ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেল প্রতাপের। তিনি বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসলেন। একটি। নিষ্ঠুর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি, তার রেশ এখনো লেগে আছে চোখে-মুখে।
সমুদ্র থেকে উত্থিত মহাসর্পের মতন প্রতাপ ক্রুর নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। পাশে শুয়ে। আছেন মমতা, মুন্নির বিছানাটা একটুখানি আলাদা, সে কখন যেন উঠে এসে মায়ের বুকের কাছে জায়গা করে নিয়েছে। প্রতাপের নিঃশ্বাস যেন জননী ও কন্যাকে একসঙ্গে দগ্ধ করে দেবে।
কত সাধে, কত মমতায় মানুষ একটা নিজস্ব সংসার গড়ে তোলে। অজস্রের মধ্য থেকে সে নির্বাচন করে নেয় তার সঙ্গিনীকে, সর্বস্ব দেওয়া-নেওয়ার অঙ্গীকার হয়ে যায় মনে মনে। এক এক করে পুত্র-কন্যারা আসে, ছড়িয়ে যায় মায়াজাল, শীতের রোদ্দুরে পা দিয়ে আরাম করার মতন পুরুষ উপভোগ করে বন্দীত্বের সুখ।
আবার এক এক সময়, বাইরের কোনো আঘাতে নয়, সব চেয়ে আপন দুটি নারী-পুরুষের পারস্পরিক অবিশ্বাসে জ্বলে ওঠে আগুন। যেন পাশাপাশি দুটি গাছ সুপবনে মাথা দোলাচ্ছিল, বিনিময় করছিল সুখ-দুঃখের কথা, হঠাৎ তাদের সংঘর্ষে ফুলকি দিয়ে উঠলো দাবানল। তখন সব স্মৃতিই তুচ্ছ হয়ে যায়, সব কিছুই বিষবৎ মনে হয়।
প্রতাপ কিছুক্ষণ মমতা ও মুন্নির দিকে তাকিয়ে রইলেন, সে দৃষ্টিতে ভালোবাসা নেই, স্নেহ নেই।
বাঙালী মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি হয়, কিন্তু মধ্য তিরিশেও মমতার যৌবন অটুট। তাঁর যে বড় বড় তিনটি সন্তান রয়েছে তা তাঁর শরীর দেখলে বোঝবার উপায় নেই। তিনি রোগা নন, আবার স্থূলত্বও তাঁকে স্পর্শ করে নি, নাকের দু’পাশে ভাঁজ এখনো চোখে পড়ে না। এই ঘুমন্ত নারী আজও দর্শনীয়া। কিন্তু প্রতাপ সে চোখে মমতাকে দেখলেন না, দুঃস্বপ্নের প্রভাবে তাঁর চোখ রাগে জ্বলছে।
বিছানা থেকে উঠে তিনি আলনা থেকে তাঁর পাঞ্জাবিটি তুলে নিয়ে মাথায় গলালেন, তারপর নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন বাইরে।
ভালো করে আলো ফোটেনি, তবু পথে কিছু কিছু মানুষজন বেরিয়েছে। এ পাড়ার অনেকেই গঙ্গাস্নানে যায়, ব্রাহ্ম মুহূর্তে জলে দাঁড়িয়ে সূর্য-প্রণাম করে। জলখাবারের দোকানগুলিতেও উনুনে আগুন ধরানো শুরু হয়েছে, স্নান-ফেরত লোকেরা গরম সিঙ্গাড়াকচুড়ি কিনে নিয়ে যায় বাড়িতে। করপোরেশনের ধাঙ্গড়রাও এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দেয়।
প্রতাপ হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন গঙ্গার ধারে। চমৎকার ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাঁর মস্তিষ্ক জুড়োলো না, নদীর শোভা তাঁর মনকে হরণ করলো না। চরম অসুখী, উদ্ভ্রান্তের মতন তিনি চলতে লাগলেন অনির্দিষ্টের দিকে।
গ্রামের অভ্যেস অনুযায়ী প্রতাপ ছাত্র বয়েসে লুঙ্গি পরতেন। বিয়ের পরও কিছুদিন চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু মমতার লুঙ্গি পছন্দ নয়। মমতার বাপের বাড়ির কেউ কোনো দিন লুঙ্গি পরে না, তাই প্রতাপকেও তিনি লুঙ্গি ছাড়িয়ে পা-জামা ধরিয়েছেন। পা-জামাটা বাড়ির পোশাক, ধুতি না পরে প্রতাপ কখনো রাস্তায় বেরোন না, কিন্তু আজ তাঁর হুঁস নেই। চুলে চিরুনি দেননি, চোখের নিচে অসমাপ্ত ঘুমের কালো ছাপ।
চা খাওয়ার আগে প্রতাপ দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরান না। আজ তিনি চলতে চলতে এক সময় পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজলেন। পেলেন না। রাত্তিরবেলা সিগারেটের প্যাকেট ও দেশলাই থাকে বেড-সাইড টেলে। পকেটে অবশ্য টাকা রয়েছে কুড়ি পঁচিশটা।
শ্মশানের ধারে পান-বিড়ির দোকান প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে। চিতার আগুনের মতন ঐ দোকানদারদেরও ছুটি নেই। প্রতাপ হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন নিমতলার কাছে। এত ভোরেও এখানে বেশ ব্যস্ততা রয়েছে। একটি দোকানে দাঁড়িয়ে প্রতাপ সিগারেট কিনলেন। তারপর সিগারেটে কয়েকটা টান দেবার পর তাঁর মস্তিষ্ক সচল হল। সেই মুহূর্তে তিনি নির্বাসন দণ্ড দিলেন মমতাকে।
বিচিত্র এই দণ্ড। মমতাকে বনবাসে যেতে হবে না, এক চুলও স্থানচ্যুত হবে না। বিছানা, জানলার পদা, টবের ফুলগাছ, রান্নাঘর, পুত্র-কন্যা নিয়ে মমতা ঐখানেই থাকবেন, কিন্তু প্রতাপ আর ফিরবেন না। প্রতাপের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ। কী করে সংসার চলবে, কোথা থেকে টাকা আসবে, তা মমতা বুঝুক! পৃথিবীতে কিছুই থেমে থাকে না। আকস্মিক হৃদরোগে প্রতাপের মৃত্যু হলে মমতাকেই তো সব বুঝেসুঝে চালাতে হতো!
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবার পর প্রতাপের কপালের কুঞ্চন রেখা মুছে গেল। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সেইটুকু বাতাসে যেন উড়ে গেল তাঁর পশ্চাৎ-জীবন।
আদালতের হাকিমকে চলতে হয় লিখিত আইনের ছক বাঁধা পথে। কিন্তু প্রতাপের ব্যক্তিগত জীবন বে-আইনী, তিনি প্রায়ই যুক্তিহীন, জেদ-তাড়িত পথে যেতে চান। আর্থিক অনটন চিন্তার জগতে একপ্রকার ক্ষুদ্রতা এনে দেয়, সেটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। অথচ এই অবস্থা তাঁকে ইদানীং মেনে নিতে হচ্ছে। বাজারে মাছ কিনতে গেলে মাছ পছন্দ করার চেয়েও টাকার হিসেব করাটাই প্রধান হয়ে ওঠে, প্রতাপের তখন খুব ছোট মনে হয় নিজেকে। তাঁর ছেলে পিকলু কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে পুরী বেড়াতে যেতে চেয়েছিল, জ্যেষ্ঠ সন্তান প্রতাপের বড় প্রিয়, তবু প্রতাপ পিকলুকে যেতে দিতে পারেননি। শুধু তাই নয়, পিকলুর কাছে তাঁকে সামান্য মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে, এ জন্য প্রতাপ মরমে মরে গেছেন।
প্রতাপের থেকে আরও কত গরিব তোক তো আছে। দেশ বিভাগের ফলে কত শত-সহস্র পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, শিয়ালদা স্টেশানে শুয়ে আছে কত জন, কত সাধারণ গৃহস্থ এপার বাংলায় এসে পথে পথে ভিক্ষে করে। কিন্তু প্রতাপকে এসব বোঝানো যাবে না। তাঁর স্বভাবের মধ্যেই গেঁথে আছে এক ধরনের আত্মম্ভরিতা, তিনি দাতা হবেন, কখনোই গ্রহীতা হতে পারবেন। না। অন্য কেউ তাঁর প্রতি সামান্য অনুকম্পা দেখালেই তাঁর গাত্রদাহ হয়।
মমতাকে তিনি যথার্থ ভালোবাসেন এবং তিনি মনে করেন সেই ভালোবাসাটাই যথেষ্ট। মমতার আর কোনো মতামত দেওয়ার অধিকার নেই, কেননা, প্রতাপ যা কিছু করবেন, সবই তো মমতার ভালোর জন্যই করবেন। মমতার শাড়ী কিংবা জানলার পর্দার রং অবশ্য মমতাই পছন্দ করবেন, কারণ প্রতাপ ওসব বোঝেন না, কিন্তু পিকলুকে পুরী পাঠাবার বদলে একটা খাট তৈরি করা যে বেশি প্রয়োজনীয়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার মমতাকে কে দিয়েছে? কাল রাত্তিরে সুপ্রীতির প্রসঙ্গ তুলে মমতা একেবারে মর্মাহত করে দিয়েছেন প্রতাপকে। ঘুমের মধ্যেও, দুঃস্বপ্নে, প্রতাপ যেন এক ভয়ংকর কালো রঙের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তাঁর দিদির সঙ্গে মমতা একসঙ্গে থাকতে চান না! তুতুলকে নিয়ে কোথায় চলে যাবেন দিদি? প্রতাপের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে কি তিনি তাঁর দিদিকে ঐ রকম কোনো কথা সামান্য ইঙ্গিতেও বলতে পারবেন?
মমতা যে এত বুদ্ধিমতী তা প্রতাপ আগে কোনোদিন টের পাননি। দিদির প্রসঙ্গ তুলে। খানিকক্ষণ অভিমানের ফোঁসফোঁসানির পর মমতা আবার নিজে থেকেই প্রতাপের গায়ে হাত। বুলিয়ে বলেছেন যে, থাক, কিছুই বদলাতে হবে না, মমতা এখনকার অবস্থাই মেনে নেবেন। অর্থাৎ, এখন থেকে, দিদির জন্য প্রতাপকে সব সময় মমতার দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। প্রতাপকে প্রতি মুহূর্তে তোয়াজ করে বলতে হবে, মমো, তুমি আমার দিদির মনে দুঃখ দিও না, দিদি যেন কিছু টের না পায়!
সব চুলোয় যাক, দিদি আর তুতুলের যা-হয় তোক। মমতা তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যেমন করে পারুক সংসার চালাক। প্রতাপের আর কোনো দায়িত্ব নেই।
হন হন করে প্রতাপ হাঁটতে লাগলেন হাওড়া স্টেশানের দিকে। স্ট্র্যাণ্ড রোড দিয়ে লরি। চলাচল শুরু হয়ে গেছে। পাট গুদামগুলির পাশের সরু রাস্তাটা ধরলেন প্রতাপ। গঙ্গার ওপর। পাতলা কুয়াশা ছড়িয়ে আছে। শোনা যাচ্ছে কোনো কোনো পুণ্যার্থীর কম্পিত গলার গান। সারা গায়ে জবজবে সর্ষের তেল মেখে কুস্তি করছে কয়েকজন। ব্রীজের নিচে বসে গেছে ফুলের বাজার।
হাওড়া স্টেশনে এসে প্রতাপকে টিকিট ঘর খোলার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল।
প্রথমে তিনি ঠিক করলেন কাশীর টিকিট কাটবেন। যা সামান্য টাকা আছে তাতে আর বেশি দূর যাওয়া যায় না। কাশীতে অবশ্য প্রতাপের চেনা কেউ নেই। সেখানে গিয়ে কী করবেন তা জানেন না, তবু যেতে হবে।
পর পর দু’ ভাঁড় চা ও আরও একটি সিগারেট খাবার পর প্রতাপের মাথা পরিষ্কার হল। স্টেশানের ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। বাড়িতে কেউ এখনও ঘুম থেকে ওঠে নি। মমতা ছ’টার আগে জাগেন না। প্রতাপ এখন বাড়ি ফিরে গেলে টেরই পাবেন না কেউ কিছু। কিন্তু প্রতাপের গোঁয়ার্তুমি এত সামান্য সময়ে কমে না। মমতাকে কিছু শিক্ষা দেবার জন্য তিনি। বদ্ধপরিকর।
যথা সময়ে কাশীর টিকিট কেটে তিনি প্ল্যাটফর্মে ঢুকে একটি বেঞ্চিতে বসলেন। সকালে কাশীর কোনো ট্রেন নেই, অন্য একটি ট্রেন মোগলসরাই-এর ওপর দিয়ে যাবে, তারও দেরি আছে।
চা খাওয়ার পর বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা এসে পড়ে। স্টেশানের বাথরুমে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, মনে পড়লেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। শরীর কতকগুলো আরামে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, আবার মনের বিকার হলে সেই সব অভ্যেসও পরাস্ত হয়ে যায়। বেঞ্চে বসে প্রতাপ একটার পর একটা সিগারেট পোড়াতে লাগলেন।
পাশে যে আর একজন লোক এসে বসেছে, প্রতাপ বেশ কিছুক্ষণ তা খেয়ালই করেন নি। লোকটি প্রতাপের চেয়ে বয়েসে কিছুটা বড়, খাঁকি প্যান্ট ও নীল রঙের জামা পরা, রোদে-পোড়া তামাটে মুখ, মাথায় অল্প টাক, পায়ের কাছে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। আর একটি লাঠি।
প্রতাপের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই লোকটি বললো, নমস্কার, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার দেশলাইটি একবার দেবেন?
দেশলাই নিয়ে লোকটি একটি বিড়ি ধরালো। দু হাতের তালুর মধ্যে বিড়িটি লুকিয়ে জ্বালাবার একটি বিশেষ কায়দা আছে। কয়েকবার ধোঁয়া ছাড়ার পর দেশলাইটি ফেরত দিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, মশায়ের কোথায় যাওয়া হবে? মেদিনীপুরের দিকে নাকি?
প্যান্ট-শার্ট পরিহিত হলেও লোকটির কথা বলার ভঙ্গি পুরোনো ঢঙের। অপরিচিত মানুষকে স্টাডি করা প্রতাপের একটি শখ হলেও এখন তিনি গল্প করার মেজাজে নেই। তিনি সংক্ষেপে বললেন, না।
কিন্তু ঐ লোকটি যেন কথা বলার কোনো সঙ্গী খুঁজছে। প্রতাপ অন্য দিকে মুখ ফেরালেও লোকটি বললো, মশায় কি মাঝে মাঝেই ট্রেনে যাতায়াত করেন? তা হলে আপনি টের পাবেন না। রেল ইস্টিশানের একটা কুচ্ছিৎ গন্ধ আছে। এই গন্ধের জ্বালায় সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।
প্রতাপের কৌতূহল এবারে উসকে উঠলো। সারা রাত? শিয়ালদা স্টেশানের তুলনায় হাওড়া অনেক পরিষ্কার। এখানে রিফিউজিদের আস্তানা হয়নি। কুলি কামিন ছাড়া এই স্টেশানে তো রাত্রে কেউ শোয় না।
লোকটি আবার বললো, কাল পশ্চিম থেকে ফিরলুম তো। লাস্ট ট্রেন, এখানে এসে ভিড়লো রাত এগারোটার পর। তখন আর কোথায় যাই? কলকাতা শহরের কারুকে চিনি না। রাস্তাঘাটও ভালো মনে নেই, তাই শুয়ে রইলুম এখানেই।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, পশ্চিমের কোথায় থাকতেন?
লোকটি সে কথার উত্তর না দিয়ে হাসলো। বিড়িতে আবার টান দিয়ে বললো, কেউ একথা। জিজ্ঞেস করলে কী যে বলবো ভেবে পাই না। ওদিকে তো আমার ঘর বাসা বলতে কিছু ছিল না, সর্বক্ষণ ঠাঁইনাড়া। আজ এখানে তো কাল সেখানে। কানপুরে ট্রেনে চেপেছি, তাই বললুম যে আসছি পশ্চিম থেকে।
–কাজের জন্য ঘুরতে হত বুঝি?
–কাজ? আমি মশায় একেবারে অকাজের কাজী। সারা জীবন কোনো কাজই করলুম। না। গায়ে ফুঁ দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। কার্পাস তুলোর বীজ দেখেছেন? ঠিক সেই রকম। আমার বাপ-মায়ের দেওয়া নাম হল মনোহর মাইতি, কিন্তু আমি নিজেই নিজের আর একটা নাম নিয়েছি। মুক্তানন্দ! কেমন নাম? হে-হে-হে!
প্রতাপ সকৌতূহলে চেয়ে রইলেন লোকটির মুখের দিকে।
মনোহর মাইতি ওরফে মুক্তানন্দ নিজের গালে হাত বুলোত লাগলো। যেন নিজেকে আদর করছে সে।
–বুঝলেন মশায়, মুখ ভর্তি দাড়ি ছিল আমার, আঠারো বছর দাড়ি কাটিনি। গত পশুদিনকে সব সাফ করলুম। আঠারো বছর পরে বাড়ি ফিরছি, অত দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল দেখলে কেউ আমাকে চিনতেই পারবে না। এমনিতেই পারবে কি না সন্দেহ। আচ্ছা, এ দেশে চালের দাম এখন কত? ট্রেনে আসতে আসতে শুনলুম, বাঙালীরা নাকি পাথর-মেশানো চাল কেনে আর ভাত খেতে খেতে দাঁত ভেঙে যায়!
প্রতাপ মনে মনে হিসেব করলেন। আঠারো বছর মানে, যুদ্ধের আগেকার কথা। এর মধ্যে বাঙালীর জীবনে কত পরিবর্তন ঘটে গেছে, এই লোকটি তা কিছুই দেখেনি। সাধু-সন্ন্যাসী নাকি?
খানিকক্ষণ কথা বলার পর বোঝা গেল, সে সব কিছু নয়। লোকটির মধ্যে ধর্মভাব প্রবল নয়। এই মনোহর মাইতিকে যৌবন বয়েসে হিমালয় পাহাড় ডেকেছিল। সেই ডাক শুনে বাড়িঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়ে। বিয়ে-থা করেনি অবশ্য। প্রথম কিছুদিন এক বন্ধু ছিল সঙ্গে। সেই বন্ধু মাস ছয়েক পর ফিরে আসে, কিন্তু মনোহর আর ফেরে নি।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাজকর্ম কিছুই করেননি, আপনার আহার জুটতো কী করে?
লোকটি বললো, বিশ্বাস করুন মশায়, এই আঠারো বছরে একটা পয়সা রোজগার করিনি, চেষ্টাও করিনি। জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি, একথা যে সত্যি পাহাড়-পর্বতে গেলে বোঝা যায়। দেখুন না, বেঁচে তো আছি। আমি যে-সব পাহাড়ে গেছি, তার কোনো কোনো জায়গায় পাহাড়ীরা এখনো পয়সার মুখ দেখেনি, তবু তারাও তো বেঁচে থাকে!
–কিন্তু তারা কাজ করে নিশ্চয়ই। খেতে ফসল ফলায়, পশু পালন করে।
–অনেকে আবার তাও করে না। প্রকৃতি তাদের দেয়। ধওলাগিরিতে একটা ঝোরা আছে, বুঝলেন, তার জল খেলে খিদেও মেটে, তেষ্টাও মেটে। বিশ্বাস করুন আমার কথা। তারপর ধরুন, ব্ৰহ্মকমল ফুলের নাম শুনেছেন? সে ফুলের দিকে একবার তাকালে সারা দিন খাওয়া-দাওয়ার কথা একবারও মনেও পড়ে না। ওখানে বাতাসে কিছু একটা আছে, বুঝলেন!
–আপনার দাড়ি-টাড়ি ছিল, সরল পাহাড়ীরা আপনাকে সাধু মনে করে ভিক্ষে দিত, এটাই। আসল কথা। না খেয়ে মানুষ বাঁচে না!
–হা-হা-হা! আপনি বিশ্বাস না করলে আমি কী করি বলুন? হ্যাঁ, দিয়েছে, পাহাড়ীরা খাবার দিয়েছে, ভিক্ষে নয়, ভালোবাসার দান। কখনো কিছু চাইনি। এই যে প্যান্টুলুন আর জামা দেখছেন, এক সাহেব দিয়েছে। এমনিই! আবার অনেক সময় নেংটি পরে থেকেছি, শীত লাগেনি। একবার টানা এক পক্ষকাল কিছু পাইনি, শুধু জল, তাতেও শরীর শুকিয়ে যায়নি। বেশ মজাসে ছিলুম।
–এত মজা ছেড়ে তা হলে ফিরে এলেন কেন এই নরককুণ্ডে! দেশটার অবস্থা কী হয়েছে তা তো জানেন না!
মায়া, বুঝলেন, সবই মায়া। ফিরে এলুম মায়ার টানে। গাধার গায়ে সিংহের চামড়া জড়ালেই কি আর সে সিংহ হয়? সাধু সেজেছিলুম, কিন্তু প্রকৃত সাধু হতে পারলুম কই? এতকাল পরে হঠাৎ মায়ের জন্য মন টানলো। সে বুড়ি বেঁচে আছে কি না জানি না। তবু একবার তাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। আপনি দেশটাকে নরককুণ্ড বললেন কেন?
–ক’দিন থাকুন, তারপর বুঝবেন!
–হয়তো আপনি ঠিকই বলেছেন। পাহাড় থেকে নিচে নামা ইস্তক গরমে চিটপিট করছে। গা। খিদেও পাচ্ছে যখন-তখন। কাল রাতে এক পেট খেয়েছি, আজ এর মধ্যেই আবার পেট চনমনাচ্ছে! নরকের লোকদেরই কখনো খিদে মেটে না!
আরও একটু পরে লোকটি একটি অবাস্তব প্রস্তাব দিল।
মেদিনীপুরের ট্রেন এসে দাঁড়াতে লোকটি প্রতাপের দিকে কাতরভাবে চেয়ে বললো, আপনিও চলুন আমার সঙ্গে। যেখানে যাচ্ছেন, কদিন পরে যাবেন। একা এতদিন পরে বাড়ি ফিরতে আমার ভয় ভয় করছে।
অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে গিয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় নেবার ব্যাপারটা প্রতাপ উড়িয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। এসব তাঁর ধাতুতে নেই। লোকটিকে তিনি তুলে দিলেন মেদিনীপুরের কামরায়।
প্রতাপের ট্রেন আর একটু পরে আসবে। আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসলেন। লোকটিকে তাঁর বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। এই দুনিয়ায় কত রকম মানুষ আছে। সবাই জীবনের প্রতিযোগিতায় নামে না। কেউ কেউ প্রথমেই দান ছেড়ে দেয়। সংসার থেকে যারা বিবাগী হয়ে যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ফিরেও আসে।
আঠারো বছর বাদে মেদিনীপুরের এক গ্রামে ফিরে গিয়ে লোকটি কী দেখবে? তবু তো ওর ফিরে যাবার একটা জায়গা আছে।
লোকটির দুটি কথা প্রতাপের মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ঘুরতে লাগলো। হিমালয়ে গেলে সত্যি খিদে দমন করা যায়? খিদের জন্যই তো সব! অন্তত এখানে তাই মনে হয়। হিমালয় থেকে কত নিচে এই বাংলা, তাই এখানে সর্বক্ষণ নরকবাসীদের মতন খিদের হাহাকার! পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে কে না এখানে নরক দেখেছে! এখনই বা সেই অবস্থা কতটা পাল্টেছে? প্রতাপকে পালাতে হলে এখান থেকে অনেক দূরে পালাতে হবে।
পাহাড়ে পাহাড়ে অনির্বচনীয় সুখ পেয়েও লোকটা এতদিন পর ফিরে এলো মাকে দেখবার জন্য। মাতৃ-টান! কথাটা শোনার পর থেকে প্রতাপের মনে পড়ছে নিজের মায়ের কথা। মা যেন একটি শিশু। প্রতাপ সম্পর্কে কোনো দুঃসংবাদ শুনলে সুহাসিনী যে কী করবেন তার। কোনো ঠিক নেই।
কাশী নয়, প্রতাপকে আগে যেতে হবে দেওঘর।