2 of 4

৩.১১ আবু অল হাসানের কাহিনী

আবু অল হাসানের কাহিনী

ছয়শো বাইশতম রজনী :

পরদিন শাহরাজাদ নতুন কাহিনী বলতে শুরু করে :

খলিফা হারুন অল রসিদের সময় বাগদাদ শহরে আবু অল হাসান নামে খামখেয়ালী প্রকৃতির একগুঁয়ে এক যুবক বাস করতো। এতটা বয়স হলো?শাদী নিকা করার দিকে তার কোনও খেয়াল নাই। পাড়া-পড়শীদের সঙ্গে কচিৎ মেলা-মেশা করে। সারাটা দিন একা একা সে ঘরের মধ্যে বসে বসে কাটায়। এবং বিকেল হতেই শহরের প্রবেশ দ্বার পেরিয়ে বড়ো রাস্তার ওপর যে সাঁকোটা আছে সেই সাঁকোর ওপরে গিয়ে বসে। সারাটা বিকেল সন্ধ্যা ওখানেই বসে বসে পথচারীদের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করে। নতুন কোনও মুসাফির বাগদাদ শহরে ঢুকতে যাচ্ছে বুঝতে পারলেই সে সেধে তার সঙ্গে আলাপ করতো। এবং বলতো, আজকের রাতটা যদি মেহেরবানী করে আমার ঘরে মেহমান হন—কৃতার্থ হবো আমি।

তার প্রস্তাবে অনেকেই হয়তো রাজি হতো না, কিন্তু একজন না একজন হতোই। আর এই একজনকেই তার দরকার প্রতি রাতের জন্য। এবং সারা রাত ধরে অতিথির আপ্যায়নে তিলমাত্র ত্রুটি করতো না সে। নানারকম উপাদেয় খানা, ভালো ভালো দামী মদ এবং তার ঘরোয়া মেজাজের সান্নিধ্য পেয়ে সকলেই মুগ্ধ হতো। কিন্তু সকাল না হতেই সে সেই গত রাতের মহামান্য অতিথিকে এক কথায় বিদায় করে দিত।

দেখুন কিছু মনে করবেন না। আমি কোনও মেহেমানকেই এক রাতের বেশি সময় আপ্যায়ন করি না। এবার আপনি শহরের কোনোও সরাইখানায় চলে যান।

গতকাল রাতে যাকে বাদশাহী কেতায় সম্মান দেখিয়েছে তাকেই সকাল বেলায় এইভাবে বিদায় করে দিতে এতটুকু দ্বিধা করে না সে। লোকে বলে, ছেলেটার মাথার ছিট আছে।

এমন ঘটনাও হামেশাই ঘটে, সারারাত মহা সম্মানে রাখার পর যখন কোনও মুসাফির সরাইখানায় চলে যায় এবং ঘটনাক্রমে যদি পথে-ঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তবে আবু অল হাসান মুখ ফিরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। চিনেও তাকে চিনতে পারে না—চিনতে চায় না।

তার এই ধরনের অস্বাভাবিক আচরণের কোনও সদর্থ করতে পারতো না কেউ।

এইভাবে দিন কাটছিলো। প্রতিদিন সে শহর-প্রত্যন্তে সেই সাঁকোর ওপর গিয়ে বসে। প্রতি রাতেই কোনও না কোনও মুসাফিরকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। এবং যথারীতি সারারাত ধরে তার সেবা পরিচর্যা করে পরদিন সকালে বিদায় করে দেয়।

একদিন আবু অল হাসান ঘটনাক্রমে খলিফা হারুন অল রসিদকে মুসাফির ভ্রমে ঘরে নিয়ে আসে।

খলিফা মাঝে মাঝে শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে যেতেন তাঁর সালতানিয়তের হাল-চাল প্রত্যক্ষ করতে। সেদিন তিনি সেই রকম এক সফর শেষ করে সন্ধ্যাবেলা শহরে ফিরছিলেন। আপনারা জানেন, খলিফা যখন গোপনে বাইরে বেরুতেন, তিনি কোনও না কোনও ছদ্মবেশের আশ্রয় নিতেন। যাতে তাকে অন্য কেউ চিনতে না পারে। কারণ, মনে করতেন, সাধারণ মানুষ খলিফাঁকে সশরীরে সামনে দেখলে সমীহ শ্রদ্ধা ভক্তি ভয় করে তাদের আসল অভাব অভিযোগের কথা গোপন রাখবে।

সেদিন খলিফা মশুলের এক সওদাগরের ছদ্মবেশে সেজে শহর সন্নিহিত গ্রামাঞ্চল পরিদর্শন করে সন্ধ্যায় প্রাসাদে ফিরে আসছিলেন। প্রবেশ দ্বারের মুখে সেই সাঁকো পার হতে গিয়ে তিনি আবু অল হাসানের সঙ্গে পরিচিত হলেন।

আবু অল হাসান নিজেই হাত জোড় করে সামনে এসে দাঁড়ায়, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে মশুল থেকে আসছেন?

খলিফা মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলেন, ঠিকই ধরেছ। কিন্তু কেন, কী চাই তোমার?

—আপনি কী শহরেই কাটাবেন আজকের রাতটা? -সে তো অবশ্যই।

—এখানেই কী আপনার নিজের কোনও বাড়ি-ঘর বা আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে, না সরাইখানায় উঠবেন বলে মনে করেছেন।

যুবকের এবম্বিধ অদ্ভুত প্রশ্নবাণে খলিফা কিছু বিরক্ত বোধ করেন। আবার কৌতূহলও জাগে। এত সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে কেন? ছেলেটির কী মতলব? উদ্দেশ্য যত খারাপই হোক, খলিফা কখনও কাউকে দেখে ভয় পান না, বা বিচলিত হন না। এমন অনেক কাহিনী আপনাদের শোনা আছে অবশ্যই, এইভাবে ছদ্মবেশে বেড়াতে বেড়াতে অনেক সময় তিনি প্রাণ সংশয় বিপদের গুহায় ঢুকে পড়েছেন। তারপর নিজের বুদ্ধির কৌশলে এবং আল্লাহর অপার করুণায় অবশেষে প্রাণে রক্ষা পেয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন।

এই যুবক কোনও ঠগ প্রতারক নয় তো? কী এর উদ্দেশ্য? এত হাঁড়ির খবরই বা জানার আগ্রহ কেন? যাই হোক, ওতে তার কিছু যায় আসে না। খলিফা বলে, না—মানে নিজের বাড়ি-ঘর আমার মশুলে। এখানে ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষে মাঝে মাঝে আসতে হয়। চেনা দু-একটা সরাইখানা আছে, সেখানেই উঠি। দু-একদিন থাকি, কাজকাম সমাধা করে আবার দেশে ফিরে যাই। কিন্তু এতো কথা জানতে চাইছ কেন, বাবা?

আবু অল হাসান বিনয় বিগলিত কণ্ঠে করজোড়ে মিনতি জানায়, যদি মেহেরবানী করে একটা রাতের জন্য এই গরীবের ঘরে পায়ের ধুলো দেন, ধন্য হবো আমি! এ বান্দা আজকের রাতটা আপনাকে সেবা করতে চান।

বড়ো অদ্ভুত মনে হয়। আজকালকার দিনে এই বয়সের ছেলের মনে এত ধর্মভাব বড়ো একটা দেখা যায় না। খলিফা সানন্দে সম্মত হয়ে যায়।

–ঠিক আছে, চলো, তোমার দৌলতখানাতেই যাওয়া যাক। এই বিদেশে তোমার মতো একজন সঙ্গী পেয়ে রাতটা আমার কাটবে ভালো।

আবু অল হাসানের মা চমৎকার চমৎকার মুখরোচক খানা পাকাতে পারেন। সে রাতেও সে অতিথির জন্য অনেক নতুন নতুন খাবার তৈরি করলো। মোরগ মোসাল্লাম, ভেড়ার মাংসের কাবাব। হাঁসের দোপিয়াজি, পায়রার মাংসের ঝোল প্রভৃতি। খুব পরিতৃপ্তি করে আহারপর্ব সমাধা করলেন খলিফা।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো চব্বিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

মুখ হাত ধুয়ে এসে বসতে, হাসানের মা আঙুর বেদানা আপেল প্রভৃতি নানারকম ফলের রেকাবী এনে সাজিয়ে দেয়। দুজনে মিলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন।

এর পর দামি পেয়ালায় দুষ্প্রাপ্য মদ ঢেলে খলিফার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনি তো জানেন, মদ কখনও একা একা খেয়ে মজা পাওয়া যায় না। আপনাকে সঙ্গদান করার জন্যেও অন্ততঃ আমাকে এক পেয়ালা খেতে হবে, জনাব। শুধু একটি রাতের জন্য। মদ পেটে না পড়লে মানুষের ওপরের ভদ্রতা সৌজন্যের কঠিন আবরণটা সরিয়ে আসল চেহারা চরিত্র খুলে মেলে ধরা যায় না। আর তা যদি না পারা যায় জীবনে আনন্দের সন্ধানও সে পায় না কখনও।

খলিফা ভাবলেন, ছেলেটির পেটের কথা জানতে হলে ওর দোসর হতে হবে। মদ পেটে না পড়লে মনের লুকানো কথা টেনে বের করা যাবে না। শুধু এই কারণেই খলিফা বললেন, দাও খাবো।

ধীরে ধীরে সরাবের ফুরফুরে নেশা জমে ওঠে। খলিফা বললেন, আচ্ছা আবু অল হাসান, আমরা একসঙ্গে বসে নুন রুটি খেলাম, তাহলে আমি তোমার দোস্ত তা স্বীকার করতো?

হাসান বলে, আলবাত, আজ রাতে আপনি আমার মহামান্য অতিথি বন্ধু-পরমাত্মীয়।

-তা হলে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

—একশোবার, আমি আপনার গোলাম, জনাব। যা হুকুম করবেন, আমি জান কবুল করে তা করতে বাধ্য।

-আরে না না, ওসব কিছু করতে হবে না। তুমি আমার একটা ছোট্ট কথার জবাব দাও তো। তুমি বললে প্রত্যেক রাতে আমার মতো একজন মুসাফিরকে তুমি অতিথি করে ডেকে এনে প্রভূত আদর যত্ন সম্মান করো। এবং তা যে সত্যি সত্যিই করো তার প্রমাণ তো আমি নিজেই পেলাম। হয়তো শুনলে স্তাবকের মতো মনে হতে পারে আমাকে, তবু নির্দ্বিধায় বলছি, এত সৌজন্য, এত আদর আপ্যায়ন, এমন প্রাণ ঢালা দরদ, মিষ্টি ব্যবহার কখনও আমি পাইনি কোথাও।কিন্তু আমার প্রশ্ন, কেন এইসব?কী কারণে? তোমার যা বয়স তাতে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য যে করো, তা তো ভাবতে পারছি না। নিশ্চয়ই এর পিছনে অবাক করার মতো কাহিনী আছে। আর সেই কাহিনীটাই আমি শুনতে চাই। যদি আপত্তি না থাকে, বল হাসান।

হাসান বলে, কাহিনী একটা অবশ্যই আছে। তবে অবাক করার মতো নয়। বলতে পারেন—শিক্ষামূলক।

আপনি তো শুনেছেন আমার নাম আবু অল হাসান। আমার বাবা এই শহরের এক বিত্তবান বণিক ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি যথেষ্ট ধন-দৌলত রেখে গিয়েছিলেন আমার জন্যে। আমার বাবা স্বপ্রতিষ্ঠিত সওদাগর ছিলেন। জীবনে বহু দুঃখ কষ্ট ভোগ করে উত্তরকালে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এই কারণে খুব ছোটো থেকে কড়া শাসন এবং দারুণ কৃচ্ছু সাধনের মধ্যে আমাকে মানুষ করে তুলেছিলেন তিনি। বাবার জীবদ্দশায় ভোগ-বিলাস বলতে কী বোঝায় আদৌ তার স্বাদ পাইনি। বিলাস-ব্যসন তার চোখে বিষ ছিলো। তা বলে তিনি যে আমাকে খেতে পরতে দিতেন না, তা নয়। প্রয়োজনের সবটাই মেটাতেন, কিন্তু ভোগ-লালসার বস্তু থেকে শত হাত সরিয়ে রাখতেন আমাকে।

এই অতৃপ্ত বাসনা অস্বাভাবিকভাবে চরিতার্থ করে, ছোটোবেলা থেকে বঞ্চিত হওয়ার শোধ তুলেছিলাম। কিন্তু সে প্রতিশোধ আমার নিজের ওপরেই নেওয়া হয়েছিলো, তখন বুঝিনি, পরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম।

বাবা মারা যাওয়ার স্বল্পকালের মধ্যে আমার সমস্ত সম্পত্তিকে দুই রূপে রূপান্তরিত করে ফেললাম। কিছু সোনাদানা হীরে জহরৎ এবং বাকীটা নগদ মোহরে। হীরে চুনী পান্না এবং আভরণ অলঙ্কারাদি সযত্নে বাক্সবন্দী করে, নগদ টাকাটা হাতে নিয়ে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে করে দু’হাতে দেদার ওড়াতে লাগলাম। দিনকে দিন খরচের বহরটা এমনই বাড়তে থাকলো যেন মনে হলো, কোন্ আমির বাদশাহর ছেলে আমি। আর এ তো জানেন, পয়সা ওড়াতে চাইলে বন্ধু সাগরেদ অঢেল জুটে যায়।

এইভাবে একটা বছর দারুণ সুখ-সম্ভোগের মধ্যে দিয়ে কাটলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে আবিষ্কার করলাম আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। হাতে আর দু’টো পয়সাও নাই। এবং দেখলাম এক সময়ের দিবারাত্রের বন্ধুরাও হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে। পথে ঘাটে দেখা হলেও মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।

কারো কাছে কিছু ধার চাইলে একটা পয়সা কেউ দেয় না। সেই থেকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, না যথেষ্ট হয়েছে, আর কোনও বন্ধু-বান্ধব নয়, কোনও আত্মীয়-স্বজন কারো সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবো না। একমাত্র অচেনা অজানা বিদেশী মুসাফির ছাড়া কাউকেই আমি ঘরে আশ্রয় দেব না, মনস্থ করলাম।

এরপর আর একটা শিক্ষালাভ করলাম। কোনও মানুষের সঙ্গে, তা সে বিদেশী মুসাফিরই হোক—বেশি মাখামাখি সম্পর্ক গড়ে তুলবো না। যে মুসাফিরকে ঘরে আনবো, তাকেও মাত্র একদিনের জন্য আশ্রয় দেব। কারণ তার বেশি সময় কোনও বিদেশীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা করার অনেক বিপদ আছে। এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, সখ্যের নিষ্ঠুর বন্ধন-জীবনে সব সুখ-শান্তি ধূলিসাৎ করে দেয়। এই কারণে আপনাকেও আমি কাল সকালে আর আমার বাড়িতে আশ্রয় দিতে পারবো না। এমন কী এর পরে পথে-ঘাটেও যদি আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমি আর চিনতে পারবো না।

খলিফা অবাক হয়ে বললেন, তোমার এই অদ্ভুত আচরণ আমার কাছে বড়ো চমৎকার মনে হচ্ছে। তোমার মতো এই ধরনের একরোখা ছিটিয়াল মানুষ সত্যিই আমি আর দুটি দেখিনি।

যাই হোক, খলিফা বলতে থাকেন, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আশা করি তোমার সোনাদানা হীরে জহরতগুলো আলাদা করে যা সরিয়ে রেখেছিলে, সেগুলো ইয়ার-দোস্তদের থাবা থেকে বাঁচাতে পেরেছ। এখন প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ পরিচয়ে নতুন স্বাদের সন্ধান পেয়েছ। কিন্তু তুমি যে বললে, আগামীকাল সকালেই তোমার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, সে কথা শুনে আমি বড়ো ব্যথিত হলাম, হাসান। আমি যে তোমার এই সৌজন্যের জন্য কিছু প্রতিদান দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যে বলছে, কাল সকালে বিদায় নেবার পর তুমি আর আমাকে চিনতেই চাইবে না। তা হলে কথাটা আজ এই রাতেই হয়ে যাক। এক কাজ করো, আমার অনেক আছে, যা তোমার প্রাণ চায়, আমার কাছে চেয়ে নাও তুমি। আমি অত্যন্ত খুশি মনে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করবো। মনে কোনো দ্বিধা করো না, হাসান। তোমার যা অভীপ্সা অসঙ্কোচে আমার কাছে বলল, আমি তা পূরণ করবো। আল্লাহর দোয়ায় আমি অনেক পয়সার মালিক, ভোগ করার তেমন কেউ নেই, তোমাকে যদি তার খানিকটা দিতে পারি নিজেকে ধন্য মনে করবো, হাসান।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো পঁচিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

আবু অল হাসানের কোনও ভাব-বৈলক্ষণ্য দেখা গেলো না। ধীর শান্ত গলায় সে বললো, আজ রাতে আপনার সাহচর্য পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, জনাব। এর চেয়ে বেশি কি আর ধনদৌলত মেলে? আপনি হৃদয়বান ব্যক্তি। আল্লাহর দোয়াতে আপনার আছে অনেক। এবং খুশিমনেই আমাকে কিছু দান করতে চান—তাও বুঝলাম। কিন্তু জনাব, আমি সবিনয়ে আমার অক্ষমতা জানাচ্ছি। আমার যা অল্প স্বল্প আছে, তা নিয়েই মাথা নিচু করে থাকতে চাই। আপনার দাক্ষিণ্য আমার প্রয়োজন হবে না, জনাব।

খলিফা বললেন, খোদার নাম নিয়ে বলছি, তুমি আমার একটা কথা রাখ, ফিরিয়ে দিয়ো না। তা হলে মনে বড়ো দুঃখ পাবো। আর তোমার ঘর থেকে তোমার মেহমান অপ্রসন্ন মনে বিদায় নিক, এটা কী তুমিও চাও?

হাসান দেখলো, মুসাফিরকে নিরস্ত করা যাবে না। ঘরের মেহমান অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবে—এও তো হতে পারে না। এতদিন এত পরদেশী এসেছে তার ঘরে, প্রত্যেকই আদর আপ্যায়নে যথেষ্ট আনন্দিত হয়ে খুশি মনে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু আজ এই বিদেশী বণিক তাকে বড়ো অসহায় অবস্থায় ফেলেছে। প্রতিজ্ঞা করেছিলো, কারো কাছে সে হাত পাতবে না, কারো অনুগ্রহ সে নেবে না। কিন্তু ঘরে মুসাফির মেহমান এলে তাকে প্রাণ দিয়েও খুশি রাখতে হয়—এ-ও তো হাদিসের কথা।

মাথা গুঁজে একভাবে অনেকক্ষণ বসে রইলো সে। কি যেন চিন্তা করলো। তারপর একসময় বললো, একটা জিনিসই আমার চাইবার আছে, কিন্তু সে কথা শুনলে আপনি হয়তো আমাকে পাগল ভাববেন। যদি কথা দেন, সব শোনার পর ভুল বুঝবেন না। তবেই সে কথা বলতে পারি আপনাকে।

খলিফা হাসেন, এ তো তুমি বড়ো অদ্ভুত কথা বললে? কথা কী, তা না শুনেকী কোনও মন্তব্য কেউ করতে পারে। আগে বল শুনি। তারপর দেখা যাবে। তা ছাড়া তোমার সম্বন্ধে অন্যায়ভাবে খারাপ ধারণা পোষণ করবো কেন? আমি একজন বিত্তশালী বণিক। তোমার অর্থের চাহিদা মেটাবার ক্ষমতা অবশ্যই আমার আছে। সেদিক থেকে অসঙ্কোচে তোমার বক্তব্য রাখতে পার। কথা দিচ্ছি কোনও অসুবিধে হবে না।

হাসান বললো, আমার সমস্যার সুরাহা একমাত্র স্বয়ং খলিফাই করতে পারেন। আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার কাছে আমার বিনীত নিবেদন, যদি কোনও উপায়ে একটা দিনের জন্য খলিফা হারুন অল রসিদকে আমার এই গরীবখানায় আপনি নিয়ে আসতে পারেন তা হলে চিরকাল আপনার ওপর কৃতজ্ঞ থাকবো।

একটুক্ষণ চিন্তা করে খলিফা বললেন, খলিফা যদি একদিনের জন্য তোমার গৃহে আতিথ্য নেন, তবে তাকে নিয়ে কী করবে তুমি?

হাসান বলে, আপনি মুসাফির, আমাদের এই শহরের হালচাল সম্বন্ধে কতটুকু ওয়াকিবহাল, জানি না। তবে শুনন, এই বাগদাদ শহরটা ভাড়াটে বাড়ির শহর। হাজার হাজার মানুষ জীবিকার অন্বেষণে এখানে এসে মাথা গুঁজেছে। এখান বাড়িওলা শেখগুলো ভাড়াটেদের সঙ্গে কী রকম যে দুর্ব্যবহার করে তার তিক্ত ভুক্তভোগী আমি নিজে একজন। এক অসভ্য জংলী জানোয়ার জুটেছে আমার কপালে। লোকটার কুৎসিত কদাচার দেখে আমার সন্দেহ হয়, আদৌ সে মনুষ্য সন্তান নয়। মনে হয়, গাধা আর ঘোড়ার পালে ওর জন্ম হয়েছিলো। সারাদিন রাত ধরে কী অসভ্য খিস্তি খেউড় যে সে চালায় মনে হবে একটা পায়খানার ঝাঝরি। অনর্গল পূতিগন্ধময় নোংরা গালিগালাজ তার মুখে ঝরেই চলেছে। কোনও সময় একটা ভলো কথা কানে আসে না। লোকটাকে দেখেও মনে হয় একটা জানোয়ার। মোষের মতো বিশাল লোমশ বপু। হায়নার মতো হাঁ। কুলোর মতো দুখানা কান লটপট করে। যখন সে কথা বলে, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, কার সাধ্যি। থোকা থোকা থুথুর ছিটে এসে লাগে গায়ে। মুখখানা দেখতে একেবারে ঠিক বুড়ি বাঁদরীর পাছার মতো। দাঁতগুলো একটাও নাই। সারাটা দেহ যত রাজ্যের বিদঘুটে চর্মরোগে ছেয়ে গেছে তার। লোকটা রাক্ষসের মতো এককাড়ি খাবে আর হাসবে।

এই জন্তুটার দুটি সাগরেদ আছে। তারাও দুজনে দুই রত্ন। সব রকমের জাল জুয়াচুরি, বদমাইশি, লোচ্চামি তাদের নিত্যকর্ম পদ্ধতির একটা অঙ্গ। দুনিয়াতে এমন কোনও পাপকর্ম নাই—যা তারা করে না। হঠাৎ দুম করে এমন সব মিথ্যা আজগুবি খবর রটিয়ে দিয়ে প্রতিবেশীদের অহেতুক আতঙ্কিত করে তোলে যে, তা আর কহতব্য নয়। সাদাসিধে নিরীহ ভালোমানুষ দেখলে আর তার রক্ষা নাই। যেন তেন প্রকারে তার অনিষ্ট কিছু করবেই। এই হচ্ছে ওদের শিক্ষাদীক্ষা রুচি-প্রকৃতির নমুনা।

ওদের একজন ভৃত্য—বয়সের গাছ পাথর নাই, কিন্তু অদ্যাবধি গোঁফদাড়ি গজায়নি— একেবারে খোজা-মাকুন্দ। লোকটার কী খরখরে বাজখাই গলা! গাধার ডাকও কানে সওয়া যায়, কিন্তু উফ, ওই ভোঁদড়ের সুমধুর বাণী আমি আর বরদাস্ত করতে পারি না। খুব সকালে সবাই যখন শেষ ঘুমের সুখাবহ খোয়াড়ীতে আচ্ছন্ন, সেই সময় লোকটা সারা মহল্লার নিথর নিস্তব্ধতা খান খান করে হ্রেষারবে চিৎকার তুলে মেথর মুদ্দোফরাসদের সঙ্গে বচসা আরম্ভ করে দেয়। আমার তখন এমনও মনে হয়, হাতের কাছে পেলে বোধহয় আমি ওকে খুনই করে ফেলবো। এই নেড়ি কুত্তার বাচ্চাটা মুখে বড়ো ফট্টাই মারে, সে নাকি সাচ্চা আরব সন্তান। আমি বিশ্বাস করি না। লোকটা ডাইনে বাঁয়ে মিথ্যে কথা বলে। ওর চৌদ্দ পুরুষের কেউ কখনও আরবের বাসিন্দা বা মুসলমান ছিলো না। আসলে ও বেজম্মা বিধর্মী ম্লেচ্ছ—খ্রীস্টান। ওর আসল কারবার হলো হারেমের খোজাদের হাত করে তাদের মালকিনদের কাছে উঠতি বয়সের ছেলে ছোকরা জোগান দেওয়া। এই রকম দালালী করে কিছু রোজগার-পাতি হলে এক পলকেই জুয়া খেলে তা উড়িয়ে দেয়।

আর এক মক্কেল—একটা ভড়। ভোঁদড়ের মতো চেহারা। হোঁদলের মতো কুতকুতে চোখ। থপ থপ করে পা ফেলে হাঁটে। ওর কাজ কেবল বদখদ বাজে রসিকতা—কাতুকুতু দিয়ে তোক হাসানো। আর বস্তা পচা সস্তা যৌন সুড়সুড়ির কেচ্ছা বলে বিগত-যৌবন বুড়ো হাবড়াদের খানিকটা চাগিয়ে তোলা। ও যখন খুব হাল্কা-চালে এইসব ন্যক্কারজনক কথাবার্তা বলে বাজারের লোক জড়ো করে আমার মনে হয় লোকটার ঐ তেল-চকচকে টাকটার ওপর একটা মাটির হাঁড়ি ফাটিয়ে দিই।

যদি আমি কখনো ধর্মাবতারের সঙ্গে দেখা করতে পারি এবং তিনি যদি সদয় হয়ে আমাকে কোনও বর প্রার্থনা করতে হুকুম করেন, তবে আপনাকে আমি কসম খেয়ে বলছি, ধন-দৌলত কিছুই চাইবো না তার কাছে। শুধু বলবো, আপনি এই কুত্তার বাচ্চাগুলোর হাত থেকে আমাকে বাঁচান, আর কিছু আমার বাসনা নাই। আপনার বিচারে যার যা সাজা প্রাপ্য সেই সাজা দিয়ে ওদের বুঝিয়ে দিন, এ শহর শেরিফ আদমীর শহর, বেতমিজ বদমাইশ বেল্লিকদের এখানে জায়গা নাই। আমি বলবো, জাঁহাপনা, আপনি ওদের কেটে কুচি কুচি করে নর্দমায় ফেলে দিন। এ না হলে আমাদের পাড়ায় শান্তি আসবে না।

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো সাতাশতম রজনী?

আবার সে বলতে শুরু করে :

সব শুনে খলিফা বলেন, তা হলে তুমি বলতে চাইছো, এইসব অবাঞ্ছিত দুষ্ট লোকদের সমাজে বসবাস করার কোনও অধিকার নাই! কার এরা নিরীহ সৎ মানুষের চিত্ত কলুষিত করে। তোমার নালিশ অতি ন্যায়সঙ্গত। এবং খলিফা এইসব অনাচার সমাজ থেকে দূর করার জন্যই বদ্ধপরিকর। এই কারণেই তিনি মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে সাধারণ মানুষের ঘন সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করেন। তোমার এই অভিপ্রায় যদি জানতে পারেন, আমার মনে হয় একদিনের জন্য তিনি তোমার আতিথ্য নিতে গররাজি হবেন না। আমি জানি এই ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই তিনি সঞ্চয় করতে চান।

হাসান হো হো করে হেসে ওঠে, না না তার দরকার নাই। সত্যি সত্যিই গুরুগম্ভীরভাবে এসব কথা আপনাকে আমি বলিনি। হাল্কাভাবে সময় কাটানোর জন্য এমনি বললাম। আপনি আবার কাউকে যেন বলবেন না। খলিফার কানে গেলে আমাকে তিনি পাগলা-গারদে ভরে রাখবেন হয়তো। আপনি তো নামজাদা সওদাগর, প্রাসাদের আমির উজিরদের সঙ্গেও আপনার পেয়ার দোস্তি থাকা অসম্ভব নয়। দোহাই আপনার, মদের খেয়ালেও তাদের কাছে আমার এসব অলীক উচ্ছ্বাসের কোনও কথা বলবেন না যেন।

খলিফা বলেন, কথা দিচ্ছি, আমার মুখ থেকে কেউ কিছু শুনতে পাবে না। কিন্তু খলিফা স্বয়ং নিজেই যদি সন্ধান করতে করতে তোমার কাছে চলে আসেন একদিন, তখন?

হো হো করে হেসে ওঠে হাসান। হেসে ওঠেন খলিফাও। তারপর সুরাপাত্র পূর্ণ করে হাসান। খলিফা এক চুমুকে নিঃশেষ করে নামিয়ে রাখেন। হাসানও অতিথির তালে তাল রেখে চলে। এইভাবে একের পর এক মদের পেয়ালা উজাড় করে দিতে থাকে দুজনে।

নেশায় বুদ হয়ে আসছিলো হাসানের চোখ। খলিফা বললেন, এবার তুমি রাখ, আমি ভরে দিচ্ছি পেয়ালা।

খলিফা এগিয়ে আসেন। শরাব ঢালার সময় হাসানের পেয়ালায় টুক করে এক ডেলা আফিঙ ফেলে দেন তিনি। হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, কামনা করি আরো মধুর হোক আমাদের এই মৌতাত।

হাসান বলে, অনেক হয়েছে, এরপর আর চড়ালে, আমার ভয় হয়, কাল সকালে সময় মতো জেগে উঠে আপনাকে বিদায় জানাতে পারবো না। কিন্তু আপনি মহামান্য অতিথি, আপনাকে প্রত্যাখ্যান করি সাধ্য কী, দিন।

খলিফা বলেন, কিচ্ছু হবে না। আমি তোমাকে জাগিয়ে দেব।

আবু অল হাসান সে পেয়ালাও নিঃশেষ করে রেখে দেয়।

একটুক্ষণের মধ্যেই ওষুধের ক্রিয়া কাজ করতে শুরু করে। হাসানের দেহটা ঢলে পড়ে যায়। খলিফা হেসে ওঠেন।

বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিলো মাসরুর তার দেহরক্ষী এবং অন্য নফররা। জানলা দিয়ে ইশারা জানাতেই তারা এসে হাসানের অসাড় দেহটা কাঁধে তুলে নেয়। খলিফা বলেন, আমার পিছনে পিছনে এস তোমরা।

বাড়ি থেকে পথে নেমে খলিফা মাসুরকে বললেন, এই বাড়িটা ভালো করে লক্ষ্য করো, পরে যখন বলবো আবার আসতে হতে পারে।

মাসরুর বললো, ঠিক আছে জাঁহাপনা ভুল হবে না।

পথে বেরিয়ে আসার অনেক পরে খলিফার খেয়াল হয়, দরজাটা হাট করে খোলা পড়ে রইলো, বন্ধ করা হয়নি।

প্রাসাদের পিছন দিকের গুপ্তদ্বার দিয়ে হাসানকে অন্দরে নিয়ে আসেন খলিফা। তার নিজের ঘরের পালঙ্ক-শয্যায় শুইয়ে দিতে বলেন। তারপর নফরদের হুকুম করেন, ওর সাজ-পোশাক খুলে নিয়ে আমার রাতের পোশাক পরিয়ে দাও।

এরপর প্রাসাদের সব নফর চাকর খোজা দাসী বাঁদী প্রহরী সকলকে ডেকে তিনি বললেন, তোমরা সবাই খেয়াল করে শোনো, কাল সকালে এই যুবকের যখন ঘুম ভাঙবে, তখন ওকে খলিফা জ্ঞানে শ্রদ্ধা সম্মান জানাবে। মনে রেখ, আমার জন্য যা যা তোমরা করো, ঠিক সেই সবই করবে এর জন্য। মনে করবে, এই তোমাদের সুলতান খলিফা হারুন অল রসিদ। কোনও ভাবেই সে যেন বুঝতে না পারে—এটা তামাশা।

কাল সকালে তোমরা সকলে এই কামরার সামনে হাজির থাকবে! রোজ যেমন থাক। সে যা হুকুম করবে সঙ্গে সঙ্গে তামিল করবে। তা সে যত অসঙ্গতই হোক না কেন? মাথা পেতে মেনে নেবে সব। আমাকে যে ভাবে কুর্নিশ করো, সম্বোধন জানাও, ঠিক সেইভাবে সেই কায়দায় একেও কুর্নিশ কেতা জানাবে। যদি আমার এই হুকুমের কেউ অবাধ্য হও, তা সে আমার পুত্র হলেও রেহাই দেব না। এর একমাত্র সাজাপ্রাণদণ্ড এবং তাই তোমাদের ভাগ্যে জুটবে।

সমবেত সকলে মাথা নত করে জো হুকুম জাঁহাপনা বলে দাঁড়িয়ে রইলো।

খলিফা এবার উজিরকে বললেন, জাফর, আমার দরবারের সব আমির, সেনাপতি ও পারিষদদের আজ রাতেই খবর পাঠিয়ে দাও। কাল সকালে তারা যেন এই যুবক হাসানকে খলিফার মর্যাদায় মসনদে বরণ করে নেয়। সে যা হুকুম করবে তাই তোমাদের মাথা পেতে নিতে হবে। যা যা দিতে বলে অকাতরে দান করে দেবে। তাতে যদি আমার সলতানিয়তের সমগ্র ধনভাণ্ডারও উজাড় হয়, সেভি আচ্ছা। যদি কারো গর্দান নিতে চায় সঙ্গে সঙ্গে তা তামিল করবে। মনে রেখ আগামীকাল সেই তোমাদের সুলতান। তার ওপরে কথা বলার এক্তিয়ার কারো থাকবে না। এমন কি আমারও না। কোনও কিছুর জন্যেই আমার অনুমতি প্রার্থনা করার কোনও দরকার নাই। তার হুকুমই শেষ কথা। জাফর, যা বললাম তার যেন এদিক ওদিক না হয়।

মাসরুরকে বললেন, শোনো, কাল সকালে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে আমার ঘরে যাবি। হাসান জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহী কেতায় তাকে কুর্নিশ জানিয়ে তার হুকুমের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবি। মনে থাকে যেন প্রতিদিন সকালে আমাকে যা যা বলিস ওকেই বলবি সে সব কথা।এবং তার জবাবে সে যা বলবে ঘাড় হেট করে তা শুনবি। খবরদার, একটুও এদিক ওদিক হয় না যেন।

মাসরুর কুর্নিশ জানিয়ে বললো, জো হুকুম, জাঁহাপনা।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো আটাশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

পরদিন সকালে মাসরুর প্রথমে খলিফাঁকে জাগায় তারপর চলে আসে খলিফার শোবার ঘরে। সেখানে হাসান তখনও নিদ্রামগ্ন।

খলিফা এসে বসলেন একটা পর্দার আড়ালে। সেখান থেকে পালঙ্ক-শায়িত হাসানকে তিনি পরিষ্কার দেখতে থাকলেন। অথচ হাসান বা ঘরের অন্য কেউ তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে না।

জাফর এবং মাসরুর এসে হাসানের শয্যাপাশ্বে করজোড়ে দাঁড়ায়। তাদের পরিধানে সাজ-পোশাক। ঘরের চার পাশে এসে অবনত মস্তকে দাঁড়ালো প্রাসাদের নফর-চাকর বান্দা খোজা দাসী বাঁদী প্রভৃতি। কারো মুখে কোনও কথা নাই। সারা প্রাসাদটায় নেমে এলো গভীর নিস্তব্ধতা। খলিফার ঘুম থেকে ওঠার আগে রোজ যেমন হয়।

একটু পরে একটি বাঁদী খানিকটা ভিনিগার তুলোয় ভিজিয়ে এনে হাসানের নাকে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের ঘোরেই সে হেঁচে ওঠে। এক-দুই-তিন বার। এতে আফিঙের ঘোরটা কেটে যায়।

এরপর গোলাপজলের পাত্র এনে মেয়েটি হাসানের চোখমুখ তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিলো।

এইবার হাসান চোখ মেলে। কিন্তু সে পলকের জন্য মাত্র। আবার সে চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শোয়। ঘুম তার ভেঙ্গে গেছে, নেশা তার কেটে গেছে। কিন্তু একি দেখলো সে? বাদশাহী পালঙ্ক-শয্যা, অগণিত দাসদাসী নফর চাকর—এসব কী? সে কী স্বপ্ন দেখছে? কিন্তু না, স্বপ্নই বা হবে কেন? সে তো জেগেই রয়েছে।

আবার সে চোখ খোলে। কী আশ্চর্য, এরা সব তার ঘরে এলো কী করে? আর এ ঘর তো তার নয়। এত বড়ো কামরায় তো সে কোনও দিন বাস করেনি। আর এমন জাঁকজমক, বাহারী আসবাবপত্র তার ঘরে আসবেই বা কোত্থেকে?

ধীরে ধীরে আবার সে চোখের পাতা বন্ধ করে, আবার খোলে। না, সেই একই দৃশ্য।

তার পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছে শহরের সব বিখ্যাত আমির উজির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তবে কী সে জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছে? হতেও পারে। কাল সেই মশুলের সওদাগরটার সঙ্গে অনেক রাত অবধি সে অনেক মদ গিলেছে। হয়তো এই খোয়াব, তারই কুফল।

জাফর আভূমি আনত হয়ে তিনবার কুর্ণিশ জানায়।

–বান্দা হাজির, ধর্মাবতার। শয্যা ত্যাগ করে উঠতে আজ্ঞা হোক, জাঁহাপনা। আপনার নামাজের সময় হয়ে গেছে।

দুহাত দিয়ে চোখ দুটো কচলায় হাসান। কী ব্যাপার? এ সব কী? ঘরের এদিক থেকে ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়।

-না, আমি তো স্বপ্ন দেখছি না! তবে কী করে রাতারাতি খলিফা হয়ে গেলাম। আর কে-ই বা আমাকে নিয়ে এলো এখানে?

না, আর ভাবতে পারে হাসান। দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে সে। কিন্তু কী একটা অদৃশ্য শক্তি হনন করতে থাকে। চোখ বন্ধ করেও পড়ে থাকতে পারো না।

জাফর দ্বিতীয় বার আবেদন জানায়, ধর্মাবতার, আপনার সকাল বেলার নামাজের সময় বয়ে যায়। মেহেরবানী করে শয্যা ত্যাগ করতে আজ্ঞা হোক, জাঁহাপনা! আজ এতকাল আপনি তো কখনও নামাজ নষ্ট করেননি। কৃপা করে উঠুন।

এই সময় জাফর ইশারা করতে নটীরা নানারকম তারের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভৈরবীর তান তুলতেথাকলো।

আর হাসান ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো, ঘরের এক প্রান্তে একটা মঞ্চের ওপরে বসেছে। অনেকগুলো নটী নর্তকী। তাদের কারো হতে বীণা, কারো হতে সেতার, আবার কারো বা হাতে সরোদ। হাতের যাদুতে সুরের ইন্দ্রজাল রচনা করে চলেছে তারা।

হাসান ভাবে, সে তো শোবার সময় এদের কাউকে দেখিনি। তবে এই একটা রাতের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন, এত সব কাণ্ডকারখানা ঘটে গেলো কী প্রকারে? ভাবতে থাকে সে। কিন্তু কোনও কূল কিনারা খুঁজে পায় না।

এবার সে উঠে বসলো। হাত দিয়ে বালিশ বাজু পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। না, সবই তো শক্ত শক্ত মনে হচ্ছে। পরিষ্কার সে অনুভব করতে পারছে। স্বপ্ন হলে কী অনুভব করা যায়? বলতে পারবে না সে।

দুনিয়াতে এর চেয়ে তাজ্জব কাণ্ড আর কী হতে পারে? তার নাম আবু অল হাসান। তার বাবা ছিলো সওদাগর। অনেক ধনরত্ন রেখে গিয়েছিলেন তিনি। সেগুলো না উড়িয়ে জমিয়ে রাখলেও এই রকম বাদশাহী খাট-পালঙ্ক গালিচা পর্দা, নফর চাকর, দাসী বাঁদী, নটী নর্তকীর বিলাস প্রাচুর্যে দিন কাটাবার স্বপ্নও সে দেখতে পারতো না। সেই সব অসম্ভব অদ্ভুত কাণ্ড তো আজ সে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করছে।

এই সময় বাজনা থেমে গেলো। মাসরুর এগিয়ে এসে তিনবার আভূমি আনত হয়ে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, ধর্মাবতার নামাজের বেলা বয়ে যায়। দরবারে যাবার সময় আগত হয়ে এলো। শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃকৃত্য সম্পাদন করতে আজ্ঞা হোক।

আবু আল হাসান বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে মাসরুরের দিকে তাকায়। লোকটা বলে কী! তাকে দরবারে গিয়ে মসনদে বসতে হবে?

ক্রোধে ফেটে পড়তে চায় হাসান।

-আমি জাঁহাপনার বান্দা মাসরুর। আর আপনি পয়গম্বর মহম্মদের চাচা আব্বাসের পঞ্চমতম পুরুষ মহামান্য ধর্মাবতার খলিফা হারুণ অল রসিদ।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো ত্রিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে।

—তুমি একটা দোজকের পোকা-খানকির বাচ্চা। মাসরুর মাথা নুইয়ে বলে, শাহেনশাহ যথার্থই বলেছেন। নিজেকে আমি গর্বিত মনে করছি। আমার মনে হয়, জাঁহাপনার কাল রাত্রে সুনিদ্রা হয়নি। কিছু দুঃস্বপ্ন দেখে থাকবেন, সেই কারণে তিনি আমার প্রতি কুপিত হয়ে উঠেছেন। যাই হোক, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আপনাকে সুস্থ করে তুলুন।

আবু অল হাসান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আবার শয্যায় ঢলে পড়ে। দু’হাতে মুখ ঢেকে পা দুটো ছুঁড়ে দাপাদাপি করতে থাকে। পর্দার আড়ালে হারুন অল রসিদ আর হাসি চেপে রাখতে পারে না। তার হাসির শব্দে সবাই চকিত হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় রুমাল দিয়ে তিনি মুখ চাপা দিয়ে ধরেন।

আবু হাসান নিজের মনেই হো হো করে হাসতে থাকে। খলিফা হারুন অল রসিদ হা হা হা, সে নাকি স্বয়ং খলিফা! কী সব আজগুবী কাণ্ড! আবার সে তড়াক করে শয্যার উপর উঠে বসে। সামনে দাঁড়িয়েছিলো একটা ছোট্ট নিগ্রো বাঁদী, তার দিকে তাকিয়ে বলে, এ্যাঁই, এদিকে আয়। বলতো, আমি কে?

মেয়েটি ভীত চকিত হয়ে কাছে আসে, বলে, আপনি তো আমাদের খলিফা হারুন অল রসিদ।

—চোপ রও! হারুন অল রসিদ-মিথুক কোথাকার।

এরপর আর একটা ফর্সা বাঁদীর দিকে বাঁ হাতের তর্জনটা বাড়িয়ে দিয়ে সে বলে, এ্যাঁই, আমার এই আঙ্গুলটা কামড়ে দে তো!

মেয়েটি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে হাসানের আঙ্গুলটা কামড়ে ধরে।

—উঃ উঃ, ছাড় ছাড়—

হাসান হাতটা টেনে নেয়। না, স্বপ্ন হলে ব্যথা লাগবে কেন? এ তো স্বপ্ন নয়! মেয়েটিকে সে প্রশ্ন করে। আমাকে তুমি চেন? বল তো আমি কে?

মেয়েটি নির্বিকার ভাবে বলে, আপনি আমাদের মহানুভব সুলতান খলিফা হারুন অল রসিদ। হাসান আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হো হো হো। হাসান, তুমি তা হলে দেখেছ, সত্যিই খলিফা বনে গেছ। এরা যে সবাই এক কথা বলছে, তুমি নাকি বাগদাদের সুলতান খলিফা হারুন অল রসিদ।

এই সময় প্রধান খোজা তিনবার কুর্নিশ জানিয়ে বললো, ধর্মাবতার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া নিরর্থক। তবুবলছি, দরবারের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এবার তো ধর্মাবতারকে মসনদে বসতে হবে। দরবারের আমির অমাত্যরা অধীর আগ্রহে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

হাসান এক লাফ দিয়ে পালঙ্ক ছেড়ে নিচে নেমে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে একনজর নফর ছুটে আসে খলিফার হীরে মুক্তোয় চুমকি-বসানো সোনার জরিতে মোড়া টুকটুকে লাল চটি জোড়া নিয়ে। হাসানের পায়ের তলায় বসে পড়ে জুতো জোড়া বাড়িয়ে ধরে।

এমন অতি মূল্যবান শাহী জুতো সে চোখে দেখেনি কখনও। নির্বিবাদে পা দুখানা গলিয়ে দেয় সে চটির মধ্যে।

প্রধান খোজার কাঁধে ভর দিয়ে হাসান হামামে গিয়ে ঢোকে।

কিছুক্ষণ পরে হাসান ফিরে এসে দেখে, হারেমের সমস্ত বাঁদীরা দুই সরি হয়ে অবনত মস্তকে কুর্নিস জানাবার ভঙ্গী করে কোমর নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এইখানে রাত্রির সাজপোশাক খুলে ফেলে হাসানকে দরবারের বাদশাহী সাজে সজ্জিত করা হয়।

হাসান এবার সন্দেহাকুল হয়ে ভাবে, না, তা হলে সত্যিই হাসান নই। এই তো আমি স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ।তবে বোধ হয় কাল রাতের স্বপ্নটাই আমাকে ভাবিয়েছিলো, আমি এক তুচ্ছ বেকার বণিক সন্তান আবু অল হাসান! আরে ছোঃ যত সব আজগুবী খোয়াব। না না, আমি হাসান হতে যাবো কেন, আমি তো খলিফা। এই তো আমার উজির, এই তো আমার প্রাসাদ। এই তো আমার বেগম-বাঁদীরা। না, আমি আর ওসব হাসান ফাসানের কথা চিন্তা করে মাথা খারাপ করবো না। আমার ওসব বাজে কথা চিন্তা করার মতো সময় কোথায়? আমি খলিফা, ওরা আমাকে এখুনি দরবারে নিয়ে যাবে। মসনদে বসাবে। আমি বিচার করবো, হুকুম ফরমানি জারি করবো। আমার কথায় সবাই ওঠ বোস করবে।

দরবারে চলো, কদম বাড়াও।

হাসানের কণ্ঠে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। স্পষ্ট গম্ভীর আওয়াজ। কোনও দ্বিধা জড়তার লেশমাত্র নাই।

দারুন জাঁকজমক করে দরবারে নিয়ে এসে হাসানকে মসনদে বসানো হয়।

হাসান দেখলো সারা দরবারকক্ষ আমির উজির সেনাপতি সভাসদ পারিষদ বয়স্যে পরিপূর্ণ। সকলেই শ্রদ্ধাবনত হয়ে কুর্নিশ জানিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। নিয়ম হচ্ছে যতক্ষণ না খলিফা সকলকে আসন গ্রহণ করতে বলেন, ততক্ষণ কেউই বসতে পারে না। দাঁড়িয়েই থাকতে হয়। হাসান তা বুঝতে পারে না। সুতরাং কেউই আর আসন গ্রহণ করতে পারে না। উজির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে, ধর্মাবতার যদি অনুমতি করেন, আমরা আপনার চরণতলে বসতে পারি।

হাসান ইশারা করে। সবাই যে যার আসনে বসে পড়ে।

দরবারের অধিকাংশই তার অচেনা মুখ। শুধু উজির জাফর এবং কবি আবু নবাস, অল ইজলী, অল রাক্কাসী, ইবদান, অল সাকার, উমর অল টারতিস, আবু ইশাক ও জাদিমকে সে চেনে। নানা সভা-সমিতিতে অনেকবার সে দেখেছে তাদের।

জাফর একখানা বড়ো কাগজের লম্বা ফর্দ বাড়িয়ে দেয় হাসানের দিকে। সেদিন দরবারে কার কী আর্জি আছে, কোন মামলার বিচার-রায় দিতে হবে এবং কোন কোন ফরমান হুকুম জারি করতে হবে তারই লম্বা ফিরিস্তি।

এরপর জাফর প্রজাদের অভাব অভিযোগের দরখাস্তগুলো সভাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তে থাকে। পর্দার পিছনে খলিফা বসেছিলেন তামাশা উপভোগ করার জন্য। তিনি সব শুনতে থাকেন। এবং উজিরকে ইশারা করে তার ‘হা’ ‘না’ বক্তব্য জানিয়ে দিতে থাকেন।

হাসান কিন্তু এই সবের কিছুই বুঝতে পারেনা। উজির নিজের মনে সবদলিল দস্তাবেজ হুকুম ফরমানের কাগজপত্র পাঠ শেষ করে। এর কোনটায় হাঁ বলতে হবে, কোনটা না করতে হবে। হাসান বুঝবে কী করে? উজিরকে সে বলে, ওসব দেখার বা শোনার আমার সময় নাই। এখন থাক। পরে হবে। এখন হাবিলদার আহমদকে হাজির কর।

তৎক্ষণাৎ শহরের সিপাই অধিকর্তা আহমদ এসে তিনবার কুর্নিশ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হাসান বললো, দশজন সিপাই সঙ্গে নিয়ে এক্ষুনি তুমি মোস্তাফা পট্টির রমজান শেখ আর তার দুই সাগরেদকে পাকড়াও কর। এই তিনটি লোকই বেতমিজ বদমাইশ। শুধু লোক ঠকানো, ধাপ্পাবাজি, অন্যের মেয়েছেলের দিকে নজর দেওয়া, আর নিরীহ মানুষকে অহেতুক শশব্যস্ত করাই এদের পেশা। এরা সমাজের কীট। এদের ধরে আচ্ছা করে রশি দিয়ে বাঁধবে। তারপর গাধার পিছনে বেঁধে সারা মহল্লা ঘোরাবে। জনে জনে ডেকে বলবে, খলিফার হুকুমে শয়তানদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। এরপর চৌমাথার মোড়ে নিয়ে এসে প্রকাশ্য দিবালোক সহস্র জনতার সামনে ওদের প্রত্যেককে চারশো ঘা করে চাবুক লাগারে।

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো বত্রিশতম রজনী :

আবার সে গল্প শুরু করে :

তারপর লোহার ডাণ্ডা গরম করে ঐ শেখটার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে। এই মুখ দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় লোককে গালিগালাজ করে সব সময়। এরপর ওর লাশটা কুত্তাদের মুখে ছুঁড়ে দেবে। তারপর ঐ শাগরেদ দুটোকে ধরে ওই পাড়ার এক পড়শী আবু অল হাসানের খাটা-পায়খানার হাঁড়ির মধ্যে ফেলে দেবে।

আহমদ ফৌজি কায়দায় মাথায় ডান হাতখানা তুলে ধরে, পরে আর একবার কুর্নিশ জানিয়ে দরবারকক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলো।

পর্দার আড়ালে বসে খলিফা হাসানের কার্যবিধি সবই প্রত্যক্ষ করছিলেন।

তার এই ধরনের শাহচিত হুকুমনামা শুনে বিশেষ প্রীত হলেন তিনি।

কিছুক্ষণ পরে আহমদ ফিরে এলো। হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার হুকুম তামিল করেছ?

আহমদ বলে, ধর্মাবতার মহানুভব এই তার প্রমাণ।

একখানা কাগজ সে উজিরের দিকে বাড়িয়ে দেয়। উজির পড়ে শোনালো, স্থানীয় সম্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাক্ষর করে দিয়েছে—তাদের চোখের সামনে খলিফার এই হুকুম তামিল করেছে পুলিশের সর্বাধিনায়ক হাবিলদার আহমদ।

হাসান উল্লসিত হয়ে ওঠে, অতি উত্তম। আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার কাজে।

হাসান এবার প্রধান খাজাঞ্চীকে উদ্দেশ করে বলে, এক হাজার দিনার একটা থলেয় ভরে চাঁদনীচকের আবু অল হাসানের মার হাতে দিয়ে এস। হাবিলদার আহমদকে জিজ্ঞেস করলে সে হাসানের ঠিকানা বলে দিতে পারবে। থলেটা সাহেবের মাকে দিয়ে বলবে, আমাদের ধর্মাবতার খলিফা এই এক হাজার দিনার আপনাকে পাঠিয়েছে। আরও বেশি টাকা পাঠাবার ইচ্ছা ছিলো তার। কিন্তু রাজা কোষে বেশি অর্থ নাই। তাই এই দিনারগুলোই আজকের মতো রাখুন, পরে আবার পাঠাবেন তিনি।

প্রধান খাজাঞ্চী দরবার থেকে বেরিয়ে একটা থলেয় এক হাজার দিনার ভরে হাসানের মা-এর কাছে চলে যায়।

হাসান উজিরকে জানালো, আজকের মতো দরবার শেষ। উজির সেকথা আমির অমাত্যদের জানিয়ে দিতে তারা সকলে খলিফাঁকে যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে দরবারকক্ষ ছেড়ে চলে গেলো।

হাসান উজির এবং মাসরুরের কাঁধে ভর দিয়ে মসনদ থেকে নীচে নামে। তারপর ওরা হাসানকে নিয়ে হারেমে চলে আসে। সেখানে সেদিনের দুপুরের খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছিলো। মেয়েরা সকলে এসে হাসানের পাশে বসে।

সুন্দরী মেয়েরা সুমধুর তালে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। হাসান ভাবতে থাকে, সে যে সত্যি সত্যিই খলিফা হারুন অল রসিদ সেবিষয়ে তার মনে আর কোনও সংশয়, দ্বিধা নাই। এই তো সে শুনতে পাচ্ছে মেয়েদের বাজনা, ফুল শুকে সে গন্ধ আঘ্রাণ করতে পারছে, দিব্যি পায়ে হেঁটে চলে বেড়াতে পারছে। সে কথা বলছে, হুকুম করছে, তামিল হচ্ছে। একটু আগেই সে তিনজনের প্রাণদণ্ড দিয়ে এসেছে। সবাই তাকে খলিফা বলে মান্য করছে। সুতরাং সে তো আর স্বপ্ন দেখছে না। সে নিশ্চয়ই খলিফা।

ভোর হয়ে আসছে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো চৌত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

বিশাল একখানা টেবিলে থরে থরে নানা স্বাদের বাদশাহী খানা সাজানো হয়েছে। কোনওটায় মাংসের কাবাব, কোন রেকাবীতে মোরগ মোসাল্লাম, কোনটায় আফগানী কোর্মা, আবার কোন রেকাবীতে পায়রার ঝোল। তন্দুরী রুটি প্রভৃতি। এছাড়া অনেক রকমের সজীর তরকারী।

গতকাল রাত-এর পর হাসান কিছু খায়নি। বেশ চনমনে খিদেও পেয়েছে তার। তাই বেশ উন্মুখ হয়ে উঠেছিলো খাওয়ার জন্য।

হাসান নানা ব্যঞ্জন সহকারে খানাপিনা করে। তার সামনে পিছনে পাশে দাঁড়িয়ে সাতটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে চামর দুলিয়ে হাওয়া করতে থাকে। হাসানের কেমন অস্বস্তি লাগে। এসব তো আর অভ্যেস নাই কোনও কালে।

শেষ গ্রাস মুখে নেবার সময় পর্যন্ত প্রতিটি মেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। খাওয়া দেখে। হাসান ঘেমে ওঠে। তার খাওয়া কেউ দেখছে, এটা ভেবেই তার খিদের অর্ধেকটা উবে যায়। কিন্তু কি করবে, উপায় নাই। সে খলিফা হারুন অল রসিদ, তাকে তো প্রাসাদ হারেমের রীতিনীতি কেতা, মেনে চলতে হবে।

মেয়েদের ডেকে প্রত্যেকের নাম জিজ্জেস করে হাসান, কী নাম তোমাদের? একজন বলে তার নাম চুমকী। আর একজন বলে শোভা। আর একজনের নাম গুলাবী। অন্য একজনের নাম আনার। আর একটির নাম পলা। এবং বাকী দুজনের নাম চুনী ও পান্না।

—বাঃ, চমৎকার নাম তো তোমাদের।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে খোজা গরম জলের গামলা নিয়ে আসে। মেয়েরা হাসানের হাত মুখ ধুইয়ে সুগন্ধ তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেয়। তারপর হাত ধরে আর এক কামরায় নিয়ে চলে। দরজায় খোজা প্রহরী ছিলো। সে শশব্যস্ত হয়ে পর্দা গুটিয়ে ধরে।

হাসানকে পালঙ্কে বসিয়ে খোজার জিম্মায় রেখে মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশের একটা দরজা দিয়ে পরপর অন্য সাতটি পরমাসুন্দরী মেয়ে সাতখানা ফলের বারকোষ হাতে নিয়ে প্রবেশ করে। এই সাতটি মেয়ে আগের সাতটির চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী।

হাসান ওদের পাশে বসায়। এবং নিজের হাতে করে প্রত্যেককে নানারকম ফল খেতে দেয়। কাউকে দেয় আঙুর, কাউকে তরমুজ, কাউকে বা কলা—এইভাবে এক একজনকে এক এক রকমের ফল তুলে দেয় সে।

সে নিজে প্রত্যেক ফল একটু একটু করে আস্বাদ করে।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো ছত্রিশতম রজনী।

আবার সে গল্প শুরু করে :

এরপর ঐ সপ্তকন্যা হাসানকে হাতে ধরে পাশের কামরায় নিয়ে যায়। সে ঘরেও পালঙ্ক-শয্যায় বসিয়ে খোজার হেপাজতে দিয়ে ওরা বিদায় নেয়। এবং সুঙ্গে সঙ্গে পাশের একটা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অন্য সাতটি মেয়ে। তাদের প্রত্যেকের হাতে সোনার থালা। আর থালা ভর্তি এক এক রকমের মিষ্টি। পেস্তার বরফি, আলেপ্পের মণ্ডা, মশুলের জমানো খেজুর-ক্ষীর, আর বসরাহর হালওয়া প্রভৃতি। হাসান এই বস্তুগুলো খেতে ভালোবাসে না। অল্প একটু মুখে দিয়ে বলে, তোমরা খাও, আমি দেখি।

এবার মেয়েরা হাসানকে নিয়ে যায় পানঘরে। যথারীতি খোজার কাছে জমা দিয়ে দেয় তারা। এবং প্রায় সঙ্গেই সাতটি সুন্দর মেয়ে নানারকম মদের পাত্র মাথায় নিয়ে সঙ্গীতের তালে তালে (পর্দার আড়াল থেকে যে সব মেয়েরা সমধুর সুরে গান গাইছিলো তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছিল

না।) নাচতে নাচতে পাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে।

হাসানের চোখ নেচে ওঠে। বাঃ, তোফা। এতক্ষণ তো সে এই কথাই ভাবছিলো।

মেয়েরা এক এক জনের পাত্র থেকে এক এক পেয়ালা ভরে হাসানের অধরে ধরে। এক এক চুমুকে হাসান নিঃশেষ করতে থাকে। এইভাবে ছ’জনের হাত থেকে ছ’পেয়ালা মদ সে উদরস্থ করে। ধীরে ধীরে নেশাটা বেশ জমে ওঠে। এইবার সপ্তম কন্যার দেবার পালা। মদ ঢালার সময় সে কায়দা করে আফিঙের একটি ডেলা পেয়ালার মধ্যে ঢেলে দেয়। উজির জাফর মেয়েটিকে আফিং বড়িটা দিয়ে বলেছিলো, খলিফার শরাবের শেষ পেয়ালায়, তার অলক্ষ্যে এই ডেলাটা  মিশিয়ে দিয়ে তার মুখে ধরবে।

 

পলকের মধ্যেই হাসান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শয্যায় এলিয়ে পড়ে। খলিফা হারুন অল রসিদ মাসরুর আজ জাফরকে পাশে নিয়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে এই সব দেখছিলেন। এবার তিনি হো হো করে হাসতে হাসতে পর্দা ঠেলে পালঙ্ক-শয্যার পাশে দাঁড়াল।

হাসানের দেহটা তখন অসাড় অচৈতন্য। খলিফা মাসরুরকে বলেন, ওর গা থেকে আমার সাজ-পোশাক সব খুলে ওর নিজের গুলো পরিয়ে দে।

মাসরুর বাদশাহী সাজ খুলে হাসানকে তার নিজের সাজ-পোশাক পরিয়ে দেয়। খলিফা বলেন, এবং যে দরজা দিয়ে ঢুকিয়েছিলি প্রাসাদের সেই গুপ্তদরজা দিয়ে আবার একে বাইরে নিয়ে যা। যে বাড়ি থেকে এনেছিলি সেই বাড়ির সেই ঘরে এর নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে আসবি। সাবধান, কেউ যেন টের না পায়, বুঝলি?

মাসরুর মাথা নেড়ে বলে, আপনি কিছু ভাববেন না জাঁহাপনা। কাক পক্ষীটিও জানতে পারবে না।

খলিফা বলেন, উফ, সকাল থেকে হাসতে হাসতে আমার পেটে ব্যথা ধরে গেছে। হাসান যদি আর বেশিক্ষণ এখানে থাকে, আমি হাসতে হাসতেই মারা পড়বে।

খলিফার নির্দেশমতো মাসরুর হাসানকে নিয়ে চাঁদনীচকে ওর বাড়িতে চলে যায়। তারপর সেই ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিঃশব্দে কেটে পড়ে।

পরদিন সকালে হাসানের ঘুম ভাঙ্গে না। বেলা যখন দুপুর গড়িয়ে গেলো সেই সময় সে চোখ মেলে। কিন্তু কেমন সব গোলমাল মনে হয়। মাথাটায় ঝাকুনি নিয়ে ঘুমের আচ্ছন্ন ভাবটা কাটাবার চেষ্টা করে।

-কোথায়, মেয়েরা সব, কোথায় গেলে, এদিকে এস। হাসানের কণ্ঠে হুকুমের সুর। কিন্তু কেউ আসে না; কেউ কোনও সাড়া দেয় না। হাসান এবার কিছু উত্তেজিত কণ্ঠে ডাক দেয়, মেয়েরা সব কোথায় গেলে, আমি জেগে উঠেছি, দেখতে পাচ্ছ না? এদিকে এস।

কিন্তু কে আসবে? কে সাড়া দেবে?

এবার হাসান ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, এ্যাঁই জাফর-জাফর? এ্যাঁই-কুত্তার বাচ্চা? মাসরুর-খানকির ছেলে, কোথায় গেলি সব। দাঁড়া, আজ তোদের সব্বাইকে শূলে চড়াবো। এত বড়ো আস্পদ্দা, আমি কখন থেকে ডাকছি, তা নবাবজাদাদের সাড়া দেবার নাম নাই।

ক্রোধে আরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার পরই ভ্যাবাচেকা খেয়ে আবার সেবসে পড়ে খাটের ওপর। বিস্ময় বিস্ফারিত বড়ো বড়ো চোখ মেলে সে ঘরের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত দেখতে থাকে। এ কোন্ ঘর? এ তো তার প্রাসাদের শয়নকক্ষ নয়! কিছুই বুঝতে পারে না হাসান। এ কোথায় সে বসে আছে। এ তো একটা এঁদো স্যাঁতসেঁতে চুনবালীখসা ঘর। এখানে সে এলো কী করে। সে স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ। সে কেন এই দীন ভিখারীর ঘরে বসে থাকবে? কে। তাকে নিয়ে এলো এখানে? কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে-এই কাণ্ড করেছে। এবার সে আরও জোরে বাড়ি ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে, জা-ফ-র। তবু জাফর সাড়া দেয় না! ছুটে আসে তার বৃদ্ধা মা।

—কী বাবা, কী হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন-টপ্ন কিছু দেখেছিস নাকি?

হাসান সন্দেহের চোখে তাকায়, কে তুমি?

-সে কি বাবা, এখনও কী স্বপ্ন দেখছিস জেগে জেগে?

—স্বপ্ন আমি দেখছি, না তুমি দেখছো বুড়ি। জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কাকে কী কথা। বলছো? আমি স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ পয়গম্বর মহম্মদের চাচা আব্বাসের পঞ্চম পুরুষ। খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে কী আদব কেতায় কথা বলতে হয়, তাও জান না?

মা আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে, সে কি বাবা, তুই যে আমার একমাত্র চোখের মণি, আমি তোর

মা।

—তুমি মাই হও আর যেই হও—আমি তো এই মুলুকের সুলতান। আমার সামনে যখন দাঁড়াবে, সবাই যেমন সালাম কুর্নিশ করে, তুমিও তেমনি করবে। সবাই যেমন আমাকে ধর্মাবতার বলে সম্বোধন করে, তোমাকেও তাই করতে হবে। এই-ই নিয়ম। মা হয়েছ বলে তুমি খলিফার তখতের অপমান করতে পার না। জান, আমার এক আঙ্গুলের ইশারায় কী কাণ্ড ঘটতে পারে? এই তো কালই ঐ শয়তান শেখটা আর তার দুই সাগরেদকে এক হুকুমে খতম করে দিয়েছি। বাবা, আমি কি যে সে তোক নাকি। এই তো খাজাঞ্চীকে হুকুম করা মাত্র তোমাকে সে এক হাজার দিনারের একটা থলে দিয়ে গেছে। কী, দেয়নি?

হাসানের মা বলে, হ্যাঁ, কাল দুপুরে প্রাসাদ থেকে একজন এসে আমাকে একটা মোহরের তোড়া দিয়ে বললো, খলিফা এই এক হাজার দিনার পাঠিয়েছেন আপনাকে। আজ ধনাগারে বেশি অর্থ নাই, তাই এইটাই রাখুন আজকের মতো। পরে আবার পাঠিয়ে দেবেন তিনি।

হাসান ভারিক্কি চালে মাথা নাড়ে, তবেই বোঝ, আমার কী ক্ষমতা। আরে হবে না কেন, আমি যে স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ-সমগ্র ইরাক খুরাসনের প্রবল প্রতাপান্বিত মহামান্য সুলতান। আমার কথায় বাঘে গরুতে একঘাটে পানি খায়। আর এ তো অতি তুচ্ছ ব্যাপার।

হাসানের মা বুঝতে পারে, ছেলের মাথার গোলমাল হয়ে গেছে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে, ও বাবা গো, আমার একি হলো গো? আমার একমাত্র বুকের কলিজাকে কে কি গুণ তুক করেছে গো? হায় হায়, এখন আমার উপায় কী হবে?কী করে সারাবো আমি? কে সারিয়ে দেবে আমার বাছাকে।

-এ্যাঁই বুড়ি চুপ কর। মাথা আমার খারাপ হয়নি, হয়েছে তোমার। তা না হলে, খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে এই রকম বেয়াদপি করে বে-শরম বাত বলতে পার? দূর হও—দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।

হাসানের মা এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে, এসব কী বলছিস, বাবা। কে তোক কী খাইয়েছে বল? সেই মশুলের সওদাগরটাকে যখন অত রাত অবধি অত গলাগলি করছিলি তখনই আমার ভয় লাগছিলো। মশুলের লোকগুলো ভালো হয় না।ওরা অনেক রকম ঝাড়ফুঁক, গুনতুক করতে জানে। জড়ি বড়ি খাইয়ে ভালো মানুষকে পাগল করে দিতে পারে।

থামো। পাগল করে দিতে পারেহাসান খেকিয়ে ওঠে ওর মাকে, আমি শাহেন শাহ খলিফা হারুন অল রসিদ। আমাকে সে পাগল করে দেবে? সারা মশুল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেব না?

–ও বাবা গো, মা গো, এ আমার কী হলো গো? কে আমার এই সব্বোনাশ করে গেলো গো। হায় হায় হায়—আমার একমাত্র চোখের মণি—তাকে পাগল করে দিলো কে?

হাসান চিৎকার করে ডাকে, জাফর জাফর? মাসরুর, মাসরুর? এই বেয়াদপ বুড়িটাকে প্রাসাদ থেকে বাইরে বের করে দাও।

কিন্তু জাফর বা মাসরুর কেউ-ই আসেনা। হাসানের মা মুখে মধু ঢেলে বলে, জাফর মাসরুর আসবে কোখেকে, বাবা। আর এটা কী খলিফার প্রাসাদ। তাকিয়ে দেখ না, আমাদের সেই ঝরঝরে পুরনো বাড়ি-চুন বালী খসা ঘর। তুই কী এখনও বুঝতে পারছিস না, খারাপ স্বপ্ন টপ্ন দেখে এই রকম ভুল বকছিস। নে, চোখে মুখে পানি দে। একটু শরবত খা। দেখ সব ভুল ভেঙ্গে যাবে। দাঁড়া, আমি নিয়ে আসি।

মা বেরিয়ে যায়। হাসান বসে বসে ভাবতে থাকে, তবে কী সে সত্যিই স্বপ্ন দেখছিলো সারারাত ধরে? তবে কি সে আবু অল হাসান? খলিফা নয়? হয়তো মা-র কথাই ঠিক। আগাগোড়াটাই স্বপ্ন?

মা ফিরে এসে হাসানের চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। এক গেলাস শরবত তুলে দেয় ওর হাতে। এক চুমুকে শরবতটুকু নিঃশেষ করে হাসান বলে, মা, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি অল হাসান। এই তো আমার সেই চির চেনা ঘর। কাল রাতে আমি বোধহয় স্বপ্নই দেখেছিলাম।

মা-এর মুখে হাসি ফোটে। যাক, ছেলে তবে পাগল হয়ে যায়নি।

—তোকে আমি তো বললাম, বাবা, অনেক সময় নানারকম আজগুবি স্বপ্ন দেখে সকালবেলায় কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।তুই একটু সুস্থ হয়ে বোস, আমি তোর জন্যে নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসি।

মা ঘর থেকে বেরিয়ে রসুইখানায় যাবার উদ্যোগ করতেই হাসান আবার চিৎকার করে ওঠে, এ্যাঁই শয়তানী, শিগ্নির করে বলল, কে আমাকে প্রাসাদ থেকে এখানে রেখে গেছে। আমার দরবার, আমার তখত আমার হারেম-কোথায় গেলো? কে কারসাজী করে আমাকে সরিয়ে এনেছে এখানে? বল, শিগ্নির করে বল। নইলে মেরে শেষ করে দেব তোকে।

হাসান তেড়ে আসে মা-এর কাছে। চেপে ধরে তার চুলের মুঠি, এখনও বল, এসব কার ষড়যন্ত্র?

মা বলতে চায়, বাবা, শান্ত হয়ে বোস, কেন এরকম করছিস। আমি তোের গর্ভধারিণী মা। দশমাস দশদিন পেটে ধরেছি, বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছি। এই কী তার পুরস্কার? তুই কী করে খলিফা হতে পারবি, বাবা। তুই তো আমার ছেলে-হাসান।

—হাসান! ওরে শয়তান বুড়ি, আমি হাসান? জানিস না, আমার হুকুমে সারা সলনিয়ত কঁপে।

এই বলে সে এক ধাক্কা মেরে মাকে মেঝেতে ফেলে দেয়। বৃদ্ধা হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। পুত্রস্নেহে অন্ধ মা চোখের জল মুছতে মুছতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পরে নাস্তা বানিয়ে আবার ফিরে আসে সে হাসানের ঘরে। হাসান তখন গুম মেরে বসে বসে কী সব ভাবছিলো। ছেলের পাশে এসে হাত রাখে মা। বলে, নে বাবা, খেয়ে নে। তারপর যা, একটু খোলা হাওয়া থেকে ঘুরে আয়। দেখবি, ভালো লাগবে।

হাসান কোনও কথা বলে না। খেতে শুরু করে। মা বলে, জানিস বাবা, কাল হাবিলদার আহমদ এসেছিলো, আমাদের মহল্লায়। পাশের ঐ শয়তান শেখটা আর তার দুই সাগরেদকে ধরে গাধার পিঠে চড়িয়ে সারা মহল্লাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ালো। আর তাঁড়া পিটে লোকজনদের জানাতে লাগলো এই যে চাঁদনীচকের বাসিন্দারা, শোনো, এই বদমাইশ শেখ আর তার এই দুই বেল্লিক ল্যাঙবোটকে এবার চাবুক মারা হবে। যারা দেখতে চাও, চৌমাথায় জড়ো হও। কাতারে কাতারে ছেলে বুড়োরা জড়ো হলো সেখানে। আমি তো ঘরে বসে জানালার পর্দা সরিয়েই দেখতে পেলাম। ওঃ, কী মারটাই মারলো! এক এক জনকে চারশো ঘা চাবুক। তা অত মার কী আর শরীরের সয়? তখনই প্রায় দলা পাকিয়ে গেছে। তার উপর একটা লোহার শিক তাতিয়ে এনে শেখটার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো আহমদ। আর সঙ্গে সঙ্গে সব খতম। শেখের লাশটা নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলো ঐ নর্দমায় পানিভরা ডোবাটার মধ্যে। আর ওর সাগরেদ দুটোকে এনে ফেলে দিলো আমাদের খাটা পায়খানার ময়লার হাঁড়ির মধ্যে। ঠিক হয়েছে, উচিত সাজা দিয়েছেন ধর্মাবতার। পাড়াটার হাড় জুড়িয়েছে।

হাসান অনেকটা সামলে নিয়েছিলো। কিন্তু মা-র এই কথা শোনার পর আবার তার ধারণা বদ্ধমূল হলো, সে নির্ঘাৎ খলিফা হারুন অল রসিদ। কারণ আহমেদকে সে-ই তো এইহুকুম দিয়ে পাঠিয়েছিলো। আবার সে চিৎকার করে ওঠে, সেই ধর্মাবতারটি কে—জান? এই শর্মা। আমি–আমিই সেই খলিফা হারুন অল রসিদ—আমার সেই পুর্বপুরুষ আব্বাস-পয়গম্বর হম্মদের আপন চাচা। আমার হুকুমেই আহমদ ওদের তিনজনকে খতম করেছে। আর তুই শয়তানী কিনা বলছিস, আমি হাসান? এত বড়ো স্পর্ধা তোর, স্বয়ং খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে এন্তার মিথ্যে কথা বলা? জানিস, এর সাজা কী? মৃত্যু—মৃত্যুদণ্ড। জল্লাদকে দিয়ে নয়, আজ তোকে আমি নিজের হাতে খুন করবো।

এই বলে ঘরের কোণে রাখা একখানা ছড়ি তুলে নিয়ে সে ছুটে আসে মা-এর দিকে ঠাই ঠাই করে বসিয়ে দেয় কয়েক ঘা। বৃদ্ধা আর্তনাদ করে ওঠে, ও বাবা গো, মা গো, মেরে ফেললো গো, তোমরা কে কোথায় আছ, বাঁচাও বাঁচাও!

হাসানের মা-এর চেঁচামেচি চিৎকারে পাড়াপড়শীরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে।

—কী ব্যাপার, কী হয়েছে? একি! হাসান, বুড়ো মাকে ধরে মারছো? ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জা!

ওদের একজন ছুটে গিয়ে হাসানের হাতের উদ্যত ছড়িটা কেড়ে নেয়, তোমার মতো অকালকুষ্ম ছেলেকে আঁতুড়ঘরে জহর দিয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিলো। গর্ভধারিণী জননী, তার গায়ে তুমি হাত ভোলো? এত বড়ো তোমার স্পর্ধা। সাপের পাঁচ পা দেখেছ? জান না, আমরা পাড়ায় আছি-মেরে একেবারে হাড় মাস আলাদা করে দেব।

হাসান ক্রুদ্ধ নয়নে পড়শীদের দিকে তাকায়, তোমরা কে?

—আমরা? আমরা কে জান না বেশরম। আমরা তোমার মউত। মা-এর গায়ে হাত তোলার মজা এবার টের পাবে। আমরা কে এখনি দেখিয়ে দিচ্ছি। মোড়লের বাড়িতে আজ সভা ডাকা হচ্ছে। সেখানে তোমার বিচার হবে। আমরা কেউ আর তোমার সঙ্গে বসবাস করবো না। তোমার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে চড়িয়ে এ দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে তোমাকে। তোমার ছিটিয়ালি এতকাল আমরা সহ্য করেছি। কিন্তু মা-এর গায়ে হাত দিয়েছ যখন, তখন আর রেয়াত করবো না।

হাসান খুব শান্ত গলায় ভারিক্কি চালে বলে, কার সামনে দাঁড়িয়ে বেয়াদপ বেশরমের মতো এইসব আলতু ফালতু বকে যাচ্ছো, জান? চেন আমি কে?

—খুব চিনি। চিনবো না কেন, তুমি হচ্ছো—টিকিখরা ছিটিয়াল আবু অল হাসান।

-না।

সিংহের মতো গর্জে ওঠে হাসান, আমি খলিফা হারুন অল রসিদ, তামাম আরব দুনিয়ার একচ্ছত্র শাহেন শাহ। আমার পূর্বপুরুষ আব্বাস–পয়গম্বর মহম্মদের নিজের চাচা। তোমাদের এইসব বেতমিজ বদমাইশির সাজা কী ভাবে দিতে হয় তা একটু পরেই দেখবে। সবগুলোর মুখ আমি চিনে রাখলাম।দরবারে গিয়েই আহমদকে হুকুম দেবো। সে তোমাদের সবাইকে ধরে বেঁধে নিয়ে গিয়ে আমার প্রাসাদের সদর ফটকের সামনে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দেবে।

এবার প্রতিবেশীরা একেবারে চুপ হয়ে যায়। হাসানের মা-এর দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে, মাথাটা দেখছি একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। আমরা ভেবেছিলাম রাগের মাথায় আপনাকে মারধোর করছে। কিন্তু তা তো নয়। এ তো বদ্ধ উন্মাদের কাণ্ড। তা, কবে থেকে এরকম হলো?

মা ওদের সকলকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, দিব্যি আমার ভালো ছেলে, বোজ যেমন সন্ধ্যেবেলা মুসাফির মেহমান সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফেরে, পরশুদিনও সেইরকম একজনকে সে নিয়ে এসেছিলো। লোকটা মশুলের এক সওদাগর। তার সঙ্গে অনেক রাত অবধি খানাপিনা গল্প গুজব করলো। তারপর সকালবেলায় আমি ঘরে গিয়ে দেখি, দুজনের কেউই নাই। মুসাফির তো সকাল হলে চলে যাবে, সেই রকমই ওয়াদা করে মেহমানকে ঘরে আনা হয়, কিন্তু হাসান কোথায় গেলো? আমি ভাবলাম, লোকটাকে হয়তো কোনও সরাইখানায় পৌঁছে দিতে গেছে। অথবা, ভীষণ খেয়ালী ছেলে তো, কোথায় হয়তো একা একাই টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওসব নিয়ে আমি বেশ চিন্তাভাবনা করি না। কারণ,হাসানের ধাত আমার চেনা। কখন যে ওর কী খেয়াল চেপে ওঠে, কেউ বলতে পারে না। যাই হোক, সন্ধ্যাবেলায় ওর এই ঘরে এসে দেখি, বাছা আমার অকাতরে ঘুমোচ্ছে। এমন কিন্তু সাধারণতঃ হয় না। সকাল দুপুর যেখানে থাকুক, সন্ধ্যাবেলায় সে চাঙ্গা হয়ে একজন পরদেশীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে।

আমি ভাবলাম, হয়তো সারাদিন রোদে রোদে ঘুরে শরীরটা ওর ভালো নাই। তাই ঘুমে এলিয়ে পড়েছে। আমি আর ডাকলাম না। আজ সকালেও দুবার দেখে গেছি—একেবারে অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমি আর ঘুম ভাঙ্গালাম না। কিন্তু ভাঙ্গালেই বুঝি ভালো ছিলো।

দুপুর গড়িয়ে যাবার পর ওর ঘুম ভেঙ্গেছে। আর তার পর থেকেই এইসব আলতু ফালতু বকে যাচ্ছে। আমি যতই বলি তুই স্বপ্ন দেখেছিস। ওসব সত্যি না, সত্যি হতেপারে না, ততই সে ক্ষেপে আগুন হয়ে ওঠে। দোষের মধ্যে, আমি ওকে বোঝাতে গিয়েছিলাম, তুই আমার ছেলে আবু অল হাসান-খলিফা নোস। ব্যস, আর যাই কোথা, লাঠি নিয়ে তেড়ে এসে ঠাই ঠাই করে বসিয়ে দিলো আমার পিঠে! এখন আমার কী উপায় হবে—কী করবো?

প্রতিবেশীরা বলে, কাঁদবেন না, কেঁদে কী করবেন। নসিবে যা লেখা আছে তা তো খণ্ডানো যায় না, হাসানের মা। কিন্তু ছেলে আপনার বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। ওকে ঘরে রাখা নিরাপদ নয়। কখন হয়তো আপনাকে ছুরিই বসিয়ে দেবে, বলা তো যায় না কিছু! তাই বলছি, আর দেরি করবেন না, এক্ষুনি ওকে পাগলা-গারদে পাঠিয়ে দিন। সেখানে অনেক হেকিমবদ্যি আছে। তারা দাওয়াইপত্র দিয়ে সারিয়ে তুলতেও পারতে পারে। সারুক না সারুক, খুন জখমের ভয়তো থাকবে না, এবং চিকিৎসাও হবে। এখানে ঘরে থাকলে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা ছাড়া উপায় নাই। আর তাতে লাভ কী? চিকিৎসা পত্র তো কিছু হবে না।

মা কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোমরা যা ভালো বোঝ, করো।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো চল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

তখন প্রতিবেশীরা হাসানের হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে চলে পাগলা-গারদের দিকে। মজা দেখার জন্য রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। কেউ বা এসে দু’চারটে গোত্তা মারে, পাগল না হাতী! হাড়ে হাড়ে বজ্জাৎ-মাকে ধরে মারা হয়েছে? যাও এখন পাগলাগারদে—যাঁড়ের চামড়ার ফেটি দিয়ে ফাটিয়ে দেবে পিঠের খাল।

পাগলাগারদের হেকিম হাসানকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, মাকে মেরেছিস কেন?

হাসান চুপ করে থাকে।

—চুপ করে থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না, বল কেন মেরেছিস?

হেকিম ইশারা করতেই একজন নিগ্রো এগিয়ে আসে ষাঁড়ের চামড়ার ফেটি হাতে নিয়ে। সপাং সপাং করে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয় হাসানের পিঠে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে সে।

-বল, কেন মেরেছিস? তোমার পাগলামী আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি।

আবার কয়েক ঘা এসে পড়ে ওর পিঠে। এবার আর হাসান দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। লুটিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। গোঁ গোঁ করে গোঙাতে থাকে। কিন্তু নিগ্রোটা এলোপাতাড়ি, পিটিয়েই চলতে থাকে। সারা শরীর ফেটে দর দর করে রক্ত ঝরে। হেকিম বলে, যা এবার গারদে ভরে রাখ, পরে আবার চড়ানো যাবে।

অন্ধকার কয়েকখানার মধ্যে হাতে পায়ে বেড়ি পরানো অবস্থায় পড়ে থাকে মৃতপ্রায় হাসানের দেহটা। তিন দিন তিন রাত্রি আর চৈতন্য ফিরে আসে না। চার দিনের দিন সে চোখ মেলে তাকায়। সারা শরীর ব্যথায় টন টন করছে উঠে দাঁড়াবার পর্যন্ত শক্তি নাই।

প্রহরী এসে টানতে টানতে হাসানকে বাইরে নিয়ে আসে।

—চলো, তোমার মা এসেছে দেখা করতে!

ছেলের শরীরের হাল দেখে মা আর চোখের জল চাপতে পারে না। একি দশা হয়েছে বাবা, তোর?

হাসানও কাঁদে।

-মা, আমারই ভুল হয়েছিলো। স্বপ্নকেই আমি সত্যি বলে ভ্রম করেছিলাম। ঝোঁকের মাথায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে তোমাকে আঘাত করে অপরাধ করেছি। তুমি ক্ষমা করো, মা। এই দোজক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে চলো আমাকে। এখানে থাকলে ওরা আমাকে মারতে মারতেই মেরে ফেলে দেবে। আমি তো পাগল নই মা, তবে কেন, এখানে আমাকে রেখে যাবে? এখানে থাকবো না, হেকিমকে বলে আমার ছুটি করিয়ে বাড়ি নিয়ে চলো। কথা দিচ্ছি, আর কখনও তোমাকে কটু কথা বলবো না। তোমার অবাধ্য হবো না। তুমি আমাকে ঘরে নিয়ে চলো।

হাসানের মায়ের মুখে হাসি ফোটে। আনন্দে সে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুকে।

আল্লাহর দোয়াতেই তুই ভালো হয়ে গেছিস বাবা। চলো, বাড়ি চলো।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো একচল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

মা বললো, যা ঘটে গেছে ও-নিয়ে আর চিন্তা ভাবনা করিস নে, বাবা। আমার মনে হয় মশুলের ঐ সওদাগরটাই যত নাটের গুরু। ওর সঙ্গেই শয়তান এসেছিলো সে রাতে। সেই শয়তানটাই ভর করেছিলো তোর ঘাড়ে। যাই হোক, আল্লাহর করুণা, খুব বেশি মারাত্মক ক্ষতি সে করে যেতে পারেনি।

হাসান বলে, তুমি ঠিকই বলেছ মা, শয়তানই ভর করেছিলো আমার ওপর। যাই হোক, তুমি পাগলা-গারদের হেকিমকে বলো, সে যেন আমাকে ছেড়ে দেয়।

হাসানের মা হেকিম সাহেবকে কাছে গিয়ে বললো, আমার ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই, হেকিম সাহেব। আপনি ওকে ছেড়ে দিন।

হেকিম বললো, এটা তো ছেলেখেলা করার জায়গা না। নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় নিয়ে যেতে পার।

কিন্তু পরে আবার যদি এখানে রাখার জন্য কান্নাকাটি করো, তখন কিন্তু আমি আর জায়গা দেব না।

হাসানের মা বলে, তার দরকার হবে না, হেকিম সাহেব। ছেলে আমার ভালো হয়ে গেছে।

-বাঃ, তুমিই তো হেকিম হয়ে গেছ, দেখছি! তা হলে আর আমার দরকার কী? ঠিক আছে, নিয়ে যাও, আমি আর রাখবো না ওকে।

মা-এর হাত ধরে কোনও রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে বাড়ি ফিরে আসতে পারে। সারা শরীর ব্যথায় টন টন করছিলো।

মা গরম জল করে হাসানের মারের ক্ষতস্থানে সেঁক দিয়ে মলম লাগিয়ে দেয়। প্রায় একমাস ধরে ওষুধপত্র লাগাতে লাগাতে ঘা-গুলো একদিন শুকিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই ষাঁড়ের চামড়ার ফেটির মারের কালসিটে পড়া দাগগুলো আর মিললো না।

এই এক মাসের মধ্যে হাসান বাড়ির বাইরে বেরুতে পারেনি। সুতরাং মুসাফির মেহেমানও কেউ আসেনি ঘরে। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনও কালেই সে মেশে না, তাই একা একা দিন আর তার কাটতে চায় না। মা বললো, যা না, সাঁকোটার ওপর গিয়ে বোস, নিশ্চয়ই আল্লাহ আজ রাতের জন্য কাউকে জুটিয়ে দেবেন।

একমাস পরে আবার এই প্রথম শহর প্রত্যন্তের সেই সাঁকোটার উপর এসে বসে হাসান। সারাদিন শহরের কাজ সেরে সবাই এখন যে যার ঘরে ফিরে যেতে ব্যস্ত। শহরমুখী মানুষ খুবই কম। যারা আসে তাদের বেশির ভাগই এই বাগদাদ শহরের বাসিন্দা। ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে হয়তো গ্রামে গঞ্জে গিয়েছিলো। দিনান্তে তারাই আবার ফিরে আসছে শহরে নিজের ডেরায়। তবে বিদেশী মুসাফির যে একেবারেই আসেনা তা নয়। অনেকে হয়তো আরও দূর দেশের যাত্রী। পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে আসছে দেখে শহরে ঢুকে রাতের জন্য কোনও সরাইখানায় রাত কাটায়। আবার সকাল হলে বেরিয়ে পড়ে। এদেরই একজনকে হাসান তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। সে-রাতের মতো সে-ই হয় তার মেহমান-সাথী, তার কথা বলার মানুষ।

বিকেল থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে হাসান। কিন্তু নাঃ, একটি পরদেশী মুসাফিরকেও সে পায় না। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেতে থাকে।

এমন সময় সে দেখলো, সেই মশুলের সওদাগরটা আবার আসছে। হাসান পাশের শস্যক্ষেত্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। লোকটার সঙ্গে সে আর বাক্যালাপ করতে চায় না। তার জীবনের এই নিদারুণ বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ এই সওদাগরটা।

কিন্তু সওদাগর-ছদ্মবেশী খলিফা হাসানকে পাশ কাটিয়ে যান না। তিনি আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়ে হাসানের সঙ্গে মোলাকাত করার জন্যই এই পথে এসেছেন আজ।

-ও আবু অল হাসান ভাই।

খলিফা পাশে দাঁড়িয়ে হাসানকে সজাগ করতে চান। কিন্তু যে জেগে ঘুমাচ্ছে তাকে সজাগ করবে কে? হাসান কোনও সাড়াও দেয় না, মুখও ফেরায় না। এবার খলিফা ওর কাধে হাত রেখে ঈষৎ চাপ দিয়ে আবার ডাকেন, হাসান ভাইসাব?

হাসান ঝটকা মেরে কাঁধ থেকে খলিফার হাতখানা সরিয়ে দেয়। কিন্তু মুখে কথা বলে না বা ঘাড় ফেরায় না।

-এ কী রকম ব্যবহার হাসান ভাই, সে দিন রাতে এত গল্প কথা হলো। এত আদর যত্ন করলে আর এই ক’টা দিনের মধ্যেই সব ভুলে গেলে? একেবারে চিনতেই পারছো না?

হাসান মুখ না ফিরিয়েই বলে, চিনতে পারবো না কেন? খুব পাচ্ছি। হাড়ে হাড়ে পাচ্ছি। কিন্তু চিনতে আমি চাই না আপনাকে। আপনি যান।

-না, যাবো না, খলিফা হাসতে হাসতে বলেন, আজ রাতে আর একবার তোমার বাড়িতে আমি মেহমান হবো। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

হাসান ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, আপনার মতো বেহুদা মানুষের সঙ্গে আমার কোনও কথা থাকতে পারে না। আপনি আমাকে ক্ষান্তি দিন। পথ দেখুন।

খলিফা বলেন, কিন্তু তাতো হবে না, হাসান ভাই। আজকের রাতটা আমি তোমার বাড়িতেই কাটাবো।

—জুলুম নাকি?

-হ্যাঁ, জুলুমই। তবে মহব্বতের জুলুম। একটা রাতের আলাপেই তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

—ভালোবেসে ফেলেছেন? এই তার নমুনা? হাসান কামিজ তুলে তার পিঠের কালসিটে দাগগুলো দেখায় খলিফাঁকে।

-ইস, আহ-হা, এমন দশা কে করেছে তোমার?

–কে করেছে? বলতে লজ্জা করছে না আপনার? সেদিন আপনি শয়তানকে সঙ্গে করে আমার বাসায় ঢুকেছিলেন। সেই শয়তান আমার ঘাড়ে ভর করে বসেছিলো। আর তারই জন্যে পাড়ার লোকে আমাকে পাগল ঠাওরে পাগলা-গারদে ভরে দিয়ে এসেছিলো। এবং সেদিন পাগলা-গারদের জল্লাদ ষাঁড়ের চামড়ার ফেটি দিয়ে আমার পিঠের খাল খিচে নিয়েছিলো—এ সেই দাগ। আবার আপনি যেতে চাইছেন আমার বাড়ি! না না, দোহাই আপনার, আপনি আজ অন্য কোথাও যান। আপনি গেলে আবার শয়তান আমার ঘাড়ে ভর করবে। আবার সেই পাগলাগারদ, আবার সেই ষাঁড়ের চামড়ার চাবুকের ঘা —উ, না না, সে আমি ভাবতেও পারবো না। দোহাই আপনার, আপনি চলে যান। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারবো না।

খলিফা হাসানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, আমার জন্য তোমার এত তখলিফ হয়েছে—ভাবতে পারছি না, হাসান ভাই। যাই হোক, আমি তোমার যত দুঃখ তাপেরই কারণ হয়ে থাকি, আর একবার আমাকে নিয়ে চলো তোমার বাড়িতে। যে ক্ষতি সেদিন আমি করেছি তোমার, একটিবার আমাকে সুযোগ দাও, আমি তার খানিকটা পূরণ করে দেব।

হাসান বলে, ক্ষতিপূরণ কী দিয়ে করবেন? এ ক্ষতিপূরণের কোনও প্রশ্ন ওঠে না। আমার নসিবে যা লেখা ছিলো, তাই ঘটেছে। এ নিয়ে আপনার কাছে আমার কোনও নালিশ নাই। শুধু এই অনুরোধ, আপনি আর আমার বাসায় যাবেন না। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।

—এ সব তো রাগের কথা, ভাইসাব, না না, তুমি যদি রাগ করে থাক, তবে যে আমার দোজকেও জায়গা হবে না। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোেগ দাও। আমি কথা দিচ্ছি, এরপর আর কোনও দিন তোমাকে বিরক্ত করবো না। শুধু আজকের রাতটা নিয়ে চলো। তোমার পুরো কাহিনীটিও শুনবো। এবং আমার দ্বারা যা করা সম্ভব, তাও করবো।

খলিফা হাসানকে বুকের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে থাকে।

—আগে বলো, হ্যাঁ, নিয়ে যাবো। তবেই ছাড়বো, নইলে ছাড়বো না। হাসানের মনটা ঈষৎ নরম হয়। না করতে পারে না। বলে, ঠিক আছে, চলুন। বাসায় গিয়ে আপনাকে বলবো সেই অদ্ভুত কাহিনী।

বাড়িতে আসার পর কিন্তু হাসান একেবারে অন্য মানুষে হয়ে গেলো। আদর আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি রাখলো না। নানারকমের খানা একসঙ্গে বসে খেলো দুজনে। তারপর নিজে হাতে শরাবের পাত্র পূর্ণ করে খলিফার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, এবার আমার সেই কাহিনী শুনুন।

এই সময় রাত্রি ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো তেতাল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

হাসানের মুখ থেকে সব শোনার পর খলিফা বড়ো ব্যথিত হয়ে বলেন, সবই আমার দোষে ঘটেছে ভাইসাব। সেদিন যাবার সময় দরজাটা আমি বন্ধ করে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই ফাঁকে শয়তানটা ঢুকে পড়েছিলো তোমার ঘরে। যাক, যা হবার হয়ে গেছে। ও নিয়ে তো দুঃখ করে লাভ নাই। তবে আমি নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে করছি। কী করে এর খেসারত দেওয়া যায় তাই ভাবছি।

হাসান বলে ও-নিয়ে আপনি ভাববেন না। আর খেসারতের কথা তুলছেন কেন? পয়সা কড়ি দিয়ে এর ক্ষতি পূরণ করা যায়? এখন ওসব ভুলে যান তো, ভালো করে মৌজ করুন।

খলিফা জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, হাসান স্বপ্নের মধ্যে খলিফার প্রাসাদে যে মেয়েগুলোকে দেখেছিলে তার মধ্যে সব চেয়ে কোটি তোমার মনে ধরেছিলো?মানে কাকে দেখে তোমার খুব ভালো লেগেছিলো?

হাসান একটুক্ষণ চিন্তা করে বললো, চুমকী।

খলিফা আর কিছু বললেন না।

হাসানই বললো, মেয়েটির কী রূপ, কী যৌবন, আর কী সুন্দর মিষ্টি করে হাসতে জানে। এখনও ওর সেই হাসি হাসি মুখখানা আমার চোখের সামনে ভাসছে। এতটা বয়স হলো, শাদী করিনি কেন জানেন? কোনও মেয়েকেই বিবি করার যোগ্য মনে হয়নি। মায়ের অনুরোধ এড়াতে না পেরে অনেক মেয়েকেই দেখেছি, কিন্তু কেউই মনের ওপর ছাপ ফেলতে পারেনি।

কিন্তু চুমকীকে দেখা মাত্র আমি মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হলে কী হবে, সে তো অলীক স্বপ্ন মাত্র। তবে এও ঠিক শাদী যদি করতে হয় তবে ঐ মেয়েকেই। জানি না পাবো কিনা, কখনও যদি চুমকীর মতো কোনও মেয়ের দেখা পাই জীবনে, তবে যত টাকাই দেনমোহর দিতে হোক, দিয়ে তাকে আমার বিবি করে আনবো।

পেয়ালা যত নিঃশেষ হয় নেশাও ততো জমতে থাকে। এবং সেই সঙ্গে গাম্ভীর্যের মুখোশও খুলে পড়ে যায়। হৃদয়ের কামনা বাসনার একান্ত গোপন কথাও অবলীলাক্রমে বলতে থাকে হাসান।

-মনে যে বড়ো সাধ ছিলো, চুমকীকে নিয়ে ঘর বাঁধবো। সে হবে আমার মালিনী, আর আমি হবো তার মালঞ্চের মালাকার। কত সুন্দর সুখের হতে পারতো, ভাবুন তো?

খলিফা ঘাড় নাড়েন, তা ঠিক। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার গরমিল আছে বলেই মানুষ অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে উল্কার মতো ছুটে চলে।

নেশায় হাসানের চোখ ছোটো হয়ে আসে। কথা জড়িয়ে যেতে থাকে। এই উপযুক্ত সময়। হাসানের শরাবের পেয়ালায় এক ডেলা আফিঙ ফেলে দেন খলিফা!

পেয়ালাটা এক চুমুকে শেষ করে দেয় হাসান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সে অসাড় হয়ে নেতিয়ে পড়ে যায় গালিচায়।

খলিফার নফররা ইশারার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলো বাড়ির পাশে। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে হাসানকে কাঁধে তুলে তারা রাস্তায় নেমে পড়ে। এবার খলিফা বেরুবার আগে ঘরের দরজাটা

ভেজিয়ে দেন।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো চুয়াল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

ঠিক আগের দিনের মতো হাসানের সাজ-পোশাক খুলে নিয়ে খলিফার নৈশবাস পরানো হয়। তারপর খলিফার নিজস্ব কামরায় পাল-শয্যায় শুইয়ে দেয় নফররা।

খলিফা এর আগের দিন প্রাসাদের সকলকে ডেকে ডেকে যে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন আবার সেই নির্দেশ দেন।

-খবরদার, কোনও ভাবেই যেন সে বুঝতে না পারে, সে খলিফা নয়।

জাফর এবং মাসুরুরকেও যথাযোগ্য তালিম দেন তিনি।

—সকাল হতেই তোরা সব হাসানের পালঙ্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াবি। তার ঘুম ভাঙ্গলেই যথাযোগ্য সম্মান মর্যাদায় তাকে সালাম কুর্নিশ করবি। মোটকথা মনে করবি, সেই তোদের খলিফা।

পরদিন ভোরে মাসরুর খলিফাঁকে জাগিয়ে দিয়েই হাসানের শয্যাপাশ্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার অনেক আগে থেকেই সে-ঘরে হাজির ছিলো প্রাসাদের মেয়েরা। বিশেষ করে যে মেয়েগুলো খানাপিনা করিয়েছিলো সেই মেয়েগুলো দাঁড়িয়েছিলো হাসানের একেবারে চোখের কে সামনে। চোখ খুলতেই যাতে হাসান ওদের সকলকে এক জায়গায় দেখতে পায়। এদের সবার পুরোভাগে দাঁড় করানো হয়েছিলো চুমকীকে।

ওপাশে মঞ্চের ওপর নানারকম তারের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে আছে আরও একদল সুন্দরী মেয়ে। চুমকী একটা রুমালে খানিকটা ভিনিগার ভিজিয়ে হাসানের নাকে ধরে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসান তিনবার হেঁচে ওঠে। সেই সঙ্গে তার আফিঙের নেশাটা কেটে জল হয়ে যায়।

এবং তখুনি, মেয়েরা বাজনা বাজাতে শুরু করে। বাজনার সুমধুর আওয়াজে খলিফার ঘুম ভাঙ্গানো হয়—প্রতিদিন।

হাসান চোখ মেলে তাকায়। এবং খলিফার শয়নকক্ষের সেই জাঁকজমক প্রত্যক্ষ করে আতঙ্কে একবার চিৎকার করেই সে থেমে যায়।

সেই সোনার পালঙ্ক, সেই মখমলের শ্যা, সেই আটাশটি সুন্দরী কন্যা, সেই নর্তকী নটীরা—অবিকল সব আবার তার দৃষ্টিতে স্বচ্ছ হয়ে ফুটে ওঠে।

সারা ঘরময় এক অসহনীয় নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে। হাসান শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠে। সর্বনাশ। আবার তাকে পাগলা গারদে ভরবে। আবার সেই নিগ্রো জহ্বাদের চামড়ার চাবুকের কশাঘাত।

-উফ, না না না, এ হবে না। আমাকে মুক্তি দাও, বাঁচাও বাঁচাও।

তার চিৎকার—আর্তনাদ প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে থাকে।

-ওরে শয়তান, মশুলের সওদাগর, তোর ছলনায় আবার আমি ভুললাম? একবারেও শিক্ষা হলো না আমার? হায় হায়, একি সর্বনাশ হলো। আমি তার কী ক্ষতি করেছিলাম? আল্লাহ যেন মশুলের সব সওদাগরকে আগুনে পুড়িয়ে মারেন। সারা মশুল একদিন ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়ে যেন, আল্লাহ তোমার দরবারে এই আমার একমাত্র আর্জি।

হাসান পরপর অনেক বার চোখ দুটো খুললো এবং বন্ধ করলো। কিন্তু না, সে স্বপ্ন দেখছেনা বা ঘুমিয়েও নাই। আবার সে চিৎকার করে ওঠে, ওহে হাসান, আবার ঘুমিয়ে পড়—সে ঘুম যেন তোমার আর না ভাঙ্গে। শয়তানটা তোমার ঘাড়ে ভর করে আছে। সে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ তুমি ঘুমিয়েই থাক।

এই বলে সে আবার দু’হাতে মুখ ঢেকে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোয়।

খলিফা পর্দার আড়ালে বসে হাসানের এই হা-হুতাশ দেখতে থাকলেন।

বেচারা আবু অল হাসান কিন্তু আদৌ ঘুমাতে পারে না। চুমকী ওর শয্যার এক পাশে বসে মধুর করে ডাকে, ধর্মাবতার, নামাজের সময় হয়ে এলো, এবার উঠতে আজ্ঞা হোক।

হাসান মুখের ঢাকা না খুলেই আবার চেঁচিয়ে ওঠে, আল্লাহ এর সাজা দেবেন, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা শয়তানীরা।

কিন্তু চুমকী নিরস্ত হয় না। বলতে থাকে, জাঁহাপনা বোধ করি গত রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে থাকবেন। আমি তো শয়তান নই, ধর্মাবতার। আমার নাম চুমকী। আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে তুলুন, এই প্রার্থনা করি। আমাকে তো আপনি নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন জাঁহাপনা, আমি সেই চুমকী।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো পঁয়তাল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে।

আবু অল হাসান হাতের ঢাকা সরিয়ে চোখ মেলে তাকায়। তার সামনে চুমকী—হ্যাঁ সেই চুমকীই তো বসে আছে। আর ওরা যারা ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তারাও সকলে তার চেনা। শোভা, চুনী পান্না, আরও অনেকে।

হাসান দুহাত দিয়ে চোখ দুটো, রগড়ায়, কে বাবা, তোমরা? আর আমিই বা কে?

মেয়েগুলো সমস্বরে তাদের নিজের নাম উচ্চারণ করে। তারপর এক সঙ্গে সবাই বলে, আপনি আমাদের প্রভু-ধর্মাবতার খলিফা হারুন অল রসিদ, তামাম আরব দুনিয়ার মালিক।

কী বললে? আমি সেই ছিটিয়াল আবু অল হাসান নই?

মেয়েরা এক সঙ্গে বলে ওঠে, আমাদের ধর্মাবতারের ওপর দুষ্ট শয়তান ভর করেছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, সে খতম হোক। আপনি আবু অল হাসান নন–আমাদের পরম পিতা।

হাসান বলে, ঠিক আছে, একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক। এই চুমকী—তুমি তো চুমকী? এগিয়ে এগিয়ে এসে আমার এই কানটা কামড়ে ধর দেখি।

চুমকী হাসানের কানের কাছে মুখ এনে এইসা জোরে এক কামড় বসিয়ে দেয় যে, হাসান যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠে বলে, আঃ ছাড় ছাড়। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি, আমি তোমাদের ধর্মাবতার খলিফা হারুন অল রসিদ।

এই সময়ে বাদ্যযন্ত্রে নাচের বোল বেজে ওঠে। এবং মেয়েরা রক্ত নাচানো গান গাইতে শুরু করে।

হাসান আর সহ্য করতে পারে না। সেই মখমলের কুসুমাদপি কোমল শয্যায় তার দেহটা পালঙ্কের এ পাশ থেকে ও পাশ অবধি গড়াগড়ি খেতে থাকে। এমন ভাবে সে হাত পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করে যে, মাথার টুপীটা ছিটকে গিয়ে মেঝের গালিচার ওপর পড়ে। এরপর হাসান তার

অঙ্গের মহামূল্যবান সাজপোশাক ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে।

হঠাৎ সে শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তখন, বলতে গেলে, সে একেবারে উলঙ্গ। পাগলের মতো ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে গালিচার ওপর। সামনে যে আটাশটি পরমাসুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়েছিলো তারা হাসানের প্রায় উলঙ্গ শরীরটা না দেখার ভান করে পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আড়-চোখে দেখতে থাকে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভূক্ষেপ নাই আবু অল হাসানের। এলো পাতাড়ী নেচে চলে। এবং হো হো হা হা হি হি করে হাসির বন্যায় হাবুডুবু খায়।

খলিফা আর পর্দার আড়ালে চুপ করে থাকতে পারেন না। হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরে যাওয়ার দাখিল। পর্দা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি।

—আবু অল হাসান, আমার ভাই, তুমি আমার মরা মুখ দেখতে চাও। এই তোমার সামনে হাজির হয়েছি আমি মশুলের সওদাগর। এবার এস, তোমার প্রতিশোধ নেবার আছে নাও, আমি সানন্দে মাথা পেতে দিচ্ছি।

মুহূর্তের মধ্যে হাসানের তাণ্ডব নৃত্য বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েরা নিজেদের গুটিয়ে নেয়। একপাশে। সারা ঘরে নেমে আসে গভীর নিস্তব্ধতা। হাসান ঘাড় ফিরিয়ে খলিফাঁকে দেখে চিনতে পারে—এই তো সেই মশুলের সওদাগরটা। সঙ্গে সঙ্গে গত রাতের সব ঘটনা তার চোখের সামনে ছবির মতো ফুটে ওঠে। হাসান গর্জে ওঠে, হুম, তা হলে এসব তোমারই কারসাজী। এতক্ষণে বুঝলাম। দাঁড়াও, হাতে যখন একবার পেয়েছি, কী করে শিক্ষা দিতে হয় দেখিয়ে দিচ্ছি। বার বার ঘুঘু তুমি ধান খেয়ে যাও, এবার—এবার কোথায় যাবে?

খলিফা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।

—তুমি আমার চির-জীবনের সাথী—আমার ভাই—আবু আল হাসান। আমার পবিত্র পূর্বপুরুষদের নামে কসম খেয়ে বলছি, তোমার মনের সব কামনা বাসনা, সাধ আহ্লাদ আমি পূরণ করবো। আমার খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য তোমাকে অনেক দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। ভাই বলে যখন বুকে টেনে নিয়েছি, আশা করি সেসব তুমি অতীতের মিথ্যা দুঃস্বপ্ন বলে ভুলে যাবে ভাই। আজ থেকে তুমি আমার পরিবারের পরমাত্মীয় হয়ে এই প্রাসাদেই থাকবে, হাসান।

এই বলে খলিফা হাসানকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন।

খলিফার নির্দেশে মেয়েরা নতুন জমকালো সাজ-পোশাক এনে হাসানকে পরালো। খলিফা বললেন, বাঃ সুন্দর মানিয়েছে। আচ্ছা এখন বলল, হাসান, কি তোমার অভিপ্রায়। কী পেলে তুমি খুশি হও। আমি তোমাকে সব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ভাই।বল। কোনও দ্বিধা সঙ্কোচ করো না।

হাসান আভূমি আনত হয়ে কুর্ণিশ করে বলে, আমি সারাজীবন জাঁহাপনার ছায়ানুগামী এক বান্দা হয়ে থাকতে চাই, ধর্মাবতার।

হাসানের রুচি প্রকৃতি সাধারণ থেকে অনেক উঁচু পর্দায় বাঁধা। খলিফা মুগ্ধ হয়ে বললেন, এই ধরনের নিঃস্বার্থ মহব্বত দোস্তী আমার খুব পছন্দ, হাসান। আজ থেকে তুমি যে শুধু আমার ভাই এবং এক গেলাসের ইয়ার হলে তাই নয়, প্রাসাদের যত্রতত্র, যখন তখন তোমার অবাধ গতিবিধি রইলো। এর জন্য আর কোনও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। রাত দু’টোতেও যদি তুমি আমার হারেমের কোনও কামরায় ঢুকতে চাও তাতেও কেউ বাধা দেবে না। দরবার চলাকালেও দরবার-মহলে তুমি ইচ্ছে করলেই ঢুকতে বা বেরুতে পারবে। তার জন্যও কোনও অনুমতির দরকার হবে না। আমার চাচার মেয়ে—আমার পেয়ারের খাস বেগম জুবেদার মহলে অন্য কারো প্রবেশ অধিকার নাই। কিন্তু তাকেও আমি জানিয়ে দেব, এখন থেকে তার মহলে আমি যখন থাকবো, অবাধে তুমি সেখানে যেতে পারবে, এবং তার সঙ্গে আলাপ-সালাপ করতে পারবে। তোমার সামনে সে বোরখা পরে পর্দানশিন হয়ে চলবে না।

শুধু এই নয়, হাসানের বসবাসের জন্য সুন্দর সাজানো গোছানো প্রাসাদের একটি নিভৃত মহল নির্দিষ্ট করে দিলেন খলিফা। এবং তার অবসর ভাতার প্রথম কিস্তি বাবদ দশসহস্র স্বর্ণমুদ্রা বরাদ্দ করে দিয়ে বললেন, তুমি আমার প্রাসাদে থাকবে আমার সমান মর্যাদায়। সুতরাং আহার বিহার বিন্যাস ব্যসন-কোনও ব্যাপারেই যাতে তোমার কোনও রকম অভাব অসুবিধা না ঘটে,

সে সব দেখার দায় আমার রইলো।

এরপর খলিফা দরবারে যাওয়ার উদ্যোগ করতে থাকলেন।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো সাতচল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

আবু অল হাসান মা-র কাছে ছুটে যায়।

—মা, মা, মাগো, আজ তোমাকে কী মজার কথা শোনাবো!

হাসানের আনন্দ আজ ধরে না।

মা অবাক হয়। ভাবে, এ আবার ছেলের কী খেয়াল। হাসান বলতে থাকে, জান মা, যাকে আমরা মশুলের সওদাগর ভেবেছিলাম, আসলে তিনি স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ। সওদাগরের ছদ্মবেশে আমার ঘরে এসেছিলেন। তিনিই আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রাসাদে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরই হুকুমে প্রাসাদের তাবৎনারী পুরুষ আমাকে খলিফা বলে সালাম কুর্ণিশ করেছিলো। উজির জাফর আর মাসরুর আমাকে দরবারে নিয়ে গিয়ে মহামান্য ধর্মাবতারের মসনদে খলিফার মর্যাদায় বসিয়ে শাসনদণ্ড হাতে তুলে দিয়েছিলো সেদিন। তোমরা আমাকে সবাই মিলে পাগল বলে পাগলা গারদে দিয়ে এলে। কিন্তু দেখ আমি তো একটাও মিথ্যে বলিনি, মা। খলিফার খেয়াল হয়েছিলো তাই তিনি আমাকে একদিন কা সুলতান বানিয়ে আড়ালে থেকে মজা লুটেছেন। যাই হোক, পাগলাগারদে আমার মারধোর খাওয়ার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও আহত হয়েছেন। তবে দুঃখ করো না মা—দুঃখের দিন আমাদের শেষ হয়ে গেছে। এবার সুলতানের অনুগ্রহে আমরা দারুণ আনন্দ বিলাসের মধ্যে দিন কাটাবো–সে ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছেন। আমার জন্য তিনি প্রাসাদের একটা মহল বন্দোবস্ত করেছেন। আজ থেকে আমি প্রাসাদেই থাকবো। তুমি কোন চিন্তা করো না মা, প্রত্যেকদিন এসে তোমাকে আমি দেখে যাবো এখানে।

এই বলে মার কাছে বিদায় নিয়ে হাসান আবার প্রাসাদে ফিরে আসে।

হাসানের প্রতি খলিফার এই বদান্যতা এবং বন্ধুত্বের সমাচার স্বল্প সময়ের মধ্যে সারা সলতানিয়তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। এমন কি আশে পাশের মুলুকেও এই মজাদার মুখরোচক কাহিনী সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকলো।

এর পর খলিফার সহৃদয় সাহচর্য এবং নির্মল হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে হাসানের দিনগুলি মধুর হয়ে উঠতে থাকে। খলিফা আর তাকে নিয়ে উগ্র রসিকতায় মাতেন না কখনও। বলতে গেলে, হাসানই তখন তাঁর দিবারাত্রের একমাত্র সঙ্গী হয়ে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। জুবেদার মহলে, সেখানে খলিফার কোনও ইয়ার দোস্ত কারুরই প্রবেশ অধিকার নাই, হাসানকে সঙ্গে নিয়ে খলিফা সেখানে নির্বিবাদে ঢুকে পড়েন। জুবেদাও আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি রাখে না।

জুবেদা খেয়াল করে, এই হাসান ছেলেটি যখনই খলিফার সঙ্গে এ মহলে আসে, তার একান্ত অনুচর চুমকীবাদীর দিকেই সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সর্বক্ষণ। আর চুমকীও এত চঞ্চল ছটফটে মেয়ে—ঠায় বসে থাকে, এক নড়ে না। জুবেদার ভুরু কুঁচকে ওঠে, ব্যাপারটা কী, একবার দেখতে হয়।

একদিন জুবেদা খলিফাঁকে একান্তে পেয়ে বলে, ধর্মাবতার, একটা জিনিস আপনি লক্ষ্য করেছেন? আমার মনে হয়, চুমকী আর হাসান প্রেমে পড়েছে। আচ্ছা, ওদের দুটির শাদী দিয়ে দিলে হয় না।

খলিফা বলেন, অসম্ভব কিছুই না। চুমকী পরমাসুন্দরী ডাগর মেয়ে। আর হাসান সেও তো সুঠামসুন্দর স্বাস্থ্যবান নওজোয়ান। মহব্বত হতেই পারে—স্বাভাবিক। এবং আমার বিবেচনায়, এ শাদী দোষেরও কিছু হবে না। কিছুদিন ধরে আমি তোমাকে কথাটা বলবো বলবো করছিলাম, কিন্তু ঠিক মতো সময় পরিবেশ পাচ্ছিলাম না।

যাক, আজ কথাটা তুলে ভালোই করেছ। আমার মনে হয়, আর দেরি না করে শুভ কাজ শীঘ্র সমাধা করাই শ্রেয়।

জুবেদা বললো, সে তো একশো বার। কিন্তু চুমকীকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি। আপনিও হাসানের মতামতটা একবার যাচাই করে দেখে নিন! যদিও জানি, ওরা পা বাড়িয়েই আছে, তবু এ কর্তব্য করা আমাদের উচিত।

খলিফা বলেন, বাঃ, চমৎকার বলেছ তো, চাচার মেয়ে।

তখুনি চুমকী আর হাসানকে ডাকা হলো সেখানে। জুবেদা চুমকীকে জিজ্ঞেস করে, কীরে, হাসানকে তোর পছন্দ? শাদী করবি ওকে?

মুহূর্তে চুমকীর মুখ আরক্ত হয়ে ওঠে। লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারে না। একটু পরে সে জুবেদার পা দুখানা জড়িয়ে ধরে।

জুবেদার হাসতে হাসতে বলেন, ধর্মাবতার আমার চুমকী রাজি। এবার আপনি আপনার হাসানকে জিজ্ঞেস করুন।

আবু হাসান বলে, ধর্মাবতার আপনার মহানুভবতার সায়রে আমি নিয়ত অমৃত সুধা পান করছি। কিন্তু এই পরমাসুন্দরী কন্যাকে আমার জীবনসঙ্গিনী করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার আগে, আমাদের মহামান্য মালকিন বেগমসাহেবা অনুমতি করলে আমি তাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।

জুবেদা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেন, প্রশ্নটা কি শুনি।

—আমি জানতে চাই, আমার রুচি প্রকৃতির সঙ্গে তার মিল হবে কিনা। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নাই, মদ আমার বড়ো প্রিয়, মদে আমি আসক্ত। মাংস খেতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। সুমধুর সঙ্গীত এবং কাব্যালোচনা করে পরমানন্দে দিন কাটাতে চাই। যদি চুমকীও এসব পছন্দ করে এবং সহধর্মিনী হয়ে এই বিলাস ব্যসনের সমান ভাগীদার হতে পারে, তবে তাকে গ্রহণ করতে আমার কোনও অমত নাই। কিন্তু এসব যদি সে পছন্দ না করে তবে, আমার এক কথা, সারাজীবন আমি চিরকুমার হয়েই কাটাবো।

জুবেদা খিলখিল করে হেসে চুমকীর দিকে তাকান, কী রে, রাজি? দেখ পারবি তো সামাল দিতে?

চুমকী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

খলিফা তখনি কাজী আর সাক্ষীদের ডেকে পাঠালেন। শাদীনামা লিখে দিলো কাজী। সাক্ষীরা সইসাবুদ করে দিয়ে বিদায় নিলো।

এরপর একমাস ধরে প্রাসাদে আনন্দ উৎসবের বন্যা বয়ে যেতে থাকলো। নাচ গান হৈ-হল্লায় মেতে উঠলো প্রাসাদ-পুরবাসীরা। খানা-পিনার মহোৎসব চলতে থাকলো নিত্য। সরাবের নেশায় মৌজ করে গাথা কাব্য সঙ্গীতে মশগুল হয়ে রইলো চুমকী আর হাসান। দু’হাতে দেদার খরচা করে ইয়ার বন্ধুদের তুষ্ট করতে লাগলো ওরা। প্রতিদিন পোলাও বিরিয়ানী মোরগ মোসাল্লাম, কাবাব কোর্মা কোপ্তা প্রভৃতি নানাবিধ দামী দামী খানা এবং মেঠাইমণ্ডা এবং দুষ্প্রাপ্য ফলমূল দিয়ে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করে চললো।

এইভাবে একদিন ওরা দেখলো, সব সঞ্চিত বিলাস সামগ্রী এবং অর্থ নিঃশেষ হয়ে গেছে। এদিকে খলিফাও হুকুমতের কাজে নানা ব্যস্ততার মধ্যে থাকার দরুন যথাসময়ে ভাতাও পাঠাতে ভুলে গেছেন।

এইভাবে একসময় ওরা এমন এক দীনদশায় উপনীত হলো, যেদিন ওরা আর পাওনাদারদের সামান্যতম পাওনার টাকাও মেটাতে পারে না।

চুমকী বা হাসান কেউই লজ্জায় জুবেদা অথবা খলিফার কাছে তাদের অভাবের কথা জানাতে পারে না।

হাসান বলে, আমরা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে সব পয়সা-কড়ি দু’হাতে উড়িয়ে দিলাম। এটা কিন্তু মোটেই উচিত কাজ হয়নি চুমকী। এখন কোনও ক্রমেই পয়সার জন্য আমি খলিফার কাছে হাত পাততে পারবো না। এবং তুমি যে জুবেদা বেগমের কাছে বলবে, তাও আমি পছন্দ করতে পারছি না।

চুমকী বলে, কিন্তু এইভাবে কতদিন চলবে? খলিফা ভীষণ খেয়ালী মানুষ। তাছাড়া এখন তিনি দরবারে জটিল কাজে ফেঁসে আছেন। এ অবস্থায় ভাতার টাকা কবে দেবার হুকুম তিনি দেবেন, কে জানে।

হাসান বলে, আমার মাথায় একটা ফন্দী এসেছে।

-কী ফন্দী।

হাসান বলে, তোমাকে খানিকটা সাহায্য করতে হবে।

—একশো বার করবো, কিন্তু কারো কাছে কর্জ বা ভিক্ষে করতে বলো না। ওটি পিরবো না।

—তোমার কী করে মনে হলো চুমকী, তোমাকে আমি অত ছোটো হীন কাজে পাঠাবো। এই সমস্যা কাটাবার একটা সুন্দর মতলব আমি এঁটেছি।

-কী মতলব, বলো না গো।

চুমকী বায়না ধরে।

হাসান বলে, আমরা মরে যাবো।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো-আটচল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

চুমকী ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে, মরে যাবো? মানে? না, না, খোদা কসম, আমি মরতে-টরতে পারবো না। সে তুমি মরতে হয়, একাই মরগে। ওরে বাবা, না না, আমি মরতে পারবো না। আমি কিছুতেই মরতে পারবো না।

হাসান রাগ করে না। বরং মৃদু হাসতে হাসতে বলে, সারাদিন আমি চিরকুমার থাকতে চেয়েছিলাম কেন, জান? রুচি প্রকৃতি এবং বুদ্ধিতে সমতুল না হলে কোনও মেয়েকে আমি জীবন-সঙ্গিনী করবো না, এই ছিলো আমার পণ। তা তুমি যখন জানালে, আমার সঙ্গে সব দিক থেকেই তোমার মিল হবে, তখনই আমি এ শাদীতে সায় দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের সঙ্গে তোমার বিশেষ কোনও ফারাক নাই। আমার পুরো কথাটা না শুনেই তুমি লাফাতে ঝাপাতে শুরু করলে; এ কী ব্যাপার? তোমার কী করে ধারণা হলো, আমরা এই একটা অতি নগণ্য কারণে মৃত্যু বরণ করবো। গোড়াতেই তো বলেছিলাম, সমস্যাটার সুরাহা করার জন্য একটা ফন্দী এঁটেছি, কী সে ফন্দী, তা আগে ভালো করে শোনো! তা না, তার আগেই তুমি তোমার রায় দিয়ে দিলে? আরে, আমি কী তোমাকে সত্যি সত্যিই মরতে বলতে পারি? মরার ঢং করতে হবে। বুঝলে, মরার অভিনয় করে পড়ে থাকতে হবে। ব্যস, আর দেখতে হবে না, তা হলেই দেখবে মোহরে ভরে যাবে ঘর।

চুমকী ভুরু কুঁচকায়। কিছুতেই সে আঁচ করতে পারে না। বলে, কী করে?

হাসান গম্ভীর হয়ে বলে, খুব ভালো করে মন দিয়ে শোনো। আমি মরে পড়ে থাকবো। তুমি একখানা কালো কাপড় দিয়ে আমার সারা শরীর ঢেকে দেবে। এবং ঘরের ঠিক মাঝখানে আমাকে শুইয়ে রাখবে। আমার মুখ ঢাকা দেবে আমার মাথার টুপী দিয়ে। মনে থাকে যেন, মৃতদেহের পা পবিত্র কাবাহর দিকে করে রাখতে হয়। এর পর তুমি তোমার ঢং-এ মরণ-কাদা কঁদতে কাঁদতে কপাল বুক চাপড়াবে, মাথার চুল, অঙ্গের সাজ-পোশাক ছিড়তে উদ্যত হবে। তাই বলে সত্যি সত্যিই কিন্তু ছিঁড়ো না তোমার চুল।

তোমার কান্নাকাটির আওয়াজে সবাই ছুটে এসে সমবেদনা জানাবে। এবং তারাই জুবেদা বেগমকে খবর দেবে। তুমিও একটুক্ষণের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে পাগলিনীর মতো ছুটে যাবে তার কাছে। জুবেদাকে দেখেই তুমি আছাড় খেয়ে পড়ে যাবে তার পায়ের ওপর—ব্যস, তার পরেই মূৰ্ছা।

মনে থাকে যেন, যতক্ষণ না তোমার চোখ মুখ গোলাপ জলের ঝাপটা মেরে ধুইয়ে দিচ্ছে ততক্ষণ দাঁত-কপাটি খুলবে না কিছুতেই।

অনেকক্ষণ পরে তুমি যখন একটু সুস্থ হবে সেই সময় জুবেদা বেগম তোমাকে সমবেদনা সান্ত্বনা দিয়ে বলবেন, শোক করো না। মানুষ চিরকাল তো বেঁচে থাকে না। কবে কার দিন ফুরাবে, কে বলতে পারে।

এর পর দেখবে, আমাদের ঘরে টাকার পাহাড় জমে উঠবে!

চুমকী বলে, বাঃ চমৎকার! তা সত্যিই তো, মানুষের মৃত্যুর কথা কিছুতেই বলা যায় না। যে-কোনো কারণেই যে-কোনও মানুষের যখন তখন মৃত্যু হতে পারে।ঠিক আছে। তুমি তা হলে মর, আমি সব ব্যবস্থা করছি।

চুমকী হাসানকেন্যাংটো করে কার্পেটের ওপর শোয়ালো। পা দুখানা যাতে মক্কার দিকে থাকে তাও লক্ষ্য রাখলো। মুখখানা ঢেকে দিলো মাথার টুপি দিয়ে।

তারপর কপাল বুক চাপড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে সরা প্রাসাদে রটে গেলো হাসান মারা গেছে। চুমকী চুল উস্কোখুস্কো করে আলুথালু বেশে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো জুবেদার কাছে। জুবেদা তাকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর, করে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন।

কিন্তু চুমকীর কান্না থামে না, আমার আর বেঁচে থাকার সাধ নেই মালকিন, এ জীবন আমি আর রাখবো না।

-ছিঃ, ওকথা বলতে নাই। স্বামী কারো চিরকাল থাকে না। তোমার এই ভরা যৌবন, জীবনের কোনও স্বাদ আহ্লাদই পূরণ হয়নি, এখনই মরবে কেন?

কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত করে না চুমকী। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদে আর কপাল বুক চাপড়ায়।

চুমকীর দুঃখে হারেমের সব মেয়েরই চোখ জলে ভরে যায়। বেগম জুবেদা তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দশ হাজার দিনারের একটা তোড়া চুমকীর হাতে দিয়ে বলে, যাও, স্বামীর শেষ কাজটুকু ভালো করে সমাধা কর গে। তার আত্মার যেন মঙ্গল হয়।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো ঊনপঞ্চাশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

মোহরের থলেটা বগলদাবা করে চুমকী ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাসানকে টেনে তোলে, এই ওঠ ওঠ, বাজিমাত করে দিয়ে এসেছি, এই দ্যাখো।

হাসান থলেটা বুকে জড়িয়ে আনন্দের চোটে চিৎকার করে উঠতে যায় সঙ্গে সঙ্গে চুমকী ওর মুখে পাত পা চাপা দিয়ে বলে, চুপ। এক্কেবারে কোন আওয়াজ তুলবে না। ওরা জানতে পারলে সব মাটি হয়ে যাবে।

হাসান চুমকীকে একটা চুমু খেয়ে বলে, কে বলে তোমার বুদ্ধি কম। এই তো দিব্যি মাথাটা খুলে গেছে, দেখছি।

মোহরগুলো মেঝের ওপর ঢেলে স্তুপাকারে করে ফেলে হাসান। আজ তার কী আনন্দ। উফ কত টাকা! কী মজা ফুর্তিই না করা যাবে!

এই বলে কোমরে আর থুতনিতে হাত রেখে পাছা দুলিয়ে মেয়েমানুষের মতো নাচতে থাকে হাসান। হাসির তোড় আর চেপে রাখতে পারে না চুমকী। মুখের মধ্যে রুমাল গুঁজে দেয়। গাল দুটো টুকটুকে রাঙা হয়ে ওঠে। চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে।

হাসান কিন্তু একটানা নাচতেই থাকে। চুমকী বলে, তুমি একটা কী! লজ্জা শরমের বালাই নাই?

হাসান অবাক হয়, কেন? লজ্জা শরম হবে কেন?

একখানা মোহর তুলে চুমকী হাসানের নিবিবন্ধ তাক করে ছুঁড়ে মারে, বে-শরম কাহিকা। হাসান সশব্দে হেসে ওঠে, অ, এই কথা। তা ঘরে তো তুমি ছাড়া আর কেউ নাই, বিবিজান।

-তা হোক। তুমি ইজার পর।

এই কথায় হাসান ভীষণ উত্তেজিত বোধ করে। ছুটে গিয়ে সে চুমকীর পলকা দেহখানা দু’হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে ধরে গভীর আশ্লেষে এক দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দেয় ওর পাকা আঙুরের মতো টসটসে অধরে। চুমকীও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে থাকে হাসানের গলাটা।

হাসান অনেক অনেকক্ষণ ধরে আদর সোহাগ করতে থাকে চুমকীকে। চুমকীও এলিয়ে পড়ে থাকার পাত্রী নয়। সে যেমন নিতে জানে, তেমনি দিতে জানে উজাড় করে। হাসান এক সময় বলে, কিন্তু প্রিয়তমা, এখানেই তো খেলার ইতি নয়। এবার তোমার পালা। তোমাকে মরতে হবে।

চুমকী বীরাঙ্গনার মতো দৃপ্ত কণ্ঠে বলে, ওহে মৃত্যু, তুমি মোরে কী দেখাও ভয়। ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়?

চুমকীর মুখে হাত চাপা দেয় হাসান, আস্তে। শুনতে পাবে।

চুমকী জিভ কাটে। হাসান বলে, শোনো,তুমি জুবেদার কাছ থেকে যেমন দশ হাজার দিনার বাগিয়ে আনলে আমিও তেমনি, দেখে নিও, খলিফাঁকে বোকা বানিয়ে কেমন মালকড়ি বের করে নিয়ে আসি। খলিফা ভাবেন, তিনিই সবচেয়ে চালাক এ দুনিয়ার। কিন্তু দেখো, চালাকেরও বাবা আছে, তা আমি ধর্মাবতারকে এবার দেখিয়ে দিচ্ছি।

হাসান বলে, আচ্ছা আর আদর সোহাগ নিয়ে থাকলে চলবে না। তুমি এখন মর।

চুমকীকে একইভাবে বিবস্ত্র করে হাসান ওকে ঘরের ঠিক মাঝখানে মক্কার দিকে পা করে শুইয়ে কালো একখানা কাপড়ে ঢেকে দিলো। বললো, খুব সাবধানে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবে, ছাড়বে। যেন কেউ বুঝতে না পারে, বুঝলে?

মাথার টুপি খুলে ফেলে হাসান। চুল উস্কোখুস্কো করে। চোখে পেঁয়াজের রস লাগায়। গভীর দুঃখে কপাল বুক চাপড়াতে চাপড়াতে সে ছুটে যায় খলিফার হারুন অল রসিদের দরবারে। খলিফা তখন উজির, জাফর, আমির, অমাত্য এবং সভাসদদের নিয়ে দরবারে বসে হুকুমতের কাজে ব্যাপৃত ছিলেন।

হাসানকে ঐভাবে ঢুকতে দেখে খলিফা আশঙ্কিত হয়ে মসনদ ছেড়ে ছুটে আসেন ওর কাছে।

-কী? কী হয়েছে হাসান? তোমার চেহারা এমন দেখছি কেন? কী হয়েছে, বল। তোমার চোখে পানি কেন?

কিন্তু হাসান খলিফার কথার জবাব দিতে পারে না। এবার সে চিৎকার করে কেঁদে আছাড় খেয়ে পড়ে খলিফার পায়ের উপর।

—চুমকী—আমার পেয়ারের চুমকী, কোথায় গেলে তুমি

খলিফা কিছুই আঁচ করতে পারেন না, কী হয়েছে হাসান? চুমকী কোথায় গেছে? সে প্রাসাদে নাই?

–আছে। আমার ঘরেই সে শুয়ে আছে। কিন্তু–কিন্তু—

আর বলতে পারে না হাসান। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে ওর কণ্ঠ।

খলিফা বুঝলেন, চুমকী দেহ রেখেছে। রুমালে চোখ মুছলেন তিনি।

-ওঠ ভাই, শোক করে কী করবে? খোদা যাকে পায়ে ঠাই দিয়েছেন, তার জন্যে শোক করতে নাই। নিজেকে শক্ত করো হাসান। তার আত্মার কল্যাণ কামনা কর। চুমকী আমাদের সবচেয়ে আদরের বাঁদী ছিলো। তাই তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সুখে থাকবে সে। এর চেয়ে বেশি সুখ আর কোথায় পাবে সে?

খলিফা আবার চোখের জল মুছলেন রুমালে। জাফর এবং অন্যান্য আমির অমাত্যরাও চোখ মুছলো। খলিফা খাজাঞ্চীকে বললো, হাসানকে দশ হাজার দিনার দিয়ে দাও।

হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, চুমকীর শেষ কাজ খুব ভালো করে সমাধা করো ভাই। আমরা বড় ভালোবাসতাম ওকে।

হাসান মোহরের থলে হাতে করে ঘরে ফিরে এসে চুমকীকে ডেকে তোলে। ওঠ ওঠ, শিগ্নির-ওঠ। দেখো। শুধু তুমিই, আমিও খলিফাঁকে বোকা বানিয়ে কী মাল নিয়ে এসেছি।

থলেটা উপুড় করে ফেলে দিলো মেঝেয়। মোহরে মোহরে পাহাড় জমে উঠলো।

হাসান চুমকীকে আদর সোহাগ করতে করতে বলে, তা তো হলো, কিন্তু এর পরের ব্যাপারটা ভেবে দেখেছো? জুবেদা বেগম আর খলিফা দুজনে যখন জানবেন, আমরা তাদের ধোঁকা দিয়ে টাকা নিয়ে এনেছি, তখন অবস্থাটাই বা কী দাঁড়াবে একবার চিন্তা করো।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো পঞ্চাশতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে?

সেদিন খলিফা দরবারের কাজ কাম সংক্ষিপ্ত করে মাসরুরকে সঙ্গে নিয়ে জুবেদার কাছে চলে এলেন। চুমকীর শোকের হৃদয় মথিত হচ্ছিল। তাই তিনি জুবেদার কাছে এলেন নিজেকে শান্ত করতে এবং জুবেদাকে সান্ত্বনা দিতে। বেগমসাহেবার ঘরে ঢুকতেই তিনি দেখলেন, জুবেদা অঝোর নয়নে জল ফেলছে। আর হারেমের বাঁদীরা তাকে ঘিরে বসে আছে। কেউ বা তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে।

বড়োই করুণ দৃশ্য! খলিফা জুবেদার শয্যাপাশে এসে দাঁড়াল।

—চাচার মেয়ে, চুমকী তোমার কী যে আদরের ছিলো তা তো আমি জানি। তার ইন্তেকালে তোমার চেয়ে আর বেশি করে কার বাজবে বলো?

জুবেদা সবে হাসানের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে খলিফাঁকে সান্ত্বনা জানাতে যাবেন, সেই মুহূর্তে খলিফার মুখে একি কথা শুনলেন তিনি। নিজের কানকেই তিনি বিশ্বাস করতে পারে না।

জুবেদা বলেন, চুমকী দীর্ঘজীবি হোক, ধর্মাবতার। আমি চোখের পানি ফেলছি, আপনার দুঃখে। হাসান আপনার প্রাণের বন্ধু, ভাতৃপ্রতিম ছিলো। ওর মতো ভালো ছেলে বড়ো একটা দেখি না। তার শোকে আপনি বড়োই কাতর হয়েছেন, বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবেন বলুন, মানুষের আয়ু সদাই টলমল করে। কখন যে কে টুপ করে ঝরে পড়বে, কেউ বলতে পারে না।

এই নিদারুণ এক শোকাবহ মুহূর্তেও জুবেদা কেন রঙ্গ তামাশায় মশগুল হয়ে আছে, খলিফা কিছুই বুঝতে পারেন না। তবে কী বেগমসাহেবা এখনও হাসানের মৃত্যু সংবাদ জানে না? এত দুঃ খেও খলিফা বেদনার হাসি হাসেন। মাসরুরকে ডেকে বলেন, মাসরুর, তোর মালকিনকে একবার বুঝিয়ে বল, কী ঘটেছে। আমার মনে হচ্ছে ওর মেজাজটা ঠিক নাই, তাই চুমকীর মৃত্যুর সঙ্গে হাসানের মৃত্যু মিলিয়ে ফেলেছে। আমি এলাম তাকে সান্ত্বনা জানাতে। আর সে কিনা আমাকে একটা আজগুবি মিথ্যে খবর শুনিয়ে দুঃখ দিতে চাইছে। তুই নিজের চোখেই সব দেখেছিস? হাসান আমার কাছে কী ভাবে এলো, এবং কী দুঃসংবাদ দিয়ে গেলো, তোর মালকিনকে খুলে বল সব ঘটনা। আমার মনে হয় এরপর আর সে আমাদের বোকা বানাতে চেষ্টা করবে না।

মাসরুর তখন জুবেদাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বেগমসাহেবা, ধর্মাবতার যথার্থই কথা বলেছেন। আজ সকালে আবু হাসান কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে এলো। তার রুক্ষ্ম চুল, বেশবাশ ছিন্নভিন্ন, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল হয়ে গিয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতে তিনি ধর্মাবতারের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। খাবারের বিষক্রিয়ায় গত রাতে তার বিবি চুমকী দেহ রেখেছেন। তার দুঃখে ধর্মাবতার তো ব্যথিত হলেনই, দরবারের কেউই অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না।

এরপর ধর্মাবতার তার বিবির সৎকারের জন্য দশ হাজার দিনার দিয়ে দিতে বললেন খাজাঞ্চীকে।

মাসরুরের এই কথাতে কোনও ফল হলো না। বরং জুবেদা ভাবলেন খলিফার রঙ্গ রসিকতা করার হাজার ছলের এ-ও একটা ছল মাত্র। সুতরাং মাসরুরের বক্তব্যের একটি বর্ণও তিনি বিশ্বাস করলেন না। ভাবলেন, সবটাই খলিফার শেখানো বুলি।

জুবেদা ক্ষুব্ধ স্বরে নালিশ জানাল, আজকের দিনেও কি আপনি এই রকম রসিকতাগুলো মেহেরবানি করে বন্ধ রাখতে পারেন না, জাঁহাপনা! আমার কথা যদি আপনার বিশ্বাস না হয় তবে আমার কোষাধ্যক্ষকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, হাসানের সৎকারের জন্য সে কত টাকা বের করে চুমকীর হাতে দিয়েছে। আমার মনে হয়, এখানে বসে এই রকম হৃদয়হীন নির্মম রঙ্গ রসিকতায় না মেতে আপনার প্রাণের বন্ধুর মৃতদেহের পাশে উপস্থিত থেকে তার শেষকৃত্য সম্পাদন করানোর কাজে ব্যাপৃত থাকলে প্রকৃত বন্ধুর কাজ করা হতো।

খলিফা এবার ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন, এসব কী যা তা বলছো, চাচার মেয়ে? খোদা হাফেজ, আমার …আমার…আমার মনে হচ্ছে, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি বলছি—চুমকী মারা গেছে কাল রাতে। এর মধ্যে যুক্তি তর্কের আর কোনও অবকাশ নাই। এক্ষুনি হাতে নাতে তা প্রমাণ করে দিচ্ছি।

খলিফা সেখানেই দিবানের ওপর বসে পড়ে মাসরুরকে বললেন, যা এক্ষুনি আবু অল হাসানের কামরায় যা। নিজের চোখে দেখে আয়, যদিও তার কোনও দরকার নাই। দুজনের কে মারা গেছে?

মাসরুর চলে গেলে খলিফা জুবেদাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এক্ষুনি প্রমাণ হয়ে, যাবে, কার কথা ঠিক। কিন্তু তুমি তোমার সেই বরাবরের গোঁ-টা ছাড়তে পারলে না। আমি নিশ্চিত জানি, তুমি ডাহা ভুল করেছ। এখনও যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে বাজী লড়তে পারি।

-ঠিক আছে, বাজীই রইলো, জুবেদা কঠিন কণ্ঠে বলে, আমি যদি হারি তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় তসবির মহলটা চিরকালের মতো দিয়ে দেব আপনাকে।

খলিফা বললো, প্রাণাধিক প্রিয় রঙমহল’ প্রাসাদটি বাজি ধরলাম আমি। যদি আমি হারি, যা একেবারেই অসম্ভব, তবে তোমাকে বিনাশর্তে চিরকালের মতো ঐ রঙমহলের মালিকানা লিখে দিয়ে দেবো। এবং এটা তো মানো যে, তোমার ঐ তসবির-মহলের চেয়ে অনেক বেশি দামি আমার ঐ রঙমহল।

জুবেদা বেশ বিরক্ত ভাবেই বললো, থাক থাক ধর্মাবতার, এ নিয়ে আর আপনার সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করতে চাইনে। তসবির-মহলের প্রকৃত মূল্য এবং মর্ম যাঁরা বোঝেন, তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, কী তার দাম এবং নাম। আপনার সামনে যারা বলে, আপনার রঙমহলই সবার সেরা—সব চেয়ে দামী, তারাই আবার আপনার আড়ালে গিয়ে অন্য জায়গায় আমার তসবিরমহলের গুণগান করে। বলে, এর চেয়ে মূল্যবান বস্তু তামাম দুনিয়ায় কিছু নাই। আপনি যদি প্রমাণ চান, আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। তা হলে আসুন আমরা পবিত্র ফতিয়াহ’ পাঠ করে শপথ নিই।

খলিফা বললে, ঠিক আছে, এই তো কোরান সামনেই আছে, এস তাহলে পাঠ করি। এরপর দুজনেই কোরান পাঠ করে শপথ করেন। তারপর মাসরুরের আশায় বসে থাকেন। রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো একান্নতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

আবু অল হাসান জানলা দিয়ে দেখতে পেল মাসরুর আসছে। বুঝতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না, কেন তার এই আগমন? চুমকীকে বললো, বিবিজান, বিপদ আসন্ন। মাসরুর আসছে। আমার মনে হচ্ছে, বেগম আর খলিফার মধ্যে তর্ক বেধেছে—আমাদের মৃত্যু নিয়ে। আগে আমি খলিফাঁকেই জেতাবো। সুতরাং আর দেরি নয়, যাও, মক্কার দিকে পা করে মড়ার মতো শুয়ে থাকো। আমি কালো কাপড়ে তোমাকে ঢেকে দিচ্ছি।

চুমকীর শবদেহে কালো কাপড় ঢাকা দিয়ে মাথার টুপী খুলে ফেলে হাসান। চোখে পেঁয়াজ ঘষে নেয়। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

মাসরুর ঘরে ঢুকে চুমকীর মৃতদেহ দেখে মাথার টুপী খুলে হাতে নিয়ে শোকাহত হাসানের পাশে এগিয়ে যায়।

—সবই তার ইচ্ছা মালিক। তার জিনিস তিনি ফেরত নিয়ে গেলেন। এ নিয়ে শোক করে আমরা কী করতে পারি। এখন একমাত্র তাকেই ভরসা করে সান্ত্বনা লাভ করুন, এ ছাড়া কী বা বলতে পারি আমরা। যা শেষ কাজ করুন, আমি চলি। মাসরুর দ্রুত পায়ে জুবেদার মহলে ফিরে আসে।

—কী সংবাদ মাসরুর?

জুবেদা উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করে।

মাসরুর কুর্নিশ জানিয়ে বলে, বেগমসাহেবা, অপরাধ নেবেন না, ধর্মাবতারের কথাই ঠিক। গতকাল রাতে হাসানের বিবি চুমকী মালকিনই মারা গেছেন।

খলিফার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিজয় গর্বের হাসি হেসে বলেন, কী, হলো তো? এবার? এবার তো তোমার তসবির মহল হাতছাড়া হয়ে গেলো, চাচার মেয়ে। তাহলে আর দেরি কেন, পেশকারকে ডেকে আমার নামে দানপত্রটা লিখে দাও।

জুবেদা ক্রোধে ফেটে পড়েন, এই মিথুকটার কথায় কী বিশ্বাস? আপনার মনোরঞ্জনের জন্য ও পারে না এমন কোনও কাজ দুনিয়ায় নাই। আমি ওকে বিশ্বাস করি না। এরপর থেকে ওকে আর আমার হারেমেই ঢুকতে দেব না, শয়তান কোথাকার! একেবারে চোখে মুখে মিথ্যার খই ফোটায়! যা ভাগ, আমার সামনে থেকে।

এই বলে জুবেদা তার পায়ের চটি ছুঁড়ে মারলেন মাসরুরের দিকে। মাসরুর থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে যায়। বেগমসাহেবা এখন আগুন হয়েছেন। সত্যি হোক, মিথ্যে হোক এ সময় আর কোনও কথা বোঝাতে যাওয়া নিরাপদ হবেনা।

জুবেদা উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ধর্মাবতার, আপনার তাঁবেদার ঐ মাসরুরের কোনও কথা আমি বিশ্বাস করলাম না। এখন আমি আমার কোনও বাঁদীকে পাঠাচ্ছি। সে-ও যদি দেখে এসে একই কথা বলে, তবে আপনি যা বলবেন, আমি মেনে নেব।

খলিফা দেখলেন জুবেদা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে বললেন, তাই হোক। তোমার লোককেই পাঠাও।

জুবেদা তার একান্ত অনুরক্ত এক বৃদ্ধা ধাইকে ডেকে বললো, যাও তো ধাইমা, তুমি নিজের চোখে দেখে এস, হাসান, না চুমকী-কে মারা গেছে কাল রাতে।

বৃদ্ধা চলে গেলো।

আবু হাসান আশঙ্কা করেই অপেক্ষা করছিলো। এর পরে আবার নিশ্চয়ই কেউ আসবেতদন্ত করতে। বৃদ্ধাকে আসতে দেখে সে চুমকীকে বললো, বিবিজান, সাবধান। দূত আসছে। এবার আমি মরলাম।

 

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

ছয়শো বাহান্নতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে?

হাসান ঝটপট ঘরের মাঝখানে মক্কার দিকে পা করে শুয়ে পড়লো। চুমকী হাসানের মুখে টুপীটা রেখে দেহটা একখানা কালো কাপড়ে ঢেকে দিলো। নিজের চুলগুলো পাগলীর মতো এলোমেলো করে কপাল বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলো।

বৃদ্ধা ধাই ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। তারপর চুমকীর পাশে এসে দাঁড়ায়, কেঁদ না মা, কেঁদ না। কেঁদে আর কী করবে? হাসান আজ তোমাকে ছেড়ে চলে গেলো, তোমার এই কচি বয়েস, এখন বিধবা জীবন কাটাবে কী করে, মা?

এরপর বৃদ্ধা ফিরে যাবার উদ্যোগ করে বলে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না, মা। বেগম জুবেদাকে খবর দিতে হবে। কি কাণ্ড বলো! ঐ মাসরুর মিথুকটা এখান থেকে গিয়ে বলেছে, সে নাকি নিজের চোখে দেখে গেছে তুমি মরে গেছ।

চুমকী বলে, মাসরুর বোধহয় খুব মিথ্যে বলেনি, ধাইমা। কারণ কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছি। হয়তো মাসরুর যখন এসেছিলো আমি মূৰ্ছিত হয়ে মাটিতে পড়েছিলাম।

এই বলে চুমকী আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। বৃদ্ধা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, চুমু খায়, সান্ত্বনা দেয়। দুঃখ করো না, মা। নসীবে যা আছে তা এড়াবে কী করে?

এরপর আর দাঁড়ালো না সে।

বৃদ্ধা এক এক করে সব ঘটনার বিবরণ দিলো। এবং সে যে চুমকীর দুঃখে বিশেষ কাতর হয়ে পড়েছে—সে কথাও জানালো বেগম জুবেদা এবং খলিফার সামনে।

এবার জুবেদা খলিফার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকান, কী তোমার সেই সত্যবাদী সাগরেদ মাসরুরটা গেলো কোথায়? ডাকো তাকে। জবাব দিক এর। হাড়ে হাড়ে শয়তান, কুত্তার বাচ্চা!

খলিফা মাসরুরকে ডাকলেন।

-কী রে হতভাগা, এত বড়ো মিথ্যে কথা বললি কেন? কী ব্যাপার? তোর জন্য আমিও মিথ্যেবাদী হয়ে গেলাম বেগম জুবেদার কাছে।

জুবেদা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ধাইমা, এই কুত্তার বাচ্চাটাকে বলো তো, কী তুমি দেখে এসেছো?

বৃদ্ধা যা দেখে এসেছে, তার বিবরণ আবার শোনালো তাকে।

মাসরুর তো রেগে কাই। জুবেদা বা খলিফা যে সামনে আছেন, সে কথা সে বিস্মৃত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, ফোকলামুখী বুড়ি, এত বড়ো ডাহা মিথ্যে কথাটা বলতে তোমার একটুও মুখে বাধলো না। তুমি কী বলতে চাও, সেই হতভাগী চুমকীর লাশটা আমি স্বচক্ষে দেখে আসিনি?

বৃদ্ধার চোখে এবার আগুন জ্বলে ওঠে। মনে হলো, তখুনি বুঝি ভস্ম করে দেবে মাসরুরকে।

—তোমার মতো মিথ্যেবাদী ত্রিভুবনে দুটি নাই। ফাঁসীতে ঝোলালেও যোগ্য সাজা হয় না, টুকরো টুকরো কেটে তোমার মাংস কুকুরকে দিয়ে খাওয়ানো উচিত।

-চুপ কর ডাইনী বুড়ি। ঐ সব গাঁজাখুরী গল্প তোমার লাজুক মেয়েদের গিয়ে শোনাও গে! মাসরুরের এই ঔদ্ধত্যে জুবেদা নিদারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে খলিফাঁকে বললেন, আপনার এই মিথ্যের জাহাজ সাগরেদটিকে শায়েস্তা করুন। ধর্মাবতার, তা না হলে আমি হতে দেবো।

খলিফা বললেন, খোদা হাফেজ, মাসরুরু একা মিথ্যেবাদী হতে যাবে কেন? তা হলে আমিও মিথুক। তোমার ধাইও মিথুক। এবং তুমিও মিথ্যেবাদী।

এরপর আর একটিও কথা বললেন না খলিফা। মাথা নীচু করে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর এক সময় মাথা তুলে বললেন, ব্যাপারটা জটিল বলে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্য কারো ওপর আর ভরসা করা যায় না। চলো, আমরা দুজনে গিয়ে নিজের চোখে যাচাই করে দেখে আসি।

জুবেদা বললো, সেই ভালো, চলুন আমরাই দেখে আসি।

খলিফা এবং জুবেদা, মাসরুর, বৃদ্ধা ধাই ও হারেমের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে করে আবু অল হাসানের বাসার দিকে এগিয়ে চলেন।

আবু অল হাসান আগেই ভেবে রেখেছিলো, ব্যাপারটা অত সহজে মিটবে না। আরও গুরুতর কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলো সে।

সুলতান এবং জুবেদার বিশাল বাহিনী তাদের কামরার দিকে ধাবমান দেখে চুমকী হাসানকে বলে, কতবার আর চালাকী করে পার পাবে, সোনা এবার? এবার কী করবে? ঐ ওঁরা দুজনেই আসছেন।

হাসান কিন্তু হাসে। বলে, এসো, এবার আমরা দুজনেই মরবো।

খলিফা এবং জুবেদা দুজনে হাসানের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। পাশাপাশি দুটি মৃতদেহ দেখে দুজনেই শিউরে ওঠেন। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনও কথা সরে না।

এমন সময় আর একটি কাণ্ড ঘটে। এই নিদারুণ মর্মান্তিক শোকাবহ দৃশ্য দেখে বেগম জুবেদা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। মূৰ্ছিত হয়ে তার এক বাঁদীর কাঁধে ঢলে পড়েন। অন্য মেয়েরা তার মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিতে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পান জুবেদা। হায় হায় করতে করতে বলেন, চুমকী, তোমার মহব্বতের নজির নাই। স্বামীর শোক সইতে না পেরে সতীসাধ্বী চুমকী আমার, দেহত্যাগ করেছে। ও আমাকে তখনি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, হাসান ছাড়া আমার জীবনে বাঁচার আর কোনও মানে নাই, বেগম সাহেবা। আমি আর বাঁচতে চাই না। তা মুখে যা বললো, কাজেও তাই করলো চুমকী? ইয়া আল্লাহ! এ তোমার কী নিষ্ঠুর লীলা!

খলিফা বাধা দিয়ে বলেন, তুমি ভুল করছো, চাচার মেয়ে। শোকে তাপে দগ্ধ হয়ে চুমকী মরেনি, মরেছে আমার পেয়ারের দোস্ত হাসান। চুমকীকে সে জান দিয়ে ভালোবাসতো। নিজের জীবন দিয়ে সেই কথাই সে আজ প্রমাণ করে গেলো। আল্লাহ ওর আত্মার মঙ্গল করুন। বেগমসাহেবা, তুমি ভাবছো, মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলে বলেই লোকে তোমার কথা বিশ্বাস করবে? বলবে, তোমার কথাই ঠিক?

জুবেদা বলে, না। আপনার একটা মিথ্যের জাসুনফর আছে বলেই আপনার সব মিথ্যে কথা সত্যি বলে বিশ্বাস করবে তারা।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো তিপ্পান্নতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে।

-কিন্তু আবু অল হাসানের চাকররা সব গেলো কোথায়? জুবেদা জানতে চাইলেন।

–ওদের ডাকুন, ওরাই বলতে পারবে—আসল ঘটনা। কে আগে মরেছে, কে পরে মরেছে, ওরা ছাড়া আর জানার উপায় কী?

তুমি ঠিক বলেছ, চাচার মেয়ে, খলিফা চেঁচিয়ে বলেন, কই, কে আছ, কে বলতে পারবে, কে আগে মরেছে। আর কে বা শোকে কাতর হয়ে পরে মারা গেছে? যে বলতে পারবে তাকে আমি এখুনি নগদ দশ হাজার দিনার বখশিশ দেব।

ঘরের অভ্যন্তর থেকে এক অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো, আমাকে দিন ঐ দশ হাজার। আমি বলে দেব সত্যি ঘটনা। আমি, ধর্মাবতার, আমি আবু অল হাসান চুমকীর শোকে কাতর হয়ে মরে গিয়েছিলাম।

এই কথা শোনামাত্র জুবেদা এবং তার মেয়েরা ভয়ে আর্তনাদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায় ঘরের বাইরে। কিন্তু খলিফা বুঝতে পারেন এ সবই হাসানের অভিনব চাতুরী। অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন তিনি।

-হো হো, হা হা, হি হি, ওরে বাবা, ও,হাসান ভাই, আমি যে হাসতে হাসতে মরে যাবো। একি মজাদার রঙ্গ তুমি বানিয়েছ। ওঃ হো হো, আর পারি না হাসতে। ওরে বাবারে!

হাসতে হাসতে খলিফার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায়। এতক্ষণে জুবেদা বুঝতে পারেন, আসলে পুরো ব্যাপারটাই তামাশা। ভয় আতঙ্ক কেটে যায়। হাসান এবং চুমকী উঠে দাঁড়ায়। তাদের এই অভিনব ফন্দীর কাহিনী সব খুলে বলে খলিফার পায়ে লুটিয়ে পড়ে হাসান। আর চুমকী জড়িয়ে ধরে জুবেদার পা।

খলিফা প্রসন্ন চিত্তে মার্জনা করে হাসানকে। জুবেদাও হাসতে হাসতে চুমকীকে বলেন, ভীষণ দুষ্টুমী করেছ। যাও, এবারের মতো মাফ করে দিলাম।

খলিফা খুশি হয়ে হাসানকে দশ হাজার এবং চুমকীকে দশ হাজার দিনার বখশিশ দিলেন। এবং জাফরকে বলে দিলেন, জাফর, আমার হয়তো সব সময় খেয়াল থাকে না। তুমি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে এদের ভাতার টাকাটা পৌঁছে দিও হাসানের ঘরে।

এর পর ওরা দুজনে সেই প্রাসাদ পরিবেশে সুখ বিলাসের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছিলো সারাটা জীবন।

গল্প শেষ করে শাহরাজাদ সুলতান শাহরিয়ারের দিকে তাকায়। শাহরিয়ার বলে, এর পর প্রেমের একটা ছোট কিসসা শোনাও শাহরাজাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *