জাইন মাওয়াসিফের মহম্মতের কিসসা
শাহরাজাদ বলে, তা হলে জাইন মাওয়াসিফের মহম্মতের কিত্সা শুনুন।
শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :
অনেক কাল আগের কাহিনী।
এ কাহিনীর নায়ক এক সুঠাম সুন্দর প্রিয়দর্শন যুবক। তার নাম আনিস। উত্তরাধিকার সূত্রে সে ধনবান দয়ালু নম্র স্বভাব শিক্ষিত, মার্জিত রুচি এবং সদ্বংশ জাত। তার মতো সদা-প্রফুল্ল নওজোয়ান সে সময়ে বিরল ছিলো। দুনিয়ার কোনও কিছুর মধ্যেই সে অসুন্দর কিছু খুঁজে পেত না। যা দেখতো, যা শুনতো সবই তার কাছে অপরূপ মনে হতো। সঙ্গীত, কাব্য, সুগন্ধী প্রসাধন, নারীসঙ্গ, ইয়ার দোস্ত, হৈ-হল্লা, আনন্দ সবই তার কাছে খুব ভালো লাগতো। সবুজ ঘাস, কাশবন, জলকল্লোল—সবই তাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করতো।
এইভাবে দিন কাটছিলো।
একদিন সে এক বাগানে একটা ঝাকড়া গাছের তলায় একা একা শুয়ে নিদ্রামগ্ন ছিলো। এমন সময় সে স্বপ্নের মধ্যে প্রত্যক্ষ করলো চারটি সুন্দর রঙিন চিড়িয়া এবং একটি ঘুঘুর সঙ্গে সে খেলায় মেতেছে। ওদের সবাইকে নিয়ে খুব আদর সোহাগ করছে সে। কখনও বা বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। হঠাৎ সে দেখলো, একটা কালো কাক ছোঁ মেরে নেমে এসে তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঘুঘুটার ঘাড়টা খামচা ধরে শোঁ করে শূন্যে তুলে নিয়ে উধাও হয়ে গেলো। ঘটনাটা পলকের মধ্যে এমনই আচমকাভাবে ঘটে গেলো যে, আনিস ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো শুধু। কিছুই করতে পারলো না—করার কিছু সাধ্যও ছিলো না।
দারুণ যন্ত্রণার মধ্যে ঘুম ভাঙ্গে ওর। সেই বাগানের মধ্যে গাছের তলায় বসে অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে থাকলো। কিন্তু স্বপ্নের কোনও যুক্তিবহ অর্থোদ্ধার করতে পারলো না। কিন্তু কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণা তখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, মানে তাকে জানতেই হবে।
গ্রামের পথ ধরে অনেক দূরে চলে গেলো। কিন্তু এমন কাউকেই পেলো না, যে ওকে স্বপ্নের অর্থ বলে দিতে পারে। হতাশ মনে ঘরে ফিরে আসছিলো, এমন সময় সুন্দর একখানি চকমিলান বাড়ির সামনে পৌঁছতে নারী-কণ্ঠের সুমধুর সঙ্গীত ভেসে এলো ওর কানে।
সকালের নির্মেঘ নীল আকাশের গায়ে
পাখীরা ডানা মেলে উড়ে চলে দিক দিগন্তে,
আর গলা ছেড়ে গান গায় ভালোবাসার।
কিন্তু আমি পারি না।
আমি এক বান্দিনী নারী।
কেমন করে সূর্য ওঠে,
কেমন করেই বা পাটে বসে সে,
আর কেমন করে কুঁড়িরা ফুল হয়ে ফুটে,
সে তো আমার আর দেখা হলো না।
গান তো নয় বেদনার ফুল ঝরে ঝরে পড়তে থাকে যেন। গানের করুণ মূৰ্ছনায় আনিসের কোমল হৃদয় বিদারিত হতে থাকে। সে ভাবে, জীবন তো মধুর সুন্দর। সেখানে এত বেদনা এত দুঃখ সন্তাপ কী করে আসে? কেন আসে?
কে এমন দুঃখের গান গায়—দেখার জন্য আনিস বাড়িটার আধ খোলা দরজার চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। ভিতরে যতটা দৃষ্টি যায়, দেখতে পায় প্রাসাদতুল্য বাড়িটার সামনে বিশাল এক ফুলবাগিচা। তার ভেতরে কত না বহু বিচিত্র রঙের সুগন্ধী সব ফুলের গাছ। মালীর নিপূণ হাতে ঝকঝক করে সাজানো গোছানো। কত রকমের পাখী! আর কী তাদের কিচির মিচির কাকলি।
এই অপরূপ মনোহর দৃশ্যাবলী দেখে নয়ন সার্থক করার লোভ সংবরণ করতে পারে না আনিস। পায়ে পায়ে সে বাগানের ভিতরে প্রবেশ করে।
ওধারে একটি আঙ্গিনা। সেখানে এক দঙ্গল মেয়ে হুটোপুটি করে খেলায় মত্ত। বাগিচার মাঝে একটি সরু পথের ওপর তিনটি খিলান গাঁথা তোরণ। তারই আড়াল হওয়ায় মেয়েরা ওকে দেখতে পায় না।
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
ছয়শো পঞ্চান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–
প্রথম তোরণের সামনে এসে দাঁড়াতে আনিস দেখলো, সিঁদূর রঙে লেখা আছে–
আমাদের ঘরের দরজা এতই ছোট,
সে দ্বার দিয়ে দুঃখ এবং কালস্রোত-এর
বিশাল বপু ঐরাবত গলতে পারে না;
কিন্তু মহব্বত এবং আনন্দ
ঝরণার মতো উচ্ছল তরল–
তাদের পথ রুদ্ধ হবে না কখনও।
এর পর দ্বিতীয়তোরণের সামনে আসে সে। তার ওপরে সোনার জলে লেখা আছে–
যতদিন পাখীরা এই প্রস্ফুটিত কুসুমোদ্যানে
ফুলের আঘ্রাণ নিতে আসবে,
যতদিন বন্ধুত্ব সুবাস ছড়াবে প্রতি ঘরে ঘরে,
এবং ফুলেরা দল মেলে ফুটবে,
আর নিজের রূপেই দগ্ধ হয়ে ঝরে পড়বে একদিন;
যতদিন বসন্ত ফিরে ফিরে আসবে,
চারদিকে জেগে উঠবে সবুজ সুন্দর ঘাসের সমারোহ,
যতদিন এই বৃক্ষ তরুলতা গুল্ম জন্মাবে আর মরবে,
ততদিন আমার এই সুখের নীড় খুশির আনন্দে দুলবে হাওয়ায়।
এরপর তৃতীয় তোরণের সামনে এসে দেখলো, খিলানের মাথায় সবুজ রঙে লেখা আছে?
আমার এ গৃহের
নয়নাভিরাম প্রতিটি বিলাস-কক্ষের
মাথার ওপর থেকে সময় ও সূর্য সরে সরে যায় নিয়ত।
কিন্তু ভালোবাসার ছায়া
ইঁদূরের মতো লুকিয়ে থাকে
এর নিরালা নিভৃত কোণে;
সূর্য বা সময় কেউই সন্ধান পায় না তার।
তৃতীয় তোরণ পার হয়ে পথের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায় আনিস। বাগিচার তল থেকে একটা শ্বেত পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে গৃহের অভ্যন্তরে।
পায়ে পায়ে উঠে আসে সে। সামনেই একখানা প্রশস্ত ঘর। মখমলের গালিচায় পাতা একখানা আসনে বসে আছে চৌদ্দ পনের বছরের এক তরুণী। তাকে ঘিরে চারজন সহচরী গা হাত পা টিপে দিচ্ছে। তরুণী সতনুকা, পরমাসুন্দরী। চাদের আলোর মতো ধবধবে ফর্সা তার গায়ের রঙ। ক্ষীণ কটি, তন্বী। কাজল কালো টানা টানা চোখ। শিল্পীর তুলিতে আঁকা তার ভুরু।
আনিস অবনত মস্তকে অভিবাদন জানায়। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, সুপ্রভাত, শাহজাদী।
কিন্তু মেয়েটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, এই নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করার দুঃসাহস তোমার কী করে হলো?
আনিস বলে, এ জন্যে আমার কোনও দোষ নাই, মালকিন। দোষ আপনার নিজের, অথবা আপনার ঐ বাগিচার। দরজাটা আধখোলা ছিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে আমি যুই, চামেলী গুলাব-এর বাহার দেখে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারি নি। ফুল আর পাখীদের সঙ্গে মিতালী করার জন্য প্রাণ আমার আকুলি বিকুলি করে ওঠে।
মেয়েটি খিলখিল করে হাসে, কী তোমার নাম?
—আপনার বান্দা—আনিস।
—বাঃ সুন্দর। তোমার কথায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি, আনিস। এস আমার পাশে বস।
আনিস আসন গ্রহণ করে। মেয়েটি বলে, একটু চিত্ত-বিনোদন করতে চাই। তুমি দাবা জানো?
আনিস ঘাড় নেড়ে জানায়, সে জানে।
তখন মেয়েটি তার সখীদের খেলা ছক-পুঁটি আনতে বলে।
আবলুস কাঠ আর হাতীর দাঁত দিয়ে তৈরি ছক। চারধারটা কারুকার্য করা সোনার পাতে মোড়া খুঁটিগুলো লাল আর সফেদ। লালগুলো পলার আর সাদাগুলো স্ফটিক পাথরের তৈরি।
—লাল না সফেদ—কোষ্টা নেবে তুমি?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে। আনিস বলে, খোদা হাফেজ আমি সাদাই নেব। লাল মানেই রঙচঙে-ওটা আপনাকেই মানায়।
—তা মন্দ বলনি।
মেয়েটি বড়েগুলো বসাতে থাকে ঘরে ঘরে।
খেলা শুরু হয়।
কিন্তু আনিসের খেলার চেয়ে খেলোয়াড়ের মোহিনীর রূপের দিকেই নজর বেশি। মেয়েটির চাঁপার কলির মতো নিটোল মোলায়েম আঙ্গুলগুলোর সঙ্গে ওর আঙ্গুলের ঠোকাঠুকি হয়। সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। আনিস চিৎকার করে ওঠে। এরকম আঙুলের সঙ্গে আমি লড়বো কী করে।
কিন্তু মেয়েটি বলে এবার তোমার বাদশাহকে সামলাও। তুমি গেলে—শিয়রে সংক্রান্তি বুঝে আনিস খেলায় মনসংযোগ করে।
মেয়েটি বলে, নাঃ, এমনি এমনি জমছে না। এস আমরা একশো দিনার বাজি ধরি। তা হলে খেলায় মন বসবে।
—স্বচ্ছন্দে, আনিস বলে, আমার কোনও আপত্তি নাই। ঠিক আছে, রইলো বাজি—একশো দিনার।
আমাদের নায়িকার নাম জাইন মুস্তয়ামিফ। এবারে সে খুঁটি সাজিয়ে এঁটে সেঁটে বসলো। বাজি জিততে হবে। প্রথম কয়েকটি এমন চাল দিলো আনিস, যা সামলাতে জাইন হিমসিম খেয়ে যায়। হঠাৎ সে তার পাতলা রেশমের বোরখাখানা খুলে পাশে রেখে দেয়।
এবার আনিসের সব তালগোল পাকিয়ে যায়। নিজের খুঁটি ছেড়ে সে লাল খুঁটি তুলেই চাল দিতে উদ্যত হয়। জাইন হা হা করে ওঠে, ও কি, ও কি করছো, ও যে আমার খুঁটি আনিস।
মাখনের মতো নরম একখানা হাত দিয়ে আনিসের পুরুষ কঠিন হাতের মণিবদ্ধ চেপে ধরে জাইন। আনিস সরিয়ে নেয় না হাত। খুলতে চায় না ওর কোমল হাতের কঠিন বাঁধন। শুধু গভীর আয়ত চোখ মেলে জাইনের দিকে তাকায়। সে চোখের দৃষ্টিতে কী এক অব্যক্ত ভাষা মুখর হতে চায়। চোখে চোখে দৃষ্টি বিনিময় হতেই জাইন সচকিত হয়ে হাতখানা সরিয়ে নেয়।
—এইভাবে আমার খুঁটি নিয়ে তুমি চাল দেবে নাকি?
আনিস বলে, আমার আর তোমার বলে কী আছে। ঠিক আছে, আর ছেলে খেলা নয়, এ বাজির লড়াই, জান দিয়ে লড়তে হবে, আচ্ছা এই দিলাম আমার চাল, এবার এসো-ও-ও, মানে আসুন।
জলরঙ্গের ধ্বনি তুলে খিল খিল করে হেসে ওঠে জাইন, আপসে যা মুখে আসে তাকেই স্বাগত জানাও আনিস! ওসব আপনি-টাপনি থাক।
বাজির খেলা হলেও আনিস-এর চোখ মন খুঁটিতে বসে না! সর্বক্ষণ সে জাইনের রূপ-সুধা পান করে কাটায়। তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হবার তাই হলো। পরপর পাঁচটা খেলায় শোচনীয় পরাজয়। গুণে গুণে পাঁচশোটি দিনার তুলে দিলো সে জাইনের হাতে! অতি প্রসন্ন মনে।
জাইন মুচকী হেসে বলে, আহা এত টাকা হেরেছ বলে গোসা করছো কেন, আরও হয়ে যাক কয়েক হাত
-না। আমার কাছে আর পয়সা নাই। যা সঙ্গে ছিলো, সব হেরেছি।
—কেন সঙ্গে নগদ না থাকলে বুঝি বাজি লড়া যায় না? আসলে বল তুমি ভয় পাচ্ছ।
আনিস বলে, খোদা কসম, নিশ্চয়ই না। খেলাতে হার-জিত আছেই। ও নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নাই।
—তাহলে উঠছো কোথায়? বোস।
জাইন ওকে হাতে ধরে আবার বসিয়ে দেয়। বলে, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে খেলবে। দাবা ছেলে-খেলার জিনিস নয়। খুঁটি ছেড়ে আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে কী হবে? আমার মুখে তো আর খুঁটির চাল লেখা নাই। খেলার সময় ওসব দিকে মন গেলে তো চলবে না। আর হ্যাঁ, এবার থেকে বাজি অঙ্ক একহাজার করা হলো। কী রাজি?
আনিস বলে, রাজি। বাজিতে আমি ভয় পাই না।
জাইনার বলে, বাড়ানো হলো—এই কারণে যে, মনটা একটু ছকের দিকে বসবে।
কিন্তু আনিস-এর চোখ দাবার ছকে নিবন্ধ থাকে না। সারাক্ষণ সে জাইনের রূপ সায়রে সুধা পান করতে থাকে। ফলে এক এক করে টাকা পয়সা ধনদৌলত যা কিছু সঞ্চিত ছিলো সব হেরে হেরে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু আনিস তবু নিরস্ত হয় না। জমি-জমা দোকান-পাট বাড়িঘর সব স্থাবর সম্পত্তিও হেরে ফতুর হয়ে যায়।
জাইন বলে আর একটা দান খেলবো, এই দানে যে হারবে, তাকে তার অধিকারের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি খোয়াতে হবে।
আনিস বলে, আমার তাতে কিসের ভয়? সবই তো তোমার কাছে হেরে গেছি,এর পরে আর নেবে কী?
জাইন বলে, আমিও তো হারতে পারি? তাহলে তোমার হারা সম্পত্তির সঙ্গে আমার মালিকানার সম্পত্তিও সব তোমার হতে পারবে।
আনিস বলে, কিন্তু আমি যে তোমাকে হারতে দেব না, জাইন।
জাইনের মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে, তুমি একটা আস্ত আহাম্মক। যাও, চলে যাও আর কখনো এস না আমার এই বাগানবাড়িতে। তোমার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ রাখতে চাই না আমি। যা তুমি হেরেছ, আমি সব ফেরত দিয়ে দিলাম তোমাকে। যাও, বিদায় হও।
আনিস কিন্তু ওঠে না। করজোড়ে মিনতি করে বলে, তুমি আমার ওপর এমন নির্দয় হয়োনা, জাইন। আমার ধন দৌলত বিষয় আশয় সব কিছু হেরেছি—তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ নাই। সব আমি হাসিমুখে লিখে দিচ্ছি তোমাকে। কিন্তু দোহাই তোমায় আমাকে চলে যেতে বলো না। তোমাকে না দেখতে পেলে আমি বাঁচবো না। যদি চাও, আমাকে কঠোরতম সাজা দিতে পার! কিন্তু তোমার কাছ থেকে তাড়িয়ে দিয়ো না, শুধু এইটুকু দয়া করো।
জাইন বিরক্ত হয়ে ওঠে, ঠিক আছে, ফেরত যখন নেবে না তখন কাজীকে ডাক! দলিল বানিয়ে দাও আমার নামে।
আনিস কাজী এবং সাক্ষীদের ডেকে এনে তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর বিষয় সম্পত্তি এবং নগদ ধনদৌলত সব জাইনের নামে দানপত্র করে দিলো।
ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
ছয়শো ছাপান্নতম রজনী :
আবার সে বলতে থাকে?
জাইন মুচকি হেসে বলে, তাহলে আনিস তোমার সঙ্গে সব কাজ খতম। এবার পথ দেখ তুমি। এরপর তোমাকে আর চিনি না। চিনবো না।
আনিস করুণ চোখে তাকায়, আমার সব কামনা বাসনা অতৃপ্ত অপূর্ণ রেখেই আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাও, শাহজাদী?
—আমারও ইচ্ছে, তোমাকে নিয়ে সুখ সম্ভোগ করি। কিন্তু খালি হাতে তো মজা লুটা যায় না, আনিস। ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর!
আনিস বলে, বেশ, আজ্ঞা কর, কী দিতে হবে?
জাইন বলে, আমার জন্যে চার বোতল খাঁটি আতর চার হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং চারটি সুসজ্জিত খচ্চর নিয়ে এস আগে। তারপর তোমার সব বাসনা পূর্ণ করবো আমি।
আনিস বলে, ঠিক আছে, তাই হবে।
—কিন্তু পাবে কোথা থেকে। দেবে কী করে? তোমার বলতে তো আর কানাকড়িও নাই। সব সম্পত্তি এখন আমার।
– সে নিয়ে তুমি ভেবো না। আল্লাহ আমাকে জুটিয়ে দেবেন। বিষয়আশয় সবই খুইয়েছি তোমার কাছে, ঠিক। কিন্তু আমার শুভানুধ্যায়ী ইয়ার বন্ধুরা তো আছে। তাদের কাছে ধার করবো।
—ধার করবে? ঠিক আছে, ধার করেই নিয়ে এসো। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে রইলাম।
আনিস পথে নেমে পড়ে। জাইন তার অন্যতম সহচরী হুবুবকে ডেকে বলে, যা তো, সাহেবের পিছনে পিছনে ধাওয়া কর। যেন বুঝতে না পারে। দ্যাখ, কার কার কাছে সে যায়। তারা কে কী বলে শোনো। তারপর সবাই যখন এক এক করে ওকে শূন্য হাতে ফেরাবে তখন তার সামনে দেখা দিয়ে বলবি, আনিস সাহেব, আমার মালকিন এক্ষুনি একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। এনে ঐ অতিথি মেহমানদের বড়ো ঘরটায় বসাবি ওকে। তারপর আমাকে খবর দিবি। এর পর যা বরাতে থাকে, হবে।
হুবুব অভিবাদন জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে অনুসরণ করে চলতে থাকে আনিসকে। জাইন হামামে গিয়ে গোসল সেরে নিলো। জমকালো বাহারী সাজে সাজিয়ে দিলো ওর সহচরীরা। আতর ছিটিয়ে দিলো সারা গায়ে। নানারকম মূল্যবান রত্নাভরণ পরিয়ে দিলো ওর কানে গলায় হাতে পায়ে।
ইতিমধ্যে হুবুব আনিসকে অনুসরণ করতে বুঝতে পারে ওর কোনও বন্ধুই ওকে কিছু দিলো। আনিস ব্যর্থ মনোরথ হয়ে কী করবে ভাবছে, এমন সময় হুবুব ওর সামনে দেখা দিয়ে বলে, আনিস সাহেব, আমাদের মালকিন জাইন মওয়াসিফ আপনার সঙ্গে এখনি একবার মোলাকাত করতে চান। মেহেরবানী করে চলুন।
আনিসকে সঙ্গে নিয়ে হুবুব ফিরে এসে বড় ঘরে প্রবেশ করে দেখে শাহজাদীর সাজে সজ্জিত হয়ে জাইন একটা উঁচু আসনে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। জাইনকে দেখেই চমকে ওঠে আনিস। এ কোনও মানবী না বেহেস্তের ডানা কাটা হুরী। দয়িতের মন ভরেছে, বুঝতে পেরে জাইন অন্তরে রোমাঞ্চ অনুভব করে। ধীর পায়ে উঠে আসে সে আনিসের পাশে। ওর একখানা হাত ধরে। তারপর পাশের একখানা লম্বা অনুচ্চ ‘দিবানে’ নিয়ে গিয়ে বসায়। এবং নিজেও পাশে বসে।
সহচরীরা নানারকম খানাপিনা এনে সাজিয়ে দেয়। দুজনে পরিতৃপ্তি সহকারে আহারাদি শেষ করে। মুখ হাত ধোওয়ার পর ওরা এক পেয়ালায় দুজনে মদ্যপান করতে থাকে। জাইন একসময় বলে, এক টেবিলে বসে যখন একসঙ্গে নুন-রুটি ও খেলাম, তখন আজ থেকে তুমি আমার মেহমান হয়ে গেলে, আনিস। সুতরাং আমি তোমার কণামাত্র বস্তু গ্রহণ করতে পারবো না। তা তোমার পছন্দ হোক আর নাই হোক। তুমি যা লিখে পড়ে দিয়েছ তার সব তোমাকে ফেরত দিয়ে দিলাম।
জাইন-এর বদান্যতায় আনিস অধীর আনন্দে জাইনের পা জড়িয়ে ধরে। জাইন ওকে দু’হাতে তুলে ধরে, ছিঃ ছিঃ একি! তুমি না পুরুষ মানুষ! মেয়েমানুষের পায়ে ধরছো! আমার ব্যবহারে সত্যিই যদি তুমি খুশি হও, আমাকে আমার যোগ্য মর্যাদা দিতে চাও, তবে আমার পায়ে কেন, চলো আমার পালকে, আমাকে নিয়ে লুটিয়ে পড়বে সেখানে। আমি দেখতে চাই সত্যিই তুমি এক সেরা দাবাড়ে। এবার কিন্তু কিস্তিমাত তোমাকেই করতে হবে, আনিস।
ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো আটান্নতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?
আনিস আসতে হাসতে বলে, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব, জাইন, আমার সফেদ বাদশাহ তোমার সব লালবাহিনীকে কী ভাবে ঘায়েল করে ফেলে।
জাইনকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
দরজায় দাঁড়িয়েছিলো হুবুব। সাদর অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে যায় সে দু’জনকে।
এরপর শুরু হয় আবার নতুন দাবা খেলা! আনিসের সফেদ বাদশাহ বীরবিক্রমে লালবাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ছত্রখান করে ফেলে। প্রথম দানে জাইন হারে। কিন্তু সদর্পে বলে, এবার তোমার সফেদ শাহকে আমি কয়েদ করবো আনিস, সাবধান।
কিন্তু আনিসের সফেদ বাদশাহকে ফাঁদে ফেলে, লালবাহিনীর কী সাধ্য। সেবারেও কিস্তিমাত। এইভাবে বার বার পাঁচবার জাইনের লালসেনা বিধ্বস্ত হয় সফেদ শাহর হাতে। লালসেনাদের সারা অঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত, ব্যথা-বেদনায় আর্তনাদ করে ওঠে। না না আনিস, তোমার পায়ে ধরি, আর না। আমি হার মানছি। তোমারই জিত হয়েছে। বাবা তোমার সফেদ বাদশাহর কী তাগদ! প্রাণ যায় যায় আর কী?
দুজনে গভীর আবেশে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। কতক্ষণ কে জানে। এক সময়ে জাইন উঠে বসে। আনিসকে জাগিয়ে তোলে। বলে, তোমার দেহ ক্লান্ত অবসন্ন, জানি। তবু ওঠ, মৌজ মৌতাত করা যাক। গান আবৃত্তি চলুক, তাহলে আবার নতুন করে লড়ার তাগিদ হবে।
শরাবের পেয়ালা পূর্ণ করে নেয় দুজনে। ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে গুলাবী নেশায় মদির হয়ে ওঠে মন প্রাণ। জাইন বলে, আজ যে সুখ দিলে আনিস, জীবনে তা ভুলবো না। এর পর তোমাকে ছাড়া—একটা দিন আমি বাঁচবো না। একটা রাত আমার কাটবে না।
সারাটা রাত ধরে ওরা পরস্পরে অনেক আদর সোহাগ, সহবাস চুম্বন করে কাটালো। পরদিনও তেমনি আহার বিহার বাসন রাগ অনুরাগ সুরত রঙ্গে কেটে গেলো। তারও পরদিন একই আনন্দে কাটলো। এইভাবে পুরো একটা মাস সুখ-সম্ভোগের স্রোতে গা ভাসিয়ে ওরা ভেসে চলতে থাকে।
জাইন বিবাহিতা। ওর স্বামী তখন বিদেশে ছিলো। একদিন স্বামীর কাছ থেকে একখানি পত্র পেলো। বিদেশের বাণিজ্য শেষ করে সে শীঘ্রই ঘরে ফিরে আসছে।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জাইন, আনিস, এখন কী উপায় হবে। তোমাকে ছাড়া তো আমি প্রাণে বাঁচবো না, সোনা। কিন্তু আমার স্বামী একটা নরখাদক বাঘ। সে যদি জানতে পারে, আমি তোমাকে নাগর করে রতিসুখে মেতে আছি, আমাকে তোমাকে এক কোপে দুখণ্ড করে ফেলবে। লোকটা ভীষণ হিংসুটে এবং সাংঘাতিক। দুনিয়াতে সে কোনও নারীকেই বিশ্বাস করে না। তার চোখে সব মেয়েই চরিত্রহীনা—পরপুরুষে আসক্তা। এই অবস্থায় এ বাড়িতে তোমার প্রবেশ অধিকার কী করে বজায় থাকে, সে কথা ভেবে আমি সারা হচ্ছি।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে জাইন মনে মনে মতলব ভাঁজতে থাকে। তারপর এক সময় বলে, আনিস, পথ একটা পেয়েছি।
আনিস জিজ্ঞেস করে, কী?
-তুমি আতর হিং মসলার বণিক হয়ে ফিরি করতে আসবে আমার স্বামীর দোকানে। তারপর সব আমি ব্যবস্থা করবো। কিন্তু খেয়াল রেখ, আমার স্বামী যে ভাবেই তোমাকে জেরা-জুলুম করুক, তুমি কিন্তু দু’রকম কথা বলো না তার কাছে। তা হলে সব গুবলেট হয়ে যাবে।
আনিস বলে, তবে তো এখন থেকেই আমাকে ঐ ব্যবসার তালিম নিতে হয়।
জাইন বলে, বেশক। আজ থেকেই তুমি খোঁজ-খবর নাও। কোন্টার কী নাম, কোন্টার কি দর দাম। কোথাকার মাল। ব্যবসার সব খুঁটিনাটি জেনে এস।
এইভাবে আনিসের সঙ্গে সাট করে জাইন যুক্তি আঁটতে থাকে—কীভাবে তার স্বামীকে ঠকানো যায়।
জাইন-এর স্বামী ঘরে ফিরে এসে বিবির পাংশুবর্ণ চেহারা দেখে শিউরে ওঠে, একি হাল হয়েছে, বিবিজান? তোমার কী অসুখ-বিসুখ করেছিলো? সারা শরীর হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে!
এ-সব জাইন-এর চাতুরী। জাফরান-এর জল গায়ে মাখলে চেহারাটা রুগ্ন পাণ্ডুর মনে হয়। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি বিমারে পড়েছিলাম। ভয়ে মরি, কবে তুমি দেশে ফিরবে। সেদিন তোমার খৎখানা পেয়ে তবু ধড়ে প্রাণ এসেছে। আমাকে যে এমন ফ্যাকাশে দেখছো, সে কিন্তু আমার অসুখের জন্য না। তোমার অদর্শনই আমাকে এমন পাণ্ডুর করে ফেলেছে। শুধু ভেবে মরেছি, বিদেশ বিভূঁই—একা মানুষ, না জানি কখন কী বিপদ-আপদ ঘটে। কিছু একটা হলে খবরও যে পাবো, তারও কোনও উপায় নাই। তাই বলছি, ওগো, এর পর যখন বিদেশে যাবে, আর কখনও একা একা যেও না বাপু, আমার বড্ড ভয় করে। সঙ্গে কেউ থাকলে সময়ে অসময়ে সে তো একটা খবর-টবরও দিতে পারে।
সওদাগর স্বামী বিবির এই দরদ দেখে খুবই প্রসন্ন হয়। তুমি ঠিকই বলেছ, বিবিজান। এর পর থেকে তোমার কথা ছাড়া আর এক পাও চলবে না। যাক, আমি তো ভালোয় ভালোয় বহাল তবিয়তে ফিরে এসেছি। আর তো তোমার দুর্ভাবনার কোনও কারণ নাই। এবার তুমি হাসি গানে মেতে ওঠ। শরীরটাকে সুস্থ করে তোলে।
এই বলে সে জাইনকে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে দোকানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। এই সওদাগর জাতে ইহুদী, এবং তার বিবিজানও এক ইহুদী কন্যা। হিং-আতরের নয়া সওদাগর আনিস ইহুদী সওদাগরের দোকানের সামনেই ঘুর ঘুর করছিলো।জাইন-স্বামী দোকানে আসতেই তার সঙ্গে সে আলাপ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা তোলে আনিস। ইহুদী দর-দাম জিজ্ঞেস করে। বাজার থেকে সস্তা দরেই সে মাল দিতে রাজি দেখে এক কথাতেই সওদা করে নেয় সে। এবং আনিসের সহৃদয় ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ওর নিয়মিত খরিদ্দার হয়ে যায়। এর কয়েকদিন পরে ইহুদী আনিসকে প্রস্তাব দেয়, তুমি আমার ব্যবসার অংশীদার হয়ে যাও। তাঁতে তোমারও সুবিধে হবে আমারও ব্যবসা বাড়বে।
আনিস বলে; আমি রাজি। কী টাকা দিতে হবে আমাকে?
ইহুদী বলে, বেশি না, হাজার দশেক নিয়ে এস, তাহলেই হবে।
আনিসের পক্ষে এ এমন কিছু নয়। পরদিনই সে টাকা নিয়ে হাজির হয়। দু’জন নামজাদা সওদাগরকে সাক্ষী রেখে চুক্তির দলিল তৈরি করে দেন ইহুদী।
সেদিন রাতে সে আনিসকে সঙ্গে নিয়ে আসে তার নিজের বাসায়।
-আজ থেকে তুমি আমার ব্যবসার নতুন অংশীদার হলে, আনিস। চলো আজ রাতে আমার বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন। একসঙ্গে বসে খানাপিনা করবো আমরা।
আনিস এইটাই চাইছিলো। সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করে দুজনে ইহুদীর বাড়িতে এসে পৌঁছয়। আনিসকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ইহুদীটা অন্দরে চলে যায়। জাইনকে বলে, একটা সুন্দর ছেলেকে আজ থেকে আমার ব্যবসার অংশীদার করে নিলাম জাইন। কারণ বয়স হয়েছে, এখন আর একা একা খাটতে পারি না অত।
জাইন বলে, খুব ভালো করেছ। তা লোকটা কেমন?
-আমার তো খুব ভালো লেগেছে। খুব শান্তশিষ্ট নম্র বড়ো বংশের ছেলে, মালকড়িও অনেক আছে। তুমি আলাপ করলেই বুঝতে পারবে। আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আজ রাতে ও আমাদের সঙ্গে খানাপিনা করবে। সেই সুযোগে তোমার সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হয়ে যাবে।
জাইন চোখ কপালে তুলে বলে, এ তোমার কী রকম কথা, আমি তোমার ঘরের বিবি, আমাকে পরপুরুষের সামনে বেরুতে হবে?
-আহা, বুঝছো না কেন, এখন থেকে সে আর বাইরের লোক থাকছে না। সে আমার ব্যবসার সমান অংশীদার। তুমি আমার জীবনের অংশীদার, আর ও আমার ব্যবসার। তা হলে সে বাইরের মানুষ থাকে কী করে? আর তা ছাড়া বিরাট বড়লোক, অনেক পয়সার মালিক, ওকে হাতে রাখতে পারলে আখেরে ভালো হবে।
জাইন কপট রাগত স্বরে বলে, তা যাই বল বাপু, পরপুরুষের সামনে আমি ঘরের বিবি বেরুবো-এ আমার ভালো ঠেকছে না।
ইহুদীটা বলে, তুমি দেখছি, সাচ্চা মুসলমানের মেয়ের মতো কথা বলছে। ওরা ঘরের মেয়েদের বাক্সে পুরে রাখে। ভাবে, বাইরে বেরুতে দিলেই বিবিজান হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা তো আর মুসলমান নই। পয়গম্বর মুসা তো কোথাও বলেনি, ইহুদী মেয়েরা পর্দানশিন হয়ে ঘরে খাঁচার পাখীর মতো বন্দী হয়ে থাকবে? মানুষের সঙ্গে সহজ সরল ভাবে মিশবে, আলাপ করবে। দোস্তী বন্ধুত্ব করবে, এইতো স্বাভাবিক।
জাইন বলে, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছো, ওর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলে আমাদের সুবিধে হবে, আমি করবো।
সেদিন রাতে নানা উপচারে আহার পর্ব সমাধা হলো। মাথা গুঁজে আনিস খানাপিনা সারলো। ইহুদী বলে, তুমি তো আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গেলে আনিস, অত শরম করছো কেন? জাইন আমার বিবি—সেও আমার অংশীদার। সুতরাং ওর সঙ্গে একটু প্রাণ খুলে কথাটথা বলো, আলাপ পরিচয় কর!
আনিস কিন্তু বহুত সেয়ানা। আড়চোখেও একবার তাকিয়ে দেখে না জাইনকে। একেবারে লাজুক নিরীহ গোবেচারা মানুষ—যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। ইহুদী যদিও মুখে বলেছিলো, জাইনের সঙ্গে আলাপ-সালাপ কর, তবুও মনে মনে আনিসের এই সলজ্জ-বিনম্র মুখ স্বভাবতই তাকে মুগ্ধ করেছিলো।
পরদিন রাতেও ইহুদী আনিসকে সঙ্গে নিয়ে আসে। আবার তিন জনে একত্রে বসে আহারাদি করে। জাইনের স্বামী ভাবে, এইভাবে নিত্য একসঙ্গে ওঠা বসা এবং খানা পিনা করতে করতে আনিসের লাজুক ভাব এবং জড়তা একদিন কেটে যাবে। তখন সে তাদের এক অন্তরঙ্গ শুভানুধ্যায়ী হয়ে উঠবে।
ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
ছয়শো ষাটতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।
ইহুদীর কথাই ঠিক, কয়েকদিনের মধ্যেই আনিস ওদের পরিবারের এক পোষমানা পাখী হয়ে ওঠে। সওদাগর ভাবে, ছেলেটার স্বভাব চরিত্র সাচ্চা—নিরাপদ। জাইন-এর কাছে ছেড়ে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত মমে বাইরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ইহুদীটা বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে পা রাখা মাত্র পাখী তার নিজের মূর্তি ধরে। জাইনকে আদর সোহাগ করে। হাসি তামাশা, নাচ গানে মেতে ওঠে।
এরপর একদিন ইহুদীটা ঘরে ফিরে এসে জাইন আর আনিসের মাখামাখি দেখে বিস্মিত এবং সন্দিগ্ধ হয়। এই কয়দিনের মধ্যে আনিস একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। কথায় কথায় সে জাইনকে নিয়ে হাসি মস্করা করে। জাইনও কারণে অকারণে আনিসের সঙ্গে কলকল করে কথা বলে। একেবারে বেহায়া বেশরম বাজারের মেয়েমানুষের মতো।
আনিসের স্বভাবের যে সলজ্জ-ভাব সে প্রত্যক্ষ করে গিয়েছিলো তার বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট নাই। তার অনুজপ্রতিম শ্রদ্ধা সমীহ সব কোথায় উবে গেছে। বরং এখন তার আচার আচরণে একটা অস্বাভাবিক ঔদ্ধত্য এবং বেপরোয়া তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই প্রকট হয়ে উঠেছে। এত তাড়াতাড়ি এত পরিবর্তন কী করে সম্ভব? সওদাগর সন্দেহাকুল হয়ে ভাবে, নিশ্চয়ই এর পিছনে জাইন-এর কোনও ছলনা কাজ করছে।
রোজই সে তাকে-তাকে থাকে। হাতেনাতে ধরবে—এই তার বাসনা। কিন্তু সুযোগ আর মেলে না। অবশেষে একদিন সে ফাঁদ পাতলো।
সেদিন খুব সকাল সকাল আনিসকে সঙ্গে নিয়ে সে বাড়ি ফিরে এলো। আগে থেকেই জাইনকে বলে রেখেছিলো, কোতয়ালকে নিমন্ত্রণ করেছে, আজ রাতে সে ওদের সঙ্গে খানাপিনা করবে।
ইহুদী বাড়ি ফিরে দেখে, জাইন নানাবিধ ব্যঞ্জন বানিয়ে রেখেছে।
—বাঃ, খাসা সব খানা পাকিয়েছ তো, বিবিজান।
—বানাবো না? আজ ঘরে কোতোয়াল সাহেব আসবে বলেছে, তার আদর আপ্যায়নের ত্রুটি হলে চলবে কেন?
ইহুদী বলে তা ঠিক। আচ্ছা, তোমরা বসে গল্প কর, আমি কোতয়াল সাহেবকে সঙ্গে করে ডেকে নিয়ে আসি।
জাইন বলে, কখন ফিরবে বলো, সেইভাবে টেবিলে কাপড় পাতা হবে। খানাপিনা সাজানো হবে।
—তা ধর ঘণ্টাখানেক দেরি হতে পারে। ইহুদী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে নয়। ফুল-বাগিচার ওপাশ দিয়ে ছাতের ওপরে ওঠার একটা সিড়ি, সেই সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ঘরে যায় সে। সেখান থেকে জাইনাবের শোবার ঘর পালঙ্ক শয্যা পরিষ্কার নজর করা যায়।
চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
একটুক্ষণের মধ্যে খেলা শুরু হয়ে যায়। জাইন জড়িয়ে ধরে আনিসকে। টানতে টানতে নিয়ে যায় পালঙ্ক-শয্যায়। বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়ে আনিসের দেহের ওপর। তারপর চুষে কামড়ে ছিড়ে এক-সা করে দিতে থাকে আনিসকে। আনিসও কম বাহাদুর নয়। ইহুদী ভাবে—জোয়ান লেড়কীকে তাবে রাখতে গেলে তার এই ভাটা পড়া যৌবনে সম্ভব না। আনিসের মতো উদ্দাম পৌরুষ থাকা দরকার।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে বুকে। মাথায় খুন চেপে যায়। কিন্তু নাঃ, এখনই নয়। ইহুদী ভাবে, ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। যথাসময়ে এর ব্যবস্থা করা যাবে।
সওদাগরের ফেরার সময় হয়ে এসেছে দেখে জাইন নিজের বেশবাস সংবৃত করে পালঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আনিসকে বলে, ভালো করে ইজার পাতলুন পরে নাও, মুখপোড়াটা এখুনি আবার এসে পড়বে।
ইহুদী হাসতে হাসতে ঘরে ঢোকে, না জাইনার নসীব খারাপ। কোতোয়াল সাহেব একটা খুনের তদন্ত করতে শহরের বাইরে গেছেন। ফিরতে অনেক দেরি হবে। আজ আর আশা নাই। সুতরাং এস, আমরাই ভালো মন্দ যা বানিয়েছ উদরস্থ করি।
খানাপিনা শেষ হলে আনিস যথারীতি বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ি চলে যায়। ইহুদী জাইনকে সঙ্গে নিয়ে পালঙ্কে এসে শুয়ে পড়ে। জাইন এগিয়ে এসে স্বামীকে আদরের ভান দেখায়।
-তোমাকে আজ এত মনমরা দেখছি, কেন গো? আমি তখন থেকে লক্ষ্য করছি, তুমি কী যেন ভাবছো, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। কেন, কিছু হয়েছে নাকি?
কোমর থেকে একখানা চিঠি বের করে ইহুদী। বলে, আমার এক দালাল লিখেছে অনেকদূর দেশ থেকে। আর একদিনও দেরী করা সম্ভব না। এখনি রওনা হতে হবে। না হলে ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
খুশিতে নেচে ওঠে জাইন-এর মন, কিন্তু মুখে তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ করে না, বরং দুঃখে কাতর হয়ে বলে, কিন্তু তোমার এই শরীর স্বাস্থ্য, অত দূর দেশে যাবে তুমি, আমি তো ভাবতেই পারছি না গো, কী করে থাকবো। আচ্ছা, কতদিন লাগবে? কবে ফিরবে?
—তা ধর, তিন থেকে চার বছর। তিন বছরের আগে ফেরা সম্ভব হবে না। তবে চার বছরের বেশিও থাকবো না।
জাইন কত সহজে চোখে জল আনতে পারে। টসটস করে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ওর গাল বেয়ে।
—অতদিন আমি একা একা থাকবো কি করে? না না, সে আমি পারবো না, গো।
ইহুদী শান্ত কণ্ঠে বলে, আমি সেই কথাই ভেবেছি জাইন। তোমাকে এখানে ফেলে রেখে যাওয়া উচিত হবে না। অল্প দিনের ব্যাপার নয়। তা ছাড়া আমার শরীর স্বাস্থ্যও তেমন সুবিধের নয়। কখন কী অসুখ-বিসুখ করে বলা তো যায় না। সে অবস্থায় তুমি কাছে না থাকলে আমারও ভালো লাগবে না। আমি ঠিক করেছি, তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবো।
—এ্যাঁ।
প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে জাইন। নিজের অন্তরের অভিব্যক্তি আচমকা আসেমুখ দিয়ে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে ঘুরিয়ে নেয়।
-এ্যাঁ! কী মজা হবে বলো তো? এতদিনে আমার মনের সাধ মিটবে। তোমার কাছে থাকবো, কত নতুন নতুন দেশ দেখবো–এ আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। তা কবে রওনা হবে, গো?
ইহুদী বলে, না আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে। আজ খুব ভোরে উঠে তুমি সব বাঁধা-ছাঁদা করে নেবে। দশটা উটের ব্যবস্থা করে এসেছি। উট নিয়ে সহিসরা খুব সকালেই হাজির হয়ে যাবে। আমার মনে হয় আমাদের দামী দামী সব সামানপত্রই ধরে যাবে দশটা উটে, কী বলো?
জাইন-এর তখন মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। স্বামীর কথার কী জবাব দেবে?
ইহুদী বলে, কি গো, কী ভাবছো?
জাইন ধাতস্থ হয়ে নিতে পারে। বলে, না, মানে—মানে কী মজা হবে বলতো? কত নতুন নতুন দেশ দেখবো
ইহুদী ছোট্ট করে জবাব দেয়, তা বটে।
সূর্য ওঠার আগেই মালপত্র সব বোঝাই হয়ে যায় উটের পিঠে। সহিস তাড়া লাগায়, তাড়াতাড়ি করুন মালিক, বেলা বেড়ে গেলে খরায় চলতে বড় কষ্ট পেতে হবে যে।
একটা বড় উটের পিঠে ডুলি বসানো হয়। সামনে ইহুদী, মাঝখানে জাইন ও পিছনে তার চার সহচরী হাবুব, খুতুব, সুকুর এবং রুকুর বসে।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো বাষট্টিতম রজনী :
আবার গল্প শুরু হয় : চলে যাওয়ার আগে সকলের অলক্ষ্যে সদর দরজার মাথায় লিখে রেখে যায় জাইন :
তুমি আজ কত দূরে, সখা,
তবু তোমার বুকের ধকধকে তুফানের উত্তাপ
আমি অনুভব করতে পারি আমার কলিজায়।
আল্লাহ কসম, কেউ আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না,
যায় যদি বিশ্ব রেণু রেণু হয়ে যায়,
তবু তুমি আর আমি
একসাথে র’বো দুইজনে।
পরদিন সকালে আনিস দোকানে আসে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ইহুদীকে আসতে দেখে চিন্তিত হয়। কি জানি কোনও অসুখ বিসুখ করলো নাকি, সন্ধ্যা হতে না হতে তাড়াতাড়ি সে জাইনের বাড়িতে চলে আসে। সদর দরজায় ঢুকতে গিয়েই হোঁচোট খায়। দরজার ওপরে জাইনের সেই কবিতাটা পড়ে বুঝতে আর অসুবিধা হয় না, তার চোখের মণি বুকের কলিজা আর এ বাড়িতে নেই।
তাড়াতাড়ি সে অন্দরে প্রবেশ করে। সব ঘর শূন্য হাহাকার করছে। কেউ কোথাও নাই। পাড়া-পড়শীদের কাছে ছুটে যায় আনিস। তাদের কাছ থেকে জানতে পারে, সওদাগর তার বিবিকে নিয়ে বহু দূরদেশে রওনা হয়ে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে ফেরার কোনও সম্ভাবনা নাই।
শোকে মুহ্যমান আনিস ফুলবাগিচায় বসে বসে চোখের জল ফেলতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘাসের শয্যাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সে জাইনকে আপন করে পায়। জাইন ওকে আদর করে চুমু খেয়ে সান্ত্বনা দেয়। কেঁদ না সোনা, কেঁদ না। আমাদের এই বিচ্ছেদ চিরকালের নয়। আবার আমরা মিলবো, হাসবো নাচবো গাইবো—ভালোবাসা করবো।
আনিসের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আবার সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আহার নিদ্রা সব টুটে যায়। একমাত্র জাইন তার ধ্যান জ্ঞান—আর কিছুই তার ভালো লাগে না।
একটানা এক মাস পথ চলার পর ইহুদী সহিসদের বলে, সামনেই একটা বন্দর শহর আসছে। শহরে ঢোকার মুখে তাঁবু ফেলতে হবে। এখানে দু-একদিন জিরিয়ে আবার যাত্রা করা যাবে।
শহরের প্রত্যন্তে সমুদ্র উপকূলের এক নির্জন পরিবেশে তাঁবু ফেলা হলো।
জাইন-এর চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করায় ইহুদীটা।—এ্যাঁই খানকি, শিগ্নির জামা-কাপড় খোল, খুলে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়া।
জাইন ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না। ইহুদী আবার গর্জে ওঠে, কী কথা কানে যাচ্ছে না। দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি। সে নিজেই জাইনের পরনের জমকালো সাজ-পোশাকটা ফড়ফড় করে ছিড়ে ফেঁড়ে ন্যাংটো করে ফেলে। তারপর একখানা লম্বা লকলকে বেতের চাবুক এনে সপাং সপাং করে চাবকাতে থাকে জাইনের পিঠে পাছায় বুকে। দরদর করে রক্ত ঝরে পড়ে। জাইনের ফুলের মতো নরম দেহখানা রক্তে মাখামখি হয়ে তালগোল পাকিয়ে পড়ে যায় নিচে। চাবুকখানা ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে যায় ইহুদীটা।
শহরের প্রবেশ মুখেই এক কামারশালায় গিয়ে বলে, আমার বিবির হাতে পায়ে লোহার হাল লাগিয়ে দিতে হবে।
—কামার অবাক হয়, লোহার হাল মানুষের জন্য? সে আবার কী? কেন?
ইহুদী বলে, বাঁদীটা বজ্জাত মাগী, চরিত্রহীন খানকি। পরপুরুষ নিয়ে কেলি করে। আমরা ইহুদী, আমাদের শাস্ত্রমতে চরিত্রহীনা মেয়েদের এইটেই উচিত সাজা।
কামারটা ইহুদীর সঙ্গে তাবুতে আসে। জাইন তখন রক্তাক্ত দেহে কাতরাচ্ছিল। ইহুদীর এই নিষ্ঠুর অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তুমি একটা জানোয়ার, এইরকম একটা ফুলের মতো মেয়ে, তাকে চাবুকের ঘয়ে আধমরা করে ফেলেছে। এত বড় স্পর্ধা! দাঁড়াও আমি তোমাকে মজাটা দেখাচ্ছি।
কামারটি ছুটে গিয়ে কোতোয়ালকে খবর দেয়, হুজুর আপনি দেখে আসুন, ঐ সমুদ্রের ধারে একটা তাঁবুর ভেতরে পরীর মতো পরমাসুন্দরী একটা মেয়েকে প্রায় খুন করে রেখে দিয়েছে একটা ইহুদী শয়তান।
কোতোয়াল সিপাইদের হুকুম করে, জলদী যাও, ঐইহুদী, তার সুন্দরী বাঁদী আর অন্যান্য যারা আছে তাদের সব্বাইকে ধরে বেঁধে নিয়ে এস এখানে।
কিছুক্ষণেই মধ্যেই সিপাইরা এসে ওদের ধরে নিয়ে গেলো কোতোয়ালের কাছে। জাইন-এর চেহারা দেখে কোতোয়াল তো হতবাক। ভাবতে পারে না—এমন রূপ এমন যৌবন কোনও মেয়ের হয় নাকি!
তোমার নাম কি বাছা? জাইন বলে, আপনার বাঁদীর নাম জাইন, হুজুর।
-আর এই কদাকার জানোয়ারটা কে?
-একটা ইহুদী, হুজুর। লোকটা আমার মা বাবার হেপাজত থেকে ছিনিয়ে এনেছে আমাকে। সর্বক্ষণ নিষ্ঠুর অত্যাচার করে আমার ওপর। নানারকম উৎপীড়ন চালায়, বলে ইসলাম ছাড়বি কিনা বল, না হলে চাবকে ছাল খুলে নেব।কিন্তু আমার বাপ ঠাকুরদার স্বধর্ম, কী করে ত্যাগ করি, হুজুর? আমি রাজি হইনি। আর এই কারণেই সে আমার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে চলেছে।
এই বলে সে সলজ্জভাবে দেহের ওপরের কিছু অংশ অনাবৃত করে দেখায়। কোতোয়াল শিউরে উঠে। থাক থাক আমি বুঝতে পেরেছি।
জাইন বলে, হুজুর, আপনি এই কামার-ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এই ঘাটের মড়াটা তার কাছে কী প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো। আমার হাতে পায়ে লোহার হাল গেঁথে দিতে চেয়েছিলো সে। আল্লাহ মেহেরবান, কামার-ভাই রাজি হননি ওর এই নৃশংস প্রস্তাবে। তা না হলে এতক্ষণ আমার কী দশা হতো একবার ভাবুন হুজুর।
জাইন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, আপনি আমার এই সখীদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, ওরা আপনাকে বলবে, আমি সাচ্চা মুসলমানের মেয়ে। আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে আমি মানি না। আমাদের পয়গম্বর মহম্মদ।
কোতোয়াল মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী, সত্যি?
সবাই এক সঙ্গে জবাব দেয়, হা হুজুর, সত্যি।
তখন কোতোয়াল বরাষ-কশায়িত চোখে ইহুদীর দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে, মনে হতে লাগলো, কোতোয়ালের রোষানলে বুঝি ভস্ম হয়ে যাবে ইহুদীটা।
-ওরে শয়তান, শঠ, আল্লাহর দূষমন এবার তোর মোউৎ সামনে। তার আগে জবাব দে, কেন এই মেয়েটিকে তার মা বাবার হেপাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিস? কেন তার উপর এই রকম উৎপীড়ন চালিয়েছিস এতকাল? কেন তাকে ইসলামের পবিত্র পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করেছিলি, কেন তাকে তোদের ঐ ভয়ঙ্কর ম্লেচ্ছ বিধর্মের পথে টেনে নিয়ে যাবার জন্য প্রলোভন দেখিয়েছিস? কেন? কেন? জবাব দে।
ইহুদী বলে, মালিক, আমি আমাদের পবিত্র পয়গম্বর মুসা জ্যাকব এবং আবন-এর কসম খেয়ে বলছি, এই মেয়ে আমার ধর্মপত্নী।
কিন্তু কোতোয়াল সে কথা কর্ণপাত না করে গর্জে ওঠে, চোপ রও বেয়াদপ। এ্যাঁই—চাবুক লাগা শয়তানটাকে।
সিপাইরা ধাক্কা মেরে ইহুদীটাকে নিচে ফেলে দিয়ে এলোপাতাড়ি চাবুক চালাতে থাকে। একশোটা পায়ে, একশোটা পাছায় এবং একশো চাবুক ওর পিঠে মারা হয়।
কিন্তু তখনও লোকটা কাতরাতে কাতরাতে বলতে থাকে, ও আমার শাদী করা বিবি ধর্মপত্নী?
—ধর্মপত্নী? ধর্ম বলে তোদের কিছু আছে? ধর্মপত্নী! এই—যদি না স্বীকার করে ওর হাত আর পা কেটে ফেলে দে।
আতঙ্কে শিউরে ওঠে ইহুদী। তাকিয়ে দেখে, সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক উদ্যত-খড়গ জাদ!
-না না, বাবা, কেটো না। কেটো না আমাকে। করছি—স্বীকার করছি—স্বীকার না করলে যখন রেহাই পাওয়া যাবে না তখন স্বীকার করছি : এ আমার শাদী করা বিবি নয়। আমি এর মা-বাবার হেপাজত থেকে ছেনতাই করে এনে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার জন্য এর ওপর অমানুষিক অত্যাচার উৎপীড়ন করেছি এতকাল।
—হুম, এই তো বাপের সুপুত্তুরের মতো কথা। সোজা আঙ্গুলে ঘি কিছুতেই উঠতে চায় না। এ্যাঁই—জানোয়ারটাকে কয়েদখানায় ছুঁড়ে দে। যা, ওখানে থাকগে—জিন্দগীভর। দেখগে, কী মজা! বিধর্মী ম্লেচ্ছ ইহুদীদের আমরা এই সাজাই দিই। আল্লাহর এই নির্দেশ। আমরা আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে স্বীকার করি না। আমাদের পয়গম্বর মহম্মদ।
জাইন কোতোয়ালকে সালাম জানিয়ে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে তাবুতে ফিরে আসে। সেইদিনই সে সহিসদের বলে, তাঁবু গুটিয়ে বেঁধে হেঁদে নাও আমি দেশে ফিরে যাবো।
তিন দিন চলার পর জাইন সদলবলে এক খ্রিস্টান পাদরীর গির্জার মঠের কাছে এসে পৌঁছায়। এই গীর্জা-মঠে জনার চল্লিশ পাদরী অবস্থান করে। এদের প্রধানের নাম দানিস!
তখন সন্ধ্যা হয় হয়। সহিসরা জানালো এদিকটার পথ বড় দুর্গম। চোর ডাকাত এবং হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভীষণ উপদ্রব। যদি রাতের মতো কোথাও আশ্রয় নেওয়া যায়, ভালো হয়।
জাইন ভাবছিলো, কী করবে। এমন সময় ঐ গীর্জার মঠের সদরে দণ্ডারমান এক বৃদ্ধ পাদরীর আহ্বান কানে এলো। এই বিগত-যৌবন লোলচর্ম বৃদ্ধই পাদরী-পিতা দানিস। দেহ অপরাগ হলে কী হবে, অল্প বয়েসী ডবকা মেয়ে ছেলে দেখলে এখনও সে খলবল করে ওঠে। চোখে মুখে ফুটে ওঠে নোংরা বিকৃত কামনার লালসা। সারাদিন সে ফটকের পাশে একখানা কুর্শি পেতে বসে থাকে—পথের দিকে চেয়ে। উটের পিঠে চেপে যাত্রীরা যাতায়াত করে। বৃদ্ধ লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সহিস সর্দার বললো, মালকিন, খ্রীস্টান পাদরী সাহেব ডাকছেন! বলছেন রাতের বেলা এ পথে চলা নিরাপদ নয়। তার গির্জেতে রাতটা কাটাতে বলছেন তিনি। মালকিন, ওরা তো খ্রীস্টান।
জাইন বলে, হোক খ্রীস্টান। আমরা তো শুধু রাতটা থাকবো। ওদের খাবো না, তা ছোঁবো না। তাতে আর কী ক্ষতি হবে। চলো, উনি যখন ডাকছেন এখানেই থাকা যাক রাতের মতো।
সহিসরা মঠের প্রাঙ্গণে উটবাহিনীকে প্রবেশ করালো।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো পঁয়ষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।
বৃদ্ধ পাদরী-পিতা বিকৃত কামনার ফাঁদে ছটফট করতে থাকে। জাইনকে সে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে। তার রূপ-যৌবন পাগল করে তুলেছে তাকে। অবশেষে আর স্থির থাকতে না পেরে, সে তার এক চেলাকে দূত করে পাঠালো জাইন-এর কাছে। কিন্তু লোকটা জাইন-এর সামনে এসে আর কথা বলতে পারে না—তো তো করতে থাকে। জাইন তো হেসেই খুন। আসল ব্যাপার সে আগেই আঁচ করতে পেরেছিলো।
পাদরীটা কিছু না বলতে পেরে বৃদ্ধের কাছে ফিরে যায়। বৃদ্ধ আর একজনকে পাঠায়—জাইনকে রাজি করাতে। কিন্তু সেও জাইন-এর সামনে দাঁড়িয়ে তার অসামান্য রূপ-লাবণ্য দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। জাইন তাকে অট্টহাসিতে বিদায় জানায়। এইভাবে এক এক করে চল্লিশজন পাদরীই ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউই প্রস্তাবটা পাড়তে পারে না। অবশেষে কাম-কাতর বৃদ্ধ নিজেই এসে দাঁড়ায় জাইনের দরজায়। জাইন স্বাগত জানায় তাকে, এই যে আসুন, আসুন ঠাকুর্দা, আসুন! তা নাতনীকে না দেখে বুঝি ঘুম আসছিলো না।
বৃদ্ধা থতমত খেয়ে বলে, না মানে, হ্যাঁ, মানে—মানে—
খিল খিল করে হাসে জাইন, বুঝেছি, বুঝেছি। আমার বিরহ আর সইতে পারছেন না, এই তো?তা আজকের রাতটা একটু কষ্ট করে কাটান, কাল আপনার বাসনা পূরণ করে দেব, ঠাকুর্দা। পথের অনেক ধকল গেছে। আমার শরীরটা তেমন যুৎসই নাই। এ অবস্থায় তো মজা পাবেন না। সেইজন্যেই বলছি, কাল সকালে আসবেন, আমি আপনার বাদী হয়ে থাকবো। আজ তা হলে আসুন।
হুবুব এবং অন্যান্য সখীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলো জাইন, দ্যাখ—আমার মনে হচ্ছে, ঐ পালের গোদা বুড়ো পাদরীটা সারারাত ঘুমাবে না। আবার এসে আমাদের দরজা ধাক্কাবে। ঐ ইতরটার সামনে দাঁড়াতে আমার গা ঘিন ঘিন করছে। তার চেয়ে মরি-বাঁচি চলো, এখনি এই রাতেই, আবার রওনা হয়ে পড়ি।
সহচরীরাও সায় দিলো, সেই ভালো, ঐ নখ-দাঁত হীন ভালুকটার থাবায় না গিয়ে বরং পথের হিংস্র জানোয়ারদের হাতে প্রাণ খোয়ানো অনেক ভালো।
সেই রাতেই ওরা গীর্জা-মঠ ছেড়ে সকলের অজ্ঞাতসারে আবার পথে বেরিয়ে পড়ে।
আল্লাহর অপার করুণা, একদিন ওরা নিরাপদেই স্বদেশে পৌঁছে যায়। ঘর-দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে হামামে গিয়ে ঘষে মেজে ভালো করে গোসল করে জাইন। হুবুবকে বলে, যা, আনিসকে ডেকে নিয়ে যায়।
এ পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত।
আনিস জাইনের শোকে না খেয়ে না ঘুমিয়ে কেঁদে নিজেকে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছিলো। হুবুরকে দেখে সে অবাক হয়ে লাফিয়ে ওঠে, তোমার মালকিন?
হুবুব বলে, মালকিন ভালো আছেন। আজই আমরা ফিরে এসেছি। আপনি চলুন।
-তার স্বামী?
-সে নাই। কোতোয়াল তাকে কয়েদ করেছে—জীবন ভোর।
এরপর আনিস হাতে বেহেস্তে পায়। দৌড়ে নয়, বলা যায়—অপূর্ব ছন্দ তুলে নাচতে নাচতে এসে সে হাজির হয় জাইন-এর ঘরে।
জাইন তখন শাহজাদীর মতো জমকালো সাজ-পোশাক আর দামী রত্নাভরণে সেজেগুজে সামনে খানা সাজিয়ে বসেছিলোত আনিসকে দেখা মাত্র সে ছুটে গিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে।
—ইয়া আল্লাহ, এ কি চেহারা হয়েছে তোমার!
আনিস হাসে, ও কিছু নয় দেখো, আবার দুদিনেই আগের মতো ঠিক হয়ে যাবো। মোক্ষম দাওয়াই যখন পেয়ে গেছি, তখন আর ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। এখন বল কেমন ছিলে? তোমার স্বামীর খবর কী–
—সে খতম হয়ে গেছে।
জাইন আগাগোড়া সব খুলে বললো।
-এবার আমাদের পথের কাঁটা দূর হয়েছে আনিস। এখন আর কেউ আমাদের ভালোবাসায় বাস সাধতে আসবে না। আমি তোমাকে শাদী করবোএবং আজই রাতে।
সেদিন সন্ধ্যায় কাজী এবং সাক্ষীদের ডাকা হলো। শাদীনামা তৈরি করে সই-সাবুদ করে দিয়ে গেলো তারা।
এর পরের দৃশ্য বাসরঘর। সেখানে আর আজ যাবো না। গল্প এখানেই খতম।
শাহরাজাদ থামতেই দুনিয়াজাদ উঠে এসে গলা জড়িয়ে ধরে, কি সুন্দর কি দিদি, আর কী মিঠে করেই না তুমি বলতে জান।