এক বাউণ্ডেলে ছিলো। তার একমাত্র ব্যবসা পরের ঘাড় ভেঙে খাওয়া। পেটে বোমা মারলে তার ‘ক’ বেরুবে না–এইরকম বিদ্যাধর সে। একদিন সে মতলব ভাঁজলো মাদ্রাসার মৌলভী হবে সে। নানারকম বোলচাল দিয়ে এবং কায়দা কৌশল করে হলেও সে একটা মাদ্রাসা খুলে বসলো। ভাবতে অবাক লাগে, সাধারণ ভাষাজ্ঞান বিন্দুমাত্র নাই, অথচ সে মৌলভী হয়ে গেলো। এমন মুরুত্বী চালে সে কথাবার্তা বলতো যাতে মনে হবে তার মতো ভাষাবিদ বুঝি সে তল্লাটে আর দুটি নাই। সাধারণ মানুষ তার বোলচালে ভাবলো, সত্যিই বুঝি বা সে বিদ্যার দিগ্নজ। নিজেদের ছেলেদের পাঠাতে লাগলো তার মাদ্রাসায়। কিন্তু লোকটা লেখাপড়া শেখানোর ধারে কাছ দিয়েও যায় না। রোজ সে বেত হাতে ভারিাক্কী চালে মাদ্রাসায় এসে বসে। ছাত্ররা কিছু জিজ্ঞেস করতে এলে কটমট করে তাকায়। ছেলেরা ভয় পেয়ে সরে যায়।
ছেলেরা নিয়মিত বই বগলে মাদ্রাসায় হাজির হয়। নিজেরাই পড়ে, আবার নিজেরাই বই বগলে করেবাড়ি চলে যায়। এইভাবে দিনে দিনে মৌলভীর মাদ্রাসা বেশ জমে ওঠে। ছাত্র সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলে। টাকাও রোজগার হতে থাকে ঢের।
একদিন মৌলভী রোষকষায়িত চোখে বেত হাতে বসেছিলো তার কুর্শিতে। এমন সময় এক অশিক্ষিত জেনানা একখানা খৎ হাতে সেখানে এসে হাজির হলো। সবিনয়ে মেয়েটি চিঠিখানা মৌলভীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, ট্রী। মেহেরবানী করে খৎখানা যদি একবার পড়ে দেন
মৌলভী তখন দিশাহারা হয়ে পড়ে। এই অগ্নিপরীক্ষা শুক্রান্ত থেকে কীভাবে রেহাই পাওয়া যায়-ভাবতে পারে না সে। কুল-কিনারা না পেয়ে সে ব্যস্ত বাগীশের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা দিয়ে বাইরে বেরুবার চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। চিঠিখানা পড়ানো তার বিশেষ দরকার। তাই সে মৌলভীর পথ রোধ করে কাকুতি মিনুতি করে, দয়া করে আমার চিঠিখানা পড়ে দিয়ে যান মৌলভী সাহেব
মৌলভী বলে, আমার এখন সময় নাই। তাড়া আছে, তুমি অন্য সময় এসো। দুপুরবেলার নামাজের আজান হচ্ছে। আমি আর দেরি করতে পারবো না। আমাকে মসজিদে যেতে হবে।
–আল্লাহ। আপনার ভাল করবেন, মেয়েটি প্রায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায়, আমার স্বামী আজ পাঁচসাল বিদেশে গেছে। এতকাল বাদে এই তার প্রথম খৎ এসেছে। আমি আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারছি না। আপনি আমাকে বাঁচান, একটিবার পড়ে শোনান, সে কেমন আছে, কোথায় আছে, কবে আসবে-কী লিখেছে।
মেয়েটি প্রায় জোর করেই চিঠিখানু গুঁজে দিলো তার হাতে। আর কোনও কাঁটাবার পথ নাই দেখে চিঠিখানা নিতে সে বাধ্য হলো। ভাঁজ খুলে উল্টো করে মেলে ধরলো। তারপর বিড়বিড় করে পড়ার ভান করতে করতে নানারকম বিচিত্র মুখভঙ্গী করতে থাকলো সে। কখনও বা কপাল চাপড়ালো, কখনও বা মাথার টুপী খুলে নামিয়ে রাখলো, আবার কখনও বা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
মৌলভীর এই রকম ভাবভঙ্গী দেখে বেচারী মেয়েটির বুঝতে আর বাকী রইলো না, খবর শুভ নয়। হয়ত বা তার স্বামী আর বেঁচে নাই। ভয়ার্ত কণ্ঠে কোনও রকমে সে প্রশ্ন করতে পারে, কী খবর মৌলভী সাহেব? সে কি তবে বেঁচে নাই? আল্লার দোহাই, আমার মুখের দিকে চেয়ে সত্যি কথা বলুন, কোনও কিছু লুকাবেন না।
মৌলভী তখনও মুখে রা কাড়ে না। শুধু ফ্যাল ফাল করে চেয়ে থাকে মেয়েটির মুখের দিকে।
আকুলভাবে সে প্রশ্ন করে, চুপ করে থাকবেন না মৌলভী সাহেব। বলুন, আমি কী এই সাজপোশাক ছিঁড়ে ফেলবো?
মৌলভী গভীরভাবে শুধু বলে, ফেলো।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আমি কী কপাল চাপড়াবো, বুক চাপড়াবো?
–চাপড়াও।
—আমি কী ডুকরে ডুকরে কাঁদবো?
–কাঁদো।
শোকে প্রায় উন্মাদের মতো মেয়েটি ছুটে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে যায়। কপাল বুক চাপড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। সাজ-পোশাক কুটি কুটি করে, ছিঁড়তে ছিঁড়তে ছুটে চলে বাড়ির পথে। পাড়া-পড়াশীরা ছুটে আসে। কী হলো, কী ব্যাপার।
মুখে বলার অপেক্ষা রাখে না, সবাই পলকে বুঝতে পারে অভাগীর কপাল পুড়েছে। তার স্বামীটার ইন্তেকাল ঘটেছে।
কী আর সান্ত্বনা দেবে তারা। এমন দুঃখের দিনে কিইবা সান্তনা দেওয়া যায়। তবু অনেকে বোঝাবার বৃথা চেষ্টা করে, কেঁদে আর কী হবে বলে। আল্লাহ যাকে টেনে নিয়েছেন তাকে তো, হাজার মাথা কুটলেও ফেরৎ পাবে না বাছা। যাও, ঘরে যাও।
এই সময় গ্রামের একজন শিক্ষিত শেখ, তারই এক আত্মীয়, এগিয়ে এসে বলে, কই দেখি খতে কি লিখেছে।
চিঠিখানা পড়ে থ হয়ে যায় সে। একি! কে বলেছে তোমার স্বামী মারা গেছে। কে পড়ে দিয়েছে তোমার চিঠি? সে সব তো কিছু লেখা নাই। আমি পড়ছি শোনো :
‘চাচার মেয়ে, তোমাকে আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। আমি খুব বহাল তবিয়তেই আছি। এক পক্ষার মধ্যেই দেশে ফিরবো। কতদিন তোমার সঙ্গে মিলন হয়নি। এই লেফাফার মধ্যে আমি একটুকু শনের সুন্দর কাপড় তোমাকে উপহার পাঠালাম। আল্লাহ তোমার সহায় থাকুন।’
এই কথা শোনার পর মেয়েটি চিঠিখানা নিয়ে আবার মাদ্রাসার দিকে ছুটে চলে। মৌলভীকে সে জিজ্ঞেস করবে তাকে এই রকম ধোকা দেবার কারণ কী? সে তার কী সৰ্ব্বনাশ করেছে!
মাদ্রাসার দরজায় ঢুকতেই মৌলভীর দেখা পেলো সে।–একটা গরীব মেয়েছেলেকে এইভাবে ধোঁকা দিয়ে আপনার কী লাভ হলো মৌলভী সাহেব? কেন এমন প্রতারণা করলেন আমার সঙ্গে? আমার স্বামী তো লিখেছে, সে খুব ভাল আছে। এবং দিন পনেরোর মধ্যেই সে দেশে ফিরবে। খামের মধ্যে একখানা ছোট কাপড়ের টুকরো পাঠিয়েছে সে।
মৌলভী বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে, তুমি ঠিকই বলেছ, মা। আমি ঐ সময় ভীষণ চিন্তিত অন্যমনস্ক ছিলাম। কী বলতে কী বলে ফেলেছি আমার কিছু মনে নাই। যাইহোক, শুনে সুখী হলাম, তোমার স্বামী সুস্থ আছেন, এবং শিগগিরই দেশে ফিরছেন।
এরপর শাহরাজাদ মেয়েদের সেমিজের কারুকর্মের কথা বলতে থাকে।