ছাত্র বয়েসে প্রতাপের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মামুন। প্রতাপের মতন সে-ও পড়তে এসেছিল কলকাতায়। ঢাকা অনেক কাছে হলেও উচ্চশিক্ষার জন্য সচ্ছল পরিবারের ছেলেদের কলকাতায় পাঠানোই রেওয়াজ ছিল তখন। অনেকটা বিলেত পাঠাবার আগের ধাপের মতন।
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে প্রতাপ এসে ভর্তি হয়েছিল শিয়ালদার কাছে রিপন কলেজে। প্রতাপের ইচ্ছে ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার, কিন্তু তাতে ভবদেব মজুমদারের সম্মতি ছিল না। ওঁদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি ছিল ঐ রিপন কলেজের গায়েই, সেখানেই প্রতাপের থাকার ব্যবস্থা। কলকাতার রাস্তায় কত রকম বিপদ-আপদ, যখন তখন ট্রাম-বাস ঘাড়ের ওপর হুড়মুড় করে এসে পড়তে পারে। সুতরাং বাড়ির পাশে কলেজ পাওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
প্রেসিডেন্সি কলেজে না পড়তে পারার দুঃখটা প্রতাপের মনের মধ্যে অনেকদিন রয়ে গিয়েছিল। শিয়ালদা থেকে দূরত্ব অতি সামান্য। প্রতাপ তো পরে কতবার হেঁটে হেঁটেই কলেজ স্ট্রিটে গিয়েছে। তাছাড়া যে আত্মীয়ের বাড়িতে প্রথম ওঠা হয়েছিল, তিন মাসের বেশি সেখানে টেকা যায়নি। ওরা সকাল-বিকেলে জলখাবার দিত না। এক বিধবা মহিলা ছিলেন যেমন শুচিবায়ুগ্রস্ত তেমনি ঝগড়াটি, বাড়ির প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি পালা করে সারা দিন ধরে ঝগড়া চালিয়ে যেতেন। তাঁর গলার আওয়াজ শুনেই প্রতাপ ‘কাংস-বিনিন্দিত কণ্ঠ’ কথাটার মানে বুঝেছিল। অতিষ্ঠ হয়ে প্রতাপ সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস বাড়িতে। কিন্তু তখন আর প্রেসিডেন্সি কলেজে ট্রান্সফার নেবার সময় ছিল না।
সেকেণ্ড ইয়ারে এসে মামুনের সঙ্গে সৌহার্দ্য হয় প্রতাপের। শ্যামলা রঙের বড়সড়ো চেহারা, মুখোনা চৌকো মতন, সেই বয়েসেই যথেষ্ট দাড়ি-গোঁফ উঠেছে। আপাতত মামুনকে রুক্ষ স্বভাবের মনে হয়, তার মুখের ভাব কঠিন ও গম্ভীর, কিন্তু আসলে সে অতিমাত্রায় লাজুক। ক্লাসে এসে একেবারে লাস্ট বেঞ্চিতে সে বসে, প্রফেসারদের বক্তৃতার সময় সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সামনের দিকে, সহপাঠীদের সঙ্গে একটিও কথা বলে না। কমন রুমে কিংবা কলেজের সামনের ফুটপাথের আড্ডায় তাকে দেখতে পাওয়া যায় না কখনো। ক্লাস শেষ হলেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্লাসের ছেলেরা আড়ালে তার নাম দিয়েছিল মোল্লা।
প্রতাপ প্রথম থেকেই জনপ্রিয়। সহজাত ব্যক্তিত্বের জন্য সে যে-কোনো ছোট-খাটো দলের নেতার ভূমিকা পেয়ে যায়। বিশেষ কোনো চেষ্টা না করেই সে ম্যাগাজিন সাব কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে, কলেজের ফুটবল টিমেও সে স্থান পেয়েছে। তার বন্ধু বান্ধব অনেক।
ক্লাসে পাঁচজন মুসলমান সহপাঠী, তাদের মধ্যে দু’জনকে পোশাক দিয়েই চেনা যায়। তারা পরে চাপা পায়জামা ও কলিদার পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা রঙের টুপী, থুতনিতে নূর। তারা বাংলা বলে না। সবচেয়ে চাকচিক্যময় চরিত্র লুৎফর রহমানের, তাকে দেখতে পাক্কা সাহেবের মতন, তীক্ষ্ণ ধারালো মুখ, সে থ্রি পীস সুট পরে এবং বাড়ির শোফার-চালিত অস্টিন গাড়িতে চেপে কলেজে আসে। পার্ক সাকাসের এক বনেদী ধনী পরিবারের সন্তান সে, কথাবার্তায় দারুণ তুখোড়, ডিবেট কমপিটিশানে তার সামনে কেউ দাঁড়াতেই পারে না। এই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র পরেশ মুখার্জিকে লুৎফর রহমানের তুলনায় অনেক ম্লান মনে হয়।
লুৎফরকে ক্লাসের সবাই চেনে কিন্তু তার সঙ্গে কারুর ঠিক বন্ধুত্ব হয় না। সহপাঠীদের সে যেন একটু অবজ্ঞার চোখে দেখে, কেউ ঠিক তার ঘনিষ্ঠতার যোগ্য নয়, রূপে-গুণে সে অন্যদের চেয়ে অনেকখানি দূরত্বে আছে। হয়তো সে বয়েসেও খানিকটা বড়, তার ভাবভঙ্গিও বড়দের মতন। মাঝে মাঝে সে কায়দা করে বাঁ হাতটা ঘুরিয়ে মুখের সামনে এনে কজীবাঁধা ঘড়ি দেখে। বলে, আজ নেক্স্ট ক্লাসটা অ্যাটেণ্ড করতে পারছি না, আমাকে চলে যেতে হবে। আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
ধনীর দুলাল লুৎফর পার্ক সাকাস থেকে এত দূরের রিপন কলেজে পড়তে এসেছে কেন তার কারণ সে নিজেই জানিয়েছিল একদিন। এই কলেজে আছেন প্রফেসার বি ডি আইচ, তাঁর মতন ইংরিজি আর কেউ পড়াতে পারেন না, তাঁর কাছ থেকে খাঁটি ইংলিশ অ্যাকসেন্ট শেখবার জন্যই লুঙ্কর এত দূরের রিপন কলেজে এসেছে।
প্রফেসার বি ডি আইচের পড়ানো শুনলে প্রতাপের কিন্তু হাসি পেত। মানুষটি মধ্যবয়স্ক, চশমার লেন্স এত পুরু যে চোখ দেখা যায় না, মাথার চুল কাঁচা-পাকা ও অবিন্যস্ত, দাঁতে হলদে ছোপ। সারা বছরই তিনি কালো রঙের কোট প্যান্ট পরে আসেন, সে দুটির অবস্থাও জরাজীর্ণ। তিনি নাকি অক্সফোর্ডের ভালো ছাত্র ছিলেন, বিলেতে বহু বছর কাটিয়েছেন, কিন্তু তাঁর চেহারা ও পোশাক দেখলে ফুটপাতের ম্যাজিশিয়ান মিঃ ফক্সের কথা মনে পড়ে। ক্লাসে তিনি পারতপক্ষে বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেন না, তাঁর ইংরিজি শব্দগুলো শুনলে মনে হয় তিনি সাহেবদের ক্যারিকেচার করছেন। তাঁর ভাবভঙ্গিও অনেকটা নাটকীয়, রোলকলের খাতাটা হাতে নিয়ে তিনি ‘বয়েজ’ বলে প্রথমেই একটা হুংকার দেন, তারপর প্রায় এক মিনিট চুপ করে তাকিয়ে থাকেন সবার মুখের দিকে।
প্রথম দিনেই তিনি প্রতাপকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন। রোলকলের সময় প্রতাপ ‘ইয়েস স্যার’ বলতেই তিনি প্রতাপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চিবোনো ইংরিজিতে বলেছিলেন, বৎস, তোমার দেশ কোথায় : পদ্মার ওপারে? অমন বীভৎস উচ্চারণে ইংরেজি ভাষার ক্ষতি করো না। বলল, ইয়াস সা–। প্রতাপ সংশোধন করে বলেছিল, ইয়েস সার। বি ডি আবার ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আরও খারাপ হচ্ছে, বলো, ঈয়াস সা–। এইরকম পাঁচ ছ’বার চললো, প্রতাপ বুঝতেই পারলো না, তার কোথায় ভুল হচ্ছে।
আর একদিন তিনি পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে গোটা ক্লাসকে ইংরিজি full শব্দটির উচ্চারণ শিখিয়ে ছিলেন। বাংলা ফুল আর ইংরিজি full এক নয়। ইংরিজি full বলতে গেলে দাঁতের সামনে দিয়ে অনেকখানি হাওয়া ছেড়ে দিতে হয়। সবাইকে তিনি একসঙ্গে বলাতে লাগলেন, ফুল! ফুল! দাঁতের সামনে দিয়ে হাওয়া ছাড়ো! উহঁ ঠিক হচ্ছে না। আরও হাওয়া ছাড়ো! না, না, ফুল-ল নয়, ফুল! শেষ পর্যন্ত তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, সকলেই বড়জোর fool পর্যন্ত বলতে পারে, একমাত্র লুৎফর রহমানই full মার্কস পাওয়ার যোগ্য।
এই বি ডি স্যার একদিন মামুনকে ক্লাস থেকে বার করে দিয়েছিলেন, কারণ মামুন কিছুতেই অতি সাধারণ Gate শব্দটি উচ্চারণ পরতে পারছিল না, সে বারবার বলছিল গ্যাট। মামুন তারপর থেকে আর কোনোদিন বি ডি স্যারের ক্লাসে আসেনি।
অনেকদিন পর প্রতাপ জেনেছিল যে বি ডি স্যারের পুরো নাম বামনদাস আইচ, তাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ে ও অনেকগুলি পুষ্যি নিয়ে খুব অভাবের সংসার। তিনি লুৎফর রহমানের প্রাইভেট টিউটর। লুৎফরকে খুশী করবার জন্য তিনি প্রায়ই পরেশ আর বৈদ্যনাথ নামে দুটি ভালো ছাত্রকে হেনস্থা করতেন।
মামুনের আসল নাম সৈয়দ মোজাম্মেল হক। তার অন্য নামটি অনেকদিন পর্যন্ত জানা। যায়নি। ম্যাগাজিন প্রকাশ করার সময় যখন ছাত্রদের কাছ থেকে রচনা আহ্বান করা হয় তখন একটি দীর্ঘ কবিতা পাওয়া গেল যার তলায় কবির স্বাক্ষরের বদলে শুধু লেখা, মামুন, দ্বিতীয় বর্ষ বিজ্ঞান। ঐ নামের কোনো ছাত্রকে কেউ চেনে না। একদিন ক্লাস শেষ হবার পর প্রতাপ। অধ্যাপকের ডায়াসে উঠে জিজ্ঞেস করলো, সবাই শোনো, এই কবিতা কে পাঠিয়েছে। মামুন কে? কোনো উত্তর না পেয়ে সে কবিতাটি পড়তে শুরু করে দিল :
ভাঙিল না ঘুম ঘোর, পোহালো না রাতি
অজ্ঞান তিমিরে পড়ি আজও বঙ্গজাতি
জননীর খুন ধারা অশু হয়ে ঝরে
দুঃখীর আজান কেহ শুনে না অন্তরে।…
যদিও করুণ রসের কবিতা, তবু কৌতুক-প্রবণ যুবকেরা তা শুনে অট্টহাস্য শুরু করে দিল, প্রতাপের আর শেষ পর্যন্ত পড়াই হলো না। কেউ সেই রচনার পিতৃত্ব দাবিও করলো না।
প্রতাপ যদিও ম্যাগাজিন কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কিন্তু সে সাহিত্যের বিশেষ ধার ধারে না। তার ঝোঁক খেলাধুলোর দিকে। সে কবিতার ভালো-মন্দ বোঝে না, সে শুধু চেয়েছিল। কবিকে খুঁজে বার করে দীর্ঘ কবিতাটিকে হেঁটে এক পাতার মতন করে দিতে অনুরোধ জানাবে।
বৈদ্যনাথ নামে আর একটি চালু ছাত্র বললো, দেখি, দেখি হাতের লেখাটা চেনা যায় কি না।
কাগজটা নিয়ে পড়ার পর সে বললো, হ্যাঁ, চিনি, এ তো মোল্লার হাতের লেখা! সে-ও কবি নাকি? হেঃ! কাজী নজরুল আজকাল সব মোসলমান ছেলেগুলোর মাথা খাচ্ছেন! সবাই কবি হতে চায়। কবি না কপি, ছিঁড়ে ফেলে দে!
সেদিন সন্ধেবেলা প্রতাপ বৈঠকখানাবাজার থেকে পাটালি গুড় আর মাখন কিনে ফিরছে, মুসলমান পাড়া লেনের কাছে সে মামুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। এতদিন মামুনের সঙ্গে তার একটিও কথা হয় নি। এবারে মামুন নিজে থেকেই এগিয়ে এসে বললো, ভাই মজুমদার, তোমাকে একটা অনুরোধ করি। আমার কবিতাটি আমাকে ফিরৎ দাও। আমার কাছে কপি নাই। ও কবিতা ম্যাগাজিনে পাঠানো আমার ভুল হয়েছে। ও লেখা আমি সওগাত-এ পাঠাবো।
প্রতাপের বুকটা কেঁপে উঠেছিল। বৈদ্যনাথ যে তার কাছ থেকে লেখাটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে, এখন সে ফেরৎ দেবে কী করে? এই ছেলেটি বলছে, কপি রাখেনি। ছিঁড়ে ফেলাটা অন্যায় হয়েছে।
সে দোষ কাটাবার জন্য বললো, কেন ফেরৎ নেবে? ও কবিতা আমরাই ছাপাবো। আমি শুধু জানতে চাইছিলাম যে কে লিখেছে!
মামুন বললো, না, না, তার দরকার নাই। ও কবিতা তোমাদের ভালো লাগবে না, তোমরা ঠাট্টা করছিলে…
হঠাৎ মামুন মুখটা ফিরিয়ে নিল, প্রতাপ অত্যাশ্চর্য হয়ে দেখলো যে মামুনের চোখে জল এসে গেছে।
প্রতাপ নিজে কবিতা লেখে না, একটা কবিতা ছাপানো বা না-ছাপানোয় একজন কবির কী যে আনন্দ বা মর্মবেদনা তা সে বুঝবে না। সামান্য একটা কবিতার ব্যাপার নিয়ে যে সৈয়দ মোজাম্মেল হক-এর মতন একজন বলবান যুবক কেঁদে ফেলতে পারে, তা সে কল্পনাই করতে পারে নি।
সে মামুনের কাঁধে হাত রেখে জোর দিয়ে বললো, আরে, তুমি এমন ভেঙে পড়ছো কেন? তোমার কবিতা আলবাৎ ছাপা হবে। আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট…তবে ঐ কবিতাটা বড় লম্বা, চার পাতা লেগে যাবে, তুমি যদি দেড়/দু পাতার মধ্যে আর একটা দিতে পারো–।
সেই থেকে মামুনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। মামুন কুমিল্লার ছেলে, এখানে তার বন্ধু-সাথী বিশেষ। কেউ নেই। লোকজনের মাঝখানে সে চুপচাপ থাকলেও প্রতাপের কাছে সে অনেক কথা বলে। তার অনেক স্বপ্ন আছে।
মামুনের কবি-পরিচিতি রটে যাওয়ায় এরপরে ক্লাসে অনেক ঠাট্টাবিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। বিজ্ঞানের ছাত্রদের কবিতা লেখাটা যেন একটা অপরাধ! যদিও তাদের ইংরিজি বাংলা পড়তে হয়, কিন্তু ফিজিকস, কেমিস্ট্রি ম্যাথমেটিকসই তাদের আসল সাবজেক্ট। আর্টসের। ছাত্রদের সঙ্গে অনেক সময় তাদের ইংরিজি বাংলা কমবাইণ্ড ক্লাশ করতে হয়, তখন আর্টসের ছাত্ররা তাদের ইংরিজি বাংলা জ্ঞান নিয়ে ব্যঙ্গ করে। আর্টসের ছাত্রদের মধ্যে তিন চারজন গল্প কবিতা লেখে। সুবিমল নামে একটি ছেলে তো বেশ বিখ্যাত, তার তিনটি কবিতা ছাপা হয়েছে কল্লোল পত্রিকায়। এই সুবিমল আবার নজরুলের খুব ভক্ত। তার আর একজন আরাধ্য দেবতা হলো বুদ্ধদেব বসু নামে একজন তরুণ লেখক। সে প্রায়ই বলে, রবীন্দ্রনাথের যুগ শেষ, এখন। আধুনিকদের যুগ এসেছে!
সেই সুবিমল মামুনের কবিতার লাইন তুলে তুলে ছন্দের ভুল দেখায়। মামুনকে করুণার। পাত্র মনে করে সে উপদেশ দিয়ে বলে, ওহে, নজরুলের কবিতা আগে ভালো করে বুঝতে শেখো! কত বড় একখানা হৃদয় তাঁর। নজরুল শুধু হিন্দুর নয়, শুধু মুসলমানের নয়, তিনি এই নব্য বাংলার প্রধান মুখপাত্র। তিনি আমাদের যৌবনের ভাষা দিয়েছেন, বুঝলে? কিন্তু তাকে অনুকরণ করতে গেলেই তুমি ডুববে! তুমি মুসলমান বলেই যে নজরুলের অনুকরণ করবে তার কি কোনো মানে আছে? নজরুল রক্তের বদলে খুন শব্দটা ব্যবহার করেছেন বলে তোমাকেও করতে হবে?
এই সব তর্কের সময় প্রতাপ বিশেষ কিছু না বুঝেও মামুনের পক্ষ নেয়। তার কারণ সুবিমলের হামবড়া ভাবটা তার ভালো লাগে না। সুবিমলের চাঁছাছোলা উচ্চারণের কথাবার্তাও অনেকটা দূরত্ব এনে দেয়, সেই তুলনায় লাজুক স্বভাবের মামুনকে তার আপন মনে হয়।
শেষ পর্যন্ত এমন হলো যে একটুক্ষণের জন্যও দুজনে দু’জনকে ছেড়ে থাকতে পারে না। কলেজের পরেও দু’জনে একসঙ্গে ঘোরে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় বা থিয়েটার-বাইস্কোপ দেখতে যায়, অথবা পার্কে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকে। কী সুন্দর ছিল তখন কলকাতা শহর। রাস্তাগুলি ঝকঝকে তকতকে, দু’বেলা করপোরেশানের লোক সব রাস্তা ধুয়ে দিয়ে যায়। কোনো বাড়ির রং নষ্ট হয়ে গেলে বা অনেকদিন মেরামত না হলে বাড়ির মালিককে করপোরেশান নোটিশ দেয়। ট্রামগুলি ঘোট ঘোট স্টিমারের মতন, যেন জল কেটে এগিয়ে আসে। দুপুরের দিকে ফাঁকা ট্রামে ঘুরে বেড়ানোটাই একটা আনন্দের। দু’ পাশের দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেই জুড়িয়ে যায় চোখ।
একদিন ওরা দু’জনে মিলে ‘ধ্রুব’ নামে একটা বাইস্কোপ দেখতে গেল। তখন টকি চালু হয়ে। গেছে, বাইস্কোপের পাত্র-পাত্রীরা কথা বলে, গান গায়। ধুতি পরা নারদমুনি যে-ই গান গাইতে গাইতে ঢুকলো অমনি মামুন উত্তেজিত ভাবে বললো, নারদ কে সেজেছেন জানিস? উনি কাজী নজরুল ইসলাম!
প্রতাপ অবাক। কবি নজরুল যে বাইস্কোপেও পার্ট করেন তা তার জানা ছিল না, এর আগে সে নজরুলের গান শুনেছে বটে। বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিস নে আজি দোল’, এই গানখানি তো সকলের মুখে মুখে।
মামুন পর পর তিনবার দেখলো ঐ ধ্রুব বাইস্কোপ, তবু তার আশ মেটে না। সে বললো, প্রতাপ, একদিন নজরুলকে দেখতে যাবি, উনি তো এখন কলকাতাতেই আছেন শুনেছি। যাবি? আমার একা যেতে সাহস হয় না!
খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে কবি নজরুল এখন আছেন উনচল্লিশ নম্বর সীতারাম রোডে, তা ছাড়া তিনি ‘কলগীতি’ নামে একটি রেকর্ডের দোকানও খুলেছেন। ভেবে চিন্তে দোকানে দেখা করাই ঠিক হলো। কিন্তু পর পর চারদিন সেই দোকানে গিয়েও কোনো সুবিধে হলো না। দোকানে অন্য কর্মচারী বসে, কবি রোজ আসেন না। পঞ্চম দিনে আকস্মিক ভাবে সাক্ষাৎ। ওরা দু’জনে ‘কলগীতি’ থেকে রেকর্ড দেখে বেরিয়ে আসছে, এমন সময় বাইরে থামলো একটি বিরাট ক্রাইসলার গাড়ি, তার থেকে যিনি নামলেন তাঁকে দেখা মাত্র ওদের চিনতে ভুল হলো না।
হাবিলদার কবি এতদিনে বেশ মোটাসোটা, নাদুসনুদুস হয়েছেন, মাথায় বাবড়ি চুল, চোখ দুটি টানা টানা, মনে হয় সুমা লাগানো, মুখ ভর্তি পান। তাঁর পাঞ্জাবিটি কমলা রঙের, সেই রঙেরই একটা উড়ুনি কাঁধের ওপর ফেলা। কবি এই দুটি যুবককে দেখতে পেলেন না, দোকানে ঢুকে গেলেন।
প্রতাপ মামুনকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বললো, যা, কথা বল!
কিন্তু মামুনকে এখন রাজ্যের লজ্জা পেয়ে বসেছে, সে এগোতে পারছে না, সে বললো, প্রতাপ, তুই আগে কথা বল।
প্রতাপ কী কথা বলবে? সে তো কবিতা বিষয়ে কিছু জানে না। সে ঠেলতে লাগলো। মামুনকে, মামুনও কিছুতেই যাবে না। এই রকম যখন চলছে তখন নজরুল আবার বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে।
এবারে দু’জনে বসে পড়ে ঝুপঝুপ করে প্রণাম করলো তাঁর পায়ে হাত দিয়ে। কবি একটু যেন অন্যমনস্ক, তিনি প্রতাপের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে, মোতাহারের ব্যাটা না?
প্রতাপ বললো, আজ্ঞে না।
নজরুল উদাসীন ভাবে বললেন, ও। ভালো থাকো। ভালো থাকো।
তারপর উঠে গেলেন গাড়িতে।
প্রতাপ বললো, মামুন, তুই কী রে, এত কাছে পেয়েও কথা বললি না?
মামুন তখনও যেন উত্তেজনায় কাঁপছে। সে বাষ্পচ্ছন্ন গলায় বললো, প্রণাম করতে পেরেছি, এই তো ঢের!
খানিকদূর যাবার পর মামুন আবার বললো, প্রতাপ, এমন ভাবে একদিন কবিগুরুকে প্রণাম করে আসতে পারি না? সুবিমলরা যাই বলুক, রবীন্দ্রনাথই এখনো আমাদের কবি সম্রাট। জোড়াসাঁকো কত দূরে রে?
এর পরের কয়েকদিনে জোড়াসাঁকো যাওয়ার পথের সন্ধানও জেনে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কবিগুরুর দর্শন লাভের জন্য আর যাওয়া হলো না। ঝপ করে পূজোর ছুটি পড়ে গেল।
সুহাসিনী শপথ করে নিইয়েছিলেন, প্রতাপ প্রতি সপ্তাহে একখানি করে চিঠি লিখবে আর বছরে অন্তত তিনবার দেশের বাড়িতে যাবে। প্রতাপকে কলকাতায় পড়তে পাঠানোতে সুহাসিনীর আপত্তি ছিল। তাঁর একমাত্র পুত্র, তাকে ছেড়ে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেন না। প্রতাপেরও দেশের বাড়ির জন্য মন ছটফট করে। কিন্তু এবারে পূজাবকাশের দীর্ঘ এক মাস মামুনকে ছেড়ে থাকতে হবে, এই চিন্তাটাও বড় কষ্টকর। শেষ পর্যন্ত একটা রফা হলো।
ছাত্র আন্দোলনের জন্য এবার সাতদিন আগেই পূজোর ছুটি দেওয়া হয়েছে। প্রতাপ এই সাত দিন মামুনের সঙ্গে গিয়ে কুমিল্লায় তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারে। আবার ছুটি শেষ হবার সাতদিন আগে মামুন চলে আসতে পারে প্রতাপদের বাড়ি মালখানগরে।
শিয়ালদা থেকে প্রতাপ আর মামুন এক সঙ্গেই ট্রেনে চেপে বসলো। কুমিল্লায় দায়ুদকান্দি থেকে মাইল পাঁচেক দূরে মামুনদের গ্রাম।
সময় তো দর্পণের মতন থেমে থাকে না, সময় নদীর স্রোতের মতন বয়ে চলে। তবু দর্পণের প্রতিবিম্বের মতন এক একটি ছবি সময়ের স্রোতের মধ্যেও স্থির হয়ে থাকে।