ওমা, ঐ ছেলেটা মুসলমান বুঝি? আমি তো ভেবেছিলুম ও বাঙালী!
জীবনে এই কথাটা অনেকবারই অনেক জায়গায় শুনতে হয়েছে মামুনকে, কিন্তু বিনয়ের মা যখন আচমকা বলে উঠেছিলেন, তখন বাক্যটি শেলের মতন মামুনের বুকে বিঁধেছিল। আজও সেই ক্ষত পুরোপুরি মিলিয়ে যায় নি।
আজ সকালে মাদারিপুর টাউন থেকে তিনটি নবীন যুবক এসেছিল মামুনের সঙ্গে দেখা করতে। তরতাজা, উৎসাহে ভরপুর মুখ, স্বপ্নমাখা চোখ। ওদের নাম সামসুল হুদা মণি, আবু সাদেক বাচ্চু আর হাশমী মোস্তাফা কামাল। ওরা ‘নদী মাতৃক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে, সেই পত্রিকার একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্য ওরা মামুনের সাক্ষাৎকার ছাপতে চায়। তিন বছর আগে ভাষা আন্দোলন ও বিক্ষোভের সঙ্গে মামুন যে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, ঢাকায় সেই ভয়ঙ্কর, উত্তাল একুশে ফেব্রুয়ারির গুলি চালনার সময় তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী, এসব কী। করে যেন ওরা জেনে ফেলেছে।
প্রায় ঘণ্টা দু’এক ওদের সঙ্গে কাটালেন মামুন। নিজের জীবনের কথা বলার চেয়ে তিনি। ওদের জীবনের কথা জানতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। চমৎকার ছেলে তিনটি, মণি আর বাচ্চু সদ্য বি এ পাস করেছে, আর কামাল একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। ওদের চিন্তা খুব পরিচ্ছন্ন, এরাই তো নতুন দেশ গড়বে।
ওরা চলে যাবার পর হঠাৎই বিনয়ের মায়ের ঐ উক্তিটা মনে পড়লো। সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেকার ছাত্রজীবনের কথা।
বিনয়েন্দ্র সান্যালের সঙ্গে এক সময় বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, ওদের বাড়িতে মামুন, প্রতাপ আরও অনেকে যেতেন আড্ডা দিতে। তিন তলার একটি ঘরে খুব ক্যারাম খেলা হতো। অনেক রকম! খাবার দাবার আসতো, বিনয়েন্দ্রদের বর্ধমানের দেশের বাড়ি থেকে আসতো নানা রকম ফল, বিনয়ের মা ছেলের বন্ধুদের পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। প্রতাপ-মামুনরা মেসে-হোস্টেলে থাকতেন, এরকম একটা বাড়ি বাড়ি পরিবেশের জন্য তাঁদের মধ্যে আকুলতা ছিল। মামুনের চেহারা, পোশাক, ভাষা এমনকি ডাকনামটা শুনেও বিনয়ের মা বুঝতে পারেন নি যে ঐ ছেলেটি মুসলমান। একদিন মামুন এক বাক্স সন্দেশ নিয়ে গিয়ে বিনয়েন্দ্রকে বলেছিল, তোর মা-কে বল সবাইকে ভাগ করে দিতে, কাল আমাদের শবে বরাত পরব ছিল। তাই শুনেই বিনয়ের মা তাঁর দেবীপ্রতিমার মতন সুন্দর মুখোনিতে সুগভীর বিস্ময় ফুটিয়ে। বলেছিলেন, ওমা, ঐ ছেলেটা মুসলমান নাকি, আমি তো ভেবেছিলুম ও বাঙালী!
কথাটা শোনা মাত্র বিনয়ের মায়ের মুখখানাকে মনে হয়েছিল কালিমাচ্ছন্ন, বীভৎস। চোখটা ফিরিয়ে নিয়ে মামুন তিক্ততার সঙ্গে মনে মনে বলেছিলেন, মুসলমানরা বাঙালী নয়, তা হলে বাঙালী কে? মুসলমানরা তা হলে ভারতীয়ও নয়, তারা শুধু মুসলমান!
