কানু যে ব্যাঙ্কে কাজ করে, হঠাৎ একদিন সকালে সেই ব্যাঙ্কের বন্ধ দরজা আর খুললো না। সাড়ে দশটা বেজে গেছে, কর্মচারিরা, গ্রাহকেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে সামনে, কিন্তু ম্যানেজারের দেখা নেই। মালিক পক্ষের এক ছেলে এই শাখাটির ম্যানেজার। বড় লোকের ছেলের ঘুম ভাঙতে দেরি হচ্ছে একথা কারুর মনে আসে না। বরং প্রথম থেকেই যে অশুভ সন্দেহটি মনে জাগে, একটু বেলা বাড়তেই তা সমর্থিত হয়। খবর এসে পৌঁছোয় যে সেই ব্যাঙ্কের আরও দুটি শাখারও ঐ একই অবস্থা। অর্থাৎ ব্যাঙ্কটির গণেশ উল্টেছে, মালিকপক্ষ পলাতক।
অনেক লোক সামনের ফুটপাথে বসে পড়লো মাথায় হাত দিয়ে। একজন বৃদ্ধ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলতে লাগলেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল, আমার সর্বস্ব চলে গেল, পরশু আমার মেয়ের বিয়ে। ওরে বাবা, এখন আমি কী করি! আমি ট্রাম লাইনে গলা দেবো! তিনি সত্যিই ছুটে গিয়ে ট্রাম লাইনে শুয়ে পড়তেই কয়েকজন জোর করে তুলে আনলো তাঁকে, আর কয়েকজন চেষ্টা করলো ব্যাঙ্কের লোহার কোলাপসিল গেট ভেঙে ফেলার, তার মধ্যেই এসে পড়লো পুলিশ।
স্বাধীনতার পর পরই ছোটছোটো ব্যাঙ্কগুলিতে মড়ক লেগে যায় যেন। পারিবারিক মালিকানার এই সব ব্যাঙ্ক কোন্ রহস্যময় কারণে যে যখন তখন লালবাতি জ্বালে তা আর জানা যায় না শেষ পর্যন্ত। বাজারে গুজব ছড়ায় নানারকম, কেউ বলে সাধারণ মানুষের জমানো টাকায় মালিকরা ফাটকা খেলে, কেউ কেউ নাকি স্বচক্ষে দেখেছে ব্যাঙ্কের ক্যাশ ভেঙে মালিকের কোনো বখাটে ছেলেকে রেসের মাঠে কাপ্তেনি করতে, কোনো সিনেমার অভিনেত্রী নাকি বিনা অ্যাকাউন্টে যখন তখন টাকা তুলে নিয়ে যায়, ইত্যাদি। সাধারণ মধ্যবিত্তের কল্পনা এর চেয়ে বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছোয় না। অন্তরালের কাহিনী হয়তো এর চেয়ে অনেক বেশি জটিল। ব্যাঙ্কগুলির ওপর সরকারি খবরদারিও শিথিলতার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। এক একটা ব্যাঙ্কের পতন হয় আর অমনি তিন চারটি আত্মহত্যার ঘটনা বেরোয় খবরের কাগজে। তারা কেউ সদ্য অবসরপ্রাপ্ত স্কুল মাস্টার, কেউ ছোট কারখানার মালিক, কেউ বা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। কে কোথায় বসে কিসের কলকাঠি নাড়ছে তা কিছুই না জেনে এই অকস্মাৎ-রিক্ত মানুষগুলো প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে।
কানুর চাকরিটি গেল। প্রতি মাসে মাইনে পেয়ে সে পুরো টাকাটাই তুলে দিত তার দাদার হাতে, প্রতাপ তার থেকে অর্ধেক টাকা ফিরিয়ে দিতেন কানুর হাত খরচের জন্য।
শোনা যায়, বিপদ কখনো একলা আসে না, সব সময় তার একটি বা দুটি সঙ্গী থাকে। কানুর ব্যাঙ্কেই প্রতাপের অ্যাকাউন্ট ছিল, তাতে বেশি টাকা ছিল না অবশ্য, মাত্র সাড়ে চার শো টাকা। সেটা তো গেলই, কিন্তু তার চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার ঐ ব্যাঙ্কেই প্রতাপ তাঁর দিদি সুপ্রীতির গয়নাগুলো জমা রেখেছিলেন।
সংসার খরচের জন্য সুপ্রীতি মাসে মাসেই একটি দুটি গয়না দিতেন প্রতাপকে। এ সম্পর্কে তাঁর মুখের ওপর কোনো কথাই চলতো না। প্রতাপ সে গয়না একটাও বিক্রি করেননি, নানাভাবে উপার্জন বাড়িয়ে ও খরচ কমিয়ে তিনি সংসার চালাচ্ছিলেন, যথাসময়ে সুপ্রীতিকে তাঁর গয়নাগুলি ফেরত দেবার কথা ভেবে রেখেছিলেন। সেই গয়নাগুলিও যে মারা যাবে তা প্রতাপ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। ব্যাঙ্কের তহবিল তছরুপ হতে পারে, ভুল লগ্নীতে সব টাকা জলে যেতে পারে, কিন্তু গ্রাহকদের নিজস্ব লকার-এ রাখা গয়নাগাঁটি বা শেয়ারের কাগজপত্র লোপাট হবে কী করে? আদালত থেকে প্রতিনিধি বসানো হয়েছে, একদিন না একদিন লকার খুলে যার যার জিনিসপত্র ফেরত দেওয়া হবে নিশ্চিত।
নিজের কোনো ব্যাপারে প্রতাপ অন্য কারুকে ধরাধরি করা পছন্দ করেন না। কিন্তু এবারে বাধ্য হয়েই তাঁকে তাঁর বন্ধু বিমানবিহারীর শরণাপন্ন হতে হলো। বিমানবিহারীরা কলকাতায় কয়েক পুরুষের অধিবাসী,তেমন ধনী বা বনেদী না হলেও সম্রান্ত। প্রতাপরা বহিরাগত, তাঁদের তুলনায় বিমানবিহারীদের কয়েকটি অতিরিক্ত সুবিধে আছে, এদিককার ওপর মহলের অনেকের সঙ্গেই তাঁদের মুখ চেনা বা লতায় পাতায় সম্পর্ক আছে। যেমন, একদিন স্যার পি এল মিটার সম্পর্কে কী কথা উঠতেই বিমানবিহারী বলেছিলেন, হ্যাঁ, ওঁদের চিনি, ওঁর স্ত্রী তো ভুলি মাসি, আমার ছোট মাসির সঙ্গে পড়তো! সেইরকমই পশ্চিমবাংলার বর্তমান এক ক্ষমতাশালী মন্ত্রী বিমানবিহারীর কাছে জটাদা, মেম্বার বোর্ড অফ রেভিনিউ হচ্ছেন বিমানবিহারীর রাঙাকাকা, ইত্যাদি।– সব শুনে বিমানবিহারী গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি তাঁর বন্ধু প্রতাপকে মিথ্যে স্তোক দিতে পারেন না। তিনি জানেন, একটা ব্যাঙ্ক উল্টে দেবার আগে তার মালিকরা, অন্যদের ঠকাবার জন্যই হোক বা নিজেদের বাঁচাবার জন্যই হোক, কোনো পন্থা নিতেই দ্বিধা করে না। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে আর কোনো নৈতিকতার মূল্য নেই। লকার খুলে সব কিছু সাফ করে দেবার ঘটনা যে আগেও ঘটেছে তা তিনি জানেন।
তবু তিনি ছোটাছুটি করলেন অনেক। আদালত থেকে নিযুক্ত প্রতিনিধির সঙ্গে একটা যোগাযোগের সূত্র খুঁজে বার করে তিনি তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথা বললেন একদিন। কিছুই লাভ। হলো না। অফিসের চেয়ার টেবিল ছাড়া আর প্রায় কোনো সম্পত্তিই নেই ব্যাঙ্কের। নতুন বাংলা ব্যাঙ্কের মালিক সব দোষ স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেছেন আদালতে। তাঁর খুব বেশি শাস্তি হলে দশ বারো বছরের জেল হবে। জালিয়াতি-জোচ্চুরির জন্য ফাঁসী হয় না কারুর। অন্যের দোষে সর্বস্বান্ত হয়ে যে তিন চারজন আত্মহত্যা করে, সেই পাপের জন্য কেউ কিছু দণ্ড পায় না কোনো ধর্মাধিকরণে।
মানবিহারী বললেন, প্রতাপ, তোমার ঐ ব্যাঙ্কের মালিক কিন্তু তোমার দেশেরই লোক!
প্রতাপ হঠাৎ জ্বলে উঠে বললেন, আমারই দেশের লোক মানে?
বিমানবিহারী বললেন, নতুন বাংলা ব্যাঙ্কের মালিক তত তোমাদের ঢাকা জেলার লোক শুনলুম।
প্রতাপ আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তার মানে, তুমি কী বলতে চাও? দেশ ভাগের আগে গোটা বাংলা দেশটা তোমারও দেশ ছিল না? দশ বছর কেটে গেছে, এখনো তোমরা আমাদের ওপারের লোক বলে মনে করো!
বিমানবিহারী প্রসঙ্গটা লঘু করতে চেয়েছিলেন, প্রতাপের যে এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। পূর্ব বাংলা থেকে যারা এসেছে তারা যে এখনো তাদের আলাদা আইডেনটিটি বজায় রাখতে চায়, তা তো প্রত্যেকদিনই দেখা যাচ্ছে পথেঘাটে। এখন তারা ভারতের নাগরিক হলেও যে-কোনো কথা প্রসঙ্গে বলে, আমাদের বাড়ি ঢাকা জেলায় বা ফরিদপুর বা চট্টগ্রামে। এমনকি তারা অতীত ক্রিয়াপদও ব্যবহার করে না। প্রতাপও এর ব্যতিক্রম নন। এখন প্রতাপ খুব বেশি স্পর্শকাতর হয়ে আছেন। কয়েকখানা গয়না হারাবার আঘাতে যে প্রতাপ এতখানি আহত হয়ে পড়বেন তা বিমানবিহারী বুঝতে পারেননি। অবশ্য, যার যায় সেই ঠিক বোঝে।
প্রতাপ এতখানি বিচলিত হয়ে পড়েছেন তার কারণ, গয়নাগুলো তাঁর দিদির, তাঁর স্ত্রীর নয়। মমতার অধিকাংশ গয়নাই রাখা আছে তাঁর বাপের বাড়ির সিন্দুকে। বারবার ভাড়া বাড়িতে বাসা বদল, তাই মমতা নিজের কাছে দামি কিছু রাখেন না। দিদির গয়নাগুলি যে প্রতাপ সত্যিই বিক্রি করেননি, এখন তা তিনি কী করে বোঝাবেন? দিদিকে সব কথা খুলে বললে কি তিনি বিশ্বাস করবেন না? নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু বলা কি সহজ? যে ব্যর্থতার জন্য প্রতাপ নিজে দায়ি নন, সেকথা বলার মধ্যে যে কতখানি গ্লানি, তা কি অন্য কেউ বুঝবে? অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতাপের হাত এক একবার মুষ্টিবদ্ধ হয়, আবার তাঁর নিজেরই হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে।
চাকরি যাওয়ার জন্য কানুকে বিশেষ বিচলিত দেখা গেল না। ইদানীং সে বাড়ির বাইরেই বেশির ভাগ সময় কাটায়। পিকলু বাবলুর সঙ্গে এক ঘরে শুতে হয় তাকে, ওদের এখন পড়াশুনোর খুব চাপ, তাই কানু রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না। প্রতাপকে সে ভয় পায়, তাই পারতপক্ষে দাদার মুখোমুখি আসতে চায় না। প্রতাপও আজকাল নানা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত।
পরের মাসের পয়লা তারিখে কানু প্রতাপের ঘরে এলো। প্রতাপ তখন বই অনুবাদে নিমগ্ন, কানু তাঁর পায়ের কাছে দুটি একশো টাকার নোট রেখে বললো, দাদা, এই টাকাটা রইলো।
প্রতাপ অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুই টাকা কোথায় পেলি?
কানু অবনত মস্তকে সলজ্জভাবে বললো, আমি কিছু টাকা জমিয়েছিলাম।
প্রতাপ কানুকে আপাদমস্তক দেখলেন। সাজসজ্জার বেশ বাহার হয়েছে তার। আগে সে মোটা ধুতির ওপর হাফ শার্ট পরতো, এখন মলের পাঞ্জাবি, ফাইন ধুতিটা বোধহয় ফিলে কম্পানির। চুলে সিঁথি কাটেনি, উল্টে আঁচড়েছে। বাঁ হাতে একটি পলা বসানো আংটি। কটা টাকাই বা মাইনে পেত কানু, তার আদ্ধেক দিয়ে পোশাকের বাবুগিরি, যাতায়াত ভাড়া, হাতখরচ করেও টাকা জমিয়েছে? তাহলে তো বেশ গোছানো স্বভাব হয়েছে বলতে হবে।
প্রতাপ বললেন, ও টাকা দিতে হবে না, তোর কাছেই রাখ।
কানু তবু বললো, না, আমার কাছে আরও আছে।
প্রতাপ বললেন, বলছি তো, তোর কাছেই রাখ। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছিস? সামনের রবিবার তোকে একজনের কাছে যেতে হবে, মাটিন বার্ন কম্পানিতে একটা চাকরির কথা বলেছে–
কানু টাকাটা তুলে নিয়ে বিনীত ভাবে বললো, সেজদা, আমি ব্যবসা করবো ভাবছি!
ভদ্রলোক শ্রেণীর বাঙালীরা ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা ধরেই নিয়েছে ওটা অন্য প্রদেশীয়দের ব্যাপার। এদেশে ব্যবসা শব্দটির সঙ্গে ইদানীং ঘুষ, কালোবাজার, ধরাধরি, মিথ্যেকথা, লোক ঠকানো ইত্যাদি ব্যাপারগুলো জড়িয়ে গেছে, সুতরাং ভদ্রলোকরা এসবের থেকে নাক কুঁচকে দূরে থাকতে চায়।
ভাইয়ের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে প্রতাপ বললেন, ব্যবসা করবি! ব্যবসা করা সোজা নাকি, ক্যাপিটাল পাবি কোথায়?
আমার একজন চেনা লোক, সে দেবে বলেছে। আমাকে শুধু খাটতে হবে।
ওরকম অনেকেই বলে! মাটিন বার্নের চাকরিটা হয়ে যেতে পারে, আমি চিঠি লিখে দেবো, তুই কেষ্টবাবুর সঙ্গে দেখা করবি এই রবিবারে। কিংবা আমিই তোকে সঙ্গে নিয়ে যাব।
তারপর প্রতাপ আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
কেষ্টবাবু নামের ব্যক্তিটি শিয়ালদা কোর্টের এক পেশকারের জ্যাঠতুতো দাদা। পেশকারবাবুটি নিজে থেকেই প্রতাপকে বলেছিলেন, স্যার, আপনার ভাইয়ের চাকরি গেছে। শুনলুম। আমার এক দাদা মাটিন বার্নে আছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করলে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার দাদা অনেককে চাকরি দিয়েছেন। আমি বলে রাখবো, আপনি যদি একটা চিঠি দিয়ে আপনার ভাইকে পাঠিয়ে দেন…
কেষ্টবাবুর বাড়ি তিলজলায়। ঠিকানা খুঁজে বার করতে বেশ বেগ পেতে হলো কানুকে।। দোতলা বাড়ি, তার মধ্যে একতলাটি বেশ পুরনো, তার ছাদে বেখাপ্পা ভাবে দুটি নতুন ঘর তোলা হয়েছে। তার একদিকের দেয়াল থেকে বেরিয়ে আছে লোহার শিক, অর্থাৎ ওদিকে আরও বাড়াবার পরিকল্পনা আছে। এ বাড়ির পাশে একটা বড় গাছ ছিল, আজই কেটে ফেলা হয়েছে সেটাকে। একজন কাঠুরে টুকরো করছে সেই গাছের গুঁড়িটাকে, একরাশ লোক ভিড় করে দেখছে সেই দৃশ্য।
কেষ্টবাবু খুব রোগা আর লম্বা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে একটা নস্যি রঙের ব্যাপার জড়ানো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি গাছ কাটার তদারকি করছিলেন, কানুর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়ে তিনি বললেন, একটু দাঁড়াও বাবা, আগে এই কাজটা সেরে নিই।
একতলার একটি ঘরে কয়েকটি মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে একসঙ্গে গান গাইছে, সেখানে রয়েছে গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা একজন নির্দেশক, বোধহয় প্রস্তুতি চলছে কোনো ফাংশানের। কানুর বিশেষ লজ্জা টজ্জা নেই, সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গান শুনতে লাগলো। মেয়ে তিনটির বয়েস ষোলো থেকে কুড়ির মধ্যে, চেহারায় তেমন চাকচিক্য নেই, কানুর পছন্দ হল না। আজকাল কানুর এই একটা অভ্যেস হয়েছে, রাস্তাঘাটে অচেনা মেয়েদের দেখলেই মনে মনে ভেবে নেয়, চলবে কি চলবে না। দু’একজনকে সে মনে মনে নিজের পাশে দাঁড় করায়।
একটু পরে কেষ্টবাবু এসে বললেন, চলো।
তিনি তাকে নিয়ে এলেন দোতলার ছাদে। নতুন ঘরগুলোর পাশে এক জায়গায় সিমেন্ট-সুরকি জমা করা আছে, তারই একধারে রয়েছে দুটি টিনের চেয়ার। সেখানে বসলো দু’জনে।
শীত এখনো ফুরিয়ে যায়নি একেবারে। সকালের রোদ মন্দ লাগে না। বাড়িটার পাশেই একটা পানা পুকুর, মাথার ওপরে অনেকগুলো কাক ওড়াউড়ি করে কা কা করছে রাগত ভাবে। খুব সম্ভবত ভূপাতিত গাছটিতে তাদের বাসা ছিল।
কেষ্টবাবু একটা বিড়ি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হাকিমবাবুর ভাই? কী নাম?
কানু বললো, জয়দেব সরকার।
লেখাপড়া কদ্দূর?
আই-এ প্লাকড।
টাইপ, শর্টহ্যান্ড জানা আছে?
টাইপ জানি।
স্পীড কত?
কানুর একটু মজা লাগলো। মাটিন বার্ন কম্পানির চাকরির ইন্টারভিউ হচ্ছে এই ছাদে বসে, সিমেন্ট-সুরকির পাশে? এই বিড়ি-ফোঁকা, সিঁড়িঙ্গে চেহারার লোকটা ঐ কম্পানির অফিসার নাকি?
রোগা চেহারা হলেও কেষ্টবাবুর বেশ একটা ব্যক্তিত্ব আছে, কানুকে তিনি দেখছেন তীক্ষ্ণ নজরে। কানুর যোগ্যতা সম্পর্কে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করে তিনি সন্তুষ্ট হলেন মনে হলো, হাঁটু নাচাতে নাচাতে বললেন, ঠিক আছে, ওতেই চলবে। হয়ে যাবে, একটা পোস্ট খালি হবে সামনের মাসে, মাইনে সব মিলিয়ে দুশো দশ টাকা। ঠিক আছে?
কানু মাথা নেড়ে বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ।
কত টাকা এনেছো সঙ্গে?
কানু এ প্রশ্নের মানে বুঝতে পারলো না। প্রতাপ টাকার কথা তো কিছু বলেননি। চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে অনেক জায়গায় পোস্টাল অর্ডার দিতে হয়। কানুর কাছে পনেরো-ষোলো টাকা আছে, তাতে হয়ে যাওয়া উচিত।
কানু পকেট থেকে সেই টাকা বার করতেই কেষ্টবাবু গলা ঝুঁকিয়ে দেখে একগাল হাসলেন। তারপর বললেন, আমি শনিপুজোর চাঁদা চাইছি না। আমার ভাই বলে দেয়নি কিছু?
কানু দু’দিকে মাথা নাড়লো।
এ বাজারে কিছু খচা না করলে চাকরি হয়? বারো দু’গুণে চব্বিশ শো আর বারো দশকে একশো কুড়ি, ইয়ে, মোট আড়াই হাজারই ধরো। ঐ টাকাটা জমা দিতে হবে আগে।
কোথায় জমা দেবো?
আমাকেই দেবে। তা বলে ভেবো না, পুরোটাই আমি একা নেবো, আরও পাঁচজন দেৰ্তার মাথায় সিন্নি চড়াতে হয়। তোমাদের বাড়ি কোথায় ছিল?
একটুও দ্বিধা না করে কানু বললো, মুর্শিদাবাদ।
কানু আজকাল চালাক হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝেছে, সব জায়গায় নিজেদের বাঙাল পরিচয়টা জানিয়ে দিলে সুবিধে হয় না। কেষ্টবাবুর কথা শুনেই সে বুঝেছে, উনি এদিককার লোক।
কেষ্টবাবু বললেন, আমি মেদিনীপুরের ছেলেদের একটু ফেবার করি। ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুরে কত অত্যাচার হয়েছে, এখন আমি এই শালা ব্রিটিশ কোম্পানিতে যত পারি মেদিনীপুরের ছেলে ঢোকাই। তা ঠিক আছে, তুমি হাকিম সাহেবের ভাই, তোমারও দু’ হাজার দিলেই চলবে। সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করো, দেরি হলে মুশকিল, আরও অনেক ক্যান্ডিডেট ঘোরাঘুরি করছে।
একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে এসে কেষ্টবাবুকে এক গেলাস চা দিয়ে পাশেই। একা-দোক্কা খেলতে লাগলো আপন মনে। কেষ্টবাবু চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে ঐ কথাই রইলো?
অর্থাৎ ইন্টারভিউ শেষ। কানু উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, দরখাস্তটা কি রেখে যাবো?
কেষ্টবাবু দু’দিকে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, শুধু দরখাস্ত নিয়ে আমি কী করবো? সামনের রোববারের মধ্যে টাকাটা আর ওটা নিয়ে এসো একসঙ্গে।
রাস্তায় বেরিয়ে এসে কানু ভাবলো, সেজদা নিজেই কানুকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসবার কথা বলোছলেন একবার। সকালে বাড়িতে লোক এসে পড়ায় তিনি বেরুতে পারেননি। সেজদা এলে বেশ মজা হতো, টাকার কথাটা শুনলে সেজদার মুখের চেহারাটা নিশ্চয়ই হতো দেখবার মতন। তিনি এই সিঁড়িঙ্গে লোকটার সঙ্গে মারামারি শুরু করে দিতেন কি না কে জানে! ন্যায়-নীতি নিয়ে সেজদার বাড়াবাড়ির শেষ নেই। লুটেপুটে খাওয়ার যুগ এসেছে, এখন যে লব শুধু বইয়ের পাতায় লেখা থাকে, তা সেজদা কিছুতেই বুঝবে না!
কানু একটুখানি এগোতেই উল্টো দিক থেকে আসা তারই বয়েসী একটি যুবক এক টুকরো, কাগজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, দাদা, এই ঠিকানাটা কোন্ দিকে হবে বলতে পারেন।
কানু দেখলো সেটা কেষ্টবাবুরই নাম-ঠিকানা। সে মনে মনে হাসলো। আর একজন এসে গেছে এর মধ্যেই। এ ছেলেটার বাড়ি মেদিনীপুরে নাকি, তাহলে এরই চান্স বেশি।
বাড়ি ফিরে টাকার অঙ্কটা আর কমালো না কানু, পুরো আড়াই হাজারের কাহিনীটাই শোনালো প্রতাপকে। প্রতাপ কয়েক মুহূর্ত যেন হতবাক হয়ে গেলেন। অসহায়, বেকার ছেলেদের চাকরি দেবার বিনিময়ে কেউ মোটা টাকা ঘুষ চাইতে পারে, এরকম ব্যাপার যেন তাঁর কল্পনার অতীত।
রাগের চোটে প্রতাপ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ঐ লোকটাকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দেবো। আমার পেশকার… সেও কিছু বলেনি। তার এত সাহস…।
কানু মনে মনে ভাবলো, সেজদা কোন্ যুগে পড়ে আছে? ঘরে বসে গলাবাজি করলে কেউ পুছবে? মফস্বল শহরে তবু সাব জজদের খানিকটা খাতির আছে, কলকাতায় কেউ পাত্তাও দেবে না। ঐ পেশকারের রোজগারই বোধহয় সেজদার চেয়ে বেশি।
চ্যাঁচামেচি শুনে সুপ্রীতি, এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
কানুর কাছে সব কথা শুনে সুপ্রীতি বললেন, আড়াই হাজার টাকা, সে তো অনেক টাকা, কিছু কম করবে না? ঐ কম্পানির চাকরি তো ভালো শুনেছি।
প্রতাপ বললো, কক্ষনো না, আমি এক পয়সা দেবো না। ঐ লোকটাকে আমি জেলের ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়বো।
কানু তক্ষুনি ঠিক করে ফেললো, সেজদা যদি আর কারুর কাছে চাকরির জন্য চিঠি দিয়ে পাঠায়, তাহলে সে আর যাবে না, চিঠি ছিঁড়ে ফেলে একই গল্প শোনাবে।
কয়েকদিন পর দুপুরবেলা খেতে বসে থালার পাশে মাংসের বাটি দেখে প্রতাপ ভুরু কোঁচকালেন। সপ্তাহের মাঝখানে একটা ছুটির দিন। মাসে একদিন মাত্র মাংস হয়, প্রথম রবিবার।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, মাংস কে আনলো?
সুপ্রীতি বললো, কানু এনেছে। ও তো আজকাল প্রায়ই বাজার করে দেয়?
প্রতাপ খুশি হলেন না। কানুর ধরন-ধারণ তাঁর ঠিক পছন্দ নয়। সব সময় কিছু যেন একটা গোপন করে যাওয়ার ভাব আছে ওর মধ্যে। ও পয়সা পাচ্ছে কোথা থেকে? প্রতাপ সংকল্প করলেন, এরপর থেকে তিনি কানুর ওপর নজর রাখবেন।
কানু আগেই খেয়ে বেরিয়ে গেছে, পিকলু আর বাবলু খেতে বসেছে প্রতাপের সঙ্গে। ওরা মাংস ভালোবাসে। বাবলু বললো, পিসিমনি, তুমি দাদাকে নলি হাড় দিয়েছে, আমাকে দাওনি। আমায় আর একটা মাংসের আলু দাও!
প্রতাপ খাওয়া থামিয়ে চেয়ে রইলেন সন্তানদের দিকে। তাঁর হঠাৎ বুক ব্যথা করতে লাগলো। সামান্য মাংসও তিনি নিয়মিত খাওয়াতে পারেন না ছেলেমেয়েদের। তাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রতিদিন জোড়া পাঁঠা বলি হতো। তা ছাড়াও ভবদেব মজুমদার মাঝে মাঝেই বাড়িতে পাঁঠা কাটিয়ে সেই মাংস বিলি করতেন গ্রামের চেনাশুনো পরিবারে।
একদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে প্রতাপ দেখলেন দরজার পাশেই ফাঁকা জায়গাটুকুতে কয়েকটা বড় বড় বাণ্ডিল। দেখে মনে হয় কাপড়ের। এগুলো এলো কোত্থেকে?
মমতা বললেন, ওগুলো কানুর ব্যবসার জিনিস। সে নাকি এরকম বাণ্ডিল প্রায়ই আনে। ঘরের মধ্যে আরও অনেকগুলো আছে, সব ধরেনি বলেই বাইরে কয়েকটা রেখেছে, কাল সকালেই সরিয়ে নেবে।
কানু তখন বাড়িতে নেই, তাই তার সঙ্গে কথা বলা গেল না। মমতার কাছেই শুনলেন যে কানু রীতিমতন ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে, ভালই চলছে নিশ্চয়ই, সে যখন তখন বেশ পয়সা। খরচ করে। বাবলু অর পিকলুকে দুটো জামা কিনে দিয়েছে। মমতা আর সুপ্রীতিকেও শাড়ি দিতে চেয়েছিল, ওঁরা নেননি, কানুর ব্যবসার আর একটু উন্নতি হলে নেবেন বলেছেন।
কাপড়ের ব্যবসা শুনলেই মনে পড়ে কাপড়ের দোকান। প্রতাপ ভাবলেন, তাঁর ভাই কাপড়ের দোকান খুলেছে? দোকান খুলতে অনেক টাকা লাগে, কাপড়ের ফিরিওয়ালা হয়েছে নাকি কানু?
প্রতাপ নিজের কাজে মন দিলেন। তাঁর বেশি রাত করে খাওয়া অভ্যেস। তখন খোঁজ নিয়ে জানলেন, কানু এর মধ্যে এসে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাথরুমে আঁচাতে এসে প্রতাপ দেখলেন একটা নতুন তাক তৈরি হয়েছে সেখানে, তার ওপরে একটা পাউডারের কৌটো, দু একটা স্নো-পমেটমের শিশি, দাড়ি কামানোর সাবান। এসব আবার কোথা থেকে এলো? নিশ্চয়ই কানুই এসব কিনে এনেছে।
রাত জেগে প্রতাপ বই পড়তে লাগলেন, কিন্তু মাঝে মাঝেই তাঁর মনঃসংযোগ নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। বাড়িতে এতগুলো কাপড়ের বাণ্ডিল, এ সম্পর্কে কিছুতেই তিনি মন থেকে খটকা দূর করতে পারলেন না।
এক সময় তিনি বই মুড়ে রেখে বাইরে এসে একটা কাপড়ের বাণ্ডিল খুলে ফেললেন। সবই শাড়ি, দামি নয়। সাদা খোল, সরু লাল বা হলদে পাড়। আর একটা বাণ্ডিল খুললেন, তাতেও ঠিক একই শাড়ি।
প্রতাপ এগিয়ে এসে ছেলেদের ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলে ফেললেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেখলেন, দুটো দেয়ালের পাশে একই রকম অনেকগুলো বাণ্ডিল রয়েছে। এক ঘরে তিনজন থাকে, এমনিতেই ঠাসাঠাসি হয়, এর মধ্যে আবার এত মালপত্র এনে ভরার আগে কানু একবার তাঁর অনুমতি নেবার প্রয়োজনও বোধ করেনি?
কানুকে ডাকবার আগেই সে চোখ মেলে তাকালো।
আঙুলের ইসারায় প্রতাপ ডাকলেন, এই, একবার উঠে আয় তো!
যে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়েছিল, সেটাই জড়িয়ে উঠে এলো কানু। প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, এসব কী?
কানু বললো, কাপড়। আমি ব্যবসা করছি, আমাদের ওখানে রাখার জায়গা নেই।
ওখানে মানে? দোকান খুলেছিস?
না, আমাদের গোডাউন।
আমাদের মানে কী?
আমার পার্টনার আছে একজন। সে অনেকদিন ধরে কাপড়ের লাইনে আছে। আমরা মিল থেকে কাপড় ডেলিভারি নিয়ে দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিই!
এগুলো সরকারি কন্ট্রোলের শাড়ি, তাই না?
হয়তো দুএকবার চোখের পাতা কাঁপলো, তাহলেও কানু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, হ্যাঁ।
প্রতাপ বললেন, সরকারের যারা পারমিট হোল্ডার, তারাই শুধু ন্যায্য দামের দোকানে এইসব শাড়ি বিক্রি করে। তোদের পারমিট আছে?
এবারেও কানু সঙ্গে সঙ্গে বললো, হ্যাঁ।
প্রতাপ হাত বাড়িয়ে বললেন, কোথায় দেখি সেই পারমিট?
আমার কাছে নেই, আমার পার্টনারের কাছে আছে।
তার কাছে একটা কপিও রাখিসনি? আজ রাতে যদি পুলিশ এসে বলে এই কাপড়ের পারমিট কোথায় দেখাও? তাহলে?
কানু এবারে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না।
প্রতাপ খপ করে কানুর একটা কান ধরে বললেন, হারামজাদা, এই জন্যই তুই এই ব্যবসার কথা আমাকে আগে বলিসনি, তাই না? চুরির ব্যবসা ধরেছিস? জুতিয়ে তোর পিঠের চামড়া তুলে দেবো!
বাপ-ঠাকুদাদের মতনই প্রতাপ উত্তেজিত হয়ে গেলে গলার আওয়াজ নিচু রাখতে পারেন না। রাত্রি কি দিন তা খেয়াল থাকে না। কানু এর পরেও কোনো কথা বললো না, তাতে প্রতাপের রাগ আরও চড়ে গেল। কানটা ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, আমি সরকারি চাকরি করি, তুই আমার মুখে চুনকালি দিতে চাস? এত তোর টাকার লোভ!
ছেলেরা তো জেগে উঠেছেই, মমতা আর সুপ্রীতিও বাইরে চলে এসেছেন। সুপ্রীতি কাছে। এগিয়ে এসে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ও কী করছিস, খোকন? এত বড় ছেলের কান ধরতে আছে? ছেড়ে দে!
রাগের সময় প্রতাপ স্ত্রী বা দিদিকেও গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু আজ সুপ্রীতি এসে তাঁর হাত ধরতেই তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। গয়নাগুলো নষ্ট হবার পর প্রতাপ দিদির সামনে একটু কাচুমাচু হয়ে যান। মমতার কাছেও তিনি একটু অপরাধী হয়ে আছেন। সেই যে একদিন রাগ করে ভোরবেলা গৃহত্যাগ করে তিনি দেওঘর চলে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে মমতা এখনও কোনো খোঁটা দেননি, নিশ্চিত জমা রেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য। সুপ্রীতি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, কানু?
কানু এবারে ভালোমানুষ সেজে নিরীহভাবে বললো, বলছি যে এই কাপড়ের জন্য পারমিট আছে আমার পার্টনার গুপীবাবুর কাছে, সেজদা সেকথা বিশ্বাস করছে না। কাল সকালেই এনে দিতে পারি।
প্রতাপ গর্জন করে উঠে বললেন, মিথ্যে কথা!
সুপ্রীতি বললেন, তুই সব না জেনেশুনেই এরকম রাগারাগি করছিস কেন, খোকন? কাল সকালেই তো কাগজ এনে দেবে বলছে। ছেলেটা চাকরি বাকরি কিছুই তো পেল না, ব্যবসা করে যদি দুটো পয়সা রোজগার করে তাতে দোষের কী আছে?
দিদি, তোমরা বুঝতে পারবে না! এটা চুরির ব্যবসা। এই সব কাপড় গরিবদের কাছে কম দামে বিক্রির জন্য। তাই নিয়ে অনেকে কালোবাজারি করে। একবার একজনের নামে মামলাও হয়ে গেছে।
কানু মিষ্টি গলায় বললো, আমাদের পুলিশ কিছু করতে পারবে না। আমাদের কাগজপত্র সব। ঠিকঠাক করা আছে!
তাহলে এ বাড়িতে এগুলো এনে লুকিয়ে রেখেছিস কেন?
কাল সকালেই নিয়ে যাবো।
সুপ্রীতি বললেন, খোকন, তুই বড় মাথা গরম করছিস। এখন শুতে যা! ওর জন্য একটা। চাকরি তো জোগাড় করে দিতে পারলি না!
প্রতাপের ইচ্ছে করছিল লাথি মেরে মেরে কাপড়ের বাণ্ডিলগুলো বাড়ির বাইরে ফেলে দিতে। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন। সবাই মিলে যেন তাঁকে অসহায় করে দিচ্ছে।
পরদিন প্রতাপ জাগবার আগেই কানু সব মালপত্র সরিয়ে ফেললো কিন্তু কাগজপত্র এনে দাদাকে দেখালো না। প্রতাপের সামনে থেকে সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। প্রতাপ মমতাকে হুকুম দিয়ে দিলেন, কানুর কাছ থেকে সংসার খরচের জন্য যেনএকটা টাকাও না নেওয়া হয়। পিকলু-বাবলুর জন্য সে কোনো জিনিস কিনে দিলে ফেরত দিতে হবে তৎক্ষণাৎ! আর বাথরুমে স্নো পাউডার কার জন্য! এ বাড়িতে থেকে কানুর ওসব বাবুগিরি চলবে না!
দু’দিন বাদেই কানু এসে জানালো, মিজাপুর স্ট্রিটে সে একখানা ঘর ভাড়া করেছে। তার কাজের সুবিধের জন্য এখন থেকে সে সেখানেই থাকবে। এখানেও তো তার জন্য পিকলু-বাবলুদের অনেক অসুবিধে হয়! প্রতাপ হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললেন না, গুম হয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ।