হাসি-তামাশায় হারুন অল-রসিদ
শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :
শুনুন জাঁহাপনা, একদিন খলিফা হারুন অল-রাসিদ তীর উজির অল বারম্যাকী, প্রিয়পাত্র গাইয়ে ওস্তাদ আবু ইশাক এবং বয়স্য কবি নবাসকে সঙ্গে নিয়ে বাগদাদের পথে-পথে ঘুরছিলেন। চলতে চলতে এক সময় তারা এসে পড়লেন শহরের এক প্রান্তে। এইখানে বাসরাহ থেকে রাস্তা এসে মিশেছে বাগদাদে। সুলতান দেখলেন, একটি বৃদ্ধ লোক গাধার পিঠে চেপে শহরের দিকে আসছে। হারুন অল-রাসিদ জাফরকে বললেন, জাফর, লোকটাকে জিজ্ঞেস করতো— কোথায় সে চলেছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে জাফর ভেবে পেলো না, খলিফার কী উদ্দেশ্যে। কেনই বা তীর এই কৌতূহল। যাই হোক, সে বৃদ্ধের কাছে এগিয়ে গিয়ে ইশারায় তাকে থামতে বললো। বৃদ্ধ লাগামটা ঢ়িলে করে গাধাটাকে দাঁড় করালো। জাফর জিজ্ঞেস করলো হ্যাঁ গো, শেখ সাহেব, কোথায় চলেছে? কোথা থেকেই বা আসছে?
বৃদ্ধ জবাব দেয়, বসরাহ থেকে আসছি। বাগদাদেই যাবো।
জাফর বলে, এই লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এলেই বা কেন?
–খোদা মেহেরবান, শুনেছি, এখানে এই বাগদাদ শহরে অনেক নামকরা ধন্বন্তরী হেকিম আছেন। আমি তারই সন্ধানে এসেছি। চোখের ব্যামোয় বহুৎ কষ্ট পাচ্ছি। যদি কেউ ভালো সুর্ম বানিয়ে দিতে পারেন, এই আশায় এখানে আসছি।
জাফর বললো, সারা না। সারা খোদাতালার হাত; আমি একটা কথা বলবো শেখ সাহেব, এমন ধন্বন্তরী দাওয়াই আমি বানিয়ে দিতে পারি যা লাগালে এক রাতের মধ্যে তোমার চোখের সব অসুখ সেরে যাবে। এতে তোমার পয়সাও বাঁচবে ঢের।
বৃদ্ধ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। স্বগতভাবে বলে, একমাত্র আল্লাহই এর ইনাম দিতে পারে।
কিন্তু কথাটা শুনতে পায় জাফর। খলিফার কাছে সরে গিয়ে ইশারায় জানায়। তারপর বৃদ্ধের কাছে এগিয়ে এসে বলে, দেখোচাচা তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে, তাই সেধে এসে তোমার উপকার করতে চাইছি। তাহলে আমার দাওয়াই বানাবার মাল-মশলা ১) তোমাকে বাৎলে দিই? ভালো করে মন দিয়ে শোনো : তিন ছটাক নাকের প্রশ্বাস, তিন ছটাক সূর্যের আলো, তিন ছটাক চাঁদের আলো, আর তিন ছটাক চিরাগের আলো নেবে। একটা তলা খোলা হামানদিস্তায় ভালো করে মেশাবে সবগুলো। ২। তারপর খোলা হাওয়ায় রেখে দেবে সেগুলো। এই ভাবে তিন মাস হাওয়া খাওয়াবে। তার পর আরও তিনমাস ধরে সেই মেশানো মশলাগুলো খুব আচ্ছা করে ডলাইমলাই করবে। তারপর একটা পিরিচে ঢেলে নেবে। পিরিচ। সুদ্ধ মশলাগুলো আরও তিন মাস রোদে শুকোতে দেবে। এরপর তোমার দাওয়াই তৈরি হয়ে যাবে। একটা রাতে এই সূৰ্মা তিনশোবার লাগাবে তোমার চোখে। সন্ধ্যা থেকে সুবা অবধি। যদি আল্লাহ সহায় থাকেন, তবে দেখবে, এক রাতেই তোমার চোখের সব ব্যামো সেরে গেছে।
বৃদ্ধ তো কৃতজ্ঞতায় গদগদ। গাধার পিঠে বসেই মাথা নুইয়ে জাফরকে সালাম ঠুকে বললো, আপনি সেরা হেকিম। আপনার ঐ দাওয়াই-এর দাম কী দিয়ে শোধ করবো? যাই হোক, আপনি আর দেরি করবেন না, কষ্ট করে মাল-মশলাগুলো এখনি জোগাড় করে আমার দাওয়াই বানিয়ে দিন। একটু তাড়াতাড়ি করুন, নাহলে ওরা হয়তো উধাও হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি, দেশে ফিরে গিয়ে আপনার জন্যে একটা বহুৎ মজাদার বাঁদী পাঠিয়ে দেব। মেয়েটার লাল টুকটুকে খুদে ডুমুরের মতো পাছাখানা দেখে আপনি ভিরমি খেয়ে যাবেন। মেয়ে-মানুষটা এমন সুন্দর করেকাঁদতে পারে, দেখবেন, আপনার ঐ পাংশুটে মুখখানা থুথুয় লেপে দেবে, আর খড়খড়ে দাডিগুলো জব্বজবে করে ভিজিয়ে ছাড়বে।
এই বলে বৃদ্ধ তার গাধার লাগাম ঝাঁকিয়ে তড়বড় করে এগিয়ে চলে গেলো।
খলিফা তো হেসে খুন। জাফর বোকা বোবার মতো পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একটাও কথা বলতে পারলো না। লাজায় সে তখন আড়ষ্ট।
কবি আবুনবাস শুধু বিজ্ঞের মতে এগিয়ে এসে জাফরকে বাহবা দিতে লাগলো। যেন পুত্রের কৃতকর্মের জন্য এক পিতার বুক দশ হাত ফুলে উঠেছে।
এই ছোট্ট সুন্দর কাহিনীটা শুনে সুলতান শাহরিয়ারের মুখ হাসিতে ঝলমল করে ওঠে। শাহরাজাদকে বললো, এই রকম আর একটা মজাদার কিসসা শোনাও, শাহরাজাদ।
কিছুক্ষণ বিরতির পর শাহরাজাদ। আবার এক কাহিনী বলতে শুরু করে।