বিনয়ের বাবা সুরেশ্বর সান্যাল ছিলেন কংগ্রেসের একজন মাঝারিগোছের নেতা। তাঁর বাড়িতেও এই রকম মনোভাব। সুতরাং সেই সময়ে জিন্না-নাজিমুদ্দিনেরা যে তারস্বরে বলছিলেন, কয়েকটি মুশলিম লেজুড় থাকলেও, ভারতীয় কংগ্রেস হচ্ছে আসলে হিন্দুদের পার্টি, সে কথা মামুন পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেন নি।
বিনয়ের মা অবশ্য মামুনের ধর্ম-পরিচয় জানবার পর তাঁর জন্য চায়ের কাপ আলাদা করে দেননি। ব্যবহারে কোনো বৈষম্যও ঘটাননি। সেরকম অভিজ্ঞতা মামুনের হয়েছে অন্যত্র।
একবার উত্তর কলকাতায় একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন শুনতে গিয়ে সারা রাত জাগার পর মামুন আর প্রতাপ গিয়েছিলেন একটা কচুরি-সন্দেশের দোকানে নাস্তা করতে। দোকানে ঢুকেই বাঁ দিকের টেবিলে বসে থাকা মালিককে মামুন হালকাভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি মুসলমান, আমায় এখানে খেতে দেবেন তো? মালিকের কপালে চন্দনের তিলক, মাথায় একটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট টিকি, মুখখানা আজও মনে আছে মামুনের, সেই মালিক ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বলেছিল, হ্যাঁ, ঠোঙায় খাবার দিচ্ছি, তবে জলের গেলাসে হাত দিও না ভাই, বাইরে। দাঁড়াও, আমি তোমায় হাতে জল ঢেলে দেবো।
অত সকালে কাছাকাছি আর কোনো দোকান খোলে নি, খিদেও পেয়েছিল খুব। খাবারের ঠোঙা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসে প্রতাপ আর মামুন রাস্তায় করপোরেশনের কলে জল। খেয়েছিলেন। প্রতাপ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুই নিজে থেকে ঐ কথা বলতে গেলি কেন? মামুন বলেছিলেন, আত্মপরিচয় গোপন করা কি সম্মানজনক?
আর একবার ঐ উত্তর কলকাতাতেই একটা খাবারের দোকানের সামনে ঝোলানো একটা বাঁধানো ফটো আর তার নিচে লেখা কিছু সগর্ব ঘোষণা দেখে মামুনের খটকা লেগেছিল। ফটোটি কিরানা ঘরানায় বিখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁর। ছবির তলায় লেখা, “সঙ্গীত সম্রাট আবদুল করিম খাঁ সাহেব অনুগ্রহ করিয়া আমাদের দোকানে পদার্পণ করিয়াছিলেন এবং আমাদের সকল প্রকার খাদ্য আস্বাদন করিয়া পরম সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন।” সেই লেখা দেখে মামুনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ওরা কি খাঁ সাহেবকে পানির গেলাস দিয়েছিল, না দেয় নি?
মামুনের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া প্রতাপ পছন্দ করেন নি। সত্য এবং মিথ্যা সম্পর্কে। প্রতাপের মনোভাব কঠোর। প্রতাপ ঘৃণার সঙ্গে নাক কুঁচকে বলেছিলেন, এঃ, রাজনীতির লোকগুলো যখন তখন মিথ্যে কথা বলে। আমার তো ওদের ধারকাছ মাড়াতে ইচ্ছে করে না। মামুন স্বীকার করেছিলেন যে রাজনীতির লোকদের মাঝে মাঝে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয় বটে, কিন্তু তা ঠিক মিথ্যে নয়, কূটনীতি।
উত্তরকালে লীগ মিনিস্ট্রির আমলে যখন বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছিল, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বঞ্চিত করে মুসলমানদের এক তরফাভাবে সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল তখন একদিন তীব্র কথা কাটাকাটি হয়েছিল প্রতাপের সঙ্গে মামুনের। কলকাতার উপকণ্ঠে একটি সরকারি কলেজে অধ্যাপক নিয়োগের অদ্ভুত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তর্ক শুরু হয়েছিল। সেই অধ্যাপকপদে প্রার্থী ছিল এম এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া একজন হিন্দু যুবক, তাকে সেই চাকরি না দিয়ে দেওয়া হলো থার্ড ক্লাস পাওয়া একজন মুসলমানকে। তা নিয়ে কাগজে কাগজে খুব হই-চই, কাউনসিলেও প্রশ্ন উঠেছিল। উত্তরে ঢাকার নবাব বংশের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, হ্যাঁ, জেনে শুনেই এটা করা হয়েছে। ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে একজন মুশ্লিমকেই ঐ পোস্ট দিতে হবে, ফার্স্ট ক্লাস বা সেকেণ্ড ক্লাস পেলে তো ভালো কথা, নইলে থার্ড ক্লাসও চলবে।
প্রতাপ মামুনকে বলেছিলেন, তুই এইসব নোংরামিকেও সমর্থন করবি? এই সবের সঙ্গে তোর নাম যুক্ত রাখতে চাস?
মামুন বলেছিলেন, দ্যাখ প্রতাপ, লেখাপড়ার ক্ষেত্রে, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুরা অনেক কাল ধরে, অনেক রকম সুযোগ-সুবিধে পেয়েছে, এটা তো স্বীকার করবি? মুসলমানরা এতদিন কী পেয়েছে, বল? হিন্দু-মুসলমান সব রকম যোগ্যতায় সমান সমান না হলে মিলে মিশে থাকতে পারবে না। তারা এখন ধৈর্য ধরে মুসলমানদের খানিকটা এগিয়ে যেতে দে। এই রকম সময়ে দু’চারটে বাড়াবাড়ির ঘটনা তো ঘটবেই।
প্রতাপ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি যে হিন্দু সে কথা আমার মনেই থাকে না, তোরাই এখন বারবার সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছিস!
তর্ক থামিয়ে প্রতাপের পিঠে চাপড় মেরে মামুন বলেছিলেন, তুই অত রেগে যাচ্ছিস কেন? দে, একটা সিগারেট দে!
প্রতাপের ওপরেও যে তখন সরকারিভাবে অবিচার করা হয়েছে, তা মামুন সে সময়ে ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, জেনেছিলেন অনেক পরে। প্রতাপ তখন মুনসেফের চাকরি করছেন, প্রতাপের চেয়ে অনেক জুনিয়র একজন মুসলমান মুনসেফকে ভালো পোস্টিং দিয়ে প্রতাপকে ট্রান্সফার করা হয়েছে দূর মফস্বলে, জায়গাটা সবাই শাস্তির ট্রান্সফার হিসেবে গণ্য করে। প্রতাপ নিজের প্রসঙ্গ একবারও মামুনের কাছে উত্থাপন করেননি। মামুন তখন জানতে পারলে সরকারি উঁচু মহলে ধরাধরি করে নিশ্চয়ই প্রতাপের জন্য একটা ভালো পোস্টিং-এর ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। খোদ ফজলুল হকের সঙ্গেই মামুনের ভালো সম্পর্ক ছিল।
উনিশ শো সাঁইত্রিশ সালে বাংলা দেশের মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। এসেছিল নতুন আশা ও উদ্দীপনার জোয়ার। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে জেগে উঠলো একটা অধিকার বোধ। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে হলে নির্বাচন।
নতুন ধাঁচে গড়া বাংলার বিধানসভায় মোট সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট হলো ২৫০ জন। তার মধ্যে মুসলমান সদস্য থাকবে ১১৭, ইংরেজ বাসিন্দা ১১, ব্যবসায়ী ১৯ (এর মধ্যেও আবার পনেরো-ষোলোটিই ইংরেজ), অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ৩, ভারতীয় খৃষ্টান ২, জমিদার শ্রেণী ৫, শ্রমিক ৮, বিশ্ববিদ্যালয় ২, নারী প্রতিনিধি ৫, এবং সাধারণ ৮২। এই সাধারণের মধ্যে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পারসী ও ইহুদী, আবার এই সাধারণের মধ্যেও ৩০টি আসন সংরক্ষিত রইলো সিডিউল্ড কাস্টদের জন্য। অর্থাৎ বাঙালী বর্ণহিন্দুদের অধিকার সীমাবদ্ধ রইলো মোটামুটি ৫২টি আসনের মধ্যে।
ইংরেজ পরিকল্পিত এই কমুউনাল অ্যাওয়ার্ড যে বাংলার বর্ণ হিন্দুদের জব্দ করার জন্যই তৈরি হয়েছিল তা অত্যন্ত নগ্নভাবে স্পষ্ট। এমন ব্যবস্থা পাকা করা হলো যাতে ঐ হিন্দুরা কোনো ক্রমেই শাসনক্ষমতায় আসতে না পারে। এই হিন্দুরাই প্রথম পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তারপর রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়েছে, এরাই তুলেছে স্বাধীনতার দাবি। এদের মধ্য থেকেই এসেছে বিপ্লবীরা, বোমা-পিস্তলে সাহেবদের ঘায়েল করতে পিছু পা হয় নি। সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে এদেরই মুখ্য ভূমিকা। সাহিত্যে, সঙ্গীতে এরা অনবরত ছড়াচ্ছে স্বদেশী চেতনা, ওদের টিট করতে ইংরেজ সরকার বদ্ধপরিকর।
এই কমুন্যাল অ্যাওয়ার্ডে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধে পেয়ে মুসলমান সমাজ খুশী মনে চুপ করে গেল। শিক্ষিত, জাতীয়তাবাদী মুসলমানদেরও ধারণা হলো যে অবহেলিত মুসলমান সমাজকে এগিয়ে আনার জন্য এখন এইরকম কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা পাওয়ার প্রয়োজন আছে। ক্রুদ্ধ হিন্দুরা তুলল বিক্ষোভের ঝড়। টাউন হলের সভায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসে এই অন্যায্য ভাগাভাগির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ জানালেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আমল থেকে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালীর ধারণা ছিল বাংলা দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হবে না কখনো, হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ইংরেজের মুখোমুখি হবে।
কিন্তু হাওয়া এখন অনেক বদলে গেছে। মুসলিম লীগের হয়ে জিন্না সাহেব প্রায় একাই লড়ে যাচ্ছেন কংগ্রেসের সঙ্গে। তিনি তাঁর চোদ্দ দফা দাবির মধ্যে জানালেন যে হিন্দুদের ওসব চাচামেচি চলবে না, সাম্প্রদায়িক বরাদ্দ যেরকম দেওয়া হয়েছে সেরকমই মেনে নিতে হবে, আর কোনো দরাদরির প্রশ্ন ওঠে না। দ্বিধাগ্রস্ত কেন্দ্রীয় কংগ্রেসী নেতৃত্ব না-গ্রহণ না-বর্জন নীতি নিয়ে নীরব।
হয়ে গেল সাঁইতিরিশ সালের নির্বাচন।
বাংলার মুসলমান কিন্তু তখনো পুরোপুরি লীগ-সমর্থক হয়নি। তারা তাদের বাঙালী-স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে চায়। মুশলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনাব ফজলুক হক জিন্নার সঙ্গে মতবিরোধে তখন লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, তিনি গড়েছেন কৃষক প্রজা দল, অসাধারণ। তাঁর জনপ্রিয়তা। মুশলিম লীগের সঙ্গে নয়, কংগ্রেসের সঙ্গেই তিনি হাত মেলাতে উৎসাহী। অন্যান্য অনেক মুসলমানও তখন মুশলিম লীগের বাইরে নানা উপদলের সঙ্গে যুক্ত।
ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, কংগ্রেস ৪৮টি সাধারণ আসনে প্রার্থী দিয়ে পেয়েছে ৪৩টি, তপশিলি ও শ্রমিক আসন থেকে আরও কিছু পেয়ে মোট ৫৪টি আসন। ফজলুল হকের কৃষক। প্রজা পার্টি পেয়েছে ৪৪টি আসন, মুশলিম লীগও প্রায় সমান সমান, অন্যান্য মুসলমানেরা এসেছেন নির্দল বা ছোট ছোট উপদলের সদস্য হয়ে।
কংগ্রেসের পক্ষে একা সরকার গড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কোয়ালিশান গড়ার জন্য ফজলুল হক কংগ্রেসকে আহ্বান জানালেন। শরৎ বোসকে তিনি বললেন, লীগকে হঠিয়ে রাখার জন্য আসুন আমরা মিলে মিশে সরকার চালাই।
কিন্তু সর্বভারতীয় কংগ্রেস থেকে নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, যে-যে রাজ্যে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় নি, সেই সেই রাজ্যে কংগ্রেস অন্য কোনো দলের সঙ্গে আঁতাত করে শাসন-ক্ষমতা নেবে না। তার ফলে, ভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলিতেই শুধু কংগ্রেসী শাসন প্রবর্তিত হলো। বাংলা-পাঞ্জাব-আসাম-সিন্ধু প্রদেশ সম্পর্কে যেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। মুসলমানদের মধ্যে আবার এই ধারণা বদ্ধমূল হলো যে কংগ্রেস আসলে হিন্দু পার্টি।
একাধিক বৈঠকের পরেও ব্যর্থ হলো শরৎ বোস-ফজলুল হকের আলোচনা। আহত চিত্তে ফজলুল হককে শেষ পর্যন্ত মুখ ফেরাতে হলো মুশলিম লীগের দিকে।
পটুয়াখালির এক নির্বাচনী সভায় ফজলুল হক নাজিমুদ্দিনের মুখের ওপর বলেছিলেন, তিনি কোনোদিন মিরজাফর আর ক্লাইভের বংশধরদের সঙ্গে হাত মেলাবেন না। কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই বাড়ালেন, শুধু হাত নয়, মুণ্ডুটাও। ফজলুল হক আগে থেকেই অবশ্য একজন উমিচাঁদকে পুষে রেখেছিলেন। মুসলমানদের দুটি দল কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুশলিম লীগের গলা জড়াজড়ি করিয়ে দেবার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন একজন হিন্দু। এই যুগের এই উমিচাঁদ হলেন ধুরন্ধর ব্যবসায়ী এবং রাজনীতির পাশা খেলোয়াড় নলিনীরঞ্জন সরকার।
মামুনের মনে আছে সেই রাত্রিটার কথা। সার্কুলার রোডে নলিনীরঞ্জন সরকারের “রঞ্জনা। নামে প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে সেদিন সন্ধে থেকেই সাংবাদিক ও উৎসুক জনতার কি ভিড়! মামুনও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। বাড়ির মধ্যে নলিনীবাবুর মধ্যস্থতায় লীগের নেতাদের সঙ্গে হক সাহেবের বৈঠক চলছে। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে যায়, তখনও কী হয় কী হয় ভাব। সুযোগ বুঝে মুশলিম লীগ নিজেদের কোলে ঝোল টানবার জন্য প্যাঁচ কষছে।
একসময় দেখা গেল সহাস্য মুখে নেমে আসছেন লীগ পক্ষের খাজা নাজিমউদ্দীন ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং গৃহস্বামীর সঙ্গে হক সাহেব। ঘোষণা করা হলো যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে, কৃষক প্রজা দল ও মুশলিম লীগ মোচায়, ইওরোপিয়ানদের সমর্থনে গঠিত হচ্ছে নতুন সরকার।
কিন্তু বাংলার প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? সেই আসনটা কী মুশলিম লীগ নিয়ে নিল? সেটা জানার জন্যই তো মামুনরা অতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। আবার ঘোষণা করা হলো, এই সংযুক্ত মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন আবুল কাসেম ফজলুল হক।
উল্লাসের জয়ধ্বনি ও নাচানাচি শুরু হয়ে গেল বাইরে। মান্নান নামে একজন সহকর্মী মামুনকে সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এইবার আমাদের দিন এসে গেছে! মুসলমানরা বাঙালী নয়? এইবার দ্যাখ শালারা, কারা আসল বাঙালী! কারা বাংলা দেশটা চালাবে!
সেই দিন সেই মুহূর্তে মান্নানের ঐরকম উচ্ছাসে মামুন কোনো দোষ খুঁজে পান নি, বরং তাঁর ভালোই লেগেছিল! আনন্দের আতিশয্যে সারা রাত তাঁদের ঘুম হয় নি।
নতুন বিধানসভায় কংগ্রেসীরা হলো বিরোধী দল অর্থাৎ বামপন্থী, সে দলের সদস্যরা বসলেন স্পীকারের বাঁ দিকে। কংগ্রেসীরা অনেকেই রাজনীতিতে পুরোনো এবং পরিচিত মুখ। কিন্তু সভার চেহারা খুলে দিলেন নতুন মুসলমান সদস্যরা।
‘নদীমাতৃক’ পত্রিকার জন্য ছেলেদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মামুন একটা কথা বলতে ভুলে গেছেন। এখন মনে পড়লো। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালী মুসলমানরা বাহান্ন সালেই প্রথম আন্দোলন করেন নি, আটচল্লিশ সালে জিন্না সাহেবের মিটিং-এর ঘটনাও প্রথম নয়, তারও অনেক আগে, সেই সাঁইতিরিশ সালেই বাঙালী মুসলমানরা এই দাবি তুলেছিলেন।
সেই অবিভক্ত বাংলার বিধানসভায় নব নির্বাচিত মুসলমান সদস্যরাই ছিল প্রথম খাঁটি বাঙালী। এর আগে রাজনীতিতে আসতেন শুধু বড় বড় জমিদার, উঁকিল ব্যারিস্টার বা রায় বাহাদুর, খান বাহাদুররা। তাঁদের পোশাক হয় সাহেবী অথবা চোগা চাপকান। মুখের ভাষা সব সময়েই ইংরেজি। কিন্তু গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্বাচিত মুসলমান প্রতিনিধিরা বিধান পরিষদে নিয়ে এলেন বাংলা ভাষা। লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি পরে আসতেও তাদের দ্বিধা নেই। পশ্চিম বাংলার দিকের মুসলমানরা তো ধুতিও পরেন নিয়মিত। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য বাংলা ভাষায় পেশ করতে লাগলেন। তখন নিয়ম ছিল কোনো সদস্য বাংলায় বক্তৃতা করলে তা রেকর্ড করা হতো না, বক্তব্যের সারাংশ ইংরিজিতে তর্জমা করে দিতে হতো। তাই সই, তবু তাঁরা বাংলায় বলবেনই।
বাঙালী হিন্দু নেতারা ততদিনে খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি ধরেছেন বটে কিন্তু বক্তৃতার সময় হংরিজির ফোয়ারা ছোটান। কে কী বললেন, সেটা যেন বড় কথা নয়, কে কত জোরালো ইংরজির তুবড়ি ছোটাতে পারেন সেটাই যেন গর্বের বিষয়। হিন্দু নেতাদের মধ্যে এরকম একটা ইনিমন্যতা ছিল যে সর্বসমক্ষে বাংলা বললে লোকে যদি ভাবে যে লোকটা ইংরিজি জানে না! শিক্ষিত মুসলমানদের ও বালাই নেই, যাঁরা ইংরেজিতে ভালো বলতে পারেন, যেমন খুলনার সদস্য জালালুদ্দিন হাসেমী ইংরেজি বাংলা দু’ভাষাতেই সমান ভালো বক্তা, তাঁরাও ইংরজি ছেড়ে প্রায়ই শুরু করতেন বাংলায়। স্বয়ং ফজলুল হক ছিলেন শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকের চেয়েই উঁচুতে, তিনি মাঝে মাঝেই ইংরিজির বদলে শুধু বাংলা নয়, একেবারে খাঁটি বরিশালী বাঙাল ভাষায় কথা বলতেও দ্বিধা করতেন না।
মাতৃভাষার সঙ্গে আত্মসম্মানের যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক সে কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার জানাবার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দু বাঙালীই বোঝে নি। কিন্তু বাংলার মুসলমানদের মধ্যে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষার টান তখন থেকেই জেগে উঠেছে।
আটচল্লিশ সালে ঢাকায় জিন্না সাহেবের সেই উর্দু চাপানো বক্তৃতার অনেক আগের একটা ঘটনা মামুনের মনে পড়ে। এটা বোধহয় এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেকেই জানে না। সেবারে বহরমপুরে মুশলিম কাউনসিলের প্রাদেশিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করতে এসেছিলেন জিন্না। গ্রাম বাংলা থেকে হাজার হাজার মুসলমান এসেছে কায়েদ-ই-আজম জিন্না সাহেবকে দেখবার জন্য। পোশাক-পরিচ্ছদ ও আদব-কায়দায় খাঁটি সাহেব তিনি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কঠোর ভাবলেশহীন মুখ। সভাপতি হিসেবে তিনি সভার অনুষ্ঠানসূচী হাতে তুলে নিলেন। প্রথমেই রয়েছে উদ্বোধনী সঙ্গীত, গাইবেন আব্বাসউদ্দীন। জিন্না নির্দেশ দিলেন, নো মিউজিক!
বিস্ময়ের ঘোর কাটাবার জন্য কয়েক মুহূর্ত সবাই স্তব্ধ হয়ে ছিল। তারপরেই শুরু হলো হই। হট্টগোল। আব্বাসউদ্দীনের গান হবে না। এ আবার কী রকম কথা? তা হলে সভা চলতেই দেওয়া হবে না। জিন্না বুঝতেই পারেন নি যে আব্বাসউদ্দীন নামে কে একটা লোক বাংলার মানুষের কাছে এতখানি জনপ্রিয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি রাজি হলেন। সভা শুরু হবার আগে আব্বাসউদ্দীন শোনালেন পর পর তিনখানা গান।
বাংলার মুশলিম লীগের দুই প্রধান নেতা নাজিমউদ্দীন এবং সোহরাওয়ার্দী অবশ্য ভালো করে বাংলায় কথাই বলতে পারেন না। সাহেবসুবো এবং অবাঙালী ব্যবসায়ী শ্ৰেণীদের সঙ্গেই তাঁদের দহরম মহরম। সাহেবরাই তখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুশলিম লীগকে খেলাচ্ছে। বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখে পাঞ্জাব ও সিন্ধু থেকে বড় বড় মুসলমান ব্যবসায়ীরা এসে ঘাঁটি গাড়ছে কলকাতায়, তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলা দেশে। জিন্না সাহেবও কলকাতায় এলে ইস্পাহানি, আদমজী, হাজি দাউদ প্রমুখ অবাঙালী মুশলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই ওঠাবসা করতেন। শক্তিশালী অবাঙালী মুসলমান গোষ্ঠী কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের পরিকল্পনা তখন থেকেই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে।
মামুন সেই সময় ইচ্ছে করলেই নির্বাচনে দাঁড়াবার টিকিট পেতেন, ফজলুল হকের খুব প্রিয় ছিলেন তিনি, কিন্তু কখনো তাঁর ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রবেশ করার ইচ্ছে হয় নি। ফজলুল হকও তাঁকে অন্য উপদেশ দিয়েছিলেন।
ঝাউতলার বাড়িতে বসে একদিন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফজলুল হক সাহেব মামুনকে বলেছিলেন, জানোস তো, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় আমি জেলার মধ্যে ফাস্ট হইছিলাম? কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসে দেখি একটাও মুসলমান সহপাঠী নাই, সব হিন্দু। গ্রামের ইস্কুলে মুসলমান ছিল কয়টা? আমাগো বাড়ি বরিশালের চাখার গ্রামে, সেখানকার কোনো ছেলে তখন ইস্কুলে যায় না। অথচ উল্টা দিকের গ্রাম খলসেখোলা, সেখানে সবাই হিন্দু, সব বাড়ির পোলাপানেরা ইস্কুলে যায়। এরকম আর কতদিন চলবে? বুঝলি মামুন, মুসলমানের মধ্যে তুই একদিন স্যার সুরেন্দ্রনাথ, বিপিন পাল বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মতন মানুষও হয়তো খুঁজে পাবি, কিন্তু আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার একজন বিদ্যাসাগর। যিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইস্কুল খুলবেন, ছেলেমেয়েদের ডেকে ডেকে আনবেন। বিদ্যাসাগরের আমলে মুসলমান সমাজ কিছু সাড়া দেয় নাই, কিন্তু সেই ভুল সংশোধন করতে হবে তো! এখন বিদ্যাসাগরের মতন অত বড় মানুষ হয়তো চট করে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তোদের মতন শিক্ষিত ছেলেরা, তোরা গ্রামে যা, গ্রামে যা!