মোটর বাইকের গর্জনে পাড়া কাঁপিয়ে সকালবেলা উপস্থিত হলো আলতাফ। দরজার সামনে সে গলা খুলে ডাকলো, মামুন ভাই! মামুন ভাই!
সদরে কলিং বেল আছে, আলতাফের তা মনে থাকে না, প্রত্যেকবারই এসে সে ঐ রকম। হাঁক পাড়ে। একটুক্ষণও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা তার স্বভাবে নেই, সব সময়েই সে জীবনী শক্তিতে টগবগ করছে। আলতাফ এলেই আশপাশের বাড়ির জানলা খুলে যায়, অন্তঃপুরিকারা লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখে। দেখবার মতনই চেহারা তার। ছ’ ফুটের মতন লম্বা, মাথায় বাবড়ি চুল, এমন চওড়া কাঁধ ও শক্ত কবজীওয়ালা পুরুষ বাঙালীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় না। গায়ের রংও পরিষ্কার। তার পোশাকের আড়ম্বর আছে, ঢাকার শীত এমন কিছু বেশি নয়, তবু সে পরেছে একটা জমকালো উইন্ডচিটার। তাকে যেন মিলিটারির সেনাপতি হিসেবেই মানাতো। অবশ্য তার চোখে-মুখে এখনো যেন রয়ে গেছে কৈশোরের সারল্য।
সকালবেলা এ বাড়ির আবহাওয়া বড় গুমোট ছিল, আলতাফ এসে পড়ায় মামুন খুশীই হলেন।
শহীদ, পলাশ, নাদেরারা আজ ভোরেই এসে বিদায় নিয়ে গেছে, ওরা ফিরে যাচ্ছে কলকাতায়। তারপর থেকেই মঞ্জুর কী কান্না! তাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। অবুঝের মতন সে বারবার বলছে যে সেও কলকাতায় যাবে।
আলম সাহেব আর মালিহা বেগম দু’জনেই বেশ বিরক্ত হয়েছেন মঞ্জুর ওপর। মেয়েকে তাঁরা খুবই ভালবাসেন, কিন্তু মেয়ের এ কী বেহায়াপনা! প্রথমে সস্নেহ ভর্ৎসনা, তারপর মৃদু তিরস্কার, তারপর রীতিমতন বকুনি বর্ষিত হচ্ছে মঞ্জুর ওপর। খোসমেজাজী আলম সাহেব পর্যন্ত একসময় কটুভাবে বলে ফেললেন, লাই দিলেই মাথায় ওঠে। এইজন্যেই বাপ-দাদারা মাইয়া মানুষদের কড়া শাসনে রাখতেন!
মামুন দু’দিকেই সামলাবার চেষ্টা করছিলেন। মঞ্জুর কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনোর জন্য বায়না ধরা তাঁরও পছন্দ হয়নি, কিন্তু মঞ্জুর তরুণী হৃদয় অন্য যে কারণে উদ্বেল হয়ে উঠেছে সেটা তিনি বোঝেন। এ দেশের মেয়েদের সারা জীবনই কাঁদতে হয়। তবে কোনো কোনো বিশেষ কারণের জন্য কান্না লুকিয়ে রাখতে হয় অন্যদের কাছ থেকে, সে দুঃখ শুধু নিজের, চোখে জল আসে বিরলে, নিরালায়। মঞ্জু এখনও বড় ছেলেমানুষ রয়ে গেছে, কান্না লুকোতে শেখেনি।
শহীদের সঙ্গে মঞ্জুর বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি উত্থাপন না করা হলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। শহীদ বুদ্ধিমান ছেলে, সে বুঝতে পেরেও উৎসাহ দেখায়নি। কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এসে থাকার তার একটুও ইচ্ছে নেই। কলকাতায় তাদের বড় ব্যবসা, উত্তর বাংলায় জলপাইগুড়ি জেলায় তাদের চা বাগানের সম্পত্তি আছে, সেসব ছেড়ে আসার প্রশ্নই ওঠে না। ঢাকা শহরটি সুন্দর হলেও কলকাতার তুলনায় মফঃস্বল মনে হয় তার কাছে। অবশ্য মঞ্জু যদি কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনো করতে চায়, তাহলে সে সবরকম সাহায্য করতে রাজি আছে।
মালিহা বেগম আগে থেকেই জেদ ধরে আছেন যে মেয়ের বিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে আর কোথাও দেবেন না, এমনকি লন্ডনের পাত্র পেলেও না।
সুতরাং বিয়ের প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেছে। একা একা এত বড় মেয়েকে কলকাতায় পড়তে পাঠাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
ওরা যখন বিদায় নেয়, তখন মঞ্জু শহীদের বদলে পলাশের সামনে দাঁড়িয়েই প্রথম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। পলাশেরও ছলছল করে উঠেছিল চোখ। মামুন সে দৃশ্য দেখেছেন, কিন্তু তার কোনো অন্য অর্থ তিনি মাথায় আনতে চান না।
একসময় মঞ্জুর মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বলেছিলেন, তুই কাঁদিস না, মামণি, তোরে আমি কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে যাবো। আমি কথা দিতেছি।
মঞ্জু তাতেও প্রবোধ মানেনি।
আলতাফ এসে যখন বৈঠকখানায় ঢুকলো, তখনও মঞ্জু হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। আলতাফকে দেখে সে ঝড়ের মতন ছুটে বেরিয়ে গেল।
আলতাফ ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্মিত চোখে মঞ্জুকে দেখলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ঐ মেয়েটির চক্ষু লাল, কেউ বকেছে বুঝি? কী হয়েছে?
মামুন বললেন, এমন কিছু হয় নাই। মেয়েলি ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।
আলতাফ তবু ভুরু কুঁচকে রইলো একটুক্ষণ। আপন মনেই বললো, মানুষ যে অন্যকে কেন কাঁদায়? অন্যকে কষ্ট দিয়ে কী যে আনন্দ পায় মানুষ!
মামুন বললেন, বসো আলতাফ। তারপর খবর-টবর কী?
আলতাফ ঝপাস করে একটা চেয়ারে বসে বললো, আমার একটা মত কী জানেন। মামুন-ভাই, যে-সব বাপ-মায়েরা ছেলেমেয়েদের বেশি বকাবকি করে, সরকারের উচিত তাদের ফাইন করা!
মামুন কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললেন, এদেশের সরকার তো আমাদের জান্ মালের সব ক্ষমতাই নিয়ে রেখেছে, এরপর কি চাও, সরকার আমাদের পরিবারের মধ্যে এসেও মাথা গলাবে!
আলতাফের গায়ে যেন বিছুটি লেগেছে, এইভাবে ছটফটিয়ে উঠে সে বললো, না না, না, এই সরকার না, এই সরকার না! ভবিষ্যতে যখন আমাদের নিজেদের আদর্শ সরকার গড়া হবে, তখনকার কথা বলছি। তা এই মেয়েটি কাঁদছিল কেন বলেন না! কী হয়েছে?
–আরে, তোমার এত কৌতূহল কেন? ওর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে কিনা। তুমি তো আগেই বিয়ে করে বসে আছো, নইলে তোমার মতন পাত্র পেলে আমরা এক্ষুনি বিয়ে দিতাম!
আলতাফ লজ্জা পেয়ে বললো, হায় আল্লা, আমি ছাড়া কি আর পাত্র নাই? আমার ছোট ভাইটাই তো রয়েছে, সে ল্যাখাপড়ায় আমার থেকে চার গুণ ভালো! যদি বলেন তো সম্বন্ধ। করতে পারি।
–এখন কয়েকটা দিন যাক! পরে আমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করবো। এখন কাজের কথা বলো!
–আপনি তৈরি তো মামুনভাই? আজ দুপুরেই আমরা টাঙ্গাইল রওনা হবো।
–আজ দুপুরেই? এত তাড়াতাড়ি কিসের?
–পর্শু থেকে কনফারেন্স আরম্ভ! আপনি আমার সঙ্গে মোটর সাইকেলে যাবেন!
–মোটর সাইকেলে? না বাপু, সে আমি পারবো না!
–চিন্তা করবেন না, মামুনভাই। দেখবেন, একেবারে পক্ষীরাজের মতন উড়ায়ে নিয়ে যাবো আপনাকে।
–কিন্তু আমার মেয়েটাও যে আমার সঙ্গে যাবে!
–তাকেও নিয়ে নেবো সামনে বসিয়ে। অসুবিধা কিছু নাই! মামুন তবু রাজি হলেন না। মোটর সাইকেলে যেতে যে তিনি ভয় পান তা নয়। তাঁর সঙ্গে যারা একসঙ্গে রাজনীতিতে নেমেছিল, তারা অনেকেই এখন মাঝারি শ্রেণীর নেতা হয়ে পার্টির জিপ গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। অনেকের নিজস্ব গাড়ি হয়েছে। মামুনের সেসবের প্রতি লোভ নেই বটে, কিন্তু তাহলেও একজন সাধারণ পার্টি কর্মীর মোটর সাইকেলের পেছনে চেপে তিনি যেতে পারবেন না। তিনি নিজের পয়সায় বাসে চেপে যাবেন। আজ নয়, আগামীকাল।
আলতাফ বেশ নিরাশ হলো মামুনের কথা শুনে। সে মামুনকে নিয়ে যাবার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে চলে এসেছে।
মামুন বললেন, মওলানা ভাসানী তো মস্ত বড় সম্মেলন করছেন শুনতে পেলাম। ইত্তেফাক কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে। দেশে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। কত মানুষ মরছে অনাহারে, এই সময় এত জাঁকজমক করা কি ভালো?
আলতাফ বললো, প্রয়েজন আছে। প্রয়োজন আছে। আপনি গেলেই বুঝবেন। আমাদের দলের যে কতখানি শক্তি তা পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যাটাদের দেখানো দরকার!
মামুন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আলতাফ, তুমি যে বললে ভবিষ্যতে তোমাদের নিজেদের সরকার গড়া হবে, কেন, এখনই তো তোমাদের দল পাওয়ারে এসেছে।
আলতাফ অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, ফুঃ! নির্বাচন হলো না, প্রেসিডেন্টের ধামাধরা সরকার গড়া হলো, ওরা… মাফ করবেন মামুনভাই, একটা খারাপ কথা মুখে এসে যাচ্ছিল!
মামুন ঈষৎ ব্যঙ্গের সঙ্গে বললেন, তোমার মনের ভাবটা তো বুঝতে পারছি না। তুমি আওয়ামী লীগের জন্য এত খাটছো, এখন তো তোমার আহ্লাদে থাকার কথা। তোমাদের নেতা সোহরাওয়ার্দি সাহেব এখন কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিত্ব করছে, ফজলুল হক সাহেব গভর্নর। বাঙালীদের তো এখন জয়জয়কার। এমনকি প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীজা, সেও নাকি বাঙালী, এতদিন সেকথা জানতাম না, হক সাহেব তাকে বাঙালী বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। ওঁর শরীরে নাকি রয়েল ব্লাড আছে!
–ব্যাটা মীরজাফরের বংশধর! শোনেন মামুন ভাই, এই জোড়াতালি দেওয়া সরকার নিয়ে কোনো কাজের কাজ হয় না। প্রেসিডেন্টের বদখেয়াল হলে একটা লাথথি মেরে এই সরকার উল্টে দেবে। আমরা কি স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার এখনো পেয়েছি?
–আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সম্মেলন ডেকে কোন্ মুখে এখন সরকারের সমালোচনা করবেন? নিজেদেরই তো–
–সরকার আর পার্টি কি এক? শেখ মুজিবর রহমান তাড়াহুড়ো করে এই সরকার মেনে নিলেন। আমি আপনাকে বলে রাখছি, মিলিয়ে নেবেন, এ সরকারের আয়ু আর বেশিদিন নাই!
মামুন এক দৃষ্টিতে আলতাফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপর বললেন, কয়েকদিন আগে তোমার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম, ঐ যিনি হোটেলের ব্যবসা করেন। তোমার ওপর তাঁর খুব রাগ দেখলাম। তাঁর ধারণা, তুমি কমুনিস্ট। এখন মনে হচ্ছে, তাঁর ধারণাটা বোধহয় খুব ভুল নয়।
আলতাফ সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে হেসে উঠে বললো, আরে, ওর কথা বাদ দেন। ও শুধু টাকা দিয়ে মানুষকে চেনে।
মামুন বললেন, বামপন্থীরা এখন মওলানা ভাসানীর চার পাশে এসে ভিড়ছে, এ তো আমিও বুঝতে পারছি। কেন বলো তো?
প্রয়োজনে প্রগতিশীল কিংবা বামপন্থীদেরও জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়। এটা তো খুব স্বাভাবিক, তাই না? মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী এইসব প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে এখন আমাদের এককাট্টা হয়ে লড়তে হবে। এটাই তো সঠিক স্ট্র্যাটেজি!
হঠাৎ কিছু যেন কাজের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় আলতাফ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি তাহলে আজ যাচ্ছেন না? আমি এখন চলি। কাল সকালে বাস স্ট্যান্ডে দেখা হবে। আপনাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আমি রওনা হবো!
পরদিনও আলতাফ এক অদ্ভুত কাণ্ড করলো। মামুনদের বাসে তুলে দিল বটে কিন্তু সঙ্গ ছাড়লো না। মোটর সাইকেলে সে অনেক আগেই পৌঁছে যেতে পারতো, কিন্তু সে প্রায় চলতে লাগলো বাসের সঙ্গে সঙ্গে। মাঝে মাঝে সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার হঠাৎ সে চলন্ত বাসের পাশাপাশি চলে এসে হাত নাড়ে। যেন সে মামুনের বডি গার্ড।
মামুনের মেয়ে হেনা এতে বেশ মজা পাচ্ছে। জানলা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে সে আলতাফকে দেখার চেষ্টা করে, দেখতে পেলেই হেসে ওঠে খলখলিয়ে। বাচ্চাদের সঙ্গে বেশ সহজে ভাব জমাতে পারে আলতাফ, হেনাকে আনন্দ দেবার জন্য নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে সে।
মঞ্জুকেও সঙ্গে এনেছেন মামুন। বাড়িতে থাকলে সে মা বাবার কাছে আরও বকুনি খেত, কয়েকদিন বাইরে ঘুরে এলে তার মন ভাল হতে পারে। অসুবিধের কিছু নেই, টাঙ্গাইল শহরে আলম সাহেবের নিজের বাড়ি আছে, তাঁর এক চাচা সপরিবারে থাকেন সেখানে।
প্রথম প্রথম মঞ্জু মুখ ভার করেছিল। আলতাফের কাণ্ডকারখানা দেখে সেও না হেসে পারলো না। আলতাফের মাথায় আজ একটা টুপি, তাতে সে একটা কচুরিপানার ফুল গুঁজেছে।
মাঝপথে ধামরাইতে বাস থামতেই আলতাফ বললো, নেমে আসেন মামুনভাই, এখানে একটু চা খাওয়া যাক।
মঞ্জু বসে রইলো নিজের সীটে। মামুন হেনাকে নিয়ে নামলেন। আলতাফ আগে থেকেই চায়ের অর্ডার দিয়ে রেখেছে। এক কাপ চা ও দুটি বিস্কুট নিয়ে আলতাফ বাসের জানলার কাছে গিয়ে মঞ্জুকে বললো, এই নাও! তুমি কাঁদছিলে কেন গতকাল?
মঞ্জু কোনো উত্তর দিল না।
আলতাফ বললো, মেয়েরা কি শুধু কাঁদতে জানে, আর কিছু পারে না? তুমি নেমে এসো, তোমার সাথে আমার কথা আছে!
আলতাফের ব্যবহারে আর একবার মুগ্ধ হলেন মামুন। এই বয়েসী কোনো যুবককে কোনো অচেনা সদ্য যুবতীর সঙ্গে এমন সহজ সাবলীল ভাবে কথা বলতে তিনি আগে দেখেননি। তিনি বললেন, বাস এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে, তুই নেমে আয় মঞ্জু।
মঞ্জু আস্তে আস্তে নেমে এসে মুখ নিচু করে দাঁড়ালো। সে পরে আছে একটা আকাশী নীল শাড়ী। তার ওপর একটি লাল কল্কা দেওয়া সাদা শাল। ঈষৎ বিষাদাচ্ছন্ন মুখোনি তার এখন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।
আলতাফ জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী?
মঞ্জু মুখ নিচু করেই নীরব রইলো, মামুন বললেন, ওর ভালো নাম বিলকিস, ডাক নাম মঞ্জু।
আলতাফ বললো, ও বুঝি শুধু কাঁদতে জানে, কথা বলতে পারে না?
তারপর সে হেনার গাল টিপে বললো, কী রে হেনা, তোর এই আপাটা বুঝি বোবা?
হেনা বললো, না, বোবা না, ভাল গান করে!
–কথা বলে না, শুধু গান করে?
আলতাফ নাছোড়বান্দা, মঞ্জুকে শেষ পর্যন্ত কথা বলতেই হলো। চাও খেল।
আলতাফ বললো, তুমি গান করো, তুমি এই কনফারেন্সের সংস্কৃতি উৎসবে গান গাইবে?
অনেক জায়গা থেকে আর্টিস্ট আসছে, কলকাতা থেকেও আসছে। বলো, তা হলে ব্যবস্থা করে দিই!
মঞ্জু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, না, না, না, আমি গান গাইতে পারবো না।
–তুমি তা হলে ভলান্টিয়ার হও। আমাদের মেয়ে ভলান্টিয়ার দরকার।
–আমি যে ওসব কিছুই জানি না।
–তোমাকে শিখিয়ে দেওয়া হবে।
মামুন বললেন, হ্যাঁ, ওকে নিয়ে যাবো কনফারেন্সে। ও গানবাজনা ভালবাসে, সেসব তো শুনতে পারবে।
বাসের ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়েছে, আবার উঠে পড়লেন মামুনরা।
টাঙ্গাইলে পৌঁছে মামুনকে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়তে হলো। হেনাকে আর মঞ্জুকে তিনি পৌঁছে দিলেন আলম সাহেবের বাড়িতে, তারপর আলতাফের সঙ্গে তিনি চলে এলেন পার্টি অফিসে।
সমস্ত জেলা থেকে এসেছে ডেলিগেট, মামুনের অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কনফারেন্সের সাফল্য নিয়ে সকলের মধ্যেই একটা উত্তেজনার ভাব। মওলানা যে সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন, তার প্রধান আলোচ্য বিষয় দুটি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন।
দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। নতুন সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের এই দাবির স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি। এই দাবি আদায়ের জন্য জোরদার আন্দোলন দরকার ঠিকই। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি বদলের প্রসঙ্গ এখানে তোলা কি সমীচীন হবে? মার্কিন সামরিক জোটের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে পাকিস্তান, মওলানা ভাসানী এর ঘোর বিরোধী। তিনি চান পাকিস্তান ঐ সামরিক জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসুক, আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল কর্মীরা তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু এই আওয়ামী লীগেরই নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দি এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তিনি যে মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন, সেই মঞ্চ থেকেই সরকারি পররাষ্ট্র নীতির বিরোধিতা করা যায় কী?
বিভিন্ন অঞ্চলের নেতা ও ডেলিগেটদের সঙ্গে কথা বলে মামুন বুঝতে পারলেন, এর মধ্যেই এই দুটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ দেখা দিয়েছে। তর্কাতর্কিতে মাঝে মাঝেই কণ্ঠস্বর উঠে যাচ্ছে উচ্চগ্রামে।
ইত্তেফাক পত্রিকার বিশালদেহী সম্পাদক মানিক মিঞা বাইরের পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কয়েকজনের সঙ্গে। মানিক মিঞা যখন দেশ বিভাগের আগে কলকাতায় মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি ছিলেন, সেই সময় থেকে মামুন তাঁকে চেনেন। তাঁর মতন অনেকেই এখন মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। মানিক মিঞার সঙ্গে দুটো কথা বলার জন্য মামুন এগিয়ে যেতেই তাঁর বরিশালের বন্ধু বদ্রু শেখ তাঁর হাত ধরে টেনে বললেন, আরে মামুন যে! এতদিন কোথায় ডুব মেরে ছিলে?
এই কয়েক বছরে মামুনের চেহারার বিশেষ পরিবর্তন না হলেও বঢু শেখের বপু অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছ। আগে তাঁর মুখে ছিল দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, এখন পরিষ্কার করে কামানো। আগে তার পোশাক ছিল কুর্তা পাজামা, এখন প্যান্ট-কোট। চিনতে মামুনেরই অসুবিধে হলো প্রথমে।
কুশল বিনিময়ের পর পরস্পরের বর্তমান অবস্থার খবরাখবর জানাজানি হলো। মামুন কিছুই করেন না শুনে খুব আশ্চর্য হলেন বদ্রু শেখ। তিনি এক সময় হোল টাইম রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। এখন ব্যবসা করছেন। তাঁর হাসি খুশী ভাব দেখে মনে হলো, ব্যবসা বেশ ভালই চলছে!
দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে এসে বসলেন আদালত প্রাঙ্গণে এক চায়ের দোকানে। সন্ধে হয়ে এসেছে, শীত পড়ছে জাঁকিয়ে। আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বুনো হাঁসের ঝাঁক। পথে পথে সেরকমই অচেনা মানুষের স্রোত। এই ছোট শহরটিতে হঠাৎ বিপুল জনসমাগম হয়েছে।
খানিকক্ষণ পুরোনো কালের সুখ দুঃখের গল্প হল। পটুয়াখালিতে বন্দুদের বাড়িতে বেশ কয়েক মাস কাটিয়েছেন মামুন, বদ্রর মা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর হাতে তৈরি পাটিসাপ্টা পিঠের স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে আছে। বদ্রুদের বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না, তবু তারই মধ্যে সব দিক গুছিয়ে কী সুন্দর রান্না করে খাওয়াতেন তিনি।
এক সময় বদ্রু শেখ জিজ্ঞেস করলেন, কী মামুন, এখানে এসে কী রকম বুঝছো? মামুন বললেন, আমি তো ভাই একটু হকচকিয়ে গেছি। শুনেছিলাম তো সবাইকে একসঙ্গে মেলাবার জন্য ডাকা হয়েছে এই সম্মেলন। কিন্তু এসে দেখছি অনেক দলাদলি। কেউ বলছে এক্ষুনি নিবাচন চাই। কেউ বলছে, এখন আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা, এখন নির্বাচনের দরকার কী?
বদ্রু বললো, দেখোই না আরও কত কী হয়! পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নেই ফাটাফাটি হবে। সোহরাওয়ার্দি মার্কিন জোট ছাড়তে চান না, মওলানা ভাসানী তাঁকে যতই ধমকান তাতে কোনো কাজ হবে না।
–আমিও তো তাই বুঝছি!
তুমি আর একটা কথা শোনোনি? প্রধানমন্ত্রী হবার পরই সোহরাওয়ার্দি সাহেব বলতে শুরু করেছেন যে আমাদের স্বায়ত্ত শাসনের দাবিও তো আটানব্বই ভাগই মেনে নেওয়া হয়েছে।
–সে কি? আমরা কী পেয়েছি?
হে হে হে হে! ক্ষমতায় গেলে সবারই সুর পালটে যায়। সোহরাওয়ার্দি সাহেব প্রাদেশিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে সর্ব পাকিস্তান রাজনীতির চূড়ায় উঠতে চেয়েছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি ভাবলেন সব পাওয়া হয়ে গেল। এখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতের পুতুল হয়ে নাচছেন। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে গাইছেন। শতকরা আটানব্বই ভাগ পাওয়া হয়ে গেছে, আর কী চাই!
আমি তো কিছুই বুঝতে পরছি না, বদু। এই সম্মেলনে তা হলে কী প্রস্তাব নেবো আমরা?
আমার তো ধারণা, কাল একটা মস্তবড় নাটকীয় কিছু ঘটবে! বুড়ো ভাসানী ভেলকি দেখাবে! তুমি শেখ মুজিবকে চেনো?
ভাষা আন্দোলনের সময় পরিচয় হয়েছিল। সে তো স্বায়ত্ত শাসনের একজন জোরালো দাবিদার ছিল।
দেখো, এখন সেও সুর পালটাবে! সেও ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে তো, তাই সে সোহরাওয়ার্দির দিকেই বেশি ঝুঁকেছে।
আমি তো জানতাম সে মওলানা ভাসানীর ভাবশিষ্য। তাঁর কাছ থেকেই সে রাজনীতি শিখেছে।
সে তো মাঠে-ঘাটের রাজনীতি। এখন উনি শ্রেণী বদল করছেন। একটু হেসে বদ্রু শেখ বললেন, আমিও অবশ্য সোহ্রাওয়ার্দি সাহেবের পক্ষেই আছি এখন। কেন জানো? করাচীর তখতে বসে উনি ব্যবসায়ী শ্রেণীকে মদত্ দিচ্ছেন, আমরাও তো তার ছিটেফোঁটা কিছু পাবো!
এই সময় আলতাফ সঙ্গে অন্য একটি ছেলেকে নিয়ে হাজির হলো সেখানে। সে বললো, মামুন ভাই, আপনি কখন গায়েব হয়ে গেলেন? আমি খুঁজে খুঁজে মরছি আপনাকে। ভারত থেকে অনেক কবি সাহিত্যিক এসেছেন কালচারাল ডেলিগেশানে। তাদের সঙ্গে আলাপ করবেন না?
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, কে কে এসেছেন?
আলতাফ বললো, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল আরও জানি কে কে। সবার নাম জানি না। আপনি নিশ্চয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন, আমার সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দেবেন?
তারাশঙ্করবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি কখনো। তবে আমাদের কম বন্ধু আছে। তোমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ আসেন নি? তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল একবার।
জীবনানন্দ দাশ মারা গেছেন আপনি জানেন না? এক বছর হয়ে গেল!
সে কি! শুনিনি তো! বেশি বয়েস তো হয় নাই তাঁর।
কলকাতায় ট্রামে চাপা পড়েছেন। আপনার কলকাতার শহরটা কী, একজন কবিকে ট্রাম চাপা দিয়ে মেরে ফেললো?
–আমার কলকাতা শহর, হুঃ!
বদ্রু শেখ বললেন, পাটিশানের সময় কলকাতা শহরটা আমরা পাবো না শুনে তুমি খুব মুষড়ে পড়েছিলে! কলকাতার জন্য আমারও মন-কেমন করে এক এক সময়!
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মামুন আলতাফের পাশের ছেলেটির দিকে তাকালেন। ছেলেটিকে লাজুক বলে মনে হয়, কিন্তু মুখে একটা প্রতিভার দীপ্তি আছে। এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, এ ছেলেটি সাধারণের চেয়ে অন্যরকম।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটি কে?
আলতাফ বললো, এই আমার ছোট ভাই, যার কথা কাল আপনাকে বলেছিলাম, এর নাম বাবুল। সারা দিন রাত দৈত্যের মতন অঙ্ক কষে!
মামুন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা সবাই চলো, আমি যে বাসায় উঠেছি, সেখানে চলো!
পরদিন সকালে মামুন হাঁটা পথেই যাত্রা করলেন কাগমারির দিকে। টাঙ্গাইল শহর থেকে দু মাইল দূরে কাগমারি। সেখানে সন্তোষের রাজাদের বিশাল পরিত্যক্ত প্রাসাদে মওলানা ভাসানী সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। অনেক দূর থেকেই স্থাপন করা হয়েছে একটির পর একটি তোরণ। সেগুলি চমৎকার ভাবে সাজানো।
ফেব্রুয়ারি মাসের সকাল। ঝকঝকে রোদ উঠলেও ফিনফিন করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, পথে অফুরন্ত মানুষ। শুধু পাটি সদস্যরাই নয়, গ্রাম গ্রামান্তর থৈকে দলে দলে মানুষ যাচ্ছে, যেন একটা মেলা দেখতে।
হেনা আর মঞ্জুকে দু’পাশে নিয়েছেন মামুন। আলতাফ কাল রাতেই এখানে চলে এসেছে। তার ভাই বাবুলকে তিনি চোখ দিয়ে খুঁজতে লাগলেন ভিড়ের মধ্যে। কাল অল্প কিছুক্ষণের পরিচয়েই ছেলেটিকে দারুণ পছন্দ হয়ে গেছে তাঁর!
মঞ্জুর মুখের ম্লান ভাবটা আজ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সে উৎসাহের সঙ্গে এক একটি তোরণ দেখে দেখে নাম পড়ছে। বিশ্বের কত বিখ্যাত মানুষের নামে যে তোরণ আর ফেস্টুন সাজানো হয়েছে তার যেন ইয়ত্তা নেই। কায়েদে-এ-আজম, ইকবাল, গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, ফজলুল হক, রবীন্দ্রনাথ, লেনিন, লিঙ্কন, শেক্সপীয়ার, নেতাজী সুভাষ, সূর্য সেন…।কাগমারি সম্মেলনে যেন আওয়ামি লীগ শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, বিশ্বমানবিক ভাব প্রচার করতে চাইছে।
একটু আগে আগে মানিক মিঞা-যাচ্ছেন সদলবলে। মামুন এগিয়ে গেলেন তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। মানিক মিঞার সঙ্গে সম্প্রতি কোনো কোনো ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর মনান্তর হয়েছে। তিনি ভুরু তুলে অনেকখানি বিস্ময়ের সঙ্গে খানিকটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ মিশিয়ে বললেন, কী এলাহী কাণ্ড কারখানা দেখেছেন? কী আলিশান আয়োজন!
মহারাজার বাড়ির কাছাকাছি এক জায়গায় একটা ভাঙা সাইনবোর্ড পড়ে আছে, তাতে লেখা ‘বিধানচন্দ্র গেট’। মামুন জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী ব্যাপার?
মানিক মিঞা বললেন, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের নামেও একটা গেট করা হয়েছিল, পরে পার্টি ওয়াকারদের মধ্যে মতভেদ হওয়ায় সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সম্মেলনের রাজনৈতিক অধিবেশন শুরু হবার পরই মামুন বুঝতে পারলেন, বেসুরো বাজছে। বড় বড় নেতাদের বক্তৃতায় কোনো মিল নেই। ভাসানীপন্থীরা চরম কঠোর ভাষায় আক্রমণ করছেন পাকিস্তানী সরকারি নীতির। আবার সোহরাওয়ার্দির পক্ষ সমর্থন করছেন সরকারি নীতির।
বিরোধ তুঙ্গে পৌঁছালো স্বয়ং মওলানা ভাসানীর বক্তৃতায়। তিনি মেঠো ভাষায় দারুণ কঠিন কঠিন কথা শোনাতে পারেন। অনেক অঙ্গভঙ্গিও করেন।
মার্কিন সমরজোট সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি সোহরাওয়ার্দির দিকে আঙুল দেখিয়ে শোনালেন, ওরা আমাদের ছেলেদের বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে দেবে, তা আমি হতে দেবো না। আমি জান দিয়ে যুদ্ধজোটের বিরোধিতা করবো। কেউ যদি আমাকে দিয়ে জোর করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি মানিয়ে নিতে চান, তাহলে আমি কবরে এক পা দিয়ে চিৎকার করে বলবো, না, না, না, আমি ঐ সর্বনাশা যুদ্ধজোটকে সমর্থন করি না!
অনেকে চিৎকার করে সমর্থন জানালেও, মামুনের পাশে বসা একজন আপন মনে বলে উঠলো, কমুনিস্ট! ভারতের দালাল!
বক্তৃতায় শেষের অংশ আরও সাংঘাতিক। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন তুলে তিনি সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিদেশী শোষকদের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বললেন, যদি পূর্ব বংলায় তোমরা তোমাদের শোষণ চালিয়ে যাও, যদি পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃত না হয়, তা হলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, তোমরা আমাদের কাছ থেকে একটা কথাই শুনে রাখো, ‘আচ্ছালাম আলায়কুম’–তুমি তোমার পথে যাও, আমরা আমাদের পথে যাবো!
আলতাফ লাফিয়ে উঠে পাগলের মতন চিৎকার করতে লাগলো, মার হাব্বা! মার হাব্বা! এই তো চাই! এই তো চাই!
ঘুরে সে মামুনের হাত চেপে ধরে পাগলের মতন জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বললো, শুনলেন, মামুন ভাই, শুনলেন? ফাইন্যাল কথা!
মামুন কিন্তু শিউড়ে উঠেছেন এই সব কথা শুনে। মওলানার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ তো বিচ্ছিন্নতাবাদের জিগির! এতো কষ্টের, এতো সাধের, এতো রক্ত-অশু বর্ষণ করে পাওয়া গেছে যে পাকিস্তান মওলানা তা ভেঙে দিতে চান? মাত্র দশ বছর বয়েস হয়েছে এই নতুন রাষ্ট্রে, অনেক ভুল ভ্রান্তি হতে পারে, কিন্তু তাকে ভেঙে ফেলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
না, মামুন কিছুতেই মওলানার এই চরম পন্থা মেনে নিতে পারবেন না! তিনি আলতাফের। কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলেন।