বিমানবিহারীদের আদি বাড়ি কৃষ্ণনগর। মস্ত বড় বংশ। এই বংশের অনেকে ছড়িয়ে আছেন সারা ভারতবর্ষে, কৃতিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে উচ্চপদে আসীন। দুজন আই সি এস, একজন রাষ্ট্রপতির চিকিৎসক, একজন সেনাবাহিনীর মেজর। ঠাকুরবাড়ির জামাই এবং সুসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গেও বিমানবিহারীদের আত্মীয়তা আছে।
বিমানবিহারীর ঠাকুদা কলকাতায় এসে ওকালতি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। ভবানীপুরের বাড়িটি তাঁর আমলেই কেনা। বিমানবিহারীর বাবার আমলে অবশ্য অবস্থা বেশ বেড়ে যায়, কারণ তিনি উপার্জনের বদলে অর্থ ব্যয়েই বেশি আমোদ পেতেন এবং শিশির ভাদুড়ীর দলে ভিড়ে থিয়েটারের দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিছুদিন একটা রঙ্গমঞ্চ ভাড়া নিয়ে থিয়েটারের ব্যবসা করতে গিয়ে ভরাডুবি হচ্ছিলেন প্রায়, তাঁর অকালমৃত্যুই পরিবারটিকে বাঁচিয়ে দেয়।
প্রতাপের মতন আইন পাস করে বিমানবিহারীও কিছুদিন চাকরিতে ঢুকেছিলেন, তারপর তা। ছেড়ে আদালতে প্র্যাকটিস করতে যান, সেটাও তাঁর পছন্দ হলো না, ঠিক মন বসলো না। পশারহীন উঁকিল সকলেরই করুণার পাত্র, বিমানবিহারীর যখন সেইরকম অবস্থা, তখন তাঁকে পথ দেখালেন তাঁর অন্য এক বন্ধু।
কোর্টের কাছেই ডি জে কিমার অ্যাণ্ড কোম্পানি নামে একটি বিলিতি প্রচার-প্রতিষ্ঠানের অফিস, সেখানে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত আছেন বিমানবিহারীর এক বন্ধু দিলীপকুমার গুপ্ত। আদালত ছেড়ে বিমানবিহারী প্রায়ই যেতেন সেই বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে। অফিসের কাজকর্ম ছাড়াও দিলীপকুমার তখন অন্য একটি কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। তিনি তাঁর বিদুষী শাশুড়ির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সিগনেট প্রেস নামে বাংলা বইয়ের একটি প্রকাশনালয় চালাচ্ছেন। অল্প দিনেই এই প্রকাশনালয়টির দারুণ সুনাম হয়েছে। প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায় নতুন ধরনের চমৎকার সব মলাট আঁকছেন বইগুলির। সে ডি জে কিমার অ্যাণ্ড কম্পানিতেই দিলীপকুমারের সহকর্মী সত্যজিৎ। দিলীপকুমারের কামরায় ঐ দীর্ঘকায় তরুণ যুবকটিকে বিমানবিহারী দেখেছেন কয়েকবার।
দিলীপকুমারের সংস্পর্শে কিছুদিন থেকে বিমানবিহারী বই ছাপার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হলেন। দু জনের বাড়িও কাছাকাছি, দিলীপকুমার থাকেন এলগিন রোডে, এক একদিন বিকেলে দু’জনে একই সঙ্গে বাড়ি ফেরেন। প্রেস, টাইপ, কাগজ, লে-আউট, বাঁধাই এই সব বিষয়ে কথা বলায় দিলীপকুমারের অনন্ত উৎসাহ। সেই উৎসাহ বিমানবিহারীর মধ্যেও সঞ্চারিত হলো, তিনিও বই ছাপার ব্যবসায়ে নামলেন।
তবে বিমানবিহারী বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গেলেন না।
সিগনেট প্রেস থেকে গোড়ার দিকে জওহরলাল নেহরুর ইংরিজি রচনা প্রকাশিত হলেও পরের দিকে তাঁরা বাংলা সাহিত্যের বাছা বাছা বই ছাপতেই মনোনিবেশ করেন। বিমানবিহারী। প্রকাশ করতে লাগলেন শুধু ইংরিজি টেকনিক্যাল বই। ওকালতি বিষয়ে তাঁর ঠাকুর্দার লেখা। একটি বই ছিল, অনেকদিনই সেটা আউট অফ প্রিন্ট, বিমানবিহারী প্রথমে সেই বইটির পুনর্মুদ্রণ করলেন। তারপর ক্রমশ ডাক্তারি, গণিত, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বই। সাফল্য এলো দ্রুত, বি চৌধুরী। পাবলিকেশন্স-এর বই শুধু সারা ভারতবর্ষে নয়, মিশর,ইন্দোচীনেও রপ্তানি হতে লাগলো। ইনঅরগানিক কেমিস্ট্রির একটি বই পাঠ্য হলো পাঁচটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সারা বাড়িতে বই বই গন্ধ। তিনতলা বাড়ি, প্রচুর জায়গা, একতলার ঘরগুলি সবই বইএর গুদাম। মাঝে মাঝে মিল থেকে কাগজ কিনেও স্টক করে রাখতে হয়। দোতলায় বিমানবিহারীর নিজস্ব বিরাট লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরির মধ্যে একটি ছোট খাট, বিছানা আছে, প্রায় রাত্তিরেই বিমানবিহারী সেখানেই ঘুমোন। সেই ঘরেই টেলিফোন। কোনো কোনো রাতে দেড়টা-দুটোর সময়েও টেলিফোন বাজে। সে রকম টেলিফোন হঠাৎ বাজলেও ভয়ের কিছু নেই, ধরে নিতে হবে দিলীপকুমার ডাকছেন। ঐ মানুষটি নিশাচর। অদম্য তাঁর কর্মশক্তি। কোনোদিনই নাকি রাত আড়াইটে তিনটের আগে ঘুমোত যান না।
এমন বই-পাগল মানুষ দেখা যায় না। মধ্যরাত্রির পর, চতুর্দিক যখন নিস্তব্ধ, তখনই তাঁর পাণ্ডুলিপি পাঠ, কপি সংশোধন, প্রফ সংশোধন বা ফরম্যাট সাজানোর চিন্তার প্রকৃষ্ট সময়। কোনো ভালো লেখা পড়লে বা ভালো বই দেখলে তিনি তখনই উৎসাহিত হয়ে বিমানবিহারীকে জানাতে চান। তা যত রাত্ত্বিরই হোক না। একদিন মাঝরাত্তিরে টেলিফোনে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিমান, বলো তো, নির্জনতার রং কী?
বিমানবিহারী এরকম প্রশ্ন শুনলে উত্তর দেন না, কারণ তিনি জানেন, প্রশ্নকারী নিজেই উত্তর দেবেন। তিনি শুধু মৃদু কৌতূহল প্রকাশ করেন।
দিলীপকুমার বললেন, এটা বলতে পারলে না? শোনো, ভগবান শুধু চুল আঁচড়াবার জন্যই কাঁধের ওপর মাথাটা দেননি, ওটার একটা অন্য রকম ব্যবহারও আছে। মাঝে মাঝে মাথার সেই ব্যবহারটাও করো। নির্জনতার রং নীল, আবার কী?
বিমানবিহারী বললেন, যথার্থ। ঠিক বলেছো! আমার মাথায় খেলেনি।
–তাহলে দুপুরের রং কী হবে?
–ইয়ে, সাদা বোধহয়!
–সাদা আবার রং নাকি? সাদাই যদি হতো, তাহলে কি আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম? কোনোদিন কি তুমি দুপুর দ্যাখোনি? নাকি তুমি সব সময় সান গ্লাস পরে থাকো? এই একটা বাজে জিনিস, সান গ্লাস! আলো-অন্ধকার-রোদবৃষ্টি এগুলো মানুষের চোখের পক্ষে খুব স্বাভাবিক, তা না, সান গ্লাসে চোখ ঢেকে পৃথিবীটাকে অন্য রঙে দেখা।
–দিলীপ, আমি সানগ্লাস খুব কম পরি। তুমি অন্য দিকে চলে যাচ্ছো। দুপুরের রং কী? আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
–হলুদ। তাছাড়া আর কী? আমি ‘নীল নির্জন’ আর ‘দুরন্ত দুপুর’ নামে দুটি কবিতার বই ছাপছি। তুমি হলে এই দুটো বইয়ের মলাটে কী রং দিতে?
–আমি ছাপবো কবিতার বই? তোমার ভয়ে তো আমি বাংলা বই-ই ছাপি না! তুমি নাকি। এক একটা বই-এর মলাট পাঁচ-ছ’বার করে আঁকাও? আমি যা বই ছাপি তার জন্য মলাট আঁকাতেই হয় না!
আর একবার, বছর দু’এক আগে রাত দেড়টার সময় দিলীপকুমার টেলিফোনে এক চমকপ্রদ খবর দিয়েছিলেন। সেদিন বিমানবিহারী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ফোনের ঝনঝন ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে।
গলার আওয়াজ শুনেই দিলীপকুমার ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। তাই প্রথমেই বললেন, বিমান, ঘুমোচ্ছিলে বুঝি? মৃত্যুর পরে যখন চিত্রগুপ্তর কাছে যাবে, তখন তিনি বলবেন, তোমার মহাপাপ হচ্ছে এই যে তুমি অর্ধেকটা জীবন ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। অতই যদি ঘুম ভালোবাসো, তা হলে মানুষের বদলে পাথর হলেই তো পারতে!
–আজ আবার তোমার মাথায় নতুন কোন্ চিন্তার উদয় হলো?
–তুমি মানিকের ছবিটা দেখেছো?
ঘুম চোখে বিমানবিহারী বুঝতেই পারলেন না, কে মানিক, কিসের ছবি!
তিনি আলগাভাবে উত্তর দিলেন, বোধহয় দেখিনি!
দিলীপকুমার যেন সেই উত্তর শুনে শারীরিকভাবে আহত হয়ে আর্তস্বরে বললেন, বোধহয়? তার মানে কী? হয় দেখেছো, অথবা দেখোনি। আর ঐ ছবি দেখার পরেও তুমি যদি বোধহয় বলল, তাহলে আমার সন্দেহ হচ্ছে, তুমি কি মানুষ? না পুরোপুরি পাথর?
এই সবই দিলীপকুমারের কৌতুক। তিনি গম্ভীর, ধমকের সুরে মস্করা করতে ভালোবাসেন।
বিমানবিহারী বললেন, দিলীপ, ঠিক ধরতে পারছি না, একটু বুঝিয়ে বলো। কিসের ছবি?
তখনই তিনি জানলেন যে সত্যজিৎ নামে বিজ্ঞাপন অফিসের সেই তরুণ শিল্পীটিরই ডাকনাম মানিক এবং সে পথের পাঁচালি নামে একটি ফিলম তুলেছে, অনেক ঝকমারির পর সদ্য রিলিজ করেছে ফিলমটি।
বিমানবিহারীর সিনেমা-থিয়েটারের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। অল্প বয়েসে নিউ থিয়েটার্সের দু চারখানা ছবি দেখেছেন মাত্র। তা চেনাশুনো কেউ যদি একটা ফিল্ম বানিয়ে থাকে সেটা কোনো এক সময় দেখে নিলেই চলবে। এত ব্যস্ততা কিসের? সেই রকম একটা দায়সারা উত্তর দিতেই দিলীপকুমার আবার বললেন, কোনো এক সময়! তুমি বুঝতে পারছো না আমি কোন্ ছবির কথা বলছি? পথের পাঁচালি! এদেশে কেন, সারা পৃথিবীতে এরকম ফিল্ম আগে তৈরি হয়নি। দেরী করো না। শিগগির যাও, যাও, দেখে এসো!
বন্ধুর কথায় সেরকম গুরুত্ব না দিয়ে বিমানবিহারী হাসতে লাগলেন। রাত দেড়টার সময় তিনি কোথায় সিনেমা দেখতে যাবেন? দিলীপের যা কাণ্ড!
বিমানবিহারী অবশ্য পরের দিন বা পরের সপ্তাহেও ফিল্মটি দেখতে যাননি। গড়িমসি করতে লাগলেন, উপরোধে ঢোঁক গিলতে গেলে যেরকম হয়। দিলীপের কম্পানির একজন একটা শখের ফি তুলেছে, সেটা দেখার জন্য তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট করতে তাঁর দ্বিধা হয়। তিনি কাজের মানুষ।
এর মধ্যে তাঁর বাড়ির লোকেরা দেখে এসেছে। দিলীপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাঁকে ছবিটি না-দেখার কৈফিয়ত দিতে হবে বলেই বিমানবিহারী এক শনিবার সন্ধেবেলা গেলেন খুব। কাছের একটি হলে। একা। দর্শক বেশি নেই, টিকিট রয়েছে অঢেল। ছবিটি যখন শেষ হয়ে গেল, অন্য দর্শকরা উঠে পড়েছে, তখনও তিনি বসে বসে অশ্রু বর্ষণ করতে লাগলেন। এ অশ্রু শুধু কাহিনীর করুণ রসের জন্যই নয়। একটি মহৎ শিল্প প্রত্যক্ষ করার কারণে। বেশ কিছু বছর ধরে বাংলা দেশে শুধু দাঙ্গা-হাঙ্গামা, স্বার্থান্বেষীদের ঝগড়া, রাজনৈতিক রেষারেষি এই সবই চলছিল! চতুর্দিকে ক্ষুদ্রতা আর অধঃপতনের সূচনা। বাঙালীর নিজস্ব কোনো কিছু নিয়েই গর্ব করার কিছু ছিল না। এতদিনে এই একটি হলো।
বিমানবিহারী কোনো রাজনৈতিক দলের সংস্পর্শে না থাকলেও দেশ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। শুধু নিজের বা নিজের পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধিতেই তিনি সন্তুষ্ট নন। তাঁর প্রকাশনা ব্যবসা একটু দাঁড়িয়ে যাবার পর থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের বিনা মূল্যে বই দেন, প্রতি বছর দুজন রিসার্চ স্কলারকে জলপানি দেবার ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া তাঁর প্রচুর ছোটখাটো দান আছে, সেকথা বাইরের কেউ জানে না। কেউ নতুন ধরনের কোনো যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের কথা বলে তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি বিনা দ্বিধায় টাকা পয়সা দিয়ে দেন। এ ব্যাপারে প্রতারিতও হয়েছেন অনেকবার।
বিমানবিহারী বিয়ে করেছেন বেশ দেরিতে। তাঁর পুত্রসন্তান নেই, আছে দুটি কন্যা। তাঁর মা। বেঁচে আছেন, তাছাড়া রয়েছেন এক পিসিমা, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে। কৃষ্ণনগর থেকেও কেউ কেউ এসে থেকে যায়। ছেলেমেয়েদের জন্য একজন গৃহশিক্ষক আছেন, তিনি আক্ষরিক অর্থেই গৃহশিক্ষক, থাকেন এ বাড়িতেই। বাল্যকাল থেকেই বিমানবিহারী লোকজনে জমজমাট বাড়ি দেখতে অভ্যস্ত।
একদিন রাত পৌনে একটায় বাজলো টেলিফোন। সেদিন বিমানবিহারীর সামান্য জ্বর হয়েছে। তিনি সেদিন শুয়েছেন তিনতলায় তাঁর স্ত্রীর ঘরে। ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। চাকর ওপরে এসে খবর দিতেই কল্যাণী বললেন, দিলীপবাবুকে বলে দাও যে বাবুর আজ অসুখ হয়েছে।
কিন্তু এর মধ্যে ঘুম ভেঙে গেছে বিমানবিহারীর। তিনি বললেন, না, না, ধরতে বলল। আমার এমন কিছু হয়নি, আমি আসছি।
নিচে এসে রিসিভার তুলে তিনি অবাক হলেন। দিলীপকুমারের পরিচিত রঙ্গমাখা কণ্ঠ নয়। অপারেটর বললো, মিঃ বি চৌধুরী? হোল্ড দ্য লাইন …ট্রাঙ্ক কল ফর ইউ, ফ্রম লণ্ডন!
বিমানবিহারীর বুক কেঁপে উঠলো। নিশ্চয়ই দুঃসংবাদ!
ভালো করে শোনা যাচ্ছে না, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো ও নানারকম বিচিত্র শব্দের পর একজন বললো, দাদা, আমি মানু বলছি। মানু! সারাদিন ধরে তোমায় ধরার চেষ্টা করছি।
বিমানবিহারী একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। লণ্ডন শুনেই তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল। তাঁর এই প্রবাসী ভাইটি সম্পর্কে তাঁকে গোপন দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়। পারিবারিকভাবে তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তবু তো নিজেরই ভাই।
বঙ্কুবিহারী পড়াশুনোয় ভালো ছাত্র ছিল, তাই উচ্চশিক্ষার্থে যখন সে বিলেতে যেতে চেয়েছিল, তার দাদা আপত্তি করেননি। কত ছেলেই তো বিলেত থেকে ব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ফিরে আসে, এখানকার সমাজের চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বঙ্কুবিহারী লণ্ডনে যাবার দেড় বছরের মধ্যে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করে ফেলো এবং তার পড়াশুনো গোল্লায় গেল।
ছোট ছেলের ঐ রকম বিয়ের খবর শুনে মা শয্যাশায়ী হলেন। বউ নাকি থিয়েটারে কাজ করে। থিয়েটারের জগৎ সম্পর্কেই মায়ের প্রবল ঘৃণা আছে। তিনি বিমানবিহারীকে ডেকে বললেন, বীরু, তুই মানুকে লিখে দে, ও যদি ঐ বউকে ছেড়ে দিয়ে এক্ষুনি না ফিরে আসে, তাহলে আমি কোনোদিন আর ওর মুখ দেখতে চাই না।
কিন্তু বঙ্কুবিহারী তার বউকে ত্যাগ করেনি, সঙ্গে সঙ্গে ফিরেও আসেনি। সে সস্ত্রীক এসেছিল বছর চারেক আগে। সরাসরি বাড়িতে না এসে সে উঠেছিল এ্যাণ্ড হোটেলে।
মানুর বিদেশিনী বিয়ে করার ব্যাপারে বিমানবিহারীর নিজের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু তিনি মর্মাহত হলেন ছোট ভাই-এর স্বভাবের পরিবর্তন দেখে।
তাঁদের চৌধুরী পরিবারে বিলেত যাওয়াটা নতুন কিছু নয়। মেমবউও আগে দেখেছেন। বিমানবিহারীর এক মেম কাকিমা ছিলেন, তিনি অতি মধুর স্বভাবের মহিলা। তাঁর কাকাও ছিলেন পুরোপুরি বাঙালী। কিন্তু মানু ফিরলো সাহেবদের একটি ক্যারিকেচার হয়ে, ইংরিজি ছাড়া কথা বলে না, সকলের প্রতি একটা অবজ্ঞার ভাব। ওদিকে সে আবার বউ-এর ভয়ে সবসময় অস্থির। বউ যা বলে, সে সেই কথাটাই চারবার হ্যাঁ হ্যাঁ করে। স্বামী নয়, সে যেন বউয়ের মোসাহেব। আসল সাহেবরা কি এরকম বউয়ের আঁচল ধরা হয়? অবশ্য ইংরিজিতে হেন-পেন্ড হ্যাঁজব্যাণ্ড বলে একটা কথা আছে।
বঙ্কুবিহারী যখন বউকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন তাঁর মেমবউয়ের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। বিদেশিনীরা অনেকে পুরুষদের মতনই সিগারেট খায়, তা সবাই জানে। অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু বন্ধু কি তার স্ত্রীকে বোঝাতে পারতো না যে এ দেশে মায়েদের কাছে পুত্রবধূরা ঐভাবে যায় না? সে সাহসই তার নেই।
মা ছেলে বা বউয়ের সঙ্গে একটিও কথা বললেন না, একবার তাকালেন না পর্যন্ত। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বড় ছেলেকে উদ্দেশ করে বললেন, বীরু, মানুকে বলে দে, ওরা যেমন হোটেলে উঠেছে সেখানেই যেন থাকে। এ বাড়িতে তাদের জায়গা হবে না।
শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা অত্যন্ত তিক্ততায় পর্যবসিত হলো। মানু তার দাদার কাছে সম্পত্তির অংশ দাবি করে বসলো এবং শাসানি দিল মামলা-মোকদ্দমার। সে চায় ভবানীপুরের বাড়িটা বিক্রি করে অর্ধেক টাকা দেওয়া হোক তাকে। আগে সে সমীহ করতো দাদাকে, চোখ তুলে কথা বলতো না, এখন তার চক্ষুলজ্জার বালাই নেই।
নানা জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে টাকা সংগ্রহ করে বাড়িটাকে বাঁচিয়েছিলেন বিমানবিহারী। বাজার দর অনুযায়ী অর্ধেক টাকা পেয়েও মানু সন্তুষ্ট নয়, যেন শয়তান ভর করেছিল তার মাথায়, সে এই পরিবারটিকে ধ্বংস করে দিতে চায়। বিমানবিহারী যে বই-এর ব্যবসা করছেন, তাও নিশ্চয়ই শুরু হয়েছিল পৈতৃক টাকায়, সুতরাং ঐ ব্যবসায়েরও অংশ দিতে হবে মানুকে। তা ছাড়া কৃষ্ণনগরের সম্পত্তি আছে। তার আরও অনেক টাকা চাই।
শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম কিছু ঘটে যেতে পারতো, কিন্তু তার আগে হঠাৎ মানুর স্ত্রীর টাইফয়েড হয়ে গেল। এ দেশের কোনো ডাক্তারের ওপর তার ভরসা নেই, সেই জন্য। হুড়োহুড়ি করে তারা ফিরে গেল ইংল্যাণ্ডে।
তারপর মানু আর কোনো চিঠিপত্রও দেয়নি। এতদিন পর গভীর রাতে তার টেলিফোন।
বিমানবিহারী বললেন, কী খবর, মানু? কেমন আছিস?
মানুর কণ্ঠস্বর বদলে গেছে, ঔদ্ধত্যের ভাব নেই, ইংরিজি বলছে না। সে যেন আগেকার মানু।
সে বললো, দাদা, আমরা ভালো আছি। এখন আমরা আয়ার্ল্যাণ্ডে থাকি। নতুন কাজ নিয়েছি, ব্যস্ত ছিলাম, তাই তোমাদের খবর নিতে পারিনি অনেকদিন। মা আছে? মা কেমন আছে?
–মা ভালো আছেন।
–বৌদি? ছেলেমেয়েরা? দাদা, তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
–সবই ঠিক আছে। তোর খবর বল।
–দাদা, আমি কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরতে চাই। আমার স্ত্রীর খুব ভারতবর্ষ দেখার ইচ্ছে। তোমার মত আছে?
–তুই দেশে ফিরবি, তাতে আমার অমত থাকবে কেন? নিশ্চয়ই আসবি। কবে আসছিস?
–জাহাজের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। বোম্বেতে নামবো। তাই আগে জানতে চাইলাম, তোমাদের কোনো অমত আছে কি না, তা হলে আর কলকাতায় যাবো না, কাশ্মীরের দিকে চলে। যাবো।
–কেন কলকাতায় আসবি না? নিশ্চয়ই আসবি।
–একবার মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে।
–মায়ের বয়েস হয়ে গেছে, এখন অনেক নরম হয়েছেন, আমি বুঝিয়ে বলবো।
টেলিফোন ছাড়ার পর বিমানবিহারীর মনে একটা অশুভ চিন্তা এলো। আগেরবার মানুকে তিনি টাকাপয়সা দিয়েছিলেন, তার জন্য কোনো পাকা দলিল লিখিয়ে নেননি। সেই সময় পাওয়া যায়নি। টাকার একটা রশিদ সে দিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে এই বাড়ির ওপর তার অধিকার খারিজ হয়ে যায় না। মানু কি আবার টাকা আদায়ের মতলবে আসছে?
বিমানবিহারী এই চিন্তাটাকে আপাতত উড়িয়ে দিতে চাইলেন। হয়তো মানু সত্যিই আবার বদলে গেছে। তার কণ্ঠস্বরে কাতরতা ফুটে উঠছিল। রক্তের সম্পর্ক মানুষ সহজে অস্বীকার করতে পারে?
মানু যদি এ বাড়িতেই এসে উঠতে চায় সেই জন্য বিমানবিহারী দোতলার দুটি ঘর পরিষ্কার। করিয়ে রাখলেন, বাথরুম সারিয়ে, রং করালেন। কল্যাণীকে সব জানালেন, মা-কে কিছু বললেন না আপাতত।
দেড় মাস বাদে বউকে নিয়ে উপস্থিত হলো বঙ্কুবিহারী, ট্যাক্সিতে মালপত্র। বউ দেখে সবাই অবাক। এ তো আগের বউ জুডিথ নয়, অন্য একজন। এ বউও মেমসাহেব বটে, কিন্তু এর পরনে সিল্কের শাড়ি, কপালে লাল টিপ, পায়ে চটি। বঙ্কুবিহারী পরে আছে ধুতি-পাঞ্জাবি।
গাড়ি থেকে নেমে বিমানবিহারীর দিকে হাত দেখিয়ে বঙ্কুবিহারী বললো, লিজ, ইনি আমার দাদা।
হাত জোড় করে নম্র গলায়, ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বাংলায় মেম বউ বললো, নমস্কার। ভালো আছেন?