পাড়ার কয়েকটি ছেলে ধরাধরি করে সুচরিতকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। স্কুল থেকে টিফিনে বেরিয়ে সে সিকদার বাগানের ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতে শুরু করেছিল। ঐ পাড়ার কিছু ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা ছেলে এখনো স্কুলে পড়ে, তারা নিয়মিত দাড়ি গোঁফ কামায়, ফেল করে এক ক্লাসে দু বছর থাকে। অন্য ছেলেরা ভয়ে তাদের কাছ ঘেঁষে না, সুচরিত তাদের সঙ্গে পারবে কেন? তা ছাড়া, সুচরিত নাকি ফস করে পকেট থেকে একটা ছুরি বার করেছিল। তাই দেখে তিন-চারটি ছেলে একসঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হাত মুচড়ে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বেধড়ক পেটায়। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়নি, সুচরিত ঐ ছেলেগুলোর হাত থেকে কোনোক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়েছে।
চন্দ্রা বাড়িতে নেই। তাঁর বাবা আনন্দমোহন তক্ষুনি নিজের গাড়িতে সুচরিতকে নিয়ে গেলেন আর জি কর হাসপাতালে। তিনি একটি বড় ওষুধের দোকানের মালিক বলে অনেক ডাক্তারই তাঁকে চেনে, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে তিনি বিশেষ খাতির পেলেন। সুচরিতের আঘাত সেরকম গুরুতর নয়, সারা-শরীর কেটে ছিঁড়ে গেছে, দুটি দাঁত ভেঙেছে আর বাঁ পায়ের গোড়ালির হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। উৎকণ্ঠিত আনন্দমোহন অনেকক্ষণ পর সহজ নিঃশ্বাস ফেললেন। সুচরিতের অবস্থা দেখে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। অন্যের ছেলেকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, হঠাৎ যদি চরম কিছু হয়ে যেত, তা হলে ওর বাবা-মায়ের কাছে কী করে জানানো হতো সেই খবর!
সুচরিত অবশ্য একবারও জ্ঞান হারায় নি, যন্ত্রণায় গুঙিয়েছে একটু একটু, কিন্তু আনন্দমোহন বা ডাক্তার-নার্সদের কোনো জিজ্ঞাসারই উত্তর দেয় নি। একজন হাউস সার্জন তো বলেই উঠলো একবার, ও, ছেলে বটে একখানা! সেই কালু গুণ্ডাকে দেখেছিলুম, পেটের নাড়িভুড়ি হাতে চেপে ধরেছিল, আর এই দেখছি!
হাসপাতালে রেখে লাভ নেই, ড্রেসিং ও ব্যাণ্ডেজের পর আনন্দমোহন সুচরিতকে বাড়িতেই নিয়ে এলেন সন্ধেবেলা। ফেরার সময় সুচরিতকে আর শুইয়ে আনতে হলো না, সে বসে রইলো প্যাট প্যাট করে চোখ মেলে তাকিয়ে। আনন্দমোহন সামান্য রসিকতা করে বললেন, এবার থেকে তোকে আমি কালুগুণ্ডা বলে ডাকবো! পকেটে ছুরি রেখেছিলি কেন, অ্যাঁ?
সুচরিত কোনো উত্তর দিল না।
আনন্দমোহন আবার বললেন, আর যদি এক ইঞ্চি বেশি চলে যেতিস গাড়ির তলায় তাহলে তোকে এতক্ষণে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে শ্মশানে নিয়ে যেতে হতো।
সুচরিত এবারও কিছু না বলে চোখ নিচু করলো।
চন্দ্রা এখনো ফেরে নি। আনন্দমোহন আজ আর দোকানে গেলেন না। তাঁর নিজেরও শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হাসপাতালের পরিবেশ তাঁর সহ্য হয় না। চন্দ্রার মা গজগজ করছেন, মেয়ের সব রকম পাগলামিতে বাপের প্রশ্রয়ের জন্য কথা শোনাচ্ছেন বিধিয়ে বিধিয়ে, আনন্দমোহনের মুখে যে একটা রুণ ছাপ পড়েছে তা তিনি এখন লক্ষ করছেন না। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আনন্দমোহন ভাবলেন, এবারে একটা উইল করাতে হবে, আর দেরি করা বোধ হয় ঠিক নয়।
চন্দ্রা কোনদিন কখন ফেরে তার ঠিক নেই। আনন্দমোহনের ঝিমুনি আসছে, তবু তিনি বিছানার ধারের জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই জানলা দিয়ে সদর পর্যন্ত দেখা যায়।
প্রায় সাড়ে ন’টার সময় গেটের সামনে একটি ট্যাক্সি থামলো। কেউ চন্দ্রাকে পৌঁছে দিতে এসেছে, ট্যাক্সি থেকে নেমেও চন্দ্রা কথা বললো একটুক্ষণ। আনন্দমোহন স্ত্রীকে বললেন, মেয়েটাকে আগেই কিছু বলতে যেও না, আগে এসে হাত-মুখ ধুক, জামাকাপড় ছাড়ুক, তারপর যা বলার আমিই বলবো!
চন্দ্রার মা জানলার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ঐ দ্যাখো!
চন্দ্রা দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছে। তারপরই সে ছুটে এলো বাড়ির দিকে। দারোয়ানই যা বলার বলে দিয়েছে।
আনন্দমোহন খাট থেকে নেমে সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালেন। চন্দ্রার চোখ মুখের অবস্থা এমনই যে সে যেন মৃত্যুশয্যায় সুচরিতকে শেষ দেখা দেখতে পাবে কি না এই অনিশ্চয়তা নিয়ে আসছে। তার পরনে একটা পাতলা ফিনফিনে সিল্কের শাড়ি, বিশেষ সাজগোজ করে সে আজ কোথাও গিয়েছিল।
আনন্দমোহন বললেন, তুই বেশি ব্যস্ত হসনি, খুকী। সুচরিত ভালো আছে। আমি নিজে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলুম।
–বাবা, ও বাঁচবে তো?
–আমি তো বলছি, ও ভালো আছে। পার্মানেন্ট ড্যামেজ কিছু হয় নি। এখন ঘুমোচ্ছে। চন্দ্রা তার বাবাকে বিশ্বাস করে। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুচরিতের ঘরের দিকে একবার তাকালো। তারপর বললো, ওকে পাড়ার ছেলেরা সাংঘাতিক মেরেছে, তোমরা পুলিসে খবর দাও নি?
চন্দ্রার মা বললেন, পুলিসে খবর দিলে পুলিস তো আমাদেরই এসে হয়রান করবে। তোর ঐ গুণধরই তো ছুরি দিয়ে অন্যদের মারতে গিয়েছিল। দিন দিন গুণ্ডা হচ্ছে, তুই কিছু দেখিস না!
চন্দ্রা অস্ফুট গলায় বললো, ছুরি? তারপর সে বাবার দিকে তাকালো। আনন্দমোহন তাঁর স্ত্রীর কথার কোনো প্রতিবাদ করলেন না।
চন্দ্রা হঠাৎ কেঁদে ফেললো। সে সুচরিতকে আর দেখতে গেল না, দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে।
বিছানায় আছড়ে পড়ে সে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। চন্দ্রার ভাবপ্রবণতা ইদানীং প্রায়ই অতিরিক্ত হয়ে উঠছে। সে যেন সব সময়ই কিছু না কিছুর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে এবং কোনোটাতেই সে হার সহ্য করতে পারবে না। আজ এক্ষুনি যেন তার বড় রকমের একটা হার হয়েছে।
রিফিউজি কলোনি থেকে সে সুচরিতকে নিজের বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছিল প্রায় জেদ করে। হারীত মণ্ডল তার স্ত্রী ও অন্য পুত্র কন্যাদের নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে বাংলার বাইরে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। সুচরিত পড়াশুনো করতে চেয়েছিল। সে ছিল শান্ত, লাজুক স্বভাবের ছেলে, সে যে কখনো কারুর সঙ্গে মারামারি করতে পারে ভাবাই যায় নি। তার পকেটে ছুরি?
এখন সবাই এসে চন্দ্রাকে বলবে, দেখলে, দেখলে, আমরা আগেই বলেছিলুম না!
কেউ বলবে, খুনীর ছেলে কখনো লেখাপড়া শিখতে পারে? কেউ বলবে, জলবিছুটির চারা। গোলাপ বাগানে এনে পুঁতলে কি তাতে গোলাপ ফোটে? অসমঞ্জ রায় শ্লেষের সঙ্গে বলবেন, আমি সেই জন্যই তো প্রথম থেকেই পাত্তা দিইনি, তুমি তখন আমার কথা শুনতে চাইলে না, এখন বুঝলে তো?
সবাই বলবে, চন্দ্রা, তুমি হেরে গেছো, তোমার সিদ্ধান্ত ভুল।
খানিক বাদে দরজাটা সামান্য ঠেলে আনন্দমোহন বাইরে থেকে ডাকলেন, খুকী!
চন্দ্রা উঠে বসে চোখ মুছলো। তার মনে পড়লো অন্য কথা। কয়েক দিন ধরে তার মা বাবা। তার সম্পর্কে বেশি উৎসাহ দেখাতে শুরু করেছেন। দু তিনদিনের মধ্যেই এলাহাবাদ থেকে এসে পড়ছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, তার স্বামীর বোনের বিয়ে উপলক্ষে চন্দ্রাকে এলাহাবাদ পাঠাবার ব্যাপারে সবাই খুব উৎসাহী। ঐদিকে চন্দ্রার আর একটা লড়াই ঘনিয়ে এসেছে। এতদিন বাবা কিছুই বলেন নি, এখন বাবাও চলে গেছেন অন্যদিকে?
আনন্দমোহন বললেন, তুই ছেলেটাকে একবার দেখতে গেলি না? নিজের চোখে দেখলে বুঝতি ওর তেমন সীরিয়াস কিছু হয় নি।
চন্দ্রা তীব্র চোখে চেয়ে বললো, বাবা, ও সত্যিই পাড়ার ছেলেদের ছুরি মারতে গিয়েছিল? আনন্দমোহন বললেন, তাই তো শুনলুম। বোধ হয় পেন্সিলকাটা ছুরি!
–বাবা, আমি আর ওর মুখ দেখতে চাই না! তোমরা ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, যা খুশী করো!
আনন্দমাহন ক্ষীণ হেসে বললেন, পাগল! ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা উঠছে কিসে? কেউ কিছু বলেছে?
–না, আমি ওকে রাখতে চাই না। ওকে বাড়ি থেকে দূর করে দাও!
–কী বলছিস পাগলের মতন! ওকে কোথায় তাড়িয়ে দেবো? ওর কি কোনো যাবার জায়গা আছে? ওর বাবা-মা যে কোথায় গেল, কোন ক্যাম্পে আছে তা কিছুই জানা গেল না। একটা চিঠিও দেয় নি এতদিনে।
–ও সব কিছু জানি না আমি। ও যেখানে খুশী চলে যাক।
–এই তো তোর পাগলামি। সব কিছুই ঝোঁকের মাথায় করিস। ছেলেটাকে যখন হুট করে নিয়ে এলি তখনও সব দিক ভেবে দেখিস নি। এখন আবার বলছিস ওকে চলে যেতে। মানুষের জীবন নিয়ে কি এরকম ছিনিমিনি খেলা যায়?
–বাবা, ওকে এনে আমি কি ভুল করেছিলুম? তখন তুমি কিছু বলো নি তো?
–ভুল কি ঠিক তা আমি জানি না। একটা ছেলেকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিস, তাতে আমি আপত্তি করবো কেন? এ বাড়িতে জায়গার অভাব নেই, একটা ছেলে থাকবে-খাবে, এমন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু ও আগে বাবা-মাকে ছেড়ে কখনো থাকেনি, এ বাড়িতে ওর বয়েসী কেউ নেই, ওর দিকে কারুর তো একটু মনোযোগ দেওয়া দরকার। তুই বেশির ভাগ সময়ই বাড়িতে থাকিস না, আমিও সময় পাই না। কদিন আগে দেখি ছাদের সিঁড়িতে বসে আছে, মুখখানা যেন ছাই-মাখা, বাবা-মায়েদের কোনো খবর পায় না তো!
–ওসব ছিচকাঁদুনেনা আমি দু’চক্ষে সহ্য করতে পারি না। ওর মতন বয়েসের অনেক ছেলেকে আরও কত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়, অনেক বেশি স্ট্রাগল করতে হয়। ওর বাবা কাওয়ার্ড, তাকে আমি এখানে জোর করে থেকে যেতে বলেছিলুম, থাকে নি!
–ওরকম বললে কী হয়। তাদের ভালো-মন্দ তারা নিজেরাই বেশি বুঝবে। তুই চাস, সারা পৃথিবীটাই তোর মত অনুসারে চলুক। খুকী, তুই লেখাপড়া শিখেছিস, এখনো বুঝতে শিখলি না যে সংসারটা চলে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার ওপর।
–সংসার মানে? মা তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে, তুমি আমাকে বলতে এসেছো যে আমার উচিত স্বামীর সংসারে ফিরে যাওয়া। তার সঙ্গে আমার মনের মিল থাক বা নাই-ই থাক আমাকে সব মেনে নিতে হবে। কারণ আমি পুরুষ নই, মেয়ে!
আনন্দমোহন এবার জোরে হেসে বললেন, না, আমি সে কথা বলতে আসি নি। তোর মা আমাকে অনেক কিছুই শেখাতে চায় কিন্তু আমি সব শিখতে পারি না যে! আমি বলতে এসেছি, তুই ছেলেটাকে একবার দেখে আয়। এ বাড়িতে তোকেই তো ও সব থেকে আপন বলে জানে। ও জেগে আছে, বোধ হয় তুই ওকে কিছু বলবি সেই জন্যই।
চন্দ্রা চোখ বুজলো। তার মুখ কুঁকড়ে গেল অভিমানের যন্ত্রণায়। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, না, আমি আর ওকে দেখতে চাই না!
আনন্দমোহন তার পিঠে মৃদু ঠেলা মেরে বললেন, ছেলেমানুষী করিস না! যা ওঠ তো! বাড়িতে একটা ছেলে পা ভেঙে পড়ে আছে
চন্দ্রাকে যেতেই হলো। আনন্দমোহন চন্দ্রাকে সুচরিতের ঘর পর্যন্ত নিয়ে এলেন কিন্তু নিজে ভেতরে ঢুকলেন না।
সুচরিত জেগে আছে ঠিকই। সে চেয়ে আছে কড়িকাঠের দিকে।
চন্দ্রা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখলো। সুচরিতের সারা শরীরেই প্রায় আয়োডিনের দাগ, কয়েক জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার, বাঁ পায়ে ব্যাণ্ডেজ। মুখের রং যেন নীলচে হয়ে গেছে।
একটা চেয়ার টেনে তার মাথার কাছে এসে বসে চন্দ্রা প্রথমেই বললো, তোর পকেটে ছুরি ছিল? এটা সত্যি না মিথ্যে? বল, আগে বল। ছুরি ছিল কি না?
চন্দ্রার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সুচরিত বললো, হ্যাঁ, ছিল।
–কোথায় পেলি ছুরি? কে দিয়েছে?
–আমি কিনেছি।
–তুই কিনেছিস? কে তোকে পয়সা দিল?
–কেউ দেয়নি, আমি রাস্তায় পনেরো টাকা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।
–রাস্তায় টাকা কুড়িয়ে পেয়ে তুই ছুরি কিনেছিস? কেন? লোককে মারবি বলে?
–হ্যাঁ। ঐ সিকদারবাগানের তিনটে ছেলে আমায় রোজ মারে।
–তোকে রোজ মারে? তুই সে কথা আমাদের আগে বলিস নি কেন? তুই ওদের পাড়ায় যাস কেন?
–ওরা আমাদের ইস্কুলে পড়ে।
–ইস্কুলে পড়ে, তবু তোকে রোজ মারে? কেন, তোকে মারবে কেন?
–ওরা দেখলেই আমার মাথায় চাঁটি মারে। আমার বাপ তুলে গালাগালি দেয়।
–তুই কিছু করিস না, তোকে এমনি এমনি মারে আর গালাগাল দেয়?
–আমি একদিন হাসছিলাম, আমার বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম, ওদের একজন এসে আমার গালে এক চড় মেরে খারাপ খারাপ কথা বলতে লাগলো।
–কী বললো?
সুচরিতের মুখের দুটো কাঁচা দাঁত আজ ভেঙে গেছে, রক্তপাত এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বিছানার পাশে খানিকটা তুলো রাখা আছে, তাই দিয়ে সে মাঝে মাঝে কষ মুছছে। এখন সে আরেকবার রক্ত মুছলো।
চন্দ্রা সেই রক্তের দৃশ্য গ্রাহ্য না করে মাথাটা ঝুঁকিয়ে এনে আবার জিজ্ঞেস করলো, কী। খারাপ কথা বলে? বল্! আমি শুনতে চাই।
সুচরিত মুখখানা বিকৃত করে বললো, শালা, বাঙালের বাচ্ছা, দাঁত কেলিয়ে হাসছিস যে বড়? পোঁদে লাথি মেরে বাপের নাম খগেন করে দেবো! খাল খিচে বৃন্দাবন করে দেবো!
এই সব গালিগালাজের মর্ম বোঝার মতন বাংলা জ্ঞান নেই চন্দ্রার। শুধু বাঙাল শব্দটা কানে লাগলো তার। সে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, শুধু বাঙাল বলে তোকে মারে? তোদের ক্লাসে, তোদের ইস্কুলে কি আর কোনো পূর্ববঙ্গের ছেলে পড়ে না?
–হ্যাঁ, অনেক পড়ে। আমাদের ক্লাসেই দশ-বারোজন পড়ে।
–তাদেরও ওরা মারে?
–না।
–তোকে মারলে অন্য পূর্ববঙ্গের ছেলেরা প্রতিবাদ করে না? তোকে সাহায্য করে না?
–না।
–সাহায্য করে না? তাহলে ঐ বদ ছেলেরা বেছে বেছে তোকেই শুধু মারে কেন?
–আমি একদিন ওদের সঙ্গে বাটখাড়া খেলে সাড়ে চার টাকা জিতেছিলুম।
–বাটখাড়া খেলা আবার কী খেলা?
–চৌকো ঘর কেটে তার মধ্যে খুচরো পয়সা রেখে দূর থেকে বাটখাড়া দিয়ে মারতে হয়।
-–পয়সা দিয়ে খেলা?
–হ্যাঁ।
–স্কুলের ছেলে স্কুলের মধ্যে পয়সা দিয়ে এই সব খেলা হয়?
–স্কুলের মধ্যে নয়। পাশের বস্তির সামনে যে মাঠটা…
–তুই সেই খেলা খেলতে যাস?
–মোটে তিনদিন খেলেছি। প্রথম দু’দিন হেরেছিলাম, পর দিন জিতে আমার পয়সা উসুল করে আর খেলিনি। ওরা আমাকে পয়সা ফেরত দিতে বলেছিল। জেতা পয়সা কেন আমি ফেরত দেবো?
চন্দ্রা সোজা হয়ে বসে আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো। তার মুখে বিন্দুমাত্র সহানুভূতির চিহ্ন নেই। রাগের আঁচ ফুটে বেরুচ্ছে তার চামড়ার তলা থেকে।
সে বললো, তোকে মেরেছে, বেশ করেছে! তুই পয়সা নিয়ে জুয়া খেলতে যাস বখাটে ছেলেদের সঙ্গে। তোকে দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। তোকে এই জন্য আমি এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলুম? জঙ্গলে গিয়ে জংলি হয়ে থাকাই তোর উচিত ছিল। গাধা, কেউ যদি দল। বেঁধে তোর ওপর অত্যাচার করতে আসে, তুই মারামারি করে তাদের সঙ্গে জিততে পারবি? একটা পচা ছুরি দিয়ে কেউ… উফ্, তুই যে এত বোকা তা আমি ধারণাই করি নি। জিততে হয় বুদ্ধি দিয়ে। লেখাপড়া শিখে তুই যদি ওদের ছাড়িয়ে যেতে পারিস, সেটাই হবে আসল জেতা!
সুচরিত দৃঢ়ভাবে বললো, আমি আর লেখাপড়া করবো না।
–বাঃ বাঃ, বেশ, বেশ! একদিন অসমঞ্জ রায়ের কাছে গিয়ে লেখাপড়া শেখার জন্য কাঁদাকাটি করেছিলি না? এর মধ্যেই সে শখ মিটে গেছে?
–আমি ঐ ইস্কুলে আর কোনোদিন যাবো না। ওরা আমার নাম বদলে দিয়েছে। ওরা আমাকে বলে সুচরিত চাঁড়াল। আমি চাঁড়ালের ছেলে। ওরা বলে আমার বাবা মানুষ খুন করেছিল, তাই গভর্নমেন্ট আমার বাবাকে এখান থেকে দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
–এসব কথা ওরা জানলো কী করে?
–আমার বাবা কোনো মানুষ খুন করে নি। আমরা চাঁড়াল নই, আমরা মণ্ডল। আমি ঐ শালাদের দেখে নেবো।
আবার সুচরিতের মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো, সে তুলো দিয়ে মুছলো।
আনন্দমোহন বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন সবই, তিনি এবারে ঢুকে এলেন ভেতরে। কাছে এসে বললেন, চন্দ্রা, আজ আর থাক, ছেলেটাকে আর বেশি কথা বলাস নি। স্কুলের ছেলে, তারাও কী রকম নিষ্ঠুর হয়! বেঙ্গলের কী অবস্থা হলো! এখনো স্কুলের ছেলেরা বাঙাল, চাঁড়াল। এই সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে?
চন্দ্রা মুখ তুলে আস্তে আস্তে বললো, বাবা, চাঁড়াল কী?
আনন্দমোহন বললেন, ওসব কথা এখন থাক। ছেলেটাকে এখন ঘুমোতে দে। ওকে খানিকটা সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে, তবু এখনো যে ঘুমোয় নি, সেটাই আশ্চর্য!
সুচরিতকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, খুব ব্যথা করছে নাকি?
সুচরিত কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরলো। যেন সে চন্দ্রা ছাড়া আর কারুর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবে না।
আনন্দমোহন চন্দ্রাকে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, ছেলেটার আত্মসম্মান জ্ঞান আছে, এই বয়েসে, সেটা কিন্তু কম কথা নয়। ক’টা দিন যাক, ওর রাগটা একটু কমুক, শরীরটা একটু সুস্থ। হোক, তারপর ওকে অন্য কোনো স্কুলে ট্র্যানফার করিয়ে দিলেই হবে।
চন্দ্রা বললো, বাবা, আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।
আনন্দমোহন বললেন, এবারে তুইও ক’টা দিন বিশ্রাম নে। তোদের সেই আশ্রমের বাড়ি তৈরির জন্য তো হন্যে হয়ে ছুটছিস ক’দিন ধরে।
–সে বাড়ি তৈরির কাজ এখন বন্ধ আছে।
–কেন?
–টাকা নেই। যোগেন দত্ত যা টাকা দেবে বলেছিল, এখন আর দিচ্ছে না। আচ্ছা বলো ভা, একটা লোক, সমাজে বাস করে, সংসার চালায়, ব্যবসাট্যাবসা করে, অথচ কথা দিয়ে কথা রাখে না? এটা সহ্য করা যায়?
–এরকম আছে অনেক লোক। তুই আর একা কত করবি? চ্যারিটেবল কাজে মাঝে মাঝে একটু-আধটু বাধা পড়েই। কেউই এত তাড়াতাড়ি একটা বাড়ি উঠিয়ে ফেলতে পারে না। ক’টা দিন, যাক না, একটু বৃষ্টিতে ভিজুক, তাতে ভিত্ শক্ত হয়।
–ঐ যোগেন দত্তকে আমি ছাড়বো না। ওর কাছ থেকে আমি টাকা আদায় করবোই।
এরপর দু’দিন চন্দ্রা বাড়ি থেকে বেরুলো না একবারও। সে কোনো কঠিন সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। সুচরিতকে সে একবার দুবার দেখতে যায়, বাকি সময়টা নিজের ঘরে বই নিয়ে বসে থাকে। এর মধ্যে এক সময় গেট দিয়ে অসমঞ্জ রায়কে আসতে দেখে সে ঝি-কে দিয়ে বলে পাঠালো যে তার মাথা ধরেছে, সে কারুর সঙ্গে দেখা করবে না।
চন্দ্রা বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে না, বাইরের লোকদেরও প্রশ্রয় দিচ্ছে না দেখে খুশী হলেন তার মা। মেয়ে তাঁর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে চায় না, তবু তিনি তো মা, তিনি মেয়ের মনের গড়নটা খানিকটা বোঝেন। চন্দ্রা কোনো শক্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে এরকম একা একা সময় কাটায়। এরকম তিনি আগেও কয়েকবার দেখেছেন। শিবানীর বিয়েতে চন্দ্রাকে এলাহাবাদে যেতে হবে, সেখানে গিয়ে অন্য কোনো বাড়িতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না, তাকে উঠতেই হবে শ্বশুরবাড়িতে। তার স্বামীর সঙ্গে কী নিয়ে তার ঝগড়া হয়েছিল তা কেউ জানে না, কিন্তু তার স্বামীকে কেউ খারাপ ছেলে বলতে পারবে না। মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকলে ভুল-বোঝাবুঝি বাড়ে। এবারে চন্দ্রা তার স্বামীর কত কাছাকাছি যাচ্ছে অনেকদিন বাদে, এবারে ওদের মনের জট খুলে যাওয়া খুবই সম্ভব।
শনিবার এলাহাবাদ থেকে শিবানী আর তার দিদি-জামাইবাবু আসছেন কলকাতায়। হাওড়া স্টেশান থেকে তাঁদের নিয়ে আসার কথা। চন্দ্রার মা সেই জন্য আনন্দমোহনের কাছ থেকে বাড়ির গাড়ি চেয়ে রেখেছেন।
দুপুরবেলা তিনি চন্দ্রাকে বললেন, খুকী তৈরি হয়ে নে। হাওড়া স্টেশানে যাবি তো!
চন্দ্রা বললো, আমি তো যেতে পারবো না, মা। আমার আজ বিকেলে জরুরি কাজ আছে!
মা অবাক হয়ে বললেন, শিবানী আসছে, তুই আনতে যাবি না? তোর কী এমন জরুরি কাজ?
চন্দ্রা ঠাণ্ডাভাবে বললো, যোগেন দত্তর সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ডায়মন্ডহারবার যেতে হবে।
মা চোখ কপালে তুলে বললেন, ডায়মন্ডহারবার? সে তো অনেক দূর? শিবানী তোকে দেখতে না পেলে কী ভাববে বল্ তো? না, না, ওখানে আজ যেতে হবে না। বাদ দে তো! চল, হাওড়ায় চল আমার সঙ্গে।
চন্দ্রা তবু বললো, শিবানীর সঙ্গে দেখা তো হবেই। আমার কাজটা খুব জরুরি; অন্যদিন গেলে হবে না। আমার যদি বেশি রাত হয় ফিরতে, শিবানীকে শুয়ে পড়তে বলল। তোমারও জেগে থাকার দরকার নেই।
মা এবার কঠোরভাবে বললেন, তুই ঐ যোগেন দত্ত নামের লোকটার সঙ্গে ডায়মন্ডহারবার। যাবি, সেখানে আবার কী কাজ? এরকমভাবে যাওয়া, লোকে শুনলে কী বলবে? এই সময় শিবানীরা আসছে, এখন অন্তত…
মাকে থামিয়ে দিয়ে চন্দ্রা বললো, আমি কী করছি, তা আমি ভালো করেই বুঝি, মা। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।