পাতিপুকুরের বাড়ির ভিত তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে, রোজ সকালে চন্দ্রার সেখানে যাওয়া চাই। যদিও তার করার কিছুই নেই। যোগেন দত্তর চেনা কন্ট্রাক্টর বাড়ি তৈরির ভার নিয়েছে, সেই লোকটিই জোগাড়ে-মিস্তিরিদের খাটাচ্ছে, তবু চন্দ্রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটি কাটা দেখতে দারুণ উত্তেজনা বোধ করে। বাড়ি নয়, যেন ওখানে তার স্বপ্ন তৈরি হচ্ছে।
জলা জমিটার জল সেঁচে ফেলা হয়েছে, মাটি কেটে দুরমুশের কাজ চলছে। চন্দ্রা অতি উৎসাহে নিজেই একবার মাটি কাটার সময় হাত লাগাতে গিয়েছিল। কন্ট্রাক্টর বাবুটি তাকে বাধা দিয়ে বলেছে, অমন করবেন না, ওতে কাজের চেয়ে অকাজ বেশি হবে। এখানে ভিড় জমে। যাবে, আমার মিস্তিরিরা হাসবে।
চন্দ্রা ঐ লোকটির যুক্তি ঠিক ধরতে পারেনি, কিন্তু নিরস্ত হয়েছে। কন্ট্রাক্টরবাবুটি নিজে ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চন্দ্রা দাঁড়িয়ে থাকে রোদে। দু’জনে মিলে মাটি সরাবার কাজে খানিকটা সাহায্য করলে তো কাজ তাড়াতাড়ি হতে পারে।
যেদিন প্রথম ইটের গাঁথনির কাজ শুরু হলো সেদিন চন্দ্রা দ্বারিক ঘোষের মিষ্টির দোকান থেকে মস্ত বড় এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে নিয়ে এলো মিস্তিরি-মজুরদের জন্য। সেদিন কন্ট্রাক্টর সুখেন দাস চটে গেল রীতিমতন। চন্দ্রাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ ধমকের সুরে বললো, আপনি এসব কী শুরু করেছেন! একটা বাড়ি তৈরি করা ছেলেখেলার কাজ নয়। আপনি আমার লোকজনদের কাজ নষ্ট করে দিচ্ছেন। আপনার রোজ রোজ আসবার দরকারটাই বা কী?
কারুর বকুনি শুনে সহজে মেনে নেবার পাত্রী নয় চন্দ্রা। সে বললো, আমার বাড়ি তৈরি হচ্ছে, আমি আসবো না মানে? কীরকম কাজ হচ্ছে, তা দেখবো না?
সুখেন দাস বললো, কী দেখবেন? আপনি এ কাজ কিছু বোঝেন? পাঁচ ইঞ্চি আর দশ ইঞ্চি দেওয়ালের তফাৎ ধরতে পারবেন! তাও একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে হয় দেখুন, কিন্তু মিস্তিরিদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের রসগোল্লা খাওয়ানো, এসব কী?
লোকটির ব্যবহারে উত্তরোত্তর বিস্মিত হয়ে চন্দ্রা বললো, কেন, একদিন ওদের মিষ্টি খাওয়ালে দোষের কী আছে?
সুখেন দাস বললো, এর পর অন্য যেখানে কাজ করতে যাবো, প্রথম যেদিন সিমেন্ট মেশাবে সেদিনই ওরা মিষ্টি খেতে চাইবে। তখন আপনি খাওয়াবেন? তাছাড়া, আপনারা বুঝবেন না, ওরা ছাতুখাওয়া মানুষ, একদিন আপনি রসগোল্লা খাওয়ালে সারাদিন ধরে সেই গন্ধ শুকবে। এরকম করলে কাজ ঢিলে হবে বলে দিচ্ছি।
চন্দ্রার সঙ্গে রতন নামে তাদের সমিতির আর একটি ছেলেও এসেছে সেদিন। রতন বললো, উনি ঠিকই বলছেন চন্দ্রাদি, মিস্তিরিদের লাই দিলেই ফাঁকি মারে। ওদের সব সময় টাইটের ওপর রাখতে হয়।
রতনের হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি। তার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে মিষ্টিগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। বাড়ি তৈরির কাজে দেরি হয়ে যাবে শুনেই চন্দ্রা একটু দমে গেছে। সে অসহায় ভাবে বললো, ওদের নাম করে এনেছি, এখন না দেওয়াটা…
সুখেন দাস বললো, ঠিক আছে, এনেছেন যখন, দিয়ে দিন আজকের মতন। ওরাও দেখে ফেলেছে। কিন্তু এমনটি আর করবেন না। আপনার এদিক পানে এখন আর আসবার দরকার নেই, আমার বড্ড ডিসটার্ব হচ্ছে। সামনের মাসে ছাদ ঢালাইয়ের পর না হয় দেখতে আসবেন!
কৈশোর আসার পর চন্দ্রা প্রায় এরকম কোনো পুরুষমানুষকে দেখেইনি, যে তার সঙ্গ পছন্দ করে না। এই লোকটা তাকে আসতে বারণ করছে? মাল-মশলা কিছু ভেজাল দিয়ে টাকা। মারার মতলব আছে নাকি? অবশ্য টাকা দিচ্ছে যোগেন দত্ত, সে অতি ঝানু লোক, সে ঠিক বুঝে নেবে। এই কন্ট্রাক্টরকে যোগেন দত্তই তো নিয়োগ করেছে। এরা এখানে কিছু এদিক-ওদিক করলেও চন্দ্রা তা ধরতে পারবে না। কাজ যে চলছে, সেটা দেখতেই তার ভালো লাগে, সেইজন্যই এখানে আসা।
সুখেন দাসের গোলগাল, নিরীহ চেহারা। এই ক’দিনের মধ্যে একবারও সে সরাসরি তো দূরে থাক চোরাচোখেও চন্দ্রার রূপ লাবণ্য দেখার চেষ্টা করেনি। চন্দ্রার সঙ্গে সে কথা বলে চাঁছাছোলা ভাষায়। সামান্য একটু গদগদ ভাবও কখনো ফুটে ওঠে নি। এরকম মানুষও তা হলে আছে? সুখেন দাস সম্পর্কে চন্দ্রা বেশ কৌতূহল বোধ করে। এই কাজটা হয়ে যাক, তারপর চন্দ্রা একদিন সুখেন দাসের বাড়ি যাবে।
মিষ্টি সুখেন দাসের হাত দিয়েই বিলি করা হলো। সে নিজে একটাও খেল না, চন্দ্রা ও রতনের অনেক অনুরোধেও না। তার ডায়াবিটিস নেই, মিষ্টি খাওয়াতেও কোনো আপত্তি নেই, শুধু রসগোল্লাটাই সে গত বছর পুরীতে জগন্নাথের কাছে উৎসর্গ করে এসেছে।
চন্দ্রার বিস্ময়ের আর কোনো সীমা থাকে না। পুরীতে সে যায়নি কখনো। শুনেছে যে সেখানকার মন্দিরের জগন্নাথ মূর্তিটি কাঠের তৈরি, তার দুটো হাতই নেই। ইট-লোহা-সিমেন্ট নিয়ে যার কারবার, সেইরকম একটি মানুষ ঐ হস্তহীন দারুমূর্তির কাছে সারা জীবনের মতন রসগোল্লা উৎসর্গ করে আসে কিসের তাগিদে? মানুষ কত বিচিত্র! মাত্র পনেরো টাকা দিয়ে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে কত কী জানা যায়। যারা ছাতু খায়, তাদের একদিন রসগোল্লা খাওয়ালে কাজের ক্ষতি হয়!
রতনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রা চলে এলো বাস রাস্তায়। এই যশোর রোডের দু ধারে এক সময় ধনীদের বাগানবাড়ি ছিল। নিশ্চয়ই রাস্তাটাও সুন্দর ছিল এক সময়। এখন সবদিকে নোংরা নোংরা ভাব। রাস্তার পাশের নালা থেকে পাঁক তুলে রাস্তার ওপরেই রাখা হয়েছে, কোনো গাড়ি এসে ঐ পাঁক পরিষ্কার করে নিয়ে যাবে না, বৃষ্টির জলে ধুয়ে আবার নালাতেই জমা হবে। সেই দুর্গন্ধ পাঁকের পাশেই বসে একজন লোক বিক্রি করছে তেলেভাজা বেগুনি-ফুলুরি। ভন ভন করে উড়ছে নীল ডুমো ডুমো মাছি।
কলকাতার মানুষদের এখন এই দৃশ্য গা-সহা। চন্দ্রা বহুদিন প্রবাসে কাটিয়েছে বলে এই নোংরামি দেখতে এখনো পর্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তার কষ্ট হয়।
জীবনের প্রথম সাতাশটি বছর চন্দ্রা অন্যান্য অনেক মেয়ের মতনই ছিল আত্মকেন্দ্রিক। নিজের লেখাপড়া, রূপচর্চা, পুরুষের স্তুতি, খেলা, গানবাজনা এইসব নিয়েই কাটিয়েছে। নিজের পারিবারিক গণ্ডি ও চেনাশুনো মানুষদের ছোট্ট জগৎটিতে সে ছিল সুখী। বিয়ের পর প্রথম দুটি বছর যেন কেটে গেছে চোখের এক নিমেষে। তৃতীয় বছরটি হঠাৎ অহেতুক লম্বা হয়ে যায়। চন্দ্রার জীবনে এতদিন পর্যন্ত কোনো কাঁটা বা কাঁকর ছিল না, তাই সে বাইরের জগৎটার দিকেও তেমন ভাবে চায়নি। কিন্তু তার বিয়ের চতুর্থ বছরটা আর কোনোক্রমেই কাটতে চাইলো না, তার আগেই সে বেরিয়ে এলো।
হয়তো নিজের জীবনের অসংশোধনীয় কোনো ব্যথাকে চাপা দেবার জন্যই চন্দ্রা অন্যদের। দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য এত মেতে উঠেছে। কিন্তু তার সব কিছুই অন্যদের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদের জীবনে কোনোরকম নাটকীয়তা পছন্দ করে না। চোখের সামনে বড়রকম অন্যায় ঘটতে দেখলেও তারা পাশ কাটিয়ে যেতে চায়। নিজের স্বার্থে সরাসরি আঘাত না লাগলে কেউ মুখ খুলতে চায় না। সেইজন্যই চন্দ্রার অনেক ব্যবহার তাদের দৃষ্টিকটু। লাগে। রাস্তার কোনো নগ্ন পাগলিনীকে দেখে চন্দ্রা যখন চলন্ত গাড়ি থামিয়ে, পাশের দোকান। থেকে একটা শাড়ি কিনে সেই পাগলিনীকে দিতে যায়, তখন তার সঙ্গীদের মনে হয়, এটা যেন। সিনেমা সিনেমা ব্যাপার, যেন চন্দ্রার দ্যাখানেপনা। কেউ কেউ বলেছে, ওকে ঐ কাপড়টা দিয়ে। কী লাভ হলো? একটু বাদেই তো আর একজন কেউ কেড়ে নেবে!
অন্যদের যুক্তি চন্দ্রা ঠিক বুঝতে পারে না, সে অনেকখানিই ইমপালসিভ। চোখের সামনে একটা কিছু দেখলেই সেই মুহূর্তেই তার একটা কিছু করা চাই। চন্দ্রার বাবা চন্দ্রার সব ব্যাপারেই প্রশ্রয় দেন, তিনিও দু-একটি ব্যাপারের পর চন্দ্রাকে বলেছেন, একটু দেখে শুনে চলিস, দু’ দিনেই তো সব মানুষের মন পাল্টে দেওয়া যায় না। হুট করে সমাজটাকেও বদলে দেওয়া যায় না।
অন্যদের মতামত চন্দ্রা বিশেষ গ্রাহ্য না করলেও সে তার বাবাকে মানে। বাবার কথা শুনেই সে আজকাল একটু একটু থমকে যায়। নইলে, তার স্বপ্নের প্রমিলা আশ্রমের যে বাড়ি তৈরি। হচ্ছে, সেজন্য সে নিজে মাটি কাটা থেকে সবরকম শ্রমদান করবে ঠিক করেছিল, ঐ কন্ট্রাক্টর সুখেন দাসের কথায় কি সে নিবৃত্ত হতো? কিন্তু সে নিজে মাটি কাটা শুরু করলে নাকি সেখানে রাস্তায় লোকের ভিড় জমে যাবে, তাতে কাজের ক্ষতি হবে, এই যুক্তি শুনেই সে থমকে গেছে। আজকে মজুরদের রসগোল্লা খাওয়ানোর ব্যাপারেও আপত্তি ওঠায় সে বেশ দুঃখ পেয়েছে। মনে। লোকগুলো অত খাটছে, ওদের একটু উৎসাহ দেবার দরকার নেই?
দুর্গন্ধ পাঁকের পাশে বসে যে লোকটি তোলা উনুনে কড়াই চাপিয়ে বেগুনি ফুলুরি ভাজছে তার দিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রা। তারপর সে রতনকে কাতরভাবে বললল, আচ্ছা, ঐ লোকটা কি একটু দূরে সরে বসতে পারে না?
রতন ঐ লোকটিকে লক্ষই করেনি, সে বাসের জন্য তাকিয়েছিল। সে বললো, কোন্ লোকটা?
চন্দ্রা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ঐ লোকটাকে যদি আমি গিয়ে বলি, তুমি অন্তত এই ফুটপাথে এসে বসো, সেটা কি…থাক, আমার বলার দরকার নেই, রতন, তুমি গিয়ে বলো!
রতন এরকম অনুরোধ কখনো শোনেনি। রাস্তার ফেরিওয়ালা-হকাররা পুলিসদেরই গ্রাহ্য। করে না, সাধারণ মানুষের কথা শুনবে কেন? শ্যামবাজার বাজারের কাছে অত ব্যস্ত রাস্তায়। খুচরো সবজিওয়ালারা বাজার ছেড়ে, ফুটপাথ ছাপিয়ে, রাস্তার অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে, কেউ কিছু বলে না।
রতন চন্দ্রার কথাটা একটু বিবেচনা করে তারপর বললো, আপনি বা আমি বললেও ঐ লোকটা শুনবে না। কেন জানেন, চন্দ্রাদি? ঐ খানে বাস স্টপ তো, অনেক লোক এসে দাঁড়ায়, তা ছাড়া গলির মোড়, ওখানে খদ্দের বেশি পাবে।
চন্দ্রা কাতরভাবে বললো, কিন্তু নর্দমা থেকে মাছি উড়ে উড়ে বসছে ওর খাবারে…এটুকুও কেউ বোঝে না!
রতন হেসে বললো, সব সহ্য হয়ে গেছে, বুঝলেন! ঐ খাবার খেয়েও আমাদের দেশের লোক বেঁচে থাকে।
–বেঁচে থাকে, কিন্তু কী ভাবে বেঁচে থাকে? ঐ যে কটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে, ওদের দ্যাখো। পেট মোটা, হাত-পা সরু সরু,
একটা বাস এসে গেছে। রতন বললো, উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন!
এই রাস্তায় কয়েকটি প্রাইভেট বাস চলে। সব সময় ভিড়। মাঝপথে উঠলে বসবার জায়গা পাবার কোনো প্রশ্নই নেই। মেয়েদের জন্য দুটি আলাদা সিট থাকে গেটের কাছেই, মেয়েদের ওঠা-নামায় সুবিধের জন্য। কিছু পুরুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে ওখানেই, ভেতরে জায়গা থাকলেও। একটি লোক খুব সূক্ষ্মভাবে এক পা এক পা সরে এসে চন্দ্রার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তার মুখটা অন্যদিকে কিন্তু হাত দিয়ে সে চন্দ্রার শরীরে একটু একটু চাপ দিচ্ছে।
এসব তো চন্দ্রাকে প্রতিদিনই সহ্য করতে হয়। বাড়ির গাড়ি নিয়ে সে বিশেষ বেরোয় না, তার বাবার কাজে লাগে, চন্দ্রা বাসে-ট্রামে ঘোরা ফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন দু’জন লোক দু’দিক থেকে চেপে ধরে, একটু নড়াচড়াও করা যায় না। কেউ কেউ শুধু গায়ে হাত দিয়েই খুশী হয় না, গোপন অঙ্গ ছুঁতে চায়।
রতন দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। চন্দ্রা পাশের লোকটিকে লক্ষ্য করতে লাগলো। ধুতি ও পাঞ্জাবি পরা মাঝারি বয়েসী ভদ্রলোক। বেশ হৃষ্ট ধরনের মুখ, দেখলে মনে হয় বিবাহিত এবং সংসারী। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে লোকটি তার একটি হাত চন্দ্রার নিতম্বে রেখেছে।
চন্দ্রার ঠিক রাগ হচ্ছে না, বরং কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে। আজকাল সব মানুষেরই ভেতরটা দেখতে ইচ্ছে করে। এই লোকটি নিজের বাড়িতে কী রকম? স্ত্রীর সঙ্গে ভাব আছে না রোজ খিটিমিটি হয়? এই লোকটি কি অফিসে ঘুষ নেয়? নিজের ছেলেমেয়েদের আদর করে? অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে, কিংবা সোনাগাছিতে যায়? এর বাড়িতে গিয়ে এর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করতে খুব সাধ হলো চন্দ্রার। কিংবা, এখন যদি লোকটাকে বলা যায় চলুন, আমরা একসঙ্গে নামি, কোনো পার্কে গিয়ে প্রেম করি, তা হলে সেটাকে কি খুব নাটকীয় মনে। হবে?
লোকটি তার হাতটা একটু একটু করে এগিয়ে আনছে চন্দ্রার কোমরের দিকে। চন্দ্রা লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, একটু সরুন, এবারে আমাকে নামতে হবে। আপনিও নামবেন?
রমণীজাতির প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ভঙ্গিতে লোকটি তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে বিনীতভাবে বললো, হ্যাঁ, এই তো, যান।
নেমে গিয়ে চন্দ্রা একটু অপেক্ষা করলো, সেই লোকটিও নামে কিনা দেখবার জন্য। লোকটি মুখ ঝুঁকিয়ে জানলা দিয়ে চার দিকে তাকিয়ে আছে।
রতনের বাড়ি কাছেই, সে ডান দিকে বেঁকে যাবে। বিদায় নেবার আগে সে বললো, চন্দ্রাদি, আমাদের ফাণ্ডে যা টাকা আছে, তাতে বড়জোর ছাদ ঢালাই পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু তারপর জানলা-দরজা বসানো, প্লাস্টারিং এই সবের জন্য আরও তো অনেক লাগবে।
চন্দ্রা বললো, তা তো লাগবেই।
–অসমঞ্জদা বলছিলেন, আর একটা সিনেমার চ্যারিটি শো যদি অ্যারেঞ্জ করা যায়। চন্দ্রা বললো, আবার সিনেমা শো?
এই প্রমীলা আশ্রম তৈরির জন্য বহু জায়গা থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। শ্রী সিনেমা হলের গালকের সঙ্গে অসমঞ্জ রায়ের ভাব আছে, তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ওখানে একটি চ্যারিটি শো-এর। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে চন্দ্রাকে অনেক ঝঞ্জাট পোহাতে হয়েছে। পুরোনো একটা বাংলা ফিল্ম, তার টিকিট বিক্রি হতে চায় না, চেনাশুনো লোকদের কাছে গিয়ে গছাতে হয়। কেউ কেউ চন্দ্রাকে বলেছে, সকালবেলা সিনেমা দেখতে যাওয়ার আমাদের সময় কোথায়? টিকিটের দাম কত বলো, আমরা এমনি দিয়ে দিচ্ছি। সে কথা শুনে চন্দ্রার অপমান লেগেছে।
সে বললো, না, আর সিনেমা নয়, এবারে অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে।
বাড়ি ফিরেই চন্দ্রার আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
দোতলার বারান্দায় একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সুচরিত, তার হাতে একটা ঝুল ঝাড়ু। চন্দ্রার মা তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন। বাড়িটা পুরোনো আমলের, সিলিং অনেক উঁচু, কাঠের কড়ি বরগা। ওপরের দিকে কোণে কোণে মাকড়সার জাল জমেছে।
চন্দ্রা দপ করে জ্বলে উঠে বললো, মা, তুমি ছেলেটাকে দিয়ে এই সব কাজ করাচ্ছো? ও কি এ বাড়ির চাকর?
চন্দ্রার মা একটু থতোমতো খেয়ে বললেন, আমার অতদূরে হাত যায় না, তাই আমি ওকে। ডেকে
–কেন, এ বাড়িতে আর কাজের লোক নেই? ও পড়াশুনো ছেড়ে এই কাজ করবে?
–কতক্ষণই বা লাগবে? ও স্নান করতে যাচ্ছিল, তাই আমি বললুম। বাড়িটা কীরকম নোংরা হয়ে আছে।
–ওর দু’দিন বাদে পরীক্ষা…এই সুচরিত, নাম, তুই নাম ওখান থেকে! তুই খবরদার এসব কাজ করবি না! পরীক্ষায় যদি ভালো রেজাল্ট করতে না পারিস, তা হলে কী হবে মনে আছে। তো?
দ্রুত পায়ে চন্দ্রা চলে এলো নিজের ঘরে। হ্যাঁণ্ড ব্যাগটা ছুঁড়ে দিল খাটের ওপর, তারপর বাথরুমে বেসিনের কাছে গিয়ে জল দিতে লাগলো চোখে মুখে।
সেখান থেকে বাইরে এসে দেখলো মা দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। চন্দ্রাকে দেখে তিনি দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন।
চন্দ্রার মা হিমানীর বয়েস ষাট পেরিয়ে গেলেও শরীরের বাঁধুনি ঠিক আছে। মাথার চুল পাকেনি খুব বেশি, অতিরিক্ত সিঁদুর ব্যবহারে সিঁথিটা চওড়া হয়ে গেছে অনেকখানি। চন্দ্রার সঙ্গে তার মুখের মিল নেই, হিমানীর মুখোনি গোল ধরনের ও ভরাট।
অল্প বয়েস থেকেই চন্দ্রা তার বাবার বেশি আদরের, মায়ের পক্ষপাতিত্ব দাদাদের ওপর বেশি। ইদানীং মায়ের সঙ্গে তার প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয়। মায়ের ভাবভঙ্গি দেখে চন্দ্রা যুদ্ধের জন্য তৈরি হলো।
মা খাটের ওপর বসে চন্দ্রার দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর সম্পূর্ণ। অপ্রত্যাশিতভাবে বললেন, সামনের মাসে শিবানীর বিয়ে, তুই শুনেছিস?
চন্দ্রা ভোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল, তোয়ালেটা না সরিয়েই বললো, তাই নাকি? শুনিনি। তো। তুমি কী করে জানলে?
হিমানী বললেন, আমাকে চিঠি লিখেছে শিবানী। তোকেও লিখেছে তার মধ্যে। মুখ থেকে তোয়ালেটা সরা!
চন্দ্রা খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, কাকে বিয়ে করছে শিবানী?
–সে কথা লেখেনি। শো, সামনের মাসের বারো তারিখ, সেই সময় তুই আবার কোনো কাজ টাজ রাখিস না। আমরা সবাই এলাহাবাদ যাব ঠিক করেছি।
–কিন্তু এখন যে আমাদের প্রমীলা সমিতির বাড়ি উঠছে, এখন আমাকে এখানে না থাকলে তো চলবে না!
–বাড়ি উঠছে তো কী হয়েছে। তুই না থাকলে কি বাড়ি তৈরি বন্ধ হয়ে যাবে?
–টাকা পয়সা জোগাড় করতে হচ্ছে।
–তা বলে শিবানীর বিয়েতে তুই যাবি না? বলছিস কি ছোটু? তুই না গেলে শিবানী:-তোর কী হয়েছে বল তো? তুই ঘরের খেয়ে বনের ঊইস তাড়াবি আর বাড়িতে এসে আমাদের ওপর বকাবকি করবি?
চন্দ্রা এবার বুঝতে পারলো, মা কোন্দিক থেকে তাকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছেন। শিবানী চন্দ্রার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ওরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছে, শিবানী চন্দ্রাদের দেরাদুনের বাড়িতে এসে থেকে গেছে অনেকদিন। শিবানীর সূত্রেই বিমানের সঙ্গে হিমানীদের পরিচয়। চন্দ্রা নিজেই পছন্দ করে বিমানকে বিয়ে করেছিল। তারপর কেন বিমানের সঙ্গে চন্দ্রার তীব্র মনোমালিন্য হলো, কেন চন্দ্রা ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে এলো তা চন্দ্রার বাবা-মা এখনো ভালো, করে জানেন না। আনন্দমোহন চন্দ্রাকে জোর করে ফেরৎ পাঠাবার কথা উচ্চারণ করেননি একবারও। কিন্তু এবার? বিমানের সঙ্গে যাই-ই হোক না কেন, শিবানীর সঙ্গে তো ঝগড়া হয়নি। চন্দ্রার। এখন শিবানীর বিয়েতে সে যাবে না কেন?
চন্দ্রা একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে।
হিমানী আবার বললেন, শিবানী আর ওর দিদি-জামাইবাবু এ মাসের পঁচিশ তারিখে কলকাতায় আসছে বিয়ের বাজার করতে। আমি লিখে দিচ্ছি, ওরা এই বাড়িতেই থাকবে। কী বলিস?
চন্দ্রা দু’দিকে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, হ্যাঁ, সেই তো ভালো।
–তোকেও যেতে হবে এলাহাবাদ। দেখিস, শিবানী তোকে ছাড়বে না। এখান থেকেই। সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইবে।
–ঠিক আছে, ওরা আসুক।
–তোদের সমিতির বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা আর কেউ দেখবার নেই? তুই একাই সব কিছু করছিস নাকি?
–মা, তুমি যে বললে আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছি, তার মানে, আমি কিছু রোজগার করি না, তোমাদের টাকা খরচ করি।
–আমি রোজগারের কথা বলিনি মোটেই! তোর বাবা তো ওষুধের দোকানটায় তোর নামেও শেয়ার রেখেছেন।
–কিন্তু সেটাও তো আমার রোজগার নয়। ঠিক আছে, আমি এবারে একটা কাজটাজ খুঁজছি।
–তুই সব কথায় একটা ব্যাঁকাবাঁকা মানে করিস কেন বল তো ছোটু? এটা মনে রাখবি, তুই নিজেই যে সব কিছু ভালো বুঝিস তা নয়। তুই যে এক্ষুনি ঐ একটা বাইরের ছেলের সামনে আমায় ওরকম মুখ ঝামটা দিলি, সেটা কি ঠিক হলো? একটা অজাত-বেজাতের ছেলেকে একেবারে দোতলায় এনে তুলেছিস।…
–মা, তুমি, তুমি আমাকে জাতের কথা বলছো? বাবা আমাদের কোনোদিন এসব শেখাননি। তুমি যদি এরকম বলো, তা হলে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো! ও নিচু জাত বলেই তুমি ওকে চাকরের মতন খাটাচ্ছো!
–শোনো মেয়ের কথা! আমার কথা শেষ পর্যন্ত না শুনেই…আমি বলছিলুম, অজাত-বেজাতের ছেলেকে তুই দোতলায় এনে তুললেও আমি কি কোনো আপত্তি করেছি? বাড়ির ছেলের মতনই দেখি। তোর দাদা বুঝি কোনোদিন বাড়ির ঝুল ঝাড়েনি? তোর বাবাকেও তো কতদিন বলেছি। আর ওকে বললেই দোষ?
–ওর এখন পরীক্ষা!
–পরীক্ষা বলেই কি সারাক্ষণ বই মুখে করে রাখবে? নাবে-খাবে না? ও কাজটা করতে কতক্ষণই বা লাগতো? তুই কিন্তু ছেলেটাকে বড় বেশি আস্কারা দিচ্ছিস! এ জগতে কারুকেই এমনি এমনি কিছু দিতে নেই। বিনিময়ে কিছু নিতে হয়, তাহলে সম্পর্কটা ভালো থাকে। ও ছেলে কেমন বিগড়ে গেছে, তুই তো কিছু খবর রাখিস না? একদিন দেখি দারোয়ানদের সঙ্গে বসে বিড়ি খাচ্ছে!
–কে, সুচরিত?
–হ্যাঁ, তোর ঐ পুষ্যিপুত্তুর। কাল তো আরও এক কাণ্ড হয়েছে। দারোয়ানের হাতে ও এক চড় খেয়েছে। দারোয়ানের কোনো দোষ তো আমি দেখি না। চাঁপা গাছটার কাছে একটা মই আছে না, দারোয়ান ঐ সুচরিতকে বলেছিল, মইটা বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেতে। তা শুনে বাবুর কী চোটপাট! সে দারোয়ানকে বললো, আমি কেন নিয়ে যাবো, আমি কি চাকর? বোঝো! তুই আদর দিয়ে দিয়ে ওর মাথা খেয়েছিস! ওকে খেতে পরতে দেওয়া হয়েছে, ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে, তার বদলে ও কি বাড়ির কোনো কাজই করবে না? তুই বল!
মায়ের কাছে যুক্তিবাণে হেরে গিয়ে চন্দ্রার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। মায়ের এইসব কথায় সে প্রতিবাদ করতে পারছে না। তবু একটা প্রতিবাদ জানানোর জন্য সে ফস করে একটা সিগারেট ধরালো।