টানা তিন দিন বৃষ্টির পর আজ আকাশ সবে মাত্র পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। এখনো সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু দুপুরের আলো প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন। পাতলা পাতলা মেঘ ঈশান কোণ ছেড়ে যাচ্ছে নৈঋতে। বাতাস এখন সংযত।
এই ক’দিন বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল প্রায় সারাক্ষণ। ঝড়ের সময়, যখন গাছ পালার চূড়াগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ে, ডালপালাগুলো অসহায় ভাবে নাচতে থাকে, তখন পাখিরা কোথায় যায় কে জানে। কিংবা কী খায়? এখন বেরিয়ে এসেছে ঝাঁক ঝাঁক পাখি, গাঙশালিক, ছাতারে, চিল, চড়ুই, কাক, কিন্তু তাদের ডাক শুনে মনে হয় না তারা ক্ষুধার্ত। এই বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিতে এখন মনে হয় সব কিছুই নির্মল, সকলেই সুখী।
নৌকোর ছই-এর বাইরে বসে আছে তরুণ অধ্যাপক বাবুল চৌধুরী। তার পরনে কুর্তা-পায়জামা, হাতে একটি ছোট বায়নোকুলার। নদীর ধারে ঝোঁপ ঝাড় দেখলেই সে চোখে বায়নোকুলারটি লাগিয়ে নতুন কোনো পাখি আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। অবশ্য তার বায়নোকুলারটি প্রায় খেলনাজাতীয়। ফিক্সড ফোকাস, তবু পাখি দেখায় তার অদম্য উৎসাহ। একটা তিতির বা ডাহুক দেখতে পেলেই সে চেঁচিয়ে ওঠে, মঞ্জু, মঞ্জু দেখে যাও!
নদীটির নাম ইছামতী, বহরে বেশি বড় না হলেও খরস্রোতা। এই বর্ষায় সে একেবারে রঙ্গিনী হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ভাঙ্গা গাছের ডাল কিংবা কোনো বাড়ির ছাউনির গুচ্ছ গুচ্ছ খড়, তাতেই বোঝা যায়, অনেক কিছু ভাঙতে জানে এই নদী।
স্টিমার সার্ভিস থাকলেও নৌকো-যাত্রাই বাবুল চৌধুরীর পছন্দ। ধীরে-সুস্থে দেখতে দেখতে যাওয়া হবে। তাড়া তো কিছু নেই, তার কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। যাওয়ার দিনটি আগে থেকেই নির্দিষ্ট ছিল, সৌভাগ্যবশত যথাসময়ে বৃষ্টি থামলো। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা আছে, একটু আগেই খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খাওয়া হয়েছে। ইচ্ছে করলে অবশ্য কোনো গঞ্জে বাজারে থামিয়েও খেয়ে নেওয়া যায়।
বায়নোকুলার ঘুরিয়ে পাখি দেখার চেষ্টা করতে করতে বাবুল চৌধুরী হঠাৎ একটা শুশুক দেখতে পেল। মাঝ নদীতে একবার হুস করে মাথা তুলেই আবার ডুবে গেল পরমুহূর্তে। বাবুল চৌধুরী এ রকমভাবে আগে কখনো শুশুক দেখেনি। তার ধারণা ছিল, শুশুক দেখতে সিমেন্টের বস্তার মতন। এখন যেন মনে হলো মানুষের মুখের আদল। সে চেঁচিয়ে উঠলো, মঞ্জু, দেখবে এসো মঞ্জু! মঞ্জু!
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
ছই-এর দু’পাশে পা ঝুলিয়ে আব্রু রক্ষা করা হয়েছে। বাবুল চৌধুরী সরে এসে এক পাশের পদা তুলে মুখ বাড়ালো ভেতরে। মঞ্জু ওরফে বিলকিস বেগম তখন তার ছ’মাসের শিশু। সন্তানকে স্তন্য পান করাচ্ছে, বাবলুকে দেখে সলজ্জ ভুভঙ্গি করলো, শরীরটা মুচড়ে আড়াল করলো তার খোলা বুক।
বাবুল চৌধুরী মুগ্ধভাবে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বললো, ম্যাডোনা! ইস, আমি যদি ছবি আঁকতে পারতাম।
শিশুটি বেশ স্বাস্থ্যবান, গোল গোল হাত, তার পানাহারের মধ্যে বিঘ্ন ঘটায় সে আপত্তিসূচক ঊউ শব্দ করলো।
বাবুল বললো, নদীতে একটা শুশুক দেখলাম। তুমি ওকে নিয়ে বাইরে এসো না!
মঞ্জ মাথা নেড়ে বললো, আমি অনেক শুশুক দেখেছি! আপনি দ্যাখেন গিয়া।
বাবুল এখনও পিতৃত্বে অভ্যস্ত হয়নি। ছ’মাসের বাচ্চা সামলানোতে অনেক ঝাট। তার মতে বাচ্চাকে যত বেশি ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়, ততই মঙ্গল। নিজের সন্তানের হাসি মুখ। দেখতে তার ভালো লাগে, কিন্তু কান্না শুনলেই পালাতে ইচ্ছে করে। তার তরুণী বধূর মাতৃত্বের রূপটি তার কাছে একেবারে নতুন, ছেলেকে কোলে নিলেই মঞ্জুর মুখের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে যায়, সেই মুখশ্রী উপভোগ করতে করতে বাবুলের আশ মেটে না।
প্রকৃতি দেখা ছেড়ে বাবুল তার স্ত্রীর পাশ ঘেঁষে এসে বসলো।
ছই-য়ের ভেতরটি আধো-অন্ধকার। একটি ছোট জানালা আছে, তা দিয়ে শুধু জল ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, আর শোনা যায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।
একটা নীল রঙের শাড়ী পরে আছে মঞ্জু, তার কপালে একটা লাল টিপ। তার মুখমণ্ডলে একটা পাতলা বিষণ্ণতার ছায়া।
একটু পরেই শিশুটির চোখ জড়িয়ে এলো ঘুমে। মঞ্জু তাকে সাবধানে শুইয়ে দিল অয়েল ক্লথ পাতা বিছানায়। তারপর ব্লাউজের বোতাম টিপে আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে বললো, আপনে একটু শুইয়া লবেন? ঘুম পাইছে?
বাবুল তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো, পাগল, এমন সুন্দর দুপুরটা ঘুমিয়ে নষ্ট করবো? চলো বাইরে গিয়ে বসি।
বলতে বলতেই সে মঞ্জুর ডান কানের লতির নিচে মৃদু চুম্বন দিল। মঞ্জু কৃত্রিম কোপে বললো, বাইরে মাঝিগুলার সামনে আপনে এই রকম দুষ্টামি করবেন?
বাবুল বললো, না, না কিছু করবো না। শুধু গল্প করবো। কী সুন্দর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আলো হয়েছে, দেখে চক্ষু একেবারে জুড়িয়ে যায়।
মঞ্জু বললো, আপনি যান, আমি একটু পরে আসতেছি। বাবুল আরও দু’তিন জায়গায় চুম্বন দিয়ে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।
নৌকো চলছে নদীর এক ধার ঘেঁষে। উজান ঠেলে যাওয়া, একজন মাঝি হাল ধরে আছে, আর একজন তীর দিয়ে গুণ টেনে চলেছে।
হালের মাঝিটির মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি, মধ্যবয়স্ক, শরীরটি বেশ মজবুত। মুখোনি দেখলেই মনে হয়, মাঝি হবার জন্যই যেন সে জন্মেছে। যখনই কেউ নৌকোর মাঝির ছবি আঁকে, ঠিক এই রকম একটা চেহারাই আঁকে। তার গায়ের রং ঠিক কালো নয়, রোদে পুড়ে, জলে ভিজে তার চামড়া এমন একটা বর্ণ নিয়েছে যার কোনো নাম নেই।
মাঝিটির নাম তাহেরউদ্দিন, সে স্বল্পভাষী। বাবুল তার সঙ্গে দু’একবার আলাপ জমাবার চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। নৌকো এখন যেখান দিয়ে চলছে, তার ডান পাশেই একটি বেশ বর্ধিষ্ণু জনপদ। অনেক বড় বড় পাকাবাড়ি চোখে পড়ে।
বাবুল জিজ্ঞেস করলো, তাহের ভাই, এই জায়গাটার নাম কী? মাঝি উত্তর দিল, কলাকোপা।
–অনেক দালান-কোঠা দেখতাছি। হিন্দুগো গ্রাম বুঝি?
–এই সব বাড়িতে এখনও মানুষজন থাকে?
–হ।
–কী জানি, হে আমি কইতে পারবো না।
–এদিকে সাহাবাবুরা খুব ধনী আছিল, তারাই বানাইছে বুঝি?
–আমি জানি না, কত্তা!
এইরকম ভাবে আর কথাবার্তা চালানো যায় না। বাবুল তাকিয়ে দেখলো কলাকোপার দু’তলা, তিনতলা বাড়িগুলির অধিকাংশই জানলা-দরজা বন্ধ। একটি বাড়ির সামনের বাগান থেকে বাঁধানো ঘাট নেমে এসেছে নদীতে, ঘাটের সিঁড়ির দু’পাশে বেশ চওড়া বসবার জায়গা। বাড়ির মালিক শৌখিন ছিল বোঝা যায়। ঘাটটি এখন জনশূন্য।
বাবুল আবার তাহেরুদ্দিনের দিকে ফিরে তাকালো। এই লোকটি এত কম কথা বলে কেন? বাবুল লক্ষ করেছে, আজকাল কেউই যেন প্রকাশ্যে কোনোরকম আলোচনাই চালাতে চায় না। উনিশশো আটান্ন সালের সাতই অক্টোবরের পর থেকে সমস্ত জাতির যেন কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে। জেনারেল আইয়ুবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীজা সারা পাকিস্তানে গণতন্ত্র বাতিল করে দিয়ে সামরিক আইন জারি করলো, তার কুড়িদিন পর ইস্কান্দর মীজাও বিতাড়িত হলো দেশ থেকে। আইয়ুব খাঁনই এখন সর্বেসর্বা। এই চার পাঁচ বছরে শুধু ধড়পাকড়ের রাজত্ব চলছে, কে কখন কোথায় গ্রেফতার হবে তার ঠিক নেই। সমস্ত রাজনৈতিক দল এখন নিষিদ্ধ। নেতারা কারারুদ্ধ। ছোটখাটো সরকারী কর্মচারিরাই এখন হম্বিতম্বা করে, কারুর ওপর ব্যক্তিগত রাগ থাকলে তাকে দেশদ্রোহী কিংবা চোরাকারবারি আখ্যা দিয়ে জেলে ভরে দেয়। মতলেববাজরাও এই সুযোগে এর ওর নামে লাগায়, নিরীহ মানুষেরা মুখে কুলুপ বন্ধ করে থাকে।
বাবুল ভাবলো, এই যে মাঝিটি, স্বৈরতন্ত্র বা সামরিক শাসনের প্রভাব কি এরও ওপর পড়েছে? চাষী, মাঝি, জেলে জোলা যারা সমাজের দরবারে নিম্নস্তরের মানুষ, রাজা বদল বা রাজনীতি বদলে কি তাদের কিছু আসে যায়? শুধু লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে এই যে তাহেরুদ্দিনের চেহারা, ব্রিটিশ আমলে বা তারও আগেকার মোগল আমলে এখানকার একজন নৌকোর মাঝির চেহারা তো ঠিক একই রকম ছিল, কিছুই বদলায়নি। এর আগেকার চোদ্দ পুরুষ যেমন লেখাপড়া শেখেনি, তাহেরুদ্দিনেরও তেমনি অক্ষর জ্ঞান নেই, খবরের কাগজে কী লেখা হয় সে জানে না। আগেকার প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে এখনকার গভর্নর মোনেম খানের শাসনের যে কী তফাৎ, তা কি ও বোঝে? ওর জীবনযাত্রার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছে? আগেও ছিল দিনের পর দিন শুধু অন্নচিন্তা, এখনও তাই।
পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে মঞ্জু হাতছানি দিয়ে বাবুলকে ডাকলো কাছে। বাবুল মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিতে সে ফিসফিস করে বললো, চলেন, ঐ ধারে গিয়ে বসি!
দু’জনে নৌকোর অন্য দিকটার গলুই-এর কাছে বসলো, এখানে এখন কোনো মাঝি নেই। গুণটানা নৌকোর গতি অতি ধীর। আর কিছুক্ষণ পর বুড়িগঙ্গায় পড়লে পালে বাতাস লাগবে।
বাবুলের ঠোঁটে অল্প অল্প হাসি। পুরুষ মানুষ হিসেবে বাবুল বড় বেশি ফর্সা। তার ওষ্ঠাধর লালচে রঙের। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি রং লাগিয়েছে। বাবুলের কথা বলার ভঙ্গিও খুব মৃদু ও নম্র, কারুর কারুর মনে হতে পারে মেয়েলি।
অবশ্য যারা তাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনে, শুধু তারাই জানে যে যখন কোনো বিষয়ে জেদ ধরে তখন এই নরম-সরল যুবকটিই কী সাংঘাতিক কঠিন হতে পারে। যেমন, বাবুল পড়াশোনায় দারুণ ভালো ছাত্র ছিল, কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি, তার ঘনিষ্ঠ জনেরা সবাই আশা করেছিল, সে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের মেধাবী ছেলেদের পক্ষে এখন অনেক সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে হয়েছে, ঐ চাকরি নিলে পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু বাবুল সেদিকে গেল না।
সে বিদেশে চলে যেতে পারতো। তার বাপ মায়ের পয়সা আছে। তা ছাড়া স্কলারশীপ সে পেতই, তার তুলনায় অনেক নিরেশ ছাত্র হুড়হুড় করে ইংল্যাণ্ড আমেরিকায় চলে যাচ্ছে, বাবুল যেতে রাজি হলো না। বিদেশে না যাক সে ঢাকায় বসেও রিসার্চ করতে পারতো, কিংবা চাকরি করার ইচ্ছে হলেও ঢাকাতে তার চাকরির অভাব হতো না। সকলকে অবাক করে সে মফঃস্বলের একটা কলেজে অধ্যাপনা করতে চলে গেল। মঞ্জুকে বিয়ে করার পর সে সংসার পেতেছে এক গ্রামে। মঞ্জুর বাবা-মা এবং বাবুলের বাবা-মা দু’পক্ষই দারুণ হতাশ। ঐ দু’পক্ষের আদেশ, উপদেশ, অনুরোধে বাবুল কর্ণপাত করেনি। মঞ্জু আপত্তি করেনি, এইটাই ছিল তার প্রধান জোর।
মঞ্জু জিজ্ঞেস করলো, আপনে হাসতেছেন কেন?
বাবুল বললো, আমার মাঝে মধ্যে এক একটা বড় মজার ব্যাপার চোখে পড়ে। এই যে আমাগো মাঝি তাহিরুদ্দিন, তোমার কি মনে হয় না, আমাদের বাপ-দাদাদের আমলে ঐ মানুষটাই নৌকা চালিয়েছিল? আমার ঠাকুদার বাবা নাকি ঢাকায় এসেছিলেন পাবনা থেকে।
তেনাকেও এনেছিল ঐ লোকটাই। তোমরাও ওর নৌকায় চাপো নাই?
মঞ্জু বললো, কী অদ্ভুত কথা! ও কি ভূত-প্রেত নাকি? বাবুল বললো, তা নয়। ও হলো, চিরকালের মাঝি। তবে আমাদের অল্প বয়েসে দেখেছি, মাঝিরা আমাদের সঙ্গে কত রকম গল্প করেছে, কত কেচ্ছা শুনিয়েছে, কিন্তু এখন ও যেন বোবা সেজে আছে!
–সকলের কি আর সব দিন কথা বলার মতন মেজাজ-মর্জি থাকে?
–তিন দিন ঝড় বৃষ্টির পর আজ রোদ উঠলো, তবু ওর মুখে হাসি ফুটলো না?
–তিন তিনটা দিন যে ওদের নষ্ট হয়ে গেল? সেই ক্ষতির কথাই ভাবতেছে বোধ হয়।
–অধিকাংশ মানুষই পুরনো দিনের কথা বেশি ভাবে, সামনের দিনটার কথা ভাবে না। তাই না?
–কী জানি!
–মঞ্জু, তুমিও পুরনো দিনের কথা বেশি ভাবো?
–আমি? কই না তো! ছেলের জন্য আমি কোনো কথা ভাবার সময় পাই? আপনি খোকার নাম ঠিক করলেন না?
–তোমার আব্বা-আম্মা তো দু’তিনটা নাম রেখেছেন।
–আপনের আব্বা আম্মাও চার-পাঁচটা নাম লিখে পাঠিয়েছেন। এতগুলা নামের মধ্যে। কোন্টা রাখা হবে আপনে ঠিক করে দ্যান।
–ওর কোনোটাই রাখা হবে না।
–বারে বা, ছেলের কোনো নাম থাকবে না?
–কেন, এত তাড়াতাড়ির কী আছে? তোমার ছেলে কি আইজকালের মধ্যে ইস্কুলে ভর্তি হবে নাকি?
মঞ্জু হঠাৎ কান খাড়া করে ছই-এর দিকে তাকালো। বাচ্চা জেগে উঠলো নাকি, কান্নার শব্দ আসছে? না, সেরকম কিছুই না, শুধু শোনা যাচ্ছে জলের সরসর শব্দ।
পাশ দিয়ে একটা নৌকো চলে গেল, সেটা মানুষজনে ভর্তি। খেয়ার নৌকো বোধ হয়। পুরুষরা সবাই চক্ষু দিয়ে লেহন করতে লাগলো মঞ্জুর শরীর। শুধু সুন্দর বলে নয়, তার মুখ চোখে, তার কাপড় পরার ধরনে একটা শহুরে ছাপ আছে। যে জন্য গ্রামের মানুষ বারবার তাকায়।
এই রকম দৃষ্টির সামনে মঞ্জু এখনো সহজ হতে পারে না। তার লজ্জা লাগে। মানুষ ভরা আরও একটা নৌকো আসছে। মঞ্জু তার স্বামীর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে বললো, আমি ভিতরে যাই, আপনে বসেন!
বাবুল ঠিকই বুঝলো মঞ্জু কেন ভেতরে চলে যেতে চায়। সে ঝুঁকে পড়ে খপ করে মঞ্জুর হাত চেপে ধরে বললো, না না বসো, বসো।
বাইরের লোকজনের দৃষ্টির সামনে স্বামী তার হাত চেপে ধরেছে, এই শরমে মঞ্জু ঠিক যেন একটা ধরা পড়ে যাওয়া অপ্সরার মতন ছটফটিয়ে বললো, ছাড়েন, ছাড়েন, কী করেন কী?
বাবুল বায়নোকুলারটি মঞ্জুর চোখের সামনে এনে বললো, ঐ দ্যাখো, এক ঝাঁক বক যাচ্ছে, ভালো করে দ্যাখো। মানুষ দেখার চেয়ে বক দেখা অনেক ভালো।
পাশের নৌকোটির কৌতূহলী মানুষদের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো বাবুল। তারপর সেই নৌকোটি অপসৃত হলে সে বললো, মঞ্জু তুমি একটা বিপ্লব করবে?
সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে বায়নাকুলারটি নামিয়ে নিল মঞ্জু। তার দৃষ্টিতে ঘনিয়ে এলো শঙ্কা। বিপ্লব কথাটার এখন নানা রকম অর্থ। আইয়ুব খান যখন মার্শাল ল জারি করলো, তখন সব খবরের কাগজে লেখা হলো এটাই একটা বিপ্লব। রাজনৈতিক নেতারা দলাদলি আর স্বজনপোষণ আর দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়ে দেশটাকে জাহান্নমে পাঠাচ্ছিল, প্রধান সেনাপতি এসে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেশটাকে বাঁচালেন। কিন্তু অনেকেই তখন বাড়িতে দরজা-জানলা বন্ধ করে বসে থাকতো। আবার বিয়ের পর পর কিছু দিন মঞ্জু যখন ঢাকায় ছিল, তখন বাবুলের বন্ধুরা এসে প্রায়ই আড্ডার শেষ দিকে বলতো, চীনের ধাঁচের একটা বিপ্লব না ঘটালে এ দেশের মুক্তি নেই। বাবুলের সেই সব বন্ধুরা ছিল কী রকম যেন তিরিক্ষি মেজাজের, মঞ্জুর পছন্দ হতো না। বাবুলের মাথার চুলের মধ্যে একটা কাটা দাগ আছে, কোথায় জানি পলিটিকস করতে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছিল। সেটা নাকি বিপ্লবের প্রস্তুতি। বাবুল গ্রামের কলেজে চাকরি নেওয়ায় খুশী হয়েছিল মঞ্জু। ঐ সব বন্ধুদের থেকে তো দূরে থাকা যাবে!
মঞ্জু ত্রাসের সঙ্গে বললো, কী কইলেন? ঐ মতলোবেই বুঝি আপনি আবার ঢাকায় ফিরতে চাইলেন?
বাবুল হা-হা করে হেসে উঠে বললো, তুমি ভয় পাইলা নাকি? এটা একটা ঘরোয়া বিপ্লব। তোমার মা তোমার বাবার সাথে আপনি আইজ্ঞে করে কথা বলেন, ঠিক তো? আমার মা-ও আমার বাবাকে আপনি আইজ্ঞে করেন। তুমি এই রীতিটা ভেঙে দাও, তুমি এখন থেকে আমাকে তুমি বলবে!
মঞ্জু লজ্জায় মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।
বাবুল তার থুতনি ধরে গাঢ় স্বরে বললো, শুধু শুধু বিছানায় না, শুধু বন্ধ ঘরের মইধ্যে না, সক্কলের সামনে। বাবা-মায়ের সামনে। নাও, এখন থেকেই শুরু করো, স্টার্ট। বলল, ওগো প্রাণনাথ…
বাবুলের কৌতুক ও উচ্ছলতার সঙ্গে সুর মেলাতে পারলো না মঞ্জু। সে হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে খানিকটা বিষাদাচ্ছন্ন গলায় বললো, আমরা তো স্বরূপনগরে বেশ ছিলাম, আপনে ঢাকায় ফেরার জন্য এত ব্যস্ত হইলেন কেন?
–আবার আপনি? তুমি বলো?
–আমরা কেন ঢাকায় যাচ্ছি?
–আরে, মাসের পর মাস কলেজ বন্ধ, ওখানে বসে থেকে কী করব?
–ঢাকায় গিয়েই বা কী করবেন?
–বাঃ, ঢাকায় কত চেনাশুনো মানুষ, তোমার আব্বা-আম্মা, এদের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করে না তোমার? তোমার মামুন মামাও জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন খবর পেয়েছি, তাঁর সঙ্গেও দেখা হবে!
–আমি স্বরূপ নগরেই ভালো ছিলাম।
–কিন্তু কলেজের মায়না না পেলে খাওয়া-পরা চলবে কী করে?
–আপনে কথা দ্যান যে ঢাকায় গিয়ে আবার ঐ সব ঝাটের মধ্যে জড়াবেন না?
–ঝঞ্ঝাট আবার কী? পাকিস্তানে পলিটিক্স শেষ হয়ে গেছে। মাছ কেন মরে জানো? বঁড়শির টোপ দেখে মুখ খোলে বলে। এদেশে এখন মুখ খুললেই মরণ।
নদীতীর এখন নির্জন। কেউ মাছ ধরছে না, কেউ স্নান করছে না। দুপাশে ঝোঁপঝাড়। বিকেলের সূর্য যেন অনেকদিন পর কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে এসে সৌজন্যের হাসি হাসছেন। কাছেই একটা মাছরাঙা পাখি তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠলো।
বাবুল হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে নিবিড় কণ্ঠে বললো, মঞ্জ, আমার হাতটা ধরো।
কেউ দেখবার নেই বলেই মঞ্জু নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে স্বামীর ডান হাতের আঙুল ছুঁলো।
বাবুল বললো, এবারে বলল, কথা দাও! বলো, এই কথাটা বলো, কথা দাও।
মঞ্জু বললো, কথা দাও।
বাবুল উফুল্লভাবে বললো, একটা ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখা উচিত ছিল। একটা ঐতিহাসিক দৃশ্য। জানো মঞ্জু, আমার বড় ভাই আলতাফ ভাই হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে, তুমি তো দেখেছো ভাবীকে, সেই ভাবীও আলতাফ ভাইকে আপনি-আপনি করে কথা বলে। সুতরাং, আমাদের ফ্যামিলিতে তুমিই প্রথম!
মঞ্জু বললো, কিন্তু, তোমার গা ছুঁয়ে বলো তুমি সত্যিই কথা দিলে তো?
বাবুল দু’চোখে ঝিলিক দিয়ে বললো, কথা দিতে পারি, যদি তুমি এখন আমাকে তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুতে দাও।
মঞ্জু ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই বাবুল তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো, বসো বসো, যেও না। জানি অতখানি একদিনে সত্য হবে না।
নৌকোর পাটাতনের ওপর এমনিই গা এলিয়ে দিয়ে বাবুল বললো, দ্যাখো দুদিকে কত সবুজের সারি। কত রকম গাছপালা, নামও জানি না। নদীর দু’ধারে মাঝে মাঝে মানুষজন দেখা যাচ্ছে, তাদের দেখে কী মনে হয় তারা খুব অসুখী? মনে হয় না, জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। মাশাল ল, প্রেসিডেন্টস রুল হ্যাঁন ত্যান হাবিজাবি। এসব কিছুরই যেন এই নদীর ধারে কোনো মূল্য নাই। এই যে নৌকাটা শান্তভাবে পানির ওপর দিয়ে চলেছে, আমাদের দেশটাও যদি এইভাবে চলতো?
মঞ্জু বললো, তোমরা দেশ নিয়ে এত চিন্তা করো, সব কথার মধ্যে দেশের কথা টেনে আনো কেন?
বাবুল বেশ তারিফ করা চোখে মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললো, এটা তুমি খুব দামি কথা বলেছো মঞ্জু। যে-সব দেশ বেশ সলিড, একটা পাকাঁপোক্ত গভর্নিং সিস্টেম আছে, সে সব দেশে লোকেরা দেশ নিয়ে সব সময় এত মাথা ঘামায় না। আমরা উরোপ-আমেরিকার যেসব গল্প-উপন্যাস পড়ি তার মধ্যে থাকে শুধু মানুষের কথা। দেশ কোথায়? এমন কি ইন্ডিয়া থেকে, পশ্চিম বাঙলা থেকে যে সব বইপত্র আসে, মাঝে মাঝে তো পড়ে দেখি, প্রেম-ভালোবাসার গল্পই বেশী দেখি, দেশ নিয়ে তো মাথা ব্যথা চোখে পড়ে না। শুধু আমরাই কেন সব সময়ে দেশের কথা টেনে আনি?
–আপনেরা এই নিয়ে তর্ক করতে ভালোবাসেন।
–আপনি নয়, তুমি! ঠিক বলেছো, আমরা এই নিয়ে তর্ক করতে ভালোবাসি। কাজের কাজ কিছুই করি না। আসলে, ব্যাপার কী জানো, আমাদের দেশটা তো নতুন। হঠাৎ লটারির টাকা পাওয়ার মতন আমরা পাকিস্তান পেয়ে গেছি। তাই সর্বক্ষণ সেই কথাটা আমাদের মনে জুড়ে আছে। জানো তো, কোনো পরিবারে হঠাৎ লটারির টাকা এসে গেলে ভাইয়ে ভাইয়ে কাজিয়া লেগে যায়, আমাদের হয়েছে সেই অবস্থা।
মঞ্জু বায়নোকুলারটা তুলে নিয়ে চোখে লাগিয়ে বললো, কই, আপনি আমাকে শুশুক দেখালেন না?
–তুমি আবার আপনি বলছো বলে সব শুশুক ডুব মেরে আছে। বিলকিস বেগম, তোমারে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? তোমার মুখে হাসি নাই কেন?
–এমনি এমনি হাসবো নাকি? বাবুল এবারে সুর করে গেয়ে উঠলো :
বিরহিনী বিবি আমার গো, বাঁদে নাকো চুল
কজেতে ফুটেছে কাঁটা পঞ্চবানের
হুল!…
মঞ্জু ভালো গান জানে, আর বাবুলের গলায় একেবারেই সুর নেই। বাবুলের গান গাওয়ার চেষ্টা দেখে সে না হেসে পারলো না। বাবুলের মুখে সে আগে কখনো গান শোনেনি।
–এ আবার কী গানের ছিরি। এই গান আপনে…তুমি কোথায় শিখলে?
–আমাদের বাড়িতে আবদুল নামে একজন চাকর ছিল, অনেক দিন আগে। সে আমাদের অনেক গান শুনাতো। আরও কয়েকটা লাইন মনে আছে, শুনবে?
সায়েরে গিয়েছে স্বামী হাবুলি আঁধার করে
পরাণ জ্বলে গেল বিবির কুকিলের ঠোকরে।
ও মানিকপির…
মুখ ঘামেছে বুক ঘামেছে বিবির ভেসে যাচ্ছে হিয়ে
খসম্ যদি থাকতো কাছে রে পুঁচত নুমাল দিয়ে।
হাসির তরঙ্গে মঞ্জুর সারা শরীর দুলতে লাগলো। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ও সে হাসি থামাতে পারে না। হাত তুলে সে বাবুলকে চুপ করতে ইঙ্গিত জানালো, ও দিকের মাঝি শুনতে পেলে কী ভাববে?
নিজের বেসুরো সঙ্গীত থামিয়ে বাবুল বললো, এইবারে তুমি একটা গান করো!
মঞ্জু প্রবলভাবে মাথা নাড়লো। বিকেলবেলা নৌকোর ওপর বসে বে-শরমের মতন গান গাইবার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না। পাশ দিয়ে আবার যখন তখন যাত্রী-বোঝাই নৌকো যাচ্ছে। নদীর একদিকের তীরে দেখা যাচ্ছে মানুষজন। একটা অশথ গাছ তলায় উবু হয়ে গোল হয়ে বসে আছে কিছু মানুষ। নদীতে কলসী ভাসিয়ে সাঁতার কাটছে দুটি বালিকা। দূর থেকে ভেসে আসছে মগরেবের আজানের সুমিষ্ট ধ্বনি, পাখিরা ঝাঁক বেঁধে বেঁধে কুলায় ফিরছে।
বাবুল হেলান দেওয়া অবস্থায় থেকে মঞ্জুর উরুতে হাত রেখে মিনতি করে বললো, বড় ভালো লাগছে, শুনাও একটা গান।
মঞ্জু তার স্বামীর হাতের ওপর হাত রেখে বললো, যাঃ! কী যে বলেন। এখন আমি গান গাইতে পারবো না। আমার লজ্জা করে।
বাবুল বললো, তুমি আমার দিকে ফিরে বসো। যদি চাও তো মাথায় ঘোমটা টেনে দাও, তারপর খুব ছোট গলায়, গুনগুন করে একটা গান ধরো। শুধু আমি শুনবো আর নদী শুনবে।
মঞ্জু বড় বড় চোখ মেলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো স্বামীর দিকে। তারপর বললো, গান গাইতে পারি, তুমি সত্যি কথা দাও, ঢাকায় গিয়ে তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে মেতে উঠবে না?
মিটিং করতে গিয়ে মাথা ফাটাবে না?
বাবুল বললো, না, আমি আর কোথাও যাব না। তোমাকে নিয়ে আর খোকাকে নিয়েই। মেতে থাকবো। তুমিই এখন আমার পৃথিবী। আঃ, দ্যাখো, আকাশের রং কী সুন্দর হয়েছে। নদীর দু’ধার কী শান্ত আমেজ মাখা। এখন কি মনে হয় কোথাও কোনো দুঃখ আছে? নদীর ওপর নৌকায় করে যাওয়ার মতন যদি জীবনটা হতো! আঃ, জীবনটা যদি এরকম হতো!
কে নদী থেকে এক আঁজলা জল তুলে সে বললো, দ্যাখো, কী পরিষ্কার পানি। আকাশের ছায়া পড়েছে। সত্যি মঞ্জু, জীবনটা যদি এরকম হতো!