একটা নড়বড়ে কাঠের টেবিল, তার ওপরে সাজানো নানা রঙের ওষুধের শিশি। হাতলহীন চেয়ারে বসা মধ্যবয়স্ক ডাক্তারবাবুটির কপালে চন্দনের তিলক, বিরল-কেশ মাথায় একটি টিকি, গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি। ডাক্তারবাবুটিকে পুজুরী বামুন হিসেবেই যেন বেশি মানাতো। তাঁর সামনে রুগীদের লম্বা লাইন।
টেবিলের একপাশে একটি প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে আছে হারীত মন্ডল। একটা ঠেঙো ধুতি পরা, খালি গা, বুকে কাঁচা-পাকা চুল, গালে খরখরে দাড়ি। তার ঠোঁটের মিটিমিটি হাসিটি ঠিক আছে, সে একটা বিড়ি টানছে বেশ আরাম করে।
প্রত্যেক রুগীরই প্রায় একই রকম ঘ্যানঘেনে অভিযোগ, ডাক্তারবাবুটি মন দিয়ে শুনছেন না কিছুই, কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, শিশি কিংবা বোতল এনেছো তো? যারা শিশি বা বোতল সঙ্গে এনেছে, তারা বিনা পয়সায় ওষুধ পাবে। যারা আনেনি, তাদের চার আনা দিয়ে শিশি কিনতে হবে। সমস্ত রুগীরা এই দু’ভাগে ভাগ করা। যাদের শিশি নেই, তাদের অনেকের কাছে চার আনা পয়সাও নেই, সুতরাং তাদের অসুখের বিবরণ শুনেও কোনো লাভ নেই। বিনা পয়সার ওষুধ হলেও ডাক্তারবাবু তো রুগীদের গলায় তা ঢেলে ঢেলে দিতে পারেন না।
কম্পাউন্ডার একটি দশ-এগারো বুছরের ছেলে। এই কলোনি থেকেই চালাক চতুর বলে, তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। অসুখ অনুযায়ী ডাক্তারবাবু তাকে বলেন, লাল! সে বড় বোতল থেকে ঠিক মাপ করে লাল ওষুধ ঢেলে দেয় রোগীর শিশিতে।
শেষ রোগীটি একটি শিশু, বছর চারেক বয়স, জ্বরে মুখখানা নীল হয়ে গেছে, তার মা কাঁদছে হাউ হাউ করে। কারণ সেই স্ত্রীলোকটির শিশিও নেই, চার আনা পয়সাও নেই। এই চ্যাঁচার বেড়া দেওয়া ঘরখানির বাইরেই একটি লোক ঝুড়ি ভর্তি খালি শিশি-বোতল নিয়ে বিক্রির জন্য বসে আছে, সে এবার উঠি-উঠি করছে।
স্ত্রীলোকটি অবুঝের মতন শুধুই কাঁদছে, যেতে চাইছে না কিছুতে। ডাক্তারবাবু বিরক্তি-হতাশায় দু’হাত ছুঁড়ে বললেন, শিশি না থাকলে আমি কিসে ওষুধ দেবো?
হারীত মন্ডল বললো, আপনার ঐ বড় শিশি তো দুই একটা খালি হইছে, তারই একটা দিয়ে দ্যান না!
ডাক্তারবাবু চোখ গরম করে হারীত মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার স্টক থেকে খালি বোতল দেবো? ওতে আবার কাল নতুন মিক্সচার ভরতে হবে না? তা ছাড়া, একজনকে দিলে আর রক্ষে আছে? কাল আর পাঁচজন এসে আবার কেঁদে পড়বে না? বলবে, ‘অরে দিছেন, আমারে ক্যান দেবেন না?’
ডাক্তারবাবু শেষ কথাটি এমন মুখভঙ্গি করে বললেন যে, হারীত মন্ডল না হেসে পারলো না। সে বললো, তা ঠিক! পাকিস্তান থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসার সময় বুদ্ধি করে অন্তত দু’ দেশটা খালি শিশি-বোতল আনা উচিত ছিল।
তারপর সে স্ত্রীলোটিকে বললো, ও নিমাইয়ের মা, শুধু শুধু কেন্দে কী হবে? দ্যাখতে আছো তো ডাক্তারবাবুর কোনো উপায় নাই! বরং এস্টেশনের কাছে গিয়া ভিক্ষা মাইগা দ্যাখো চাইর আনা পয়সা পাও কি না!
হারীত মন্ডলের কথা শুনে স্ত্রীলোকটি কান্না থামালো। হারীত মন্ডলকে শোনাবার জন্যই সে। সম্ভবত বেশি করে কাঁদছিল। হারীত মন্ডল তাদের নেতা, সে ভরসা না দিলে আর কোন উপায় নেই।
বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে সে ফিরে যাচ্ছিল, ডাক্তারবাবু এবার তাকে ডেকে বললেন, দাঁড়াও বাছা! এত জ্বর বাছাটার—
পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি সিকি বার করে দিয়ে রাগতভাবে বললেন, এই নাও, শিশি। কিনে আনো। এ কথা যেন আর কারুকে বলো না। তা হলে আমি ফতুর হয়ে যাবো!
তারপর তিনি তাঁর কম্পাউন্ডারের দিকে ফিরে বললেন, হলুদ!
স্ত্রীলোকটি বিদায় নেবার পর ডাক্তারবাবু একটি কাঁচি সিগারেটের প্যাকেট বার করে হারীত মন্ডলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চলবে?
হারীত মন্ডল মাথা নেড়ে বললো, না, ওয়াতে আমি স্বাদ পাই না। আমার বিড়িই ভালো।
আর একটি বিড়ি ধরিয়ে সে গল্প করার ভঙ্গিতে বললো, আগে দেখতাম, ডাক্তারবাবুরা রুগী। পরীক্ষা করে তারপর পেরেসক্রিপশন ল্যাখতেন। এই দেশে আপনারা বুঝি পেরেসক্রিপশান ল্যাখেন না? নিয়ম পাল্টাইয়া গ্যাছে?
ডাক্তারটির নাম হরিসাধন চক্রবর্তী, লোকে বলে হরি ডাক্তার। এই অঞ্চলেরই মানুষ। তাঁর বাবা ছিলেন কবিরাজ, ইনি এল এম এফ। তাঁর মুখে সবসময় একটা রাগ রাগ ভাব, জোর দিয়ে, বকুনির সুরে কথা বলেন কিন্তু মানুষটি কঠোর নন্।
হারীত মন্ডলের কথা শুনে তিনি চোখ সরু করে তাকালেন। এই লোকটিকে তিনি যতই দেখছেন ততই অবাক হচ্ছেন। এই লোকটি স্থানীয় রিফিউজি কলোনির নেতা কিন্তু কখনো একে তিনি জঙ্গিভাব নিয়ে লাফ-ঝাঁপ, চ্যাঁচামেচি করতে দেখেননি। হাসি হাসি মুখে এমনভাবে অন্তর টিপ্পুনি দিয়ে কথা বলে যাতে বোঝা যায় লোকটি অনেক কিছু জানে। কিন্তু এই ধরনের মানুষ কলোনির মধ্যে এত কষ্ট সহ্য করে থাকবে কেন, এরা তো অনায়াসেই বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা জীবন যাপন করতে পারে।
ডাক্তার বললেন, প্রেসক্রিপশান লিখে কী হাতি’ ঘোড়া হবে? শুধু শুধু কাগজ নষ্ট। বাইরে থেকে ওষুধ কেনার কোনো ক্ষমতা আছে এদের?
হারীত মন্ডল সঙ্গে সঙ্গে কথাটা মেনে নিয়ে বললো, তা ঠিক। তারপর সে ওষুধের বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, লাল ওষুধ হইলো প্যাট ব্যথার, হইল্দা ওষুধ জ্বরের, সবুজ ওষুধটা মাথা ঘোরা আর গায়ে বেদনা-কাটাকুটির, আর ঐ খয়েরি রঙের ওষুধটা আমাশা-পাতলা পায়খানা …. ঠিক হয় নাই? দ্যাখেন, বসে বসে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। তবে দুই একবার দ্যাখলাম, আপনি মাথা ঘোরা কিংবা পেট ব্যথার রুগীরেও লাল ওষুধ দিলেন।
–তা হতেই পারে না!
–লাল ওষুধটা বেশি আছে, তাই ওটাই বেশি দিতেছিলেন! ডাক্তারবাবু, আমি একটু আপনের ওষুধ খেয়ে দেখবো?
–আপনি ওষুধ খাবেন কেন, আপনার আবার কী হয়েছে?
–কী জানি ভিতরে ভিতরে কত কী হয়ে বসে আছে। ওষুধ যখন আছে, তখন একটু খেয়ে লই।
তারপর হারীত কম্পাউন্ডার ছেলেটির দিকে আঙুল তুলে বললো, এই ছ্যামরা, দে তো, একটু লাল ওষুধ আমার গলায় ঢেলে দে।
ছেলেটি হারীত মন্ডলের হুকুম তামিল করলো সঙ্গে সঙ্গে। হারীত জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বললো, বাঃ, বেশ স্বোয়াদ আছে। জোরালো ওষুধ! এবারে সবুজটা একটু দে তো!
ডাক্তারবাবু হা-হা করে উঠে বললেন, এ কী করছেন? আর দরকার নেই। ওতেই যথেষ্ট হয়েছে!
হারীত একগাল হেসে বললো, খাই না, আর একটু খাই। আমাদের পন্ডিতমশাই বলতেন, অধিকন্তু ন দোষায়। আপনে শোনেননি কথাটা। এই ছামরা দে!
এক এক করে প্রত্যেকটি বোতলেরই ওষুধ চেখে দেখলো হারীত। ডাক্তারবাবু এতক্ষণে বুঝে গেছেন ওর মতলোব। লোকটির যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
হারীত মণ্ডল চোখ টিপে বললো, সব কটারই স্বোয়াদ এক। কোনো ব্যাসকম নাই!
ডাক্তারবাবু বললেন, আমি কী করবো? আমার যা বাজেট সেই অনুযায়ীই তো চালাতে হবে। সরকার আপনাদের জন্য পয়সা খরচ করতে যদি না চায়—
–তা বলে আপনি ডাক্তার হয়ে জেনেশুনে এই বোকা আর গরিব মানুষগুলোকে ধোঁকা দিচ্ছেন।
–আমার যতদূর সাধ্য তো আমি করছি। এটা একটা জেনারাল মিক্সচার, সবরকম অসুখেই কিছু কিছু কাজ হয়। ওদের বিশ্বাস জন্মাবার জন্য আমি আলাদা আলাদা রঙ করে দিয়েছি। এতে উপকার যেটুকু হবার তা হবে, কিন্তু ক্ষতি কিছু হবে না!
–আপনি মানুষ খারাপ না, আপনারে আমি দোষ দিই না। কিন্তু একইভাবে কতদিন চলবে? প্রত্যেক সপ্তাহে দুই তিনজন মারা যাইত্যাছে। আমাগো ঘরগুলা দ্যাখছেন? গরু-ছাগলেও অত খারাপ জাগায় থাকে না!
–দেখে আর কী করবো বলুন! এই দেখুন না, আমার এই ডিসপেনসারির চাল ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টির সময় জল পড়ে। রিলিফ ডিপার্টমেন্টে চিঠি লিখে লিখেও কোনো উত্তর পাই না। শুনুন হারীতবাবু, আপনাকে একটা স্পষ্ট কথা বলি। এই ক্যাম্পের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সরকার এই ক্যাম্পের জন্য আর কিছু করবে না! আপনারা বাংলার বাইরে যেতে রাজি হচ্ছেন না কেন?
–কে বললো রাজি হই নাই?
ডাক্তারবাবু তাঁর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা খবরের কাগজ বার করলেন। প্রথম পৃষ্ঠায়ই। একটা হেডলাইনের ওপর আঙুল রেখে বললেন, এই দেখুন, পালামেন্টে প্রায় প্রত্যেকদিনই আপনাদের ব্যাপার নিয়ে ফাটাফাটি হচ্ছে। পুনবাসন মন্ত্রী মেহেরচাঁদ খান্না স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরা ওভার স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে, এখানে আর রিফিউজিদের ঠাঁই দেওয়া অসম্ভব।
হারীত বললো, তার মানে? ঐ যে ওভার কী কইলেন?
–ওর মানে, ইয়ে, টায় টায় ভর্তি, মানে জনসংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে, এখন। রিফিউজিদের বাইরে সেক্স করাতে হবে।
–তা বেশ তো!
–কিন্তু বিরোধীরা আপত্তি তুলেছে। কমুনিস্ট পার্টির নেতা সাধন গুপ্ত দাবি তুলেছেন, উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গেই থাকতে চায়। সুন্দরবন অঞ্চল ডেভেলাপ করে সেখানে তাদের থাকতে দিতে হবে।
–ঐ সাধনগুপ্ত বাবু নিজে কি একজন রিফিউজি!
–তা জানি না।
–ঐ মেহেরচাঁদ খান্না বাবু কোন্ জাত?
–জাত মানে? বামুন-কায়স্থ …আমি ঐ সব নিয়ে মাথা ঘামাই না।
–সে কথা কইতেছি না। খান্না তো বাঙালী হয় না। উনি কি তাহলে পাঞ্জাবী? দ্যাখেন, রিফিউজিদের মধ্যেও তো অনেক জ্ঞানী, গুণী, বিদ্বান আছে। বাঙালী আর পাঞ্জাবীদেরই সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ হইছে। রিফিউজিরাই রিফিউজিদের দুঃখ বেশি বুঝবে। তাই আমি কইতে চাই, কোনো বাঙালী বা পাঞ্জাবী জ্ঞানী গুণী রিফিউজিরেই পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত করা উচিত কি না?
–তা কেন হবে? কংগ্রেস দলের যে-কেউ মানে, রিফিউজিরা গোটা ইন্ডিয়ারই লায়াবিলিটি।।
–মানে? ঐ লায়া কী কইলেন?
–লায়াবিলিটি …মানে….দায়িত্ব। তাদের পুনর্বাসন করা আমাদের কর্তব্য!
খবরের কাগজখানা হাতে নিয়ে হারীত মন্ডল অন্যান্য খবরের ওপর একবার চোখ বুলালো। তারপর বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলো, এড়া আপনার পড়া হইয়া গ্যাছে? আমি নিতে পারি?
ডাক্তারবাবু বললেন, হ্যাঁ নিন না।
হারীত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, মুখ মানুষ, অনেক কিছুই জানি না। আপনি তো অনেক কিছু জানেন। একটা জিনিস কইতে পারেন? অনেক মুসলমানও তো ইন্ডিয়া থেকে পাকিস্তানে চলে গেছে, তাই না? সেখানেও কি তারা রিফিউজি? এইরকম ক্যাম্পে থাকে? সবাই দূরছাই করে?
ডাক্তারবাবু বললেন, তা আমি জানি না। সেরকম কোনো খবর আমি দেখিনি।
–খবর নাই মানেই ঘটে নাই। অরা মুসলমানগো জইন্যে পাকিস্তান বানাইছে। সুতরাং মুসলমানরা আশ্রয় নিতে গেলে অরা তাদের থাকতে দেবে। এ তো স্বাভাবিক কথা। কিন্তু ইন্ডিয়া তো হিন্দুদের জন্য বানানো হয় নাই! লাখ লাখ হিন্দু রিফিউজি আইলে তাদের নিয়া কী করা হবে পার্টিশনের সময় সে কথাও আপনারা ভাবেন নাই।
–ওসব পুরোনো কথা বাদ দিন তো। বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেছে। এইটুকু পশ্চিমবাংলার মধ্যে সবাই গাদাগাদি করে থাকলে সবাইকেই কষ্ট সহ্য করতে হবে। এখন আমাদের সীমানা বাড়ানো দরকার। বাংলার বাইরে যদি বাঙালীদের জন্য আলাদা জায়গা পাওয়া যায়, তাতে আমাদের সকলেরই তো লাভ। এতে আপনারা আপত্তি করেন কেন?
–কোনো আপত্তি নাই। অনেকেই এই কথা বলে, আমিও এই যুক্তি সমর্থন করি। কোথায় আমাগো পাঠাবেন, ব্যবস্থা করেন।
–জানেন, দন্ডকারণ্য জায়গাটার এলাকা পশ্চিমবাংলার চেয়েও বড়। প্লেন থেকে সার্ভে করে দেখা হয়েছে।
–কেন, এরোপ্লেন কেন? সার্ভের লোকজন বুঝি মাটিতে নামতে ভয় পায়? সাপ-বিছা টিছা আছে?
–আহা-হা, আপনি সবসময় একটা অন্য ফ্যাকড়া তোলেন। আগে প্লেন থেকে সার্ভে করতে হয়, তারপর রাস্তাটাস্তা বানিয়ে ….এতবড় একটা জায়গা পেলে আপনাদের অবস্থা পাল্টে যাবে। জমি-জমা পাবেন, চাষবাস করতে পারবেন ….এখানে শুধু শুধু সরকারের হাত-তোলা ভিখিরি হয়ে পড়ে আছেন।
–আমি তো দুই পায়ে খাড়া। পাঠাইয়া দ্যান না আমারে জঙ্গলে। আমি নিজের হাতে জঙ্গল কেটে বসতি বানাবো!
ডাক্তারবাবু একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এবার চলি। সব রুগীকে যে একই ওষুধ দিই, একথা আবার যেন বলে দেবেন না সবাইকে। এর একটা সাইকোলজিক্যাল এফেক্ট আছে।
হারীত মন্ডলও উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুর হাত ধরে মিনতি করে বললো, দয়া করে আর একটু বসুন। আর দশ মিনিট। আর একজন রুগীরে আপনার চিকিৎসা করতে হবে।
তারপর সে কম্পাউন্ডার ছেলেটিকে বললো, এই ছ্যামরা, তুই যা, বাড়ি যা!
ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখন আবার একজন রুগী দেখতে হবে? কে?
–একটু বসুন। আমি তারে নিয়ে আসতেছি!
হারীত মন্ডল বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলো। তার বিড়ি ফুরিয়ে গেছে, প্রথমে সে কিনলো এক আনার বিড়ি। তারপর গেল নিজের বাড়ির দিকে।
বাড়ি মানে একটি লম্বা গুদাম ঘর। রানাঘাটের কাছে এই ফাঁকা জায়গাটিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনী অনেকগুলি গুদামঘর বানিয়েছিল। এখন সেখানে ছাব্বিশ হাজার উদ্বাস্তু এনে ভরে রাখা হয়েছে। এর নাম কুপার্স ক্যাম্প।
পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে হারীত মন্ডল সপরিবারে কাশীপুরের সেই কলোনি ছেড়ে চলে এসেছিল, তার ধারণা ছিল তাকে পাঠানো হবে অনেক দূরে। কিন্তু দন্ডকারণ্যের সেটেলমেন্ট এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে, তাই তাকে এই কুপার্স ক্যাম্পে এনে তোলা হয়েছে। এখনো পুলিশের নজর আছে তার ওপর। স্থানীয় থানায় তাকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়। সে কোনো প্রকাশ্য মিটিং করতে সাহস পায় না।
বড় বড় গুদামঘরগুলিতে একসঙ্গে অনেকগুলি করে রিফিউজি পরিবার থাকে। প্রথম প্রথম তারা চট, হোগলা বা ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে আলাদা আব্রু রাখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাচ্চাদের হুটোপাটিতে তা যখন-তখন খুলে পড়ে যায়, ছিঁড়ে যায়। এখন চক্ষুলজ্জা ঘুচে গেছে। বিনা আব্রুতেই বিভিন্ন পরিবার তাদের সংসারধর্ম পালন করে চলেছে।
এই ক্যাম্প ছাড়াও কাছাকাছি রয়েছে একটি মহিলা শিবির, আর একটি রূপশ্রী পল্লী শিবির। মহিলা শিবিরে রাখা হয় যে সব নারীর অন্য কোন আত্মীয়স্বজন নেই বা পথে মারা গেছে, কিংবা যে-সব ধর্ষিতা নারী তাদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্তা হয়েছে, তাদের। সম্প্রতি এই মহিলা শিবিরের ওপর নানারকম হামলা চলছে। এককালে এখানে টিনের বেড়া দেওয়া ছিল। সেইসব টিন খুলে খুলে নিয়ে গেছে চোরেরা। তাদের চেয়েও বড় চোরেরা প্রকাশ্যেই ভেতরে ঢুকে। বাছাই করা মেয়েদের নিয়ে যেতে চায়। একটা বেশ ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। এমনকি এই ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে উদ্বাস্তুদের মধ্যেই দলাদলি, মারামারি শুরু হয়ে গেছে।
হারীত মন্ডল জানে যে উদ্বাস্তুদের একতা নষ্ট হলে তারা একেবারে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে যারা তাদের সঙ্গে শত্রুতা করতে চায় তারা এখনো ভয় পায় উদ্বাস্তুদের প্রবল জনসংখ্যাকে। হারীত ওদের প্রাণপণে তাই-ই বোঝাবার চেষ্টা করে।
হারীত যে এখানে এসে রয়েছে তা সে কলকাতায় কারুকে জানায়নি। তার স্ত্রী কতবার তাকে অনুরোধ করেছে একটা অন্তত পোষ্টকার্ড লিখে তাদের ছেলে সুচরিতের খবরাখবর। নিতে। হারীত তাতে রাজি নয়। তাদের একটা ছেলে অন্তত লেখাপড়া শিখুক, বড় হোক। সুচরিত ভালো হাতে পড়েছে, সে বেঁচে যাবে। তাকে আর কোনোক্রমেই হারীত এই দুর্দশার মধ্যে টেনে আনতে চায় না। অদৃষ্টে যদি থাকে তাহলে আবার কোন না কোনদিন ছেলের সঙ্গে। দেখা হবে।
নিজেদের গুদাম ঘরটিতে ঢুকে হারীত তার বিছানার কাছে গেল। এখানে রয়েছে কয়েকটি কাঠের পুতুল। কুমোরবাড়ির ছেলে হারীত অল্প বয়েস থেকেই নানারকম মূর্তি গড়তে– শিখেছিল। এখানকার মাটি ভালো নয়, তাতে ভালো মূর্তি হয় না। কিন্তু এখানে পেয়ারা গাছ আছে প্রচুর, সে গাছের কাঠ দিয়ে সে পুতুল বানায়, হাটবারে নিজের ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে সেই পুতুল বিক্রি করে। বিক্রি হয় মোটামুটি, এর থেকে তার দুচার পয়সা রোজগার হয়।
একটি বেশ বড় পুতুল বেছে নিল হারীত। তারপর গুদামঘরের এককোণে শুয়ে থাকা। একটি মেয়েকে ডেকে বললো, এই গোলাপী, গোলাপী ওঠ!
এই গরমের মধ্যেও মেয়েটি কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। হারীত একটানে কাঁথাটা সরিয়ে দেখলো মেয়েটি উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। মেয়েটির বয়স আঠারো-উনিশের বেশি। নয়, পিঠের ওপর এক রাশ চুল, পরনে একটা শতচ্ছিন্ন লাল-ডুরে শাড়ি। ছেঁড়া হলেও শাড়িটি। পরিষ্কার।
দুঃখী মানুষের কান্না হারীত অনেক দেখেছে। কান্না দেখতে দেখতে মানুষের বুক পাথর হয়ে যায়। এই মেয়েটির কান্না দেখেও হারীতের কণ্ঠস্বর একটুও কোমল হল না। সে ধমক দিয়ে বললো, এই ছেমরী, ওঠ তো! সময় নাই বেশি!
জোর করে হাত ধরে টেনে সে অনিচ্ছুক মেয়েটিকে দাঁড় করালো, আবার বকুনি দিয়ে। বললো, মুখখানা মোছ! এ যেন একেবারে শ্মশানকালী!
মেয়েটির গায়ের রং কালো, কিন্তু তার মুখে একটা উজ্জ্বল শ্ৰী আছে। সেখ দুটি গভীর। তার ঘাড়ের ওপর একটা বড় কাটা দাগ, কোনো ধারালো অস্ত্রের কোপ পড়েছিল সেখানে, এখনো ভালো করে শুকোয়নি।
গুদামঘরের এখানে ওখানে আরও অনেকে শুয়ে আছে। এরা দিনের বেলাতেও শুয়ে। থাকে। কারুর কোনো কাজ নেই। সরকারি ডোলে কোনোরকমে খাওয়াটা জুটে যায়। হারীতের কথাবার্তা শুনে কেউ কোনো মন্তব্য করলো না, হারীতের স্ত্রী ঘরের মধ্যে নেই।
গোলাপীকে নিয়ে হারীত চলে এলো বাইরে, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সেই বৃষ্টির মধ্যেও হারীত গোলাপীর হাত ধরে নিয়ে চললো। একবার গোলাপী থেমে যেতেই হারীত তাকে একটা মদ চড় কষিয়ে বললো, আবার? ডাক্তারবাবু চইলা যাবেন দেরি হইলে।
ডিসপেনসারির মধ্যে ঢুকে হারতি দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর ডাক্তারবাবুকে বললো, এর নাম গোলাপী। নাম শুনেছেন আশা করি।
ডাক্তারবাবু বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। হ্যাঁ, তিনি নাম শুনেছেন। গত মাসে উদ্বাস্তুদের নিজেদের মধ্যেই একটা খন্ডযুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, গোলাপী নামের একটি মেয়ে ছিল তার নায়িকা। দু’একটি পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছিল।
হারীত তার হাতের পুতুলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, ডাক্তারবাবু, আপনারে তো আমি ফি দিতে পারবো না। এই পুতুলটা ন্যান, আপনার ঘর সাজাবেন।
ডাক্তার পুতুলটি দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলেন। একেবারে পাকা হাতের কাজ। তাঁর খানিকটা শিল্পের বোধ আছে, তিনি দেখেই বুঝলেন, গ্রাম্য হাট-বাজারে যে-সব পুতুল দেখা যায়, সেগুলির সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে বানিয়েছে? আপনি?
হারীত গা মুচড়ে বললো, এই আর কী, কিছু তো কাজ-কাম নাই, তাই একটু টুকটাক যা পারি–
ডাক্তারবাবু পুতুলটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। একটি মেয়ের পূর্ণাবয়ব মূর্তি, মুখোনিতে ভারি সারল্য মাখা।
হারীত বললো, দ্যাখেন তো, ঐ পুতুলের মুখের সাথে এই মেয়েটির মুখের কোনো মিল পান কি না। অরে দেখেই বানাইছিলাম।
ডাক্তারবাবু চোখ তুলে গোলাপীকে দেখলেন। গোলাপীর কান্না-মাখা মুখের সঙ্গে এই পুতুলের কোনো মিল খুঁজে পেলেন না।
হারীত বললো, এ আমার মেয়ে। আপন নয় অবশ্য। ওর বাবারে আমি চিনতাম, সে কলেরায় মরেছে। ওর মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই, সেই দ্যাশ ছাড়ার সময় থেকেই, বুঝলেন। অনাথা মেয়ে বলে যাতে ওরে মহিলা শিবিরে ভরে না দেয়, তাই আমি ওরে আমার কন্যা পরিচয় দিয়ে নিজের কাছে রেখেছি।
গোলাপীর সর্বাঙ্গে নজর বুলিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, বাকিটা আর বলতে হবে না, বুঝেছি। কিন্তু মন্ডলমশাই, এর চিকিৎসা করার ক্ষমতা আমার নেই।
হারীত বললো, না, শোনেন, বাকিটা শোনেন। আপনি তো জানেন, আমাগো গুদামঘরগুলিতে সকলে মিলে কী রকমভাবে থাকি। ছেলেময়েগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে, তারা পাশাপাশি শোয়। পাটখড়ি আর আগুন কাছাকাছি আনলে কী রকম পট পট চড় শব্দ হয় শোনেন নাই? উঠতি বয়সের পোলা-মাইয়ারা সেইরকম আগুন আর পাটখড়ি। ভাবলাম কোনোরকমে নমো নমো করে মেয়েটার বিয়া দিয়ে দিই। তিন নম্বর ওয়ার্ডের একটি ছেলেরে কোনরকমে রাজি করাইছিলাম। তার পরেই হইলো কী, রূপশ্রী কলোনির একটি হেলেরও খুব পছন্দ নাকি গোলাপীকে। সে কথা সে আগে বলে নাই। এই নিয়েই তো তিন নম্বর ওয়ার্ড আর রূপশ্রী কলোনির ছেলেগো মধ্যে কাজিয়া। রাগের চোটে একজন এই গোলাপীর কান্ধে কোপ মেরেছিল, এই দ্যাখেন!
ডাক্তারবাবুটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, এখন মেয়েটির এই অবস্থা করলো কে?
হারাত বললো, জানি না। আমি অরে জিজ্ঞাসাও করি নাই। কাকে দোষ দেবব বলেন? ওর পোয়াতী হবার জন্য আসল দায়ী কে জানেন? দায়ী হলো শনি, উনিশ শো সাতচল্লিশ সালে যে শনি আমাগো উপর ভর করেছে।
–এখন এই অবস্থায় ওর তো আর বিয়ে হবে না। কে বিয়ে করবে?
–কেউ না সব বীরপুঙ্গব এবারে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। আর অন্য সকলে এই মেয়েটারে আর ওর পেটের টারে মেরে ফেলতে চাইবে। তাই…! এখন ডাক্তারবাবু, আপনার দ্বারস্থ হয়েছি, এখন দেখেন আপনি বাঁচাইতে পারেন কি না!
গোলাপী মাটির দিকে মুখ করে আছে, হাত দুটি বুকের কাছে মুঠি করা, তার দন্ডায়মান মূর্তিটিকে নিষ্প্রাণ মনে করা যেত, যদি না তার দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়াতো।
ডাক্তারবাবুও মুখ নিচু করে বললেন, আমি আর কী করি বলুন! আমার কতটুকু সাধ্য আছে?
হারীত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, তা হলে ওকে পাঠিয়ে দেবো মহিলা শিবিরে? মেয়েটা দ্যাখতে শুনতে খারাপ না, খুব শিগগিরি চালান হয়ে যাবে কইলকাতায়। তারপর বিক্রি হয়ে যাবে মাংসের বাজারে।
ডাক্তারবাবু উষ্ণ হয়ে বললেন, আরে না, না, ছি ছি, আপনি জেনেশুনে একাজ করবেন? আপনি না ওদের নেতা?
হারীতও গলা চড়িয়ে বললো, আর না হলে কী করবো কন? আমি ওকে নিজের মেয়ের। মতন দেখি, আমি তো অরে বিয়া করতে পারি না! তবে অরে আপনি কিছু বিষ দ্যান, যাতে বিনা যন্ত্রণায় মরতে পারে!
দু’জন পুরুষ পরস্পরের দিকে তীব্র চোখে তাকালো। যেন পরস্পরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দু’জনেই অসহায়, তাই এত ক্রোধ। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে এক আর্ত নারী, যাকে উদ্ধার করতে চায় দু’জনেই, কিন্তু সামর্থ্য নেই।
ডাক্তারবাবুই আগে চোখ পাকিয়ে বললেন, আপনি এক কাজ করুন। এই মেয়েটিকে নিয়ে, আপনার পরিবার নিয়ে চরবেতিয়া চলে যান। উড়িষ্যার চরবেতিয়ায় ক্যাম্প আছে। আমি রেকমেন্ড করে দিলে কাল-পরশুই আপনারা চলে যেতে পারবেন। উড়িষ্যার মানুষজন ভালো, ভদ্র, নম্র। সেখানে মেয়েটির যা হোক একটা পরিচয় দেবেন। নতুন জায়গা, কোনো অসুবিধে হবে না আশা করি। বলুন, যাবেন? হারীত মন্ডল এতক্ষণ বাদে আবার হাসলো, পকেট থেকে বিড়ি বার করে বললো, চরবেতিয়া, হ্যাঁ নাম শুনেছি, তা মন্দ কী! নতুন জায়গায় গিয়েই দ্যাখা যাক। আমাদের পন্ডিতমশাই বলতেন, চরৈবেতি, চরৈবেতি! সে কথাটার মানে মনে নাই, বোধহয় চরবেতিয়ায় আমার নিয়তি আমায় নিয়ে যাবে, সে কথাই তিনি আগে থেকে টের পেয়ে গেছিলেন, তাই না?