2 of 4

২.৩৩ মসুলের বিখ্যাত কালোয়াতী গায়ক ইশাকের কাহিনী – বাক্সের মধ্যে খলিফা

এরপর শাহরাজাদ অন্য কাহিনী বলতে শুরু করে : এই কাহিনীটা মসুলের বিখ্যাত কালোয়াতী গায়ক ইশাকের :

একদিন রাত্রে প্রচুর মদ্যপান করে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। ভীষণ প্রস্রাবের বেগ দিচ্ছিল। আমার তলপেটাটা টনটন করছিলো। আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। রাস্তার একাধারে বিরাট প্রাচীর দেখে সেইদিকে এগিয়ে গিয়ে প্রস্রাব করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ ধরে জলধারা নিৰ্গত হওয়ার পর শরীরটা বেশ হাল্কা মনে হলো। মাটি নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাবো এমন সময় ওপর থেকে কি একটা কঠিন বস্তু এসে আঘাত করলে আমার মাথায়! সঙ্গে সঙ্গে চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগলাম। আঁতকে ছিটকে সরে গেলাম কয়েক হাত। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ে দেখি প্রাসাদের ওপর থেকে কে বা কারা রেশমীর দডিতে বেঁধে নামিয়ে দিয়েছে একটা সুন্দর কাঠের বাক্স। ওপরটা খোলা। বাক্সের ভিতরে পাতা একখানা সুন্দর কাজকরা সুগন্ধী আসন।

সে দিন মদের মাত্ৰাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। বেশ নেশা হয়েছিলো। নেশার ঝোকেই বুঝিবা কোনও কিছু চিন্তা ভাবনা না করে সোজা গিয়ে বাক্সটার মধ্যে বসে পড়লাম। তখন আমাকে এক অদ্ভুত মজয় পেয়ে বসেছিলো।

একটু পরে রেশমীর দডিতে টান পড়লো। ধীরে ধীরে বাক্সটা ওপরে উঠতে লাগলো। আমার কোন বিকার নাই, যেমন বসেছিলাম। তেমনি বসে রইলাম। বাক্সটা আমাকে নিয়ে ক্রমশ উপরে উঠতে উঠতে প্রাসাদের এই অলিন্দে উঠে এলো। কয়েকটি মেয়ে, মনে হল পরিচারিকা-টরিচারিকা হতে পারে, আমাকে ইশারায় নেমে ঘরের ভিতরে এসে কুর্শিতে বসতে বললো। আমি সুবোধ বালকের মতো তাদের নির্দেশ মতো বাক্স ছেড়ে বেরিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে বসলাম। মেয়েগুলো আমাকে বসিয়ে রেখে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ বাদে আর একটি সুবেশ তরুণী এসে আমাকে বললো, আমার সঙ্গে আসুন। আমি মন্ত্রচালিতের মতো তাকে অনুসরণ করলাম। সে আমাকে অনেক বারান্দা, অনেক দরজা পার করিয়ে একটি সুন্দর সাজানো গোছানো ঝকঝকে তকতাকে বিলাসবহুল শয়ন কক্ষে নিয়ে এসে বললো, আপনি এই গদী-আঁটা আরাম কেদারাটায় বসুন।

আমি তার আজ্ঞামতো মুখটি বুজে। আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিলাম। নেশোটা ততক্ষণে থিতিয়ে এসেছে। এদিক ওদিক যতই যা কিছু নজরে পড়ে ততই কেমন ঘাবড়ে যাই। একিরে বাবা, এ আমি কোথায় এলাম! এমন সব দামী দামী বাহারী সাজ-পোশাক, আসবাব পত্র-এ তো সাধারণ মানুষের ঘরে থাকার কথা নয়। তবে কি-নেশার ঘোরে প্রাসাদেরই অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছি নাকি?

সামনে একটা বিরাট রেশমী পর্দা। একটু পরে ধীরে ধীরে পর্দাটা উঠে গেলো। দেখলাম গোটা দশেক সুন্দরী রমণী আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে একজন পূর্ণ শশী নিন্দিতা অনিন্দ্য সুন্দরী। সারা ঘর দামী আতর-সুবাসে মদির হয়ে গেলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সালাম জানালাম। মধ্যমণি স্মিত হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, আমার কী সৌভাগ্য, আজ এলেন আমার ঘরে। আপনি মুসাফীর, এই প্রথম দেখলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে, যেন কত কালের চেনা। তা দাডিয়ে রইলেন কেন, মেহেরবানী করে বসুন।

আমি বসলাম। সেও আমার পাশে বসলো। ততক্ষণে আমার নেশা ফেশা কেটে জল হয়ে গেছে। খুব শান্ত সংযত হয়ে বসে রইলাম তার পাশে।

সুন্দরী প্রশ্ন করে, এই রাতে, এই পথে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন? আর ঐ বাক্সেই বা বসলেন কেন? আপনি কী জানতেন, আমি বাক্সটা নামিয়ে দিয়েছিলাম?

আমার জবাব : পথে চলতে চলতে ভীষণ প্রস্ৰাব পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু খোলামেলা পথের ধারে বসি কি করে? তাই একটু আড়াল খুঁজতে খুঁজতে আপনাদের প্রাচীরের সামনে এসে বসে পড়লাম। প্রস্রাব শেষে উঠতে যাবো, এমন সময় মাথায় একটা বাড়ি খেলাম। তাকিয়ে দেখি, একটা ঢাকনা খোলা রেশমীর সুতোয় বেঁধে উপর থেকে নামানো হচ্ছে। আমি তখন মদে চুর হয়ে আছি, মাথায় কেমন বন্দ বুদ্ধি খেলে প্রিয় গেলো। ভাল মন্দ কী হতে পারে না পারে ভাবতে চাইলাম না, বাক্সের মধ্যে এসে বসে পড়লাম। বিশ্বাস করুন, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে বসিনি আমি। নেহাতই মজা—নেহাতই খেয়াল। বলতে পারেন সরাবের শয়তানী।

মেয়েটি আমার কথার মধুর প্রতিবাদ করে, আহা, শয়তানী হতে যাবে কেন? আমি খুব খুশি হয়েছি, সাহেব। মনে হচ্ছে যেন, কতকাল ধরে আপনারই প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে আর কালগুণে বসেছিলাম আমি। আপনি এলেন বসন্ত ফাল্গুনে। আমি বড় আনন্দ পেলাম। তা সাহেবের কী করা হয়?

আমি যে খলিফার সভা গায়ক ইশাক সে কথা তাকে বলবো কী করে? তাহলে পরদিন সকালে সারা শহরে টিঢ়ি পড়ে যাবে না? খলিফার প্রিয় গায়ক-ইশাক তামাম আরব-জোড়া যার নাম সে কিনা লম্পটের মতো চোরের মতো ঢুকছে এক রমণীর অন্দর মহলে! নিজের পরিচয় গোপন করে বললাম, এ বান্দা, এই শহরেই তাঁতীবাজারে কাপড় বুনে।

মেয়েটি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।–কী সুন্দর। আপনার বলার ঢং। আর কী চমৎকার আপনার ব্যবহার। আপনি তো আপনার তাঁতীকুলের শিরোমণি। আপনাকে দেখে কিন্তু আমার ধারণা হয়েছিলো, আপনি কবিটবি বা তেমনি একজন কেউকেটা কিছু হবেন। কাব্য-টাব্য চর্চা করেন নিশ্চয়ই! কোনও নাম করা কবির পয়ার কিছু জানেন?

-খুবই সামান্য।

—তা যদি মেহেরবানী করে দু-একটা সায়ের শোনান।

না না, শোনাবার মতো তেমন কিছু জানি না। এই মানে মাঝে-মধ্যে একটু আধটু পড়ি-টডি আর কি? আমি বলি, তার চেয়ে আপনি আমাকে দু-চারটে শোনান। আজ রাতে আমি তো আপনার মেহেমান। আমার মনোরঞ্জন করাই তো আপনার কাজ—

মেয়েটি বলে, নিশ্চয়ই শোনাবো। আমি যা জানি সব শোনাবো আপনাকে।

এক এক করে অনেকগুলো ভালো কবিতা আবৃত্তি করলে সে। বিখ্যাত সব কবির লেখা। প্রাচীনদের মধ্যে ইমুরু অল কাইস, জুহাইর, আস্তার, নবীঘা, আমির ইবন কলুতুম এবং তারাফা। আর একালের কবিদের মধ্যে ছিলো আবু নবাস, অল বাক্কাশী আর আবু মুসারের কবিতা। সবচেয়ে ভালো লাগলো মেয়েটির আবৃত্তি করার নিজস্ব এক সুন্দর ভঙ্গী। তার সুললিত কণ্ঠের উচ্চারণ আজও আমার কানে বাজে।

মেয়েটি বললো, আশা করি এতক্ষণে লজার জড়তা আপনার কেটে গেছে। এবার নিশ্চয়ই দু-একটা শোনাবেন—

আমি কাকুতি মিনতি জানাই, আপনি বিশ্বাস করুন, সুন্দরী, লজ্জা বা ভয়ের জন্য নয়, জানা থাকলে সানন্দে আপনাকে শোনোতাম। কিন্তু সত্যিই আমি ও-সব রসে একেবারে বঞ্চিত। যাই হোক, আপনার যখন এতই ইচ্ছা, দু-একটা পদ্য আমি বলছি। যদি কোথাও ছাড় হয়ে যায় বা ভুলচুক হয়, মেহেরবানী করে শুধরে দেবেন।

খুব নাম করা বাছা বাছা দুটি কবিতা মোটামুটি চলনসই কায়দায় আবৃত্তি করলাম। সঙ্গত এবং অতি সহজ ভাবেই আমার কণ্ঠে সুর এসে পড়ে। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে আবৃত্তি দুটি সুর-বিহীন করার সচেতন প্রয়াস করেছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার আবৃত্তি শুনে সুন্দরী বিশেষ পুলকিত হয়েছিলো।

—হায় বাপ, কী সুন্দর ভরাট আপনার গলা। যেন মধু ঝরছিলো! তাঁতী-বাজারে এমন হীরে পাওয়া যায় তাতো জানা ছিলো না?

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো পঁচাশিতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

নানা উপাচারে সাজিয়ে খানাপিনার ব্যবস্থা করা হলো। মেয়েটি নিজে-হাতে আমাকে পরিপাটি করে খানাপিনা পরিবেশন করলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মেজে পরিষ্কার করে সরাবের ঝারি এবং সুদৃশ্য পেয়ালা এনে রাখলে সে। এক পাত্র মদ ঢেলে সে আমার হাতে দিলো।

—এবার আপনার দু-একটা কিসসা শুনতে চায় এই বাঁদী।

আমি বললাম, বহুৎ আচ্ছা, বেশ শোনাচ্ছিা!

বেশ কয়েকটা মজাদার কিসসা শোনালাম তাকে। আমার গল্প বলার কায়দায় কখনও সে হেসে খুন, আবার কখনও বা ভয়ে শিউরে উঠতে লাগলো। সবই একালের শাহবাদশাহদের দরবারের কাহিনী।

এক সময়, গল্পের মাঝখানেই সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, তাজ্জব কী বাত, সামান্য একজন তীতীর পক্ষে খলিফার দরবারের এমন নিখুঁত খুটিনাটি সবিস্তারে বর্ণনা কী করে দেওয়া সম্ভব?

অবাক হওয়ারই কথা। কিন্তু আমার সৌভাগ্য, খলিফার দরবারের এক কৰ্মচারী আমার জীগরী দোস্ত। প্রতি দিন সে দরবার থেকে ফিরে এসে সব বৃত্তান্ত আমাকে শোনায়। তা না হলে এত সব ভেতরের কথা, আমি এক নগণ্য তাঁতী, জানবো কেমন করে?

সে যাই হোক, আপনার মনে রাখার ক্ষমতারও তারিফ করতে হয়। এমনভাবে বলছেন, যেন সব নিজের চোখে দেখা–

সুন্দরীর লাস্যময় ভঙ্গী, চোখের বাণ, অধরের মধুর হাসি এবং দেহের সুবাস আমাকে সারাটা রাত মোহিত করে রেখেছিলো। সে-দিনের সেই সুন্দর রাত্রির প্রতিটি মুহূর্তের সুখ-স্মৃতি আজও আমাকে পুলকিত করে। তেমন সুখের রমণীয় রাত্রি তার আগে আমার জীবনে একটিও আসেনি।

মেয়েটি বলে, আপনার কথাবার্তায় কী সুন্দর মার্জিত ভাব। আপনার শান্ত সৌম্য চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দেখে মনে হয় আপনি আর পাঁচজন সাধারণ মানুষ থেকে কত আলাদা। আর একটা অনুরোধ আপনাকে জানাবো, যদি মেহেরবানী করে আমার সঙ্গে একটু গানবাজনা করেন। আমার খুব ইচ্ছে-খুব খুশি হবো।

সঙ্গীত আমার পেশা। তাই এই আনন্দ পরিবেশে গান গাইবার কোন সম্পূহা আমার নাই। বললাম, এক সময় গান শেখার শখ হয়েছিলো, কসরৎ করেছিলাম যথেষ্ট। কিন্তু আমার গানের ইন্দ্রজালে যখন শুরু গৰ্দভরাই ছুটে আসতে লাগলো তখন থেকে পাড়াপাড়শী ইয়ার দোস্তদের একান্ত অনুরোধে তা বন্ধ করে দিয়েছি। আর কখনও গাইনি।

আমার কথা শুনে সুন্দরী হেসে লুটিয়ে পড়ে।-ইয়া আল্লাহ, কী মজার মানুষ আপনি! কী সুন্দর করে কথা বলেন।

–বিশ্বাস করুন, গান আমার আসে না। তা না হলে আপনার মতে রূপসী কন্যা আমাকে এত খোসামোদ করছেন—আমি রাখতাম না?

তার চেয়ে আপনি গেয়ে শোনান। আপনার কণ্ঠের আওয়াজ শুনে আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারছি ও বিদ্যায় আপনি পটিয়সী। আজকের এই মধুযামিনী আরও মধুময় হয়ে উঠুক। আপনার সুরের মুর্ছনায়। আর দেরি নয়। সুন্দরী, আপনি শুরু করুন।

আমি ভেবেছিলাম, আর পাঁচটা মেয়েছেলে যেমন সাধারণভাবে গায় সেও তেমনি কিছু একটা গাইবে। কিন্তু তার অপূর্ব কণ্ঠ, তালমান লয় জ্ঞান শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। এতো তা বড় তা বড় নাম জাদ ওস্তাদাদেরও তাক লাগিয়ে দেবে!

আমাকে বিস্ময়ে হতবাক দেখে সে খুব খুশি হলো।

—জানেন, কার লেখা গীত এটা?

আমি যথারীতি অজ্ঞতার ভান করে বললাম, না; বলতে পারবো না।

—সে কী! তামাম দুনিয়ার কারো কি অজানা এই গীত? আবালবৃদ্ধবণিতা কে না জানে এর গায়ক আর গীতকারের নাম? আপনি জানেন না, এর গীতিকার কবি আবু নবাস, আর গেয়েছেন। মসুলের বিখ্যাত গায়ক ওস্তাদ ইশাক?

আমার মুখের কোনও ভাব পরিবর্তন হলো না। বললাম, ইশাকের গান আমি শুনেছি। কিন্তু আপনার কাছে সে দাঁড়াতে পারবে না। এমন গলা সে পাবে কোথায়?

-থাক থাক, খুব হয়েছে, অত মিথ্যে তোষামদে আমার মন ভরবে না, সাহেব, গুণী লোকের মর্যাদাহানী করে বাহবা পাওয়া যায় না। ইশাকের জুড়ি তামাম আরব দুনিয়ায় নাই। এ আপনি কী বলছেন? আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ইশাকের গান আপনি শোনেন নি কখনও। এই বলে আবার সে গাই ৩ থাকলো। এবং মাঝে মাঝে থেমে সে আমাকে ইশাকের মহিমা বোঝাতে লাগলো। এইভাবে সারাটা সুন্দর রজনী এক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। গান থেমে গেছে, কিন্তু তার মধুর রেশ তখনও সেই ঘরের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়ে ফিরছিলো। এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছিলো আমার মনপ্ৰাণ। কেমন করে কোথা দিয়ে যে ফুডুৎ করে পালিয়ে গেলো। সেই রাতটা টেরই পেলাম না। সুখের সুন্দর মুহূর্তগুলো বুঝি এমনিভাবেই তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।

একজন বয়স্ক ক্রীতদাসী এসে জানালো, রাত আর নাই। সকাল হতে চলেছে। এবার আসর বন্ধ করতে হবে। না হলে পালাবার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

সেই বিদায়বেলায় তার চোখের করুণ চাহনী আমি কখনও ভুলবো না। একটিমাত্র রাতের পরিচয়, কতটুকুই বা সময়, কিন্তু তার মধ্যেই যেন আমরা অনেক অনেক শীত গ্ৰীষ্ম বসন্ত অতিক্রম করে ফেলেছি। মনে হলো এই অচেনা অজানা অনিন্দ্য সুন্দরী যেন কতকালের চেনা, কত গভীর নিবিড় অন্তরের অচ্ছেদ্য বন্ধনে যেন আমরা বাধা। তাই এই বিদায়ের বেলায় বিচ্ছেদের বাণ বুকে বড় বেশি করে বাজে।

ভারাক্রান্ত কণ্ঠে মেয়েটি বলে, আপনি সারা রাত ধরে যেভাবে আমায় সুখসঙ্গ দান করলেন তার জন্য বহুৎ সুক্ৰিয়া।

আমি বলি, থাক না, ধন্যবাদের কী বা প্রয়োজন। আমি কী দিতে পেরেছি। জানি না, কিন্তু যা পেয়েছি তুলনা তার নাই। একে সামান্য শুকনো ধন্যবাদে খাটো করে দেবেন না।

মেয়েটি অবাক হয়, আপনি সত্যিই সমঝদার মানুষ। ক্কচিৎ কখনও সখনো, বরাতে থাকলে, এমন গুণী-জ্ঞানী মানুষের সঙ্গ লাভ করা যায়—

আমি আর দাঁড়ালাম না। এখনি দিনের আলো ফুটবে। তাড়াতাড়ি আবার সেই বাক্স চেপে তরতর করে রাস্তায় নেমে পড়ি।

সকালবেলায় নামাজ সেরে শুয়ে পড়লাম। সারাটা দিন পড়ে পড়ে ঘুমালাম। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন সন্ধ্যা হয় হয়। তাড়াতাড়ি সাজ পোশাক করে প্রাসাদের দিকে রওনা হলাম। প্রাসাদের সচিব আমাকে জানালো, খলিফা বাইরে বেরিয়েছেন। তিনি না ফেরা পর্যন্ত আমি যেন অপেক্ষা করি। কারণ সে রাত্রে খলিফা এক উৎসবের আয়োজন করেছেন। জোর খানাপিনা নাচ গান হবে।

আমি অনেকক্ষণ বসে রইলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো। তখনও খলিফা ফিরলেন না দেখে আমি প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার তখন রক্তে নাচন শুরু হয়েছে। চলতে চলতে এক সময় আবার সেই প্রাসাদ-প্রাচীরের পাশে এসে দাঁড়ালাম। কি যেন এক অদ্ভুত নেশার পেয়ে বসেছিলো আমাকে। না হলে, সে রাতে আবার সেই সুন্দরীরর ঘরে যাবার তো আমার কথা ছিলো না। তবু আমি কলের পুতুলের মতো সেই বাক্সটার মধ্যে বসে পড়লাম। পলকের মধ্যে আবার আমি উঠে এলাম প্রাসাদ-আলিন্দে। সেই নির্বক মেয়েগুলো আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে গেলো সুন্দরীর ঘরে।

আমাকে দেখে সে হো হো করে হেসে উঠলো।–খোদা হাফেজ, মনে হচ্ছে এইখানে আপনি পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিতে চান!

আমি মাথা নত করে সালাম জানিয়ে বললাম, তা যদি হয় মন্দু কী। আমি আপনার অতিথি, হিসেব মতো অতিথির সৎকার যথাযোগ্যভাবে তিন দিন করার নিয়ম। আজ আমার দ্বিতীয় দিন। তৃতীয় দিনের পরেও যদি আমি আবার হ্যাংলার মতো আসি তখন নিশ্চয়ই কথা শোনাতে পারেন। আপনি।

সে রাত্রিও বেশ হাসি গল্প গানবাজনার মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো। খুব আনন্দ পেলাম। রাত্রি শেষে আবার যখন বিদায় জানিয়ে বাক্সে গিয়ে বসলাম তখন আমি খলিফার রোয্যের কথা ভেবে আতঙ্কিত হতে থাকলাম। ভাবলাম, খলিফা আমার কোনও কৈফিয়ৎই মানবেন না। একমাত্র এই রোমাঞ্চকর অভিসারের কাহিনী যদি তাকে বলতে পারি। তবেই হয়তো ঠান্ডা হতে পারেন। সেই মুহূর্তে আমার নিচে নামা হলো না। আবার ফিরে গেলাম সুন্দরীর ঘরে।

—কী ব্যাপার, ফিরে এলেন যে?

আমি বললাম, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আপনি তো গান খুব ভালোবাসেন। কিন্তু আমি তো আপনার সে-সাধ মেটাতে পারলাম না। আমার এক সম্পর্কে ভাই আছে, সে খুব ভাল গায়। ভেবেছি আজ রাতে তাকে নিয়ে আসবো আপনার ঘরে। তার গলা শুনলে আপনি খুব খুশি হবেন। তা ছাড়া দেখতে তিনি সুপুরুষ-। ওস্তাদ ইশাকের প্রায় সব গানই সে সুন্দর করে গাইতে পারে। আপনি যদি আজ্ঞা করেন তাহলে আজ রাতেই তাকে নিয়ে আসতে পারি। আর কথা দিচ্ছি, অদ্যই শেষ রজনী। এর পর আপনাকে আর বিরক্ত করবো না। রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

তিনশো ছিয়াশিতম রজনীর দ্বিতীয় যামে আবার সে শুরু করে :

মেয়েটি বলে, আপনার কি মাথাটাথায় কিছু গোলমাল ঘটেছে? তা —আপনার ভাইকে যদি এখানে আনতে চান আনুন, আপত্তির আর কী থাকতে পারে। বলছেন, তিনি গানটান জানেন। বেশ ভালই হবে, নিয়ে আসবেন তাকে।

তার অনুমতি আদায় করে আমি ফিরে এলাম বাক্সের কাছে। তরতর করে নেমে পড়লাম নিচে।

বাড়ি ফিরে দেখি, খলিফার প্রহরী দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখা মাত্র গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলো তারা খলিফার দরবারে। পথে যেতে যেতে অনেক গালমন্দ করতে লাগলো লোকগুলো।

দরবারে ঢুকেই দেখি, রোষ কষায়িত নয়নে খলিফা বসে আছেন তখতে। চোয়ালের পেশী কঠিন হয়ে উঠেছে। আমাকে দেখামাত্র তিনি গর্জে উঠলেন, এ্যাই কুত্তাকা বাচ্চা, এত বড় স্পর্ধা তোমার, আমার হুকুম অগ্রাহ্য করতে সাহস পাও। জািন এই বেয়াদপির কী সাজা?

–দোহাই ধর্মাবতার, আমার সব কথা আগে শুনুন, তার পর সাজা দিতে হয় দেবেন। কিন্তু মেহেরবানী করে না। শুনে কিছু করবেন না, হুজুর, এই আমার আর্জি।

—বলো কী তোমার কৈফিয়ৎ।

–এই প্রকাশ্য দরবারে সে-কথা বলা যাবে না, জাঁহাপনা। নিভৃতে বলতে চাই।

সঙ্গে সঙ্গে দরবারের সবাইকে বাইরে চলে যেতে বললেন তিনি। তখন আমি তাকে গত দুটি রাত্রির রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।

—আজ রাতে সে আমাদের দুজনের জন্যেই পথ চেয়ে থাকবে। আমি তাকে কথা দিয়ে এসেছি। জাঁহাপনা, আজ। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।

এতক্ষণে খলিফা মামুনের মুখে হাসি ফুটলো।

—তাই বলো, তা তুমি এক্ষেত্রে আমার হুকুম অমান্য করে খুব একটা অপরাধ করনি। ঠিক আছে, যাবো। তুমি যে সেখানে বসেও আমার কথা চিন্তা করেছ তার জন্য আমি খুশিই হয়েছি, ইশাক। তাহলে ওই কথাই রইলো, সন্ধ্যা হতে না হতে তৈরি হয়ে চলে আসবে। এখানে। আমি বলি যথা সময়ে বান্দা হাজির হবে জাঁহাপনা। কিন্তু আপনার কাছে একটা আমার আর্জি, আমার আসল পরিচয়টা ফাঁস করে দেবেন না। সেখানে। তাহলে বড় বেইজিৎ হব। আমি বিশ্বাস ঘাতক হবো।–তার কাছে; দোহাই আপনার

খলিফা হাসলেন, ঠিক আছে, আমার মনে থাকবে। ও-নিয়ে তুমি কোনও দুশ্চিন্তা করো না।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই খলিফা এক সওদাগরের ছদ্মবেশ ধরে আমাকে নিয়ে পথে নামলেন। চলতে চলতে এক সময় সেই প্রাসাদ-প্রাচীরের সামনে এসে দাঁড়ালাম দুজনে। একটু পরেই সেই বাক্সটা নেমে এলো। আমরা দুজনেই চেপে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সুন্দরীর সুরম্য শয্যাকক্ষে।

সে রাতে সে আরও সুন্দর করে সেজেছিলো। তাকালে চোখ আর ফেরানো দায়। আমি লক্ষ্য করলাম, খলিফা অপলকভাবে তাকিয়ে দেখছে তাকে। তার রূপের জৌলুস তাকে প্রায় পাগল করে তুলেছে।

তারপর সুন্দরী যখন সুমধুর তানে গান ধরলো খলিফার অবস্থা তখন কাহিল। বুঝতে পারলাম তিনি আর তার মধ্যে নাই তখন। সুন্দরীর ধ্যানে তীর চৈতন্যর দফা-রফা হয়ে গেছে। বেহেড মাতালের মতো অসংলগ্ন প্রলাপ বকতে লাগলেন তিনি। আমি প্রমাদ গুনলাম।

আনন্দে উল্লাসে দিশাহারা খলিফার দিল তখন দরিয়া সদৃশ। এক সময় তিনি আমাকে আরও কাছে সরে আসতে বললেন, ইশাক, এসো আমার কাছে এসো। তুমি কেন তোমার গান শুরু করছ না, ইশাক। তোমার গান শুনে তামোম দুনিয়া পাগল হয়, আর আজ রাতে এই সুন্দরীর পাশে মুখ বুজে বসে রয়েছ! এমন সহেলী রাত কী রোজ রোজ আসবে ইশাক। গাও, তোমার সব চাইতে ভালো গানগুলো শোনাও তাকে। বড় গুণী মেয়ে, গুণের কদর করবে।

মরমে মরে গেলাম। আমি; আমার সব ছলনা ধরা পড়ে গেছে। মেয়েটির কাছে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে গেলাম। মাথা হেট করে বললাম, যো হুকুম জাঁহাপনা।

মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে আমাদের দুজনকে দেখতে থাকলো। তারপর এক সময় কোনও কথাবার্তা না বলে ভীত-চকিত এক হরিণীর মতো পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে এই ছদ্মবেশী সওদাগর স্বয়ং খলিফা ছাড়া আর কেউ নন। আমার জাঁহাপনা’ হুজুর এই সব সম্বোধন তার মনে অনেকক্ষণ ধরেই সন্দেহের উদ্রেক করেছিলো। এবার আমার পরিচয় ফাঁস হওয়াতে সে নিঃসন্দেহ হয়ে গেলো ইশাকের সঙ্গীটি সুলতান ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। যেহেতু সুলতানের সামনে কোনও নারীই বেআব্রু থাকতে পারে না, সেই কারণে সে পর্দার আড়ালে চলে গেলো।

খলিফা ঈষৎ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আমাকে কী মনে ধরলো না? পালিয়ে গেলো কেন ইশাক?

এ কথার আমি আর কী জবাব দেবো। খলিফা এবার কিছু রাগ প্রকাশ করলেন, খোঁজ নাও তো, মেয়েটি কে? এই বাড়ির মালিককে একবার তলব করা।

আমি খলিফাকে ফিসফিস করে বললাম, ওসব কথা শুনলে এরা যে আপনাকে সন্দেহ করবে, জাঁহাপনা।

খলিফা জিভ কামড়ালেন। আমাকেও তর্জন করলেন, তোমারই বা কী বুদ্ধি! এরকম ‘জাঁহাপনা। টাহপনা’ না বললেই কী হতো না!

—ইস, তাই তো ভারি বেকুফের মতো কাজ হয়ে গেছে—

খলিফা বললেন, আর লুকিয়ে কোনও লাভ নাই। সবই সে জেনে ফেলেছে। যাই হোক, বাড়ির মালিককে একবার খোঁজ করতো।

বৃদ্ধা দাসীটার কাছ থেকে জানতে পারা গেলো। সেই প্রাসাদের মালিক খলিফারই দরবারের উজির শাহল। এই সুন্দরী মেয়েটি তারই।

খলিফার হুকুমে উজির এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ায়। মুখে চোখে দারুণ বিস্ময় আর আতঙ্ক। খলিফাকে এইভাবে এখানে দেখবে তা সে স্বপ্নে ভাবতে পারেনি।

খলিফা আল মামুন হো হো করে হেসে ওঠেন, এ তোমার মেয়ে?

-হ্যাঁ, হুজুর।

—কী তার নাম?

—কাদীজা।

—শাদী হয়েছে?

—না, হুজুর।

খলিফা বললেন, আমার ইচ্ছা, তোমার মেয়েকে আমি ধর্ম মতে শাদী করে বেগম করবো। তোমার কী মত, বলে।

উজির বলে, আমি এবং আমার মেয়ে জাঁহাপনার একান্ত আজ্ঞাবহ, হুজুর। আপনি যা বলবেন, তাই হবে।

তোমার মেয়েকে আমি একলক্ষ দেন মোহর দেবো, উজির। কাল সকালে আমার প্রাসাদে গিয়ে তুমি টাকাটা নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে তোমার মেয়েকে তুমি রাজি করাও। তাকে আমার বেগম হওয়ার মতো করে তৈরি করা। আমি তোমার মেয়ের পরিবার পরিজনদের জন্য এক হাজারটি গ্রাম এবং এক হাজারটি খামার যৌতুক দেবো। তুমি সবাইকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে। ९ि3।

এই বলে খলিফা উঠে দাঁড়ালেন। আমিও। এবার আমরা সদর ফটক দিয়েই রাস্তায় বেরুলাম। বাক্সে ঝুলে নামার আর দরকার হলো না।

খলিফা আমাকে সতর্ক করে বললেন, এ ব্যাপারে কারো কাছে কিছু বলবে না, ইশাক।

খলিফা এবং কাদীজা যতকাল জীবিত ছিলেন একথা কারো কাছে কখনও আমি বলিনি। এতটা বয়স হলো, জীবনে অনেক নারী আমি দেখেছি, কিন্তু কাদীজার মতো পরমা সুন্দরী একটাও চোখে পড়েনি। আল্লা জানেন, তার সমান সুন্দরী। তিনি আর কাউকে বানিয়েছেন কিনা।

গল্প শেষ হলে দুনিয়াজাদ উঠে এসে শাহরাজাদকে জড়িয়ে ধরে। কী সুন্দর কিসসা, দিদি। আর কী অপরূপ মিষ্টি করেই না তুমি বলতে পারো।

শাহরাজাদ বলে, এর পর তোমাদের আর একটা কিসসা শোনাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *