ভবদেব মজুমদারের আমলে আত্মীয়-কুটুম, দাস-দাসী, আশ্রিতজন সবাইকেই পুজোর সময় নতুন শাড়ি-ধুতি-জামা দেওয়া হতো। ভবদেব যথেষ্ট ভূ-সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন, তাঁর আয় ছিল ছোটখাটো জমিদারের মতন, তিনি পারতেন। প্রতি বছর তিনি প্রতাপকে ফর্দ আর টাকা পাঠাতেন, ভবদেবের নজর ছিল উঁচু, তিনি সেরা জিনিস ছাড়া কারুকে কিছু দিতেন না, প্রতাপ বড়বাজার থেকে সেই সব কিনে নিয়ে যেতেন দেশের বাড়িতে।
ভবদেব নেই, সেই দেশও নেই, বাড়িও নেই, তবু প্রতাপ এখন পরিবারের প্রধান। সময় বদলেছে, পরিবেশ বদলেছে, তা হলেও পারিবারিক প্রথা হঠাৎ ভেঙে দেওয়া যায় না। শুধুমাত্র চাকরির আয় সম্বল, তা সত্ত্বেও প্রতাপকে এ বছরেও সবাইকে ঠিকঠাক সব দিতে হয়েছে। প্রতাপের পিসিরা থাকেন ভবানীপুরে, বড়দিরা বরানগরে। কানুর মামাদের বাড়ি সোদপুর, মমতার দাদা থাকেন তালতলায়, এই সব জায়গায় প্রতাপ নিজে যাননি, কানু আর পিকলুর হাত দিয়ে পাঠিয়েছেন জিনিসপত্র। তাঁর বাবা লোককে দিয়ে সুখ পেতেন, প্রতাপ অন্তরে অন্তরে গজরেছেন। সারা বছর যাদের সঙ্গে দেখা নেই, অন্য কোনো রকম সম্পর্ক নেই, তাদেরও বছরে একবার ধুতি-শাড়ি দিতে হবে কেন?
বাবার সঙ্গে প্রতাপের অনেক বিষয়েই অমিল। বাবা ছিলেন অনেকটা গোষ্ঠি অধিপতির মতন, এই গোষ্ঠির সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে ছিল তার ঝোঁক। ভবদেব দুটি বিবাহ করেছিলেন, দুটি শ্বশুরবাড়ি, তা ছাড়াও যৌবনে তিনি ঘুরে ঘুরে দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেন। মজুমদার পরিবারের একটি শাখা বিচ্ছিন্ন হয়ে বরিশালে বসতি স্থাপন করেছিল, অনেকদিন তাঁদের সঙ্গে কোনো চিঠিপত্রের লেনদেনও ছিল না। এক সময় ভবদেব লোকমুখে শুনলেন যে তাঁর সেই ঠাকুরদার ভাইয়ের বংশ নাকি হঠাৎ দুরবস্থায় পড়েছে, অমনি ভবদেব বরিশালে ছুটলেন তাঁদের উদ্ধার করতে। বরিশালের সেই মজুমদাররা এর পরে অনেক দিন খুব জ্বালাতন করেছিল। অভয়পদ নামে চোয়াড়ে চেহারার এক কাকা প্রায়ই আসতো টাকা চাইতে। প্রত্যেকবারেই এক একটি চমকপ্রদ অজুহাত। পুকুরের সব মাছ মরে যাচ্ছে, জল সেঁচে ফেলতে হবে। তার ছেলে ইস্কুল বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ভুল করে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ইত্যাদি। আসলে লোকটি নাকি জুয়াড়ি। ভবদেব প্রত্যেকবারই কিছু না কিছু দিতেন। প্রতাপ বাবার মুখের ওপর প্রতিবাদ করতে সাহস পেতেন না, তবু তাঁর মনে হতো বাবা অন্যায়ের প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
এই তো কিছুদিন আগে, ঠনঠনে কালী বাড়ির সামনে সেই অভয়পদকে প্রতাপ দেখতে পেয়েছিলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে, চটি খুলে কপালে দু হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে প্রণাম করছিল। মুখে কিন্তু একটুও ভক্তি ভাব নেই, সেই পুরোনো জুয়াড়ির ভাব। তার ময়লা পাঞ্জাবির পকেট থেকে যে ছোট বইটি উঁকি মারছে, সেটি রেসের বই। অভয়পদ চোখ খোলার আগেই প্রতাপ দ্রুত সরে গিয়েছিলেন অন্য ফুটপাথে। দেখতে পেলেই বাড়ি ধাওয়া করতো নিশ্চিত। শুধু মাত্র ক্ষীণ রক্তের সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগসূত্র আছে বলেই কারুর সঙ্গে বাক্যালাপ করতে হবে, প্রতাপ এতে বিশ্বাস করেন না। প্রতাপ তাঁর আপন মামাকেই পছন্দ করেন না, পারতপক্ষে কথা বলেন না, কারণ তিনি মিথ্যেবাদী।
দেওঘরে আসার সময়েও নতুন ধুতি-শাড়ির বাণ্ডিল আনতে হয়েছে। প্রত্যেকের জন্য তো বটেই, তা ছাড়া অতিরিক্ত আধ ডজন। সুহাসিনী চিঠি লিখে আনতে বলেছিলেন। মা কোনোদিনই টাকা পয়সার ব্যাপারটা বোঝেন না। অবস্থা যে অনেক পাল্টে গেছে সে ব্যাপারেও তাঁর কোনো বোধ নেই। দেশের বাড়িতে তাঁর অনেক পুষ্যি ছিল, এখানেও ইতিমধ্যে কিছু পুষ্যি জুটেছে নাকি। প্রতাপ কোনোদিনই টাকা পয়সার ব্যাপারে হিসেবী নন, তিনি কৃপণ নন কোনো মতেই, তবু যে ইদানীং তাকে হাত আঁট করে থাকতে হয় সেজন্যই তিনি মনে মনে ক্ষুব্ধ।
দেওঘরে আসার প্রস্তুতির সময় থেকেই প্রতাপকে টাকা পয়সার চিন্তা করতে হচ্ছে। বড়বাজারের এক সাহাদের দোকানে তাঁর বাবার আমলের সাড়ে তিন হাজার টাকা পাওনা আছে, সে টাকা এখন তারা দিতে চাইছে না। প্রতাপের নিজস্ব সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে। পিকলু কলেজে ভর্তি হয়েছে, এবার থেকে তার জন্য একটা বড় খরচ আছে। দেওঘরে গানের ইস্কুল খুলে বিশ্বনাথ গুহর উপার্জন যৎসামান্য, তাঁর কাছে প্রতাপ সপরিবারে গিয়ে উঠবেন, খরচপত্র সব প্রতাপেরই করা উচিত।
বিশ্বনাথ কিন্তু আয়োজন করে রেখেছেন তাঁর সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
বাড়িটি ছোট হলেও সংলগ্ন জমি আছে বেশ খানিকটা। এককালে বাগান ছিল, তার বিশেষ চিহ্ন এখন না থাকলেও কয়েকটি বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছ ও আতা গাছ আছে। এক কোণে কেয়ার টেকার ভজন সিং-এর ঘর। এই ভজন সিংহের দুই বউ, তারা একই সঙ্গে থাকে। তার মধ্যে একটি বউ আবার নেপালী, সে বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারার ও মধ্যবয়েসী। ভজন সিং কী করে যে এই নেপালী স্ত্রীটি জোগাড় করলো তা কে জানে। দুই পক্ষের দুটি করে ছেলেমেয়ে। ভবদেবের আমলে ভজন সিং-এর মাইনে ছিল আঠেরো টাকা, এখন তা বেড়ে পঁচিশ হয়েছে। এই টাকায় সে কী করে সংসার চালায় তা এক রীতিমতন রহস্য। অথচ খেয়ে-পরে তো বেশ আছে, ছেলেপুলেদের স্বাস্থ্যও খারাপ নয়। এ বাড়ি যতদিন খালি পড়েছিল ততদিন ভজন সিং মালিকের অনুমতি ছাড়াই প্রায়ই চেঞ্জারদের ভাড়া দিত, সে খবর প্রতাপের কানে গেছে। কিন্তু মাঝখানের কয়েকটি বছর কলকাতার-ঢাকার ব্যাপার নিয়ে প্রতাপ এমন ব্যতিব্যস্ত ছিলেন যে এদিকে মনোযোগ দিতে পারেননি।
বাগানের একদিকে ভজন সিং-এর কোয়াটার চাচার বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে গোটা দশেক ডাগর চেহারার মোরগ ঘুরছে। ঐগুলি বিশ্বনাথের সম্পত্তি। প্রতাপদের দেশের বাড়িতে মুর্গী ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল, এখানেও সুহাসিনী এসে পড়ায় সেই নিয়ম স্থাপিত হয়েছে। বিশ্বনাথ অনেকগুলি বছর পশ্চিমে কাটিয়েছেন, মুসলমান ওস্তাদদের সংস্পর্শে থেকেছেন, তাই তাঁর। খাদ্যরুচি অন্যরকম। গরু-ভেড়া-মুৰ্গী সবই চলে। প্রতাপ অবশ্য গো-মাংস কোনো দিন স্পর্শ। করেননি, তবে কুকুট মাংসে তাঁর আপত্তি নেই। বিশ্বনাথ তা জেনেই আগে থেকে অতগুলি। মোরগ কিনে রেখেছেন। মোরগ আর মুগীর মধ্যে বিশ্বনাথ নিজে আবার মুর্গী পছন্দ করেন না।
এ ছাড়া বিশ্বনাথ সঞ্চয় করে রেখেছেন পাঁচ সের অতি উৎকৃষ্ট ঘি, এক মণ দাদখানি চাল, মটর-মুসুরি-সোনামুগ ইত্যাদি নানা রকম ডাল, আধ মণ করে আলু ও পেঁয়াজ, এক বস্তা চিঁড়ে, অনেকগুলো পাটালি গুড়, আরও কত কী। তাঁর শ্যালক যাতে বাজার খরচা করতে না পারে সেই জন্যই বিশ্বনাথের এই বন্দোবস্ত। প্রথমদিন এসে এসব দেখেই প্রতাপ বুঝতে পারলেন তাঁর ছোড়দির দু’ একখানি গয়না নিশ্চিত জলাঞ্জলি গেছে। বিশ্বনাথ যেমন পাগল, শান্তি আবার ততটাই নরম। বিয়ের পর থেকেই প্রায় মায়ের কাছে থেকেছেন বলে তাঁর সংসারবুদ্ধি হয়নি। বিশ্বনাথ আগেও তাঁর স্ত্রীর গয়না ভেঙেছেন, প্রতাপ জানেন। ভবিষ্যটা যে কী করে চলবে তা এঁরা দু জনেই বোঝে না। প্রতাপ মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, ওস্তাদজীর সঙ্গে পরে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
একতলায় চারখানি কামরা, ছাদে একটি চিলেকোঠা আছে, সেখানে সুহাসিনী ঠাকুর-ঘর করেছেন। দেশ ছেড়ে আসবার সময় নারায়ণ শিলা সঙ্গে এনেছেন সুহাসিনী, এখানে নিত্য তার পুজোর ব্যবস্থা হয়েছে। এক দুবেজী এসে দু বেলা ফুল ছিটিয়ে যায়, তার মাস মাইনে আড়াই টাকা। বছর সাতেক আগে সুহাসিনী কাঠিয়াবাবার কাছে মন্ত্র নিয়েছেন, সকাল সন্ধ্যায় তাকে বেশ কিছুক্ষণ ঠাকুরের সামনে চুপ করে বসে থাকতে হয়। এরকম বসে থাকাটা সুহাসিনীর পক্ষে সত্যিই খুব কষ্টকর। যত ছোটবেলা থেকে প্রতাপ মায়ের চেহারাটা মনে করতে পারেন, তাতে মনে পড়ে সুহাসিনীর স্বভাবটি দারুণ চঞ্চল। এক জায়গায় স্থির হয়ে পাঁচ মিনিটও বসতে পারেন না। কেউ হয়তো সুহাসিনীকে কোনো কথা বুঝিয়ে বলছে, তার মাঝখানেও সুহাসিনীর অন্য কথা মনে পড়ে যায়, অমনি তিনি উঠে চলে যান। এ জন্য তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে। কতবার বকুনি খেয়েছেন। এত বয়েসেও তাঁর সেই স্বভাবটি যায়নি। এই রকম মানুষের পক্ষে ঠাকুরের সামনে চোখ বুজে বসে থাকা তো একটা শাস্তি। তা হলে কী দরকার ছিল মন্ত্র নেবার? একটা বয়েসে সব মহিলাই এ রকম মন্ত্র নেন, তাই সুহাসিনীও নিয়েছেন।
চুপ করে তিনি থাকতে পারেন না অবশ্য। প্রথম প্রথম তো দু’ পাঁচ মিনিট পরেই ভুল করে উঠে পড়তেন, এখন চোখ বুজে বসে থাকলেও মুখ চলে। মাঝে মাঝেই বলে ওঠেন, ও শান্তি, ছাদে বড়ি শুকোতে দিয়েছি, দ্যাখ তো কাকে মুখ দিল নাকি? ওরে টুনি কোথায় গেল দ্যাখ, তার গলা শুনছি না কেন? ওরে বিশ্বনাথ বাজার যাচ্ছে নাকি, ওকে বল সন্ধব লবণ আনতে। এই সবই হলো সুহাসিনীর মন্ত্র।
সুহাসিনীর স্বভাবটি যেমন চপলতায় ভরা, তাঁর চোখে তাঁর ছেলে-মেয়েরাও এখনও যেন ছেলেমানুষ। প্রতাপের ডাক নাম খোকন। তিনি এখন লম্বা-চওড়া জোয়ান পুরুষ, তিন ছেলেমেয়ের বাবা, তবু সুহাসিনী প্রায়ই তাঁকে বলেন, ও খুকন, তুই আমার সামনে আইস্যা বয় তো একটু, তোর মাথায় হাত বুলাইয়া দেই। এত কাজ করস, কত রকম ভাবনা-চিন্তা, মাথা গরম হইয়া যায় না?
মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেনই, প্রতাপের অস্বস্তি লাগে, তাই দেখে পিকলু বাবুলরা হাসে। বিশ্বনাথ রঙ্গ করে বলেন, মা, আপনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন না কেন? আমার বুঝি মাথা গরম হয় না?
সুহাসিনী সরল ভাবে উত্তর দেন, তুমি তো কাজ করো না, তুমি তো গান গাও!
সুহাসিনীর কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি যায়।
এবারে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছোবার পর সুহাসিনী প্রতাপকেই প্রথমে বলেছিলেন, আহা রে, সারা রাইত ট্রেনে কইরা আইছস। বড় কষ্ট হইছে নারে?
বিশ্বনাথ বললেন, বাঃ, বেশ তো মা। আপনার ছেলের বউ এলো, নাতি-নাতনীরা এলো। তাদের কোনো কষ্ট হলো না, শুধু আপনার ছেলেরই একা কষ্ট হয়েছে!
সুহাসিনী বললেন, অগো তো মুখ শুকনা দেখি না, ভালোই তো দেখি, খুকনেরই তো দেখি চক্ষের নিচে কালি!
মমতা বললেন, মা, আপনার ছেলে যে শখ করে সারা রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসেছে। এক ফোঁটা ঘুমায় নি!
এ কথা শুনে সুহাসিনী একেবারে আর্ত হয়ে পড়লেন। তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। তাঁর সন্তান এক রাত্রি ঘুমোয় নি এরকম একটা মহা দুঃসংবাদ শোনার জন্য তাঁকে বেঁচে থাকতে হলো? তিনি বললেন, কও কি, বৌমা, তোমরা অরে ঘুমাইতে দাও নাই? এমনিতেই মাথায় : কত চিন্তা, কত কাম করে,…ওরে শান্তি, খুকনের জন্য চিনির সরবৎ কইরা দে? অ্যাখনি দে!
প্রতাপ দু হাত ছুঁড়ে বললেন, আঃ মা, তুমি কী যে করো! হঠাৎ আমি চিনির সরবৎ খেতে যাবো কেন? একটু চুপ করে বসো, অনেক কথা আছে।
সুহাসিনী তখন কোনো কথা শুনতে আগ্রহী নন, তিনি প্রতাপের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, খা, আগে একটু সরবৎ খাইয়া ল, তাতে মাথা ঠাণ্ডা হয়!
প্রতাপ বললেন, দিদি-জামাইবাবু আসেন নি, তুমি তাঁদের কথা একবারও জিজ্ঞেস করলে না?
শান্তি বললেন, খোকনরে দ্যাখলে মা আমাগো কথা ভুইল্যা যায়।
সুহাসিনী বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই শান্তিড়া বড় হিংসা-হিংসি করে। ছুটবেলা থাইক্যাই ও খুকনের লগে।
বিশ্বনাথ বললেন, তা তো একটু হিংসে করতেই পারে। আপনি আপনার ছেলেকে এত ভালোবাসেন যে আমারও হিংসে হয়।
মায়ের বিধবা বেশ প্রতাপের চোখে এখনও অভ্যস্ত হয়নি। নীল রঙের শাড়ীর দিকে সুহাসিনীর বেশী সুহাসিনীর বেশী ঝোঁক ছিল। প্রতাপের চোখে এখনও তাঁর মাতৃমূর্তি নীলবসনা। সুহাসিনী এখন পরে আছেন সাদা থান, তাঁর কপাল ও সিঁথি বড় বেশি সাদা। এই বয়েসেও সুহাসিনীর চুল পিঠ ছাড়িয়ে যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর সুহাসিনী ন্যাড়া হতে চেয়েছিলেন, প্রতাপ তীব্র আপত্তি করে তা আটকেছেন। প্রতাপ তাঁর ঠাকুমা ও বড় পিসিমার মাথায় কোনো দিন মেয়েলি চুল দেখেন নি। আগেকার কালে বিধবারা মাথা ন্যাড়া করতেন, তারপর আর চুল বাড়তে দিতেন না। কিন্তু প্রতাপ নারীদের মাথায় কদম ছাঁট চুল সহ্য করতে পারেন না।
মমতাকে এবং স্টেশান থেকে আসবার পথে বিশ্বনাথকেও শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মায়ের কাছে দিদি জামাইবাবুর না-আসার কারণটা যথা সম্ভব সামলে সুমলে বলতে হবে। বড় জামাইবাবুর চাকরি নেই শুনলে মা উতলা হয়ে পড়বেন। তিনি নিশ্চিত চাইবেন তাঁর বড় মেয়ে আর জামাইকে দেওঘরে নিজের কাছে এনে রাখতে। সেটা সম্ভব নয়। তাতে সংকট বাড়বে ছাড়া কমবে না। বড় জামাইবাবুর ম্যালেরিয়া এবং সামনেই তুতুলের পরীক্ষা, এই দুটিই ওদের না আসার কারণ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। ওঁরা জানুয়ারি মাসে আসবেন।
বড় জামাইবাবুকে নিয়ে প্রতাপের একটা গোপন দুশ্চিন্তা চলছে। ওঁর যে শুধু চাকরি গেছে। তাই-ই নয়, বিপদটা তার চেয়েও বড়, ওঁর মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। এখানে আসবার দিন দশেক আগে সুপ্রীতি একদিন প্রতাপকে আলাদা ডেকে এই কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন। বাইরে থেকে এখনও বিশেষ কিছু বোঝা না গেলেও সুপ্রীতি ঠিকই বুঝেছেন যে তাঁর স্বামী আর আগের মতন নেই। তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্রটা নড়ে গেছে কোনো ভাবে। প্রতাপও একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন, কিছুদিন ধরেই অসিতদা খুব কম কথা বলেন, প্রায় সর্বক্ষণ গুম হয়ে থাকেন, কোনো কথা জিজ্ঞেস করলেও সহজে উত্তর দিতে চান না। অথচ কী হাসি খুশী, প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন অসিতদা।
সুহাসিনী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছেন তাঁর বড় মেয়ে জামাইয়ের না-আসার কারণটা। শান্তি আর সুপ্রীতির চরিত্রের অনেক তফাত আছে, সুপ্রীতি খুবই বুদ্ধি ধরেন, মাথা ঠাণ্ডা, সব দিকে বিবেচনা আছে, সেই জন্যই সুপ্রীতির সংসার নিয়ে তাঁর মা বিশেষ দুশ্চিন্তা করেন না।
বেশ হৈ চৈ করে এখানে দিন কাটতে লাগলো। দু বছর পর পারিবারিক মিলন। দেশের বাড়িতে সেই প্রতি বছর পুজোর সময়ের যে আনন্দ তা তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তবু দেওঘরের পরিবেশটি বেশ মনোরম।
সকালবেলাতে বিশ্বনাথের গানের স্কুল বসে। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এই সময়টাতেই। বিশ্বনাথের ছাত্র ছাত্রী জোটে একটু বেশি। খানিকটা শীত পড়লেই যক্ষ্মা রুগীরা হাওয়া বদলের জন্য দুতিন মাস বাড়ি ভাড়া করে এখানে সপরিবারে থাকে। তাদের ছেলে মেয়েরা জুটে যায়। বিশ্বানাথের ইস্কুলে। বিশ্বনাথের আফশোস তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত জানেন না। ইদানীং ঐ গানের খুব চাহিদা। গার্জেনরা এসে বলেন, মাস্টারজী, দু তিন খানা রবীন্দ্র সঙ্গীত তুলিয়ে দিতে পারেন না? মেয়ের বিয়ের সময় আজকাল যে পাত্রপক্ষ রবীন্দ্র সঙ্গীত চায়!
বাইরের টানা বারান্দায় শুরু হয় ক্লাস। এখন ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা এগারো জন, মাইনে। প্রত্যেকের পাঁচ টাকা। শান্তি বলছিলেন, কেউ কেউ মাইনে না দিলেও বিশ্বনাথ কিছুতেই চাইবেন না। টাকা নিয়ে গান শেখাতে হচ্ছে বলে বিশ্বনাথের মনে এমনিতেই গ্লানি রয়ে গেছে।
মমতা জোর করে পিকলু, বাবলু, মুন্নিকেও জুড়ে দিয়েছেন গানের ক্লাসে। পিকলু তবু কথা শোনে, কিন্তু বাবলু- মুন্নি কিছুতেই বসতে চায় না, মমতা দরজায় কাছে দাঁড়িয়ে পাহারা দেন। সবাই এক টানা গান ধরে :
এ রি মইকা
সব সুখ দিও
দুধ পুত আওর ধন জন লছমী
একবার এ পর্যন্ত হলেই বিশ্বনাথ চেঁচিয়ে বলেন, আবার ধরো, এ রি মইকা…।
সুরটা প্রতাপের কানে লাগে। প্রথম দিন তিনি বিশ্বনাথকে বলেছিলেন,ওস্তাদজী, আপনি সক্কালবেলাতেই পূর্বী সুর গাওয়ান কেন ওদের? আশাবরী বা রামকেলি ধরালে হতো না?
বিশ্বনাথ হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, আরে শিশুদের আর সকাল-সন্ধে কী? ওদের তো যতক্ষণ জেগে থাকা, সেই সব সময়টাই উৎসব! তাই না? তাছাড়া তুমি লক্ষ্য করবে, ব্রাদার, অবরোহণের সুর বাচ্চাদের গলায় সহজে আসে, ভালো আসে।
ইস্কুল-পর্ব শেষ হলে ভজন সিং-এর কোয়াটারে মোরগ কাটা শুরু হয়। বিশ্বনাথ চুরুট টানতে টানতে নির্দেশ দেন। কাজটি সহজ নয়। প্রত্যেকদিনই একটা না একটা মোরগ বেড়া ডিঙ্গিয়ে পালায়। যে-মোরগটিকে কাটা হবে সেই কি টের পায়,নাকি যে পালায় তারই ওপর মৃত্যুদণ্ড পড়ে! ভজন সিং-এর ছেলেমেয়েরা আর পিকলু বাবলুরা সেই মোরগ ধরে আনার জন্য ছোটে। এই কাজটি বাবলু বেশ ভালো পারে, প্রায়ই তারই হাতে ধরা পড়ে মোরগটি।
কাটার কাজটি নেয় ভজন সিং-এর নেপালী বউটি। রান্নাও সেই করে, বেশ ভালো রান্নার হাত, তবে অসম্ভব ঝাল দেয়। প্রতাপের তাতে আপত্তি নেই, বিশ্বনাথেরও না, কিন্তু মমতা একটুও ঝাল মুখে ছোঁয়াতে পারেন না। ছেলেমেয়েদেরও ঝাল খেতে দিতে চান না মমতা, তাই নিয়ে রোজ এক কাণ্ড। নেপালী বউটি কিছুতেই ঝাল কমাবে না, আর ছেলেমেয়েরা মুর্গীর মাংস খাবেই। এই মাংসে একটা নিষিদ্ধ ব্যাপারের স্বাদ আছে, এ মাংস বাড়ির মধ্যে ঢুকবে না, বাগানে বসে খেতে হবে। প্রত্যেকদিনই পিকনিক। পিকলুবাবলু খাওয়ার মাঝপথে উস-আস শব্দ করে, চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে, তবু খাওয়া ছাড়ে না।
একদিন মোরগ কাটা চলছে, এমন সময় সামনের গেট ঠেলে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা প্রবেশ করলো। পুরুষটির ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মান্যগণ্য করার মত চেহারা, মহিলাটির একজন অকাল-প্রৌঢ়া, অন্যজন পরিণত যুবতী। অভ্যেসবশতু, প্রতাপ মহিলা দুটিকেই আগে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। টুকটুকে লাল শাল জড়ানো যুবতীটির দিকে দু’এক পলক বেশি তাকিয়ে প্রতাপের ওষ্ঠে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠলো।
বিশ্বনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ঐ তো, সত্যেনরা এসেছে। ব্রাদার, তুমি ওদের চেনো নাকি?
প্রতাপ বললেন, মনে হচ্ছে ওঁদের মধ্যে একজনকে চিনি। মেঘহীন আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে নির্মল রোদ, প্রতাপের চোখেরও কোনো দোষ নেই, তবু কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন চতুর্দিক ঝাঁপসা অন্ধকার মনে হলো প্রতাপের। কেন যেন একটা প্রবল ঝড়ের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। সে রকম ঝড় প্রতাপ সারাজীবনে আর দেখেন। নি। অনেকদিন আগেকার কথা, তবু প্রতাপের স্পষ্ট মনে আছে, সেই ঝড় শেষের দিবাগত রাতেই বুলার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল।