ট্রেনে আসবার সময়েই প্রতাপের ক্ষোভ-উম্মা অনেকটা কমে গেছে, আস্তে আস্তে জেগে উঠেছে লজ্জা ও আত্ম-ধিক্কার। কারুকে কিছু না জানিয়ে ভোর বেলা গৃহ ত্যাগ করাটা তার পক্ষে খুবই ছেলেমানুষীর কাজ হয়েছে, এটা তাঁকে মানায় না। বুদ্ধ বা শ্রীচৈতন্যর মতন তাঁর মনে তো সংসার সম্পর্কে মায়া-জ্ঞান জন্মায়নি। প্রতাপের মনে একছিটেও ধর্মভাব বা অধ্যাত্ম আকর্ষণ নেই, বরং যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে অহংকার আছে। কিন্তু বউয়ের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে পালানোটা কোন্ যুক্তি দিয়ে সমর্থন করা যায়?
প্রতাপ একবার ভেবেছিলেন বর্ধমানে নেমে পড়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। আদালত দু’দিন ছুটি আছে, সেদিকে অসুবিধে নেই। ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে, মমতাকে কারণটা ব্যাখ্যা করতে হবে। কী বলবেন মমতাকে? তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই বর্ধমান পেরিয়ে গেল।
সব মানুষের মধ্যেই একটি একচক্ষু হরিণ আছে। জীবনে মাঝে মাঝে এমন এক একটা অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন সেদিকে কানা চোখটি ফিরিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়, অন্তত কিছুক্ষণের। জন্য। প্রতাপ নিজেকে বোঝালেন যে মাকে যখন দেখার ইচ্ছে হয়েছে, তখন দু’এক দিনের জন্য দেওঘর ঘুরে আসাটাই যুক্তিসংগত। খবর না পেয়ে মমতা দুশ্চিন্তা করবে, তা করুক, বুঝুক যে প্রতাপ না থাকলে সংসারের কী অবস্থা হয়!
কিন্তু প্রতাপ অনেকদিন বাদে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন অথচ সঙ্গে কোনো জিনিসপত্র নেই, এরই বা কী ব্যাখ্যা দেবেন? প্রত্যেকবার দেওঘরে যাওয়ার সময় প্রতাপ অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড়, কলকাতার দই, আমের আচার, হিং-এর বড়ি, কাসুন্দি ইত্যাদি নিয়ে যান। স্টেশান থেকে কিছু কিনে নেবেন? ফেরার ভাড়া বিশ্বনাথের কাছ থেকে চাইতে হবে। প্রতাপ একবার ভাবলেন, কয়েকটা সোডার বোতল কিনে নিয়ে যাবেন, মা। সোডা খেতে ভালোবাসেন। কিন্তু হাতে আর কিছু নেই। বেডিং না, সুটকেস না, শুধু কয়েকটা। সোডার বোতল, এই অবস্থায় দেওঘরে উপস্থিত হওয়া, দৃশ্যটা ভাবতে প্রতাপের নিজেরই হাসি। পেয়ে গেল। ওস্তাদজী খুব ক্ষেপাবেন এই জন্য!
সারা রাস্তা প্রতাপ শুধু চা খেয়ে কাটালেন।
দেওঘরে এসে পৌঁছোলেন সন্ধের পর, সুহাসিনী ধাম তখন নিঝুম। বাড়িতে কেউ নেই। বিশ্বনাথ গুহ গেছেন গানের টিউশানি করতে। ভজন সিং জানালো যে মাইজীরা সব গেছেন সৎসঙ্গের আশ্রমে গান শুনতে। প্রতাপ এক হিসেবে খুশীই হলেন। তাঁর অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা দেবার ব্যাপারটা যত দেরিতে হয় ততই যেন সুবিধের।
বারান্দায় বসে তিনি ভজন সিং-এর সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন।
সম্প্রতি সুহাসিনী ধামে কিছু মেরামতের কাজ হয়েছে, সামনের ভাঙা গেটটি বদলে গেছে, বাগানটির শ্ৰী ফিরেছে। তাতে খানিকটা বিস্মিত বোধ করলেন প্রতাপ। মায়ের জন্য মাসে মাসে পঁচাত্তর টাকা করে পাঠান প্রতাপ, তবু তাঁর আশঙ্কা ছিল গানের ইস্কুল চালিয়ে বিশ্বনাথ গুহর যা সামান্য রোজগার, তাতে তিনি এ সংসার বেশিদিন চালাতে পারবেন না। কিন্তু চলছে তো ঠিকই। বাড়ি মেরামত হওয়া মানে সচ্ছলতার লক্ষণ। ওস্তাদজী তো তা হলে বেশ তালেবর মানুষ।
গেটের সামনে একটা টাঙ্গা এসে থামলো। প্রতাপ ভাবলেন, মা ফিরে এসেছেন। মাকে দেখে প্রথম কী কথাটা বলবেন তা প্রতাপ এখনো ঠিক করতে পারেননি। “মা, হঠাৎ তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হলো, তাই ছুটে এলাম?” এ রকম আবেগময় বাক্য প্রতাপের চরিত্রে একেবারে মানায় না। “মা, স্বপ্ন দেখলাম, তুমি খুব অসুস্থ, তাই দেখতে এলাম তোমাকে?” মিথ্যে কথা প্রতাপের মুখে একেবারেই আসে না। তার চেয়ে মুচকি হেসে, “হঠাৎ এসে পড়লাম” বলাই অনেক ভালো। মা তো প্রতাপকে দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেনই, বেশি কিছু জানতে চাইবেন না।
গেটটা খোলাই ছিল, আবছা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হেঁটে এলেন একজন মহিলা,সঙ্গে একটি বালক। কাছাকাছি আসতেই প্রতাপের বুকটা ধক করে উঠলো। বুলা! প্রতাপ যেন সহসা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। বুলা এখনো দেওঘরে? আবার এসেছে?
এ যেন অবিশ্বাস্য এক কাহিনীর মতন। প্রতাপের দেওঘরে আসার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না এ সময়ে, হঠাৎ এসে পড়েছেন, বাড়িতে কেউ নেই, প্রথমেই দেখা হলো বুলার সঙ্গে? বুলাকে দেখে প্রতাপ পুলকিত হলেন না, রোমাঞ্চ বোধ করলেন না। বরং যেন ভয় ছড়িয়ে পড়লো তাঁর সর্বাঙ্গে। হ্যাঁ, ভয় ছাড়া আর কী নাম দেওয়া যায়। ভয় এবং অপরাধবোধ। একদিন না একদিন মমতা এই ঘটনা ঠিকই জানতে পারবেন। বুলা সম্পর্কে মমতার মনে একটা ঈষার কাঁটা গভীর ভাবে বিধে আছে। অকারণ ঈর্ষা। এই ঘটনা শুনলে মমতা নিশ্চিত ভাববেন যে বুলার জন্যই প্রতাপ হঠাৎ কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন দেওঘরে। নির্জন বাড়িতে বুলার সঙ্গে সময়-যাপন।
তেজস্বী পুরুষ হিসেবে পরিচিত প্রতাপ মজুমদার যেন কুঁকড়ে খানিকটা ছোট হয়ে গেলেন সেই মুহূর্তে।
বুলার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, এ বাড়িতে সে প্রায়ই আসে। যখন তখন। বুলা পরে আছে একটা নীল রঙের শাড়ি, তার চোখে এখন চশমা, হাতে একটা ছোট্ট মাটির হাঁড়ি। প্রতাপকে বিশ্বনাথ হিসেবে ধরে নিয়ে বরান্দার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বুলা বললো, ওস্তাদজী, সারা বাড়ি এত চুপচাপ কেন? ভজন সিং! সামনের আলো জ্বালোনি?
প্রতাপ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
ভজন সিং উত্তর দিল, কলকত্তাসে বড় দাদাবাবু এসেছেন!
আগেরবার বুলা তাঁর সঙ্গে একটাও কথা বলেননি, সে কথা প্রতাপ ভুলবেন কী করে? তিনি নজে থেকে আর বুলাকে কিছু বলবেন না। বুলার জীবনে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। এইটাই সত্য। প্রতাপ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে ধরালেন।
মাটির হাঁড়িটা ভজন সিং-এর হাতে দিয়ে বুলা বললো, এটা ভেতরে রাখো। মাইজী কোথায়? নেই? তুমি আলো জ্বেলে দাও।
প্রতাপ মনে মনে ভাবলেন, বুলা তাঁর মায়ের জন্য মিষ্টি-ফিষ্টি কিছু একটা নিয়ে এসেছে। মা নেই জেনে সে এখন অনায়াসে ফিরে যেতে পারে। তাঁর কিছু বলার নেই।
ভজন সিং হাঁড়িটা নিয়ে ভেতরে চলে যাবার পরেও বুলা স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো একটুক্ষণ। তারপর খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো, প্রতাপদা?
সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপের মনে পড়লো, এই বাড়িতে, অনেকদিন পর প্রথম বুলার সঙ্গে দেখা হলে। তিনিও ঠিক এই প্রশ্নই করেছিলেন বুলাকে। বুলা কোনো উত্তর দেয়নি।
প্রতাপও কোনো উত্তর না দিয়ে চোখ তুলে তাকালেন বুলার দিকে। অনেকদিন পর চার চক্ষের সোজাসুজি মিলন হলো।
বুলা আবার বললো, তোমার আসার কথা ছিল আজ, কিছু শুনিনি তো?
প্রতাপ বললেন, জানলে তুমি এই সময় নিশ্চয়ই আসতে না এ বাড়িতে। তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না, আমি জানি!
একটু কড়া ভাবে এই কথাগুলি বলে ফেলে প্রতাপ নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। যেন তাঁর ওষ্ঠ দিয়ে এই কথা অন্য কেউ বলালো। এখন আর ফেরানো যায় না।
কথাগুলি শুনে বুলা চমকে গেল না, আহত হলো না, হাসলো। একটু সরে গিয়ে বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, কোন্ ট্রেনে এলে?
আগেরবারের তুলনায় বুলার ব্যবহার অনেক সহজ। তার কারণ কি, বাড়িতে আর কেউ নেই বলে? প্রতাপের এখনো মনে হচ্ছে, বুলা চলে গেলেই ভালো হয়। ওস্তাদজী এসে পড়লে এই প্রসঙ্গ নিয়ে পরে কত কী রসিকতা করবেন তার ঠিক নেই। মমতার কানে পৌঁছোবেই। অকারণ জটিলতা।
প্রতাপ এটাও বুঝলেন যে একটি নারীর প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে বসে থাকা যায় না। মেয়েরা এরকম পারে। পুরুষরা পারে না। যদিও অনেক প্রশ্ন, অনেক উত্তরই অর্থহীন। তুমি কেমন আছো, এই প্রশ্নের কি কোনো উত্তর দেওয়া যায় এক কথায়? এখানে মাত্র দুটো-তিনটে ট্রেনই আসে, প্রতাপ কোন্ ট্রেনে এসেছেন তা অবান্তর। তিনি বুলার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি করতে চাইলেন। যেন এই দেওঘরে দেখার আগে বুলার পূর্ব পরিচয় কিছু নেই। প্রবাসে সদ্য চেনা এক মহিলা, তার সঙ্গে টুকটাক মামুলি দু’চারটে কথা তো সহজ ভাবে বলা যেতে পারে অনায়াসেই।
প্রতাপ বললেন, তুমি দেওঘরেই থাকো নাকি?
বুলা বললো, হ্যাঁ। তুমি যে গত এপ্রিল মাসে এখানে এসেছিলে, তখনও আমি ছিলাম এখানে।
এপ্রিল মাসে বিশ্বনাথ গুহ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে প্রতাপ এসেছিলেন মাত্র দু’দিনের জন্য। অতি ব্যস্ততায় সময় কেটে গেছে। বুলার প্রসঙ্গ তখন এ বাড়িতে কেউ তোলেনি। বুলা জানতে প্রতাপের আসার খবর? ইচ্ছে করেই সে ঐ দু’দিন আসেনি এ বাড়িতে?
–তুমি কি এখানেই থেকে যাবে?
বুলার সঙ্গে যে ভৃত্যটি এসেছে তার দিকে ফিরে বুলা বললো, এই, তুই টাঙ্গায় গিয়ে বোস, দ্যাখ, ও আবার চলে না যায়। আমি এক্ষুনি আসছি!
তারপর প্রতাপের দিকে ফিরে বললো, তুমি ট্রেন জার্নি করে এসেছো, খাওয়া-দাওয়া হয়নি। নিশ্চয়ই। আমি প্যাঁড়া এনেছি, তার থেকে খাবে দুটো? খেয়ে দ্যাখো, খুব বেশি মিষ্টি নয়। জিভের স্বাদ যাবে না!
এই যে খুব বেশি মিষ্টি নয় বললো, এর মধ্যেই ঝলসে উঠলো পূর্ব পরিচয়ের স্মৃতি। প্রতাপ যে মিষ্টি পছন্দ করেন না বুলা তা মনে রেখেছে। কত কাল আগেকার কথা। সেই দায়ুদকান্দিতে, বুলার মা প্রতাপকে লেডিকেনি খাওয়ার জন্য ঝুলোলাঝুলি করেছিলেন, প্রতাপ একটার বেশি খাননি, হাত নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন, বেশি মিষ্টি আমি খেতে পারি না, মিষ্টি খেলে আমার জিভ অসাড় হয়ে যায়!
প্রতাপ বললেন, পরে খাবো, এখন আমার খিদে নেই।
–তুমি আমাকে একবার বসতেও বললে না, প্রতাপদা?
এর মধ্যে কী এমন ঘটেছে যার জন্য বুলার এতখানি পরিবর্তন? শুধু সহজ, সাবলীল নয়, বুলা যেন খানিকটা প্রগলভা হয়ে উঠেছে আজ। তার ঠোঁটে চাপা হাসি।
প্রতাপের পাশে আর একটি বেতের চেয়ার। সেটাকে খানিকটা দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি বললেন, বসো!
–নাঃ, আমি এখন যাই!
বসো! বুলা সে কথা শুনলো না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে বললো, তোমার মা আমায় খুব ভালোবাসেন…মাসিমার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে…
আর একটুখানি এগিয়ে গিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে সে বললো, বৌদি, তোমার ছেলেমেয়েরা সবাই ভালো আছে নিশ্চয়ই! আমি যাই।
প্রতাপ বুলার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমে তিনি চাইছিলেন, বুলা তাড়াতাড়ি চলে গেলেই ভালো হয়। তারপর তিনি যখন বুলাকে বসতে বললেন, তখন বুলা সে কথা শুনলো না।
বুলার টাঙ্গার আওয়াজটা মিলিয়ে যাবার পর একটা অদ্ভুত কঠিন নিস্তব্ধতা প্রতাপকে আঘাত করতে লাগলো। প্রতাপ অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। তিনি যেন আর একটুক্ষণও এখানে বসে থাকতে পারবেন না। এক্ষুনি স্টেশানে গিয়ে একটা ফেরার ট্রেন ধরলে কেমন হয়?
প্রতাপ উঠে দাঁড়াবার পর খেয়াল করলেন, তাঁর কাছে যথেষ্ট পয়সা নেই। পয়সা থাকলেই বা কী হতো, এই ভাবে এসে আবার চলে যাওয়া, এ তো প্রায় পাগলামির লক্ষণ। কিংবা, যে কেউ শুনলেই ভাববে, তিনি যেন শুধু বুলার সঙ্গে দেখা করার জন্যই এসেছিলেন। নিভৃতে বুলার সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে তা কেউ জানবে না।
নিজে থেকেই কথা বলা শুরু করে আবার হঠাৎ কেন চলে গেল বুলা? নাঃ, এসব কিছুতেই বোঝা যাবে না।
একটু পরেই এসে পৌঁছোলেন বিশ্বনাথ। সাইকেল থেকে নেমেই তিনি গান ধরলেন, ‘পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না, এ পৃথিবী ভালোবাসিতে জানে না, যেথা আছে শুধু ভালো বাসাবাসি, সেথা যেতে প্রাণ চায় মা!’
প্রতাপ বারান্দা থেকে নেমে এসে ডাকলেন, ওস্তাদজী!
বিশ্বনাথ প্রতাপকে দেখে খুব যেন বিস্মিত হলেন না। গান থামিয়ে কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়ে থেকে তারপর এক মুখ হেসে বললেন, এই যে, ব্রাদার! তোমাকেই খুর দরকার ছিল এখন। তুমি না এসে পড়লে আমিই দু’চারদিনের মধ্যে কলকাতায় যেতাম!
প্রতাপই অবাক হয়ে বললেন, কেন? কী ব্যাপার?
বিশ্বনাথ বললেন, তেমন কিছু নয়। পরে শুনবে। আরে এসব তো আছেই। সংসার করতে গেলে কত কী-ই না সহ্য করতে হয়। সেই যে গান আছে না, লোহার বাঁধনে বেঁধেছে সংসার, দাসখৎ লিখে নিয়েছে হায়! শুনবে গানটা? মিশ্র সাহানায় আছে।
বিশ্বনাথ আবার গান ধরতেই প্রতাপ বুঝতে পারলেন, ওস্তাদজী বেশ খানিকটা নেশা করে এসেছেন। বাড়ির বাইরে এখানে সেখানে বিশ্বনাথ মাঝে মাঝে মদ্য পান করেন, তা জানেন প্রতাপ। কিন্তু এখন তিনি এই অবস্থায় বাড়িতেও ফিরছেন? মা আছেন জেনেও!
গান শেষ করার পর ওস্তাদজী বললেন, এরা সব ফেরেনি এখনো? তুমি কতক্ষণ বাইরে বসে আছো?
প্রতাপ বললেন, তাতে অসুবিধে কিছু হয়নি।
–সবাই আশ্রমে গেছেন। পাবনার অনুকূল ঠাকুর এখানে মস্ত বড় আশ্রম করেছেন, তোমার মা তোমার বোনকে নিয়ে প্রায়ই যান সেখানে।
–আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? গানের টিউশানি করছেন সন্ধেবেলা? বিশ্বনাথ অট্টহাসি করে উঠে বললেন, টিউশানি? না হে, তার চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার। কোর্ট সিঙ্গার হয়েছি! বিদূষকও বলতে পারো!
–তার মানে?
–জসিডিতে সেই যে মস্ত বড় গোলাপ বাগানওয়ালা বাড়িটি দেখেছিলে গতবার, মনে আছে? সেটা ঘোষেদের বাড়ি। ঐ ঘোষরা জমিদার। তা সেই জমিদারবাবুর টি বি হয়েছে। বলে সদলবলে এখানে এসে আছেন দু’মাস। তা টি বি হলে কী হয়। জমিদার বলে কথা! রোজ পারিষদ নিয়ে সভা সাজিয়ে বসেন। দু’খানা মেয়েছেলে এনেছেন কলকাতার সোনাগাছি। থেকে। তারা খ্যামটা নাচে, আমি গান গাই! নতুন নতুন গান শিখেছি। রসের গান। শুনবে?
–ছিঃ। ওস্তাদজী!
–আরে তুমি ছি ছি করলে কী হবে, পয়সা ভালো দেয়। মুড হলে হাত থেকে আংটি খুলে দেয়! এখন ব্যাটা বেশি দিন বাঁচলে হয়। যদি শিগগির শিগগির টেসে যায় তা হলেই দুধের বদলে চোনা। হে-হে-হে!
হাতের চুরুটটা নিবে গেছে, তবু সেটাই মাঝে মাঝে ঠোঁটে দিয়ে টানছেন বিশ্বনাথ। এই ক’মাসেই তাঁর চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে বেশ। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো।
ঝপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে তিনি বললেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার দ্যাখো! বড় লোকদের হয় টি বি! ওটা তো ইস্কুল মাস্টার আর ব্যর্থ প্রেমিকদের অসুখ ছিল এতদিন তাই না? এখন আমি এদিককার বড় বড় বাড়িগুলোতে লোকজন এলেই খোঁজ নিই টি বি রুগী এসেছে কি না! এদিকে আমি দালাল লাগিয়ে রটিয়ে দিয়েছি যে গান বাজনা শুনলে টি বি রোগের উপকার হয়। তাই শাঁসালো মক্কেল এলেই আমার ডাক পড়ে। অনেকেই দেখছি সঙ্গে করে বাজারের মেয়েছেলে আনে।
প্রতাপের দুই ভুরু যুক্ত হয়ে গেছে। খানিক আগের দুর্বল ভাবটা কেটে গেছে একেবারে। বিশ্বনাথ সম্পর্কে ও বয়েসে তাঁর থেকে বড় হলেও প্রতাপ ধমকের সুরে বললেন, এসব কী। বলছেন, ওস্তাদজী? আপনি…আপনার গানকে এত নিচে নামিয়ে এনেছেন? আপনিই না বলেছিলেন যে আপনার গুরুজীর আদেশ আছে, আপনি গান কোনোদিন বিক্রি করবেন না? ছোট ছেলেমেয়েদের গান শেখান, …সে আলাদা কথা! কিন্তু বড়লোকদের বাড়িতে গিয়ে সেখানে নষ্ট মেয়েমানুষেরা থাকে সেখানে আপনি…আমি এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে। পারছি না!
বিশ্বনাথ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতাপের কথা শুনলেন। তারপর সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে বসলেন, ধুর! ওসব কথা ছাড়ো!
প্রতাপ তবু চাপ দিয়ে বললেন, ওস্তাদজী, আপনি কেন এইসব বললেন আমাকে? সত্যিই এই রকম করছেন?
–সংসার চালাতে গেলে মানুষকে প্রয়োজনে ওরাং ওটাং-এর মতন চার হাত-পায়ে ছুটতে হয়, হয় না?
–আপনি যে বলেছিলেন–
–আগে কী বলেছিলাম তা ধরে রাখলে চলে? আগেকার কত কিছু বদলে গেল না? কোথায় গেল তোমাদের মালখানগর? রূপকথা হয়ে গেছে, তাই না?
–তবু আমাদের অবস্থা এমন হয়নি যে এত নীচে নামতে হবে! নষ্ট মেয়েমানুষরা নাচবে আর আপনি সেখানে গান গাইবেন? আপনার এই অধঃপতন আমি সহ্য করতে পারবো না। এই সন্ধ্যেবেলা আপনি নেশা করে এসেছেন…
পর পর দুটি হেঁচকি তুলে বিশ্বনাথ একটুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তুমি যাদের নষ্ট মেয়েছেলে বললে, তাদের দু’একজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাদের তুলে আনা হয়েছে রিফিউজি কলোনি থেকে। তারা যেকারণে নষ্ট হয়েছে আমিও সেই কারণেই নষ্ট কিংবা ভ্রষ্ট যা-ই বলো। দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় দোষ কী জানো, দারিদ্রে মানুষের নৈতিক চরিত্রটাও পচে যায়। পভার্টি ডিজেনারেটস! ঐ যে নজরুল লিখেছেন, হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান। ওটা অতি বেঠিক কথা! বাকোয়াস!
কথা শেষ করে বিশ্বনাথ উঠে গেলেন ভেতরে। বাথরুমে জল পড়ার শব্দ হতে লাগলো। প্রতাপ গুম হয়ে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। তাঁকেও এখন প্রায়ই অর্থ সংকটের কথা চিন্তা করতে হয়, তবু দারিদ্র্যের প্রসঙ্গ তিনি সহ্য করতে পারেন না।
একটু পরে তাঁর বুলার কথা মনে ফিরে এলো। বুলা অনেক বদলে গেছে, সে যেন কিছু বলতে চেয়েছিল। তবু সে চলে গেল নিজে থেকে।
বুলা যে এসেছিল সে কথা কি বিশ্বনাথকে জানাবার প্রয়োজন আছে? অতি তুচ্ছ একটা ঘটনা, এটার উল্লেখ না করলে কি তা মিথ্যে ভাষণের পর্যায়ে পড়ে? কিছু না বলাটা কী করে মিথ্যে হয়? বুলা নিশ্চয়ই পরে আবার দেখা করতে আসবে মায়ের সঙ্গে। কিন্তু ঐ প্যাঁড়ার হাঁড়িটা? প্রতাপ ছাড়া আর কেউ যখন ছিল না, তখন বুলা এসেছিল, এটা গোপন করা যাবে না। এটা গোপন করার মতন এমন কী-ই বা ব্যাপার?
সুহাসিনীরা ফিরলেন একটু পরেই। পায়ে হেঁটে। প্রতাপ প্রথমেই সেটা লক্ষ করলেন। বুলা টাঙ্গাতে আসে যায়, টাঙ্গা দাঁড় করিয়ে রাখে, কিন্তু প্রতাপের মাকে হেঁটে যাতায়াত করতে হয় কেন? সৎসঙ্গের আশ্রম এখান থেকে বেশ দূর। মাকে পচাত্তর টাকা করে হাত খরচ পাঠান প্রতাপ, খুব একটা কম টাকা নয়, তাতে মায়ের কুলোয় না? টাকাটা আরও বাড়ানো দরকার?
প্রতাপকে দেখে বালিকার মতন দৌড়ে এলেন সুহাসিনী। ব্যাকুল ভাবে বলতে লাগলেন, ও খুকন, কখন এলি, কতক্ষণ বসে আছিস, এ রাম রাম, কেন আমি গ্যালাম আজ আশ্রমে, ইস রে ছেলেটা কত কষ্ট কইরা আইছে…
প্রতাপের মাথাটা সুহাসিনী চেপে ধরলেন বুকে। অন্য সময় প্রতাপ প্রবল অস্বস্তিতে মাথাটা সরিয়ে নেন সঙ্গে সঙ্গে, আজ নিলেন না। মায়ের বুকে যেন তিনি পেলেন বাল্যকালের সৌরভ, মালখানগরের সেই আম-জাম-নারকোল গাছের বাতাস বিধৌত বাড়িতে কৈশোর বয়েসের সব রকম সুখ। প্রতাপ ভাবলেন, ঐ বয়েসটায় যদি ফিরে যাওয়া যেত, যখন টাকা পয়সার চিন্তা থাকে না…দিদির গয়না…মমতার দুঃখ…ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর চিন্তা…ওস্তাদজীর গান…মায়ের টাঙ্গার ভাড়া…। আঃ, যদি ফিরে যাওয়া যেত!