2 of 4

২.২৭ আইনের প্যাঁচে জুবেদা

সেই রাতে শাহরাজাদ আরও একটা গল্প শোনালো সুলতান শাহরিয়ারকে—জুবেদার গল্প :

খলিফা হারুন অল রসিদ একদিন খাড়া দুপুরবেলা বেগম জুবেদার শোবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ইচ্ছা ছিলো, একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু বিছানায় গিয়ে বসতেই তার নজরে এলো, চাঁদরের ঠিক মাঝখানে একটা তাজা ঘোলাটে দাগ। খলিফার মুখ কালো হয়ে গেলো। চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। একি দৃশ্য! রাগে সারা শরীর রিরি করে উঠলোঁ; গর্জে উঠলেন। তিনি, এসব কী, জুবেদা? বিছানায় দাগ কেন?

জুবেদাও অবাক। ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগলো। মাথাটা নামিয়ে বিছানায় ওপর কুঁকে পড়ে আঘ্ৰাণ করে বোঝার চেষ্টা করলো।

—এ তো, মনে হচ্ছে পুরুষের বীর্য, ধর্মাবতার।

কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠেন খলিফা।–কী তাজ্জব ব্যাপার! পুরুষের তাজা বীর্য-এই দিনে দুপুরে তোমার বিছানায় কীভাবে আসতে পারে? আমি তো তোমার ঘরে আজ এক সপ্তাহ পরে এলাম! তোমার সঙ্গে এ শয্যায় আমি অনেকদিন শুইনি। তবে? জুবেদা আহত কণ্ঠে বলে, আপনি কী আমাকে সন্দেহ করছেন, জাঁহাপনা? আপনার অবিশ্বাসের কাজ কী আমি কখনও করেছি? না, করতে পারি? আপনি কী মনে করছেন, আমি পরপুরুষের অঙ্কশায়িণী হয়েছিলাম?

-আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

খলিফা উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকেন, আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। এখুনি কাজীকে তলব পাঠাচ্ছি। কাজী আবু ইউসুফ বিচক্ষণ বিচারক, এ ব্যাপারে তার কী মত, আমার জানা দরকার। আমার পূর্ব পুরুষের মর্যাদা রক্ষার জন্য, শোনও আমার চাচার মেয়ে—আমার বেগম, কাজীসাহেব যদি তার রায়ে বলেন তুমি দোষী, আমি তোমাকে উপযুক্ত সাজা দিতে দ্বিধা করবো না।

কাজী এলো। খলিফা হারুন অল রসিদ তাকে বললো, এই দেখুন কাজীসাহেব, আমাদের বিছানায় এই তাজা দাগটা পরীক্ষা করুন। আপনার কী মনে হয়, আমাকে বলুন।

কাজী বিছানায় উঠে এলো। দাগটার মাঝখানে তর্জনী রাখলো। তারপর আঙ্গুলটা চোখের সামনে তুলে ধরে ভালো করে নিরীক্ষণ করলো। নাকের কাছে ধরে আত্মাণ নিলো। তারপর সাফ জানিয়ে দিলো, ধর্মাবতার, এ মানুষের বীর্য।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো একাশিতম রজনী :

আবার গল্প শুরু হয়। শাহরাজাদ বলতে থাকে।

কাজী আরও বলে এবং সদ্য নিৰ্গত-একেবারে তাজা।

খলিফা ছটফট করে উঠলেন। কিন্তু তা কী করে সম্ভব, কাজীসাহেব? সাতদিন পরে আমি বেগমের ঘরে আজ এসেছি। বিছানায় বসার আগেই আমার নজরে পড়েছে। এ জিনিস।

কাজী মুহূর্তে সব ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। বেগম। জুবেদা তার ওপর খড়গ-হস্ত হবেন সন্দেহ নাই। তাঁর বিরাগভাজন হওয়ার পরিণাম যে শুভ হতে পারে না তা সে তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করতে পারলো। ওপরের দিকে চেয়ে দেখতে থাকলো সে। মনে হতে পারে, সে এই ব্যাপারটা আরও ক্ষতিয়ে তলিয়ে চিন্তা করছে।

হঠাৎ তার নজরে পড়লো, ছাদ ঘেঁসে দেওয়ালের মাথায় একটা ফোকর। আর সেই ফোকরে একটা বাদুর-ডানা মেলে ঝুলছে। আবু ইউসুফের মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

-আমাকে একখানা তরোয়াল দিতে পারেন?

খলিফার দিকে চেয়ে কাজী ইউসুফ বললো। খলিফার নির্দেশে তৎক্ষণাৎ একখানা তারোয়াল এনে দেওয়া হলো তার হাতে। কাজী বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে তরোলায়খানা দিয়ে বাদুড়টাকে মারলো এক কোপ। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বাদুড়টা ছিটকে পড়লো মেজেয়। তারোয়ালের আঘাতে সে ঘায়েল হয়েছে। ওঠবার আর শক্তি নাই। কাজী বললো, এই যে বাদুড়টা দেখছেন জাঁহাপনা, এদের বীর্য আর মানুষের বীর্য দেখতে অবিকল একরকম। কোনও ফারাক বুঝতে পারবেন না। আমাদের হেকিমী শাস্ত্ৰে সেই কথাই সবিস্তারে লেখা আছে। আমার ধারনা বেগম জুবেদা যখন ঘুমিয়েছিলেন তখন এই বাদুড়টা বেগম সাহেবার উপর উপগত হয়েছিলো। এবং তারই অবশ্যম্ভাবী ফল। এই বীর্যপাত। তার এই অপকর্মের জন্য আমি তাকে নিজে হত্যা করে সাজা দিলাম।

এতক্ষণে খলিফা ধাতস্থ হলেন। বুঝতে পারলেন, তার বেগম জুবেদা নিতান্তই নির্দোষী। তার অজ্ঞাতসারে যা ঘটে গেছে তার জন্য তাকে দোষী করা যায় না।

শুধু হারুন অল রসিদ নয়, জুবেদার মুখের কালো মেঘ কেটে গিয়ে খুশির বন্যা ছড়িয়ে পড়লো সারা দেহ মনে। খলিফা নানা মূল্যবান উপহার সামগ্ৰী এবং অনেক নগদ মোহর ইনাম দিলেন তাকে। বেগম জুবেদাও দিলো মূল্যবান রত্নাভরণ। এবং বললো, আসুন কাজীসাহেব, আজ আপনি আমাদের সঙ্গে খানা করবেন।

মেজেয় পাতা পারস্য গালিচার ওপর খলিফা আর বেগমের মাঝখানে বসে পরিতৃপ্তি করে খানাপিনা করলো কাজী আবু ইউসুফ। বেগম। জুবেদা নিজে হাতে বড় বড় পাকা মর্তমান কলা তুলে দিলো কাজীর হাতে, আমার নিজের বাগানের ফল, এ সময়ে এ ফল আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার বাগানে ফলিয়েছি, খান। কলা খেতে আপত্তি নাই তো কাজী সাহেব?

কাজী ইউসুফ বললো, না। আপত্তি কেন? আপনি লক্ষ্য করবেন, বিচারের রায় মনের মধ্যে এইরকম পরিপুষ্ট হয়ে না থাকলে আমি প্রকাশ করি না। এই কলা আপনার অকালের ফল। কিন্তু বেশ পুষ্ট, পাকা।

বেগম জুবেদা তার বাগানের আরও কিছু সুমিষ্ট ফল। এনে রাখলো কাজীর সামনে! এক এক করে কাজী সবই উদীরস্থ করলো। জুবেদা জিজ্ঞেস করে, সবচেয়ে কোনটা ভালো লাগলো—আপনার রায় শুনতে চাই।

কাজী মৌন হয়ে চিন্তা করলো ক্ষণকাল। তারপর বললো, দেখুন বেগম সাহেবা, সবগুলোই আমি বেশ তৃপ্তি করে খেয়েছি। এখন আপনি জানতে চাইছেন, কোন ফলটা সেরা। এ প্রশ্নে জবাব দেওয়া আমার পক্ষে শক্ত। তার কারণ ওরা এখন সবাই আমার উদরে। এককে ছেড়ে অন্যকে বেশি প্রশংসা করলে বাকীরা আমার পেটে বিদ্রোহ করবে। আমার বন্দ হজম হোক এটা নিশ্চয়ই চান না।

জুবেদা এবং হারুন অল রসিদ সশব্দে হো হো করে হেসে ওঠেন। সুলতান শাহরিয়ার, শাহরাজাদের এই কাহিনী থেকে একটা কথাই বুঝলো, স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ তার বেগমকে কিছুক্ষণের জন্যও দোষী সাব্যস্ত করে খুব সঙ্গত কাজ করেন নি।

শাহরাজাদ সুলতানের এই মানসিক প্রতিক্রিয়া আঁচ করতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে আর একটা গল্পের মধ্যে ডুবিয়ে দেবার জন্য নতুন এক কাহিনী ফেঁদে বসলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *