তুতুল বাগবাজারের একটি স্কুলে ক্লাস টেন-এ ভর্তি হয়েছে। বাড়ি থেকে স্কুল বেশি দূরে নয়, সহজ রাস্তা, সে একাই যায়-আসে। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে এক একদিন দুটি যুবককে দেখতে পায়, যারা পরস্পর ফিস ফিস করে কথা বলে, তুতুলের দিকে আড়চোখে তাকায়। পেছনে পেছনে অনেকটা পথ আসে। এরা বরানগরের ছেলে, তুতুল ওদের মুখ চেনে, ওদের মধ্যে যে বেশি লম্বা, ঠোঁটে সব সময় সিগারেট ঝুলে থাকে, সে একদিন বরানগরের স্কুল থেকে ফেরার সময় তুতুলের হাতে জোর করে একটা চিঠি গুঁজে দিয়েছিল।
ছেলেদুটিকে দেখলেই তুতুলের ভয় ভয় করে। কিন্তু বাড়িতে এসে মা-কে আর কিছু বলে না।
পড়াশুনো করতে তার ভালো লাগে, ঘুমোবার সময়টুকু ছাড়া সর্বক্ষণ তার হাতে বই। পিকলু বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছে, সে দুখানা করে বই আনে, তুতুল সেই বই পিকলুর কাছ থেকে কাড়াকাড়ি করে পড়ে। স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকেও সে পত্র-পত্রিকা পায়। বরানগরের বাড়িতে থাকার সময় কিছুদিন তার জন্য একজন বৃদ্ধ গানের মাস্টার রাখা হয়েছিল, দেওঘরে বিশ্বনাথ কয়েকদিন তুতুলকে সাধাতে গিয়ে বলেছিলেন, এ মেয়ের কিন্তু গান হবে। চর্চা করলে নাম হবে। কিন্তু এখন তুতুলের গানের পাট চুকে গেছে। বরানগরের বাড়ি ছাড়ার সময় হারমোনিয়ামটা নিয়ে আসা হয় নি, এখানে তুতুল বাথরুমে মাঝে মাঝে গুন গুন করে শুধু।
শোবার ঘরেই জানলার পাশে একটা ছোট টেবিল, সেখানে বসে পড়াশুনা করে তুতুল। পাশের ঘরে পিকলু আর বাবলু প্রায়ই চ্যাঁচামেচি করে, তাছাড়া মাঝে মাঝেই চলে আসে বাইরের লোক, তাই তুতুলের জন্য আলাদা ব্যবস্থা।
এই ঘরের সামনে গলি, উল্টোদিকেই একটি ছোট একতলা বাড়ি। সেই বাড়ির উঠোনে একটি আমগাছ আছে, গাছটির শাখা-প্রশাখা ঢেকে দিয়েছে অর্ধেক ছাদ।
গলি দিয়ে কতরকম ফেরিওয়ালা হেঁকে যায়, কে কখন আসবে তা তুতুলের মুখস্থ হয়ে। গেছে। সকালের দিকে আসে, মুড়ির চাক, চিড়ের চাক, ছোলার চাক চাই! তিলকুটো, চন্দ্রপুলি, শোন-পা-প-ড়ি! মাখন চাই, মাখন যে বলে তার গলা অনেকটা কীর্তন গায়ক কানাকেষ্টর মতন। দুপুরে আসে বাসনওয়ালীরা, তাদের এক একজনের গলায় এক এক রকম সুর, তাদের মধ্যে একটি লাল ফুলফুল ছাপ শাড়ী পরা বাসনওয়ালীকে কি সুন্দর দেখতে। একজন পুরুষ বাসনওয়ালাও আসে, সে খুব গেরেমভারি, তার পেছনে একটি মুটের মাথায়। থাকে পেতল-কাঁসার বাসনপত্র, আর সে নিজে একটা কাঁসি বাজাতে বাজাতে আসে। চুড়িওয়ালা ও শিল কাটাবে–এরাও দুপুরেই আসে। সন্ধের পর পকৌড়ি, মালাই বরফ, আর। বেলফুল চাই, বেল ফুল!
বরানগরে মস্ত বড় বাড়ি ছিল, সেখান থেকে রাস্তার প্রবাহিত জীবনের শব্দ-গন্ধ এমন পাওয়া যেত না।
সামনের একতলা বাড়িটার ছাদের ওপর ছাতার মতন মেলে থাকা আমগাছটায় কত রকম পাখি এসে বসে। আসে ঝাঁক ঝাঁক টিয়া পাখি। শালিক-চড়ুই-পায়রা তো আছেই। একদিন একটা বেশ বড় মতন খয়েরি-সাদা মেশানো ল্যাজ-ঝোলা পাখি এসে বসেছিল, তুতুল সে। পাখির নাম জানে না। আমগাছটার ডগার দিকে ডালে প্রায় আটকে থাকে একটা না একটা। ঘুড়ি। বৃষ্টির সময় গাছের ডালগুলো যেন প্রবল খুশীতে মাথা ঝাঁকাতে থাকে।
ঐ ছাদে, আমগাছের ছায়ায় প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকে একটি যুবক। পা-জামার ওপর গেঞ্জি পরা, মাথায় বড় বড় চুল, জুলফি দুটো কানের লতি পর্যন্ত নামানো। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তুতুলের জানলার দিকে। তুতুলের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে হাতছানি দিয়ে কী যেন বলতে চায়। তুতুল সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
ঐ যুবকটির কথাও তুতুল মাকে বলেনি কিন্তু সুপ্রীতির ঠিক নজরে পড়ে গেল একদিন। সুপ্রীতি নিজে অনেকক্ষণ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাতেও সেই যুবকটি সরে গেল না, তার চক্ষুলজ্জা নেই, নিজেদের বাড়ির ছাদে সে ঘুরবে। তাতে কার কী বলার আছে?
সুপ্রীতির নির্দেশে এখন সেই জানলা বন্ধ রাখতে হয় তুতুলকে। এজন্য তার কান্না পেয়ে যায় মাঝে মাঝে। একটা জানলা আছে, তবু খোলা যাবে না। দিনের বেলা আলো জ্বেলে বই পড়তে হবে। যদি পিকলু এই টেবিলে বসে পড়াশুনো করতো, তাহলে কি জানলা বন্ধ রাখতে হতো?
তিনতলায় বাড়িওয়ালাদের কাছে অনেকগুলো বাঁধানো প্রবাসী পত্রিকা আছে, আর আছে বসুমতী সিরিজের কয়েকটা গ্রন্থাবলী। গল্পের বই-এর অনটন হলে তুতুল ওপর থেকে ঐ বই আনতে যায়। বাড়িওয়ালার স্ত্রী প্রথম দিন থেকেই ওদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছেন, তাঁর সঙ্গে গল্প করতেও ভাল লাগে।
কিন্তু সেখানেও একটা উপদ্রব আছে। অতসীর এক মামাতো ভাই হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে, প্রায়ই সে দুপুরের দিকে চলে আসে দিদির কাছে। তুতুল যেদিনই ওপরে যায় সেদিনই সে ঐ ছেলেটিকে অতসীর ঘরে শুয়ে থাকতে দেখে। ছেলেটি হস্টেলের জীবন সম্পর্কে নানা রকম মজার মজার গল্প বলে, খাট থেকে নেমে সে নানান অঙ্গভঙ্গি করে হস্টেল-সুপারের চরিত্র বোঝায়। শুনতে বেশ মজাই লাগে।
একদিন ঐ রকম গল্প হচ্ছে, হঠাৎ অতসী বললেন, এই রে, উনুনে দুধ চাপিয়ে এসেছি, তোর গল্প শুনতে শুনতে সব গেল বুঝি রে! বলেই তিনি দৌড়ে চলে গেলেন রান্না ঘরে।
আর সঙ্গে সঙ্গে মামাতো ভাইটি তড়াক করে খাট থেকে নেমে এসে বললো, দেখি তো তুতুল, তুমি কতটা লম্বা! সে তুতুলের কাঁধে হাত দিয়ে তার পাশে দাঁড় করাবার ছলে ইচ্ছে করে তুতুলের বুক ছুঁয়ে দিল।
তারপর থেকে আর তুতুল তিনতলায় যায় না।
এই সব কারণে, মাঝে মাঝেই মেয়ে হয়ে জন্মাবার জন্য তুতুলের ভীষণ রাগ হয়! সে ভাবে, ভগবান কেন এত স্বার্থপর? ভগবান নিজে পুরুষ বলেই মানুষের মধ্যে পুরুষদের অনেক বেশি সুবিধে দিয়ে মেয়েদের অনেক ব্যাপারে বঞ্চিত করেছেন। পিকলু তার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়, অথচ তার তুলনায় পিকলু কত স্বাধীন! তুতুল যতই মন দিয়ে পড়াশুনো করুক, তবু তাকে যত ব্যাঘাত সহ্য করতে হয়, পিকলুকে তো সে সব কিছুই সহ্য করতে হয় না!
বইতে মন বসাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে তুতুলের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তুতুল বরানগরের সেই ছেলেদুটির সঙ্গে তার পিসতুতো দাদা শিবেনকে দেখতে পেল। বোস পাড়া লেনের মুখটায় দাঁড়িয়ে সে অন্য দু’জনের সঙ্গে সিগারেট টানতে টানতে গল্প করছে। বংশের ধারা অনুযায়ী শিবেনও কোনো কাজকর্ম করে না, পড়াশুনোয় মাঝপথে ইস্তফা দিয়েছে। তার চেহারা ও পোশাকে ঠিকই বোঝা যায় সে বনেদী বংশের ছেলে।
তুতুলের জন্য সে প্রতীক্ষা করছিল, কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তুতুলকে দেখে এগিয়ে এসে সে অবাক হবার ভাণ করে বললো, আরে, তুতুল, তোরা এখেনে থাকিস নাকি? বরানগর থেকে চলে এলি, তারপর তো কোনো পাত্তাই নেই! মাইমা কেমন আছেন? তুই এত রোগা হয়ে গেলি কী করে র্যা?
উত্তরের অপেক্ষা না করে শিবেন নিজেই অনেক কথা বলে যায়। তারপর একবার জিজ্ঞেস করলো, তোরা কোন্ বাড়িতে থাকিস? চ, মাইমার সঙ্গে দেখা করে আসি।
তার পরনে গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় পাউডার ও একটি সোনার চেইন, ধুতির কোঁচার ফুলটি রাস্তার ধুলো ঝাড় দিতে দিতে চলে। বাড়িতে এসে সে সুপ্রীতির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো, মাইমা, হঠাৎ চলে এলেন, আমাদের একটা খপরও পর্যন্ত দিলেন না। আমরা কি আপনার পর?
ছেলেটিকে দেখে খুশী হননি সুপ্রীতি। বরানগরের বাড়িতেও এই শিবেন যখন তখন এসে বসে থাকতো বিনা কারণে। এর মুখে শুধু কথার ফুলঝুরি। তবু আপন ননদের ছেলে, একেবারে হেলা-তুচ্ছ করা যায় না। তিনি বাবলুকে দিয়ে পাশের দোকান থেকে মিষ্টি আনিয়ে। তাকে খেতে দিলেন, তার বাড়ির সবার খোঁজ-খবর নিলেন।
শিবেন বললো, এই বাড়িতে এসে রয়েছেন, মাইমা? স্যাঁতসেঁতে, ঘরে আলো ঢোকে না। বরোনগরের বাড়িতে আপনার মহোলটা এখনো খালি পড়ে রয়েছে, ফিরে চলুন না। মা বলছিলেন, আমাদের বংশে কেউ কোনোদিন ভাড়া বাড়িতে থাকেনিকো।
সুপ্রীতি বললেন, না, এখানেই বেশ আছি।
এক ঘণ্টা পরে সে উঠলো এবং পরদিন আবার এলো। এ বাড়িতে জায়গা কম, ঘরের মধ্যে একজন লোক বসে থাকলে বড় অসুবিধে হয়। তাছাড়া শিবেনের বাচালতা ধৈর্য ধরে শুনবে কে? সুপ্রীতি ওকে মিষ্টি আনিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যান, তুতুলকেই বসে থাকতে হয়।
তৃতীয় দিনে এসে বললো, মাইমা, তুতলকে একটু বেড়াতে নিয়ে যাবো?
সুপ্রীতি অবাক হয়ে বলেন, তুতুলকে তুমি নিয়ে যাবে? কোথায়?
শিবেন বললো, বেশি দূরে নয়, এই ঘণ্টাখানেক, মানে আমাদের বাড়িতেই, মা বলচিলেন, তুতুলকে অনেকদিন দেকিনি, একবার নিয়ে আয় না!
সুপ্রীতি তুতুলের দিকে তাকালেন। তার মুখ ঘোঁচ হয়ে গেছে। সে শিবেনদার সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না।
সুপ্রীতি বললেন, তোমার মা-কেই একদিন এখানে নিয়ে এসো বরং। আমিও তোমার মা-কে অনেকদিন দেখিনি।
ক্রমে শিবেন একটি শিরঃপীড়া হয়ে দাঁড়ালো। সে কেন আসে, তা বোঝা যাচ্ছে না। অথচ সে আসে, বসে থাকে, পিকলুবাবলুর সঙ্গেও ভাব জমাবার চেষ্টা করে। পিকলু অতি ভদ্র ছেলে, সে শান্ত ভাবে শিবেনের সব কথা শোনে। কিন্তু তার মনোজগৎ শিবেনের চেয়ে সম্পূর্ণ। আলাদা। আর বাবলু শিবেনের দু একটা কথায় হুঁ-হাঁ করে পালিয়ে যায়, তার এখন ঘুড়ি ওড়াবার নেশা।
একদিন শিবেন এসে সুপ্রীতিকে বললো, মাইমা, আপনার সঙ্গে আমার একটা আর্জেন্ট কথা। আচে। তুতুল, তুই একটু বাইরে যা তো!
শিবেন এসে তুতুলের পড়ার টেবিলের চেয়ারটায় বসে। নিজেই বন্ধ জানলাটা খুলে দেয়। তারপর একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে দোলাতে থাকে। তার পায়ের পাতা বেশ ফস, খুব যত্ন নিয়ে সে রোজ দেহশুদ্ধি করে বোঝা যায়।
সুপ্রীতি উৎসুক ভাবে তাকিয়ে রইলেন।
শিবেন বললো, মাইমা, তুতুলের বিয়ে দেবেন? আমার চেনা খুব ভালো পাত্র আচে। নাম ডাকওয়ালা ফ্যামিলি, মাছের ভেড়ির মালিক, ছেলেটি দেখতেও সুন্দর। তুতুলের সঙ্গে মানাবে। ছেলেটি আমার বিশেষ বন্ধু।
এক হিসেবে সুপ্রীতি এই কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। এতদিনে শিবেনের আগমনের কারণ জানা গেল। সে তার এক বন্ধুর বিয়ের ঘটকালি করতে চায়। তুতুলের জন্য যে এখন এরকম প্রস্তাব মাঝে মাঝে আসতে থাকবে, সে জন্য সুপ্রতি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছেন। তুতুলের শরীরের গড়ন তার বাবার মতন, এখনই তাকে তার বয়েসের তুলনায় অনেক বড় দেখায়।
সুপ্রীতি খানিকটা আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, ছেলেটি কী করে?
শিবেন বললো, ঐ যে বললুম ওদের ভেড়ির বিজনেস, ও তাই-ই দেখে। ও লাইনে আজকাল ভালো পয়সা। আমিও তো ঐ লাইনেই যাবো ভাবচি। অলরেডি শুরু করে দিয়িচি।
–তোমার বন্ধু কতদূর পড়াশুনো করেছে?
–মাইমা, আপনারামানে… ইয়ে… আপনারা সব সময় বড্ড লেখাপড়া লেখাপড়া করেন! আজকালকার দিনে বি-এ এমএ পাশ করে কী হয়? বড় জোর একশো টাকার কেরানিগিরি জোটে। অনেক বি-এ পাশ ছেলে এদানি রিক্সা চালায়, বুঝলেন? আই হ্যাভ সীন ইন মাই ওউন আইজ! টাকা পয়সা রোজগার করাটাই আসল। ওরা এখনও তিন পুরুষ বসে বসে খেতে পারবে!
–ছেলে লেখাপড়া শেখে নি তাহলে!
— শিখবে না কেন, যথেষ্ট শিখেছে, ইংলিশে কথা বলতে পারে।
–শোনো শিবেন, তুমি যখন বলছো, তখন ছেলেটি নিশ্চয়ই ভালো। আর তুমি যে তুতুলের বিয়ের জন্য চিন্তা করেছো…
–বাঃ, করবো না, আমার আপন মামাতো বোন!
–সেই কথাই তো বলছি, তুমি যে ওর জন্য চিন্তা করেছে, তাতেই খুব ভালো লাগলো। কিন্তু আমি এখন তুতুলের বিয়ের কথা ভাবছি না। আগে অন্তত বি এ পাশটা করুক।
–মাইমা, ভুল করছেন, এরকম সুযোগ ছাড়বেন না। পাত্রপক্ষের কোনো দাবি-দাওয়া নেই, তুতুলকে দেখেই ওদের পছছন্দ হয়ে গ্যাচে খুব, সেইজন্যই–
–দেখে পছন্দ হয়েছে, মানে? তুতুলকে ওরা দেখলো কোথায়?
–দেখেছে, দেখেছে, মানে, যখন ও-বাড়িতে ছিলেন, সেইসময়ে।
–ওদের বলে দিও, তুতুলের এখনও বিয়ের বয়েস হয়নি।
–মাইমা, ডাগর মেয়েকে বেশিদিন বাড়িতে রাখতে নেই। এমন সুযোগ আর পাবেন না। ওরা তুতুলকে গয়নায় মুড়ে রাখবে।
–শিবেন, এ নিয়ে আর আমি কথা বলতে চাই না।
তারপর থেকে শিবেন এ বাড়ি আসা বন্ধ করে দিল বটে কিন্তু সুপ্রীতি সন্ত্রস্ত হয়ে রইলেন। শিবেনের কথাবার্তার ভঙ্গি তার একদম ভালো লাগে নি। প্রতাপকে তিনি কিছু জানালেন না কিন্তু তুতুলকে বারবার সাবধান করে দিলেন, শিবেন যদি বলে, তুই ওর সঙ্গে কক্ষনো কোথাও যাবি না। ওদের বাড়িতেও যাবি না!
তুতুল বুঝতে পারে যে তাকে ঘিরে একটা অশান্তি ঘনিয়ে আসছে। তার শরীর যেমন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি তার হৃদয়ে উন্মেষ হয়েছে প্রেমের। একজন নয়, বেশ কয়েকজন পুরুষকে সে ভালোবাসে। তারা কেউ-ই জীবন্ত নয়, কয়েকটি উপন্যাসের চরিত্র এবং দু-তিনজন লেখক। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসটি সে সাত-আটবার পড়েছে, তার নায়ক অন্তুকে সে স্বপ্নেও দেখেছে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র নামে দুজন আধুনিক লেখককে সে চিঠি লেখার কথা ভাবে। পিকলুদের কলেজে একদিন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন শুনে তার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করেছিল। ঐ সব লেখকদের রক্ত-মাংসের চেহারায় সত্যি সত্যি দেখা যায়?
তুতুল চায় তার নিজের ঘর, পড়ার টেবিল, ইস্কুল আর গল্পের বইয়ের মধ্যে সব সময় মগ্ন হয়ে থাকতে, তাকে যেন আর কোনো বিষয়ে কেউ বিরক্ত না করে। এমন কি কোথাও বেড়াতে যেতে বা থিয়েটার বাইস্কোপ দেখতেও তার বিশেষ উৎসাহ নেই।
সুপ্রীতি যা আশঙ্কা করেছিলেন, একদিন তাই-ই ঘটলো।
স্কুলের রাস্তায় বেশ কয়েকদিন বরানগরের সেই ছেলে দুটিকে বা শিবেনকে দেখতে পাওয়া যায় নি। একদিন খুব বৃষ্টি, দুপুরবেলায় আকস্মিক ঝমঝমানো বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমে গেছে এক হাঁটু, এইরকম জল ভেঙে হাঁটার অভ্যেস নেই বলে তুতুল ছুটির পর বেরিয়ে একটা রিকশা নিল। একটু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ শিবেন কোথা থেকে উদয় হয়ে বললো, এই রিকশাওয়ালা, রোকো। তুতুল, তোর সঙ্গে আমি যাবো!
ওপরে উঠে বসেই সে রিকশাওয়ালাকে হুকুম দিল, এই, ডাহিনে যাও!
তুতুল জিজ্ঞেস করলো, ওদিকে কোথায় যাবো? আমি বাড়ি যাচ্ছি!
শিবেন বললো, হ্যাঁ, বাড়িতে তো যাবিই। আমি কি তোকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি নাকি? একটুখানি শুধু ঘুরে যাবো।
তুতুল বিরক্ত-দুঃখিত ভাবে শিবেনের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে বললো, দেরি হলে মা চিন্তা করবেন।
শিবেন বললো, বাদলার দিনে একটু দেরি হয়ই। আমি তোকে পৌঁছে দেবো। তোর চিন্তা কী?
আপন পিসতুতো দাদা রিকশায় চড়ে বসলে কোনো মেয়ে তো চিৎকার করে রাস্তার লোক ডাকে না। তুতুলের ক্ষেত্রে সে প্রশ্নই নেই, সে মরে যাবে, তবু চিৎকার করতে পারবে না। বৃষ্টির মধ্যে সে একটা চমৎকার কথা ভাবতে ভাবতে আসছিল, শিবেনদা সব নষ্ট করে দিল।
রিকশা এসে থামলো বৃন্দাবন পাল লেনের একটা বাগানওয়ালা বাড়ির গেটের সামনে। টিপি টিপি করে এখনো বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তার এখানটায় জল নেই, বৃষ্টির জন্যে পথে মানুষজন। কম। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বরানগরের সেই ছেলে দুটি।
রিকশা থেকে শিবেন তাদের মধ্যে একজনের দিকে হাত দেখিয়ে বললো, এ আমার বন্ধু সুদর্শন, তোর সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
দুটি ছেলের মধ্যে যেটি গত বছর বরানগরে তুতুলের হাতে জোর করে চিঠি গুঁজে দিয়েছিল, সে চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে। সুদর্শন নামে যার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হলো, অল্প বয়েসে সে নিশ্চয়ই সুদর্শন বালক ছিল, বেশ লম্বা চেহারা, ফর্সা রং, মাথায় ঘন কোঁকড়া চুল, সমুন্নত কপাল ও তীক্ষ্ণ নাক। কিন্তু এখন তার মুখে একটা চোয়াড়ে চোয়াড়ে ভাব, চোখ দুটি কুঁচকোনো, সামনের একটা দাঁত ক্ষয়ে গেছে! সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুতুলের দিকে।
শিবেন বললো, দেখলি, নিয়ে আসতে পারলুম কি না। আমার বোন খুব ভালো মেয়ে, আমার কথা শোনে। চল, কোথাও বসে চা-টা খাওয়া যাক।
সুদর্শন চোখ না সরিয়ে বললো, চিত্রা সিনেমার কাছে আমার চেনা একটা দোকান আছে। ভালো ফিস ফ্রাই বানায়।
শিবেন বললো, চল, সেখানে চল। আর একটা রিকশা ডাকলেই হবে।
তুতুল বললো, আমি তো কোথাও যাবো না। আমি বাড়ি যাবো।
শিবেন বললো, আরে, বলেছি না, আমি তোকে নিজে পৌঁছে দেবো। আমি মাইমাকে বলে দেবো, তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না। সুদর্শন অনেকদিন ধরে তোর সঙ্গে আলাপ করতে আর দুটো কথা বলতে চাইছে।
সুদর্শনকে সে বললো, এই, তুই তুতুলের সঙ্গে এটাতে উঠে পড়ে এগিয়ে যা। আমি আর হরে অন্য একটাতে যাচ্ছি।
তুতুল বললো, আমি যাবো না!
সে রিকশা থেকে নেমে পড়তে যেতেই শিবেন তার হাত চেপে ধরে বললো, বোস চুপ করে।
ব্যাপারটা কোন দিকে গড়াতে তার ঠিক নেই, কিন্তু এই সময় হঠাৎ পিকলু এসে পড়লো সেখানে। সে তার এক বন্ধুর সঙ্গে ঐ রাস্তা দিয়েই ফিরছে কলেজ থেকে।
সে শিবেনকে দেখে নিরীহভাবে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী খবর, শিবেনা?
তুতুলকে রিকশায় বই-খাতা নিয়ে বসে থাকতে দেখে সে একটু বিস্মিত হলেও কোনো মন্তব্য করলো না।
শিবেনের সঙ্গে সুদর্শন ও হরির চোখে চোখে কিছু কথা হয়ে গেল। শিবেন সূক্ষ্ম ভাবে চোখের পলক ফেলে ও সামান্য মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল জোর-জবরদস্তির লাইনে যাওয়া ঠিক হবে না।
সে হাসি মুখে পিকলুকে বললো, তুই এই রাস্তা দিয়ে কলেজ থেকে রোজ ফিরিস বুঝি? তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, আমার দুই বন্ধু, হরি আর সুদর্শন। এই সুদর্শনদের মাছের ভেড়ির ব্যবসা আছে। আমিও ওদের সঙ্গে ঐ ব্যবসায় নামচি, বুঝলি?
পিকলু কিছুই বুঝলো না। সে জানে যে খালি গায়ে, নেংটি পরা জেলেরা পুকুর নদী থেকে মাছ ধরে, সেই মাছ শহরের বাজারে আসে, বাহুতে রূপোর তাবিজ বাঁধা মাছওয়ালারা সেই মাছ বিক্রি করে। ভালো ভালো জামা-কাপড় পরা ভদ্র বাড়ির ছেলেদের যে সেই ব্যবসার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।
সে শুকনো হেসে বললো, ও আচ্ছা!
পিকলুর সঙ্গের বন্ধুটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, সে হাত নেড়ে বললো, আমি যাই রে!
শিবেন বললো, এ পিকলু, তুই যে বৃষ্টিতে একদম ভিজে গিয়েছিস। সর্দি লেগে যাবে যে! চল, কোথাও বসে গরম গরম চা খাই।
পিকলু এবারে তুতুলের দিকে তাকালো। পড়ে নিল তার চোখের ভাষা। সে বললো, না, আজ থাক, বাড়ি গিয়ে জামা-কাপড় ছাড়তে হবে।
শিবেন পিকলুর পিঠে হাত দিয়ে বললো, একটু এদিক পানে শোন। একটা প্রাইভেট কথা আচে।
পিকলুকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে সে বললো, শোন পিকলু, আমার ফ্রেন্ড এই যে সুদর্শন, খুব ভালো ফ্যামিলির ছেলে বুঝলি, ওর বাবা-মা চাইচেন ওর একটা বিয়ে না দিয়ে ব্যবসার পুরোপুরি ভার ওর হাতে দেবেন না। এখন মুশকিল হচ্ছে, কোনো মেয়েকেই সুদর্শনের পছন্দ হয় না। একমাত্র তুতুলকে দেখেই ওর খুব মনে ধরেছে। এখন এই বিয়েটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তুই ভালো ছেলে, বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, তুই ঠিক বুঝবি।
মাছের ভেড়ির ব্যবসার মতনই বিয়ে সম্পর্কেও পিকলুর কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। বিয়ে তো বয়স্ক নারী-পুরুষদের ব্যাপার।
স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই সে বললো, যাঃ! তুতুলের বিয়ে এখন কী! এখনো ইস্কুলে পড়ছে। আগে লেখাপড়া শেষ করুক!
শিবেন অস্ফুটভাবে বললো, বাঙালের মরণ! খালি নেকাপড়া আর নেকাপড়া! ও মেয়ে হয়ে বি এ এম এ পাশ করে কী করবে, ডিগ্রি ধুয়ে জল খাবে? না আমাদের ফ্যামিলির মেয়ে চাকরি করতে যাবে?
পিকলু অসহায়ভাবে বললো, কিন্তু তুতুল তো এখনো বাচ্চা!
–ঐ বয়েসের মেয়ে দু ছেলের মা হয়ে যায়। শোন পিকলু, তুই হচ্ছিস ওর মামাতো দাদা আর আমি হচ্ছি পিসতুতো দাদা। কোন সম্পর্কটা বেশি? আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা হলো গে রক্তের সম্পর্ক। ঠিক কি না!
–তা তো বটেই!
–আমরা যা বলবো, তাই-ই হবে। সেই কথাটাই আজ বাড়ি গিয়ে মাইমাকে বুঝিয়ে বলবি!
সুদর্শন তুতুলের মুখ ও শরীর থেকে একবারও দৃষ্টি সরায় নি। কিন্তু আজ তাকে বিফল হয়ে ফিরতে হলো শিবেনের পরামর্শে। তুতুলকে ছেড়ে দেওয়া হলো পিকলুর সঙ্গে।
পিকলু সেই রিকশায় উঠে বসে খানিকটা যাবার পর জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার রে, তুতুল? তুই এখানে এলি কী করে? ঐ সুদর্শন বলে ছেলেটাকে তুই আগে চিনতিস?
তুতুল এবার পিকলুর কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো।
পিকলু বললো, অ্যাই, বোকার মতন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবি না তো! কী হয়েছে বল্!
একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে সে বললো, বলছি। কিন্তু পিকলুদা, তুমি কথা দাও, মাকে কিংবা মামাকে কিছু বলবে না! ওঁদের এমনিতেই কত চিন্তা, আমি চাই না আমার জন্য ওঁদের চিন্তা বাড়ুক।