযানের কাহিনী সবিস্তারে শোনালো সে। এখানে তার পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই।

যদিও মুগ্ধ বিস্ময়ে সব শুনলেন সুলতান, কিন্তু বার বার মাথা নেড়ে বললেন, কাজটা তুমি আদৌ ভালো কর নি, বেটা। পানির তলায় মানুষ যায় কখনও? ভবিষ্যতে আর কখনো যাবে না। —এই আমার ইচ্ছা। এরপর থেকে, তুমি আমার জামাতা এবং মান্যবর উজির হয়ে ঝুড়ি মাথায় করে নগণ্য এক কুলিমজুরের মতো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে, তাও আমি চাই না। ধন-দৌলতের প্রয়োজন আছে মানি, কিন্তু সব আগে মান ইজ্জত। এখন আর তোমার ঐ কাজ সাজে না। পাঁচজন পাঁচরকম কথা বলছে তোমাকে নিয়ে। সবই আমার কানে আসে। যাইহোক, ধন-দৌলত অনেক হয়ে গেছে, আর তোমার সমুদ্র-সৈকতে যাওয়ার কোনও দরকার নাই।

সুলতানের আদেশ অমান্য করতে পারলো না আবদাল্লা। সেই তার শেষ। আর কোনও দিন সে সমুদ্র উপকূলে যায় নি তার দোস্ত দরিয়ার সঙ্গে দেখা করতে।

জানি না, দরিয়া এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলো কি না, ভেবেছিলো কি না—মাটির মানুষেরা কী সবাই এইভাবে কসম খাওয়া কথার খেলাপ করে?

শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে সুলতান শাহরিয়ার-এর দিকে তাকায়।

-বাঃ বেড়ে মজার কিসসা শোনালে শাহরাজাদ।

শাহরাজাদ বলে, এবার শুনুন, পীতাম্বর যুবকের কাহিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *