কোনো খবর না দিয়েই দেওঘরে এসে উপস্থিত হলেন সত্যেন। মার্চ মাস ফুরোতে না ফুরোতেই হঠাৎ কিটকিটে গরম পড়ে গেছে। আকাশে শ্লেট রঙের মেঘ, তাদের কোনো নড়া-চড়া নেই। শীতের ফুলগুলি ঝরে গেছে, বসন্তের ফুল ভালো করে ফুটলো না।
গেটের সামনে ঘোড়ার গাড়ি থামার শব্দ শুনে দোতলার জানলা দিয়ে বুলা দেখলেন গাড়ি থেকে সত্যেনের সঙ্গে নামছে তাঁর ছেলে বাপ্পা। এই গরমের মধ্যেও সে পরে আছে নীল রঙের কোট-প্যান্ট, গলায় টাই। তার হাতে নতুন ঘড়ি। সে ওপরের দিকে তাকিয়ে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ গলায় ডেকে উঠলো, মা!
বুলা দৌড়ে নিচে চলে এলেন।
সত্যেন যখনই আসেন একরাশ জিনিসপত্র আনেন সঙ্গে। দেওঘরে এই বাড়িটি কেনার পর থেকে তিনি এটিকে নতুনভাবে সাজাচ্ছেন। একজন গোমস্তা রেখেছেন এখানে, এ বাড়ির পেছন দিকের জমিটাও কেনার ইচ্ছে আছে তাঁর। নারায়ণগঞ্জের সম্পত্তি হারিয়ে তিনি এখানে নতুন করে সম্পত্তি তৈরি করতে চান।
গাড়ি থেকে আর একটি অল্পবয়েসী রমণীও নামলো, তার পরনে সাদা শাড়ী। সত্যেন তার পিঠে হাত দিয়ে নিয়ে এলেন ভেতরে।
বাপ্পা বললো, মা, সিনিয়র কেমব্রিজের রেজাল্ট বেরিয়েছে, তুমি শুনেছো?
বুলার বুকের মধ্যে একবার ধক্ করে উঠলো। উৎকণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, বেরিয়েছে? বাপ্পা মুচকি হেসে বললো, আমার কী রেজাল্ট হয়েছে বলো তো? আমি ফেল করেছি।
সত্যেন অট্টহাসি করে উঠে বললেন, ও-রকম বলিস নারে, বাপ্পা! তোর মা হার্টফেল করবে! বড়গিন্নি, তোমার ছেলে দারুন রেজাল্ট করেছে! বুলার চোখে জল এসে যাচ্ছিল প্রায়। তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন।
এই সব পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষা পাশের খবর জানিয়ে বাবা-মাকে প্রণাম করে। বাপ্পাকে তা শেখানো হয়নি, সে কোটের পকেট থেকে একটা চিউইংগাম বার করে মুখে পুরে দিল।
ছেলে বড় হয়েছে, আগের মতন আর তাকে যখন তখন বুকে জড়িয়ে ধরা যায় না, তবু বুলা এখন বাপ্পার মাথাটা টেনে নিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, সত্যি বলছিস, বাপ্পা? আমার কী দারুণ ভয় হয়েছিল!
বাপ্পা মাথাটা সরিয়ে নিয়ে বললো, এবার তুমি আমায় কী দেবে বলো? আমি যা চাইবো তাই-ই দেবে?
বুলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, তুই কী চাস বল?
বাপ্পা বললো, প্রমিস?
বুলা বললেন, হ্যাঁ, তুই যা চাস!
বাপ্পা এবারে সগর্বে বললো, আই ওয়ান্ট টু গো টু ইউ কে, ফর ফারদার স্টাডিজ!
সত্যেন বললেন, আরে ওসব কথা পরে হবে! বাপ্পা, আগে সব জিনিসপত্র নামাবার ব্যবস্থা কর।
তারপর বুলার দিকে তাকিয়ে পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, একে বোধ হয় তুমি চেনো না। বিভার খুড়তুতো বোন নিরু, ওকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। নিরু, ইনি আমার বৌদি, প্রণাম করো!
মেয়েটি বিধবা, বয়েস চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়, গায়ের রং মাজা মাজা, চোখ মুখে শহরের পালিশ পড়েনি। বিভার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। বুলা তাকে নিয়ে এলেন ভেতরে।
সত্যেন এলেই বাড়ি সরগরম হয়ে যায়। সত্যেন হাঁক-ডাক দিয়ে তোক খাটাতে। ভালোবাসেন। বাউন্ডারি ওয়াল কোথায় একটু ভেঙেছে, বাগানে কোথায় আগাছা জন্মেছে, কোন্ গাছের যত্ন নেওয়া হয়নি এই সব তিনি তদন্ত করতে লাগলেন আর গোমস্তা, মালি, দারোয়ানরা তটস্থ হয়ে ঘুরতে লাগলো তাঁর পেছনে পেছনে।
নিরুর জন্য একটা ঘর ঠিক করে দিয়ে বাপ্পাকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন বুলা। তারপর বললেন, এই গরমের মধ্যে কোট টাই কী করে পরে আছিস রে, বাপ্পা? খুলে ফেল!
বাপ্পার মুখে বিনবিনে ঘাম ফুটে উঠেছে, তবু সে কোট খুললো না। কায়দা করে হাতটা ঘুরিয়ে একবার ঘড়ি দেখলো, তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের গিটে হাত দিয়ে বললো, এই স্যুটটা মহাম্মদ আলির দোকান থেকে করালুম, তোমার পছন্দ হয়েছে, মা?
ছেলের চেহারায় অবিকল তাঁর স্বামীর আদল। বাপ্পা হঠাৎ যেন বড় হয়ে গেছে। ‘স্যুট করালুম’ এরকম বড়রাই বলে। গত এক বছর হোস্টেলে থেকে তার ব্যবহার বদলে গেছে। অনেকটা, অনেক উন্নতিও হয়েছে, না হলে পরীক্ষায় ভালো ফল করলো কী করে?
–হ্যাঁরে, বাপ্পা, তোর কবে রেজাল্ট বেরুলো? আমাকে টেলিগ্রাম করিস নি কেন?
–রেজাল্ট তো বেরিয়েছে পশু। কাকামণি বললেন, এখানে আসবেন, তাই আমিও চলে এলুম।
–কোটটা অন্তত খোল বাপ্পা, তোকে দেখে আমারই গরম লাগছে।
–মা, তুমি কিন্তু প্রমিস করেছো!
–তুই সত্যি সত্যি বিলেত যাবি নাকি? যাঃ! তুই যে বলেছিলি, খড়গপুরে পড়বি?
–ম্যানচেস্টারে পড়বো। মা, আই রোট আ লেটার টু ড্যাড। অ্যান্ড হি রিপ্লায়েড। তুমি দেখবে চিঠিখানা?
বুলা স্থিরভাবে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাপ্পা তার কোটের অন্দর-পকেট থেকে সাবধানে বার করলো একটি খাম। তার মধ্যে পাতলা কাগজে টাইপ করা চিঠি। প্রবাসী পিতা তাঁর পুত্রকে চিঠি লিখেছেন ইংরিজিতে।
বুলা চিঠিখানা হাতে নিয়ে চলে এলেন জানলার ধারে। শুধু আলোর জন্যই নয়, ছেলের কাছ থেকে তিনি মুখটা আড়াল করতে চান। বাপ্পার চিঠির উত্তরে নরেন জানিয়েছেন যে বাপ্পার বিলেতে আসার ব্যাপারে তাঁর কোনো আপত্তি নেই, তিনি কলেজে ভর্তি করে দেবার ব্যবস্থা করবেন। কলেজে যাবার আগে সে কিছুদিন বাবার কাছেই থাকতে পারে। বিলেতে আসার প্রস্তুতি হিসেবে কয়েকটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন, হাতঘড়ি পরা অভ্যেস করতে হবে। বিলেতে সব কাজ চলে ঘড়ির কাঁটায়। প্রত্যেকটা মিনিটের দাম আছে সেখানে। ঘুম কমাতে হবে। দিনের বেলা ঘুমোনো ভারতীয়দের বিচ্ছিরি অভ্যেস, এখানে তা একেবারেই চলবে না। চটিপরা চলবে না, সব সময় মোজা ও ফিতে লাগানো জুতো পরতে হবে…
চিঠিটি দু পৃষ্ঠার। তার মধ্যে নরেন বিষয় সম্পত্তির কথাও কিছু লিখেছেন। সত্যেনের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা আনাতে হবে কোন্ কোন্ খাতে, তারও উল্লেখ আছে। রয়েছে বিভিন্ন জাহাজ কম্পানির নাম, তার মধ্যে ইটালিয়ান লাইনারের খাবার-দাবার ভালো ইত্যাদি।
একবারও বুলার নামের উল্লেখ নেই কোথাও।
কিন্তু বুলার চোখে জল এলো না, হাত কাঁপলো না। শুধু ছেলের কথাই তাঁর মন জুড়ে রইলো। বাপ্পা চলে যাবে। কলকাতায় টালিগঞ্জের বাড়িতে বিভার সঙ্গে মানিয়ে থাকতে পারছিলেন না বলে বুলা দেওঘরের বাড়িটাতে এসে রয়েছেন। এখানে তাঁর ভালোই লাগে, কখনো খুব একা-একা বোধ হয়নি, কিন্তু এখন যেন বুকটা ভীষণ খালি খালি লাগতে লাগলো।
বাপ্পা বললো, প্যাসেজ মানি কাকামণি দিয়ে দেবে বলেছে। কন্ডিশান হলো তোমার কনসেন্ট। তুমি তো কনসেন্ট দিয়েই দিয়েছে।
বুলা নিঃশব্দে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। একটা মাত্র ছেলে, সেও যেন তাঁর আপন নয়।
বাপ্পা প্যান্ট-কোট বা জুতো-মোজা কিছুই ছাড়লো না, চলে গেল নিচে। বুলা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন একই জায়গায়।
নরেনের চিঠিখানা টেবিল থেকে উড়ে গিয়ে পড়লো মেঝেতে। বুলা তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। স্বামীর সম্পর্কে তাঁর রাগ বা দুঃখ কিছুই হলো না। নরেন যে চিঠিতে একবারও বুলার নাম উল্লেখ করেননি, তাতে বোঝা যায় লোকটির এখনো কিছুটা চক্ষুলজ্জা আছে। বাপ্পা বিলেত যাবেই, সেই বিদেশ-বিভুইতে ছেলেটা একা গিয়ে পড়বে না, তার বাবা তাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন, তাতে তো বুলার খুশী হবার কথা।
এক সময় বুলার মনে পড়লো, বাড়িতে একটি নতুন মেয়ে এসেছে, তার দেখাশুনো করা উচিত।
নিরুকে দেখেই বুলার একটু খটকা লেগেছিল। মেয়েটির চোখ মুখে, পোশাকে, দাঁড়াবার ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু আছে, যাতে বোঝা যায় সে এই পরিমণ্ডলের বাইরের মানুষ। সত্যেনের স্ত্রী বিভাবতী বেশ ধনী পরিবার থেকে এসেছে, তার কোনো খুড়তুতো বোন এরকম হওয়া যেন মানায় না। হয়তো আপন নয়, দূর সম্পর্কের, কিন্তু সেরকম কোনো বোনকে সত্যেনের সঙ্গে দেওঘরে পাঠানোও তো অস্বাভাবিক।
মেয়েটি বিধবা। নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক দাঙ্গায় তাদের ঘর পুড়েছে, এক ভাসুরের সঙ্গে এসে উঠেছিল খড়দায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে, তাদের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, সেখান থেকে বিভাবতাঁকে একখানা চিঠি লেখা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের লোকের কোনো বিপদের কথা শুনলেই সত্যেন উদারভাবে সাহায্য করেন। নিরুর ভাসুরকে তিনি পাটকলে একটি চাকরি করে দিয়েছেন, নিরুকে এনে রেখেছেন নিজেদের বাড়িতে। বিভাবতীই সত্যেনের পরিচর্যার জন্য তাকে পাঠিয়েছেন এখানে।
মেয়েটির প্রতি মমতা হলো বুলার। নদীর ধারের পলিমাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ পড়বার আগে যে একরকম মসৃণতা থাকে, ওর মুখে সেইরকম ভাব। চোখ দুটিতে ভয়মাখানো সারল্য। দেশে ওদের অবস্থা সচ্ছল ছিল না, খড়দায় যে কয়েক মাস ছিল, খুবই লাঞ্ছনার মধ্যে কেটেছে, তারপর এক ধনী পরিবারে আশ্রয় পেয়ে অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে। কেউ একটু ভালো ব্যবহার করলেই ধন্য বোধ করে!
মানুষকে তার নিজের পরিবেশ থেকে উপড়ে নিয়ে এলে তার জীবনটা মলিন হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল ভাব। নারায়ণগঞ্জের সামান্য বাড়ির উঠোনেও এই মেয়েটি নিশ্চয়ই ছুটে ছুটে বেড়াতো, এর বয়েস তো বেশি নয়, কিন্তু এখানে মেয়েটি প্রথম থেকেই জড়োসড়ো হয়ে আছে, মুখোনি আড়ষ্ট, বুলাকে সে যেন খানিকটা সন্দেহের চোখে দেখছে।
দোতলায় একটি মাত্র স্নানের ঘর, বুলা নিজে সেটা ব্যবহার করেন, নিরুকে তিনি সেখানেই স্নান করে নিতে বললেন। তাকে দিলেন নিজের একটি শাড়ী ও সাবান। তারপর তাকে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে ওপরের ছাদে এনে দেখালেন দূরের ডিগরিয়া পাহাড়। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আগে পাহাড় দেখেছো?
নিরু দু’দিকে মাথা নেড়ে বললো, না।
বুলা বললেন, এই জায়গাটা খুব সুন্দর। তুমি আর কলকাতায় গিয়ে কী করবে, এখানেই। থাকো!
পাহাড় সম্পর্কে নিরুর খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না। সে জিজ্ঞেস করলো, এই বাড়িখান বুঝি আপনের? এত বড় দালানকোঠা, আর কোনো মানুষ থাকে না?
বুলা বললেন, বাড়িখানা তোমার জামাইবাবুর। তবে বেশির ভাগ সময় আমি একাই এখানে থাকি।
এই সময় নিচ থেকে সত্যেন ডাকলেন, নিরু, নিরু!
ওরা দু’জনে নেমে এলো নিচে। সত্যেন একতলায় উঠোনে একটা জলচৌকি পেতে বসেছেন, খালি গা, ধুতিটা উরু পর্যন্ত তোলা। এখানে এলে সত্যেন উঠোনে বসে তোলা জলে স্নান করেন। বাড়ির কোনো চাকর প্রথমে তেল মাখিয়ে তারপর জল ঢেলে দেয়। কলকাতায় এসব চলে না। কলকাতায় থাকার সময় সত্যেন অতি ছিমছাম ভদ্রলোক, কিন্তু দেওঘরে এসে তিনি প্রাক্তন নারায়ণগঞ্জের বাড়ির প্রথা চালাতে চান।
আজ সত্যেন উদারভাবে বললেন, নিরু, আমায় গায়ে তেল মাখিয়ে দাও তো!
পুরুষদের স্নানের দৃশ্য বুলার পছন্দ হয় না, তিনি উপরে উঠে যাচ্ছিলেন, সত্যেন বললেন, বড়গিন্নি, দাঁড়াও না, তোমার সঙ্গে তো ভালো করে কথাই হলো না!
বুলা বললেন, না, যাই, দেখি বাপ্পাটা চান করলো কি না। ও তো সহজে চান করতেই চায় না!
দোতলায় এসে বুলা দেখলেন, বারান্দায় একটা আয়না টানিয়ে বাপ্পা একটা শেভিংসেট খুলে দাড়ি কামাতে শুরু করেছে। গায়ের কোটটা সে খুলেছে অবশ্য, কিন্তু জুতোমোজা এখনো ছাড়েনি।
হঠাৎ বুলার হাসি পেল। বাপ্পাকে তিনি আগে কখনো দাড়ি কামাতে দেখেননি। কবে ওর দাড়ি হলো? বছর চারেক আগেও তিনি বাপ্পাকে জোর করে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে দিয়েছেন। সাবান মাখতে ওর খুব আপত্তি, বুলা ওর মুখে সাবান দিলেই চেঁচিয়ে উঠতো, চোখ। জ্বালা করছে, চোখ জ্বালা করছে। মা, ছেড়ে দাও!
সেই ছেলে এখন দাড়ি কামাচ্ছে নিজে নিজে। পাশ থেকে ওকে অবিকল নরেনের মতন দেখায়।
বুলা জিজ্ঞেস করলেন, তুই কবে থেকে শুরু করলি রে, বাপ্পা? কে তোকে শেখালো? বাপ্পা মুখ ফিরিয়ে বললো, এই নিয়ে থার্ড বার। নিজে নিজে শিখেছি। আচ্ছা মা, কাকামণি ওরকম খালিগায়ে চান করে কেন?
–তোদের বিলেতের লোকেরা বুঝি জামা কাপড় পরে চান করে?
–আই মিন, হোয়াই ডাজনট হি ইউজ দা বাথরুম!
–তুই বুঝি আমার সঙ্গেও ইংরিজি বলা প্র্যাকটিস করছিস?
–মা, তুমি ম্যাট্রিকুলেশনে পাশ করেছিলে, তোমার ইংরিজি বোঝা উচিত।
–সে কবেকার কথা, এখন কি আর মনে আছে? তাছাড়া, বুঝি বা না বুঝি, বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতে নেই।
–বাবা, আমার বাবা কি বাংলা বুঝতে পারে?
–বিলেতে গিয়ে তুই-ও বুঝি বাংলা ভুলে যাবি? আমাকেও ভুলে যাবি?
–ভ্যাট! পড়াশুনো শেষ করার পর হোয়েন আই উইল গেট আ জব, তখন আমি তোমাকেও নিয়ে যাবো ইংল্যান্ডে।
একটা তোয়ালে নিয়ে বাপ্পার মুখটা মুছে দিতে দিতে বুলা বললেন, আমি মরতে ও দেশে গেছি আর কি! লেখাপড়া শেষ হলেই তুই ফিরে আসবি এ দেশে। সেই কথা না দিলে আমি, তোকে যেতেই দেবো না!
বাপ্পা দৃঢ়ভাবে বললো, অফ কোর্স আমি ফিরে আসবো। তুমি কি ভেবেছো, আমি ও-দেশে সেটুল করবো? কক্ষনো না!
–এই তো লক্ষ্মী ছেলে, চল বাপ্পা, এইবার চান করে নিবি!
সঙ্গে সঙ্গে বাপ্পা তিন-চার বছর আগেকার কিশোর হয়ে গিয়ে কাকুতিভরা গলায় বললো, মা, প্লীজ, আজ চান করবো না। আজ ছেড়ে দাও!
–ও কি, এতখানি রেলের রাস্তা এলি, চান করবি না,? তোর গায়ের গন্ধে যে ভূত পালাবে?
–এখন না, তা হলে বিকেলবেলা।
আগেকার দিনের মতন বুলা ছেলেকে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন বাথরুমে। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর বুলা একটুখানি শুয়েছেন, বাপ্পা গেছে কোথায় টো-টো করে ঘুরতে, নিরু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্নান গলায় বললো, একটা পান!
বুলা বললেন, তুমি পান খাবে? সাজতে জানো তো? ঐ যে মীটসেফের মধ্যে পানের বাটা : আছে, তুমি সেজে নাও। নিরু বললো, কিসের মধ্যে আছে?
–মীটসেফ।
–সেটা কী?
এই তারের জাল ও কাঠের তৈরি জিনিসগুলি অতি সাধারণ, প্রত্যেক বাড়িতেই থাকে, নিরু সেটাও চেনে না! বুলা উঠে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ঐ যে ছোট আলমারির মতন দেখছো, ওটা খোলো, নিজে সেজে নাও।
নিরু বললো, আমার জন্য নয়, উনি পান চেয়েছেন!
বুলার এবার মনে পড়লো যে খাওয়ার পর সত্যেনকে একটি পান সেজে দেওয়া তাঁর নিজের দায়িত্বের মধ্যেই ছিল। সত্যেন কলকাতা থেকে আসবার সময় প্রত্যেকবার ভালো পান নিয়ে আসেন। বুলা নিজের হাতে তাকে পান সেজে দেন।
এবারে বুলা সেটা ভুলে গেছেন। সত্যেনের ঐভাবে খালি গায়ে উঠোনে বসে নিরুকে দিয়ে তেল মাখানোর ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ হয়নি। সত্যেন আগে এরকম ছিলেন না, দিন দিন তাঁর স্বভাবে কিছু কিছু কর্কশ দিক ফুটে বেরুচ্ছে।
নিরুর হাতের সাজা পান হয়তো সত্যেনের মনোমতন হবে না, তাই বুলা নিজেই খাট থেকে নেমে এসে দুটি পান সেজে দিলেন।
একটু পরেই নিরু ফিরে এসে বললেন, উনি আমার হাতের পান খাবেন না। আপনেরে দিতে বললেন।
বুলা আবার নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। হাতে করে পান পাঠানোটা ঠিক হয়নি। কাঁসার রেকাবিতে সাজিয়ে, সঙ্গে কিছু মশলা, চুন আর বোঁটা দিয়ে পরিপাটি করে দেওয়া উচিত ছিল।
বুলা এবারে সেরকমভাবেই সাজিয়ে বললেন, এবার নিয়ে যাও!
নিরু স্নানভাবে বললেন, আপনেরে যেতে বলছেন। রাগ করতেছেন আমার ওপর।
বুলা একটু বিরক্ত হলেন। সত্যেনের কোনোরকম বিসদৃশ অভিপ্রায় মানতে তিনি বাধ্য নন, এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন অনেকবার। পান পাঠাবার যখন তোক আছে, তখন বুলাকে যেতে হবে কেন?
কিন্তু নিরুর সামনে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা, চলো!
সত্যেন, তাঁর নিজের ঘরের খাটে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বুলাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ভাত খাওয়ার পর তোমার হাতের সাজা পান পাইনি, তাই সিগারেটেও স্বাদ পাচ্ছি না! এসো বড়গিন্নি, একটুখানি বসো এখানে।
এই বড়গিন্নি ডাকটাও বুলার কাছে অরুচিকর লাগে, কিন্তু সত্যেন কিছুতেই তাঁকে বৌদি বলবেন না। বুলার নাম ধরে ডাকলেও বুলার আপত্তি ছিল না।
বুলা বললেন, এখন বসবো না। ট্রেন জার্নি করে এসেছেন, ঘুমিয়ে নিন, বিকেলবেলা কথা হবে।
–বসো না। আমার ঘুম পায়নি। বাপ্পার সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে না?
নিরু দাঁড়িয়ে আছে চৌকাঠের ওপারে, সত্যেন তার দিকে ভুরুর ইসারা করে বললেন, তুমি এখন যাও!
নিরু চলে যাবার পর সত্যেন সকৌতুক মুখ ভঙ্গি করে বললেন, স্পাই! বুঝলে বড়গিন্নি, বিভা ওকে স্পাই হিসেবে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছে।
বুলা ভুরু কুঁচকে বললেন, ছিঃ, বিভা সম্পর্কে ওরুমভাবে বলছেন কেন? মেয়েটির সব কথা শুনলুমু, বেশ ভালো মেয়ে। সরল।
–তুমিও সরল, কিছু বুঝতে পারো না। বিভা তোমাকে সন্দেহ করে। আমি এখানে এলেই বিভা মনে করে আমি তোমার সঙ্গে ইয়ে করতে আসছি!
অকারণে হা-হা করে হেসে উঠলেন সত্যেন।
সত্যেনের কথাটা হয়তো একবারে মিথ্যে নয়। বুলা সম্পর্কে বিভার বিদ্বেষ দিন দিন বাড়ছে। তার স্পষ্ট কোনো কারণ নেই। বুলা অনেক চেষ্টা করেছেন বিভার মন পাবার, কিছু কাজ হয়নি। বিভার চোখের আড়ালে থাকার জন্যই তো বুলা চলে এসেছেন এখানে।
হাসি থামিয়ে সত্যেন বললেন, হায় রে, তুমি যে আমাকে পাত্তাই দাও না, তা বিভা কিছুতেই বুঝবে না। তোমায় আমি কত তোষামোদ করি, তবু তোমার মন পাই না।
বুলা বললেন, আমার বোধ হয় মন বলে কিছু নেই।
–আছে, আছে, বড়গিন্নি, আমি সব টের পাই। তোমার মন বাঁধা আছে অন্য জায়গায়। আমি যখন এখানে থাকি না, তখন প্রতাপ মজুমদার নামে সেই লোকটা প্রায়ই দেখা করতে আসে তোমার কাছে।
–তার মানে?
–আমি কীরকম খবর রাখি বলো?
হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠলো ক্রোধ। সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেল তার শিখা। এমন রাগ বুলার বহু দিন হয়নি। বুলা মুখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে যেন কিছু খুঁজতে লাগলেন। কোনো ভারি জিনিস দিয়ে তিনি যেন সত্যেনের মুখে আঘাত করে চিরকালের মতন তার বাকশক্তি শেষ করে দিতে চান।
সত্যেনের অনুপস্থিতিতে প্রতাপদা একবারই মাত্র এসেছিলেন এ বাড়িতে, মাস তিনেক আগে, বিশ্বনাথ গুহ’র সঙ্গে। বিশেষ কিছুই কথা হয়নি। প্রতাপদা সম্পর্কে অনেক কিছু কথা জমে আছে তাঁর বুকের মধ্যে, কিন্তু দেখা হলেই কীরকম যেন জিভ আটকে যায়। কিছুতেই কিছু বলা হয় না। প্রতাপদাও চুপ করে থাকেন। সেদিন এসে বিশ্বনাথ গুহই বকবক করেছেন, প্রতাপদা বসেছিলেন শুকনো মুখে। প্রতাপদার শরীর খারাপ কি না সে কথা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পারেননি বুলা। সারা জীবনে হয়তো কোনোদিনই আর প্রতাপদার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যাবে না।
সেই প্রতাপদা সম্পর্কে এরকম অপবাদ?
বুলা তাঁর ক্রোধের দাহ শুধু নিজের শরীরেই রেখে বললেন, ছিঃ!
বুলা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সত্যেন বলে উঠলেন, আচ্ছা, পরে আবার কথা হবে। তুমি একটু নিরুকে পাঠিয়ে দাও তো, বড়গিন্নি। গা-হাত-পায় বড় ব্যথা হয়েছে, নিরু একটু টিপে দেবে!