বঙ্কুবিহারীর স্ত্রী এলিজাবেথ হাটটে, সংক্ষেপে লিজ, একজন ভারত-প্রেমিকা। এই আইরিশ মেয়েটির পরিবার অনেক দিন থেকেই আয়াল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। লিজ-এর এক পিতৃব্য প্রখ্যাত বিপ্লবী ডি ভ্যালেরার সঙ্গে জেল খেটেছিলেন, জেল ভেঙে পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আয়াল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীরা অনেকেই উগ্র ইংরেজ-বিরোধিতার কারণে ভারতের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন।
কবি ইয়েটস-এরও খুব ভক্ত লিজ। ইংরেজি ভাষার এই প্রধান কবি কেলটিক পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনেও নেতৃত্ব নিয়েছিলেন এবং আইরিশদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অহংকার দিয়েছেন। ইয়েটস-এর সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গে আইরিশদের পরিচয় হয় এবং লিজ রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে এমনই মুগ্ধ হয় যে সে নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখতে শুরু করে।
বঙ্কুবিহারীর সঙ্গে লিজ-এর পরিচয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রেম এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহের প্রধান কারণ এই যে বঙ্কুবিহারী একজন ভারতীয় এবং বাঙালী। এর আগে লিজ কোনো ভারতীয়কে চাক্ষুষ দেখেনি। ভারত তার কাছে এক স্বপ্নের দেশ এবং ভারতীয় মাত্রই পাঁচ হাজার বৎসরের সভ্যতার ধারক।
বঙ্কুবিহারী অবশ্য স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইতে রবীন্দ্রনাথের দু’একটি কবিতা ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। বেদ-উপনিষদ আর গ্রীক ভাষা তার কাছে একই। অল্প বয়েসে বিলেতে যাবার পর থেকেই সে নিজের গা থেকে ভারতীয়ত্ব মুছে ফেলে প্রাণপণে ইংরেজদের অনুকরণ করতে চেয়েছে।কতরকম ভাষায় দৈনিক আবহাওয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে হয় তা সে জানে কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী জানে না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিষয়েও প্রায় কিছুই জানে না বলতে গেলে।
বঙ্কুবিহারীর চেহারাটি সুন্দর, বনেদী বংশের ছাপ আছে। তার প্রথমা স্ত্রী তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায় কারণ বন্ধু তার বিলাসব্যসনে পুরোপুরি তাল দিতে পারছিল না; তারপর সে বেশ কিছুদিন এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে একটা চাকরিসূত্রে ডাবলিনে গিয়ে পৌঁছোয়। প্রথম আলাপেই লিজ-এর উচ্ছ্বাস দেখে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল বেশ। লিজ তাকে দেখেছে মোহের অঞ্জন মাখা চোখে। ওদেশে বঙ্কুবিহারী থেকে তার ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল হ্যারি, তাড়াতাড়ি সে আবার বন্ধু হয়ে গেল, লিজ শুনে বলেছিল কী সুইট স্যানসক্রিট নাম! যদিও লিজ সেই নামটি শেক্সপীয়ারের একটি চরিত্রের মতন ব্যাঙ্কো উচ্চারণ করে।
লিজ-এরও আগে একটি বিবাহ ছিল। সে ক্যাথলিক, তাদের সমাজে ডিভোর্স চালু নেই, তার আগের স্বামী সুবিধেমতন সময়ে মারা গেছে। লিজ বন্ধুর চেয়ে এক বছরের বড়। বন্ধু অবশ্য লিজকে শুধুমাত্র তার ভারত-প্রীতির জন্যই বিয়ে করতে রাজি হয় নি। লিজ-এর বাবা একজন সম্পন্ন আলু-চাষী, তাঁর পুত্র সন্তান নেই, তিনটি কন্যা। লিজ পিতৃ-সম্পত্তির ভাগ পাবে, মৃত স্বামীর জমি-জমাও সে পেয়েছে। সুতরাং বন্ধুর চোখে পত্নী হিসেবে লিজ বেশ শাঁসালো। তবে বন্ধুর বন্ধুরা তাকে উপদেশ দিয়েছে, সব সময় বউ-এর মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে যাবি, দেখিস সাবধান, একটু যেন এদিক ওদিক না হয়। আইরিশ মেয়েরা এমনিতে যতই নরম হোক আর সংস্কৃতিচর্চা করুক, কখন যে দপ করে জ্বলে উঠবে তার ঠিক নেই। আইরিশ। মেজাজ বলে কথা!
বন্ধু তার পত্নীকে মুগ্ধ করার জন্য নানারকম ভড়ং শিখেছে। সে সকাল-বিকেল ঘণ্টাখানেক ধরে আহ্নিক করে, সপ্তাহে একদিন নিরামিষ খায়, বিলেতে থাকতে শিব-দুর্গা বা কোনো হিন্দু ঠাকুর দেবতার ছবি জোগাড় করতে পারে নি কিন্তু গৌতম বুদ্ধের একটি ছবি পেয়ে সেটিকেই লকেটে পুরে গলায় ধারণ করে।
প্রথম দিন, এসেই সে বিমানবিহারীকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করেছিল, দাদা, তুগি গীতা। পড়েছো?
ছোট ভাই এবারে বিলেত থেকে বোম্বাইতে নেমে ধুতি-পাঞ্জাবী কিনে তা পরে কলকাতায় এসেছে বটে কিন্তু তার কাছ থেকে গীতা সম্পর্কে আগ্রহের কথা শুনবেন, এমনটি বিমানবিহারী কল্পনাও করেন নি।
তিনি আমতা আমতা ভাবে বললেন, না, সেরকমভাবে পড়িনি, পড়লেও বুঝি নি।
বন্ধু বললো, আমার বউ, বুঝলে গীতা-টিতা সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্টেড! আমাকে প্রায়ই নানা কথা জিজ্ঞেস করে। আমি তো ওসব জানি না ছাই! একটা বামুন পন্ডিত জোগাড় করো, মোটামুটি আমাকে বুঝিয়ে দেবে। আর হ্যাঁ, রামায়ণ মহাভারতের ইংলিশ ট্রানশ্লেশন পাওয়া যায়? ও দুটোও পড়ে নিতে হবে আমাকে। শ্রীকৃষ্ণকে আমি অর্জুনের মামা বলেছিলুম, ও ঠিক ধরে ফেলেছে। ও বলে, শ্রীকৃষ্ণ নাকি অর্জুনের শালা?
বিমানবিহারী হাসতে লাগলেন। বউ-এর ঠেলায় পড়ে কাবু হয়ে গেছে তাঁর ভাই। কোনোদিন যে-সব বই সে ছুঁয়েও দেখে নি, এখন সেই রামায়ণ-মহাভারত পড়ে বউয়ের কাছে তাকে পরীক্ষা দিতে হবে।
মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার পর্বটি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই উৎরে গেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ লিজ-এরই বেশি ছিল। বিমানবিহারী আগে থেকেই মা-কে বুঝিয়ে এসেছিলেন যে এই নতুন বউ কিছু কিছু বাংলা জানে, স্বভাব মোটেই উগ্র নয়, অতি লক্ষ্মী মেয়ে ইত্যাদি। মা এখন প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকেন, হাঁপানিতে কাবু করে ফেলেছে, আগের মতন, আর তেজ নেই।
বন্ধু স্ত্রীকে নিয়ে মায়ের ঘরে এলো বাইরে জুতো খুলে রেখে, লি-এর ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট থাকার প্রশ্নই নেই কারণ সে একেবারেই সিগারেট খায় না। শাড়ি পরা মেম বউমার দিকে মা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। লিজ বাংলাতেই বললো, মা আপনার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিতে এসেছি। কিন্তু তার উচ্চারণের জন্য মা সে ভাষা একবর্ণও বুঝতে পারলেন না। লিজ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই মা আঁতকে উঠে বললেন, না, না, না, ওরে বারণ কর, আমাকে ছুঁতে বারণ কর!
মাকে পা গুটিয়ে দেখে নিতে লিজ হতভম্বভাবে স্বামীর দিকে তাকাতেই বন্ধু বললো, আমার মামার স্কিন ডিজিজ আছে, সেইজন্য টাচ্ করতে বারণ করছেন, তোমার ভালোর জন্যই। তুমি একটু ডিসটেন্স থেকে নমস্কার করো।
এরপর লিজ হাত জোড় করে নমস্কার জানাতে মা-ও প্রতিনমস্কার জানালেন। উপহার। হিসেবে লিজ কয়েকটি চকলেট বার এবং এক জোড়া দুল বার করতেই ফিক করে হেসে ফেললেন মা। তিনি ভাবলেন, ও দেশের বুড়ো ধাড়ী শাশুড়িরাও বুঝি চকলেট খায়? বিধবারা কানে দুল পরে? মায়ের সেই হাসিতেই পরিবেশ অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেল।
পরে মা বিমানবিহারীকে বলেছিলেন, ওরা এ বাড়িতে থাকতে চায় থাকুক, কিন্তু ঐ বউয়ের হাতের ছোঁয়া আমি খেতে পারবো না। ও যেন নিরিমিষ রান্নাঘরে না যায়। ওরা এঁটোকাঁটা মানে না…।
বিমানবিহারী বলেছিলেন, মা, এ বউ কিন্তু আমাদের আচার অনুষ্ঠান অনেক কিছু জানে।
মা উত্তর দিয়েছিলেন, দ্যাখ বীরু, আমরা আর ক’দিন? আমাদের মতন পুরোনোরা সব মরেঝরে গেলে, তারপর তোরা সব মেনে নিস।
প্রথম প্রথম এ দেশের সব কিছুই লিজ-এর পছন্দ। ভালো লাগাবার মতন মন নিয়েই সে এসেছে। পথঘাটের আবর্জনা, হিসির দুর্গন্ধ, মানুষের সরাসরি কৌতূহলী দৃষ্টি, ট্রামবাসের অমানুষিক ভিড়, অনাবশ্যক কোলাহল, এসব কিছুই তাকে দমিয়ে দিতে পারে না। যা কিছু সে দেখে সবই হাউ সুইট, কী চুন্ডোর, কী বালো! একমাত্র ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে সে নাক সিটকে বললো, এঃ এটা কী? হোয়াট মনস্ট্রসিটি! পাথরের বিপুল অপচয়। আমি এটা দেখতে চাই না, আমি কালীঘাটের মন্দির দেখব।
ইংরেজ চলে যাবার পরেও সারা ভারত জুড়ে ইংরেজ-ভক্তির প্রাবল্য দেখে লিজ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়। তাদের আয়াল্যান্ডে তো এরকম নেই। কুচক্রী ইংরেজ ভারতবর্ষকে দু’টুকরো করে দিয়ে গেছে, আয়াল্যাণ্ডেও ঠিক তাই। ইংরেজের সেই ভেদ-নীতির কথা মনে পড়লেই আইরিশ রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালেই স্বাধীন আয়াল্যাণ্ড কমনওয়েলথের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করেছে, কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এখনো কমনওয়েলথের জয়গান করেন।
ভারতীয়রা দার্শনিক বা উদাসীন বা ক্ষমাপরায়ণ, সেটা বুঝতে পারে লিজ, কিন্তু রেজ-চাটুকারিতার কারণ সে খুঁজে পায় না। এখানকার শিক্ষিত মানুষদের ভাব ভঙ্গি ইংরেজদের মতন। লিজ নিজে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার সঙ্গে সবাই কথা বলে ইংরিজিতে। সে শ্বেতাঙ্গিনী বলেই যে তাকে বেশি খাতির করা হচ্ছে এটা সে টের পায়। যে-কোনো বাড়ির অন্দর মহলে গেলেই সে বাড়ির মেয়েরা তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলাবলি করে, কী ফর্সা! অথচ ভারতীয় মেয়েদের জলপাই রঙের গাত্রবর্ণ লিজের অনেক বেশি সুন্দর মনে হয়।
লিজ নিজেকে বারবার আইরিশ বলে পরিচয় দিলেও সবাই তাকে ইংরেজ বলেই ধরে নেয়। আয়াল্যাণ্ড সম্পর্কে এখানকার অনেকেরই প্রায় কিছুই ধারণা নেই, ইউনাইটেড কিংডম ও আয়াল্যাণ্ড যে দুটি আলাদা স্বাধীন দেশ, তা এরা জানে না। কেউ কেউ অবশ্য জর্জ বার্নার্ড শ এবং সিস্টার নিবেদিতার নাম বলে, ঐ দুটি মাত্র আইরিশ নাম এ দেশে পরিচিত।
সিস্টার নিবেদিতা অর্থাৎ মিস মাগারেট নোবেল-এর নাম লিজ আগে শানে নি। এই মহিলাটির কোনো পরিচিতিই নেই তাঁর নিজের দেশে! এর জীবনী পড়ে লিজ অবাক হয়। অতদিন আগে তার দেশের একটি মেয়ে এত দূর দেশে এসে কত সব কাজ করে গেছে! নিবেদিতার কাহিনী জানার পর লিজ একদিন দেখতে গেল বেলুড় ও দক্ষিণেশ্বর। দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে সে যেন আবহমানকালের ভারতবর্ষকে প্রত্যক্ষ করে। সেই তুলনায় কলকাতা-নগরী যেন ব্রিটিশের পরিত্যক্ত এক আবর্জনার স্তূপ। কেউ সম্মার্জনী ধরে পুরোনো ক্লেদ ঝেটিয়ে ফেলে তাকে ভারতীয় রূপ দেবার চেষ্টা করে না।
লিজ একদিন তার স্বামীকে বললো, সে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান দেখতে যাবে।
এসব ব্যাপারে বন্ধুর জ্ঞান ভাসা-ভাসা। সে বললো, টেগোরের জন্মস্থান, সে তো শান্তিনিকেতন, সেখানে খুব গরম। চলো ডার্লিং, তোমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাবো। সেখানে ভালো ঠাণ্ডা পাবে।
বন্ধুর থেকে লিজ অনেক কিছু বেশি জানে। এ দেশে আসার পর থেকে সে স্বামীকে আস্তে আস্তে চিনতে শিখেছে। সে বললো, ঠাণ্ডা ভোগ করার জন্য কি আমি এ দেশে এসেছি? ডাবলিনে ঠাণ্ডা কিছু কম আছে? শান্তিনিকেতন তো কবির আশ্রম ছিল, কিন্তু কবি জন্মেছিলেন এই কলকাতা শহরেই। আমি সেই বাড়িটা দেখতে যেতে চাই।
বন্ধু তখন তার দাদাকে জিজ্ঞেস করলো, রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান কোথায়। বিমানবিহারী। বললেন, জোড়াসাঁকোতে, সেটা নর্থ ক্যালকাটায়, তিনি নিজেও সেখানে কোনোদিন যান নি। বন্ধু বললো, তাহলে কী করে সেখানে যাওয়া যায়? ট্যাক্সিওয়ালারা কি চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? বিমানবিহারী বললেন, তাতে সন্দেহ আছে, কলকাতায় ট্যাক্সি-ড্রাইভার প্রায় সবাই পাঞ্জাবী বা বিহারী।
এই সব আলোচনা শুনে লিজ আরও অবাক হয়। অত বড় একজন কবি, এসিয়ার প্রথম নোবেল লরিয়েট, এই শহরে তিনি জন্মেছেন, অথচ এখানকার শিক্ষিত লোকেরা তাঁর বাড়ি কোথায় জানে না? বিয়ের পর লিজ বন্ধুর সঙ্গে মাস ছয়েক লন্ডনে এসে ছিল। সেখানে বন্ধুর যে-সব ভারতীয় বন্ধুদের সে দেখেছে, তারা তো প্রত্যেকেই একবার না একবার স্ট্র্যাটফোর্ড অন আভ-এ শেক্সপীয়ারের বাস্তুভিটে দেখতে ছুটেছে।
শেষ পর্যন্ত বিমানবিহারীর প্রকাশনালয়ের এক কর্মচারীকে সঙ্গে দিয়ে পাঠানো হলো। চিৎপুরের কদর্য রাস্তা, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার মুখে সরু গলিতে সারি সারি তোলা উনুনের ধোঁয়া, সামনের চত্বরে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে দুটি ষাঁড়, এসব দেখে লিজ-এর মনটা বিমর্ষ হয়ে যায়। অতি মনোহর প্রাচীন বাড়িটির গায়ে কোথাও কোথাও দগদগে ঘায়ের মতন নতুন প্লাস্টার ও ক্যাটকেটে রং করা। সেই বিশেষ দিনটিতে আরও চারজন বিদেশী এসেছে সেই ঐতিহাসিক ভবনটি দেখতে কিন্তু ভারতীয় দর্শক আর একজনও নেই। কয়েকটি খালি-গায়ে বাচ্চা ছেলে তাদের ঘিরে ধরে ভিক্ষে চাইছে।
অলি আর বুলি সেদিন গিয়েছিল লিজ-এর সঙ্গে। এই দুটি মেয়েকে লিজ-এর খুব পছন্দ। প্রথম প্রথম লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওরা মেম কাকিমার সঙ্গে মিলতে পারত না, কিন্তু এখন বেশ সাবলীল। মেমকাকিমার সঙ্গে ইংরিজি বলতে হয় না, বরং তার মজার বাংলা কথা শুনে ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। এখন ওদের কাছেই লিজ বাংলা উচ্চারণ শেখে।
অলির বয়েস মাত্র এগারো হলেও রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা সে পড়েছে। ঠাকুরবাড়ির দোতলায় যে-ঘরটিতে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন, সেই ঘরটিতে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ বলে ওঠে :
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত-পাখির গান
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ…
লিজ ছাড়া অন্য বিদেশীরাও মুগ্ধ হয়ে শুনলো সেই আবৃত্তি। তারপর অলি চুপ করতেই লিজ তাকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভিজিয়ে দিল তার গাল।
বঙ্কু সঙ্গে আসেনি, অফিসের কর্মচারিটি অপেক্ষা করছে ভাড়া করা ট্যাক্সিতে। নিচে নেমে এসে লিজ অলিকে বললো, চলো, আরও কোথাও যাই।
কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?
অলি বললো, বাবলুদাদাদের বাড়ি যাবে?
–কে বাবলুদাদান
–বাবলুদাদা আমার বন্ধু। আর ও বাড়িতে মুন্নি আছে, সে বুলির বন্ধু।
–তোমাদের দু’জনেরই বন্ধু আছে যখন, তখন সেখানে তো যেতেই হয় একবার। কিন্তু এই দুপুরবেলা গেলে তোমাদের বন্ধুদের মা-বাবা কিছু মনে করবেন না তো?
বুলি বললো, না, কাকিমা সব সময়ে হাসে।
খানিক বাদে বাগবাজারে বাবলুদের বাড়ির সামনে থামলো ট্যাক্সি। সেই ট্যাক্সি থেকে লিজকে নামতে দেখেই ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল। হোক না শাড়ি পরা, তবু তো খাঁটি মেম। এ পাড়াতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানও চোখে পড়ে না।
গ্রীষ্মের ছুটি তাই বাবলু, পিকলু, তুতুল সবাই বাড়িতে আছে। প্রতাপ কলকাতার বাইরে গেছেন কী একটা কাজে। মমতা শশব্যস্ত হয়ে উঠলেও খুব একটা ঘাবড়ালেন না, অল্প বয়েসে তিনি ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে একটি স্কুলে খাঁটি ইংরেজ শিক্ষয়িত্রীর কাছে পড়েছেন। তাঁর বাপের বাড়িতে একটা ইংরিজি আবহাওয়া ছিল, এখনো তিনি ইংরিজিতে কথা বলার কাজ চালিয়ে দিতে পারেন।
সুপ্রীতি গ্রামে লেখাপড়া করেছিলেন, তিনি ইংরিজি জানেন না, তিনি মেমকে আসতে দেখেই এস্তে রান্নাঘরে আশ্রয় নিলেন এবং সেখান থেকে মেয়ের মুখে বাংলা কথা শুনে তিনি ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চিত হতে লাগলেন।
বাবলু-পিকলুদের ঘরটা এমনই লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে যে সেখানে কোনো বিশিষ্ট অতিথিকে বসানো যায় না। লিজকে আনা হলো মমতাদের শোবার ঘরে। মমতা অলি আর বুলির দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা আসবি, আগে থেকে খবর দিস নি কেন?
লিজ বললো, আমরা আপনাডেরকে চোকে ডিটে এশেসি!
মমতা লজ্জা পেয়ে বললেন, বেশ করেছেন, বেশ করেছেন, খুব খুশী হয়েছি। ইউ আর ওয়েলকাম। মোস্ট ওয়েলকাম। আমরা খুব খুশী হয়েছি।
মুশকিল এই যে এ মেয়ের সামনে বাংলায় কোনো গোপন কথা বলারও উপায় নেই। অলি-বুলিদের যে একজন মেমকাকিমা এসেছে, সে খবরই জানতেন না মমতা। তিনি ওদের জন্য মিষ্টি কিনে আনতে পাঠালেন বাবলুকে।
লিজ যে-কোনো বাড়িতে গেলেই সে পরিবারের প্রত্যেকের সম্পর্কে প্রশ্ন করে। কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, কে কোন কাজ করে বা কতদূর লেখাপড়া জানে। এই সব জানতেই তার কৌতূহল। তুতুলকে দেখার পর তার মাকেও ডেকে আনা হলো প্রায় জোর করে। সুপ্রীতিকেই কেন যেন বেশি পছন্দ হলো লিজ-এর। সুপ্রীতির সঙ্গে নাকি তার মায়ের মুখের খুব মিল।
এতটুকু একটা অ্যাপার্টমেন্ট-এ যে একটা যৌথ পরিবার থাকতে পারে, সেটাই লিজ-এর কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। চারটি ছেলেমেয়ের কেউ হস্টেলে থাকে না, বাড়িতে থেকে পড়ে। আর্থিক অনটন আছে তা বুঝতেই পারা যায়। কিন্তু এদের মধ্যে যে একটা চাপা সমবোধ আছে লিজ সেটাও টের পেল, কথায় বাতায় কোনো হীনমন্যতা নেই। লিজ জানে তার নিজের দেশের দরিদ্ররা কত রুক্ষ ও তাদের কথাবার্তা কী রকম অমার্জিত হয়। মনে মনে সে এই তুলনাটা করে নিল।
দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পিকলু। তার মুখে সদ্য দাড়ি-গোঁফের রোম রেখা উঠেছে, ঠিক পলিমাটির ওপরে নবীন তৃণের মতন। সে একাগ্রভাবে দেখছে লিজকে। তার যা বয়েস তাতে। সে কোনো অপরিচিতা নারীর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারে না, দৃষ্টিটা শরীরের নানা অংশে ঘোরে।
লিজ একবার পিকলুর দিকে মনোযোগ দিয়ে বললো, এবারে আমি এই যুবকটির সঙ্গে কথা বলতে চাই। সব বাংলায় বলতে পারবো না, তোমার সঙ্গে আমি ইংরিজিতে কথা বলতে পারি?
পিকলু মাথা নেড়ে বললো, ইয়েস, ইউ ক্যান।
লিজ বললো, নবীন যুবক, এর পর তোমরাই তো ইন্ডিয়া নামে দেশটা চালাবে। তোমার কী মত, এই দেশটা পাশ্চাত্তের অনুকরণে যান্ত্রিক সভ্যতাকে বরণ করে নেবে না খাঁটি প্রাচ্য দেশীয় হয়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে?
পিকলু মাটির দিকে চোখ রেখে একটু চিন্তা করে ইংরিজিতে বললো, আমার তো মনে হয় এ দেশে সমস্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি বর্জন করে মেষপালকদের যুগে ফিরে যাওয়া উচিত।
–মেষপালকদের যুগ? তার মানে?
–এ দেশে এত মানুষ। একজন মেষপালকই ভালো জানবে কী করে এতজনকে একসঙ্গে চালাতে হয়।
লিজ হাসতে গিয়েও থেমে গেল। ভুরু কুঁচকে বললো, এটা খুব একটা উজ্জ্বল চিন্তা নয়।
পিকলু বললো, আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, এ দেশের বড় বড় কলকারখানার দরকার নেই। মোটর গাড়ি কিংবা সেলাইকলের দরকার নেই। তার বদলে সারা দেশের প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। অসংখ্য টিউবওয়েল পুঁতে দেওয়া হোক, তাতে সব মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল পাবে, সেই জল দিয়ে চাষ করতে পারবে। প্রত্যেক গ্রামে তাঁত বসানো থোক, তাতেই প্রয়োজনীয় জামাকাপড়। পাওয়া যাবে।
–তাতে তোমার দেশটা সারা পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে না?
–আমাদের এই সদ্য স্বাধীন দরিদ্র দেশ পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে গেলে এমনিতেই পারবে না, হোঁচট খেয়ে পড়বে। তার চেয়ে আলাদা হবার চেষ্টা করাই ভালো।
–তুমি বুঝি একজন কবি?
–না, না, সে সব কিছু না। এমনিই বললুম! বেলা প্রায় পৌনে একটা বাজে, এবারে উঠতে হয়। ভবানীপুরের বাড়িতে ওঁরা চিন্তা করবেন। অলি আর বুলিকে নিয়ে লিজ উঠে পড়লো, মমতা আর সুপ্রীতিকে অনেক ধন্যবাদ জানালো।
দরজার বাইরে বাবলুকে দেখে লিজ বললো, এই বুঝি ওলির বয়ফ্রেণ্ড? তুমি আমাদের সঙ্গে একটাও কথা বললে না কেন?
অলি বললো, এই বাবলুদা, তুমি কথা বললে না কেন কাকিমার সঙ্গে? জানো কাকিমা, বাবলুদাটা বড্ড রাগী!
লিজ বললো, তাই নাকি?
হাত বাড়িয়ে সে বাবলুর একটা হাত ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেমন আছো?
বাবলু গড় গড় করে বললো, অল রাইট, ভেরি গুড! হাউ আর ইউ!
লিজ হেসে ফেলে বললো, কী মিষ্টি গলা! ওলি, তোমার ছেলেবন্ধুকে যদি আমি একটা চুমু খাই তুমি কি তাতে রাগ করবে?
বলেই সে ফটাফট করে বাবলুর দু গালে দুটি চুম্বন এঁকে দিল। লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল বাবলুর।
বাড়িতে একটি জলজ্যান্ত মেম আসা বেশ বড় একটা ঘটনা। দিনের পর দিন সেই আলোচনা চলে। তার হাসি, তার শাড়ি পরার ধরন, তার বাংলা উচ্চারণ, তার দু আঙুলে চিমটের মতন সন্দেশ তুলে খাওয়া। বাবলুর গালে সেই মেম চুমু খেয়েছে বলে তুতুল, পিকলু আর মুন্নি রোজ তাকে রাগায়। কানুও সেই সঙ্গে জুটেছে। কানু বলে মেমের খুব পছন্দ হয়েছে বাবলুকে, সে তাকে বিলেতে ধরে নিয়ে যাবে! বাবলু তাই শুনে সবাইকে মারতে যায়।
লিজ-এর সঙ্গে তর্ক করে পিকলুরও খুব উৎসাহ হয়েছে মেমের সঙ্গে আবার কথা বলার। প্রতাপ ফিরে আসার পর একদিন গেলেন ভবানীপুরের বাড়িতে, পিকলু গেল তাঁর সঙ্গে। বাবলুর সেদিন জ্বর, তার যাওয়া হলো না। তার বিষম রাগ হলো জ্বরের ওপর।
পিকলু ফিরে এসে রাত্তিরবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফিসফিস করে জানালো, বন্ধুকাকার সঙ্গে মোকাকিমার খুব ঝগড়া হয়ে গেছে। তিনি একা একা তাজমহল দেখতে চলে গেছেন আজ সকালেই। এখানে আর ফিরবেন না।
বাবলু পাশ ফিরে শুয়ে একটিও কথা বললো না। জ্বরের ঘোরে তার খুব দুঃখ হলো, সারা জীবনে তার আর কোনো মেম দেখা হবে না।