তাম্র নগরীর কাহিনী
শাহরাজাদ বলে—এখন আপনাকে যে গল্পটা বলতে চাইছি তার নাম হলো তাম্ব নগরীর গল্প। আজ পর্যন্ত আপনাকে যে সব গল্প বলেছি। এটি হচ্ছে তাদের চেয়ে অনেক ভালো। অর্থাৎ, এর কাছে সেগুলি কিছুই নয়। জাঁহাপনার মজি হলে গল্পটা কাল রাত থেকে শুরু করতে পারি।
দুনিয়াজাদ অস্থির হয়ে বললেন—না, না। আজই তুমি শুরু কর গল্পটা। কিছুটা তো বলো।
মুচকি হেসে শুরু করলো শাহরাজাদ :
জাঁহাপনা, আল্লাহই রাজার রাজা। কোন এক সময় এক নগরীতে একটি রাজা রাজত্ব করতেন। সেই নগরীর নাম….
ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প থামিয়ে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।
তিনশো উনচল্লিশতম রজনী :
এক সময় দামাস্কাসে রাজত্ব করতেন ওমিয়াদ বংশের খলিফারা। সেই বংশে একজন খলিফা ছিলেন। তাঁর নাম হলো আবু আল-মালিক বিন মারবান। গুণী ব্যক্তিদের তিনি সম্মান দেখাতেন, করতেন আপ্যায়ন। দেশ-বিদেশের নানান কাহিনী শুনতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। এই সব গল্প বলতেন জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা। ডেভিডের পুত্র আমাদের মালিক সুলেমানের গল্প শুনতেই বিশেষ করে ভালোবাসতেন তিনি। সুলেমানের গুণাবলী, বিচক্ষণতার কাহিনী, মরুভূমির সবরকমের পাশবিক অত্যাচারকে তিনি যে দমন করেছিলেন সেই কাহিনী, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যেসব ইফ্রিদ আর জিন ঘুরে বেড়ায় তাদের কেমন করে যে তিনি বশে এনেছিলেন সেই সব কাহিনী বারবার তিনি শুনতে চাইতেন।
একদিন এক ভূ-পর্যটক তীর রাজসভায় এসে উপস্থিত হলেন। এর নাম তালিব-বিন-সাল, খলিফাকে ইনি নানান কাহিনী শোনালেন। সেই সঙ্গে শোনালেন তামার জালার গল্পটাও। গল্পটা এমনই অদ্ভুত যে খলিফা তা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। তামার জালাটা কালো ধোঁয়ায় ভর্তি। এই ধোঁয়া নাকি ধোঁয়া নয়, আসলে দৈত্য-দানোর গায়ের রোয়া। এ কি বিশ্বাস করা যায়?
খলিফার বিশ্বাস উৎপাদন করানোর জন্যে তালিব-বিন-সাল বললেন-জাঁহাপনা, আপনি ধাৰ্মিক ব্যক্তি, মহাপ্ৰাণ। আপনাকে মিথ্যা কথা বলার সাহস আমার নেই। আপনাকে সত্যি ঘটনাই বললাম।
অনেককাল আগে সুলেমানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলো জিন। তারই শাস্তিস্বরূপ তাকে তিনি ওই তামার জালাটার ভেতরে আটকে রেখেছিলেন। তারপরে মুখটা বেশ ভালো করে। এাটে পশ্চিম আফ্রিকার মঘরিব-এর বাইরে বিলাপ-সাগরে সেই জালাটা ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। জালাটা তলিয়ে যাওয়ার আগে কিছু ধোঁয়া বেরিয়ে এসেছিলো বাইরে। সেই ধোঁয়া হচ্ছে ইফ্রিদের জমাট বাধা আত্মা। বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে আবার সে তার নিজের রূপ ফিরে পেলো।
খলিফা তো অবাক! এও কখনো হয়! নিজের চোখে দেখতে হবে তো ব্যাপারটা। তিনি তালিব-বিন-সালকে বললেন-ইফ্রিদের ধোঁয়ায় ভরা কয়েকটা জালা আমি দেখতে চাই। এটা কি সম্ভব? কী বলো তুমি? সম্ভব হলে, আমার সঙ্গে চলো। নিজের চোখে দেখে আসি ব্যাপারটা।
তালিব-বিন-সাল বললেন—ধর্মাবতার, আপনি অযথা কষ্ট করবেন কেন? আপনার আদেশে এখানেই দেখানো যাবে! এ আর এমন কথা কী? এর জন্যে একটু কষ্ট করে আপনাকে একটা চিঠি লিখতে হবে-এই যা। আপনার প্রতিনিধি হিসাবে আমীর মুশা মঘরিব প্রদেশ শাসন করছেন। তাকেই একটা চিঠি লিখে দিন। লিখবেন-পাহাড় যেখানে শেষ হয়ে সমুদ্রে মিশেছে। সেইখানে এক টুকরো শুকনো জমি রয়েছে। তারই কাছে সমুদ্রে তামার জালাগুলো রয়েছে। আপনার নির্দেশ পেলে মুশা সেই জালাগুলো আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবে।
—তাহলে, তুমি নিজেই যাও। আমার মোহরের ছাপ দিয়ে চঠি লিখে দিচ্ছি তাকে। জালাগুলো এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর। লোকজন যা চাই নিয়ে যাও। যাও, তাড়াতাড়ি।
নিজের হাতে একটা চিঠি লিখলেন খলিফা; তাতে মোহর দিলেন নিজের। তারপরে সেটি তুলে দিলেন তালিবের হাতে। তালিব সেটি নিয়ে সোজা চলে গেলেন মুশার কাছে মঘরিবে।
যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে তালিবকে সংবর্ধনা জানালেন মুশা। চিঠিটা খুলে পড়লেন। তারপরে সেটি তাঁর ঠোঁট আর মাথায় বুলিয়ে তিনি বললেন-বুঝেছি! মহামান্য ধর্মাবতার খলিফার আদেশ। আমাকে তা পালন করতেই হবে।
মুশা তাঁর সেনাধ্যক্ষ আব্দ আল-সামাদকে ডেকে পাঠালেন। দুনিয়ার হেন জায়গা নেই যেখানে আব্দ আল-সামাদের গতিবিধি ছিলো না। বেশ বয়স হয়েছে তার; বংশধরদের জন্যে তিনি এখন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা লিখে রাখছেন। অনেক লোমহর্ষক কাহিনীর বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ছিলো।
আব্দ আল-সামাদ হাজির হলে মুশা তাকে বললেন-ধর্মাবতার বিশেষ একটি দূত এখানে পাঠিয়েছেন সামাদ সাহেব। জিনের আত্মা-ভর্তি কয়েকটা তামার জালা তার চাই। ডেভিডের পুত্র সুলেমান এই জিনগুলোর আত্মা জালায় বন্দী করে রেখেছিলেন। জালাগুলো নাকি রয়েছে সমুদ্রের তলায়। সেগুলিকে খুঁজে আনতে হবে। মঘরিব প্রদেশের একেবারে শেষ সীমান্তে পাহাড় রয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ এসে সেই পাহাড়েরই গায়ে প্রচণ্ড আবেগে আছড়ে পড়ে ভেঙে চুরমার হয় যাচ্ছে, তারই পাশে সমুদ্রের ভেতরে ওগুলি নাকি রয়েছে। অনেক দিনই আমি এদেশ শাসন করছি। এদেশের সবই প্রায় আমার জানা। কিন্তু তালিব সাহেব সমুদ্রের যে অংশটার কথা বলছেন তা আমি কোনদিনই শুনিনি। কোন পথ ধরলে সেখানে পৌছানো যাবে তাও আমার অজানা। কিন্তু সারা দুনিয়ায় তো আপনি ঘুরে বেডিয়েছেন। পৃথিবীর হেন জায়গা নেই যা আপনি জানেন না। তালিব সাহেব যে পাহাড় আর সমুদ্রের কথা বলছেন তাদের আপনিও নিশ্চয় জানেন—তাই না?
মুশার কথা শুনে বৃদ্ধ সামাদের কপালের রেখাগুলি কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। অনেকক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন—মুশা বিন নুশায়ের, মনে পড়েছে। পাহাড় যেখানে সমুদ্রে মিশেছে সেখানে আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে আমি একা আর সেখানে যেতে সাহস করছিনে। ইচ্ছে থাকলেও, শক্তিতে কুলোবে না এখন। পথ দুৰ্গম। পথের ধারে তেষ্টা মেটানোর মত কোন পানি নেই। সেখানে পৌঁছতেই লেগে যাবে দু’বছর কয়েক মাস। ফিরতে লাগবে আরও বেশী সময়; অবশ্য, সেই ভয়ঙ্কর জায়গা থেকে একেবারেই ফেরা যাবে কি না সেদিক থেকেও সন্দেহ কম নেই। সে দেশে জীবন্ত মানুষের কোন চিহ্ন নেই। দাঁড়ে যেমন পাখি ঝুলে পাহাড়ের ওপরে মানুষগুলো সেইরকম ঝুলে রয়েছে। বাইরে থেকে কেউ আজ পর্যন্ত সেই শহরে ঢুকতে পারেনি। এই শহরের নাম ‘তাম্র নগরী’।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বৃদ্ধ সামাদ আবার বলেন-আমীর আপনার কাছে আমি কিছুই লুকোইনি, লুকোবোও না। ওপথ কেবল দুৰ্গমই নয়, রীতিমত ভয়াল, ভয়ঙ্কর রকমের বিপজ্জনক। পথে একটা মরুভূমি পড়বে। ইফ্রিদ আর জিনেরা সেই পথ আর মরুভূমি পাহারা দিচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টা। আজ পর্যন্ত কোন মানুষ ও অঞ্চলে বসবাস করতে পারেনি। আমীর মুশা, আপনি নিশ্চয় জানেন যে আফ্রিকার পশ্চিম প্রান্ত চিরকালই মানুষের কাছে নিষিদ্ধ স্থান। আজ পর্যন্ত মাত্র দুটি মানুষই সেখানে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তঁদের একজন হচ্ছেন ডেভিডের পুত্র সুলেমান, আর একজন হচ্ছেন জোড়া সিঙ্গের আলেকজান্দার। র্তাদের পরে আর কেউ সেখানে যাননি। জায়গাটা হচ্ছে অনন্ত এক নীরবতার রাজত্ব। ধূ-ধূ করছে মরুভূমি—খা-খাঁ করছে বালি। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই বালি তাথৈ-তাথৈ নৃত্য করছে। কবরখানার এক ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা সেখানে থমথম করছে।
আমীর মুশা বললেন—সবই সত্যি সামাদ সাহেব; স্বীকার করছি, ওপথে বিপদ আছে আপদ রয়েছে। কিন্তু ও-সবই তো উপেক্ষা করতে হবে। আপনি যদি যেতে না চান তো আমাকেই যেতে হবে। জাঁহাপনার নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে চলবে না।
সামাদ বললেন-আমি ছাড়া আর কেউ বোধ হয় একাজ পারবে না। ওদেশে পৌছানোর পথ আমারই কেবল জানা রয়েছে। এক কাজ করুন আমীর মুশা। সঙ্গে নিন। দুহাজার উট। এক হাজার বইবে জল, এক হাজার খাবার-দাবার। বেশী সৈন্য সামন্ত নেওয়ার দরকার নেই। আমরা যেদেশে যাচ্ছি। তারা কেউ জীবন্ত মানুষ নয়। তারা সব প্রেতলোকের বাসিন্দা, ছায়ার মত ঘুরে বেড়ায়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ওদের গায়ে লাগবে না। রেগে গেলে ওদের ঠেকিয়ে রাখার শক্তি সৈন্য-সামান্তের নেই। তাই ফালতু বেশী অস্ত্রশস্ত্র আর লোকজন নিয়ে গিয়ে লাভ কী? এতে ওরা আরও ক্ষেপে যেতে পারে। সব গোছগাছ করে নিন। আমিও তৈরি থাকব। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।
তিনশো চল্লিশতম রজনী :
সামাদ চলে যেতেই বেশ ঘাবড়ে গেলেন আমীর মুশা। যাই হোক, আল্লাহর নাম নিয়ে সব কিছু গোছগাছ করতে শুরু করে দিলেন। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখার অধিনায়ক আর সর্বাধিনায়কদের ডেকে পাঠালেন তিনি। নিজের ইচ্ছা ব্যক্ত করে সকলের সামনেই পুত্র হারুণকে তিনি সিংহাসনে বসালেন। ঠিক হলো, তার অবর্তমানে হারুণই রাজ্যশাসন করবেন।
হারুণকে সিংহাসনে বসিয়ে আল সামাদ যা যা বলে গিয়েছিলেন। সেই–সেই জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে লেগে গেলেন মুশা। তাঁর সঙ্গে তালিব-বিন-সাল আর বৃদ্ধ সামাদ ছাড়া আর কয়েকজন বাছাই করা যোদ্ধাও চললো। সব যোগাড়যন্ত্র শেষ হলে ভালো দিন দেখে আল্লাহর
দুহাজার উটের বিরাট বাহিনী এগিয়ে চললো ধীরে-বীরে। দিনের পর দিন কেটে গেলো। মাসের পর মাস। এমনিভাবে কয়েকটি মাস কাটার পরে দল বিশাল একটা বালির সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে পড়লো। সে এক নিস্তব্ধ মরুভূমি-যেদিকে তাকাও শুধু বালি আর বালি। কোন প্রাণেরই চিহ্ন নেই। সেখানে।
একদিন হঠাৎ দিগন্তরেখার ধারে এক টুকরো চকচকে মেঘের মত কী জানি একটা জিনিস তাদের চোখে এসে পড়লো। মেঘ? না, মেঘের মত কিছু একটা? উটের মুখ তারা সেইদিকে ঘুরিয়ে দিলো। কিছুটা এগিয়ে যেতেই তারা বুঝতে পারলো, ওটা মেঘ নয়। চক-মেলানো একটা বাড়ি। সাদা উঁচু ইস্পাতের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। চারটি সোনার থামের ওপরে বাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়ির পরিধি হবে হাজার দশেক ফুটের মত। বাড়িটার গম্বুজ শীসে দিয়ে তৈরি, হাজার-হাজার কাক যাতে বসতে পারে সেইজন্যে গম্বুজের চারধারে বিরাট একটা কার্নিশ। এখানে তাহলে প্রাণী বলতে কি ওই হাজার-হাজার কাক? কাক ছাড়া আর কোন প্রাণীই তো চোখে পড়ছে না, বিশাল পাচিলের তলায় প্রধান ফটক। দরজার পাশে একটা ফলক। কালো পাথরের চারধারে সোনার মোটা দাগ। সেই কোলো পাথরের ওপরে রোমান হরফে কয়েক ছত্ব লেখা। লেখার হরফগুলি কোন লাল ধাতু দিয়ে তৈরি। রোমান হরফ কেবল সামাদই পড়তে পারতেন। কবিতাটি পড়ে মুশাকে তার অর্থটা তিনি বুঝিয়ে দিলেন।
এইখানে প্রবেশ কর।
তাহলেই তোমরা রাজাদের কাহিনী কী তা জানতে পারবে।
আমার এই গম্বুজের ছায়ায় একটু বিশ্রাম করেই
তারা হাওয়ায় মিশে গিয়েছে।
সূর্য ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা
ছায়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
মৃত্যুর ঝড়ের সামনে
কুটোর মত উড়ে গিয়েছে তারা।
বাণীটার অর্থ বুঝতে পেরে মুশা খুব দুঃখ পেলেন। ফিসফিস করে বললেন আল্লাহ ছাড়া ভগবান নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দলবল নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে পড়লেন মুশা। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তারা বিরাট কালো একটা গ্রানাইট পাথরের মিনার দেখতে পেলেন। মিনারের চারপাশে এত কালো কাক বসেছিলো যে দরজার বাইরে থেকে তাঁরা বুঝতেই পারেননি যে ওটি একটি মিনার। স্তম্ভের চারপাশে অজস্র কবর! সমাধিগুলির ওপরে একটা বিরাট পাথরের স্তম্ভ। তারই গায়ে রোমান হরফে সোনার পাতে একটি কবিতা উৎকীর্ণ করে রয়েছে?
যৌবনের উন্মত্তা বিকারের ঝেকের মত গেছে কেটে—তথাপি
অনেক অনেক কিছু আমি দেখিলাম। কদাপি।
কি ভোলা যায় যৌবনের জয়দীপ্ত বলক্ষিপ্ত দিন
যদিও স্বীকার করি আজ আমি ধূলিমাঝে হয়েছি বিলীন?
উন্মাদ যুদ্ধের নেশায় রোষদৃপ্ত অশ্বক্ষুরধ্বনি
আজও আমি কান পেতে শুনি।
অগ্নিবর্ষী ঝড়ের আবেগে অজগর শহরের করেছি বিনাশ
বারবার। ত্রস্ত নর-নারী যত সভয়ে ফেলেছে নিঃশ্বাস।
আমার রথের চাকায় রাজাদের করেছি জবাই
কোন ক্ষমা করি নাই।
কিন্তু বর্তমানে,
যৌবনের উদ্দামতা বিকারের স্বপ্ন শুধু আনে।
বালির চরেতে আঁকা ফেনার অক্ষর
বিবর্ণ, বিশীর্ণ যেন মৃত যাদুঘর।
মৃত্যু আমাকে করেছে আজিকে বন্দী–
ব্যর্থ আমার সেনানী, ব্যর্থ ফিকির ফন্দি।
হে পথিক শোনো,
আমার মৃত্যুর বাণী কান দিয়ে শোনো
কারণ, আমার জীবনের কথা সে তো নয়।
আত্মার করো না অপচয়।
কালই হয়ত এ মাটি বলিতে পারে
জঠরের মাঝে আমি যে নিয়েছি তারে।
কবিতা পড়ছেন সামাদ। মুশা আর তাঁর সঙ্গীদের বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। সমাধিগুলির সামনে নির্বাক হয়ে তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। আল্লাহর অভিশাপে বেচারাদের কী কষ্টই না ভোগ করতে হয়েছে?
এবারে তাঁরা স্তম্ভটির দিক এগিয়ে গেলেন। মিনারের নিচেও আবলুস কাঠের একটা বিরাট দরজা। সেই দরজার গায়েও আর একটি সোনার পাতে রোমান হরফে উৎকীর্ণ হয়ে রয়েছে—
মহাকালের নামে
সেই পরম শক্তিমানের নামে
সেই চিরস্থিতিশীল পরমেশ্বরের নামে,
বলছি,
তোমরা যারা এখানে এসেছ তোমাদের বলছি
তোমরা কোনদিন আয়নার দিকে তাকিয় না।
তোমাদের একটি নিঃশ্বাসই তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো
করতে পারে।।
মায়াটাই মানুষের পা মচকানোর ফাঁদ।
আমার শক্তির কথা তোমাদের বলি :
আমার ঘোড়া ছিলো দশ হাজার
তাদের সহিস ছিলো বন্দী রাজার দল
আমাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে
হারেমে আমার ছিলো হাজারটা অনূঢ়া রাজকুমারী।
তাদের কুচগুলি চাদের মত মিষ্টি।
সারা বিশ্ব থেকে তাদের আমি সংগ্রহ করেছিলাম
পূর্ব আর পশ্চিম
আমার কাছে মাথা নত করেছিলো সবাই।
ভেবেছিলাম আমার ক্ষমতা অনন্ত
তারপর তারপর
যিনি অজর অমর সেই তাঁর কাছ থেকে
আমার ডাক এলো।
আমি আমার হাজার হাজার সেনানীদের ডাকলাম
ডাকলাম আমার অধীনস্থ শ্রেষ্ঠ রাজন্যবর্গকে
তাদের সামনে আমার কোষাগার খুলে দিয়ে বললাম :
‘আমার এই পাহাড় প্রমাণ সোনা-দানা, হীরা-মুক্তা
তোমরা সব নিয়ে যাও।
প্রতিদানে আর একটা দিন কেবল আমাকে
বাঁচিয়ে রাখ।’
মাটির দিকে মাথা নিচু করে
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো তারা।
আমার মৃত্যু হলো।
মৃত্যু এসে অধিকার করলো
আমার সিংহাসন।
সামাদের কবিতা পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সকলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। হৃদয়ের রুদ্ধ বেদনা কান্নার স্রোতে দুর্নিবার বেগে এলো বেরিয়ে। অনেকক্ষণ কান্নার পরে চোখের জল মুছে একজন একজন করে ভেতরে ঢুকলেন সবাই। বিরাট বিরাট হলঘর শূন্য—আদিগন্ত নিঃস্তব্ধতার মধ্যে নিঃসাড়ে পড়ে রয়েছে। কয়েকটা এই রকম হলঘর পেরিয়ে সব শেষে তাঁরা একটি বড় সাজানো গোছানো ঘরে এসে দাঁড়ালেন। এ ঘরখানা বেশ বড়-অন্য ঘরগুলির চেয়ে অনেক বড়। মাঝখানে বিরাট একটা টেবিল পাতা। টেবিলটি চন্দন কাঠের। টেবিলের ঠিক মাঝখানে ছোট একটি গাথা উৎকীর্ণ হয়ে রয়েছে–
এই টেবিলের চারপাশে
একদিন অনেক শকুনি রাজারা বসে থাকত
তাদের সঙ্গে বসে থাকত কানা রাজার দল।
এখন তারা সবাই অন্ধকারে শুয়ে আছে,
এখন তারা কেউ আর উঠতে পারে না,
এখন কেউ আর পায় না দেখতে।
ধাঁধাঁ লাগে মুশার। এ কবিতার অর্থ কী? এর উদ্দেশ্যটাই বা কী? এক টুকরো চামড়া বার করে বয়েতটা লিখে নিলেন তিনি। তারপরে প্রাসাদ ত্যাগ করে তানগরীর দিকে যাত্রা করলেন তাঁরা।
ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প বলা থামালো শাহরাজাদ।
তিনশো একচল্লিশতম রজনী :
পরের দিন রাত্রিতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ। তিনদিন ধরে একটানা চলছেন তাঁরা। তৃতীয় দিন বিকালের দিকে দিকচক্রবালের কাছাকাছি একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো তাদের। দেখতে পেয়েই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তারা। একটা ঘোড়াসওয়ার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুর্যাস্তের লাল রঙ তার গায়ের ওপরে পড়ে চকচক করছে। কিছুটা এগিয়ে গিয়েই বোঝা গেলো ওটা একটা মূর্তি। উঁচু বেদীর ওপরে বসানো। ঘোড়াসওয়ারের ডান হাতে বিরাট একটা তরোয়াল, লোহার। তরোয়ালশুদ্ধ হাতখানা জামার ওপরে তোলা। সেই তরোয়ালের ওপর শেষ সূর্যের আলো পড়ায় দূর থেকে লাল দেখাচ্ছিল। দূরে দিকচক্রবালে তখন লাল আলোর ফুলঝুরি ঝরছে। ধীরে ধীরে তারা মূর্তিটার কাছে এসে পৌঁছলেন। বেদী, ঘোড়া, আর তার সওয়ার সব কিছুই তামার পাতে। তৈরি। একমাত্র তরোয়ালটিই যা লোহার। বেদীর ওপরে একটি বয়েৎ। লেখার ধরনটি দেখলে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে?
এই নিষিদ্ধ দেশে
যদি তুমি পথ হারিয়ে ফেলো
তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে তুমি আমাকে ধাক্কা দাও।
সেই ধাক্কা খেয়ে।
যেদিকে আমি মুখ করে দাঁড়াব
সেইটি তোমার পথ।
মুশা এগিয়ে গিয়ে মূর্তিটার গায়ে একটা ধাক্কা মারলেন। সঙ্গে-সঙ্গে মূর্তিটা ঘুরে তারা যেদিকে এগোচ্ছিল তার ঠিক উলটো দিকে মুখ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আব্দ অল সামাদ ভুল পথে যাচ্ছিলেন। মূর্তির নির্দেশিত পথটাই যে আসল পথ তা তিনি বুঝতে পারলেন। নির্দিষ্ট পথে আবার তারা চলতে শুরু করলেন।।
চলছেন, চলছেন, চলছেন। একটানা অনেকদিন ধরে তারা চলছেন। পথে পড়লো বালি আর বালি। চারদিকে চুপচাপ। সেই নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললেন তারা। নেই কোন জীবন্ত প্রাণী; সবুজ পান্থপাপদ দূরস্থান, একমুঠো সবুজ ঘাসও কোথাও পড়লো না চোখে। তবু তাদের হাঁটার বিরাম নেই। তবু তারা চলছেন…চলছেন চলছেন।
বেশ কিছুদিন চলার পরে একদিন রাত্রিশেষে তারা বিশাল একটা কালোপাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেই পাহাড়ের গায়ে একটা অদ্ভুৎ প্রাণী। কে বা কারা তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। প্রাণীটার আধখানা মাটির তলায় পোঁতা; বাকি অর্ধেকটা মাটির ওপরে। ওপরের চেহারা ভয়ঙ্কর একটা দৈত্যের মত। মনে হলো, দোজখের কোন শয়তান সম্ভবত অনন্তকাল ধরে এই জীবটাকে শাস্তি দিচ্ছে। দুটো কালো রঙের পাখনাও রয়েছে তার। চারটে হাত তার। দুটো হাত সিংহের থাবার মত। বড়-বড় নখ বেরিয়ে রয়েছে। মাথাটা দেখতে গাধার মত। তার ওপরে কালো-কালো কোঁকড়া চুল ঝড়ো হাওয়ায় দুলছে। ভাটার মত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মাথার দুপাশে দুটো লম্বা-লম্বা শিং। চোখের ভুরু দুটো পাগলা ষাঁড়ের ভুরুর মত দেখতে। জীবটার চোখ তিনটে। তাদের মধ্যে একটা দুটো ভুরুর মাঝখানে স্থির হয়ে বসে রয়েছে। শিকার ধরার আগে চিতাবাঘ যেমন করে তাকায় এই চোখটার দৃষ্টি সেইরকম ভয়ঙ্কর। রঙটাও তার সবুজ। কিন্তু সেই জীবটার দেহের রঙ একেবারে কালো মিশমিশে। শরীরটা বিরাট একটা তালগাছের মত।
মুশার দলকে সামনে দেখে দৈত্যটা গর্জন করে শেকল ছোঁড়ার চেষ্টা করলো। ভাগ্যিস দৈত্যটাকে কালো পাথরের দেওয়ালে শেকল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিলো। তা লো হলে, শেকল ছিঁড়ে সে একটা কাণ্ড করে বসত। শেকল ছেড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতো সে, আর তা না পেরে আর্তনাদ করছে দারুণ। মুশার দল তো ভয়েই অস্থির। ভয়ে-বিস্ময়ে যেখানে তাঁরা। দাঁড়িয়ে ছিলেন সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পাও আর এগোতে সাহস করলেন না।
সামাদকে জিজ্ঞাসা করলেন মুসা—এই দৈত্যটার কী হয়েছে? আপনি কিছু জানেন?
ওকেই জিজ্ঞাসা করুন না। মনে হচ্ছে কিছু জিজ্ঞাসা করলে ও জবাব দেবে। আচ্ছা, দাঁড়ান; আমিই জিজ্ঞাসা করছি।
একমুহূর্ত দেরী না করে সামাদ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—দিন-দুনিয়ার মালিক পরমেশ্বর আল্লাহ এ জগতের সব দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু সৃষ্টি করেছেন। তোমাকেও সৃষ্টি করেছেন তিনি। আল্লাহ নামে তোমাকে অনুরোধ করছি, আমি যা যা তোমাকে প্রশ্ন করছি, তুমি তাদের জবাব দাও। তুমি কে? কী তোমার পরিচয়? কত দিন তুমি এইখানে এইভাবে শাস্তি পাচ্ছ?
প্রশ্নগুলি শুনে কুকুরের মত ঘেউ-ঘেউ করে উঠলো দৈত্যটা। তারপরে সে বললো—আমার নাম দাহিশ বিন আল-আমাশ। আমি ইব্লিসের একজন ইফ্রিদ। জিনের বাবা আমি। অদৃশ্য কোন শক্তি আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছে। অনন্তকাল ধরে আমার এই শাস্তি ভোগ চলবে।
সমুদ্রের রাজা এক সময় এই দেশ শাসন করতেন। লাল-পাথরের একটি মূর্তি “তাম্রনগরী” পাহারা দিত। মূর্তিটাকে আমি দেখাশুনা করতাম। থাকতামও তারই ভেতরে। নানান দেশ থেকে কাতারে-কাতারে মানুষ আসত আমার দৈববাণী শুনতে।
আমি ছিলাম সমুদ্রের রাজার একটি সামন্ত। ডেভিডের ছেলে সুলেমানের ফরমান অমান্য করে অনেক জিনই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। সমুদ্রের এই রাজা সেই জিনদের দলপতি হয়েছিলেন। আসলে এই রাজা কোনদিনই জিনদের প্রভু ছিলেন না। জিনদের প্রভুর সঙ্গে এই রাজার একদিন প্রচণ্ড লড়াই হলো। এই লড়াই-এ রাজা আমাকে তার প্রধান সেনাপতির পদে বরণ করলেন। লড়াইটা অকারণে শুরু হয়নি। এর পেছনে যে কারণটা ছিলো সেটাই আমি বলছি–
সমুদ্রের রাজার একটি পরমাসুন্দরী কন্যা ছিলো। তার রূপের কথা ছড়িয়ে পড়েছিলো দুনিয়ার সর্বত্র। একদিন সুলেমানের কানেও সেই সংবাদটা পৌঁছলো। সুলেমানের বিবি ছিলো অনেক। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? বিবির ভাঁড়ারে আরও একটি রত্ন সংগ্রহ করার বাসনা হলো তাঁর। রাজার মেয়েকে শাদী করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি একদিন দূত পাঠালেন। দূতের হাতে শাদীর প্রস্তাব ছাড়া আর দুটি নির্দেশ ছিলো তার। একটি হলো, সেই লাল পাথরের মূর্তিটা ভেঙে ফেলতে হবে। দ্বিতীয়টি ছিলো, আল্লাহ ছাড়া কোন ঈশ্বর নেই; আর সুলেমানই হচ্ছেন সেই আল্লাহর প্রেরিত একমাত্র ধর্মপ্রচারক।
এই দুটি নির্দেশ তাকে মেনে নিতে হবে।
দূতের কাছ থেকে এই নির্দেশ পেয়ে সমুদ্রের রাজা তার সমস্ত উজিরদের ডাকলেন; সেই সঙ্গে ডাকলেন আমাকে। আমরা সবাই জমায়েৎ হলে তিনি বললেন—সুলেমান আমাকে সাবধান করে দিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে আমাকে। তার প্রথম নির্দেশ তার সঙ্গে আমার মেয়ের শাদী দিতে হবে। তার দ্বিতীয় নির্দেশ জিনদের সেনাপতি দাহিস দিন আল-আমাশ যে পাথরের মূর্তির ভেতর থাকে সেই মূর্তিটা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এবার তোমরাই বলো এ নির্দেশ আমি মানব কি লো।
উজিররা বললেন—জাঁহাপনা আপনি সুলেমানকে মোটেই ভয় পাবেন না।
আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন—আমাদের সৈন্যরা সব ওঁর মত শক্তিশালী।
রাজা আমার দিকে তাকালেন।
আমি বললাম—জাঁহাপনা, আদেশ দিন, ওই দূতটাকে ধরে আমি উত্তম মধ্যম দিয়ে দিই। তাহলেই সুলেমানের চিঠির উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।।
আমার কথামতই কাজ হলো। ভালো করে উত্তম-মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো দূতকে—যা ব্যাটা, তোর মালিককে সব বলিস। যা
অপমানিত দূত সুলেমনের কাছে ফিরে গেলো। দূত অবধ্য। তাকে অপমান করার নীতি সভ্য সমাজে কোথাও নেই। দূতের কাছে সব শুনে সুলেমান প্রচণ্ড আক্রোশে ফেটে পড়লেন। চোখদিয়ে তার আগুন বেরোতে লাগলো। সেই সঙ্গে সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে জড় হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তার সৈন্যদের ভেতরে মানুষ ছিলো, জিন ছিলো, এমন কি পশু পাখিও ছিলো। মানব সেনানীর ভার দিলেন আসব বিন বারখিয়ার হাতে; ইফ্রিদের রাজা দিমর্যিাৎ সমস্ত জিন সৈন্যদের পরিচালনার ভার নিলেন; সেই সঙ্গে নিলেন পশু আর পাখিদের দায়িত্ব। সমগ্র আর বিচিত্র সেনাবাহিনীর সর্বময় দায়িত্ব নিলেন সুলেমান নিজে। তার সেই বিরাট বাহিনীটি জল, স্থল, অন্তরীক্ষ—এই তিনটি দলে ভাগ হয়ে গেলো। তারপরে শুরু হয় যুদ্ধ যাত্রা।
চার সারিতে পশুদের সেনাবাহিনী সাজানো হলো পাশাপাশি। বড়-বড় পাখিরা উড়তে লাগলো মাথার ওপরে। আমাদের সৈন্যদের গতিবিধি গুপ্তচরের মত আকাশ থেকে দেখে নিলো তারা। সুযোগ পেলেই পাখিগুলো এক একবার ছোঁ-মারার ভঙ্গীতে নীচে আসে তীরের মত; তারপরে, আমাদের সেনানীদের কারও কারও চোখ খুবলে নিয়ে আবার উড়ে যায় আকাশের ভেতরে। তারপরে এগিয়ে এলো মানব-বাহিনী। সকলের শেষে জিন। সর্বাধিনায়ক সুলেমান তার ডানদিকে রাখলেন উজির আসফ বিন বারখিয়া আর বাঁয়ে নিলেন ইফ্রিতদের রাজা দিমিব্যাতকে। স্বয়ং সুলেমান চললেন সোনা দিয়ে মোড়া পাথরের সিংহাসনের ওপরে চেপে সকলের মাঝখানে। চারটে হাতি টেনে নিয়ে চললে; তার সিংহাসন।
শুরু হলো যুদ্ধ।
সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হলো প্রচণ্ড কোলাহল। বেজে উঠলো দাদামা আর কাড়ানাকড়া। অশ্বারোহীরা ঘোড়ায় চড়ে ছুটে এলো। সে শব্দের সঙ্গে মিশে গেলো জিনদের চিৎকার। কর্কশ আওয়াজ শুনে শিকারী পাখিরা আকাশ থেকে ঝাপিয়ে পড়ছে শত্রু সেনাদের ওপরে। বাঘ-সিংহ-চিতা-হায়নারা ছুটে এসে আমাদের সৈন্যদের মুখে করে ধরে নিয়ে গিয়ে বসে-বসে কড়মড় করে চিবোতে লাগলো তাদের হাড়। লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়ের দাপাদাপিতে মাটি উঠলো কেঁপে। লক্ষ লক্ষ পাখির পাখার ঝাপটায় আকাশটা ফালাফালা হয়ে গেলো। আহতদের আর্তনাদে খানখান হয়ে গেলো আকাশ বাতাস। সে এক বীভৎস দৃশ্য। মনে হলো যেন সারা দোজখই নেমে এসেছে পৃথিবীর ওপর।।
বিদ্রোহী জিনদের সেনাপতি আমি। আমিও আমার সৈন্যদের যুদ্ধ করতে আদেশ দিলাম। আমার সৈন্যরা দিমির্যাত পরিচালিত জিনদের ওপরে ঝাপিয়ে পড়লো। সামনে থেকে সেনাবাহিনী পরিচালনা করলাম আমি।
ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করলো শাহরাজাদ।
তিনশো বিয়াল্লিশতম রজনী।
পরের দিন আবার শুরু করলো শাহরাজাদ।
আমি ভাবলাম সুলেমানকে খুঁজে বার করে নিজের হাতে তাকে শেষ করে ফেলব। যেই তার কাছাকাছি গেছি অমনি সুলেমান তার আগ্নেয়গিরির মত মুখব্যাদন করে আগুনের গোলা ছুঁতে লাগলেন। তার ওপরে সোঁ করে লাফিয়ে পড়ব বলে আমি আকাশের অনেক ওপরে উঠে গিয়েছিলাম। আগুনে গোলার হলকা আমাকে নীচে নামিয়ে আনল। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। জ্বলন্ত কয়লা লেগে আমার সারা শরীরটা জ্বলতে লাগলো। জ্বলন্ত কয়লার গোলা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়তে লাগলো আমাদের সৈন্যদের ওপরে।
এভাবে কতক্ষণ যুদ্ধ করা যায় বলো? তবু আমি হাল ছাড়িনি—আপ্রাণ লড়তে লাগলাম সৈন্যদের নিয়ে। কিন্তু সুলেমানের সৈন্য এত বেশী, আর এত বিচিত্র ধরনের যে পিছু হটা ছাড়া আমাদের আর উপায় রইলো না। সৈন্যদের পিছু হটার নির্দেশ দিলাম আমি। আর সে সঙ্গে আমিও প্রাণপণ শক্তি উড়ে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলোমা না। পশু-পাখি-মানুষ আর জিন দিয়ে সুলেমান আমাকে ঘিরে ফেললেন। আমাদের অনেকেই একেবারে মারা গেলো; অনেকেই জানোয়ারদের পায়ের চাপে চ্যাপটা হয়ে গেলো। সুলেমানের পাখিরা আমাদের সৈন্যদের মধ্যে অনেকেরই চোখ নিলো খুবলে, মাংস খেলো ছিঁড়ে খুঁড়ে।
প্রায় তিন মাস পালিয়ে বেড়ানোর পরে ধরা পড়লাম আমি। শাস্তিস্বরূপ তারা আমাকে এই কালোপাহাড়ের গায়ে শক্ত করে বেঁধে রাখল। এ শাস্তি আমাকে চিরকালই ভোগ করতে হবে। আমার সৈন্যদের ধোঁয়ায় রূপান্তরিত করে তামার জালার ভেতরে বন্দী করে রাখা হলো। সেই জানলাগুলির মুখ ভালো করে এঁটে সুলেমান তার নিজের সীলমোহরের ছাপ দিয়ে দিলেন। তারপরে সেগুলিকে সমুদ্রের গর্ভে ফেলে দেওয়ার দিলেন নির্দেশ। সেই সমুদ্রের ঢেউ তাম্র-নগরীরর প্রাচীরে এসে ক্রমাগত ধাক্কা খাচ্ছে।
যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই আমার এই অবস্থা। এই দেশের আর সকলের নসীবে কী ঘটছে তার আমি জানি নে। তবে তাম্র-নগরীর ভেতরে গেলে কাউকে-না-কাউকে নিশ্চয় তোমরা দেখতে পাবে। তারাও হয়ত আমারই মত বন্দী। তাদের সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয় তোমরা তাদের-ও কাহিনী শুনতে পাবে।
কাহিনী শেষ করে দৈত্যটা প্রচণ্ড বেগে ঝাড়া দিলো একটা। সেই শব্দে চারপাশে বিরাট একটা আলোড়ন জেগে উঠলো। ভয় পেয়ে মুশা তাঁর দলবল নিয়ে একটু পিছিয়ে গেলেন। দৈত্যটার কাহিনী শুনে মুশার একটু দয়াও হয়েছিলো। হয়ত, বাঁধনটা তার খুলেও দিতেন তিনি; কিন্তু তার এই বর্বর ব্যবহারে, তার মায়া নষ্ট হয়ে গেলো। দৈত্যটিকে পেছনে ফেলে তারা তাম্র-নগরীর দিকে যাত্রা করলেন। ওই তো কাছেই তাম্র-নগরী। তার মিনারের, স্তম্ভের, প্রাচীরের গায়ে সূর্যাস্তের অজস্র লাল রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত পায়েই এগিয়ে গেলেন তাঁরা।
তাম্র-নগরীতে পৌঁছবার আগেই অন্ধকার নেমে এলো; তারপরে এলো রাত। সমস্ত নগরীটিই নিস্তব্ধ অন্ধকারে থমথম করছে। কী যেন একটা ভয়ে তাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
কী করা উচিৎ পরামর্শ করলেন মুশা। তারপরে ঠিক হলো–রাত্রিতে নগরীতে প্রবেশ করে কাজ নেই। ভোর হলেই না হয় যাওয়া যাবে। তাই হলো। সিংহ দরজার কাছে তাবু খাটিয়ে সকলেই শুয়ে পড়লেন। পথশ্রমে ক্লান্ত হওয়ার ফলে শোওয়া মাত্র সবাই গভীর নিদ্রায় চলে পড়লেন।
ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটে উঠেছে। সবাইকে জাগিয়ে দিলেন মুশা। তাড়াতাড়ি সব কিছু বেঁধে ছেদে রওনা হলো দলটি। যে-কোন একটা দরজা দিয়ে ভেতরে চলো। ভোর পেরিয়ে সকাল এগিয়ে এলো। চারপাশে আলো ঝলমল করছে। সেই আলোতে তাম্র-নগরীর তামার পাঁচিল গেলো দেখা। কী চমৎকার ঝকমক করছে। দেখলেই মনে হবে, এইমাত্র যেন পাঁচিলটা কারখানা থেকে তৈরি হয়ে এসেছে। খুব উঁচু পাঁচিল চারপাশে পাহাড়টাকে আড়াল করে রেখেছে। পাহাড়ের সঙ্গে তামার পাতগুলি বেশ শক্ত করে আঁটা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ওটা পাহাড়েরই একটা অঙ্গ।।
প্রযুক্তিবিদ্যার এমন নিখুঁৎ কাজ আগে কেউ দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে সবাই সেই পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু দরজা কোথায়? তাজ্জব ব্যাপার! সকলের চোখই দরজা খুঁজতে ব্যস্ত। সেই দরজার অনুসন্ধানে পাঁচিলের পাশ দিয়ে সবাই হাঁটতে লাগলেন। ভেতরে ঢোকার পথ নিশ্চয় কোথাও না কোথাও রয়েছে।
অনেকক্ষণ কেটে গেলো। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। কোন দরজাই মিললো না। নিদেন পক্ষে একটা আধটা ফোকর পেলেও চলত। তা-ও চোখে পড়ে না কারও। এত বড় একটা নগরী। এখানে একটা প্রাণীকেও তারা ঢুকতে বা বেরিয়ে আসতে দেখলেন না। সত্যিই বড় আশ্চর্য ব্যাপার।
এদিকে বেলা বাড়তে লাগলো। অথচ নগরীর ভেতর থেকে আওয়াজ নেই। জীবন্ত প্রাণী থাকলেই কিছু-না-কিছু একটা শব্দ হয়। কিন্তু এখানে সেরকম একটা শব্দও তাদের কানে এলো না। নিজেদের পায়ের শব্দ আর কথা বলার শব্দ ছাড়া কোথাও আর কোন শব্দ নেই।
কিন্তু মুশা হাল ছাড়ার পাত্র নন। সকলকেই তিনি উৎসাহ দিতে লাগলেন। আগে চলো, আগে চলো, চলতে চলতে এগিয়ে এলো বিকাল। তারপরে একসময় তাও গড়িয়ে গেলো। সামনে সেই নিচ্ছিদ্র তামার প্রাচীর। মনে হলো যেন পৃথিবী যুঁড়ে তাদের সামনে উঠে দাঁড়িয়েছে। এর না আছে আদি না আছে অন্ত। সন্ধ্যার অন্তরালে একটা প্রাগৈতিহাসিক ছায়া যেন তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে।
ধীরে ধীরে নেমে এলো রাত্রি। বিশ্রাম করার জন্যে সবাইকে নির্দেশ দিলেন মুশা। আগের দিনের মত তাবু খাটিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। একা জেগে রইলেন কেবল মুশা। ভাবতে লাগলেন এ-হেন পরিস্থিতিতে কী করবেন তিনি, কী তাঁর করা উচিৎ। যেমন করে তোক ভেতরে ঢোকার পথ তো একটা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। সৈন্যদের ওপরে তাঁবু রক্ষার ভার দিয়ে সামাদ আর তালিব বিনকে নিয়ে তিনি পাহাড়ে ওঠার জন্যে রওনা হয়ে গেলেন। দেখতে হবে ভেতরে কী রয়েছে। চারপাশটাও একবার দেখা দরকার। কেন ভেতরে ঢোকার পথ পাওয়া যাচ্ছে না। তাও খুঁজে বার না করলে আর চলছে না।
রাত্রি শেষ হতে চললো দেখে গল্প বলা থামিয়ে দিলো শাহরাজাদ।
তিনশো তেতাল্লিশতম রজনীতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ :
সটান পাহাড়ে উঠে গেলেন তিনজন। চারপাশে একেবারে নিতল কালো অন্ধকার তার ডানা মেলে চুপচাপ বসে রয়েছে। সেই দুকূলপ্লাবনী অন্ধকারে চোখগুলি থিতিয়ে নিতে সময় গেলো তাঁদের। হঠাৎ পূব দিক থেকে একটা জোরালো আলো এসে পড়লো। দেখা গেলো পাহাড়ের পেছন থেকে চাঁদ উঠছে। দেখতে-দেখতে চাদটা পাহাড়ের ওপরে উঠে এলো। এবার পাহাড় আর সমতল সবই ভরে গেলো অপরূপ একটি রূপালি আলোতে। সেই আলোয় তাম্র-নগরীর ভেতরে তাকালেন তারা। যা দেখলেন, তাতে তাদের চোখ আপ্লুত হয়ে উঠলো বিস্ময়ে। বিস্মিত হতবাক হয়ে গেলেন তারা।
এ যেন এক স্বপ্নময় শহর।
সারা শহর চাদের আলোতে ভেসে যাচ্ছে। অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। সে আলোকে তারা দেখতে পেলেন বড়-বড় প্রাসাদ আর তাদের গম্বুজগুলি সারা শহর ছড়িয়ে রয়েছে। কী সুন্দর তাদের গঠন-ভঙ্গিমা। দেখা যাচ্ছে বড়-বড় প্রাসাদের ছাদ, আর অলিন্দ। শহরের মাঝখান দিয়ে বেশ বড় একটা খাল যাচ্ছে বয়ে। তার দুপাশে অজস্র সবুজ গাছের সারি। সেই সব গাছে ছায়ার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে খালের জল বয়ে চলেছে। প্রাচীরের বাইরেই সমুদ্র। দূর থেকে দেখতে লাগছে অনেকটা ধাতুর পাহাড়ের মত। তামার প্রাচীর, বাড়ির ছাদ, সমুদ্র, খাল, আর পশ্চিমের পাহাড়ের ছায়া সব মিলিয়ে ওই চাদের আলোয় রাত্রের মিঠে হাওয়া এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
সেই আলোতে বিস্তীর্ণ সমাধিক্ষেত্র নিঝুম হয়ে পড়ে রয়েছে। কোন মানুষ নেই, মানুষের কোন চিহ্ন ওখানে নেই। সমাধিক্ষেত্রের ওপরে তামার ঘেরাটোপ, পাথরে কুঁদা অশ্বারোহীর বিরাট মূর্তি, আকাশের পাখি, বিরাট-বিরাট প্রাসাদ যেন কোন এক মায়ামন্ত্র বলে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে দাঁড়িয়ে। বাদুড় বা প্যাঁচা—তারাও বোধ হয় এই বিশাল স্তব্ধতাকে এড়িয়ে চলেছে।
তাম্র-নগরী সুপ্ত। এ ঘুম বোধ হয় আর ভাঙবে না তার।
এ এক অভিশপ্ত পুরী।
সবই দেখলেন মুশা; কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। সঙ্গীদের নিয়ে নীচে নেমে এলেন তিনি। পাহাড় থেকে নেমে আবার তাঁরা প্রাচীরের সামনে এসে থামলেন। প্রাচীরের দিকে তাকাতেই চারটি উত্তীর্ণ লিপি চোখে পড়লো তাদের। এগুলির হরফ-ও রোমান। সেখ আব্দ-অল-সামাদ লিপিগুলি একটি একটি করে পড়ে তাদের অর্থ বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে।
প্রথম কবিতাটি পড়লেন সামাদ–
হে মানুষের সন্তান, তোমরা কেবল
ভবিষ্যতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ যোগ করে যাচ্ছ;
কিন্তু মৃত্যুর ধূসর শূন্যতা
তোমাদের সমস্ত সঞ্চয় নষ্ট করে দিচ্ছে।
সকলের ওপরে এক প্রভু রয়েছেন–
তিনি সৈন্যবাহিনীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন
রাজচক্রবর্তীদের জন্যে তিনি ছোট-ছোট
অন্ধকারে কুঠরি ঠিক করে দিয়েছেন।
রাত্রির অন্ধকারে তারা সব ধূলিশয্যা থেকে উঠে
সব একাকার হয়ে যায়।
বুকের বেদনা চেপে রাখতে পারলেন না মুশা; বলে উঠলেন—উঃ! কী নিষ্ঠুর!! আত্মা অবিনশ্বর। এ-দুনিয়ায় আল্লার চোখে সবই সমান। কিন্তু আত্মাকে তো ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় না। সে জাগবেই। সত্যি বলছি সামাদ সাহেব, বয়েটি আমার মনে গেঁথে গেলো।
দ্বিতীয় কবিতাটি পড়লেন সামাদ–
হে মানুষের সন্তান, চোখের ওপরে
তোমরা হাত চাপা দাও কেন?
ভয়ে-ভয়ে তুমি এই পথে খেলা কর কেন?
এই পথই তো তোমাকে আর একটি ঠিকানায় নিয়ে যাবে।
সেই রাজারা আজ কোথায়?
কোথায় বা সেই সব বলদীপ্ত মানুষগুলি?
হে মানুষের সন্তান,
সেই ইরাকের প্রভু আজ কোথায়?
কোথায় আজ সেই ইস্পাহানের সম্রাট?
এই কবিতাটিও বড় ভালো লাগলো মুশার। তৃতীয় কবিতাটি পড়তে লাগলেন সামাদ :
হে মানুষের সন্তান, পথের ওপরে
অপরিচিত একটি মানুষকে তুমি দেখতে পাচ্ছ,
তুমি তাকে ডাকলে, সে থামলো না।
সেই তো তোমার জীবন।
এখন সে ভারত আর চীন সম্রাটের সঙ্গে
তাড়াতাড়ি দেখা করতে ছুটছে
সিনহা আর নুবিয়ার সম্রাটের সঙ্গে
তার যে জরুরী দরকার।
তারা তো তোমারই মত
দুর্নিবার কোন এক নিঃশ্বাসের ঝড়ে
পাহাড়ের চূড়া থেকে গড়িয়ে পড়েছে নীচে।
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন মুশা—কোথায় গেলো সেই নুবিয়া আর সিনহার সুলতানেরা? সব শেষ হয়ে গিয়েছে তাদের। এক দুর্নিবার ঝড়ে প্রভুত্বের শিখর থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছে তারা।
শেষ কবিতাটি পড়তে শুরু করলেন সামাদ–
হে মানুষের সন্তান, কৃশাঙ্গী মৃত্যু
তোমার কাঁধের ওপরে পাখির মত বসে রয়েছে,
তোমার সুরার পেয়ালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে
তাকিয়ে রয়েছে তোমার প্রিয়ার কুচ যুগের দিকে।
বিশ্বের চাতুরীর জালে ধরা পড়েছ তুমি–
আর মাকড়সা তোমারই পেছনে ওৎ পেতে বসে রয়েছে–
শূন্যতাই এই মাকড়সার আর একটি নাম।
পাহাড়ের শিখরের মত যাদের আশা ছিলো উঁচু
তারা আজ কোথায়?
তারা পাচারই আগে থাকত কবর খানায়
আজ তারা প্রাসাদের বাসিন্দা।
অন্তরের বেদনা চোখ দিয়ে উপছে পড়লো মুশার। চোখ দুটো দিয়ে তাঁর জলের ধরা গড়িয়ে পড়লো। কপাল টিপে মুখ নিচু করে আপনার মনেই তিনি বললেন-হে জন্ম-মৃত্যুর নিয়ন্তা, মেরেই যদি ফেলবে তাহলে অযথা আর মানুষের জন্ম দিলে কেন? আমরা তুচ্ছ মানুষ। পরম পিতা আল্লাহই আমাদের আসল ঠিকানা জানেন। এই প্রশ্নের জবাব কী হবে একমাত্র তিনিই জানেন। আমাদের কাজ কেবল তার আরাধনা করা, তার নির্দেশ বিনা অভিযোগে মেনে নেওয়া।
সঙ্গীদের সঙ্গে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এলেন মুশা। তাঁবুতে ফিরে নির্দেশ দিলেন সেনানীদের—এখনই দুখানা মই তৈরি কর। সেই মই বেয়ে আমরা তামার প্রাচীর টপকে ভেতরে যাব। একখানা মই থাকবে বাইরে; সেটা দিয়ে উঠবে। একটা থাকবে ভেতরে, সেটা দিয়ে নামবে।
সেনানীরা সঙ্গে-সঙ্গে পাহাড় থেকে কাঠ কেটে নিয়ে এলো। ফালাফালা করলো কাপড়। সেই ফালা কাপড় আর কোমর বন্ধনী দড়ির মত করে নিলো। সেই সঙ্গে নিলো কিছু উটের লাগাম। তাই দিয়ে বেশ শক্ত করে দুটো মই তৈরি করে ফেললো। পাথরের ছোট, টুকরো দিয়ে শক্ত করে নিলো মই-এর গোড়া। মই লাগানো হলো দেওয়ালের গায়ে। আল্লাহর নাম করে উঠতে লাগলো সবাই। আগে উঠলেন মুশা নিজে।
ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।
তিনশো চুয়াল্লিশতম রজনী?
পরের দিন রাতে আবার শুরু হলো শাহরাজাদের কাহিনী।
তাম্র নগরীতে ঢোকার আগে মুশা জন কয়েককে রেখে গেলেন তাঁবু পাহারা দেওয়ার জন্যে। বাকি সকলকে নিয়ে তিনি উঠলেন প্রাচীরের মাথায় প্রাচীরটা বেশ চওড়া। কিছুটা পথ প্রাচীরের ওপর দিয়েই হেঁটে গেলেন সকলে; থামলেন দুটো উঁচু বুরুজের মাঝখানে। বুরুজ দুটো দু’খানা তামার দরজা দিয়ে শক্ত করে আঁটা। দরজা দুটো এমনভাবে আঁটা যে তাদের ফাক দিয়ে একটা সুঁচ-ও গলানো যায় না। দরজার পাল্লার ওপরে সোনার তৈরি নিরস্ত্র একটি অশ্বারোহীর মূর্তি। একখানা হাত দিয়ে কী যেন বলতে চাচ্ছে সে। ভালো করে পড়তেই দেখা গেলো রোমান হরফে একটি নির্দেশ লিপি। লিপিটি যথারীতি পাঠোদ্ধার করার পরে বোঝা গেলো সব। লেখা রয়েছে—নাভির কাছে একটা পেরেক আছে। বারোবার সেটা টিপে দাও।.
তাড়াতাড়ি মুর্তিটার কাছে এগিয়ে এলেন মুশা। মূর্তিটার নাভির কাছে সত্যিই একটা সোনার পেরেক রয়েছে। গুণে-গুণে বারোবার সেই পেরেকটা টিপে দিলেন মুশা। আর সঙ্গে-সঙ্গে ম্যাজিকের মত পাল্লা দুটো ফাক হয়ে গেলো। দেখা গেলো, দরজার পাশ দিয়ে লাল গ্রানাইট পাথরের বিশাল একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গিয়েছে। দেরি না করে মুশা তার দলবল নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন। নেমে এসে একটা হলো ঘরের মধ্যে দাঁড়ালেন তারা। হল ঘরের সামনে রাস্তার ওপরে কয়েকজন প্রহরী পাহারা দেওয়ার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের এক হাতে ধনুক, আর এক হাতে তরবারি।
মুশা বললেন—ওরা যাতে আমাদের বাধা না দেয় সে কথা ওদের বলতে হবে আমাদের।
প্রহরীদের কাছে গিয়ে দলবল নিয়ে মুশা দাঁড়ালেন; বললেন—আমি এদের দলপতি। আপনাদের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখতে চাই। আমরা ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলব।
কেউ নড়লো না, চড়লো না। যেমন দাঁড়িয়েছিলো তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো।—নিথর নিস্পন্দ। আগন্তুকের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখলো না। তবে কি এরা আরবি বুঝতে পারছে না?
সামাদকে বললেন মুসা—আপনার জানা যত ভাষা রয়েছে সেই সব ভাষাতে এদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, এরা বুঝতে পারে কি না।
গ্রীক ভাষা দিয়ে শুরু করলেন সামাদ। কোন কাজ হলো না। হিন্দু, হিব্রু, ইথিওপিয়ান, এমনকি শেষ পর্যন্ত পারশিয়ান আর সুদানিজ ভাষাতেও কথা বললেন তাঁদের সঙ্গে। বৃথা চেষ্টা। কেউ কোন সাড়া পর্যন্ত দিলো না।
মুশা বললেন—আমরা কেউ ওঁদের অভিবাদন জানাই নি। সেই জন্যেই সম্ভবত এঁরা আমাদের ওপরে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আপনি একটা কাজ করুন সামাদ সাহেব। দুনিয়ায় যত রকমের অভিবাদনের রীতি রয়েছে সে সবগুলিই আপনি এঁদের কাছে দেখান তাতে কোন কাজ হয় কি না দেখি।
ত্রিকালজ্ঞ বৃদ্ধ সামাদ বিভিন্ন দেশের রীতিতে অভিবাদন জানালেন। না; এতেও তাদের মুখে কোন কথা ফুটলো না। কেউ সাড়া দেবে না বলেই যেন মনে হচ্ছে। আর ফালতু চেষ্টা আর সেই সঙ্গে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সবাইকে পিছু পিছু আসার নির্দেশ দিয়ে মুশা রাস্তায় নেমে চলতে
শুরু করলেন। প্রহরী যেমন ছিলো তেমনি নির্বকার ভাবেই পড়ে রইলো।
যেতে-যেতে সামাদ বললেন—আল্লাহ দুনিয়ায় অনেক ঘুরেছি আমি, দেখেছি অনেক। কিন্তু এমন তাজ্জব ব্যাপার কোন দিনই আমাদের চোখে পড়েনি। এ যেন আমাকে
হাঁটতে-হাঁটতে দলটি একটা বাজারে এসে পড়লো। দোকান পাট সব খোলা; হাটের ভেতরে গিজগিজ করছে লোকে। থরো-থরে জিনিসপত্র সব সাজানো দোকানে। জোর বাজার চলছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। কিন্তু কী অদ্ভুৎ! কেউ নড়াচড়া করছে না। যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতবড় বাজার। এত লোক! কিন্তু টু শব্দটিও নেই কোথাও। দেখে মনে হচ্ছে, পরদেশী দেখে সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভিনদেশী মানুষেরা চলে গেলে আবার যে যার কাজে মন দেবে। কিন্তু তাদের দিকে কেউ ভ্বদক্ষেপ করছে না। নাকি, অবজ্ঞা দেখিয়েই তারা ওদের আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে নীরবে।
বাজার থেকে বেরিয়ে তারা আবার চলতে শুরু করলেন। চলতে-চলতে আর একটা ছন্দওয়ালা বাজারে হাজির হলেন তারা। কিন্তু সেই একই ব্যাপার। লোক আছে, লস্কর আছে, জিনিস আছে, পত্ব আছে, ক্রেতা আছে, বিক্রেতা আছে। যা নেই তা হচ্ছে আলোড়ন; মুশার দলের লোকের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না।
রাস্তার ওপরের দৃশ্যও সে-ই একই। দুপাশে চক মেলানো বাড়ি। রাস্তায় অনেক লোকজন। তাঁরা চলছেন। কেউ তাদের লক্ষ্য করছে না; আহ্বানও করছে না, বিরক্ত-ও হচ্ছে না। এমন কি তাঁদের দেখে কারও মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠেনি। পথের ধারে সোনার দোকান, রেশমী কাপড়ের দোকান, মশলার দোকান, গন্ধ দ্রব্যের দোকান। কিন্তু সব চুপচাপ সবই নিশ্চল।
একটা বাজারের সীমান্তে এসে থামলেন তারা। সামনেই বিরাট একটা তামার চাদর। তারই ওপরে রোদ পড়ে ভীষণ চকচক করছে সব। ওরই আলোতে ঝলমল করছে বাজার। তামার চাঁদরের ওপাশে শ্বেতপাথরের বিরাট একটা প্রাসাদ। তার দুধারে দুটো কেল্লা। কেল্লার পুরোটাই তামার তৈরি। কেল্লার মাথাটা এত উঁচু যে মাথা তুলে দেখতে গেলেই মাথাটা ঘুরে যায়। কেল্লার সেই তামার দেওয়ালে সোনার পাতে আঁকা-নানা রকম পশুর ছবি। সেই সব পশুদের আবার পাখা রয়েছে। প্রাসাদের সামনে প্রহরীরা সব সারিবীন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের কারও হাতে তরবারি, কারও হাতে বল্লম। সূর্যের আলো পড়ায় তরবারি আর বল্লমগুলি যেন আগুনের মত জ্বলছিলো। প্রাসাদের যে বিরাট দরজা সেটিও সোনায় তৈরি।
মুসা তাঁর দলবল নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করলেন। ঢুকেই একটা বড় গ্যালারি দেখতে পেলেন। নিরেট পাথরের বিরাট বিরাট থামের ওপরে প্রাসাদটা দাঁড়িয়ে। গ্যালারির মাঝখানে সুন্দর এক ফালি চাদর। রঙিন পাথর দিয়ে সেটি তৈরি। গ্যালারিটাকে একটা দুর্গ বলে মনে হচ্ছে। এর দেওয়ালে দেওয়ালে কত রকমের অস্ত্র শস্ত্র যে ঝুলছে তার আর ইয়ত্তা নেই। অস্ত্রগুলির হাতলে মূল্যবান পাথর বসানো। সেই গ্যালারিতে বসে-বসে অনেক দর্শক সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখছে। কালো মেহগনি কাঠের ওপরে সোনার পাতা দিয়ে মোড়া আসনগুলি।
আশ্চর্যের কথা মুশার সৈন্য সামন্তদের দেখে কেউ কিন্তু আদৌ বিচলিত হলো না। এমন কি তাঁদের কেউ বাধাও দিলো না। নিবিবাদে এগিয়ে চললেন তারা।
ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।
তিনশো পঁয়তাল্লিশতম রজনী :
পরের দিন রাত্ৰিতে যথারীতি গল্প শুরু করলো শাহরাজাদ। গ্যালারির বাঁকানো কাৰ্নিশের দিকে নজর পড়লো তাদের। সেখানেও সোনার পাতে রোমান হরফে একটা কিছু লেখা রয়েছে। সামাদ তার পাঠোদ্ধার করে বললেনঃ
হে মানুষের সন্তান,
তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে দাঁড়াও,
দেখবে, মৃত্যু তোমার পিছনে রয়েছে।
আদম তাকে দেখেছিলো, দেখেছিলো নিমরড;
পারস্যের সম্রাটরাও দেখেছিলো তাকে।
আর দেখেছিলো বিশ্বজয়ী আলেকজান্দার।
হামাম, কারুম, আর সাদাদা-ও দেখতে
ভুল করে নি তাকে।
এ-জগৎ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছিলো
তাদের ওপরে।–
একটি প্রশ্নও করা হয়েছিলো তাদের
যে প্রশ্ন এ-জগৎ করতে পারত না তাদের।
হে অমৃতের পুত্রগণ, শোনো :
মৃত্যুর ভয়ই মানুষের মধ্যে জ্ঞানের
উন্মেষ করে;
এ জীবনে যতটুকু ভালো কাজ তুমি করবে
এই রক্তাক্ত জীবনে
সেই গুলিই ফুল হয়ে ফুটে উঠবে।
ছত্র কটি লিখে নিলেন মুশা। সেই দেখে আরও কয়েকজন লিখে নিলেন বয়েতটি। তারপরে দলটি গ্যালারির পাশ দিয়ে আর একটি ঘরে ঢুকলো। এই ঘরের মাঝকানে স্বচ্ছ পাথরের মুখ দিয়ে জলের ফোয়ারা বেরিয়ে আসছে। ভেতরে ছাদটা ঢাকা ছিলো সোনালি সূতোয় কাজ করা সিল্কের কাপড়ে। শিল্পশৈলীর এ এক অপরূপ নিদর্শন। ফোয়ারার জল চারটি নালি দিয়ে বয়ে চলেছে। মেঝের ওপর দিয়ে আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে নালিগুলি কাটানো হয়েছে। চারটি নালির চারটি তলা বিভিন্ন রঙ দিয়ে তৈরি। প্রথমটি লাল পাথরের, দ্বিতীয়টি পোখরাজের, তৃতীয়টি পান্নার মত সবুজ পাথরের, চতুর্থটি তৈরি হয়েছে নীলকান্ত মনি দিয়ে। নালির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় জলগুলিও ভিন্ন-ভিন্ন রঙে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। সিল্কের ছাদ থেকে আলো এসে পড়েছে সেই সব নালির জলের ওপরে। সেই রঙ ছিটকে পড়ছে শ্বেত পাথরের দেওয়ালের ওপরে। প্রতিবিম্বিত হয়ে সেই রঙ বিশাল সমুদ্রের আমেজ এনে দিচ্ছে ঘরের মধ্যে।
দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বেরিয়ে আর একটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো দলটি। সেই ঘরে জমা হয়ে রয়েছে পুরানো আমলের সোনা রূপার মুদ্রা, হীরা, মুক্তা, মনি, জহরৎ। কিন্তু এত দামী-দামী পাথরগুলি ঘরের মেঝেতে ছত্রাকার হয়ে পড়ে রয়েছে। ফলে ঘরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়।
এই ঘরের ভেতর দিয়ে দলটি আর একটি ঘরে প্রবেশ করলো। এই ঘরেছিলো নানান জাতীয় অস্ত্রশস্ত্ব—বহু দুষ্প্রাপ্য আর মূল্যবান ধাতু দিয়ে গড়া সেগুলি। রঙিন পাথর বসানো সোনার উইিছল, সাবেকী আমলের শিরস্তান, ভারতীয় তরবারি, বর্শা, বল্লম ইত্যাদি। এসব অস্ত্র সব ডেভিড অথবা সুলেমানের আমলের। অস্ত্রগুলি সব চকচক করছে। মনে হলো, যেন সবে তৈরি হয়ে এসেছে।
চতুর্থ ঘরটি জামা-কাপড়ে বোঝাই। দেওয়ালের ধারে চন্দন কাঠের আলমারিতে সাজ পোশাক সব যত্ন করে তোলা রয়েছে। দুর্মুল্য সিল্ক আর মসলিনে তৈরি এই সব পোশাক। এর পরের ঘরটিতে নানা রকমের বাসন কোসন ছিলো। ফুলদানি থেকে শুরু করে খানাপিনীর, মায় স্নানের বাসন পর্যন্ত রয়েছে। এসব বাসনই সোনা বা রূপোর তৈরি। স্নানের পাত্রটি স্বচ্ছ পাথরের, মূল্যবান পাথরের তৈরি পান পাত্র। খাবার বাসনগুলি দামী দামী নানান রঙিন পাথরের তৈরি।
মনে হয় যেন বেহেস্তের ঐশ্বর্য এক জায়গায় এসে জড় হয়েছে এইখানে। দেখে–দেখে আশা মেটে না কারও। হঠাৎ তাঁদের মনে হলো, অনেকক্ষণ ঘুরছেন তাঁরা; এবার ফেরার সময় হয়েছে। যে পথে এসেছেন সেই পথ ধরে ফেরাই সুবিধেজনক।
পেছন ফিরলেন তারা। সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের একটা দেওয়ালের ওপরে তাদের চোখ আটকে গেলো। সোনার কাজ করা মহামূল্যবান সিল্কের বিরাট একটি পর্দা ঝোলানো রয়েছে সেইখানে। তাতেই ঢাকা পড়েছে দেওয়ালটা।
পর্দাটি তুলতেই বিরাট একটা দরজা দেখা গেলো। আবলুস কাঠের দরজায় রূপের তালা ঝোলানো। কিন্তু ঘরটা খোলা যায় কেমন করে? ওর চাবিটা কোথায়? তালাটা খোলার কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না তারই জন্যে সামাদ সাহেব চারপাশে দেখতে লাগলেন। তালাটার নিচে ছোট একটা স্প্রিং লাগানো। সেইখানে চাপ দিতেই তালাটা গেলো খুলে। তালাটা খুলে যেতেই সবাই ঢুকে পড়লেন ভেতরে। মার্বেল পাথরের বিরাট গম্বুজ রয়েছে ঘরের ভেতরে। আয়নার মত চকচক করছে পাথরের জানোলা। তাতে নানান রকমের মূল্যবান পাথরের কাজ। বাইরের আলো সেই সব পাথরের ওপরে পড়ে মেঝের ওপরে লুটিয়ে পড়েছে। অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ঘরের মাঝখানে মেঝের ওপরে পাতা সোনার কাজ করা কাপেট। তার ওপরে বসানো পাখি। তার ঠোঁট দুটো রুবির; পাখার পালক পান্নার। তাছাড়া রয়েছে সুন্দর সুন্দর ফুলের শোভা। কেবল গন্ধটাই নেই তাদের। চারধারে গাছের ডালে বসে রয়েছে পাখিরা। এখনই যেন সঙ্গৎ শুরু হবে। ঘরের মাঝখানে একটা উঁচু বেদী।
কয়েকজনকে নিয়ে মুশা সেই বেদীর ওপরে এসে দাঁড়ালেন। একটা জিনিস দেখে তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন। মনিমুক্তার কাজ করা একটি মখমলের চাঁদোয়ার তলায় বড় একটি পালকের ফুলের মত একটি মেয়ে শুয়ে রয়েছে। টানা টানা ভুরুর দু’ধারে পদ্ম পাপড়ীির মত চোখ বুজিয়ে মেয়েটি ঘুমোচ্ছে। তার মাথার সোনার মুকুটখানি তার চুলগুলিকে জড়িয়ে রেখেছে, হাওয়ায় এলোমেলো হতে দেয় নি। মুক্তার হারটি তার কণ্ঠালগ্ন হয়ে সলজ্জভঙ্গীতে পড়ে রয়েছে। দুধারে মেয়েটির মাথার কাছে দুটি ক্রীতদাসী দাঁড়িয়ে। একজন ফর্সা, আর একজন কালো, একজনের হাতে উন্মুক্ত কৃপান, আর একজনের হাতে বর্শা। মেয়েটির পায়ের কাছে একটি পাথরের ফলকে লেখা : আমার নাম তন্দমুর। আমালকাইৎসের রাজকন্যা। এ শহর আমার। চারদিকে ধনরত্ন যা পড়ে রয়েছে তা তোমরা ইচ্ছেমত নিয়ে যেতে পোর। এখানে যে আসবে সব কিছু তারই। কিন্তু সাবধান। আমার রূপে অন্ধ হয়ে কেউ যেন আমাকে স্পর্শ করো না। যে করবে তার সর্বনাশ হবে। ঘুমন্ত রাজকুমারীকে দেখে মুশা কেমন যেন সংবিৎ হারিয়ে ফেলছিলেন। সাবধান বাণী’ পড়ে হঠাৎ নিজেকে সামলিয়ে নিলেন তিনি।
মুশা বললেন—এখন থেকে এখোন আমাদের চলে যেতে হবে। দুনিয়ার সব আশ্চর্য জিনিসই তো আমরা দেখলাম। এ দৃশ্য জীবনে কেউ ভুলতে পারবে না। এবার যেতে হবে সমুদ্রের দিকে। খুঁজে বার করতে হবে তামার জালাগুলি। সৈন্যগণ, তোমরা যার যা খুশি ধনরত্ন নিয়ে যেতে পার। কিন্তু সাবধান, রাজকুমারীর অঙ্গস্পর্শ কেউ করবে না।
ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প থামিয়ে চুপ করে রইলো শাহরাজাদ।
তিনশো ছেচল্লিশতম রজনী :
পরের দিন রাত্ৰিতে আবার শুরু হলো গল্প। সকলকেই সাবধান করে দিলেন মুসা। তালিব বিন-সান বললেন—আমীর, এই মেয়েটির রূপের কাছে এই প্রাসাদের সব কিছুই তুচ্ছ। ওকে দামাসকাসে তুলে নিয়ে গিয়ে খলিফাকে উপহার দিতে না পারলে আমার দুঃখের আর সীমা পরিসীমা থাকবে না। আমার বিশ্বাস, ইফ্রিতের জালা বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই মেয়েটিকে নিয়ে গেলে খলিফা আরও বেশী খুশি হবেন।
মুশা বললেন–রাজকন্যাকে আমরা স্পর্শ করতে পারব না।
তালিব বললেন—স্পর্শ করলে রাজকুমারী খুশিই হবেন। এটুকুর জন্যে উনি কিছু মনে করবেন না।
এই বলে রাজকুমারীকে কোলপাঁজা করে তুলে নিলেন তালিব। সঙ্গে-সঙ্গে একজন ক্রীতদাসীর কৃপণের আঘাতে তীর ছিন্ন মুণ্ডু মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। দ্বিতীয় ক্রীতদাসীর বর্শার ফলক তালিবের বুকে আমূল বিদ্ধ হয়ে গেলো। তালিবের মৃতদেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেলো যে কেউ বুঝতে পারলো না কী হলো। প্রাসাদের ভেতরে মুশা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত বেরিয়ে এলেন প্রাসাদ ছেড়ে, হাঁটতে লাগলেন সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রের পাড়ে এসে কয়েকজন জেলেকে দেখতে পেলেন। হ্যাঁ; এরাই প্রথম কথা বললো তীর সঙ্গে। জেলেদের এক বুড়ো সর্দারকে ডেকে তিনি বললেন—আমাদের মালিক খলিফা আব্দ আল-মালিক-এর নির্দেশে আমি এখানে এসেছি। ধর্মপ্রচারক সুলেমানের সময় কতকগুলি ইফ্রিতকে তামার জালায় পুরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। আমরা সেইগুলির খোঁজে এসেছি। এ ব্যাপারে তুমি আমাদের একটু সাহায্য করবে? আর একটা কথা রয়েছে আমার। এই শহরের লোকজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছ। কেন জান?–
বুড়ো জেলে বললো—সমুদ্র তীরের সমস্ত জেলে আল্লার নির্দেশে চলে আসছে। পরম পিতা আল্লার ধর্মপ্রচারকের নির্দেশও আমরা মেনে চলি। তাম্র নগরীর মানুষদের এই অবস্থা অনেকদিন থেকেই চলে আসছে। বিচারের দিন পর্যন্ত ওই রকমই চলবে।
ইফ্রিতের জালা পেতে আপনার কষ্ট হবে না। অনেক ইফ্রিৎ বন্দীই এখানে রয়েছে। জালার ঢাকনা খুলে ইফ্রিৎ বার করে মাছের সঙ্গে রান্না করে আমরা খাই। যতগুলি ইফ্রিৎ আপনার দরকার সবই আপনাকে আমি দিতে পারব। তবে খুব সাবধান। ঢাকনা খোলার আগে নিজের হাতে জালার মুখটা টিপে রাখবেন। ওদের দিয়ে শপথ করিয়ে নেবেন—ধর্মপ্রচারক মোহাম্মদের নির্দেশ আমরা মানবো। ডেভিডের পুত্র সুলেমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য আমরা প্ৰায়শ্চিত্ত করব।
খলিফা আব্দ আল-মালিকের প্রতি আমাদের আনুগত্য দেখানোর জন্যে দুটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে উপহার স্বরূপ আপনার সঙ্গে পাঠাব। এমন রূপ দুনিয়ায় আপনি দেখতে পাবেন না।
এর পরে বুড়ো জেলে মুশার হাতে বারোটি মুখ আঁটা তামার জালা তুলে দিলো। প্রত্যেকটির ওপর সুলেমানের মোহর রয়েছে। সমুদ্রের দুটি মেয়েকেও এনে দিলো সেই সঙ্গে। সত্যিই অপূর্ব দেখতে মেয়ে দুটি। পিঠ ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল। মুখখানা চাঁদের মত সুন্দর। বর্তুলাকার বক্ষ। নিম্নাঙ্গ আরও আকর্ষণীয়। গুরুভার নিতম্ব, সবল কদলী কাণ্ডের মত উরুদ্বয়। মনুষ্য জগতে এরূপ সত্যিই দুর্লভ। চলতে গেলে মাছের মত একটু ডানদিকে একটু বাঁদিকে হেলে। সে তো চলে না নাচে। কেউ দেখছে বুঝতে পারলে নাচের ভঙ্গী আরও বেড়ে যায়। মিষ্টি গলার স্বর। হাসিটি আরও মিষ্টি। নেশা ধরে যায় যেন। জানা-অজানা কোন ভাষাতেই ওরা কথা বলতে পারে। না, বুঝতে পারে না। কিন্তু বললে কেবল হাসে।
মুশা আর তাঁর সঙ্গীরা জেলেদের অজস্র ধন্যবাদ জানালেন। তারা তাঁদের অনেক সাহায্য করেছে। মুশা তাদের সর্দারকে বললেন-তোমরা আমাদের সঙ্গে দামাসকাসে চলো-আমরা তোমাদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে রয়েছে বিরাট বহর। কোন কষ্ট হবে না তোমাদের। তাছাড়া, ফুলের শহর, ফলের শহর হচ্ছে এই দামাসকাস, বড় মিষ্টি শহর। খুব ভালো লাগবে। তোমাদের।
মুসার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলো জেলেরা।
এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় আবার তারা তাম্র-নগরীতে প্রবেশ করলেন। যে যার ইচ্ছামত যতটা পারলেন সোনা, দানা, হীরা, মুক্ত, জহরৎ, দামী-দামী পাথর বোঝাই করলেন বস্তায়, উটের পিঠে। তারপরে ফিরে এলেন তাম্র-নগরীর প্রাচীরের বাইরে যে তাঁবু ফেলা ছিলো। সেইখানে। তারপরে গোটানো হলো তাঁবু। মুশার বাহিনী দামাস্কাসের পথ ধরলো। তাম্র-নগরীতে পড়ে রইলো কেবল তালিব বিন-সাল। কামনার আগুনে বেচারা নিজের প্রাণটা পুডিয়ে দিলো নিম্প্রাণ নগরীর চত্বরের মধ্যে।
দামাস্কাসে ফেরার পথে তাদের আর কোন বিপদে পড়তে হয়নি। মুশার মুখে সব শুনে খলিফা আব্দ আল-মালিক খুব খুশী হলেন; বললেন : আমার নসীব খারাপ। তাই তোমাদের সঙ্গে তাম্র-নগরীতে যেতে পারলাম না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই যাতে আমি নিজে একবার সেই শহরটা ঘুরে আসতে পারি। তাম্র-নগরীর রহস্য তখনই আমি ভেদ করার চেষ্টা করব।
খলিফা এবারে নিজের হাতে এক এক করে জালার ঢাকনাগুলিকে খুলে দিলেন। জালাগুলি থেকে প্রথমে ধোঁয়া বেরিয়ে এলো; তারপরে বেরিয়ে এলো বিশালকায় ভীষণ দর্শন বারোজন ইফ্রিত।
তারা খলিফার পায়ের ওপরে পড়ে বললো-মালিক সুলেমানের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলাম। তার জন্যে আপনার কাছে আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনি আমাদের বাঁচান।
বলতে-বলতে ঘরের ছাদ ফুটো করে ইফ্রিৎগুলো সব শূন্যে মিলিয়ে গেলো। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে ওদের দেখলো।
মেয়ে দুটির রূপ, যৌবন, মিষ্টি হাসি আর মিষ্টি চাহনি দেখে খলিফা তো বেজায় খুশী, ফোয়ারার পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো তাদের। কিন্তু বেশীদিন বাঁচল না। তারা। অত গরম সহ্য করতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই তারা মরে গেলো।
খলিফার কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে মুশা জেরুজালামে ফিরে গেলেন। যে-সব উৎকীর্ণ লিপি তাম্র-নগরী থেকে তিনি টুকে নিয়ে এসেছিলেন সেগুলি সামনে রেখে তাদের গভীর তত্ত্বগুলি বোঝার চেষ্টা করলেন; তারপরে ধ্যান করতে-করতে একদিন জেরুজালামেই দেহ রাখলেন তিনি। ভগবানের এত বড় সাধক পৃথিবীতে খুব কমই জন্মেছেন।
গল্প শেষ করে শাহরাজাদ বললো—এই হলো তাম্র-নগরীর গল্প।
শাহরিয়ার বললো-সত্যি, গল্পটি খুবই চমৎকার।