পাড়াটির নাম বাগবাজার হলেও দৈনিক বাজারের জন্য যেতে হয় শ্যামবাজারে। ছুটিছাটার দিন হলে প্রতাপ আর একটু উজিয়ে চলে যান হাতিবাগানে। ওখানে মাছ ভালো পাওয়া যায়, বিশেষত জ্যান্ত মাছ।
মাছের বাজারে প্রতাপ বেশ কিছুক্ষণ ঘুরতে ভালোবাসেন। কেনার চেয়েও দেখাতেই বেশি আনন্দ। জ্যান্ত ট্যাংরা, ছটফট করে লাফানো চিংড়ি, কালা মাছের মুখ খোলা আর বন্ধ হওয়া মাছের দেশের মানুষদের এ দৃশ্য তো প্রিয় হবেই। মালখানগরে নিজেদের বাড়ির পুকুরে প্রতাপ বড়শী দিয়ে অনেক মাছ ধরেছেন একসময়। কালা নয়, প্রতাপদের পুকুরে যে-মাছটা বেশি ছিল তার নাম কালবোস। ভারি মিষ্টি স্বাদ। আর সোনালি রঙের ট্যাংরা। এদেশে যার নাম পোনা মাছ, ওদেশে তার নাম নলা। একবার সিরাজগঞ্জে গিয়ে প্রতাপ যে রুই মাছ খেয়েছিলেন সে রকম রুইমাছের স্বাদ আর বহুদিন পাননি। আর একটা সুস্বাদু মাছ হচ্ছে বলসে। তা তো কলকাতার বাজারে ওঠেই না প্রায়। তবে, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, এদিককার চিংড়ি মাছের স্বাদ অনেক ভালো। সেইজন্যই এদিকে অনেকে এখনো বলে, ‘বাঙাল, চিংড়ি মাছের কাঙাল।’
প্রতাপ নিজে থেকে মাছের দর জিজ্ঞেস করেন না আগে। অন্য খদ্দেরদের পাশে দাঁড়িয়ে মাছওয়ালার সঙ্গে তাদের দরাদরি শোনেন। একটু ভালো মাছ হলেই প্রতাপদের মতন ক্রেতাদের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। প্রতাপ প্রাণে ধরে বরফ দেওয়া মাছ কিনতে পারেন না। অল্প-স্বল্পও কিনতে পারেন না। কেউ কেউ অনায়াসে আধ পো বা এক পো মাছ দিতে বলে। ঢাকার কোনো মাছওয়ালা হলে শুনিয়ে দিত, বাবুর বাড়িতে আইজ যজ্ঞ নাকি?
মাছের দাম দিন দিনই বাড়ছে। গত সপ্তাহে ছিল তিন টাকা সের, এ সপ্তাহে সাড়ে তিন! আজ ছুটির দিন বলে বড় সাইজের জ্যান্ত ট্যাংরা চাইছে চার টাকা! অবিশ্বাস্য ব্যাপার! চার। টাকা দিয়ে কে মাছ কিনে খাবে? কালো কালো ট্যাংরাগুলো, দেখলেই বোঝা যায় ডিম ভর্তি পেট, এই মাছ প্রতাপের খুব প্রিয়। কিন্তু প্রতাপের বাজারের বাজেটই তিন টাকা। সুপ্রীতিকে বাদ দিয়ে প্রতাপের বাড়িতে মাছ খাবার লোক ছ’জন, ঐ মাছ অন্তত এক সের কেনা উচিত। এখন সব দিক হিসেব করে চালাতে হচ্ছে, প্রতাপের বাজেট বাড়াবার উপায় নেই।
মাছের বাজারে এরকম আগুন লাগার কারণ পাকিস্তান থেকে হঠাৎ মাছ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। পশ্চিমবাংলায় নদী-খাল-বিল কম, মাছও কম। বিহার-উড়িষ্যা থেকে মাছ এনেও কলকাতার মৎস্য ক্ষুধা মেটানো যাচ্ছে না। কলকাতায় শুধু যে জনসংখ্যা বেড়েছে তাই-ই নয়। মাছ-খোর বাঙালের সংখ্যা অনেক গুণ বেড়েছে। পূর্ব বাংলা থেকে যত মানুষ চলে এসেছে, তাদের কথা ভেবেই তো পূর্বপাকিস্তান থেকে রোজ কিছু মাছ পাঠানো উচিত। অথচ প্রতাপ খবরের কাগজে পড়েছেন, বরফের অভাবে খুলনায় অনেক মণ ইলিশ মাছ পচে যাচ্ছে, কোনো কোনো দিন চার পয়সা, ছ’পয়সা সেরে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে সেখানে। বঞ্চিত হচ্ছে সেখানকার জেলে সম্প্রদায়।
কলকাতার বাজারে মাছের তুলনায় মাংস সস্তা। পাঁঠার মাংস এখনো তিন টাকা। কিন্তু মাংস তো মাছের মতন এক দু’টুকরো খাওয়া যায় না। প্রতাপদের যৌবনে বড় জামবাটি ভর্তি মাংস দেওয়া হতো এক একজনকে, কবজি ডুবিয়ে খাওয়া হতো। তাঁর ছেলেমেয়েদের এখন উঠতি বয়েস, তারা দু’টুকরো মাংস খাওয়ার পর থালা চাটবে, এ দৃশ্য প্রতাপ সহ্য করতে পারেন না।
একজনের কাছে একটা বোয়াল মাছ রয়েছে। গায়ের চকচকে ভাবটা দেখেই বোঝা যায়। মাছটা টাটকা, ওজন হবে সের খানেক। বোয়ালের দামও সস্তা। এক টাকা বারো আনা করে চাইছে, একটু চেপে ধরলে দেড়টাকায় দেবে। কিন্তু মমতা বোয়াল মাছ খান না। সেই দেখাদেখি ছোট মেয়েটাও খায় না। ওদের নাকি বোয়াল মাছে কী রকম গন্ধ লাগে। তাহলে ওদের জন্য আমার অন্য মাছ কিনতে হয়। শুধু বোয়াল নয়, মমতা বেলে মাছ, শোল মাছ, চিতল মাছ এসব খান না। বান মাছ দেখলে তো তাঁর ঘেন্না হয়, ওগুলো নাকি সাপের মতন।
প্রতাপের পকেটে একটা দশ টাকার নোট আছে বটে কিন্তু খরচ না বাড়াতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বোয়াল মাছের কাছ থেকে সরে গিয়ে, ডিমভরা ট্যাংরা মাছগুলোর দিকে কয়েকবার তারিফ করা চোখে তাকিয়ে তিনি পার্শে মাছ কেনাই ঠিক করলেন। সবে মাত্র তিনি সেই মাছওয়ালার সামনে দাঁড়িয়েছেন, পেছন থেকে একজন বললো, মজুমদারদা, কেমন আছেন?
প্রতাপ মুখ ফিরিয়ে দেখলেন ধুতির ওপর গিলে করা পাঞ্জাবিপরা একজন বেঁটে খাটো মোটাসোটা মানুষ তাঁর দিকে চেয়ে আছেন। প্রতাপ প্রথমে চিনতে পারলেন না। লোকটির মুখটি হাসিমাখা, বেশ পরিতৃপ্ত ধরনের মুখ, চেহারায় আর্থিক সাচ্ছল্যের ছাপ আছে। লোকটি বাজার করতে এসেছে ঠিকই। কিন্তু হাতে কোনো থলি বা চুবড়ি নেই, তার পেছনে ভৃত্যশ্রেণীর একজন লোক একটা ধামা মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতায় পুরোনো লোকদের এরকম চাকর সঙ্গে নিয়ে বাজার করতে আসাই প্রথা।
লোকটির একটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো, তাই দেখেই প্রতাপের মনে পড়ে গেল। বিমানবিহারীর বাড়িতে লোকটিকে দু’একবার দেখেছেন, প্রতাপের সঙ্গে আলাপও হয়েছে। কিসের যেন ব্যবসা আছে।
প্রতাপও হাসির উত্তর দিয়ে বললেন, কী খবর? আপনি এদিকেই থাকেন নাকি?
লোকটি বললো, আমার বাড়ি তো এই গ্রে স্ট্রিটে। আপনি তো দাদা থাকেন বাগবাজারে, তাই না? হঠাৎ এদিকে? প্রতাপ বললেন, এলাম আপনাদের বাজারে, যদি ভালো মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু যা দাম!
এবারে প্রতাপের মনে পড়লো, লোকটির নাম জগৎপতি দত্ত। হ্যাঁ, ঠিক জগৎপতিই বটে, ঐ নাম নিয়ে বিমানবিহারী কী যেন একটা রসিকতাও করেছিলেন। জগৎপতি দত্তদের কয়েক পুরুষের কাগজের ব্যবসা।
প্রতাপের কথা শুনে জগৎপতি মহা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আর বলবেন না! ব্যাটারা গলা কাটবে একেবারে! পাকা রুই বলে কি না চার টাকা চার আনা? কেউ কখনো শুনেছে এরকম? এরপর আর বাঙালীকে মাছ খেতে হবে না, আঁশ ধোয়া জল খেয়েই সাধ মেটাতে হবে, বুঝলেন?
মাছওয়ালাটি এই আলোচনা শুনতে পেয়েছে। তার এখন অন্য খদ্দের নেই। সেইজন্য সে। আলোচনায় যোগ দেবার জন্য বললো, শুধু আমাদের দোষ দিচ্ছেন? আলুর দাম কত উঠেছে বলুন? ন’আনা সের আলু! আর পটল, অন্য বছরে এই সময় ছাগলেও খেতে চায় না, সেই পটল দশ আনা? চালের মন ধাঁ ধাঁ করে সাতাশ টাকায় চড়ে বসলো। আমাদেরও পেটে খেয়ে বাঁচতে হবে তো!
জগৎপতি মাছওয়ালাটির দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বললো, তোদেরই তো এখন পোয়া বারো। চেহারায় কী রকম চেকনাই হয়েছে। হাতে তিনখানা আংটি! একদিকে ওজনে মারবি, আবার দামও হাঁকবি যাচ্ছেতাই।।
জগৎপতিরা এই সব মাছওয়ালা শ্রেণীর লোকদের অনায়াসে তুই বলে সম্বোধন করেন। প্রতাপ এমন পারেন না। নিজের পরিবারের বাইরে তিনি কারুকেই তুই বলেন না।
জগৎপতি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই পার্শে মাছ কিনছেন নাকি? এ ব্যাটা কত করে চাইছে?
মাছওয়ালা বললো, মোট তিন পোয়া আছে। সব ল্যান তো আড়াই টাকা দরে দিয়ে দেবো!
জগৎপতি এক ধমক দিয়ে বললেন, মাছি বসছে, এর দর আড়াই টাকা? মজুমদারদাদা, কিনবেন না, এগুলো কিনবেন না। ওদিকটায় একজনের কাছে ভালো পাবদা আছে, সাড়ে তিন করে দিচ্ছে, চলুন আমি কিনিয়ে দিচ্ছি। এ বাজারে তো সব ব্যাটা মাছওলা আমার চেনা!
প্রতাপের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জগৎপতি তাঁকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে এক সের পাবদা মাছ কেনালেন। প্রতাপের বাজেট ছাড়িয়ে গেল। চক্ষুলজ্জায় তিনি আপত্তি করতে পারলেন না। তাছাড়া পাবদা মাছ তাঁর মাটি মাটি লাগে। এ মাছগুলো দেখতে নরম-সরম হলেও ওজন আছে বেশ। এক সেরে উঠলো মোটে আটটা। তা ছাড়া, পাবদা মাছ প্রতাপের পছন্দের মাছ নয়! এই একটা মাছ যাতে মাছের গন্ধ নেই।
জগৎপাত জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, আপনি এই ফিটিস্থ আগস্ট কী করছেন? খুব ব্যস্ত, অনেক মিটিং-এ যেতে হবে?
প্রতাপ হেসে বললেন, না না, আমার আবার মিটিং কিসের?
–আপনারা হাকিম মানুষ, আপনাদের কত লোক ডাকে!
প্রতাপ আবার হাসলেন। মফস্বলে যখন পোস্টিং ছিল, তখন অনেকে মানতো ঠিকই। স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের জন্য তাঁকেই ডাকা হতো। কিন্তু কলকাতায় কেউ গ্রাহ্য করে না।
জগৎপতি বললো, আপনি ঐ দিন ফ্রি আছেন? তবে আমাদের সঙ্গে চলুন না। বিমানদাও যাচ্ছেন।
–কোথায়?
–বারুইপুরে এই গরিবের একখানা ছোট বাড়ি আছে, ছুটির দিনটায় দু’চারজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে যাবো ঠিক করিছি। চলুন না, খারাপ লাগবে না, পুকুরের মাছ খাওয়াতে পিরবো আশা করি।
প্রতাপ এড়িয়ে যাবার জন্য বললেন, ঠিক আছে, আমি বিমানের সঙ্গে কথা বলবো।
জগৎপতি একগাল হেসে বললেন, কথা বলার আর কী আছে? মাঝখানে তো আর তিনটে মাত্র দিন। আপনি সকাল সাড়ে আটটায় শেয়ালদা সাউথ স্টেশনে চলে আসুন! প্রতাপ বললেন, আচ্ছা দেখি!
–আর দেখাদেখির কিছু নেই। আপনাকে কিন্তু কাউন্ট করছি। আমি বিমানদাদাকে আগেই আপনাকে ইনফ্লুড করার কথা বলেছিলুম, বিশ্বাস করুন। আটটা পঞ্চাশের ট্রেন, ফেইল না হয়!
জগৎপতি বিদায় নেবার পর প্রতাপ বাকি বাজার সারতে লাগলেন। ইচ্ছে মতন মাছ কিনতে পারেননি বলে তাঁর মুখখানা গোমড়া হয়ে গেছে। একজন তরকারিওয়ালার সঙ্গে তিনি প্রায় ঝগড়া করে ফেলছিলেন। একেই তো সব জিনিসের দাম বেশি, তার ওপর খুচরো পয়সা দেবার সময়েও ওরা ঠকাচ্ছে। কয়েক মাস আগে নয়া-পয়সা চালু হয়েছে। টাকা-আনা-পাইয়ের বদলে একশো নয়া পয়সায় একটাকা। এখনো আনি-দুয়ানি চলছে, নয়া পয়সাও চলছে। পুরনো পয়সার বদলে নতুন খুচরো দিতে গিয়ে সব দোকানদারই কম দেয়।
মেজাজ গরম করতে গিয়ে প্রতাপ শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন। সামান্য দু’একটা পয়সার জন্য বকাবকি করা কি তাঁর মানায়? তিনি এত নীচে নেমে যাচ্ছেন? প্রতাপ নিজেকেই ধমক দিলেন। তারপর আলুওয়ালার কাছ থেকে খুচরো পয়সা ফেরৎ না নিয়েই হনহন করে বেরিয়ে গেলেন বাজার থেকে।
পরদিন বিমানবিহারীর একজন কর্মচারী একখানা চিঠি নিয়ে এলো। ১৫ অগাস্ট জগৎপতি দত্তের বারুইপুরের বাড়িতে পিকনিকে যাওয়ার জন্য তিনি প্রতাপকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যাদেরও নেমন্তন্ন।
মমতার ক’দিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তিনি যেতে রাজি হলেন না। পিকলু আর বাবলু দু’জনেই পাড়ার ক্লাবের ফাংকশনের সঙ্গে জড়িত। তুতুল আর মুন্নিকে অন্তত নিয়ে যেতে চাইলেন প্রতাপ, তুতুলও অনিচ্ছা প্রকাশ করলো!
১৫ই আগাস্ট খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল সকলের। প্রভাত ফেরী বেরিয়েছে বিভিন্ন ক্লাব থেকে। শুধু গান নয়, তার সঙ্গে আছে বিউল ও কেব্ল ড্রাম। একটার পর একটা মিছিল। আসছে।
প্রতাপ তৈরী হয়ে নিয়ে মুন্নির হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন সাতটার মধ্যে। ট্রাম বাসে যাওয়া অনিশ্চিত, আজ শিয়ালদা পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হবে। মুন্নি একটা লাল রঙের ফ্রক পরেছে, তার পিসিমণি এটা বানিয়ে দিয়েছেন। সুপ্রীতির শেলাই-ফোঁড়াইয়ের যথেষ্ট জ্ঞান আছে। প্রতাপকেও নিজের হাতে একটা পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছেন এবারের জন্মদিনে।
মুন্নি এখন স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু তার মুখে আঙুল দেওয়া রোগটি এখনো যায়নি। মমতা আজ বারবার বলে দিয়েছেন বাইরের লোকজনদের মাঝখানে সে যেন ওরকম অসভ্যতা না করে। প্রতাপকেও তা সর্বক্ষণ নজর রাখতে হবে।
রাস্তার মোড়ে বানানো হয়েছে তোরণ। চতুর্দিকে ঝুলছে কাগজের মালা। অনেক বাড়ির ছাদে ওড়ানো হয়েছে জাতীয় পতাকা, প্রতাপের বাড়িওয়ালাও বাদ যায়নি। এ বছরের উৎসবের জাঁকজমক অনেক বেশী। শুধু স্বাধীনতার দশম বৎসর তো নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের একশো বছর পূর্তি। ১৭৫৭-তে পলাশী যুদ্ধে বাংলার পতন, ১৮৫৭-তে সিপাহী বিপ্লব, তারপর এই ১৯৫৭; অনেকে ভেবেছিল এ বছরও সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা ঘটবে! এ পর্যন্ত তো কিছুই দেখা গেল না! অবশ্য গুজব ছড়িয়েছে নানারকম। অনেকেই বলাবলি করছিল, নেতাজী সুভাষ বোস তিব্বতে তাঁবু গেড়ে আছেন, এই বছরই তিনি বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে আবার ভারতে ঢুকবেন, তারপর হিন্দুস্থান-পাকিস্তান এক করে দেবেন। তাঁকে সবাই মানবে।
প্রতাপ অবশ্য এ গুজব একটুও বিশ্বাস করেননি। সুভাষ বোস যদি বেঁচেও থাকেন, তাহলে তিনি সৈন্যবাহিনী পাবেন কোথায়? আই এন এর সবাই তো আত্মসমর্পণ করেছিল। যুদ্ধ চলার সময় জওহরলাল বলেছিলেন, সুভাষ বোস যদি বিদেশী সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতে পা দেন তাহলে তিনি নিজে তলোয়ার নিয়ে তাঁর মোকাবিলা করবেন। এখন যদি সুভাষবাবু সত্যিই কোনো সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন তাহলে কী বলবেন জওহরলাল? তিনি কি সহ্য করতে পারবেন তাঁর এই প্রতিদ্বন্দ্বীটিকে?
বহু বাড়ির ছাদ ও বারান্দায় তো জাতীয় পতাকা উড়ছেই, রাস্তায় অনেক লোক হাতে একটা করে তেরঙ্গা ঝাণ্ডা নিয়ে ঘুরছে। মুন্নি বললে, বাবা, আমাকে একটা ফ্ল্যাগ কিনে দাও!
প্রতাপকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হলো না, শ্যামবাজারের মোড়ে আসবার আগেই একদল ছেলে তাঁর আর মুন্নির জামায় আলপিন দিয়ে দুটি পতাকা আঁকা ব্যাজ লাগিয়ে দিয়ে বললো, একটা টাকা দিন স্যার!
ব্যাজগুলোর দাম দু’আনার বেশী নয়। এই সুযোগে কেউ কেউ ব্যবসাও শুরু করে দিয়েছে। বিনা আপত্তিতে প্রতাপ টাকাটা দিয়ে দিলেন। আর এক টাকা দিয়ে মুন্নির জন্য একটা পতাকা আঁকা গ্যাস বেলুনও কিনলেন। বেলুনের সুতোটা বেঁধে দিলেন মুন্নির বাঁ হাতে। স্বাধীনতা না উড়ে চলে যায়!
স্বাধীনতা! প্রতাপদের যৌবনের স্বপ্নের স্বাধীনতা! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি যখন বোঝা গিয়েছিল ইংরেজ জিতুক বা হারুক, এবারে সত্যিই ভারতের স্বাধীনতা আসবে। তখন কী সাংঘাতিক উত্তেজনায় দিন গেছে। স্বাধীনতা শব্দটি শুনলেই রক্তস্রোত চঞ্চল হয়ে উঠতো। যেন স্বাধীনতা এদেশে সোনার দিন এনে দেবে।
স্বাধীনতার পর অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়, তা সবাই জানে। দেশের মানুষ অনেক রকম ত্যাগ স্বীকার না করলে একটা নতুন দেশের স্বাধীনতা মজবুত হয় না। কিন্তু ত্যাগ স্বীকার করছে কারা? শুধু গরিবরা। যারা ধনী, তারা অনেকেই আরও ধনী হচ্ছে, রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে তৈরি হচ্ছে একদল নতুন ধনী সম্প্রদায়। একটা উটকো দালাল শ্রেণী, তাদের ধরন বারণই অসহ্য। এই দশ বছর ধরে পণ্ডিত নেহেরু ভারতে টিকিয়ে রেখেছেন গণতন্ত্র। এই তাঁর গর্ব। শুধু ভোটের গণতন্ত্র! সারা দেশ জুড়ে অভাব-অনটন। চতুর্দিকে ধর্মঘটের হুমকি। এই মাসেই তো সর্বভারতীয় সরকারি কর্মচারী ধর্মঘটের প্রস্তাব কোনো রকমে ধামা চাপা দেওয়া হলো। ডাক ও তার কর্মীরা ধর্মঘটে প্রায় নেমেই পড়েছিল, তোষামোদ করে থামানো হয়েছে। এদের বেলায় তোষামোদ, কিন্তু দিল্লীতে ঝাড়ুদারদের ধর্মঘটে নেহরুর নাকের ডগার ওপর রেহ গুলি চালালো পুলিশ। সরকারী হিসেবেই মারা গেছে দু’জন, বেসরকারী হিসেবে কতজন কে জানে? যেখানে গান্ধীজী নিহত হয়েছিলেন সেখানেই আবার গুলি খেয়ে মরলো তাঁর প্রিয় হরিজনরা!
–বাবা, ওটা কী ঠাকুর?
মুন্নির কথা শুনে প্রতাপ ধাতস্থ হলেন। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। আজ এই সব তিক্তকথা মন থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই ভালো।
একটা বেশ বড় ক্লাবের মিছিল বেরিয়েছে। সাদা পোশাক পরা নানা বয়েসী ছেলে-মেয়েরা ধীরতালে হাঁটছে দু’সারিতে, গান গাইতে গাইতে। অবশ্য ড্রাম-বিউগলের ধুন্ধুমারে গান শোনাই যাচ্ছে না। কিন্তু ফুটফুটে মুখগুলি দেখতে ভালো লাগে। কার্ডবোর্ড কেটে গান্ধীজীর একটা বড় মূর্তি বানিয়ে মাঝখান দিয়ে নিয়ে চলেছে একটা ঠেলা গাড়িতে চাপিয়ে। মুন্নি ওটাকেই ঠাকুর ভেবেছে। হ্যাঁ ঠাকুরই বটে, গান্ধী ঠাকুর, জাতির পিতা! প্রত্যেক সরকারী অফিসে, স্কুল-কলেজে গান্ধীজীর রং করা ছবি ঝোলে। এমনকি আদালতে, বাররুমেও। কিন্তু গান্ধীজীকে ভুলে গেছে সবাই, তার নীতিটিতি সব গোল্লায় গেছে। অহিংসার কথা শুনলেই সবাই হাসে। গান্ধী টুপি পরা মন্ত্রীরা প্রথম প্রথম সব বক্তৃতাতেই একবার করে গদগদ স্বরে গান্ধীজীর নাম। উচ্চারণ করতেন, এখন তাও বন্ধ। পণ্ডিত নেহরু পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে জেদাজেদি করে সমরাস্ত্র বাড়িয়ে চলেছেন।
-–ঠাকুর না রে, উনি হচ্ছেন মহাত্মা গান্ধী।
–নমো করবো?
প্রতাপ একটু দ্বিধা করলেন। মেয়েকে তিনি কী শেখাবেন? গান্ধীজীর মূর্তিকে প্রণাম করবার তিনি কোনো যুক্তি খুঁজে পান না। কিন্তু বাচ্চা মেয়ে, ওদের জগৎটা অন্যরকম।
এর পর যে মিছিলটা এলো, তাতে গান্ধীজীর মূর্তি নেই, কিন্তু ছেলেমেয়েরা অনেকগুলি বড় বড় ছবি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই ফরোয়ার্ড ব্লকের। ছবিগুলি সুভাষ বোস, ধীলন, শা-নওয়াজ খান, লছমী বাঈ এই সব আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের। এই মিছিল দেখে রাস্তার দু’পাশের লোক হাততালি দিয়ে উঠলো। বাঙালীরা কোনোদিন যুদ্ধ করেনি, কিন্তু যুদ্ধের গল্প ভালোবাসে। আজকাল সুভাষবাবুর ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ছবি দেখাই যায় না। সবই মিলিটারি পোশাক পরা চেহারা। সুভাষবাবু সম্পর্কে মাঝে মাঝেই যেসব গুজব ছড়ায়, তার কোনোটাতেই তাঁর একা ফিরে আসার কথা নেই। তিনি আসবেন সামরিকবাহিনীর প্রধান হয়ে!
মানিকতলা পর্যন্ত হেঁটে আসার পর প্রতাপ বুঝতে পারলেন মুন্নি ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সে বাবার কোলেও চড়বে না। বাস দেখা যাচ্ছে না একটাও কিন্তু ট্রাম বেরিয়েছে, কচ্ছপ গতিতে চলছে। প্রতাপ একটা ট্রামে চেপে বসলেন। হাতে অনেক সময় আছে।
মুন্নি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মিছিল দেখতে দেখতে বললো, বাবা, স্বাধীনতা দিবসে গাড়িতে চড়লে কি পাপ হয়? সবাই যে হেঁটে যাচ্ছে!
প্রতাপ বললেন, না রে! ওরা তো মিছিল করে যাচ্ছে, আমরা অন্য জায়গায় যাচ্ছি।
মুন্নি আবার জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বাবা, ওরা হাঁটতে হাঁটতে কত দূরে যাবে? স্বাধীনতা কোথায় আছে?
প্রতাপের পাশে একজন বৃদ্ধ সহযাত্রী ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, এইবার মোশাই আপনার মেয়ে একখানা সুকঠিন প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিন!
প্রতাপও হাসলেন।
বৃদ্ধটি মুন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ভারী মিষ্টি মেয়ে। মা, সারা জীবন ধরেই স্বাধীনতা খুঁজতে হয়। সহজে তো পাওয়া যায় না!
শিয়ালদায় নেমে প্রতাপ দেখলেন প্রধান গেটের কাছেই জগৎপতি দাঁড়িয়ে আছেন একটি ছোট দল নিয়ে। প্রতাপকে দেখে উনি হৈ হৈ করে স্বাগত জানালেন। তারপর বললেন, ঐখেনে ছায়াতে গিয়ে দাঁড়ান, বিমানদারাও এসে গেছেন।
বিমানবিহারীর সঙ্গে এসেছে অলি আর বুলি। মুন্নি ওদের দেখে ছুটে গেল। অলি জিজ্ঞেস করলো, পিকলুদা বাবলুদা আসেনি? কেন? এমা, ভাল্লাগে না, আমরা তো ওখানে আর কারুকে চিনি না!
বিমানবিহারী আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, মেঘ মেঘ করেছে, বৃষ্টি হলেই সব পণ্ড হয়ে যাবে!
প্রতাপ বললেন, এ বছর তো বৃষ্টি হলোই না ভালো করে। হোক, বৃষ্টি হোক। বিমানবিহারী হেসে বললেন, তা বলে আজকের দিনটাতেই হতে হবে কেন? আজ সব ছেলে-মেয়েরা উৎসব করছে, আমরা পিকনিক যাচ্ছি…
একটি চা-ওয়ালা সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবে নাকি? ওহে, দাও তো–
বিমানবিহারী সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, আমি না, আমি না, ওরে বাবা, এই চা! গুড় দিয়েছে, কতক্ষণ ধরে ফুটিয়েছে ঠিক নেই, জিভের স্বাদ নষ্ট করে দেবে!
প্রতাপ বললেন, আমার জিভ পুরু, আমার এতেই চলবে।
মাটির খুরিতে পেতলের কলসী থেকে ঢালা চা দু’বার নিলেন প্রতাপ। তারপর সিগারেট ধরিয়ে গল্প করতে লাগলেন বন্ধুর সঙ্গে।
কিন্তু এখানে এক জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়াবার উপায় আছে? অসম্ভব ভিখিরির উপদ্রব। বুড়ো, বুড়ি, বাচ্চা ভিখিরী। নাছোড়বান্দা সব। বিমানবিহারীদের মাঝে মাঝেই সরে দাঁড়াতে হয়। স্টেশন চত্বরটাতে যেমন নোংরা, তেমন দুর্গন্ধ। ভেতরের সব প্ল্যাটফর্মে উদ্বাস্তুদের স্থায়ী আস্তানা, এখন অনেকে বাইরেও উপছে এসেছে। এদিকে ওদিকে ছেঁড়া চটের তাঁবু। তার মধ্যেই চলেছে মানুষের সংসার।
বিমানবিহারী ছাপাখানার গল্প শুরু করেছেন। পূজোর আগেই তাঁর পাঁচখানা বই প্রকাশ করার কথা, কিন্তু তাঁর প্রেসের কর্মচারীরা ধর্মঘট করেছে। অকটোবর-নভেম্বরের মধ্যে বই বাজারে ছাড়তে না পারলে তিনি টেক্সট বুক সিলেকশন কমিটিতে ধরাতে পারবেন না, সেইজন্য তিনি উদ্বিগ্ন। এই রকম মেঘলা দিনে ছাপা ভালো হয়। তাঁর বন্ধু দিলীপকুমার গুপ্ত বলেন, কবিরা যেমন আকাশের মেঘ দেখে কবিতা লেখে, সেইরকম কবিতার বই ছাপার জন্যও আকাশে মেঘের অপেক্ষা করতে হয়।
একটি বুড়ি ভিখিরী অনেকক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করছে। প্রতাপ এক সময় চমকে উঠলেন। কালুর মা নয়? মালখানগরে কালুর মা ছিল অনেকগুলি বাড়ির বাঁধা ধাইমা। প্রতাপও কালুর মা’র হাতে জন্মেছেন। সেই কালুর মা এখানে ভিক্ষে করছে? পরক্ষণেই প্রতাপ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। কালুর মায়ের এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়। তবু তিনি বুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি কোথায় ছিল।
ঘোলাটে চোখ তুলে বুড়ি বললো, বাড়ির কথা আর জিগাইও না, বাবা! কুনোদিন যে আমাগো বাড়ি আছিল, তা যেন নিজেরই আর বিশ্বাস হয় না!
প্রতাপ একটা দশ নয়া দিলেন। এ সে নয়, তবু এই বুড়ির চেহারা অবিকল কালুর মায়ের মতন।
বিমানবিহারী এখনো ছাপাখানার কথা বলে যাচ্ছেন, প্রতাপ সে দিকে মন দিতে পারছেন না। তিনি দেখছেন রিফিউজিদের তাঁবু। তাঁর আর বিমানবিহারীর দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ হবেই। কলকাতার মানুষদের রিফিউজি দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে। সহানুভূতি শুকিয়ে গেছে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটানা দশ বছর ধরে সহানুভূতি টিকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু প্রতাপ এখনো এদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন।
তিনি অস্ফুটভাবে বললেন, দেশ বিভাগের দশ বছর পূর্ণ হয়ে গেল, এখনো রিফিউজিদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করতে পারলো না দেশের সরকার। এই স্বাধীনতার মূল্য কী?
বিমানবিহারী এবারে এদিকে মনোযোগ ফিরিয়ে বললেন, দশ বছরের স্বাধীনতা তো নিতান্ত শিশু, এর মধ্যে কতটুকুই বা করা সম্ভব বলো। সমস্যা তো হাজারটা।
তারপর আশপাশের তাঁবুগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,এরা সবাই কিন্তু ইস্ট পাকিস্তানের রিফিউজি নয়, বুঝলে। শুনেছি, সুন্দরবন অঞ্চলে এ বছর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে–সেখানকার মানুষ হাজারে হাজারে কলকাতায় চলে আসছে। এরপর রাস্তাঘাট সব ভরে যাবে।
প্রতাপ বললেন, সুন্দরবন থেকে যারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতে আসে, তারাও রিফিউজি!
ট্রেনের সময় হয়ে গেছে, কুড়িবাইশ জনের একটি দল ট্রেনে উঠলো। বারুইপুরে পৌঁছে দেখা গেল জগৎপতি দত্ত অতি বিনয় করেছিলেন। এখানে তাঁর প্রচুর সম্পত্তি। একটি বেশ ছড়ানো পাকা বাড়ি, দু’দিকে ঘেরা বারান্দা, সামনে চওড়া উঠোন, তারপর বাগান, একধারে একটি পুকুর সেটিকে দীঘি বলা যায়। সে বাড়ীতে পৌঁছানো মাত্র ফল-মিষ্টি-মাছভাজা দিয়ে এমন জলখাবার দেওয়া হলো যে দুপুরের খাওয়াটা কী পরিমাণ হবে তা অনায়াসে বোঝা যায়।
ছেলেমেয়েদের খুব মজা, এতখানি ফাঁকা জায়গা তো কলকাতায় পাওয়া যায় না। উঠোনের এক কোণে একটা সবেদা গাছ, মুন্নি ঐ গাছ আগে দেখেনি। সে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, ক্যাম্বিসের বলের মতোন ঐগুলো কী? উঠোনের আর এক কোণে বড় বড় বঁটিতে কাটা হচ্ছে পুকুর থেকে ধরা রুই কালা, একটা প্রায় চার-পাঁচ সের ওজনের রুই এখনো লাফাচ্ছে, অত। বড় মাছও মুন্নি দেখে নি কখনো, সে ভয় পেয়ে বাবার হাত চেপে ধরলো।
পুকুরঘাটে একটা নৌকো বাঁধা আছে। অলিবুলি বায়না ধরলো সেই নৌকো চাপবে। সবাই এক সঙ্গে না না করে উঠলো। জগৎপতির ছেলে করুণাসিন্ধু বললো, আমাদের হারান থাকলে তবু নিয়ে যেতে পারতো ওদের, সে ভালো নৌকো চালায়, কিন্তু হারানের জ্বর।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, বৈঠা আছে? তা হলে মাঝির দরকার নেই, আমিই চালাতে পারবো।
করুণাসিন্ধু জিজ্ঞেস করলো, আপনি বুঝি রোয়িং জানেন?
প্রতাপ হেসে বললেন, না, আমি কোনো সুইমিং ক্লাবে রোয়িং শিখিনি, তবে নদী-নালার। দেশের মানুষ তো। নৌকো চালাতে জানি।
বৈঠা নিয়ে তিনি নৌকোয় উঠে বাচ্চাদের ডেকে বললেন, আয়, তোদের ঘুরিয়ে নিয়ে। আসি।
বিমানবিহারীর মুখ শুকিয়ে গেছে। আদালতের একজন হাকিম নৌকো চালাবেন, একথা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রতাপ বিমানবিহারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয় নেই, বাচ্চাদের দায়িত্ব আমার। তুমিও আসবে নাকি!
বিমানবিহারী সাঁতার জানেন না, তিনি নৌকোয় উঠতে রাজি হলেন না।
প্রতাপ মনে মনে হিসেব করে দেখলেন, যুদ্ধের পরের বছর দেশে গিয়ে তিনি শেষবার নৌকো চালিয়েছিলেন। এগারো বছর আগে। বৈঠা জলে ফেলে তিনি বুঝতে পারলেন, কিছুই ভোলেন নি। তিনি অনায়াসে চলে এলেন মাঝপুকুরে। বেশ স্বচ্ছ জল, এদিকে ওদিকে ফুটকাটা দেখে মনে হয় অনেক মাছ আছে। প্রতাপদের বাড়ির দীঘিটাও এইরকম সাইজই হবে। তবে তার একদিকে ঘন জঙ্গল ছিল, এখানে বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে, প্রতাপদের দীঘির পাড়ে সেই ঘন জঙ্গল কি এখনো আছে?
অলিবুলিরা একটুও ভয় পায়নি, তারা হাসছে খলখলিয়ে। প্রতাপ ফিরতে চাইলেও তারা রাজি নয়। তারা সমস্বরে বলছে, আর একটু, আর একটু। দূরে ঘাটের কাছে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অনেক দর্শক।
দুপুরের খাওয়ার আয়োজন দেখে সত্যি চক্ষু চড়কগাছ হবার উপক্রম। প্রত্যেকের জন্য বড় কাঁসার থালা, সেই থালা ঘিরে সাতখানা বাটি। এত বাসনপত্র আছে এদের? এত খাওয়া কি। মানুষে খেতে পারে? জগৎপতি খাওয়াতে খুব ভালোবাসেন, মাঝে মাঝেই নাকি কলকাতা। থেকে এরকম বন্ধুবান্ধবের দল নিয়ে আসেন।
বিমানবিহারী স্বল্পাহারী মানুষ, তিনি প্রায় কিছুই খাচ্ছেন না, জগৎপতি জোর করছেন তাঁকে। সামনে বসে বলছেন, দাদা, খান, খান, একদিন তো, কলকাতায় খেয়ে কিছু সুখ আছে? সবই তো বাসি কিংবাভেজাল। এরকম টাটকা জিনিস পাবেন কোথায়? জানেন দাদা, যা যা খাচ্ছেন, তার একটা জিনিসও কেনা নয়। সব আমার নিজের বাড়ির। আমার নিজের খেতের চাল, বাড়ির গরুর দুধের ঘি, আলু-পটল-বেগুন সবই আমার বাগানে হয়, নিজের পুকুরের মাছ…
তারপর তিনি প্রতাপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, খাচ্ছেন তো?
প্রতাপ উত্তর দিতে পারলেন না। তাঁর গলা হঠাৎ আটকে গেছে, চোখ জ্বালা করছে। নিজেকে তিনি সামলাবার চেষ্টা করছেন অতি কষ্টে। এ কী ছেলেমানুষী করছেন তিনি, বাস্তবকে মেনে নিতে পারছেন না? ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হয়। এত লোকের সামনে তিনি কেঁদে ফেলবেন নাকি?
কথা না বলে প্রতাপ শুধু দু’বার মাথা নাড়লেন। তারপর জগৎপতি কী যে বলে যেতে লাগলেন, তিনি আর তা শুনতে পেলেন না। তাঁর মনে পড়ছে মায়ের কথা। দেওঘরে মা একেবারে নিষ্প্রাণ, শীতল হয়ে গেছেন। অথচ মাত্র এক দশক আগে, তাঁর মা এইরকমভাবে সবাইকে কত উৎসাহ করে খাওয়াতেন, অবিকল এইরকম একটি বাড়ি, নিজেদের খেতের চাল, বাগানের তরকারি, পুকুরের মাছ, বাড়িতে তৈরি ঘি….
আজ স্বাধীনতার দিনে জগৎপতি দত্ত বন্ধু-বান্ধবকে খাইয়ে আনন্দ করছেন। স্বাধীনতার মূল্য এক একজনের কাছে এক একরকম!