2 of 4

৩.০৩ আবু কাইর আর আবু শাইর-এর মজাদার কাহিনী

আবু কাইর আর আবু শাইর-এর মজাদার কাহিনী

শাহরাজাদ বলতে শুরু করে।

শুনুন জাঁহাপনা, এবার আপনাকে আবু কাইর আর আবু শাইর-এর মজাদার কাহিনী শোনাচ্ছি।

এক সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে আবু কাইর নামে এক রজক আর আবু-শাইর নামে এক নাপিত বাস করতো। দু’জনেরই শহরে দোকান ছিলো।

আবু কাইর-এর মতো পাজি বদমাইশ আর দুটি ছিলো না। চোখে মুখে সে মিথ্যে কথা বলতো। তার মতো অসৎশঠ প্রবঞ্চক সে শহরে আর কেউ ছিলো না। তার কুখ্যাতি ও কুকীর্তির নানা কাহিনী লোকের মুখে মুখে ফিরত। লোকটা নানা ছল চাতুরী করে তোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করতো। কেউ তার কাছে জামা কাপড় রং করতে এলে ধোঁকা দিয়ে পুরো টাকা আগাম নিয়ে নিত সে। বলতো, বাজারে রং পাওয়া যাচ্ছে না। চড়া দামে নগদে রং কিনতে হবে। লোকে বিশ্বাস করে অগ্রিম দিয়ে যেত। কিন্তু আবু কাইর সেই টাকা দিয়ে ভালো ভালো খানা-পিনা এনে স্ফুর্তি করে খেত। কিন্তু খদ্দেরকে মাল তৈরি করে দিত না। আগাম টাকাটাই আত্মসাৎ করে ক্ষান্ত হতো না, তাদের জামা কাপড়ও বেচে দিত। এইভাবে হাজার হাজার লোককে সে ঠকাতো। বেচারা খদ্দেররা দিনের পর দিন ফিরে যেত। রোজই লোকটা নতুন নতুন ছল করে তাদের ধোঁকা দিয়ে ফেরাতো। কাউকে বলতো, আমার বিবির বড় বিমার, কদিন কাজে একদম হাত দিতে পারেনি। কিছু মনে করবেন না, দিন দুই পরে আসবেন।দুদিন বাদে এসে তারা আবার এক নতুন কথা শুনে। আর বলবেন না, গতকাল থেকে এমনভাবে পেট ছেড়ে দিয়েছে। যে, উঠে দাঁড়াতে পারছি না। কথা দিচ্ছি, দিন কয়েকের মধ্যেই আপনার পোশাক রং করে দেব। খদ্দের ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যায়। মুখে কিছু বলতে পারে না। মানুষের শরীর খারাপ হতেই পারে। কিন্তু তারা তো জানে না যে, পোশাক অনেক আগেই সে বেমালুম বেচে দিয়েছে।

এইভাবে দিনের পর দিন প্রতিটি নিরীহ খদ্দেরকে নানা ছল ছুতোয় ঘোরাতে থাকে। কিন্তু এমনভাবে বেশিদিন চললো না। একদিন একজন ফেটে পড়লো, সাফ সাফ সত্যি কথা বলো, আমার কামিজ কোথায়? দিনের পর দিন তুমি আমাকে নানা ছলে ঘোরাচ্ছো। আজ আমি তোমার কোনও কথা শুনতে চাই না। আগে বের কর আমার কামিজ আর টাকা। তা না হলে তোমারই একদিন কি আমারই একদিন, আমি দেখিয়ে দেবো।

আবু কাইর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, আপনি বিশ্বাস করুন মালিক, সত্যি কথাটা বলবো বলবো করে কিছুতেই আপনার কাছে বলতে পারছিলাম না। কিন্তু এখন দেখছি, না বলে আর উপায় নাই।

খদ্দেরটি গর্জে ওঠে, ওসব ভণিতা রেখে কি বলতে চাও, বলো।

ধোপাটা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমি আপনার কামিজটা রং করে দোকানের বাইরে মেলে দিয়েছিলাম। এমন সুন্দর রং হয়েছিলো, আপনাকে কি বলবো, কিন্তু সবই আমার নসীব—বিকাল বেলায় তুলতে গিয়ে দেখি, চুরি গেছে। শুধু আপনারটাই না, ঐ সঙ্গে আরও দু’জনের সাজ-পোশাক ছিলো—সবই নিয়ে চম্পট দিয়েছে ব্যাটা। এখন আমি কী করি? কী করে আপনাদের বোঝাই। এতে আমার কোনও হাত ছিলো না। আর এসব বললেই বা আপনারা শুনবেন কেন বলুন। আপনারা আমার খদ্দের, উচিত মূল্য দিয়ে কাজ করাবেন। ক্ষয় ক্ষতি হলে আপনারা মানবেন কেন?

খদ্দেরটি বলে, কিন্তু তোমার দোকানের সামনে থেকে চুরি যাবে কি করে? কার এতো বড় সাহস? তোমার নাকের ডগা থেকে চুরি করে হাওয়া হবে?

—আর বলবেন না সাহেব, আমার পাশেই একটা মহা চোরের ডেরা।

-কে সে?

আর বলবেন না মালিক, এই যে ছুঁচো নাপিতটা—ঐ ব্যাটাই আমার সর্বনাশ করছে। একটু বেসামাল হয়েছি কি রক্ষা নাই। ব্যাটা ওৎ পেতেই থাকে—লোকটা এমন অসৎ ছিচকে চোর-একবার যদি বাছাধনকে হাতে-নাতে ধরতে পারি, জন্মের সাধ ঘুচিয়ে দেব।

খদ্দেরটির সব রাগ জল হয়ে যায়। আহা, বেচারা গরীব মানুষ, এতো দামী সাজ-পোশাকের খেসারত সে দেবে কি করে? আর কাজীর কাছে মামলা করেই বা ফয়দা কী? ওর দোকানে কী আছে? কী ক্রোক করে নেওয়া যাবে? শুধু-শুধু খাটুনিই সার হবে। সুতরাং মাল আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়ে শুকনো সান্ত্বনা দিয়ে সে চলে যায়, দুঃখ করো না দোকানী। পাপের শাস্তি আল্লাহ দেবেন। তোমার ক্ষতিপূরণ তুমি একদিন সুদে আসলে পাবে।

লোক ঠকানোর ব্যবসা আর কত দিন চলে। এইভাবে একদিন তার সব খদ্দের সরে পড়ে। শহরে তার ভীষণ বদনাম, কেউ আর তার ছায়া মাড়ায় না।

রোজগারপাতি একেবারে বন্ধ, দিন আর চলে না। প্রতিবেশি সদাশয় নাপিত দেখলো লোকটা না খেতে পেয়ে মারা যাবে। একদিন সে আবু কাইরকে বললো, দেখ ভাই, দেখতে পাচ্ছি, তোমার ব্যবসা একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। এখন খাবে কী? এক কাজ কর, যতদিন না কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পার, আমার বাসাতেই খানা-পিনা কর। তারপর যখন সুদিন আসবে, আবার পসার জমবে।

আবু শাইর-এর বদান্যতায় কোনও রকমে জীবন ধারণ করতে থাকে আবু কাইর। কিন্তু নাপিতের ব্যবসাও তেমন কিছু চলে না। তার ওপরে বয়স হয়েছে, তেমন খাটতেও পারে না। দিনকে দিন রুজি-রোজগার কমতেই থাকে। অথচ খরচ বেড়ে গেছে। ঘাড়ের ওপর ধোপার সংসার। নিজে যা খায়, তাদেরও তা খাওয়াতে হয়।

একদিন আবু কাইর বললো, দেখ বন্ধু, আমি বুঝতে পারছি তোমার রোজগার কমে আসছে। এই বাজারে তোমার নিজের সংসার চালিয়ে আমার সংসারের ভার বয়ে চলা বড় শক্ত। আমি বলি কি, চলো আমরা বিদেশে যাই। নতুন কোনও শহরে। হয়তো আল্লাহ মুখ তুলে চাইবেন। আমরা আবার নতুন করে দোকান-পাট সাজাবো। এখানকার দোকান তুমি বেচে দাও। চলো, ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ি।

আবু কাইর বলে, তা কথাটা মন্দ বলনি, ভাই। এ পোড়া শহরে আমাদের আর কিছু হবে না। তাই চলো, অন্য দেশেই চলে যাই।

আবু শাইর দোকান বিক্রি করে দিয়ে বিদেশ যাত্রার তোড়জোড় করতে থাকে। আবু কাইর বলে, কোরাণ ছুঁয়ে হলফ করছি, আজ থেকে তুমি আমার ভাই। আমরা যা লাভ করবো দু’জনে সমান ভাগ করে নেব। তা সে যদি একা আমর খাটুনিতেও রোজগার হয় তারও সমান ভাগ তোমাকে দেব, কেমন?

আবু শাইর বলে, এর চাইতে ভালো কথা আর কি হতে পারে, ভাই।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো অষ্টাশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

জাহাজ ছাড়ার দিন দুই বন্ধুতে বন্দরে এসে আল্লাহর নাম করে জাহাজে চেপে বসে। সঙ্গে সামানপত্র বিশেষ কিছুই নাই। এমন কি রাহাখরচ বা খানাপিনা কিছুই সঙ্গে নিতে পারেনি তারা। পাবেই বা কোথায়। দোকানটা বিক্রি করে যা কিছু সামান্য পেয়েছিলো : তার থেকে বিবি বাচ্চাদের খাওয়া পরার জন্য কিছু দিয়ে এসেছে। বাকী টাকায় জাহাজের ভাড়া মেটাতে হয়েছে!

কিন্তু নসীব সাধ দিলো। জাহাজের কাপ্তান, খালাসী, যাত্রী ও, সওদাগরদের চুল দাড়ি কেটে খানাপিনার পয়সা রোজগার হতে লাগলো। আবু শাইর ছাড়া জাহাজে অন্য কোনও নাপিত ছিলো না। তাই, সাদরেই তাকে দিয়ে তারা ক্ষৌরকর্ম করায় এবং হিসেবের তুলনায় কিছু বেশি পয়সা দেয়। আবু শাইর বলে, পয়সার আমাদের তেমন প্রয়োজন নাই, আপনারা যদি আমাদের দু’জনের খানাপিনার ব্যবস্থা করে দেন তা-ই যথেষ্ট হবে।

যাত্রীদের কেউ রুটি কেউ মাখন কেউ মধু কেউ বা একটু মাংস দেয়। যারা খানাপিনা কিছুই দিতে পারে না তাদের কাছ থেকে পয়সা নেয় আবু শাইর।

এইভাবে সে কয়েকদিনের মধ্যেই সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে! স্বয়ং কাপ্তান একদিন ডেকে বললো, তোমার তো খুব সুখ্যাতি শুনছি। খুব সুন্দর করে নাকি কামাতে পার। তা আমার মাথাটা একবার কামিয়ে দাও তো দেখি।

খুব যত্ন করে আবু শাইর কাপ্তানের মাথা কামিয়ে দেয়। ক্ষুর চালাতে চালাতে সে তার এবং আবু কাইর-এর দুর্ভাগ্যের কাহিনী খুলে বলে।

-স্বদেশে আর খেতে পরতে পেলাম না সাহেব, তাই বিদেশে চলেছি ভাগ্য অন্বেষণে।

আবু শাইর-এর ব্যবহারে খুশী হয় কাপ্তান। বলে, আজ থেকে তোমার দোস্তকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা আমার কামরায় যেও। যতদিন না তোমাদের এই জাহাজ যাত্রা শেষ হয় প্রতিদিন আমার সঙ্গে খানপিনা করবে তোমরা, কেমন?

আবু শাইর এতোটা আশা করেনি। কাপ্তানের বদান্যতায় সে গদগদ হয়ে বলে, আপনার এ ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না, সাহেব।

—তার দরকার নাই। তোমরা বিপদে পড়েছ, সাধ্যমতো সাহায্য করা আমার কর্তব্য।

আবু শাইর কাজ-কাম শেষ করে ফিরে এসে দেখে, আবু কাইর নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন কাজ করে আজ তার অনেক রোজগার হয়েছে। রুটি, মাখন, মধু, মাংস, সজী এনেছে অনেক।

আবু কাইরকে জাগাতেই সে লাফিয়ে ওঠে, ওরে বাস, এতো খাবার? কোথায় পেলে?

লোকে ভালোবেসে দিয়েছে। আবুকাইর আর কোনও কথা বলে না। গোগ্রাসে মুখে পুরতে থাকে। আবু শাইর যে সারাদিন খেটেখুটে এসেছে, তার সঙ্গে বসে ভাগাভাগি করে খাওয়া দরকার, সেই সৌজন্যবোধটুকু তার নাই।

আবু শাইর বলে, ধীরে বন্ধু, ধীরে। একদিনেই সব খেয়ে ফেললে কাল কী খাবে?

—কেন, কাল কি কাজে বেরুনে না?

-বেরুবো না কেন, কিন্তু যদি রোজগার না হয়। ভবিষ্যতের জন্য তো কিছু সঞ্চয় করে রাখা দরকার। কিছুই তো বলা যায় না। তা ছাড়া আরও একটা খবর আছে।

—কী?

কাপ্তান সাহেব আমাকে খুব সুনজরে দেখেছেন। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা তার কামরায় তোমার আমার নেমন্তন্ন। সেখানেই পেট পুরে খেতে পারবো। সুতরাং এগুলো এখন না খেয়ে ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখাই বোধহয় ভালো।

আবু কাইর মাংসের একটা টুকরো মুখে পুরতে পুরতে বলে, সমুদ্রের এই নোনা হাওয়ায় আমার শরীরটা ভালো নাই। গা হাত পা ব্যথা ব্যথা করছে। আমি আর কাপ্তানের কামরায় যাবে না। তুমি একাই গিয়ে খানাপিনা করে এসো। যদি পার, ভালোমন্দ খানিকটা আমার জন্যে নিয়ে এসো।

আবু শাইর বললো, সে তুমি ভেবো না, ভালো জিনিস তোমাকে না খাইয়ে আমার মুখে রুচবে না।

আবু শাইর-এর সারদিনের সংগৃহীত সমস্ত খানাপিনা একাই সাবাড় করে দিলো আবু কাইর। একটা ক্ষুধার্ত রাক্ষস! যেন কতকাল খেতে পায়নি।

এই সময় কাপ্তানের লোক এসে বললো, খানা তৈরি, কাপ্তান আপনাদের খেতে ডাকছেন।

আবু শাইর আবু কাইরকে বললো, কী যাবে না?

—তুমিই যাও ভাই, আমার শরীরটা বেজায় খারাপ। সমুদ্রের শয়তানটা আমার ওপর ভর করেছে। উফ কী ব্যথা, সারা শরীরটা টনটন করছে। এক পাও নড়ার শক্তি নাই আমার।

সুতরাং আবু শাইর একাই গেলো কাপ্তানের কামরায়। লম্বা একটা মেজের উপর সাদা কাপড় বিছানো হয়েছে। তার উপরে নানা ধরনের বাদশাহী খানা থরে থরে সাজানো। প্রায় গোটা কুড়ি রেকাবী ভর্তি মুখরোচক খানা! কাপ্তান মেজের মাঝখানে বসে আবু শাইর এবং তার আরও দু-চারজন মেহেমানের প্রতীক্ষায় বসে আছে।

নাপিতকে একা দেখে কাপ্তান প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার, তোমার দোস্ত কোথায়? সে এলো না?

জী না। তার বিমার হয়েছে। সমুদ্রের জল হাওয়া সবারই তো ধাতে সয় না। বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। তবে দু’একদিনেই সেরে যাবে মনে হয়।

কাপ্তান বললো, ঠিক আছে, এই এখানে আমার পাশে এসে বস। একখানা বড় দেখে থালা নাও। যা যা পছন্দ, যত খুশি তুলে নাও। কোনও সঙ্কোচ করো না। খাবার লোক বেশি নাই। কিন্তু কম করে হলে জনাদশেকের খানা সাজানো আছে। পেট ভরে খাবে কিন্তু। বুঝলে?

আবু শাইর ঘাড় নেড়ে জানায়, সে যতটা পারে খাবে।

প্রাণ ভরে তৃপ্তি করে খেলো সে। কাপ্তান একখানা বড় থালা টেনে নিয়ে নিজে হাতে নানারকম খানায় ভর্তি করে আবু শাইর-এর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, তোমার বন্ধুর জন্যে নিয়ে যাও। বেচারা, বিমারে কষ্ট পাচ্ছে।

আবু শাইর ফিরে এসে দেখে, আবু কাইর-এর পেটটা ফুলে যেন জয়ঢাক। ঘন ঘন ঢেকুর তুলছে। লোভে পড়ে খেয়েছিলো। এখন তার ঠেলা সামলাতে পারছে না।

—তোমাকে পই পই করে বারণ করলাম, ঐ সব বাজে জিনিস খেয়ে শরীর খারাপ করো। তা আমার কথা তো কানে তুললে না! এখন দেখ, কত সুন্দর জিভে জল আসা খানা নিয়ে এসেছি। তখন কম করে খেলে এখন কত রসিয়ে রসিয়ে খেতে পারতে–

আবু কাইর-এর লোভী চোখ দুটো ধক ধক করে জ্বলতে থাকে।

—আরে রাখ রাখ, আমার সামনে রাখ দেখি। আঃ, কী বাহারী-খানা গো! এ কি না খেয়ে থাকা যায়?

আবু শাইর আঁৎকে ওঠে, আঁ, বলো কী? এ অবস্থায় আবার তোমার গলায় নামবে?

-খুব নামবে। তুমি দেখই না, কেমন করে সাবাড় করে দিই। আহ, এমন সুন্দর শাহী কাবাব, কোর্মা, কালিয়া চাপ, তন্দুরী,—একি কালকের জন্যে ফেলে রাখা যায়! কাল যদি না-ই বাঁচি।

আবু শাইর-এর হাত থেকে প্রায় ছোঁ মেরে রেকাবীখানা কেড়ে নিয়ে দু’হাত চালিয়ে মুখে পুরতে থাকে সে। নেকড়ের মতো লোভী লোলুপ তার চোখের দৃষ্টি। সিংহের মতো ক্ষিপ্রতায় সে হাত মুখ চালাতে থাকে। পলকের মধ্যে পুরো থালাটাই সাবাড় করে ফেলে। দু হাত দিয়ে থালাখানা মুখের সামনে তুলে ধরে জিভ দিয়ে চেটেপুটে ফর্সা করে আবু শাইর-এর হাতে ফেরত দিয়ে বলে, বেড়ে খেলাম।

আবু শাইর হতবাক। একটা লোক এতো খেতে পারে? ভয় হয়, লোভে পড়ে খেলে বটে, কিন্তু বাঁচবে তো?

আবু শাইর-এর আশঙ্কা বৃথা। দিব্যি আরামে মোষের মতো নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে লাগলো আবু কাইর। সারা রাত ধরে তার নাসিকা গর্জন আর সমুদ্রের ভয়াল তর্জন মিলে-মিশে। একাকার হয়ে যেতে থাকলো।

পরদিন সকালে উঠে আবার আবুশাইর জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে ঘোরা-ফেরা করে। কারো মাথা কামায়, কারো গোঁফ ছাঁটে। এইভাবে সারাদিন কাজ-কাম করার পর কাপ্তানের কামরায় হাজির হয়। আবু কাইর তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সমানে নাসিকা গর্জন করে চলেছে।

কাপ্তান সাহেব তাকে আদর আপ্যায়ন করে খানাপিনা করায়।

এইভাবে সপ্তাহ তিন কেটে গেলো। জাহাজ এসে ভিড়লো এক নাম-না-জানা বন্দরে। আবু কাইর আর আবু শাইর তীরে নামে। বন্দরের পাশেই শহর। ওরা একটা কম দামী সরাইখানায় একখানা ঘর ভাড়া করে নিলো। আবু কাইর কিন্তু তখন দরিয়া-বিমারে শয্যাশায়ী। সে আবু শাইর-এর মাদুরের এক পাশে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।

আবু শাইর তার ক্ষুর কচি সঙ্গে নিয়ে একটা জনবহুল রাস্তার চৌমাথার এক পাশে একটু জায়গা করে বসে পড়ে। প্রথমে একটা কুলি পরে গাধার সহিস, ভিস্তিওলা, ফলওলা, ফেরিওলা প্রভৃতি গরীব খদ্দেরগুলো জুটতে থাকে। তার কামাবার কায়দা দেখে পথচারীরা থমকে দাঁড়ায়। আপনা থেকে বাহবা শব্দ বেরিয়ে আসে, বাঃ চমৎকার হাত তো লোকটার!

আস্তে আস্তে পয়সাওলা লোকগুলিও পাছায় ইট নিয়ে আবু শাইর-এর সামনে কামাতে বসে পড়ে।

দিনের অনলা শেষ হয়ে গেলে আবু শাইর সেদিনের মতো ক্ষুর কাঁচি জড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ে এবং ঘরে ফেরার পথে খানাপিনা কিনে নিয়ে যায়। বন্ধুবর আবু কাইর তখনও শয্যাশায়ী। নাসিকা গর্জনে কামরা কাঁপিয়ে তুলছে। আবু শাইর ওর নাকের কাছে মাংসের কালিয়াটা ধরতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলো সে।

—বাঃ বেড়ে গন্ধ তো! আবু কাইর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে থাকে। লোলুপ চোখে খাবারের ভাঁড়ের দিকে তাকায়। দু’জনে মিলে ভাগ করে খানাপিনা করে। বলাবাহুল্য আবু কাইরই বেশী খায়।

এইভাবে প্রতিদিন কাজে বেরিয়ে যায় আবু শাইর আর কুঁড়েটা পড়ে পড়ে ঘুমায়। জিজ্ঞেস করলে বলে, উঃ, সারা গায়ে কী দর্দ। এপাশ-ওপাশ করতে পারি না।

এমনি করে চল্লিশটা দিন কেটে গেলো। সারাদিন খেটে খুটে ভালো মন্দ খানাপিনা নিয়ে আসে আবু শাইর আর তার ভাগ বসায় কুঁড়ের বাদশা ধোপাটা। আবু শাইর দুএকবার বলার চেষ্টা করেছে, ঘরের মধ্যে এইভাবে আবদ্ধ না থেকে শহরটা ঘুরে ফিরে একবার দেখে এস। কি সুন্দর সব দোকান-পাট রাস্তা-ঘাট, ফুলের বাগিচা, ফোয়ারা-চোখ জুড়িয়ে যাবে।

আবু কাইর হঠাৎ কঁকিয়ে ওঠে, উ-হু-হু, গেলাম—

আবু শাইর ভীত চকিত হয়ে ওঠে কী, কী হলো?

-পায়ের রগে টান ধরেছে, একটু মালিশ করে দাও।

আবু কাইর কাতরাতে থাকে। সরল প্রাণ নাপিত বুঝতে পারে না ওর বাহানা। কাছে এসে পা-খানা ডলে দিতে থাকে।

—আহা-হা থাক থাক, তুমি আর ওঠা বসা করো না। শুয়েই থাক। পা দু’খানা টান করে রাখ। আমার আবার দেরি হয়ে গেলো, চলি। খানা ঢাকা আছে ওপাশে, দুপুরবেলায় উঠে খেয়ে নিও।

আবু কাইর বলে আচ্ছা। তুমি কিছু ভেব না, অসুখটা সারলেই আমি কাজে লেগে যাবো। তারপর দুজনে মিলে রোজগার করে চটপট অনেক টাকা বানিয়ে ফেলবো।

আবু শাইর তখনও দরজার চৌকাঠ পার হয়নি, আবু কাইর নাক ডাকাতে আরম্ভ করে।

দিনের পর দিন টাটা রোদুরে খেটে খেটে একদিন আবু শাইর অসুখে পড়লো। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো, কী করে আর কাজে বেরোয়। সরাইখানার মালিককে ডেকে বললো, আমার তবিয়ৎ বহুৎ খারাপ-হয়ে পড়েছে। কাজে বেরুতে পারছিনা। যদি মেহেরবানী করে দিন দুই ভাইটাকে খেতে দেন, বড় উপকার হয়। আমি ভালো হয়ে আপনার পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেব।

আবু শাইর-এর কথামতো আবু কাইরকে দুদিনের মতো খানাপিনা পাঠিয়ে দিলো সে। কিন্তু আবু শাইর ইতিমধ্যে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। জ্বরের ঘোরে সে ভুল বকতে আরম্ভ করে। কিন্তু অপদার্থ ধোপাটার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। একবার ফিরেও তাকায় না তার দিকে। ক্ষিদের জ্বালায় তার পেট জ্বলছে, সরাইখানার মালিক আর খানা দেবে না, ঘরেও কিছু নাই, আবু কাইর ছটফট করতে থাকে, কী খাবে সে? আঁতিপাতি করে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। কিন্তু না, কোথাও কিছু নাই। হঠাৎ একটা ছোট বটুয়া খুঁজে পেলো সে। প্রতিদিন কিছু কিছু দিরহাম বাঁচিয়ে আবু শাইর এই বটুয়াটায় কিছু পয়সা জমিয়েছিলো! আবু কাইর বটুয়াটা ট্র্যাকে খুঁজে পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। সেই সময় সরাইখানার মালিকও সেদিকে ছিলো না। সকলের অলক্ষ্যে সে শহরের পথে হন হন করে হেঁটে চলে। কিছু দূর যেতেই একটা হালুইকরের দোকান দেখতে পায়। আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সে দোকানে ঢুকে পড়ে! দোকানীকে বলে, খুব জলদি রুটি আর হালওয়া দাও। বড্ড খিদে পেয়েছে।

পেটপুরে খেয়ে দেয়ে দাম চুকিয়ে বাজারের পথে বেরিয়ে পড়ে। এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো ঊননব্বইতম রাতে আবার সে শুরু করে :

বাজারে গিয়ে আবু কাইর সুন্দর দেখে জামা কাপড় কিনে পরে নিলো। রাস্তায় নেমে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গজেন্দ্র-গমনে চলতে থাকে। একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হয়, রাস্তায় যত মানুষ চলা-ফেরা করছে তাদের সকলের সাজ-পোশাক মাত্র দুটি রঙে সীমাবদ্ধ। সাদা আর নীল। এর বাইরে অন্য কোনও রঙ তার চোখে পড়ে না।

আবু কাইর এক রজকের দোকানে ঢোকে। দোকানী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী চাই জনাব।

আবু কাইর পকেট থেকে একখানা সাদা রুমাল বের করে বলে আমি এটা রঙ করাতে চাই! কত লাগবে?

দোকানী বলে, কুড়ি দিবহাম। আবু কাইর-এর চোখ কপালে, ওঠে, কুড়ি দিরহাম? কেন?

—কেন কী, কুড়ি দিরহামই বাঁধা দর। বিশ্বাস না হয় আর পাঁচটা দোকান যাচাই করে দেখুন!

—কিন্তু আমাদের দেশে তো এই রুমালখানা রং করতে আধ দিরহাম লাগে?

দোকানী নির্লিপ্তভাবে বলে তাহলে আপনার দেশে গিয়েই করাবেন। আমরা ওর কমে করতে পারবো না।

আবু কাইর বলে, ঠিক আছে, তাই দেবো। আমাকে লাল রঙ করে দেবেন।

দোকানী অবাক হয়ে তাকায়, লাল?

—হ্যাঁ, লাল রঙই আমার পছন্দ।

—আপনার পছন্দমতো কাজ হবে না, সাহেব!

-মানে?

-মানে আবার কী? নীল ছাড়া অন্য কোনও রং করা যাবে না।

এবার আবু কাইর অবাক হয়, কেন? কেন করা করা যাবে না?

—এ দেশে নীল আর সফেদ এই দুটো রঙই হয়। আপনি পথে ঘাটে লক্ষ্য করেননি? কোনও মানুষের সাজ-পোশাকে অন্য কোনও রঙ দেখেছেন?

-না, তা অবশ্য দেখি নি। কিন্তু কেন অন্য রং করা যাবে না?

এখানে—এই শহরে আমরা চল্লিশ ঘর রঙের কারিগর আছি। বংশানুক্রমে এই আমাদের জাতব্যবসা। বাবা একমাত্র ছেলেকে শিখিয়ে যায়। সেজন্য অন্য কোনও লোক এখন পর্যন্ত এ ব্যবসাতে নাক গলাতে পারেনি। আমরা শুধু জানি, নীল রঙ করতে। অন্য কোনও রঙের কাজ

আমাদের বাপঠাকুর্দাও জানতো না, আমরাও জানি না।

আবু কাইর বললো, যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলি। আমি বিদেশী, আলেকজান্দ্রিয়াতে আমার ঘর। এখানে ভাগ্যান্বেষণে এসেছি। আমারও জাতব্যবসা এই কাপড় রঙ করা। আমি চল্লিশ রকম রঙের কাজ জানি। আমাকে যদি আপনার সঙ্গে নেন তবে সব কাজ আপনাকে আমি শিখিয়ে দেবো। তখন দেখবেন, আপনার দোকোনে কী ভিড় জমে যায়।

দোকানী সন্দিগ্ধভাবে আবু কাইর-এর দিকে তাকায়। বলে, আমার ওসব ঝমেলার দরকার নাই। এই বেশ আছি।

আবু কাইর বলে, বেশ, আমাকে একটা চাকরীতেই বহাল করুন কোনও অংশ চাই না। আমি আপনাকে সব শিখিয়ে দেবো।

দোকানী বললো, সে হয় না। আমরা কোনও বিদেশীকে চাকরী দিতে পারি না। আমাদের রজক-সভার অনুমতি ছাড়া কোনও কাজ আমরা করি না। আমাদের সভাপতির নির্দেশ আছে, কোনও বিদেশীর সঙ্গে কারবার করবে না তাদের কাউকে কর্মচারী রাখবে না।

আবু কাইর হতাশ হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আর একটা কাপড় রঙ করার দোকানে ঢোকে। কিন্তু কি আশ্চর্য, সে দোকানীটাও ঐ একই কথা বলে তাকে ফিরিয়ে দেয়। এইভাবে সে যতগুলো দোকোনেই গেলো, সবাই একই কথা বলে, না, কোনও বিদেশীকে তারা দোকানে ঢোকাবে না। এরপর সে গেলো রজক-সভার সভাপতির কাছে। লোকটি বয়সে প্রবীণ। ব্যবহারও বেশ ভালো। কিন্তু তারও সেই এক কথা, আমাদের বাপঠাকুর্দার নির্দেশ আছে, সাহেব। হাত পা আমাদের বাঁধা, কোনও বিদেশীকে আমাদের দোকানে জায়গা দিতে পারি না!

অবশেষে আবু কাইর মরীয়া হয়ে সেখানকার সুলতানের দরবারে গিয়ে হাজির হয়। আবু কাইর বিদেশী, সুলতান তাকে সাদর স্বাগত জানায়। যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে সে বলে, জাঁহাপনা, আমি আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী। হুজুরের দরবারে একটা আর্জি পেশ করতে চাই।

সুলতান বলে, বেশ বলল, কী বলতে চাও?

—জাঁহাপনা, জাতে আমি রজক। কাপড় রঙ করে রোজগার করি। নিজের দেশে ব্যবসা চললো না, তাই ঘুরতে ঘুরতে আপনার শহরে এসেছি। উদ্দেশ্য গায়ে গতরে খেটে দুবেলার রুটি সংগ্রহ করবো। কিন্তু আপনার শহরে, চল্লিশটি রজকের দোকান আছে, প্রতিটি দোকানে আমি ঘুরেছি! কেউ আমাকে কাজ দিলো না। আমার একমাত্র অপরাধ, আমি বিদেশী। কিন্তু আমাকে কাজে নিলে তারা লাভবান হতো, হুজুর।

সুলতান প্রশ্ন করে, কেন? লাভবান হতো কেন?

-আপনার শহরের প্রতি মানুষ এমনকি স্বয়ং সুলতান পর্যন্ত দেখছি দুটি রঙের সাজ-পোশাক পরেন। সাদা আর নীল। দোকানীদের কাছ থেকে জানলাম, নীল ছাড়া তারা নাকি অন্য কোনও রঙের কাজ জানে না।

সুলতান বাধা দিয়ে বলে, তা তারা অন্যায়টা কী বলেছে? সত্যিই তো, নীল ছাড়া অন্য রঙে সাজ-পোশাক রাঙানো যাবে কী করে?

—হুজুর যদি অভয় দেন তো বলি, আমি লাল, নীল, হলুদ, জাফরান, গোলাপী, বেগুনী, সবুজ প্রভৃতিচল্লিশটা রঙের কাজ জানি। একেবারে পাকা রঙ। আপনি যে রঙ বলবেন। সেই রঙে কাপড় রঙিয়ে দিতে পারি। কাপড় ছিড়ে যাবে, কিন্তু রঙ জ্বলজ্বল করবে।

সুলতান হতবাক, কয়েক মুহূর্ত তার মুখে কথা জোগায় না। সারা দরবার অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আবু কাইর-এর মুখের দিকে। লোকটা বলে কী। মাথাটাথা খারাপ? পাগল নয় তো?

সুলতান বলে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু তুমি বিদেশী, তাই তোমাকে অসম্মান করে একেবারে নস্যাৎ করে দিচ্ছি না। বেশ তুমি কী চাও, বলো, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কিন্তু একটা কথা শুনে রাখ, বিদেশী, যদি তোমার কথা ঠিক হয় তবে তোমাকে আমি মাথায় করে রাখবো। আর যদি ধোঁকাবাজী কর, তোমার গর্দান যাবে।

আবু কাইর কুর্নিশ জানিয়ে বলে, তাই হবে জাঁহাপনা। আপনি আমাকে শহরের যে-কোনও রাস্তার ওপরে একখানা দোকান ঘর-এর ব্যবস্থা করে দিন। আর চাই কয়েকজন লোক, কিছু কাপড় আর রঙ তৈরি করার খরচা।

সুলতানের হুকুমে সেইদিনই শহরের চৌমাথার কাছে একখানা বিরাট দোকান ঘর ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো তাকে। যে কজন লোক দরকার সব পেয়ে গেলো সে।

আবু কাইর লোকজনদের কাজে লাগিয়ে দোকানটাকে পরিপাটি করে সাজালো। সুলতান বললো, এই নাও, এক হাজার দিনার, এটা রাখ। যতদিন না কাজ শুরু হয়, তোমার হাত খরচা হিসাবে দিলাম। তোমার থাকার জন্য একখানা বাড়ি আমি সাজিয়ে গুজিয়ে দিতে বলেছি। এখন থেকে সেই বাড়িতেই থাকবে তুমি। চাকর নফর যা দরকার তোমার সব ব্যবস্থা করে দেবে উজির—আমার বলা আছে। তোমাকে অন্য কোনও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে না। শুধু কাজ নিয়ে মেতে থাকবে। কাজ শেষ হলে খানাপিনা আর ফুর্তি করবে।

দু-একদিনের মধ্যেই আনুসঙ্গিক সব কাজ সমাধা হয়ে গেলো। ঝকঝকে করে সাজানো হলো দোকান। সুলতান বললো, এবার তাহলে কাজ শুরু করে দাও। কিন্তু পয়সা না হলে কী করেই বা শুরু করবে? এই নাও, পাঁচ হাজার দিনার। এ দিয়ে রঙ, মসলাপত্র সব কিনে নাও। আমি পাঁচশো গজ কাপড় পাঠিয়ে দিচ্ছি-খুব ভালো করে বাহারী রঙ করে দেবে, বুঝলে?

আবু কাইর এতো টাকা এক সঙ্গে জীবনে দেখেনি। মোহরের থলেটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে বিনয়ে গদগদ হয়ে বলে, সে আবার বলতে, হুজুর! এমন রঙ করে দেবো, দেখে লোকে ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবে।

–লোকে যাক, কিন্তু আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো না তে, হে?

-কী যে বলেন, হুজুর। আমি তো আপনার কথা বলিনি।

সুলতান চলে গেলে আবু কাইর মোহরের থলে থেকে একটা মোহর বের করে থলেটা ভালো করে কোমরে জড়িয়ে বাঁধে। মনে মনে বলে, সুলতানটা কী আহম্মক। এক দিনার লাগবে না রঙ কিনতো–পাঁচ হাজার দিয়ে গেলো! বড় মানুষের পয়সা—যত ঠকিয়ে নেওয়া যায় ততই লাভ।

পরের দিনই সুলতান পাঁচশো গজ সাদা রেশমী কাপড় পাঠিয়ে দেয়। আবু কাইর নানা ধরনের সুন্দর রঙে রাঙিয়ে দোকানের সামনে ঝুলিয়ে দেয় কাপড়গুলো। পথের লোক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, এমন আজব চীজ তারা জীবনে কখনও দেখেনি। কাপড়ের এতো রঙ কী করে করা সম্ভব, ভাবতে পারে না তারা। এখানকার মানুষ জন্ম থেকে দেখে আসছে। মাত্র দুটি রঙ। সাদা আর নীল। হরেক রকম রঙের বাহার দেখে তাজ্জব বনে যায় শহরবাসী। অতি রক্ষণশীল বয়বৃদ্ধরা আশঙ্কা প্রকাশ করে, শেষ বিচারের দিন আসতে আর বাকী নাই। দুনিয়া এবার ধ্বংস হয়ে যাবে। তা না হলে এই সব ভূতুড়ে আজগুবি কাণ্ডকারখানা শুরু হচ্ছে। কেন?

উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কিন্তু বুড়োদের এই সব নাক-উঁচু কথায় আমল দেয় না। তারা বলে, দিন বদলাচ্ছে, মানুষের রুচি ও প্রয়োজন পালটাচ্ছে। নতুন নতুন কত কি আবিষ্কার হচ্ছে। এও একটা আবিষ্কার। তাতে দুনিয়া রসাতলে যাবে কেন?

সবচেয়ে খুশি হয় সুলতান নিজে। চল্লিশ রকমের রঙে রঙিয়েছে সে কাপড়গুলো। কোনওটা বেদানার দানার মতো, কোনওটা বা কমলা। আবার কোনওটা পাকা ন্যাসপাতির মত। কোনওটার রঙ চাপার কলির মতো। কোনওটা বা পারিজাত অথবা গোলাপ-সদৃশ। আকাশের নীল, সমুদ্রের গভীর নীল, কচি কলাপাতা, তাল পাতা, জাম আর জামরুল, জাফরান, দারুচিনি, কালোজিরে, পেস্তা, আখরোট বাদাম প্রভৃতি যত রঙ ভাবা যায়, সব রঙেই সে রাঙিয়েছে।

গর্বে বুক ফুলে ওঠে সুলতানের। এ আবিষ্কার যেন তার নিজেরই। অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সে কাপড়গুলো। উজিরকে বলে, কাপড়গুলো প্রাসাদে নিয়ে চলো। বেগমদের পরতে দাও। আর আবু কাইরকে আরও এক হাজার গজ কাপড় পাঠিয়ে দাও আজই।

কয়েকদিনের মধ্যে সে কাপড়গুলোও রঙ করে দিলো আবু কাইর। সুলতান খুশি হয়ে দশ হাজার দিনার ইনাম দিলো তাকে। সারা শহরে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেলো। উজির আমির ওমরাহেরা কাপড় পাঠাতে লাগলো। আবু কাইর চড়া দর হাঁকে। কিন্তু দামের কথা তখন আর কে চিন্তা করে। কিছুদিনের মধ্যেই আবু কাইর শহরের সেরা ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠলো। মোহরের যেন শিলাবৃষ্টি হতে লাগলো তার দোকানে। এতো টাকা সে রাখবে কোথায়?

শহরের অন্য সব রজকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে। তাদের দোকানে লোক ঢোকে না। শেষে একদিন রজক-সমিতির সেই বৃদ্ধ সভাপতি সদলে আবু কাইর-এর কাছে ক্ষমা চাইতে আসে।

—আমরা আপনাকে চিনতে পারিনি, সাহেব। আমাদের গোস্তাকি মাফ করে দিন। আমরা আপনার একান্ত অনুগত হয়ে আপনার অধীনে নোকরি করতে চাই। আমাদের কাজ দিয়ে বাঁচান। না হলে, বাল-বাচ্ছা নিয়ে না খেতে পেয়ে মারা যাবো।, কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করার বান্দা আবু কাইর নয়। বললো, এখন কেন এসেছ? কত কাকুতি-মিনতি করেছিলাম, তখন তো আমার কথা শোনওনি তোমরা। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। এখন কেন এসেছ হাত জোড় করতে? ওসবে আমার হৃদয় গলবে না। আমার দ্বারা কিছু হবে না। মানে মানে কেটে পড়।

এই সময় রাত্র প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো বিরানব্বইতম রজনী।

আবার সে শুরু করে।

আবু শাইর-এর যা কিছু সঞ্চিত অর্থ ছিলো সবই চুরি করে পালালো আবু কাইর। তখন . আবু শাইর জ্বরে চৈতন্য। তিন দিন তিন রাত্রি একইভাবে পড়ে রইলো সে। দেখার কেউ নাই, কে দেবে দাওয়াই, কে দেবে এক বিন্দু পানি! সরাইখানার মালিক অতটা খেয়াল করেনি, কিন্তু তিন দিনের মধ্যে কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। দেখে অবাক হয়ে আবু শাইর জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে, অথচ আবু কাইর পাশে নাই। ঘরের ভিতরে ঢুকে সে আবু শাইর-এর পাশে এসে বসে।

—কী হয়েছে শেখ, তোমার সাথী কোথায়?

আবু শাইর-এর গলা দিয়ে আধা-স্পষ্ট একটা আওয়াজ বের হয়, খোদা জানেন। আজ একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে। জানি না, কতকাল ধরে আমি এই ভাবে এখানে পড়ে আছি। বলতে পারবো না, আমার সঙ্গীটি কোথায় গেছে। জ্ঞান হওয়ার পর আমি আর তাকে দেখিনি এখানে। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, একটু পানি দেবেন, ভাইসাব? ওই যে ওখানে আমার যন্ত্রপাতির থলেটা দেখছেন—ওর মধ্যে আমার জমানো কিছু পয়সা আছে। যদি মেহেরবানী করে ওর থেকে পয়সা বের করে আমার জন্যে কিছু পথ্যের ব্যবস্থা করে দেন, খুব উপকার

হয়।

সরাইখানার মালিক যন্ত্রপাতির থলেটা নিয়ে এসে আবু শাইর-এর সামনে মেলে ধরে। আঁতিপাতি করে খুঁজেও কোনও পয়সার বটুয়া পাওয়া যায় না।

-কই গো শেখ, এর মধ্যে তো কিছু নাই। -নাই?

অত জ্বরের ঘোরেও আবু শাইর চঞ্চল হয়ে ওঠে, নাই কী? ওর মধ্যে যে আমার যথা-সর্বস্ব ছিলো?

সরাইখানার মালিক থলেটা উপুড় করে সব যন্ত্রপাতি মেজেয় ঢেলে দেয়, কই দেখ তোমার ক্ষুর কঁচি-টাচি ছাড়া তো কিছুই নাই!

আবু শাইর হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে। সে নিয়ে ভেগেছে। আমাকে পথে বসিয়ে গেছে। ইয়া আল্লা, এ কী হলো, এখন এই বিদেশ-বিভূই-এ বেঘোরে মারা যাবো যে।

সরাইখানার মালিক বললো, আমি থাকতে তোমার কোনও ভয় নাই, শেখ। বিনা চিকিৎসায় বা না খেতে পেয়ে তুমি মারা যাবে না। আমার সাধ্যমতো আমি করবো। কিছু ভেবো না। তোমার কষ্টের পয়সা চুরি করে কেউ সুখী হবে না। যাক, চোখের পানি মুছে ফেলো। আমি তোমার জন্য বার্লি তৈরি করে আনছি। মনে রেখ, আজ থেকে তুমি আমার সেবা-যত্নে থাকবে।তোমার কোনও অসুবিধে হবে না।

একটু পরে সে এক বাটি বার্লি আর মুরগীর ঝোল নিয়ে এসে বললো, নাও, খেয়ে নাও তো। অসুখ সারাতে গেলে দেহের মনের জোর থাকা দরকার। খানাপিনা না করলে দেহের গদ হবে কী করে? নাও ওঠ।

নিজের হাতে ধরে খুব যত্ন করে সে খাওয়ালো তাকে। তারপর ভালোভাবে শুইয়ে গায়ে চাদর চাপা দিতে দিতে বললো, আমি মাঝে মাঝেই এসে দেখে যাবো। তবুও যদি কখনও দরকার হয়, কোনও দ্বিধা না করে আমাকে ডাক দেবে, বুঝলে? আমি তো তোমার পাশেই আছি। হেকিমের কাছে যাচ্ছি, যা দাওয়াই পত্র তিনি দেন আমি তোমাকে খাইয়ে যাবো খন।

একটানা দুটি মাস সরাইখানার মালিকের অক্লান্ত সেবা-যত্নে সুস্থ হয়ে ওঠে আবু শাইর। খরচাপাতির কোনও কার্পণ্য করে না সে।

আবু শাইর-এর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে, আপনার এ ঋণ অমি পয়সা দিয়ে কখনও শোধ করতে পারবো না। আপনি আমার পুনর্জন্ম দিয়েছেন। তবে যতদিন বাঁচবো আপনার এই সেবা এই যত্ন এই আদর কোনওদিন ভুলবো না আমি। আজ আমার কিছু নাই। কিন্তু আল্লাহ যদি কখনও দিন দেয় আপনাকে আমার মনে থাকবে। অবশ্য পয়সা-কড়ি আপনার অনেক আছে ও সব কথা তুলে আপনার এই ভালোবাসাকে ছোট করতে চাই না।

সরাইখানার মালিক বলে, একমাত্র খোদাতালাকেই ধন্যবাদ জানাও শেখ। তিনিই তোমাকে আরোগ্য করে তুলেছেন। আমি তো নিমিত্ত মাত্র। আমি অন্তরে তার নির্দেশ পেয়েছিলাম বলেই তোমার দেখাশুনা করেছি। তিনিই আমাকে পাঠিয়েছিলেন।

আবু শাইর-এর চোখ জলে ভরে আসে। দুনিয়াটা শুধুই ঠগে ভরা নয়। ভালো মানুষও দু-চারটে আছে।

আরও কয়েকদিন পরে বেশ সুস্থ হয়ে উঠলে আবু শাইর ক্ষুর কাঁচি জড়িয়ে আবার বাজারের পথে বেরিয়ে পড়ে। রোজগারের ধান্দা দেখতে হবে। ঘুরতে ঘুরতে সে এক জায়গায় বহু লোকের জটলা দেখে সেইদিকে এগিয়ে যায়। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস। আবু কাইর-এর দোকানের সামনে শহরের লোক ভেঙ্গে পড়েছে। হরেক রকম রঙের কাপড় দেখার কৌতূহলে ছুটে আসছে মানুষ। কাপড়ে এতো বাহারী রঙ তারা এতোকাল ভাবতে পারেনি।

আবু শাইর-এর শরীর দুর্বল। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে পারে না। একজনকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, এতো জমায়েত কেন? কী হয়েছে এখানে?

লোকটা অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।—সে কি, সারা শহর তোলপাড় করে ফেলেছে। এই পরদেশী, কোনও খবর রাখ না কিছু?

আবু শাইর বলে, না ভাই, আমি বহুদিন বিমার ছিলাম। কিছুই জানি না। লোকটা বলে, আরে সব ব্যাটাকে কানা করে দিয়েছে। আবু কাইর নামে আলেকজান্দ্রিয়ার এক রজক এসে এখানে দোকান খুলেছে। তার হরেক রকম রঙের বাহার দেখে লোকে ললাকারণ্য। অন্য সব রজকের দোকান সাহারা হয়ে গেছে। একটা মাছি ঢোকে না এখন। আহা লোকটা যাদু জানে, তা না হলে কে কবে শুনেছে, নীল ছাড়া অবার রঙ হয়! আর ঐ দেখ, কত মজাদার রঙের কাপড় সব ঝুলছে। লোকে এই কাপড় ফেলে ঐ বস্তাপচা নীল রঙের কাপড় পরবে আর?

আবু শাইর দেখলো দোকানের সামনে নানা রঙের অসংখ্য কাপড় ঝুলান। আনন্দে উল্লাসে নেচে উঠলো তার মন। এখানে তাহলে আবু কাইর জোর ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। পয়সার থলেটা চুরি করে আবু কাইর তাহলে একটা কাজের কাজই করেছে। মুহূর্তের মধ্যে তার মন থেকে সব রাগ সব ক্ষোভ মুছে গেলো। যাক, আল্লাহ এতোদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। এবার তাদের দুঃখ দুর্দশার অবসান হবে।

আবু শাইর কোন রকমে ভিড় ঠেলে ঠেলে দোকানের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দোকানের ভিতরে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসেছিলো আবু কাইর। তার পিছনে দাঁড়িয়ে চারজন আজ্ঞাবহ হাবসী ক্রীতদাস চামর দোলাচ্ছে। দোকানের ভিতরে জনাদশেক কর্মচারী কাপড় রঙ করাতে ব্যস্ত।

আবু শাইর দু পা এগিয়ে যায় সামনে। আবু কাইর কিন্তু তখন আরাম-কেদারায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে চামরের হাওয়া খাচ্ছিল। আবু শাইর ভাবে, এ অবস্থায় ওর তন্দ্রা কাটানো বোধহয় ঠিক হবে না। এখানে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করা যাক। যখন সে চোখ খুলবে, নজর পড়লেই সে অবাক হয়ে যাবে।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো চুরানব্বইতম রজনীতে আবার সে শুরু করে।

হঠাৎ আবু কাইর সজাগ হয়ে দরজার দিকে তাকায়। ক্রোধে জ্বলে ওঠে তার চোখ। চোর বদমাইশ কোথাকার, এখানে এসে আমার দোকানে হানা দিয়েছ! দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি। এই লোকটাকে পাকড়াও। ব্যাটা মহাচোর।

আবু কাইর-এর হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাবসী নফরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে আবু শাইর-এর ওপর। দমাদ্দম কিল চড় ঘুষি চালাতে থাকে! ধোপাটা উঠে দাঁড়িয়ে একটা ছড়ি হাতে তেড়ে আসে, তোর এতো বড় সাহস দিন-দুপুরে এসেছিস আমার দোকানে চুরি করতে।

মেরে ছাল চামড়া খুলে নেব।

সপাং সপাং করে বেতের চাবুক কষাতে থাকে সে। কয়েক পলকের মধ্যেই যন্ত্রণায় নীল বর্ণ হয়ে যায় শাইর-এর দেহখানা। সবে এভোবড় অসুখ থেকে উঠেছে। গায়ে জুতসই বল হয়নি, তার উপর এই পাশবিক অত্যাচার। জোয়ান মদই সহ্য করতে পারে না, সে তো বয়সের ভারেই নুয়ে পড়েছে, তার এই রুগ্ন বার্ধক্য জর্জর দেহে এই আঘাত সে সইবে কি করে? আবু শাইর-এর অসাড় অচৈতন্য দেহখানা লুটিয়ে পড়ে গেলো।

আবু কাইর হাঁপাতে হাঁপাতে ছড়িখানা ছুঁড়ে ফেলে দেয়, ফের যদি কখনও তোকে এ-মুখো আসতে দেখি, সুলতানকে বলে জন্মের মতো হাজতে ঢুকিয়ে দেবো ঠগ জোচ্চোর কোথাকার।

তারপর হাবসীদের বললো, লোকটাকে রাস্তার ওপরে ফেলে দিয়ে আয়। আর ককখনো ব্যাটাকে এই মহল্লায় ঢুকতে দিবি না।

সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান ফিরে আসে আবু শাইর-এর। কোনও রকমে ব্যথা জর্জর দেহখানা টেনে নিয়ে সরাইখানায় ফিরে আসে। ভেঁড়া মাদুরের উপর শুয়ে সারা রাত ধরে কাতরায়।

সকাল বেলা অনেকটা সুস্থ বোধ করে আবু শাইর, রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। অনেক দিন বাদে আজ সে হামামে গোসল করবে। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে এখানকার হামামটা কোন দিকে, ভাই?

—হামাম? হামাম আবার কী?

লোকটা অবাক হয়ে আবু শাইরকে প্রশ্ন করে।

আবু শাইর বলে, কেন হামাম জান না? যেখানে সাধারণ মানুষে গোসল করে। আমাদের দেশে প্রতি মহল্লায় সরকার থেকে হামাম ঘর বানিয়ে দেয়। যাতে সাধারণ মানুষে অল্প পয়সায় গোসল করতে পারে।

নোকটা বললো, গোসল করার জন্যে দরিয়ায় দাও। যত খুশি প্রাণ ভরে ডুব। দিয়ে গোসল কর। হামাম আবার কী? আমরা সবাই তো দরিয়ার পানিতেই গোসল করি।

-কিন্তু দরিয়ার পানি তো নোনা। মিঠা পানি না হলে গোসল করা যায়? লোকটা অবোধের মতো বলে, কি জানি হামাম বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ। আমি তো বাপের জন্মে হামাম বলে কিছু শুনিনি। আমাদের যখন ইচ্ছে হয় আমরা দরিয়ায় যাই।

আবু শাইর এই প্রথম বুঝতে পারলো এদেশের লোক গোসলের বিলাসিতা বোঝে না। তারা ঠাণ্ডা পানি গরম পানি দিয়ে গোসল করার মজা কখনও অনুভব করেনি।

আবু সুলতানের দরবারে যায়। বিদেশী একজন দর্শন-প্রার্থী শুনে সুলতান তাকে ডেকে পাঠান। আবু শাইর সুলতানের সামনে এসে যথাবিহিত কুর্নিশ করে বিনম্র ভঙ্গীতে হাত জোড় করে দাঁড়ায়।

—সুলতান মহানুভব, আমি এক বিদেশী। সুলতানের দরবারে আমি এক আর্জি নিয়ে এসেছি।

—সুলতান বলে, বেশ বলো তোমার আর্জি।

আবু শাইর বলে, জাতে অমি নরসুন্দর। হামামের সব কাজ জানি। যদিও আমাদের দেশে একটা হামামে পানি গরম করার এবং গোসল করানোর লোক আলাদা আলাদা, কিন্তু আমি একাই সমস্ত কাজ জানি। জাঁহাপনা যদি অনুমতি করেন আমি একটা হামাম ঘরের দায়িত্ব নিতে পারি।

সুলতান অবাক হয়। অবাক হয় উজির আমির সকলেই। এমন তাজ্জব কথা শুনেছে নাকি কেউ। হামাম ঘর-গোসলখানা—সে আবার কী বস্তু?

সুলতান বলে, তোমার কথা বুঝলাম না পরদেশী। হামাম কাকে বলে?

আবু শাইর বলে, সে আমি বুঝতে পারছি, জাঁহাপনা। আপনি হামাম ঘর কখনও দেখেননি। সেখানে গোসল করার যে কী আনন্দ আপনার দেশের মানুষ তা জানে না। আজ সকালে আমি হামামে গোসল করবো বলে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমার কথা বুঝতেই পারালো না। তখন জানলাম আপনার দেশে হামাম বলে কিছু নাই। আপনার এতো বড় সুন্দর এই শহর, মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ব্যবস্থারই ত্রুটি রাখেননি আপনি, অথচ অবাক লাগে, কোনও হামাম নাই। পথশ্রান্ত মানুষ একটু জিরিয়ে নেবে, তারপর গা হাত পা ঘষে মেজে সাফ করে ঠাণ্ডা গরম পানি দিয়ে গোসল করে, শরীরটা ঝরঝরে চাঙ্গা করে তুলবে তার কোনও ব্যবস্থা নাই। হামাম ঘর সব সভ্যদেশের শহরের শোভা। যে শহরের হামাম ঘর যত সুন্দর আমরা সে-শহরের তত প্রশংসা করি। একটা শহরের হামাম ঘরে ঢুকলেই সে শহরের মানুষের পরিচ্ছন্নতা রুচি প্রকৃতির পরিচয় পাই। এক কথায় বলতে গেলে, আধুনিক মানুষের জীবনে হামামই বেহেস্ত। সারাদিনের খরতাপে দগ্ধ হয়ে দুদণ্ডের শান্তি এনে দিতে পারে শুধু হামামই।

সুলতান বলে কিন্তু তোমার কথায় তো কিছু ঠাওর করতে পারছি না পরদেশী। কি এমন চীজ যাকে তুমি বেহেস্তের সঙ্গে তুলনা করছ?

আবু শাইর বোঝাতে থাকে, জাঁহাপনা, হামাম ঘর কী ভাবে বানাতে হয় বলছি শুনুন! একখানা বড় ইমারতবিশেষভাবে হামামের জন্যেই তৈরি করা হয়। তাতে থাকবে বিশ্রাম করার বড় জায়গা। গোসলের পর সাজ-পোশাক প্রসাধনের ঘর। আর থাকবে খানা-পিনার কামরা। মোট কথা একটা মানুষ তেতে পুড়ে সেখানে ঢুকে আগে খানিকটা বিশ্রাম করে নিজেকে ঠাণ্ডা করে নেবে। তারপর গোসল সেরে সাজ-পোশাক পালটে প্রসাধন করে অল্প কিছু হালকা সরবৎ পানি খেয়ে ঝরঝরে তাজা হয়ে বেরুতে পারবে। হামামে গোসল করাবার লোক ভাড়া পাওয়া যায়। তাদের কাজ সাবান ছোবড়া দিয়ে খদ্দেরের সারা শরীরের ময়লা সাফ করে দেওয়া। তারপর সুগন্ধী পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দেয় তারা। মেয়েদের জন্য মেয়ে এবং মর্দদের জন্য পুরুষ মানুষ ভাড়া পাওয়া যায়। হামামের বিশ্রামাগারে নাপিত বসে থাকে। যদি কেউ চুলদাড়ি কামাতে চায় কমিয়ে দেবে সে! তার জন্যে সামান্যই দক্ষিণা দিতে হয়। আপনি যদি আগ্রহ দেখান আমি আপনাকে আরও নিখুঁতভাবে সব বুঝিয়ে দিতে পারি, জাঁহাপনা।

সুলতান মুগ্ধ বিস্ময়ে আবু শাইর-এর কথা শুনছিলো এতক্ষণ।

—বড় আজব ব্যাপার। ঠিক আছে আমি রাজি। আজ থেকেই তুমি কাজে লেগে যাও পরদেশী! তোমার যা যা দরকার, আমি উজিরকে বলে দিচ্ছি, সব তোমাকে জোগান দেবে সে।

আবু শাইর বলে, আপনার রাজমিস্ত্রিকে ডাকুন। আগে আমি হামামের জন্য কি ভাবে ইমারত বানাতে হবে তাকে বুঝিয়ে দেব।

সেইদিনই সুলতানের হুকুমে রাজমিস্ত্রীরা হাজির হলো। আবু শাইর হামামের নক্সা এঁকে তাদের বুঝিয়ে দিলো—কী ভাবে কী ধরনের ইমারত বানাতে হবে।

সুলতান আবু শাইর-এর থাকার জন্য একখানা বড় বাড়ি কয়েকজন চাকর নফর দাসী, দামী দামী আসবাব পত্র, সুন্দর সুন্দর খচ্চর গাধা ঘোড়া, বাহারী সাজ-পোশাক আর প্রচুর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দিলো।

হামামঘরের জন্য শহরের ঠিক মাঝখানে এক জায়গা নির্বাচন করা হলো। সেখানে বানানো হবে আবু শাইর-এর নক্সা মত একখানা ইমারত।

দিনরাত খেটে মিস্ত্রীরা কয়েক দিনের মধ্যে একখানা বিশাল ইমারত বানিয়ে দিলো। আবু শাইর নিজের পছন্দ মতো আসবাবপত্রে সুন্দর করে সাজালো সেই হামামঘর।

সাজানো-গোছানো শেষ হলে সুলতানের কাছে গিয়ে সে বললো, জাঁহাপনা আপনার হামাম তৈরি হয়ে গেছে। মেহেরবানী করে আপনি একবার পায়ের ধুলো দেবেন, চলুন।

সুলতান হামামে এসে খুশিতে উপচে পড়ে। এমন চমৎকার বস্তু যে মানুষ কল্পনা করতে পারে ভাবতে পারে না সে। ঘরের ভিতরে পা দিতেই এক অপরূপ প্রশান্তিতে ভরে যায় মন-প্রাণ। সত্যিই, আরামের জায়গা।

আবু শাইর বললো, সবই হয়ে গেছে, এখন আমার কিছু কর্মচারী চাই, হুজুর।

সুলতান বললো কী কী ধরনের কর্মচারী চাও, বলো। আজই আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

—জনা কুড়ি তাগড়াই হাবসী ছোকরা চাই—এরা ডলাই-মলাই করে গায়ের ময়লা সাফ করবে। কী করে করতে হবে আমি তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে নেব।

-এ আর বেশি কথা কী। আমার প্রাসাদ থেকে এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। আর কী চাই বলো?

-আর বিশেষ কিছু না, কিছু দামী সুগন্ধী আতর, গোলাপ নির্যাস, কিছু তুরস্কের তোয়ালে, সাবান ইত্যাদি।

সুলতান বললো, ও সব তোমার পছন্দ মতো বাজার থেকে কিনে নেবে। এই রাখো দশ হাজার দিনার-হবে তো?

-এতো কী হবে, জাঁহাপনা।

—যা লাগে লাগবে, বাকীটা তোমার বকশিশ।

 

আবু শাইর কুর্নিশ জানায়, জাঁহাপনার অসীম দয়া।

সুলতান বললো একটা ভালো দিনক্ষণ দেখে শুভ উদ্বোধন করো। আমি হবো তোমার প্রথম খদ্দের, কী, রাজি?

আবু শাইর বিনয়াবনত হয়ে বলে, আমি দিনক্ষণ দেখে আপনাকে জানাবো, হুজুর।

সারা শহরে লোকের মুখে মুখে একই কথা উচ্চারিত হতে থাকে, এক পরদেশী আজব জিনিস বানিয়েছে—গোসলখানা। স্বয়ং সুলতান সেখানে আসবেন গোসল করতে। দলে দলে মানুষ এসে জড়ো হতে লাগলো হামাম ঘরের সামনে। বিশাল পেল্লাই ইমারত। আগাগোড়া শ্বেত পাথরে তৈরি। নানা কারুকার্য করা। বাইরে থেকে দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ভিতরে না জানি কী আছে। সুলতান আজ গোসল করবেন এখানে। তারপর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই হামাম। তখন সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারবে ভিতরে।

সকালে উঠেই আবু শাইর উনুনে চাপিয়েছে পানি। গরম পানি ঠাণ্ডাপানি দুই-ই লাগে গোসলের সময়। সদর ফটকে শানাই বসানো হয়েছে। মালিকে বলা ছিলো, নানা রকম বাহারী ফুলে সাজিয়ে দিয়ে গেছে সারা হামামঘর।

উজির আমির বয়স্যদের নিয়ে সুলতান এলো গোসল করতে। সামনে পিছনে সেনাপতিরা ভিড় সরাতে ব্যস্ত। সুলতান সদর ফটকে পা দিয়েই চমকে ওঠে।

–আঃ, কী মজাদার খুশবু।

যুঁই ফুলের সৌরভে মদির হয়ে গেছে চারদিক। আবু শাইর কুর্নিশ জানিয়ে বললো, আজ জাঁহাপনার গোসলের পানিতে যুঁই-এর আতর মেশানো হয়েছে।

অন্দরে গোসলঘরে জলের ফোয়ারায় আতর দেওয়া হয়েছে। তার সুবাসে সারা বাড়ি ভরপুর! সুলতানকে সাদর অভ্যর্থনা করে বিশ্রামাগারে নিয়ে যায় আবু শাইর। দেওয়ালের চারপাশে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা নগ্ন নিরাবরণ নারী-পুরুষের জলকেলি এবং রতিরঙ্গের দৃশ্যবলী। ঘরের ঠিক মাঝখানে বিরাট শ্বেত পাথরের গোলাকৃতি মেজ। সেই মেজ-এর উপরে ডাবর-সদৃশ একটা কারুকার্যখচিত রূপোর ফুলদানিতে এক ঝাড় নানা বর্ণের সুন্দর ফুল। ঘরের চারপাশে আরামকেদারা, কুর্শি, পালঙ্ক।

সুলতানকে পালঙ্কে বসিয়ে নিরাবরণ করলো আবু শাইর। দু’খানা বড় বড় তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর মুড়ে দিলো তার। বললো, এবার মেহেরবানী করে গোসল ঘরে চলুন, জাঁহাপনা।

সুবোধ বালকের মতো সুলতান আবু শাইরকে অনুসরণ করে পাশের কামরায় চলে যায়। ধবধবে সাদা মসৃণ শ্বেত পাথরের মেজেয় শুইয়ে দেয় সুলতানকে। তারপর দুটি ছোকরা বান্দার সাহায্যে আবু শাইর সুলতানের সারাদেহ পানি সাবান আর ছোবড়া দিয়ে আচ্ছা করে সাফ করে। বহুকালের সঞ্চিত ক্লেদ ঘষা মাজায় সাফ হয়ে যায়। ঠাণ্ডা-গরম পানি মিশিয়ে সুলতানকে নিজে হাতে গোসল করায় আবু শাইর।

স্নান পর্ব শেষ করে নতুন সাজ-পোশাক পরে যখন সরবতের টেবিলে এসে বসে মনে হয় তার দেহের ওজন বুঝি শূন্য হয়ে গেছে। ইচ্ছে হয়, ডানা মেলে দুর নীল নভে উড়ে চলে যায়। স্নানের যে এতো অপার আনন্দ, এর আগে কখনও অনুভব করেনি সুলতান। খুশিতে ভরে যায় দেহ মন প্রাণ। আবু শাইর আজ তাকে নতুন জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছে। এর বিনিময়ে কী মূল্য তাকে দেবে সে? আবু শাইর এক গেলাস পেস্তার সরবত এনে সামনে ধরে। আঃ কী সুন্দর সুবাস। সরবতে চুমুক দিয়ে সুলতান বলে, আজ যে সুখ বিলাসের সন্ধান তুমি দিলে আবু শাইর তা আমার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। এখন বললো, কী ইনাম তুমি চাও।

আবু শাইর মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও কথা বলে না।

-না না, চুপ করে থাকলে হবে না, আবু শাইর, বলো তুমি কী চাও।

আবু শাইর মৃদু কণ্ঠে বলে, আমার কিছুই চাইবার নাই, জাঁহাপনা। হুজুরের ভালো লেগেছে, এ-ই আমার সব চাইতে বড় পুরস্কার।

শুধু সুলতান নয়, উজির আমির বয়স্যসকলেই অবাক হয়ে তাকায় আবু শাইর-এর দিকে। লোকটা বলে কী? স্বয়ং সুলতান তাকে দিতে চাইছেন। যা মুখ ফুটে চাইবে তাই সে পেতে পারে। এক মুহূর্তে সে লক্ষপতি হতে পারে। অথচ বলে কিনা—চাইবার কিছুই নাই!

সুলতান বলে, এ তুমি কি বলছো, আবু শাইর! তুমি যদি আমার কাছে কিছু চাইতে, তা সে যত মূল্যের হোক, আমি দিতাম। কিন্তু কিছুই না চেয়ে তুমি আমাকে অনেক বেশি দেনার অঙ্গীকারে বেঁধে ফেললে। তোমার মতো বিচক্ষণ বুদ্ধিমান মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। যাক, তুমি যখন দেশে ফিরে যাবে সেই সময় তোমাকে আমি আমার সাধ্যমতো ইনাম দেবো-খুশি হয়ে নিয়ে যেও, কেমন?

আবু শাইর বলে, সুলতান মহানুভব, এর চাইতে ভালো আর কী হতে পারে, জাঁহাপনা।

সুলতান বলে, আচ্ছা আবু শাইর তোমার হামামে যারা গোসল করতে আসবে তাদের কাছ থেকে কী নেবে তুমি।

—জাঁহাপনা, যদিও এই আমার রুজি-রোজগারের পথ, তবুও ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষকে দুদণ্ডের শাস্তি দেওয়াই এর আসল উদ্দেশ্য। লোক খুশি হয়ে যে যা আমাকে দিয়ে যাবে তাই

আমি মাথা পেতে নেবো হুজুর। আমার কোনও দাবি নাই।

সপারিষদ সুলতান আর একবার চমকে ওঠে। সত্যিই লোকটা অসাধারণ। উজির বলে, আচ্ছা ধর লোকে যদি এসে গোসলাদি সেরে পয়সা না দিয়েই চলে যায়—

আবু শাইর মুচকি হাসে, বেশ কাল আপনি আসবেন, আপনাকে দিয়েই তার পরীক্ষা হয়ে যাবে।

সুলতান সহ পারিষদরা সকলে হো হো করে হেসে ওঠে। সুলতান বলে, কী উজির, তোমার হোতা মুখ ভোতা করে দিয়েছে তো আবু শাইর। আমার সারা সলতানিয়তে তোমার চেয়ে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান আর কেউ নাই বলে তুমি আমার পরমর্শদাতা—উজির। কিন্তু আজ তুমি সামান্য এক নাপিতের কাছে হেরে গেলে?

উজির বলে, আমার চাইতে যে বিচক্ষণতার কাছে নতি স্বীকার করতে আমার কোনও লজ্জা নাই, জাঁহাপনা।

সুলতান হাসতে হাসতে বলে, এরজন্যে দশ হাজার দিনার জরিমানা হলো তোমার। টাকাটা পাবে আবু শাইর। আর যাবে আমার খাজাঞ্জিখানা থেকে। খাজাঞ্জিকে হুকুম দিয়ে দিও।

সবাই আমোদে হাসতে থাকে।

পর পর তিনদিন সাধারণের জন্য বিনামূল্যে হামামের দরজা উন্মুক্ত করে দিলো আবু শাইর। লোকে আসুক, দেখুক-হামাম ঘর কী বস্তু। তারপর তারাই পাঁচজনের মধ্যে প্রচার করবে এর গুণগান।

আবু শাইর-এর এই চালে কয়েকদিনের মধ্যেই সারা শহরের সমস্ত মানুষ জেনে গেলো হামামের মহিমা। যারা গোসল করে গেলো, তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আত্মীয়-স্বজন ইয়ার-বন্ধুদের পাঠাতে থাকলো। ফলে, প্রতিদিন সকাল থেকেই হামামের সামনে বিরাট ভিড় জমতে লাগলো। আবু শাইর বললো, সবাই সমান সুযোগ পাবেন। আপনারা মেহেরবানী করে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান।

বাঁধাধরা পয়সা দেবার কোনও ব্যাপার না থাকায় যার যা খুশি ইনাম দিয়ে যেতে লাগলো। এতে গরীব লোকরা যেমন অল্প পয়সায় আরাম আনন্দ পেতে থাকলো, বড়লোকরা তেমনি খুশি হয়ে আবু-শাইর-এর ঝুলি ভরে দিয়ে যেতে লাগলো। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আবু শাইর শহরের এক সেরা ধনী হয়ে উঠলো।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

চারশো ছিয়ানব্বইতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয়।

শহরের উজির আমির সম্রান্ত সওদাগররা সকলেই হামামের নিয়মিত খদ্দের। তারা যতবারই গোসল করতে আসে আবু শাইরকে একশোটা সোনার মোহর একটি ফর্সা এবং একটি হাবসী বান্দা উপহার দিয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে একটি করে বাঁদীও দিয়ে যায় তারা। কয়েক দিনের মধ্যে আবু শাইর পেলো চল্লিশটা ফর্সা, চল্লিশটা হাবসী বান্দা আর চল্লিশটা বাঁদী। এছাড়া সুলতান তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, দশটা ফর্সা ছোকরা, দশটা হাবসী ছোকরা বান্দা, আর দশটা চাদের মতো সুন্দরী বাদী পাঠালো।

আবু শাইর সুলতানের কাছে গিয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, আপনি মেহেরবান শাহেনশাহ। আপনার অসীম কৃপায় আজ আমার অনেক হয়েছে। কিন্তু জাঁহাপনা, আমি এই বান্দা আর বাঁদীর বাহিনী নিয়ে কী করবো! গরীব মানুষ, খেটে খাই, এতোগুলো লোককে বসে বসে খাওয়ানোর সামর্থ্য নাই আমার। সামর্থ্য থাকলেও প্রয়োজন নাই। আমি তো আর লড়াই করতে যাবো না করো সঙ্গে! আপনি ওদের ফেরত নিয়ে নিন, এই আমার আর্জি।

সুলতান বললো, এ সবই তো সম্পত্তি। যার ঘরে যত দাসদাসী বান্দা নফর থাকে, তাকেই আমরা তত বিত্তবান মনে করি। তোমার কাছে যদি এসব বোঝা বলে মনে হয়, কিছু চিন্তা করো না, যখন তুমি দেশে ফিরে যাবে, আমাকে সব দিয়ে যেও। আমি ন্যায্য দামে কিনে নেবো ওদের।

আবু শাইর বলে, দামের কোনও কথা ওঠে না, জাঁহাপনা। আমি ওদের আপনার প্রাসাদে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার ওসব ঝামেলা সহ্য করার অভ্যাস নাই।

সুলতান হাসলেন, তা ঠিক। তুমি সদাশয় নিঝঞাটে থাকতে চাও। বেশ ওদের পাঠিয়ে দাও। আমি প্রত্যেকটির জন্য একশো দিনার দাম দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।

আবু শাইর স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি হুজুর।

সুলতান খাজাঞ্চীকে ডেকে বলে দিলো, একশো দিনার হিসাবে একশো পঞ্চাশটা বান্দা বাদীর দাম দিয়ে দাও আবু শাইরকে।

আবু শাইর দু’হাতে পয়সা লুঠতে থাকলো। এতো পয়সা সে কী করবে? মোহরগুলো বস্তাবন্দী করে একটা ঘরে পরপর সাজিয়ে রাখতে লাগলো। কিছুকালের মধ্যে এতো বস্তা জমে উঠলো যে, ঘরে আর রাখার জায়গা হয় না।

হামামের প্রবেশ দ্বারের এক পাশে বিরাট একটা বাক্স। গোসল শেষে যে যা ইচ্ছা করে সেই বাক্সে ফেলে দিয়ে চলে যায়। আবু শাইর রাত্রি বেলায়, হামামের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, বাক্সটা খুলে দেখে, দিরহামে একেবারে ভর্তি। এইভাবে প্রতিদিন পয়সার পাহাড় জমতেই থাকে। আবু শাইর ভেবে পায় না, এতো অর্থ নিয়ে সে কী করবে?

সুলতান, বেগম, উজির আমিররা নিয়ম করে প্রতিসপ্তাহে একদিন হামাম ঘরে আসে। প্রতিবারই মোটা দক্ষিণা পায় আবু শাইর।

এতো অর্থ, এতো বাদশাহী খাতির, কিন্তু আবু শাইর-এর কোনও অহঙ্কার নাই। আগেও যেমন ছিলো, এখনও সে তেমনি সদাশয় পরোপকারী। চালে-চলনে, পোশাকে-আশাকে না, এমনকি খানা-পিনাতেও সে অনাড়ম্বর একেবারে সাদাসিধে মানুষ। কোথাও কোনও পরিবর্তন হয়নি। অভুক্ত মানুষ দেখলে এখনও তার মন কাঁদে। পরের উপকারে আসতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করে সে। এখনও সে আগের মতোই গল্পবাজ, আড্ডা-প্রিয়, সদা উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মানুষ। তার এই দিল দরিয়া ব্যবহারের জন্য একবার সে কী ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছিলো সে কাহিনী পরে শোনাচ্ছি। শুধু এইটুকু এখন শুনে রাখুন, একদিন এক জাহাজোর কাপ্তান এসেছিলো তার হামামে। ঘটনা চক্রে তার কাছে। কোনও পয়সা কড়ি ছিলো না। আবু শাইর তাকে, কোনও রকম পয়সার তোয়াক্কা না করে, খুব যত্ন করে ঘষে মেজে গোসল করিয়ে দিয়েছিলো। কাপ্তান খুব খুশি হয়ে চলে গিয়েছিলো সেদিন। বলে গিয়েছিলো, আল্লাহ যদি কখনও সুযোগ করে দেয়, আমি তোমার এই সদ্ব্যবহারের প্রতিদান দেবো, শেখ। সারা জীবন আমি তোমাকে মনে রাখবো।

আপনারা এর পরের কাহিনী পরে শুনবেন। এখন পরম বন্ধু আবু কাইর-এর কথা শুনুন:

সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে হামামের প্রশংসা। আবু কাইর একদিন এলো গোসল করতে। শহরের সব বিত্তবানরাই গোসল করে যায়। তারা কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে, হামামে সে গোসল করেছে কিনা। আবু কাইর সময় পাই নি, পরে যাবো’ বলে বলে এড়িয়ে আসছিলো। কিন্তু আর চুপ করে থাকা যায় না। যায় যাবে শ’খানেক দিনার, তবু তাকে হামামে যেতেই হবে। নইলে সমাজে ইজ্জৎ থাকে না। তাই আজ এসেছে সে গোসল করতে।

পরনে জমকালো বাদশাহী সাজ। বাহারী জীন লাগামে খচ্চরটাকে সাজিয়ে তার পিঠে চেপে এসেছে আবু কাইর। সামনে পিছনে বান্দাদের এক বাহিনী। সারা পথ তারা সেলাম ঠুকতে ঠুকতে আবু কাইরকে তোয়াজ করতে করতে নিয়ে এসেছে।

হামামের দরজার সামনে পৌঁছতেই এক সুন্দর সুবাস ভেসে আসে তার নাকে। চন্দনের গন্ধ। আবু কাইর লক্ষ্য করে, দলে দলে লোক ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। কিন্তু কোনও হুড়োহুড়ি বিশৃঙ্খলা নাই। একজনের পাশে এসে আর একজন বসে অপেক্ষা করছে। একের পর এক সবাই গোসল করার সুযোগ পাবে। গরীব বড়লোক কোনও ভেদাভেদ নাই। সকলের সমান মর্যাদা, সমান সুযোগ।

বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করতেই আবু কাইর দেখতে পেলো, একধারে একটা কুর্শিতে বসে আছে তার পুরনো দোস্ত আবু শাইর। মুখে তার সহজাত মিস্টি হাসি। আবু কাইর বিশ্বাস করতে পারে না, এই সেই আবু শাইর। রোগা হাড় জিরজিরে চেহারা ছিলো তার, কিন্তু এখন সে দিব্যি নাদুস নুদুস হয়ে উঠেছে। আপেলের মতো সুন্দর গালে যেন রক্ত ফেটে পড়ছে। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু দেহের চেকনাই-এ খোলতাই হয়ে গেছে তার রূপ।

কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো তারপর দারুণ উচ্ছ্বাসের ভান করে সে এগিয়ে এলো আবু শাইর-এর দিকে।

—আরে—আরে তুমি? আবু শাইর? এখনও বেঁচে আছো? আচ্ছা লোক যাহোক, তোমার এই অপদার্থ বন্ধুটি বেঁচে রইলো কি মরে গেলো, একবার খোঁজও নিলে না। একেইবলে আজব দুনিয়া—না? তুমি হয়তো বলবে, এতো বড় শহর, কোথায় আমার খোঁজ করবে? কিন্তু সে কথা কি ঠিক? সারা শহরের প্রতিটি মানুষ আজ আবু কাইর-এর নাম জানে। আমি এখন সুলতানের রজক। এ দেশে রঙের বন্যা এনে দিয়েছি। এখানকার মানুষ আগে সাদা আর নীল ছাড়া অন্য কোনও রঙের ব্যবহার জানতো না। কিন্তু আমি তাদের নানা রঙে রাঙিয়ে তুলেছি। তারাও আমাকে মাথায় করে রেখেছে। আজ শুধু আমার পয়সাই হয়নি, নাম যশ খ্যাতি প্রতিপত্তিতে আজ আমার জুড়ি নাই। কোনও উৎসব অনুষ্ঠান আমাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। সুলতানের দরবারে একমাত্র আমারই অবাধ গতি। আমি যখন তখন তার সঙ্গে দেখা করতে পারি। কেউ কোনও টু শব্দটি করতে পারবেনা। এমন কি স্বয়ং উজিরও আমার নাম শুনলে ভয়ে কাঁপে। আমার ইচ্ছায় সুলতানকে দিয়ে করতে না পারি এমন কোনও কাজ নাই।

আমার যখন সুদিন ফিরলো, বিশ্বাস কর দোস্ত, সব আগে তোমার কথাই আমার মনে হয়েছিলো। চার দিকে চর পাঠালাম। সারা শহরের গলিঘুচি, সরাইখানা মুসাফিরখানা-সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছে তারা। কিন্তু কেউই তোমার কোনও সন্ধান দিতে পারে নি।

আবু শাইর হাসে, অবিশ্বাসের হাসি। বলে, কিন্তু বন্ধু আমি তো তোমার দোকানের দরজায় গিয়েছিলাম। সেদিন তুমি আমাকে যে ভাবে আদর অভ্যর্থনা করেছিলে, তা তো ভুলবার নয়।

-কী যা তা বলছে, দোস্ত। তুমি আমার দোকানে কবে গিয়েছিলে?

সে খুব বেশি দিনের কথা নয়। এই হামাম ঘর তৈরি হওয়ার কিছুদিন আগে। দুটি মাস আমি বিমারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ঐ সরাইখানার মালিক না থাকলে মরেই যেতাম। তোমার ঠিকানা পেতেও বেগ পেতে হলো না। কিন্তু ঠিকানা না পেলেই বুঝি ভালো হতো—

আবু শাইর-এর চোখ জলে ভরে আসে। সেদিন সবে আমি পথ্য করেছি। গায়ে এক ফেঁটা বল নাই, কোনও রকমে পথে পা ফেলে চলতে পারি, সেই রোগ-জর্জর অবস্থায় সেদিন তুমি আমাকে চুরির অপবাদ দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিলে আবু কাইর। কী, ভুলে গেছ?

আবু কাইর যেন আকাশ থেকে পড়ে।—কী যা তা বলছো ভাই?

—যা তা নয় আবু কাইর, বুকে বড় ব্যথা নিয়ে বলছি এসব কথা। সেদিন তুমি আমার ওপর তোমার হাবসী বান্দা লেলিয়ে দিয়েছিলে বন্ধু!

—অসম্ভব। তুমি আমার দোকানে গেছ, আর আমি চিনতে পারবো না?

-কেন চিনতে পারবে না ভাই? তুমি আমাকে, অসুখে যত ক্ষীণ কৃশকায়ই হয়ে থাকি, দেখামাত্র চিনেছিলে।

বিশ্বাস করো, আবু কাইর মিথ্যা অনুতাপের ভান করে বলতে থাকে, আমি চিনতে পারিনি। কত চোর ছাচোড় দোকানের সামনে থেকে কাপড়-চোপড় চুরি করে সরে পড়ে তুমি জান না। সেই কারণে আমার লোকজনকে বলা আছে, ভিখিরি টিখিরি জাতের কোনও লোককে দোকানের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। ওরাই বেশি চোর হয়। এ তা তোমার তো তখন খুব দৈন্যদশা। হয়তো ওরা ভুলটুল করে থাকবে। তুমি কিছু মনে করো না, ভাই।

আবু শাইর কঠিন কণ্ঠে বলে, না, ভুল কেউ করেনি। তোমার বান্দারাও করেনি তুমিও করোনি! তুমি জেনে শুনেই তোমার লোককে হুকুম দিয়েছিলে আমার ওপর চড়াও হতে। তোমার আশঙ্কা হয়েছিলো, আমি তোমার লাভের ব্যবসায় ভাগ বসাতে চাইবো। তাই সেই মুহূর্তেই পথের কাটা সরিয়ে দিতে বেতের চাবুক নিয়ে ছুটে এসেছিলে তুমি। এই দ্যাখো, এখনও কোন দাগই মিলায়নি, কি নির্মমভাবে তুমি আমাকে সেদিন প্রহার করেছিলে, ভাই। কী করে হাত উঠেছিলো তোমার?

আবু কাইর একমুহূর্ত কোনও কথা বলতে পারে না। দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকে, ইস এতোবড় ভুল আমি করেছি, দোস্ত। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কী করে আবু শাইর-এর বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না, লোকটা এখনও তাকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে।

–যাক ভাই, ওসব কথা। যা গেছে তা গেছে। ওনিয়ে আর আমার কোনও ক্ষোভ নাই। হ্যাঁ চলো, গোসল করবে তো?

আবু কাইরকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায় আবু শাইর।

রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

চারশো আটানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

আবু কাইর জিজ্ঞেস করে তোমার এই ভাগ্য পরিবর্তন কবে হলো? কী ভাবে হলো?

আবু শাইর বলে, আল্লাহ যখন যাকে দেয়, ছল্পর কুঁড়েই দেয়। কোনও কারণ থাকে না তার।

এরপর সে আদ্যোপান্ত সমস্ত কাহিনী খুলে বললো তাকে। আবু কাইর মনের জ্বালা চেপে মুখে খুশির বন্যা ভাসিয়ে বলে, সুলতান যে তোমার উপর সদয় হয়েছেন এতে আমার চেয়ে আর কেউই এতো খুশি হতে পারবে না দোস্ত। আমি সুলতানকে তোমার গুণের কথা শোনাবো। বলবো, তুমি আমার শুধু স্বদেশবাসীই নয়, একেবারে জীগরী দোস্ত। দেখো, তাতে তিনি তোমাকে আরও সুনজরে দেখবেন।

আবু শাইর বলে, আমি কিন্তু একমাত্র আল্লাহর ওপরেই ভরসা রাখি, ভাই। আজ আমার যা কিছু ধন-দৌলত, সে সবই তাঁর কৃপায়। আমি বিশ্বাস করি, তিনি কেড়ে নিতে চাইলে, স্বয়ং বাদশাহও আমাকে সুখে রাখতে পারবেন না। আর তিনি যদি দরাজ হাতে আমাকে দিতে চান, সাধ্য নাই কারো আমার সুখ সম্পদ কেড়ে নিতে পারে। সুতরাং ওসব কথা থাক। সবই নসীবের লেখা। কেউ তা এড়াতে পারবে না।

আবু কাইরকে নিরাবরণ করে তোয়ালে জড়িয়ে সে গোসলখানায় নিয়ে যায়। নিজে হাতে তাকে সাবান ছোবড়া দিয়ে ঘষেমেজে সাফ করে গোসল করায়। তারপর প্রসাধন কামরায় নিয়ে এসে সাজ-পোশাক পরিয়ে দামী সরবৎ খেতে দেয়।

সাধারণ মানুষ দেখলো সুলতানের পেয়ারের রজককে হামামের মালিক স্বয়ং তোয়াজ করে গোসল করাচ্ছে। একমাত্র সুলতান ছাড়া, দ্বিতীয় কোনও মানুষকে সে নিজে হাতে কখনও গোসল করায় না।

আবু কাইর যাবার সময় আবু শাইরকে একটা মোহরের তোড়া দিতে যায়। আবু শাইর গ্রহণ করে না, তোমার একটুও লজ্জা হলো না আবু কাইর। তোমার আমার সম্পর্ক কি পয়সার? সামান্য এই পয়সা দিয়ে আমাদের বন্ধুত্বে ইতি করতে চাও?

-না ভাই তা কেন চাইবো। তোমার আমার বন্ধুত্ব চির-জীবনের। যাক ওসব কথা, তোমার হামামের সব ব্যবস্থাই চমৎকার। শুধু একটি খুৎ চোখে পড়লো।

-কী বলে?

—তোমার খদ্দেরদের চুল দাড়ি কামাবার সময় নরম কাই লাগিয়ে নাও না কেন? তাতে যেমন মোলায়েম করে কামানো যায়, তেমনি আরও আরাম পেতে পারে মানুষ। আমি তোমাকে এই কাই তৈরি করার কায়দা-কানুন সব বলে দিতে পারি।

-বাঃ চমৎকার বলেছে তো। আমিও ভাবছিলাম। কিন্তু এদেশে শখের জিনিস বড় একটা পাওয়া যায় না। তা বানাবার মাল-মসলা আর কায়দা যদি বাৎলে দাও; আমি বানিয়ে নেবো!

আবু কাইর বলে, তুমি বাজার থেকে হলদে রঙের সেঁকো বিষ আর কড়া চুন কিনে আনবে। একটু তেলের সঙ্গে এই দুটো খুব ভালো করে মেড়ে নেবে। তারপর দেবে খানিকটা আতর। তাহলে বদ গন্ধটা কেটে যাবে। তৈরি হয়ে গেলে মাটির ভাড়ে.ভরে রাখবে। এসব বিশেষ ধরনের প্রসাধন সাধারণ মানুষের জন্য নয়, যখন সুলতান আসবেন গোসল করতে শুধু তারই মুখে মাথায় মাখিয়ে কামাবে। দেখবে, তিনি কত খুশি হন। তোমাকে একেবারে। মাথায় করে রাখবেন।

আবু শাইর একখানা কাগজে সব লিখে রাখলো, আমি আজই তৈরি করে রাখছি। সুলতান প্রত্যেক জুম্মাবারে আমার হামামে আসেন চুল দাড়ি কামিয়ে গোসল করতে।

আবু কাইর আর দাঁড়ালো না। হামাম থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলো সুলতানের দরবারে।

—কী সংবাদ রজক-প্রবর? এসো, এসো—

সুলতান স্বাগত জানায় আবু কাইরকে। আবু কাইর বলে জাঁহাপনা বড়ই দুঃসংবাদ।

—সে কী? কী ব্যাপার?

—আপনার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সুলতান এবং দরবারের সকলে এক সঙ্গে আঁৎকে ওঠে, সে কী?

আবু কাইর মুখে কপট গাম্ভীর্য টেনে বলে, হ্যাঁ, হুজুর, আমার খবর মিথ্যা নয়। আপনাকে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি, ভুলেও আর কখনও আপনি ঐ হামামে গোসল করতে যাবেন না।

-কেন? কেন?

—আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। আপনার দেহে গেঁকো বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে আপনাকে খতম করবে আবু শাইর। ঐ মারাত্মক বিষ কড়া চুন দিয়ে সে কাই তৈরি করে রেখেছে। আপনি গেলেই আপনার মাথায় মুখে মাখিয়ে চুল দাড়ি কামিয়ে দেবে। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন আপনার মুখ মাথা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে। সে আপনাকে বলবে, ঐ মারাত্মক কাই আপনার তলপেটের নিচে লাগাতে। ওটা লাগালে ক্ষুর কঁচির দরকার হয় না। এমনিতেই চুল খুলে সাফ হয়ে যাবে। আপনি হুজুর, ঐ শয়তানের কারসাজীতে ভুলবেন না। যেখানে লাগবে পুড়ে দগদগে ঘা হয়ে যাবে।

সুলতান তাজ্জব হয়ে যায় আবু কাইর-এর কথা শুনে।

-কিন্তু আমাকে সে মারবে কেন, কী ফায়দা?

-লোকটা আসলে খ্রীস্টান সম্রাটের গুপ্তচর। ছদ্মবেশ ধরে এসেছে এখানে, আপনাকে মারতে পারলে সে অনেক ইনাম পাবে তাদের কাছ থেকে।

সুলতান ঘাড় নাড়েন, হুঁ। বুঝলাম। দুনিয়াতে মানুষ চেনা ভার। কে যে কী উদ্দেশ্য নিয়ে চলা ফেরা করে—বোঝা দায়।

আবু কাইর চোখে মুখে দারুণ উৎকণ্ঠা দেখিয়ে বলে, এই খবর শোনা ইস্তক আমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে জাঁহাপনা। আমি সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছি আপনার কাছে। যদি আপনি আজই চলে যান হামামে

সুলতান দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় এখনই বুঝি কে যেন তার সারা অঙ্গে বিষ ঢেলে দিয়েছে।

–ঠিক আছে, এসব নিয়ে আর বেশি আলোচনার প্রয়োজন নাই। এখন সবাই চুপচাপ থাক, আমি উজিরকে নিয়ে আজই হামামে যাবো। দেখবো কী ব্যাপার?

উজিরকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান হামামে আসে। আবু শাইর পুলকিত হয়। দু’জনকে নিয়ে পাশের ঘরে যায়। প্রথমে সুলতান এবং পরে উজিরের সারা দেহ দলাই মলাই করতে থাকে।

এক সময় আবু শাইর বলে, জাঁহাপনা, চুল সাফ করার আমি এক রকম কাই তৈরি করেছি। ওতে আর ক্ষুরের দরকার হয় না। শুধু লাগিয়ে দিলেই হলো। ব্যাস, সব চুল পলকে উঠে সাফ হয়ে যাবে।

সুলতান গম্ভীরভাবে বলে, আগে উজিরের তলপেটে লাগাও দেখি। ওর তো সারা শরীরে ভালুকের মতো লোম।

মাটির ভাঁড় থেকে খানিকটা কাই নিয়ে আবু শাইর উজিরের তলপেটে লাগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে উজির। সুলতান বুঝতে পারে, আবু কাইর মিথ্যে বলেনি, মারাত্মক বিষই বটে। গর্জে ওঠে সুলতান। সঙ্গে সঙ্গে হামামের হাবসী ক্রীতদাসেরা এসে হাজির হয়।

-এই খুনীটাকে বাঁধো।

আবু শাইরকে পিঠমোড়া করে বেঁধে প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়। সুলতান বন্দরের কাপ্তানকে ডেকে বলে, এই বিশ্বাসঘাতকটাকে একটা চুনের বস্তায় পুরে দরিয়ার জলে ছুঁড়ে দাও। আমি আমার প্রাসাদের জানালা দিয়ে স্বচক্ষে দেখতে চাই, লোকটা, কেমন করে ডুবে মরে।

কাপ্তান কুর্নিশ জানিয়ে বললো, জো হুকুম জাঁহাপনা।

আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে একদিন আবু শাইর তার হামামে এক কাপ্তানকে বিনা মূল্যে খুব আদর যত্ন করে গোসল করিয়েছিলো। এই কাপ্তানই সেই ব্যক্তি।

কাপ্তান প্রহরীদের বললো, বন্দীকে আমার বন্দরে নিয়ে এসো।

বন্দর থেকে সুলতানের প্রাসাদ বেশি দূরের পথ নয়। কাপ্তান একখান ছোট্ট ডিঙিতে আবু শাইরকে তুলে দাঁড় বাইতে বাইতে অদূরে একটা ছোট্ট দ্বীপে গিয়ে ভেড়ে।

—আমাকে চিনতে পারে শেখ?

কাপ্তান প্রশ্ন করে! আবু শাইর এতক্ষণ তার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করেনি। নিজের দুরদৃষ্টের কথা ভেবে ভেবেই সে সারা। কাপ্তানের কথায় চোখ মেলে তাকাল সে। তাই তো, সেই কাপ্তানই, বটে, একে সে একদিন গোসল করিয়েছিলো।

কাপ্তান বললে, তোমার সেদিনের ব্যবহার আমি কোনও দিন ভুলতে পারবো না শেখ। তোমার মতো সদাশয় মানুষ, এই জঘন্য কাজ কী করে করতে পারলো?

আবু শাইর-এর চোখে জল আসে।-বিশ্বাস করুন, কাপ্তান সাহেব, আমার মধ্যে কোনও ঘোর পাঁচ নাই। আমি সরল সাদাসিধে মানুষ—সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করি, আপন করে নিতে চাই। আমরা বন্ধু আবু কাইর চুল কামাবার কই একটা বানাবার মতলব দিয়ে গিয়েছিলো। তার কথামতো মালমশলা কিনে এনে বানালাম সেই কাঁই। তখন কি জানি, বন্ধু আমার প্রাণনাশের ফাঁদ ধরিয়ে দিয়ে গেলো আমার হাতে।

কাপ্তান বললো, অধর্মের জয় কোনও দিনই হয় না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো, তোমার কাজের সুফল তুমি পাবেই, শেখ। সুলতান এখন ক্রুদ্ধ। তাকে কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা। সময় আসতে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। দিন কয়েক তুমি এই দ্বীপেই থাকো। তারপর আমি তোমার বিধি-ব্যবস্থা করে দেবো। এবার আমি যাচ্ছি, সুলতান তোমাকে দরিয়ার পানিতে ডুবিয়ে মারার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখবেন বলে তার প্রাসাদের বাতায়ন-পাশে বসে আছেন।

আবু শাইর বলে, কিন্তু আমি তো রইলাম এখানে! কী ভাবে তাকে দেখাবেন।

কাপ্তান হাসে, এই যে বস্তাখানা দেখছো, তোমাকে এতে ভরে পানিতে ফেলে দেবার কথা ছিলো। এই বস্তায় আমি বালি আর পাথরের চাই ভরে নিচ্ছি। ডিঙি বেয়ে প্রাসাদের সামনে। গিয়ে সুলতানের চোখের সামনে ঝুপ করে ফেলে দেবো-বুঝতেও পারবেন না তিনি।

আবু শাইর-এর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। আমার জন্যে আপনি এতো ঝক্কি নেবেন—যদি কোনওক্রমে ধরা পড়ে যান!

কাপ্তান বলে, যদি ধরা পড়ে যাই? যাই যাবো। তবু এই ভেবে মরতে পারবোে এক সহৃদয় নিরপরাধ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রাণ দিচ্ছি।

দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আবু শাইর-এর দু-গাল বেয়ে।

একটুক্ষণ পরেই কাপ্তান ডিঙি বেয়ে প্রাসাদের পিছনে এসে হাজির হয়। বাতায়নে বসে আছে সুলতান—পাশে পারিষদরা। কাপ্তান বালি আর পাথর ভর্তি বস্তাটা গড়াতে গড়াতে ডিঙির ধারে নিয়ে আসে। সুলতান জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ইশারা করতেই সে ঠেলে ফেলে দেয় সমুদ্রের জলে।

সুলতান হাতখানা গুটিয়ে নিয়ে দেখে তার অনামিকা থেকে মহামূল্যবান আংটিটা খসে পড়ে গেছে দরিয়ার অগাধ জলে। এই আংটিটা ছিলো দৈবশক্তি সম্পন্ন। সুলতান এবং তাবৎ প্রজাদেরও বিশ্বাস সুলতান ঐ আংটির বলেই বলীয়ান। যতক্ষণ তার কাছে ঐ অলৌকিক আংটি থাকবে ততক্ষণ দেশের বা বিদেশের কোনও শত্রু তার কোনও অনিষ্ট করতে পারবে না। প্রজারা একান্ত বশংবদ হয়ে থাকবে।

সুলতান দিশাহারা হয়ে পড়ে। এ কী হলো? এখন সে কী করবে। একথা জানাজানি হয়ে গেলে তার প্রজারা আর পরোয়া করবে না তাকে। সারা সলতানিয়াতে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। ক্ষমতালোভী উজির সেনাপতিরা তাকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করে বসতে পারে। সুতরাং কাউকে কিছু না বলাই সঙ্গত মনে করলো সে। কিন্তু মনে মনে দুর্বল, অসহায় বোধ করতে থাকলো। ভয়ে প্রাণ শুকিয়ে যেতে লাগলো। সমুদ্রের পানি শোষণ করা তো সম্ভব নয়, সুতরাং তার সমস্ত শক্তির উৎস সে-আংটিও আর উদ্ধার হবে না কোনও দিন। সুলতান বিষণ্ণ বদনে শয্যাকক্ষে প্রবেশ করলো। সকলে ভাবলো, হাজার হলেও সুলতানের দয়ার শরীর, আবু শাইরকে প্রাণদণ্ড দিয়ে অন্তরে আঘাত পেয়েছেন খুব।

সেই জন-মানব শূন্য নির্জন দ্বীপে আবু শাইর একা একা দিন কাটাতে থাকে। কাপ্তান তাকে কিছু খাবার-দাবার আর একখানা মাছ ধরার জাল দিয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন সে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ায়। কখনও ইচ্ছে হলে জাল ফেলে। ছোট বড় কত না জানা মাছ ওঠে। আবু শাইর নিজের খাবার মতো রেখে বাকীগুলো জলে ছেড়ে দেয়। কী হবে শুধু শুধু মাছগুলোকে মেরে।

সেদিনও সে খেলাচ্ছলেই জাল ফেলেছিলো। কিন্তু টেনে আর তুলতে পারে না। পেল্লায় ভারি। কোনও রকমে কিনারে ওঠাতে দেখলো, বিরাট একটা মাছ জালে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক দিন এতো বড় মাছ সে চোখে দেখেনি। আবু শাইর ভাবলো, আজ আর অন্য কিছু না, এই মাছেরই ফলার করবে সে। ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতেই পেটের নাড়িভূঁড়ির মধ্যে কী যেন ঝকমক করে উঠলো। আবু শাইর কৌতূহলী হয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে, পাথর বসানোে একটা আংটি। নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেও সে কিছু বুঝতে পারলো না, পাথরটা কী? যাই হোক ডান হাতের মাঝের আঙ্গুলে পরে নিলো সে। ভাবলো কাপ্তান এলে তাকে দেখাবে, হয়তো সে চিনলেও চিনতে পারে!

কিছুক্ষণ বাদে বন্দর থেকে একখানা ডিঙি ভাসিয়ে কাপ্তানের দুই অনুচর এসে হাজির হলো আবু শাইর-এর কাছে।

আবু শাইর জিজ্ঞেস করে, কাকে চাই?

ছেলে দুটি বলে, আমাদের কাপ্তান সাহেব সেই সক্কালবেলা বেরিয়ে গেছেন! এখন পর্যন্ত ফেরেননি। তিনি আমাদের মাছ ধরতে বলে গেছেন। রোজ সুলতানের প্রাসাদে মাছ পাঠাতে হয় কিনা। কিন্তু আজ কী বরাত, সারা সকাল ধরে জাল ফেলে একটা মাছ তুলতে পারলাম না। এখন কী হবে। মাছ না পাঠাতে পারলে গর্দান যাবে যে

আবু শাইর বললো, অনেক সকালে কাপ্তান সাহেব একবার এদিকে এসেছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেননি। তারপর এইদিকে চলে গেছেন।

আবু শাইর ডান হাতটা ছেলে দুটোর মাথার ওপর দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে নির্দেশ করে দেখায়। কিন্তু সেই মুহূর্তে এক তাজ্জব কাণ্ড ঘটে গেলো। হাতটা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে দু’টোর ধড় থেকে মাথা দু’টো উড়ে গেলো, আর ধড় দু’খানা পাক খেয়ে গড়িয়ে পড়লো নিচে।

আবু শাইর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এ কি হলো? কী করে হলো—কিছুই অনুমান করতে পারে না সে। মনে হলো, তাকে ঘিরে ধরেছে বুঝি এক ঝাক জীন। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। নিজেকে আর সে ধরে রাখতে পারলো না। লুটিয়ে পড়ে গেলো বালির ওপর। তারপর আর কিছু মনে নাই।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। কাপ্তান তার অনুচরদের খুঁজতে খুঁজতে সেই দ্বীপে এসে ডিঙ্গি ভেড়ায়। কিন্তু একি কাণ্ড, ছেলে দু’টো ছিন্নমুণ্ডু অবস্থায় ছিটকে পড়ে আছে। আর আবু শাইর বালির ওপরে অসাড়ে নিদ্রামগ্ন। তার হাতের আংটিটার দ্যুতি এসে বিধলো কাপ্তানের চোখে। সর্বনাশ এই আংটি তো সুলতানের। অলৌকিক ক্ষমতায় ছেলে দুটোর জীবনান্ত ঘটেছে।

এমন সময় আবু শাইর আড়ামোড়া ভেঙ্গে পাশ ফেরে। কাপ্তান চমকে ওঠে। আবু শাইর যদি ঘুম ভেঙ্গে উঠে তার দিকে কোন ভাবে হাত বাড়ায়, তা হলে তারও দশা ঐ ছোকরা দুটোর মতোই হবে। সে চিৎকার করে ওঠে, আবু-শাইর-তোমার ডান হাতটা গুটিয়ে রাখো, আমার দিকে বাড়িও না, ভাই। তা হলে নির্ঘাৎ আমার মৃত্যু হবে।

আবু শাইর ধড়মড় করে উঠে বসে। ডান হাতখানা পিছনের দিকে করে রাখে। প্রশ্ন করে, কিন্তু কেন কী ব্যাপার, কাপ্তান সাহেব?

তার আগে বলো, তোমার হাতের ঐ আংটি তুমি পেলে কোথায়? ওটা সুলতানের হাতের অলোকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দৈব আংটি। ঐ আংটির দৌলতেই তিনি অসীম শক্তিধর। কিন্তু যেভাবেই হোক, ঐ আংটি তাঁর হাতছাড়া হয়েছে। সুতরাং এখন তিনি আমার মতোই সাধারণ একজন মানুষ মাত্র। তিনি যে বলে বলীয়ান ছিলেন সে শক্তি আজ তোমার করায়ত্ত! তুমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেকটি মানুষকে তোমার গোলাম বানিয়ে রাখতে পারে। এমন কি সুলতানকেও। যদি তিনি বেগড়বাই করার চেষ্টা করেন, তোমার এক ইশারাতে তারও মুণ্ডু উড়ে যেতে পারবে। আবু শাইর তোমাকে বলেছিলাম না, সৎপথে থাকলে আল্লাহ তার সহায় হন। চলো, এখানে আত্মগোপন করে থাকার আর কোনও প্রয়োজন নাই। চলো, সুলতানের সামনেই যাবো। দেখবে, তিনি তোমার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। না হলে, তার প্রাণ যাবে।

আবু শাইরকে সঙ্গে নিয়ে কাপ্তান সোজা সুলতানের দরবারে চলে আসে। সুলতান তখন উজির, আমির পারিষদ পরিবৃত হয়ে দরবারের কাজে ব্যাপৃত ছিলো। কাপ্তানের সঙ্গে আবু শাইরকে সশরীরে দেখে সুলতান আঁৎকে ওঠে।

—এ্যাঁ; ভূত নাকি? দরবারের উজির আমির সকলেই অবাক হয়ে আবু শাইরকে দেখতে থাকে। তাইতো, লোকটাকে জলজ্যান্ত দরিয়ার মধ্যে বস্তাবন্দী করে ফেলে দেওয়া হলো, সে আবার উঠে এলো কী করে? যাদুমন্ত্র জানে নাকি?

সুলতান গর্জে ওঠে, কাপ্তান তুমি বিশ্বাসঘাতক। আমাকে ধোঁকা দিয়েছ, এর কী সাজা তোমার জানা নাই।

-খুব জানা আছে, হুজুর। সুলতানের হুকুম তামিল না করলে গর্দান যায়, কিন্তু গর্দান নেবার তো ক্ষমতা এখন আপনার নাই।

-কী এতো বড় স্পর্ধা।

—অপরাধ নেবেন না, হুজুর। আপনি যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, যার বলে আপনার প্রজারা পদানত ছিলো, সে দৈব অঙ্গুরীয় আপনার হাতে আর নাই। ওটা দেখুন, আবু শাইর-এর হাতে।

সুলতান চমকে ওঠে। অজ্ঞাতসারে ডান হাতখানা আড়াল করতে চায়। তার চোখে মুখে সে-এক মৃত্যুর বিহুলতা। মুহূর্তের মধ্যে সারা মুখে বড় বড় স্বেদবিন্দু জমে ওঠে। উজির আমিররা এতক্ষণে নজর করলো, সত্যিই সুলতানের অনামিকা রিক্ত। আবু শাইর-এর ডান হাতের দিকে তারা তাকিয়ে দেখতে পেলো, সুলতানের সেই দৈব আংটি জ্বলজ্বল করছে।

সুলতান সিটকে যায়। ভাবে তার মৌৎ সামনে হাজির। এক মুহূর্তের মধ্যে তার মুণ্ডু উড়ে যাবে।হঠাৎ সে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আবুশাইরকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার সঙ্গে যে আচরণ আমি করেছি তার প্রতিশোধ তুমি নেবে বলেই এসেছ। কিন্তু আমি তোমার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছি, আবু শাইর। আমাকে প্রাণে মেরো না। তার বদলে আমি ছেড়ে দিচ্ছি এই মসনদ।

তুমি আমার সারা সলতানিয়তের সুলতান হও। শুধু আমার আর্জি, প্রাণে মেরো না আমাকে।

আবু শাইর সেই নিস্তব্ধ দরবার কক্ষের অপর প্রান্তে কাপ্তানের পাশে এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়েছিলো। এবার সে ধীর পদক্ষেপে সুলতানের পাশে এসে দাঁড়ালো। সকলকে চমকিত করে সুলতানের হাতে সে খুলে দিলো সেই আংটি।

তখত-এর গৌরব আমার প্রয়োজন নাই। সলতানিয়তের লোভে আমি লুব্ধ নই। এই নিন আপনার অলৌকিক অঙ্গুরীয়। আমি অতি সাদাসিধে সাধারণ মানুষ—এই অমিত বিক্রমের অধিকারী আমি হতে চাই না। এ আংটি আমি পেয়েছি একটি মাছের পেটে। কাপ্তান আমাকে বললেন, আংটিটা আপনার। তাই ফেরত দিতে এসেছি। কোনও শর্ত নয় শুধু একটি মাত্র প্রার্থনা আমার, এই কাপ্তান সাহেব আপনার হুকুম অমান্য করে আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন, তাকে আপনি কোনও সাজা দেবেন না। আরও একটা কথা, আপনি আমার প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন আমার অপরাধের সূত্র অনুধাবন না করেই। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি আসল অপরাধীকে সনাক্ত করুন। আমার সব কথা শুনলে আপনার কাছে সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সুলতান দু-হাতে জড়িয়ে ধরে আবু শাইরকে। দু-চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা।

-আমি সব বুঝেছি আবু শাইর। কোনও এক দুষ্টচক্রান্তের শিকার হয়েছিলে তুমি। তোমার মতো সরলপ্রাণ সদাশয় মানুষকে প্রতারণা করতে তত বেশি কসরত করতে হয় না। তুমি সবাইকেই বুক ভরে ভালোবাসা দিতে পারো, বিশ্বাস করতে পারে। আমারই দোষ, আমিই তোমাকে চিনতে পারিনি এতোদিন। আমি ন্যায় বিচার না করে তোমাকে অন্যায়ভাবে সাজা দিয়েছিলাম। কিছু মনে রেখ না, আবু শাইর। আমার হঠকারীতার জন্য আমি অনুতপ্ত। কিন্তু এখন আমার কাছে বলো তো, কে তোমাকে পরামর্শ দিয়েছিলো সেই বিষাক্ত কাই তৈরি করার?

আবু শাইর বলে, সে আমারই স্বদেশবাসী—আবু কাইর। কাইটা যে ঐ রকম মানুষ খুন করা মারাত্মক বস্তু হতে পারে, আপনি বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, আমি জানতাম না।

—আমি সবই এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আবু শাইর। ঐশ্বর্য দেখে আপনজনই সব চাইতে বেশি ঈর্ষাকাতর হয়। আবু কাইর আমাকে এসে বলেছিলো, তুর্কি খ্রীষ্টানদের গুপ্তচর। আমাকে হত্যা করার জন্যেই তারা তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে। সে নিজেই যে এই শয়তানীর পাণ্ডা তা আমি খতিয়ে দেখিনি তখন।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো একতম রজনীতে আবার বলতে শুরু করে :

আবু শাইর মাথার চুল ছিড়তে থাকে, উফ, লোকটা কী মিথ্যাবাদী শয়তান? আমার জীবনে আমি কখনও কোনও খ্রীষ্টানদেশে যাইনি। আর বলে কি না, আমি তাদের গুপ্তচর। জানেন জাঁহাপনা, এই লোকটাকে আমি দিনের পর দিন মাসের পর ৯ মাস খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।

-তাই বলো! এতক্ষণ আমি আসল সূত্রটা ধরতে পারছিলাম না। তুমি তার উপকার না করলে সে তোমার এতো বড় অনিষ্ট কী করে করে?

এর পর আবু শাইর আবু কাইরকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে করে এখানে আসা, সরাইখানায় ওঠা এবং তাকে জ্বরে অচৈতন্য অবস্থায় ফেলে তার সঞ্চিত অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া এবং তার দোকানে তাকে অমানুষিক প্রহার করা ইত্যাদি সমস্ত কাহিনী খুলে বললো সুলতানকে।

—আপনি আরও প্রমাণ পাবেন হুজুর, সেই সরাইখানার মালিককে একবার ডেকে পাঠান।

সুলতানের হুকুমে তখনই সরাইখানার মালিককে হাজির করা হলো সেখানে। সে বললো, লোকটা কাফের জাঁহাপনা। আমি দেখেছি দিনের পর দিন সে কুঁড়ের বাদশার মতো ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকতো, আর এই আবু শাইর সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খেটে খানাপিনা নিয়ে এসে তাকে খাওয়াতো। তার পুরস্কার সে কী ভাবে দিয়েছিলো শুনুন : আবু শাইর যখন অসুখে পড়লো, বেদম জ্বরে সে যখন অচৈতন্য, তখন তার যা কিছু জমানো পয়সা কড়ি ছিলো সব হাতিয়ে নিয়ে একদিন সে হাওয়া হয়ে গেলো। এর মাস দুই পর আবু শাইর অসুখ থেকে উঠে খুঁজতে খুঁজতে আবু কাইর-এর দোকানে গিয়ে ঢোকে। তাকে দেখামাত্র লোকটা হাবসী বান্দাদের দিয়ে মারায়। তাতেও সে সন্তুষ্ট হয় না, বেতের চাবুক দিয়ে মেরে সারা অঙ্গ চৌচির করে রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে যায় বেচারাকে।

সুলতান থামিয়ে দিলো, থাক, আমার সব জানা হয়ে গেছে। এবার দেখ, ওকে কী ভাবে শায়েস্তা করি আমি। এই কে আছিস, শয়তান ধোপাটাকে পিছ-মোড়া করে বেঁধে নিয়ে আয় আমার সামনে।

সুলতানের আদেশে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলো পেয়াদারা। আবু কাইর তখন তার পালঙ্ক-শয্যায় শুয়ে সুখ-স্বপ্নে বিভোর ছিলো। তার একমাত্র পথের কাঁটা আবু শাইরকে সে চির-জীবনের মতো সরিয়ে দিতে পেরেছে। এখন আর তাপেপক পায় কে!

পেয়াদাগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে তার ঘরে। আবু কাইর তম্বি করে তাড়া করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওরা সে-সুযোগ দিলো না তাকে। রশি দিয়ে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেললো। আবু কাইর হাতপা ছুঁড়ে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু হাবসী পেয়াদার বিরানব্বই সিক্কার গোটাকয়েক ঘুষিতেই বাছাধন কঁকিয়ে থেমে গেলো। জামা পাতলুন ছিড়ে খুঁড়ে প্রায় আধা উলঙ্গ করে ফেললো তাকে। টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে হাজির করলো সুলতানের সামনে।

আবু শাইর তখন বসেছিলো সুলতানের ডান পাশে। সরাইখানার মালিক দাঁড়িয়েছিলো একদিকে। নজর পড়তেই আবু কাইর-এর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার দাখিল। আর রক্ষা নাই। সব চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে। এবার নির্ঘাত মৃত্যু। প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতার সাজা এবার তাকে পেতেই হবে।

সুলতান গর্জে ওঠে, তোমার দোস্তকে চিনতে পারছো আবু কাইর? একে তুমি বেত্রাঘাত করেছিলে? এর সঞ্চিত অর্থ অপহরণ করেছিলে? হাবসী-বান্দাদের দিয়ে পিটিয়েছিলে? এবং একে ফাঁসীর কয়েদী বানাবার চক্রান্ত করেছিলে? ঠিক কিনা? চুপ করে থেকো না, চটপট জবাব দাও। তুমি চক্রান্ত করলে কী হবে, আল্লাহ যার সহায় আছেন, তার অনিষ্ট কেউ করতে পারে না। তোমার এর চরম প্রতারণার সাজা কী হতে পারে জান? মৃত্যু।

দরবারের সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুলতান জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কী বলো?

সকলে হাত উঠিয়ে জানালো সুলতানের বিচার ন্যায়সঙ্গত।

এরপর সুলতান পেয়াদাদের হুকুম দিলো, লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে সারা শহর ঘোরাবে। তারপর খারের বস্তায় ভরে ওকে দরিয়ার পানিতে ছুঁড়ে দেবে।

দরবারের সকলে সুলতানের বিচারের প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে। আবু শাইর বলে, জাঁহাপনা, আমি ওকে ক্ষমা করে দিলাম, ওর সম্বন্ধে সব অভিযোগ আমি তুলে নিচ্ছি।

—কিন্তু আমি ভুলে যেতে পারছি না, আবু শাইর। সে শুধু তোমাকে নয় আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সে সাজা তাকে পেতেই হবে।

পেয়াদাদের হুকুম দিলো, যাও নিয়ে যাও।

সুলতানের যথা নির্দেশ মতো আবু কাইরের কোমরে দড়ি বেঁধে সারা শহরে বর-কয়েক ঘোরালো তারা। হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রত্যক্ষ করলো, একদিন যার দাপটে সারা শহরবাসীরা থরথর করে কাঁপতো আজ তার কী হাল! একেই বলে নসীবের খেলা।

শহর ঘোরানো শেষ হলে পেয়াদারা আবু কাইরকে একটা চুনের বস্তায় পুরে দরিয়ায় পানিতে ডুবিয়ে দিলো।

সেইদিন পূর্ণ দরবার কক্ষে সুলতান আবু শাইর-এর দু’হাত ধরে বললো আবু শাইর, তোমার কাছে নিজেকে বড় ঋণী এবং অতি ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। তোমার যা প্রাণ চায়, চাও আমার কাছে। তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই। যা চাইবে—তাই দিয়ে আমি ধন্য হবো। চাও, আবু শাইর, যা তোমার ইচ্ছা, চাও আমার কাছে। তোমাকে দু’হাত ভরে দিয়ে আমি নিজের দীনতা কমাতে চাই।

আবু শাইর-এর মুখে অমায়িক হাসি, আমার কিছুই চাই না, জাঁহাপনা। আপনার দৌলতে এই শহরে এসে অনেক অর্থ আমি উপার্জন করেছি। আর বেশি কিছু চাই না। শুধু আমার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দিন আপনি। অনেকদিন আমার আপনজনদের দেখিনি। মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

সুলতান বললো, তোমার বুদ্ধি বিচক্ষণতার যে পরিচয় পেয়েছি তাতে তুমি আমার প্রধান উজির হতে পারে। আমার ইচ্ছা, তুমি উজিরের মর্যাদা নিয়ে আমার কাছেই থাক।

আবু শাইর বললো, আপনার আদেশ মাথায় রাখলাম। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিন, জাঁহাপনা। মন আমার দেশে পড়ে রয়েছে, এখন কোনও কাজেই মন বসবে না। আপনি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। তা হলেই আমি খুব আনন্দ পাবো।

সুলতানের নির্দেশে একখানা জাহাজে দামী দামী সাজ-পোশাক, আসবাবপত্র, সামানপত্র এবং সোনা-দানায় ভর্তি করা হলো। বেছে বেছে সুন্দর সুন্দর দাস দাসী, বান্দা-বাঁদী তুলে দেওয়া হলো সেই জাহাজে। সুলতান বললো, এগুলো আমার উপহার!

আবু শাইরও এনে তুললো তার সঞ্চিত মোহরের বস্তাগুলো। যথাসময়ে জাহাজ ছেড়ে দিলো আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশে।

শাহরাজাদ থামলো।

এই হলো আবু কাইর ও আবু শাইর-এর কাহিনী। এরপর আপনাকে শোনাবো আর এক চমকপ্রদ কিসসা। দুই আবদাল্লার এই উপকথা আপনার নেহাত মন্দ লাগবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *